প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড
1 of 2

১.৪ জামগাছ ॥ কৃষণ চন্দর / কমলেশ সেন

জামগাছ ॥ কৃষণ চন্দর / কমলেশ সেন

জামগাছ – কৃষণ চন্দর

রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় হয়ে গেছে। সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এর লনের জামগাছটা উপড়ে পড়েছে সেই ঝড়ে। ভোরে মালি দেখতে পেল গাছটার নিচে একজন মানুষ চাপা পড়ে আছে।

মালি ছুটতে-ছুটতে চাপরাসির কাছে গেল–চাপরাসি ছুটতে-ছুটতে গেল ক্লার্কের কাছে ক্লার্ক ছুটতে-ছুটতে গেল সুপারিনটেনডেন্টের কাছে।

সুপারিনটেনডেন্ট ছুটতে-ছুটতে বাইরে লনে এলেন। দেখলেন ঝড়ে উপড়েপড়া

গাছের নিচে যে মানুষটি চাপা পড়ে আছে তার চারদিকে বেশ ভিড় জমেছে।

একজন ক্লার্ক আক্ষেপ করে বলল, ‘আহা, এই জামগাছে কতই-না ফল ধরত।’ আর-একজন ক্লার্ক তাকে মনে করিয়ে দিল, আর এর জাম কী রসেই-না ভরপুর ছিল।’

তৃতীয় ক্লার্কটি বলল, ফলের মরসুমে আমি ঝোলা ভর্তি করে এই ফল নিয়ে যেতাম। আর আমার বাচ্চারা কত আনন্দেই-না এই জাম খেত।

মালি গাছের নিচে চাপাপড়া মানুষটির দিকে ইশারা করে বলল, ‘আর এই মানুষ?

হ্যাঁ, এই মানুষ…।’ সুপারিনটেনডেন্ট খুব চিন্তায় পড়লেন। একজন চাপরাসি জিজ্ঞেস করল, ‘জানি না এ বেঁচে আছে, না মরে গেছে।’

অন্য একজন চাপরাসি বলল, ‘বোধহয় মারা গেছে, এত বড় গাছ কোমরের উপর পড়লে কি মানুষ বাঁচতে পারে?’

গাছের নিচে চাপা-পড়া মানুষটি বেশ রুক্ষ স্বরেই বলল, না, আমি বেঁচে আছি।’ একজন বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘আরে, বেঁচে আছে!

মালি প্রত্যেকের উদ্দেশ্যে বলল, গাছটিকে সরিয়ে মানুষটিকে এর নিচ থেকে তাড়াতাড়ি বের করতে হবে।’

একজন ফাঁকিবাজ হৃষ্টপুষ্ট চাপরাসি ভারিক্কিচালে বলল, মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অত সোজা নয়। গাছের গুঁড়িটি বেশ ভারিই হবে।’

মালি জিজ্ঞেস করল, ‘সোজা নয় কেন? সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব যদি হুকুম দেন, তবে আমরা পনের-বিশজন মালি-চাপরাসি আর ক্লার্ক মিলে গাছের নিচে থেকে মানুষটিকে অনায়াসে বের করে আনতে পারি।

বেশ কিছু ক্লার্ক মালিকে সমর্থন করে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হাঁ, হাঁ, মালি ঠিক বলেছে। আমরা তৈরি, হাত লাগাও।’

অনেকে গাছটিকে সরানোর জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল।

সুপারিনটেনডেন্ট হঠাৎ বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়াও, ‘আমি আন্ডার সেক্রেটারির কাছে একবার জিজ্ঞেস করে আসি।’

সুপারিনটেনডেন্ট আন্ডার সেক্রেটারির কাছে গেলেন। আন্ডার সেক্রেটারি গেলেন ডেপুটি সেক্রেটারির কাছে। ডেপুটি সেক্রেটারি গেলেন জয়েন্ট সেক্রেটারির কাছে। জয়েন্ট সেক্রেটারি চিফ সেক্রেটারির কাছে গেলেন। চিফ সেক্রেটারি মিনিস্টারের কাছে। মিনিস্টার চিফ সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। চিফ সেক্রেটারি জয়েন্ট সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। একইভাবে জয়েন্ট সেক্রেটারি ডেপুটি সেক্রেটারিকে এবং ডেপুটি সেক্রেটারি আন্ডার সেক্রেটারিকে কিছু বললেন। ফাইল চলতে লাগল–এর মধ্যে পার হল অর্ধেক দিন।

দুপুরের লাঞ্চের পর সেই চাপা-পড়া মানুষের চারদিকে আরো ভিড় বেড়ে গেল। নানা মানুষ নানা ধরনের কথা বলতে লাগল। কয়েকজন বিজ্ঞ ক্লার্ক সমস্যার সমাধান বের করে ফেললে নিজেরাই। বিনা হুকুমেই তারা যখন গাছ সরানোর পরিকল্পনা করছে ঠিক তখনই সুপারিনটেনডেন্ট ফাইল নিয়ে ছুটতে-ছুটতে হাজির হলেন। বললেন, আমরা এই গাছ আমাদের খেয়াল-খুশি মতো এখান থেকে সরাতে পারবে না। কারণ আমরা বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত, আর এই গাছ কৃষি দপ্তরের এক্তিয়ারে। আমি এই ফাইল আর্জেন্ট মার্ক করে এখনই কৃষি দপ্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেখান থেকে উত্তর আসার পর আমরা গাছ সরাব।

দ্বিতীয় দিন কৃষি বিভাগ থেকে উত্তর এল, এই গাছ বাণিজ্য দপ্তরের লনে পড়েছে, সুতরাং এই গাছ সরানোর দায়িত্ব বাণিজ্য দপ্তরের।

উত্তর পড়ে বাণিজ্য দপ্তর যারপরনাই চটে গেল। তারাও সঙ্গে-সঙ্গে দিল কড়া জবাব, এই গাছ সরানো বা না-সরানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব কৃষি দপ্তরের। বাণিজ্য দপ্তরের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

পরের দিনও ফাইল চলতে আরম্ভ করল। সন্ধ্যার সময় জবাব এল, আমরা এই সমস্যা হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টে পাঠালাম। কারণ এ এক ফলদার গাছের ব্যাপার। এগ্রিকালচারাল ডিপার্টমেন্ট শাকসজি এবং খেত-খামার সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। জামগাছ ফল দেয়। সুতরাং এই ধরনের ফলদার গাছের ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টেরই অন্তর্গত।

রাত্রে মালি চাপা-পড়া মানুষটিকে ডাল-ভাত খাওয়াল। তার চারদিকে পুলিশের কড়া পাহারা বসেছে, কোনো মানুষ যেন নিজের হাতে কানুন তুলে নিয়ে গাছ সরানোর চেষ্টা না-করে। কিন্তু চাপা-পড়া মানুষটির প্রতি করুণা হয় একজন পুলিশের। সে মালিকে খাওয়ানোর অনুমতি দেয়।

মালি চাপাপড়া মানুষটিকে বলল তোমার ফাইল চলছে, মনে হচ্ছে কালকের মধ্যে একটা ফয়সালা হয়ে যাবে।

চাপাপাড়া মানুষটি মালির কথার কোনো জবাব দেয় না।

মালি গাছটির দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, ভাগ্যিস গাছটা তোমার কোমরের একদিকে পড়েছে, কোমরের মাঝখানে পড়লে তোমার শিরদাঁড়া ভেঙে যেত।’

চাপাপড়া মানুষটি কিন্তু মালির কথার কোনো জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে না।

মালি আবার বলল, তোমার যদি কোনো ওয়ারিশ থাকে তবে আমাকে তার ঠিকানা। বল, আমি তাকে খবর দেওয়ার চেষ্টা করব।

চাপাপড়া মানুষটি অনেক কষ্টে মালিকে বলল, আমি নিজেই বেওয়ারিশ।

মালি দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেল।

তৃতীয় দিন হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট খুব কড়া এবং ব্যঙ্গপূর্ণ জবাব দিল।

হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি সাহিত্যদরদী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সাহিত্যিক ভাষায় লিখলেন, খুব আশ্চর্যের কথা যখন সমগ্র দেশে আমরা বৃক্ষ রোপণ করছি, তখনই আমাদের দেশে এমনকি সরকারি আইন আছে যার বলে বৃক্ষ কাটা যায়! বিশেষ করে এমন এক বৃক্ষ–যা ফল দেয়। আর এই বৃক্ষ হচ্ছে একটি জাম বৃক্ষ, যার ফল সবাই আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করে। আমাদের বিভাগ কোননামতেই এই ধরনের এক ফলদার বৃক্ষকে কাটার অনুমতি দিতে পারে না।

একজন রসিক মানুষ আপসোস করে বলল, এখন তবে কী করা যায়? যদি গাছ কাটা না যায় তবে মানুষটিকেই কেটে বের করা হোক।’ সে সবাইকে তার প্রস্তাব বুঝিয়ে দিল, ‘দেখুন, যদি মানুষটিকে এখান থেকে কাটা যায় তবে অর্ধেক মানুষ এদিকে বেরিয়ে আসবে, অর্ধেক ঐদিকে। আর গাছটিও যেমনকার তেমন থাকবে।’

চাপা-পড়া মানুষটি তার কথার প্রতিবাদ করে উঠল, কিন্তু আমি যে মারা যাব।’ একজন ক্লার্ক বলল, ‘হাঁ, একথাও ঠিক।

মানুষটিকে কাটার জন্য যিনি নিপুণ যুক্তি হাজির করছিলেন, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি কত উন্নতি সাধন করেছে। একে যদি দুখণ্ড করে কেটে বের করা যায় তবে প্লাস্টিক সার্জারি করে আবার জোড়া লাগানো যাবে।’

এইবার ফাইল মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ্যাকশন নিল সঙ্গে-সঙ্গে। যেদিন তাদের ডিপার্টমেন্টে ফাইল পৌঁছল তার পরদিনই তারা ঐ ডিপার্টমেন্টের যোগ্যতম প্লাস্টিক সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিল। সার্জেন খুঁটিয়ে চাপাপড়া মানুষটির স্বাস্থ্য, রক্তচাপ, নাড়ির গতি, হার্ট এবং মাংস পরীক্ষা করে এক রিপোর্ট লিখলেন : হাঁ, প্লাস্টিক অপারেশন হতে পারে এবং অপারেশন সফলও হবে, তবে মানুষটি মারা যাবে।

সুতরাং এই ফয়সালাও আর গ্রহণ করা হল না। রাত্রে মালি চাপাপড়া মানুষটিকে খিচুড়ি খাওয়াতে-খাওয়াতে বলল, তোমার ব্যাপারটি ওপর মহলে গেছে। শুনেছি কালকে সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত সেক্রেটারিদের মিটিং হবে। ঐ মিটিং-এ রাখা হবে তোমার কেস। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে।

চাপাপড়া মানুষটি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,

‘জানি আমাকে হয়তো অস্বীকার করবে না।
কিন্তু তোমার কাছে যখন খবর আসবে
তখন আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাব।’

মালি আচমকা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি…তুমি কবি?

চাপাপড়া মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।

পরের দিন মালি চাপরাসিকে বলল, চাপরাসি বলল ক্লার্ককে, ক্লার্ক হেডক্লার্ককে, কিছুক্ষণের মধ্যে সারা সেক্রেটারিয়েটে খবর রটে গেল চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি। আর দেখতে দেখতে কবিকে দেখার জন্য লোক ভেঙে পড়ল। এই খবর শহরেও পৌঁছে গেল। আর সন্ধ্যার মধ্যে শহরের অলিগলিতে যত কবি আছেন তারা এসে জমা হলেন। সেক্রেটারিয়েটের লন কবি, কবি আর কবিতে ভরে উঠল। চাপাপড়া মানুষটির চারদিকে কবি সম্মেলনের এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। সেক্রেটারিয়েটের কয়েকজন ক্লার্ক এবং আন্ডার সেক্রেটারি–যারা সাহিত্য এবং কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও থেমে গেলেন এখানে। কয়েকজন কবি চাপাপড়া মানুষটিকে তাদের কবিতা এবং দোহা শোনাতে শুরু করলেন। আর কয়েকজন ক্লার্ক তাকে তার নিজস্ব কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে বললেন।

চাপাপড়া মানুষটি যে একজন কবি, এই খবর যখন সেক্রেটারিয়েটের সাব কমিটিতে পৌঁছুল, তখন তারা রায় দিলেন : চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি, সুতরাং তার ব্যাপার ফয়সালা করতে হার্টিকালচার বা এগ্রিকালচার দপ্তর পারে না। এ সম্পূর্ণভাবে কালচারাল বিভাগের ব্যাপার। কালচারাল বিভাগকে অনুরোধ করা হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হতভাগ্য

কবিকে চাপাপড়া ফলদার গাছ থেকে মুক্ত করা হোক।

ফাইল কালচারাল ডিপার্টমেন্টের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগ ঘুরতে-ঘুরতে সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারির হাতে এল। বেচারা সেক্রেটারি ঠিক ঐ সময়েই গাড়িতে করে সেক্রেটারিয়েট এসে চাপাপড়া মানুষটির ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন।

–তুমি কবি?

সে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে হাঁ।’

–কোন নামে তুমি পরিচিত?

–ওস।

ওস? সেক্রেটারি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন। ‘তুমি সেই ওস–যার পদ্য সংগ্রহ ‘ওসের ফুল’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে?’

চাপাপড়া মানুষটি রুক্ষ কণ্ঠে বলল, হাঁ।

সেক্রেটারি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাদের একাডেমির মেম্বার?

–না।

সেক্রেটারি বললেন, আশ্চর্যের কথা। এত বড় কবি–’ওসের ফুলে’র লেখক আমাদের একাডেমির সদস্য নয়! আহা কী ভুল হয়ে গেছে আমার, কত বড় কবি, অথচ কী অন্ধকারের নিচে নাম চাপা পড়ে আছে!

–আজ্ঞে, নাম চাপা পড়ে নেই, আমি স্বয়ং এক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছি। দয়া করে আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করুন।

‘এক্ষুণি করছি’ বলে সেক্রেটারি তখনই নিজের দপ্তরে রিপোর্ট করলেন।

পরের দিন সেক্রেটারি ছুটতে-ছুটতে কবির কাছে এলেন। বললেন, ‘নমস্কার, মিষ্টি খাওয়াও। আমাদের সাহিত্য একাডেমি তোমাকে কেন্দ্রীয় শাখার সদস্য করে নিয়েছে। এই নাও তোমার সদস্যপত্র।’

চাপাপড়া মানুষটি বেশ কঠোরতার সঙ্গে তাকে বলল, আমাকে তো আগে এই গাছের নিচ থেকে বের করুন। খুব ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন খুব কঠিন অসুখ আর দুঃখের মধ্যে পড়েছে।

সেক্রেটারি বললেন, এ ব্যাপারে আমার করার কিছুই নেই। আমি যা করতে পারি তা তা করে দিয়েছি। তুমি যদি মারা যাও তবে তোমার স্ত্রীকে পেনসন দিতে পারি।’

কবি থেমে-থেমে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।

সরকারের সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, ‘মুশকিল কী জান, আমার দপ্তর শুধুমাত্র কালচারের সঙ্গে যুক্ত। গাছ কাটাকাটির ব্যাপার তো আর দোয়াতকলমে হয় না–কুড়াল-কাটারির সঙ্গেই এর গভীর সম্পর্ক। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে আর্জেন্ট লিখে দিয়েছি।’

সন্ধ্যার সময় মালি এসে চাপা-পড়া মানুষটিকে বলল, ‘কাল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক এসে গাছে কেটে দেবে, আর তুমিও বেঁচে যাবে!

মালি খুব খুশি। চাপাপড়া মানুষটির শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। বাঁচার জন্যে সে যুঝে চলেছিল আপ্রাণ। কাল পর্যন্ত…কাল ভোর পর্যন্ত…যে কোনোভাবেই হোক কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।

পরের দিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মানুষজন যখন কুড়াল-কাটারি নিয়ে গাছ কাটতে হাজির হল, তখন বৈদেশিক দপ্তর থেকে খবর এল, গাছ কাটা বন্ধ রাখ। কারণ দশ বছর আগে পিটোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেক্রেটারিয়েটের লনে এই গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন যদি এই গাছ কাটা হয় তবে পিটোনিয়া সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারেন।

একজন ক্লার্ক চিৎকার করে বলল, কিন্তু একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন যে জড়িত।’

আর একজন ক্লার্ক অন্য ক্লার্কটিকে বলল, আরে এ যে দু-দেশের সম্পর্কের প্রশ্ন। তুমি কি জান না পিটোনিয়া সরকার আমাদের দেশকে কীভাবে সহযোগিতা করছে। আমরা কি বন্ধুত্বের জন্য একজন মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে পারি না!

–কবির মরে যাওয়া উচিত।

–নিশ্চয়ই।

আন্ডার সেক্রেটারি সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষ করে ফিরছেন। বিকেল চারটায় বৈদেশিক দপ্তর এই গাছ সম্পর্কিত ফাইল তাঁর কাছে পেশ করবেন। উনি যা বলবেন তাই-ই হবে।’

বিকেল পাঁচটায় সেক্রেটারি স্বয়ং ফাইল নিয়ে হাজির হলেন। এই যে শুনছ। খুশিতে গদগদ তিনি ফাইল দোলাতে-দোলাতে বললেন, এই গাছ কাটার হুকুম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্ত আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কালই এই গাছ কাটা হবে। আর তুমিও বেঁচে যাবে এই সমস্যা থেকে। আরে শুনছ কি! আজ তোমার ফাইল পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’

কিন্তু কবির হাত তখন বরফের মতো ঠাণ্ডা। চোখের তারা স্থির। একসার পিঁপড়ে তার মুখের ভিতর ঢুকছিল।

তার জীবনের ফাইলও পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।

1 Comment
Collapse Comments
মাহমুদ হাফিজ May 8, 2023 at 5:22 am

আমলাতন্ত্র কী ও কাহাকে বলে !

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *