১৫. সাগরতীর থেকে

পনেরো

সাগরতীর থেকে খানিকটা ভেতরে, স্যামসনের এক প্রান্তে সেইন্ট পিটার গির্জা। নিয়মিত প্রার্থনাকারীদের কেউই আজ গির্জায় আসেনি গ্রাম ফাঁকা বলে।

গ্রাম ফাঁকা কারণ গিলিয়াত নামের সেই হতচ্ছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটা ভয়ঙ্কর ডোভার থেকে শেষ পর্যন্ত সত্যি সত্যি দূরান্দের এনজিন উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে, এ খবর ছড়িয়ে পড়তে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই জাহাজ ঘাটে ছুটে গেছে।

সকাল দশটায় গির্জায় এসে ঢুকল রেভারেন্ড কড্রে, দেরুশেত ও গিলিয়াত। ক্লান্ত দেহে রাত জাগার ফলে শুকনো মুখটা আরও শুকিয়ে এতটুকুন গেছে গিলিয়াতের! ভীষণ ক্লান্ত আর অন্যমনস্ক লাগছে ওকে। ওদিকে বর-কনের মুখে কথা নেই। জড়পিণ্ডের মত হাঁটছে ওরা।

ভেতরে একটা টেবিল ঘিরে বসে আছে তিনজন লোক। সৌম্য চেহারার ফাদার, গির্জার সচিব ও বিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মচারী। তাদেরই গির্জার এক রেভারেন্ডের সাথে মাদামোয়াজেল দেরুশেতের বিয়ে রেজিস্ট্রি করাতে হবে, তাই পাত্র-পাত্রী ও পাত্রীর অভিভাবকের অপেক্ষায় আছে লোকগুলো।

বিয়ে সংক্রান্ত সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করাই আছে, এখন শুধু বর-কনে কিছু ফাঁকা ঘর পূরণ করে স্বাক্ষর করে দিলেই হয়। কনেসহ বর রেভারেন্ড কড্রে ও গিলিয়াতকে ভেতরে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন ফাদার ও অন্য তিনজন। ফাদারের সৌমা মুখে হাসি ফুটল।

আসুন, আসুন! আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। সব কিছু ঠিক করা আছে, অনুষ্ঠান শুরু করতে বিশেষ কোন বাধা নেই।

একটু থামলেন তিনি। একে একে তাদের তিনজনকে দেখে নিয়ে বললেন, আপনাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করানোর আবেদন আরও আগে পেলে ভাল হতো, এত আড়াহুড়ো করতে হতো না। যাই হোক, সমস্ত আয়োজন সারা হয়ে গেছে।

বরের পক্ষে বিয়ের সাক্ষী হবেন আমাদের গির্জার সচিব, কি কনের পক্ষে  কথা শেষ না করে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে গিলিয়াতের দিকে তাকালেন ফাদার। তার অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়ল যুবক-কনের পক্ষে ও নিজে সাক্ষী হবে।

তাহলে আর কি! ফাদার মাথা নাড়লেন। ঠিকই আছে, আর বিশেষ কোন সমস্যা নেই।

আড়চোখে এক পলক গিলিয়াতকে দেখল বর রেভারেন্ড কড়ে! লোকটার ডোভর অভিযানে যাওয়ার মূল প্রেরণার উৎস কি ছিল, সে কথা এখন আর অজানা নেই তার। কাজেই সঙ্কোচ বোধ করছে সে। ওদিকে দেশতও আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের বিয়ে দিতে গিলিয়াত এত ব্যগ্র কেন, তাই ভাবছে সকাল থেকে!

না, একটু ভুল হলো, ক্ষমা প্রার্থনার দৃষ্টিতে কড্রের দিকে তাকালেন ফাদার। সমস্যা একটা এখনও আছে, গিলিয়াতকে নির্দেশ করলেন। আজ খুব ভোরে এই ভদ্রলোক এসে মাদামোয়াজেল দেরুশেতের বাবার হয়ে আপনাদের বিয়ের অনুমতির জন্যে লিখিত আবেদন করেছেন।

এঁর মুখে শুনেছি, মঁশিয়ে লেতিয়ারি খুব জরুরি এক কাজে ব্যস্ত বলে বিয়েতে থাকতে পারবেন না। কিন্তু তিনি চান, বিয়েটা যেন আজ সকালের মধ্যেই হয়ে যায়। তার ইচ্ছের ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ করার কিছু নেই।

কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মঁশিয়ে লেতিয়ারি স্বয়ং কনের বাবা ও অভিভাবক। এরকম ক্ষেত্রে আমাদের গির্জার আইনমতে কিছুটা সমস্যা আছে। তা হচ্ছে, কনের অভিভাবকের মৌখিক ইচ্ছেকেই যথেষ্ট বলে মনে করে না আমাদের আইন।

এ জন্যে লিখিত প্রয়োজন। মঁশিয়ে লেতিয়ারির নিজ হাতে লেখা একটা চিঠি বা ওরকম কিছু একটা হলে ভাল হয়, আবার ক্ষমা প্রার্থনার হাসি হাসলেন ফাদার। আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন …।

নড়ে উঠল গিলিয়াত! পকেট থেকে এক টুকরো ভাজ করা কাগজ বের করে ফাদারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন ফাদার, এ ব্যাপারে সঁশিয়ে লেতিয়ারির নিজ হাতে লেখা চিঠি। পড়ে দেখুন। আর তাড়াতাড়ি করুন দয়া করে। এ জন্যে দেরি করার প্রয়োজন দেখি না আমি।

ভাঁজ খুলে কাগজটা দেখলেন ফাদার। ছোট্ট একটা চিঠি, ওই দিনের তারিখে লেখা।

সেটা এরকম : ফাদারের কাছ থেকে বিয়ের অনুমতিপত্র চেয়ে নিয়ে এসো। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। আর একটুও দেরি করতে রাজি নই আমি।

-লেতিয়ারি।

চিরকুটটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিলেন ফাদার। মুখ তুলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে গিলিয়াতের দিকে তাকালেন।

এতে কিন্তু কিছুই প্রমাণ হয় না, সঁশিয়ে। শিয়ে লেতিয়ারির সই থাকলেও এটা কাকে লেখা, বোঝা গেল না। কোন সমোধন বা সেরকম কিছুই নেই।

চিঠিতে বিয়ের কথা আছে বটে, কিন্তু কার সঙ্গে কার বিয়ে, সে ব্যাপারেও কিছু লেখেননি মঁশিয়ে লেতিয়ারি। পড়ে তো আমার মনে হয়, পত্রবাহক যে-ই হোন, তার নিজের বিয়ের ব্যাপারে বলা হয়েছে এটায়।

একটু থামলেন ফাদার। তবে ভদ্রলোক নিজেই যখন এ বিয়ের সাক্ষী হতে এসেছেন, নিজেই বলছেন এটা এই দুজনের বিয়ের ব্যাপারেই লিখেছেন মঁশিয়ে লেতিয়ারি, তখন চিঠিটাকে বিয়ের প্রধান দলিল হিসেবে গ্রহন করতে আমাদের আপত্তির কিছু থাকতে পারে না।

আমাদের একজন সহকর্মীর বিয়ের ক্ষেত্রে এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর দরকার নেই। এবার তাহলে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে দেয়া যেতে পারে।

ধীরে ধীরে বসলেন বৃদ্ধ ফাদার। কলমদানী থেকে কলম তুলে নিয়ে বিয়ের দলিলের শূন্য ঘরগুলো নিজেই একে একে পূরণ করতে লাগলেন।

কাজটা শেষ হতে বর ও কনেকে কাছে ডাকলেন। হাত ধরাধরি করে ধীর পায়ে টেবিলটার দিকে এগোল কড্রে ও দেরুশেত। ওদের জীবনের এক পরম লগ্ন এটা, তাই দুজনেই মনে মনে উত্তেজিত। গিলিয়াত একটু দূরের এক পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, দেরুশেতকে দেখছে একদৃষ্টে।

চোখের সামনে বাইবেল মেলে ধরে বিয়ের গৎ বাঁধা শ্লোক আওড়ালেন ফাদার, তারপর মুখ তুলে অমুকের সঙ্গে তমুকের বিয়ে ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করলেন, এই দুজনের বিয়েতে কারও কোনরকম আপত্তি বা বাধা আছে বলে জানা আছে। আপনাদের কারও?

কেউ জবাব দিল না দেখে সন্তুষ্ট হলেন ফাদার। কনে সম্প্ৰদান কে করবেন?

গিলিয়াত আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আমি, ফাদার।

অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এল গির্জার হলরুমে, আপনজনকে একান্ত করে পাওয়ার আনন্দের মাঝেও একটা অস্বস্তিকর অনুভুতি অনবরত খুঁচিয়ে চলেছে কড্রে ও দেরুশেতকে। কেউই গিলিয়াতের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

বিয়ের আংটি কোথায়? ফাদারের প্রশ্নে নীরবতা ভঙ্গ হলো। লজ্জায় পড়ে গেল কড্রে। অসহায়ের মত এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। হুড়োহুড়িতে কনের জন্যে আংটির ব্যবস্থা করা হয়ে ওঠেনি। কথাটা মনেই ছিল না। গিলিয়াত উদ্ধার করল তাকে। ওর নিজের হাতের একমাত্র আংটিটা খুলে নীরবে তার হাতে তুলে দিল।

চরম বিব্রত চেহারায় ওটা নিল কড্রে, কোনমতে দেরুশেতের কম্পিত বাঁ হাতের অনামিকায় পরিয়ে দিয়ে ফাদারের সাথে গলা মিলিয়ে ওকে আমৃত্যু সহধর্মিনী হিসেবে গ্রহন করার ঘোষণা উচ্চারণ করল।

***

জাহাজঘাটে বেজায় ভিড়। গোটা স্যামসন ভেঙে পড়েছে যেন দুরান্দের এনজিন দেখতে। ওদিকে লেতিয়ারি নিজের বিছানায় শুয়ে রয়েছে। ভীষণ আনমনা সে, গম্ভীর।

কিছু ভাবছে। হয়তো গিলিয়াত আর দেরুশেতের কথাই ভাবছে। বেলা তো কম হলো না, এতক্ষণে ওদের বিয়ে হয়ে গেছে নিশ্চয়ই!

সেই সকাল থেকে এ পর্যন্ত মেয়েকে দেখেনি লেতিয়ারি। কখন গিলিয়াতের সাথে গির্জায় চলে গেছে কে জানে! বিয়ের জন্যে এতই ব্যস্ত যে বুড়ো বাপের কথা একবারও মনেই পড়েনি হয়তো, ভাবছে সে।

তা ব্যস্ত হওয়ারই কথা। যে নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে লেতিয়ারিকে তার মেয়েসহ পথে বসার হাত থেকে উদ্ধার করেছে, জন্ম-জন্মান্তরের জন্যে ঋণী করে ফেলেছে তাদেরকে, তার মত একজন বীরকে স্বামীত্বে বরণ করার মত সৌভাগ্য কজন মেয়ের হয়? হোক না সে হতচ্ছাড়া ভবঘুরে।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বিয়ে হয়ে গেছে ওদের, ভাবল বৃদ্ধ। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে তার আর্শীবাদ নিতে ফিরে আসবে ওরা! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে বসল লেতিয়ারি।

হায়! যদি জানত কি অকল্পনীয় নাটক চলছে তখন সেইন্ট পিটার গির্জায়। যদি জানত তার সমস্ত স্বপ্নসাধ ভেঙে খানখান হয়ে গেছে ততক্ষণে! কিছুই জানতে পারল না বৃদ্ধ। জান। কেবল নিষ্ঠুর বিধাতা।

অন্তরীক্ষে বসে নির্বিকার চিত্তে সেই বিয়োগান্তক নাটক উপভোগ করছে সে প্রাণ ভরে।

***

বিয়ে সেরে ওরা যখন গির্জা থেকে বের হলো, ঘাটে তখন কাশমিরের ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়া প্রায় শেষ। ওটায় করে আজ, এখনই সস্ত্রীক লন্ডনে চলে যাচ্ছে কড়ে।

উপায় নেই, যেতেই হবে। নইলে মামার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারবে না সে।

চলুন, চলুন! ওদের দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে দেখছেন না!

ওর দিকে চকিতে একপলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল দেরুশেত। আজ ভোরবেলা থেকে তাদের দুজনের বিয়ে নিয়ে মানুষটা যে তৎপরতা দেখাল, ব্যাপারটা রীতিমত রহস্যময় লাগছে ওর। কিন্তু সে ভাবনা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না মনে, ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ল দেরুশেত।

জাহাজ ছাড়তে সত্যি আর দেরি নেই, এখন লেতিয়ারির সাথে দেখা করে তার আশীর্বাদ নিতে গেলে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই ঠিক হলো, আজ আর তার সাথে দেখা করতে যাবে না বর-কনে। বরং লন্ডন থেকে একটা চিঠিতে বৃদ্ধকে এর কারণ পুলে জানাবে তারা। লেতিয়ারি যে এ বিয়েতে মত দিয়েছে, তাতে দেরুশেত বা কড্রের মনে কোন সন্দেহ নেই। কারণ অনুমতি দিয়ে লেখা তার চিঠি তো তারা দেখেছে। কাজেই বিশেষ কারণে দেখা করতে না পারার ক্রটি নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে সে।

জোর পা চালিয়ে আগে আগে জাহাজ ঘাটের দিকে চলল দেরুশেত ও কড্রে, গিলিয়াত রয়েছে ওদের একটু পিছনে। উপযুক্ত জেটির অভাবে এখানে তীর থেকে সরাসরি জাহাজে চড়ার উপায় নেই, নৌকায় করে উঠতে হয়। তাই নৌকার দিকে এগোল ওরা।

কড্রে আগে উঠল নৌকায়। দেরুশেত তাকে অনুসরণ করতে যাচ্ছিল, এই সময় পিছন থেকে গাউনে টান পড়তে ঘুরে তাকাল। দেখল গিলিয়াত ওর গাউনের প্রান্ত ধরে আছে।

কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করে বিদেশে চলে যেতে হচ্ছে, চোখাচোখি হতে অপ্রস্তুতের মত হাসল যুবক, জামা কাপড় কিছুই তো নিয়ে যেতে পরলে না। কিন্তু ওসব ছাড়া চলবে কি করে? তাই জাহাজে তোমাদের কেবিনে একটা বড় বাক্স রেখে এসেছি আমি, ওর মধ্যে মেয়েদের কয়েক সেট পোশাক আছে। সব নতুন।

একটু দ্বিধাগ্রস্থ দেখাল গিলিয়াতকে। ওগুলো আমার মা জমিয়ে রেখেছিলেন নিজের ছেলের বউ এলে তাকে দেবেন বলে। তুমি ওগুলো গ্রহন করলে আমি খুশি হবো!

বলার মত কিছু খুঁজে পেল না দেরুশেত, কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

গিলিয়াত নিচু স্বরে বলে চলল, তোমাকে কোনদিন নিজের মনের কথা বলা হয়নি আমার। জীবনে আর কখনও হবেও না, তাই এই ফাঁকে কয়েকটা কথা বলে নিই।

যেদিন দুরান্দের ডুবে যাওয়ার খবর আসে, সেদিন আরও অনেকের সাথে তুমিও ছিলে তোমাদের বৈঠকখানায়। তখন সাময়িক উত্তেজনাবশেই বোধহয় সেখানে একটা প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলে তুমি।

এখন বুঝতে পারছি একটা কথার কথা ছিল সেটা। মঁশিয়ে লেতিয়ারিও ঈশ্বরের নামে শপথ করে একই ধরনের কথা বলেছিল সে সময়ে। কথাটা তোমার মনে নেই, বুঝতে পারছি। তা ভুলে যাওয়ারই কথা।

এরকম প্রতিজ্ঞা তো আমরা কতই করে থাকি, সব কি আর মনে রাখা যায়? না রাখলেই তা পালন করা সম্ভব হয়? আর মঁশিয়ে লেতিয়ারির তো তখন দুরান্দ হারিয়ে পথে বসার দশা, মাথার ঠিক ছিল না। কি বলতে কি বলেছিল! সে কবেকার কথা, কে অতসব মনে করে বসে থাকে!

একটু থামল যুবক। মুখে বিষণ্ণ হাসি। হাত তুলে দূরের বড়সড় একটা জটলা দেখাল দেরুশেতকে।

ওই যে ওখানে ভিড় করে আছে মানুষ, কেন বলতে পারো? স্যামসনের সবাই দুরান্দের এনজিন দেখতে এসেছে। অনেক বলে-কয়েও যখন ওটাকে উদ্ধার করে আনতে কাউকে ডোভারে পাঠানো যাচ্ছিল না, নগদ টাকার কথা বলেও না, তখন আমি এক কথায় যেতে রাজি হয়েছিলাম। কোন কথার ওপর, আজ আর তার কোন মূল্য নেই। আর সে অনেক বছর আগের এক বড়দিনের কথা, স্যামসনের রাস্তা বরফের তলায় চাপা পড়ে ছিল সেদিন। তুমি গির্জা থেকে ফেরার সময় পথের ওপর কি যেন লিখেছিলে। কাছে গিয়ে দেখি সেটা আমারই নাম।

শ্রাগ করল গিলিয়াত। কি জানি! সেদিন তো বেশ কুয়াশা ছিল, হয়তো ওর মধ্যে ভুলই দেখেছি! যাকগে, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। জাহাজ ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।

তোমাদের যাত্রা আজ ভালই হবে মনে হচ্ছে। কেমন পুবাল বাতাস বইছে দেখেছ? যাও তাহলে! বিদায়!

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে একটু পিছিয়ে এসে দাঁড়ল গিলিয়াত। পনেরো মিনিটের মধ্যে জাহাজে উঠে পড়ল দেরুশেত ও কড্রে। একটু পর ঘণ্টী বাজাল কাশমির, ঘড়ঘড় শব্দে নোঙর তোলা হলো। ঘাট ছেড়ে পিছিয়ে গিয়ে অনেকখানি জায়গা নিয়ে ঘুরতে শুরু করল ওটা। ঘাড় কাত করে সেদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকল যুবক।

বুকের ভেতরে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ওর। জীবনে এই প্রথমবার মনে হলো, ঈশ্বর সৃষ্ট এতবড় পৃথিবীতে সে সত্যিই বড় একা। ভীষণ একা। জীবনটা যেন কেমন তার, আদি-অন্ত হীন নিরস, ধূ ধূ মরুভূমির মত। বসন্তের বাতাস বইল না সেখানে, ফুল ফুটি ফুটি করেও ফুটল না, পাখি ডাকল না।

বেখেয়ালে এক চিলতে রাস্তাটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মহিষ পাহাড়ে এসে উঠল গিলিয়াত। পুবাল বাতাস পেয়ে সাগরের পানি যে হু হু করে বাড়ছে, সেদিকে মনে হলো খেয়ালই নেই।

অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে কি যেন ভাবল ও। মনে হলো গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কিসের, তা সে-ই জানে। নিজের বাড়িটা এক পলক দেখে নিল ও, তারপর লেতিয়ারির বাড়ির দিকে তাকাল।

গোটা স্যামসনের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল বিষাদ মাখা অলস দৃষ্টি। তারপর আরেকবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে সিংহাসনের ওপর বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে আরও আগেই-পুবাল বাতাসের তাড়নায় ওর চারদিকের এ্যানিটের দেয়ালে ছলাৎ ছল শব্দে আছড়ে পড়ছে ইংলিশ চ্যানেল।

কিন্তু গিলিয়াত নির্বিকার, যেন এ জগতে নেই। পানির শব্দ ছাপিয়ে দূর থেকে কাঠ কাটার শব্দ আসছে। লেতিয়ারি বোধহয় ওর নৌকা থেকে এনজিনটা নামানোর জন্যে লোক লাগিয়েছে।

পশ্চিম দিকে তাকাল গিলিয়াত। এইমাত্র ঘোরা শেষ করেছে কাশমির, মহিষ পাহাড়ের কাছ ঘেঁষে মন্থর গতিতে গভীর সাগরের দিকে চলতে শুরু করে দিয়েছে।

ডেকে বসা দেরুশেত ও কড্রের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল গিলিয়াত। ওরা দুজনও তীরের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে। কথা নেই কারও মুখে।

হঠাৎ মহিষ পাহাড়ের ওপর চোখ পড়তে বিস্মিত হলো দেরুশেত। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, দেখো, দেখো! ওই পাহাড়ের চুড়োয় কে যেন বসে আছে! সাগরে তো জোয়ার এসে গেছে, তারপরও বসে আছে লোকটা! হুঁশ নেই নাকি?

জবাবে কড়ে কি বলল জানা হলো না।

কয়েক মিনিটের মধ্যে গিলিয়াতের পা ছুঁয়ে ফেলল পানি। তারপর দেখতে দেখতে হাঁটু পর্যন্ত উঠে এল। ও শুধু একবার নিচের দিকে তাকাল, পানি কতখানি উঠেছে দেখে নিয়ে আগের মত অপলক, সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে দ্রুত বিলীয়মান জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকল। অন্য কোনদিকে খেয়ালই নেই।

অনুকুল বাতাস পেয়ে ভালই গতি লাভ করেছে কাশমির, ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় দিগন্তে পৌঁছে গেছে। তবু গিলিয়াতের সেদিক থেকে নজর ফেরানোর কোন লক্ষণ নেই, চেয়ে আছে তো আছেই।

এক ঘন্টা কেটে গেছে এর মধ্যে, পানি ওর কোমর পর্যন্ত উঠে এসেছে, তবু হুশ ফিরছে না। যেন দুচোখ মেলে পৃথিবীর শেষ সীমা অব্দি জাহাজটাকে অনুসরণ করতে না পারলে ফিরবেও না।

আরও এক ঘণ্টা কাটল। আবছা ধোয়াটে দূর দিগন্তে কাশমিরকে দেখতে লাগছে ছোট একটা ম্যাচবাক্সের মত। ক্রমে আরও ছোট হয়ে আসছে। সূর্যের শেষ বিকেলের নিস্তেজ রশি চ্যানেলের বুকে অদ্ভুত মায়াবি এক রঙের মেলা বসিয়েছে।

গিলিয়াতের চারদিকের লোনা পানি খল খল্ ছল্ ছল শব্দে প্রাণ খুলে হাসছে। জাহাজ ঘাটের কোলাহল জোয়ারের পানির ভয়াবহ শব্দের কাছে হার মেনে গেছে অনেক আগেই।

ও বসে আছে ধ্যানমপ্নের মত। গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে পানি, কোনমতে মাথাটা জেগে আছে কেবল, তবু গিলিয়াত মহিষ পাহাড়ের মত অবিচল, অনড়।

মাথার ওপর গাঙচিল ও অন্যান্য সামুদ্রিক পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে, ডানা ঝাঁপটে আর অবিরাম চিৎকার করে বৃথাই বোকা লোকটাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছে ওরা। কোন কাজ হচ্ছে না।

কাশমির ততক্ষণে অনেক অ-নে-ক দূরে চলে গেছে। অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে ওটাকে, একটা বিন্দুর মত। গিলিয়াতের দুচোখ এখনও একভাবে অনুসরণ করছে জাহাজটাকে। পৃথিবীর কোন কিছুর সাথেই তার সেই বিষাদ মাখা করুণ দৃষ্টির তুলনা চলে না।

সেখানে ফুটে আছে সব হারানোর কঠিন মর্মবেদনার ছাপ। দীর্ঘদিন ধরে মনের রাজ্যে একটু একটু করে গড়ে তোলা কল্পনার রঙিন বাসর আচমকা ঝড় এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে এমনই হয় বোধহয়।

অপ্রত্যাশিত বেদনায় হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত গিলিয়াতের, অথচ কারও বিরুদ্ধে তিল পরিমাণ অভিযোগ নেই। এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি। মুখ বুজে জীবনের এতবড় ব্যর্থতাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু অন্তর সে কষ্ট সয়ে নিতে পারলেও চোখ দুটো পারেনি বোধহয়। তাই এত বিষাদ, এত বেদনা আর ব্যাকুলতা ফুটে আছে সেখানে।

ধীরে ধীরে গোধুলির আবছা অন্ধকার নেমে আসছে স্যামসনে। গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া বাড়িটা খা খা করছে-মনে হচ্ছে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলেছে ওটা, কাকে যেন খুঁজছে ব্যাকুল হয়ে। আরেকদিকে লেতিয়ারির বিশাল বাড়িতে কিসের যেন হই-চই চলছে।

বৃদ্ধ কি করছে এখন কে জানে! বোধহয় মেয়ে-জামাইয়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় আছে অস্থির চিত্তে।

ধরনী থেকে গোধুলির সামান্য আলোটুকুও মিলিয়ে গেছে এখন। কুয়াশায় পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গেছে দিগন্ত, তাই কাশমিরকে আর দেখা যাচ্ছে না।

ওটার চিহ্ন মুছে গেছে ধরণীর বুক থেকে, একই সঙ্গে গিলিয়াতের মাথাটাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আর উঠল না হতভাগ্য যুবক। মহিষ পাহাড়ের মাথায় বড় বড় ঢেউ হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল ভরা জোয়ারের পানি, কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

সদ্য সন্তানহারা, বেদনাকাতর মায়ের মত কি এক অব্যক্ত আকুতি নিয়ে গিলিয়াতের বাড়ির পায়ের কাছে বারে বারে মাথা খুঁড়তে লাগল ইংলিশ চ্যানেল। উন্মাতাল বাতাস আর পানির মিলিত বোবা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সাঁঝের পরিবেশ।

দিনের আলো মুছে গিয়ে আঁধারের রাজত্ব শুরু হয়েছে গেরানসি দ্বীপের স্যামসন গ্রামে। রাত নেমেছে। ব্যতিক্রমী এক রাত।

গ্রামবাসীরা কেউ জানে না, আর কোনদিন গভীর নিশীথে ঘুম ভাঙলে সেই খেয়ালী বাঁশিওয়ালার মনকাড়া সুরের জাদু শুনতে পাবে না তারা।

সারাদিন মাছ ধরে আর বাঁশি বাজিয়ে বেড়ানো সেই হতচ্ছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটি চিরতরে হারিয়ে গেছে।

1 Comment
Collapse Comments

Ending ta khub kosto dilo. But awesome story. Thanks!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *