১০. ছোট সেই নৌকাটা

দশ

সর্বক্ষণের সঙ্গী ছোট সেই নৌকাটা নিয়ে একদিন সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর ডোভারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল গিলিয়াত, একা। আবহাওয়া ভাল ছিল না সেদিন। সাগরের চেহারা ঝোড়ো, মারমুখো। দেখলে যে কোন নাবিকের বুক কেঁপে উঠবে, কিন্তু ওর অতসব দেখার সময় নেই। ওর মধ্যেই নৌকা বেয়ে চলল একমনে।

মাথার মধ্যে কেবল একটাই চিন্তা, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে ডোভারে। যে করে হোক এনজিনটা উদ্ধার করে আনতে হবে। নইলে বেশি দিন ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলে অনবরত ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজের খোল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে এনজিনটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ডোভারের ভীষণ স্রোত।

ডোভারে পৌঁছার সোজা, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক কোর্স ধরে চলল গিলিয়াত। সারারাত ঝড়ের সাথে একটানা যুদ্ধ করতে করতে এগোল। পুব আকাশে দিনের আলোর আভাস দেখা দেয়ামাত্র বাতাসের বেগ কমতে শুরু করল। কমতে কমতে একসময় প্রথমেই গেল।

রোদের সোনালী আলোয় হেসে উঠল ইংলিশ চ্যানেল। রাতভর বাতাসের টানা শো শো গান শুনে অভ্যস্ত হয়ে আসা যুবকের কানে হঠাৎ এই নীরবতা কেমন যেন লেগে উঠল। চারদিকে চোখ বোলল ও। যতদূর দেখা যায় তীরের কোন চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ল না, যেন অন্য কোন পৃথিবী এটা।

চার দিগন্ত পর্যন্ত কেবল নীল পানি আর সাদা ফেনার কিরীট পরা অশান্ত ঢেউ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। সারাদিন একটান নৌকা বেয়ে চলল গিলিয়াত, তারপর সারারাত।

দু হাত অনবরত উঠছে আর নামছে, নামছে আর উঠছে। যন্ত্রচালিতের মত। নিজের কাজে এত মগ্ন, এতটাই একাগ্র, দেখে মনে হয় জীবনে এই একটা ব্রত নিয়েই বুঝি পৃথিবীতে এসেছে গিলিয়াত!

পরদিন দুপুরের দিকে ডোভারে পৌঁছল ও। সাগর বেশ শান্ত তখন। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। ভাটা চলছে, পানি সরে যাওয়ায় অনেকখানি জেগে উঠেছে ডোভার।

গোড়ার দিকের গর্তগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গিলিয়াত। জাহাজটা দুই ডোভারের মাঝের ফাঁকে আটকে আছে, তবে উপুড় হয়ে। এ অবস্থায় এনজিন উদ্ধার করা বেশ কঠিন হবে। জেনেও আমল দিল না।

কাজটা যে সহজ হবে না, তা জেনে-বুঝেই তো এসেছে, তাহলে আর এ নিয়ে মাথা ঘামাননা কেন? তাছাড়া দু’ চারদিনে শেষ হওয়ার নয় এ কাজ, তাও জানে।

তাই কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রশি ইত্যাদির সাথে জামা-কাপড়, বিস্কিট, পাউরুটি, বেসন দেয়া মাছ এবং বড় চামড়ার ব্যাগ ভরা খাবার পানিও নিয়ে এসেছে ও। অন্তত দিন দশেক চলে যাবে এতে।

দুই ডোভারের চারদিকে প্রথমে একটা চক্কর দিয়ে নিল গিলিয়াত, একটা সুবিধেজনক জায়গা বেছে নিয়ে কোনমতে নোঙর করল নৌকাটাকে। তারপর সাথে করে বয়ে আনা মানপত্রগুলো রাখার উপযুক্ত জায়গার খোঁজে ভাঙায় উঠে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। খানিক পর ডোভারের চূড়ায় উঠতে শুরু করল ও।

ওখান থেকে চারদিকটা ভালমত দেখতে পাওয়া যাবে। পাহাড়ের খাঁজে খুঁজে পা রেখে এমন অনায়াস ভঙ্গিতে উঠে যেতে শুরু করল যুবক, যেন এ পথ তার বহু চেনা। নিত্যই ওঠা-নামা করে। ওপরে উঠে দুরান্দের কাছে এসে দাঁড়াল গিলিয়াত, ভাল করে চোখ বোলাল ওটার ওপর।

একেবারে দুই চূড়ার মধ্যিখানে ফেঁসে গেছে জাহাজটা। দেখলেই বোঝা যায় ব্যাপারটা ভরা জোয়ারের সময় ঘটেছে, নইলে ওটার অত উঁচুতে ওঠার কোন কারণ নেই। কোনমতে জাহাজে উঠে খোলর মধ্যে ঢুকল ও।

দেখল ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে খোলটা। তবে আসল জিনিস ঠিকই আছে। একদম নতুনের মত ঝকঝক করছে এনজিনটা ওটাকে খেল থেকে মুক্ত করা খুব কঠিন হবে, জানে। কিন্তু সে চিন্তায় সময় নষ্ট করল না গিলিয়াত। সে যখনকার কাজ, তখন দেখা যাবে

এখন অন্য কাজ আছে। প্রথম কাজ হলো নৌকাটার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করা, তারপর নিজের জন্যেও একটা আশ্রয় চাই। উপযুক্ত জায়গার খোঁজে চারদিকট, ভাল করে দেখে নিল যুবক!

তারপর নিচে এসে নৌকা নিয়ে আরেক চক্কর দিল ডোভারকে কেন্দ্র করে। স্কেলিটন চূড়ার নিচে, বড় ডোভারের কোলের কাছের খানিকটা জায়গা বেশ নিরাপদ মনে হলো গিলিয়াতের। নৌকাটা ওখানে রাখা যায়, ঝড় এলেও তেমন কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।

ওর সামান্য ওপরে, পাহাড়ের গা থেকে লম্বালম্বিভাবে বেরিয়ে আছে একটা দীর্ঘ, খাড়া পাথর। দানবীয় একটা হাত আকাশ নির্দেশ করছে যেন। হাতটা যেখান থেকে বেরিয়েছে, সেখানে একটা গুহামত আছে। ওটার মধ্যে একজন মানুষ কোনমতে রাত কাটাতে পারবে মনে হলো গিলিয়াতের। ওতেই চলবে, এর বেশি কিছু চায়ও না সে।

নৌকাটাকে জায়গামত এনে কষে বেঁধে রেখে সাথের পোঁটলাপাটলি নিয়ে পাথরের খাড়া হাত বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল গিলিয়াত। জায়গাটা দেখে সন্তুষ্ট হলো। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, এখানে একজন মানুষের রাত কাটাতে কোন সমস্যাই হবে না।

বরং ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচা যাবে। গুহায় নিজের সমস্ত মালপত্র গুছিয়ে রাখল ও। তারপর লম্বা একটা রশি নিয়ে সেটার একমাথা খাড়া পাথরটার সঙ্গে মজবুত করে বাঁধল, অন্য মাথাটা বাঁধল দুরান্দের সাথে, টাটা করে।

প্রয়োজনের সময় লাইনটা ধরে ঝুলে ঝুলে স্কেলিটন থেকে জাহাজ, জাহাজ থেকে স্কেলিটনে ইচ্ছেমত আসা-যাওয়া করতে পারবে গিলিয়াত। নিচে নামতে হবে না সে জন্যে।

তবে এর একটা সমস্যাও আছে, মাঝপথে কোনমতে একবার হাত ফসকে গেলেই সর্বনাশ। অনেক নিচের সাগরে গিয়ে আছড়ে পড়তে হবে। কিন্তু সে চিন্তা করছে না গিলিয়াত। এ ধরণের চিন্তার পিছনে সময় নষ্ট করার মত মানুষ ও নয়। লাইনটা টেনেটুনে দেখে সন্তুষ্ট হলো যুবক।

তারপর নির্ভীকচিত্তে ডোভারের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঝড়ে দুরান্দ থেকে যে সমস্ত জিনিসপত্র উড়ে গিয়ে এখানে-সেখানে পড়ে ছিল, সব একটা একটা করে কুড়িয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল।

পরদিন থেকে শুরু হলো তার আসল কাজ। ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে কাজে লেগে পড়ল গিলিয়াত, অন্ধকার হয়ে না আসা পর্যন্ত মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নিল না।

সারাক্ষণ একটাই চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াল ওকে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুরান্দের এনজিন উদ্ধার করে নৌকায় তুলতে হবে, দেশের পথে পাড়ি জমাতে হবে। দেরি করা চলবে না।

যেদিকেই চোখ যায়, কেবল পানি আর ঢেউ, ঢেউ আর পানি। কোথাও জনমানুষের চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা সামুদ্রিক পাখি দেখা যায়, এছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সাড়া নেই, এমনই এক নির্জন দ্বীপে দিনের পর দিন, ভোর থেকে সন্ধের আঁধার না নামা অব্দি ভূতের মত খেটে চলল গিলিয়াত।

সময়মত খায় না, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয় না, সারাদিন কেবল কাজ কাজ আর কাজ। যখন ঘন আঁধার গ্রাস করে ফেলে বিশ্বচরাচর, রশি ধরে ঝুলে ঝুলে নিজের গুহায় ফিরে যায় গিলিয়াত।

ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহটা গ্যানিটের শীতল মেঝেতে এলিয়ে দেয়। তখন মনে হয়, ঘুমানোর সময় মা যেমন করে সারাদেহে তার স্নেহের কোমল হাত বুলিয়ে দিত, সাগরও যেন তেমনি ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।

অন্ধকারে প্রায়ই দেরুশেতের মায়াবী মুখটা ওর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, বিভোর হয়ে সেটার দিকে অপলক চেয়ে থাকে গিলিয়াত। ছবি মিলিয়ে গলে হতাশ হয়ে দার্শনিঃশ্বাস ছাড়ে, পাশ ফিরে শোয়।

এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পুরো দশটা দিন কাটিয়ে দিল গিলিয়াত। অতিরিক্ত খাটুনি, অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং ঘুমের অভাবে এরমধ্যে দেহ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর, দাড়ি-গেঁফে মুখ ভরে উঠেছে। বনমানুষের মত হয়েছে চেহারা।

জামাকাপড় সব ছিঁড়ে-ফেটে একাকার, পায়ের জুতো জোড়া কোথায় গেছে তার হদিস নেই। ওদিকে খাবার আর পানি, তাও ফুরিয়ে এসেছে অল্প কিছু বিস্কিট ছাড়া এখন তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই।

দেহের বল দিন দিন কমে আসছে ওর, ভয়ঙ্কর ডোভার একটু একটু করে শুয়ে নিচ্ছে জীবনী শক্তি। অথচ এখনও বোঝা যাচ্ছে না কতদিনে কাজটা শেষ হবে! খাবার-পানি ফুরিয়ে গেলে কি অবস্থা হবে জানে না গিলিয়াত, জানতে চায়ও না। ও শুধু জানে যতদিনে হোক, যে করে হোক, দুরান্দের এনজিন তাকে উদ্ধার করতে হবে।

ওটা না নিয়ে কিছুতেই ফিরে যাবে না সে।

এগারো

অবশেষে টানা পনেরো দিনের অমানুষিক সংগ্রাম আর কঠোর অধ্যবসায় সাফল্য নিয়ে এল একদিন। এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে তখন।

শেষ কাজটা শুধু বাকি এখন গিলিয়াতের। দুপুরের মধ্যে সেটাও সেরে ফেলল ও করাতের সাহায্যে দুরান্দের খোল কেটে চিমনিসহ অসম্ভব ভারী এনজিনটা আলাদা করে ফেলল। খোল থেকে মুক্তি পাওয়ামাত্র ওটার গড়িয়ে সাগরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই আগেই জাহাজের বড় বড় শেকল দিয়ে দুই চূড়ার সাথে এটাকে খুব মজবুত করে বেঁধে নিয়েছিল গিলিয়াত। এমনভাবে বেঁধেছে, যাতে দুই চূড়ার মাঝখানে স্কুলে থাকে, ভাতে বাকি কাজ সারতে অনেক সুবিধে হবে।

জোয়ারের সময় পানি যখন বাড়তে থাকবে, তখন নৌকাটাকে এনজিনটার একদম তলায় নিয়ে যাওয়া যাবে, বাঁধন খুলে ওটাকে তখন নৌকার পাটাতনে নামিয়ে আনা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

তাই করল গিলিয়াত, নৌকা ওটার তলায় নিয়ে এসে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকল। জোয়ার হতে সাগরের পানি ফুলেফেঁপে উঠতে আরম্ভ করল, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৌকাটাও একটু একটু করে ওপরে জেগে উঠছে। একসময় এনজিনটার ঠিক তলায় এসে ঠেকল নৌকা, কাজ সেরে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময়।

শেকল কাটতে উঠল গিলিয়াত, তখনই হঠাৎ করে ওর হাত পা অসাড় হয়ে এল। রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসাদ এসে হেঁকে ধরায় চোখে রীতিমত আঁধার দেখল ও।

জীবনে দুঃসাহসী কাজ কম করেনি গিলিয়াত, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে অচিন সাগরের হাজারো বিপদ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কত অসাধ্যই না সাধন করেছে সে। এবারেরটা ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিনতম।

যে ডোভারে একা একা যাওয়ার কথা মানুষের স্বপ্নেরও অতীত, যেখানকার পরিবেশের কথা ভেবে অতি বড় দুঃসাহসীও শিউরে ওঠে, সেই ভয়ঙ্কর ডোভারে একা একটানা দুই সপ্তাহ কাটিয়ে দিল সে।

যে অসম্ভব কাজ নিয়ে এসেছিল, অমানুষিক পরিশ্রম করে তাতে সফলও হয়েছে। কল্পনার অতীত এই সাফল্যের কথা ভেবে গিলিয়াত নিজেই যার পর নাই বিস্মিত। আনন্দে উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

আর তখনই, সাফল্যের একেবারে দোড়গোড়ায় পা রাখামাত্র হঠাৎ কেন যেন আপাদমস্তক শিউরে উঠল, ধপ করে নৌকার পাটাতনের ওপর বসে পড়ল গিলিয়াত। ওর অবচেতন মনে কোন অশুভ আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গিয়েছিল কি না কে জানে!

সারাদেহ থর থর করে কাঁপতে শুরু করল গিলিয়াতের। অবশ্য মনের সঙ্গে জোর খাঁটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলল সে, লোহা কাটার করাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি কাজ শেষ করতে। বিশ মিনিট পর এনজিন নিরাপদেই নামিয়ে আনল ও, ছোট নৌকা অনেকখানি দেবে গেল জিনিসটার ভারে।

গিলিয়াতের ডোভার অভিযান শেষ, এবার নিশ্চিন্তে গেরানসি যাত্রা করা যায়। না, ভুল হলো। এখনও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে ওর। দুরান্দের চিমনিটার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ওটাও নিতে হবে। এনজিন নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে চিমনির কথা ভুলেই গিয়েছিল গিলিয়াত। কিন্তু এখনই ওটাকে নৌকায় তোলার উপায়ও নেই।

এ মুহূর্তে দুই ডোভারের একটার সাথে মাথা ও অন্যটার সাথে লেজ ঠেকিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে আটকে আছে জিনিসটা। পানির সাথে তাল রেখে দুলছে। এখন তোলা যাবে না। ভাটার সময় করতে হবে কাজটা।

কিন্তু আবার ভাটা আসতে আসতে তো সেই মাঝরাত। অতরাতে কাজ শেষ করে যাত্রা করা কঠিন হয়ে যাবে। তা হয় হোক, তবু কাজ অসমাপ্ত রেখে ফিরে যেতে রাজি নয় গিলিয়াত। কাজে কোনরকম খুঁত রাখা চলবে না।

একটু বিশ্রাম দরকার। পেটে কিছু দেয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে, নইলে আর পারা যাচ্ছে না ও। খুঁজে খুঁজে কয়েকটা কাঁকড়া ধরল গিলিয়াত, তার সাথে কিছু বিস্কিট দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিল। এবার একটু পানি চাই। পানির ভাণ্ডার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ওর বাড়তি কয়েকদিন লেগে যাওয়ায়, এখন খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আজ যে প্রচণ্ড ধকল গেছে, তাতে অন্তত কয়েক ঢোক না খেলেই নয়। কাজেই চামড়ার ব্যাগটা উপুড় করে কোনমতে গলা ভেজাবার মত খানিকটা বেল গিলিয়াত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠবে বলে এনজিনটার পাশে শুয়ে পড়ল।

নানান উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় গত কয়েক রাত এক মুহূর্তের জন্যেও ঘুমাতে পারেনি, তাই পাটাতনে পিঠ ছোঁয়ানোমাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

কত রাতে কে জানে, হঠাৎ চোখের ওপর তীব্র আলোর ছটা এসে পড়তে গভীর ঘুমটা ভেঙে গেল, ধড়মড় করে উঠে বসল গিলিয়াত। হতবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। এ কিসের আলো!

ভাবসাব দেখে মনে হলে চ্যানেলের প্রতিটা ঢেউয়ের মাথায় আগুন ধরে গেছে বুঝি, আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল। ডোভারের প্রতিটা কোনা কানাচে নেচে বেড়াচ্ছে তার উজ্জ্বল ছটা।

তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকল ও। বুঝে উঠতে পারছে না আলোটার উৎস কি। এমন আজব দৃশ্য জীবনে এই প্রথম দেখল। ভাগ্য ভাল ঘুমটা ভেঙেছিল, ভাবল ও। নইলে আর কিছুক্ষণ পর কি ঘটত বলা যায় না।

হুঁশ ফিরতে দেখল ভাটা শেষ হয়ে আবার জোয়ার এসেছে সাগরে! ওদিকে দুরান্দের চিমনিটা কি করে যেন আগের অবস্থান থেকে ছুটে অনেকটা নিচে এসে নতুন করে আটকে গেছে, ওর মাথার মাত্র কয়েক হাত ওপরে।

পানি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ওর নৌকা ক্রমে ওপরে উঠছে। পানি আর এক হাত বাড়লেই এনজিনটা চিমনির সাথে ঠেকে যাবে, ঠেকে যাবে নৌকাও।

পানি বাড়বে অথচ নৌকা জাগবে না, তার ফল কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। ব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত, তাড়াতাড়ি নৌকা সরিয়ে না নিয়ে গেলে বিপদ। যে কাজ অন্য সময়ে দুমিনিটে করে ফেলতে পারত, ভীষণ ক্লান্ত বলে সেই কাজেই পুরো দশ মিনিট লাগল।

নৌকাটাকে বিপদমুক্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ও, একই সাথে চিমনির আশা ছেড়ে দিল। দরকার নেই ওটার। শুধু এনজিনটা নিয়ে ভালয় ভালয় জায়গামত পৌঁছতে পারলে হয়।

গেরানসি যাত্রা করার জন্যে জোয়ারই উপযুক্ত সময়। এ মুহূর্তে একে তো জোয়ার, তারওপর সাগরও বেশ শান্ত, তাই নৌকা ছেড়ে দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কেন যেন সাহস হলো না গিলিয়াতের।

অবাক চোখে আগুন রঙের অদ্ভুত আলোটার খেলা দেখছে ও। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে বোকার মত। কিছুক্ষণ পর আচমকা মিলিয়ে গেল আলোটা, ঘন আঁধারে ডুবে গেল ধরনী। দুর দিয়ে এক আঁক সামুদ্রিক চিল আতঙ্কিত গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে পালিয়ে গেল।

এ নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বাভাস!

পাখিগুলোর আতঙ্কিত চিৎকার ও পালিয়ে যাওযার পড়িমরি ভাব দেখেই বুঝে ফেলেছে গিলিয়াত। ওর সমস্যা আরও বাড়াতে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ঝড় আসছে! এমনিতে এই অঞ্চলে ঝড় ঝাঁপটা সারাক্ষণ লেগেই থাকে।

সাধারণ ঝড় এখানে কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু অসন্ন ঝড়টা এইমাত্র নিজের আগমনের যে আলামত দেখিয়ে গেল, তাতে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল ও।

অজান্তেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠল গিলিয়াতের। না জানি কি ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা নিয়ে আসছে ঝড়টা। নৌকাটাকে তাড়াতাড়ি পাহাড়ের গোড়ার সেই নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল ও, তারপর ভয়ে ভয়ে কি ঘটে তা দেখার অপেক্ষায় থাকল।

সকাল হলো। কিন্তু ভীষণ মুখ গোমরা সকাল। চ্যানেল এখন পর্যন্ত শান্তই আছে। সূর্য কিছুক্ষণের জন্যে দেখা দিয়ে গায়েব হয়ে গেল। বাতাস জমাট বেঁধে থাকায় ক্রমে শুমোট হয়ে উঠতে লাগল পরিবেশ। অবশেষে দুপুরের একটু আগে শুরু হলো প্রত্যাশিত ঝড়।

বাতাসের সামান্য ছোঁয়া পেতেই চেহারা বদলে গেল শান্ত ইংলিশ চ্যানেলের-রুদ্র মূর্তি ধরল চোখের পলকে। ভীষণভাবে কুঁসে উঠল। কুদ্ধ, দানবীয় সাপের মত হাজারটা ফণা তুলে প্রলয় নাচন জুড়ে দিল ডোভারকে ঘিরে।

দুনিয়া আঁধার করা বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টিও শুরু হলো একই সাথে। অন্ধকার আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চিরে দিয়ে সাপের জিভের মত সকল চমকাতে লাগল, সেকেন্ডে সেকেন্ডে দিনের মত ঝলসে উঠতে লাগল চারদিক। বিরামহীন বাজ পড়ার বিকট, ভয়াবহ শব্দে গিলিয়াতের মত দুঃসাহসী নাবিকেরও বুক কাঁপতে লাগল।

নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় অসহায়ের মত নৌকায় বসে থাকল ও। টানা বিশ ঘণ্টা দুনিয়া ওলট-পালট করা ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে অবশেষে থামল ভয়ঙ্কর ঝড়টা। বাতাস, বৃষ্টি, একযোগে থেমে গেল। স্বস্তির দম ছেড়ে নৌকার পাটাতনে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিল গিলিয়াত।

বারো

অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙল ওর। সাগর তখন বেশ শান্ত। সময় মত গেরানসিতে পৌঁছতে হলে আরও আগেই রওনা করা উচিত ছিল ওর। তা যখন হলো না, তখন আজ আর যাত্রা করবে না ঠিক করল গিলিয়াত। তারচেয়ে বরং একটা দিন দেরিতে যাত্রা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

অসহ্য খিদেয় নাড়িভূঁড়ি সব হজম হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে ওর। সারাদেহ কাঁপছে থর থর করে। ভয় হলো, এখনই কিছু খাবার জোগাড় করতে না পারলে ও বোধহয় মরেই যাবে।

গায়ের জামাটা তখনও একটু একটু ভেজা ছিল, ওটা খুলে ফেলল গিলিয়াত। পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে নিজের আরেক সর্বক্ষণের সঙ্গী, লম্বা ফলার ধারাল ছুরিটা নিয়ে নেমে পড়ল নৌকা থেকে। খাওয়ার জন্যে কিছু একটা জোগাড় করতেই হবে ওকে।

নৌকাটা যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে, তার কয়েক হাত দূরে পাহাড়ের গায়ে বেশ বড়সড় একটা গর্ত। গুহামুখের ওপরে খিলানের মত পাথরের কার্নিশ, সামনের দিকে বেরিয়ে আছে অনেকখানি।

বুক সমান পানি ওখানটায়। ঝড়ের সময় প্রচুর বড় বড় কাঁকড়া আশ্রয় নিয়েছিল গুহার ভেতরে, আগেই লক্ষ করেছে গিলিয়াত। এখনও আছে সেগুলো বের হতে সাহস পায়নি আবার ঝড় আসতে পারে সেই ভয়ে।

খিলানের নিচ দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই মস্ত বড় একটা কাঁকড়া দেয়ালের আশ্রয় ছেড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, পাশ ফিরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে খিচে দৌড় লাগাল গুহামুখের দিকে। ওটাই ছিল ওর প্রধান লক্ষ্য, কাজেই পিছু ছাড়ল না।

ওটাকে ধাওয়া করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহাটার আকার দেখে বেশ অবাক হলো গিলিয়াত। বাইরে থেকে কল্পনাই করা যায়নি ওটা এত বড় হতে পারে।

মস্তবড় গুহা। একজন মানুষ অনায়াসে চলাচল করতে পারে ভেতরে। একটু দাঁড়াল ও আবছা অন্ধকারে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্যে। তারপর বড় কাকড়াটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।

এই সময় গুহার ও মাথায় বেদীর মত উঁচু, শুকনো খানিকটা জায়গা চোখে পড়ল। বাইরে থেকে সূর্যের আলো এসে পড়েছে ওখানটায়। ব্যাপার বোঝার জন্যে আরও কয়েক পা ভেতরে এগিয়ে দাঁড়াল গিলিয়াত, তখনই এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল।

নরম গুড়ের মত একটা ঠাণ্ডা হাত পিছনে থেকে আচমকা ওর ডান হাতটা পেঁচিয়ে ধরল শক্ত করে। বরফের মত ঠাণ্ডা হাত! জনপ্রাণীবিহীন নির্জন জায়গায় হঠাৎ এমন অচিন্তনীয় আক্রমণে মুহূর্তের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ও।

পরমুহূর্তে ভয়ে জান উড়ে গেল হাতটা ওকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করছে বুঝতে পেরে। প্রচণ্ড শক্তিতে টানছে বরফের মত ঠাণ্ডা হাতটা! সামলে নিয়ে এক পা গুহার দেয়ালে বাধিয়ে নিজেকে ছাড়াবার জন্যে গায়ের জোরে টানা-হঁচড়া শুরু করল গিলিয়াত।

কাজ হলো না। অজ্ঞাত আক্রমণকারীর কঠিন মুঠি এক চুলও শিথিল হলো না তাতে, বরং আরও এঁটে বসল। আরেকটা গুঁড় এসে ওর নগ্ন পেট পেঁচিয়ে ধরল। পরমুহূর্তে মনে হলো, ছোট ছোট অসংখ্য সুঁই পেটের প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে রক্ত শুষে নিতে আরম্ভ করেছে বুঝি।

এরমধ্যে আরেকটা শুঁড় এসে বুক পেঁচিয়ে ধরেই চাপ দিতে শুরু করল। চাপের চোটে দম বন্ধ হয়ে এল গিলিয়াতের, ভয় হলো বুকের খাঁচা এখনই খুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে বুঝি। খানিক পরই নতুন আরও দুটো শুড় এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে, নড়াচড়ার উপায় রাখল না তেমন।

দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল ওর, অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে সারাদেহ। এত কিছু ঘটে গেল মাত্র দুই থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে। আত্ৰমণকারীকে তখনও পর্যন্ত দেখতে পায়নি গিলিয়াত।

তবে সেটা যে কি হতে পারে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হলো না। সাগরে এমন প্রাণী একটাই আছে, তার নাম অক্টোপাস-যার খপ্পরে পড়ার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু।

তবে ভরসার কথা যে ওর ছোরা ধরা বাঁ হাত আর ঘাড় এখনও মুক্ত আছে। এ পর্যন্ত পাঁচটা গঁড় কাজে লাগিয়েছে অক্টোপাসটা, আরও তিনটে কাজে লাগাতে বাকি। তার আগেই রুখে দাঁড়ানো না গেলে নির্ঘাৎ মৃত্যু। ওটা কোথায় আছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল ও।

গুহায় ঢুকতেই বাঁ দিকে একটা ছোট গর্ত আছে; কাঁকড়ার দিকে নজর থাকায় আগে খেয়াল করেনি গিলিয়াত, সেটার মধ্যে বসে আছে অক্টোপাসটা-নাগালের মধ্যেই। ড্যাবৃড্যা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সে কী ভয়ঙ্কর চাউনি।

দুচোখ জ্বল জ্বল করছে সাক্ষাৎ শয়তানটার, খুব সম্ভব শিকার ধরার আনন্দে। বিশাল ধড়, এতবড় অক্টোপাস আগে কখনও দেখেনি গিলিয়াত। পাঁচটা গঁড় স্থির ওটার, ওকে ধরে রেখেছে বলে টাটা হয়ে আছে। বাকি তিনটা কিলবিল করছে শূন্যে, যে কোন মুহূর্তে কাজে লেগে পড়বে ওগুলোও।

পাকড়াও কর্ম সম্পন্ন হলে ধড়টা ওর দিকে এগিয়ে নিয়ে আসবে ড্যাডেবে শয়তানটা, বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে একসঙ্গে আটটা ঔড় দিয়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে যাতে দম বন্ধ হয়ে আসে গিলিয়াতের। তারপর মৃত্যু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।

লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে বাঁ হাতে ধরা ছোরাটা বিদাৎ গতিতে শয়তানটার দুই চোখের মাঝখান দিয়ে চালিয়ে দিল গিলিয়াত, একেবারে মগজে ঢুকিয়ে দিল ওটার দীর্ঘ ফলা। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল অক্টোপাস, শুড়ের বাঁধনগুলো শিথিল হয়ে গেল দেখতে দেখতে।

আরেকবার আঘাত করার জন্যে ছুরি খসাতে হাত টান দিল গিলিয়াত, কিন্তু তার আর দরকার হলো না। টান খেয়ে গর্তের মুখের দিকে খানিকটা এগিয়ে এল সাগর-দানবটা, তারপর প্রাণহীন জড়পিণ্ডের মত ধীর গতিতে পানিতে গড়িয়ে পড়ল। শুড়গুলো কুঁকড়ে আছে যন্ত্রনায়। ওই অবস্থায়ই ধোয়ার মত রক্ত ছাড়তে ছাড়তে তলিয়ে গেল ওটা। অদৃশ্য হয়ে গেল।

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকল গিলিয়াত। প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। গুড় দিয়ে ওর হাত, বুকসহ যেখানে যেখানে ধরেছিল অক্টোপাসটা, সে সব জায়গা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, খুব জ্বালা করছে।

সমুদ্রের লবণ পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জায়গাগুলো ডলে ডলে ধুয়ে নিল ও। জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা কমে আসতে সামনে নজর দিল। সুড়ঙ্গের ভেতরে বেদীর মত যে শুকনো জায়গাটা দেখতে পেয়েছিল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।

জায়গাটা বেশ উঁচুতে, তাকের মত-বেশ খানিকটা লম্বা এবং শুকনো। দেখে মনে হলো মাত্রাছাড়া জোয়ার না এলে ওই পর্যন্ত পৌঁছায় না পানি। কাঁকড়াটা নিশ্চয়ই ওখানে আছে ভেবে এগোল গিলিয়াত।

পাহাড়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় মোটামুটি দেখা যাচ্ছে তাকটা। খানিকটা এগোতেই হঠাৎ ওটার ওপরে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পেয়ে থমকে গেল ও।

গা ছমছম করে উঠল। চোখ কুঁচকে তাকাল। কি ওটা!

মনে হলো একজন মানুষ যেন শুয়ে আছে তাকটার ওপরে, দু’ পাটি ধপধপে সাদা দাঁত বের করে বিকট হাসি হাসছে। একটু থেমে থেকে সাহসে ভর করে আবার এগোল ও।

এবার পরিষ্কার দেখতে পেল জিনিসটাকে। মানুষই বটে, তবে জীবীত নয়-মৃত। একটা নরকঙ্কাল। ওটার চারপাশে স্তূপ হয়ে আছে অজস্র মৃত কাঁকড়ার খোসা, নরকঙ্কালটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে ওগুলো। বিস্ময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেল গিলিয়াতের। কিছু সময় হাঁ করে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এখানে নরকঙ্কাল আসে কি করে? ভাবল ও। সময় নষ্ট না করে তাকটার দিকে এগিয়ে গেল।

দুহাতে কঁকড়ার খোসা সরিয়ে কঙ্কালটাকে দেখল ভাল করে। কোন এককালে ওটা কোন মানুষেরই ছিল, এই সত্যটা ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করতে পারল না ও। তবে কঙ্কালটার কোমরে ঢামড়ার চওড়া একটা বেল্ট দেখতে পেল।

লোহার বাকলে জং ধরা ছাড়া অন্য কোন ক্ষতি হয়নি বেল্টটার। টাকা-পয়সাসহ ছোটখাট জিনিসপত্র রাখার জন্যে ওটায় কয়েকটা খোপ আছে। তার মধ্যে একটা বেশ ফুলে আছে দেখে খুলল ও, ভেতর থেকে বের হলো একটা লোহার তৈরি মানিব্যাগ।

একটা নাম খোদাই করা আছে ওটায় : ক্লুবিন।

ওটাতেও মরচে ধরে গেছে, তবে প্রিঙের কল-কব্জা কাজ করছে ঠিকমতই। ব্যাগটা খুলল গিলিয়াত, খুলেই অবাক হয়ে গেল ভেতরে পনেরো হাজার স্ট্রার পাঁচটা নোট দেখতে পেয়ে।

এখনও ভাল আছে টাকাগুলো নষ্ট হয়নি। কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেল ব্যাগে। গুনে দেখল ও, মোট একুশ গিনি। বেল্টটা কঙ্কালের কোমর থেকে খুলে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এল গিলিয়াত। চিন্তিত।

তেরো

নৌকায় উঠেই মাথা ঘুরে গেল গিলিয়াতের। কখন কি ভাবে ওটার তলা ফুটো হয়ে গেছে, কে জানে! হড়হড় করে পানি উঠছে। এর মধ্যেই এক হাঁটু পানি জমে গেছে খোলর ভেতরে। এখনই ফুটো বন্ধ করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গিলিয়াতের এতদিনের অমানুষিক পরিশ্রম বরবাদ হয়ে যাবে।

দিনের বাকি সময়টা ওই ফুটো বন্ধ করতেই কেটে গেল ওর। তাও তেমন সন্তোষজনক হলো না কাজটা। পুরো এক বেলা পরিশ্রম করে কাপড়চোপড়ের তালি মেরে একবার ওটা প্রায় মেরামত করে এনেছিল, এমন সময় আবার ছুটে গেল।

নতুন করে পানি ওঠা শুরু হতে ফের একই বিরক্তিকর কাজে হাত লাগাতে হলো ওকে। সঙ্গে যত কাপড়চোপড় ছিল, এবার তার সবই কাজে লাগাল গিলিয়াত। প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও সে রাতে অনেক সাধ্য-সাধনা করেও ঘুমাতে পারল না গিলিয়াত, নানান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এলই না ঘুম।

পরদিন ভোর হতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল, তারপর প্রস্তুত হলো তিন সপ্তাহের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল নিয়ে স্যামসনে ফিরে যাওয়ার জন্যে। তখন আর চেনার জো নেই গিলিয়াতকে। অনাহার, অনিদ্রা আর অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, পাঁজরের হাড় সব ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। চোখ বসে গেছে কোটরে।

তবে এতকিছুর পরও সাফল্যের আনন্দে ঝলমল করছে ওর চোখমুখ। চোখের সামনে দেরুশেতের মোহনীয় মুখটা ভেসে উঠছে একটু পর পর। ওর সেদিনের উচ্চারিত প্রতিজ্ঞার প্রতিটা শব্দ কানে বাজছে।

বহুদিন পর নিজের প্রিয় গানটা গুন্ গুন্ করে গেয়ে উঠল গিলিয়াত। ডোভার পাহাড়ের আশেপাশে সে সময় যদি কেউ থাকত, ওর সেই হৃদয় কাড়া কোমল, মিষ্টি সুর নিশ্চয়ই তার অন্তর ছুঁয়ে যেত।

***

স্যামসনে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। কারণ, সেইন্ট পিটার গির্জায় কড্রে নামে যে নতুন রেভারেন্ড এসেছে কিছুদিন আগে, সে নাকি হঠাৎ করে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে।

লন্ডনে তার এক মামা ছিল, মস্ত বড়লোক। কড্রে ছাড়া আপনজন বলতে কেউ ছিল না তার। সেই মামা মারা গেছে, এবং তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে সে এখন তার যাবতীয় টাকা-পয়সা, জমিজমা ইত্যাদির একমাত্র মালিক। আজই কড্রের মামার মৃত্যুর খবর এসেছে স্যামসনে।

লন্ডন থেকে আসা কাশমির নামের এক জাহাজে এ খবর এসেছে, সেই সাথে কড্রেকে অনতিবিলম্বে লন্ডনে যাওয়ার অনুরোধও। মামার শেষকৃত্যে যোগ দেয়া এবং তার সবকিছু বুঝে নিতে তার যাওয়া খুব জরুরি। দেরি করার উপায় নেই, তাই প্রস্তুতি নিতে লাগল রেভারেন্ড।

এর কয়েকদিন আগের ঘটনা। বুড়ো লেতিয়ারির নামে সীলগালা করা একটা চিঠি এল। খামের ওপর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের ছাপ। বেশ কৌতূহল নিয়ে খামটা খুলল সে। বেশি বড় নয় চিঠিটা-ডেটলাইন লেখা রয়েছে ১০ মার্চ। চিঠিটার বক্তব্য এরকম?

মঁশিয়ে লেতিয়ারি,
এত বছর পর আমার চিঠি পেয়ে আপনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হবেন। বিশেষ একটা খবর আপনাক জানানো জরুরি ছিল বলে চিঠি না লিখে উপায় ছিল না। এ মুহূর্তে তামোলিপা নামের এক জাহাজে লিসবনের পথে রয়েছি আমি।

গেরানসির একজন নাবিক আছে, সে দেশে ফিরে আপনাকে একদিন আমার এ চিঠি পৌঁছে দেবে, সেই ভরসায় লিখতে বসেছি। কথাটা হলো আমি আপনার সমস্ত টাকা ফেরত দিয়েছি। কয়েক বছর আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে আপনার পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ আমি ধার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাসখানেক আগে সেইন্ট ম্যালো বন্দরে আপনার বিশ্বস্ত কর্মচারী ক্লুবিনের সাথে দেখা হয় আমার, তখন সেই পঞ্চাশ হাজার এবং তার সূদ হিসেবে আরও পঁচিশ হাজার, মোট পঁচাত্তর হাজার ফ্ৰা তার হাতে তুলে দিয়েছি আমি। পনেরো হাজার জঁর পাঁচটা নোটে। আপনার প্রতিনিধি হিসেবে টাকাটা বুঝে নিয়েছে ক্লুবিন। কাজেই আমি এখন দায়মুক্ত।

খবরটা আপনার জানা দরকার বলে এ চিঠি লিখলাম। আর একটা কথা, টাকাটা নেয়ার ব্যাপারে ক্লুবিনকে অতিরিক্ত উৎসাহী মনে হয়েছে আমার। সে সময় তার হাতে গুলি ভরা পিস্তলও ছিল, তাই টাকা প্রাপ্তির রসিদ চাইতে সাহস হয়নি আমার।

– আপনার বিশস্ত রাতাগ।

চিঠি পড়া শেষ হতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল লেতিয়ারি, প্রায় বিস্মৃত বিশ্বাসঘাতকটার কথা ভাবছে। ক্লুবিন সম্পর্কেও একটা বিচ্ছিরি সন্দেহ ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। গত কিছুদিন থেকে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে নানান সন্দেহজনক কথাবার্তা বলাবলি করছে।

সবই কানে এসেছে সেভিয়ারিয়। তাদের ধারণা, ক্লুবিন নাকি ইচ্ছে করেই দুরান্দকে দুর্ঘটনায় ফেলেছে। অথচ সবাইকে বোঝতে চেয়েছে এ ব্যাপারে তার কোন হাত ছিল না। আসলে সে-ই সম্পূর্ণ দায়ী এ জন্যে। ওটাকে ডুবিয়ে দিয়ে লোকজন সবাইকে সাইফবোট করে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে বদমাশটা।

কিন্তু আসলে পরে কোন একসময় পালিয়ে গেছে হ্যাঁনওয়ে থেকে। এই চিঠির বক্তব্য তাদের ধারণাকেই সমর্থন করছে বলে সন্দেহ আরও হাজারগুন বাড়ল বৃদ্ধের। টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতলবেই তার এতবড় একটা সর্বনাশ ঘটাতেও পিছপা হয়নি ক্লুবিন লোকটা।

চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে উঠল লেতিয়ারি। কারও সাথেই কথাবার্তা তেমন একটা বলে না। একা একা থাকে সারাক্ষণ, কি যেন চিন্তা করে। যেদিন কড্রের মামার মারা যাওয়ার খবর এল, সেদিন আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর দেখা গেল তাকে।

রাতে পূর্ণ চাঁদের আলোয় গোটা স্যামসন ঝলমল করছে দেখে দেরুশেতকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে এল লেতিয়ারি। কিন্তু একটু পরই ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সে, ঘুম পেয়েছে বলে ভাইঝির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে গেল।

দেরুশেত তার এই অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত হলেও কিছু বলল না। ও লক্ষ করেছে, গত কিছুদিন থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে উঠেছে, অন্য কারও সাথে তো নয়ই, এমনকি ওর সাথেও পর্যন্ত ঠিকমত কথা বলে না।

ওর ধারণা, প্রিয় দুরান্দের কথা ভেবে মন খারাপ করেছে বোধহয় তেতিয়ারির। তারওপর আজ খুব ক্লান্তও দেখাচ্ছিল তাকে, তাই কিছু জিজ্ঞেস করল না ও। একাই পায়চারী করতে থাকল বাগানে।

ওদিকে গভীর রাতে কেন যেন হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল লেতিয়ারির। মাথা ঘোরালেই জানালা দিয়ে বন্দর দেখা যায়, চোখ মেলে অভ্যেসবশে আনমনে সেদিকে তাকাল সে। যতদূর চোখ যায় চাঁদের আলোয় কাঁচের মত চকচক করছে সাগর।

প্রথমে বোধহয় কিছুটা আনমনা ছিল বৃদ্ধ, একটু পর হঠাৎ অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য চোখে পড়তে ধড়মড় করে উঠে বসল। বন্দরের কাছে পানিতে কি ভাসছে ওটা? জাহাজের চিমনির মত মনে হচ্ছে না! ভাল করে চোখ রগড়ে আবার তাকাল লেতিয়ারি-হা, তাই তো! একটা চিমনিই তো ঠিক তার দুরান্দের চিমনির মত।

দুরান্দ ছাড়া এই অঞ্চলের আর কোন জাহাজের এরকম চিমনি নেই। তাহলে কি আর স্থির থাকতে পারল না লেতিয়ারি, এক হাতে একটা লণ্ঠন ও অন্য হাতে ছড়িটা নিয়ে পাগলের মত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে।

হোঁচট খেতে খেতে বন্দরের দিকে ছুটল। ওখানে পৌঁছে যা দেখল, তাতে কেবল নড়াচড়াই ভুলে গেল না বৃদ্ধ, ভাষাও হারিয়ে ফেলল। নিজের চোখকেও সন্দেহ হতে লাগল তার।

জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি না তো আমি? ভাবল সে। কারণ শুধু চিমনি নয়, দুরান্দের গোটা এনজিনটাও রয়েছে ওখানে-জেটিতে বাঁধা ছোট একটা নৌকার ওপর। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে ওটার ধাতব দেহ। কয়েকবার ভাল করে চোখ রগড়ে দেখে নিয়ে নিঃসন্দেহ হলো বৃদ্ধ, না, ভুল দেখেনি সে। যা দেখছে সে, জিনিসটা আসলেই তাই।

এবার নৌকাটাকে দেখল সে। বুঝল, এরকম নৌকা একটাই আছে গেরানসিতে। এবং আর সবার মত ওটার মালিকও তার খুবই চেনা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গিলিয়াতকে খুঁজল সে, কিন্তু কোথাও নেই সে। বন্দর-জেটি সব খা খা করছে।

ওকে খোঁজার ধৈর্য হারিয়ে ফেলল বৃদ্ধ, বাতের ব্যথা ভুলে বাচ্চা ছেলের মত লাফাতে লাফাতে নৌকায় গিয়ে উঠল হাতের লণ্ঠন নাচাতে নাচাতে।

মহাব্যস্ত হয়ে এনজিন পরীক্ষা করতে লাগল। আনন্দে, উত্তেজনায় সারাদেহ কাঁপছে থর থর করে, ফোপাচ্ছে। ঠিকই আছে এনজিনটা, পরীক্ষা শেষ করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল লেতিয়ারি, কোন ক্ষতি হয়নি। প্রতিটা ক্রু পর্যন্ত আগের মতই আছে। তাহলে আর চিন্তা কি? অপ্রকৃতিত্নে মত হেসে উঠল লেতিয়ারি। এনজিনের যখন কিছুই হয়নি, তাহলে আর ভয় কিসের?

শুধু একটা খোল তৈরি করিয়ে নিলেই তো তার নতুন আরেকটা জাহাজ হয়ে গেল! আবার নতুন করে জাহাজ ব্যবসা শুরু করতে পারবে সে। আবার আগের মত।

 ঘুমে বিভোর বন্দর কাঁপিয়ে পাগলের মত হা হা করে হেসে উঠল লেতিয়ারি। নিস্তব্ধ রাত চমকে উঠল সে শব্দে। দীর্ঘসময় ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াল তার অট্টহাসি, তারপর ক্রমান্বয়ে দূর থেকে বহুদূরে মিলিয়ে গেল।

কে কোথায় আছ! চিৎকার করে উঠল সে, ছুটে গিয়ে জেটির ঘণ্টীর শেকল ধরে টানতে শুরু করল। বিকট ঢং! ঢং! ঢং! ঢং! শব্দে আবার কেঁপে উঠল স্যামসন। থামার নাম নেই লেতিয়ারির, ঘণ্টী বাজিয়ে চলেছে একনাগাড়ে। তার ইচ্ছে, ঘুম ভেঙে যাক গ্রামের সবার, বন্দরে ছুটে আসুক তারা।

এসে দেখুক, লেতিয়ারির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খুশিতে পাগল হয়ে গেছে সে।

চোদ্দ

মাঝরাতের খানিক পর বন্দরে এসে পৌঁছল গিলিয়াত। গোটা গ্রাম চাঁদের আলো মেখে হাসছে তখন। চারদিক নীরব, নিঝুম। কোথাও কেউ জেগে আছে বলে মনে হয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। জেটির যেখানটায় দুরান্দ বাঁধা থাকত, সেখানে নৌকাটা শেকল দিয়ে কষে বাঁধল গিলিয়াত।

তীরে নেমে এসে ভাবল, এতরাতে কাউকে ডাকাডাকি করে কাজ নেই। নৌকা থাকুক এখানে, সকালে এসে যা করার করা যাবে। গ্রামমুখী রাস্তাটা ধরে ধীরপায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চলল গিলিয়াত। লেতিয়ারির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কৌতূহল বশে বাগানের দেয়ালের কাছে দাঁড়াল।

এতরাতে দেরুশেতকে বাগানে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, তবু যদি পাওয়া যায়, এই ভেবে আইভি লতায় ছাওয়া নিজের বিশেষ জায়গাটায় এসে দাঁড়াল ও। জায়গাটা পথের বাঁকের মুখে। এবং নির্জন। তার ওপর লতায় লতায় ছাওয়া। বলে এখানে দাঁড়ালে সহজে কারও দেখে ফেলারও উপায় নেই। সেখান থেকে ভেতরে তাকাল গিলিয়াত।

কে যেন বসে আছে না বাগানের বেঞ্চটায়, একা? হ্যাঁ, তাইতো! বেঞ্চটার কাছেই বড় একটা গাছ আছে, চাঁদের আলো আড়াল করে রেখেছে বলে পরিষ্কার দেখা না গেলেও ওটা যে মানুষের কাঠামো, তা ঠিকই বোঝা যায়।

ওটা দেরুশেত না আর কেউ, তখনই বুঝে উঠতে পারল না গিলিয়াত। অবশ্য একটু পর বুঝল আর কেউ নয়, ওটা দেরুশেতই। চুপচাপ বসে আছে, ডান হাতের ওপরে গাল রেখে বিভোর হয়ে কি যেন ভাবছে। সব ভুলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকল গিলিয়াত।

হঠাৎ কাছেই কোথাও একটা আওয়াজ উঠতে দেরুশেত ও গিলিয়াত একযোগে চমকে উঠল। নজর যোরতে একটা ছায়া চোখে পড়ল গিলিয়াতের-বাগানের মধ্যে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেঞ্চটার দিকে এগোচ্ছে।

একজন পুরুষ মানুষ!

লেতিয়ারি নয়, দেখামাত্র বুঝে ফেলেছে গিলিয়াত, এ অন্য কেউ। কিন্তু কে? বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলল ওর। এত রাতে নির্জন বাগানে কে এসেছে তার দেরুশেতের সাথে দেখা করতে?

গিলিয়াতের বিস্মিত চোখের সামনে চট করে ওর পাশে বসে পড়ল লোকটা। মেয়েটি এক পলক তাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল, মনে হলো আবার নিজের ভাবনায় ডুবে গেছে। তবে স্পষ্ট বোঝা গেল লোকটি ওর অচেনা কেউ নয়। আর তার এই নিশি অভিসারও ওর কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়।

মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করল ও, কিন্তু গাছের ছায়ার জন্যে পারল না। তাছাড়া নতুন করে একটু একটু মেঘও জমতে শুরু করেছে আকাশে, বারবার চাঁদের সামনে আড়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খণ্ড খণ্ড মেঘ।

একটু পর আগন্তুকের গলা শুনতে পেল গিলিয়াত। আবেগ মাখা গলায় বলল লোকটা, দেরুশেত, সারা স্যামসনে এখন তোমার-আমার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। লোকে বলে, আগে নাকি কখনও এই সময় তুমি একা একা বাগানে বসে থাকতে না। আমি এতদিন ধরে রোজ তোমার কাছে আসছি, কিন্তু আমার মনের কথা খুলে বলার মত সাহস পাইনি কোনদিন।

কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বোঝ সেটা কি। কাল সকালে আমি লন্ডনে চলে যাচ্ছি। দুই-একদিনের জন্যে হলেও যেতেই হবে। তাই আজ বিশেষ করে তোমার কাছে এসেছি।

একটু থামল লোকটা। তারপর আবার বলতে শুরু করল, এতদিন আমি গরীব ছিলাম, তাই নিজেকে তোমার উপযুক্ত ভাবতে পারিনি।

কিন্তু আজ আর গরীব নই আমি, মামা মারা যাওয়ায় তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছি।. অনেক ধনী আজ আমি। তাই যাওয়ার আগে আরেকবার বলতে এসেছি, আমি তোমাকে ভালবাসি, দেরুশেত।

আমি জানতে চাই, তুমিও আমাকে ভালবাসো কিনা? তুমি ছাড়া আর কোন মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারি না আমি। তুমি আমার জীবন-মরণ, তুমিই আমার সব। বলল, দেরুশেত, যে তোমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, তুমি তাকে ভালবাসো কিনা?

মাথা নিচু করে বসে ছিল দেরুশেত, তেমনিই থাকল। মৃদু স্বরে কেবল বলল, কিন্তু আমি যে মনে মনে নিজেকে তার পায়ে সঁপে দিয়েছি।

কথা কটা এতই মৃদু স্বরে বলল ও যে পাশে বসা প্রেম নিবেদনকারীটি পর্যন্ত শুনতে পেল না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কয়েক হাত দূরে থেকেও গিলিয়াত প্রতিটা শব্দ একদম স্পষ্ট শুনতে পেল।

চুপ করে রইলে যে, দেরুশেত? পুরুষটি বলল। আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না?

কি উত্তর দেব, বলো? তেমনি মৃদু গলায় বলল ও।

আমি তোমার পরিষ্কার জবাব চাই, দেরুশেত!

ঈশ্বর শুনেছেন আমার উত্তর, দেরুশেত বলল। আমাকে আর জিজ্ঞেস কোরো না।

একটু পর মেঘ সরে যেতে বাগানের রাস্তার ওপর দুটো ছায়া পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল গিলিয়াত, বোকার মত অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেদিকে। তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মাথা ঘুরছে ওর, পা টলছে। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে।

এমন সময় দূর থেকে লেতিয়ারিকে চিৎকার করে উঠতে শুনল ও, কে কোথায় আছ! পরক্ষণে ঢং! ঢং! ঢং ঢং করে জেটির ঘণ্টী বাজতে শুরু করল। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার কিছু সময় বাগানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল গিলিয়াত। তারপর রিক্ত, পরাজিতের মত মাথা নিচু করে পায়ে পায়ে বন্দরের দিকে ফিরে চলল।

একটু পর ঘন্টা বাজানো থামিয়ে জেটি থেকে নেমে এল লেতিয়ারি, সামনে তাকিয়ে দেখল কে যেন তার দিকে আসছে। একটু কাছে আসতে চিনল তাকে বৃদ্ধ, ওটা গিলিয়াত। ছড়ি, লণ্ঠন ফেলে পাগলের মত ছুটে গেল লেতিয়ারি। ওকে দুহাতে বুকে জাপটে ধরল। অন্তরের সমস্ত কৃতজ্ঞতা উজাড় করে অনেক কিছুই বলতে চাইল বৃদ্ধ, কিন্তু প্রচণ্ড আবেগে গলা বুজে গেল, কিছুই বলা হলো না।

গিলিয়াতের মুখের দিকে চেয়ে থাকল কেবল। একটুপর হুঁশ হতে টানতে টানতে ওকে বাড়ির দিকে নিয়ে চলল। বৈঠকখানায় ওকে জোর করে সোফায় বসিয়ে নিজে বসল একটা চেয়ারে! এতক্ষণে যেন ভাষা খুঁজে পেল বৃদ্ধ।

কান্নাভেজা আবেগ মাখা কণ্ঠ বলতে লাগল, গিলিয়াত! গিলিয়াত!! জানো, বাবা! আমার মন বলত এ কাজ যদি কাউকে দিয়ে কোনদিন সম্ভব হয়, তাহলে কেবল তোমাকে দিয়েই হবে। আর কাউকে দিয়ে না, বাবা। তুমি ডোভার চলে যাওয়ার পর সবাই বলাবলি করত, গিলিয়াত একটা ছন্নছাড়া, ভবঘুরে। কাজ নেই কাম নেই সারাদিন বাঁশি বাজিয়ে আর টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, ওই ছোকরা যাবে দুরান্দের এনজিন উদ্ধার করতে? তাহলে আর চিন্তা ছিল কি?

কিন্তু আমি জানতাম, বাবা। আমি জানতাম। আমার মন বলত তুমি পারবে, কিন্তু, তারপরও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হতে চাইত না। ওই ছোট নৌকাটা নিয়ে যেদিন তুমি ডোভার যাবে বলে চলে গেলে, আর সবার মত আমারও বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না তুমি সত্যিই সেখানে যাচ্ছ। লোকে বলত, লক্ষ্মীছাড়া ভঘুরে ডোভার গেছে! দেখোগে আর কোথাও হাওয়া খেতে গেছে। কথায় পেয়েছে যেন বৃদ্ধকে, একনাগাড়ে বলেই চলেছে সে। তারপর এক মাসের মত হয়ে গেল তোমার খবর পাইনি। তাই আমিও আশা-ভরসা ছেড়েই দিয়েছিলাম, বাবা।

প্রচণ্ড আবেগে গলা বুজে এল তার। একটু পর সামলে নিয়ে আবার শুরু করল, গিলিয়াত! গিলিয়াত!! সত্যিই তুমি। ডোভারে গিয়েছিলে, বাবা? এতবড় এক দুঃসাধ্য কাজ একা কিভাবে সম্ভব করলে তুমি? এতক্ষণ জেটিতে এনজিনটা পরীক্ষা করছিলাম আমি, কিছুই হয়নি ওটার। একদম আগের মত আছে। একটা স্কুও নষ্ট হয়নি। সেই বয়লার, সেই চিমনি, সেই এনজিন, সবকিছু অবিকল আগের মতই আছে।

থামল বৃদ্ধ, চকচকে চোখে সামনে বসা যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকল ও কিছু বলবে ভেবে। কিন্তু গিলিয়াত কিছু বলছে না, একদম চুপ করে বসে আছে।

মাথা নাড়ল লেতিয়ারি। তারপর যেন এইমাত্র মনে পড়েছে, এমনভাবে আবার শুরু করল, ও হ্যাঁ। দুরান্দের দুর্ঘটনা যে ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছে, সে কথা শুনেছ তো? এর সবটাই আসলে বিশ্বাসঘাতক ক্লুবিনের ষড়যন্ত্র, বুঝলে?

যাত্রা করার আগের রাতে ক্লুবিন কায়দা করে এক নাবিককে মদ খাইয়ে পুরো মাতাল করে নিয়েছিল, জানো? পরদিন তাকেই জাহাজের হাল ধরার দায়িত্ব দেয় ও। যাকগে। সে অনেক কথা, পরে সব বলব তোমাকে।

সশব্দে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল বৃদ্ধ। যাক, এনজিনটাই যখন ফিরে পেলাম, আর ভয় কি? এবার ডানযিগ থেকে ভাল কাঠ আনিয়ে নতুন করে আবার জাহাজ তৈরি করাব আমি। দুরান্দের চেয়ে আরও বিশ ফুট বড় হবে এবারেরটা।

তারপর আবার আমার জাহাজ সাগরে ভাসবে, তুমি হবে তার নতুন ক্যাপ্টেন। হ্যাঁ, গিলিয়াত। তুমিই হবে আমার নতুন জাহাজের ক্যাপ্টেন।

তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না আমি। আহা! আজ যদি আমার সেই পঁচাত্তর হাজার ফ্রা থাকত, এখনই কাজে লেগে পড়তাম আমি। ক্লুবিন যে ফেরার, সে কথা জানো? শয়তানটার কোন খোঁজ নেই। রাতাগ আমাকে চিঠি লিখেছে, জানো? ওর কাছ থেকে আমার নাম করে মোট পঁচাত্তর হাজার ফ্রা নিয়ে পালিয়ে গেছে হারামজাদা।

এতক্ষণ অন্য জগতে ছিল গিলিয়াত, কোন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল, তেতিয়ারির শেষ কথাগুলো কানে যেতে নড়ে উঠল। নীরবে পকেট থেকে ক্লুবিনের সেই বেল্টটা বের করল, লোহার মানিব্যাগ থেকে নোটগুলো বের করে বৃদ্ধের সামনের টেবিলে বিছিয়ে রাখল। টাকার পাশে ব্যাগটাও।

অনেকক্ষণ ধরে বিস্ফারিত দুচোখ মেলে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল বৃদ্ধ। চরম বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, চোয়াল ঝুলে পড়েছে তার। এসব কি সত্যি! এনজিন, টাকা, সবই ফেরত পেয়েছে সে?

কিছুই তাহলে খোয়া যায়নি? টাকাগুলো ধরে দেখল লেতিয়ারি। সত্যিই তো! এই তো সেই পনেরো হাজার ফ্রাঁর পাঁচটা নোট-চিঠিতে রাতাগ যেগুলোর কথা লিখেছিল! অর্থাৎ গ্রামের মানুষের ধারণা মিথ্যে ছিল না!

আমার টাকাগুলোও উদ্ধার করে এনেছ তুমি? গলা ভেঙে গেল বৃদ্ধের। কৃতজ্ঞতার পানিতে চোখ ভিজে উঠেছে। গলা কিছুতেই বাগে রাখতে পারছে না সে, কাঁপছে।

তুমি কি মানুষ, গিলিয়াত? যে ডোভারে যাওয়ার কথা মানুষ ভাবতেও ভয় পায়, সেখানে একা গিয়ে আমার দুরান্দের এতবড় এনজিনটাকে নিয়ে এসেছ! তার ওপর আবার টাকাগুলোও? বাবা, সত্তর বছরের জীবনের প্রায় ষাট বছরই সাগরে ঘুরে কেটেছে আমার, কিন্তু এমন ঘটনা আজই প্রথম দেখলাম।

পরের টাকা হাতে পড়লে তা কেউ ফেরত দেয়, সে অভিজ্ঞতাও জীবনে এই প্রথম আমার। গিলিয়াত, তোমার শরীর কি রক্ত-মাংসের না, বাবা? তুমি কি এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় হওনি? টাকার লোভ বলে কিছুই কি নেই তোমার মধ্যে?

চোখ নামিয়ে ক্লুবিনের নাম লেখা বেল্ট ও মানিব্যাগটা দেখল লেতিয়ারি। মাথা দোলাল। বুঝতে পেরেছি। এর অর্থ হচ্ছে দুরান্দকে ডোবাতে গিয়ে ওই হারামজাদা নিজেও মরেছে! তাই না, গিলিয়াত?

ও আগের মতই চুপ করে বসে আছে। একটা কথাও বলেনি এ পর্যন্ত। ক্লান্ত দুচোখ স্থির, কিন্তু জাগতিক কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। কোনও সুদূরের অজানালোকের পানে তাকিয়ে আছে যেন। লেতিয়ারির সেদিকে খেয়ালই নেই, সে আপনমনে নিজের কথাই শুধু বলে চলেছে।

দেখো, বাবা, সত্যি কথাটা স্বীকার করার এখনই উপযুক্ত সময়। স্বীকার না করলে মহাপাপ হবে আমার। তুমি যে সত্যি সত্যিই ডোভারে গিয়েছিলে, অন্যদের মত আমিও কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করিনি।

ভেবেছিলাম তোমার ভবঘুরে স্বভাব, হয়ত কদিন কাটিয়ে আসতে আর কোথাও গিয়েছ। এক মুহূর্তের জন্যে থামল বৃদ্ধ। গিলিয়াত, তুমি আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও, বাবা। এতদিনেও আমরা কেউই আসলে তোমাকে চিনতে পারিনি, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল সে।

এবার তুমি আমার দেরুশেতকে বিয়ে করো। জীবনের শেষ কটা দিন তোমাদের দুজনকে নিয়ে একসাথে কাটাতে চাই আমি। একটু শান্তিতে থাকতে চাই।

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল গিলিয়াত, দুর্বল পা দুটো দেহের ভার সইতে পারছে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল ও, না, ঘঁশিয়ে, তা হয় না।

চমকে উঠল বৃদ্ধ মুখ তুলে বোকার মত তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। কি হয় না, বাবা?

আমি দেরুশেতকে বিয়ে করতে পারবো না।

কেন, বাবা? ভীষণ অবাক হলো বৃদ্ধ। হঠাৎ এ কথা কেন? আমার দেরুশেত কি কোনদিক থেকে তোমার অযোগ্য?

না, মঁশিয়ে।

তাহলে?

আমি আমি, মানে, দেরুশেতকে ভালবাসি না, মঁশিয়ে। তাই…

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বিস্মিত লেতিয়ারি। দুহাত প্যান্টের পকেটে ভরে কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে, তারপর আচমকা হা হা করে হেসে উঠল। হাসির দমকে বৃদ্ধের শীর্ণ দেহ বারবার বাঁকা হয়ে উঠতে লাগল। কি বললে? অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল বৃদ্ধ। কি বললে তুমি, গিলিয়াত? আমার দেরুশেতকে তুমি ভালবাসো না? গিলিয়াত, এতবড় একটা মিথ্যে কথা তুমি আমার সামনে বলতে পারলে?

এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলল তুমি? দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে এই মাথার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাঁপটা গেছে, বাবা! জীবনে হাজারো ঘটনা দেখেছে এই দুই বুড়ো চোখ। তুমি এই চোখকে আজ ফাঁকি দিতে চাইছ?।

গভীর রাতে বহুদিন তোমার বাড়ির দিক থেকে বাঁশির করুণ সুর ভেসে আসতে শুনেছি আমি। কাকে শোনাবার জন্যে তুমি ওভাবে বাঁশি বাজাতে, আমি বুঝি না? কাকে আপন করে পেতে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তুমি ডোভারের মত– ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জায়গায় গিয়েছিলে, পুরো একটা মাস ঝড়-তুফান আর খিদে-তেষ্টার অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করে এনজিনটা নিয়ে এলে, আমি তা বুঝি না ভেবেছ? এত কষ্ট করেছ তুমি কেবল এই বুড়োকে খুশি করার জন্যে?

আর কারও জন্যে নয়? স্বর্গের দেবতারা সবাই নেমে এলেও যে কাজ করতে পারত না, সেই অসম্ভব কাজ তুমি একা সম্ভব করেছ শুধু আমার দিকে চেয়ে?

মাথা নাড়ল বৃদ্ধ। দেরুশেতকে ভালবাসো না, এমন ডাহা মিথ্যে কথাটা কি করে বললে তুমি? আমাকে এ কথাও বিশ্বাস করতে বলো? বুড়ো হয়েছি বলে কি আমি কিছুই বুঝি না?

ওর জবাবের জন্যে একটু অপেক্ষা করল বৃদ্ধ, কিন্তু এত কথার পরও ছেলেটা নীরব, একটা কথাও বলছে না দেখে মন দমে গেল তার। সন্দেহ দেখা দিল।

তাছাড়া, বাবা! এবার অনুনয়ের সুরে বলল লেতিয়ারি,  দেরুশেত যে তোমাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে! এখন যদি তুমি বিয়ে না করো, তাহলে যে ওকে সারাজীবন কুমারী থেকে যেতে হবে! না, না, গিলিয়াত। তা হয় না, বাবা। এ কিছুতেই হতে পারে না।

তুমি দেরুশেতকে অবশ্যই বিয়ে করবে, তুমি আমার নতুন দুরান্দের ক্যাপ্টেন হবে, আমরা তিনজন মিলে আবার নতুন করে আমাদের সংসার গড়ে তুলব। তুমি এখন না বললে তো চলবে না, বাবা!

না, এ ব্যাপারে তোমার কোন আপত্তি শুনতে চাই না আমি। দাঁড়াও না, সকাল হলেই গির্জার ফাদারকে চিঠি দিচ্ছি আমি। যাতে সকালেই উনি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। নাহ্, আর দেরি করা যায় না।

আপনমনে বক বক করে চলেছে লেতিয়ারি, টেরও পায়নি কখন চলে গেছে গিলিয়াত। বাইরে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল ও, যেন ভেবে পাচ্ছে না কোনদিকে যাবে।

চাঁদ ডুবে যেতে বসেছে, হলদেটে হয়ে এসেছে আলো। একটু দূরে অশান্ত চ্যানেলের বড় বড় ঢেউ অবিশ্রান্তভাবে তীরে আছড়ে পড়ছে। এ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই কোথাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *