০৫. বড়দিনের দিন

পাঁচ

পথে-ঘাটে দেরুশেতের সঙ্গে অনেকবার চোখাচোখি হয়েছে গিলিয়াতের, কিন্তু কথা হয়নি কখনও। বড়দিনের দিন নির্জন পথে আবারও দুজনের দেখা হয়ে যাওয়া এবং বরফের ওপর দেরুশেতের তার নাম লিখে রাখার ব্যাপারটা একেবারে হতচকিত করে তুলল গিলিয়াতকে।

এমন কিছু ঘটতে পারে, স্যামসনের কেউ ওকে নিয়ে মাথা ঘামায়, তা কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সে। এটা যখনকার ঘটনা, দেরুশেতের বয়স তখন মোল পুরো হয়েছে।

খুব চিন্তিত মনে সেদিন বাড়ি ফিরল গিলিয়াত। ভেবে পেল না, এই কনকনে শীতের মধ্যে কি এমন জরুরি কাজে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল সে। বড়দিন বলে অন্যদের মত প্রার্থনা করতে গির্জায় যাবে বলে বেরিয়েছিল, ব্যাপারটা যদি সেরকম হত, কোন কথা ছিল না।

কিন্তু সে জন্যে তো বেরোয়নি সে, তাহলে কেন বেবিয়েছিল? কি কাজে? দিনটা আকাশ-পাতাল ভেবে পার করল গিলিয়াত। রাতে ঘুমাতে গিয়ে আবিষ্কার করল, ঘুম তার চোখের ত্রিসীমানার ধারও ঘেঁষছে না। রাজ্যের যত আবোল তাবোল চিন্তা জুড়ে বসে আছে মাথার মধ্যে। মায়ের কথা মনে পড়ল ওর, ঘরের কোণে রাখা সেই বাক্সটার কথা মনে পড়ল। আরও কত-শত ভাবনা আলোড়িত করল রাতভর, তার ইয়ত্তা নেই। পরদিন যখন ওর ঘুম ভাঙল, তখন কড়া রোদে ঘর ভরে গেছে।

***

কয়েকদিন পরের কথা। দেরুশেত ওর রুমে বসে পিয়ানোয় কি এক মিষ্টি সুর বাজাচ্ছে, এই সময় বাগানের দেয়ালের ওপাশের রাস্তা ধরে কোথাও যাচ্ছিল গিলিয়াত।

সুরটা কানে যেতেই সচেতন হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। বাগানের নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে চোরা চোখে দেরুশেতকে খুঁজল সে, কিন্তু মেয়েটির দেখা পেল না।

ওইদিন থেকে কেমন এক নেশায় পেয়ে বসল যেন যুবককে। যখন,তখন ওদের বাড়ির পশ্চিম দেয়াল ঘেঁষে অযত্নে বেড়ে ওঠা বড় এক ঝোঁপের আড়ালে এসে দাঁড়াত। দেরুশেতের দেখা পাওয়ার আশায় অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

একটুও ক্লান্তি অনুভব হত না গিলিয়াতের। ভাগ্য ভাল থাকলে মেয়েটিকে কোনদিন বাগানে ফুল তুলতে দেখতে পেত, অথবা আড়াল থেকে ভেসে আসা ওর মিষ্টি গলার গান শুনতে পেত। কোনও কোনও দিন আবার কিছুই ঘটত না, হতাশ মনে বাড়ি ফিরে যেত সে। ও বাড়ির বাগানে বড় একটা বেঞ্চ পাতা আছে, রোজ সন্ধের পর দেরুশেতকে নিয়ে সেটায় বসত বৃদ্ধ।

বিশ্রাম নিত, শরীর-মন ভাল থাকলে আদরের ভাইঝিকে নিজের জীবনের সগ্রাম আর সুখ-দুঃখের কাহিনী শোনাত সে লম্বা সময় ধরে। গল্পে গল্পে রাত কখন গম্ভীর হয়ে এসেছে, হুঁশ থাকত না তাদের কারও।

কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না যে আরও একজন শ্রোতা আশেপাশেই আছে। লেতিয়ারির জীবন যুদ্ধের গল্প সে-ও শুনছে মুগ্ধ হয়ে।

এক রাতে শুতে যাচ্ছে দেরুশেত, এমন সময় দূর থেকে বাঁশির মন পাগল করা মিষ্টি সুর ভেসে আসতে শুনে কান খাড়া হয়ে উঠল ওর। আওয়াজটা গিলিয়াতের বাড়ির দিক থেকে আসছে না?

অবাক হলো দেরুশেত। কে এই জাদুকর যে বাঁশিতে এমন হৃদয় নিংড়ানো সুর তুলতে পারে?

আশ্চর্য! পিয়ানোয় ও নিজে সাধারণত যে সুর তুলে থাকে, সেই সুরই তো! ভাবতে ভাবতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কিছুই দেখার উপায় নেই। তন্ময় হয়ে বাঁশির সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল ও।

সেদিনের পর থেকে প্রায় রাতেই নিয়মিত শোনা যেতে লাগল সেই বাঁশি, বিশেষ করে অন্ধকার রাতে। কে বাজাত, জানে না দেরুশেত।

অচেনা, খেয়ালী বাদকের সেই মায়াবী, মিষ্টি সুর অন্ধকার রাতের বুকে কাঁপন ধরিয়ে একসময় ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যেত। আর কারও প্রাণে তা কোনরকম দোলা জাগাতে পারত কি না কে জানে! এভাবেই দেখতে দেখতে চার বছর পার হয়ে গেল। চার বছর একেবারে কম সময় নয়! দেরুশেত কুড়িতে পা দিয়েছে, অথচ এতদিনেও ওর সাথে গিলিয়াতের একটা বাক্য বিনিময় পর্যন্ত হয়নি। ওকে নিয়ে দিনরাত কেবল কনার জাল বুনে চলেছে যুবক।

এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। গ্রামের সেইন্ট পিটার গির্জায় এক নতুন রেভারেন্ড এসেছে। বয়স অল্প, প্রায় গিলিয়াতের বয়সী। নাম কড্রে। আর্থিক অবস্থা তেমন সচ্ছল নয় তার, তবে শিক্ষা-দীক্ষা ভালই আছে।

গেরানসির সবাই জানল, লন্ডনে তার এক মামা আছে। ভদ্রলোক খুব ধনী। ছেলে-মেয়ে বা আর কোন ওয়ারিশ নেই সে মামার, ভাগ্নে কড্রেই তার সমস্ত সহায়-সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। কাজেই মামার মৃত্যুর পর সে যে ধনী হয়ে যাবে, সে ব্যাপারে প্রত্যেকে নিশ্চিত। যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছিলাম, তা এই রেভারেন্ডকে নিয়েই।

তার সেইন্ট পিটার গির্জার কাজে যোগ দেয়ার একদিন কি দুদিন পর গিলিয়াত ওর খুদে নৌকাটা নিয়ে সাগরে বেরিয়েছিল মাছ ধরতে। সারাদিন মাছ ধরে সন্ধের আগে আগে দ্বীপে ফিরে যাচ্ছে ও।

মহিষ পাহাড়ের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ মনে হলো ওটার সিংহাসনের ওপর আবছামত একটা ছায়া যেন দেখা যাচ্ছে! এখন জোয়ারের সময়। গিলিয়াত ভাল করেই জানে এ সময় ওখানে থাকার মত দুঃসাহস এ তল্লাটের কারও থাকতেই পারে না। ওদিকে পানি বেড়ে ওঠায় মহিষ পাহাড়ে যাওয়ার সরু পথটাও ততক্ষণে তলিয়ে গেছে।

কাজেই কোন জীব-জন্ত্ররও ওখানে থাকার সম্ভাবনা নেই এখন। এরকম বিপজ্জনক মুহূর্তের সময় তারাও ওই টিলার ধারেকাছে ঘেঁষে না। কিন্তু কেউ যে মহিষ পাহাড়ে আছে, তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না গিলিয়াতের।

দেরি না করে নৌকার গলুই সেদিকে ঘুরিয়ে দিল ও। কাছে গিয়ে দেখল সন্দেহ মিথ্যে নয়, সত্যিই কেউ একজন আছে। সিংহাসনে শুয়ে আছে। নড়াচড়া নেই, একদম নিথর।

এদিকে জোয়ারের পানি ততক্ষণে আরও ফুলে-ফেঁপে উঠে মহিষ পাহাড়কে উপকূল থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা টিলাটাই সম্পূর্ণ তলিয়ে যাবে সাগরে।

মানুষটা যে-ই হোক, ওরকম অনড় শুয়ে আছে কেন ভেবে পেল না গিলিয়াত। মরে যায়নি তো? কিন্তু দেখে সেরকম মনে হলো না ওর! বরং মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে।

নিশ্চিত হওয়া দরকার, কাজেই সময় নষ্ট না করে গায়ের জোরে নৌকা বেয়ে টিলার যতটা সম্ভব কাছে চলে এল সে, চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল লোকটাকে। কিন্তু অনেক ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া গেল না তার।

আগের মতই অসাড় পড়ে আছে। ওদিকে উন্মত্ত চ্যানেলের ভরা জোয়ারের পানি তাণ্ডব নৃত্য শুরু করে দিয়েছে মহিষ পাহাড়ের চূড়াটাকে ঘিরে। লোকটার নিরাপত্তার কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল গিলিয়াত। এরকম সময় নৌকা নিয়ে টিলার বেশি কাছে যাওয়াও বিপদ, ঢেউয়ের আঘাতে ওটার ওপর আছড়ে পড়ে চোখের পলকে চুরমার হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু না গেলেও নয়, কিছুক্ষণের মধ্যে নির্ঘাত মরবে তাহলে লোকটা। কাজেই খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও, বিপদের ভয় একপাশে সরিয়ে রেখে টিলার দিকে এগোল।

ততক্ষণে ও নিশ্চিত বুঝে ফেলেছে মানুষটা যে-ই হোক, ঘুমিয়ে আছে। তাই সাড়া দিচ্ছে না। দ্রুত আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে দেখে মহাব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত। টিলার আরও কাছে এগিয়ে গেল। অন্ধকারে লোকটাকে চিনতে না পারলেও সে যে স্থানীয়, তেমনও মনে হলো না ওর। তার পরনে পাদ্রিদের মত পোশাক। এর মধ্যে পানি মহিষ পাহাড়ের চূড়ার এতই কাছে পৌঁছে গেছে যে নৌকার ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলেই ও লোকটাকে ছুঁতে পারে।

জোয়ারের পূর্ণতা পেতে আর বেশি দেরি নেই, তাই পানির লাফ-ঝাঁপ সামান্য কমেছে বলে মনে হলেও খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারল না গিলিয়াত।

কারণ পানি বাড়লেও স্রোতের তেজ এখনও বলতে গেলে আগের মতই আছে, এই পরিস্থিতিতে সতর্ক না থাকলে বিপদ। যে কোন মুহূর্তে ওর সাধের ছোট্ট নৌকাটাকে টিলার ওপর আছড়ে ফেলে চুরমার করে দেয়ার মত যথেষ্ট ক্ষমতা এখনও রয়েছে চ্যানেলের।

তাই আরও সাবধানে এগোল গিলিয়াত, নৌকাটাকে বহুকষ্টে কোনমতে টিলার কয়েক হাতের মধ্যে নিয়ে এল। তারপর ওটাকে আড়াআড়িভাবে রেখে এক পা নৌকায়, আরেক পা টিলার সাথে ঠেকিয়ে দাঁড়াল সে। নৌকা যাতে এ্যানিটের দেয়ালে বাড়ি না খায়, সেদিকে কড়া নজর।

সামলে নিয়ে ঘুমন্ত লোকটার পা ধরে টান দিল গিলিয়াত। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে উঠে বসল সে, পরমুহূর্তে নিজের চারদিকে পানির অস্বাভাবিক বিস্তার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল একেবারে।

এই যে, মঁশিয়ে! গলা চড়িয়ে ডাকল ও। কে আপনি? এই অসময়ে এখানে কি করছেন?

ভয়ে বিস্ফারিত চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল লোকটা, ওর প্রশ্ন শুনে হড়বড় করে বলতে লাগল, দেখুন, মঁশিয়ে! আমি এই দ্বীপে নতুন। সব জায়গা ঠিকমত চিনি না। আজ দ্বীপটা ঘুরে দেখতে এসে এই জায়গাটা ভাল লেগে গেল বলে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছিলাম। সমুদ্রযাত্রায় খুব ক্লান্ত ছিলাম কি না, তাই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, টেরই পাইনি।

তা তো বুঝলাম, বলল গিলিয়াত। কিন্তু এটা কোন ঘুমানোর জায়গা হলো? আর কয়েক মিনিট এভাবে থাকলে যে ঘুমটা চিরস্থায়ী হয়ে যেত আপনার! জোয়ারের পানি টিলা ডুবিয়ে দিতে বসেছে দেখছেন না?

গিলিয়াতের নৌকার পাটাতনে কিছু মাছ দেখতে পেয়ে লোকটা ওকে জেলে ভেবে নিল। কিন্তু এই ভরা জোয়ারের সময় এতটুকুন এক নৌকা নিয়ে মানুষ কিভাবে বিক্ষুব্ধ সাগরে যেতে সাহস করে, ভেবে ভারী অবাক হলো সে। অথচ মাঝি লোকটা কি নির্বিকার, আমলই দিচ্ছে না ব্যাপারটাকে।

হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, বলল লোকটা। কিন্তু আপনিই বা এই অসময়ে কোত্থেকে এলেন?

সে সব পরে শুনলেও চলবে, লোকটার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল গিলিয়াত। আমার হাত ধরুন। তাড়াতাড়ি উঠে আসুন নৌকায়।

তাকে কোনমতে তুলে নিল ও, তারপর এ্যানিটের দেয়ালে বৈঠা দিয়ে জোর এক পুঁতো মেরে ওটার কাছ থেকে সরে এল, গলুই ঘুরিয়ে নীরবে উপকূলের দিকে চলতে শুরু করল। অল্প সময়ের মধ্যে লোকটাকে নিয়ে তীরে পৌঁছে একটা খুঁটির সাথে নৌকা বাঁধার জন্য উঠল গিলিয়াত।

এমন সময় চোখের কোনে একটা নড়াচড়া ধরা পড়তে ঘুরে তাকিয়ে দেখল, লোকটা তার পরনের যাজকদের মত ঢোলা, কালো পোশাকের পকেট থেকে একটা গিনি বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে আছে। হাতটা সরিয়ে দিয়ে নীরবে নৌকা বাঁধতে লাগল গিলিয়াত।

ওর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল আগম্ভক, তারপর মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল, দেখুন, মঁশিয়ে, আজ আপনি আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আপনি না থাকলে …

হতে পারে, নির্বিকার চেহারায় জবাব দিল ও।

সে জন্যে আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ, মঁশিয়ে। এতবড় একটা ঋণ শোধ করার 

ঋন? সে তো কখন শোধ হয়ে গেছে, বাধা দিয়ে বলে উঠল গিলিয়াত। অন্যমনস্ক।

কিন্তু আপনার তো অনেক কষ্ট হয়েছে! তা হয়েছে। কিন্তু নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে হলে ওটুকু যে আমাকে করতেই হতো! পাশাপাশি হেঁটে চলল গিলিয়াত ও রেভারেন্ড কড্রে, কথা নেই কারও মুখে। আগন্তকই মুখ খুলল একটু পর।

আপনি এই গ্রামের লোক? সঙ্গীকে ভাল করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল সে।

না।

তাহলে?

হাত তুলে আকাশ নির্দেশ করল গিলিয়াত। ওই যে, ওখানকার।

আর কোন প্রশ্ন করল না লোকটা, অবাক চোখে যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের পথে চলে গেল। কিন্তু কয়েক পা গিয়ে কি খেয়াল হতে ফিরে এল সে। পকেট থেকে চামড়ায় বাঁধানো একটা ছোট, সুদৃশ্য বই বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল।

এই বইটা আপনাকে উপহার দিতে চাই আমি। নিতেই হবে আপনাকে।

আপত্তি না করে হাত বাড়াল গিলিয়াত। বুঝল ওটা একটা বাইবেল। জীবন রক্ষাকারীর হাতে বইটা তুলে দিয়ে নিজের পথে চলে গেল রেভারেন্ড। আনমনে তার গমণপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ও।

ছয়

সেইন্ট ম্যালো ফ্রান্সের এক উপকূলীয় বন্দর। স্যামসন থেকে প্রতি মঙ্গলবার দুরান্দ বোঝাই করে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এখানে আসে ক্লুবিন। দুদিন থেকে বয়ে আনা মালপত্র খালাস করে, তারপর নতুন পণ্য নিয়ে শুক্রবার স্যামসনে ফিরে যায়।

সেইন্ট ম্যালো জাহাজ ঘাটের কাছেই একটা হোটেল আছে। সেটার একটা রুম লেতিয়ারির জাহাজ কোম্পানির অফিস হিসেবে ব্যবহার হয়। দুরান্দের শাখা অফিস। ক্লুবিন এলে সেই রুমেই থাকে।

হোটেলটার ডাইনিং রুমে দুটো বড় টেবিল আছে, একটা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের খাওয়া-দাওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট, অন্যটা শুল্ক বিভাগের অফিসার ও সাধারণ নাবিকদের জন্যে। সেদিন দুই টেবিলেরই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল কয়েক ঘন্টা আগে বন্দরে নোঙর করা তামোলিপা নামের এক আমেরিকান জাহাজ এবং সেটার ক্যাপ্টেন জুয়েলা।

কিছুদিন পর পর দেখা মেলে লোকটার। ব্যবসার কাজে তার জাহাজ ফ্রান্সের বিভিন্ন উপকূলীয় বন্দরে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। সেইন্ট ম্যালো বন্দরে সম্ভবত এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ক্যাপ্টেন জুয়েলাকে চেনে না।

কারও অজানা নেই অল্পদিনেই প্রচুর কাঁচা টাকা-পয়সার মালিক বনে গেছে সে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে দুনম্বরী কারবার করে। মানুষ পাচারের ধান্ধা করে থাকে ক্যাপ্টেন জুয়েলা। ক্লুবিনও চিনত জুয়েলাকে, কিন্তু কখনও আলাপ হয়নি তাদের দুজনের।

পুলিসের ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকা চরমপন্থী রাজনীতিক অথবা পাওনাদারদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানো দেউলিয়া বা পুলিসের তাড়া খাওয়া খুনী-ডাকাত, অথবা অন্য যে কোন অপরাধেই অপরাধী হোক না কেন, দেশ ছেড়ে কারও পালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তাকে সাহায্য করতে জুয়েলা সব সময় এক পায়ে খাড়া।

তামোলিপার খোলের মধ্যে পুরে তাকে সবার চোখে ধুলো দিয়ে নিরাপদে পাচার করে দেবে সে, বিনিময়ে দিতে হবে মোটা অঙ্কের টাকা। কথাবার্তা পাকা হয়ে গেলে উপকূলের নির্দিষ্ট কোন এক নির্জন, গোপন জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে হয় তাদেরকে। পরে সময়মত বন্দর ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে জাহাজের লাইফবোট পাঠিয়ে তাদেরকে তুলে নেয় জুয়েলা। কুকমটা বন্দর থেকে নিরাপদ দূরতে গিয়ে সারা হয় বলে ফরাসী কাস্টমস, উপকূল রক্ষী পুলিস বা গোয়েন্দারা হাতেনাতে ধরতে পারে না লোকটাকে।

অনেকের মতে গত সফরের সময়ও নাকি এরকম দুজনকে নিয়ে গেছে জুয়েলা। এবারও তার একই প্ল্যান আছে। বিরাট দাও মারতে যাচ্ছে এবার সে।

তবে পুলিস কি ভাবে যেন আগেভাগেই টের পেয়ে গেছে ব্যাপারটা। কড়া নজর রেখেছে তারা ক্যাপ্টেন জুয়েলার ওপর। গোয়েন্দারাও সদাসতর্ক-এবার পাকড়াও করবেই তাকে।

ওদিকে এবারের মত তামোলিপায় মালপত্র বোঝাই দেয়ার কাজ পুরোদমে চলছে, আর কদিনের মধ্যেই সেইন্ট ম্যালো ছেড়ে যাবে ওটা।

মঙ্গলবার শেষ বিকেল। আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। সূর্য ডুবতে আর বেশি দেরি নেই। এই সময় দুরান্দ এসে নাক ঢোকাল সেইন্ট ম্যালো হারবারে। ওটার ফোর ডেকে দাঁড়িয়ে আছে তখন ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, নাবিকদেরকে এটা-সেটা নির্দেশ দিচ্ছে।

ওরই মাঝে তীরের দিকে চোখ গেল তার। দেখতে পেল বন্দর থেকে বেশ খানিকটা দূরে, নির্জন সাগরতটে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক-কথা বলছে। যথেষ্ট দূরে রয়েছে বলে তাদের ঠিকমত দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু ভাবভঙ্গী দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় জরুরি কোন বিষয় নিয়েই আলোচনা চলছে লোক দুটোর মধ্যে।

সন্দেহ হলো ক্লুবিনের। এরকম অসময়ে বন্দর থেকে এত দূরে, নির্জন জায়গায় কারা ওরা? এমন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে? দূরবীন তুলে চোখে লাগাল সে, অমনি একলাফে অনেক কাছে চলে এল দৃশ্যটা।

আঁধার হয়ে এলেও প্রথম দর্শনেই দুজনের একজনকে চিনে ফেলল সে। লোকটা ক্যাপ্টেন জুয়েলা। দ্বিতীয়জনের দিকে নজর দিল কুবন, একভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মনে হল কেও যেন চেনা চেনা লাগছে।

বেশ বয়স্ক মানুষ সে, তবে যথেষ্ট শক্তপোক্ত দেহের অধিকারী। দেখলেই বোঝা যায় এই বয়সেও দেহে প্রচুর শক্তি ধরে মানুষটা।

বন্দরে নেমে প্রথমেই তামোলিপা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিল ক্লুবিন। জানা গেল আরও দশদিন থাকবে ওটা সেইন্ট ম্যালোয়, তারপর ছেড়ে যাবে।

নিয়মমাফিক পরের শুক্রবার মালপত্র নিয়ে স্যামসনে ফিরে এল দুরান্দ। মাল খালাসের কাজ শুরু হলো। একসময় রাত নামল দ্বীপে। রাত একটু গম্ভীর হতে ক্যাপ্টেন ক্লুবিন তৎপর হলো। একটা কম্পাস, একটা দূরবীন এবং সাথে কিছু বিস্কিট ইত্যাদি একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে সবার অলক্ষে জাহাজ থেকে নেমে এল সে। বন্দর এলাকা ছাড়িয়ে এসে উপকূল রেখা ধরে জোর পায়ে হেঁটে চলল অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। ঘন্টাখানেক একনাগাড়ে চলার পর উপকূলের কাছাকাছি হোট, নির্জন এক গ্রাম, প্লইমোয় এসে পৌঁছল যুবক।

খুব ছোট আর জনবিরল গ্রাম প্লইমো, স্যামসনের কয়েক মাইল দূরে। হাতে গোনা কয়েক ঘর জেলে ছাড়া আর কেউ থাকে না সেখানে। রাত নামতে না নামতেই চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে গ্রাম।

এই গ্রামের এক মাথায়, সাগরের তীরে পুরানো আমলের একটা পোড়োবাড়ি আছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে নির্ভয়ে সেই বাড়িটায় ঢুকে পড়ল ক্লুবিন, ব্যাগটা ভেতরে কোথাও রেখে একটু পরই আবার বেরিয়ে এসে ধীর গায়ে স্যামসনে ফিরে চলল। সে সময় অন্যমনস্ক লাগছিল তাকে। কোন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল হয়তো।

যে পোড়োবাড়িতে গিয়েছিল ক্লুবিন, সেটা আসলে স্থানীয় চোরাচালানীদের প্রধান আল্লখানা! এখান থেকেই পরিচালিত হয় এ অঞ্চলের যত নিষিদ্ধ ও চোরাই মালামালের আমদানী রফতানীর ব্যবসা।

বাড়িটার ছাদ থেকে তাকালে উপকূল থেকে সাগরের এক মাইল ভেতরের হ্যাঁনওয়ে পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। গোটা অঞ্চলে ভীষণ কুখ্যাতি আছে হ্যাঁনওয়ের। শোনা যায়, এমন কোন কুকর্ম নাকি নেই যা ওখানে ঘটে না।

অনেক গুহা আছে হ্যাঁনওয়েতে-জোয়ারের সময় পানির নিচে তলিয়ে যায়, ভাটার সময় আবার জেগে ওঠে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ভাল করে খুঁজে দেখলে ওইসব গুহায় মানুষের প্রচুর কঙ্কাল পাওয়া যাবে।

চ্যানেলের মাঝখানে ছোট ছোট তিনটা পাহাড় নিয়ে হ্যাঁনওয়ে। কত জাহাজ যে ওগুলোর সাথে ধাক্কা খেয়ে তলিয়ে গেছে চ্যানেলের অতল গভীরে, তার কোন লেখাজোখা নেই। হ্যানওয়ে থেকে চ্যানেল সাঁতরে তীরে পৌঁছানো একেবারে অসাধ্য না হলেও খুবই যে দুঃসাধ্য, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্লুবিনের কাছে সেটা কোন সমস্যাই নয়।

যে সমস্ত পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করার মধ্যে দিয়ে ক্লুবিন লেতিয়ারির মন জয় করতে পেরেছিল, হ্যাঁনওয়ে থেকে সাঁতরে তীরে পৌঁছানো ছিল তার একটি।

পরের মঙ্গলবার যথারীতি সেইন্ট ম্যালোয় পৌঁছল দুরান্দ। জাহাজ ভিড়িয়ে হোটেলে চলে এল ক্লুবিন, হোটেল মালিককে তামোলিপা সম্পর্কে এটা-সেটা প্রশ্ন করতে লাগল।

সে রাতে রীতিমত একটা অঘটন ঘটিয়ে বসল ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, ডিনারের পর দেখা গেল অফিসে নেই সে। হোটেলেও নেই। কোথায় গেছে, কেউ জানে না। কাউকে বলে যায়নি। এমন তো কখনও ঘটে না।

বন্দরের যে সব জায়গায় সে যায় বা যেতে পারে, সে সব জায়গা ভাল করে খুঁজে দেখা হলো, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নেই তো নেই-ই লোকটা। তার জন্যে জাহাজের মালপত্র খালাসের আগে ট্যাক্স ইত্যাদি পরিশোধ করাসহ আর যে সব নিয়ম পালন করা জরুরি, সেসবের কোনটাই সেদিন ঠিকমত পালিত হলো না।

সবাই বলাবলি করতে লাগল, ক্লুবিনের মত দায়িত্বশীল একজন ক্যাপ্টেনের এতবড় গাফিলতি চিন্তাই করা যায় না। অবশ্য রাতেই হোটেলে ফিরে এল সে।

কিন্তু অনুপস্থিতির সময়টায় কোথায় ছিল ক্লুবিন, সে ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলল না লোকটা। সম্পূর্ণ চেপে গেল। পরদিন জানা গেল, আগের রাতে সেইন্ট ম্যালোর এমন এক প্রতিষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে, যারা বিভিন্ন দেশের টাকা-পয়সা অদল বদলের ব্যবসা করে। বন্দরের একমাত্র আগ্নেয়াস্ত্রের দোকানেও নাকি গিয়েছিল সে।

***

তামোলিপার বন্দর ছাড়ার দিনকার ঘটনা।

জেটির কিছুটা দূর দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের মত দেখতে এক সারি পাথরের টিলা সোজাসুজি সাগরের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে, দূর থেকে ওগুলোকে দেখতে লাগে ঠিক একটা বর্শার মত।

সঙ্কীর্ণ একটা পাথর খণ্ড এই বর্শার সাথে তীরের সংযোগ রক্ষার কাজ করছে। বর্শার মাথা আর সব পাহাড়ের চেয়ে বেশ খানিকটা উঁচু এবং চওড়া।

সেখান থেকে আরেকটা পাথর বের হয়ে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়া হাতের মত আড়াআড়িভাবে চলে গেছে একদিকে। সব মিলিয়ে চমৎকার, মনোরম একটা পরিবেশ। কিন্তু সাগরের বেশ খানিকটা ভেতরে এবং খুব নির্জন বলে এখানে কেউ তেমন একটা আসে না।

তবে সেদিন বিকেল চারটার দিকে একজনকে দেখা গেল সেখানে। একা। বর্শার মাথায় দাঁড়িয়ে দূরবীন চোখে লাগিয়ে একভাবে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষায় আছে।

পরনে সৈনিকের পোশাক। এবং সে যে সশস্ত্র, তা-ও বুঝতে অসুবিধে হয় না। লোকটা একজন উপকূল রক্ষী। বিশেষ এক গোপন খবর পেয়ে এখানে এসেছে। এক সময় তার প্রতীক্ষার অবসান হলো। অনেক দূরে, আকাশ যেখানে সাগরের সাথে মিশেছে, সেখানে বিশাল নীল চাদরের ওপর কালো ফোঁটার মত একটা বিন্দুর দেখা পেল লোকটা। বিরক্তিকর লম্বা সময় নিয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেটা। সেইন্ট ম্যালোর দিকেই আসছে।

একটা জাহাজ! দম বন্ধ করে একভাবে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল রক্ষী লোকটা। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই।

পিছন থেকে কতবড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে, ঘুণাক্ষরেও টের পেল না লোকটা। জানতেও পারল না পাহাড়ের গা বেয়ে খুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। একভাবে সামনে তাকিয়েই থাকল। বেশ খানিকক্ষণ পর যখন বুঝল বিটা সত্যিই বড় হচ্ছে, হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।

এর কারণ আছে, তার গোপন সংবাদ ফলতে শুরু করেছে। ওটা তামোলিপা। বন্দর ছেড়ে গন্তব্যের পথে যাত্রা করেছিল ঘণ্টা দুয়েক আগে, এখন আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠল গার্ড।

ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে বিন্দুটা, এখন জাহাজটাকে বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রক্ষী। গতি কমে আসতে শুরু করেছে ওটার। কমতে কমতে এক সময় থেমেই পড়ল তামোলিপা।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল। একটা ছোট নৌকা সাগরে নামানো হলে সেটা থেকে, কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওটার যাত্রীদের চেহারা-সুরত, আচরণ খুবই সন্দেহজনক।

একটু পর জাহাজ থেকে আলাদা হয়ে এদিকেই আসতে শুরু করল ওটা। উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠল উপকূল রক্ষী লোকটা, বারবার পা বদল করতে লাগল। চোখ থেকে দূরবীন না সরিয়েই এক পা এক পা করে বর্শার একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল সে। মাত্র এক হাত সামনেই যে খাড়া তীর, নিচে উন্মত্ত সাগর, সে কথা ভুলেই গেছে বোধহয়।

পিছনের লোকটা যেন এরকম এক মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠল তার। মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েই দুজনের মাঝখানের বাকি হাত কয়েকের ব্যবধান এক লাফে পেরিয়ে এল সে, তারপর পিছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল লোকটাকে।

মরার আগে চিৎকার করারও সময় পেল না রক্ষী, খাড়া কিনারা থেকে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। শূন্যে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে অনেক নিচের সাগরে পড়েই তলিয়ে গেল সে। দূরবীনটা পড়ে থাকল জায়গায়।

এদিকে সাফল্যের বীভৎস আনন্দে বিকট হাসিতে ফেটে পড়ল হত্যাকারী। কিন্তু হাসিটা পুরো করতে পারল না সে, তার আগেই পিছনে এক জোড়া পায়ের চাপা শব্দ উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠল কে যেন, হ্যালো, রাতাগ!

চমকে উঠে ঘুরে তাকাল প্রথমজন। মাত্র কয়েক হাত পিছনে ছোটখাট এক যুবককে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে উঠল তার। এক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই আবার হেসে উঠল সে, পিস্তলধারীকে চিনতে পেরেছে।

ক্লুবিন!

চিনতে পেরেছ তাহলে?

পারিনি আবার? তিক্ত, কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বলল বয়স্ক লোকটা। খুব চিনেছি!

সাগরের দিক থেকে দ্রুত দাঁড় টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে, তীরের মাথার কাছে এসে পড়েছে নৌকা। ওটার যাত্রীদের চড়া গলার কথাবার্তার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। তাদের গলা শুনেই বোধহয় কিছুটা ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা গেল রাতাগকে।

আমার কাছে কি চাও তুমি, ক্লুবিন? বলল লোকটা।

কি চাই? বাঁকা হাসি ফুটল ক্লুবিনের মুখে। তেমন কিছু। দেহের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে চাপাল। আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল বোধহয় দশ বছর আগে, তাই না? তা আছ কেমন?

ভাল। তুমি?

আমিও ভালই আছি, কথার ফাঁকে লোকটা এক পা এগিয়ে এসেছে দেখে পিস্তল ধরা ডান হাত একটু উঁচু করল ক্লুবিন। সাবধান, রাতাগ! আমাদের মাঝের দূরত্ব যা আছে তাই থাকুক, কমাবার চেষ্টা কোরো না। সুবিধে করতে পারবে না। দেখতেই পাচ্ছে আমার পিস্তল আছে।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। চেহারার রং বদলে যেতে শুরু করেছে, পিস্তল আর যুবকের দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। কি চাও তুমি? বলল সে। বলে ফেলো, আমার একটু তাড়া আছে।

বললাম না তেমন কিছু না! তোমার সাথে একটু গল্প করতে চাই! একটু বিরতি দিল যুবক। তুমি এইমাত্র একজন উপকূল রক্ষীকে সাগরে ফেলে দিয়েছ, রাতাগ। আমার মনে হয় এতক্ষণে মরে গেছে লোকটা।

জবাব দিল না রাতাগ। বেশ কিছু সময় নীরবে তাকিয়ে থাকল ক্লুবিনের মুখের দিকে, তারপর হেসে প্রশংসার সুরে বলতে লাগল, এত বছর পর পিছন থেকে নিজের আসল নামের ডাক শুনেই আমি বুঝেছি এ তুমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। আমাকে কি করে চিনলে তুমি? সন্তর্পণে আবারও দুপা এগোল সে কথার ফাঁকে। আমি এখানে আছি, সে কথা জানলে

রাতাগ! শীতল গলায় হুমকি দিল ক্লুবিন। যেখানে ছিলে পিছিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াও, যদি বাঁচতে চাও।

দ্রুত নির্দেশটা পালন করল বৃদ্ধ। পিছিয়ে গিয়ে বোকার মত তাকিয়ে থাকল যুবকের দিকে।

শোনো, রাতাগ, দেহের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিল দুরান্দের ক্যাপ্টেন। তারপর যেন কোন তাড়া নেই, এমন ধীরস্থির, শান্ত গলায় বলল, এখান থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে, তোমার ডানদিকে আরেকজন কোস্ট গার্ড আছে। আর বন্দরের কাস্টমস কালেক্টরেটের অফিসটাও খুব বেশি দূরে নয়। ওখানে কতজন গার্ড আছে কে জানে!

আমি যদি পিস্তলের একটা ফাঁকা আওয়াজ করি, হুড়মুড় করে ছুটে আসবে সবাই। সে ক্ষেত্রে যে গার্ডটাকে এইমাত্র তুমি সাগরে ফেলে খুন করেছ, তার লাশ খুঁজে পেতে একটুও দেরি হবে না ওদের। কাজেই বুঝতেই পারছ কি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছ তুমি!

হ্যাঁ, পারছি, শুকনো মুখে মাথা ঝাঁকাল সে। বেশ, বলল কি চাও তুমি।

বলছি, মৃদু হাসি ফুটল যুবকের মুখে। বিজয়ীর হাসি। মন দিয়ে, শোনো। তোমার পরনের পাজামাটার দুটো পকেট আছে। তার একটায় আছে তোমার প্রিয় ঘড়িটা, ওটা যত্ন করে রেখো কিন্তু।

রাখব, ধন্যবাদ। আর কি?

আবার মাথা ঝাঁকাল ক্লুবিন, হাসছে। বলছি, বলছি! এত ব্যস্ত হলে কি চলে নাকি? আর তোমার দ্বিতীয় পকেটে লোহার পাতের তৈরি একটা মানিব্যাগ আছে। প্রিঙের সাহায্যে খোলে ওটা, ঠিক?

হ্যাঁ, ঠিক। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠল বৃদ্ধের।

ওটা বের করো।

কেন? ঢোক গিলল সে।

ওটা আমার চাই, তাই। দাও, এদিকে ছুঁড়ে দাও ওটা।

দেখতে দেখতে চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল লোকটার, রেগে উঠেছে। ও! এই জন্যেই তুমি এ যে দেখছি রীতিমত ডাকাতি!

তাই বুঝি? হাসল যুবক। ডাকাতি? তা বেশ তো! কোস্ট গার্ডরা বেশি দূরে নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে সেদিক দেখাল। তাহলে আর দেরি করছ কেন? ডাকো না তাদের! এসে তোমাকে ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাক।

অবস্থা বেগতিক দেখে আপোষে আসার চেষ্টা করল বৃদ্ধ। সুর নরম করে বলল, ঠিক আছে, ক্লুবিন। এসো, একটা রফা করি আমরা। আমার মানিব্যাগে যত টাকা আছে, তার অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।

উহুঁ, মাথা নাড়ল যুবক। অর্ধেকে চলবে না, পুরো টাকা চাই আমার। কারণ ওই টাকাগুলো চুরির টাকা। ওগুলোর ওপর তোমার কোন অধিকার নেই।

রেগে উঠল সে। আমি চোর! আর তুমি বুঝি খুব সাধু?

দুচোখ জ্বলে উঠল যুবকের। চড়া কণ্ঠে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি সাধু! এ অঞ্চলের যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখো, সে-ই বলবে দুরান্দের ক্যাপ্টেন ভাল মানুষ। সৎ। আর রাতাগ একটা বিশ্বাসঘাতক।

যাকগে সে সব। দশ বছর আগের এক রাতের কথা ভুলে যাওনি নিশ্চই? যে রাতে তুমি লেতিয়ারির সিন্দুক খালি করে সমস্ত টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলে! মনে পড়ে?

তোমার নিজেরও কিছু টাকা ওর মধ্যে ছিল ঠিকই, কিন্তু লেতিয়ারির ছিল পুরো পঞ্চাশ হাজার ফ্রা। দশ বছরে সেই পঞ্চাশ হাজারের সুদ আসে আরও পঁচিশ হাজার, তার মানে সব মিলিয়ে টাকাটা দাঁড়াল পঁচাত্তর হাজারে।

কাল রাতে তুমি যখন বন্দরের টাকা বদলকারীর অফিসে গিয়েছিলে, তখন সেখানে তোমার চেনা এক লোকও ছিল। তাড়াহুড়োয় খেয়াল করোনি তুমি। যা হোক, যখন তুমি ওই অফিস থেকে টাকা বদল করে বেরিয়ে এলে, তখন তোমার ব্যাগে পনেরো হাজারের পাঁচটা নোটে পঁচাত্তর হাজারসহ আরও কিছু খুচরো ঐ ছিল। কাল বোধহয় খুব বেশি তাড়া ছিল তোমার, তাই না, রাতাগ?

তাই কেউ একজন যে অন্ধকারে তোমাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করেছে, খেয়ালই করোনি। অবশ্য তোমার তাড়া থাকারই কথা।

তামোলিপার বন্দর ছেড়ে যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক, তোমাকে সেটায় যে করে তোক উঠতেই হবে। কাজেই আমি অন্তত এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখি না।

একটু থামল ক্লুবিন, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রাতাগের দিকে। মনে মনে ওজন করছে লোকটাকে। রাতাগও দেখছে। তাকে। চেহারায় পরাজয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট।

কয়েকদিন আগে সী-বীচে ক্যাপ্টেন জুয়েলার সাথে আলাপ করছিলে তুমি, আবার বলতে শুরু করল ক্লুবিন। নিশ্চই পালাবার ফন্দি-ফিকির পাকা করছিলে? দেখো, সে খবরও কিছু অজানা নেই আমার। তার সাথে তোমার যে একটা গোপন চুক্তি হয়েছে, তাও জানা আছে। কি বলো, অবাক হলে?

সাগরের দিক নির্দেশ করল ক্লুবিন। ওই তো তোমার সাধের তামোলিপা দাঁড়িয়ে আছে, মাস্তুল দেখা যাচ্ছে ওটার। তোমার জিনিসপত্র তো আগেই ভোলা হয়ে গেছে ওটায়, তাই না? চুক্তি অনুযায়ী নৌকা নিয়ে জুয়েলার লোকজনও তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।

মাথা নাড়ল সে। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য যে তুমি যেতে পারছ না। যতক্ষণ না আমি তোমাকে যেতে দিচ্ছি। এতক্ষণে তা নিশ্চই বুঝে ফেলেছ! কি বলল, পারছ না?

হাসল ক্লুবিন। মনে তো হয় পারছ। তা তোমাকে ছেড়ে দিতে আমার কোন আপত্তি নেই, রাতাগ। কিন্তু যদি যেতে চাও, তাহলে যা বলি তাই করতে হবে তোমাকে। লেতিয়ারির খোয়া যাওয়া টাকার খোঁজ এত বছর যখন পেলামই, তখন তার কর্মচারী হিসেবে ওগুলো উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব।

দাও, দিয়ে দাও টাকাটা। মানিব্যাগ পকেট থেকে বের করে ছুঁড়ে দাও এদিকে। কিন্তু খবরদার! কোনরকম চালাকি করতে যেয়ো না যেন। চালাকি করে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে তুমি।

যুবকের নির্দেশ পালন করা ছাড়া কিছু করার উপায় নেই দেখে কিছুক্ষণ অসহায় রাগে ফুঁসল রাতাগ। ভারী মানিব্যাগটা বের করে হতাশ চেহারায় উল্টে-পাল্টে দেখল কিছু সময়, তারপর ছুঁড়ে দিল সেটা।

ক্লুবিনের পায়ের কাছে এসে পড়ল মানিব্যাগ। পিস্তল ধরা হাত এবং নজর লক্ষ্যে স্থির রেখে একটু ঝুঁকে অন্য হাতে ওটা তুলে নিয়ে মৃদু হাসল।

ধন্যবাদ। আরেকটু কষ্ট করো, পিছন ফিরে দাঁড়াও। টাকা হারানোর শোকে কাতর হলেও দেরি না করে সুবোধ বালকের মত তার নির্দেশটা পালন করল রাতাগ, গ্রচণ্ড ক্ষোভে চোখমুখ বিকৃত ঘুরে দাঁড়াল। এই ফাঁকে প্রিঙে চাপ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগটা খুলল ক্লুবিন, ভেতরে চোখ বুলিয়ে সম্ভষ্ট হয়ে মাথা দোলাল। আছে টাকাগুলো।

লেতিয়ারির পঁচাত্তর হাজার তো আছেই, বরং আরও কিছু বেশিই আছে। প্রতিটা পনেরো হাজার মূল্যমানের মোট পাঁচটা নোট রেখে বাকি টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করল ক্লুবিন, বন্ধ করল ওটা।

ঠিক আছে, রাতাগ। এবার এদিকে ফিরে দাঁড়াতে পারো। লোকটা ঘুরে দাঁড়াতে আবার বলল, তোমাকে আগেই বলেছি আমি কেবল লেতিয়ারির প্রাপ্য পঁচাত্তর হাজার স্ট্রা চাই। তার এক পয়সাও বেশি চাই না। এই নাও বাকিটা।

পায়ের কাছে পড়ে থাকা এক খণ্ড পাতলা টিন দিয়ে নোটগুলো মুড়ে রাতাগের দিকে ছুঁড়ে মারল সে। গড়িয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে গিয়ে থামল দলাটা। নিরাসক্ত চোখে সেদিকে একপলক তাকাল বৃদ্ধ, তারপর এক লাথিতে সাগরে ফেলে দিল সব টাকা।

যাক, তোমার টাকা-পয়সার বিশেষ প্রয়োজন নেই দেখে খুশি হলাম, ক্লুবিন বলল। বোঝা যাচ্ছে নিজের অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটিয়েছ তুমি এই কবছরে, কি বলল? তবে আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি।

তোমার ভাগ থেকে এক ফ্রা-ও নিইনি আমি। এবার যাও তাহলে, রাতাগ। তামোলিপার ক্রুদের কথা শোনা যাচ্ছে, ওরা তোমার দেরি দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে মনে হয়। যাও, রাতাগ। বিদায়।

শেষবারের মত কিছুক্ষণ আগুনঝরা চোখে ক্লুবিনের দিকে তাকিয়ে থাকল লোকটা, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পাথরের বাড়ানো হাত ধরে শ্লথ গতিতে হাঁটতে লাগল। আর একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।

এক সময় চোখের আড়ালে চলে গেল সে, আরও খানিক পর পানিতে বেশ কয়েকটা বৈঠার ঝপাঝপ শব্দ শুনতে পেল ক্লুবিন। নিহত গার্ডের দূরবীনটা কাছেই পড়ে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে সেটা তুলে নিল।

ওটা চোখে লাগিয়ে নৌকাটার দিকে তাকাল। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচতে নাচতে বেশ দ্রুত গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে ওটা। একটু পর চ্যানেলের গর্জন ছাপিয়ে একটা কণ্ঠস্বর কানে এল তার।

ভণ্ড ক্লুবিন! তুমি যে কত ভাল মানুষ, তা আমার জানা আছে। ওই টাকা তুমি লেতিয়ারিকে কেমন ফেরত দেবে, তাও বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তোমাকে এত সহজে রেহাই দেবো না, ক্লুবিন! লেতিয়ারিকে সব জানিয়ে চিঠি দিচ্ছি আমি। এই নৌকায় গেরানসির একজন নাবিক আছে, সে সাক্ষী দেবে, আমি তার সমস্ত টাকা সুদে-আসলে তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। ওই টাকা তুমি কোনদিনও হজম করতে পারবে না।

কণ্ঠস্বরটা কার, বুঝতে বাকি রইল না ক্লুবিনের।

***

সেদিন অনেক রাতে হোটেলে ফেরার পথে কি মনে করে বাজার থেকে নামী কোম্পানির তৈরি বেশ দামী এক বোতল ব্র্যান্ডি কিনে নিয়ে এল ক্লুবিন। কেউ যাতে দেখে না ফেলে, সে জন্যে বোতলটাকে কোটের নিচে ভরে বেশ সতর্কতার সাথে হোটেলে ঢুকল।

অবশ্য রাত তখন বেশ গভীর বলে দেখার মত তেমন কেউ ছিলও না। ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

পরদিন গেরানসির পথে যাত্রা করবে দুরান্দ, সে জন্যে সমস্ত প্রতি রাতেই নিয়ে রাখতে হবে তাকে।

সাত

গেরানসির দক্ষিণে ছোট একজোড়া পাহাড় আছে, চ্যানেলের মাঝামাঝি জায়গায়, নাম ডোভার পাহাড়। উপকূল থেকে মাইল বিশেক দূরে। পানি থেকে খাড়া আকাশের দিকে উঠে গেছে পাশাপাশি দুই পাহাড়। একটার চূড়া অন্যটার তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা।

সেটার নাম বড় ডোভার, অন্যটার নাম ছোট ডোভার। এই দুই পাহাড়কে ঘিরে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টাই প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসের মাতামাতি চলে, তার সাথে তাল মিলিয়ে সাগরও সারাক্ষণ উন্মত্ত আচরণ করে এখানে।

পানি আর বাতাসের ভয়াবহ ক্রুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায় ডোভারে। মনে হয় যেন একসাথে হাজারটা কামান থেকে অনবরত গোলা ছোঁড়া হচ্ছে।

সার্বক্ষণিক ঢেউয়ের আঘাতে পাহাড় দুটোর গা ক্ষয়ে ক্ষয়ে সিঁড়ির মত খাজ কাটা ধাপের সৃষ্টি হয়েছে, ক্রমে চূড়ার দিকে উঠে গেছে ধাপগুলো। গোড়ার দিকে বড় বড় গুহাও আছে বেশ কয়েকটা।

গোটা ইংলিশ চ্যানেলে ডোভারের মত বিপজ্জনক জায়গা আর নেই। নাবিকেরা যমের মত ভয় করে ডোভারকে, ওই এলাকার ধারেকাছে ঘেঁষার কথা স্বপ্নেও ভাবে না তারা। একমাত্র সামুদ্রিক পাখি ছাড়া অন্য কোন প্রাণী দেখা যায় না, ডোভারে।

এই দুই পাহাড়ের দুই চূড়াকে দূর থেকে দেখতে লাগে একজোড়া খাড়া গম্বুজের মত। দুই গম্বুজের মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। চ্যানেল এমনিতেই সারাক্ষণ ভীষণ বিক্ষুব্ধ থাকে এদিকটায়, দুই ডোভারের মাঝখানে থাকে আরও অনেক অনেক বেশি।

দুটোর মধ্যে দিয়ে সারাক্ষণ প্রচণ্ড ঘূর্ণি, জলোচ্ছ্বাস আর তীব্র স্রোত থাকে, সব মিলিয়ে সাঘাতিক আবহাওয়া ডোভারের। আর স্রোত? সে এক অবিশ্বস্য ব্যাপার-দিশেহারার মত ভয়ঙ্কর গতিতে এদিক-সেদিক ছোটে।

নাবিকেরা জানে ওই ঘূর্ণি আর স্রোতের মধ্যে একবার পড়লে আর রেহাই নেই, পানির আঘাতে ডোভারে আছড়ে পড়ে ছাতু হয়ে যাবে জাহাজ। তাই অনেক পথ ঘুরে ওই এলাকাকে সযতে পাশ কাটিয়ে চলাচল করে তারা। ডোভার পাহাড়ের কাছে আরেকটা পাহাড় আছে, সেটার নাম স্কেলিটন।

শোনা যায়, অনেক বছর আগে এই পাহাড়ের কাছে কোথাও একটা জাহাজডুবী হয়েছিল। সেটার এক নাবিক ভাগ্যক্রমে ভাসতে ভাসতে এই পাহাড়ে এসে ওঠে। কাঁকড়া ইত্যাদি খেয়ে সপ্তাখানেক বেঁচে ছিল হতভাগ্য লোকটা। তারপর যা দটা তাই ঘটল।

এর অনেকদিন পর এক দুঃসাহসী জেলে এদিকে মাছ ধরতে এসে দূর থেকে পাহাড়টার ওপর একটা কঙ্কাল দেখতে পায়। সেই থেকে ওটার নাম স্কেলিটন। সেটাকে ঘিরেও পানি আর বাস একই আচরণ করে।

* * *

শুক্রবার সকাল নটায় সাতজন নাবিক ও দুজন যাত্রী নিয়ে সেইন্ট ম্যালো বন্দর ত্যাগ করল দুরান্দ। খোলা সাগরে পৌঁছে তাঙরুল নামের এক পুরানো, অভিজ্ঞ নাবিকের ওপর জাহাজের হাল ধরার দায়িত্ব দিল ক্লুবিন। নাবিক হিসেবে খুব দক্ষ ছিল লোকটা, কিন্তু মস্ত একটা দোষও ছিল তার।

প্রায় সময়ই মদ খেয়ে বেহেড মাতাল থাকত। তাছাড়া মদ নিয়ে বসলে একেবারে গলা পর্যন্ত না গিলে উঠত না লোকটা। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস।

রাতের প্রথমভাগে প্রায়ই ডিউটি অফ থাকত তাঙরুলের। ওই সময়টা ঘুমিয়ে কাটাত সে, তারপর মাঝরাতে উঠে মদের বোতল নিয়ে বসত। এটা ছিল তার নিয়মিত রুটিন। ব্যাপারটা ক্লুবিনের জানা ছিল।

এ-ও ভালই জানত যে সকালের দিকে নেশা বেশ তুঙ্গেই থাকে তাঙরুলের, তবু তার ওপরেই প্রথমদিন দুরান্দের হাল ধরার দায়িত্ব দিল সে। নেশাখোরদের প্রত্যেকেরই নেশা করার নির্দিষ্ট গোপন একটা জায়গা থাকে।

তাঙরুলেরও এরকম একটা জায়গা আছে দুরান্দে। ক্লুবিনের সে খবর জানা ছিল। এবং এই জ্ঞানটাও ভালমতই কাজে লাগিয়েছিল সে।

জাহাজ যাত্রার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত আছে কিনা, বাপারটা চেক করে দেখতে আগেরদিন অনেক রাতে দুরালে এসেছিল ক্লুবিন। তাঙরুল সে সময় নিজের কেবিনে প্রবল বেগে নাক ডাকাচ্ছে। পরে ঘুম ভাঙতে পান করার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এল সে।

ঘুম ঘুম চোখে সেখানে বড় একটা বোতল দেখে অবাক হলো লোকটা। ব্র্যান্ডি! লেবেল দেখলেই বোঝা যায় ভাল কোম্পানির তৈরি দামী জিনিস। আশ্চর্য, এই জিনিস কি ভাবে এল এখানে? কে আনল? সে তো কখনও ব্র্যান্ডি খায় না!

তার এখানে বাইরের কেউ আসেও না, তাহলে কে আনল এটা? ভাবনা-চিন্তার পিছনে সময় নষ্ট না করে বোতলটার ছিপি খুলে ফেলল সে। ভাল জিনিস গেলার এমন একটা সুযোগ যখন পাওয়াই গেল, সেটা ছাড়া চরম বোকামী হবে। বোতলের আসল মালিক যে কোন সময় হুট করে এসে পড়তে পারে, এই ভয়ে ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করে দিল সে। বলতে গেলে এক চুমুকেই সবটা সাবাড় করে নিশ্চিন্ত হলো, বোতল সাগরে ফেলে দিল।

পরদিন ক্লুবিনের নির্দেশে যখন হাল ধরল, তখন বলতে গেলে পুরোপুরি মাতাল তাঙরুল। মাথা ঘুরছে তার, পা টলছে, দু-তিনটা করে দেখছে সবকিছু।

আকাশ একদম পরিষ্কার সেদিন। ঝলমল করছে। এক ফোঁটা মেঘও চোখে পড়ছে না কোথাও। পানি কেটে তরভর করে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে চললেও কিছুক্ষণ পরই জাহাজের আরোহী ও নাবিকদের কারও কারও মনে সন্দেহ দেখা দিল, দুরান্দ সঠিক কোর্সে চলছে না মনে হলো তাদের।

তবে ক্যাপ্টেন ক্লুবিনের ওপর সবার অগাধ আস্থা আছে, তারা জানে সে থাকতে চিন্তার কিছুই নেই। তাই ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না কেউ। কিন্তু আরও বেশ কিছু সময় পর অনেকেরই আস্থায় চিড় ধরতে শুরু করল।

সেই পুরনো সন্দেহ ফিরে এল তাদের মধ্যে। কারও কারও মনে হলো পথ ভুল করেছে দুরান্দ। গেরানসির দিকে নয়, জারসি দ্বীপের দিকে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা কানে যেতে প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দিল ক্যাপ্টেন। তার ধারণা, এতবড় ভুল তাঙরুলকে দিয়ে হতেই পারে না। কিন্তু নাবিকরা তো নয়ই, যাত্রীরাও তার ধারণার সাথে একমত হতে পারছে না দেখে একসময় ঘটনা তদন্ত করতে এল সে। দেখল সত্যিই তো! ভুল পথেই তো চলেছে দুরান্দ! তাঙরুলকে খানক বকাঝকা করে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ওটাকে গেরানসির সঠিক কোর্সে নিয়ে এল সে। এর ফলে বেশ কিছু সময় অনর্থক নষ্ট হলো। ওদিকে হুইল হাউসে তাঙরুলের নেশা কমার কোন সক্ষণ নেই।

বরং তখনও একটু একটু করে চড়ছে। পা রীতিমত টলছে তার, হাতেও মনে হলো শক্তি পাচ্ছে না সে ঠিকমত। তবে এ নিয়ে তখনই আর কোন কথা উঠল না। একটু পর পর ক্যাপ্টেন নিজে এসে খোঁজখবর নিচ্ছে, কাজেই চিন্তা কিসের?

দুপুরে খাবারের ঘণ্টী বাজতে সবাই খেয়ে নিল, খেল না কেবল ক্লুবিন। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তাকে, চোখেমুখে অস্বাভাবিক একটা ভাব। যেন কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে মানুষটা।

খেয়েদেয়ে গল্প করছে জাহাজের নাবিক ও যাত্রীরা, এমন সময় হুইল হাউস থেকে ক্যাপ্টেনের চিৎকার ভেসে এল, বেরিয়ে যাও, মাতাল কোথাকার!

কৌতূহলী হয়ে পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সবাই। দেখতে পেল ভেতরে তাঙরুলের সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন, রাগে তার দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়।

ওদিকে নেশাগ্রস্ত হলেও নিজের অপরাধ সম্পর্কে তাঙরুলকে ভালই সচেতন মনে হলো তাদের। ধমক খেয়ে ক্লুবিনের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা ব্যাপার বুঝতে না পেরে সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তখনই আচমকা অন্য এক ঘটনা ঘটল। দেখতে দেখতে ঘন কুয়াশায় ছেয়ে গেল আকাশ, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কুয়াশার বিশাল এক মেঘ দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল দুরান্দের দিকে।

তাই দেখে ভয় পেয়ে গেল অনেকেই। কিন্তু ক্লুবিনকে মোটেও বিচলিত হতে দেখা গেল না। নাবিকদের নির্দেশ দিল সে, এনজিনে বেশি করে কয়লা ভরে স্টীম বাড়িয়ে দাও!

বেশ কিছুক্ষণ কুয়াশার মেঘটার ধার ঘেঁষে চলল দুরান্দ, তারপরই চরদিক থেকে খুব দ্রুত এগিয়ে এল মেঘ, দুরান্দকে ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলল। একটা অদ্ভুত কালো চাদর যেন মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বচরাচর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিল ওটাকে।

কোনদিকেই কিছু দেখার উপায় রইল না। ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠল প্রত্যেকের। প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই এল দ্বিতীয় ধাক্কা, হঠাৎ শীত শীত অনুভূতি হলে সবার। ব্যাপার ঠিকমত বুঝে ওঠার আগে শীতে কাঁপুনিই উঠে গেল।

অসহ্য ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে গরম কাপড়ের খোঁজে যে যার আশ্রয়ের দিকে ছুটল মানুষগুলো। খানিক পর চারদিকের পরিবেশে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এল হঠাৎ করে। সাগরের সমস্ত আলোড়ন যেন অদৃশ্য কোন হাতের ইশারায় থমকে গেছে। এনজিনের ধুক ধুক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

ঘন কালো বিশাল মেঘের পাহাড়টার মধ্যে দিয়ে অজ্ঞাত ভয়ে অন্ধের মত পড়িমরি করে ছুটে চলেছে দুরান্দ। ভোঁশ ভোশ করে ধোয়া বেরোচ্ছে চোঙ থেকে। অকল্পনীয়, ভৌতিক একটা দৃশ্য।

স্টীম খুব বেশি খরচ হচ্ছে, ক্যাপ্টেন, নাবিকদের একজন সাহস করে বলল। তারওপর এত কুয়াশা, আমার মনে হয় এ সময় আর এখোনো ঠিক হবে না। কোথাও নোঙর ফেলে অপেক্ষা করলেই বোধহয় ভাল হতো।

তার উপায় নেই, ক্লুবিন জবাব দিল। এই মাতালটার জন্যে যে সময় নষ্ট হয়েছে তা পূরণ করতে হবে না?

আগের মত পূর্ণ গতিতেই ছুটতে থাকল দুরান্দ। ওদিকে কুয়াশায় পথ দেখা যায় না বলে গেরানসির একটা জেলে নৌকা মাঝসাগরে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করছিল, একটু পর খুব কাছ দিয়ে ওটাকে পাশ কাটাল দুরান্দ। জেলে লোকটার সন্দেহ হলো জাহাজটার গতিপথ লক্ষ করে।

একটু যেন বেশি পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে না ওটা? চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল জেলে। পশ্চিমদিকে যাচ্ছে না? তাই তো! সঠিক কোর্সে চলছে না দুরান্দ।

তাছাড়া এই ঘন কুয়াশার মধ্যে ওটার এরকম পড়িমরি করে ছোটাও খুব অদ্ভুত মনে হলো জেলের। এভাবে অন্ধের মত এগোতে থাকলে যে কোন মুহূর্তে জাহাজ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে, এই সাধারন জ্ঞানটাও ক্যাপ্টেনের নেই নাকি? ভাবছে লোকটা।

বেলা দুটোর পর আরও খারাপের দিকে মোড় নিল আবহাওয়া। কুয়াশা এত ঘন হয়ে উঠল যে কয়েক হাত দূরের জিনিসও ভাল করে দেখা যায় না।

সাগর আকাশ সম্পূর্ণ মুছে গেছে চোখের সামনে থেকে। বাতাসেরও নাম-গন্ধ নেই। বৃষ্টি নেই, অথচ তারপরও সবার কাপড়চোপড় ভিজে উঠেছে। এ কেমন আবহাওয়া?

নাবিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সংক্রামক অসুখের মত। মুখে না বললেও চেহারা দেখে তাদের মনের অবস্থা বুঝতে অসুবিধে হয় না-প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সবাই। ওদিকে ক্যাপ্টেন ক্লুবিন অনেক আগেই তাঙরুলকে সরিয়ে দিয়ে নিজে হাল ধরেছে জাহাজের। রাগ পড়েনি তার, এখনও থেকে থেকে লোকটাকে গালাগাল করে চলেছে।

শয়তান কোথাকার! আমাদের সাথে চালাকি করেছ তুমি! আগে থেকেই আমাদের এই বিপদে ফেলার বুদ্ধি করে রেখেছিলে, কেমন? তোমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা উচিত, বদমাশ কোথাকার! যাও, দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে!

জবাব দেয়া দূরে থাক, মাথাই তুলছে না লোকটা। অপরাধীর মত নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

তিনটার সময় নিচের দিকের কুয়াশা অনেকটা হালকা হয়ে আসতে দীর্ঘ সময় পর সাগরের দেখা পাওয়া গেল। চারদিকে নীল পানির বিস্তার চোখে পড়তে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল যাত্রী-নাবিক সবাই।

এক হাতে হাল ধরা অবস্থায় অন্য হাতে দূরবীন তুলে নিল ক্লুবিন, সামনে তাকিয়ে আপনমনে বলল, মাতালটা দেখছি অনেক দূরে এনে ফেলেছে আমাদের। এখন আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা চলবে না।

ওদিকে গেরানসির দুই যাত্রীর একজন জাহাজের একদম মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের দূরবীন চেখে লাগিয়ে সামনে তাকিয়ে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করছিল সে। অনেকক্ষণ পর দূরে, হালকা কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ সামান্য আলো ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল দেখে ভয় পেল লোকটা।

এক ছুটে হুইল হাউসে এসে দাঁড়াল সে, ভীত গলায় হড়বড় করে বলল, ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন!!

কি ব্যাপার।

আমরা মনে হয় ভুল করে হ্যাঁনওয়ের কাছে এসে পড়েছি।

দূর! হেসে উঠল ক্যাপ্টেন। তা হয় কি করে!

হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, লোকটা জোর দিয়ে বলল। ওটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ই।

অসম্ভব! রেগে উঠল ক্লুবিন। নিশ্চই ভুল দেখেছেন আপনি। এখন যান এখান থেকে।

কিন্তু সে অনড়। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, মোটেই ভুল দেখিনি আমি, ক্যাপ্টেন। হ্যাঁনওয়ের চূড়া একদম স্পষ্ট দেখেছি আমি। ভুল হতেই পারে না।

কই, কোথায় আপনার হ্যাঁনওয়ে? বলল সে। কি এক আনন্দে চোখমুখ মুহূর্তের জন্যে ঝলমল করে উঠল।

সরল মানুষ যাত্রীটি খেয়াল করল না ব্যাপারটা। হাত তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দিল ক্যাপ্টেনকে। ওই যে!

দূর! বিরক্ত হওয়ার ভান করে সেদিকেই দুরান্দের গলুই ঘুরিয়ে দিল ক্লুবিন। কি আবোল-তাবোল বলছেন! কোথায় হ্যাঁনওয়ে পাহাড়? আমি তো ওদিকে খোলা সাগর ছাড়া আর কিছুই দেখছি না!

লোকটা কয়েক মুহূর্ত বোকার মত ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর তাড়াতাড়ি হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এসে দূরবীনের কাঁচ পরিষ্কার করে আবার সামনে তাকাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। ভয়ে দুচোখ বিস্ফারিত। ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন–

আবার কি হলো? বাঁচতে চাইলে এখনই জাহাজের গলুই ঘুরিয়ে দিন। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল সে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

কেন? নকল বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল ক্লুবিন।

আমার দেখায় ভুল হয়নি। ওটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ের চূড়া!

জোরে জোরে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন। হতেই পারে না আপনি আসলে ঘন কুয়াশার তূপ দেখেছেন।

আতঙ্কে কাঁপতে লাগল লোকটা। জড়ানো গলায় হড়বড় করে বলল, যিশুর কসম করে বলছি, ক্যাপ্টেন, এটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়! এখনও সময় আছে, বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি জাহাজ ঘোরান, নইলে আমাদের সবাইকে আজ ধনেপ্রাণে মরতে হবে।

আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি যান। আমি দেখছি! এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কথা শেষ করে যেন লোকটাকে আশ্বস্ত করার জন্যেই হাল একদিকে সামান্য ঘুরিয়ে দিল ক্লুবিন, এর পরপরই কিছু একটার সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটল দুরান্দের, বো থেকে স্টার্ন পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল।

সামনের দিক থেকে ওঠা কাঠ ভাঙাচোরার বিকট কড়কড় মড়মড় শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে ঝাঁকির পর ঝাঁকি আর হোঁচট খেতে খেতে অনেক কষ্টে একটু একটু করে খানিকটা এগোল ওটা। তারপর গতি পুরোপুরি হারিয়ে একেবারে থেমেই পড়ল শেষ পর্যন্ত। ওদিকে ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই প্রথম ধাক্কার চোটেই ছিটকে চলে গেছে এদিক-সেদিক।

অনেকক্ষণ পর জাহাজ মোটামুটি স্থির হলো। সাথে সাথে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সেই যাত্রীটি। দূরবীন ডেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দুহাত আকাশের দিকে তুলে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।

হায়, হায়! আমি ঠিকই বলেছিলাম ঠিকই বলেছিলাম আমি! জাহাজ হ্যাঁনওয়ের ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছে। শেষ হয়ে গেলাম আমরা! হায়, হায়! এখন কি হবে আমাদের।

তার দেখাদেখি অন্যরাও চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল, কি ধমক মেরে সবাইকে থামিয়ে দিল ক্লুবিন। চুপ করুন! সবাই চুপ করুন! এত ভয় পাওয়ার মত কিছু ঘটেনি। কেউ শেষ হয়ে যায়নি এখনও।

ডেকে কারও ছুটে আসার ভারী ধুপধাপ্ পায়ের শব্দ উঠতে ঘুরে তাকাল সবাই। দেখা গেল প্রায় নগ্ন এক নিগ্রো নাবিক এনজিন রুমের দিক থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছে। এমনিতেই মানুষটা কালো, সেই সঙ্গে এনজিনরুমের কালিঝুলি মেখে কিত চেহারা হয়েছে।

লোকটা দুরান্দের এনজিনম্যান। ক্লুবিনের সামনে এসে বেদম হাঁপাতে লাগল সে। ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন! সর্বনাশ হয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন!

কি হয়েছে? ধমক মেরে উঠল ক্লুবিন।

জাহাজের তলা জাহাজের তলা ফেটে গেছে, ক্যাপ্টেন! অনেকখানি। এনজিনরুমে স্রোতের মত পানি ঢুকছে। আগুন নিভে যাবে যে কোন মুহূর্তে।

কারও বুঝতে বাকি রইল না দুরান্দের ভাগ্যে কি ঘটেছে ডুবো পাহাড়ের চূড়ায় বেকায়দারকম ধাক্কা খেয়ে তলা ফেটে গেছে ওটার। সেই ফাটল দিয়ে হুড়মুড় করে পানি ঢুকছে ভেতরে।

এদিকে চারদিক আঁধার করে রাতও ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে, তারওপর ঘন কুয়াশা। কোনদিকে নজর চলে না। এই অবস্থায় কপালে কি আছে, কাউকে তা বলে দেয়ার দরকার পড়ে না।

মাঝসাগরে ডুবন্ত জাহাজের ডেকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল সবাই। বোধবুদ্ধি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।

ওদিকে জাহাজ ধাক্কা খেতে তাঙরুলের নেশা কেটে গেছে। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বেশি দেরি হলো না তার। সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাল সে ফ্যালফ্যাল করে, তারপর পায়ে পায়ে এনজিনরুমের দিকে এগিয়ে গেল।

একটু পর উদ্বিগ্ন চেহারায় ফিরে এসে মিনমিনে গলায় বলল, খোলের ভেতরে খুব বেগে পানি ঢুকছে, ক্যাপ্টেন। মনে হয় দশ মিনিটের মধ্যে ডেকে উঠে আসবে।

এ কথা শুনে নাবিক-যাত্রী প্রত্যেকে ভয়ে বেদিশা হয়ে উঠল, পাগলের মত অর্ধহীন ছোটাছুটি শুরু করে দিল দুরান্দের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। যখন হুশ ফিরছে; বুঝতে পারছে এভাবে পালিয়ে বাঁচা যাবে না, তখন কিছুক্ষণের জন্যে থেমে এদিক-ওদিক তাকায়।

তারপর আবার সেই চিৎকার-চেঁচামেচি, দৌড়-ঝাঁপ। অবস্থা বেগতিক বুঝে লোকগুলোকে আশ্বস্ত করার জন্যে এক জায়গায় জড়ো করল ক্লুবিন। সবাই এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াতে নিগ্রো লোকটাকে জিজ্ঞেস করল সে, এনজিন আর কতক্ষণ চালু রাখা যাবে?

বড়জোর পাঁচ-ছয় মিনিট, ক্যাপ্টেন জবাব দিল লোকটা। তার বেশি না।

গেরানসির সেই যাত্রীর দিকে ফিরল ক্লুবিন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি তো হাল ধরা অবস্থায় ছিলাম, ঠিকমত দেখতে পাইনি। আপনি পাহাড়টা দেখেছিলেন, না?

হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। একদম স্পষ্ট দেখেছি। সেই জন্যেই তো আপনাকে তখন বারবার সতর্ক করেছিলাম, কিন্তু আপনি আমার কথায় কান দেননি। আমার কথা যদি শুনতেন …।

এ অভিযোগের কোন উত্তর দিল না ক্লুবিন। একটু সময় ভাবল, তারপর মৃদু গলায় বলল, এখান থেকে উপকূল কতদূর হবে মনে হয়?

মাইলখানেকের মত।

দুরান্দের খোলর ভেতরে ছিল এক পাল গরু-ছাগল, হঠাৎ করে সেগুলো ভীত সন্ত্রস্ত গলায় চেঁচামেচি শুরু করে দিতে ওপরেও ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। নিশ্চয়ই পানি ঢুকে পড়েছে ওগুলোর প্রকোষ্ঠে।

তাকে ঘিরে থাকা আতঙ্কিত মুখগুলোর দিকে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে তাকাল ক্লুবিন। কিছুসময় ভাবল কি যেন। তারপর চড়া গলায় নির্দেশ দিল, তাড়াতাড়ি পানিতে নামাও লাইফবোট! আর দেরি করা যায় না।

নির্দেশ পাওয়ামাত্র ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রতিটা নাবিক-যাত্রী, হুড়োহুড়ি করে বোটটা নামানো হলো পানিতে। ঠিক তখনই থেমে গেল এনজিনের শব্দ, আগুন নিভে গেছে। অর্থাৎ আর বেশি দেরি নেই জাহাজ ডুবতে।

দ্বিতীয়বার নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে তাড়াতাড়ি লাইফবোটে নেমে গেল দুরারে সাধারণ দুই যাত্রী, তারপর নামল নাবিকেরা। এরমধ্যে নিজের কেবিন থেকে জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র ও কম্পাসসহ অন্যান্য দামী যন্ত্রপাতি একটা থলেতে বেঁধে নিয়ে এসেছে ক্লুবিন। থলেটা নিগ্রো মেশিনম্যানের হাতে তুলে দিল সে।

এটা নিয়ে যাও সাথে করে। লেতিয়ারিকে দিয়ো। যাও, তাড়াতাড়ি বোট ছেড়ে দাও।

ক্যাপ্টেনের কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো সবাই, একযোগে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কি বলছেন? আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন না?

মুখ খোলার আগে রেলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকাল ক্লুবিন, দেখল পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জাহাজের একদিকের খোল একেবারেই চুরমার হয়ে গেছে। তবে এখনই ডুববে না দুরান্দ, জুবো চুড়ায় আটকে গেছে বলে সময় লাগবে।

আবহাওয়ার যে অবস্থা, তাতে ঝড় উঠবে যে কোন সময়ে, আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে সাগর, পাহাড় সমান একেকটা ঢেউ উঠতে শুরু করবে।

তখন কি ঘটবে জানা কথা। ঢেউয়ের আঘাতে অনবরত পাহাড়ে আছাড় খেতে খেতে গোটা জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

না, শান্ত কণ্ঠে বলল সে। আপনারা চলে যান।

সে কি! কেন? কেউ একজন বলল।

আমি কোথাও যাচ্ছি না। জাহাজেই থাকছি।

সবাই ভাবল বোটে এতজন মানুষ ধরবে না বলেই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যাপ্টেন, তাই একযোগে চেঁচামেচি শুরু করে দিল তারা। সমস্বরে বলতে লাগল, না, না, ক্যাপ্টেন! তা কেন করতে যাবেন আপনি? চলে আসুন। বোটে আরেকজনের জায়গা ঠিকই হয়ে যাবে।

তাঙরুল বলল, আপনার কি দোষ, ক্যাপ্টেন? আপনি জাহাজে থেকে কেন আত্মাহুতি দিতে চাইছেন? দোষ যদি কারও হয়ে থাকে, হয়েছে আমার। সে জন্যে শাস্তি তো আমারই হওয়া উচিত। আমাকে যা খুশি শান্তি দিন, তবু আপনি চলে যান।

না, তা হয় না, তাঙরুল ক্লুবিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল। এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন হয়ে আমি নিজের জাহাজ ছেড়ে যাই কি করে? জাহাজের ভাগ্যে যা ঘটে, ক্যাপ্টেনের ভাগ্যেও তাই ঘটা উচিত। তাছাড়া দুরান্দের ক্যাপ্টেন তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি, এমন কথা বলার সুযোগ আমি কাউকে দেব না। তোমরা চলে যাও।

তাঙরুলের দিকে তাকাল সে। সহজ, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, যাও তাঙরুল, মনে কোন দুঃখ রেখো না। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। একটু থেমে গলা চড়িয়ে বলল, আমি আদেশ করছি, নৌকা ছেড়ে দাও। তীরের দিকে যাত্রা করো এখনই। বিদায়, বন্ধুরা! বিদায়!

ক্যাপ্টেনের নামে ঘন ঘন জয়ধ্বনি করতে লাগল আরোহীরা। ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, দীর্ঘজীবী হোন! অন্ধকার ইংলিশ চ্যানেলের বুক কেঁপে উঠল তাদের চিৎকারে।

বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় দোল খেতে খেতে জাহাজের গা থেকে সরে গেল লাইফবোট, ঘুরে উপকূল লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগল ধীর গতিতে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ওটা কুয়াশা আর অন্ধকারের মধ্যে।

দুরান্দের ডেকে সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছে ক্লুবিন, সাগরের গভীর থেকে ফুলেফেঁপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ঢেউয়ের ভয়াবহ রূপ দেখছে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে চারদিকে একটু পরপর হাজারটা কামান একযোগে হুঙ্কার ছাড়ছে যেন।

ভয়াবহ ক্রুদ্ধ গর্জনের সাথে অসীম দিগন্তের পাণে ছুটে চলছে সাগর।

আট

হঠাৎ করে আরও ঘন হয়ে উঠল কুয়াশা, ক্লুবিনের চোখের সামনে কে যেন আচমকা একটা পুরু পর্দা ঝুলিয়ে দিল। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। পেলে কলজের পানি শুকিয়ে জমাট বেঁধে যেত তার।

পাহাড় সনাক্তকারী যাত্রীর মত তারও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দূরান্দ সত্যি সত্যি হ্যাঁনওয়ের কোন জুবো পাহাড়েই ধাক্কা খেয়েছে। হ্যাঁনওয়ের সাথে খুব ভাল পরিচয় ছিল ক্লুবিনের।

পাহাড় থেকে উপকূলের দূরত্ব মাত্র এক মাইল, জানে সে। এইটুকু পথ সঁতরে পাড়ি দেয়া তার জন্যে কোন ব্যাপারই নয়। সব সময় কোমরে একটা চওড়া চামড়ার বেল্ট পরে থাকত ক্লুবিন, শার্টের নিচে ঢেকে রাখত। সেটার বাকলে তার নাম খোদাই করা আছে।

টাকা-পয়সা রাখার কয়েকটা বিশেষ খোপও আছে তাতে, নিজের যাবতীয় সঞ্চয় সব সময় তার একটার মধ্যে রাখে সে। রাতাগের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া পঁচাত্তর হাজার ফ্ৰাসহ তার লোহার মানিব্যাগটাও আছে ওটার অন্য এক খোপে।

সেইন্ট ম্যালোর নির্জন সৈকতে যেদিন জুয়েলা-রাতাগকে শলা পরামর্শ করতে দেখল ক্লুবিন, সেদিনের সেই মুহূর্তেই আজকের এই অদ্ভুত জাহাজডুবী নাটকের পরিকল্পনা তার মনের মধ্যে গেড়ে বসে।

মনে মনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেয় সে। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছে, একটা নয়, এক ঢিলে চার-চারটা পাখি মেরেছে ক্লুবিন।

এক, কায়দা করে একদম উপযুক্ত জায়গায় জাহাজডুবী ঘটিয়েছে, দুই, আত্মাহুতি দিয়ে নিজের ক্যাপ্টেনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে, তিন, সবার অলক্ষে দুরান্দ থেকে কেটে পড়া এখন কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র, এবং চার, রাতাগের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া পঁচাত্তর হাজার ফ্রাঁর সদগতি-সেটাও হতে কোন বাধা নেই এখন।

কিছুক্ষণ পর জোয়ার হলো সাগরে। পানির সাথে বাতাসের তেজও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেখতে দেখতে প্রচণ্ড ঝড়ও শুরু হয়ে গেল। বাতাস আর পানির চাপে ঘন ঘন আড়মোড়া ভাঙতে শুরু কবল দুরান্দ। সেই সাথে গোঙাচ্ছে অনবরত।

কিছু সময় এভাবেই চলল, তারপর আগের অবস্থান ছেড়ে একটু একটু করে সরে এল ওটা। খানিকটা দূরের অন্য দুই পাহাড় চূড়ার মধ্যে নতুন করে আটকালো। বেশ ভালভাবেই আটকেছে এবার। তাই দেখে খুশি হলো ক্লুবিন। এখন আর সহজে ডুবছে না জাহাজ, কাজেই তারও তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। নৌকাটা আরও দূরে সরে যাক।

তারপর ধীরেসুস্থে আর যাবেই বা কতদূর ওটা? ভাবল ক্লুবিন। যে ভীষণ ঝড় শুরু হয়েছে, তাতে ওইটুকু নৌকা ডুবে যেতে বেশি সময় লাগবে না। তাই যাক, তারপর নিশ্চিন্তে যাত্রা করতে পারবে তাহলে ক্লুবিন। এই সামান্য পথ পাড়ি দিতে কতক্ষণই বা লাগবে তার! বড়জোর এক ঘন্টা।

ঠিক করা আছে, প্রথমে সঁতরে তীরে গিয়ে প্লইমো গ্রামে উঠবে সে, সেই পোড়োবাড়িতে আশ্রয় নেবে। তাতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ একে ঝড়ো আবহাওয়া, তারওপর সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত গম্ভীর হয়ে যাবে, অন্ধকারে কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।

প্রাইমোয় পৌঁছে শুকনো কাপড়চোপড় পরে কিছু খেয়ে নেবে সে, তারপর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসবে। তবে প্রয়োজনের বেশি এক মুহূর্তও প্রাইমোতে থাকার ইচ্ছে নেই ক্লুবিনের। কারণ ওই পোড়াবাড়িটা হলো চোরাচালানীদের আড্ডাখানা। তাদের মধ্যে পরিচিত কেউ ওখানে থাকলে সমস্যা, ক্লুবিনকে চিনে ফেলতে পারে।

তাহলে তার এত যত্নের প্ল্যান মাঠে মারা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বরবাদ হয়ে যেতে পারে সব। কিন্তু ক্লুবিন তা কিছুতেই হতে দিতে পারে না।

কয়েকদিনের মধ্যে একদল স্প্যানিশ নাবিক জাহাজে করে চোরাই মালপত্র নিয়ে প্রাইমোয় আসবে বলে খবর পেয়েছে সে। এদিকের কাজ সেরে দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার কথা তাদের। টাকা পেলে তাকেও নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।

একবার যেতে পারলে হয়, তারপর আর কে পায় তাকে? নতুন একটা নাম, নতুন একটা পরিচয় নিয়ে নতুন কোন দেশে আবার জীবন শুরু করবে ক্লুবিন। টাকা তো আছেই সাথে, আর চিন্তা কি? ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল সে। মনটা আনন্দে নাচছে তার থেকে থেকে।

ভাগ্যের চাকা এমন অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে যাবে, কদিন আগেও কি কল্পনা করতে পেরেছিল ক্লুবিন?

স্বপ্নের ঘোর ভাঙতে সচকিত হলো সে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, নৌকাটা নিশ্চয়ই অনেক দূরে চলে গেছে এরমধ্যে। অথবা কে জানে, ডুবেই গেছে হয়তো!

এদিকে আঁধারও হয়ে এসেছে, আর দেরি করা যায় না। সাগরের যে অবস্থা, তীরে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত অনেক হয়ে যাবে হয়তো।

কোমরের বেল্টটা আরেকটু কষে বেঁধে নিয়ে পানিতে নামার জন্যে প্রস্তুত হলো ক্লুবিন। তখনই জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো তাকে।

হঠাৎ করে সামনের কুয়াশার পর্দার মাঝে বড় একটা ফাঁক সৃষ্টি হলো। চারদিকের অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের সামনে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সামনে তাকাল ক্লুবিন। পরক্ষণে চোখের সামনে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে ভীষণ এক ঝাঁকি খেল।

এ কি! এ কোথায় এসে পড়েছে সে? কোথায় হ্যাঁনওয়ে পাহাড়, এ যে ডোভার পাহাড়! তাইতো! ওই তো সামনেই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নাবিককূলের ত্রাস, ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সেই স্কেলিটন! এত কঠিন এক বিস্ময় হজম করতে অনেক সময় লেগে গেল কবিনের, বারবার আপাদমস্তক শিউরে উঠতে লাগল। ভয়ে, আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেছে তার।

সর্বনাশ! এমন কাণ্ড কি করে ঘটল? কি হবে এখন? হ্যাঁনওয়েতেই দুরান্দকে ডুবিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল ক্লুবিন, কিন্তু বেলা দুটোর পর থেকে চারদিক কুয়াশায় এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেল যে জাহাজ কোনদিকে যাচ্ছে ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেনি।

তাই বলে যে এমন একটা সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে যাবে, কে ভেবেছিল? তার মত অভিজ্ঞ এক ক্যাপ্টেন থাকতে জাহাজ সঠিক কোর্স ছেড়ে জাহাজ এত দূরে সরে আসবে, এ কেমন কথা? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়!

তারওপর যাত্রীটি যখন বারবার জোর দিয়ে বলতে লাগল হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ই দেখেছে সে, তখন মুখে যাই বলুক, মনে মনে ঠিকই বিশ্বাস করেছিল ক্লুবিন। কারণ হিসেবে তাই হওয়ারই তো কথা ছিল!

তাছাড়া ওই লোকের কথা সে এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে সত্যতা ভালমত যাচাই করারও প্রয়োজন মনে করেনি। হিসেবে যে ভুল হতে পারে, সে চিন্তাই মাথায় আসেনি।

হায় হায়! এখন কি হবে? ভুল শোধরাবার আর কোন উপায়ও তো নেই! বোকার মত বারবার বড় ডোভার ও হোট ডোভারের দিকে তাকাতে লাগল সে, ভয়ে কাঁপছে ঠক ঠক করে। হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে।

কোথায় গেরানসির উপকূল থেকে এক মাইল দূরের হ্যাঁনওয়ে আর কোথায় বিশ মাইল দূরের বড় ডোভার আর ছোট ডোভার! এরকম মারাত্মক এক ভুল কেমন করে ঘটল তার মত অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনকে দিয়ে? এভাবেই শেষ হয়ে যাবে তার এত যত্নে গড়া সপ্নসৌধ? তাহলে কি নিষ্ঠুর নিয়তি তার ভাগ্যে তীর থেকে বহুদূরের এই সর্বনাশা পাহাড়ে খিদে আর তেষ্টায় ধুকে ধুকে মরার কথাই লিখে রেখেছিল? ভাগ্যের এ কি নির্মম পরিহাস!

দুরান্দের লাইফবোটটা থাকলেও না হয় একটা আশা ছিল, এখন তো তাও নেই অন্যদেরকে প্রায় জোর করেই ওটা নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ক্লুবিন।

এক মাইল দূরে তীর, সেই আশায় বোট বেয়ে চলেছে লোকগুলো-খাবার পানি কিছুই নেই সঙ্গে। এক সময় আসল ব্যাপার যখন ধরতে পারবে লোকগুলো, তখন কি হবে কে জানে! নিশ্চয়ই চরম হতাশায় ভেঙে পড়বে মানুষগুলো।

খিদে তেষ্টা ঝড় আর অসহনীয় শীত, এতগুলো দুর্লজ্ঞ বাধা জয় করে বিশ মাইল উন্মত্ত সাগর ওই খুদে বোটে পাড়ি দেয়া কোনদিনও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, সে ব্যাপারে ক্লুবিন প্রায় নিশ্চিত।

আর যদি ওরা গেরানসিতে পৌঁছতে না-ই পারে, তাহলে দুরান্দের ক্যাপ্টেনের এখানে আটকে পড়ার খবরও বাইরের পৃখিবীর কেউ কোনদিন জানতে পারবে না। তথাৎ কেউ আসবে না তার খোঁজে।

তাহলে কি উপায় হবে ক্লুবিনের? বাইরের সাহায্য ছাড়া কি ভাবে লোকালয়ে ফিরবে সে? এখানকার চরম বিরূপ আবহাওয়ায় একজন মানুষের পক্ষে কতদিন টিকে থাকা সম্ভব?

এদিক-ওদিক তাকাল সে আশা নিয়ে। যতদূর দেখা যায় অসীম পানি আর পানি ছাড়া কিছুই নেই কোথাও। এখানে কোনরকম সাহায্যের আশা করা বৃথা বুঝতে পেরে ধপ করে দুরান্দের দোদুল্যমান ডেকের ওপর বসে পড়ল সে।

একটু পর বাতাসের বেগ আরও কিছুটা বাড়তে কুয়াশার পর্দা পুরোপুরি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, একেবারে দিগন্তরেখা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেল ক্লুবিন। সাথে সাথে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল নতুন এক সম্ভাবনার কথা ভেবে।

সাগরে কুয়াশার সময় দুর্ঘটনা এড়াতে সব জাহাজই নোঙর ফেলে অপেক্ষা করে, কুয়াশা কেটে গেলে আবার যাত্রা করে। কপাল ভাল থাকলে সেরকম একটা জুটে যেতেও পারে ভেবে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল ক্লুবিন, সামনে তাকিয়ে থাকল।

যা ভেবেছিল ঠিক তাই ঘটল। বেশ কিছুক্ষণ পর অনেক দূরে, দিগন্তরেখার কাছে একটা জাহাজের মাল চোখে পড়তে আনন্দে মন নেচে উঠল তার। পুর্ব থেকে পশ্চিমে, অর্থাৎ এদিকেই আসছে সেটা।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ডোভারের কাছ দিয়ে যাবে। আনন্দে হেসে উঠল ক্লুবিন। মনে মনে বলল, এবারের মত বোধহয় বেঁচে গেলাম। পরমুহর্তে ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। কি ভাবে জাহাজটার ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল।

দুই ডোভারের মাঝে আটকাপড়া আধা ডুবন্ত দুরান্দ এমনিতে ওটা কারও চোখে পড়বে না, সে ব্যাপারে ক্লুবিনের কোন সন্দেহ নেই। কাজেই যাতে পড়ে, সে জন্যে কিছু একটা করতে হবে। কি করা যায়?

নিজেকে প্রশ্ন করল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত বড় ডোভারের চূড়াটাকেই সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে হলো তার। কোনমতে যদি ওখানে একবার উঠতে পারে সে, তাহলে বিপদ কেটে যাবে।

কাপড় উড়িয়ে দূরাগত জাহাজটার কারও না কারও দৃষ্টি নিশ্চয়ই আকর্ষণ করতে পারবে সে। চূড়াটার দিকে তাকিয়ে দুরান্দের সাথে ওটার দূরত্ব আন্দাজ করে নিল সে। মনে হলো দুশো হাতের বেশি হবে না।

সাগর যদিও ভীষণ অশান্ত, কিন্তু ক্লুবিন ওসব পরোয়া করে না। যত ঢেউ আর স্রোতই থাকুক না কেন, সে ঠিকই জায়গামত পৌঁছে যেতে পারবে।

পানির ওপরে সাঁতার কাটতে সমস্যা হলে ডুব সাঁতার দিয়ে এগোবে। চিন্তা কি? ডুব সাঁতারেও ক্লুবিনের কোন জুড়ি নেই। মোট কথা এই সামান্য পথ পাড়ি দেয়া কোন ব্যাপারই নয় তার জন্যে।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, আর দেরি করা যায় না, এখনই পানিতে নামতে হবে। নইলে জায়গামত পৌঁছতে দেরি হয়ে যেতে পারে।

কাপড়চোপড় পরা অবস্থায় সাঁতার কাটতে অসুবিধে হবে বলে পরনে যা যা ছিল, সব খুলে ফেলল সে। ওসবের চিন্তা এখন না করলেও চলবে। একবার ওই জাহাজটায় উঠতে পারলে জামা-কাপড়ের অভাব হবে না।

কোমরের বেল্টটা আরও একটু কষে বেঁধে নিয়ে বড় ডোভারের দিকে তাকাল ক্লুবিন, শেষবারের মত আরেকবার ভাল করে ওটার দূরত্ব আর দিক নির্ণয় করে নিয়ে মাথা নিচু করে ডাইভ দিল। অনেক উঁচু থেকে একদম খাড়া ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ায় সাঁ করে বেশ অনেকখানি গভীরে চলে গেল সে। ইচ্ছে আছে ওই এক ডুবেই বড় ডোভারের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছবে, তারপর পাথরের খাজে খাজে পা রেখে উঠে যাবে চূড়ায়। এবারের হিসেবে কোন ভুল ছিল না, এক ডুব সাঁতারে ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছল সে।

পানির ওপরে মাথা তুলতে গুহার মত বড় বড় কয়েকটা গর্ত দেখতে পেল-পরিচিত গর্ত। ভাটার সময় জেগে থাকে, এই পথে আসা-যাওয়ার সময় দূর থেকে বহুবার দেখেছে।

পানি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল ক্লুবিন, এমন সময় কাছের এক গুহা থেকে নরম, গুড়ের মত দীর্ঘ একটা হাত আচমকা বেরিয়ে এসেই তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল।

ভীষণ ঠাণ্ডা একটা হাত! পরমুহূর্তে হ্যাঁচকা টান পড়ল কোমরে, চোখের পলকে তাকে গুহার ভেতরে টেনে নিয়ে গেল ওটা। ঠিকমত কিছু বুঝে ওঠার বা আত্মরক্ষার জন্যে কিছু করার বিন্দুমাত্র সুযোগও পেল না। যুবক, শেষ মুহূর্তে কেবল একটা চিৎকার করতে পেরেছিল কোনমতে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্লুবিনের, কারও কানে গেল না তার আতঙ্কিত মরণ চিৎকার।

নয়

রেভারেন্ড কড্রেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে বন্দরে ফিরে এল গিলিয়াত। লোকটা নিজের পথে চলে যেতে সে-ও বাড়ির দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, এমন সময় দুঃসংবাদটা শুনতে পেল-লেতিয়ারির সাধের দুরান্দ সাগরে ডুবে গেছে।

একটু আগেই খবরটা পাওয়া গেছে-ঝড়ে বিধ্বস্ত দুরান্দ থেকে কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা নাবিক-যাত্রীদের মুখ থেকে। মনটা খারাপ হয়ে গেল গিলিয়াতের। ঘটনা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে লেতিয়ারির বাড়ির দিকে এগোল ও।

দূর থেকেই সেখানে অনেক মানুষের জটলা দেখতে পেল ও। রীতিমত ভিড় জমে গেছে বাড়িটার সামনে-ভেতরে। খবর শুনে বন্দরের চেনা-অচেনা অনেকেই এসেছে বৃদ্ধকে সহানুভূতি জানাতে, বিস্তারিত জানতে।

নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া জাহাজটির নাবিক যাত্রীরাও আছে তার মধ্যে, তাঙরুল ছাড়া অবশ। পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্যে এগোল গিলিয়াত, ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ল সামনের ঘরে। প্রচুর মানুষ সেখানে, পা রাখার জায়গা নেই।

প্রথমেই দেরুশেতের ওপর চোখ পড়ল ওর। ঘরের এক মাথায় চেয়ারে বসে আছে ও পাথরের মূর্তির মত, দুগাল বেয়ে দরদর করে পানি ঝরছে। লেতিয়ারি রয়েছে ওর এক পাশে। দেয়ালে হেলান দিয়ে সামনের জটলার দিকে ফ্যা ফ্যা করে তাকিয়ে আছে সে।

হ্যাট ভুরু পর্যন্ত নামানো। তলা দিয়ে দীর্ঘ, কাঁচাপাকা কিছু চুল বেরিয়ে আছে, বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে। তার হাত দুটো নিজীবের মত ঝুলছে দেহের দুপাশে। দাঁড়াবার মধ্যে শিথিল, গা ছাড়া একটা ভাব। দেখে মনে হয় বোধবুদ্ধি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে মানুষটার।

তা পাওয়ারই কথা। দুরান্দ নেই, দুরান্দের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আর কখনও সতৃষ্ণ নয়নে সাগরের দিকে তাকিয়ে দিন গুণতে হবে না, এত বড় রূঢ় এক বাস্তব কি করে মেনে নেয়া সম্ভব লেতিয়ারির পক্ষে? জীবনের বাকি দিনগুলো তাহলে কি নিয়ে কাটাবে সে?

এই বয়সে তার পক্ষে নতুন করে আর কিছু কি করা সম্ভব? রাতাগের বিশ্বাসঘাতকতার পর শেষ সম্বল যা ছিল, তাই দিয়ে দুরা গড়েছিল লেতিয়ারি। ওটাই ছিল তার জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন। দুরান্দ না থাকার অর্থ হলো লেতিয়ারির আয় রোজগার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ এখন স্রেফ পথে বসতে হবে তাকে! এই ধরনের হাজারো চিন্তা হতবা, স্থবির করে তুলেছে লেতিয়ারিকে। স্তব্ধ হয়ে নাবিক ও যাত্রীদের মুখে নিজের প্রিয় দুরান্দের ধ্বংসের বর্ণনা শুনছে সে।

সেটা মোটামুটি এরকম : আগের দিন দুপুরের পর ঘন কুয়াশায় দিক ভুল করে ডোভার পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে দুরান্দ। প্রচণ্ড ধাক্কায় দুরান্দের খোলর

একদিক একেবারে চুরমার হয়ে গেছে।

প্রথমে অবশ্য এটাকে হ্যাঁনওয়ে ভেবেছিল সবাই। কারণ। কুয়াশা এত ঘন ছিল যে কেউ ঠিকমত চিনে উঠতে পারেনি জায়গাটা। তাছাড়া ওটা যে ডোভার হতে পারে, সে কথা কেউ ভাবেইনি। ভাবার কোন কারণও ছিল না। কেননা সেইন্ট ম্যালো-স্যামসন রুট থেকে ডোভার অনেক দূরে!

কোর্স ছেড়ে অতদূর সরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না দুরান্দের। এই দুর্ঘটনার জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী নাবিক তাঙরুল, ব্যাটা ইদ্দ মাতাল অবস্থায় জাহাজ চালাচ্ছিল।

দুর্ঘটনার ব্যাপারে ক্যাপ্টেনের কোন দোষ ছিল না। সে বরং যথার্থ ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করে গেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জাহাজ বাঁচানোর কোন উপায় দেখে নাবিক-যাত্রীদের সময় থাকতে লাইফবোট নিয়ে চলে আসতে বাধ্য করেছে।

ঝড়ের মধ্যে সাগরে চলার উপযুক্ত লাইফবোট একটাই ছিল দুরান্দে, উপায় নেই দেখে সেটায় করে চলে আসে তারা। বারবার অনুরোধ করার পরও ক্যাপ্টেন আসেনি তাদের সঙ্গে। প্রতিজ্ঞা করেছে, সে জাহাজেই থাকবে।

জাহাজ ছেড়ে আসার একটু পরই প্রবল ঝড়ে পড়ে লাইফবোট। বিশাল একেকটা ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে খাবি খেতে খেতে প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল, জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিল সবাই, এমন সময় কাশমির নামে একটা জাহাজ এসে পড়ায় অল্পের জন্যে প্রাণে রক্ষা পায় লোকগুলো।

জাহাজটা তাদেরকে সেইন্ট পিটার বন্দরে পৌঁছে দিয়েছে। তাঙরুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানে। লেতিয়ারির সামনের এক টেবিলে ক্লুবিনের পাঠিয়ে দেয়া দুরান্দের কম্পাস জরুরি কাগজপত্র রয়েছে।

মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্তও লোকটা যে তার ওপর অর্পণ করা দায়িত্ব একান্ত আন্তরিকতার সাথে পালন করে গেছে, ওগুলো তার সাক্ষী।

ক্লুবিন যে বিশ্বস্ত ও মহত্বদয় মানুষ, সব শোনার পর সে ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহ রইল না। তবে লোকটা যে মরেনি, এখনও বেঁচে আছে, সে ব্যাপারেও তাদরকে একমত হতে হলো। কেন, এবার আসছে সেই কাহিনী। ভিড়ের মধ্যে শিনটিন নামে এক জাহাজের ক্যাপ্টেনও ছিল, তার জানা আছে দুরান্দের সর্বশেষ পরিণতির খবর।

লোকটা তার কাহিনী বলতে শুরু করল, সেটা এরকম দুরা যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, শিনটিন নিয়ে তখন ওই এলাকার কাছাকাছিই ছিল সে। কুয়াশা পরিষ্কার হলে যাত্রা করবে বলে সাগরের মাঝে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করছিল।

অনেকক্ষণ পর ঝড়ের বেগ কিছুটা কমে আসতে কুয়াশাও হালকা হয়ে গেছে দেখে ফের যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শিনটিন, এমনসময় হঠাৎ দূর থেকে গরু-বাছুরের ভয়ার্ত চেঁচামেচি শুনে চমকে ওঠে ক্যাপ্টেন।

যেদিক থেকে শব্দ আসছিল, নোঙর তুলে সেদিকে এগিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। কিছুদূর যেতে দূর থেকে ডোভার পাহাড়ের এক ডুবো চূড়ায় দুরান্দকে আটকে থাকতে দেখতে পায় সে। বেহাল অবস্থা তখন সেটার।

উদ্ধারের কোন আশাই নেই। ওটা যেখানে, জাহাজ নিয়ে তার বেশি কাছে যাওয়ারও উপায় ছিল না। তাই কিছুটা দূরে নিজের জাহাজ থামিয়ে ওটায় মানুষজন আছে কি না বোঝার চেষ্টা করল ক্যাপ্টেন।

নানারকম শব্দ ও সঙ্কেতের মাধ্যমে দুরান্দের আরোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে সে অনেকক্ষণ ধরে। কোন লাভ হয়নি। সাড়া দেয়নি কেউ।

এক সময় ক্যাপ্টেনের সন্দেহ হলো, ওটায় বোধহয় মানুষজন নেই। গরু-বাছুরই আছে কেবল। তবু ভালমত নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সেখানেই রাত কাটায় শিনটিন। পরদিন, অর্থাৎ আজ ভোরবেলা আরেকবার দুরান্দের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালানো হয় অনেকভাবে। কেউ সাড়া দেয়নি। নিশ্চিত হয়ে ফিরে আসার আয়োজন করছে সে, এমন সময় আবার ঝড় ছাড়ল।

সে কি ভীষণ ঝড়! বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় অল্প সময়ের মধ্যে ডুবো পাহাড় থেকে দুই ডোভারের মাঝখানে গিয়ে আটকে গেল দুরান্দ।

এখন সেখানেই ঝুলন্ত অবস্থায় আছে জাহাজটা খোল বরবাদ হয়ে গেলেও কাঠামোটা আরও কিছুদিন ভেসে থাকবে, খুব শীঘিই ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে নিত্য ঝড় আর পানির আঘাত সহ্য করে কতদিন ভেসে থাকতে পারবে, সে কথা বলা মুশকিল।

কাহিনীর শেষ পর্যায়ে এত হতাশার মধ্যেও একটা আশার বাণী শোনাল লোকটা। তা হলো, দুরান্দের কাঠামো অকেজো হয়ে গেলেও দামী এনজিনটার কোনরকম ক্ষতি হয়নি। ঠিকই আছে ওটা। চেষ্টা করলে হয়তোবা ওটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হতেও পারে।

এই কথাটা যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করল লেতিয়ারির দেহে। নড়েচড়ে বসল সে। ভাবতে লাগল, শুধু ওই এনজিনটা নির্মাণের পিছনেই প্রায় চল্লিশ হাজার ফ্রা খরচ হয়েছিল এত টাকা দিয়ে ওরকম আরেকটা তৈরি করানো তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তাছাড়া ফ্রান্সের যে এনজিনিয়ার ওটা তৈরি করেছিল, সে-ও আর বেঁচে নেই।

কাজেই ওই চিন্তা বাদ দিতে হবে। এখন একটাই উপায় আছে, কোনমতে ওটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা, যদি সম্ভব হয়। তাহলেও দুরান্দ হারানোর ক্ষতি কিছুটা পূরণ হয়। কিন্তু কে করবে কাজটা

এমন অসম্ভব একটা কাজ করার মত বুকের পাটা কার আছে স্যামসনে? এতবড় দুঃসাহসী কে আছে যে ডোভারের মত গজব পড়া জায়গায় গিয়ে তার এই উপকারটা করে দেবে?

কে না জানে ডোভার কত ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জায়গা? এনজিন উদ্ধার করা তো পরের কথা, আগে তো ডোভারের ধারেকাছে পৌঁছতে হবে! এ অঞ্চলে এমন নাবিক কে আছে যে সেখানকার বিপদ সম্পর্কে জানে না?

একদিকে লেতিয়ারি এইসব ভাবছে, অন্যদিকে জিনিসটা উদ্ধারের নানান সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে উপস্থিত সবাই। কিন্তু শুধু সময় গড়াচ্ছে তাতে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

কেউ সফল হওয়ার মত কোন পথ কেউ দেখাতে পারছে না। যে ওটা উদ্ধার করে আনতে পারবে, তাকে প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা পুরস্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা করার পরও কেউ রাজি হচ্ছে না দেখে শিনটিনের ক্যাপ্টেন নিজেই এক সময় সম্ভাবনাটা বাতিল করে দিল।

না, না, এ কাজ কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, বলল সে। ওটার আশা ছেড়ে দেয়াই ভাল। ওই অঞ্চল আমি খুব ভাল করে চিনি। ওর ত্রিসীমানার কাছেই যেতে পারবে না কেউ, এনজিন উদ্ধার করা তো পরের কথা। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও কেউ এমন অসম্ভব দায়িত্ব নেবে, আমার তা মনে হয় না। কাজেই ব্যাপারটা নিয়ে শুধু শুধু মাথা ঘামানোর কোন অর্থ হয় না।

ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দেরুশেত। পটলচেরা দুচোখের শান্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিল জটলার মুখগুলোর ওপর। এমন কোন দুঃসাহসী পুরুষ কি আছে, তেমনি শান্ত কণ্ঠে বলল ও, যে ডোভার থেকে দুরান্দের এনজিনটা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে? তাহলে তাকেই বিয়ে করব আমি।

সমস্ত আলোচনা, গুঞ্জন মুহূর্তে থেমে গেল। প্রত্যেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির মুখের দিকে। কারও মুখে কথা নেই, পলক পড়ছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন সবাই। নড়তে-চড়তেও ভুলে গেছে।

জটলার মধ্যে থেকে দেরুশেতের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল একজন। সে গিলিয়াত। দেরুশেত, সত্যি বলছ তাকেই বিয়ে করবে তুমি?।

দেরুশেত জবাব দেয়ার আগেই বুড়ো লেতিয়ারি ওর সামনে এসে দাঁড়াল। আশা-নিরাশার অদ্ভুত এক দোলায় দুলছে মানুষটা। হ্যাঁ, গিলিয়াত, প্রচণ্ড আবেগে গলা কেঁপে গেল তার। হ্যাঁ। আমি ঈশ্বরের শপথ করে বলছি, আমার দেরুশেত তাকেই বিয়ে করবে। আমার সবকিছুর মালিকও হবে সে।

গিলিয়াত আর কিছু বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *