০৫০. ওয়াশিংটনের মেট্রো-রেল

৫০

ওয়াশিংটনের মেট্রো-রেলটা ফেডারেল ট্রায়াঙ্গল স্টেশন পার হলো, কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের কাছে মনে হচ্ছে গতিটা খুবই কম। সে ট্রেনের ভেতরে এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। ভেতরটা ফাঁকাই বলা চলে। মারজোরি টেঞ্চের লাল এনভেলপটা গ্যাব্রিয়েলের কোলের উপরে পড়ে রয়েছে, এটার ওজন তার কাছে দশ টনের মত মনে হচ্ছে।

আমাকে সেক্সটনের সঙ্গে কথা বলতে হবে! ট্রেনটা গতি বাড়িয়ে দিতেই সে ভাবলো। এটার গন্তব্য সেক্সটনের অফিসের দিকে। এক্ষুণি!

গ্যাব্রিয়েলের কাছে পুরো ব্যাপারটাই মনে হচ্ছে হেলোলুসিনেশনের মতো।

আমাকে বলো এটা ঘটেনি।

সে তার কোলে রাখা এনভেলপের দিকে তাকালো। ওটার ভেতর থেকে একটা ছবি বের করে আনলো সে। ছবিটা তার কাছে অতি চেনা– সিনেটর সেজউইক সেক্সটন তার অফিসে পুরোপুরি নগ্ন, তার মুখটা একেবারে ক্যামেরার দিকে ফেরানো, আর গ্যাব্রিয়েলের নগ্ন দেহটা একটু আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছে সিনেটরের পাশেই, শোয়া।

সে একটু কেঁপে উঠলো, ছবিটা এনভেলপের ভেতরে রেখে দিলো।

সবশেষ হয়ে গেছে।

গ্যাব্রিয়েল কী মনে করে যেনো তার সেলফোনটা বের করে সিনেটরের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করলো। তার ভয়েস মেইল জবাব দিলো। হতভম্ব হয়ে সে সিনেটরের অফিসে ফোন করলে সেক্রেটারি জবাব দিলো।

“আমি গ্যাব্রিয়েল বলছি। সে কি আছে?”

সেক্রেটারিকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। “তুমি কোথায় ছিলে?তিনি তোমাকে খুঁজছেন!”

“একটা মিটিং-এ ছিলাম, বেশ সময় নিয়েছে তাতে। এক্ষুণি তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলা। দরকার।”

“তোমাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি ওয়েস্টব্রুকে আছেন।”

ওয়েস্টকে সিনেটরের একটি বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট রয়েছে। সেটা তার ওয়াশিংটনের নিবাস।”সে তো ফোন ধরছে না,” গ্যাব্রিয়েল বললো।

“ব্যক্তিগত মিটিংয়ের জন্য তিনি আজ রাতে বুক হয়ে আছেন,” সেক্রেটারি মনে করিয়ে দিলো। “তিনি খুব আগেভাগেই চলে গেছেন।”

গ্যাব্রিয়েলের মনে পড়লো। ব্যক্তিগত মিটিং। এসব মিটিংয়ে তিনি মোটেও বিরক্ত করা পছন্দ করেন না। ব্যক্তিগত মিটিং মানে, কেবল আগুন লাগলেই আমার দরজায় টোকা মেরে, তিনি প্রায়ই বলেন। তানা হলে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। গ্যাব্রিয়েল জানে এখন সেক্সটনের ঘরে নিশ্চিত আগুন লেগেছে। আমি চাই তুমি তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দাও।”

“অসম্ভব।”

“খুবই জরুরি, আসলেই–”

“না, আমি বলতে চাচ্ছিলাম, আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব। তিনি তাঁর পেজারটাও আমার কাছে রেখে গেছেন এবং বলে গেছেন আজ রাতে যেনো তাকে বিরক্ত না করা হয়। সে থামলো। “একটু অন্যকম মনে হচ্ছিলো তাকে।”

“ধ্যাত্। ঠিক আছে, তোমাকে ধন্যবাদ।

গ্যাব্রিয়েল ফোনটা রেখে দিলো।

গ্যাব্রিয়েল চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো ছবি আর ডকুমেন্টগুলোর কথা। গ্যাব্রিয়েলের কানে মারজোরি টেঞ্চের ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠটা আবারো কোনো গেলো। সঠিক কাজটি করা। এফিডেফিটে স্বাক্ষর করো। সম্পর্কের কথা স্বীকার করে নাও।

গ্যাব্রিয়েল ভাবতে লাগলো ছবিগুলো যদি সিনেটর পত্রিকায় দেখে তবে কী ভাববে।

ছবিগুলো পত্রিকায় ছাপা হলেও গ্যাব্রিয়েল যদি সম্পর্কের কথাটা না স্বীকার করে তবে সিনেটর সুন্দর করেই বলবেন এগুলো বানোয়াট, কম্পিউটারে তৈরি করা হয়েছে।

তিনি অস্বীকার করবেন।

হ্যাঁ। তিনি মিথ্যে বলবেন… অসাধারণভাবেই বলবেন।

সেক্সটন পাল্টা অভিযোগ করে বলবেন যে প্রসিডেন্ট স্বয়ং এসব নোংরা কাজ করার আদেশ দিয়েছেন।

হোয়াইট হাউজ কেন প্রকাশ করেনি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এসব ছবি উল্টো হোয়াইট হাউজের বিজেই চলে যাবে। সবাই দুষবে তাদেরকেই।

আচমকই গ্যাব্রিয়েলের মধ্যে আশর ঝলক দেখা গেলো।

এসব যে সত্যি তা হোয়াইট হাউজ প্রমাণ করতে পারবে না!

তাকে দিয়ে সম্পর্কে কথাটা স্বীকার করিয়ে নেবার টেঞ্চের প্রস্তাবটা এবার সে ধরতে পারলো। হোয়াইট হাউজের দরকার গ্যাব্রিয়েলকে দিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করার। তানা হলে হবিগুলো মূল্যহীন হয়ে পড়বে। হঠাৎ করেই সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলো।

হয়তো টেঞ্চের বলা ঘুষ গ্রহণের সব কথাই মিথ্যা।

হাজার হোক, গ্যাব্রিয়েল তো দেখেছে ঐ সব ডকুমেন্ট, আর ছবিগুলো। তারও এতেও কিছু যায় আসে না– কিছু ব্যাংক ডকুমেন্টের জেরক্স কপি আর কতিপয় নোংরা ছবি। সবগুলোই সম্ভাবনাময় জালিয়াত। টেঞ্চ তাকে কৌশলে এসব দেখিয়ে বোঝাতে চেয়েছে যে সিনেটর একজন খারাপ লোক।

সেক্সটন নির্দোষ, গ্যাব্রিয়েল নিজেকে বললো। সব কিছুই এবার তার কাছে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো। তাকে চাপে ফেলে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় হোয়াইট হাউজ।

কেবল একটি ব্যাপার বাদে…

একমাত্র দ্বিধান্বিত ব্যাপার হলো গ্যাব্রিয়েলের কাছে টেঞ্চ নাসা বিরোধী ই-মেইল পাঠাতো। এটা হয়তো এজন্যে যে, এভাবে সেক্সটনকে নাসা-বিরোধী অবস্থানে এনে পুরো ব্যাপারটা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। অথবা অন্য কিছু কি?

ই-মেইলগুলো যদি টেষের কাছ থেকে না এসে থাকে তবে কি হবে?

এটা সম্ভব যে, স্টাফদের মধ্যে একজন এ কাজটা করেছে, টেঞ্চ তাকে ধরে ফেলে বরখাস্ত করেছে এবং নিজেই শেষ ই-মেইলটা পাঠিয়েছে গ্যাব্রিয়েলকে মিটিংয়ে ডাকার জন্য। টেঞ্চ হয়তো এমন ভান করে থাকবে যে, সে-ই নাসা-বিরোধী ডাটাগুলো দিয়ে একটা উদ্দেশ্য হাসিল কযুতে চেয়েছে- গ্যাব্রিয়েলকে ছুটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।

ট্রেনটা গন্তব্যে থেমে গেলে সব দরজা খুলে গেলো।

এনভেলপটা হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে তার নতুন গন্তব্যের দিকে গ্যাব্রিয়েল ছুটতে কাগলো।

ওয়েস্টব্রুক এপার্টমেন্টে।

৫১

লড়াই না হয় পালাই।

একজন বায়োলজিস্ট হিসেবে টোল্যান্ড জানে কোনো প্রাণী যখন বিপদের গন্ধ টের পায় তখন তার শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডে বিশাল পরিবর্তন ঘটে। এড্রেনালাইন প্রবাহিত হয় সেরেবাল কর্টেক্সের দিকে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় আর মস্তিষ্ক একটি পুরনো এবং স্বজ্ঞাপূর্ণ নির্দেশ পঠায়– হয় যুদ্ধ করো না হয় পালাও।

টোল্যান্ডের স্বজ্ঞ বলছে পালাতে, তারপরও নোরাকে ফেলে রেখে যেতে চাচ্ছে না সে। অবশ্য এখানে পালানোরও কোনো জায়গা নেই। একমাত্র সুকানোর জায়গা হলো দূরের ঐ হ্যাবিস্ফেয়ারটা। তাদের আক্রমণকারী, তারা যে-ই হোক না কেন, হিমবাহের ঢালুর ওপরেই অবস্থান নিয়েছে। এজনে, হ্যাবিস্ফেয়ারে দৌড়ে চলে যাওয়াটার কথা বাদ দিতে হচ্ছে। তার পেছনে বিশাল সমতল বরফভূমি দুই মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, সেদিকে যাওয়া মানে নির্ঘাত লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া।

বরফের গুলিগুলো অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে, সেগুলো লাগছে উল্টে পড়ে থাকা যন্ত্রপাতি বোঝাই ডেল্টাতে গিয়ে। টোল্যান্ড সেই অবস্থায়ই গড়িয়ে রাচেলের কাছে চলে এলো। সে যন্ত্রপাতির গাদা থেকে কোনো অস্ত্র আছে কিনা হাতড়ে দেখলো। কোনো ফ্লেয়ার বন্দুক, রেডিও … যাইহোক।

“পালাও!” রাচেল ছিকার করে বললো। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেনো।

তারপর, আচমকাই বরফের বুলেট ছোঁড়া বন্ধ হয়ে গেলো। ঝড়ো বাতাসের মধ্যেও রাতটা হঠাৎ করেই নিরব-নিথর হয়ে উঠলো …যেনো ঝড়টা অপ্রত্যাশিতভাবেই গুটিয়ে গেছে।

ঠিক তখনই, স্লেডের আড়াল থেকে টোল্যান্ড সতর্কভাবে চারপাশটা তাকাতেই তার জীবনের সবচাইতে ভীতিকর দৃশ্যটা দেখতে পেলো।

অন্ধকার থেকে আলোর বৃত্তের মধ্যে তিনটি ভূতুরে শরীর আবির্ভূত হলো। নিরবে স্কি করে এসে থামলো সেগুলো। পুরোপুরি সাদা সুট পরা। তাদের হাতে কোনো স্কি-পোল নেই, বরং ধরা আছে বড়সড় রাইফেল যেটাকে বন্দুকের মতো লাগছে না। এরকম জিনিস টোল্যান্ড কখনও দেখেনি। তাদের স্কিগুলোও অদ্ভুত। অত্যাধুনিক এবং অপেক্ষাকৃত ছোট।

শান্তভাবে, যেন তারা জেনে গেছে যুদ্ধটাতে বিজয়ী হয়েছে, অচেতন শিকার নোরা ম্যাঙ্গোরের সামনে এসে থামলো তারা। টোল্যান্ড একটু উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের দিকে তাকালো। আক্রমণকারীও তাকে দেখে ফেললো অদ্ভুত ইলেক্ট্রনিক চশমা দিয়ে। তাদেরকে এ ব্যাপারে আগ্রহী বলে মনে হলো না, অনন্তপক্ষে ক্ষণিকের জন্য হলেও।

ডেল্টা-ওয়ান তার সামনে অচেতন পড়ে থাকা মহিলাকে দেখে মোটেই অনুশোচনা বোধ করলো না। সে আদেশ পালন করার জন্য প্রশিক্ষিত, এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করার জন্য নয়।

মহিলা কালো থার্মাল সুট পরে আছে। তার নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসছে। আইএস রাইফেলটার গুলি লেগেছে তার।

এখন কাজ শেষ করার সময় এসেছে।

ডেল্টা-ওয়ান হাটু মুড়ে মহিলার পাশে বসে গেলো। তার সঙ্গের লোকেরা বাকিদেরকে টার্গেক করে রেখেছে– একজন লক্ষ্য করছে ছোটখাট এক লোককে যে পাশেই পড়ে রয়েছে, অন্য জন স্লেডের ওপাশে লুকিয়ে থাকা দু’জনকে কড়া নজরে রেখেছে। যদিও তার লোকেরা খুব সহজেই কাজটা শেষ করে ফেলতে পারে, কিন্তু বাকি তিনজন শিকার একেবারেই নিরস্ত্র আর কোথাও পালাতেও পারবে না তারা। ইচ্ছে করলেই তারা একসাথে সবাইকে খুন করতে পারে, কিন্তু আসল জাদুটা হলো, এমনভাবে তাদেরকে হত্যা করতে হবে যাতে তারা কীভাবে মারা গেছে তার কোনো চিহ্ন না থাকে।

ডেল্টা-ওয়ান মহিলার থার্মাল সুটটার মুখের অংশ খুলে ফেলে মহিলার মুখে এক মুঠো বরফ ঢুকিয়ে দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে রাখলো। গলায় ব্রফ আঁটকে সে তিন মিনিটের মধ্যেই মারা যাবে।

এই কৌশলটা রাশিয়ার মাফিয়ারা আবিষ্কার করেছিলো। এটাকে তারা বলে বাইলায়া স্মার্ত–সাদা মৃত্যু। বরফ তার নিঃশ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলবে, মৃত্যুর পর বরফ গলে গেলে কোনো প্রমাণই পাওয়া যাবে না নিহত ব্যক্তি কীভাবে মারা গেছে।

বাকি তিন জনকে পাকড়াও করে একইভাবে হত্যা করা হবে। তারপর ডেল্টা-ওয়ান সবাইকে সেড়ে তুলে দিয়ে সেটা কয়েক শত গজ দূরে ঠেলে দেবে। আর স্লেডের ছুটে চলে যাওয়া দাগগুলো তার বরফের উপর থেকে মুছে ফেলবে অনায়াসে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা বরফে জমে যাবে। মনে হবে তাদের মৃত্যু হয়েছে হাইপোথার্মিয়াতে মানে তীব্র ঠাণ্ডায়। তাদেরকে যারা খুঁজে পাবে, তারা তাদের মৃত্যু নিয়ে মোটেই অবাক হবে না।

এই মুহূর্তে ডেল্টা-ওয়ান স্লেডের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বাকি দুজনকে নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়।

.

মাইকেল টোল্যান্ড এইমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দেখলো, তার জীবনেও এমন বীসদৃশ্য সে দেখেনি। লোকটা এবার নোরা ম্যাঙ্গোরকে ফেলে কর্কি কাছে গেলো।

আমাকে কিছু একটা করতেই হবে।

কর্কি উঠে বসে গোঙাতে লাগলো। কিন্তু সৈনিকদের একজন তাকে ধাক্কা মেরে বরফে শুইয়ে দিলো। কর্কির হাত দুটোর উপর তারা হাঁটু চেপে বসে পড়লে কর্কি তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো, কিন্তু সেটা প্রচণ্ড বাতাসে হারিয়ে গেলো।

সুতীব্র আতংকে টোল্যান্ড ব্লেডের যন্ত্রপাতিতে কিছু খুঁজে বেড়ালো। এখানে কিছু না কিছু তো আছেই! একটা অস্ত্র! সেরকম কিছু! কিন্তু সেরকম কিছুই পেলো না। তার পাশে রাচেল উঠে বসার চেষ্টা করলো। “পালাও … মাইক…”

টোল্যান্ড তাকিয়ে দেখে রাচেলের হাতের কব্জির সাথে একটা কুড়াল লাগানো আছে ফিতা দিয়ে। এটা একটা অস্ত্র হতে পারে। টোল্যান্ড ভাবলো এটা দিয়ে তিন জন আক্রমণকারীর সাথে লড়াই করা যাবে কিনা।

আত্মহত্যা।

রাচেল উঠে বসলো। টোল্যান্ড তার পেছনে কী যেনো দেখছে। একটা মোটা-সোটা ভিনাইল ব্যাগ। মনে মনে প্রার্থনা করলে ওটাতে যেনো কোনো ফ্লেয়ার গান অথবা রেডিও থাকে। সে তাকে ডিঙিয়ে ব্যাগটা ছো মেরে নিয়ে নিলো। ভেতরে সে খুঁজে পেলো বিশাল ভাজ করা একটা মাইলার কাপড়ের টুকরো। মূল্যহীন। এটা এক ধরণের আবহাওয়া বেলুন। এটা বড়জোর একটা কম্পিউটারকে বহন করার মতো শক্তি রাখে, এর বেশি কিছু না। হিলিয়াম ছাড়া নোরার এই বেলুনটা একেবারেই কোনো কাজে আসবে না।

বাঁচার জন্য কর্কির আর্তনাদ আর ধস্তাধস্তিটা শুনছে টোল্যান্ড, কিন্তু নিরুপায় সে, কিছুই করতে পারছে না। একেবারেই অসহায়। টোল্যান্ডের চোখ বেলুনটার পাশে রাখা আরেকটা ব্যাগের দিকে গেলো। তার মাথায় একটা পরিকল্পনা এলো। যদিও তার এমন মোহগ্রস্ততা ছিল না যে, এই পরিকল্পনাটা তাদেরকে এ যাত্রা থেকে উদ্ধার করতে পারবে, তারপরও সে জীনে এখানে থাকলে তারা সবাই নিশ্চিত মরবে। সে ভাজ করা মাইলারটা ধরল। সেটাতে লেখা আছে সতর্ক বাণী : সাবধান: ১০ নটিক্যালের বেশি বাতাসে এটা ব্যবহার করা যাবে না।

সাবধানের নিকুচি করি! সেটাকে শক্ত করে ধরে টোল্যান্ড রাচেলের পাশে আসলো। রাচেল কিছুই বুঝতে পারছে না, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। খুব কাছে এসে টোল্যান্ড বললো, “এটা ধরো!”

টোল্যান্ড রাচেলের কাছে ভাঁজ করা কাপড়টা দিয়েই বেলুনের গিটটা খুলে দিলো। তারপরই গড়িয়ে রাচেলকে জড়িয়ে ধরলো।

টোল্যান্ড আর রাচেলের দেহ এক হয়ে গেলো।

নোরা মরে গেছে, টোল্যান্ড নিজেকে বললো। তার জন্য কিছুই করার নেই।

আক্রমণকারীরা এবার জোর করে ককির মুখে বরফ ঢুকিয়ে দিতে চাচ্ছে। টোল্যান্ড জানে তাদের সময় শেষ হয়ে আসছে।

টোল্যান্ড রাচেলের কাছ থেকে বেলুনটা নিয়ে শক্ত করে ধরলো। কাপড়টা একেবারে টিসু পেপারের মতো পাতলা– একেবারেই নাজুক মনে হচ্ছে।কিছুই হবে না। “ধরো।”

“মাইকা” রাচেল বললো, “কি

টোল্যান্ড ভাঁজ করা মাইলটা তাদের মাথার ওপর ছুঁড়ে মারলো খুলে ফেলার জন্য। প্রচণ্ড বাতাসে সেটা প্যারাসুটের মতো ফুলে ফেঁপে উঠলো।

টোল্যান্ড আসলে কাটাবাটিক ঝড়ের বাতাসকে হালকা করে দেখেছিলো। মুহূর্তের মধ্যেই সে আর রক্তল একটু শূন্যে উঠে গিয়ে আবার নিচে নেমে এলো। একটু বাদেই, টোল্যান্ড টের পেলো কর্কি মারলিনসনের সাথে যে পঁড়িটা বাঁধা ছিলো সেটা তাকে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে। বিশ গজ দূরে, তার ভীতসন্ত্রস্ত বন্ধু অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তিন জন আক্রমণকারীর একজন দড়িটার টানে পেছনের দিকে ঝুঁকে পড়লো। কর্কিও যখন টোল্যান্ড আর নাচেলের সঙ্গে সঙ্গে সবেগে ছুটে চলতে লাগলে সে একটা চিৎকার দিলো। দ্বিতীয় পঁড়িটা কৰ্কির পাশেই ছিলো, সেটা নোরা ম্যাঙ্গোরকে যুক্ত করেছে।

তিনটি মানুষের শরীর হিমবাহের ঢালু দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। বরফের গুলি ছুটে আসতে লাগলো তাদের দিকে, কিন্তু টোল্যান্ড জানে আক্রমণকারীরা সেই সুযোগ হারিয়েছে। তাদের পেছনে সাদা পোশাক পরা সৈনিকেরা অপসৃত হয়ে গেলো।

তাদের সামনে রয়েছে দুমাইলেরও কম দূরত্ব। মিলনে আইস শেল্ফটা শেষে গিয়ে থেমেছে আর্কটিক সাগরে- শেষ প্রান্তটি থেকে ১০০ ফুট নিচেই সাগর।

৫২

হোয়াইট হাউজের কমিউনিকেশন রুমের দিকে যাবার সময় মারজারি টেঞ্চ হাসছিল। গ্যাব্রিয়েল এ্যাশের সাথে মিটিংটা ভালই হয়েছে। যাই হোকনা কেন, গ্যাব্রিয়েল ভীত হয়ে এফিডেফিটে স্বাক্ষর করতে চায়নি।কিন্তু চেষ্টাটা দারুণ ছিল।

বেচারী মেয়েটার কোনো ধারণাই নেই সেক্সটনের পতনটা কত জলদি হতে যাচ্ছে।

কয়েক ঘন্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্টের সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, আর সেই সাথে। সেক্সটনেরও পতন রু হয়ে যাবে। গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ যদি সহযোগীতা করত, তবে সেটা সিনেটরের জন্য ধ্বংসাত্মক হত। সকালে টেঞ্চ গ্যাব্রিয়েলের এফিডেভিটা প্রকাশ করতে। পারত, সঙ্গে সেক্সটনের পূর্বের অস্বীকার করা ফুটেজটা সহকারে।

দু-দুটো ঘুষি।

হাজার হোক, রাজনীতি কেবল নির্বাচনে জেতার জন্য নয়। এটা হলো চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হওয়ার জন্য।

আদর্শগতভাবে, সিনেটরের প্রচারণা কাজটির ধ্বংস হবে পুরোপুরি– দুদিক থেকে আঘাতটা আসবে, রাজনীতি এবং তাঁর নীতির উপরে। এই কৌশলটাকে ওয়াশিটনে বলা হয় হাই-লো’ হিসেবে। সামরিক বাহিনীর যুদ্ধকৌশল থেকে এটা চুরি করা হয়েছে-শত্রুকে দুটো ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে বাধ্য করা। যখন একজন প্রার্থী তার প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক তথ্য পায় তখন অপেক্ষা করে দ্বিতীয় কোনো নেতিবাচক তথ্যের জন্য। একসাথে দুটো তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করে দিতে পারলেই সুব্বিা বেশি পাওয়া যায়।

আজ রাতে, সিনেটর সেক্সটন তার সবচাইতে বড় ইসু নাসা বিরোধীতা নিয়ে যারপর নাই বিপাকে পড়বেন। এটা হবে তার রাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন।

কমিউনিকেশন রুমের দরজার সামনে আসতেই টেখে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল লড়াই করার উত্তেজনায়। রাজনীতি হলো যুদ্ধ।সে গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো। ৬টা ১৫ বাজে।প্রথম গুলিটা ছোঁড়া হবে এখন।

সে ভেতরে ঢুকল।

কমিউনিকেশন অফিসটা ছোটখাট। এটা এ বিশ্বের সবচাইতে কার্যক্ষম গণ যোগাযোগ স্টেশন, যাতে কাজ করে মাত্র পাঁচজন কর্মচারী। এই মুহূর্তে, পাঁচ জনের সবাই মনিটরের সারির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো সাতারুরা গুলির শব্দের জন্য অপেক্ষা করছে।

তারা প্রস্তুত হয়ে গেছে, টে তাদের উদগ্রীব চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো।

সে সব সময়ই অবাক হয়ে ভাবে, এই ছোট্ট অফিসটা মাত্র দু’ঘন্টার প্রস্তুতি নিয়ে এই সভ দুনিয়ার একতৃতীয়াংশ লোকের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। এই পৃথিবীর প্রায় দশ হাজার সংবাদ উৎসের সাথে এই ঘরটার সংযোগ রয়েছে বিশাল টিভি নেটওয়ার্ক থেকে ছোট্ট শহরের সংবাদপত্র পর্যন্ত– হোয়াইট হাউজ কমিনিউকেশন রুমটা মাত্র একটা বোতাম টিপেই সারা দুনিয়ার কাছে পৌঁছে যেতে পারে।

একজন জেনারেল যেমন তার সৈন্যবাহিনী ইন্সপেকশনে যায় সেও তেমনি নিরবে ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা প্রিন্টার থেকে ফ্ল্যাশ রিলিজটা বের করে নিলো। এটা এখন লোড করা হয়েছে, যেনো সব বন্দুকে গুলি ভরা হয়েছে।

টেঞ্চ সেটা পড়ে নিজের মনেই হেসে উঠল। অন্যসব রিলিজের মত এটা তৈরি করা হয়নি। এটা যেনো কোনো ঘোষণা করার চেয়েও বিজ্ঞাপনের মতই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে। এই লেখাটা খুবই যথার্থ– মূল শব্দটি খুবই সমৃদ্ধ এবং বিষয়বস্তু লঘু। মারাত্মক সংমিশ্রণ এটি।

.

মারজারি টেঞ্চ কমিউনিকেশন রুমের চারদিক তাকিয়ে স্টাফদের দিকে চেয়ে প্রসন্ন একটি হাসি দিলো। তাদেরকে খুব উদগ্রীব দেখাচ্ছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে সে কিছু মুহূর্ত পার করলো। মনে মনে কী যেনো ভেবে নিলো। অবশেষে, সে দাঁত বের করে হাসলো। “আপনারা আপনাদের ইনজিন চালু করেন।”

৫৩

রাচেল সেক্সটনের মনে সব ধরণের যুক্তি বুদ্ধি উবে গেলো। তার মাথা থেকে উল্কাপিণ্ড, জিপিআর প্রিন্ট-আউটটার রহস্যময়তা, মিংয়ের মৃত্যু, ভয়ংকর আক্রমণের কথা, সবই উধাও হয়ে গেলো। কেক একটি মাত্র ব্যাপারই রয়েছে মাথায়।

বাঁচতে হবে।

তার নিচের বরফগুলো যেনো পিচ্ছিলো একটা মহাসড়ক হয়ে গেছে। তার শরীর অসাড় হবার জন্য নাকি ভারি সুটের জন্য সেটা সে জানে না কিন্তু তার কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না। তার কিছুই অনুভূত হচ্ছে না।

তবুও।

তার পাশেই, শরীরের সাথে শরীর লেগে জড়িয়ে আছে টোল্যান্ড। তাদের থেকে কিছুটা সামনেই, বেলুনটা মাটি ঘেষেই বাতাসে ফুলে ওঠে প্যারাসুটের মতো তাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কর্কি তাদের পেছনে পেছনে আসছে। তাদেরকে যেখানে আক্রমণ করা হয়েছিলো সেই জায়গার ফ্রেয়ারগুলো একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাদের নাইলনের সুট বরফের সাথে ঘষা লেগে হিসৃহিস্ করে শব্দ করছে। রাচেলের কোনো ধারণাই নেই কতো দ্রুতবেগে তারা। ছুটে চলেছে। কিন্তু বাতাসটা কমপক্ষে ঘন্টায় ষাট মাইল বেগে চলছে, আর তাদের নিচের বরফের যে রানওয়ে, সেটা এতোটাই পিচ্ছিলো যে প্রতি সেকেন্ডেই গতিটা বেড়ে যাচ্ছে। মাইলার বেলুনটা, মনে হচ্ছে ছিঁড়ে যাবার কিংবা ফেটে যাবার কোনো ইচ্ছাই সেটার নেই।

আমাদেরকে বেলুন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, রাচেল ভাবলো। তারা মারাত্মক গতিতে ছুটে যাচ্ছে এখন– সরাসরি সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রটা এখান থেকে এক মাইলেরও কম দূরে রয়েছে! বরফের পানি তার ভীতিকর স্মৃতিটা জাগিয়ে তুললো আবার।

.

বাতাস জোরে বইতে লাগলে তারাও দ্রুত ছুটতে শুরু করলো। তাদের একটু পেছনেই কর্কি তীব্র একটা আতংকে চিৎকার করে উঠল। এই গতিতে ছুটতে থাকলে রাচেল জানে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা হিমবাহের শেষ প্রান্তে এসে ছিটকে পড়বে একশ ফুট নিচে হিমশীতল সমুদ্রে।

টোল্যান্ডও মনে হলো একই কথা ভাবছে। সে বেলুনটা থেকে তাদের শরীরের যে সংযোগ সঁড়ি রয়েছে সেটা খুলে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলো।

“আমি এটা খুলতে পারছি না!” সে জোরে বললো। “খুব শক্ত করে লাগানো আছে!” রাচেল কিছুক্ষণের জন্য আশা করেছিল বাতাসে হয়তো দড়িটা ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু কাটাবাটিক ঝড় বিরামহীনভাবেই তাদেরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, দড়িটাও ছিঁড়ছে না। টোল্যান্ডকে সাহায্য করার জন্য রাচেল তার শরীর একটু গড়িয়ে পায়ের জুতোর ধারালো

স্পাইকরফে গেঁথে দিলো, এতে করে তাদের গতি কিছুটা কমে গেলো।

“এখন।” সে চিৎকার করে বললো, পা-টা উঠিয়ে ফেললো।

কিছুক্ষণের জন্য বেলুনের দড়িটা আলগা হয়ে গেলে এই সুযোগে টোল্যান্ড একটু বুকে দড়িটার সংযোগ ক্লিপ খুলে ফেলার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার ধারে কাছেও যেতে পারলো না সে।

“আবার কর!” সে চেঁচিয়ে বললো।

এবার তারা দু’জনেই নিজেদের পায়ের ধারালো স্পাইক ব্যবহার করলো বরফের উপরে। তাতে করে গতি একটু বেশি করেই কমে গেলো।

“এখনই!”

টোল্যান্ডের এই কথার সাথে তারা দুজনেই এক সঙ্গে পা উঠিয়ে ফেলতেই, হেচকা টানে বেলুনের একটু কাছে চলে গেলো। এবার টোল্যান্ড বেলুনের ক্লিপটা ধরতে পারলো। ক্লিপটা খুলে ফেলার চেষ্টা করলো সে। খুব কাছে আসা সত্ত্বেও আরেকটু আলগা করার দরকার হলো। এসব ক্লিপ এমনই যে, বেশি টান পড়লে সেগুলো খোলা যায় না, বরং আরো শক্ত করে লেগে থাকে। আলগা না করলে খোলাই মুশকিল।

শালার সেফটি ক্লিপের জন্যই বুঝি মরতে হবে। রাচেল ভাবলো।

“আরেকবার করো!” টোল্যান্ড বললো।

নিজের সমস্ত শক্তি আর আশা এক করে রাচেল যতটুকু সম্ভব নিজের শরীরটা বেঁকিয়ে দুপা দিয়ে বরফে আঘাত করলো যাতে জুতোর স্পাইকগুলো আটকে যায়। পায়ের গোড়ালীর। ওপর ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। টোল্যান্ডও তার মতো করলো। রাচেলের মনে হলো তার গোড়ালী বুঝি ভেঙে গুঁড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে।

“রাখো… রাখো …” তাদের গতি কমতেই টোল্যান্ড জোকার ক্লিপটা খুলে ফেললো। “হয়ে গেছে …”

রাচেল আচমকা একটা ধাক্কা খেলো। বেলুনটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লে রাচেল আর টোল্যান্ডও সঙ্গে সঙ্গে একপাশে ঝুঁকে পড়লো, এর ফলে টোল্যান্ডের হাত থেকে ক্লিপটা ছুটে গেলো।

“ধ্যাত!”

মাইলার বেলুনটা যেনো রেগে গেছে, তার গতি আরো বেড়েছে, তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে হিমবাহ থেকে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রাচেল জানে হিমবাহের শেষ মাথায় তারা খুব জলদিই পৌঁছে যাবে। এখন যদি থামতে না পারে তবে তারা শত ফুট উঁচু থেকে বিপজ্জনক সমুদ্রে গিয়ে পড়বে। আর্কটিক সাগরে। তাদের পথের সামনে তিনটি বরফের ঢিবি দাঁড়িয়ে আছে। মোটা প্যাডের মার্ক-দশ সুট পরা সত্ত্বেও এরকম গতিতে ফের খাড়া ঢিবির সাথে সংঘর্ষ হলে ভয়ংকর ব্যাপার হবে।

রাচেল চেষ্টা করলো বেলুন থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নিতে। ঠিক তখনই সে একটা (বইতে বাক্য সম্পূর্ণ করা নেই)

ভয়ের চোটে তার কোমরের বেল্টের সাথে লাগানো কুড়ালটার কথা রাকল ভুলেই। গিয়েছিলো। বেলুনটার সাথে তারা যে দড়িটা দিয়ে বাঁধা সেটা পাতলা নাইলনের। রাচেল বুঝতে পারলো উপায় একটা পাওয়া গেছে। কুড়ালটা নিয়ে রাজ দড়িটা কাটতে চেষ্টা কলো।

“হ্যাঁ!” টোল্যান্ড চিৎকার করে বললো। নিজের কুড়ালটা কোমর থেকে নেবার চেষ্টা কালো।

দু’এক কোপেই তারা দুজনে দড়িটা কেটে ফেলতে সক্ষম হলো। ঈড়িগুলো শূন্যে উড়ে গেলো যেনো।।

আমরা পেরেছি, রাচেল ভাবলো।

সে তাকিয়ে দেখলো সামনেই টিবিটা।

এসে গেছে।

সাদা দেয়ালের মতো খাঁড়া টিবিটার সঙ্গে তাদের প্রচওজোরে ধাক্কা লাগলো। রাচেলের পেট আর পিঠের একপাশে আঘাত লাগলো। আঘাতের চোটে হারে কুড়ালটা ছিটকে পড়ে গেলো। ঢিবিটা বরফের, তাই ওটা ভেঙে তারা দুজনেই সামনের দিকে ছিটকে পড়লো।কিন্তু তাদের সামনে আরো দুটো টিবি রয়েছে। তারপরই শেষ প্রান্ত–নিসমুদ্র।

পেছনে করি তীব্র আর্তনাদে রাচেলের কানে তালা লাগবার যোগাড় হলো। তাদের পেছনে একটা বরফের ঢিবি গড়িয়ে তাদের ওপরেই পড়তে যাচ্ছে।

রালে তাকিয়ে দেখলো বরফের ধ্বস তার দিকেই তেড়ে আসছে। ফের উড়ে মানুষের শরীর সব একাকার হয়ে গেলো। বরফ ধসে গিয়ে তাদের ওপর আছড়ে পড়লো। সেই অবস্থায়ই পরবর্তী টিবিটার সাথে আঘাত যাতে না লাগে, মচেল তার হাত-পা ছড় দিলো, যাতে গতি একটু কমে গিয়ে আঘাতটা লাগে। কিন্তু সামনের টিবিটাতে আঘাত লাগার সময় ওটা সহ তারা শেষ প্রান্তের দিকে গিয়ে পড়লো। টিবিটা ধ্বসে গেছে। আর মাত্র আশি ফুট বাকি আছে মিলনে হিমবাহের।

যতোই তারা শেষ প্রান্তের দিকে যেতে লাগলো রাচেলের মনে হলে তারা নিচের দিকেই আস্তে আস্তে পড়ে যাচ্ছে। সে জানে খুব বেশি দেরি হয়ে গেছে।হিমবাহের শেষপ্রান্তটি যেনো তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। রাচেল অসহায়ের মতো একটা আর্তনাদ করে উঠলো।

তারপরই সেটা ঘটলো।

তাদের নিচের বরফের জমিনটা সরে গেলো। শেষ যে জিনিসটা রাকেলের মনে আছে তা হলো, তারা নিচে পড়ে যাচ্ছে।

৫৪

ওয়েস্ট ব্রুক এপার্টমেন্টটা ২২০১ এন স্টৃটে অবস্থিত। গ্যাব্রিয়েল দ্রুত রিললভিং দরজাটা ঠেলে লবিতে একেরলো। সেখানে একটা কৃত্রিম ঝরণা রয়েছে।

ডেস্কে বসা প্রহরী তাকে দেখে খুবই অবাক হলো। “মিস অ্যাশ? আমি জানতাম না আজ রাতে আপনি আসবেন।”

“আমার একটু দেরি হয়ে গেছে।” গ্যাব্রিয়েল খুব দ্রুত বলে ছুটতে লাগলো। মাথার

ওপরে একটা ঘড়ির দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে নিলো সময়টা। ৬টা ২২ মিনিট।

প্রহরী মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “সিনেটর আমাকে একটা তালিকা দিয়েছেন, সেখানে কিন্তু আপনার নামটি–”।

“তারা সব সময়ই সেই সব লোকদের কথা ভুলে যায় যারা তাদেরকে সাহায্য করে থাকে।” সে তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে লিফটের দিকে ছুটে গেলো।

এবার প্রহরী একটু অস্বস্তি বোধ করলো। “ভালো হয় আমি তাকে ফোন করে দেখি।”

ধন্যবাদ, গ্যাব্রিয়েল লিফটের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো। বোকা, সিনেটরের ফোনটা বন্ধ আছে।

দশ তলায় উঠেই গ্যাব্রিয়েল অভিজাত হলোওয়ে দিয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলো। সিনেটরের দরজার সামনে সে দেখতে পেলো মোটাসোটা গার্ডকে– বিশাল দেহরক্ষী– বসে আছে। তাকে খুব বিরক্ত মনে হচ্ছে। গার্ড তাকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো।

“আমি জানি, গ্যাব্রিয়েল বললো। “এটা ব্যক্তিগত মিটিংয়ের সময়। সে চায় না কেউ তাকে বিরক্ত করুক।”

গার্ড দরজাটার সামনে এসে বাধা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। “তিনি ব্যক্তিগত একটা মিটিংএ আছেন।”

“সত্যি?” গ্যাব্রিয়েল লাল রঙের এনভেলপটা বের করে হোয়াইট হাউজের সিলটা তুলে ধরলো লোকটার চোখের সামনে। “আমি এইমাত্র ওভাল অফিস থেকে এসেছি। এই খবরটা সিনেটরকে এখনই দেয়া দরকার। তার যতো পুরনো দোস্তই আজকের আড্ডায় থাকুক না কেন, কয়েক মিনিটের জন্য তাকে আমার সময় দিতেই হবে। এখন, আমাকে যেতে দাও।”

এটা আমাকে খুলতে বল না যেনো, গ্যাব্রিয়েল ভাবলো।

“ফোল্ডারটা রেখে যান, সে বললো। আমি তাঁকে এটা দিয়ে দেবো।”

“আরে বলো কী। হোয়াইট হাউজের সরাসরি নির্দেশ রয়েছে এটা তার হাতে দিতে হবে। তাঁর সঙ্গে যদি এখনই আমি কথা বলতে না পারি, তবে আগামীকাল আমাদের সবাইকে নতুন চাকরি খুঁজতে হবে। তুমি বুঝেছো?”

গার্ড দ্বিধাগ্রস্ত হলো বলে মনে হলো। গ্যাব্রিয়েল আঁচ করতে পারলো সিনেটর তাকে কতো কড়াকরিভাবে নির্দেশটা দিয়েছেন। গ্যাব্রিয়েল গার্ডের কানের কাছে এসে নিচু স্বরে মাত্র ছয়টি শব্দ বললো, যা ওয়াশিংটনের সব সিকিউরিটিদের কাছেই ভীতিকর একটি কথা।

“তুমি পরিস্থিতিটা ঠিক মতো বুঝতে পারছে না।” রাজনীতিকদের নিরাপত্তা রক্ষীরা কখনই পরিস্থিতি বুঝতে পারে না। তারা এটাকে ঘৃণা করে। তারা বন্দুক-পিস্তল নিয়ে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে, এসব বোঝারও কোনো দরকার নেই তাদের।

গার্ড হোয়াইট হাউজের সিলটার দিকে আবারো তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো। “ঠিক আছে, আমি সিনেটরকে বলবো আপনি ভেতরে আসতে চাচ্ছিলেন।”

সে দরজাটা খুলতেই গ্যাব্রিয়েল তাকে ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকে গেলো। এপার্টমেন্টের ভেতরে ঢুকেই গ্যাব্রিয়েল দরজাটা লাগিয়ে দিলো।

.

ফয়ার’র কাছে আসতেই হলঘর থেকে ভেসে আসা সিনেটরের কথাবার্তার শব্দ পাওয়া গেলো– পুরুষ মানুষের কণ্ঠস্বর। গ্যাব্রিয়েল এপার্টমেন্টের আরো ভেতরে যেতেই দেখতে পেলো ক্লোসেটে আধ ডজন দামি কোট ঝোলানো আর কয়েকটি বৃফকেসও ফ্লোরে রাখা। একটা বৃফকেসের দিকে গ্যাব্রিয়েলের চোখ আঁটকে গেলো। সেটাতে বিখ্যাত একটি কোম্পানির লোগো লাগানো আছে। লাল রঙের একটা রকেটের ছবি।

সে থেমে গিয়ে হাটু গেঁড়ে সেটা পড়ে নিলো।

স্পেস আমেরিম, ইনকর্পোরেশন।

হতভম্ব হয়ে সে অন্য বৃফকেসগুলোও ভালো করে দেখলো।

বিইএল অ্যারো স্পেস। মাইক্রোকসমস, ইনকর্পোরেশন। বোটারি রকেট কোম্পানি। কাইস্টলার এ্যারোস্পেস।

মারজোরি টেঞ্চের রুক্ষ্ম কণ্ঠস্বরটা প্রতিধ্বনিত। তুমি কি জানো, সেক্সটন প্রাইভেট এ্যারোস্পেস কোম্পানি থেকে ঘুষ নিয়েছে?

গ্যাব্রিয়েলের নাড়ি স্পন্দন বেড়ে গেলো। সে জানে তার এখন ডাক দেয়ার দরকার, উপস্থিতিটা জানানোর জন্য কিন্তু তারপরও সে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলো। সে একেবারে নিরবে একটা ছায়া ঢাকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো … কথাবার্তাগুলো শুনতে লাগলো চুপিচুপি।

৫৫

ডেল্টা-থৃ যখন নোরা ম্যাঙ্গোরের মৃতদেহ এবং ডেল্টা জড়ো করছিলো তখন বাকি দুজন সৈনিক হিমবাহ দিয়ে সবেগে নেমে গেলো তাদের শিকারদের ধাওয়া করার জন্য।

তাদের পায়ে লাগানো আছে ইলেক্ট্রো স্ট্রিড পাওয়ার স্কি। এটা এক ধরনের তুষাড় গাড়ির মতো। যা পায়ে পরা হয়। পায়ের বুড়ো আঙুলের চাপে এর গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। শক্তিশালী জেল ব্যাটারিতে এটা চলে।

ডেল্টা-ওয়ান একটু হাটু মুড়ে সামনের দিকে ভালো করে তাকালো। মেরিনদের ব্যবহার করা প্যাট্রিয়ট মডেলের চেয়ে তাদের ব্যবহার করা নাইট-ভিশনটা অনেক বেশি আধুনিক। এটা দিয়ে কেবল রাতেই দেখা যায় না, বরং বহু দূরের বস্তুকেও দেখা যায়। এই জিনিস দিয়ে চার পাশের দৃশ্যগুলো হালকা সবুজ রঙের আভায় দেখা যায়।

প্রথম ঢিবিটার দিকে পৌঁছতেই, ডেল্টা-ওয়ান দেখতে পেলো তুষাড়ের মধ্যে মানুষের টেনে হিঁচড়ে যাওয়ার ছাপ। চারপাশটা দেখে তার মনে হলো ঐ তিন জন অবশ্যই নিচের সমুদ্রে পড়ে গেছে। এছাড়া আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ডেল্টা-ওয়ান জানে তার শিকারদের পরে থাকা সুরক্ষাকারী সুটের কারণে তারা অন্য কারোর চেয়ে অনেক বেশি সময় এই বরফের সমুদ্রে বেঁচে থাকবে। কিন্তু প্রবল স্রোত তাদেরকে টেনে নিয়ে যাবে বহু দূরে। ডুবে যাওয়াটা কোনোভাবেই এড়ানো যাবে না।

তার আত্মবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও, ডেল্টা-ওয়ান কখনও অনুমাণ করার জন্য প্রশিক্ষিত হয়নি। তার দরকার মৃতদেহগুলো দেখার। সে আরো জোরে ছুটতে লাগলো সামনের দিকে। ঢিবিটা অনায়াসেই ডিঙিয়ে গেলো সে। মাইকেল টোল্যান্ড নিশ্চল পড়ে রয়েছে, দুমড়ে-মুচড়ে গেছে তার শরীরটা। কিন্তু সে টের পেলো তার কোনো হাড় ভাঙেনি। মার্ক-দশ সুটের ভেতরে থাকা জেলের জন্য যে আঘাতের। হাত থেকে সে বেঁচে গেছে সে সম্পর্কে তার খুব কমই সন্দেহ রইলো। চোখ খুলতেই তার চিন্তাভাবনাসমূহ ধাতস্থ হতে শুরু করলো। এখানে সব কিছুই নরম মনে হচ্ছে … চুপচাপও। বাতাসটা এখনও গর্জন করছে, কিন্তু ভয়ংকর ভাবটা আগের চেয়ে কম।

আমরা শেষপ্রান্ত অতিক্রম করে ফেলেছি– তাই নয় কি?

ভালো করে খেয়াল করতেই টোল্যান্ড বুঝতে পারলো সে বরফের ওপর শুয়ে আছে। তার নিচে রাচেল সেক্সটন চাপা পড়ে রয়েছে। সে তার নিঃশ্বাসটা টের পেলো। কিন্তু সে রাচেলের মুখটা দেখতে পারছে না। তার ওপর থেকে গড়িয়ে নেমে গেলো সে, তার মাংসপেশীগুলো যেনো অসাড় হয়ে গেছে।

“রাচেল …?” টোল্যান্ড নিশ্চিত হতে পারলো না তার ঠোঁটটা কোনো শব্দ তৈরি করতে পারছে কিনা।

টোল্যান্ডের মনে পড়ে গেলো পড়ে যাবার আগ মুহূর্তের কথাটি। বরফ পিছলে তারা তিন জন নিচে পড়ে গেলো, কিন্তু তাদের পতিত হবার সময়টা অদ্ভুতভাবেই সংক্ষিপ্ত ছিল। তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তারা সমুদ্রে না প’ড়ে পড়লো মাত্র দশ ফুট নিচের আরেকখণ্ড বরফের উপর। কর্কি পড়ে আছে তার পায়ের কাছেই।

এবার, মাথাটা একটু তুলে টোল্যান্ড সমুদ্রের দিকে তাকালো। খুব বেশি দূরে নয়, শান্ত ভাবে, যেনো তারা জেনে গেছে যুদ্ধটাতে বিজয়ী হয়েছে, অচেতন শিকার নোরা ম্যাঙ্গোরের সামনে এসে থামলো তারা। টোল্যান্ড একটু উঠে দাঁড়িয়ে আক্রমণকারীদের দিকে তাকালো। আক্রমণকারীও তাকে দেখে ফেললো অদ্ভুত ইলেক্ট্রনিক চশমা দিয়ে। তাদেরকে এ ব্যাপারে আগ্রহী বলে মনে হলো না, অন্ততপক্ষে ক্ষণিকের জন্য হলেও।

শেষ ধাপটির নিচে ছোট্ট একটা ধাপ রয়েছে, দশ ফুট নিচেই। সৌভাগ্যবশত তারা সেখানেই পড়েছে। এই অংশটা সমতল, একটা হকি খেলার মাঠের আয়তনের মতো। এটার কিছু অংশ ধ্বসে পড়েছে সমুদ্রে, আর বাকি অংশটাও যেকোন সময়ে সমুদ্রে পড়ে যেতে পারে।

টোল্যান্ড বরফের সমতল অংশটার দিকে তাকালো। এর তিন দিকেই রয়েছে সমুদ্র।

যেনো এটা হিমবাহের একটি বেলকনি। এটার একটা প্রান্তই হিমবাহের সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। টোল্যান্ড দেখতে পেলো হিমবাহের সাথে সংযোগের স্থানটি আর যাইহোক স্থায়ী নয়, মজবুতও নয়।

টোল্যান্ড উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো, কিন্তু তার সাথে এখনও রাচেলের দড়ি দিয়ে বাধা আছে। সে দড়িটা খুলে ফেললো।

রাচেল উঠে বসতে চেষ্টা করলো। তাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আমরা এখানে .. পড়ে যাইনি?” তার চোখে বিস্ময়।

“আমরা বরফের একটু নিচের ব্লকে পড়েছি,” টোল্যান্ড বললো। “কর্কিকে আমার সাহায্য করতে হবে।”

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় টোল্যান্ড দাঁড়াবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পায়ে শক্তি পেলো না। সে দড়িটা ধরে টান দিতেই কর্কি তার দিকে সরে এলো। বার কয়েক এভাবে টানার পর কর্কি তাদের কাছে এসে পড়লো। সে ছিলো একেবারে শেষপ্রান্তে। সমুদ্রে যাতে গড়িয়ে না পড়ে যায়, তাই তাকে টেনে আনা হলো একটু নিরাপদে।

কর্কি মারলিনসনকে বিধ্বস্ত দেখালো। তার গগলসটা হারিয়ে গেছে। ঠোঁটের কাছে একটু কেটেও গেছে তার। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। কর্কি একটু উঠে বসে টোল্যান্ডের দিকে রেগেমেগে তাকালো।

“যিশু,” সে আর্তনাদ করলো। এসবের মানে কি?”

টোল্যান্ড একটু স্বস্তি পেলো।

রাচেল উঠে বসে চোখ কচলাচ্ছে এখন। সে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। “এখান থেকে আমাদেরকে স’রে পড়তে হবে। এই বরফের অংশটা পড়ে যাবে।”

টোল্যান্ডও একমত হলো। একমাত্র প্রশ্ন হলো কখন পড়বে।

.

সমস্যা সমাধান করার কোনো সুযোগই তারা পেলো না। একটা যন্ত্রের শব্দ হিমবাহের ওপর থেকে ভেসে এলো। টোল্যান্ড উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সাদা পোশাক পরা স্কি চালিয়ে দু’জন লোক ওখানে এসে থেমেছে। দু’জনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো, যেনো কোনো শিকার খুন করার আগে শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে।

.

ডেল্টা-ওয়ান তার তিন জন শিকারকে জীবিত দেখে অবাকই হলো। যদিও সে বুঝতে পারলো তাদের এ অবস্থাটা খুবই সাময়িক। তারা হিমবাহের শেষপ্রান্তের দশ ফুট নিচে একটা ছোট অংশের ওপর পড়েছে। সেটা যেকোন সময়েই ভেঙে নিচে পড়ে যাবে। এদেরকে এখনই হত্যা করা যেতে পারে, কিন্তু তার চেয়ে খুব বেশি সুন্দর হবে অন্যভাবে কাজটা করতে পারলে। এমন একটি পথে, যাতে করে কোনো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ডেল্টা-ওয়ান আবারো তাকালো নিচের দিকে। যেকোনদিন নিচের ধাপটা ধ্বসে পড়বে গহীন আর বন্য সমুদ্রে।

তাহলে এখন নয় কেন..

এখানে কিছুক্ষণ পর পরই বিশাল বিশাল বরফ খণ্ড ধ্বসে পড়ে সমুদ্র। তাহলে এ রকম শব্দ কে আর খেয়াল করবে আলাদা করে?

খুন করার আগে তার যেরকম অদ্ভুত উত্তেজনা লাগে, সেরকমই লাগছে এখন। ডেল্টা ওয়ান তার পকেট থেকে একটা লেবু-আকৃতির বস্তু বের করলো। এটা হলো এক ধরণের নিরীহ গ্রেনেড। নিরীহ এজন্যে যে, এটাতে কেবল তীব্র আলো আর প্রচণ্ড শক্তির ওয়েভ তৈরি হয়, শত্রুকে ক্ষণিকের জন্য হতবিহ্বল করার জন্য। আজ অবশ্য, জিনিসটা নিরীহ থাকবে না। এটা হবে ভয়ংকর।

সে নিচের দিকে তাকিয়ে একটু দেখে নিলো। তারপর ডেল্টা-ওয়ান গ্রেনেডে দশ সেকেন্ডের সময় ঠিক করে দিয়ে সেটার সেফটি পিন খুলে নিচে ছুঁড়ে মারলো।

তারপর ডেল্টা-ওয়ান এবং তার সঙ্গী দৌড়ে গিয়ে একটা ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

এমন বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থায় থাকার পরও রাচেল সেক্সটন ঠিকই বুঝতে পারলো আক্রমণকারীরা কি ছুঁড়ে মেরেছে এখানে। মাইকেল টোল্যান্ড বুঝতে পেরেছে কিনা সেটা রাচেল বুঝতে পারলো না, কিন্তু সে তার চোখে বিপদের আভাটা টের পেলো।

যেনো তীব্র একটা আলোতে রাচেলের পায়ের নিচের বরফটা প্রচণ্ড আলোতে জ্বলে উঠলো। তাদের চার পাশে একশ গজের মত বৃত্তে তীব্র আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। এরপরই কান ফাটা শকওয়েভ ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।

সঙ্গে সঙ্গে তারা যে বরফের টুকরোটার ওপরে আছে সেটা কেঁপে ওঠে মটমট করে শব্দ হতে লাগলো। কোনো কিছু যেনো ভেঙে পড়ছে। রাচেল টোল্যান্ডের দিকে ভীত চোখে তাকালো। কাছেই, কর্কি তীব্র একটা আর্তনাদ করে উঠলো।

বরফের অংশটা নিচে পড়তে লাগলো।

কয়েক মুহূর্তের জন্য রাচেলের নিজেকে ওজনহীন মনে হলো। কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের বরফের ব্লকটি যেনো শূন্যে ভাসছে। তারপরই, তারা যেনো একটী হিমশৈলের উপর চড়ে বসলো– একটা হিমশীতল সমুদ্রে।

৫৬

বরফ ধ্বসে পড়ার প্রচণ্ড শব্দে রাচেলের কানে তালা লেগে গেলো। বরফের বিশাল খণ্ডটি সমুদ্রের পানিতে পড়ার সাথে সাথে রাচেলের শরীরটা, সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য শূন্যে ভেসে ছিল, বরফের উপর আছড়ে পড়লে খুব কাছেই টোল্যান্ড আর কর্কিও তীব্রভাবে বরফের ওপর আঁছড়ে পড়লো।

বরফের বিশাল ব্লকটা সমুদ্রের পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পানি কয়েক ফুট উঠে গেলো। উঠছে .. উঠছে… তারপর আবার নেমে গেলো। তার শৈশবের দুঃস্বপ্নটা ফিরে এলো। বরফ… পানি… অন্ধকার।

বরফ খণ্ডটির চারপাশ পানিতে একটু ডুবে গিয়ে আবার উপরে উঠে এলো।

রাচেলের চারপাশে সমুদ্রের পানি এসে লাগতেই তার মনে হলো লবণ পানিটা যেনো তার গায়ের চামড়া পুড়িয়ে ফেলছে। তার নিচের বরফের জমিনটা উধাও হয়ে গেলো। রাচেলের সুটটা বয়ার মতো কাজ করলো, তাকে ভাসিয়ে দিলো। তার মুখে কিছু লবণ পানি। ঢুকে গেছে। রাচেল দেখলো টোল্যান্ড আর করি অবস্থাও একই রকম। টোল্যান্ড তাকে চিৎকার করে বললো।

“এটা আবার জেগে উঠছে!”

বরফের খণ্ডটি যেনো ধীরে ধীরে জেগে উঠছে পানির নিচ থেকে অন্ধকারের মধ্যে। রাচেলেরও মনে হলো সে উপরে উঠে আসছে। উঠে আসার সাথে সাথে বরফ খণ্ডের উপরের পানি গড়িয়ে নিচে পড়তে শুরু করলে রাচেলও সেই স্রোতের টানে চলে যেতে লাগলো। রাচেল দেখতে পেলো সে বরফ খণ্ডের একেবারে প্রান্তসীমায় এসে পড়েছে। সমুদ্রে পড়ে যাচ্ছে সে।

ধর! রাচেলের মা তার শৈশবের সেই ডুবে যাওয়ার ঘটনার সময় ঠিক এভাবেই বলেছিলো। ধরো! নিচে চলে যেও না!

সে দেখতে পেলো দশ ফুট দূরে কর্কির শরীরটা পড়ে আছে, তার সাথে এখনও একটা দড়ি দিয়ে বাধা আছে। পানির স্রোতের টানে যে-ই রাচেল পিছলে বরফ খণ্ড থেকে সমুদ্রে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই কর্কির পাশ থেকে আরেকটি গাঢ় কালো ছায়া আবির্ভূত হলো। সে হাটু গেঁড়ে কর্কির সঁড়িটা ধরে টান দিতেই নোনাজলের কারণে সে বমি করে ফেললো।

মাইকেল টোল্যান্ড।

রাচেল চুপচাপ পড়ে থেকে সমুদ্রের গর্জন শুনলো। তারপর তীব্র ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়াতে কোনো রকম হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে চেষ্টা করলো।

হিমবাহের ওপরে, ডেল্টা-ওয়ান নাইট-ভিশন গগল্স দিয়ে নিচের সমুদ্রের এইমাত্র জন্ম নেয়া হিমশৈলের দিকে তাকালো। যদিও সে পানিতে কোনো মানুষের শরীর দেখতে পেলো না, তারপরও সে মোটেও বিস্মিত হলো না। সমুদ্রটা অন্ধকারে কালো দেখাচ্ছে আর তার শিকারদের পোশাকটা কালো রঙেরই।

ভাসমান বিশাল বরফ খণ্ডটির দিকে সে কোনোভাবেই ফোকাস করতে পারলো না। সেটা খুব দ্রুত সমুদ্রের প্রবল স্রোতের টানে দূরে সরে যাচ্ছে। সে চোখটা সরাতেই একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখতে পেলে। বরফ খণ্ডটির উপর তিনটি কালো বিন্দু। এগুলো কি তাদের দেহ? ডেল্টা-ওয়ান সেগুলো তার ফোকাসে আনার চেষ্টা করলো।

“কিছু দেখেছো কি?” ডেল্টা-টু জিজ্ঞেস করলো।

ডেল্টা-ওয়ান কিছুই বললো না। সে ফোকাস করতেই থাকলো। ভাসমান বরফ খণ্ডটির ওপরে তিন জন মানুষের শরীর দেখে সে বিস্মিত হলো। তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে সে ব্যাপারে ডেল্টা-ওয়ানের কোনো ধারণাই নেই। তাতে কীইবা এসে যায়। তারা যদি বেঁচেও থাকে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নির্ঘাত মারা যাবে। তারা ভিজে গেছে। ঝড় ধেয়ে আসছে, আর তারা ভেসে বেড়াচ্ছে এই গ্রহের সবচাইতে বিপজ্জনক এবং মারাত্মক এক সাগরে। তাদের মৃতদেহ কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

“কেবল ছায়া, ডেল্টা-ওয়ান তার সঙ্গীর দিকে ঘুরে বললো, “ঘাঁটিতে ফিরে চলো।”

৫৭

সিনেটর সেক্সটন তার ওয়েস্টব্রুক এপার্টমেন্টের ফায়ার প্লেসের সামনে বসে আছেন। নিজের চিন্তাভাবনাসমূহ একটু জড়ো করে নিচ্ছেন। তার পাশেই বসে আছে ছয় জন লোক, নিরবে … অপেক্ষা করছে তারা। সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে। এখন সময় এসেছে সিনেটর সেক্সটনকে তাঁর উদ্দেশ্যটা খুলে বলার। তারা সেটা জানে। তিনিও সেটা জানেন।

রাজনীতি হলো বেচা-বিক্রির ব্যাপার।

আস্থা স্থাপন করা। তাদেরকে জানতে দাও যে, তুমি তাদের সমস্যাটা বুঝতে পেরেছে।

“আপনারা তো জানেনই,” সেক্সটন তাদের দিকে ফিরে বললেন। “বিগত কয়েক মাস ধরেই আপনাদের মত অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাত করেছি।” তিনি হেসে বসে পড়লেন। তাদের কাতারে নিজেকে নিয়ে গেলেন। “আপনাদেরই কেবল আমি আমার বাড়িতে নিয়ে। এসেছি। আপনারা অসাধারণ ব্যক্তি, আমি আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি।”

সেক্সটন তার হাতটা ভাঁজ করে ঘরের চার দিকে তাকিয়ে প্রত্যেক অতিথির সঙ্গে চোখাচোখি করে নিলেন। তারপর তার প্রধান লক্ষ্যের দিকে তাকালেন– কাউবয় টুপি পরা বিশালদেহী এক লোক।

“হিউস্টনের স্পেস ইন্ড্রাস্ট্রি, সেক্সটন বললেন, “আপনি আসাতে আমি খুশি হয়েছি।”

টেক্সাসের লোকটা সায় দিলো, “আমি এই শহরটা একদম ঘৃণা করি।”

“তার জন্য আপনাকে দোষ দেবো না। ওয়াশিংটন আপনার সাথে অন্যায় ক’রে আসছে।”

টেক্সাসের লোকটা টুপির নিচ থেকে তাকালো।

“বারো বছর আগে,” সেক্সটন শুরু করলেন। “আপনি ইউএস সরকারের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আপনি প্রস্তাব করেছিলেন তাদের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলারে মহাশূন্য স্টেশন বানিয়ে দিতে পারবেন।”

“হ্যাঁ, তাই বলেছিলাম। আমার কাছে নক্সাটা এখনও আছে।”

“তারপরও নাসা সরকারকে এই বলে বোঝাতে পেরেছে যে, এই প্রকল্পটি তাদের নিজস্ব হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

“ঠিক। নাসা প্রায় এক দশক আগেই সেটা বানাতে শুরু করেছে।”

“এক দশক পরেও, নাসার মহাশূন্য স্টেশন এখনও ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠেনি। আর এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে আপনার প্রস্তাবের প্রায় বিশগুণ অর্থ। একজন আমেরিকান করদাতা হিসেবে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি।”

ঘরের মধ্যে কথাটার সম্মতির প্রতিধ্বনি কোনো গেলো।

“আমি ভালো করেই জানি যে,” সিনেটর সবার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন। “আপনাদের কয়েকটি কোম্পানি প্রাইস্টে স্পেস শাটল লঞ্চ করার জন্য প্রতি ফ্লাইটের খরচ পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব করেছিলো।”

আরো সায় মিললো।

“তারপরও নাসা আপনাদের প্রস্তাবকে কাটছাট করে আটত্রিশ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছিল, যেখানে নাসার নিজের লাগে প্রতি ফ্লাইটে দেড়শ মিলিয়ন ডলার।”

“এভাবেই তো তারা আমাদেরকে মহাশূন্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে,” একজন লোক বললো। “প্রাইভেট সেক্টরের কোনো কোম্পানি এমন কোনো কোম্পানির সাথে প্রতিযোগীতা করতে পারবে না যারা প্রতি ফ্লাইটে চারশত শতাংশ লোকসান দিয়েও ব্যবসায় টিকে আছে।”

সেক্সটন এবার তার পাশে বসা একজনের দিকে তাকালেন। কাইস্টলার এ্যারোস্পেস, সেক্সটন বললেন, “আপনার কোম্পানি এমন একটি রকেটের ডিজাইন এবং নির্মাণ করেছে যা প্রতি ফ্লাইটে প্রতি পাউন্ডের জন্য দুই হাজার ডলারে লঞ্চ করতে পারবে, নাসা যেখানে প্রতি পাউন্ডে খরচ করে থাকে দশ হাজার ডলার।” সেক্সটন থামলেন। “তারপরও আপনাদের কোনো খদ্দের নেই।”

“আমি কেন খদ্দের পাবো?” লোকটা জবাব দিলো। গত সপ্তাহে নাসা আমাদেকে আট শত বারো ডলার প্রতি পাউন্ড চার্জ নেবার কথা বলে দেয়, যেখানে তারা নিজেরা নিয়ে থাকে। নয় শত শতাংশ বেশি

সেক্সটন সায় দিলেন। “এটা খুবই দুঃখজনক,” তিনি বললেন, “যে নাসা এককভাবে মহাশূন্যকে আগলে রাখতে চায়।”

“এটা মহাশূন্যের ওয়াল মার্ট, টেক্সাসের লোকটা বললো।

ভালোই বলেছেন, সেক্সটন ভাবলেন। কথাটা আমি মনে রাখবো। ওয়ালমার্ট নিজেদের প্রসার বাড়ানোর জন্য বাজার মূল্যের থেকে কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করার জন্য কুখ্যাত। এতে করে প্রতিযোগী কোম্পানিগুলোকে খুব সহজেই হটিয়ে দেয়া যায়।

“আমি একেবারে অসুস্থ আর ক্লান্ত হয়ে পড়েছি,” টেক্সাসের লোকটা বললো।

“আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি,” সেক্সটন বললেন।

“তাদের জন্য এক আইন, আর আমাদের জন্য আরেক আইন, এটাতো অন্যায়।” আরেক জন বললো পাশ থেকে।

“আপনাদের সাথে আমি একেবারেই একমত।”সেক্সটন বললেন।

“এটা ডাকাতি,” আরেকজন ঝট করে বললো। “আমার কোম্পানি আগামী মে’তে প্রথম। পর্যটক-শাটল যান লঞ্চ করার আশা করছে। আমরা বিশাল স্পেস কভারেজ আশা করছি। নাইক জুতো কোম্পানি তাদের শ্লোগান আর লোগোটা শাটলের লেখার জন্য সাত মিলিয়ন ডলার দিতে চাচ্ছে। পেপসি দিতে চাচ্ছে তারও দ্বিগুণ টাকা। কিন্তু ফেডারেল আইন অনুযায়ী আমরা আমাদের শাটল যানে বিজ্ঞাপন ব্যবহার করতে পারবো না, কালে লঞ্চ করা নিষিদ্ধ করা হবে!”

“ঠিক বলেছেন,” সেক্সটন বললেন। “আমি যদি নির্বাচিত হই, তবে এসব অন্যায় আইন তুলে নেবো। এটা আমার প্রতীজ্ঞা। স্পেস সব ধরণের বিজ্ঞাপনের জন্যই মুক্ত থাকবে, যেমন পৃথিবীর প্রতিটি ইঞ্চি বিজ্ঞাপনের জন্য মুক্ত আছে।”

সেক্সটন এবার তার শ্রোতাদের দিকে তাকালেন। “আমাদের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে যে, নাসা’কে প্রাইভেটাইজেশন করার বেলায় সবচাইতে বড় বাধা কিন্তু আইনের নয়, বরং এটা জনগণের ধারণা। বেশির ভাগ আমেরিকানই আমেরিকার স্পেস কর্মসূচী নিয়ে রোমান্টিসিজমে ভুগে থাকে। তারা এখনও বিশ্বাস করে নাসা সরকারী এজেন্সি হিসেবে থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

“এসব হলো হলিউডি ছবির কারবার। একজন বললো। “ঈশ্বরই জানে, হলিউড কতত ছবি বানিয়ে দেখিয়েছে যে নাসা একটি বিধ্বংসী এ্যাস্ট্রোরয়েডের হাত থেকে কততবার এ বিশ্বকে রক্ষা করেছে? এটা হলো প্রোপাগান্ডা!”

“জনগণের মস্তিষ্ক ধোলাই,” একজন হিসপ্যানিক গজগজ করে বললো।

সেক্সটন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর কণ্ঠটা ট্র্যাজিক হয়ে উঠলো। “সত্যি, আমি আর আপনাদেরকে মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন দেখছি না যে, আশির দশকে যখন শিক্ষা বিভাগ দেউলিয়া হয়ে উল্লেখ করেছিলো নাসা’র যে মিলিয়ন ডলার অপচয় করে থাকে সেটা শিক্ষা খাতে খরচ করা যেতে পারে। নাসা উল্টো প্রমাণ করতে চাইলে তারা শিক্ষা বান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান। তারা এক পাবলিক স্কুলের শিক্ষককে স্পেসে পাঠিয়ে দিলো।” সেক্সটন থামলেন। “আপনারা সবাই ক্রিস্টা ম্যাকঅলিফি’র কথাটা নিশ্চয় মনে রেখেছেন।”

ঘরে নিরবতা নেমে এলো।

“জেন্টেলমেন,” সেক্সটন নাটকীয়ভাবে বলতে শুরু করলেন এবার। “আমি বিশ্বাস করি সময় এসেছে আমেরিকানদের সত্যটা বোঝার, আমাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্যই। নাসা আমাদেরকে এমন কিছু দিচ্ছে না, এর চেয়েও অনেক বেশি দিতে পারে সেটা। মনে করে দেখুন কম্পিউটার ইন্ড্রাস্ট্রির কথাটা। যখনই ব্যক্তিগত খাতে ওটা ছেড়ে দেয়া হলো কী। উন্নতিটাই না করলো অল্প সময়ের মধ্যে। কারণ ব্যবসাটা মুক্তবাজার অর্থনীতিতে করা হয়েছিল। ভাবুন কম্পিউটার ইন্ড্রাস্ট্রিটা যদি সরকারী খাতে থাকত? তবে আমরা এখনও অন্ধকার যুগেই থাকতাম। আমাদেরকে সেরকমভাবেই স্পেস আবিষ্কারের দায়িত্বটা প্রাইভেট খাতে তুলে দিতে হবে। তাহলেই স্পেস বিজ্ঞানের অসামান্য উন্নতি ঘটবে। অসামান্যই ঘটবে। আমি যদি নির্বাচিত হই তবে এটা করার জন্য সব রকম চেষ্টা করবো, কথা দিচ্ছি। মহাশূন্যকে খুলে দেবো সবার জন্য।”

সেক্সটন তাঁর কন্যাক মদের বোতলটা তুলে ধরলেন।

“বন্ধুরা আমার, আপনারা এখানে এসেছেন, আমি আপনাদের আস্থাভাজন কিনা সেটা দেখতে। আমি আশা করছি সেটা অর্জন করার পথে রয়েছি আমি। আপনারা যেমন বিনিয়োগ করে মুনাফা আশা করেন, তেমনি রাজনৈতিক বিনিয়োগকারীরাও রিটার্ন আশা করে। আজ রাতে, আপনাদের কাছে আমার সরল বার্তাটি হলো : আমার উপর বিনিয়োগ করুন, আমি আপনাদের কখনই ভুলে যাবো না। কখনও না। আমাদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন।”

সেক্সটন তাঁর গ্লাসটা সবার দিকে টোস্ট করার জন্য এগিয়ে দিলেন।

“আপনাদের সাহায্যে, বন্ধুরা আমার, আমি খুব জলদিই হোয়াইট হাউজে যেতে পারবো আর আপনারা সবাই নিজেদের স্বপ্নকে ওড়াতে সক্ষম হবেন।”

.

কেবল, পনেরো ফিট দূরে, গ্যাব্রিয়েল অ্যাশ ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে, হিমশীতলভাবে। পাশের ঘর থেকে কাঁচের টুংটাং শব্দ ভেসে এলো, সেই সাথে আগুনের কাঠ ফাটার কটমট শব্দটাও।

৫৮

তীব্র আতংকে নাসার এক টেকনিশিয়ান হ্যাবিস্ফেয়ার থেকে বের হয়ে এলো। খুবই ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। সে নাসা প্রশাসককে প্রেস এরিয়ার কাছে একা পেয়ে গেলো।

“স্যার,” দৌড়ে এসে সে বললো। “একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে!”

এক্সট্রম যেনো উদাস হয়ে ছিলো, অন্য একটা ব্যাপারে সে চিন্তিত। “কি বললে তুমি? দুর্ঘটনা? কোথায়?”

“উল্কা উত্তোলনের গর্তে। একটা মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। ডক্টর মিংয়ের।”

এক্সট্রমের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। “ডক্টর মিং? কিন্তু …”

“আমরা তাকে টেনে তুলেছি, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। তিনি মারা গেছেন।”

“হায় ঈশ্বর! কতোক্ষণ সে ওখানে পড়েছিলো?”

“মনে হচ্ছে এক ঘণ্টা। দেখে মনে হচ্ছে তিনি পিছলে পড়ে গেছেন।”

“হায় ঈশ্বর, একি হলো! এটা আর কে কে জানে?” এক্সট্রম বললো।

“কেউ না স্যার। কেবল আমরা দু’জন। আমরা তাকে টেনে তুললেও ভাবলাম খবরটা আগে আপনাকে জানাই–”

“তুমি ঠিক কাজটি করেছো।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক্সট্রম বললো। “ডক্টর মিংয়ের মৃতদেহটা এক্ষুণি গুদাম ঘরে রেখে এসো। এ ব্যাপারে আর কিছু বলো না।”

টেকনিশিয়ান হতবিহ্বল হয়ে গেলো। কিন্তু স্যার, আমি–”।

এক্সট্রম তার বিশাল হাতটা লোকটার কাঁধে রেখে বললো, “আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শোনো। এটা খুবই হৃদয়বিদারক একটি দুর্ঘটনা, আমার খুবই অনুশোচনা হচ্ছে।

অবশ্যই, এটা আমি উপযুক্ত সময়ে দেখবো। এখন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নয়।”

“আপনি চাচ্ছেন মৃতদেহটা লুকিয়ে রাখতে?”

এক্সট্রমের শীতল নর্ডিক চোখ দুটো বুজে এলো। “ভাবো, এটা যদি সবাইকে বলে বেড়াই তাতে আর কী হবে? আর এক ঘণ্টা পরই সংবাদ সম্মেলন। এ মুহূর্তে দুর্ঘটনার কথা ঘোষণা দিলে, সেটাই আলোচনায় চলে আসবে, সংবাদ সম্মেলনটা ধামা চাপা পড়ে যাবে। ডক্টর মিং বেখেয়ালে পড়ে গেছেন। আর এজন্যে নাসা’ কেন মূল্য দেবে। সংবাদ সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ডক্টর মিংয়ের খবরটা গোপন রাখা হোক। তুমি বুঝতে পেরেছো?”

লোকটা ফ্যাকাসে হয়ে সায় দিলো। আমি তার শরীরটা গুদামে রেখে দিচ্ছি।”

৫৯

মাইকেল টোল্যান্ডের সমুদ্রের অভিজ্ঞতা অনেক, সে জানে সমুদ্র তার শিকারকে কতোটা নির্দয়ভাবে, নির্বিকারভাবে গ্রাস করে থাকে। সে বরফ খণ্ডের উপর শুয়ে দেখতে পেলো মিলনে আইস শেলফটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। সে জানে আর্কটিক সাগরের শক্তিশালী স্রোত এলিজাবেথ দ্বীপ থেকে ধেয়ে এসে উত্তর রাশিয়ার দিকে চলে যায়। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। সেটাও এখান থেকে এক মাসের পথ।

আমরা হয়তো ত্রিশ মিনিট পাবো… বড়জোড় পাঁচচল্লিশ মিনিট।

তাদের জেলপূর্ণ সুটটা পরা না থাকলে তারা ইতিমধ্যেই মরে যেভো। ধন্যবাদ মার্ক-দশ সুটটাকে, ভাবলো মাইকেল টোল্যান্ড।

খুব জলদিই হাইপোথার্মিয়া জেঁকে ধরবে তাদেরকে। শুরুটা হবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড় হওয়ার মধ্যে দিয়ে, তারপর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্ত চলাচল প্রবাহ বিঘ্নিত হবে। অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। শরীর তার ভেতরের তাপকে সংরক্ষণ করার জন্য হৃদস্পন্দন বাদে সব ধরণের জৈবিক কাজই বন্ধ করে দেবে। এরপরই অচেতন হয়ে যাবে শরীর। শেষে, হৃদস্পন্দনও বন্ধ হয়ে যাবে।

টোল্যান্ড রাচেলের দিকে তাকালো, তার মনে হলো তাকে বাঁচানোর জন্য যদি কিছু করা যেতো।

.

রাচেল সেক্সটনের শরীরটা অবশ হওয়ায় যন্ত্রণাটা তার ধারণার চেয়েও কম অনুভূত হলো। যেনো এই এনেসথেটিকটাকে স্বাগতমই জানালো। প্রকৃতির মরফিন। তার চোখের গগল্সটা পড়ে গেছে, ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা চোখে সে তাকিয়ে আছে। সে টোল্যান্ড আর কর্কিকে পাশেই পড়ে থাকতে দেখলো। টোল্যান্ড তার দিকে চেয়ে আছে, তার চোখে অনুশোচনা। কর্কি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার ডান গালটা কেটে রক্ত ঝরছে।

রাচেলের মনে একটা প্রশ্ন উঠতেই তার শরীরটা কেঁপে উঠলো। কে? কেন? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তার মনে হলো তার শরীরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে, চোখে ঘুম নেমে আসছে। সে ঘুম ভাবটা কাটাতে চাইলো জোর করে। তার ভেতরে ক্রোধের ঝড় বইয়ে যাচ্ছে।

তারা আমাদেরকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে। সে চার পাশের ভীতিকর সমুদ্রটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তাদের আক্রমণকারীরা সফল হয়েছে। আমরা মরেই গেছি। রাচেলের মনে হলো এই নোংরা খেলার পেছনে কে রয়েছে সেটা সে ইতিমধ্যেই জেনে গেছে।

নাসা প্রধান এক্সট্রমই বেশি লাভবান হবে। সে-ই তাদেরকে বাইরে পাঠিয়েছে। সে পেন্টাগন আর স্পেশাল অপারেশন ফোর্সের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এক্সট্রম বরফের নিচে উল্কাখণ্ড ঢুকিয়ে কি অর্জন করবে? অন্যকারোরই বা তাতে কী লাভ?

রাচেল জাখ হার্নির কথাও ভাবলো, হয় প্রেসিডেন্ট একজন ষড়যন্ত্রকারী না হয় তিনিও দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। হার্নি কিছুই জানেন না। তিনি নির্দোষ।

নাসা অবশ্যই তাঁকে বোকা বানিয়েছে। আর এক ঘণ্টা পরই প্রেসিডেন্ট নাসার আবিষ্কারের ঘোষণাটা দিতে যাচ্ছেন। আর তিনি সেটা করবেন একটা ভিডিও প্রামান্য চিত্রের সাহায্যে, যাতে চার জন সিভিলিয়ান বিজ্ঞানীর সমর্থন রয়েছে।

চার জন মৃত সিভিলিয়ান বিজ্ঞানী।

রাচেল প্রেস কনফারেন্সটা থামানোর জন্য কিছুই করতে পারবে না এখন। কিন্তু সে প্রতীজ্ঞা করলো যেনো এই জঘন্য আক্রমণটা করে থাকুক না কেন তাকে রেহাই দেয়া হবে না।

নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে রাচেল ওঠে বসার চেষ্টা করলো। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে আছে। গিটগুলো নড়লেই ব্যথা করে। সে আস্তে আস্তে হাটুর উপর ভর দিয়ে উঠলো। তার চার পাশে সমুদ্রের গর্জন। টোল্যান্ড তার পাশেই পড়ে থেকে চেয়ে আছে।

রাচেল লক্ষ্য করে দেখলো তার কোমরে এখনও কুড়ালটা বেল্টের সাথে লেগে আছে। সে কুড়ালটা ধরল। কুড়ালটা উল্টো করে ইংরেজি টি অক্ষরের মতো করে ধরে বরফে জোরে জোরে আঘাত করতে শুরু করলো। ভোতা আওয়াজ হলো। টোল্যান্ড ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেখতে লাগলো। রাচেল আঘাত করতেই থাকলো।

টোল্যান্ড কনুইর উপর ভর দিয়ে একটু ওঠে বসার চেষ্টা করলো। “রা … চেল?”

সে কোনো জবাব দিলো না।

“আমার মনে হয় না এই সর্ব দক্ষিণে,” টোল্যান্ড বললো, এসএএ সিগনাল কেউ শুনতে পাবে…”

রাচেল টোল্যান্ডের দিকে তাকালো। ঠিক বলেছো আমি এসএএ সিগনাল দিচ্ছি না। সে আঘাত করতেই থাকলো।

এসএএর অর্থ হলো সাব-ওশানিক একুয়েস্টিক এ্যারে, স্নায়ু যুদ্ধের একটি পুরনো কৌশল যা বর্তমানে সারা পৃথিবীর সমুদ্র বিজ্ঞানীরা তিমি মাছের ডাক কোনোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পানির নিচে এসএ’র উনপঞ্চাশনটি মাইক্রোফোন রয়েছে, সারা পৃথিবীর সাগর তলেই সেগুলো ছড়িয়ে আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এই আর্কটিক সমুদ্রে সেগুলো নেই। কিন্তু রাচেল জানে অন্য কিছু রয়েছে এখানে, যারা এই শব্দটা শুনতে পাবে। তাদের সম্পর্কে পৃথিবীর খুব কম লোকেই জানে। সে আঘাত করতেই থাকলো।

ধুপ। ধুপ। ধুপ।

রাচেলের এমন বিভ্রম ছিলো না যে, তার এই কাজ সবার জীবন বাঁচিয়ে দেবে। তার শরীর অসাড় হতে শুরু করেছে। তার আশংকা হলো আধ ঘন্টাও বেঁচে থাকবে কিনা কে জানে। তাদের উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসলেও সেটা কোনো কাজে আসবে না। কিন্তু সে উদ্ধারের আশায় এসব করছে না।

ধুপ। ধুপ। ধুপ।

“সময় … নেই…” টোল্যান্ড বললো।

এটা আমাদের জন্য নয়, সে ভাবলো। এটা আমার পকেটে রাখা তথ্যটার জন্য। রাচেল তার পকেটে থাকা জিপিআর-এর প্রিন্টটার কথা ভাবলো। আমার দরকার এই প্রিন্ট আউটটা এনআরও’র কাছে পৌঁছে দেয়া… জলদি।

রাচেল নিশ্চিত ছিলো তার বার্তাটা গৃহীত হবে। আশির দশকের মাঝামাঝিতে, এনআরও এসএএ’কে প্রতিস্থাপন করে ত্রিশগুন বেশি শক্তিশালী মাইক্রোফোন বসিয়ে। পুরো ভু গোলককে সেটা কভার করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই শব্দটী পৌঁছে যাবে এনআরও/এনএসএ’র শ্রবণকেন্দ্র, মিনউইথ হিলে সেটা অবস্থিত। সেখান থেকে খবরটা পাঠানো হবে গ্রিনল্যান্ডের থিউল এয়ারফোর্স ঘাটিতে। তাদের প্লেন তিনটি মৃতদেহ হিমশৈলের উপর খুঁজে পাবে। জমে যাওয়া, মৃত। তাদের একজন এনআরও’র কর্মী…আর তার পকেটে একটা অদ্ভুত ছবি পাওয়া যাবে।

জিপিআর এর একটি প্রিন্ট-আউট। নোরা ম্যাঙ্গোরের শেষ কীর্তি।

উদ্ধারকারীরা ছবিটা দেখলেই বুঝতে পারবে উল্কাখণ্ডটির আসল কাহিনী কি। সব প্রকাশ পেয়ে যাবে। তখন কী হবে, সে সম্পর্কে রাচেলের কোনো ধারণাই নেই। তবে কমপক্ষে, সিক্রেটটা আর তাদের সঙ্গে এই বরফে হারিয়ে যাবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *