1 of 2

অস্থির কলঙ্করেখা

অস্থির কলঙ্করেখা

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আদমের পাঁজর থেকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছিলেন প্রথম রমণী—ইভ। আর সেইমুহূর্ত থেকেই বোধহয় বক্ররেখার বাঁকা অর্থ জন্ম নিয়েছিল। সুতরাং ধোঁয়ার আঁকাবাঁকা রেখায় যদি আমি নগ্ন তরুণীর লাস্য খুঁজে পাই, তা হলে সে আমার দোষ নয়। তা ছাড়া তারক হালদার সবিস্তারে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সবকিছু। সেইদিন থেকেই ধোঁয়া দেখলে আমি ভয় পাই। বিশেষ করে সিগারেটের ধোঁয়া।

সিগারেটের অগ্নিবিন্দু থেকে সাদা ধোঁয়ার রেখা যখন সাবলীল ভঙ্গিতে শূন্যে ভেসে যায়, তখন মনে হয় কোনও নর্তকী যেন তার বুক-কোমর-নিতম্ব হেলিয়ে দুলিয়ে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে ছলাকলা বিস্তার করছে শূন্যে। অন্যায় কলঙ্কের রেখা এঁকে যাচ্ছে আপনমনে।

না, আগে আমার এমনটা মনে হত না। সবকিছুর মূলে ওই তারক হালদার—এক অদ্ভুত বিচিত্র মানুষ। তিনি আমাকে স্পষ্ট করে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, সিগারেট খাওয়া কেন স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে লেখা ওই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের আসল অর্থই-বা কী।

তারক হালদারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল অনুপম। না, সরাসরি ঠিক পরিচয় করিয়ে দেয়নি। তারক হালদারের একটা ভিজিটিং কার্ড ও আমাকে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘ট্রাই করে দেখ, এই মানুষটা তোর জীবন একেবারে বদলে দেবে। প্রমিস—।’

অনুপমের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল এয়ারপোর্টে। অফিসের মিটিং-এ দিল্লি যাব বলে ডিপারচার লাউঞ্জে বসে আছি। কাচের দেওয়ালের বাইরে ভোরের সকাল। রানওয়ের ওপরে কুয়াশা জমে আছে। তারই মাঝে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে এয়ারবাস। আমাদের দিল্লি নিয়ে যাবে। আমি আনমনাভাবে বসে মৌসুমীর কথা ভাবছিলাম। আর ভাবছিলাম ছেলে তাপসের কথা।

অফিসের কাজে মাসের মধ্যে ছ-সাতবার কলকাতা-দিল্লি করা নিয়ে কাল রাতেও একটু-আধটু ঝগড়া হয়েছে মৌসুমীর সঙ্গে। এমনিতে যে-কোনও ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করাটা মৌসুমীর বেশ পছন্দের। তার ওপর গতকালের বিষয় ছিল ‘তাপসের পড়াশোনার ক্ষতি ও পিতার নির্লিপ্ত অবহেলা।’ যথেষ্ট গুরুতর বিষয়। সুতরাং আলোচনা বেশ ভালোরকম তাপমাত্রায় পৌঁছেছিল। আমি সাধারণত যাকে ‘ঝগড়া’ বলি, মৌসুমী তাকেই বলে ‘আলোচনা’।

মোল্ডেড প্লাস্টিকের চেয়ারে আরাম করে বসে সেই ‘আলোচনা’র অ্যাকশান রিপ্লে করছিলাম মনের পরদায়, অঅর ডানহাতের দু-আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়ছিল। এমন সময় আমার পাশে এসে কেউ বসল। আলতো চাপড় মারল কাঁধে: ‘কীরে, কেমন আছিস?’

তাকিয়ে দেখি অনুপম। ফিটফাট ঝকঝকে চেহারা। এই পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই বয়েসেও স্বাস্থ্য রেখেছে দারুণ। গত বছরেও ওর চোখে চশমা ছিল। এখন বোধহয় কনট্যাক্ট লেন্স নিয়েছে। ওর মধ্যে আমি ছাত্রজীবনের অনুপম মুখার্জিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ও ‘ফর্টি প্লাস’ নামে কোনও ট্যাবলেট খাচ্ছে নাকি?

অনুপম ছাত্রজীবনে আমার পাড়ার কাছাকাছি থাকত। দুজন দু-কলেজে পড়লেও ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমরা একসঙ্গে পড়াশোনাও করেছি। পরে পাশটাশ করে ও ‘সেঞ্চুরি পাবলিসিটি’ নামের একটা অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি নেয়। এখন ‘অ্যাডফোকস’ অ্যাড এজেন্সিতে ডেপুটি ম্যানেজার। আর আমি আছি ‘ফোর স্কোয়্যার কনসালট্যান্টস’-এ।

চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পরেই অনুপম বিয়ে করে বেলেঘাটার দিকে কোথায় যেন ফ্ল্যাট কিনে চলে যায়। তারপর থেকে ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ প্রায় হতই না। হঠাৎ করে বছরদশেক ধরে ওর সঙ্গে আমার এয়ারপোর্টেই বলতে গেলে দেখা হয়। কোম্পানির কাজে ও দিল্লি-বম্বে-মাদ্রাজ করে বেড়ায়। আর আমিও তাই। সুতরাং এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে অথবা প্লেনে বসেই আমাদের সুখ-দুঃখের গল্প হয়। তা ছাড়া দিল্লি-বম্বে-মাদ্রাজে মিটিং-এর পর হাতে সময় থাকলে আমরা আড্ডা মারতে বসি হোটেলে-রেস্তরাঁয় বা কোম্পানির গেস্ট হাউসে।

অনুপমের সঙ্গে একবছর আগে আমার দেখা হয়েছিল দিল্লি এয়ারপোর্টে। দুজনে একসঙ্গে কলকাতা ফিরেছিলাম।

আমি ওর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তুই তো দেখছি বিশবছর বয়েস কমিয়ে ফেলেছিস!’

ও হাত নেড়ে বলল, ‘আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি—।’

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

ছাত্রজীবন থেকে যে অনুপম মুখার্জি চেইন স্মোকার, যে চেইন রিঅ্যাকশন ঘটিয়ে আরও অন্তত একশোজন চেইন স্মোকারের জন্ম দিয়েছে, গত বছর দিল্লিতেও যে চেইন স্মোকার ছিল, সেই অনুপম মুখার্জি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে!

আমিও চেইন স্মোকার হয়েছি অনুপমের হাতে পড়ে। সুতরাং হেসে বললাম, ‘শোন, যারা তোর-আমার মতো চেইন স্মোকার তারা যদি মাঝে-মাঝে প্রতিজ্ঞা করে পাঁচ-সাতদিনের জন্যে সিগারেট না-ছাড়ল তবে আবার চেইন স্মোকার কীসের!’ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা গলায় বললাম, ‘রোহিণীকে ছুয়ে দিব্যি করেছিস না কি?’

রোহিণী ওর বউয়ের নাম। মৌসুমীকে ছুঁয়ে দিব্যি কেটে আমিও সাত-আটবার সিগারেট ছেড়েছি। তবে প্রত্যেকবারই ওই দিব্যির এফেক্ট সাত-আটদিনের বেশি স্থায়ী হয়নি।

আমার ঠাট্টায় অনুপম হাসল না। বরং বেশ সিরিয়াস মুখ করে বলল, ‘নারে, আমি সত্যি-সত্যি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।’

আমি একটু হকচকিয়ে গেলেও ঠাট্টার সুরটা বজায় রেখে বললাম, ‘হঠাৎ এরকম সাধু মতলবের কারণটা জানতে পারি?’ হাতের সিগারেট ছোট হয়ে গিয়েছিল। সেটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা ধরালাম।

অনুপমের ফরসা মুখে সতেজ ছোঁয়া লাগল। অস্বস্তির ভাবটা ঝেড়ে ফেলে ও বলল, ‘প্রথম-প্রথম বেশ কাশি হত, বুঝলি। তো ডাক্তার দেখলাম। তার তো একটাই প্রেসক্রিপশান: সিগারেট জীবনের মতো ছাড়তে হবে। কিন্তু তুই তো জানিস, আমার যে-রকম চেইন স্মোকিং-এর অভ্যেস—ছাড়ব বললেই কি আর ছাড়া যায়! রোহিণীও সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার জন্যে ঘ্যানঘ্যান করত। শেষকালে একেবারে বিরক্ত হয়ে ছেড়েই দিলাম। কিন্তু সিগারেট কি আর অত সহজে আমাকে ছাড়তে চায়! দিনে পাঁচ-ছ’ প্যাকেটের জায়গায় দু-তিনটে করে লুকিয়ে-চুরিয়ে খেতে লাগলাম। তো কাশিটা লেগেই রইল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, এভাবে কিছু হবে না, কিন্তু কী করব! তারপর একদিন…।’

এমনসময় আমাদের ফ্লাইটের অ্যানাউন্সমেন্ট হল। ক্লোজড সার্কিট টিভিতে ভেসে উঠল নির্দেশ। আধ-খাওয়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেলে দিলাম। অনুপম ওর ব্রিফকেসটা তুলে নিয়ে বলল, ‘চল, যেতে-যেতে বলছি—।’

রানওয়ের খোলা জায়গায় বেরোতেই বোঝা গেল শীত এখনও পুরোপুরি যায়নি। তার থাবায় আঁচড় কাটার মতো এখনও কয়েকটা নখ রয়ে গেছে। সূর্য বেশ খানিকটা ওপরে উঠে যাওয়ায় কুয়াশা ফিকে হয়ে এসেছে। প্যাসেঞ্জার কারে করে প্লেনের দিকে যাওয়ার সময় হুহু বাতাসে আমার বেশ শীত করে উঠল।

অনুপম সিট নিয়েছে নন-স্মোকিং জোনে। আর আমি যথারীতি ধোঁয়াটে অঞ্চলে। কিন্তু ওর গল্পের টান আমাকে যেন বঁড়শিতে গেঁথে ফেলেছিল। তাই ওর পাশেই একটা ফাঁকা সিট দেখে বসে পড়লাম। গল্পের শেষটুকু শোনা হয়ে গেলে স্মোকিং জোনে ফিরে যাওয়া যাবে।

লুকোনো স্পিকারে আলতোভাবে সেতারের সুর বাজছিল। মাথার ওপরে লাগেজ ক্যাবিনেটে হাতব্যাগ রেখে যাত্রীরা যে-যার সিট খুঁজে নিতে ব্যস্ত। আজকের ফ্লাইটে ভিড় খুব বেশি নেই।

অনুপমের পাশে গুছিয়ে বসে বললাম, ‘তারপর কী হল বল—।’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। একদিন আমার এক বন্ধু—কোম্পানির মিটিং করতে গিয়ে আলাপ, নাম বললে তুই চিনবি না—সে আমাকে একটা কার্ড দিল। এলগিন রোডের একটা কোম্পানি, তারা নাকি সিগারেট ছাড়ানোর ব্যাপারে স্পেশালিস্ট। তো আমি সেখানে গেলাম। ভাবখানা ছিল, গিয়েই দেখি না কী হয়। বিশ্বাস কর, তারপর থেকে আমি আর সিগারেট ছুঁইনি।’

আমি অবিশ্বাসের গলায় বললাম, ‘কী করে ওরা তোর নেশা ছাড়াল? কোনও ওষুধ-টষুধ দিয়েছিল?’

‘না, না, ও সব কিচ্ছু না—’ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তার ভেতরে কী খুঁজতে লাগল অনুপম, আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘দু-চারটে কার্ড আমার কাছে ছিল। ওরা বলেছিল বন্ধুবান্ধবদের দরকার পড়লে দেবেন। কোথায় গেল?…এই তো!’

মানিব্যাগ থেকে একটা সাদামাটা ভিজিটিং কার্ড বের করে আমার হাতে দিল অনুপম।

Dr. Tarak Halder

Anti-smoking specialist

‘Mukti’

7. LALA LAJPAT RAI SARANI

CALCUTTA-700020

Phone 475-2137

‘জানিস তো, এলগিন রোডের নতুন নাম লাল লাজপত রাই সরণি। কার্ডটা ইচ্ছে হলে তুই রাখতে পারিস, রাজীব। ওরা তোর সিগারেটের নেশা একদম ছাড়িয়ে দেবে। পাক্কা গ্যারান্টি। ”মুক্তি” নাম ওদের সার্থক।’

‘কী করে ছাড়াবে বল তো!’ কার্ডটা আমি পকেটে রেখে দিলাম।

‘সেটা বলতে পারব না।’

‘বলতে পারবি না? তার মানে?’

‘ওদের ওখানে একটা এগ্রিমেন্ট আমাকে সই করতে হয়েছে। তাতে লেখা আছে, ওসব কথা কাউকে বলা যাবে না। তবে তোর চিন্তা নেই। প্রথমদিন ইন্টারভিউর সময় ডক্টর হালদার তোকে সব বলে দেবেন।’

‘তোকে এগ্রিমেন্ট সই করতে হয়েছে?’ আমি অবাক হলাম।

‘হ্যাঁ—।’

‘আর সেজন্যে তুই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিস?’

‘তা বলতে পারিস।’ অনুপম একটু হাসল।

আমি একটু জেদ করেই বললাম, ‘বাদ দে তোর এগ্রিমেন্ট! আমাকে ব্যাপারটা একটু খুলে বল দেখি—কে আর জানতে পারবে!’

অনুপম কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। বোঝা যাচ্ছিল, এ-নিয়ে ও আর বেশি আলোচনা করতে চায় না। আমার কথায় মুখ ফেরাল, বলল, ‘না রে, বলা যাবে না। দেখবি, এগ্রিমেন্ট সই করার পর তুইও ওসব কথা কাউকে বলতে পারবি না।’

‘আচ্ছা ডক্টর হালদার যদি সত্যি করেই সিগারেট ছাড়ানোর স্পেশালিস্ট হন তা হলে এত লুকোচুরি কীসের? তা ছাড়া সিনেমায় বা টিভিতে ”মুক্তি”র বিজ্ঞাপনও তো দেখিনি!’

অনুপম হাসল: ‘ডক্টর হালদারের কোনও বিজ্ঞাপন লাগে না। হুইসপারিং ক্যামপেইনেই ওরা গাদা-গাদা ক্লায়েন্ট পেয়ে যায়। আর পাবে না-ই-বা কেন! ওঁর কোম্পানির সাকসেস রেট নাইনটি এইট পারসেন্ট।’

‘তুই নিজে অ্যাড লাইনের লোক হয়ে এ-কথা বলছিস!’

অনুপম শুধু মুচকি হাসল।

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে জিগ্যেস করলাম, ‘ওরা কি হাত-পা বেঁধে একটার-পর-একটা সিগারেট খাওয়াতে থাকে, যতক্ষণ না সিগারেট দেখলেই বমি পায়?

অনুপম মাথা নাড়ল ‘না।’

‘এমন কোনও ওষুধ খাওয়ায় যাতে সিগারেট ধরালেই শরীর খারাপ লাগে?’

‘না—।’

‘সিগারেটের মতো দেখতে কোনও হালকা নেশার লজেন্স ধরিয়ে দেয়? পরে সেই লজেন্সের বদলে আরও হালকা কোনও লজেন্স ধরায়, তারপর…’

‘না, তাও নয়।’ এবার মজা পেয়ে চওড়া হাসল অনুপম, বলল, ‘তুই নিজে গিয়েই দেখ না—তোর কি সিগারেট খেতে সত্যি খুব ভালো লাগে, বল?’

না, সিগারেট খেতে সত্যি যে আমার খুব ভালো লাগে তা নয়। কিন্তু এত পুরোনো একটা অভ্যেস—হাতে সিগারেট না থাকলেই মনে হয় কি যেন নেই।

অনুপম বেশ খুঁটিয়ে আমাকে দেখছিল। নরম গলায় বলল, ‘ডক্টর হালদার আমার জীবনটা একেবারে বদলে দিয়েছেন। নিজেই বুঝতে পারি, আমার শরীর-স্বাস্থ্য আগের চেয়ে কত ভালো হয়েছে। রোহিণীর সঙ্গে রিলেশানও বেটার হয়েছে। বেশ আছি রে। ট্রাই করে দেখ, এই মানুষটা তোর জীবন একেবারে বদলে দেবে। প্রমিস—।’

‘কিন্তু তুই তো আমাকে বেশ ঝামেলায় ফেললি। আমার যে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে, কী করে…।’

‘সরি, রাজীব, আমাকে রিকোয়েস্ট করিস না। এসব ব্যাপারে নিজে সরাসরি জেনে নেওয়াটাই ভালো।’

অনুপমের সিরিয়াস মুখ আমাকে বলে দিল আমি কানাগলি দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছি।

এরপর ও কথাবার্তা শুরু করলে অফিস নিয়ে। সামনের মাসে ও ম্যানেজার হয়ে যাচ্ছে। এখন দিল্লিতে মিটিং-এ যাচ্ছে রইস ক্লায়েন্ট বাগাতে।

ম্যানেজার হওয়ার খবর শুনে আমি ওকে আগাম অভিনন্দন জানালাম। তারপর বললাম আমার অফিসের ঝামেলার কথা, বাড়ির অশান্তির কথা, শরীরের নানা সমস্যার কথা।

অনুপম হেসে চোখ মারল আমাকে: ‘মুক্তি!’

প্লেন ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল। আমি ‘পরে আবার দেখা হবে’ বলে স্মোকিং জোনে নিজের সিটে ফিরে গেলাম।

মাসখানেক পর একদিন দুপুরবেলা একটা ফারনেস ডিজাইনের কাজ নিয়ে ওয়েসম্যান ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে গেছি। কাজের শেষে অফিসের গাড়ি নিয়ে লালা লাজপত রাই সরণি, মানে, এলগিন রোড দিয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎই সাত নম্বর বাড়িটা চোখে পড়ল।

দু-আঙুলের ফাঁকে যথারীতি সিগারেট জ্বলছিল। কী কারণে জানি না, গলা খুসখুস করে উঠে কাশি হল কয়েকবার। আর ঠিক তখনও কোনও শয়তানি দাবার চালে সাত নম্বর বাড়িটা দেখতে পেলাম। একইসঙ্গে ‘মুক্তি’ লেখা ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডটাও চোখে পড়েছিল আর অনুপমের কথাগুলো মনে পড়ে গিয়েছিল।

অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিয়ে আমি নেমে পড়লাম রাস্তায়। কটকটে রোদ্দুরে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম ‘মুক্তি’র দিকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে অনুপমের দেওয়া ভিজিটিং কার্ডটা একবার দেখে নিলাম।

ঝকঝকে শৌখিন তিনতলা বাড়িটার রং সাদা। বাড়ির ঠিক সামনে ফুটপাথের ওপরে একটা অশ্বত্থ গাছ। গাছতলায় এক টিয়াপাখি-জ্যোতিষী বসে ঝিমোচ্ছে।

বাড়িটার বাইরের দেওয়ালে অন্তত গোটা পাঁচেক কোম্পানির সাইনবোর্ড। দরজায় উর্দিপরা দারোয়ান। তাকে জিগ্যেস করে জেনে নিলাম, ‘মুক্তি’ দোতলায়। কিন্তু ভিতরে ঢোকার আগে কী ভেবে হাতের সিগারেটটা রাস্তায় ফেলে দিলাম।

লিফট নেই। তবে আধুনিক চওড়া অথচ খাটো উচ্চতার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে কোনও কষ্ট হল না। সামনেই বড় কাচের দরজা। কাচের ওপরে লাল রং দিয়ে ভিজিটিং কার্ডের কথাগুলোই লেখা। দরজার নবে সোনালি শিকলিতে একটা প্লাস্টিকের বোর্ড ঝুলছে। তাতে লেখা: OPEN।

কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত, সাজানো-গোছানো, সুন্দর। দেওয়ালে ক্রিম রঙের ডিসটেম্পার। হঠাৎ করে থ্রি স্টার হোটেলের রিসেপশান বলে ভুল হয়। ডানদিকে দেওয়াল ঘেঁষে বাদামি ভেলভেটে মোড়া সোফা সেট। তার সামনে পালিশ করা মেহগনি কাঠের টেবিলে কারুকাজ করা পিতলের ফুলদানি আর ম্যাগাজিন। দুজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক ব্যাজার মুখে সোফায় বসে আছে। কে জানে, আমারই মতো বৈরাগী হতে এসেছে কি না!

নীল রঙের ল্যামিনেটেড প্লাস্টিকে মোড়া রিসেপশান কাউন্টারে সালোয়ার কামিজ পরা একটি সুন্দরী মেয়ে বসে ছিল। সামনে রাখা পারসোনাল কম্পিউটারের কিবোর্ডে ওর নেলপালিশ রাঙানো সরু আঙুল দ্রুত নড়াচড়া করছে।

আমাকে দেখে আঙুল থামাল মেয়েটি। কম্পিউটারের পরদা থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। ওর গভীর দৃষ্টিতে প্রশ্ন।

আমি একটু ইতস্তত করে ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। গোলাপি আর কালোয় ছাপা সালোয়ার-কামিজে বেশ মানিয়েছে ওকে।

পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ বের করে তার ভেতর থেকে ভিজিটিং কার্ডটা বের করলাম। সেটা তরুণীর সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এটা এক বন্ধু আমাকে দিয়েছিল। ও এখান থেকে ট্রিটমেন্ট করিয়েছে…।’

মেয়েটি হাসল, বলল ‘আমাদের ক্লায়েন্টরা আমাদের কখনও ভোলে না। আপনার নাম?’

‘রাজীব দত্ত।’

কম্পিউটারের কিবোর্ডের ওপরে মেয়েটির হাত চলতে শুরু করল আবার।

‘ঠিকানা?’

‘থ্রি বাই ফোর গৌরীবাড়ি লেন, ক্যালকাটা ফোর।’

‘আপনি কি ম্যারেড, মিস্টার দত্ত?’

‘হ্যাঁ—’ কিন্তু বিয়ের সঙ্গে সিগারেটের সম্পর্ক কী!

‘ওয়াইফের নাম?’

‘মৌসুমী দত্ত।’

‘ছেলেমেয়ে?’

‘একটি ছেলে—’

‘নাম?’

একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তাপস দত্ত।’

‘আমাদের কোম্পানির কথা আপনাকে কে বলেছে, মিস্টার দত্ত?’

‘আমার এক পুরোনো বন্ধু—অনুপম মুখার্জি।’

কিবোর্ডের ওপরে মেয়েটির আঙুল পেশাদারি ভঙ্গিতে চলতেই লাগল। একটু পরে ও কী একটা বোতাম টিপতেই পাশে রাখা ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টারে একটা ফ্যানফোল্ড পেপার ছাপা হয়ে বেরিয়ে এল। সেটা হাতে নিয়ে মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সোফার দিকে আঙুল দেখিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘একটু ওয়েট করুন, মিস্টার দত্ত। আমি দেখছি যাতে আপনাকে বেশিক্ষণ বসতে না হয়।’

মেয়েটি স্বচ্ছন্দ পা ফেলে একটা কাচের দরজা ঠেলে মসৃণ করিডর ধরে চলে গেল ভেতরে। আর আমি দোনামনা পায়ে এগিয়ে লম্বা সোফায় একপ্রান্তে গা এলিয়ে বসে পড়লাম। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, টেবিলে কোনও অ্যাশট্রে নেই। এটাই কি ডক্টর হালদারের ট্রিটমেন্টের প্রথম ধাপ? সুতরাং সিগারেটের মায়া ছেড়ে টেবিল থেকে একটা ‘সানডে’ ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে চোখ বোলাতে লাগলাম। আড়চোখে দেখলাম, সোফায় বসা অন্য দুজন ভদ্রলোক বেশ উসখুস করছে।

ঠিক তখনই মিষ্টি গলা কানে এল ‘মিস্টার দত্ত, আপনি ভিতরে যান—।’

রিসেপশানের সুন্দরী ফিরে এসেছে।

ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি ভেতরে যাওয়ার দরজা ঠেলে করিডরে পা রাখলাম।

এবার কোনদিকে যাব? এ-কথা ভাবামাত্রই কোথা থেকে একজন স্বাস্থ্যবান লোক এসে হাজির হল আমার পাশে। তার পরনে জিনস, আর নীল টি-শার্ট। টি-শার্টে লেখা: ‘CIGARETTE SMOKING IS INJURIOUS TO HEALTH’। লেখাটার ঠিক নীচেই একটা নরকরোটির ছবি। সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে।

লোকটা চাপা গলায় আমাকে বলল, ‘আমার সঙ্গে আসুন—।’

অনেকগুলো বন্ধ দরজা পার হয়ে গেলাম আমরা। তারপর করিডরের শেষে ডানদিকে ঘুরেই একটা দরজা সামনে পেলাম। দরজার গায়ে প্লাস্টিকের হরফে ডক্টর তারক হালদারের নাম লেখা। নামের নীচে গোটা তিনেক ডিগ্রি। তার মধ্যে এম. বি. বি. এস.-টাই শুধু আমার চেনা।

দরজায় টোকা দিয়ে সামান্য অপেক্ষা করল লোকটি। কয়েকসেকেন্ড পরেই বেশ মোলায়েম গলায় কেউ বলে উঠল ‘কাম ইন—’

দরজা ঠেলে আমরা দুজন ভেতরে ঢুকলাম।

ছোট অথচ ছিমছামভাবে সাজানো ঘর। এক অদ্ভুত ঠান্ডা নরম স্নিগ্ধ আলো সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে ঘরের মধ্যে। বেশ বড় মাপের একটা টেবিলের ও-পাশে বসে আছেন ডক্টর হালদার। দোলানো চেয়ারে অল্প-অল্প দুলছেন। সৌম্য চেহারায় আত্মীয়ের ছাপ। ডানহাতে একটা কাগজ।

আমাকে দেখেই হেসে বললেন, ‘আসুন মিস্টার দত্ত, বসুন। আপনার ডেটা শিটটাই দেখছিলাম।’ হাতের কাগজটা সামান্য নাড়লেন তিনি। তারপর আমার সঙ্গের লোকটিকে বললেন, ‘প্রতাপ, তুমি এখন এসো। আমরা একটু প্রাইভেট কথাবার্তা বলব—।’

সঙ্গে-সঙ্গে প্রতাপ চলে গেল ঘর থেকে।

চেয়ারের দুলুনি থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ডক্টর হালদার। আমি এবার ওঁকে মনোযোগ দিয়ে দেখলাম।

বয়স বড়জোর চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে। ফরসা। মাথার সামনেটা টাক, তবে পেছন দিকে ঘাড় পর্যন্ত চুল। কপালে কয়েকটা ভাঁজ। তীব্র চোখে চওড়া ফ্রেমের চশমা। নাকের ডগায় একটা আঁচিল। পরনে সাদা অ্যাপ্রন। আর গলায় স্টেথো ঝুলছে।

ঘরের দুটো জানলাই পরদা ঢাকা। এ ছাড়া ডক্টর হালদারের পেছনের দেওয়ালে ছোট মাপের আয়তাকার লম্বা একটা জানলা—তার ওপরেও সবুজ পরদার আড়াল।

ঘরের বাঁদিকের দেওয়ালে বেশ বড়সড় একটা তেলরঙ ছবি। ছবিতে আপাদমস্তক শীর্ণকায় একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পরনে দামি পোশাক। চোখে খর দৃষ্টি। গাল ভাঙা। এবং হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

আমার গলা খুসখুস করছিল। পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটার ওপরে একবার হাত বুলিয়ে নিলাম। খাঁচায় বন্দি আমার পোষা পাখি।

পায়চারি করতে-করতেই ডক্টর হালদার মোলায়েম আন্তরিক গলায় বললেন, ‘মিস্টার দত্ত, আপনি কি সত্যি-সত্যি সিগারেট ছাড়তে চান?’

আমি ইততস্ত করে একবার ঢোঁক গিলে জবাব দিলাম, ‘হ্যাঁ…ছাড়তেই তো এসেছি।’

‘ভালো কথা—খুব ভালো কথা।’ আমার চোখে সরাসরি তাকিয়ে হাসলেন তারক হালদার। হাতের কাগজটা টেবিলে রাখলেন। চেয়ারের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে একটা ড্রয়ার খুললেন। তার একটু পরেই একটা টাইপ করা এগ্রিমেন্ট বের করে এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।

‘আমাদের ক্লিনিকের কয়েকটা ফরম্যালিটি আছে। এই এগ্রিমেন্টটা পড়ে নিয়ে সই করে দিন, প্লিজ—।’

আমি চট করে চোখ বুলিয়ে নিলাম কাগজটায়। ‘মুক্তি’-র চিকিৎসাপদ্ধতি আমি গোপন রাখব। কোনওভাবেই ক্লিনিকের স্বার্থবিরোধী কাজ করব না। ইত্যাদি-ইত্যাদি।

সুতরাং টেবিল থেকে একটা বলপয়েন্ট পেন তুলে নিয়ে খসখস করে সই করে দিলাম।

ডক্টর হালদার মুখে তৃপ্তির একটা শব্দ করলেন। আমার কাছে এসে কাঁধের পাশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে এগ্রিমেন্টের কাগজটা তুলে নিয়ে চলে গেলেন টেবিলের ও-পাশে। ড্রয়ারে আবার রেখে দিলেন কাগজটা।

হাতে হাত ঘষে শব্দ করে হাত ঝাড়লেন তারক হালদার। হেসে বললেন, ‘মিস্টার দত্ত, এভাবেই রিলেশান তৈরি হয়। এখন থেকে আপনি আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড। আসলে যারা স্মোক করে তাদের সবার সঙ্গেই আমি রিলেশান তৈরি করতে চাই।’

টেবিলের ডানপাশে একটা পারসোনাল কম্পিউটার বসানো ছিল। তার সফট হোয়াইট মনিটরে আয়তাকার কারসর দপদপ করে জ্বলছে। ওটার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে ডক্টর হালদার বললেন, ‘আমার কাছে যতগুলো কেস আছে, তার সবকটাই আমি নিজে হ্যান্ডল করি। নেহাত পেরে না-উঠলে আমার অ্যাসিস্ট্যান্টদের সাহায্য চাই…।’

তারক হালদার চেয়ারে বসে পড়লেন। কম্পিউটারের কিবোর্ডের বোতাম টিপতে-টিপতে হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন আমাকে: ‘বলতে পারেন, ভারতে প্রতি সেকেন্ডে কটা সিগারেট বিক্রি হয়?’

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম: ‘দুশো?’

শব্দ করে হাসলেন হালদার। কম্পিউটারের পরদায় তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললেন, ‘উঁহু, আড়াই হাজারের ওপর। বছরে বিক্রি হয় প্রায় আশি বিলিয়ন সিগারেট।’

সংখ্যাটা আমাকেও নাড়া দিল। কিন্তু গলাটা ভীষণ শুকনো লাগছে। এখান থেকে বেরিয়েই যদি একটা সিগারেট না-ধরাই তা হলে আমি আর বাঁচব না। কেন যে অনুপমের কাছ থেকে কার্ডটা রাখতে গেলাম!

‘মিস্টার দত্ত, সিগারেট খেলে স্বাস্থ্যের অনেকরকম ক্ষতি হয়।’ কম্পিউটারের দিক থেকে সরে এসে আমার মুখোমুখি তাকিয়ে হালদার বললেন, ‘টোব্যাকোতে নিকোটিন আছে তা তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন। প্রায় ৪০০ বছর ধরে তামাকের ব্যবহার চলে আসছে। সেই তুলনায় সিগারেট খাওয়ার শখ মাত্র ৯০ কি ১০০ বছরের পুরোনো। আমরা এটা অভ্যেস করেছি সাহেবদের কাছ থেকে।’ তারক হালদার মাথা নাড়লেন: ‘খুব খারাপ অভ্যেস—।’

হায় ভগবান। এরকম জ্ঞান দিয়েই কি ডক্টর হালদার আমাকে সিগারেট ছাড়াবেন?

‘সিগারেটের ধোঁয়াতে, বুঝলেন, মিস্টার দত্ত—চার হাজারেরও বেশি জিনিস রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটা ফারমাকোলজিক্যালি অ্যাকটিভ: অ্যান্টিজেনিক, সাইটোটক্সিক, মিউটাজেনিক আর কারসিনোজেনিক। এগুলো নানাভাবে শরীরের ক্ষতি করে।’

আমার মুখের চেহারা দেখে হালদার বোধহয় কিছু একটা অনুমান করলেন। একটু তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, ‘জানি, আমি একটু টেকনিক্যাল কথাবার্তা বলছি, কিন্তু তবু এসব আপনার জানা উচিত। আজকেই যা আমাদের একটু বেশি সময় লাগবে। এরপর থেকে সবই খুব ছোটখাটো ব্যাপার।’

কম্পিউটারের মনিটরের দিকে একবার তাকিয়ে থুতনিতে আলতো করে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, ‘সাধারণত তামাকপাতায় কার্বোহাইড্রেট, ননফ্যাটি অরগ্যনিক অ্যাসিড, নাইট্রোজেন কম্পাউন্ড আর রেজিন থাকে। সিগারেট ধরালে ঠোঁটের দিকটায় টেম্পারেচার হয় ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর আগুনের দিকে প্রায় ৯০০ ডিগ্রি। এই হিটে পাইরোলিসিস রিঅ্যাকশান হয়ে নানারকম রাসায়নিক তৈরি হয়। তার মধ্যে শতকরা ৮৫ ভাগই হল নাটট্রোজেন, অক্সিজেন আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড। বাকি ১০ ভাগে গ্যাস, বাষ্প বা সূক্ষ্ম কণার অবস্থায় থাকে কার্বন মনোক্সাইড, টার, নিকোটিন, ফিনল, বেনজোপাইরিন এইসব। ধোঁয়ার এক মিলিলিটারে ০.৩ থেকে ৩.৩ বিলিয়ন পার্টিকল থাকে। এদের মাপ হল, ০.২ থেকে ০.৫ মাইক্রোমিটার। সুতরাং খুব সহজেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে চলে যায় এসব তথ্য আপনাকে জানানো আমার ডিউটি।’

তারক হালদার হাসলেন মিটিমিটি। হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘মিস্টার দত্ত, ব্যাপারটা অনেকটা চণ্ডীপাঠের মতো শোনাচ্ছে, তাই না? আপনার হয়তো ঘুম পাচ্ছে—।’

আমি তাড়াতাড়ি একটু নড়েচড়ে বসে জবাব দিলাম, ‘না, না খারাপ লাগছে না—আপনি বলুন। এরকম করে আমাকে কখনও কেউ বুঝিয়ে বলেনি।’

শালা অনুপম! দাঁড়া, আবার কখনও তোর সঙ্গে আমার এয়ারপোর্টে দেখা হোক! তোর ইয়েতে আমি চারমিনারের ছ্যাঁকা দেব।

এখন এই ঠগটা কত টাকা চাইবে কে জানে! একটা সিগারেট পেলে ভালো হত।

‘মিস্টার দত্ত, আমরা চণ্ডীপাঠ দিয়ে শুরু করি বটে, তবে জুতো সেলাই দিয়ে খতম করি। আচ্ছা, বলুন তো, দিনে মাত্র এক প্যাকেট সিগারেট খাওয়া মানে বছরে সিগারেটে মোট টান দেওয়া?’

আমি মাথা নাড়লাম। আন্দাজে বোকার মতো উত্তর দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

সবজান্তার ঢঙে মাথা দোলালেন তারক হালদার ‘সত্তর হাজারেরও বেশি। এতে কী হয় জানেন? মুখ, নাক, ফ্যারিংস আর ট্রাকিওব্রংকিয়াল ট্রি-র মেমব্রেগুলোতে তামাকের ধোঁয়া লাগে। ধোঁয়ার কতকগুলো কম্পাউন্ড সরাসরি মেমব্রেনের সঙ্গে রিঅ্যাক্ট করে, আর বাকিগুলোর কিছু রক্তে মিশে যায়, নয়তো মুখের লালার সঙ্গে পেটে চলে যায়। যারা রেগুলার স্মোক করে তাদের দেখবেন মাঝে-মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়, কাশি হয়। তা ছাড়া কার্ডিয়াক প্রবলেম, পেপটিক আলসার হওয়া ছাড়াও লাংস, ল্যারিংস বা ফুড পাইপেও ক্যান্সার হতে পারে।’

আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাঁ-হাতটা বরাভয় ভঙ্গিতে তুলে স্মিত হাসলেন হালদার, বললেন, ‘জানি, এ নিয়ে বিতর্ক আছে—তবে এসব রোগের ভয়টা নিছক অহেতুক নয়।’

ডক্টর হালদার আবার কম্পিউটারের দিকে মনোযোগ দিলেন, কিবোর্ডের বোতাম টিপলেন পটাপট। তারপর আমার দিকে না-তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোন ব্রান্ডের সিগারেট খান, মিস্টার দত্ত?’

‘উইলস ফিল্টার—।’

‘হুঁ। একটা সিগারেটের লেংথ ৭৪ মিলিমিটার, ফিল্টারের লেংথ ২২ মিলিমিটার, ডায়ামিটার সাড়ে সাত মিলিমিটার। আর একটা সিগারেটের ওজন ৯৪০ মিলিগ্রাম। নিকোটিনের পরিমাণ তেমন মারাত্মক নয়। বরং চারমিনারের ওজন ৮৬৫ মিলিগ্রাম আর লেংথ ৬৮ মিলিমিটার হলেও নিকোটিনের সমস্যাটা একটু বেশি। আসলে নিকোটিন নিয়েই যত সমস্যা আমাদের।’

‘হ্যাঁ, দেখেছি—রুমালে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়লে হলদে ছাপ পড়ে।’

‘না, না।’ মাথা নাড়লেন ডক্টর হালদার ‘পিওর নিকোটিনের কোনও রং নেই। দশটা কার্বন পরমাণু, চোদ্দোটা হাইড্রোজেন পরমাণু, আর দুটো নাইট্রোজেন পরমাণু দিয়ে এই ভয়ঙ্কর বিষ তৈরি। প্রকৃতির এমনই লীলা, তামাক পাতার মধ্যে এই বিষ রয়েছে—অবশ্য খুব সামান্য পরিমাণে। আসলে কী জানেন? নিকোটিনের মধ্যেই একটা নেশার টান থাকে। যার জন্যে অনেকেই সহজে সিগারেট ছাড়তে পারে না। আমার কাছে এলে অবশ্য আর কোনও প্রবলেম থাকে না—।’

এই লোকটার কথা যতই শুনছি ততই সিগারেটের তেষ্টা পাচ্ছে আমার।

‘আমরা কীভাবে সিগারেটের নেশা ছাড়াই সেটা বলার আগে ক্লিনিক কী করে সেটা একটু বলি। ডাক্তাররা প্রায় সকলেই একমত যে, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু আশ্চর্য, সিগারেটের নেশা ছাড়ানোর ব্যাপারে ডাক্তারদের তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। যেসব ডাক্তাররা সিরিয়াসলি ট্রিটমেন্ট করতে চান, তাঁরা কেতাবি ঢঙে পেশেন্টদের সাহায্য করেন। যেমন, পেশেন্টের স্মোক করার হিস্ট্রি জানতে চান। বন্ধুর মতো তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, সিগারেট খাওয়া কী-কী কারণে স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। সিগারেটের নেশা ছেড়ে দিলে আখেরে কী-কী লাভ হতে পারে সেগুলোর ওপরে জোর দেন। সিগারেট ছাড়ার ব্যাপারে পেশেন্টকে পরামর্শ দেন, তাকে অ্যাসিস্ট করেন। পেশেন্টের সেলফ-হেলপ-এর জন্যে বইপত্তর পড়তে দেন। দরকার হলে ফরমাল ট্রিটমেন্ট প্রোগ্র্যামে পেশেন্টকে ভর্তি করে নেন। সিগারেট ছেড়ে দেবার পর পেশেন্ট যাতে আবার সিগারেট না ধরে তার জন্যে পেশেন্টকে সাহায্য করেন, উৎসাহ দেন। মোট এই সাতটি কেতাবি ধাপ। আমি এর নাম দিয়েছি ”সপ্তপদী”।’

কথাটা বলে বেশ মজা করে হেসে উঠলেন তারক হালদার। টেবিলে ছোট্ট একটা চাপড় মেরে বললেন, ‘কী বিচিত্র চিকিৎসা! এতে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা এতটুকু কমেছে বলে আপনার মনে হয়?’

আমি প্রশ্নটা পাশ কাটিয়ে গিয়ে বললাম, ‘শুনেছি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলে মাথা ঘোরে, মাথা টনটন করে, পেট ফেঁপে যায়…।’

তারক হালদার মাথা নাড়লেন, বললেন, ‘এর বেশিরভাগটাই মনের অসুখ। তবে সিগারেট হঠাৎ ছেড়ে দিলে কিছু-কিছু অসুবিধে হয় বইকি। এ-জন্যে বিদেশে নিকোটিনওলা চুয়িংগাম পাওয়া যায়। সিগারেটের বদলে পেশেন্টরা ওটা খায়—অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তবেই খায়।’

আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, ‘ডক্টর হালদার, আপনি এখনও আমার ট্রিটমেন্টের কথা কিছুই বলেননি—।’

তারক হালদার মিষ্টি করে হাসলেন। কম্পিউটারের কিবোর্ডে একটা চাটি মারলেন। সঙ্গে-সঙ্গে মনিটরের সব লেখা মুছে গেল। কালো পরদায় শুধু একটা ডস প্রম্পট আর সাদা কারসর দপদপ করতে লাগল।

চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন হালদার। মাথা ঝুঁকিয়ে দু-আঙুলে নাকের গোড়া টিপলেন কয়েকবার। তারপর এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। তাঁর লম্বা চুল-ঝাঁকুনি খেল। হঠাৎই আবার মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখের কনীনিকা সামান্য কটা বলে মনে হল এখন।

‘মিস্টার দত্ত, আমার ট্রিটমেন্টের কায়দা কোনও বইতে লেখা নেই। এটা খুব সহজ, কিন্তু দারুণ কাজ দেয়। কে কী বলল-না-বলল তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা স্রেফ রেজাল্ট চাই—পজিটিভ রেজাল্ট।’

ডক্টর হালদার উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। হাত নেড়ে হেসে বললেন, ‘আমরা কোনও ওষুধ দিই না, নিকোটিনওলা কোনও চুয়িংগামও দিই না। মহাপুরুষদের বাণী শুনিয়ে জ্ঞান দিই না। পেশেন্টকে কোনওরকম ডায়েটিং করতে বলি না। আর—’ চওড়া করে হাসলেন হালদার। তাঁর সুন্দর দাঁতের সারি দেখা গেল। বললেন, ‘পেশেন্ট সিগারেট ছেড়ে যদি টানা একবছর থাকতে পারে তবেই আমরা টাকা নিই। আর তাও খুব সামান্য—পেশেন্টের পাঁচবছরের সিগারেটের নেশার খরচ।’

‘সে কী!’ আমার মুখ দিয়ে শব্দ দুটো যান্ত্রিকভাবে বেরিয়ে এল। ডক্টর হালদার বলছেন কী! এত সস্তা!

‘কেন, অনুপমবাবু আপনাকে এ-কথা বলেননি?’

‘না—।’

‘আচ্ছা, ভালো কথা, মিস্টার মুখার্জি কেমন আছেন? ভালো আছেন তো?’

‘হ্যাঁ, ভালো আছে।’

‘বাঃ, ফাইন। এবারে কয়েকটা প্রশ্ন করব, মিস্টার দত্ত। প্রশ্নগুলো একটু…ব্যক্তিগত, তবে কথা দিচ্ছি এর উত্তরগুলো আর কেউ জানবে না।’

‘বলুন?’ আমার গলাটা শুকিয়ে যেন সাহারা হয়ে গেছে।

‘আপনার স্ত্রীকে আপনি ভালোবাসেন?’

আমি বিরক্ত চোখে তারক হালদারের দিকে তাকালাম, কিন্তু তিনি অবিচলিতভাবে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

সুতরাং অস্পষ্ট গলায় বিড়বিড় করে বললাম, ‘হ্যাঁ, ভালোবাসি—’

‘বাঃ, বেশ, বেশ।’ টেবিলের পাশ দিয়ে আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এলেন ডক্টর হালদার। তারপর আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘আপনার ছেলে তাপসকে আপনি ভালোবাসেন?’

আমি বেশ রেগে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। অনেকটা চেঁচিয়ে বললাম, ‘সিগারেট ছাড়ার সঙ্গে এসব প্রশ্নের কী সম্পর্ক?’

অবুঝ ছেলের রাগ দেখে বুদ্ধিমান পিতা যেমনভাবে ক্ষমার হাসি হাসেন, ঠিক সেইভাবে হাসলেন তারক হালদার। তারপর বললেন, ‘সম্পর্ক আছে, মিস্টার দত্ত। বসুন। উত্তেজিত না-হয়ে আপনি দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন—’

‘হ্যাঁ, ওকে আমি ভীষণ ভালোবাসি,’ বলে আবার বসে পড়লাম চেয়ারে।

‘বাঃ, চমৎকার! কোন স্কুলে পড়ে তাপস?’

‘সে জেনে আপনি কী করবেন?’ একটা সিগারেট! ওঃ, একটা সিগারেট কেউ দয়া করে আমাকে দিক!

তারক হালদার হাসলেন। থুতনিতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, বলতে হবে না। আমরা জেনে নেব। কাল বিকেল তিনটে থেকে আপনার ট্রিটমেন্ট শুরু হবে। যদি আপনার কোনও প্রশ্ন থাকে তা হলে কাল তার উত্তর পাবেন।’

‘আজ তা হলে আসি—’ আমি উঠে পড়লাম। বাইরে বেরিয়েই সিগারেট ধরাতে হবে।

ডক্টর হালদার আবার ফিরে গেছেন নিজের চেয়ারের কাছে।

‘শেষ একটা প্রশ্ন, মিস্টার দত্ত। প্রায় ঘণ্টাখানেক আপনি কোনও সিগারেট খাননি। কেমন লাগছে বলুন—।’

‘ভালোই লাগছে,’ মিথ্যে কথা বললাম। এই বুজরুকটাকে আমি নাস্তানাবুদ করে ছাড়ব। তবে ওর ট্রিটমেন্টের টেকনিকটা জানার জন্যে খুব কৌতূহল হচ্ছে।

‘ভালো, খুব ভালো,’ স্মিত হেসে বললেন হালদার। চশমাটা টেবিল থেকে তুলে আবার বসালেন নাকের ওপর: ‘আজ যত পারেন সিগারেট খান। কাল ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার পর থেকে আর কখনও আপনি সিগারেট খাবেন না। সিগারেটে আপনার অ্যালার্জি হয়ে যাবে।’

‘তাই?’

‘হ্যাঁ, মিস্টার দত্ত। এটা আমার গ্যারান্টি।’ দেওয়ালের ছবির মানুষটার দিকে একপলক তাকিয়ে আমি ডক্টর হালদারের চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

প্রতাপ কোথা থেকে যেন এসে হাজির হল আমার পাশে। চুপচাপ আমাকে এগিয়ে দিল রিসেপশান পর্যন্ত।

পরদিন ‘মুক্তি’-র রিসেপশানে যখন হাজির হলাম তখন কাঁটায়-কাঁটায় তিনটে।

গতকাল সারাটা সন্ধে আর আজ সকালটা শুধু দোটানায় ভুগেছি: তারক হালদারের সঙ্গে আর দেখা করব কি করব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুটো কারণে দেখা করতে এসেছি। প্রথমত, অনুপমের একটা কথা আমার কানে বাজছিল: ‘ট্রাই করে দেখ, এই মানুষটা তোর জীবন একেবারে বদলে দেবে। প্রমিস—।’ আর দ্বিতীয়ত, আমার কৌতূহল।

মৌসুমীকে ‘মুক্তি’-র কথা কিছু বলিনি। কে জানে, গোটা ব্যাপারটা হয়তো একটা ধাপ্পা। পরে ও উঠতে-বসতে এ নিয়ে আমাকে খোঁটা দেবে। ব্যাপারটা আর একটু এগোক, তারপর না-হয় দেখা যাবে।

‘মুক্তি’-র অফিসে ঢোকার আগে বাড়িটার দরজায় দাঁড়িয়ে প্রাণভরে সিগারেটের টান দিয়েছি। একেবারে ফিল্টার পর্যন্ত খেয়ে তারপর টুকরোটা ফেলেছি। এটাই বোধহয় আমার জীবনের শেষ সিগারেট—অন্তত ডক্টর হালদার গতকাল সে-রকমই বলেছেন। কিন্তু সিগারেটের শেষ টানটা কেমন বিচ্ছিরি লাগল।

রিসেটশানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ভেতরে যাওয়ার ডাক পেলাম। প্রতাপ আমাকে পৌঁছে দিল ডক্টর হালদারের ঘরে। তারপর চলে গেল ঘর ছেড়ে।

তারক হালদার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে। বললেন, ‘আসুন, আসুন, মিস্টার দত্ত। আপনি এসেছেন—আমি খুব খুশি হয়েছি। আমাদের বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট প্রথম ইন্টারভিউর পর আর আসেন না। মনে হয়, তাঁরা সিগারেট ছাড়ার ব্যাপারে তেমন সিরিয়াস নন। আশা করি আপনার সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পাওয়া যাবে—।’

হিপনোটাইজ-টিপনোটাইজ করে কিছু করবে না কি? এখন তো হিপনোটিজম ছাড়া আর কিছু আমার মাথায় আসছে না।

‘আমার—ইয়ে, মানে, ট্রিটমেন্ট কখন শুরু হবে?’ ইতস্তত করে জিগ্যেস করলাম।

এবার তারক হালদার একটুও না হেসে বললেন, ‘শুরু হবে নয়, শুরু হয়ে গেছে, মিস্টার দত্ত। আপনি আমার ঘরে ঢোকামাত্রই আপনার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেছে। এখন আপনার সিগারেট না-ছেড়ে আর উপায় নেই। আপনার কাছে সিগারেট আছে?’

 আমি একটু অবাক চোখে ডক্টর হালদারকে দেখলাম বললাম, ‘হ্যাঁ, আছে।’

ডক্টর হালদার প্রথমে চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন। সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে সাদা অ্যাপ্রনটা খুলে ফেললেন গা থেকে। সেটা টেবিলের একপাশে রেখে হাত বাড়ালেন আমার দিকে।

‘সিগারেটগুলো আমাকে দিন—।’

আমি প্যাকেটটা পকেট থেকে বের করে হালদারের হাতে দিলাম। প্যাকেটে তিনটে সিগারেট ছিল।

প্যাকেটটা টেবিলে রেখে তারক হালদার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বুঝতে পারলাম, মানুষটাকে এখন যেন অন্যরকম লাগছে। চশমা, স্টেথো আর অ্যাপ্রন খুলে ফেলায় হালদারকে মোটেই আর ডাক্তার বলে মনে হচ্ছে না। যদিও তাঁর ফুলহাতা চেক শার্ট আর টেরিকটনের প্যান্ট যথেষ্ট আধুনিক এবং নিখুঁত।

হঠাৎই ডানহাত মুঠো পাকিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটার ওপরে এক প্রচণ্ড ঘুষি বসিয়ে দিলেন হালদার। তাঁর কটা চোখ জ্বলজ্বল করছে, সরু ঠোঁটে একচিলতে হাসি।

মুখের ভাব এতটুকু না পালটে প্যাকেটটার ওপরে ঘুষির-পর-ঘুষি মেরে চললেন তিনি। ঘুষির শব্দে বন্ধ ঘরটা যেন কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল। সিগারেটের প্যাকেটটা দলা পাকিয়ে গেল, থেঁতলে গেল, সিগারেটের টুকরো ছিটকে গেল, তামাক ছড়িয়ে গেল টেবিলে।

শব্দেই বোঝা যাচ্ছিল, তারক হালদারের ঘুষির জোর নেহাত কম নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর মুখের হাসিতে এতটুকু চিড় ধরেনি। আমার কেমন ভয়-ভয় করতে লাগল।

তারক হালদার একসময় থামলেন। তাঁর স্বাস্থ্যবান শরীরটা সামান্য হাঁফাচ্ছিল। টেবিল থেকে তামাকের গুঁড়ো আর থেঁতলানো প্যাকেটটা নিয়ে ফেলে দিলেন বাজে-কাগজ-ফেলার ঝুড়িতে। বললেন, ‘মিস্টার দত্ত, বিশ্বাস করুন, এ-কাজে আমি দারুণ আনন্দ পাই। এত বছর হয়ে গেল এ-ব্যবসায় নেমেছি, কিন্তু এই তৃপ্তিতে একটুও ভাটা পড়েনি।’

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আপনার কি মনে হয় এতেই আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেব? এই বিল্ডিং-এর ঠিক উলটো দিকে একটা পানের দোকান রয়েছে—।’

‘ধীরে, মিস্টার দত্ত, ধীরে।’ হাত তুলে আমাকে বাধা দিলেন তারক হালদার ‘এত অল্পে অধৈর্য হবে না। আমি ছেলেমানুষ নই যে, ভাবব এই সিগারেটের প্যাকেট থেঁতলানো দেখেই আপনি সিগারেটের নেশা ছেড়ে দেবেন। সবাই যদি এতই সুবোধ হত তা হলে আমাদের দেশে এত সমস্যা থাকত না। আর আমাদের মতো ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ত না।’

মানুষটাকে আমার কেমন অসহ্য লাগছিল। কিছু একটা বলার জন্যে যেই মুখ খুলতে গেছি অমনি তারক হালদার বাধা দিলেন আমাকে। কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ে ফটাফট কিবোর্ডের বোতাম টিপলেন। একগাদা লেখা ফুটে উঠল মনিটরে।

সেদিকে তাকিয়ে হালদার বললেন, ‘আপনার ছেলে হেয়ার স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে। কথায় সামান্য তোতলামি ভাব আছে। বিয়ের আগে আপনার স্ত্রীর পদবি ছিল নন্দী। উনি ইকনমিক্স নিয়ে বি. এ. পাশ করেছেন। আপনারা আগে—।’

আমি রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। উত্তেজিতভাবে বললাম, ‘এসব আপনি কোত্থেকে জানলেন? কোন সাহসে আপনি আমার ফ্যামিলি—।’

তারক হালদার এতটুকু বিচলিত হলেন না। শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি তো কালই আপনাকে বলেছি, দরকার পড়লে আমরা সব জেনে নেব। তবে আপনার কোনও চিন্তা নেই, এসব আর কেউ জানতে পারবে না।’

‘অনেক ধন্যবাদ। আমি চললাম।’ সিগারেটের নেশা আমি ছাড়তে চাই না।’ আমি চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে এগোতে গেলাম দরজার দিকে।

‘মিস্টার দত্ত!’

তারক হালদারের ডাকে থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম মানুষটার মুখ ভাবলেশহীন। বাঁ-হাতে ঘাড়ের কাছে লম্বা চুলগুলো একটু নেড়ে তিনি বললেন, ‘এখুনি যাবেন না, মিস্টার দত্ত। দয়া করে একটু বসুন, কথা আছে।’

আমি ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসলাম। হালদার তখন মিটিমিটি হাসছেন—যেন এরকম ছেলেমানুষি উত্তেজনা দেখে-দেখে তিনি ক্লান্ত।

‘আপনাকে তো আগেই বলেছি, মিস্টার দত্ত। আমরা কাজের লোক—শুধু কাজ বুঝি। আমরা শুধু রেজাল্ট চাই, রেজাল্ট। সিগারেটের নেশা ছাড়ানো যে কী ঝামেলার তা আমরা হাড়ে-হাড়ে জানি। এ-নেশা যাঁরা ছাড়েন তাঁদের শতকরা প্রায় সত্তরভাগ আবার পুরোনো হ্যাবিটে ফিরে যান। অথচ দেখুন, ড্রাগের নেশা যাঁরা একবার ছাড়েন, তাঁদের শতকরা পাঁচজনও ওই ড্রাগের নেশায় আর ফিরে যান না। সেদিক থেকে সিগারেটের নেশাটা বড় অদ্ভুত। এককথায় এক্সট্রর্ডিনারি।’

ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের দিকে চোখ গেল আমার। প্রায় ইঞ্চিদেড়েক লম্বা একটা সিগারেটের টুকরো দেখা যাচ্ছে। ওটা ধরিয়ে অনায়াসে গোটাকয়েক টান দেওয়া যায়। কিন্তু তারক হালদার আমাকে লক্ষ করছিলেন। একটু হেসে টুকরোটা তুলে নিলেন বাজে-কাগজ-ফেলার ঝুড়ি থেকে। দু-আঙুলে রগড়ে ওটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করলেন। তারপর আবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুরু করলেন।

‘ছবির ওই মানুষটাকে দেখুন, মিস্টার দত্ত—’ আঙুল তুলে অয়েল পেন্টিং-এর শীর্ণকায় মানুষটিকে দেখালেন তারক হালদার: ‘সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া ওই কর্মঠ মানুষটার জীবন অকালে শেষ করে দিয়েছে। প্রথমে স্মোকার্স লাঙ, তারপর লাঙ ক্যান্সার, আর সবশেষে মৃত্যু—অকালমৃত্যু। লক্ষ-লক্ষ টাকার মালিক ছিলেন ভদ্রলোক। যখন বুঝতে পারলেন, শেষদিন আর বেশি দূরে নেই, তখন তাঁর শেষ ইচ্ছের কথা বলেছিলেন: সিগারেটের কুৎসিত নেশাকে উচ্ছেদ করতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়া তাঁর চোখে ছিল অশ্লীল। তাই অঢেল টাকা ঢেলে গড়ে তুলেছিলেন ”মুক্তি” ফাউন্ডেশন। মারা যাওয়ার সময় আমার দু-হাত চেপে ধরে জানিয়েছিলেন তাঁর সাধের কথা। আমি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম। তাই আমার চোখের সামনে এই ছবি রেখেছি। ছবির ওই মহৎ মানুষটা সবসময় তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে, আমাকে শাসনে রেখেছে—যেন আমার শপথের কথা আমি কখনও ভুলে না যাই।’

কথা বলার সময় তারক হালদারের মুখের রেখা নরম হয়েছিল। নিজেকে সামলে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন তিনি। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন ধীরে-ধীরে, ‘মিস্টার দত্ত, সবচেয়ে আশ্চর্য হল, ওই মানুষটি নিজে ডাক্তার ছিলেন—ডক্টর মহেন্দ্রনাথ হালদার। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তিনি সিগারেটের নেশা ছাড়তে পারেননি। এটাই হচ্ছে ট্র্যাজেডি।’

‘উনি কি আপনার কেউ…’

‘হ্যাঁ। আমার বাবা। আমার নাম উনি রেখেছিলেন তারকনাথ। কিন্তু ওঁর মৃত্যুর পর অকালে যখন অনাথ হলাম নিজের নাম থেকে ওই নাথটুকু আমি ছেঁটে ফেলে দিয়েছি। এখন আমার সামনে শুধু একটাই লক্ষ্য। আমার ক্লিনিকের লাভটা বড় কথা নয়, কাজটাই বড় কথা।’

তারক হালদার হাত বুলিয়ে মুখ মুছলেন, বললেন, ‘আচ্ছা, মিস্টার দত্ত, সিগারেটের ধোঁয়া যখন এঁকেবেঁকে শূন্যে ভেসে যায় তখন মনে হয় না কোনও তরুণীর শরীরের কোমল ভাঁজ-খাঁজ এসব ফুটে উঠছে?’

আমি বিরক্ত হয়ে জবাব দিলাম, ‘না, কখনও ভেবে দেখিনি।’

‘এবার থেকে ভেবে দেখবেন। আসলে পুরো ব্যাপারটার মধ্যেই একটা বিকৃত যৌনকামনা লুকিয়ে আছে। এই যে লম্বা সরু সিগারেট দু-ঠোঁটে চেপে ধরে আপনারা চোষেন—মানে টানেন, সেটাও ওই সেক্সের ব্যাপার। ফ্রয়েড দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। অথচ দেখুন, সিগারেটের নেশাকে আমাদের সমাজ মোটেই অন্যায় বলে মনে করে না—’ একটু চুপ করে থেকে চোয়ালের রেখা শক্ত করে তারক হালদার চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আমি অন্যায় বলে মনে করি। সমাজ অসুস্থ বলে আমি তো আর অসুস্থ হতে পারি না—।’

‘এবারে ট্রিটমেন্টের ব্যাপারটা দয়া করে বলবেন?’ আমার ধৈর্য ক্রমশ কমে আসছিল।

‘হ্যাঁ, এবার সে কথাই বলব।’ দাঁত বের করে হালদার হাসলেন: ‘দেখবেন, আমার টেকনিকটা শোনার পর আপনার সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যাবে। আসুন, এদিকে আসুন—।’

তারক হালদার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন, পেছনের দেওয়ালের সবুজ পরদা ঢাকা ছোট জানলাটার কাছে গেলেন। কী। একটা বোতাম টিপতেই পরদা সরে গেল। ততক্ষণে আমি ওঁর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

গোটা জানলাটা কাচে ঢাকা। কাচের মধ্যে দিয়ে ও-পাশের একটা ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরের মেঝেটা ইস্পাতের তৈরি। তার ঠিক মাঝখানে একটা প্লেটে কিছু কচি ঘাস আর লেটুস পাতা রয়েছে। গলায় টুকটুকে লাল ফিতে বাঁধা একটা সাদা-কালো খরগোশ প্লেটের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আপনমনে ঘাস-পাতা খাচ্ছে। আর মাঝে-মাঝে এদিক-ওদিক মাথা নাড়তেই ওর লম্বা-লম্বা কান দুটো নড়ছে।

প্রাণীটার মখমলের মতো লোম এত লোভনীয় যে, হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ডক্টর হালদার খরগোশটা আমাকে দেখাচ্ছেন কেন? খরগোশের সঙ্গে সিগারেটের সম্পর্ক কী?

‘খরগোশটার দিকে নজর রাখুন, মিস্টার দত্ত।’ কথাটা বলেই তারক হালদার জানলার তাকে লাগানো একটা লাল বোতাম টিপতে লাগলেন, আর নিরীহ প্রাণীটা খাওয়া থামিয়ে তিড়ি-তিড়িং করে লাফাতে লাগল।

ওটার চোখ গোল-গোল হয়ে গেল। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল শজারুর কাঁটার মতো। আর লাফাতে লাগল পাগলের মতো।

‘কী করছেন কী! খরগোশটাকে মেরে ফেলবেন না কি!’

আমার চিৎকারে এতটুকুও বিচলিত না-হয়ে তারক হালদার বললেন, ‘না, মরবে না। খুব অল্প ভোল্টেজের ইলেকট্রিক শক দিয়েছি—।’

লক্ষ করলাম, একটা সরু তার কোথা থেকে যেন এসে খরগোশটার গলার ফিতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।

‘দেখুন খরগোশটা এবার কী করে।’ বোতাম থেকে হাত সরিয়ে তিনি বললেন।

খরগোশটা প্লেট থেকে প্রায় ছ-সাত ফুট দূরে সরে গেছে। গুটিসুটি মেরে বসে থরথর করে কাঁপছে। চোখে দিশেহারা ভয়।

‘খাওয়ার সময় যদি খরগোশটাকে বারবার এরকম শক দেওয়া হয় তা হলে ও ধরে নেবে, খেতে গেলেই ব্যথা পেতে হবে। সুতরাং, ও খাওয়া ছেড়ে দেবে। শক দিতে-দিতে এরকম একটা অবস্থা আসবে, মিস্টার দত্ত, যখন সামনে খাবার থাকা সত্ত্বেও খরগোশটা ভয়ে খাবার ছুঁয়ে দেখবে না। স্রেফ উপোস করে মরে যাবে। এটাকে বলে ”অ্যাভারশন ট্রেনিং”। আমি এর বাংলা নাম দিয়েছি ”বিতৃষ্ণা-থেরাপি”।’

কথা শেষ করে হো-হো করে হেসে উঠলেন ডক্টর হালদার। ওঁর চোখ অদ্ভুতভাবে চকচক করতে লাগল। আর আমি সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারলাম, আমার সিগারেটের নেশা ছাড়াতে ওঁর ট্রিটমেন্ট ঠিক কোন পথ ধরে এগোবে। সুতরাং আর একটি কথাও না-বলে আমি সোজা এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে।

‘মিস্টার দত্ত, প্লিজ, আমার কথাটা আগে শুনুন—।’

আমি দরজার হাতল ধরে টান মারলাম।

দরজা বন্ধ!

‘ডক্টর হালদার, যদি এক্ষুনি দরজা না খুলে দেন তা হলে দশমিনিটের মধ্যে পুলিশ এখানে চলে আসবে।’

বরফের মতো ঠান্ডা গলায় তারক হালদার বললেন, ‘বসুন, মিস্টার দত্ত।’

তারক হালদারের সবকিছুই যেন এখন পালটে গেছে। ওঁর চোখে এখন মহেন্দ্রনাথ হালদারের শোণিত দৃষ্টি। চোয়ালের রেখা শক্ত। জিভ বুলিয়ে নিলেন ঠোঁটে। টেবিলে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ায় কাঁধের পেশি ফুলে উঠেছে। ঠোঁটের একটা কোণ সামান্য বেঁকিয়ে এক অদ্ভুত বেপরোয়া হাসি ফুটিয়ে তুললেন। কপালের একটা শিরা কাঁপছে। সব মিলিয়ে শিকারি যেন শিকারের দৌড় দেখছে।

মানুষটাকে এই প্রথম সাইকোপ্যাথ বলে মনে হল। এই মুহূর্তে একটা সিগারেটের বিনিময়ে আমি একটা সাম্রাজ্য দিয়ে দিতে পারি।

‘আমার সহজ ট্রিটমেন্টের কায়দাটা আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলি।’

‘ঢের হয়েছে, ডক্টর হালদার। আপনার ট্রিটমেন্টে আমার আর কোনও আগ্রহ নেই। এই সোজা ব্যাপারটা আপনার মাথায় কেন যে ঢুকছে না বুঝতে পারছি না!’

‘না, ব্যাপারটা বরং উলটো। আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, মিস্টার দত্ত, আপনার আর ফেরার পথ নেই। আমি যখন বলেছি আপনার ট্রিটমেন্ট শুরু হয়ে গেছে তখন সত্যি-সত্যিই শুরু হয়ে গেছে। বসুন, আপনাকে একটু বুঝিয়ে বলি…।’

‘সে আপনি যতই বোঝান, এখান থেকে বেরিয়েই আমি পাঁচ প্যাকেট সিগারেট কিনব। তারপর সেগুলো টানতে-টানতে থানায় পৌঁছে যাব।’ টের পাচ্ছিলাম, নেহাত অকারণেই আমার বুকের ভিতরে হাতুড়ির শব্দ হচ্ছে।

‘আপনার যা মরজি। তবে আমার ধারণা, পুরো ব্যাপারটা শোনার পর আপনি বোধহয় মত পাল্টাবেন।’ তারক হালদার একইভাবে টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বললেন।

আমি বিরক্তভাবে চেয়ারের কাছে এলাম। অযথা শব্দ করে চেয়ারটা হ্যাঁচকা মেরে টেনে নিয়ে বসে পড়লাম: ‘বলুন, শুনি—।’

‘ট্রিটমেন্টের প্রথম মাসটায় আমার লোকেরা আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা নজরে রাখবে। চব্বিশ ঘণ্টায় যদি আপনাকে ওরা সিগারেট খেতে দ্যাখে তাহলে সঙ্গে-সঙ্গে আমাকে ফোন করে জানাবে।’

‘আর আপনি আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসে ওই খরগোশের খেলা খেলাবেন?’ আমার কথায় খানিকটা ব্যঙ্গ আর তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া ছিল, কিন্তু মনের গভীরে একটা আতঙ্ক জন্ম নিচ্ছিল ধীরে-ধীরে। আমি বোধহয় কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছি।

‘না, না। আপনি ভুল বুঝেছেন, মিস্টার দত্ত।’ তারক হালদার সাপের মতো হাসলেন: ‘এই ইলেকট্রিক শক আপনাকে দেওয়া হবে না—দেওয়া হবে আপনার স্ত্রীকে। আর আপনি জানলা দিয়ে দেখবেন। আপনি তো জানেন, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।’

আমি স্তম্ভিত হয়ে ডক্টর হালদারকে দেখছিলাম। আপনার স্ত্রীকে আপনি ভালোবাসেন? আপনার ছেলে তাপসকে আপনি ভালোবাসেন? এসব অদ্ভুত প্রশ্নের কারণ বোধহয় এখন বোঝা যাচ্ছে।

‘মিস্টার দত্ত, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর—এই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ আপনি বহুবার দেখেছেন, কিন্তু আমল দেননি। এর কারণ কী জানেন? কারণ, এই ওয়ার্নিং-এর আসল অর্থটা আপনি বোঝেননি।’

তারক হালদার আক্ষেপে মাথা নাড়লেন, হাতে হাত ঘষলেন।

‘আপনার আর কী দোষ! এই ওয়ার্নিং-এর আসল অর্থটা বেশিরভাগ লোকই বোঝে না। আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলি। আপনি সিগারেট খেলে শুধু আপনার নয়, আপনার ফ্যামিলিরও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে। আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, আপনার ছেলের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হবে, আর আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি তো হবেই। হাইলি ইনজুরিয়াস।’

ডক্টর হালদার পায়ে-পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এলেন। তাঁর সহজ ট্রিটমেন্টের কায়দাটা জলের মতো বুঝিয়ে দিলেন আমাকে।

আমার প্রথম ভুলের জন্যে মৌসুমীকে তুলে নিয়ে এসে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার অবাধ্য হলে আমার কপালে জুটবে ওই শাস্তি। তৃতীয়বার আমাদের দুজনকেই শক দেওয়া হবে। আর চতুর্থবার যদি সিগারেট ধরানোর ভুল করি তা হলে বাধ্য হয়ে ডক্টর হালদার তাপসের স্কুলে কাউকে পাঠিয়ে দেবেন। সুযোগ বুঝে ছেলেটাকে ধরে একটু ‘পালিশ’ দেওয়া হবে।

জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে ডক্টর হালদার বললেন, ‘বাচ্চাটার কী কপাল দেখুন! বাপি কথা শুনছে না দেখে সে মার খাচ্ছে—।’

‘আপনি মানুষ না জানোয়ার!’ রাগে আমার মাথা দপদপ করছিল। বুকের ভিতরেও কেমন এক ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেছে।

তারক হালদার মোলায়েম হেসে বললেন, ‘তবে ভয়ের কিছু নেই, মিস্টার দত্ত। আমার কাছে যত ক্লায়েন্ট আসে তাদের ফর্টি পার্সেন্টের ক্ষেত্রে কোনও স্টেপ আমাকে নিতে হয় না। আর তিন-তিনবার অবাধ্য হয় এরকম ক্লায়েন্টের সংখ্যা মাত্র টেন পার্সেন্ট। এতে আপনার ভরসা পাওয়া উচিত।’

ভরসা দূরের কথা, একটা ঠান্ডা ভয় আমাকে পাকে-পাকে জড়িয়ে ধরছিল।

‘যদি পাঁচবারের বার আপনি একই ভুল করেন, তা হলে…।’

‘কী বলতে চান আপনি?’

হালদার নিষ্পাপ হাসলেন: ‘আপনাকে আর মিসেস দত্তকে শক দেওয়া হবে। তাপসকে আবার পালিশ দেওয়া হবে, আর মিসেস দত্তকে একটু-আধটু রগড়ে দেওয়া হবে—।’

আমি ধৈর্য হারিয়ে ক্ষিপ্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লাম ডক্টর হালদারের ওপরে। ওঁর জামাটা খামচে ধরে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে লাগলাম। কিন্তু ডক্টর হালদার চোখের পলকে একটু সরে গিয়ে হাঁটু চালিয়ে দিলেন আমার তলপেটে। বাঁহাতে আমার চুলের মুঠি ধরে টান মেরে মাথাটা হেলিয়ে দিলেন একপাশে। তারপর ডানহাতের শক্ত আঙুলে আমার টুটি টিপে ধরে সজোরে এক ধাক্কা মারলেন। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম মেঝেতে। আহত জন্তুর মতো হাঁফাতে লাগলাম।

‘শান্ত হয়ে বসুন, মিস্টার দত্ত। আপনাকে তো বলেছিলাম, আমরা চণ্ডীপাঠ দিয়ে শুরু করি…আর জুতো সেলাই দিয়ে শেষ করি।’

হাত ধরে আমাকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন তারক হালদার। তাঁর ভাবখানা এমন, যেন কিছুই হয়নি।

‘আসুন, এবার ভদ্রলোকের মতো কথাবার্তাগুলো শেষ করে নেওয়া যাক।’

আমি বড়-বড় শ্বাস নিতে-নিতে ভাবছিলাম, এই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কখন শেষ হবে।

‘মুক্তি’-র চিকিৎসা পদ্ধতিতে শাস্তির ধাপ রয়েছে দশটি। ছ’নম্বর, সাত নম্বর আর আট নম্বর ধাপ হল ইলেকট্রিক শক আর পালিশ। তবে শকের ভোল্টেজের মাত্রা যেমন বাড়বে তেমনই বাড়বে পালিশের তেজ। সেইসঙ্গে মিসেস দত্তকে শ্লীলতাহানি থেকে শুরু করে ধর্ষণের ভয় পর্যন্ত দেখানো হবে। ন’নম্বর ধাপ হল তাপসের যে-কোনও একটা হাত ভেঙে দেওয়া।

‘আর দশ নম্বর?’ আমার গলার ভিতরে ধুনি জ্বলছে। টের পাচ্ছি, ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে। শীততাপনিয়ন্ত্রণ গোল্লায় গেছে।

তারক হালদার হতাশভাবে মাথা নেড়ে বসে পড়লেন নিজের চেয়ারে।

‘তখন আমরা হাল ছেড়ে দিই, মিস্টার দত্ত। মাত্র টু পার্সেন্ট পেশেন্টের ক্ষেত্রে আমার ট্রিটমেন্ট ফেইল করে। আপনি তখন সেই টু পার্সেন্টের দলে পড়বেন—।’

‘সত্যি আপনি হাল ছেড়ে দেন?’

‘বলতে গেলে একরকম তাই।’ কথা বলতে-বলতে ডক্টর হালদার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সাইলেন্সার লাগানো কোল্ট অটোমেটিক পিস্তল বের করে টেবিলে রাখলেন: ‘তবে সেই অবাধ্য দু-পার্সেন্ট ক্লায়েন্ট জীবনে আর কখনও সিগারেট খায় না। আমার আগমার্কা গ্যারান্টি—’

রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে টিভিতে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ দেখছিলাম। মৌসুমী থালায় ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিচ্ছিল আর মাঝে-মাঝে টিভির দিকে তাকাচ্ছিল। তাপস আগেই খেয়েদেয়ে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমি অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলাম, আর অন্যমনস্ক হয়ে বারবার দাঁত দিয়ে নখ কাটছিলাম।

খাওয়া শুরু করেই মৌসুমী জিগ্যেস করল, ‘তোমার কী হয়েছে বলো তো! সেই তখন থেকে কেমন করছ!’

আমি খেতে-খেতেই গম্ভীরভাবে বললাম, ‘না, কিছু না। মানে…আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’

এরকম ঘোষণা মৌসুমী আগে অনেক শুনেছে। তাই খাওয়া থামিয়ে ও হাসল। হাসলে ওর ডান গালে টোল পড়ে। দারুণ দেখায়। ওকে প্রায়ই বলি, ‘তোমার ওই টোলে পড়ে আমার আইবুড়ো জীবনটা একেবারে শেষ হয়ে গেল।’ এখন বলতে ইচ্ছে করল না।

ওর চোখে তাকিয়ে সিরিয়াসভাবে বললাম, ‘সত্যি ছেড়ে দিয়েছি।’

ও হেসে বলল, ‘কখন ছেড়েছ? পাঁচমিনিট আগে?’ আবার খেতে শুরু করল।

‘না, বিকেল তিনটে থেকে।’

‘তখন থেকে একটাও সিগারেট খাওনি!’ মৌসুমীর খাওয়া একেবারে থেমে গেছে।

‘না।’ আমি কখন আবার যেন দাঁত দিয়ে নখ কাটতে শুরু করেছি।

‘এরকম একটা দারুণ খবর—কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইছে না। কিন্তু হঠাৎ ছাড়তে গেলে কেন?’

‘তোমার জন্যে…আর, তাপসের জন্যে…।’

মৌসুমী এবার চোখ বড় করে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। তারপর একটু দূরে একটা খাটো টেবিলে রাখা অ্যাশট্রের দিকে একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘হঠাৎ এই সুবুদ্ধি তোমাকে কে দিয়েছে জানি না, তবে এই প্রতিজ্ঞা টিকলে হয়।’

এই প্রতিজ্ঞা টিকবে, মৌসুমী। না টিকলে তোমাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে-দিয়ে ওরা নীল করে দেবে। তোমার গালের ওই টোল সমান করে দেবে ক্ষুর দিয়ে। তাপসকে ওরা চুরমার করে দেবে। আমাদের জীবন একেবারে বদলে দেবে।

মুখে বললাম, ‘এবার আমাকে পারতেই হবে।’

মৌসুমী খেতে শুরু করল আবার: ‘পারলে তো ভালোই। পয়সা বাঁচবে। তা ছাড়া তোমার সিগারেটের ওই উৎকট ধোঁয়া আমার একটুও ভালো লাগে না।’

ডক্টর হালদারের ভাবলেশহীন মুখটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। তলপেটটা এখনও ব্যথা করছে। আতঙ্ক জমাট বেঁধেছে শরীরের ভেতরে কোথাও। দরকার পড়লে ওই মানুষটা যে নির্মম হতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছি আমি। আমার সঙ্গে বন্দি খরগোশটার কোনও তফাত নেই।

খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম বটে কিন্তু চোখে ঘুম এল না।

মৌসুমী তাপসের সঙ্গে পাশের ঘরে শুতে চলে গেছে। যাওয়ার আগে আমার বিছানা পেতে মশারি টাঙিয়ে কপালে হাত বুলিয়ে আদর করে গেছে। আর নিচু গলায় বলেছে, ‘ইচ্ছে করলে সিগারেট খেয়ো। আমি রাগ করব না।’ রাগ না-করলে মৌসুমীর কোনও তুলনা নেই।

আমি উত্তর না দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরেছি। অকুল সাগরে মৌসুমী আর তাপসই আমার খড়কুটো।

ওর হাতে আলতো করে চুমু খাওয়ার পর ও চলে গেল। দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে শোওয়ার আগে একটা সিগারেট আমার বড় প্রিয় ছিল। বিছানার পাশেই তাকে রয়েছে সিগারেট আর লাইটার। অন্ধকারে ওগুলো ব্যবহার করছি সাতবছর ধরে। চোখে না দেখতে পেলেও ওদের স্থানাঙ্ক আমার ভুল হয় না। যদি হাত বাড়াই তা হলে এখনও ভুল হবে না। প্যাকেটে এখনও চারটে সিগারেট আছে আমি জানি। কিন্তু…। শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিলাম একবার। তাকালাম মাথার কাছের জানলার দিকে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। কেউ কি এখনও লক্ষ রাখছে আমার ওপরে?

তারক হালদারের কথাগুলো মনে পড়ছিল। প্রথম মাসে চব্বিশ ঘণ্টা আমার ওপরে নজর রাখা হবে। পরের দু-মাসে আমি নজরবন্দি থাকব দিনে আঠেরো ঘণ্টা করে। কিন্তু কোন আঠেরো ঘণ্টা সেটা বুঝতে পারব না। চতুর্থ মাসটাই পেশেন্টেদের পক্ষে বেশি বিপজ্জনক। তখন তাদের মনটা আঁকুপাঁকু করে একটা সিগারেটের জন্যে। সেই কারণেই তারক হালদার তখন আবার চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করেন—পেশেন্টেদের স্বার্থে। তারপর আটমাস ধরে দিনে বারো ঘণ্টা করে। একটানা বারো ঘণ্টা নয়, এলোমেলো বারো ঘণ্টা। তারপর?

তারপর সারা জীবন ধরে চলবে এই নজরদারি। তারক হালদারের খেয়ালখুশি মতো।

সারাটা জীবন আমাকে ‘মুক্তি’-র বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

ডক্টর হালদারের ভয়ঙ্কর হাসিটা মনে পড়ল।

‘সবসময়েই আপনাকে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হবে, মিস্টার দত্ত। কেউ কি এই মুহূর্তে লুকিয়ে লক্ষ করছে আমাকে? দু-বছর পর হয়তো একদিন-বাদে-একদিন নজর রাখব আপনার ওপরে। কিংবা টানা একসপ্তাহ, বা মাসে দশদিন। আপনি কিচ্ছু টের পাবেন না। যদি কখনও লুকিয়ে সিগারেট টান দেন, তা হলে সে-রিস্ক আপনার। যদি সাধ করে সাপ নিয়ে খেলতে চান খেলবেন। কিন্তু আপনার মনে ভয় থাকবে: কেউ কি জানতে পেরেছে? তাপসকে কেউ কিডন্যাপ করেনি তো? আমার বউকে কেউ তুলে নিয়ে যায়নি তো? কী চমৎকার কায়দা বলুন তো, মিস্টার দত্ত! এই অবস্থায় যদি আপনি সিগারেটে লুকিয়ে একটি টানও দেন, তা হলে দেখবেন কী বিচ্ছিরি তার টেস্ট। মনে হবে, আপনি যেন বউ আর ছেলের রক্ত চুষে খাচ্ছেন।’

কিন্তু এখন, এই নিঝুম রাতে, কেউ কি সত্যিই নজর রেখেছে? মনে হয় না। তাছাড়া জানলা দিয়ে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তারক হালদার বলেছিলেন, ‘নজরদারির কাজ যারা করবে তাদের দু-একজনকে হয়তো আপনি চিনে ফেলবেন, কিন্তু সবাইকে চিনতে পারবেন না…।’

নিকুচি করেছে তারক হালদারের! উচ্ছন্নে যাক ‘মুক্তি’ আর ওই সিড়িঙ্গে বুড়ো মহেন্দ্রনাথ হালদার!

আমার অবাধ্য হাত অন্ধকারে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। অন্ধকারে আগুন জ্বলে উঠল। উপোসী ঠোঁট যেন একযুগ পর সিগারেটের স্বাদ পেল। আঃ—!

কীসের একটা শব্দ হল না? কোনদিক থেকে এল শব্দটা? বুকের ভেতরে আচমকা একটা ঢিপঢিপ শব্দ শুরু হয়ে গেল। সিগারেট ধরা হাতটা কাঁপতে লাগল অবাধ্য হয়ে। সিগারেটের ধোঁয়া ফুসফুসের ভিতরে জট পাকিয়ে কাশি পেল। দম আটকে যেতে চাইল কাশির দমকে। তাড়াতাড়ি সিগারেটটা নিভিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলাম জানলা দিয়ে। আবছা অন্ধকারে হাত নেড়ে ধোঁয়ার রেখা সাফ করে দিতে চাইলাম। হে ভগবান, কেউ যেন দেখতে না-পায় আমার এই অবাধ্য আচরণ! মৌসুমী…তাপস…সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।

শত চেষ্টাতেও ঘুম আসতে চাইল না চোখে। হাত দিয়ে চোখ ঢেকে শুয়ে রইলাম অন্ধকারে। শুনতে লাগলাম আমার ভয়ার্ত হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি।

সকালে চায়ের কাপ, খবরের কাগজ, শীতের বারান্দা—অথচ সিগারেট নেই! প্রাত্যাহিক কাজে টয়লেটে বন্দি, অথচ সিগারেট নেই! অফিসের ইয়ার এন্ডিং-এর বাড়তি কাজ বাড়িতে বয়ে নিয়ে এসে রাত জেগে ফাইল ওলটানো, অথচ সিগারেট নেই! রাতের খাওয়া সেরে খোলা বারান্দায় ‘ওয়াক এ মাইল’ অথচ সিগারেট নেই!

শেষ পর্যন্ত আমি বাঁচব তো!

কী করে যে এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়লাম! স্রেফ অনুপমের জন্যে! ও তো স-ব জানত! তবু কেন আমাকে এই ভয়ঙ্কর ফাঁদে ফাঁসাল? ওকে একবার হাতের কাছে পাই!

আবার কানে এল শব্দটা। দরজার কাছ থেকে কি শব্দটা ভেসে এল?

উঠে দরজার কাছে গিয়ে শুনব ভালো করে?

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। অন্ধকারে পা টিপে-টিপে গেলাম দরজার কাছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজা খোলার সাহস পেলাম না।

পায়ে-পায়ে আবার বিছানায় ফিরে এলাম। এই অসহায় মুহূর্তে আমার মন ভীষণভাবে মৌসুমীকে পাশে চাইছিল। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে সময় কাটতে লাগল আমার।

ভোরবেলার দিকে বোধহয় সামান্য তন্দ্রা এসে থাকবে, কারণ মৌসুমীর ডাকে ঘুম ভাঙল। চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছ, অফিসে যে দেরি হয়ে যাবে।’

জানলা দিয়ে চোখে রোদ এসে পড়ছিল। বিছানায় উঠে বসলাম। চোখ জ্বালা করছে। মাথা দপদপ করছে। জিভে তেতো স্বাদ।

তড়িঘড়ি চায়ের কাছে চুমুক দিতে গিয়ে জিভে ছ্যাঁকা লেগে গেল।

মৌসুমী চোখ মটকে বলল, ‘এখনও তুমি সিগারেট-অনশন চালিয়ে যাচ্ছ, না কি একটা-আধটা টেনেছ?’

আমি জড়ানো গলায় জবাব দিলাম, ‘না, খাইনি।’

কাল রাতের ওই একটা-দুটো টানকে কি আর খাওয়া বলে!

‘দেখবে, অফিসে গিয়েই তোমার প্রতিজ্ঞা পিঠটান দেবে—।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কী হচ্ছে, মউ! আমি কোথায় সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তাতে হেলপ না-করে তুমি উলটে…।’

‘আচ্ছা বাবা, ভুল হয়েছে, সরি—।’

আমি বাঁ-হাতটা মৌসুমীর কাঁধে রাখলাম। ওর ঘাড়ের কাছে আলতো করে আঙুল চালালাম। এ যে কী মারাত্মক প্রতিজ্ঞা সেটা তোমাকে কেমন করে বোঝাই বলো তো, মউ! এ যে আমার ভীষণ গোপন কথা।

বাথরুমের দরজায় আওয়াজ হল।

‘যাই, তাপস বোধহয় স্নান করে বেরিয়েছে—’মৌসুমী সরে গেল আমার কাছ থেকে। তাপসকে ও ভীষণ ভালোবাসে—হয়তো আমার চেয়েও বেশি। কিন্তু আমি যে ওদের দুজনকে তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। ওরা যদি জানত, আমার সমস্ত প্রতিজ্ঞা শুধু ওদেরই জন্যে!

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই একটা ধাক্কা খেলাম।

কলিংবেল বাজাতে দরজা খুলল শান্তির মা। কিন্তু মৌসুমী বাড়িতে থাকলে ও-ই দরজা খোলে। আমার বেল বাজানোর ঢং ওর খুব চেনা। এসময়ে ও কোথায় বেরোল?

তাপস চাটার্ড বাসে করে স্কুলে যায়-আসে। যাওয়ার সময় মৌসুমী ওকে নিয়ে যায় অরবিন্দ সেতুর মুখে, বাসে তুলে দেয়। আর ছুটির সময় তাপসকে বাস থেকে নামতে হয় ওই একই জায়গায়। সেখান থেকে ওকে নিয়ে আসে আমাদের কাজের লোক শান্তির মা। তাপসকে নিয়ে বাড়ি ফিরে ও বউদিদিমণিকে পায়নি। কলিংবেলের শব্দে কেউ সাড়া দেয়নি। তখন পাশের ফ্ল্যাট থেকে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে শান্তির মা আমাদের ফ্ল্যাটের দরজা খোলে। এমার্জেন্সি অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্যে আমাদের ফ্ল্যাটের একটা বাড়তি চাবি পাশের ফ্ল্যাটে রাখা থাকে। শান্তির মা সেটা জানে।

শান্তির মায়ের কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তাপস সরল নিষ্পাপ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে। ওর স্কুল থেকে ফেরার সময়ে মৌসুমী কখনও ফ্ল্যাট ছেড়ে যায় না। হঠাৎ গেলেও খবর রেখে যায়। পাশের ফ্ল্যাটের রবীনবাবুকে সে ব্যাপারে জিগ্যেস করতে যাব ভাবছি, এমনসময় টেলিফোন বেজে উঠল।

কে ফোন করছে? কোনও হসপিটাল থেকে? না কি পুলিশ?

‘দাদাবাবু, একটু আগে কে একজন আপনাকে ফোন করেছিল…।’

শান্তির মায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ছুটে গিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে কানে চেপে ধরেছি।

‘হ্যালো—।’

‘রাজীব দত্ত?’ একজন পুরুষের গলা।

‘কথা বলছি।’ অকারণেই আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল।

‘সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।’

এইবার গলাটা চিনতে পারলাম। ডক্টর তারক হালদার।

কিন্তু আমি কিছু বলে ওটার আগেই তিনি বললেন, ‘দত্তবাবু, আপনি সাতটা নাগাদ আমার চেম্বারে একবার আসতে পারবেন? একটু দরকার ছিল।’

‘মৌসুমী…আমার স্ত্রী কোথায়?’

‘কোথায় আবার, আমার কাছে।’ হালদার চিবিয়ে-চিবিয়ে হাসলেন।

আমার চোখের সামনে হাজার-হাজার সরষে ফুল নাচছিল আর একটা সাদা-কালো খরগোশ লাফাচ্ছিল পাগলের মতো। কাল রাতে আমি সিগারেটে দুটো টান দিয়েছি।

‘ডক্টর হালদার, প্লিজ, ওকে কিছু করবেন না…ছেড়ে দিন। কাল রাতে…আমি মাত্র দুটো টান দিয়েছি…শরীরটা কেমন খারাপ লাগছিল…প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন!’

আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। আরও অনেক কিছু বলতে চাইছিলাম, কিন্তু—।

‘সাতটায় আমাদের দেখা হচ্ছে।’ তারক হালদার নির্লিপ্ত গলায় বললেন, তারপরেই টেলিফোনের লাইন কেটে গেল।

ঠিক সাতটার গিয়ে হাজির হলাম ‘মুক্তি’-র রিসেপশানে।

ফাঁকা ঘরে বসে রিসেপশানিস্ট মেয়েটি কম্পিউটারের বোতাম টিপছিল। আমাকে দেখে একচিলতে হেসে টেলিফোন তুলে নিল। আমার উদভ্রান্ত অবস্থাকে কোনও আমল দিল না।

‘ডক্টর হালদার, মিস্টার রাজীব দত্ত আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ‘যান, ভিতরে যান।’

করিডর ধরে হেঁটে এগিয়ে চলেছি, প্রতাপ কোথা থেকে এসে হাজির হল আমার পাশে। একটু হাসল। ওর হাতে একটা রিভলভার।

ডক্টর হালদারের ঘরে ঢুকতেই উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন আমাকে: ‘আসুন, মিস্টার দত্ত। এ কী চেহারা হয়েছে আপনার!’

আমি তারক হালদারের কাছে এগিয়ে গেলাম, বললাম, ‘ডক্টর হালদার, প্লিজ, এবারের মতো ছেড়ে দিন। আমি…আমি যা টাকা লাগে দেব…।’

‘অবুঝ হবেন না, মিস্টার দত্ত। ক্যান্সার আমার বাবাকে ছেড়ে দেয়নি। আসুন, এই জানলার কাছে আসুন। আমি কথা দিচ্ছি, মিসেস দত্তর তেমন একটা লাগবে না—অন্তত এই প্রথমবার।’

আমি রাগে কাঁপতে লাগলাম। এই সাংঘাতিক লোকটাকে তুলোধোনা করতে পারলে তবে আমার মন শান্ত হবে।

ডক্টর হালদার পেছনের দেওয়ালের ছোট জানলার কাছে গিয়ে পরদা সরিয়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তাই ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, দত্তবাবু। প্রতাপ আপনার উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করবে। না, গুলি করবে না। বাজে খরচ আমি অপছন্দ করি। ও রিভলভারের বাঁট দিয়ে আপনার মাথায় একটু ইয়ে করবে। আর মিসেস দত্তকে আমার ক্লিনিকের নিয়মমাফিক শক দেওয়া হবে। সুতরাং আপনার ওসব ছেলেমানুষি উত্তেজনা দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। আসুন, এদিকে আসুন।’

আমি আচ্ছন্নের মতো এগিয়ে গেলাম জানলাটার কাছে। পেছন থেকে প্রতাপ একবার আমাকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিল।

শয়তান ডাক্তারটা মউকে এখন ইলেকট্রিক শক দেবে, আর আমাকে সেটা দেখতে হবে।

‘বাস্টার্ড!’ বলতে চাইনি, কিন্তু কীভাবে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল শব্দটা।

তারক হালদার আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন: ‘মিস্টার দত্ত, এ-পর্যন্ত যত গালাগাল আমি খেয়েছি, গালাগালপিছু প্রত্যেকে যদি একটা করে টাকা আমার হাতে দিত তা হলে এতদিনে আমি টাটা বিড়লা হয়ে যেতাম। তা ছাড়া, যারা সমাজের জন্যে, দেশের জন্যে, ভালো কাজ করতে চায় তাদের কপালে চিরকাল গালাগালই জোটে। আসুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে—।’

জানলা দিয়ে মৌসুমীকে দেখতে পেলাম।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ও হতবাক হয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। ওর ডানহাতের কবজিতে একটা সরু তার জড়ানো।

‘মউ! মউ!’ আমি বিপন্ন গলায় চেঁচিয়ে ডাকলাম ওকে।

ডক্টর হালদার আমার পিঠে হাত রাখলেন: ‘ডেকে লাভ নেই। ও-ঘর থেকে কিছু শোনা যায় না, কিছু দেখা যায় না।’ কাচের জানলাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা সাধারণ কাচ নয়, ওয়ান ওয়ে মিরার। ও-ঘর থেকে এটাকে আয়না বলে ভুল হয়। যাকগে, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নিই। আপনার প্রথমবারের ছোটখাটো ভুল—পনেরো সেকেন্ডের বেশি দেওয়াটা ঠিক হবে না। প্রতাপ—।’

প্রতাপ হাতের রিভলভারটা আমার শিরদাঁড়ায় চেপে ধরল। আর ডক্টর হালদার লাল বোতামটা টিপে ধরলেন।

আমার জীবনের দীর্ঘতম পনেরো সেকেন্ড শেষ হল একসময়। মাথা ঝিমঝিম করছে, পা দুটো যেন রবারের, চোখের নজর ঝাপসা।

ডক্টর হালদার আমার পিঠে মোলায়েমভাবে হাত রেখে বললেন, ‘গা গুলোচ্ছে? বমি পাচ্ছে?’

আমি কোনওরকমে মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম।

তারক হালদার জানলার পরদা টেনে দিলেন। আমার হাত ধরে বললেন, ‘আসুন—।’

‘কোথায়?’ কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে আমার।

‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন আসুন।’

কী করে মৌসুমীকে মুখ দেখাব আমি? ওকে আমি ভালোবাসি! এই আমার ভালোবাসার নমুনা!

প্রতাপ আগেই কখন যেন ঘর ছেড়ে চলে গেছে। আমি আচ্ছন্নের মতো ডক্টর হালদারকে অনুসরণ করলাম।

করিডর দিয়ে কিছুটা পথ চলার পর ডক্টর হালদার একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘যান, ভেতরে যান। কোনও চিন্তা নেই, উনি আপনাকে ভুল বুঝবেন না।’

আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে উনি চলে গেলেন। ধবধবে সাদা দেওয়ালে ঘেরা ঘরটায় শুধু একটা লম্বা সোফা রয়েছে। মৌসুমী সোফায় বসে মুখ নিচু করে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

‘মউ!’

ও চমকে তাকাল আমার দিকে। সোফা থেকে প্রায় ছুটে এসে জাপটে ধরল আমাকে। বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে উঠল, ‘রাজীব! রাজীব!’

আমি ওর মাথায় হাত ঝুলিয়ে দিলাম। চোখের জল মুছিয়ে দিলাম। কপালে, মাথায় চুমু খেলাম বারবার।

মৌসুমী ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে যা বলল তার সারমর্ম হল এই: দুপুর দুটো নাগাদ অচেনা তিনটে লোক হঠাৎই ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে; ও ভেবেছিল ওরা বোধহয় ডাকাত, বা অন্য কোনও বদ মতলবে ঢুকেছে; কিন্তু লোকগুলো মৌসুমীর নাকে ভেজা তুলো চেপে ধরে; সেই অবস্থাতেই ওকে চাদরে মুড়ে তুলে নেয়; তারপর ওর আর কিছু মনে নেই; পরে জ্ঞান ফিরল দ্যাখে একটা ছোট ঘরে ও বন্দি; তারপর…তারপর…।

‘রাজীব, এই লোকগুলো কেন আমাকে এরকম টরচার করল বলো তো—?’

‘আর বলতে হবে না, মউ, থাক।’ আমি দু-হাতে আঁজলা করে মৌসুমীর মুখটা তুলে ধরলাম। ধরা গলায় বললাম, ‘তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে, মউ। এই মুহূর্তে সব খুলে না-বলতে পারলে আমি কিছুতেই শান্তি পাব না। এসো, বসো এখানে—’

ওকে সব কথা বলার পর আমি মাথা হেঁট করে বসে রইলাম। বিড়বিড় করে বললাম, ‘ছি ছি! তোমার চোখে কত ছোট হয়ে গেলাম আমি…।’

মৌসুমী আমার থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরল ওর দিকে। গাঢ় স্বরে বলল, ‘রাজু, তোমাকে আমি এখনও আগের মতোই ভালোবাসি।’

‘সত্যি!’ আমার চোখে জল এসে গেল।

‘হ্যাঁ, সত্যি। ডক্টর হালদার তোমার ভালোর জন্যই সব করছেন। সিগারেট খাওয়া তুমি একেবারে ছেড়ে দাও।’

এখন তো আর না-ছেড়ে উপায় নেই। আমি অবাক চোখে মৌসুমীকে দেখছিলাম। গালে টোল পড়া মেয়েটা হঠাৎ আমার কাছে এগিয়ে এসে টপ করে গালে একটা চুমু খেল। বলল, চলো, ‘বাড়ি চলো। তাপস অনেকক্ষণ ধরে একা আছে…।’

দু-সপ্তাহ পর একদিন রাতে টেলিফোন বেজে উঠল।

ফোন ধরতেই ডক্টর হালদারের গলা চিনতে পারলাম। একটা দলাপাকানো ভয় উঠে এল গলার কাছে। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘ডক্টর হালদার, আপনি ভুল করছেন। আমি একটিবারের জন্যেও সিগারেট ঠোঁটে ছোঁয়াইনি—বিশ্বাস করুন—।’

‘না, সে আমি জানি। একটা কাজের ব্যাপারে ফোন করছি। কাল বিকেল পাঁচটায় আমার চেম্বারে একবার আসতে পারবেন? একটু কথা আছে।’

‘সেটা কি…?’

‘না, না, সিরিয়াস কিছু নয়। আসুন, একটু আলোচনা করব। ও হ্যাঁ, তাপসের পরীক্ষার রেজাল্ট তো খুব ভালো হয়েছে! তাপসকে কনগ্র্যাচুলেশান জানাবেন। কাল ওর জন্যে একটা চকোলেটের বাক্স পাঠিয়ে দেব।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘জানতে হয়, মিস্টার দত্ত। জানাটা আমার ট্রিটমেন্টের একটা ভাইটাল পার্ট।’

তারক হালদার ফোন কেটে দিলেন।

সেই মুহূর্ত থেকেই আমি পরদিন বিকেল পাঁচটার অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

পরদিন পাঁচটা বেজে পাঁচ মিনিটে তারক হালদারের মুখোমুখি যখন হাজির হলাম তখন বুঝলাম, অকারণেই আমি ভয় পেয়েছি।

হালদার আমার মুখের চেহারা লক্ষ করে হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার? মুখটা এরকম করে রেখেছেন কেন? ভয় নেই, কেউ আপনাকে শক দেবে না। আসুন, এটার ওপরে উঠে দাঁড়ান।’

ওজন করার একটা যন্ত্র।

‘সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার পর আমার ওজন বোধহয় একটু বেড়ে গেছে—।’

‘সেটাই স্বাভাবিক। আমার ক্লায়েন্টেদের প্রায় সিক্সটি সেভেন পার্সেন্টের এরকম সিমটম দেখা গেছে। আসুন, উঠুন এটার ওপরে—।’

যন্ত্রের প্ল্যাটফর্মে উঠে দাঁড়ালাম। আটষট্টি কেজি।

‘আচ্ছা, নেমে আসুন।’ বলে অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটি ল্যামিনেটেড প্লাস্টিকের কার্ড বের করে তারক হালদার কী যেন দেখতে লাগলেন।

‘আপনার হাইট কত, মিস্টার দত্ত?’

‘পাঁচ-পাঁচ।’

‘তা হলে আপনার ওজন হওয়া উচিত তেষট্টি কেজি। কয়েকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, এগুলো ঠিকমতো খাবেন। আর বডি ওয়েটের দিকে খেয়াল রাখবেন। আজ এপ্রিল মাসের তিন তারিখ। আপনি প্রতিমাসের ঠিক তিন তারিখে আমার কাছে ওজন নিতে আসবেন। যদি কখনও না আসতে পারেন তা হলে আগে ফোন করে অবশ্যই খবর দেবেন। যেন কোনওরকম ভুল না হয়।’

‘যদি আমার ওয়েট তেষট্টি কেজির বেশি হয়ে যায়?’

তারক হালদার হাসলেন, বললেন, ‘ওজন বেড়ে যাওয়াটা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। যদি আপনার ওজন তেষট্টির বেশি হয়ে যায় তা হলে আমার লোক আপনার বাড়িতে যাবে। চপার দিয়ে আপনার বউয়ের একটা কড়ে আঙুল কেটে নেবে। ঠিক আছে, তা হলে সামনের মাসের তিন তারিখে আমাদের দেখা হচ্ছে, মিস্টার দত্ত—।’

এরপর তিনমাসের মধ্যে আমার মেদ আর বয়েস, দুটোই অনেকটা করে কমে গেল। জামা-প্যান্টগুলো সব ঢোলা-ঢোলা হয়ে গেল। তা নিয়ে মৌসুমী কম ঠাট্টা করল না। তাছাড়া একদিন রাস্তায় কেনাকাটায় বেরিয়ে ও বলল, ‘তোমার পাশে এখন আমাকে বুড়ি-বুড়ি লাগে।’

আমি বললাম, ‘তোমার কথার কোনও মাথামুন্ডু নেই!’ কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ভালো লাগল।

আজকাল পাড়ায় আর অফিসে পরিচিত সকলেই বলে, আমার বয়েস নাকি বোঝা যায় না। ওরা এর রহস্য জানতে চায়। আমি বলি, ‘সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি, তাই।’

‘আমিও অনেকবার ছেড়ে দিয়েছি, ভাই। কিন্তু এমনই বদ অভ্যেস, আবার ঘুরে এসেছে।’

একদিন রাতে তারক হালদারের ফোন পেলাম।

‘মিস্টার দত্ত, কেমন আছেন?’

‘ভালো—’

‘কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘না, না।’

‘আমার ক্লিনিকের জন্যে একটা ছোট্ট উপকার করতে হবে আপনাকে। কালই আমি আমার পঞ্চাশটা ভিজিটিং কার্ড আপনাকে পাঠিয়ে দেব। আজ থেকে ঠিক এক বছরের মধ্যে অন্তত চারজন ক্লায়েন্ট আমি চাই। মনে হয় না, চারজন স্মোকারকে সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কনভিন্স করাতে আপনার কোনও অসুবিধে হবে। আপনার বন্ধু, মিস্টার অনুপম মুখার্জি, আপনাকে নিয়ে মোট ছ’জনকে পাঠিয়েছে। সুস্থ সমাজ তৈরির জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, মিস্টার দত্ত। একাজে আপনারা সবাই যদি হেল্প না করেন, তা হলে…।’

‘চারজনকে আ-আমি পাঠাব।’ এরই নাম হুইসপারিং ক্যামপেইন!

তারক হালদার হাসলেন: ‘জানতাম আপনি রাজি হবেন। ও হ্যাঁ, আমাদের এগ্রিমেন্টের ওই পয়েন্টটা মনে আছে তো? মানে, ট্রিটমেন্টের কায়দা একদম টপ সিক্রেট?’

‘হ্যাঁ, ভুলিনি।’

‘থ্যাঙ্ক য়ু। আমরা কিন্তু নজরদারির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি—’ তারক হালদারের গলাটা হঠাৎই কেমন ঠান্ডা শোনাল। সঙ্গে-সঙ্গে খরগোশটার কথা মনে পড়ে গেল আমার। ডক্টর হালদার ফোন রেখে দিলেন।

এর মাসদেড়েক পর একদিন বিকেলে নিউ মার্কেটে অনুপমের সঙ্গে দেখা হল আমার। ও একা নয়—সঙ্গে রোহিণীও ছিল।

অনুপমের বউকে আমি এই প্রথম দেখলাম। ফরসা, লম্বা, সুশ্রী। চেহারায় ব্যক্তিত্ব আছে। অনুপম আমার সঙ্গে ওর বউয়ের আলাপ করিয়ে দিয়ে মজা করে বউকে বলল, ‘আমার দশবছরের হাওয়া-দোস্ত, বুঝলে! বলতে গেলে, শুধু এয়ারপোর্ট আর প্লেনেই ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়। কলেজ লাইফের পর এই প্রথম কলকাতার ডাঙায় দেখা হল, কী বলিস?’ কথা শেষ করে আমার কাঁধ চাপড়ে দিল অনুপম। একটু থেমে আবার বলল, ‘রাজীব, তোকে কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে। ডায়েটিং করে স্লিম হয়েছিস?’

‘না রে, আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি। ডক্টর তারক হালদার আমার জীবনটা একেবারে বদলে দিয়েছেন।’ আমার বুকের ভিতরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছটফট করছিল।

অনুপম আমার দিকে গভীর চোখে তাকাল। আমিও ওকে দেখলাম। এখন আমরা সত্যিকারের বন্ধু। পরস্পরের গোপন ব্যথা আমরা জানি।

ঠিক তখনই রোহিণীর বাঁহাতের কাটা কড়ে আঙুলটা আমার নজরে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *