মাটির মেডেল

মাটির মেডেল

লজ্জা পেলে অনেক রকম হয়। কেউ চুপচাপ গাল লাল করে বসে থাকে। কেউ বেশি কথা বলে। কিন্তু সেই কথা জড়িয়ে যায়। কেউ কথা বলে না, শুধু লাজুক ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকায় আর মিটিমিটি হাসে।

উমানাথ হালদারের তিন নম্বরটা হয়েছে। তিনি লাজুক ভঙ্গিতে মিটিমিটি হাসছেন। কিন্তু সেই হাসি মুখে ফুটছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, হাসি যে মুখে ফোটেনি সেটা উমানাথবাবু নিজেও বুঝতে পারছেন না। তিনি সেই না-ফোটা হাসিমুখ নিয়েই বোকা বোকা ভাবে চারপাশে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে, এইমাত্র সাতান্ন বছরের মানুষটার অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। সারাটা বছর ভুল করার পর আজ হঠাৎ শুনছেন, অঙ্কে নাকি একশোতে একশো হয়ে গেছে! একেবারে ফুল মার্কস। বিরাট লজ্জার বিষয়।

মাইকে ঘোষণা চলছে। ঘোষণার মাঝখানে ফটাফট হাততালি।

গলাটা কার? অ্যাকাউন্টাসের সন্তোষ না? কীরকম যেন ঘষা ঘষা। মাইকে কথা বললে এরকম বিচ্ছিরি লাগে? আবার ঘোষণা হল। আবার হাততালি। এবার হাততালির সঙ্গে হাসি। সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে উমানাথ হালদারকে খুঁজছে। এত বছর ধরে সকালে বিকেলে দেখার পরও আজ যেন নতুন করে আর একবার দেখতে চাইছে।

ছি ছি, কী কাণ্ড!

উমানাথবাবু মুখ লুকোনোর চেষ্টা করলেন। এই বুড়ো বয়সে এরকম একটা বিপদে পড়বেন কল্পনাও করতে পারেননি। নার্ভাস লাগছে। খুবই নাভাস লাগছে। বিপদ-আপদের সময় পাশে বাড়ির লোক কেউ থাকলে কিছুটা ভরসা পাওয়া যায়। তাও নেই। অথচ অনেকের বাড়ির লোক এসেছে। প্রতিবারই আসে। ছেলে, মেয়ে, বউ। আসবে না কেন? অসুবিধে তো কিছু নেই। বাড়ির লোকদের জন্য বিনি পয়সায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। যতবার খুশি চা। দুপুরে প্যাকেটে লাঞ্চ। কোনওবার লাচ্ছা পরোটা, কোনওবার ফ্রায়েড রাইস। সঙ্গে আলুর দম, মাংস আর একটা করে নলেন গুড়ের সন্দেশ। স্টোরের পরিমল এবার তো ওর শালাকেও এনেছে। শালা বাড়ির লোকের মধ্যে পড়ে কি না তা নিয়ে একটু গুজগুজ ফুসফুস হয়েছে, পরিমল পাত্তা দেয়নি। ছোকরা মাঠের পাশে চেয়ার নিয়ে বসেছে। পায়ের ওপর পা তোলা। জামাইবাবুর লাফঝাঁপ দেখে মিটিমিটি হাসছে।

উমানাথবাবুও বাড়ির লোক আনতে চেয়েছিলেন। গতকাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে গিন্নির কাছে কথাটা পাড়লেন। তবে সরাসরি পাড়েননি। অন্য কথা দিয়ে শুরু করেছিলেন। পরে আসল কথায় গেছেন। ইদানীং উমানাথবাবু এটা করছেন। ধমক খাওয়ার ভয়ে গিন্নিকে আসল কথা সরাসরি বলছেন না। আসল কথার আগে নকল কথা দিয়ে খানিকটা ধানাইপানাই করে নিচ্ছেন। তাঁর ধারণা, গোড়াতে আসল কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশির ভাগ সময়ই ভুল করে বসেন, আর তাতেই যত বিপত্তি হয়। সুলেখার মাথা গরম হয়ে যায়। নকল কথা দিয়ে শুরু করলে মনে সাহস আসে, ভুলও কম হয়। যদিও ঘটনা তা নয়। নকল কথাতেও প্রায়ই ভুল করে বসেন উমানাথবাবু। কালও করেছেন।

‘সুলেখা, টিভি দেখছ?’

সুলেখাদেবী ভুরু কোঁচকালেন। তিনি খাটের ওপর বসে পান সাজছিলেন। দিনের শেষের এই পানটা তিনি যত্ন করে সাজেন। সাজতে সাজতে টিভি দেখেন। কালও দেখছিলেন। টিভিতে সিরিয়াল চলছে। হাসির সিরিয়াল। এই সিরিয়ালের প্রতিটি ডায়লগে হেসে গড়িয়ে পড়ার উপকরণ রয়েছে। সুলেখাদেবী হাসছেন না। তাঁর মুখ থমথমে। থমথমে থাকাটাই স্বাভাবিক। তিন দিন হতে চলল টিভির আওয়াজে গোলমাল চলছে। নায়ক, নায়িকা, ভিলেন সবার গলাই ফ্যাসফ্যাসে শোনায়। ফ্যাসফ্যাসে গলার কথা শুনে আর যাই হোক হাসি পায় না। উলটে রাগ হয়। সুলেখাদেবীর ইচ্ছে করছে লোকগুলোকে ধরে চড় লাগাতে। সেটা সম্ভব নয়। তাই মুখ থমথমে করে বসে আছেন।

সুলেখাদেবী যে টিভির আওয়াজ ঠিক করার চেষ্টা করেননি এমন নয়। চেষ্টা করেছিলেন। মেকানিক ডাকার জন্য ছেলেমেয়ে দু‘জনকেই তিনি বলেন। দু’জনের কেউই সময় দিতে পারেনি। বিল্টুর সময় দিতে না পারাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। শুধু তিন দিন নয়, গত এক বছর ধরেই সে বাড়ির কোনও কাজে সময় দিতে পারে না। তার হাতে একদম সময় নেই। গতবার কান ঘেঁষে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর পরই সে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা। ব্যাবসা চিন্তা। কলেজে নাম লেখানো আছে, কিন্তু এক সপ্তাহের বেশি যাওয়ার সময় পায়নি। আর কোনওদিন পাবে বলে মনে হয় না। এখনও পর্যন্ত সে ষোলো জন পার্টনারের সঙ্গে মোট তেরো ধরনের ব্যাবসা করেছে। মূলধন ছাড়া ব্যাবসা করার এই একটা সমস্যা। ঘনঘন পার্টনার এবং ব্যাবসার বিষয় বদলাতে হয়। বিল্টুকেও হয়েছে, এবং সেগুলোর কোনওটারই আয়ু এগারো দিনের বেশি হয়নি। শুধু একটাই যা একটু বেশি দিন টিকেছিল। প্রায় তিন সপ্তাহ। এই ছেলের সামান্য টিভি- রেডিয়োর আওয়াজ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়?

বুলি সময় দিতে পারেনি অন্য কারণে। সে তার দাদার মতো ব্যস্ত নয়। বরং বলা উচিত তার হাতে অঢেল সময়। প্রায় সারাদিনই বাড়িতে শুয়ে-বসে থাকে এবং রূপচর্চার নানাবিধ পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়। কখনও আলুথেঁতোর রস মুখে মেখে শুয়ে আছে, কখনও হাতে-পায়ে পাতিলেবুর রস লাগাচ্ছে। মাধ্যমিকে খুব নিচুর দিকে নম্বর পেয়ে বুলি এ বছর ক্লাস ইলেভেনে পড়ছে। তবে বেশিদিন পড়বে না। বিয়ে করে ফেলবে। তার মা এবং মেজমাসি তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। অল্প বয়সে বিয়ের কথায় বাবা মিনমিন করে আপত্তি তুলেছিল। সেই আপত্তি শোনা হয়নি। এ-বাড়িতে বাবার ছোটখাটো কোনও আপত্তিই শোনা হয় না, এ তো অনেক বড় ব্যাপার। মেয়ের বিয়ে। মায়ের বিশ্বাস, কালো মেয়ের বিয়ে যত আগে হয় তত ভাল। কারণ যত বয়স বাড়বে রং নাকি আরও কালো হবে। ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। ফরসাদের ক্ষেত্রে এটা হয় না, এই সমস্যা নাকি শুধু কালোদের! মায়ের সেই বিশ্বাসমতো কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। মুখে বেশি করে পাউডার দিয়ে বুলির ছবি তোলা হয়েছে। দু’রকম ছবি। ফুল সাইজ আর হাফ সাইজ। বড় ছবিটার পিছনে স্টুডিয়োর আঁকা ঝরনা রয়েছে। পাথরের ওপর ঝরনা আছড়ে পড়ছে। অন্যটার পিছনে কিছু নেই। শুধু নীল রং। ঘন নীল। এটা মেজমাসির কথামতো করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, পাত্রীর ছবিতে নীল রং একটা শুভ জিনিস। এতে ছেলে সারাজীবন বউ-ন্যাওটা হয়ে থাকে। কাগজের বিজ্ঞাপনে দাগ দিয়ে এই দু’ধরনের ছবিই পাঠানো চলছে। যত দিন যাচ্ছে বুলি বুঝতে পারছে, লেখাপড়ার থেকে বিয়ে অনেক ইন্টারেস্টিং বিষয়। এই বিষয়ের মধ্যে নানা ধরনের মজা এবং রহস্য লুকিয়ে আছে। লেখাপড়ায় মন না বসলেও, তার বিয়েতে মন বসে গেছে। শনিবার কাঁথির একটা পার্টি এসে মেয়ে দেখে গেল। পাত্র নিজে ছিল না, তবে তার এক বন্ধু ছিল। চ্যাংড়া ধরনের বন্ধু। জুতো পরে ঘরে ঢুকে পড়ল এবং চেয়ারে বসে বিশ্রীভাবে পা নাচাতে লাগল। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আরও আছে। চ্যাংড়াটা পকেটে করে বুলির ছবিও এনেছিল। মাঝেমধ্যে সেই ছবি লুকিয়ে লুকিয়ে বের করে কী যেন মেলাচ্ছিল। আর কেউ না দেখতে পাক, বুলি দেখেছে। মনে হয় গায়ের রং মেলাচ্ছিল। অন্য কিছুও হতে পারে। যেটাই হোক ঘটনা খুব ইন্টারেস্টিং তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কথাটা কাউকে বলেনি বুলি। বিয়ে সম্পর্কিত ইন্টারেস্টিং বিষয় সবাইকে বলা যায় না। কাঁথির এই পার্টি যে- কোনওদিন রেজাল্ট জানিয়ে দেবে। হাবেভাবে বোঝা গেছে মেয়ে তাদের অপছন্দ হয়নি। ছেলের মামা দুটো লুচি চেয়ে খেয়েছেন। মেয়ে পছন্দ না হলে কেউ লুচি চেয়ে খায়? এই অবস্থায় বুলি কীভাবে বাড়ি থেকে বেরোবে? ফাইনাল না হলেও, সে এখন বিয়ের পাত্রী। বিয়ের পাত্রী অনেক কিছু পারে, কিন্তু পথে ঘুরে ঘুরে টিভি মেরামতের মিস্ত্রি খুঁজতে পারে না। মা বললেও পারে না।

শেষ পর্যন্ত সুলেখাদেবী নিজেই মেকানিক ধরে আনলেন। সে অনেক কায়দা করল। টিভি চালিয়ে একবার কাছ থেকে শুনল, একবার দুর থেকে শুনল। একবার খবরের চ্যানেল ঘোরাল, একবার সিনেমার গান চালাল। তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘খরচা আছে কাকিমা। ভোকাল কর্ড বিগড়েছে। ভয়েস ঠিক করতে ঝামেলা হবে। হাজার টাকার কমে কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না।’

এক হাজার টাকা দিয়ে টিভি সারানোর সামর্থ্য এবাড়ির নেই। ‘পরে খবর দেব’ বলে মেকানিক বিদায় করেছেন সুলেখাদেবী। তারপর থেকে মেজাজটা আরও থম মেরে আছে। এই অবস্থায় স্বামীর প্রশ্ন শুনে ভুরু কোঁচকানো আশ্চর্যের কিছু নয়। তিনি ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তোমার কী মনে হচ্ছে? আমি অন্য কিছু করছি? টিভির দিকে তাকিয়ে আমি কুনকে দিয়ে মোহর গুনছি?’

উমানাথবাবু বুঝলেন প্রশ্নটা ভুল হয়ে গেছে। সামলে নিয়ে বললেন, ‘না না, তা বলিনি। টিভির আওয়াজটা কেমন গোলমাল করছে তো, তাই বলছিলাম।’

‘টিভির আওয়াজ গোলমালে তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে? তুমি তো টিভি দেখছ না, টিভি দেখছি আমি। অসুবিধে হলে আমার হবে। বাজে কথা বলো কেন। রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।’

উমানাথবাবু মিনমিন করে বললেন, “রাগ করছ কেন সুলেখা? আমি তো খারাপ কিছু বলিনি। টিভিটা সারিয়ে নেওয়ার কথা বলছিলাম। সারিয়ে নিলেই পারতে।’

সুলেখাদেবীর পান সাজা হয়ে গেছে। তিনি সেই পান মুখে পুরতে গিয়ে থমকে গেলেন। সুপুরি দেওয়া হয়েছে? নাকি ভুলে গেছেন? মনে রাগ থাকলে অনেক সময় ছোটখাটো ভুল হয়ে যায়। সুলেখাদেবী হাত নামিয়ে সাজা পান খুলতে খুলতে বললেন, ‘ঠিকই, সারিয়ে নিলে পারতাম। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষটা যদি আর পাঁচটা ভদ্র মানুষের মতো রোজগার করত তা হলেই সারিয়ে নিতাম। তোমাকে এত করে বলতে হত না!’

কম রোজগারের অভিযোগ কোনও হাসির কথা নয়। তবু উমানাথবাবু শুকনো ধরনের হাসলেন। এইসময় তিনি যে হাসতে চান এমন নয়। তবু হাসতে হয়। পঁচিশ বছরের অভ্যেস। যতবার তিনি গিন্নির কাছ থেকে একথা শোনেন ততবারই এরকম হয়। শুকনো ধরনের হাসেন। সম্ভবত অন্য কোনও উত্তর জানা নেই বলেই হাসতে হয়।

প্রথম প্রথম সুলেখাদেবী রেগে যেতেন। কাটা কাটা গলায় বলতেন, ‘কম রোজগারের কথা শুনে বোকার মতো হাসছ কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে আমি কোনও হাসির কথা বলছি? এই ভরসন্ধেতে সংসারের টানাটানি নিয়ে তোমার সঙ্গে রঙ্গরসিকতা করতে বসেছি?’

তখনও সুলেখাদেবী সন্ধের দিকে হালকা সাজগোজ করতেন। চোখে একটু কাজল দিতেন। গালে অল্প পাউডার। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। বেশিরভাগ দিনই তার রং হত কালো। বেশ দেখাত। উমানাথবাবু আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেন। তারপর ধমক শুনে মুখ নামিয়ে বলতেন, “ছি ছি মজা করবে কেন? আসলে কী হয়েছে জানো, অফিসে সেদিন শুনলাম মাইনে বাড়বে। এবার না বাড়লেও সামনের বছর অবশ্যই বাড়বে। ক্লারিকাল পোস্টগুলো নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা চলছে। ওপরের লেভেলের ভাবনাচিন্তা তো তাই সময় লাগছে।’

এরপর গলায় খানিকটা জোর আনার চেষ্টা করতেন উমানাথবাবু। বলতেন, ‘হারামজাদারা টাকা না বাড়িয়ে যাবে কোথায়? অ্যাঁ, যাবে কোথায়? আর কারও না বাড়াক, আমারটা বাড়াতেই হবে। কেরানি হলে কী হবে আমি এই অফিসের কত পুরনো লোক জানো? একদিন নিয়ে যাবখন। দেখবে পিয়ন থেকে অফিসার সবাই কী খাতিরই না করে। উমানাথদা বলতে অজ্ঞান। এই বছরটা একটু কষ্ট করে সামলে নাও সুলেখা, পরের বছর অবস্থা পালটে যাবে।

কথা শেষ করে আবার হাসতেন উমানাথ। সেই শুকনো ধরনের হাসি। আর সেটাই হত মারাত্মক। আগুনে যেন ঘি পড়ত। এক ফোঁটা নয়, এক শিশি ঘি।

সুলেখাদেবী চিৎকার করে উঠতেন।

‘চুপ, একদম চুপ। হাসি বন্ধ করো। বন্ধ করো হাসি। লজ্জা করে না? কাপড় কাচা, বাসন মাজা থেকে শুরু করে দোকান-বাজার, ঘর ঝাঁট, সারাদিন দাসী-বাঁদির মতো কী না করাচ্ছ? এর ওপর বাড়িওলা ভাড়া চাইতে আসছে, মুদির দোকানে মাসকাবারির টাকা বাকি। উনি পিয়ন অফিসারের খাতির দেখান। বিরাট খাতিরের লোক এসেছেন। দাঁত বের করে হাসেন। কাল যে বিল্টু- বুলির স্কুলের মাইনের দিন মনে আছে? খেয়াল আছে? ছি ছি। হাসছ কোন মুখে? লজ্জা করে না? মুখ নামিয়ে বসে থাকো। বসে থাকো মুখ নামিয়ে, বসে থাকো বলছি।’

বকুনির শেষের দিকটাতে সুলেখাদেবী সম্ভবত কেঁদে ফেলতেন। গলাটা ভেজা ভেজা লাগত। চোখের কাজলটা কি থেবড়ে যেত? উমানাথবাবুর ইচ্ছে করত একবার দেখি। পারতেন না। কারণ, তিনি তখন সত্যি সত্যি স্ত্রীর কথামতো মাথা নামিয়ে বসে থাকতেন। ক্ষতি কী? স্ত্রীর কথায় মাথা নামানোয় কোনও লজ্জা নেই। আহা, এতে যদি মেয়েটার দুঃখ একটু কমে।

রোজগারের প্রসঙ্গ এড়িয়ে উমানাথবাবু চাপা গলায় বললেন, ‘কাল একটু সময় হবে সুলেখা? আমার সঙ্গে যাবে একটা জায়গায়?’

সুলেখাদেবী সাজা পান খুলে দেখলেন, না, সুপুরি দেওয়া হয়েছে। ফের পান মুড়ে মুখে দিলেন। স্বামীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো? আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছ! গত দশ বছরে তো এমন কথা শুনিনি। কী হল তোমার? শরীর-টরির খারাপ করছে নাকি?’

উমানাথবাবু লজ্জা পেলেন। কথাটা কীভাবে বলবেন? সুলেখা নিশ্চয় খুব হাসবে। হাসতে হাসতে ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে না বসে। তুলে হয়তো বলল, ‘ওরে, তোরা তোদের বাবার কাণ্ড শোন। এই বুড়ো বয়সে…। মাথাটা একেবারে গেছে মনে হচ্ছে রে বিল্টু।’

সে বড় লজ্জার হবে। ছেলেমেয়ের এসব না জানাই ভাল।

হাত বাড়িয়ে উমানাথ বললেন, ‘একটা পান হবে? আচ্ছা, পান দিতে হবে না। সুপুরি দাও।’

সুলেখাদেবীর সুবিধের মনে হচ্ছে না। মানুষটার সত্যি সত্যি কিছু হয়েছে নাকি? দু’টুকরো সুপুরি এগিয়ে দিয়ে বললেন, কী হয়েছে তোমার? অফিসে গোলমাল-টোলমাল কিছু নয় তো?’

উমানাথবাবু সোজা হয়ে বসলেন। সুপুরি মুখে ফেলে কোলের ওপর বালিশটা তুলে বললেন, না না, সেসব কিছু নয়। বলছি কী হয়েছে, তবে হাসতে পারবে না কিন্তু সুলেখা। কাউকে বলতেও পারবে না। সবাইকে ডেকেডুকে মাঝরাতে যে একটা হট্টগোল বাধিয়ে ফেলবে তা চলবে না। আগেই বলে রাখছি।’

‘বাজে কথা ছেড়ে বলো কী হয়েছে। সুলেখাদেবীর গলায় ধমকের সুর। ধমকের সঙ্গে অল্প উদ্বেগ।।

গিন্নির কৌতূহলে উমানাথবাবু সামান্য উৎসাহ পেলেন। সরে এলেন একটু। কাঁধের ওপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, একটা কাণ্ড করে ফেলেছি সুলেখা। বোকার মতো কাণ্ড। সবাই মিলে এমনভাবে চেপে ধরল… প্রথমটায় রাজি হচ্ছিলাম না। বিশ্বাস করো একদম রাজি হচ্ছিলাম না। পরিতোষ, তপনবাবু, প্রেমাংশুটা এমনভাবে বলতে লাগল…।’

উমানাথবাবু এক মুহূর্তের জন্য থামলেন। টিভির আওয়াজে খ্যাসখ্যাসে ভাবটা আরও বেড়েছে যেন। সুলেখাদেবী স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। উমানাথবাবু ডান হাতের আঙুলগুলো মাথার অল্পক’টা চুলে নার্ভাসভাবে বোলালেন। তারপর বললেন, ‘ওরা অমন করে বলল আমি শেষ পর্যন্ত পারলাম না।’

‘কী পারলে না?’

উমানাথবাবু চোখ তুলে সরাসরি গিন্নির দিকে তাকালেন। কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘রাজি না হয়ে পারলাম না সুলেখা, আমি স্পোর্টসে নাম দিয়ে ফেলেছি। অফিসের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। কাল হবে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে? ওরা তোমাকেও নিয়ে যেতে বলেছে।’

স্পোর্টস! মানে দৌড়-ঝাঁপ? সুলেখাদেবী নড়েচড়ে বসলেন। তিনি কি ঠিক শুনছেন? মনে হচ্ছে না, ঠিক শুনছেন। যে মানুষ প্রতিদিন ভাত খাওয়ার পর কম করে তিনটে চোঁয়া ঢেকুর তোলে, অমাবস্যা, পূর্ণিমায় যার ডান হাঁটুতে বাতের তেল মালিশ করতে হয়, শীত পড়বার মাসখানেক আগেই যাকে মাফলার বের করে দিতে হয়, সে যদি দৌড়-ঝাঁপের কথা বলে তা হলে ‘ভুল শুনছি’ মনে করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ। তুমি অফিসে দৌড়োতে যাবে? লাফাবে?’

উমানাথবাবু ভেবেছিলেন সুলেখা তার কথা শুনে হেসে ফেলবে। তার বদলে গম্ভীর মুখ দেখে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। তাড়াতাড়ি হাত তুলে বললেন, ‘না না, দৌড়োব কেন? কী যে বলো! এই বয়েসে কি ওসব হয় নাকি? হাই জাম্প, লং জাম্প, হান্ড্রেড মিটার্স সব ছেলেছোকরাদের জন্য থাকছে। আমার নাম নিয়েছে হাঁড়ি ভাঙাতে। ব্রেকিং দ্য জার।’

সুলেখাদেবী চোখ সরু করে বললেন, ‘কী? কী জার?’

উমানাথবাবু লাজুক ভঙ্গিতে হাসলেন। বললেন, ‘ব্রেকিং দ্য জার। হাঁড়ি ভাঙা। হাঁড়ি ভাঙা জানো না? কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে হাতে লাঠি ধরিয়ে দেবে, আর সেই চোখ বাঁধা অবস্থায় তোমায় হাঁড়ি ভাঙতে হবে। হাঁড়ি কেউ ভাঙতে পারে না। ওই যতটা কাছে গিয়ে লাঠি মারে আর কী। দেখতে বেশ মজা লাগে। প্রেমাংশু বলল, উমানাথদা, আপনি তো কোনও দিন অফিস স্পোর্টসে পার্টিসিপেট করেননি। এবার কিন্তু করতেই হবে। এই আপনার নাম লিখে রাখলাম। কাল সকালে মাঠে যেন দেখতে পাই। আমি বললাম, খেপেছ? আমি বাবা ওসবে নেই। এই বয়সে হাত-পা ভাঙব নাকি?’

স্বামীর কথার মাঝখানেই সুলেখাদেবী খাট থেকে নামলেন। টেবিলের ওপর পানের কৌটো রাখলেন। টিভির সুইচ বন্ধ করলেন। জল খেলেন এক গেলাস। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে খাটে এসে উঠলেন আবার। বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললেন, ‘তারপর?’

অন্ধকারেই উমানাথবাবু বলে যেতে লাগলেন।

‘তারপর আর কী, পরিতোষ বলল হাত-পা ভাঙবেন কেন দাদা? লাঠি তো আর নিজের গায়ে মারছেন না। লাঠি মারবেন মাটির হাঁড়িতে। হাঁড়ির কাছে যেতে পারলেই হবে। সারা বছরই তো ভাঙা টাইপ মেশিন নিয়ে খুটুরখাটুর করছেন, একদিন না হয় লাঠি হাতে হাঁটবেন। বলো দেখি, কী ফাজিল। বলে কিনা লাঠি হাতে হাঁটবেন?’

সুলেখাদেবী ওপাশ ফিরে শুলেন। ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, ‘তুমি কী বললে?’

উমানাথবাবু খুশি হলেন। সুলেখা প্রশ্ন করছে। এটা ভাল লক্ষণ। মনে হচ্ছে, কাল সঙ্গে যেতেও রাজি হয়ে যাবে। হেসে বললেন, ‘কী আর বলব? রাজি হয়ে গেলাম।’ তারপর সামান্য ঝুঁকে বললেন, ‘শুনেছি ভাল প্রাইজ আছে। ফ্লাস্ক, টেবিল ল্যাম্প, জলের জাগ। ফ্লাস্কটা পেয়ে গেলে মন্দ হয় না। কী বলো মন্দ হয়? শীতের ক’টা দিন চা রাখা যাবে। যখন ইচ্ছে ঢেলে গরম গরম খাব। সুলেখা, অ্যাই সুলেখা, কাল চলো না। অনেকেই ফ্যামিলি নিয়ে যায়। শামিয়ানার নীচে চেয়ারে বসে থাকবে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আছে। মাঠেই প্যাকেট দেবে। ড্রাই লাঞ্চ। ড্রাই লাঞ্চ কী জানো? কাল দেখবে। যাবে? অ্যাই, বলো না যাবে?’

উমানাথবাবু ভয়ে ভয়ে স্ত্রীর গায়ে হাত রাখলেন। সামান্য নাড়া দিলেন। সুলেখাদেবী কোনও উত্তর দিলেন না। আবার নাড়া দিলেন উমানাথবাবু। এবার একটু জোরে। লাভ হল না। সুলেখাদেবী ঘুমিয়ে পড়েছেন।

মাইকে সন্তোষ বলছে—

‘আপনারা মন দিয়ে শুনুন…শ্রীউমানাথ হালদার…শ্রীউমানাথ হালদার কোথায় আপনি? যেখানেই থাকুন, এগিয়ে আসুন। আমরা আবার জানাচ্ছি, আমাদের সহকর্মী উমানাথ হালদার হাঁড়ি ভাঙা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন।’

ঘোষণার মাঝখানেই হাততালি। সন্তোষ চুপ করল কয়েক মুহূর্ত। হাততালি কমলে বলতে শুরু করল ফের।

‘উপস্থিত দর্শকবৃন্দ, আপনারা শুনে খুশি হবেন, উমানাথদা শুধু প্রথম হননি, তিনি রেকর্ড করেছেন। আমাদের অফিস স্পোর্টসের ইতিহাসে অনেক রকম ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। অনেকেই হাঁড়ির কাছাকাছি গেছেন, কেউ হাঁড়ির গায়ে লাঠি ছুঁয়েছেন, কিন্তু হাঁড়ি ভেঙে ফেলতে পারেননি। উমানাথদা পেরেছেন। আপনারা যারা সেই সময় উপস্থিত ছিলেন তাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন, চোখ বাঁধা অবস্থায় তিনি কীভাবে লাঠি মেরে হাঁড়ি ভাঙলেন। একটা মারেই মাটির হাঁড়ি তিন টুকরো হয়ে গেছে।’

মাঠের একপাশেই রঙিন শামিয়ানার তলায় পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠান চলছে। এতদিন অন্যরকম হত। স্পোর্টস হয়ে যাওয়ার কটা দিন পর মিউনিসিপ্যালিটির হল ভাড়া করে ফাংশন হত। এবার মিটিং-এ ঠিক হল, মাঠের অনুষ্ঠান মাঠেই শেষ হবে। গম্ভীর গান-আবৃত্তির সঙ্গে হাই জাম্প, লং জাম্প চলে না। মজা নষ্ট হয়ে যায়।

বাজে কথা বলার অন্যতম লক্ষণ হল বেশি কথা বলা। এই অফিসের অ্যাকাউন্টস বিভাগের তন্ময় হাজরার ঘটনা উলটো। সে খুবই কম কথা বলে এবং বাজে কথা বলে। ঘটনা উলটো হওয়ার কারণে সেই বাজে কথা চট করে ধরা কঠিন হয়। কিন্তু সেদিন মিটিং-এ সবাই ধরে ফেলল।

তন্ময় গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি মন্ত্রী নিয়ে আসব। এবার আমাদের চিফ গেস্ট হবেন মন্ত্রী। বিশেষ অতিথি। তিনি প্রাইজ দেবেন।’

সবাই একেবারে রে-রে করে উঠল। সব কিছুর একটা সীমা থাকে। অফিস স্পোর্টসে মন্ত্রী হবেন বিশেষ অতিথি! ‘বস্তা দৌড়’ আর ‘যেমন খুশি সাজো’র পুরস্কার বিলি করতে আসবেন! ডাহা মিথ্যের মতো তন্ময় একটা ডাহা বাজে কথা বলেছে। আজ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে লোকাল থানার ও.সি-র বেশি নামকরা কাউকে পাওয়া যায়নি। আর উনি শোনাচ্ছেন মন্ত্রীর গল্প! একবার তো ও.সি-ও জোটেনি। সে এক কেলেঙ্কারি। অনুষ্ঠান শুরুর আধঘণ্টা আগে থানায় গিয়ে জানা গেল, বড়বাবু নেই। তিনি ডাকাত ধরতে সুন্দরবনের দিকে গেছেন। ফিরতে কম করে তিন দিন। পাঁচ দিনও হতে পারে। তিন না পাঁচ নির্ভর করছে নদীর জোয়ার-ভাটার ওপর। সকলের মাথায় হাত। শেষ সময় অনেক কিছু পাওয়া যেতে পারে, ‘বিশেষ অতিথি’ পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, ও সি- র বদলে ও.সি-র বউকে নিয়ে যেতে হবে। পাশেই কোয়ার্টার! গিয়ে একবার অনুরোধ করলে কেমন হয়? একবারে রাজি না হলে অনেকবার বলতে হবে। তেমন হলে, হাতে- পায়ে ধরতে হবে। মনে হয় না তাতেও মহিলা রাজি হবেন। তবু একটা শেষ চেষ্টা আর কী।

একবার বলতেই সেবার ও.সি-র বউ রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এক গাল হেসে বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন ভাই। আমি তৈরি হয়ে আসছি। আপনারা গাড়ি এনেছেন? না আনলে অসুবিধে নেই। আমি থানা থেকে জিপ আনিয়ে নিচ্ছি।’

এক গা গয়না পরে সেবার হাসি হাসি মুখে তিনি পুরস্কার বিলি করলেন। গয়নার খুব প্রশংসা হয়েছিল।

তন্ময় ভুরু তুলে নাটকীয় গলায় বলল, ‘মন্ত্রীর কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো?’

সবাই একসঙ্গে বলল, ‘না, বিশ্বাস হচ্ছে না।’

তন্ময় মৃদু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, বিশ্বাস কোরো না। আমি মন্ত্রী আনবই। সবাই চমকে যাবে।’

সবাইকে চমকে দিয়েই তন্ময় আজ মন্ত্রী এনেছে। হোমরাচোমরা কিছু নয়, ছোটখাটো মন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রী। গ্রামীণ ও অবলুপ্তপ্রায় লোকক্রীড়া দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী। খুব বড় ধরনের চুরিচামারি না করলে কাগজে এই ধরনের মন্ত্রীর নাম বা ছবি কোনওটাই ছাপা হয় না। দেখলে মন্ত্রী বলে মনেই হবে না। মনে হবে, নার্ভাস প্রকৃতির এই রোগাসোগা মানুষটা এইমাত্র ভিড় ঠেলে বাস থেকে নামলেন। তাঁকে খাতির করে শামিয়ানার তলায় বসানো হল। তন্ময় খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাতের সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই ধমক লাগাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে একবার চা, একবার ভাব, একবার কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে মন্ত্রীর কাছে ছুটে ছুটে যাচ্ছে। প্রতিবারই মনে করা হচ্ছে, মন্ত্রী মহাশয় এবার প্রত্যাখ্যান করবেন। করছেন না। সবই খাচ্ছেন। ঠান্ডার পর গরম, গরমের পর ঠান্ডা, তারপর আবার গরম। খাচ্ছেন এবং ঘনঘন নাকের ওপর ঝুলে পড়া চশমা ঠিক করছেন।

‘বন্ধুগণ, বন্ধুগণ আপনারা শান্ত হন। আপনাদের জন্য আরও একটা সুখবর রয়েছে। হাঁড়ি ভাঙা প্রতিযোগিতার জন্য আমরা সাধারণ পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু উমানাথ হালদার হাঁড়ি ভেঙে ফেলে অসাধারণ কাজ করেছেন। সাধারণ পুরস্কারে তাঁকে মানায় না। সেই কারণে একটু আগে আমরা, কমিটি মেম্বাররা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাকে মেডেল দেওয়া হবে। মেডেল দিয়ে আমরা তাঁকে সম্মান জানাতে চাই। আপনারা হাততালি দিন। জোরে হাততালি দিন। এখন সেই মেডেল উমানাথ হালদারের গলায় পরিয়ে দেবেন মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়…।’হাততালির আওয়াজে সন্তোষের কথার শেষটুকু বোঝা গেল না।

উমানাথবাবু উঠে দাঁড়ালেন। তার হাঁটু দুটো কি কাঁপছে? হ্যাঁ, কাঁপছে। একটা ঘোরের মতো মনে হচ্ছে। ভয় করছে, আবার ভয় করছেও না। বিশ্বাস হচ্ছে না, আবার হচ্ছেও। মাথাটা টলটল করছে। শরীরটা মনে হচ্ছে হালকা হয়ে এসেছে। ফুরফুরে লাগছে। প্রেশারটা ঠিক আছে তো? মেডেল নেওয়ার সময় কি এরকমই হয়? মাথা টলটল করে? শরীর হালকা হয়ে আসে? হাঁটলে মনে হয় ভেসে যাচ্ছি!

ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলেন উমানাথ। কেউ হাত জড়িয়ে ধরছে। কেউ কাঁধে হাত রাখছে। কেউ আবার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলছে, শাবাস, দাদা।’

সুলেখা পাশে থাকলে বেশ হত। বেচারি সংসারের জন্য অনেক কষ্ট করে। আজ নিশ্চয় খুশি হত। কে জানে, স্বামীর গলায় মেডেল দেখে ছেলেমানুষের মতো লাফালাফিই শুরু করে দিত হয়তো। পরে অফিসের সবাই খেপাত। বিশেষ করে পরিতোষটা যা ফাজিল! ঠিক বলত, ‘বাপ রে, মেডেল দেখে সেদিন বউদি একটা কাণ্ড করেছিল বটে।’না, সুলেখা আসেনি ভালই হয়েছে। তার থেকে বরং বিল্টু আর বুলি এলে পারত। এতদিন ধরে দেখে আসা সামান্য বাবাটাকে হঠাৎ মেডেল পরা অবস্থায় দেখলে হয়তো চিনতেই পারত না। বুলি হয়তো মজা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করত, ‘অ্যাই মশাই আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।’

বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই উমানাথবাবুর বুকটা ধক করে উঠল। অন্ধকার কেন? আলো চলে গেছে? নাকি নেই কেউ? আশ্চর্য তো! এই ভরসন্ধেতে বাড়ি ফেলে সব গেল কোথায়? দরজায় তালা নিশ্চয়। তা হলেই হয়েছে কাণ্ড। বাড়ি ঢুকতে হচ্ছে না। বাইরে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।

দু’পা এগিয়ে এসে উমানাথ দেখলেন, না, তালা নয়। অন্ধকার বারান্দায় বুলি বসে আছে। একা। বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। গ্রিলের দরজা খুলে বলল, ‘এসো।’

উমানাথবাবু অবাক গলায় বললেন, ‘অন্ধকারে বসে আছিস কেন? তোর মা কই?’

‘এসো বলছি।’

মেয়ের গলার আওয়াজে চমকে উঠলেন উমানাথবাবু। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী হয়েছে বুলি? তোর মা কোথায়?’

‘মা থানায় গেছে।’

‘থানায়!’

বুলি কান্নাভেজা গলায় বলল, “হ্যাঁ, থানায়। দাদাকে দুপুরে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।’

উমানাথবাবুর পা টলে উঠল। তিনি দ্রুত হাত বাড়িয়ে গ্রিলের দরজাটা ধরে ফেললেন। কখন জানি রিকশাওলাটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গম্ভীর এবং বিরক্ত গলায় সে বলল, ‘এগুলোর কী হবে? কোথায় রাখব?’

উমানাথবাবু মুখ ফিরিয়ে অন্ধকারেই দেখলেন লোকটার হাতে ভাঙা মাটির হাঁড়ির কতগুলো টুকরো।

টানা তিন দিন ফ্যাঁস ফ্যাঁস করবার পর আজ সকাল থেকে টিভিতে কোনও শব্দ নেই। তবে ছবি দেখা যাচ্ছে। শব্দহীন ছবি। সেই শব্দহীন ছবি নিয়েই টিভি চলছে। এখন অবশ্য সিরিয়াল হচ্ছে না। বিদেশি চ্যানেলে বাথরুম বিষয়ে একটা প্রোগ্রাম চলছে। দামি হোটেলের বাথরুম। প্রোগ্রামে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধরনের বাথটাব, কমোড, বেসিন দেখা যাচ্ছে। লাল জামা পরা একজন ছোট চুলের মেমসাহেব ছুটে ছুটে গিয়ে কখনও বাথটাবে স্নান করছে, কখনও বেসিনে মুখ ধুচ্ছে, কখনও আবার কমোডে বসে পড়ছে ধপাস করে। বসার সময় ফিক করে হেসে সামনের ফিনফিনে পরদাটা টেনে নিচ্ছে। আওয়াজ না থাকার কারণে গোটা অনুষ্ঠানটাই লাগছে কার্টুন ছবির মতো।

সুলেখাদেবী আজও টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন, তবে খাটে বসে নেই। তিনি বসে আছেন মোড়ায়। স্থির হয়ে। হাত দুটো কোলের ওপর রাখা। পাশে নিচু বেতের টেবিলে থালা রেখে রাতের খাওয়া সারছেন উমানাথ। রুটি, আলু-পোস্তর তরকারি আর মুসুরির ভাল। পাশে ছোট বাটিতে অল্প দুধ। তাতে বেশি করে চিনি দেওয়া। শেষ রুটিটা উমানাথবাবু দুধে ভিজিয়ে খান।

উমানাথবাবুর খুব ইচ্ছে করছে, সুলেখাকে বলেন, তার খাবারটাও নিয়ে আসতে। তারপর দু‘জনে মিলে একসঙ্গে খেতে। কথাটা বলতে সাহস হচ্ছে না। বাড়িতে যা ঘটে

গেছে তাতে এই ধরনের কথা বলা কঠিন। উমানাথবাবু তাও চেষ্টা করছেন। মনে সাহস আনার চেষ্টা করছেন।

শুধু স্ত্রীকে একসঙ্গে খেতে বলা নয়, উমানাথবাবুর আজ বড় ধরনের পরিকল্পনা ছিল। বাড়ি আসবার সময় রিকশাতে বসেই গোটা পরিকল্পনাটা নিজের মনে ঝালিয়ে রেখেছিলেন। তার প্রস্তাব শুনে কে কী বলতে পারে, উত্তরে তিনি কী বলবেন—সবটাই ভাবা হয়ে গিয়েছিল। একবারে নাটকের মতো। তিনি ঠিক করেছিলেন, আজ রাতের খাওয়ার সময় ছেলেমেয়েকেও ডেকে নেবেন। বলবেন, ‘আয়, আজ আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসি।’ বললেই যে সবাই ছুটে চলে আসত এমন নয়। বিল্টুটার সবসময় ছটফটানি। সে অবধারিতভাবে বলত, ‘একসঙ্গে খাব! খেপেছ নাকি বাবা? নাওয়া- খাওয়ার সময় আছে আমার? নতুন প্রজেক্টে হাত দিতে চলেছি। এবার পার্টনার সলিড। তোমরা খেয়ে নাও। আমার বারোটার আগে কোনও চান্স নেই। ব্যাঙ্ক লোনের কাগজপত্র নিয়ে বিস্তর ঝামেলায় আছি।’

বুলির ছটফটানি নেই। তবে মা আর মাসির পাল্লায় পড়ে মেয়েটার মাথা বিগড়েছে। বিয়ের কারণে তাকে নাকি এখন নানা ধরনের নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। আটটার মধ্যে রাতের খাওয়া সারতে হবে। ন’টার মধ্যে সোজা বিছানায়, ঘুম না পেলেও জোর করে চোখ বুজে শুয়ে থাকা চাই। বেশি রাত পর্যন্ত চোখ খোলা রাখার মানে নাকি একটাই। চোখের তলায় কালি ফেলা। কালো মেয়ের তো সবই কালো, তার আবার চোখের তলায় কালি কীসের? উমানাথবাবু বুঝতে পারেন না। তবে এইটুকু বোঝেন বুলিও এসব উদ্ভট নিয়মকানুনে খুশি। বাবার প্রস্তাব শুনে সে বলত, ‘একসঙ্গে খাব! বাবা, তুমি বোধহয় জানো না আমার অনেক আগেই খাওয়া হয়ে গেছে। এখন আমার ঘুমোতে যাওয়ার সময়। ঘুম না পেলে চোখ বুজে শুয়ে থাকব। একটা জিনিস হতে পারে। আমি তোমাদের সঙ্গে চোখ বুজে বসে থাকতে পারি। চলবে?’

পরিকল্পনার সময়তেই উমানাথবাবু জানতেন সব থেকে ঝামেলার জায়গাটা সুলেখা। তাকে রাজি করানোটাই হবে আসল ব্যাপার। সুলেখা বিশ্বাস করে, তার স্বামীর মতামতের যেমন কোনও মূল্য নেই, তেমনই তার যে-কোনও পরিকল্পনাই সংসারের পক্ষে অতি বিপজ্জনক। একসঙ্গে খেতে বসার পিছনেও নিশ্চয় কোনও বিপদ লুকিয়ে আছে। সে তখন কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে দিয়ে যেতে চেষ্টা করবে। জানতে চাইবে বিপদটা ঠিক কোন ধরনের। বড়, না ছোট? নাকি মাঝারি?

ভাবা ছিল, এরকম একটা টানাপোড়েনের সময় উমানাথবাবু হাসবেন। প্রথমে অল্প অল্প। পরে বেশি। হাসতে হাসতে বলবেন, “ঠিক আছে বোসো না। ভেবেছিলাম, আজ তোমাদের একটা দারুণ খবর দেব। সেটা আর বলা হল না।’

উমানাথবাব নিশ্চিত সুলেখা এই সময় ঠোঁট বেঁকিয়ে বলত, ‘বুড়ো বয়সে ঢঙ কোরো না। তোমার আবার দারুণ খবর!’

বুলি নির্লিপ্ত মুখে বলত, ‘তোমার দারুণ খবর আমার জানা আছে বাবা। নিশ্চয় পুরনো কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে তোমায় জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে চা আর বিস্কুট খাইয়েছে।’

বিল্টু চোখ নাচিয়ে বলবে, ‘আমার কী মনে হয় জানিস বুলি? আমার মনে হয়, বাবার কোনও কলিগ পুরী গিয়েছিল। বাবার জন্য একটা বড় সাইজের গামছা এনেছে। গামছা বাবার বিরাট ফেভারিট জিনিস। কী বাবা আমি ঠিক বলেছি? তুমি গামছা পেয়েছ। তাই না?’

উমানাথবাবুর ভাবা ছিল, এইরকম একটা সময় তিনি আসল কাজটা করবেন। দু’হাত পাশে ছড়িয়ে বলবেন, ‘পেয়েছি ঠিকই, তবে গামছা নয়। মেডেল। মেডেল পেয়েছি।’

কে বেশি চমকাবে? রিকশাতে বসে অনেক ভেবেছেন উমানাথ। নিশ্চিত হতে পারেননি। একবার মনে হয়েছে স্ত্রী, একবার মনে হয়েছে মেয়ে। বিল্টু যে চমকাবে না এমন নয়, তবে সেটা বুঝতে দেবে না। আজকালকার ছেলেরা স্মার্ট হয়। চট করে কিছু বুঝতে দেয় না। তবে চমকালেও সুলেখা মুখে কিছু বলবে না। হাতের কাজ থামিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকবে। বুলি লাফিয়ে উঠবে। চোখ কপালে তুলে বলবে, ‘অসম্ভব। বিশ্বাস করি না। তুমি মেডেল পেয়েছ! কই দেখি। দেখাও তো।’

উমানাথবাবুর ভাবা ছিল, এবার আর হাসবেন না। গম্ভীর হয়ে বলবেন, ‘উঁহু এখন নয়। এসো আগে সবাই মিলে খেতে বসি। খেতে খেতে অফিসের ব্যাগ থেকে বের করব। শুধু মেডেল নয়। ভাঙা হাঁড়িটাও দেখাব।’

বুলি বলবে, ‘সেটাও কি তোমার ব্যাগে আছে নাকি!’

‘দূর, ব্যাগে থাকবে কেন? কী যে বোকার মতো বলিস! পরিতোষরা জোর করে রিকশাতে তুলে দিল। দেওয়ার সময় বলল, সঙ্গে নিয়ে যান। চোখ বাঁধা অবস্থায় ভেঙেছেন। চাট্টিখানি কথা নয়। আসলে ছেলেগুলো বিরাট ফাজিল। কী আর করব, মাটির টুকরোগুলো এনে বাইরে রেখে দিয়েছি। খাওয়ার পর দেখাব।’ এরপর গিন্নির দিকে তাকিয়ে বলবেন, “হ্যাঁগো, বাইরের বাল্‌বটা ঠিক আছে তো?’

বুলি বলবে, “ঠিক না থাকলে কোনও চিন্তা নেই। আমরা টর্চ জ্বেলে তোমার ভাঙা হাঁড়ি দেখব।’

বিল্টু বোনকে ধমকে দিয়ে বলবে, “কেন? টর্চ জ্বেলে দেখব কেন? টুকরোগুলো ঘরের ভেতর আনতে অসুবিধে কোথায়? প্রত্নতাত্ত্বিক যুগের মাটির বাসনপত্রের মতো এরও একটা দাম আছে। তাই না বাবা?’

এবার বিন্টু-বুলির মা কি কিছু বলবে? বলতে পারে, আবার নাও বলতে পারে। উমানাথবাবু এখানটায় একটু ধাঁধার মধ্যে আছেন। ভাঙা হাঁড়ি তারও কি দেখতে ইচ্ছে করবে না? নিশ্চয় করবে। কিন্তু মুখে বলতে লজ্জা পাবে। তখন হয়তো রাগের ভান করে বলবে, ‘খবরদার, খবরদার বলে দিচ্ছি, ওই মাটির ঢেলা কিছুতেই ঘরে ঢোকানো চলবে না।’

আসলে এসব কিছুই হয়নি। মেডেলের কথা বাড়িতে বলতেই পারেননি উমানাথ। পারবেন কী করে? খানিক আগে ছেলেকে নিয়ে থানা থেকে ফিরল সুলেখা। বাড়িতে এসেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছে বিল্টু। মাথা ধরেছে বলে বুলিও না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় অতি তুচ্ছ এই মেডেলের কথা কি বলা যায়?

উমানাথবাবু নরম গলায় বললেন, ‘সুলেখা, তোমার খাবারটা নিয়ে এসো না। দু’জনে মিলে খাই।’

সুলেখাদেবী চুপ করে বসে রইলেন।

উমানাথবাবু আবার বললেন, ‘সুলেখা, যাও নিয়ে এসো।’

সুলেখাদেবী এবারও বসেই রইলেন।

উমানাথবাবু গলা আরও নরম করে বললেন, ‘এত চিন্তা করছ কেন? বিল্টুকে তো পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। বিন্টুর তো কোনও দোষ নেই। দোষ নেই বলেই তো ছেড়েছে। ওর পার্টনারটাই মিথ্যে বলে ওকে ফাঁসাতে চাইছিল৷ পারল না তো। পারবে কী করে? বিল্টুর কাছে তো কাগজপত্র সব আছে। আসলে কী জানো, ব্যাবসা করতে গেলে এরকম একটু-আধটু ঝামেলা হয়। সেই ঝামেলা…’

সুলেখাদেবী যেন এইজন্যই অপেক্ষা করছিলেন। স্বামীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মুখ ঘুরিয়ে ফোঁস করে উঠলেন।

‘একটু-আধটু! এটা একটু-আধটু হল? কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করছে না? কোথায় ছিলে তুমি? কোথায় ছিলে? ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর বুড়ো বাবা মাঠে গিয়ে দৌড়োচ্ছে। ছিঃ! বলতে লজ্জা করছে না? কাগজপত্রগুলো নিয়ে আমি থানায় না ছুটলে পুলিশ বিল্টুকে ছাড়ত? কী ভেবেছ? ছাড়ত ছেলেটাকে? হাজতে বসে পচতে হত। তাই ভাল ছিল। যে-ছেলের বাবা এরকম তার হাজতে বসে পচাই উচিত।’

উমানাথবাবু মুখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমাকে বলছ কেন? আমি তো ওকে ব্যাবসা করতে বলিনি।’

‘তোমাকে বলব না তো কাকে বলব? কী করেছ তুমি ছেলেমেয়ের জন্য? আমার জন্য? কী পারো তুমি? ছেলের একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পেরেছ?’

‘আজকাল চাকরি জোগাড় করা অত সহজ নয় সুলেখা। তুমি তো জানো। জানো না তুমি?’

সুলেখাদেবী এবার পুরোটা ঘুরে বসলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘বাবা, সারাদিন মাঠে লাফঝাঁপ দিয়ে এসে গলার খুব জোর বেড়েছে দেখছি! ছেলের চাকরি না পারো মেয়ের জন্য একটা পাত্র তো এনে দিতে পারতে। না কি সেটাও আজকাল পাওয়া কঠিন?’

এই সময় কারও মিষ্টির কথা মনে পড়ার কথা নয়, তবু উমানাথবাবুর মনে পড়ে গেল। কুড়ি টাকার সন্দেশ। আসার পথে রিকশা থামিয়ে কিনেছিলেন। ভেবেছিলেন, বাড়িতে থাকা ভাল। বলা তো যায় না, হুট করে যদি কেউ এসে পড়ে। তারপর সুলেখার কাছে মেডেলের গল্প শুনে হয়তো মিষ্টি খেতে চেয়ে বসল। ঘরে কিছু না থাকলে সে একটা লজ্জার ব্যাপার হবে। সেই কারণেই কেনা। ইস, বাক্সটা ব্যাগের মধ্যেই রয়ে গেছে। পিঁপড়ে ধরে গেল নাকি? ধরাটা স্বাভাবিক। এতক্ষণ ধরে রয়েছে। নষ্ট না হয়ে যায়। এই বাজারে কুড়ি টাকা কম নয়।

সুলেখাদেবী বলতে থাকলেন, কী হল, কথা বলছ না যে? কষ্ট হচ্ছে? বুড়ো বয়সে মাঠে গিয়ে লাফাতে পারো আর বউয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুটো কথা বলতে কষ্ট হয়? হাঁপ ধরে?’

উমানাথবাবু থালা সরিয়ে উঠে পড়লেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কী বলব বলো? বুলির জন্য তো তোমরাই ছেলে দেখছ। আমি আর নতুন করে কী করব? প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ক’টার জন্য অফিসে বলে রেখেছি। কাঁথির ওরা নিশ্চয় রাজি হয়ে যাবে। রাজি হয়ে গেলেই একটা অ্যাপ্লিকেশন করে দেব।’

এতক্ষণ পর মুখ নামালেন সুলেখাদেবী। বেশ খানিকটা সময় চুপ করে রইলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, কাঁথির ওরা খবর পাঠিয়েছে। মেয়ে পছন্দ হলেও মেয়ের গায়ের রং ওদের পছন্দ হয়নি। ছেলে রাজি নয়। আমি জানতাম এরকম একটা কিছু হবে।

আরও হবে। হোক, যত খুশি হোক। যে বাবার মেয়ে বিয়ে দেওয়ার মুরোদ নেই…।’

কথা শেষ হল না। তার আগেই কান্না শুরু হল। উমানাথবাবু দেখেছেন সুলেখার এই এক অসুবিধে। অনেক দিনের অসুবিধে। সে উঁচু গলায় ধমক দিয়ে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারে না। কেঁদে ফেলে। চাপা, ফিসফিসে ধরনের কান্না। এই ধরনের কান্না সহজে থামতে চায় না। অনেকক্ষণ চলে। চলতেই থাকে।

উমানাথবাবু টিভির দিকে তাকালেন। বাথরুমের অনুষ্ঠান শেষ। এবার খাওয়াদাওয়া দেখাচ্ছে। অচেনা সব খাবার। খাবার দেখে মিষ্টির কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। না, বাড়িতে ঢুকেই জিনিসটা বের করে রাখা উচিত ছিল। মস্ত ভুল হয়ে গেছে। আসলে থানা- পুলিশে সব গোলমাল হয়ে গেল। শুধু মিষ্টি কেন? আসল জিনিসটাও ব্যাগে আছে। ছোট্ট বাক্সের ভেতর। বাক্সের গায়ে সবুজ ভেলভেট। হাত বোলালে আরাম লাগে। জিনিসটা ঠিকঠাক আছে তো? দেখতে পারলে হত। বড় সুন্দর দেখতে। শেষ বিকেলের আলো পড়ে ঝলমল করছিল। হঠাৎ দেখে মনে হয়েছিল সোনার! সোনার মেডেল! তাতে লাল ফিতে বাঁধা। পরিতোষ মজা করে বলল, ‘সোনা বলে ভুল করবেন না দাদা। এটা আসলে মাটির মেডেল। মাটির হাঁড়ি ভাঙার জন্য মাটির মেডেল। সাবধানে রাখবেন। ভেঙে না যায়।’

আহা, একবার যদি দেখা যেত। ঠিক আছে, না দেখলেও হবে। হাত দিয়ে ছুঁলেই হবে। সুলেখাকে লুকিয়ে যাবে নাকি? ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা একবার ছুঁয়ে আসবে?

নিজের ছেলেমানুষিতে নিজেই হেসে ফেললেন উমানাথবাবু। বাথরুমের অন্ধকারে দাড়িয়ে নিজের মনে হাসতে হাসতে শুনতে পেলেন সুলেখাদেবী তখনও কাঁদছেন। চাপা, ফিসফিসে ধরনের কান্না।

রাত ক’টা? দুটো? তিনটে? নাকি আরও বেশি মানুষগুলো তো ঘুমোচ্ছেই, মনে হচ্ছে বাড়িটাও ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার কাছের জানলাটার ফাঁকফোকর দিয়ে আলো আসছে। নীল, আবছা আলো। কীসের আলো? চাঁদের? চাঁদের আলো এই ঘরে ঢোকে নাকি! কই কখনও তো খেয়াল হয়নি!

খাট থেকে নামলেন উমানাথবাবু। পা টিপে টিপে পৌছোলেন ব্যাগের কাছে। সাবধান, আওয়াজ যেন না হয়। ঘুম যেন ভেঙে না যায় সুলেখার। না জানি বেচারি কত রাত পর্যন্ত জেগে থেকেছে। জেগে থেকে কেঁদেছে কি?

মেডেলটাকে শুধু একবারে ছুঁয়ে দেখতে অন্ধকারেই নিঃশব্দে ব্যাগ হাতড়াচ্ছেন উমানাথবাবু। হাতড়ে চলেছেন।

দেশ, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *