দাঁত

দাঁত

প্রথম কামড়েই খচ করে লাগল।

নিখিল সাঁতরা থমকে গেলেন। খাওয়া বন্ধ করে ভুরু কোঁচকালেন। লাগল কেন? মন ভাল নেই নিখিল সাঁতরার। থাকার কথাও নয়। খানিক আগে ইউনিয়ন অফিসে যে ঘটনা ঘটেছে তারপর মন ভাল থাকতে পারে না। ভাগ্যিস মান-অপমান বোঝার কলকবজাগুলো অকেজো হয়ে এসেছে, নইলে বেশি খারাপ লাগত। কান্টিনে আসবার সময় নিখিল সাঁতরা ভেবেছিলেন, আজ টিফিন খাবেন না। এক কাপ চা খেয়েই পেট ভরাবেন। তবু টিফিন বক্স খুলে ফেললেন খানিকটা অভ্যেস আর খানিকটা ভয়ে। আজকাল অনেকক্ষণ পেট খালি রাখলে কেমন জ্বালা জ্বালা করে। কে জানে আলসার-টালসার কিছু হচ্ছে কিনা। হলে বিরাট ঝামেলা। কষ্ট তো আছেই, বড় কথা চিকিৎসার বিরাট ধাক্কা। অপমানের দাম কানাকড়িও নয়। চিকিৎসার খরচ অনেক।

নিখিল সাঁতরা অন্যমনস্কভাবেই টিফিন মুখে তুললেন। আর তখনই লাগল খচ করে।

লাগল কেন! আজকের টিফিনে মুখে লাগার মতো তো কিছু নেই। না মাছের কাঁটা, না মাংসের হাড়। বক্সে চাপাচুপি করে রয়েছে দুটো রুটি, খানিকটা আলুর দম, একদলা ছানা। আগে ছানার ব্যবস্থা ছিল না। কিছুদিন হল মন্দিরাদেবী ব্যবস্থা চালু করেছেন। কোথা থেকে যেন শিখে এসেছেন ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল, সুগারের সঙ্গে লড়তে ছানা হল অব্যর্থ ওষুধ। যমে-মানুষে টানাটানির মতো ছানায়-অসুখেও টানাটানি চলে। সেই টানাটানিতে ছানার জয় সুনিশ্চিত। তথ্যের সত্যাসত্য নিয়ে নিখিল সাঁতরা মৃদু প্রশ্ন তুলেছিলেন।

‘ছানা ভাল জিনিস, কিন্তু এতটা ভাল বলে তো জানতাম না মন্দিরা। একেবারে সব অসুখ সারিয়ে দেবে!’

মন্দিরাদেবী স্বামীর প্রশ্ন অবজ্ঞা করে বলেছিলেন, ‘আগে জানতে না, এবার জানবে। অনেক কিছুই এবার জানবে। এখনও সঙ্গে রুটি-পরোটা দিচ্ছি, এরপর শুধু ছানাই দেব। অসুখ যেমন বাধিয়েছ টিফিনও তেমন পাবে।

’কথাটা নিয়ে তর্ক করা যেত। ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল বা সুগার সর্দি কাশি নয় যে বৃষ্টিতে ভিজে নিজে বাধানো যাবে। তার ওপর ছানার এত ব্যাপক গুণ সত্যিই আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কিন্তু নিখিল সাঁতরা তর্ক করেননি। ছানা তো অতি সামান্য বিষয়, অনেক বড় বড় বিষয় নিয়েও তিনি তর্ক করেন না। ঘরে-বাইরে কোথাওই নয়। তার মানে এই নয় যে তর্ক তাঁর পছন্দ নয়। খুবই পছন্দ। বহুদিনই মনে হয় ঝগড়াঝাঁটি, চিৎকার-চেঁচামেচি করে একটা বড়সড় গোলমাল পাকিয়ে দিতে পারলে বেশ হত। অফিসে তো প্রায় রোজই ইচ্ছে করে। অন্যরা ‘সাঁতরাদা প্লিজ, এটাও একটু করে দিন’ বলে ঘাড়ে একটার পর একটা কাজ চাপিয়ে যখন সরে পড়ে তখন মনে হয়, খুব জোর একটা চিৎকার দিই—‘কেন হে? অফিসটা কি আমার বাপের? নাকি তোমাদের থেকে বেশি বেতন পাই?’ ছোটখাটো ভুল নিয়ে ওপরওলারা চিবিয়ে চিবিয়ে অপমান করলে ইচ্ছে করে টেবিল চাপড়ে বলতে ‘স্যার, এর থেকে ঢের বেশি ভুল করেও অনেকে এ অফিসে রেহাই পেয়ে যায়। কেন? আপনাদের তেল মারে বলে?’ শুধু অফিসে নয়, সংসারেও মাঝেমধ্যে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করতে মন চায়। স্ত্রীর দাপট, মেয়ের অবজ্ঞা, ছেলের তাচ্ছিল্য দেখে কখনও-সখনও মনে মনে তিনি প্রস্তুতিও নেন। চোখমুখ লাল করে হাত-পা ছুড়ে বলবেন—

‘আমাকে তোমরা পেয়েছটা কী? ভেবেছটা কী সবাই? কিছু বলি না বলে …সকাল থেকে মাথার ঘাম ফেলছি অথচ মানুষ বলেই মনে করো না…।’

কিন্তু শেষ পর্যন্ত করা হয় না। শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারা খুবই কঠিন একটা জিনিস। দীর্ঘ জীবন পার করে এসে নিখিল সাঁতরা অনুভব করেছেন, মানুষ আসলে তিন প্রকারের। এক প্রকারের মানুষ সব কিছুতেই শেষ পর্যন্ত যেতে পারে। আরেক রকমের মানুষ যাওয়ার চেষ্টা করে এবং মাঝপথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর তিন নম্বর ধরনের মানুষ শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কি পারব না নিয়ে দোলাচলে পড়ে হাবুডুবু খায়। এই দোলাচল তার মধ্যে এক ধরনের বিশেষ স্বভাব তৈরি করে। এই স্বভাবকে বলা যেতে পারে শামুক স্বভাব। গুটিয়ে থাকা টাইপ। সম্ভবত তিনিও এরকমই গুটিয়ে থাকেন।

ব্লাড সুগারের কারণে ছানায় চিনি নেই। চিনিহীন ছানা যে কত বড় অখাদ্য একটা জিনিস যে না খেয়েছে তার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। নিখিলবাবু রোজই ভাবেন একটু মুখে দিয়ে বাকিটুকু ফেলে দেবেন। মন্দিরা জানতে পারবে না। ক্যান্টিনের ডাস্টবিনে উলটে দিলেই হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেন না। কোনওরকমে গিলে নেন। গিলতে গিলতে বুঝতে পারেন কোনও কিছু রাখার জন্য যেমন জোর লাগে, ফেলে দেওয়ার জন্যও লাগে। দুটোর একটাও তাঁর নেই।

কিন্তু আজ মুখে লাগল কেন!

ঠান্ডা হয়ে চিমসে মেরে গেলেও রুটি মুখে লাগার মতো জিনিস নয়। আলুর দমে আলুগুলো একটু শক্তর দিকে, কিন্তু তারা তো আর মাড়িতে কামড় দেবে না। তবে?

খোঁচাটা লেগেছে মুখের সামনে। নীচের মাড়িতে। ওপরের দাঁত দিয়ে কামড় পড়লে যেমন হয়। সত্যি কথা বলতে কী, এরকম একটা সামান্য আঘাত নিয়ে এতখানি মাথা ঘামানোর কোনও দরকার ছিল না। ঘামাতে হচ্ছে অন্য কারণে।

টিফিন খাওয়ার সময় মুখে লাগার ঘটনা আগেও ঘটেছে নিখিল সাঁতরার। বেশি নয়, মাত্র বছরখানেক আগের কথা। তখনও খাবার নিয়ে এরকম কড়াকড়ি শুরু হয়নি। মন্দিরাদেবী টিফিনে একটা মাছের চপ দিয়েছিলেন। বাড়িতে তৈরি মাছের চপ। তাতে কাঁটা থাকার কথা নয়। তবু কীভাবে যেন সেদিন থেকে গিয়েছিল। ছোট সাইজের জিনিস, আলু-টালুর আড়ালে ঘাপটি মেরে ছিল বোধহয়। দুইয়ের পর তিন নম্বর কামড়েই বেটা টাগরায় খোঁচা মারল। গোড়াতে পাত্তা দেননি নিখিল সাঁতরা। কাটা ফেলে টিফিন শেষ করেছিলেন হালকা মনে। চা খেলেন, সিগারেট ধরালেন। তখনও দিনে দুটো সিগারেটের পারমিশান ছিল। মন্দিরাদেবীর পারমিশান। সকালে একটা রাতে একটা। অফিসের টিফিনে আরও একটা খেতেন লুকিয়ে। সেই সিগারেট শেষ করতেন গভীর তৃপ্তিতে। লুকানো জিনিসে তৃপ্তি বেশি। একেবারে ফিল্টারের ডগা পর্যন্ত টান মারতেন। সেদিনও মারলেন। তারপর নিজের টেবিলে ফিরে গিয়ে বসলেন ফাইল নিয়ে। আধঘণ্টা পর থেকে শুরু হল ঝামেলা। প্রথমে অস্বস্তি, তারপর অল্প ব্যথা। অফিস ছুটির পর সেই ব্যথা টনটনে চেহারা নিল। বাড়ি ফেরার সময় ট্রাম থেকে নেমে একেবারে মারকিউরোক্রম কিনে বাড়ি ফিরতে হল। ততক্ষণে ব্যথা আরও বেড়েছে। রাতে শক্ত খাবার খেতে পারলেন না। মুখ বেজার করে মন্দিরাদেবী সুজি করে দিলেন। মুখ বেজার হওয়ারই কথা। অত রাতে সুজি বানাতে কারও মুখই হাসি হাসি থাকে না। শুতে যাওয়ার আগে নিখিল সাঁতরা তুলোয় করে যখন মুখের ভেতর ওষুধ লাগাচ্ছেন মন্দিরাদেবী বললেন, উফ সামান্য একটা কাটা নিয়ে যা শুরু করেছ! একটু দেখেশুনে খেলেই পারতে। পেটরোগা মানুষকে এসব দেওয়াটাই ভুল হয়েছে আমার।’

ব্যথা-কষ্টে এমনিতেই রাগ হয়। স্ত্রীর কথায় নিখিল সাঁতরা আরও রাগলেন। ঠিক করলেন, ওষুধ লাগানো শেষ হলে স্ত্রীকে কথা শোনাবেন। শোনানোর দরকার। বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বলবেন- ‘অফিসের টিফিন কোনও রেস্তোরার মেনু নয় মন্দিরা, যে মাছের চপ, মাংসের কাটলেট সাজিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া পেটের সঙ্গে কাঁটা লাগার সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে রান্নার। চপ তৈরির সময় আরও মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল।’

স্বাভাবিকভাবেই নিখিল সাঁতরা তেমন কিছু বলতে পারলেন না। শুধু জড়ানো গলায় বললেন, ‘অফিসে কাঁটা বাছাবাছির সময় থাকে না।’

রাতে শোওয়ার আগে গ্লাস ভরতি জল খান মন্দিরাদেবী। সেই গ্লাস হাতে নিয়েই স্বামীর দিকে তাকালেন। ভুরু তুলে বললেন, ‘কেন?’

অবাক হয়ে নিখিল সাঁতরা বললেন, ‘কেন মানে! অফিসে কি আমি খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই থাকি? কাজ নেই আমার?’

গ্লাস তুলে জল শেষ করলেন মন্দিরাদেবী। আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘কী কাজ?’

টাগরার ব্যথা গিলতে গিলতে নিখিল সাঁতরা আরও অবাক হলেন। বললেন, ‘কী কাজ মানে! আমার অফিসের কাজ তুমি কী বুঝবে?’

নাকে ‘ফুঁ’ ধরনের বিদ্রুপের হাসি হেসে মন্দিরাদেবী বললেন, ‘না বুঝব না। তাও বড় কোনও অফিসার-টফিসার হলে একটা কথা ছিল। এত বছর চাকরি করলে, সেকশন ইনচার্জটুকুও তো হতে পারোনি এতদিনে। এখনও তো সেই মাছিমারা কেরানি। তুমি আমায় কাজের কথা বলো কোন মুখে!’

এরপরই নিখিল সাঁতরা চুপ করে যান। দ্রুত গুটিয়ে যান বলাই ভাল। স্ত্রীর কথাটা আদ্দেক সত্যি, আদ্দেক মিথ্যে। সেকশন ইনচার্জ হতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু একটা প্রোমোশন ঝুলে রয়েছে। বড় কিছু নয়, ছোট প্রোমোশন। লোয়ার ডিভিশন থেকে এক ধাপ ওঠবার প্রোমোশন। বছর দুয়েক ধরে ‘হচ্ছে হবে’ বলেও হচ্ছে না। ফাইলটা গলিগুঁজিতে কোথাও পড়ে আছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। যে ফাইলের বাপ-মা থাকে না সে ফাইলের ধুলো মেখে পড়ে থাকাটাই নিয়ম। ফাইলের বাপ-মা খুঁজতে অফিস ইউনিয়নের নেতাদের কাছে যেতে হয়। নেতাদের সামনে বসে হাত কচলাতে হয়। হাত কচলানোয় খুশি হলে নেতারা ওপরতলায় চাপ মারে। তখন ওপরতলা নড়ে। ফাইলও নড়ে। নিখিল সাঁতরা প্রায়ই ভাবেন, এবার একদিন যাবেন। ইউনিয়ন অফিসে গিয়ে দরবার করবেন। সেক্রেটারি এখন তালুকদার। তিন বছর আগে রিটায়ার করেছেন, কিন্তু কর্মচারী ইউনিয়নের চেয়ার ছাড়েননি। এসব কথা মন্দিরাকে বলে কী লাভ? কোনও লাভ নেই। তার থেকে গুটিয়ে যাওয়াই ভাল। মুখে মাছের কাঁটার চিনচিনে ব্যথা নিয়ে সেদিন আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন নিখিল সাঁতরা। অন্ধকারে হাঁ করে শ্বাস টেনেছিলেন। অতিরিক্ত অক্সিজেনে যদি একটু আরাম হয়। আরাম কিছু হয়নি। ব্যথা পুরোপুরি যেতে দিন দুয়েক সময় লেগেছিল সেবার।

এবারও সেরকম কিছু হল না তো?

বাকি টিফিনটুকু হেলাফেলায় শেষ করলেন নিখিল সাঁতরা। কিছুটা খেলেন, বাকিটা ফেলে দিলেন। তারপর তড়িঘড়ি বাথরুমে ঢুকে আয়নায় মুখ রেখে হাঁ করলেন বড় করে। আয়নার অবস্থা শোচনীয়। জায়গায় জায়গায় ছোপ। জলের দাগ, পানের পিক, ধুলো জমে আছে। কত বছর যে পরিষ্কার হয়নি! নিজের মুখ দেখলে ভয় করে। চিনতে অসুবিধে হয়। বাথরুমে আলোও কম। গনগনে দুপুরেও ছায়া ছায়া। তবু মুখ পেতে ধরলেন নিখিল সাঁতরা। হাঁ-করা মুখ হেলিয়ে দুলিয়ে, কাত করে দেখতে লাগলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। খোঁচা লাগার কারণ খুঁজতে লাগলেন প্রাণপণে। হলদেটে দাঁত, কালো হয়ে থাকা থেবড়া ঠোঁট। এবড়ো-খেবড়ো মোটা জিভ কোথাও সাদা, কোথাও ফ্যাকাশে। বাকিটুকুর বেশিরভাগই অন্ধকার। হাঁ বাড়িয়ে কমিয়ে মুখের ভেতর আলো নেবার চেষ্টা করলেন নিখিল সাঁতরা। হল না। অবাক লাগল। মানুষের মুখের ভেতরটা কি এতটাই অন্ধকার! নাকি আজ বেশি লাগছে? একটা টর্চ পেলে হত। কতদিন তিনি নিজেকে এভাবে দেখেননি! কোনওদিনই কি দেখেছেন? মনে করার চেষ্টা করলেন নিখিল সাঁতরা। কোনও কারণ নেই, তবু মনে করার চেষ্টা করলেন।

কিছুই পাওয়া গেল না। টিফিন বক্স ধুয়ে, চোখে মুখে জল দিয়ে টেবিলে ফিরে এলেন। কাগজ দিয়ে মুছে ব্যাগে টিফিন বক্স পুরলেন যত্ন করে। রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। টেবিলের এক পাশে ঢাকা দিয়ে রাখা গ্লাস তুলে জল খেলেন দু’চুমুক। তারপর খোঁচার কথা ভুলে ফাইলে মন দিতে চেষ্টা করলেন। মন পুরোটা দেওয়া গেল না। মিনিট কুড়ির মধ্যে ক্যাশের বিপুল হালদার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। অনুমতি ছাড়াই চেয়ার টেনে উলটোদিকে বসতে বসতে নিচু গলায় বলল, ‘সাঁতরাদা, ঘটনাটা কী?’

কাজ শুরুতেই ব্যাঘাত পেয়ে একটু বিরক্তই হলেন নিখিল সাঁতরা। বিরক্তি লুকিয়ে বললেন, ‘কোন ঘটনা বিপুল?’

বিপুল হালদারের বয়েস বেশি নয়, তবে মাতব্বরি বেশি। ইউনিয়ন ইলেকশনে দু’বার দাড়িয়ে দু’বারই হেরেছে। এখন টেবিলে টেবিলে ঘুরে ঘোঁট পাকায়। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আপনি নাকি সকালে ইউনিয়ন অফিসে গিয়েছিলেন? সেখানে আপনাকে… ভুলে গেলেন!’

শুকনো হাসলেন নিখিল সাঁতরা। ঘটনা আসলে তাই। অপমান প্রায় ভুলেই গেছেন।

অন্যদিন হলে হয়তো আরও একটু সময় লাগত। আজ মুখে খোঁচা লাগার কারণে আরও

কম লেগেছে।

‘না সেরকম কিছু নয়।’

বিপুল হালদার চাপা অথচ কঠিন গলায় বলল, ‘সেরকম নয় মানে? আপনার ন্যায্য প্রোমোশন এতদিন ঝুলে আছে, সেটা বলতে গিয়ে অপমানিত হবেন সেটা কিছু নয়। কে ছিল ওখানে? ওই তালুকদার হারামজাদাটা না? আর? আর ওই মেয়েছেলেটা?’

নিখিল সাঁতরা ভয় পেলেন। নেতাদের নামে গালি শুনতে ইচ্ছে করে, কিন্তু শুনলে ভয় করে। তার ওপর আবার একেবারে নিজের টেবিলে বসে শোনা তো মারাত্মক।

‘না না, ওরাই বা কী করবে? ইউনিয়নে তো আর প্রোমোশন দেখে না। একটু বলতে টলতে পারে আর কী।’

‘দেখে না বললেই হবে? শুনলাম তিন বছরের বেশি আপনার কেসটা ঝুলে আছে।’

‘ছেড়ে দাও বিপুল। ওপরতলা না চাইলে কে কী করবে বলো? তা ছাড়া প্রোমোশনটা হলে হাতি ঘোড়া বিরাট কিছু মাইনে বেড়ে যাবে এমনটা তো নয়। এই একটু হল আর কী। বাড়িতে গিয়ে বললাম, ছেলেমেয়েরা খুশি হল ব্যস। তাও বুড়ো বয়েসে একটা কিছু হয়েছে।’

কথা শেষ করে বানিয়ে হাসলেন নিখিল সাঁতরা।

বিপুল দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘এই ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও নেকামিটা এবার ছাড়ুন তো সাঁতরাদা। বেটারা আসলে আপনার কেসটা উঠতেই দেয় না। ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে নেগোসিয়েশনের সময় আর পাঁচটা নিয়ে ঘষাঘষি করে।’

নিখিল সাঁতরা আবার হাসতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। বললেন, ‘বাদ দাও বিপুল। অন্যরা অনেকদিন ধরেই বলছে, তাদেরটাও তো দেখতে হবে। আমারও আগে বলা উচিত ছিল, যাওয়া উচিত ছিল… ভেবেছিলাম নিজে থেকে হয়ে যাবে। সামান্য ব্যাপার। সবারই তো হয়।’

টেবিলে আঙুল দিয়ে রাগের টোকা মেরে বিপুল বলল, ‘ঘোড়ার ডিম হয়ে যাবে। পারচেজের ওই নতুন মেয়েটার কী নাম যেন? রমলা না কমলা? না না পর্ণা। পর্ণা রায়। তার কী করে এত অল্পদিনে পরপর দু’-দুটো প্রোমোশন হয়ে গেল? কিছু জানি না ভেবেছেন? ডিপার্টমেন্টে কোনও কাজ করে না। সারাদিন ইউনিয়নবাজি। শুনেছি তালুকদারের সঙ্গে নটর-ঘট আছে। সন্ধের পরও অফিস ঘরে বসে থাকে… জানি না ভেবেছেন? …ঢলানি সবাই জানে… বেটা বুড়ো।’

নড়ে-চড়ে বসলেন নিখিল সাঁতরা। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এইসব ছেলেছোকরাদের বাড়াবাড়ি করার ক্ষমতা থাকতে পারে, তাঁর নেই। যদিও আজকের অপমানের ঘটনাটা ওই মেয়েটিকে নিয়েই ঘটেছে। ঘটেছে না বলে ঘটানো হয়েছে বলাই ভাল। একতলার অফিসে গিয়ে তালুকদারের কাছে কথাটা পেড়েছিলেন তিনি।

‘অনেক বছর আটকে আছে ভাই।’

‘আটকে আছে তো আমরা কী করব নিখিলবাবু? ইউনিয়ন তো প্রোমোশন ডিমোশন আটকে রাখার মালিক নয়।’

‘তবু যদি একটু বলতেন…।’খুবই লজ্জিত গলায় বললেন নিখিল সাঁতরা। বলতে বলতে ভাবলেন, কেন যে এলাম। আসলে মেয়েটার বিয়ের কথা শুরু হয়েছে। শুরু করেছে মন্দিরা। দু’-একটা সম্বন্ধ আসছে। চিঠি-চাপাটিও চলছে। উর্মি নাকি তার মাকে বলেছে, ‘চিঠিতে বাবা কী করে সেটা আর ঢাকঢোল পিটিয়ে লেখার দরকার নেই। চাকরি করে ব্যস এইটুকু লিখেই চেপে যাও।’ কথাটা পরশু মন্দিরা তাঁকে ঠারে-ঠোরে বলেছেও। যেমন অবাক হন, তেমন রাগও হয় নিখিল সাঁতরার। বাপের পয়সায় বড় হয়েছে, বাপের পয়সায় বিয়েও করবে, অথচ পরিচয় দেওয়ার বেলায় লজ্জা! তিনি শান্তভাবেই স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কী বললে?’

‘কী আবার বলব? ঊর্মি তো বাজে কথা কিছু বলেনি। হাতি-ঘোড়া এমন কিছু তো কাজ করো না যে ছেলের বাড়িতে বললে তারা লাফিয়ে উঠবে।’

‘তা বলে নিজের বাবার সম্পর্কে অমন বলবে!’

মন্দিরা ঝাঁঝিয়ে ওঠে। বলে, ‘মেয়েরও তো একটা মান-সম্মান আছে। শুধু নিজেরটা দেখছ কেন?’

নিখিল সাঁতরা খানিকটা মিনমিন করে বললেন, ‘আমি যে কাজ করি সেটাই তো বলব।’

মন্দিরাদেবী এবার চাপা গলায় হিসহিসিয়ে উঠলেন। বলতে লাগলেন একটানা— ‘কাজটা বড় কথা নয়, উদ্যোগটাই আসল। শুরু যেখানে থেকেই করো, একটা জায়গায় তো মানুষ যায়। বড় হয়। তোমার সঙ্গে অফিসে চাকরি শুরু করে কতজন কত এগিয়ে গেছে দেখেছ একবার? হিসেব করেছ? রিটায়ারমেন্টের আর কটাদিন বাকি? শুধু কি অফিস? সংসারেও তো কোনও কম্মে লাগো না। এতদিনেও নিজেদের একটা ফ্ল্যাট হল না। জন্মভর ভাড়া করা বাসাতেই পচে মরছি। আরে বাপু, শুধু কি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট হয়? এদিক-ওদিক ধরাকরায় লোকজনেরা কত সস্তায় ফ্ল্যাট বাড়ি পেয়ে যাচ্ছে সে খবর জানো? জানতে চাও? সৌমির ননদাই পাইকপাড়ায় গরমেন্টের…..। যাক এখন আর বলে কী হবে? ছেলেটা কলেজ শেষ করে বসে আছে আট মাস। চাকরির জন্য যে ক‘জনকে বলতে গেলে, দেখছি, দেখব বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। দেবেই তো, তোমার মতো মেদামারা পুরুষমানুষকে কে কোলে বসিয়ে খাতির করবে বলো? মেয়ের বিয়ে নিয়েও মাথা-ব্যথা নেই। আজকাল সব কিছুতেই সোর্স লাগে। ছেলে খুঁজতেও লাগে। ভাল পাত্র ঘাপটি মেরে থাকে। মাটি খুঁড়ে বের করতে হয়। আমি যেটুকু করার করছি। কিছু বলতে গেলে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ।’

একটা দুটো অভিযোগেই চুপ করে যান নিখিল সাঁতরা, এ তো দীর্ঘ তালিকা! নিয়মমতো গভীর নৈঃশব্দ্যে চলে যান তিনি। সত্যি তো, মন্দিরা ভুল কিছু বলেনি। নিখিল সাঁতরা সিদ্ধান্ত নিলেন, অন্য কিছু না হোক বকেয়া প্রোমোশনটা নিয়ে একবার তদ্বির করে দেখবেন। যদি হয়ে যায় সামান্য হলেও কিছু তো হল। ঊর্মির ভাবী শ্বশুরবাড়িতে না হয় বলা যাবে— ‘মেয়ের বাবার একটা প্রোমোশন হয়েছে। তেমন কিছু না, বুড়ো বয়েসে… হে হে।’

এই সিদ্ধান্ত মতোই টিফিনের মুখে ইউনিয়ন অফিসে এসে কাঁচুমাচু মুখে কথাটা তুলেছেন নিখিল সাঁতরা।

তালুকদার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলেন, ‘এই একটুটাই মুশকিল দাদা। আপনি বলছেন, একটু দেখুন, অথচ এই একটু দেখতে হলে যে কত পরিশ্রম করতে হয় জানা নেই আপনাদের। আপনার তো মোটে বছর তিনেকের মামলা। পাঁচ-দশ বছরের কেস নিয়ে জেরবার হয়ে আছি। দেখবেন ক’টা অ্যাপ্লিকেশন পড়েছে? দেখবেন? নিন দেখুন না!’

টেবিলের একপাশে ডাঁই হয়ে পড়ে থাকা কাগজপত্রে হাত বাড়ান তালুকদার। নিখিল বললেন, ‘না না তার কোনও দরকার নেই, আপনারা যখন বলছেন আমি বিশ্বাস করছি।‘

ঠোঁটের কোনায় বিদ্রুপের হাসি হাসলেন তালুকদার।

‘এটাই তো সমস্যা নিখিলবাবু। বুড়ো বয়স পর্যন্ত শুধু নিজেরটুকু নিয়েই ব্যস্ত রইলেন। অন্যের কী হল না হল ভাবলেন না একবারও। অফিসে লেট করে এলুম, টিফিনে ছানা খেলুম, তারপর বাড়ি চলে গেলুম— এটা করলে কীভাবে চলবে বলুন দেখি? আর পাঁচটা সহকর্মীর কথাও তো ভাবতে হবে। তাই না?’

নিখিল সাঁতরার মনে হল, তালুকদার যেন এক গালে সপাটে চড় কষাল। সেই চড় পড়ল আর এক গালেও। নারীকণ্ঠের চাপা হাসিতে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, এবার হতচকিতে মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখতে পেলেন ঘরের এক কোনায় মেয়েটি বসে আছে। আধো আলো, আধো ছায়ায় মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। ঠাট্টার হাসি। তালুকদারও হাসতে লাগলেন।

‘দেখছেন তো নিখিলবাবু, আমরা কর্মীদের কেমন খবর রাখি? তাদের টিফিন বক্সের ভেতরও আমাদের নজর আছে। শুধু শুধু কি আর এই চেয়ারে বসে আছি এতদিন? বলেন তো আরও ভেতরের খবর বলতে পারি। বলব?’

মেয়েটি হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়ল। খসে যাওয়া আঁচল একই সঙ্গে সামলে এবং না সামলে বলল, “উফ তালুকদারদা, আপনি না কিছু পারেন।’

কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে নিখিল সাঁতরার। তালুকদার বললেন, ‘একে চেনেন? চিনে রাখুন। পর্ণা রায়। পারচেজে এসেছে বছর তিনেকও হয়নি। এসেই ইউনিয়নে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। রাতদিন পড়ে থাকে। দেখে শেখবার মতো। এরাই আগামীদিনের লিডার।’

মেয়েটি চেয়ারে হেলান দিয়ে আবো আধো গলায় বলল, ‘কী যে বলেন না তালুকদারদা, দূর, লিডার না ছাই হব।’

‘যা সত্যি তাই বলছি পর্ণা। এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। অনেক বুড়ো-হাবড়ারা যা পারে না তোমরা তা করে দেখিয়ে দিচ্ছ।’

নিখিল সাঁতরা মাথা নামালেন। ‘বুড়ো-হাবড়া’ কথাটা যে তার জন্যই বলা সেটা বুঝতে অসবিধে হওয়ার কিছু নেই। তালুকদার সিগারেটের শেষ অংশটুকু অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, ‘পর্ণা একটা কাজ করো তো, এই ভদ্রলোকের কেসটা হ্যান্ডেল করো। শুনলে তো সবই। বেচারি শান্তশিষ্ট, লাজুক মানুষ বলে ডিউ প্রোমোশন তিন বছর ঝুলে থাকবে এটা কোনও কথা নয়। ভোকাল মানুষকে নিয়েও যেমন আমাদের চলতে হবে, লাজুক মানুষকে নিয়েও তো চলতে হবে। ইউনিয়ন তো সবার। তাই না? তুমি দেখো নেক্সট মিটিং-এই যেন ফাইলটা পুট-আপ করা হয়। ওঁর কাছ থেকে একটা অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে রাখো।’

নিখিল সাঁতরা মুখ তুলে বললেন, ‘অ্যাপ্লিকেশন কি আজই দেব? এখনই?

কনুইয়ে পড়া আঁচল কাঁধে তুলে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে পর্ণা রায় বলল, ‘না না আজ নয়। আজ আমি খুব বিজি। আপনি বরং কাল, থাক কাল আবার পরপর দুটো মিটিং আছে একেবারে সোমবারই দিন।’

তালুকদার সোজা হয়ে বললেন, ব্যস হয়ে গেল। সোমবার বারোটা নাগাদ অফিসে এসে কাগজপত্র দিয়ে যাবেন। দেরি করবেন না। পর্ণা না থাকলে অপেক্ষা করবেন। থাকবে না-ই ধরুন। তবু অপেক্ষা করবেন। ও আবার খুব লেট লতিফ মেয়ে।’

পর্ণা নাক কুঁচকে বলল, ‘ওমা লেট না করে উপায় কোথায় তালুকদারদা? বাড়িতে কত কাজ। বরকে অফিসে পাঠিয়ে, ছেলেকে খাইয়ে…।’

তালুকদার এতক্ষণে সম্পূর্ণভাবে মেয়েটির দিকে ঘুরে বসেছেন। চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘কী খাইয়ে ছানা?’ দুজনের হাসির মাঝখানেই সম্পূর্ণভাবে নিঃশব্দে উঠে এসেছিলেন নিখিল সাঁতরা। ক্যান্টিনে যেতে যেতে ভেবেছিলেন, টিফিন যেমন খাবেন না, তেমন অ্যাপ্লিকেশনও জমা দেবেন না। কিন্তু এখন মত বদলেছেন। সোমবার অ্যাপ্লিকেশন দেবেন বলে ঠিক করেছেন। দরকার হলে ওই মেয়েটির জন্য সারাদিন বসে থাকবেন।

নিখিল সাঁতরা অনুরোধের ঢঙে বললেন, ‘বিপুল, এখন বরং এসব থাক। আমার হাতেও অনেক কাজ। দেখছ তো কতগুলো ফাইল! না দিতে পারলে আবার খিটমিট করবে।’

বিপুল মুখ বিকৃত করে উঠে দাড়াল। বলল, সারাজীবন এই খিটখিটের ভয়েই মরুন আপনারা। আমার কী? কিছুই নয়। শুনলাম, ওই পর্ণা মেয়েটা নাকি আপনাকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করেছে। বলেছে, ঘরে এসে বসে থাকবেন। সেইজন্যই বলতে আসা। নিজের প্রেস্টিজ নিজে যদি না বোঝেন…।’

বিপুল চলে যাওয়ার পর ফাইল খুলে বসলেন নিখিল সাঁতরা। কিন্তু কাজ বেশি এগোল না। চার নম্বর ফাইল দেখার সময়েই মুখে আবার লাগল। এবার সেই ব্যথা তীক্ষ্ণ। ঠিক যেন কেউ ছুঁচ ফোটাল! চমকে উঠলেন নিখিল সাঁতরা। জিভ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন এবং বুঝতেও পারলেন দ্রুত।

ওপরের একটা দাঁতের ডগা ছুঁচালো হয়ে গেছে!

আগেকার দিনে ডাক্তাররা রোগীর হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন। এখন ব্যবস্থা পালটেছে। প্রেসক্রিপশনের ওপর নিজের হাতেই তাঁরা ছবিটবি এঁকে সমস্যা বুঝিয়ে দেন। এই ডেনটিস্ট ভদ্রলোকও তাই করছেন। একটু যেন বেশিই করেছেন। সব সময়েই করেন? নাকি আজ বেশি করছেন? টেবিলের ওপর ঝুকে পড়ে নিখিল সাঁতরার দাঁতের ছবি এঁকেছেন। এলোমেলো স্কেচ। সারি সারি দাঁত। ডাক্তারের মুখ থমথমে। সম্ভবত দাঁতের চিকিৎসকরা রোগীর সামনে হাসেন না।

‘এই হল মানুষের দাঁত। মোটামুটি এটাই ধরুন কম্পোজিশন। এই সামনের চারটেকে বলে ইনসিজার, পাশের দুটো ক্যানাইন। ইনসিজার দিয়ে আমরা খাবার ছিড়তে পারি। আর ক্যানাইন সেই খাবার টুকরো করতে কাজে লাগে। আর এই যে পাশের দুটো দেখছেন? এই দুটো হল প্রিমোলার। খাবার ক্রাশ করে। ভেঙে ফেলে বলতে পারেন। এদের ফাংশনও খুব জরুরি। পিছনের তিনটে দাঁত ইউসড ফর গ্রাইন্ডিং ফুড। বাংলায় পেষাপিষি বলতে পারেন। আপনার হয়েছে…।’

ডাক্তারের কাছে আসার সিদ্ধান্ত নিখিল সাঁতরা নিজেই নিয়েছেন। নিয়েছেন কাল গভীর রাতে। বাড়ির কাউকে জানাননি।

অফিস থেকে ফেরার পর দাঁত সমস্যা নিয়ে বাড়িতে কাউকেই কিছু বলেনওনি। ইচ্ছে করেই বলেননি। বছরখানেক আগের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। মাছের চপের কাঁটা নিয়ে স্ত্রীর কথা শুনতে হয়েছিল। তার ওপর মন্দিরা এখন বিয়ে নিয়ে খুবই ব্যস্ত। দুপুরের পোস্টে আন্দুলের দিক থেকে একটা সম্বন্ধ এসেছে। ছেলের মা চিঠি লিখেছে। ছেলের দুটো ফটোও পাঠিয়েছে। রঙিন আর সাদা কালো ফটো। রঙিন ফটো দেখে উর্মি নাক বেঁকালেও, সাদা কালো চেহারা তার পছন্দ হয়েছে। ছেলে ভাল। স্কুল টিচার। ছেলের মা ব্রাকেট করে জানিয়েছে, মোটা টিউশনি আছে। উর্মির চেহারা তাদের ফটোতে ভাল লেগেছে। এখন একবার চোখে দেখতে চায়। বড় কথা হল, দেওয়া-থোওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। শুধু আন্দুলের বাড়ির দোতলায় ছেলে ছেলের বউয়ের জন্য একটা ঘর বানিয়ে দিলেই চলবে। ঘরের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ। সেই ঘরের মেঝে মার্বেল হবে না টাইলস বসবে, জানলা একটা না পাঁচটা হবে, বাথরুমে ফিটিংস ওয়েস্টার্ন না দেশি হবে সবই মেয়ের ইচ্ছেমতো করলে চলবে। এ বিষয়ে ছেলে ট্যাঁ ফুঁ করবে না। ছেলের মা-বাবারও কোনও বক্তব্য নেই। ঘর তৈরির সময় তারা ফিরেও দেখবে না। মন্দিরাদেবী গদগদ হয়ে পড়েছেন। এ তো হিরের টুকরো পাত্র! উর্মি অভিমান করে বলেছে, ‘শুধু পাত্র ভাল বলছ মা! শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন দেখছ না? কী ভাল! একেবারে নাক গলানো টাইপ নয়। সেটা একবার বলবে না? এই পরিস্থিতিতে দাঁতের ঘটনা বলা যায় না। তা ছাড়া একটা দাঁত একটু ছুঁচালো হয়ে পড়াটা এমন একটা ‘আনন্দঘন’ পরিবেশে বলার মতো ঘটনাও নয়। রাতে শোওয়ার আগে জল খেতে খেতে মন্দিরাদেবী বললেন, ‘প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার জন্য কালই অ্যাপ্লাই করো। বাকিটা ধার-দেনা করতে হবে। এই সুযোগ আমি মরে গেলেও হাতছাড়া করব না। কিছুতেই করব না। কী শুনছ?’

‘শুনছি মন্দিরা।’

‘মনে তো হচ্ছে না। মুখের ভেতর যেভাবে বনবন করে জিভ ঘোরাচ্ছ। ঘাবড়ে গেলে নাকি?’।

জিভের নড়াচড়া সামলে নিখিল সাঁতরা হাসার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘না ঘাবড়াব কেন? আসলে…।’

‘আসলে কী?’ রাগে ভুরু তুললেন মন্দিরাদেবী।

‘না কিছু নয়।’

‘না হলেই ভাল। তোমার মতো মানুষের আসল-নকল যত কম থাকে ততই সংসারে মঙ্গল।’

তখনও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি নিখিল সাঁতরা। নিলেন মাঝরাতে।

সবাই ঘুমিয়ে পড়বার পর। বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা ছোট্ট টর্চটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন পা টিপে টিপে। দরজা আটকে টর্চ জ্বালিয়ে মুখের ভেতর আলো ফেলেই শিউরে উঠলেন। এ কী! একটা তো নয়, দু’পাশের দুটো দাঁতেই…।’

ডেনটিস্ট ভদ্রলোক একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আপনার এই ক্যানাইন দুটোতে সমস্যা হয়েছে। বাংলায় এদের আমরা বলি শ্বদন্ত। সমস্যাটা খানিকটা আনইউসুয়াল। অন্তত, আমি

তো কখনও দেখিনি। ইটস ডাসন্ট ম্যাটার। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেককিছুই প্রথম দেখতে হয়। অভিজ্ঞতার মধ্যে চলাটাই বড় কথা।’

এতটা বলে ডাক্তার একটু চুপ করলেন। নিখিল সাঁতরা পলকহীন চোখে বললেন, ‘সমস্যাটা কী ডাক্তারবাবু?’

ডাক্তার নিজের আঁকা ছবি থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘দুটো দাতঁই হঠাৎ করে অন্যদের থেকে খানিকটা লম্বা হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এদের মুখ দুটোও দেখলাম সরু। অনেকটা নিডল সেপড্‌। মানে ছুঁচের মতো হয়ে গেছে। তা ছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে। যদিও আমি শিয়োর নই, এক্স-রে করে দেখতে হবে, মনে হচ্ছে দাঁত দুটোর ভেতরে একটা ফাঁপা অংশ তৈরি হয়েছে, পাইপের মতো।’

নিখিল সাঁতরার মনে হল, শরীরটা একটু কাঁপছে। তিনি দু’হাতে টেবিলের কোনা চেপে ধরলেন। ডাক্তার ভদ্রলোক এই প্রথম হাসলেন। সুন্দর হাসি। দাঁতের ডাক্তারের হাসি কি সবসময় সুন্দর?

‘চিন্তা করবেন না মিস্টার সাঁতরা। ড্রাকুলার দাঁত বলে কিছু হয় না। এটা কল্পনা মাত্র। আমার ধারণ ক্যালশিয়ামের কোনওরকম আনইউসুয়াল গ্রোথের কারণেই… যাই হোক, এখন আমাদের সামনে অপশন দুটো। এক, আমি দুটো দাঁত আপাতত ঘসে খানিকটা নরমাল সেপে এনে দিতে পারি। সেকেন্ড, আপনি বললে ক্যানাইন দুটো তুলে দিই। তা হলে আর কোনওরকম ঝুঁকি থাকে না। ভবিষ্যতেও ভয় নেই। নাউ ইউ ডিসাইড। একদিন সময় নিন, বাড়িতে কথা বলুন।’

তিনশো টাকা ভিজিট শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেন নিখিল সাঁতরা। সঙ্গে আছে তো? মানিব্যাগ বের করে দেখলেন, হ্যাঁ, আছে। বেশিই আছে। ডেসপ্যাচের অমূল্যর কাছ থেকে নেওয়া ধার শোধ করার জন্য সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন ক‘টা দিন। ছোকরা তিনদিন হল অফিস কামাই করে বসে আছে। ভাগ্যিস করছে। নইলে আজ লজ্জায় পড়তে হত। সুন্দর হাসির ডাক্তার একটা আধময়লা একশো টাকার নোট বদলে নিতে নিতে বললেন, ‘সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করবেন না। যতই হোক ঝামেলাটা অন্যরকম।’

দেরি করলেন না নিখিল সাঁতরা। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাস কামরার ভিড়ে ছাতা, ব্যাগ, টিফিন বাক্স সামলাতে সামলাতে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন।

থাক না দাঁত দুটো। ক্ষতি কী? শেষ পর্যন্ত যদি কোনওদিন কাজে লাগে।

আজ বরং অফিসে পোঁছেই একবার ইউনিয়নের ঘরে যাবেন। তালুকদারকে ঠান্ডা গলায় বলবেন, ‘থাক, আমার ফাইলটা নিয়ে আপনাদের ব্যস্ত হতে হবে না। এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা আমি নিজেই বুঝে নিতে পারব।’ খারাপ মানুষকে ঠান্ডা গলায় সব থেকে বেশি ভয় পাওয়ানো যায়৷

নিখিল সাঁতলা ট্রামের দুলুনি সামলাতে সামলাতে নিজের মনেই হাসলেন। জিভ দিয়ে উঁচু হয়ে আসা দাঁত দুটোকে স্পর্শ করলেন গোপনে। আদরের স্পর্শ গোপনেই করতে হয়।

শারদীয়া বর্তমান ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *