গোলাপি জামা

গোলাপি জামা

শান্তনুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গিয়েছে। তবু সে তানিয়াকে একটা সুযোগ দিতে চায়। ওনলি ওয়ান চান্স। মানুষ রাগের মাথায় অনেক কিছু করে বসে, পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে। হয়তো তানিয়াও বুঝতে পেরেছে। এখন সেই অনুতাপের কথা জানার জন্যেই সুযোগ করে দেওয়া। এতে যদিও সিদ্ধান্তের কোনও হেরফের হবে না। তাই মনটা খুব শক্ত করে রেখেছে সে! টেলিফোন তুলে তানিয়ার নম্বর টিপল শান্তনু।

তানিয়া ঘুম জড়ানো বিরক্ত গলায় বলল, ‘এত ভোরে ঘুম ভাঙালি কেন? তুই জানিস না, আমি দেরি করে উঠি?’

শান্তনু ছোট মতো একটা ধাক্কা খেল। কাল এত বড় একটা অন্যায় করেও বেলা পর্যন্ত ভোঁস ভোঁস করে কেউ ঘুমোতে পারে! এও হয়! অথচ কাল রাতে সে নিজে একফোঁটাও ঘুমোতে পারেনি। এই তানিয়ার অনুতাপের বহর? ছি ছি!

শান্তনু নরম গলায় বলল, ‘সরি, আমি বুঝতে পারিনি।’

তানিয়ার বিরক্তি যেন আরও বাড়ল। বলল, ‘এইটুকু না বুঝতে পারলে কী হবে? উফ, তুই কি চিরকাল একই রকম হাঁদা থাকবি শান্তনু? ফার্স্ট ইয়ার শেষ হয়ে সেকেন্ড ইয়ার হতে চলল, এইটুকু তো বুঝতে হবে!’

শান্তনুর উপর ধাক্কা আরও জোরে এল! জ্ঞান দিচ্ছে! নিজে ভয়ংকর একটা কাণ্ড করে তাকে এখন জ্ঞান দিচ্ছে?

তানিয়া ফোনের মধ্যে হাই তুলল। বলল, ‘চুপ করে আছিস কেন? কী বলবার তাড়াতাড়ি বলে ফেল। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ‘রোমান হলিডে’ সিনেমাটা দেখলাম। ছবিটার কথা অনেক শুনেছি, দেখা হয়নি। হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে গিয়েছে। আজ ঠিক করেছি, একদম হাসব না। হাসিকে রেস্ট দেব। সিনেমাটা তুই দেখেছিস নাকি?’

শান্তনু চমকে উঠল, সে ঠিক শুনছে তো? এই মেয়ে কাল রাতে সিনেমা দেখেছে? শুধু দেখেছে না, আবার বলেছে হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে গিয়েছে! নাঃ, এই মেয়ের উপর আর কোনও আশা নেই!

সে গম্ভীর গলায় বলল, ‘না দেখিনি।’

‘চান্স পেলেই দেখে নিবি।’

শান্তনু গম্ভীর গলায় বলল, ‘আচ্ছা দেখে নেব।’

তানিয়া হেসে বলল, গুড। এবার কী বলবে চট করে বলে ফেলো দেখি।’

তানিয়ার হাসি ওর কানে কাঁটার মতো বিধল। এইসময় হাসি৷ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তানিয়া তোকে একটা প্রশ্ন করব?’

‘প্রশ্ন? সাতসকালে ঘুম ভাঙিয়ে প্রশ্ন করবি? এত ভোরে তো যাবতীয় প্রশ্ন শুরু হয় কাকদের! তুই তা হলে কাক হয়ে গেলি শান্তনু। অ্যাঁ, ভোর হতে না হতেই শুরু করে দিলি?’

শান্তনুর মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে কাক? আর কালকের ওই ঘটনার পর উনি বুঝি কোকিল হয়েছেন আর কুহু-কুহু করছেন! হাসি থামিয়ে তানিয়া তাড়া দিল, “অ্যাই, যা প্রশ্ন-টশ্ন করবি তাড়াতাড়ি কর, করে টেলিফোনটা ছাড় দেখি। আমি আর একবার ঘুমোনোর ট্রাই নেব। কলেজ ছুটি, তাও দুপুরে একবার বেরোতে হবে, অনেক কাজ আছে। তার আগে একটু ঘুমিয়ে চোখ ফুলিয়ে নেব। বিউটি স্লিপ।’

শান্তনু বুঝতে পারছে, আর-একটা কথাও না বলে, তার রিসিভারটা নামিয়ে রাখা উচিত। ফোন করাটাই ভুল হয়েছিল। মারাত্মক ভুল। কিন্তু ফোন কেটে দেওয়ার সাহসও হচ্ছে না। একবার বিচ্ছিরি কাণ্ড হয়েছিল। মাঝখানে ফোন কেটে দেওয়ায় তানিয়া টানা সতেরো মিনিট চেঁচিয়েছিল। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে শান্তনু বলল, ‘তানিয়া, তুই কি মনে করিস না, কাল যে কাজটা তুই করেছিস, সেটা খুব অন্যায়?’

‘অন্যায়? কোন কাজটা অন্যায়?’ তানিয়ার গলায় অবাক সুর।

ন্যাকামি হচ্ছে? কোন কাজ মনে পড়ছে না?

শান্তনু গলা নামিয়ে বলল। ‘ওই জামার ব্যাপারটা। জামা নিয়ে তুই যা করলি…’ কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তানিয়া ধমকে উঠল, ‘তুই ওটাকে অন্যায় বলছিস শান্তনু? ছি ছি।’

ধমকানিতে শান্তনু থেমে গেল। থতমত খেয়ে বলল, ‘না, না, অন্যায় নয়। মানে ভুল আর কী। আমি জানি, রাগের মাথায় কাজটা তুই করে ফেলেছিস। সেটাই তোকে জিজ্ঞেস করছিলাম। কনফার্ম করছিলাম বলতে পারিস।’

তানিয়া ওপাশ থেকে একেবারে তেড়েফুড়ে উঠল, ‘ভুল হয়েছে? ভুল হতে যাবে কেন? যা করেছি, বেশ করেছি। ঠিক কাজ করেছি। খুব ভাল কাজ করেছি।’

এরপর আর ফোনের রিসিভার ধরে থাকার কাও মানে হয় না। ফোন কেটে দেওয়াই উচিত। যত খুশি রাগ করুক। মেয়েটাকে ভাল মতো বুঝিয়ে দেওয়া উচিত সেই দিন আর নেই। তার রাগ দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার দিন লে গিয়েছে! আজ সকাল থেকেই চলে গিয়েছে। কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া গেল না। তার আগেই তানিয়া ফোন নামিয়ে রাখল। শান্তুনু খুশি হল। যাক, ভালই হয়েছে। নিজের কাছে পরিষ্কার থাকা গেল। এমন নয় যে, সে সুযোগ দেয়নি। সুযোগ সে দিয়েছিল। তানিয়া যদি বলত, ‘সরি, কিছু মনে করিস না, কালকের জন্য আমি খুব দুঃখিত,’ তা হলেই বরং সমস্যা হত। মুখে যাই বলুক, কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে শান্তনুকে তখন দু’বার ভাবতে হত। সে ঝামেলা আর রইল না। আজ এই মুহূর্ত থেকে এই মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। শান্তনু বালিশের পাশ থেকে ঘড়িটা বার করে দেখল। ছ’টা সাইত্রিশ। সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নোট করে রাখা উচিত। পরে অনেক সময় রেফারেন্সে লাগে। কালকের ঘটনার সময়ও শান্তনু ঘড়ি দেখে রেখেছিল। তখন ঠিক বিকেল চারটে এগারো মিনিট। তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নেমে চারটে সতেরোর মেট্রো ধরতে চলে যায় তানিয়া।

শান্তনু বসে আছে টেবিলে। সামনে কেমিস্ট্রি বই খোলা রয়েছে। একটা অক্ষরও মাথায় ঢুকছে না। ঢোকবার কথাও নয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, এবার সেটা জানাতে হবে। জানাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এই ধরনের কাজে কী ফল হয়, সেটা ওই মেয়ের দ্রুত টের পাওয়া দরকার। কিন্তু পদ্ধতিটা কী হবে? আচ্ছা, একটু বেলার দিকে আবার টেলিফোন করলে কেমন হয়? তারপর কড়া গলায় বলতে হবে, ‘অনেক হয়েছে তানিয়া, আর নয়। এনাফ ইজ এনাফ। তোমার মতো একটা মেয়ের সঙ্গে আমার কোনওরকম সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয়। তুমি তোমার পথ দেখো, আমি আমার পথ দেখব। তোমার যদি পথ দেখতে ইচ্ছে না করে, তা হলে কুহু কুহু করে কোকিলের মতো ডেকে বেড়াও! কিন্তু দয়া করে আর আমাকে জ্বালাতন কোরো না।’

কাজটা কি বুদ্ধিমানের মতো হবে? মনে হচ্ছে না। একটা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। তখনও যদি তানিয়া ঘুমিয়ে থাকে? দু’-দু’বার ঘুমিয়ে থাকলে তো কেলেঙ্কারি ব্যাপার হয়ে যাবে। এইসব ঝুঁকি নিয়ে বরং কাজ নেই। এর চেয়ে চিঠি লেখা নিরাপদ। কলেজে কাউকে দিয়ে এই চিঠি ধরিয়ে দিলেই হল। ছোট চিঠি বেশি ধানাই পানাই থাকবে না। থাকবে কেবল কাজের কথাটুকু। শান্তনু মনে মনে চিঠির খসড়া লিখতে শুরু করল,

তানিয়া, কাল বিকেলে তুই যে কাজটা করলি, সেটা যে-কারও পক্ষে চরম অপমানজনক। ঘটনাটা একবার ভাল করে ভাবলেই বুঝতে পারবি, আমি কী বলতে চাইছি। আচ্ছা আমিই মনে করিয়ে দিচ্ছি। আগামী সপ্তাহে আমার জন্মদিন আর সেই উপলক্ষে তুই আমায় একটা জামা উপহার দিলি। আমি কফি হাউজে বসে সেই জামা খুলে দেখলাম জামার রং অতি জঘন্য। গোলাপি। আমি অবাক হয়ে বললাম, এইরকম একটা গোলাপি রঙের জামা তুই আমার জন্য কিনলি? তুই বললি, সে নাকি একটা মজার কাণ্ড। কবে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফেরার সময় তুই দেখেছিস আকাশের রংটা গোলাপি হয়ে আছে। তোর ইচ্ছে করল যে, তুই রংটা হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁবি। এরপরেই নাকি তুই অনেক খুঁজে পেতে জামাটা কিনেছিস। আমি বললাম, এই জামাটা তুই বদলে দে। এই রঙের জামা আমি পরব না। কেউই পরবে না। যদিও বা পরে, তা হলে ব্যাপারটা খুব হাস্যকর হবে। তুই গম্ভীর হয়ে বললি, তাই হবে। দে জামাটা দিয়ে দে। আমি বদলে দেব। এরপর আমরা হাবিজাবি গল্প করতে করতে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত গেলাম। মাঝপথে তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেলি। মুখে লঙ্কা পড়ায় তুই ‘উঃ আঃ’ করলি। এই পর্যন্ত ঘটনা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর? তারপর তুই যা কাণ্ড করলি, তা একবার ভেবে দেখ? মেট্রো স্টেশনের সিঁড়িতে বসে থাকা একটা ভবঘুরে টাইপের লোককে জামার প্যাকেটটা দিয়ে গটগট করে চলে গেলি। আমি নিশ্চিত, ওই লোকটা নিশ্চয় জামাটা দশ-বারো টাকায় বেচে রাতে নেশা করেছে। তুই একেই অতগুলো টাকা নষ্ট করলি এবং আমায় অপমান করলি। তবে অপমানের কায়দা মারাত্মক। গোলাপি এমন কিছু মারাত্মক রং নয় যে, তাকে খারাপ বলায় তুই আমার সঙ্গে অমন কঠিন ব্যবহার করলি। পরে আমার মনে হয়েছিল, তুই জেনে বুঝে জিনিসটা করেছিস। আসলে তুই আমায় অপমান করতে চেয়েছিলি। তবুও একটা সুযোগ আমি তোকে দিতে চাইলাম। আমার আশা ছিল, তুই নিজের ভুল বুঝে দুঃখ প্রকাশ করবি, সেই কারণে তোকে কাল ফোন করা। তুই বলতে পারিস, কেন আমি আগ বাড়িয়ে ফোন করলাম। আই ডোন্ট মাইন্ড। তা ছাড়া আমাদের টেলিফোন ক’দিন ধরে গোলমাল করছে, লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু শোঁ শোঁ করছে। ভেবেছিলাম তুই চেষ্টা করছিস, পাচ্ছিস না।

চিঠি এই পর্যন্ত ভেবে শান্তনু থেমে গেল। কেমন যেন লাগছে। একে তো অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, তার উপর মনে হচ্ছে না, এটা আদৌ সম্পর্ক শেষ করে দেওয়ার চিঠি! এ তো ভোরবেলায় ঘুম ভাঙানোর কৈফিয়তের মতো শোনাচ্ছে। কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। ভয়ের কী আছে? কিচ্ছু না।

না, যাক চিঠি-ফিঠির মধ্যে না যাওয়াই ভাল। যার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ, তাকে আবার চিঠি কীসের? তা ছাড়া, মেয়েটাকে জোরে একটা ধাক্কা দিতে হবে। চিঠি লিখে সে ধাক্কা দেওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না। শান্তনু ভাবতে লাগল।

শান্তনু এখনও টেবিলে বসে আছে। সামনে আর কেমিস্ট্রি বই খোলা নেই। তার বদলে রয়েছে সাদা কাগজ। তানিয়াকে জোরে ধাক্কা দেওয়ার একটা জবরদস্ত উপায় পেয়েছে সে। শান্তনু ঠিক করেছে, তানিয়া তাকে যা যা উপহার দিয়েছে, সবকটা সে ফিরিয়ে দেবে। সেই উপহারের একটা তালিকা করার চেষ্টা চালাচ্ছে শান্তনু। এইবার মেয়ে বুঝতে পারবে, যে কাক কেবল কা কা করে না। ঠোকরাতেও জানে। কাজটা ছেলেমানুষের মতো হচ্ছে না তো? একটা ভিখারিকে গোলাপি জামা দিয়ে তানিয়া কী এমন বড় মানুষির কাজ করেছে শুনি? মনে মনে হাসল শান্তনু। প্রতিশোধের হাসি। তবে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে দেখল যে, কাজটা মোটেও সোজা নয়। অনেক আইটেম মনে পড়ছে না। আর মনে পড়বেই বা কী করে? তানিয়ার হাতটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের খোলা। নিষ্ঠুর মেয়েদের কি এরকমই হয়? উপহার দেওয়ার ব্যাপারে মেয়েটা কোনওকালেই কোনও নিয়মকানুন মানেনি দেখা যাচ্ছে। জন্মদিনা-টন্মদিনে দিলেও মনে আছে। গত বর্ষাতে একটা ফোল্ডিং ছাতা সঙ্গে একটা ক্যাসেট। শান্তনু অবাক হয়ে বলল, ‘ছাতার সঙ্গে ক্যাসেট দিলি কেন?’

তানিয়া বলল, ‘হাঁদার মতো কথা বলিস না তো! বৃষ্টিতে বাইরে বেরোলে ছাতা নিবি আর বাড়িতে থাকলে রবীন্দ্রসংগীত শুনবি। দেখছিস না, রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান।’

শান্তনু কাগজে প্রথম লিখল ছাতা। তার নীচে লিখল ক্যাসেট। ক্যাসেটের পাশে জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিল। ছাতাটা আছে, কিন্তু ক্যাসেটটা কি আছে? থাকলে কোথায়? দিদি নিয়েছে না বড়মাসির কাছে আছে? মনে পড়ছে না। এরপর পেন। পেন তো অজস্র দিয়েছে। গুনে শেষ করা যায় না। দরকারও নেই। ড্রয়ারেই আছে। ধরিয়ে দিলেই ল্যাটা চুকে যাবে। সমস্যা একটাই। প্রায় সবকটারই কালি শেষ হয়ে গিয়েছে, নয় ফুরোনোর মুখে। এটাও মন্দ নয়। কালি ফুরোনো পেন ফেরত দিলে ধাক্কাটা আরও জোর হবে। বইগুলো সবই ফেরত দেওয়া যাবে। তবে সেখানেও একটা ঝামেলা রয়েছে। বাড়ির ভয়ে সেগুলো তানিয়া কেটে বন্ধুদের নাম লিখে রেখেছে শান্তনু। যেমন, প্রিয় শান্তনুকে বিশ্বনাথ, প্রাণের শান্তনুকে কৌশিক, শান্তনুকে খুব ভালবাসি দেবাঞ্জন, শুধু তোমাকে ভোম্বল। ছোড়দি একদিন বইগুলো উলটে- পালটে দেখে বলল, ‘তোদের কলেজের ছেলেরা তো ভারী ন্যাকা!’

ছোড়দি না হয় ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে। তা বলে তানিয়া? এই কাণ্ড দেখে সে কী মনে করবে? নিশ্চয় খুব ভিতু ভাববে। ভাবুক গে, যা খুশি ভাববে। যার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে ভাবা নিয়ে কী যায় আসে? কিছুই আসে যায় না।

তারপর আসছে খাবার-দাবার। ক্যান্টিনে চা-কফি, কোল্ড ড্রিঙ্ক, আলুর চপ তো আছেই। সঙ্গে ক্যাডবেরি, আইসক্রিম ও চাইনিজ। সত্যি মেয়েটার পয়সায় কম খাওয়া-দাওয়া করা হয়নি। কী করা যায়? এগুলো তো আর গুনে ফেরত দেওয়া যায় না। ফেরত যখন দেওয়া হচ্ছে তখন সব ফেরত দেওয়াই ভাল। কোনও ফাঁক রাখা চলবে না। আচ্ছা, মোটামুটি একটা হিসেব করে টাকা ধরে দিলে কেমন হয়? না বাবা, এখনই সেটার দরকার নেই। রেগে-মেগে একটা কেলেঙ্কারি করে বসতে পারে। একসঙ্গে এতটা সাহস না দেখালেও চলবে। এগুলো আপাতত তোলাই থাক। তালিকার একদম শেষে শান্তনু বড় বড় করে লিখল, বত্রিশটা চিঠি এবং সাতটি ফোটো। লিখে তলায় লাল কালির দাগ দিল। চিঠি আর ফোটো ফেরত হবে আর সেটা তানিয়ার কাছে রাম ধাক্কা, তাই লাল কালির দাগ। ব্যাগটা মনে হচ্ছে বেশ ভারী হবে। তবে তালিকা তৈরি করে মনটা বেশ হালকা হয়ে গিয়েছে। আজ দুপুরে তানিয়া কোথায় বেরোবে বলছিল যেন? তার আগেই ভারী ব্যাগ আর হালকা মন নিয়ে ওর বাড়িতে হাজির হতে হবে। বেল টিপতে তানিয়ার মা বেরিয়ে আসবেন। হেসে বলবেন, ‘আরে শান্তনু। ভিতরে এসো, কতদিন আসোনি। কী খাবে, শরবত না চা?’ শান্তনু তখন খুব ভদ্রভাবে বলবে, ‘না মাসিমা, আজ আর ভিতরে যাব না। হাতে একদম সময় নেই। আপনি বরং তানিয়াকে একটু ডেকে দিন। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।’ তারপর তানিয়া এলে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে কি একটু হাসবে? হাসাই উচিত। এইসময় তার হাসি, তানিয়ার গায়ে জ্বালা ধরানোর কাজ করবে!

মানুষ যেমন ভাবে, সবটা তেমন হয় না। কিছুটা হয়, কিছুটা উলটো হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অনেকটাই উলটো হয়ে গেল। শান্তনু ডোরবেল বাজাতে তানিয়ার মা দরজা খুললেন ঠিকই, কিন্তু ভিতরে আসতে বললেন না। ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘দুপুরে এতবার বেল দিচ্ছ কেন? দাঁড়াও তানিয়াকে খবর দিচ্ছি, ও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

প্রথম চোটেই শান্তনু চমকে গেল। তানিয়া ওর জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক শুনছে তো? তানিয়া ওর জন্য অপেক্ষা করতে যাবে কেন? সে তো বলে আসেনি। হইহই করতে করতে বেরিয়ে এল তানিয়া। সেজেগুজে একেবারে রেডি। হেসে বলল, ‘দেরি করলি কেন? সকালে বললাম না, দুপুরে বেরোব?’

শান্তনু ভেবে এসেছিল, হেসে সে তানিয়ার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবে! কিন্তু তানিয়ার হাসির চোটে শান্তনুর গায়ে জ্বালা ধরে গেল। বেরোব বললেই তাকে ছুটে বেরোতে হবে নাকি? সেদিন আর নেই। কাল পর্যন্ত ছিল, আজ থেকে নেই। হাতের ব্যাগটা আড়াল করতে করতে বলল, ‘তানিয়া তোর সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে।’

তানিয়া চোখ পাকিয়ে বলল, ‘রাখ তোর কথা। ওসব কথা-টথা পরে হবে। আগে ছুটে গিয়ে ওই ট্যাক্সিটাকে ধর। ইস, দেরি হয়ে গেল। যা যা!’ তানিয়ার তাড়ার চোটে সত্যি ছুটে গেল শান্তনু। হাতের ভারী ব্যাগ নিয়ে ছুটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল তার।

সত্যি তানিয়ার অনেক কাজ ছিল। সারাদুপুর টো-টো করে ঘুরল। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বই বদলাল। মোবাইলে কার্ড ভরল। শ্রেয়া নামে এর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নোট নিল। সালোয়ার কামিজের সঙ্গে ম্যাচিং একজোড়া দুল কিনল ফুটপাথ থেকে। ঘড়ির ব্যান্ড বদলাল। কলেজ স্ট্রিটে এসে ভাইয়ের ইতিহাসের বই কিনল। তারপর কফি হাউজে ঢুকে একগাল হেসে বলল, ‘নে, এবার কোল্ড কফি বল।’

কোল্ড কফি অর্ডার দিয়ে শান্তনু বুঝল, গোলমাল হয়ে গিয়েছে। যে মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, তার সঙ্গে এতটা সময় কাটানো উচিত হয়নি। মনে হচ্ছে, তানিয়ার বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনাটা ভুল হল। আসলে তানিয়াই ঠিক বলে। ও একটা হাঁদা! তানিয়ার সামনে আরও বেশি হাঁদা হয়ে যায়। এই মেয়ের তাড়া আর ধমকানি তুচ্ছ করে ব্যাগটা ধরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এখন দেব? এই কফি হাউজের মাঝখানে তানিয়ার চিঠি, পেন, বই ছাতা সব বের করে বসে? সে আর-এক বিপদ হবে। তার চেয়ে বরং একেবারে যাওয়ার সময় হাতে ব্যাগটা দিয়ে বলতে হবে, ‘টা টা।’ বাড়ি ফিরে গিয়ে এ কাঁদুক-হাসুক, যা খুশি করুক। কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।

শান্তনু কফির সঙ্গে দুটো প্রন কাটলেট ও বলল। তার যে খুব খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল তা নয়। তবে বড় ধাক্কা খাওয়ার আগে পেট ভরে থাকাই ভাল।

তারিয়ে তারিয়ে কাটলো খেতে খেতে তানিয়া বলল, ‘বুঝলি শান্তনু, আজ একটা জিনিস দেখতে পাব।’

‘কী জিনিস?’

‘উহুঁ, এখন বলব না। আগে নিজে দেখি, তারপর বলব,’ কথা শেষ করে তানিয়া মিটিমিটি হাসল।

শান্তনুও হাসল। তবে মনে মনে। আজ তোমাকে আমি একটা জিনিস দেখাব বাছাধন। একেবারে জিনিসের মতো জিনিস। ব্যাগ ভরতি জিনিস। শান্তনু টেবিলের তলায় ব্যাগটা একটু সরিয়ে রাখল। ছাতা উঁচু হয়ে খোঁচা মারছে।

মেট্রো স্টেশনের সামনে এসে পৌঁছোতে আজ একটু দেরিই হয়ে গেল। বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে। নরম একটা আলো আকাশ থেকে পিছলে পিছলে পড়ছে। একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এ আলোর রং গোলাপি। হালকা গোলাপি।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল তানিয়া। শান্তনুর হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘দেখ, কী সুন্দর লাগছে!’

শান্তনু মন কঠিন করল। তানিয়া যতই হাত ধরুক, এই কঠিন মন নরম হবে না। আজ সারা দিনটা তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতটা সময় একসঙ্গে ঘুরল, কই একবারও তো বলল না, কালকের কাজটা ভুল হয়েছে। আর সুযোগ নয়।

উফ! তানিয়া কনুইয়ের কাছে একটা চিমটি কেটেছে। গলা আরও নামিয়ে বলল, ‘দেখ না? ওই তো, ওই যে!’

আবার চিমটির ভয়ে শান্তনু বিরক্তি নিয়ে মুখ তুলে তাকাল। তুলেই চমকে উঠল।

মেট্রো স্টেশনের সিঁড়িতে আজও বসে আছে সেই ভবঘুরে লোকটা। বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিন্ত মনে পা নাড়াচ্ছে। সেই এলোমেলো চুল। হালকা দাড়ি। তবে আজ লোকটার গায়ে একটা নতুন জামা। সেই জামার রং গোলাপি। লোকটা একটু পরে পরেই জামাটা টেনেটুনে ধুলো ঝেড়েঝড়ে নিচ্ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, একটা গোলাপি আলোর মধ্যে একটা গোলাপি মানুষ পরম আনন্দে বসে আছে।

শান্তনু বিড়বিড় করে বলল, ‘খুব সুন্দর, না রে!’

‘অ্যাই হাঁদা, এমন হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার ট্রেনের টাইম হয়ে গেল। যা বলবার তাড়াতাড়ি বল। ঠিক এক মিনিট টাইম দেব। ওনলি ওয়ান মিনিট।’

তানিয়ার কথায় ঘোর কাটুল শান্তনুর। লজ্জা-লজ্জা মুখ করে সে বলল, ‘না, কিছু বলব না। তুই যা। কাল দেখা হবে।’

রাতে হাতে বেশ ব্যথা হল শান্তনুর। হবেই তো। অত ভারী একটা ব্যাগ নিয়ে যাওয়া, আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা তো চাট্টিখানি কথা নয়!

উনিশ কুড়ি, শরৎ ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *