জলছাপ

জলছাপ

সমস্যাটা শুরু হল খুব আবছাভাবে।

দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে তালা খুলে ঘরে ঢুকছিল সুগত। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে ক্লাস সেভেনের এক বাড়িল হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার খাতা। সব সামলে ঘরের ভেতর পা রাখতেই থমকে দাঁড়াল সুগত। কেমন একটা অস্বস্তি হল। মনে হল, ঘরে কিছু একটা হয়েছে। বড় কিছু নয়, ছোটখাটো কিছু। কিন্তু হয়েছে।

বৈশাখের গনগনে দুপুরেও ছোট এই ঘরটা ঠান্ডা। ছায়া ছায়া অন্ধকার। বাইরে থেকে হঠাৎ ঢুকলে আরাম হয়। চোখ সইতে খানিকটা সময় নিল সুগত। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। পুব-দক্ষিণ দুটো জানলাই বন্ধ। বারান্দার দিকের দরজাটিতে ছিটকিনি তোলা। খাটের ওপর অগোছালো পড়ে আছে বালিশ, চাদর। মশারির একটা খুঁট এখনও দেয়ালের পেরোকে বাঁধা। বাকিটুকু গা এলিয়ে পড়ে আছে বিছানার ওপর। বাথরুমের সামনে ছাড়া লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি ছড়ানো। ঘরে পরবার চটি ছিটকে আছে মাঝপথে। একটা পাটি কাত হয়ে রয়েছে আলসে ভঙ্গিতে। সুগত টেবিলের দিকে ফিরল। না, সেখানেও কোনও গোলমাল নেই। বইপত্র ছড়ানো, স্কুলের খাতা উঁই করা। চেয়ারের হাতলে গামছা ঝুলছে। একটা সময় ছিল যখন চেয়ারে গামছা, তোয়ালে দেখলে বিরক্ত হত সুগত। এখন আর হয় না।

না, ঘরের সবকিছু একইভাবে রয়েছে। বেরোবার আগে ঠিক যেমন রেখে গিয়েছিল। একচুলও এদিক-ওদিকও হয়নি কিছু। তা হলে কী হল?

সুগত মনে মনে নিজেকে ঝাঁকানি দিল। নিশ্চয় মনের ভুল। এতটা পথ কড়া রোদে হেঁটে আসার পর হঠাৎ প্রায় অন্ধকার ঘরে ঢুকে ভুল মনে হচ্ছে। হতেই পারে। আশ্চর্যের কিছু নয়। আলোর ফারাক শুধু যে দৃষ্টিতে বিভ্রম ঘটায় এমন নয়, মুহুর্তের জন্য মনকে ভুল বোঝাতে পারে। এখনও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। কিছু হয়নি, তবু মনে হয়েছে কিছু একটা হয়েছে।

সুগত ছাতাটাকে দাঁড় করিয়ে রাখল দরজার পাশে। কলকাতায় ফোল্ডিং ছাতায় কাজ চলে যায়। এখানে চলে না। এখানে রোদ জল বেশি। ঢাউস ছাতা সঙ্গে না রাখলে বিপদ। আড়াই বছর আগে যখন স্কুলে চাকরি পেয়ে এখানে প্রথম আসে সুগত, তখন ফোল্ডিং ছাতাই এনেছিল। সবাই হেসে বলল, ‘দূর, এসব শহুরে ফ্যাশন গাঁয়ে চলে না। গ্রামের বৃষ্টিতে যেমন ঝাপটা, রোদে তেমন তাত। ও জিনিসে কোনও কাজ হবে না বাপ। জায়গাটা যদিও পুরো গ্রাম নয়। হাতে গোনা কয়েকটা পাকা বাড়ি আছে তো বটেই, স্টেশন, বাজার একটা সিনেমা হলও আছে। তবে মাঠ, পুকুর, গাছপালা, কাঁচা রাস্তা, ধানখেতটাই বেশি। পরের মাসেই সুগত বেতের হাতলওলা এই বুড়োটে ছাতা কিনে নিল।

কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে ফেলে সুগত খাতার বান্ডিলটা নামিয়ে রাখল নীচে। সুইচ টিপে ফ্যান চালিয়ে ঘামে ভেজা জামাটা খুলতে খুলতে চেয়ারে বসল পা ছড়িয়ে। ফ্যানে জোর নেই, এখানে ভোল্টেজের অবস্থা শোচনীয়। ফ্যান ঘোরে, কিন্তু হাওয়া দেয় না। বেশিরভাগ দিনই সন্ধের পর আলো জ্বেলে লেখাপড়ার উপায় নেই। ঝড় জল হলে তো সেটুকুও গেল। গাছ পড়ে, কাঠের পোস্ট উলটে অবস্থা ভয়াবহ। কারেন্ট থাকে না। ফিরতে সাতদিনও হয়ে যায়।

ঝিনুক বলেছিল, ‘একটা ফ্রিজ নিলে হত না?’

সুগত অবাক হয়ে বলেছিল, ‘ফ্রিজ!’

‘হ্যাঁ, বাপের বাড়িতে ছোট ফ্রিজটা তো পড়েই আছে। পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। আনলে আর কিছু না হোক মাঝেমধ্যে ঠান্ডা জল খাওয়া যেত।’

সুগত হেসে বলল, ‘খেপেছ ঝিনুক? এখানে ফ্রিজ চালাবে কী দিয়ে? কারেন্ট কোথায়? দেখছু তো আলোই জ্বলতে চায় না। কেরোসিনে যদি চালাতে পারো তো বলো নিয়ে আসি।’

‘ঠিক আছে, ফ্রিজ না হোক, টিভি তো আসবে? সারাদিন ঘরে বসে করবটা কী?’

‘কেন, আমার সঙ্গে গল্প করবে।’ সুগত মজা করতে যায়।

ঝিনুক মজা বুঝতে পারে না। বলে, ‘তুমি বুঝি সারাদিন ঘরে থাকে যে তোমার সঙ্গে গল্প করব?’

সুগত বলে, ‘কতটুকু সময় আর বাইরে থাকি? স্কুলের পরেই তো সোজা বাড়ি। এই গণ্ডগ্রামে ইচ্ছে করলেও যাওয়ার জায়গাটা কোথায়? দুটো কথা বলার লোক নেই। সেই কারণেই তো তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করে ফেললাম। আর কেউ না হোক বউয়ের সঙ্গে তো গল্ল করা যাবে।’

কথা শেষ করে হাসল সুগত। ঝিনুক হাসল না। বলল, ‘তা হোক, একটা টিভি এনে দাও। দুপুরটুকু তো সময় কাটবে।’

‘টিভি কি চলবে? স্কুলের মাস্টাররা বলে টিভি এখানে চলে না ঠিকমতো। দু’-একজনের বাড়িতে আছে বটে কিন্তু দেখা যায় না। ফুলদানির মতো সাজিয়ে রাখতে হয়। এখানে রেডিয়োর এক হাল। চালালেই ঘস ঘস করে। সিগন্যাল পায় না।’

‘ঠিকমতো চলার দরকার নেই। যেটক চলবে তাতেই হবে। সারাদিন একা থাকতে বিরক্ত লাগে।’

‘একা থাকো কেন? মাঝেমধ্যে দোতলায় যেতে তো পারো। বাড়িওলার স্ত্রীর সঙ্গে দুটো কথা বলে এলে। ওকেও ডাকতে পারো নীচে। মহিলা খারাপ নয়।’

ঝিনুক মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘ওসব আমার ভাল লাগে না।’

‘কীসব? ওই মহিলাকে?’

‘না। এখানে কাউকেই ভাল লাগে না।’

সুগত স্ত্রীর দিকে তাকায়। রোগা হলেও টলটলে মুখের এই মেয়ে যথেষ্ট সুন্দরী। রং খুব ফরসা না হলেও একটা উজ্জ্বল ভাব আছে। টিকালো নাক, টানা টানা ভুরুতে আরও ভাল দেখায়। তার ওপর মেয়ে শান্ত আর চুপচাপ বিয়ের আগেই জেনেছিল সুগত। কলকাতা থেকে বড়মাসি ফটো পাঠিয়ে বলেছিল, ‘তুই নিজে এসে একবার মেয়ে দেখে যা সুগত। দেখতে শুধু সুন্দর নয়, মেয়ে ভারী শান্তশিষ্ট। আজকালকার মেয়েদের মতো হুটোপাটি করা মেয়ে নয়। মনে হল, কথাও কম বলে। তোর মতো শান্ত ছেলের জন্য এরকম মেয়েই ভাল। মন দিয়ে ঘর সংসার করবে।’

বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই সুগত বুঝেছিল, ঝিনুক একটু বেশিরকমের চুপচাপ। এতটা চুপচাপ আবার ভাল নয়।

সুগত নরম গলায় বলল, ‘এমন করলে চলবে কী করে ঝিনুক? এখানে যখন থাকবে সবার সঙ্গে মিলেমিশেই তো থাকতে হবে।’

ঝিনুক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি নিজের মতো বেশ থাকি। টিভি কি তুমি আনবে? নাকি বাবাকে পাঠিয়ে দিতে বলব?’

ছোট একটা টিভি সেট কলকাতা থেকে কিনে এনেছিল সুগত। খাটের পায়ের কাছে উঁচু টুল পেতে রাখাও হল। কিন্তু ওই রাখাই পর্যন্ত। একেই তো কেব্‌ল লাইন নেই। দুরদর্শনের যেটুকু দেখা যায়, তাও হয় কাঁপে, নয় ঝিরঝির করে। বেশিক্ষণ তাকালে মাথা ধরে যায়। টুলের ওপর এখনও সেই টিভি রয়েছে। সুগত ঠিক করেছে, এবার কলকাতায় গেলে জিনিসটা রেখে আসবে।

গত ছ’মাস ধরে প্রতিদিনই স্কুল যাওয়ার আগে দরজা-জানলা বন্ধ করে বেরোয় সুগত। বড় কিছু না হলেও ছিঁচকে চুরির ভয় আছে এখানে। তার ওপর একতলা। জানলা-দরজা খোলা পেলে শিক ঢুকিয়ে কাপড় জামা তুলে নিতে পারে। স্কুলের মাস্টাররা প্রথমেই সাবধান করে রেখেছিল, ‘ওই কম্মটিও কোরো না। বিরাট চোরের জায়গা।’ বিরাট চোরের জায়গা না হলেও সুগত সাবধানই হয়েছিল। বারান্দায়ও কিছু ফেলে রাখে না। গ্রিল-টিলের বালাই নেই। বাড়িতে কেউ থাকলে ঠিক আছে। না থাকলে বিপদ। ঝিনুক আসার পর সুগত ঠিক করেছিল, বাড়িওলার সঙ্গে কথা বলে বারান্দায় গ্রিল আর সদরে কোলাপসেবলের ব্যবস্থা করবে। করছি করব বলে আর হয়ে ওঠেনি।

বারান্দার দরজা খুলে গামছা রাখতে গেল সুগত। বাইরে গরম হলকা। সত্যি এখানে শীত, বর্ষা, গরম সবই বেশি। লেবু চিনি দিয়ে এক গ্লাস শরবত খাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল সুগতর। লেবু কি ঘরে আছে? রান্নাঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না। কালির মা থাকলে হত। শরবত করে দিতে পারত। কিছুদিন আগে কালির মাকে প্রস্তাব দিয়েছিল, দুপুরটুকু সে যদি থেকে যায়। এতটা সময় বাড়িটা ফাঁকা থাকে। বাড়িওলা স্ত্রীকে নিয়ে গেছেন ইন্দোর। ছেলের কাছে। নাতি হয়েছে। কয়েক মাসের আগে ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই। গোটা বাড়িটাই খাঁ খাঁ করে। সুগত কালির মাকে বলেছিল ‘অতটা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরবে কেন কালির মা? তার থেকে বরং খেয়েটেয়ে এখানেই বিশ্রাম নিয়ো। বিকেলে একেবারে রান্না-টান্না সেরে যেও’খন। ততক্ষণে আমিও চলে আসব স্কুল থেকে।’

বুড়ি রাজি হয়নি। ‘বউদি’র ঘটনার পর এ বাড়িতে তার একা থাকা নাকি অসম্ভব।

‘কেন?’ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে সুগত।

কালির মা উত্তর দেয়নি। মাথার ঘোমটা টেনে ঘর ঝাঁট দিতে শুরু করে। সুগত আবার বলে, ‘আগে তো ছিলে। তখনও তো ঝিনুক আসেনি। আমার বিয়ের আগে। ছিলে না?’

বুড়ি বলে, ‘সে ছিলাম ছিলাম। এখন পারব না।’

সুগত নিচু গলায় বলে, ‘ঘটনা তো এখানে হয়নি, যা হওয়ার হয়েছে কলকাতায়।’

কালির মা বলে, ‘ওই একই হল। মেয়েটা তো এখানেও ছিল।’

সুগত বিষণ্ণ হেসে বলে, ‘এখন তো আর নেই।’

কালির মা বিড়বিড় করে বলে, ‘অমন চট করে কি কেউ যায় গো?’

সুগত বুঝতে না পেরে বলে, ‘মানে!’

বুড়ি উত্তর দেয় না কোনও। সুগতও আর কথা বাড়ায়নি। আড়াই বছর আগে সে যখন চাকরি পেয়ে এখানে এসে ঘর নিল, বাড়িওয়ালার স্ত্রী বলেছিল, ‘কালির মাকে রেখে দাও। কাচাকুচি তো পারেই, রান্নাবান্নার হাতও খারাপ নয়, ভাল। তুমি ব্যাচেলর মানুষ। একটা লোক তো লাগবে। সবথেকে বড় কথা হল মানুষটা বিশ্বাসী।’ কালির মাকে রেখে দিল সুগত। বাড়িওয়ালার স্ত্রী সবটা ঠিক বলেনি। কালির মায়ের রান্নাবান্নার হাত খুব খারাপ। কিন্তু মানুষটা সত্যি বিশ্বাসী। বুড়ি কামাইয়ের স্বভাব নেই। ঝিনুক আসার পর সুগত ভেবেছিল, ঘর সংসারের সব দায়িত্ব সে নিজের হাতে তুলে নেবে। জলতোলা, কাচাকাচি, ঝাড়পোঁছের মতো বড় খাটাখাটনি না করুক, রান্নাবান্না অন্তত দেখবে। প্রথম ক’টা দিন শুরু করলেও সেই উৎসাহ খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায় ঝিনুকের। কী রান্না হবে শুধু সেটুকু বলেই থেমে যেত। কোনও কোনও দিন তাও বলত না। কালির মা জানতে চাইলে বলত, ‘দেখো না, দাদাবাবু কী বাজার করেছে।’ এমনকী চা করতেও তার ছিল অনীহা। সুগতর চায়ের নেশা বেশি বলে বড় একটা ফ্লাস্কের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। কালির মা ভরে রেখে যেত। একেকদিন খেতে বসে সুগত বলত, ‘রান্নাটা তো তুমি করতে পারো ঝিনুক। রোজ রোজ কালির মায়ের রান্না কি মুখে তোলা যায়?’

ঝিনুক ভাত নাড়তে নাড়তে বলত, ‘কেন? আমি তো বেশ পারি।’

সুগত গম্ভীর হয়ে বলত, ‘ও।’

পরের দু’দিন রান্নাঘরে ঢুকত ঝিনুক। ব্যস ওই দু’দিনই। আবার যে কে সেই। ঝিনুক শুয়ে বসে, বই পড়ে, ঝিরঝিরে টিভি আর খসখসে রেডিয়ো নিয়ে সময় কাটাত।

মাসখানেক পরে বড়মাসিকে ফোন করেছিল সুগত। সম্বন্ধ তিনিই দেখেছিলেন। ভালমন্দ তাঁকেই আগে জানানো উচিত। বড়মাসি বললেন, ‘ও কিছু নয়। বড়লোকের আদুরে মেয়ে, নিজের বাড়ি ছেড়ে গেছে। বয়সও কম। দেখবি ঠিক মন বসে যাবে।’

বউয়ের ‘মন বসা’র জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সুগত। একমাস, দু’মাস, তিনমাস। লাভ হল না। ঝিনুকের মন বসল না।

আজ স্কুল ছুটি হয়ে গেছে বেলা দুটোর কিছু পরে, চার পিরিয়ড হয়ে। পাড়াগাঁয়ের স্কুলে মাঝপথে ছুটি কোনও ঘটনা নয়। যে-কোনও ছুতোনাতা একটা পেলেই হল। ঘোর বর্ষা, হাড়কাঁপানো শীত, ঠা ঠা পোড়া গরম তো আছেই, এর সঙ্গে রয়েছে মাস্টারমশাইদের কামাই, কমিটির বৈঠক, স্কুল মাঠে পলিটিক্যাল পার্টির সভা। শ্রীজ্ঞানদানন্দ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আরও এক কাঠি ওপরে। প্রধান শিক্ষক মঙ্গলাচরণ মিত্র নিজেই ‘ছুতোনাতা’ খুঁজে বের করেন। কিছুদিন হল মনীষীদের জন্মমৃত্যুর দিনেও তিনি ছুটির ব্যবস্থা চালু করেছেন। মনীষী বুঝে ছুটি। খুব চেনা হলে হাফ, কম চেনা হলে কোয়ার্টার।

আজ যেমন হাফ ছুটি হয়েছে। তবে মনীষীদের জন্য নয়, ছুটি হয়েছে জলের অভাবে। স্কুলের একমাত্র টিউবওয়েল গড়বড় করছে। ছাত্রদের অভিযোগ পেয়ে হেডমাস্টার নিজে তদন্ত করতে যান। তদন্তে দেখা যায় ঘটনা সত্যি। টিউবওয়েলের হাতলে সমস্যা। এরপর ইচ্ছে থাকলেও স্কুল চালু রাখা সম্ভব নয়।

জলের কথা মনে পড়তে শরবতের ইচ্ছেটা আরও তীব্র হল সুগতর। ক্লান্তভাবে অগোছালো ঘরের দিকে তাকাল সুগত। কালির মা তিনদিন ধরে কামাই করছে। তার নাতি খবর দিয়ে গেছে, দিদিমার জ্বর। জ্বর বেশি নয়, তবে শরীর দুর্বল। প্রথমদিন নিজেই স্টোভ জ্বেলে ভাতে ভাত করে নিল সুগত। এখানে এসে চালিয়ে নেবার মতো রান্নার অভ্যেস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরে স্টেশনের কাছে হোটেলে গিয়ে খাওয়ার ঝামেলা সারত। কালির মা আসায় ব্যবস্থা পালটায়। বিয়ের পর তো কথাই নেই। তবে এই ক’দিন আবার হোটেলে খাচ্ছে। হোটেলের মালিক লোক ভাল। একটু বেশি কথা বলে এই যা। একসময় নাকি জ্ঞানদানন্দ স্কুলের ছাত্র ছিল। সত্যি মিথ্যে কে জানে। মাস্টারমশাইয়ের জন্য কম তেল মশলা দিয়ে মাছের ঝোল রেঁধে দেয়। খাওয়ার সময় টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রোজই একসুরে বলে, ‘আহা, বউদি মানুষটা বড় ভাল ছিল গো। আমার হোটেলে কোনওদিন আসেনি ঠিকই, কিন্তু লোকের মুখে কত প্রশংসাই শুনেছিলুম। বড় শান্তশিষ্ট, লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে ছিল… মসটারমশাই আর একটু ভাত দিতে বলি? আর একটা মাছ নিন না। গাদার দিকের একপিস?’

সুগত কোনও কথা বলে না। শুধু মাথা নেড়ে ‘না’ বলে।

গত দু’দিন ঘরদোরের দিকে নজর দেয়নি সুগত। এমনকী মশারির সবকটা খুঁট পর্যন্ত পেরেক থেকে খোলে না। সন্ধের পর টেবিলে বসেই স্কুলের কাজ-টাজ সারে। মাঝখানে একবার ঘরে তালা দিয়ে একটু হেঁটে আসে। তখনই হোটেল থেকে তিনটে রুটি আর ভাঁড়ে করে খানিকটা তরকারি নিয়ে ফেরে। পরশু ডিম ভেজে নিয়েছিল। রাতের খাওয়া সেরে কোনওদিনও শুয়ে পড়ে, কোনওদিনও বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকে খানিকক্ষণ। বারান্দাটা একফালি হলেও সামনেটা অনেকখানি খোলা। মাঠ চলে গেছে রাস্তা পর্যন্ত। গাছপালাও প্রচুর। ফলে ধুলোবালির দাপটও কম নয়। কাল স্কুল থেকে ফিরে ঘর ঝাঁট দিয়েছিল সুগত। তাতে কাজ হয়নি। ধুলো যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে।

শুধু রান্নাবান্না নয়, অন্য কাজেও ঝিনুকের উৎসাহ ছিল না। হয় বিছানায় চিত হয়ে গল্প উপন্যাসের পাতা ওলটাত, নয়তো বারান্দায় বেতের চেয়ারটায় বসে থাকত সারা বিকেল। তবে সাজগোজে আলিস্যি ছিল না। গরমে তিনবার পর্যন্ত গা ধুত। ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে অনেকটা সময় নিয়ে ক্রিম ঘষত গালে, হাতে, পায়ে। কাজের মধ্যে খুব বেশি হলে কোনওদিন হয়তো আলনাটা গোছাল একটু, বালিশের ওয়াড় বদলাল দুটো। কখনও সুগতর টেবিলের বই খাতাগুলো নেড়েচেড়ে রেখে দিত একইভাবে। যেন গুছোচ্ছে না, যেন সময় কাটাচ্ছে অলসভাবে। বড়মাসির মতোই সুগত ভেবেছিল, মন খারাপ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারল, না, মন খারাপ নয়। ঝিনুক আসলে এই ঘরসংসার নিজের বলে মেনে নিতে পারছে না। একসময় সুগত অল্প অল্প বলতে শুরু করল। সরাসরি নয়, বলতে শুরু করল ঘুরিয়ে।

‘মেঝেতে ধুলো কিচকিচ করছে।’ অথবা, ‘ইস দেয়ালে কত ঝুল।’ বা ‘রান্নাঘরটা তো নরক হয়ে রয়েছে।’

ঝিনুক শুনেও শুনত না। অন্যমনস্কভাবে হাই তুলত। আড়মোড়া ভাঙত। বড় বড় সুন্দর চোখদুটোকে নিষ্প্রাণ করে বলত, ‘কালির মাকে কালকে বলে দেব।’ বিরক্ত হতে লাগল সুগত। এমনটা নয়, ঝিনুক এখানে না জেনেশুনে এসেছে। সম্বন্ধ হওয়ার সময়েই জানত, ছেলে গাঁয়ের স্কুলে মাস্টারি করে। বিয়ের পর তাকে সেখানে গিয়েই থাকতে হবে। সেখানে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটও নেই, রাজপ্রাসাদও নেই। তবে মাটির ঘরে তো আর উঠতে হয়নি। এখানে যতটা ভাল পাওয়া সম্ভব তার মধ্যেই ব্যবস্থা হয়েছে। ঘর মাত্র একটা হলে কী হবে, অ্যাটাচড বাথরুম। ঘরের পাশেই রান্নার ব্যবস্থা। বিয়ের পরপর বাড়ি বদলানোর সিদ্ধান্তর কথা ভেবেছিল সুগত। দুই বা দেড় কামরার যদি কিছু পাওয়া যায়। খোঁজখবর করতে পাওয়া গেল দু’-একটা। কিন্তু কোনওটাই সুবিধের হল না। ঘর বেশি তো বাথরুম অনেকটা দুর। উঠোন পেরিয়ে যেতে হয়। ঝিনুক রাজি হল না। সুতরাং একঘরে থাকার জন্য সুগত দায়ী এমন নয়। পরিস্থিতিই বাধ্য করেছে।

সুগত আবার তার বড়মাসিকে বলল, ‘সংসার নিয়ে এত নির্লিপ্ত, এত উদাসীন হলে চলবে কেন?’

বড়মাসি ঢোঁক গিলে অপরাধীর গলায় বললেন, ‘বোঝানোর চেষ্টা কর। ভাল করে বুঝিয়ে বললে, নিশ্চয় শুনবে।’

চেষ্টা করল সুগত। রাতে কাছে টেনে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো ঝিনুক? শরীর-টরির খারাপ হয়নি তো?’

ঝিনুক সুগতর দিকে সরে এসে বলে, ‘কই, না তো!’

‘তা হলে? তা হলে তোমার সমস্যাটা কী? শান্তভাবে ঝিনুকের বাহারি রাত পোশাক খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে সুগত। নিজের উন্মুক্ত বুকদুটো স্বামীর শরীরে লুকোতে লুকোতে ঝিনুক বলে, ‘কীসের সমস্যা?’

সুগত বউয়ের গলায় ঠোঁট রেখে আদর করে। নাকে ক্রিম পাউডারের তীব্র গন্ধ আসে। পিঠে দু’হাত রেখে চাপ দেয়। বলে, ‘এই যে তুমি সারাদিন শুয়ে বসে থাকো, মুখ ফিরিয়ে থাকো সংসার থেকে…। ভাল লাগে না? আমার ঘরদোর, আমাকে ভাল লাগে না তোমার?’

নগ্ন শরীরে লজ্জা পায় ঝিনুক। অন্ধকারেও চোখ বোজে। ফিসফিস করে, ‘এই তো লাগছে।’

বউয়ের ঠোঁটে, চিবুকে হাত বোলাতে বোলাতে সুগত বলে, ‘আমি জানি এখানে তোমার ভাল লাগার মতো কিছুই নেই ঝিনুক। কলকাতার মতো বন্ধুবান্ধব, হইচই কিছুই নেই। তবু মানিয়ে তো নিতে হবে,’ কথা শেষ করে ঝিনুকের গায়ে হাত রাখে সুগত। হাত সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে ঝিনুক। ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, চেষ্টা করব।’

সুগত খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বউকে।

কিন্তু ওই রাতের কথাটুকুতেই সব শেষ। ঝিনুক মানানোর কোনও চেষ্টাই করে না। দিনকয়েক পরে সুগত গলা চড়ায়। মেজাজ দেখায়। তবে ঝিনুককে নয়, রাগ দেখায় কালির মাকে। ঘরে ধুলো ময়লা দেখলে ঝিনুককে শুনিয়ে বকাবকি করে। বাসি জামাকাপড় অগোছালো দেখলে ধমক দেয়।

ঝিনুকের কিছু এসে যেত না। সে উঠে বাথরুমে যেত। দরজা আটকে দীর্ঘ সময় ধরে স্নান করত। বেরিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসত পাউডারের কৌটো নিয়ে। তখন সুগত স্কুলে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছে। তার দেরি হয়ে গেছে।

এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে রান্নাঘরে গিয়ে সুগত দেখল, খাবার জল নেই। আগে কুঁজো ছিল। বিয়ের পর বড় মাটির জালা কেনা হয়েছে। জল ঠান্ডা থাকে। সকালেই জালা ভরতি করে রাখতে হয় এখানে। নইলে টানাটানি হয়। জালা ফাঁকা দেখে চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলেছিল সুগত। ঘরে ফিরে দেখেছিল, ঝিনুক গায়ের কাপড় আলগা করে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সুগত অনুভব করল, শিকড় গড়তে পারছে না ঝিনুক। চাইছেও না। সংসারে নিজেকে ভাসিয়ে রেখেছে পাতার মতো। সুগত দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। মনে মনে বুঝেছিল, বাকি জীবনটা এভাবেই চলতে হবে তাকে। চিলতে হবে ঘরসংসারে উদাসীন এক স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে।

এর দু’মাসের মধ্যে ঝিনুক সন্তানের জন্ম দিতে কলকাতায় চলে যায়। সুগত মৃদু আপত্তি করেছিল।

‘আর কটাদিন থেকে যেতে পারতে। এখনও তো অনেকটা দেরি আছে।’

‘না, বাবা-মা রাগারাগি করছে।’ ঝিনুক চাপা অথচ জোর গলাতেই বলে। এর অর্থ তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে।

‘রাগারাগি। কেন রাগারাগি করছ কেন?’

‘বলছে, এখানে ভাল ডাক্তার নেই। এই সময়টা নিয়মিত চেকআপের দরকার। ব্লাড কাউন্ট রাখতে হবে, প্রেশার, সুগার সব মাপতে হবে। তা ছাড়া এখানে খাওয়াদাওয়ার সমস্যা।’

সুগত ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কেন বাজার-টাজার তো রোজই করছি। এদিকে শাকসবজি, ফলমূল সবই টাটকা। মাছও একেবারে পুকুরের। টেস্টই আলাদা। আমার তো কলকাতার মাছ মুখে রোচে না আজকাল।’

ঝিনুক খাটের তলা থেকে সুটকেস টানতে টানতে বলল, ‘টাটকাটা বড় কথা নয়। এই সময় সব মেয়ের বাবা-মা-ই মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চায়। একটু যত্ন আত্তি করতে চায়?’

‘তুমি যা ভাল বোঝে।’

‘বাচ্চা হওয়ার পরও কিন্তু আমি কলকাতায় থাকব বেশ কিছুদিন। অতটুকু বাচ্চাকে নিয়ে এখানে এসে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সে ঝুঁকি নিতে পারব না।’

সুগত চুপ করে গিয়েছিল। ভাল ডাক্তার নেই কথাটা সত্যি। ঝিনুক অ্যানিমিক। সত্যি নিয়মিত চিকিৎসকের নজরদারিতে থাকা দরকার তার। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার সমস্যা কথাটার মধ্যে ঠেস আছে। অথবা কে জানে, চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে দ্রুত পালাতে চাইছে। পুরো একটা দিন ভাবে সুগত। ভেবে দেখে, সত্যিই তো, এখানে যত্ন কোথায়? মাঝেমধ্যে স্বামীর ভালমন্দ বাজার করে আনার মধ্যে আদর সোহাগ থাকতে পারে যত্ন থাকে না। যে মেয়ের সংসারে মন বসেনি, স্বামীর আদর সোহাগে তার কী এসে যায়? সুগত পরের শনিবার বউকে নিয়ে কলকাতায় রওনা দেয়।

ঝিনুককে কলকাতায় রেখে এসে আবার ব্যাচেলর জীবন শুরু হল। গোড়ার দিকের সেই অগোছালো জীবন। বিছানা না তুললেও চলে, ঘরে ধুলোবালিতে অসুবিধে নেই। দু’দিন যেতে না যেতে মনে হল, এই ভাল। ঝাড়া হাত পা।

তখনও সুগত জানত না, সেটাই ছিল ঝিনুকের এখান থেকে শেষ যাওয়া। কলকাতার ডাক্তারদের কাছে নিয়মিত চেকআপ, বাবা-মা’র অঢেল যত্ন পাওয়া সত্ত্বেও ঝিনুক খুব অল্পদিনের মধ্যে জটিল শারীরিক সমস্যার মধ্যে পড়ল। এক ঝড় বৃষ্টির রাতে তার লেবার পেন ওঠে। প্রিম্যাচিওরড পেন। পরদিন ভোরে, নার্সিংহোমে অঢেল রক্তক্ষরণের মধ্যে ঝিনুক এক মৃত শিশুর জন্ম দেয় এবং ঘন্টাখানেকের মধ্যে নিজেও মারা যায়।

খবর পাওয়ার পর সুগত ভেবেছিল, যাব না। কী হবে গিয়ে? পরে রাতের ট্রেন ধরে।

তেষ্টা বাড়ে সুগতর। টেবিলে ফেলা ব্যাগ হাতড়ে জলের বোতল বের করে। জল নিঃশেষ। এই বিশ্রী গরমে এইটুকু বোতলের জল থাকবেই বা কতক্ষণ? টেবিলে রাখা প্লাস্টিকের জগটা হাতে তুলে নিয়েও নামিয়ে রাখল সুগত। জল গরম। রান্নাঘরে জালা রয়েছে। কিন্তু তাতে কি জল আছে? গত ক’দিন জলই ভরা হয়নি যে! জালা নিশ্চয় খালি। নাকি তলানিতে পড়ে আছে খানিকটা? থাকলে আজকের দিনটা চলে যাবে। নইলে মুশকিল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে আসে সুগত। এলোমেলো রান্নাঘর। খানিকটা নোংরাও। সকালের কাপ ডিশ, চায়ের পাতা পড়ে আছে এক কোনায়। সসপ্যানটা এখনও স্টোভের ওপর। উঁচুতে হাত বাড়িয়ে খড়খড়ির ছোট্ট জানলাটা খুলে দিল সুগত। বাসি গন্ধটা বেরিয়ে যাক। তারপর হাত বাড়িয়ে জালার ঢাকনা তুলতে গিয়েই চমকে উঠল!

কাচের গেলাসে ওটা কী! ছোট একটা ডিশ দিয়ে ঢাকা গেলাসের ভেতর সাদা জল চিকচিক করছে জানলা দিয়ে ছিটকে আসা আলোয়। পাশে দুটো লেবুর টুকরো নিজেদের সব রস নিঃশেষ করে পড়ে আছে দুমড়ে মুচড়ে।

শরবত! শরবত কে বানিয়েছে!

যে সমস্যা শুরু হয়েছিল আবছাভাবে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল। সুগত একেবারেই ভিতু প্রকৃতির মানুষ নয়। সে শুধু বিজ্ঞানের মাস্টারই নয়, ভাবনাচিন্তার মধ্যেও কখনও অবাস্তব, অসম্ভবকে ঠাঁই দেয়নি। ঠান্ডা মাথায় যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করা, মেনে নেওয়াই তার স্বভাব। কিন্তু এই ঘটনায় সে হতচকিত হয়ে পড়ল। যুক্তি কাজ করল না। তালা বন্ধ বাড়িতে কে তার জন্য শরবত বানিয়ে রাখবে!

কালির মা পাঁচদিনের মাথায় কাজে যোগ দিয়েছে। শরবতের কথা বলব বলব করে সুগত কিছু বলেনি। বুড়ি শুনে ঘাবড়ে যাবে। বরং মনকে বুঝিয়েছে, কাজটা হয়তো তারই! স্কুলে যাওয়ার আগেই গ্লাস ভরে বানিয়ে রেখেছিল। বেরোবার আগে এক চুমুকে শেষ করে যাবে ভেবে। আগে কখনও করেনি তো কী হয়েছে? আজ থেকে শুরু করা যায় না? গরমে লেবু চিনির শরবত তো শরীরের জন্য ভালই। বিশেষ করে গনগনে রোদে বেরোবার আগে। পরে তালেগোলে ভুলে গেছে। হতেই পারে নানারকম চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকলে সবকিছু মনে রাখা কঠিন। নিজের জন্য শরবত বানানোটা এমন কোনও বড় কাজ নয় যে মনে রাখতে হবে।

কিন্তু সোমবারে ঘটনাটা অবশ্যই মনে রাখার মতো হল।

গামছা মেলতে ভুলে গেলেও বেরিয়ে যাওয়ার সময় বারান্দায় রাখা জিনিস ঘরে তুলে যেতে কখনও ভুল করে না সুগত। সে শুকোতে দেওয়া কাপড়-জামাই হোক, বই খাতা, চা খাওয়ার কাপ ডিশ, বেতের চেয়ারই হোক। শুধু চুরির ভয় নয়, ভয় ঝড়-জল, রোদেরও। এরকমটা হয়েছে বেশ কয়েকবার। ঝিনুক শাড়ি জামা তুলতে ভুলে গেছে। দুপুরের ঝড়জলে উড়ে গেছে। একবার একটা মোড়া চুরি হয়ে গেল। ঝিনুকের চিরুনি হারিয়েছে বেশ কয়েকবার। পাঁচিলের ওপর রেখে আসত ভুলা মনে। স্নানের পর বারান্দায় বসে চুল আঁচড়ানোর অভ্যেস ছিল তার।স্নানের পর বারান্দায় বসে চুল আঁচড়ানোর অভ্যেস ছিল তার।

সোমবার স্কুল থেকে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে গেল সুগতর। প্রায় সন্ধে। নতুন রুটিন নিয়ে হেডমাস্টারের ঘরে মিটিং ছিল। বাড়ি ফিরে দেখল, কালির মা তালা দেওয়া দরজার বাইরে বসে অপেক্ষা করছে। দ্রুত হাতে দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সুগত বলল, ‘আগে গিয়ে চা বসিয়ে দাও তো কালির মা। বেশি করে করবে। ফ্লাকে রেখে যেয়ো। রাত পর্যন্ত পরীক্ষার খাতা দেখতে হবে আজ।’

কালির মা বলল, ‘আর কিছু খাবে?’

‘না, স্কুলে টিফিন করেছি। একেবারে রাতে খেয়ে নেব।’

কালির মা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, ‘এমন করলে চলবে কী করে? বউদি চলে যাওয়ার পর খাওয়াদাওয়ার কী ছিরি করেছ বাপু।’

সুগত কথায় কান দেয় না। টেবিলে খাতা, পেন গোছাতে গিয়ে খেয়াল করে, ঘরে বেতের চেয়ারটা নেই। কী হল! স্কুলে যাওয়ার সময় টেবিলের পাশেই রেখে গিয়েছিল তো। স্পষ্ট মনে আছে। চেয়ার নিয়ে ঢুকতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে বারান্দার আধখোলা দরজায় সামান্য ঠোক্কর খায়। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যথা লাগে। সেই ব্যথা এখন আর নেই। তবে ছড়া দাগটা রয়েছে। তা হলে? দ্রুত বারান্দার দরজা খুলে বাইরে যায় সুগত।

চেয়ার বারান্দায়! যেভাবে রোজ বিকেলে ঝিনুক পেতে বসত, ঠিক সেইভাবে সাজানো। একটু কোনা করে। শুধু চেয়ার নয়, বারান্দার নিচু পাঁচিলে একটা গোলাপি রঙের চিরুনিও রয়েছে। হতভম্ব সুগত ঝুঁকে পড়ে সেই চিরুনি তুলল।

সেদিন রাতে ঘুম আসতে দেরি হল সুগতর। নিজেকে বোঝাল, এই ভুলটাও তার। সেদিন যেমন গ্লাসে শরবত বানিয়েছিল, আজও তাই হয়েছে। চেয়ারটা বারান্দাতেই পড়ে ছিল। চিরুনিও ফেলে এসেছিল নিশ্চয়। ঝিনুকের মৃত্যুতে এখনও মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। খুঁটিনাটি সব মনে থাকছে না। ধীরে ধীরে এই সমস্যাটা নিশ্চয় কাটবে। পাশ ফিরে চোখ বুজল সুগত।

সকালে সুগতর ঘুম ভাঙল ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে। চেয়ার হাতে দরজার কোনায় ঠোক্কর খাওয়ার ব্যথা। বেশিরভাগ সময়ে এটাই হয়। যে ব্যথা হারিয়ে গেছে বলে মনে হয়, পরে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

পরদিন স্কুল গেল না সুগত। খবর পাঠাল, শরীর ভাল নেই। সত্যিই তাই। রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি। তবে আসল কথা হল গোটা দিনটা ঘরে কাটাতে চায় সে। বুঝতে চায়, গোলমালটা কোথায়। সত্যি কি কোনও গোলমাল? নাকি অশান্ত মনের ভুল। কীসের অশান্তি? ঝিনুকের মৃত্যু তাকে দুঃখ দিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে শান্তিও কি দেয়নি?

সকালটা দিব্যি খাতা দেখে কাটাল। বিকেলে ইচ্ছে করেই মিনিট কুড়ি বারান্দায় গিয়ে বসল সুগত। ঝিনুকের মৃত্যুর পর এই তার প্রথম বিকেলে বারান্দায় বসা। সন্ধের পর রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই চা বানাল। চায়ের কাপ হাতে ঝিরঝির করা টিভি চালিয়ে খবর শুনল। রাতে খাওয়ার সময় রেডিয়ো বাজাল জোর ভল্যুমে। খসখস আওয়াজ হল খুব, তবু বন্ধ করল না। ঘুমও হল ছেঁড়া ছেঁড়া। কিন্তু কোনও গোলমাল হল না।

গোলমাল হল পরদিন।

স্কুল ছুটি হয়ে গেল তিন পিরিয়ডের মাথায়। এর সঙ্গে রয়েছে ছেলেদের আবদার। ছাত্ররা অঙ্ক খাতার পাতা ছিঁড়ে হেডমাস্টারের কাছে দরখাস্ত জমা দিয়েছে, ‘মাননীয় প্রধানশিক্ষক মহাশয়, আজ বৈকালে তারাপোতা গ্রামের আদ্যনাথ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের সহিত আমাদের ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হইবে। এই উপলক্ষে আপনার কাছে আমাদের বিনীত অনুরোধ আপনি যদি তিন পিরিয়ডের পর বিদ্যালয়ের ছুটি ঘোষণা করেন…।’ সুগত ফিরে এলও তাড়াতাড়ি। শরীর সংক্ষিপ্ত একটা ঘুম চাইছে। খাতা দেখাও শেষ করতে হবে। হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে দেরি নেই। তার ওপর শনিবার কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছে। বাবার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বড়মাসির কাছেও যাওয়ার দরকার। ঝিনুকের বাপের বাড়ির দেওয়া গয়নাগাটি, কাপড়জামা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মেয়ের বাবা-মা কি ওগুলো ফিরিয়ে নেবে? না নিলে কী করা হবে?

সোজা বাথরুমে ঢুকল সুগত। পুরো দু’বালতি জল ঢালল মাথায়। গা মুছতে মুছতে সুগতর মনে হল, অনেক খারাপের মধ্যেও নিজেকে ধুয়ে মুছে রাখার অভ্যেসটা ঝিনুকের ভালই ছিল। আরামেরও। কতদিন মাঝরাতে বাথরুমে গিয়ে জল ঢেলেছে। ভেজা গায়ে এসে শুয়ে পড়েছে ফের। ঠাণ্ডা লাগার ভয় দেখালেও শুনত না। বলত, ‘ও কিছু হবে না। বাপের বাড়িতে আমার অভ্যেস ছিল।’

ভেবেছিল ঘুমোবে অল্প। সুগতর ঘুম হল লম্বা। বিকেলের মুখে ঘুম ভাঙল। কালির মা আজ আর আসবে না। নাতনিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। সুগত এ বেলা হোটেল থেকেই খেয়ে আসবে। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাল সুগত। এবার খাতা নিয়ে বসতে হবে। খানিকটা ফুরফুরে মেজাজেই হাতে চায়ের কাপ নিয়ে রান্নাঘর থেকে ঘরে ফিরল। ফিরেই থমকে গেল। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটু স্রোত বয়ে গেল তার। ঘরের লাল সিমেন্ট করা মেঝের ওপর ওগুলো কী!

বাথরুম থেকে কতকগুলো ভেজা পায়ের ছাপ চলে গেছে। চলে গেছে খাট পর্যন্ত। অস্পষ্ট সেই ছাপ কোনও নারীর!

চায়ের কাপটা মাটিতে পড়ে সশব্দে ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জানলা বন্ধ ঘরে সেই আওয়াজ রয়ে যায় অনেকক্ষণ। কাঁপা হাতে দেয়াল ধরে কোনওরকমে নিজেকে সামলায় সুগত। মুখ তুলে তাকায় খাটের দিকে। বিকেলের আবছা আলোয় দেখতে পায়, বিছানা পরিপাটি করে পাতা। পাশাপাশি দুটো মাথার বালিশ কে যেন সাজিয়ে রেখেছে যত্ন করে!

তন্দ্রা চুল বাঁধছে। চেয়ারে বসে আড়চোখে নজর করছে সুগত। চুল বাঁধার আগে তুন্দ্রা ঘরের কোনায় রাখা এঁটো থালা বাসন রান্নাঘরে শুধু রেখেই আসেনি, ধুয়েছেও। সুগত বলেছিল, ‘থাক না কাল সকালে কালির মা তো আসবেই।’ তন্দ্রা শোনেনি। জল ভরে এনেছে জগে। সুটকেস থেকে কাপড় জামা বের করে আলনায় সাজিয়ে রেখেছে যত্ন করে। ঝাঁটা খুঁজে এই রাতেও মেঝেতে বুলিয়েছে বার কয়েক সুগত অবাক হওয়ায় সে অবাক হয়েছে আরও বেশি। ছোট চোখ দুটো বড় করে বলেছে, ‘বাঃ, ঝাঁট না দিলে হবে কেন? পায়ে লেগে বিছানায় ধুলো উঠবে না!’

সুগত চুপ করে গেছে।

আজ দুপুরের ট্রেনে তন্দ্রাকে নিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে সুগত। কাল থেকে স্কুলে জয়েন করবে। সব মিলিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিল। তাও শেষে একটা রবিবার রেখেছে। দ্বিতীয় বিয়েতে এর বেশি ছুটি নেওয়া যায় না। তবে সহকর্মীরা সবাই খুশি। বলেছে, ‘খুবই ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েই সুগত। কারেক্ট ডিসিশন।’

সুগত লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল, ‘আমি রাজি হই-ইনি। বড়মাসিই জোর করলেন। মা-ও বলল, একা থাকিস…।’

‘ঠিকই বলেছেন। গোটা জীবনটাই পড়ে আছে তোমার। কী বা বয়স হয়েছে? কিছুই নয়। একটা দুর্ঘটনার জন্য… না না নতুন করে সংসার শুরু করো আবার।’

এই অল্প কয়েকদিনেই সুগত লক্ষ করেছে রাতে শোওয়ার আগে অনেকটা সময় ধরে চুল বাঁধে তন্দ্রা। না বেঁধে উপায় কী? মেয়েটার চুল অনেকখানি। তবে গায়ের রং কালো। শরীরটাও ভারীর দিকে। মোটাই বলা চলে। বড়মাসি মেয়েকে দেখার পর বলেছিল, ‘এই ভাল। রোগা প্যাংলা অসুস্থ মেয়ে আর চাই না। বড়লোক বাপের আদুরে মেয়েতেও কাজ নেই। ঘরসংসার ফেলে সারাদিন শুয়ে বসে ঘুমোবে তা চলবে না। কাজ করতে হবে বাপু।’

সুগত বলেছিল, “আঃ, মাসি। কাজের লোক তো খুঁজছি না, বউ খুঁজছি। ওখানে গিয়ে মন বসবে কিনা সেটাই আসল। জল তোলা, বাসন মাজার জন্য কালির মা তো রইলই।’

বড়মাসি বিরক্ত গলায় বললেন, ‘তুই চুপ কর দেখি। কালির মা-ই থাকুক আর বাবাই থাকুক। ঘরের বউ নিজের সংসার না দেখলে চলে কখনও? এই মেয়ে পারবে। দেখিস তুই ঠিক পারবে।’

খানিকটা নিশ্চিন্ত, খানিকটা অবিশ্বাসী গলায় সুগত বলে, ‘তুমি বুঝলে কী করে?’

‘ওসব ঠিক বুঝতে পারি। গরিব ঘরের মেয়ে অত রং ঢং জানে না। লেখাপড়াও কম। সারাদিন যে শুয়ে বই পড়বে সে উপায় নেই। বাপের বাড়ি থেকেই খাটাখাটনিতে অভ্যস্ত। দেখলি না, ছেলের দ্বিতীয় বিয়ে শুনেও এককথায় কেমন রাজি হয়ে গেল? আগেরবার আমারই ভুল হয়েছিল। মেয়ে পছন্দ করবার আগে সবদিক ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত ছিল।’

চুল বাঁধা শেষ করে তন্দ্রা স্বামীর দিকে ফিরে বলল, ‘গা-টা ধুয়ে আসি?’

সামান্য চমকাতে গিয়েও নিজেকে সামলাল সুগত।

‘তোমারও রাতে স্নান করা অভ্যেস নাকি?’

তন্দ্রা সহজ ভাবে বলল, ‘না অভ্যেস নয়। তবে এখানে বড্ড গরম।’

‘বৃষ্টি শুরু হলে গরম থাকবে না। যাও চট করে সেরে এসো।’

চট করে পারল না, তবে বাথরুমে বেশি দেরি করল না তন্দ্রা। আলো নেভানোর আগে সুগতকে তুলে বিছানার চাদর বদলাল। মশারি টাঙাল যত্ন করে। তারপর সহজভাবে শাড়ি ছেড়ে সায়া ব্লাউজ পরে উঠে আসে খাটে। সুগতর গা ঘেঁষে বসে পিঠ ফেরায়। মাথার চুল তুলে ধরে ঠোঁটের ফাঁকে অল্প হেসে বলে, ‘নাও খোলো।’

একটু অস্বস্তি হলেও সুগতর খুব ভাল লাগে। সহজ, স্বাভাবিক মেয়ে। চার-পাঁচদিনেই স্বামীকে মেনে নিয়েছে। মন ভরে যায় সুগতর। সে দ্রুত হাতে ব্লাউজের হুক খুলতে থাকে।

একসময় তার বুকে হাত রেখে ফিসফিস করে বলে, ‘আমাকে পছন্দ হয়েছে?’

সুগতর আর একটা হাত নিজের উরুর ওপর নিয়ে তন্দ্রা বলে, ‘খুব।’

‘আর এই ঘর?’

স্বামীর গলা জড়িয়ে তন্দ্রা বলে, ‘আরও বেশি। অ্যাই তুমি জানতে, না, আজ আসব?’

বউয়ের কোমর নিজের দিকে টেনে নেয় সুগত। চেপে ধরে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে আজই যে আসব এমনটা ঠিক ছিল না। তবে কাল সকালে আসতেই হত। কেন বলো তো?’

সুগতর লুঙ্গির গিট খুলতে খুলতে তন্দ্রা বলল, ‘না, এমনি। বাথরুমে নতুন সাবান সাজিয়ে রেখেছ তো, তাই। আমি তো ভয়ে মরছিলাম। সাবান, পাউডার, তেল সব ফেলে এসেছি। গুছিয়েও তাড়াহুড়োয় ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেছি। একটু আগে খেয়াল হল। বলতে ভয় করছিল, তুমি যদি রাগ করো। স্নান করতে গিয়ে দেখলাম, ওমা… নাও এবার এসো।’

চমকে উঠল সুগত। বাথরুমে নতুন সাবান! কই না তো! সে তো কিছু জানে না! কে আনল?

নগ্ন শরীরে স্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল সুগত। তন্দ্রা অনেক চেষ্টা করেও সেই শরীর জাগাতে পারল না।

আমার সময়, শারদীয় সংখ্যা ১৪১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *