হিরে

হিরে

ফুলছে, ফুঁসছে। পাক মেরে চাপা গর্জন তুলছে, সোঁ সোঁ। খানিক আগেই হলুদ বিপদসীমা পেরিয়েছে। এখন ছুটছে লাল বিপদসীমার দিকে। সর্বনাশের আর বেশি দেরি নেই। পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দ্রুত। যে-কোনও মুহূর্তে চরম বিপদসীমা পেরিয়ে যাবে। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বাইরে।

নদী-বাঁধে এই বিপদের সময়গুলোতে মানুষকে জানানোর অনেকরকম ব্যবস্থা থাকে। কখনও সাইরেন বেজে ওঠে। কখনও ওড়ে লাল নিশান। সবাই বুঝতে পারে, বিপদ আসছে। পাড় টুপকে, বাঁধ ভেঙে জল উপচে পড়বে এবার।

দুধের ডেকচিতে সাইরেনের ব্যবস্থা নেই। রান্নাঘরের মানুষ তা নিজেই খেয়াল রাখে এবং সতর্ক হয়।

গোপালের মা সতর্ক হচ্ছে না। গ্যাসের ওপর রাখ দুধের ডেকচির দিকে তার কোনও খেয়াল নেই। তার খেয়াল বাইরে। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছে ড্রইংরুমের দিকে। এই মুহূর্তে ড্রইংরুমে যা ঘটছে তাতে গোপালের মা নিশ্চিত এ বাড়ির গিন্নির মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। ছোট খাটো গোলমাল নয়, বড় গোলমাল। মাথায় বড় গোলমাল ছাড়া একজন মানুষ কখনও এ কাণ্ড করতে পারে? পারে না। এখন নিজের বাড়িতে করছে, বেলা বাড়লে রাস্তায় বেরিয়ে করবে। চড়া রোদ এবং রাস্তার মোড় মাথা গোলমাল মানুষদের খুবই পছন্দের জিনিস। ঘটনা খুবই দুঃখের। চোখে কি জল এল? আসেনি। না আসুক। দুঃখের সময় এত বাছবিচার চলে না। গোপালের মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। এতদিনের কাজের বাড়ি বলে কথা। গোপালের মা গ্যাস বন্ধ করে, দুধের ডেকচি মাল সাবধানে। এখন কাজ অনেক। হাতে সময় কম। হঠাৎ করে বাড়ির গিন্নির মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। কাজের লোকের জীবনে এরকম সুযোগ দু’বার আসে না। সুযোগ বড় কথা নয়, বড় কথা হল সুযোগকে কাজে লাগানো। এখনই রান্নাঘর হাতড়ে খালি শিশি কৌটো খুঁজে বের করতে হবে। তারপর এল, ডাল শুকনো লঙ্কা, পারলে কিছুটা তেজপাতা ভরে ফেলতে হবে। দু’মঠো বাসমতী নিলে কেমন হয়? খারাপ হয় না। কখন লেগে যায় বলা যায় না। আর হ্যাঁ, গরম মশলা। গরম মশলা একটু লাগবে। তবে বেশি নয় দামি জিনিস। অল্প নিলেই চলবে। গোপালের মা আড়চোখে তাকাল ড্রইংরুমের দিকে। আহা রে, পাগল মানুষ, চুরি-চামারির কী বোঝে? কিছু বোঝে না। কে জানে দেখে ফেললে, হয়তো একগাল হেসে বললে, ‘গোপালের মা, মনে করে ক’টা কিসমিস নিয়ে যেয়ো। পায়েসে দিয়োখন।’

কিসমিসের কৌটো খুঁজতে খুঁজতে আবার শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল গোপালের মা।

ড্রইংরুমে অঞ্জলি পায়চারি করছে। শুধু পায়চারি করছে না, তার হাতে একটা বই। বইটা সে একবার খুলছে, একবার বন্ধ করছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছেও। সেই বিড়বিড়ানি ফ্যানের হাওয়ায় ঘরের মধ্যে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ‘…চিনের প্রাচীর… চিনের প্রাচীর… চিনের প্রাচীর… এক্স রে আবিষ্কার… এক্স রে আবিষ্কার… এক্স রে আবিষ্কার… উচ্চ জলপ্রপাত… উচ্চ জলপ্রপাত… উচ্চ জলপ্রপাত…’

শুধু গোপালের মা নয়, যে এই দৃশ্য দেখবে তারই মনে হবে, হলটা কী? সত্যিই কি অঞ্জলির মাথাটা খারাপ হয়ে গেল? অর্ণবই বা এই সাতসকালে গেল কোথায়? বোধহয় বাজারে গেছে। সে কি জানে না তার স্ত্রী ক্লাস সেভেনের একটা সাধারণ জ্ঞানের বই নিয়ে ঘুরে দুরে মুখস্থ করছে? মনে হয় না জানে। জানলে বাজারে না গিয়ে সে স্ত্রীর মাথায় ঠান্ডা জল ঢালার ব্যবস্থা করত। আচ্ছা, অর্কই বা কোথায়? সে তো তার মাকে একটু দেখতে পারে। ক্লাস সেভেনে পড়লে কী হবে? সে যথেষ্ট স্মার্ট। কম্পিউটার চালায়। ডাক্তারও ভাকতে পারবে। অর্ক কি স্কুলে গেল?

না অর্ক স্কুলে যায়নি। আজ তার কামাই! অর্কর সঙ্গে তার বাবারও আজ কামাই। অর্ণবও আজ অফিসে যাবে না। শুধু বাবা আর ছেলে নয়, অঞ্জলিও আজ তার প্রোগ্রাম বাতিল করেছে। বিকেলে ছোটবোনের সঙ্গে তার শপিং-এ যাওয়ার কথা ছিল। জটিল ধরনের শপিং। দু’ দফায় কেনাকাটা। প্রথম দফায় পোশাক, দ্বিতীয় দফায় সেই পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে ইমিটেশন গয়না, পুল, হার, চুড়ি। গয়না যদি মেলানো না পাওয়া যায় তা হলে কেনাকাটা আবার প্রথম দফায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন পোশাক বদলের ব্যাপার থাকলে। সেই কারণেই জটিল। মাঝখানে খাওয়াদাওয়া। এক মাস আগে ঠিক করা প্রোগ্রাম। এ বাতিল হয়েছে। অঞ্জলি সব প্রোগ্রাম বাতিল করতে পারে, খাওয়ার প্রোগ্রাম পারে না। আজ সেরেছে।

ব্যাপারটা কী? সত্যি সত্যি মাথায় গোলমাল?

না গোলমাল নয়। তবে ব্যাপার মারাত্মক।

আর কয়েক ঘণ্টা পরে, আজ বিকেলে এই বাড়িতে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে চিলেছে সাংঘাতিক এবং রোমাঞ্চকর।

এই সময় টিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হল ‘হিরের টুকরো গিন্নি’। আর তাতেই চান্স পেয়েছে অঞ্জলি। এক-এক দিন এক-এক জন গিন্নির পারফরমেন্স। বাসন মাজা, ঘর ঝঁট, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি। জিততে পারলে পুরস্কার এমন যে, হাত নিলে বুক কাঁপে। হিরে! সত্যিকারের হিরে! ঘন নীল ভেলভেটের বাক্স খুলে সেই হিরে যখন ক্যামেরার সামনে মেলে ধরা হয় তখন ঘরে ঘরে গিন্নিদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

গিন্নিরা আদর করে এই অনুষ্ঠানের একটা ডাকনাম রেখেছে। হিরে।

সেদিন দুপুরে এই ‘হিরে’ থেকে যখন চিঠি আসে তখন বাড়িতে কেউ ছিল না। অঞ্জলির একটা শকের মতো হল। প্রথমে মনে হল, আনন্দে লাফাই। লাফাতেই থাকি। পরক্ষণেই মনে হল, জীবন অনিত্য। সংসার মায়া। শেষ পর্যন্ত মনে হল, এই চিঠি মিথ্যে চিঠি। ফোন নম্বর দেখে অঞ্জলি ফোন করল। একবার নয়, তিনবার। তিনবার তিনরকম গলায়। শেষবার জোর ধমক দেয়, ‘ব্যাপারটা কী? এতবার ফোন করেন কেন? ঘরে কাজকর্ম নাই?

টেলিফোন কেটে দেওয়ার পর অঞ্জলি বুঝতে পারল, তার শরীর কাঁপছে। অল্প কাঁপছে কিন্তু কাঁপছে। মানুষের শরীর কাঁপে ভয়ে অথবা আনন্দে। অঞ্জলির শরীর দুটো কারণেই কাঁপছে। ভয়ে এবং আনন্দে। সে দ্রুত হাতে অর্ণবের মোবাইল নম্বর টেপে। অর্ণব অফিসে জরুরি কাগজপত্র দেখছিল। জরুরি কাগজপত্র দেখার সময় অর্ণব ফোন ধরে না। নম্বর দেখে কেটে দেয়। এইসময় ফোন ধরলে তার অসুবিধে হয়। অঞ্জলির নম্বর দেখে সে তাড়াতাড়ি ধরল। এই ফোন না ধরলে বাড়ি ফিরে অনেক বেশি অসুবিধে হবে। শুধু ধরল না, নরম গলায় বলল ‘বলো অঞ্জলি। কেমন আছ?’ ভাবটা এমন যেন বউয়ের সঙ্গে এক মাস পরে তার কথা হচ্ছে!

অঞ্জলি কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, ‘অ্যাই, তুমি চলে এসো। এক্ষুনি বাড়ি চলে এসো। একটা বিপদ হয়েছে।

অর্নব সোজা হয়ে বসে। জরুরি কাগজপত্র সরিয়ে চাপা গলায় বলে, ‘বিপদ! কী বিপদ? অ্যাক্সিডেন্ট ও আগুন? চুপ করে আছ কেন অঞ্জলি? বলো কী বিপদ।’

অঞ্জলির কাঁদোকাঁদো গলা এবার হাসিহাসি হল। সে হাসতে হাসতে বলে, ‘হিরে থেকে চিঠি পাঠিয়েছে। আমি চান্স পেয়েছি। সত্যি আমি চান্স পেয়েছি। ফোনও করেছিলাম।’

অর্ণব ফিসফিসিয়ে বলে, ‘হিরে! হিরেটা কী অঞ্জলি?’

‘উফ, হিরে জানো না! তুমি কী গো? তুমি কি মানুষ? হিরের নাম শোনোনি! তোমার সঙ্গে আমি যে কী করে এতদিন সংসার করছি! হিরে একটা টিভি প্রোগ্রাম। হিরের টুকরো গিন্নি। ভীষণ পপুলার। গিন্নিরা ওখানে ভাল পারফরমেন্স করলে দারুণ প্রাইজ পায়। কী প্রাইজ বলো তো? হিরে? নকল হিরে নয়, সত্যিকারের হিরে। দেখলে তোমার চোখ কপালে উঠে যাবে। সোমবার ক্যামেরা, মেকআপ ম্যান নিয়ে ওরা বাড়িতে আসছে। বাড়িতেই সারাদিন শুটিং। বাইরের কাউকে বলতে বারণ করেছে। খবরদার, তুমি কাউকে বলবে না। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!’

‘আনন্দ! এই যে বললে বিপদ হয়েছে তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে অঞ্জলি? ডাক্তারকে ফোন করব?

অঞ্জলি ভুরু কোঁচকায়। মানুষটা বড্ড প্রশ্ন করছে। সমস্যার কিছু নেই। সে জানে বেশ প্রশ্ন করা স্বামীর ওষুধ কী? একটা সময়ের পর এদের ধমক দিতে হয়। মৃদু ধমক নয়, জোর ধমক। সেই ধমকে শাশুড়ি, ননদ এবং পারলে জা-কেও আনতে হয়। তেমন বাড়াবাড়ি কিছু না হলে অসুখ এতেই সারে।

‘চুপ। একদম চুপ। আনন্দ হবে না? কী বলছ তুমি? হিরেতে চান্স পাওয়া কত বড় ব্যাপার তুমি জানো? জানো তুমি? বউ চান্স পেয়েছে অমনি চোখ টাটাচ্ছে। সারাদিন বাড়িতে গাধার মতো মুখ বুজে খাটব তবেই উনি খুশি। দাঁড়াও এবার মজা বুঝাবো।তোমরা মা-বোনের মুখ একেবারে অমসি করে দেব। টিভির পরদায় যখন আমার হাতে হিরেটা দেখবে তখন হিংসেতে হাত-পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে না দেয়। আমার তো বেশ ভয় করছে।’

ধমক খেয়ে অর্ণব ভেবেছিল চুপ করে যাবে। পারে না। ভুল করে সে আবার প্রশ্ন করে বসে। বলল, ‘ভয়! কীসের ভয়? এই তো বললে আনন্দ হচ্ছে। বললে না?’

অঞ্জলির মনে হল যেন পৃথিবীর সবথেকে বোকা মানুষটার সঙ্গে তার কথা হচ্ছে। বলল, ‘আরে বাবা, সেই ভয় নয়। এটা অন্য ভয়। টিভিতে আমাকে দেখে তোমার ছোটভাইয়ের বউ রত্না রাগ করে তার নিজের টিভিটা ভেঙে না ফেলে। শুনেছি বেচারি নাকি নতুন টিভি কিনেছে। তাই ভয় করছে। পুরনো হলে করত না।’

অর্ণবের ইচ্ছে করল ফোনটা কেটে দিতে। তার বদলে সে হাসল। স্ত্রীর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ে এটাই হয়। যা ইচ্ছে করে তা পারে না। বদলে হাসে। আজও হেসে বলল, ‘ছাড়া তো ওসব। সত্যি দারুণ ব্যাপার অঞ্জলি। এত বড় একটা অনুষ্ঠান থেকে ডাক পেয়েছ, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। কনগ্রাচুলেশনস। বলো আমি তোমার জন্যে কী করতে পারি।’

অঞ্জলি সন্তুষ্ট হল। অল্প ডোজেই ওষুধ কাজে দিয়েছে। সে আদুরে গলায় বলল, ‘অ্যাই, আমাকে হেল্‌প করতে হবে। চিঠির সঙ্গে ওরা সিলেবাসও পাঠিয়েছে। খুব টাফ।’

অর্ণব তাড়াতাড়ি বলল, ভয়ের কিছু নেই সোনা। আমি আছি না? হাতে শনি আর রবিবারটা তো পাচ্ছি। ঠেসে প্র্যাকটিস করবে। ঠেসে প্র্যাকটিস করলে কোনও সমস্যাই হবে না। ভয়ের কিছু নেই।’

ভয়ের অনেক কিছু আছে। কারণ সিলেবাস ভয়াবহ। থিয়োরি ও প্র্যাকটিক্যাল দু’রকম প্রশ্নই থাকছে। সেই প্রশ্ন কখনও সিন, কখনও আনসিন। ঘর ঝাঁট, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, রান্নাবান্নার প্র্যাকটিক্যাল তো আছেই, এদের সঙ্গে ভয়ংকর ভয়ংকর সব প্রশ্ন। শুনলে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়।

সিলেবাসের সঙ্গে যেসব নমুনা প্রশ্নগুলো এসেছে সেগুলো এরকম—

মনে করুন, আপনি ঘর ঝাঁট দিয়েছেন, এমন সময় আপনার ছেলেমেয়ে আপনার কেনা নতুন কাঁচির বার পরীক্ষা করবে বলে পরিকল্পনা করল। পরিকল্পনামতো গোপনে প্রচুর কাগজ কাটল এবং দ্রুত ঘরময় কাগজের নানাপ্রকারের টুকরো ফেলল। এবার যে ঝাঁটটা আপনি দেবেন সেটা ঠিক কেমন হবে? আপনার ঝাটের গতি এবং ছন্দ কি প্রথম পর্যায়ের ঝাঁটের মতোই থাকবে? নাকি পালটাবে? আপনার মনের অবস্থা কি দ্বিতীয় পর্যায়ের ঝাঁটে কোনও প্রভাব ফেলতে পারে? যদি পারে তা হলে সে প্রভাবকে কীভাবে আপনি নিয়ন্ত্রণ করবেন? হাসিমুখে? নাকি গম্ভীর হয়ে? ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করে? নাকি শান্ত গলায় মনীষীদের ছেলেবেলার গল্প শুনিয়ে?

বাসন মাজার নমুনা প্রশ্ন আরও ভয়ংকর।।

সকালে উঠে আপনি জানতে পারলেন কাজের লোক আসছে না। তার পেট ব্যথা। শুধু আজ নয়, সে কালও আসবে না। এই পরিস্থিতিতে গাদাখানেক বাসন মাজার সময় ঠিক কোন ধরনের রবীন্দ্রসংগীত আপনার মনকে শান্ত করতে পারে? পূজা পর্যায় না প্রকৃতি? যদি পুজা পর্যায়ের হয় তা হলে ঠিক আছে, কিন্তু যদি প্রকৃতি হয় তা হলে কোন প্রকৃতি, গ্রীষ্ম? বসন্ত? নাকি শরৎ?

রান্নার সিলেবাস দেখতে তো মনে হবে অনার্সের আটটা পেপার! পিৎজা থেকে মুলো শাকের ঘণ্ট কী নেই? ব্যাপার এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। হিরে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? কাপড় কাচা, বাসন মাজার মতো মোটা বিষয়ের পাশে আছে সূক্ষ্ম বিষয়। সেই সূক্ষ্ম বিষয়ে কোনওটা ক্যামেরার সামনে বলতে হবে। কোনওটা হাতেকলমে করে দেখাতে হবে। সাধারণ জ্ঞান, চিত্রকলা, সিনেমা, থিয়েটার, আবৃত্তি, গান ও নাচ। বাপ রে! কী নেই?

নাচের কথা শুনে অর্ণব আঁতকে উঠল। বলল, ‘নাচ! অঞ্জলি তুমি নাচতে পারবে?’

অঞ্জলি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ওমা, আমি কেন নাচতে যাব? নাচবে তো তুমি।’

‘আমি!’ অর্ণবের প্রায় সোফা থেকে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সে কপালের ঘাম মুছে বলে, ‘আমি! আমি নাচব? তুমি কী বলছ অঞ্জলি! পারফরমেন্স তোমার। হিরে পাবে তুমি। আমি কেন নাচতে যাব?’

অঞ্জলি স্বামীর দিকে তাকায়। ‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে বলে, ‘তোমাদের নিয়ে এই হয়েছে মুশকিল। কিছুই জানো না। এই প্রোগ্রামে, ছেলের আবৃত্তি, মেয়ের গান, স্বামীর নাচ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নম্বর তোলার জায়গা। কর্তাকে নাচ দেখাতেই হয়।’

‘ব্যাপারটা তুমি একটু শান্ত মাথায় ভেবে দেখো অঞ্জলি। এটা কি ঠিক? আমার নাচাটা কি উচিত হবে?’ অর্ণবের গলায় কাকুতিমিনতি।

অঞ্জলি চাপা গলায় ধমকে ওঠে। বলে, ‘কেন উচিত হবে না কেন? তুমি আমার জন্য এইটুকু করতে পারবে না? তোমার জন্যে, তোমার বাড়ির জন্যে সারাজীবন আমি কম নেচেছি? বলো, কম নেচেছি?’

অর্ণব তাড়াতাড়ি হাত তুলে বড়কে শান্ত করে। আমতা আমতা করে বলে, ‘নিশ্চয় নেচেছ। একশোবার নেচেছ। তবু বলছিলাম, মানে ধরে, টিভিতে আমার নাচ দেখাল। অফিসের লোকজন দেখল তাদের ম্যানেজারবাবু ধেই ধেই করে নাচছে, সেটা কেমন হবে না?’

অঞ্জলি পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘খুবই ভাল হবে। ওরাই তোমার কাছে জানতে চাইবে, তুমি কোনটার সঙ্গে নাচতে চাও। হিন্দি, ক্লাসিকাল না রবীন্দ্রসংগীত। আমি একটা কথা বলব?’

অর্ণব হাল ছেড়ে দিয়ে মিনমিন করে বলল, ‘বলো।’

‘তুমি বাউল চাইবে। বাউল সংগীত। তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, বাঙল নাচটা তোমার সঙ্গে মানাবে ভাল। ওরা নাচতে বললে তুমি চট করে একটা কাপড় কোমরে পেঁচিয়ে নেবে। এখন থেকে ক্যাসেট চালিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করে দাও। তোমার কী মনে হয়?’

অর্ণব বাড়লের মতো উদাস ভঙ্গিতে বলে, আমার কিছু মনে হয় না।’

সেই প্র্যাকটিস হয়েছে। ক্যাসেটে গান চলেছে, ‘কী ঘর বানাইলা আমি শূন্যরও মাঝার… লোকে বলে, বলে রে…।’

শুধু অর্ণবের নাচ নয়, অঞ্জলির কাপড় কাচা, বাসন মাজা, ঘর ঝাঁট, রান্না সবেরই প্র্যাকটিস চলছিল জোরকদমে। চলছিল জেনারেল নলেজ মুখস্থ। তাতে চিনের প্রাচীরের উচ্চতা যেমন আছে তেমনি আছে গদারের সিনেমা, পিকাসোর তুলি, দস্তয়েভস্কির কোটেশন। এগোচ্ছিল বেশ ভালভাবেই।

বিপর্যয়ের খবর এল গতকাল বিকেলে।

অঞ্জলি গোপনে সাজেশনের জন্যে লোক লাগিয়েছিল। লাস্ট মিনিট সাজেশন। সেই লোক খবর দিয়েছে, এই সপ্তাহে ঝাঁটা, বাসন, পিকাসো রাউন্ডের থেকেও অনেক বেশি ইমপর্টান্ট, ‘শ্বশুরবাড়ি রাউন্ড।’ বিচারকরা নাকি এই রাউন্ডের ওপর বিশেষ নজর রাখবেন।

অঞ্জলি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

‘উফ ঝাঁটা, বাসন, মুড়িঘণ্ট এত কিছু থাকতে এবারই শ্বশুরবাড়ি রাউন্ডটা ইমপর্টান্ট হল? বেছে বেছে আমার বেলাতেই? আমরা শুনছি, হিরেওলারা নাকি ক্যামেরা চালিয়ে শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করবে, আপনার বউমা কেমন রাঁধে? ঝালের হাত বেশি, না মিষ্টির হাত বেশি?’

অর্ণব আমতা আমতা করে বলল, ‘তোমার বদলে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এলে হয় না? মানে ধরো, আমার বাবা, মা, বোনের বদলে তোমার বাবা, মা, ভাই, বোনেরা এল। তারা নিশ্চয় তোমার খুবই প্রশংসা করবে। কোনও ঝুঁকি থাকবে না। ওরা শ্বশুরবাড়ি। চেয়েছে, একটা হলেই তো হল। হল না?’

অঞ্জলি চাপা গলায় হিসহিসিয়ে ওঠে। বলে, ‘চুপ। একেবারে চুপ। স্ত্রীর হাত থেকে হিরে ফসকে যাচ্ছে আর তুমি রসিকতা করছ? ইস এত মুখস্থ, এত নাচ-গান প্রাকটিস জলে গেল। আমার কান্না পাচ্ছে।’

নাচ প্র্যাকটিসের ফলে অর্ণবের সারা শরীরেই ব্যথা, সে অঞ্জলির কাঁধে অতি কষ্টে একটা হাত রেখে বলল, ‘ভেঙে পোড়ো না সোনা। আমি বরং সসামবার সকালে ও বাড়িতে একবার যাই। গিয়ে বাবা-মাকে বলি। ঝগড়াঝাটি ভুলে ওঁরা যদি আসেন।

অঞ্জলি মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘ইস তুমি বললেই যেন সুড়সুড় করে চলে আসবে ভেবেছ? কিছুতেই আসবে না। আমার শ্বশুরবাড়ির মতো পাজি, স্বার্থপর, জ্বালাতনের শ্বশুরবাড়ি একটাও নেই। সব একটা হিংসুটের দল। এমনি এমনি ও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি? আমার উপকার হবে শুনলে ওরা মোটেই আসবে না।’

অর্ণব জানে আসবে না। আসার পরিস্থিতি তিন বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। সে বলল, ‘তবু বলি। তোমার হিরের কথাটা জানাই।’

অঞ্জলি উঠতে উঠতে বলল, ‘হিরের কথা না বলে তুমি বরং ঘুঁটের কথা বলো। ছেলের বউ খুঁটে পাবে শুনলে ওঁরা এলেও আসতে পারেন। নইলে গিয়ে কোনও লাভ নেই।’

কোনও লাভ নেই জেনেও ঘুম থেকে উঠে আজ অর্ণব তার বাবা-মায়ের কাছে গেছে। সাল মুখ শক্ত করে পায়চারি করতে করতে চিনের প্রাচীরের উচ্চতা মুখস্থ করছে। এমন সময় অর্ক পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নাক কুঁচকে বলল, ‘মা, হচ্ছে না।’ অঞ্জলি পায়চারি থামিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে না?’

‘অত বড় কবিতাটা মুখস্থ হচ্ছে না।’

অঞ্জলি কড়া গলায় বলল, ‘হচ্ছে না মানে? কান টেনে ছিঁড়ে দেব। তিন দিনে একটা কবিতা মুখস্থ হচ্ছে না! ছি ছি। ক্যামেরার সামনে তুমি ডোবাবে দেখছি। ‘মায়ের বকুনিতে অর্ক রেগে যায়। বলে, ‘হিরে পাবে তুমি। আমি কেন কবিতা মুখস্থ করব? বয়ে গেছে।’ অঞ্জলি চড় মারবার ভঙ্গিতে ছেলের দিকে এগিয়ে আসে। অর্ক ছুটে বারান্দায় পালায়।

গোপালের মা রান্নাঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে নিশ্চিন্ত হল। সে যেরকম ভেবেছিল সেরকমটাই ঘটছে। মাথা গোলমেলে মানুষরা প্রথমে ঘরের লোকদের মারধর শুরু করে। তারপর আক্রমণ ছড়ায় বাইরের লোকদের ওপর। আহা রে, ব্যাপার খুবই দুঃখের। গোপালের মা আঁচল দিয়ে শুকনো চোখ মুছল। এখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটাই বুদ্ধির। তার ওপর সঙ্গে এতগুলো শিশি কৌটো আছে। বেশিক্ষণ থাকাটা ঠিক নয়।

এমন সময় বারান্দা থেকে অর্ক চিৎকার করে ওঠে, ‘মা, মা শিগগিরি এসে দেখে যাও কারা এসেছে। ট্যাক্সি থেকে নামছে।’

অর্কর এই এক বিচ্ছিরি স্বভাব। রেগে গেলে সে মিথ্যে বলে। তখন তার কান মুলে দিতে হয়। সেই কান মুলে দিতেই অঞ্জলি বারান্দায় এল। এসে চমকে উঠল। শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি নয়, ননদ চন্দনা, ছোট জা রত্নাও ট্যাক্সি থেকে নামছে! ইস, চন্দনাটা মোটা হয়ে গেছে। আরে, সঙ্গে ওটা কে? রত্নার মেয়েটা না? হ্যাঁ, বুলুই তো। বাবা, কী লম্বা হয়েছে! ওদের বাড়ির ধাতটাই এরকম। সবাই তড়বড়িয়ে লম্বা হয়। চমক্কার লাগে।

এরপর এ বাড়িতে দুটি ঘটনা ঘটেছে। একটা ছোট, একটা বড়।

ছোট ঘটনা হল, ‘হিরের টুকরো গিন্নি অনুষ্ঠানের কর্মকর্তারা দুপুরে টেলিফোন করে জানিয়েছে, তাদের পরিচালকের ইনফ্লুয়েঞ্জা। ইনফ্লুয়েঞ্জাটা বড় বিষয় নয়, বড় বিষয় হল, সকাল থেকে পরিচালকের হাঁচি একবারও থামেনি। সাউন্ড ট্র্যাকে সব ধরনের বাড়তি শব্দ ম্যানেজ করা যায়, কিন্তু হাঁচির শব্দ ম্যানেজ করা যায় না। সুতরাং শুটিং বাতিল। অসুখ সারলে কাজ হবে।

এই খবর শুনে অঞ্জলির ভেঙে পড়বার কথা। তাকে নার্সিংহোমে ভরতি করতে হলেও আশ্চর্যের কিছু ছিল না। কিন্তু বড় ঘটনা হল, সে একেবারেই ভেঙে পড়েনি! সত্যি কথা বলতে কী, এই মুহূর্তে তার এদিকে মন নেই। তার মন এখন ননদ এবং জায়ের সঙ্গে গল্প করায়। তিন বছরের জমে থাকা গল্প তো কম কিছু নয়। সম্ভবত বড় ধরনের কোনও পরচর্চা নিয়ে তারা এখন ব্যস্ত। নইলে তিনজনেই অমন হাসবে কেন?

অন্যদিকে বউমার শুটিং বাতিলের খবরে অর্ণবের বাবা ও মা দুজনেই খুশি হয়েছেন। বুড়োবুড়ি দু’জনেই জানিয়েছেন, বড়ছেলের বাড়িতে ক’টা দিন অপেক্ষা করে যেতে তাঁদের তেমন কোনও অসুবিধে নেই। বিশেষ করে যখন তাঁদের থাকাটা দরকার। কথাটা জানানোর সময় তাঁরা দুজনেই লজ্জা পেয়ে হেসেছেন।

বেলা অনেক হয়েছে। খালি শিশি কৌটোতে তেল, ডাল, গরম মশলা ভরা হয়ে গেলে গোপালের মা এখনও বাড়ি যেতে পারেনি। পারবে কী করে? বলা নেই কওয়া নেই এতগুলো মানুষ হুট করে চলে এসেছে। খাওয়া-দাওয়ার একটা ব্যাপার আছে। তার একটা দায়িত্ব আছে। এখন ফেলে যাওয়া যায়? তবে এরা সবাই মিলে যেরকম হাসাহাসি শুরু করেছে তাতে তার খানিকটা ভয়-ভয়ই করছে। দুপুরবেলা বাড়িসদ্ধ লোকের হাসি ভাল জিনিস নয়। মাথা খারাপের লক্ষণ।

এবার বুলু আর অর্কও কোথায় যেন হেসে উঠল। শুধু হাসি নয়। হাসির সঙ্গে হাততালিও।

গোটা বাড়িটা ঝলমল করে উঠল হিরের মতো।

সুখী গৃহকোণ, আগস্ট ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *