সন্ন্যাসী

সন্ন্যাসী

টিফিনের পর পার্থ সমাদ্দারকে তার টেবিলের দিকে আসতে দেখে সুপ্রতীক সতর্ক হল। সব অফিসেই এক ধরনের ‘নিচু-গলা’ টাইপের লোক থাকে। এরা যে-কোনও ধরনের আলাপ-আলোচনা গলা নামিয়ে করতে ভালবাসে। হয়তো ক্যান্টিনের মেনু বা বনগাঁ লোকালের লেট নিয়ে কথা বলবে, কিন্তু ভাব ভঙ্গি এমন যেন ভারত-আমেরিকার পরমাণু চুক্তি নিয়ে গোপন শলাপরামর্শ করতে এসেছে। কেউ শুনে ফেললে বিরাট বিপদ। প্রধানমন্ত্রী বকাঝকা দেবে।

পার্থ সমাদ্দার এই অফিসের সেই ‘নিচু-গলা’ টাইপের লোক। কথা বলার সময় সে শুধু গলা নামায় না, চারপাশে ইতিউতি চাইতেও থাকে। কেউ দেখে ফেলছে না তো? অনেকেই দেখে, কিন্তু আমল দেয় না। তারা জানে, এই ফিসফিসানির কোনও দাম নেই। সম্ভবত সেই কারণেই সমাদ্দার সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে কিছু কিছু কথা বানিয়ে বলতে শুরু করেছে। এতে যদি তার নিচু গলার গুরুত্ব বাড়ে। তবে এখনও এ খবর খুব বেশি চাউর হয়নি।

আজও কি সেরকম কিছু ঘটল? পার্থ সমাদ্দার কি বানিয়ে কিছু বলছে? নইলে সুপ্রতীক অমন চমকে উঠবে কেন?

‘এসব আপনি কোথা থেকে শুনলেন পার্থদা? এ আপনি কী বলছেন!’

সমাদ্দার মুচকি হাসল। পাশের টেবিল থেকে চেয়ার টেনে এনে বসল মুখোমুখি। টেবিলের স্তূপাকৃত কাগজপত্রের পাশ থেকে মুখ বের করে বলল, ‘ওকথা ছাড়ো, তুমি বলো খবর সত্যি কি না।’

সুপ্রতীক ঠোঁট কামড়ে মুহূর্তখানেক চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘ভুল করছেন না তো? হয়তো একই নামের অন্য কেউ গিয়েছিল।’

‘খেপেছ? উনি তোমার নাম বলেছেন।’

‘আমার নাম!’

পার্থ সমাদ্দার ফিসফিস করে বলল, ‘শুধু তোমার নাম নয়, তোমার মিসেসের নাম, বাড়ির ঠিকানা সব বলেছেন। এমনকী তুমি যে এখানে কাজ করো তাও। সেই কারণেই তো বিশু আমাকে কথাটা বলল। নইলে বলবে কেন? ওদের ওখানে এরকম রোজই কতজন যাচ্ছে।’

সুপ্রতীক নিজের অজান্তেই গলা নামিয়ে বলল, ‘বিশু! বিশু কে?’

পার্থ সমাদ্দার হাসি হাসি মুখে বলল, ‘বিশু, বিশ্বনাথ। বিশুই তো ওখানে নামটাম লেখে, ম্যানেজার মতো। আমার ভগ্নিপতির বাড়ির পাশেই থাকে। ছেলে খারাপ নয়, ছেলে ভাল, একটু বেশি বকবক করে এই যা। কাল ভগ্নিপতির বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। ছেলের জন্মদিন। ওখানেই ছোকরার সঙ্গে দেখা। বলল, পার্থবাবু, আপনাদের অফিসের… আমি তো শুনে থ’।’

সুপ্রতীক নার্ভাস গলায় বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এদিক ওদিক তাকিয়ে পার্থ সমাদ্দার বলল, ‘ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়েছে?’

সুপ্রতীকের সবটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সমাদ্দার এসব কী বলছে! নিশ্চয় কোনও গোলমাল করছে। বানাচ্ছে না তো? লোকটা নাকি আজকাল বানিয়ে বানিয়েও কথা বলে। কিন্তু এরকম অদ্ভুত একটা কথা বানিয়ে বলতেই বা যাবে কেন? তা ছাড়া কথাটা তো এলেবেলে কিছু নয়, কথা সাংঘাতিক। নিজেকে সামলে, শুকনো হেসে সুপ্রতীক বলল, ‘না, না, ঝগড়া কার সঙ্গে হবে? কেনই বা হবে? এই তো অফিসে বেরোনোর সময় শর্মিলাকে দেখে এলাম ব্রেকফাস্টের জন্য চা-টোস্ট, অমলেট, একটা বড় সাইজের কলা নিয়ে…।’

নিচু গলাতেই খুক খুক ধরনের হাসল সমাদ্দার। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘ঝগড়ার সঙ্গে কলার সাইজের সম্পর্ক কী? ঝগড়া তোমার ছোট কাঁঠালি কলাতেও হতে পারে, বড় সিঙ্গাপুরিতেও হতে পারে। পারে না?’

হাতের পেন টেবিলের ওপর রেখে পিঠ সোজা করে সুপ্রতীক খানিকটা সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলল, ‘তা ঠিকই, কিন্তু সত্যি পার্থদা, আমি কিছুই জানি না। কী মুশকিল হল বলুন তো।’

পার্থ সমাদ্দার ঠোঁটের ওপর আঙুল দিয়ে বলল, ‘স্ স্‌… আস্তে বলো সুপ্রতীক, এসব জিনিস জোরে বলার নয়। লোকে শুনলে ভুল বুঝবে। ভাববে তোমরাই জোর করে…। আরও ব্যাপার হয়েছে।’

‘আরও ব্যাপার! ব্যাপারের আর বাকি কী রইল?’ সুপ্রতীকের ভেঙে পড়ার জোগাড়।

পার্থ সমাদ্দার এবার চোখের বদলে শুধু ভুরু নাচিয়ে বলল, উনি তোমার আর তোমার গিন্নির গুণগান করেছেন। একটু গুণগান নয়, বেশি রকমের গুণগান। বিশু তো বলছিল, পুত্রবধূর প্রশংসায় ভদ্রলোক নাকি একেবারে পঞ্চমুখ। রান্নাবান্না, সেবা যত্ন, ঘর গুছিয়ে দেওয়ার লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন। বিশু তখন বলেছে, স্যার, এখানে অতটা তো পাবেন না, তবে যতটা হয়…।’

সুপ্রতীক মিনমিন করে বলল, ‘তা হলেই বুঝুন।’

টেবিলে টোকা দিতে দিতে সমাদ্দার দার্শনিক ধরনের চিন্তিত মুখ করে বলল, ‘এটাই তো ব্যাপার সুপ্রতীক। মানুষের মনের কথা আর বাইরের কাজ যখন আলাদা হয়ে যায় তখনই ব্যাপার জটিল হয়ে দাঁড়ায়। নিশ্চয় ভেতরে কোনও ক্ষোভ অভিমান তৈরি হয়েছে।’

খানিকটা চুপ করে থেকে সুপ্রতীক মুখ নামিয়ে বলল, ‘জায়গাটা কোথায়?’

সমাদ্দার চারপাশে এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে আরও ঝুঁকে পড়ল। গলা বাড়িয়ে প্রায় সুপ্রতীকের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘অ্যাকিউরেট লোকেশন জানি না, তবে বিশুর কাছে শুনেছি, জায়গা অতি চমৎকার।’

দাঁতে দাঁত চেপে সুপ্রতীক নিজের নার্ভাস ভাব গোপন করার চেষ্টা করল। বলল, ‘চমৎকার না কদাকার জানতে চাইনি, জায়গাটা কোথায় সেটা কি আপনি জানেন?’

‘জানি। উত্তরপাড়া স্টেশন থেকে যেতে হয়, গঙ্গার ধারে। দোতলার ওপর গঙ্গা ফেসিং একটা ঘর উনি পছন্দ করে এসেছেন। তিনতলাতে আরও ভাল ঘর ছিল। নেননি, হাঁটুতে ব্যথা, ওঠা-নামা করতে পারবেন না।’

সুপ্রতীক আঁতকে উঠল। হাঁটুতে ব্যথা! কই তার তো জানা নেই! কবে থেকে হল?

‘সে কী! ঘর পর্যন্ত পছন্দ হয়ে গেছে! ছি ছি।’

সমাদ্দার সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ডোন্ট বি সো আপসেট সুপ্রতীক। আজই বাড়ি গিয়ে ঝামেলা মেটানোর চেষ্টা করো। যতই হোক বুড়ো মানুষ। বয়স কত হল?’

সুপ্রতীকের আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না। তার শরীর খারাপ করছে। তবু সে বিড়বিড় করে বলল, ‘সিক্সটি এইট। সামনের আশ্বিনে নাইনে পা দেবে। তেরোই আশ্বিন।’

সমাদ্দার ঠোঁট উলটে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না না সুপ্রতীক, এটা ঠিক নয়। তোমাদের আজই ঘটনা মেটানো উচিত।’

‘কী মেটাব? কিছু হলে তো মেটামেটির প্রশ্ন। আপনি বিশ্বাস করুন পার্থদা, বিলিভ মি। নিজেই তো শুনেছেন, উনি শর্মিলাকে কতটা পছন্দ করেন।’

‘আমার শোনাশুনিতে কী এসে যায়? লোকে শুনবে না। তোমাকে এই অফিসে সবাই গুডবয় হিসেবে জানে। শুধু গুডবয় নয়, তুমি হলে একজন ডিউটিফুল ফ্যামিলিম্যান। সেই তোমার বাড়িতেই যদি এই কাণ্ড হয় তা হলে কী বিচ্ছিরি বলো তো? সবার সামনে কী এক্সমপেল তৈরি হবে? আমি এখন চললাম, গাদাখানেক ফাইল ছাড়তে হবে। বস তো খালি আমার টেবিলের দিকেই চোখ পেতে রেখেছে, যাক, দরকার হলে বোলো, সেরকম হলে আমিও বোঝাতে যাব। তোমাদের একটা সোশ্যাল প্রেস্টিজ আছে।’

আবার মুচকি হেসে, পিঠে দু’বার চাপড় দিয়ে পার্থ সমাদ্দার নিজের ডিপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়াল। সুপ্রতীকের মনে হল ‘চাপড়’ নয়, পিঠে দু’ ঘা চাবুক পড়ল। সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দ্রুত শর্মিলার নম্বর টেপে।

দুপুরের এই সময়টা শর্মিলা টেলিফোন পছন্দ করে না। এই সময় সে তার দুই মেয়ে চন্দ্রাবলী এবং চন্দ্রাবতীকে স্কুলে পাঠিয়ে ঝাড়া হাতপায়ে বসে টিভিতে রান্নার প্রোগ্রাম দেখে। আজও দেখছে। বিদেশি চ্যানেলে সুন্দরী মেমসাহেব হাসি হাসি মুখে চকোলেট কেক বানাচ্ছে। শর্মিলা বিস্মিত দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তার বিস্ময় চকোলেট কেকের জন্য নয়, বিস্ময় রান্নাঘরের জন্য। এটা রান্নাঘর! রান্নাঘরও এত সুন্দর হয়! রান্নাঘর না হয়ে একে অনায়াসে ড্রইংরুম বা স্টাডিও বলা যেতে পারে। সিঙ্কের পাশে ফুলদানি। মাইক্রোআভেনের ওপর বইয়ের র‍্যাক। ইয়া বড় জানলায় মেরুন রঙের পরদা ঝুলছে। তার রান্নাঘরে যদি এরকম একটা লম্বা, কালো মার্বেল টেবিল থাকত তা হলে কথাই ছিল না। গরমের দুপুরে মাঝে মধ্যেই পালংশাক, ধনেপাতা, সজনেডাঁটা সরিয়ে একটু গড়িয়ে নিত। একেবারে বেডরুম। আহা!

সত্যি কথা বলতে কী, একটা ঝকঝকে রান্নাঘরের স্বপ্ন শর্মিলার বহুদিনের। সেই বিয়ের পর থেকেই। তার শ্বশুরবাড়ির সব ভাল, একতলা ছিমছাম বাড়ি। তিনটে বড় বড় বেডরুম। সঙ্গে টাইলস মোড়া বাথরুম। পুব আর দক্ষিণে দুটো খোলা বারান্দা। ডাইনিং কাম ড্রইংটাও ছোটর ওপর মন্দ নয়। শুধু রান্নাঘরটাই হতকুচ্ছিত। অন্ধকার, ঘুপচি, যেন বাড়ির এক কোনায় লজ্জায় মুখ লুকিয়ে আছে কুশ্রী মেয়ের মতো। ওখানে ঢুকলেই, খানিকটা পর থেকে শর্মিলার শরীর ঝিমঝিম করে, মাথা ধরে যায়, দম আটকে পড়ে। শাশুড়ি বেঁচে থাকতে একবার কথাটা তুলেছিল শর্মিলা।

‘মা, রান্নাঘরটা একটু ঠিকঠাক করলে হয় না?’

‘ঠিকঠাক! রান্নাঘরের আবার ঠিকঠাক কী! তেল মশলা, ফোড়ন কমিয়ে বাড়িয়ে রান্নার ঠিকঠাক হয় শুনেছি, তুমি কী বলতে চাইছ আমি ঠিক ধরতে পারছি না শর্মিলা!’

শর্মিলা আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, এই ধরুন জানলাটা কেটেকুটে খানিকটা বড় করা হল, দেয়ালে টাইলস দিলাম, ওপরদিকে একটা বড় ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের ভেতরে মশলাপাতি থাকল।’

শাশুড়ি চোখ বড় করে বললেন, ‘আর?’

শর্মিলা নার্ভাস হেসে বলল, ‘আর… আর ঘরটা সাইজে যদি খানিকটা বড় করা যায়। এদিকের ওয়ালটা ভেঙে ফেলে খানিকটা বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।’ শর্মিলা কথা থামিয়ে ঢোঁক গিলে আবার বলতে শুরু করল, ‘আজকাল রান্নাঘরের কনসেপ্টটাই বদলে গেছে মা। সিনেমা, টিভিতে দেখেন না, ফ্ল্যাটবাড়িতে সব মডিউলার কিচেন। স্পেশিয়াস, এয়ারি। আমাদের মতো নয়, দু’জন ঢুকল কি ঢুকল না গায়ে গা লেগে যায়।’

শাশুড়ি ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘শর্মিলা, আমার যতদূর জানা আছে তোমার শ্বশুরমশাই রান্নাঘর সিমেন্ট বালি দিয়েই বানিয়েছেন, ইলাস্টিক দিয়ে নয়। ইলাস্টিক বা রাবার দিয়ে করলে না হয় টেনে বড় করা যেত। তা ছাড়া এটা ফুটবল খেলার মাঠও নয় যে তার ভালমন্দ আলো হাওয়ায় বিচার হবে। রান্নাঘরের বিচার হবে রান্নার কোয়ালিটিতে। তুমি ঘরের দিকে মন না দিয়ে বরং রান্নায় মন দিলে ভাল হবে। সেরকম অসুবিধে হলে তুমি রান্নার জন্য আলাদা লোকও রাখতে পারো। বাড়ির বউকে রোজ হেঁশেল ঠেলতে হবে এরকম কোনও নিয়ম আমার সংসারে নেই। রান্নাঘর সিনেমা-টিভির মতো করে সাজানোর থেকে তার খরচ কম হবে বলেই আমার মনে হয়।’

এরপর আর এ প্রসঙ্গ তোলার সাহস পায়নি শর্মিলা। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর সুপ্রতীককে কয়েকবার কথাটা বলেছিল। সে ‘হচ্ছে, হবে’ বলে চুপ করে গেছে। সেও প্রায় কয়েক বছর পার হয়ে গেল। এবার শর্মিলা নিজেই উদ্যোগ নিয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে শ্বশুরমশাইকে গোপনে নিজের ইচ্ছে জানিয়েছে। বৃদ্ধ মানুষটা শুধু রাজি হননি, খুবই উৎসাহও দেখিয়েছেন। শুধু রান্নাঘর নয়, বাড়ির লোকদের যে-কোনও ধরনের ইচ্ছেতেই এই মানুষের বিরাট উৎসাহ। যত দিন যাচ্ছে উৎসাহের পরিমাণ বাড়ছে। নাতনিদের অ্যাকোরিয়ামের শখ তো নিজেই দু’জনকে নিয়ে হাতিবাগানে ছুটলেন গোল্ড ফিশ আনতে। শর্মিলা ছাদে গাছ করবে শুনে, টব আনলেন গাদাখানেক। সঙ্গে নয়নতারার চারা। সেই চারার বেশিটাই গেল মরে। উনি বললেন, নো প্রবলেম। আরও আসবে। ছুটির দিনে ছেলে বেলা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে? কই বাত নেহি। সেদিন দোকান-বাজারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে একটা হইচই শুরু করে দিলেন। বাজারের সঙ্গে এল গরম জিলিপি। চন্দ্রাবলী-চন্দ্রাবতী গরম জিলিপি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে হাতে মুখে রস মেখে একাকার কাণ্ড করল। মানুষটার এই হইচইয়ের অভ্যেস আজ থেকে নয়, গোড়া থেকেই দেখছে শর্মিলা। শাশুড়ি চোখ পাকিয়ে বলতেন, ‘আদিখ্যেতা কোরো না তো।’

শর্মিলার মুখে সেদিন রান্নাঘরের কথা শুনে বললেন, ‘বুঝলে বউমা, রান্নাঘর হল বাড়ির হার্ট। সে যেমন পাম্প করে গোটা বাড়ির শরীরে রক্ত সাপ্লাই করে, তেমন আবার সে হৃদয়ও বটে। খাবারে যত্ন, ভালবাসার ছোঁয়া লাগাতে জানে। রাঁধুনির মন খারাপের সময় কতবার যে রান্না পুড়ে গেছে আর রাগের সময় ঝাল পড়েছে বেশি তার ওপর যদি একটা সার্ভে হত… হা হা।’

শর্মিলা খুশি হয় আবার লজ্জাও পায়। হেসে বসে, ‘মা বেঁচে থাকতে বলেছিলাম একবার।’

‘তিনি প্রোপোসাল ঘ্যাচাং করে দিয়েছিলেন তো? জানি দেবেন। আরে বাবা, তোমার শাশুড়ির যুগ ছিল অন্যরকম। সে ছিল রান্নাঘরে বন্দি থাকার যুগ, আর তোমাদের যুগ হল আরেকরকম। রান্নাঘরে মুক্তির যুগ। কাজটা এতদিন যে কেন হয়নি, সেটাই আমার অবাক লাগছে।’

শর্মিলা অনুযোগের সুরে বলে, ‘দেখুন না বাবা, আপনার ছেলেও তো বুঝতে চাইছে না। কতদিন ধরে বলছি।’

শ্বশুরমশাই চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘সুপ্রতীকের কথা বাদ দাও দেখি, তুমি বলদেওকে খবর পাঠিয়ে আজই প্ল্যান প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেলা। রাজমিস্ত্রি হিসেবে বলদেও খারাপ নয়। খরচাপাতির হাতটা একটু বেশি। তবে ও নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমি আছি।’

মানুষটাকে নিয়ে এই এক মুশকিল হয়েছে শর্মিলার। যে-কোনও কাজেই জমানো টাকা ফরফর করে বের করে দেন। সুপ্রতীক শুনলে রাগারাগি করে। শর্মিলা বলে, ‘বাঃ, আমায় বলছ কেন? আমি কি চেয়েছি নাকি? উনি চিরকালই তো এরকম। মা বেঁচে থাকতে কম অশান্তি হয়েছে?’

বলদেওকে ডেকে ইতিমধ্যে দু’পর্যায়ে কথা হয়ে গেছে শর্মিলার। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কথা ফাইনাল হলে, আসবে কাঠের মিস্ত্রি। একদম শেষে ইলেকট্রিকের লোক। সবই ঠিক আছে, অসুবিধে হচ্ছে শুধু ঘরের সাইজ বড় করায়। রান্নাঘর বড় করতে হলে লিভিং ডাইনিং রুমের খানিকটা কেটে নিতে হবে। তা ছাড়া দেয়াল ভাঙলে বাড়ির খোলনলচেতে কোনও গোলমাল হয়ে যায় কিনা সেটাও দেখার। শর্মিলা অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। ডিজাইন ফাইনাল হয়ে গেলে, শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে বলদেওকে বসিয়ে দেবে। তবে শর্মিলার ইচ্ছে আগে একবার বলদেওকে টিভির প্রোগ্রাম দেখিয়ে দেওয়ার। ফটোর থেকে টিভি দেখলে আইডিয়া পরিষ্কার হবে।

বিরক্ত মুখে সুপ্রতীকের ফোন ধরেছিল শর্মিলা। এখন থমথমে মুখে বসে আছে। শুধু মুখ থমথমে নয়, চোখও ভেজা। ইচ্ছে করছে এখনই উঠে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে যায় এবং জিজ্ঞেস করে ঘটনা সত্যি কি না? সত্যি হলে কেন সত্যি? তারা কী অন্যায় করেছে? কী অসুবিধে হচ্ছে তাঁর?

দুপুরে খাওয়ার পর মানুষটা নিজে একটু বিশ্রাম করেন। ঘরটা বাড়ির মধ্যে সবথেকে ভাল। দক্ষিণমুখো। জানলার কাছেই চাঁপা ফুলের গাছ ঝুঁকে আছে। গরমের সময় ফুলে ফুলে ভরে থাকে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর, এই ঘর ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। শর্মিলাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এত বড় ঘরে আর দরকার কী? তুমি বরং এটাতে চলে এসো বউমা।’

শর্মিলা, সুপ্রতীক দু’জনেই কথাটা উড়িয়ে দেয়।

সুপ্রতীক টেলিফোনে বলেছে, ‘তুমি হড়বড় করে বাবাকে কিছু বলতে যেয়ো না। আমি ফিরে যা বলার বলব।’

শর্মিলা চাপা গলায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘কেন? আমি বলব না কেন? আমি কী দোষ করলাম?’

‘আহা, তোমার দোষের প্রশ্ন উঠছে কেন?’ ওপাশ থেকে ফিসফিস করে বলল সুপ্রতীক।

কাঁদোকাঁদো গলায় শর্মিলা বলে, ‘উঠছে না? সবাই তো আমার দিকেই আঙুল তুলবে। বলবে নিশ্চয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করে… ছি ছি, এরপর মুখ দেখাতে পারব?’

সুপ্রতীক একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘তোমার সঙ্গে কিছু হয়নি তো শর্মিলা?’

‘আমার সঙ্গে! আমার সঙ্গে কী হবে?’ এবার সত্যি সত্যি চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে শর্মিলার। বলে, ‘তুমি এখনই বলতে শুরু করেছ!’

সুপ্রতীক গলা নরম করে বলে, ‘আহা, ওভাবে কথাটা নিচ্ছ কেন? হয়তো ডাইরেক্ট কিছু হয়নি, ধরো, উনি তোমার কোনও কথায় দুঃখ পেয়েছেন অথবা কোনও আচরণে। তুমি বুঝতে পারোনি।’

‘কী বুঝতে পারব না? খানিক আগেই তো কত গল্প করলাম, উনি ভাত খেতে বসেছিলেন। নাতনিদের নাচ-গান নিয়ে হাসাহাসি করলেন, কাল রাতদুপুর পর্যন্ত তোমার দুই মেয়ে নাকি জ্বালিয়ে মেরেছে। রেগে থাকলে কেউ অমন হাসাহাসি করতে পারে!’

‘আচ্ছা, চন্দ্রাবলী-চন্দ্রাবতী কিছু করেনি?’

শর্মিলা এবার হিসহিসিয়ে উঠল। বলল, ‘তোমার মাথা কি একেবারে গেছে? ক্লাস ফোরের দুটো মেয়ে কী করবে? আর যদি করেও থাকে, উনি একেবারে বাড়ি ছেড়ে…।’

সুপ্রতীক ফোনেই যেন নিজের মনে বলল, ‘ঠিকই তো। তা-ই বা কী করে হবে? কিছুই বুঝতে পারছি না শর্মিলা। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কোনও কারণ নেই তবু… আমি নিজেও যে ওঁকে আঘাত দেওয়ার মতো কিছু বলেছি এমন তো নয়, সেদিন শুধু বললাম, অতবার দোকান বাজার ছুটো না বাবা। নাতনিরা রং পেনসিল চাইল, লজেন্স চকোলেট চাইল অমনি গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে ছুটলে, বয়স বাড়ছে না? তা হলে কী এমন ঘটল? যাক, আমি ফিরে দেখছি।’

শর্মিলা চোখ মুছে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘হ্যাঁগো, তোমার মামা কোনও পরামর্শ দেয়নি তো? ওর মাথায় কিন্তু নানারকম বদ মতলব খেলে।’

সুপ্রতীক বলল, ‘খেপেছ! বাবা কারও পরামর্শ শুনে চলার মানুষ? তা ছাড়া পরামর্শ দিয়ে ওদের লাভ কী?’

‘লাভ কিছু নয়, হিংসে। ছেলে, ছেলের বউ, নাতনিদের নিয়ে বুড়ো মানুষটা এমন সুন্দরভাবে মিলেমিশে আনন্দে রয়েছেন সেই দেখে হিংসে। ক’টা বাড়িতে এমন হয়?’

এত সমস্যাতেও সুপ্রতীক হেসে ফেলল, ‘এটা বাড়াবাড়ি ধরনের ভাবনা হয়ে যাচ্ছে শর্মিলা। যাক, আমি তাড়াতাড়ি ফিরছি। ততক্ষণ তুমি কিছু বোলো না। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। জানোই তো বাবা একবার কোনও ডিসিশন নিয়ে ফেললে নড়চড় হয় না, তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আরও একটা জিনিস হতে পারে।’

‘আবার কী?’

‘শুনেছি সমাদ্দারটা নাকি আজকাল মিথ্যেও বলছে। নিচু গলার কারণে, মনটাও নিচু হয়ে গেছে। তাই যদি হয়…।’

এ প্রান্তে কপালে ডান হাত ঠেকিয়ে শর্মিলা বলল, ‘তাই যেন হয় ঠাকুর, বানানোই যেন হয়।’

বিকেলে শ্বশুরমশাই ঘুম থেকে উঠলে রোজকার মতো শর্মিলা চা দিতে গেল। মন খারাপ হলে কী হবে, এই কাজে শর্মিলার কখনও গোলমাল হয় না। বরাবরই শর্মিলা চায়ের বাপারে সতর্ক। বিছানায় আধশোয়া অবস্থাতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে শ্বশুরমশাই হাসলেন।

‘থ্যাঙ্কু। আমাদের বাড়ির নাচিয়ে গাইয়ে দুই ওস্তাদ স্কুল থেকে ফিরেছে নাকি?’

শর্মিলা অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘এবার ফিরবে। আমি ওদের টিফিন করতে যাব।’

‘শোনো শর্মিলা, আজ কিন্তু আমার একটা আবদার তোমায় রাখতে হবে।’

শর্মিলা ভুরু কোঁচকাল। অনুরোধ! অবাক গলায় বলল, ‘বলুন।’

‘আজ তোমাকে মেয়ে দুটোর জন্য লুচি ভাজতে হবে। শুধু ভাজলেই চলবে না, খেয়াল রাখতে হবে, লুচি যেন ফুলকো হয়। নাতনি দুটোকে কাল রাতে বলেছি, ওদের নাচগানে আমি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছি, পুরস্কার হিসেবে আজ ফুলকো লুচি আর মণ্ডা মিঠাইয়ের ব্যবস্থা করা হবে। মিঠাইয়ের ব্যবস্থা আমি করব, কিন্তু লুচির জন্য তুমি ভরসা। হা হা।’

শর্মিলা চমকে ওঠে। এই চমৎকার মানুষটাই অমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন! হতেই পারে না। কিছুতেই হতে পারে না। সুপ্রতীক নিশ্চয় কোথাও গোলমালা করছে। অফিসের লোক মজা করেননি তো? অফিসের সব লোক ভাল হয় না। তারা বিচ্ছিরি ধরনের ঠাট্টা করতে ভালবাসে। সুপ্রতীক যে বলেছিল, ওই সমাদ্দার না তালুকদার মিথ্যে কথা বলে? নিশ্চয় তাই হয়েছে। শর্মিলা কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলাল। থাকুক, সুপ্রতীক কিছু বলতে বারণ করেছে।

‘তোমার রান্নাঘর রেনোভেশনের কাজ এগোচ্ছে তো শর্মিলা? বলদেওকে আমার সঙ্গে একবার কথা বলতে বোলো দেখি। এতদিন পরে কাজটা যখন হচ্ছে ভাল করেই হওয়া দরকার।’

আলো কমে আসা বিকেলে ঘুপচি রান্নাঘর আরও অন্ধকার। ময়দা মাখতে মাখতে শর্মিলা নিশ্চিন্ত হল, সুপ্রতীকের খবর সত্যি নয়। এই চমৎকার মানুষটার কিছু হয়নি। রাগ অভিমান হলে লুচি, রান্নাঘরের কথা কেউ হাসতে হাসতে বলতে পারে? কখনওই নয়। সুপ্রতীক ফিরে আসার পর যখন সে তার বাবাকে কথাটা বলবে, তখন যে খুব একচোট হাসাহাসি হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। গল্পটা শুনে মানুষটার মুখ কেমন হবে? ঘাবড়ে যাবেন? নাকি লজ্জা পাবেন? মনে হয় খুব জোরে একটা হাসি দেবেন। আচ্ছা, সে যদি সেইসময় নরমাল গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, আপনি কোন সুটকেসটা নিয়ে যাবেন? জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করি?’ এতে হাসি কি বাড়বে? মনে হয় বাড়বে। চন্দ্রাবলী-চন্দ্রাবতী পড়া ফেলে ছুটে এসে দাদুর ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং কিছু না জেনে তারাও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে।

দৃশ্যটা ভেবে শর্মিলা নিজের মনেই হাসল।

দ্রুত টেনশন মুক্ত হতে হতে শর্মিলা সিদ্ধান্ত নিল, নতুন রান্নাঘরের একপাশে একটা ছোট্ট টিভি সেট রাখা হবে। এতে প্রোগ্রাম দেখতে দেখতে হাতেকলমে রান্না শিখতে সুবিধে হবে।

কলিং বেল পর্যন্ত হাত যায় না বলে, রোজই স্কুল থেকে ফিরে চন্দ্রাবতী এবং চন্দ্রাবলী প্রবল উৎসাহে দরজায় ধাক্কা মারে। যেন আজ স্কুলে তাদের দরজা ধাক্কা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। দরজা খুলে শর্মিলা প্রথমেই জোর ধমক লাগায়। আজ লাগাল না। দরজা খুলে একগাল হেসে বলল, ‘তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে নাও, তোমাদের দাদু তোমাদের জন্য লুচি-মণ্ডার ব্যবস্থা করেছে।’

সন্ধের মুখে মুখে চন্দ্রাবতী-চন্দ্রাবলী তাদের মায়ের কাছে এসে একটা মজার খবর বলতে বলতে হেসে কুটোপাটি খেতে লাগল। ধমক দেওয়ার পর জানা গেল, খানিক আগে তাদের দাদু নাকি মস্ত একটা সুটকেস নিয়ে খুব ঝামেলায় পড়েছিল। ঠেসে জামাকাপড় ভরার পর আর সুটকেস বন্ধ করতে পারে না! শেষ পর্যন্ত দুই বোন ওপরে বসে…

শর্মিলার মেজাজ ভাল নেই। চকোলেট কেক ঠিকমতো হয়নি। দুই মেয়েই টেস্ট করতে গিয়ে নাক কুঁচকেছে। এই হয়েছে এক ঝামেলা। নতুন রান্নাঘর মনের মতো হলেও, খাবারগুলো সবসময় মনের মতো হচ্ছে না। আজও হয়নি। আবার যে চেষ্টা করবে সে সময়ও নেই। বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। উত্তরপাড়া একেবারে কম পথ নয়। গঙ্গার ধারের বৃদ্ধাবাস পর্যন্ত পৌঁছাতে আরও খানিকটা যেতে হয়। সেই বাড়ির দোতলার গঙ্গামুখী বারান্দায় বসে আছেন এক বৃদ্ধ। আজ তাঁর জন্মদিন। তিনি ছেলেমানুষের মতো ছটফট করছেন। এত দেরি হচ্ছে কেন? কখন ওরা আসবে? নাতনিরা কখন ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলে কেকের টুকরো মুখে তুলে দেবে?

বৃদ্ধবাসের অনেকেই তাঁর এই ছটফটানি দেখে হাসাহাসি করছে। করুক। তাঁর কিছু এসে যায় না। আর কেউ না জানুক, তিনি তো আসল কথা জানেন। জীবনের বাকি দিনগুলো সংসারে থাকার জন্যই যে তিনি সংসার ছেড়েছেন। ঘরবাড়ির নকল সংসার নয়, সত্যিকারের সংসার।

সাপ্তাহিক বর্তমান, ২৪ জানুয়ারি ২০০৯

1 Comment
Collapse Comments

শেষটা ভালো এবং অন্যরকম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *