দিঘি

দিঘি

আবার দেখা দিল!

দেখা দিল সেই একই জায়গায়! রাস্তার ঠিক ওপাশে, ফুটপাথ টপকে। সারি সারি দোকান বাজার, বাড়িঘর এক টানে সরিয়ে ফেলে টলটল করছে জল। সকালবেলার ঝকঝকে আকাশ তাতে ছায়া ফেলেছে। নীল ছায়া। মনে হচ্ছে নিজের একটা টুকরো ভেঙে নীচে ফেলে রেখেছে।

জগন্নাথ প্রথমে চোখ কচলাল তারপর মাথা ঝাঁকাল। অনেকসময় মাথা ঝাঁকালে মিথ্যে দৃশ্য চোখের সামনে থেকে সরে যায়। এই জিনিস কিন্তু সরল না। উলটে আরও স্পষ্ট হল! পানকৌড়ি ধরনের কোনও একটা পাখি সেই ঝকঝকে নীল জলে টুপ করে ডুব দিল!

মিথ্যে জলে, মিথ্যে পানকৌড়ি!

সবটাই মুহূর্তখানেকের জন্য। যেন সিনেমার দৃশ্য। নিমেষে এসে পরদা থেকে সরে গেল নিমেষেই। আবার ফিরে এল সেই দোকানবাজার, বাড়িঘর। সেই এটিএম কাউন্টার! সেই ফুটপাথের গায়ে পার্ক করা ইনোভা গাড়ি।

জগন্নাথের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কাঁপা দুটো হাতে বারান্দার রেলিং চেপে ধরল সে। স্পর্শ না করেও বুঝতে পারল ভোরের এই আলগা শীতেও তার কপালে। ঘাম জমেছে।

ঘাম হওয়া আশ্চর্যের নয়। বালিগঞ্জের মোড়ের কাছে যদি চোখের সামনে হঠাৎ একটা বড়সড় দিঘি দেখা দেয়, আর সেই দিঘির জলে যদি পানকৌড়ি ডুব মারে, তা হলে ঘেমে ওঠাটাই স্বাভাবিক। আরও বড় কিছু হলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

আজ প্রথম নয়, এই নিয়ে ঘটনাটা পরপর দু’দিন ঘটল। জগন্নাথ মাথা ঠান্ডা করে বোঝার চেষ্টা করে। একেই কি হ্যালুসিনেশন বলে? মায়া? নাকি অন্য কিছু?

প্রথমদিন জিনিসটা দেখা দিয়েছিল রাতে। ঘড়ি দেখেনি জগন্নাথ। তবে এগারোটার কিছু পরেই হবে। রাতের খাওয়া শেষ করে সবে বেডরুমে এসে দাঁড়িয়েছিল জানলার সামনে। সাততলার ওপর ফ্ল্যাট। রাতের এই সময়টা দক্ষিণের জানলায় হু হু করে হাওয়া দেয়। স্কাইস্ক্যাপার, ফ্লাইওভার, শপিংমলে ধাক্কা খাওয়ার পরও সেই হাওয়ায় একটা বুনো এলোমেলো ভাব। শহুরে হাওয়া কোথা থেকে যে এই ভাবটা পায়! মনেই হয় না কলকাতায় আছি। বেশি কথা বলা প্রমোটার ছোকরা এক গাল হেসে বলেছিল, ‘ফ্ল্যাটটার দাম যেটুকু বেশি মনে হচ্ছে দাদাভাই, তা আসলে হাওয়ার জন্য।’

জগন্নাথ অবাক হয়ে বলল, ‘হাওয়া!’

প্রোমোটার মুচকি হেসে বলল, ‘অবাক হচ্ছেন দাদাভাই। অবাক হবেন না। কলকাতা শহরে এখন মাটির দাম নেই, দাম হল হাওয়ার। আগে ছিল জলের দর এখন হচ্ছে হাওয়ার দর।’

‘হাওয়ার দর! মানে? কী বলছ আবোল তাবোল?’

বকবকানি ছোকরা আবার হেসেছিল। ভুরু নাচিয়ে লেকচারের কায়দায় বলল, ‘মানে খুব সোজা দাদাভাই। তিন-চারতলায় ফ্ল্যাট আর আজকাল কেউ নিচ্ছে না। কেন জানেন? কারণ ওসব ফ্ল্যাটে আজকাল আর আলো বাতাস ঢোকে না। আমার হাতে ওই জিনিস অনেক আছে। ইচ্ছে করলে দু’-পাঁচটা এখনই দেখিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ও জিনিস আপনাদের পছন্দ হবে না। নীচের দিকে জায়গা নেই বলে কলকাতা বাড়ছে ওপরের দিকে। যত বাড়ছে দাদাভাই, নীচের আলো বাতাস তত আটকাচ্ছে। এই যুগ হল টাওয়ারের যুগ। আপনাকে যে সাততলাটা বেছেবুছে দেখাচ্ছি তা কি আর এমনি এমনি? কদিন পরে মনুমেন্টের ডগায় না উঠলে বাতাস কী জিনিস কলকাতার মানুষ ভুলে যাবে। চারপাশে ওনলি ভ্যাকুয়াম। সেইদিন এলও বলে।’

ছোকরার বকবকানি পুরোটা মনে না ধরলেও, অনেকটা ধরেছিল। শুধু মনের ব্যাপার নয়, ঘটনা সত্যিও। বেডরুমের জানলাদুটো খুলে দিতেই রঞ্জনার চুল হাওয়ায় উড়তে লাগল। সম্ভবত সেদিনটা ছিল খানিকটা ঝোড়ো হাওয়ার। প্রোমোটার জানলার গ্রিলে হাত রেখে বীরদর্পে হেসে বলেছিল, ‘কী দিদিভাই, বলেছিলাম কি না হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে? বলেছিলাম তো?’

রঞ্জনা মাথার চুল, গায়ের আঁচল ঠিক করতে করতে গদগদ গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ ভাই বলেছিলে। আমার খুব পছন্দ। হ্যাঁগো, তোমার কেমন লাগছে?’

নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর রঞ্জনার গোছগাছের বাতিক বেড়েছে। ঠাট্টা করলে বলে, ‘বাতিক বলছ কেন? নিজের বাড়ি সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে কার না ভাল লাগে?’

‘বাড়ি! সাড়ে আটশো স্কোয়ার ফুটের একটা পুচকে ফ্ল্যাটকে বাড়ি বলছ!’ জগন্নাথ কৌতুকে তাকায়।

রঞ্জনা চোখ বড় করে বলে, ‘বাঃ বাড়ি নয়? নিজের বাড়ি তো বটেই। সাড়ে আটশোই হোক আর সাড়ে তিনশোই হোক। তোমার ওই সন্তোষপুরের তিনতলা বাড়িকে আমি কখনই নিজের ভাবিনি। বিয়ের এতগুলো বছর হয়ে গেল, এখনও এটা শ্বশুরবাড়িই। পরের। তা ছাড়া এটা কত সুন্দর। যে দেখছে সবাই বলছে। বলো, বলছে কি না? ছোড়দি সেদিন বলল, যেতেই ইচ্ছে করছে না রে, এমন হাওয়া বাতাসের ঘর।’

গর্বিত হাসল রঞ্জন।

হাওয়া বাতাসের ঘর কিনতে জগন্নাথকে অনেক দেনা করতে হয়েছে। একেবারে গলা পর্যন্ত। ব্যাঙ্ক লোনে কুলোয়নি। ব্যক্তিগত ভাবেও ধার নিতে হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ, আত্মীয়স্বজন যার কাছ থেকে যতটা পাওয়া গেছে। আপত্তি করেছিল জগন্নাথ। তার চাকরিতে এত বিলাসিতা মানায় না। রঞ্জনা শোনেনি। সমানে চাপ দিয়েছে।

‘বাড়ি তো দশবার কিছু না, একবারই কিনছ।’

‘তা বলে এত দাম দিয়ে।’

‘আহা, লোকেশনটা দেখবে না। তার ওপর ফ্ল্যাটের পজিশন? শুধু যে ওপরে তা তো নয়, তার ওপর আবার সাউথ ফেসিং।’

জগন্নাথ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘অতটা দেনা ঘাড়ে নিয়ে সাউথ, নর্থ ফেস করার ইচ্ছে থাকবে ভেবেছ? ভাল করে ভাবো রঞ্জনা। হুট করে কাজটা করে ফেলার আগে দশবার ভাবা উচিত। এত লোন শোধ হবে তো? পারবে?’

রঞ্জনা মুখ ঘুরিয়ে বলেছিল, ‘আমার ভাবা হয়ে গেছে। ওটাই নেব। আমার গলার হার আর দুটো চুড়ি বাঁধা দেব ঠিক করেছি।’

সেদিন রাতে জগন্নাথ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে দেনার হিসেবই কষছিল। মাসিক কিস্তির সঙ্গে সংসার খরচের যোগবিয়োগ! টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। ছেলেমেয়ে হলে এই টানাটানিও আরও বাড়বে। দক্ষিণ খোলা জানলার হাওয়া চিন্তা কমাতে পারছিল না, বরং বাড়াচ্ছিল। ডাইনিং থেকে খুটখাট আওয়াজ আসছে। রঞ্জনা টেবিলে গোছাচ্ছে। সবসময়ের কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে সে। টাকাপয়সার কারণেই ছাড়িয়েছে। মুখে অবশ্য সেকথা বলে না। বলে, ‘ফ্ল্যাটে সবসময়ের কাজের লোক চলে না। তা ছাড়া ওরা কাজের থেকে অকাজই করবে বেশি। যা নোংরা, মা গো।’

চিন্তিত মনে সিগারেট ধরিয়ে বাইরে, নীচে তাকাল জগন্নাথ। অনেক নীচে। আর তখনই দিঘিটা দেখতে পেল সে! রাস্তার ওপাশে, অলস ভঙ্গিতে, অনেকটা জায়গা জুড়ে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে যেন। জলে রাতের আলো পড়েছে। রাতের অন্ধকার পড়েছে।

ঠোঁটের সিগারেট হাতে নিয়ে ভুরু কোঁচকাল জগন্নাথ। জল! বালিগঞ্জে জল আসবে কোথা থেকে? তা ছাড়া ফুটপাথের ওদিকটায় তো সারি সারি দোকানবাজার, বাড়ি। এটিএম কাউন্টার। মোবাইল শপ। ফ্ল্যাট দেখতে আসার সময়েই রঞ্জনা খুশি হয়ে বলেছিল, ‘ইস কী সুবিধে বলো! রাস্তা টপকালেই হাতের কাছে সবকিছু। সন্তোষপুরের মতো কথায় কথায় রিকশা ধরতে হবে না।’

জগন্নাথ জানলার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে ভাল করে দেখতে চাইল। হ্যাঁ, ওই তো, জলই তো! যতদূর চোখ যায়। রাস্তার তীব্র তীক্ষ্ণ আলো পড়ে সেই জল কোথাও কোথাও চকচক করছে। ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটে কেঁপে কেঁপে উঠছে!

হাওয়ায় একটা জোলো, সোঁদা গন্ধ না?

রঞ্জনার ঘরে-ঢাকা আওয়াজে সংবিৎ ফিরল জগন্নাথের।

‘দেখছ তো, তুমি ফ্ল্যাটটার কেমন প্রেমে পড়ে গেছ? জানলা থেকে নড়তেই চাইছ না।’

জগন্নাথ মুখ না ফিরিয়েই বিড়বিড় করে বলেছিল, ‘না ঠিক তা নয়…।’

রঞ্জনা দরজা আটকে দ্রুত হাতে পোশাক বদলাতে থাকে। এখানে আসার পর মনের মতো একটা রাত্রিবাস কিনেছে সে। এমনিতে গা দেখা যায় না, তবে খুলতে সোজা। আগেরটায় জগন্নাথ কতবার যে গিট পাকিয়ে ফেলেছিল।

‘আহা লজ্জার কী আছে? কেনার সময় কিন্তু কম গালাগালি দাওনি।’

জগন্নাথ ফিসফিস করে বলল, ‘একবার এদিকে এসো রঞ্জনা।’

‘কী হয়েছে?’

জগন্নাথ খানিকটা ভূতগ্রস্তের মতো গাঢ় গলায় বলে, ‘একটা জিনিস দেখে যাও।’

পিছন ফিরে শাড়ি খোলে রঞ্জনা। অন্তর্বাসের জঞ্জাল থেকে মুক্ত হতে হতে বলে, ‘এত ওপর থেকে একটা কেন, সবটাই ভাল। তুমি সিগারেটটা ফেলো দেখি, ফ্ল্যাটে সিগারেটে খুব অসুবিধে হয়।’

হাতের সিগারেট হাতেই পুড়ছিল জগন্নাথের। দিঘি তার জল, আলো, ছায়া নিয়ে সরে গেছে ততক্ষণে! আবার সেই ঘরবাড়ি। সেই ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া দু’-একটা রাতের মানুষ। সেই এটিএম বুথ। সেই মোবাইল শপের ঝলমলে আলো।

রাত্রিবাসের বুকের বোতাম না আটকেই রঞ্জনা জগন্নাথের পাশে এসে দাঁড়াল। দাঁড়াল ঘনিষ্ঠ হয়ে। স্বামীকে শরীরের স্পর্শ দিয়ে। এত ওপরে এই আরেক সুবিধে। আশেপাশে থেকে উঁকি মারার কেউ নেই। জগন্নাথ যদি তাকে এখন জড়িয়ে চুমুও খায় কেউ দেখতে পাবে না। সন্তোষপুরের বাড়িতে এটা অসম্ভব ছিল। চুমু তো দূরের কথা, দু’জনে মিলে একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার পর্যন্ত উপায় ছিল না।

‘কী দেখছ?’

জগন্নাথ অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘জানো রঞ্জনা, এইমাত্র ওদিকটায়, ওপাশে…।’

জগন্নাথ চুপ করতে রঞ্জনা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী ওপাশে?’

জগন্নাথ নিজেকে সামলাল। সে যা দেখেছে সেকথা রঞ্জনাকে বলতে গেলে একটা বিরাট হাসাহাসির কাণ্ড হবে। ঘটনা তো হাসাহাসিরই। রাস্তার পাশে বাড়িঘর গজাতে পারে, দোকানপাট বসতে পারে, একটা বড়সড় দিঘি তো তৈরি হতে পারে না।

রঞ্জনা বলল, ‘কী হল, বললে কী দেখেছ?’

জগন্নাথ সিগারেটের টুকরো জানলা গলিয়ে ফেলে দিল, তারপর হেসে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে।

‘দেখি, একটা লোক রাস্তার ওপাশে, ফুটপাত ধরে দৌড় দিচ্ছে।’

রঞ্জনা চোখ বড় করে বলল, ‘সে কী গো। মারামারি নাকি?’

জগন্নাথ স্ত্রীর দিকে ঘন হয়ে এসে বলল, ‘মনে হয় না।’

‘মনে হয়, বাড়িতে বউ অপেক্ষা করছে। তোমার মতো এইরকম সুন্দর হয়ে।’

রঞ্জনা হাত দিয়ে স্বামীর মুখ সরিয়ে লজ্জা লজ্জা হাসল। ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘যাঃ যত ফাজলামি। নিজের ফ্ল্যাটে এসে খুব ফাজলামি বেড়েছে না?

পরদিন থেকে আর মিথ্যে দিঘির কথা মনে রাখেনি জগন্নাথ। রাতে মানুষ কতরকম ভুল শোনে, ভুল দেখে সব কি মনে রাখা যায়? নাকি রাখতে হয়?

মনে পড়ল আবার আজ সকালে। প্রায় দশদিন পেরিয়ে। আবার দিঘিটা দেখার পর।

রঞ্জনা এখনও ওঠেনি। সন্তোষপুরে অনেক ভোরে বিছানা ছাড়ত। এখানে ঘুম ভাঙার পরও খানিকটা গড়িয়ে নেয়। বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল জগন্নাথ। একেবারে কাক ভোরে যাকে বলে। শহরের ঘুম ভাঙব ভাঙব করছে। রাস্তায় একটা দুটো করে লোকজন হাঁটছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে অল্প অল্প। বেশ লাগছে। অনেকটা ওপর থেকে লোকজন, পথঘাট দেখতে অন্যরকম লাগে। নিজেকে সবার থেকে আলাদা মনে হয়। ক’টা বছর কষ্ট করে যদি দেনার বোঝা হালকা করা যায়, তা হলে বলতে হবে রঞ্জনা সত্যি একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেয়েরা একই সঙ্গে অবুঝ আর সাহসী হয়। রঞ্জনা সাহস না করলে সে কিছুতেই এত খরচ করে ফ্ল্যাটটা নিত না।

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জগন্নাথ মুখ তুলে তাকায় এবং আবার দিঘিটা দেখতে পায়। দিনের আলোয় জলরেখা স্পষ্ট! একটু একটু যেন ঢেউও আছে! একটা পানকৌড়ি পর্যন্ত!

রঞ্জনা প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে মুচকি হেসে বলল, ‘জল মানে? সুইমিংপুল?’

কষ্ট করে হাসল জগন্নাথ।

‘ঠাট্টা করছ?’

‘বাঃ তুমি বালিগঞ্জের রাস্তায় আস্ত একটা দিঘি দেখতে পাচ্ছ আর আমি ঠাট্টা করতে পারব না?’

জগন্নাথ বউয়ের কাছে স্মার্ট হতে চাইল।

‘দিঘি দেখতে পাচ্ছি তো বলিনি, বলেছি দিঘির মতো লাগছিল।’

‘মরীচিকা?’

এখানে আসার পর খাওয়ার দাওয়ার ব্যবস্থা রঞ্জনা সবই কাচের প্লেটে করেছে। প্লেটগুলোও সুন্দর। পাশে হালকা নকশা। আগে ভাতেই মুসুরির ডাল ঢেলে দিত। এখন ডালের জন্যও আলাদা বাটি। সেই বাটি টেনে নিতে নিতে জগন্নাথ বলল, ‘মরীচিকা ঠিক নয়, এক ধরনের আলো ছায়ার মায়া বলতে পারো। কে জানে হয়তো এতটা ওপর থেকে কোনও কোনও সময় আলো এমনভাবে পড়ছে মনে হচ্ছে জলের মতো। চকচক করছে।’

‘আর বাড়িঘর, দোকানবাজারগুলো সব যাচ্ছে কোথায়? জলে ডুব মারছে?’

মুখ টিপে হাসল রঞ্জনা। তারপর প্লেটে ভাত তুলে দিতে দিতে বলল, ‘ঠিক আছে আমি দেখব তো, আলো নিশ্চয় তোমার জন্য একা পড়বে না। আমার জন্যও পড়বে। আমাকেও দিঘি দেখাবে। ভালই হবে। ফ্ল্যাট থেকে খানিকটা নেচারল বিউটি পাওয়া গেল।’

‘তুমি কিন্তু আবার ঠাট্টা করছ রঞ্জনা।’

‘আচ্ছা, করব না, আসলে কী হয়েছে জানো, টাকাপয়সার চিন্তায় তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে। সেই কারণে তুমি যা-তা দেখতে শুরু করেছ। এখন বালিগঞ্জে জল দেখছ, এরপর শ্যামবাজারে পাহাড় দেখাবে।’

জগন্নাথ এবার লজ্জা পেল। না, দুম করে ঘটনাটা রঞ্জনাকে বলা উচিত হয়নি। সত্যি তো একটা ছেলেমানুষি কাণ্ড। চিন্তাভাবনার মধ্যে থাকলে কত কী যে হয়। জগন্নাথ খাওয়ায় মন দিল। অফিসে লেট হয়ে যাবে। সামনে একটা প্রোমোশনের চান্স আছে। হয়ে গেলে মাইনে বাড়বে। এখন মাইনে বাড়ার খুব প্রয়োজন। খেতে খেতেই মনকে শক্ত করল জগন্নাথ। যেন পণ করল, আর কিছুতেই উলটোপালটা দেখবে না।

মজা হল, মানুষের অনেক কিছুর ওপর যেমন নিয়ন্ত্রণ থাকে তেমন আবার অনেক কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিশেষ করে নিজের ওপর। জগন্নাথেরবেলাতেও তাই ঘটল। সে আবার পথের ধারে ঘরবাড়ি মানুষ শূন্য করে দিঘিটা দেখতে পেল। এবার অনেক দ্রুত এবং পরপর।

সাইক্রিয়াটিস্ট ভদ্রলোক গম্ভীর ধরনের মানুষ। ভারী গলায় বললেন, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে আপনি সত্যি সত্যি জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন?’

‘না, ডাক্তারবাবু আমি বিশ্বাস করি না।’

জগন্নাথ ভেবেছিল, এই স্বীকারোক্তিতে ডাক্তার খুশি হবেন। হলেন না। ভদ্রলোকের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। ‘হ্যালুসিনিশনের এটাই সমস্যা। গোড়াতে মিথ্যে বলেই বিশ্বাস হয়। পরে সেই বিশ্বাস বদলায়।’

‘কী হয়?’

ডাক্তার এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘ঝামেলা করে।’

জগন্নাথ কঁদোকাঁদো বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমার কি মাথার গোলমাল হয়েছে?’

সাইক্রিয়াটিস্ট ভদ্রলোক এতক্ষণ পরে সামান্য যেন হাসলেন।

‘মাথায় কখনও গোলমাল হয় না। গোলমাল থাকে। কারওটা ধরা যায়, কারওটা ধরা যায় না’

‘আমারটা কি ধরা গেছে?’

‘মনে হয় না। হ্যালুসিনেশনে আমরা সকলেই ভুগি। তবে আপনার মতো একটানা হয় না। তার ওপর একটা অন্যরকম। ইট কাঠ পাথর সরিয়ে একটা ওয়াটার বডি দেখতে পাচ্ছেন.. আচ্ছা, আপনার দেশ কোথায়? আপনি কি গ্রামে বড় হয়েছেন? অনেক সময় স্মৃতি ভিসুয়ালি ফিরে আসে।’

জগন্নাথের খুব খারাপ লাগছে। বিষয়টা যে এত প্রকটভাবে দেখাবে সে ভাবতেও পারেনি। রঞ্জনাও খুব আপসেট হয়ে পড়েছে। যে হাওয়া-বাতাসের জানলাটার জন্য এত দাম দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা সেটাই পাকাঁপাকি বন্ধ করে দিয়েছে। মজার কথা হল, সাততলার ওপর থেকে ছাড়া দিঘিটা কখনও দেখাও দেয়নি! অন্তত আজ পর্যন্ত তো নয়ই। রঞ্জনাই তাকে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে জোর করে পাঠাল। নিজেও আসতে চেয়েছিল। জগন্নাথই রাজি হয়নি। বলেছে, ‘আগে আমি যাই, সিরিয়াস কিছু হলে তুমি যেয়ো।’

ডাক্তার বললেন, ‘কী হল বললেন না, দেশের বাড়িতে কোনও পুকুরটুকুর আছে?’

জগন্নাথ গলা নামিয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু, দেশের বাড়ি বলতে আমার আলাদা কিছু নেই। কলকাতাতেই আমার জন্ম। এখানেই লেখাপড়া, বড় হয়েছি।’

ডাক্তার প্রেসক্রিপশনের প্যাড টেনে নিয়ে বললেন, ‘কোনওরকম টেনশন আছে?’

জগন্নাথ একটু চিন্তা করল। ভাঙা গলায় বলল, ‘ফ্ল্যাটটা অনেক খরচ করে কিনেছি, অনেকটা লোন, তা ছাড়া…।’

‘তা ছাড়া কী?’ চশমার ওপর দিয়ে তাকালেন ডাক্তার।

‘তা ছাড়া অফিসে একটা প্রোমোশনের ব্যাপারও আছে।’

‘ও। এটাই তো আগে বলবেন। চিন্তা করবেন না। স্ট্রেস থেকে হ্যালুসিনেশন একটা কমন ব্যাপার। ওষুধ লিখে দিচ্ছি, আজ থেকেই শুরু করবেন। থ্রি উইকস পরে রিপোর্ট করবেন। আশা করি তার মধ্যে অনেকটা ঠিক হয়ে যাবেন।’

জগন্নাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এরকম কেন হচ্ছে ডাক্তারবাবু? আমার ভয় করছে। স্ত্রীও ভীষণ ঘাবড়ে গেছে।’

গম্ভীর ডাক্তার আবার সামান্য হাসলেন।

‘এরকম কেন হচ্ছে সেটা বোঝালে জটিল হয়ে যাবে। আসলে এত চাপ, উদ্বেগ আপনার ভেতরে কোনও কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন শুরু করেছে। তারা আপনার অবচেতনে একধরনের মুক্তির পথ খুঁজছে। খুব সম্ভবত দিঘিটা এক ধরনের সিম্বল। প্রতীক। আপনার উদ্বিগ্ন মনের খোলামেলা কোনও মুক্তির পথ। এটা জল না হয়ে জঙ্গলও হতে পারত। মাসখানেক কেটে গেলে মিসেসকে নিয়ে বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আসবেন।

জগন্নাথ খানিকটা আশ্বস্ত হল

‘থ্যাঙ্কু ডাক্তারবাবু। শেষ একটা কথা জিজ্ঞেস করছি, আমি কি জানলাটা খুলব?’

‘অফকোর্স। আপনার দিঘি তো আপনার ফ্ল্যাটের জানলার বাইরে নেই, আছে আপনার মনের ভেতরে। আশা করি আমার ওষুধ মন থেকে তাকে দূর করবে।’

তিন সপ্তাহ লাগল না, দু’সপ্তাহ যেতে না যেতে ওষুধ কাজ দিল। খুব ভালভাবেই দিল। রঞ্জনা দারুণ খুশি। জগন্নাথও। এর মধ্যে আবার দুটো কাণ্ড ঘটেছে। জগন্নাথের অকৃতদার বড়মামা মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে ভাগনেকে তাঁর বারাসতের জমির একটা অংশ লিখে দিয়ে গেছেন। বিক্রি করলে হেসে খেলে এই ফ্ল্যাটের দাম অনেকটা উঠে আসবে। আর দু’নম্বর কাণ্ড হল, জগন্নাথের প্রমোশনটা হয়ে গেছে।

রাতে রঞ্জনা দক্ষিণের জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দেখলে তুমি টেনশন করতে করতে কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলে। কই এসো তো, দেখো দিকি তোমার ওইসব পুকুর, দিঘি, সমুদ্র আর দেখতে পাও কিনা।’

জগন্নাথ জানত দেখতে পাবে না। তবু সে এগিয়ে এল। তাকিয়ে দেখল, না, কিছুই নেই। সেই ঘরবাড়ি, দোকানের সারি। এত রাতেও আলোয় উজ্জ্বল।

রঞ্জনা হেসে ফিসফিস করে বলল, ‘পাগল একটা।’

জগন্নাথ বলল, ‘আসলে টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে করতে…।’

জগন্নাথ একেবারে ঠিক হয়ে গেছে। সে আর কখনওই তার হাওয়ায় ভেসে যাওয়া ফ্ল্যাটের ওপর থেকে টলটলে জলের মিথ্যে দিঘিটা দেখতে পায় না। তবে নতুন কাউকে ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিতে গেলে মজা করে বলে—

‘ফ্লাইওভারটা পেরোলেই দেখবেন একটা দিঘি। খুব বড়। জল একেবারে টলমল করছে। এর উলটোদিকের ফ্ল্যাটের সাততলায়…।’

ডাক্তারবাবু বা রঞ্জনা এই মজার কথা জানতে পারে না।

নতুন গল্পপত্র, জানুয়ারি ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *