কুঞ্জবিহারীর দুঃস্বপ্ন

কুঞ্জবিহারীর দুঃস্বপ্ন

তীব্র একটা অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল কুঞ্জবিহারী সামন্তর। এ আবার কেমন স্বপ্ন! ধড়ফড় করে উঠে বসলেন কুঞ্জবিহারী। ঘর অন্ধকার। দিনের আলো দেখে মোটামুটি একটা সময় আন্দাজ করা যায়। রাতের অন্ধকারে সেই সুবিধে নেই। সবই এক মনে হয়। রাত এখন কত? কুঞ্জবিহারীর মনে হল, শরীর কাপছে। খুব সামান্য হলেও কাপছে। তিনি হাত বাড়িয়ে মাথার বালিশটা আঁকড়ে ধরলেন। নড়াচড়ায় বিছানায় হালকা তরঙ্গ উঠল। খাটটা এভাবেই তৈরি। একটা স্তরে স্প্রিংগুলো একে অপরকে আলতো করে ছুঁয়ে আছে। সামান্য নড়াচড়াতেই বিছানায় যেন ঢেউ খেলে! একটা সমুদ্র সমুদ্র এফেক্ট। নতুন খাট তৈরির প্রথম রাতে কুঞ্জবিহারী সমুদ্র-খাটে শুয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘বুঝলে প্রতিমা, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়?’

প্রতিমাদেবী এ কথার মানে বুঝতে পারলেন না। স্বামীর কাছে ঘন হয়ে এসে বললেন, ‘মরণ, বুড়ো বয়েসে এইসবের শখ হয়েছে না? নাও যা করবে তাড়াতাড়ি করো, আমার ঘুম পেয়েছে।’

আজ সমুদ্র শয্যার দোলায় ভয় করে উঠল। কুঞ্জবিহারীবাবু ফ্যালফ্যাল করে ঘরের চারপাশে তাকালেন। জায়গাটা কোথায়? নিজের ঘরই তো? অতিরিক্ত আতঙ্কে মানুষ সবার আগে চেনা পরিবেশ খোঁজে। তারপর খোঁজে চেনা মানুষ। হ্যাঁ, নিজেরই ঘর। এই তো তাঁর আলিপুর রোডের দোতলা বাড়ি, এই তো তাঁর সুসজ্জিত বেডরুম। প্রথমে চোখ খুলে অন্ধকার মনে হলেও বেডরুম একেবারে অন্ধকার নয়। আবার খুব আলোকিতও নয়। নাইটল্যাম্প জ্বলছে। চাপা নীলাভ আলোর মধ্যে একটা ফুরফুরে ভাব। সেই ফুরফুরে আলোয় কুঞ্জবিহারী মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, পাশে স্ত্রী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ। হালকা ধরনের নাক ও ভাকছে। কুঞ্জবিহারী অবাক হলেন। নাক ডাকছে! কই, নাক ডাকার অভ্যেস তো প্রতিমার ছিল না। নাক ডাকার মধ্যে একটা সুখী সুখী’ ভাব। কুঞ্জবিহারী স্ত্রীর দিকে আগ্রহ ভরে তাকালেন। ছেচল্লিশ বছরের এই ঘুমন্ত মহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সবথেকে সুখী মহিলা। স্বামী প্রচুর অর্থের মালিক হলে যে-কোনও বোকা ধরনের স্ত্রীই নিজেকে পৃথিবীর ‘সবথেকে সুখী মহিলা’ বলে মনে করতে পারে। দোষ দেওয়া যায় না। একটু বেশি বোকা হলে কি সেই ভাব নাক ডাকার মধ্যেও ফুটে ওঠে?

কুঞ্জবিহারী মুখ ফেরালেন। বুঝতে পারলেন তিনি ঘেমেছেন। গায়ের ফতুয়াটা ভিজেছে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট কটনের এই ফতুয়া ‘মনসুর টেলরিং শপ’ থেকে বানানো। ‘মনসুর টেলরিং শপ’ সুট প্যান্ট ছাড়া অন্য কিছুতে হাত দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। বললে অপমানিত হয়। তবে ‘সামন্ত অ্যান্ড অ্যাসোসিয়টস কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর কুঞ্জবিহারী সামন্তর মতো সামান্য কয়েকজনের বেলায় নিয়ম অন্যরকম। তখন ফতুয়ার মতো তুচ্ছ জিনিসের অর্ডারও তারা হাসিমুখে নিয়ে নেয়। বাড়াবাড়ি ধরনের ধনী মানুষের কোনও কিছুই তুচ্ছ নয়। সেই ফতুয়া ঘামে ভিজেছে। যদিও ভেজার কথা নয়। এসি মেশিন চলছে। আগে একটা ছিল, গত বছর গরম বেশি পড়ার পর প্রতিমাদেবী বেডরুমে মেশিনের সংখ্যা বাড়িয়ে দুটো করেছেন। ঘর বরফ ঠান্ডা। তারপরেও ঘাম। দুঃস্বপ্নটা কি এতটাই ভয়ংকর?

কুঞ্জবিহারী কিছুক্ষণ খাটের ওপর থম মেরে বসে রইলেন। স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে কেমন হয়? তুলে যদি স্বপ্নের ঘটনাটা বলেন? আর কয়েক মাস পরেই চুয়ান্ন শেষ করে পঞ্চান্নতে পা দেবেন। এই বয়েসের একজন পুরুষমানুষের পক্ষে মাঝরাতে স্ত্রীকে ঘুম থেকে তুলে দুঃস্বপ্নের গল্প শোনানো কি উচিত? উচিত নয়। কুঞ্জবিহারী তবু স্ত্রীকে ডাকলেন।

‘প্রতিমা, অ্যাই প্রতিমা। শুনছ?’

স্বামীর ডাক প্রতিমাদেবী শুনলেন না। ঘুমন্ত অবস্থাতেই এপাশ ওপাশ করলেন। পায়ের ওপর গুটিয়ে যাওয়া হালকা কম্বল টেনে তুললেন। এই মহিলার ঘুম আগে ছিল হালকা। অল্প আওয়াজেই চট করে ভেঙে যেত। বিয়ের পর পর ভোর হতেই বিছানা ছাড়তেন। সংসারে হাজারটা কাজ। এখন সে প্রশ্ন নেই। সংসারের কিছুই নিজের হাতে করতে হয় না। সব ধরনের কাজের জন্য সব ধরনের লোক রয়েছে। তিনি নিশ্চিন্তে বেলা পর্যন্ত বিছানায় গড়ান। কাজের মেয়ে চা বানিয়ে আললে অতি কষ্টে চোখ খোলেন। আধশোয়া অবস্থাতে ফিনফিনে কাপ ঠোঁটে তুলে বলেন, ‘গিজারটা চালিয়ে দাও গোপালের মা। গা-টা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। ভাবছি একটা হট শাওয়ার নেব।’

প্রতিমাদেবী আজকাল কথাবার্তায় দু’-একটা ছোটখাটো ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছেন। তবে বেশিটাই বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে। একটা প্র্যাকটিসের মধ্যে থাকার চেষ্টা আর কী। পার্টি-টার্টিতে একটু-আধটু ইংরেজি বলতে না পারলে লজ্জা করে। এত বড়মানুষের স্ত্রী বলে কথা।

কুঞ্জবিহারী স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে নাড়া দিলেন। ফিসফিস করে বললেন, ‘আই শুনছ?’ প্রতিমাদেবী চোখ না খুলে জড়ানো গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে?’। বললেন, ’স্বপ্ন!’

এবার থমকে গেলেন কুঞ্জবিহারী। সত্যি তো কী এমন ঘটছে যার জন্য স্ত্রীর ঘুম ভাঙাতে হল? তিনি খানিকটা লজ্জা পেয়েই বললেন, ‘না, তেমন কিছু হয়নি, একটা স্বপ্ন দেখলাম।’

প্রতিমাদেবী মাথা ঘুরিয়ে এবার চোখ খুললেন। বললেন, ‘স্বপ্ন!’

‘হ্যাঁ, স্বপ্ন…।’ কুঞ্জবিহারী আমতা আমতা করে বলেন।

প্রতিমাদেবী এবার শুয়ে শুয়েই হাসলেন। আহ্লাদি গলায় বললেন, ‘ওমা, সে কী গো, আমিও তো স্বপ্ন দেখছিলাম! খুব মজার স্বপ্ন। তুমি কী দেখলে? অাই বলো না, প্লিজ বলো।’

কুঞ্জবিহারী কিছু একটা বলতে গেলেন, প্রতিমাদেবী শুনলেন না, তিনি নিজেই বলতে থাকে—

‘আমি দেখলাম একটা বাগানে বেড়াচ্ছি আর একঝাক প্রজাপতি আমাকে ঘিরে ঘিরে উড়ছে। হাত বাড়িয়ে একটাকে যেই ধরতে গেলাম অমনি কী হল জানো? আমিও একটা প্রজাপতি হয়ে গেলাম! হি হি। বেগুনি রঙের ডানা, গায়ে হলুদ ফুটি ফুটি। শুনেছি স্বপ্নে কালার দেখা যায় না, আমি কিন্তু কালার দেখলাম গো। খুব মজার না?’

মোটা না হলেও প্রতিমাদেবীর চেহারা ভারীর দিকে। যত দিন যাচ্ছে ভার বাড়ছে। সম্ভবত সুখের ভার। আজকাল অল্প পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে পড়েন। চেয়ার, সোফা থেকে আর আগের মতো চট করে উঠতে পারেন না, অসুবিধে হয়। কাজের মেয়েদের ধমক দেন, ‘হাঁ করে দেখছিস কী গাধা? হাতটা ধরতে পারিস না?’ মুখেও গোলমাল শুরু হয়েছে। বিয়ের সময় যে মুখ লম্বাটে ছিল, ক্রমশ গোল হচ্ছে। গোলগাল মুখের মোটা এক মহিলা প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দৃশ্যটা কতখানি মজার সেই চিন্তার মধ্যে না গিয়ে কুঞ্জবিহারী নিচু গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ মজার। তবে আমারটা সেরকম না। আমারটা মনে হয় দুঃস্বপ্ন।’

প্রতিমাদেবী আঁতকে উঠলেন। আধখানা উঠে বসে বললেন, ‘দুঃস্বপ্ন! ওমা সে কী গো! কী দুঃস্বপ্ন? বদ্যিকে নিয়ে কিছু নয় তো?’

বদ্যি, বদ্যিনাথ। কুঞ্জবিহারী সামন্তর একমাত্র শালা। প্রতিমাদেবী আজকাল তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনকে নিয়ে নানা ধরনের আদিখ্যেতা শুরু করেছেন। সেই আদিখ্যেতা তালিকার প্রথমেই রয়েছে তার এই অপোগণ্ড ভাইটি। জামাইবাবুকে ধরে বদ্যিনাথ ইতিমধ্যেই দু’জায়গায় চাকরি পেয়েছে। দু’জায়গা থেকেই খেদিয়ে দিয়েছে। এখন ব্যাবসা করার ফন্দি আঁটছে। কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘তোমার ভাইকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখব কেন!’

‘আহা, তোমাকে কাল বললাম না, ছেলেটার মনমেজাজ ভাল নেই? বলিনি? কাজকর্ম নেই মন ভাল থাকবে কী করে? তার ওপর কদিন হল সর্দি জ্বরে ভুগছে বেচারি। ছেলেটাকে নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকি।’

কুঞ্জবিহারী থমথমে গলায় বললেন, ‘আমি থাকি না। তা ছাড়া দুঃস্বপ্নটা তোমার ভাইকে নিয়ে নয় প্রতিমা।’

প্রতিমাদেবী চোখ বড় করে বললেন, ‘তা হলে! কাকে নিয়ে? আমাকে?’

কুঞ্জবিহারী বিরক্ত গলায় বললেন, ‘কাউকে নিয়ে নয়, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।’

প্রতিমাদেবী আবার বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বললেন, ‘হ্যাঁগো, সাপ-টাপ নিয়ে কিছু দেখোনি তো?’

কুঞ্জবিহারী আরও বিরক্ত হলেন। না, প্রতিমা সত্যিই অতিরিক্ত রকমের বোকা হয়ে পড়েছে। একে ঘুম থেকে ডেকে তোলাটাই ভুল হয়েছে। তিনি চাপা গলায় হিসহিসিয়ে ওঠেন, ‘সাপ নিয়ে স্বপ্ন দেখব কেন? আমি কি সাপুড়ে?’

’ওমা, ঘুম থেকে ডেকে তুলে ধমক দিচ্ছ কেন? আমার কী দোষ? এমন করছ যেন দুঃস্বপ্ন তুমি দেখোনি, আমি দেখেছি। অ্যাই বলো না সাপ দেখোনি তো? স্বপ্নে সাপ দেখা ভাল নয়। বউয়ের অসুখ করে। শীলার বর একবার সাপ দেখেছিল, দু’দিন পরেই শীলার বুক ধড়ফড় শুরু হল। ডাক্তার বলল ইসিজি করে। স্বপ্নে হাঁস মুরগি দেখাও ভাল নয়। সংসারে অশান্তি হয়। তবে বক দেখা ভাল। তন্দ্রা একদিন ঘুমের মধ্যে বক দেখল, তারপর…।’

কুঞ্জবিহারী অবাক হলেন। ‘তুমি এসব উদ্ভট কথা কোথা থেকে জানলে!’

‘ওমা, শেখার কী আছে! এ তো সবাই জানে। স্বপ্নে কী দেখলে কী হয় তার বইও পাওয়া যায়। ফুটপাথে বিক্রি হয়। তুমি কিন্তু সাপ-টাপ দেখে একটা কেলেঙ্কারি করে বোসো না বাপু। বঙ্কার বিয়ে আছে। তোমার স্বপ্নের ঠেলায় হয়তো কাল সকাল থেকেই আমার পেট ব্যথা শুরু হল। বিয়ে-টিয়ে মাথায় উঠবে। লকার থেকে গাদাখানেক গয়না তুলেছি। গায়ে পরে শুয়ে শুয়ে কাতরাতে হবে।’

কুঞ্জবিহারী হতাশ গলায় বললেন, ‘সাপ ব্যাং কিছুই দেখিনি প্রতিমা। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোও।’

প্রতিমাদেবী পাশ ফিরলেন এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ফের গভীর ঘুমের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। ‘সুখী সুখী’ নাক ডাকাও শুরু হল। স্ত্রীর বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে কুঞ্জবিহারীর ধারণা কোনওদিনও ভাল নয়। অবস্থার যে অবনতি হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছিলেন। মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি আরও কিছুক্ষণ খাটের ওপর বসে রইলেন, তারপর নামলেন নিঃশব্দে। ঘরের একপাশে একটা বামন রেফ্রিজারেটর। বেডরুমে রেফ্রিজারেটর রাখার বুদ্ধি প্রতিমার। মাঝরাতে কনকনে ঠান্ডা জল খাওয়ার ইচ্ছে হলে ঘর থেকে যাতে বেরোতে না হয়। কুঞ্জবিহারী অনেকটা জল খেলেন। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম শরীরের সঙ্গে মনের ওপরও অনেক সময় কাজ করে। সত্যি মন খানিকটা শান্ত হল যেন! স্বস্তিবোধ করলেন কুঞ্জবিহারী। বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিলেন। আরও ভাল লাগছে। ঠান্ডার কারণে শরীরে অল্প একটু কঁপুনি দিচ্ছে। দিক, কোনও অসুবিধে নেই। আতঙ্কের কাঁপুনির থেকে শীতের কাঁপুনি ঢের ভাল। কুঞ্জবিহারী এবার খাটে এসে শুয়ে পড়লেন। এখন অনেকটা সহজ লাগছে। দুঃস্বপ্নটা মাথার ভেতর আবছা হয়ে এসেছে। একটা ঘুমের ওষুধ খেলে খারাপ হত না। হালকা ধরনের কোনও ওষুধ। একসময় হাউজ ফিজিশিয়ন ডাক্তার সেন ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন। অবশ্য সে সময়টা ছিল কঠিন দুশ্চিন্তার সময়। ব্যাবসাপাতির ট্রানজিশন পিরিয়ড। টেন্ডার, অর্ডার সাপ্লাই নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা। অর্ডারের জন্য দরজায় দরজায় ঘুরতে হত। ব্যাঙ্কে বিরাট লোন। রাতে ঘুম আসত না। সেই অবস্থা বছর পনেরো আগে কেটে গেছে। ওষুধ খাওয়াও বন্ধ হয়েছে। দুশ্চিন্তা কি ফিরে আসছে? চোখ বুজলেন কুঞ্জবিহারী। কীসের দুশ্চিন্তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ব্যবসা হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। মাইনে করা দক্ষ ম্যানেজাররা নিখুঁত হাতে কাজ সামলায়। ছোটখাটো কয়েকটা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নাক গলানো ছাড়া প্রায় কিছুই করতে হয় না তাঁকে। দুর্গাপুরের নতুন প্রজেক্ট যে-কোনও মুহূর্তে শুরু হয়ে যাবে। জাপানি এক কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্টভেঞ্চার। দিল্লির ছোট একটা অ্যাপ্রুভালের জন্য আটকে আছে। তদ্বিরের জন্য লোক গেছে। টাকাপয়সা খরচ করা হচ্ছে জলের মতো। যে-কোনও সময় গিঁট খুলে যাবে। তা হলে? কুঞ্জবিহারীর মনে হল, ভাঙা ঘুম ফিরে আসছে। একমাত্র মেয়ে সৌমী বেঙ্গালুরুতে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। পড়া শেষ হতে বছরখানেক বাকি। প্রতিমা খবর দিয়েছে, অর্চি না অর্ক নামের একটা ছেলের সঙ্গে তার ভাব-ভালবাসা হয়েছে। কম্পিউটারে গল্প করতে করতে চেনাজানা। আজকাল ভাব-ভালবাসা নাকি সব কম্পিউটারেই হয়। সেই ছেলের আবার লেখাপড়ায় ঝোঁক। রসায়ন শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা করতে চায়। এটা খুবই ভাল। অর্থাভাবে নিজের খুব বেশি লেখাপড়া সম্ভব হয়নি কুঞ্জবিহারীর, অথচ ইচ্ছে ছিল। শিক্ষিত মানুষদের প্রতি একটা দুর্বলতা রয়েই গেছে। সেখানে খোদ জামাই যদি লেখাপড়ার জগতের লোক হয় তা হলে তো খুবই আনন্দের কথা। সব মিলিয়ে সুখের মধ্যেই আছেন। হাবিজাবি স্বপ্ন নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও মানেই হয় না। মনে প্রশান্তি নিয়ে সমুদ্র-খাটে সামান্য তরঙ্গ তুলে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরলেন কুঞ্জবিহারী। ঘুমিয়েও পড়লেন দ্রুত।

ভোর রাতে দুঃস্বপ্ন আবার ফিরে এল। ফিরে এল আরও ভয়ংকর হয়ে। কুঞ্জবিহারী ঘুম ভেঙে উঠে পড়তে চাইলেন। পারলেন না। তিনি ঘুমের মধ্যেই ছটফট করে উঠলেন। ফতুয়া ঘামে ভিজে উঠল।

ডাক্তার সেন শান্ত গলায় বললেন, ‘একই স্বপ্ন দু’বার দেখলেন?

কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘না, দু’বার নয়, একবারই দেখলাম। মাঝখানে ঘণ্টাখানেকের গ্যাপ। প্রথম পর্যায়টা দেখলাম মাঝরাতে, পরের অংশ ভোরের দিকে। কন্টিনিউটি বলা যেতে পারে।’

অফিস থেকে আগে বেরিয়েছেন কুঞ্জবিহারী। বেরোনোর আগে ডাক্তার সেনকে টেলিফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান। ডাক্তার সেন হেসে বলেন, ‘আপনার আবার অ্যাপয়েনমেন্ট কী? সোজা চেম্বারে ঢুকে পড়বেন। কিন্তু হলটা কী? জ্বর-টর নাকি? সিজন চেঞ্জের সময়।’

কুঞ্জবিহারী শুকনো হেসে বললেন, ‘না, জ্বর নয়। কী হল সেটাই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, কিছু হয়নি।’

‘যা বাবা, কিছু হয়নি তবু ভাক্তারের কাছে!’

‘গিয়ে বলছি।’

দুপুর পর্যন্ত কুঞ্জবিহারী ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। তিনি সময় নিচ্ছিলেন। স্বপ্ন এমনই একটা জিনিস যা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বেশিরভাগ স্বপ্নই ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে উধাও হয়। কুঞ্জবিহারী ভেবেছিলেন, এই ক্ষেত্রেও তাই হবে। যতই দু’পর্যায়ে দেখা দিক, স্বপ্ন বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। লাঞ্চের পর খানিকটা বিশ্রাম নেন কুঞ্জবিহারী। নরম গদির চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ দুটো বুজে থাকেন। আজও ছিলেন। আর তখনই বুঝতে পারলেন, স্বপ্নটা শুধু মনে আছে নয়, একেবারে খুঁটিনাটি নিয়ে মনে আছে! মাথার ভেতর সিনেমার মতো হয়ে চলেছে একটার পর একটা দৃশ্য। এরপরই ডাক্তার সেনকে তিনি ফোন ধরেন।

চেম্বারে বসতে ডাক্তার সেন বললেন, ‘বলুন, সমস্যা কী?’

কুঞ্জবিহারী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘জানি না এটা কোনও সমস্যা কিনা। ডাক্তার সেন, মানুষ কি কখনও একই স্বপ্ন ভাগে ভাগে দেখতে পায়? এখন খানিকটা, আবার পরে খানিকটা? হয় এরকম?’

ডাক্তার সেন একটু থতমত খেলেন। ঠোঁটের কোনায় সামান্য হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো মিস্টার সামন্ত, মনে হচ্ছে স্বপ্ন নিয়ে কোনও গোলমাল হয়েছে?’

কুঞ্জবিহারী অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘কাল রাতে একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখছিলাম, এতটাই বিশ্রী যে খানিকটা দেখার পর ঘুম ভেঙে গেল। মিসেসকে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম।’

‘স্বপ্ন দেখে মিসেসকে ডেকে তুললেন!’

কুঞ্জবিহারী ক্লান্ত হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, কাজটা বোকার মতো করেছি, কিন্তু স্বপ্নটা এতটাই খারাপ ছিল, একটা আনইজি ফিলিংস হচ্ছিল… যাই হোক ওকে কিছু বলিনি। নিজে উঠে জল-টল খেলাম, বাথরুমে গেলাম। মনটা খানিকটা শান্ত হল। ফিরে এসে এপাশ ওপাশ করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভাবলাম মাথা থেকে ঘটনাটা বেরিয়ে গেছে। আসলে বেরোয়নি। পরে আবার বাকিটুকু দেখলাম।’

ডাক্তার সেন অবাক হলেন। এত বড় মানুষটা স্বপ্নের কারণে স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে! অবাক ভাব গোপন করে তিনি কুঞ্জবিহারীর চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলেন, ‘একই স্বপ্ন দু’বার দেখলেন?’ কুঞ্জবিহারী জানান, না একই নয়। স্বপ্নটা একবারই দেখেছেন। তবে দুটো আলাদা ভাগে। ডাক্তার সেন একটু থমকালেন। তিনি বুঝতে পারছেন, মানুষটার মধ্যে একটা ছটফটানি ভাব এখনও রয়েছে। বাইরে থেকে সেই ভাব দেখা না গেলেও, ভেতরে আছে এটা বোঝা যাচ্ছে। টেবিলের ওপর রাখা প্রেসক্রিপশন প্যাডের পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে বললেন, ‘কফি খাবেন? খান, ভাল লাগবে। আমার এখানে কফি তৈরির ব্যবস্থা আছে।’ কুঞ্জবিহারী মাথা নেড়ে জানালেন, খাবেন না। ডাক্তার সেন নরম গলায় বললেন, ‘এতে চিন্তা করার কী আছে? ঘুমিয়ে পড়বার পরও আপনার অবচেতনে হয়তো ঘটনাটা ছিল। ভোরের দিকে সে বাকিটুকু দেখিয়ে দিয়েছে।’

‘তাই হবে। দু’ভাগেই হোক আর দশ ভাগেই হোক, স্বপ্নটা ভাল নয় বলেই হয়তো আমি এত ভাবছি। শেষের অংশটা বেশি মারাত্মক।’

ডাক্তার সেন হালকাভাবে হাসলেন। স্বপ্নটা যে মারাত্মক কিছু সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কী ধরনের মারাত্মক? নিজের মৃত্যু? তাই হবে। মৃত্যু স্বপ্ন মনে থাকলে অনেকক্ষণ খচখচ করে। মানুষটাকে আগে শান্ত করা প্রয়োজন।

‘আমি স্বপ্ন বিশেষজ্ঞ নই মিস্টার সামন্ত, তবে এটা জানি স্বপ্ন ভাল মন্দ দু’রকমই হতে পারে, সেইজন্যই তো ‘দুঃস্বপ্ন’ কথাটা এসেছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, আবার ভুলেও যাই।’

‘আমি ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষাও করলাম। দেখলাম, একটুও ভুলিনি। সবটাই মনে আছে। ডিটেইলসে।’

ডাক্তার সেন আবার অল্প হাসলেন। বললেন, ‘নিশ্চয় বেশি খারাপ ধরনের কিছু দেখেছেন। সেই কারণেই মন থেকে যায়নি। খারাপ কিছু মন থেকে চট করে যেতে চায় না। সে স্বপ্নই হোক, আর সত্যি হোক। এত চিন্তা করার কী আছে? রিল্যাক্স।’

মুখে একথা বললেও ডাক্তার সেন মনে মনে একটু চিন্তিতই হলেন। মানুষটা ভাল। অতিরিক্ত টাকাপয়সা হয়ে গেলে মানুষের মধ্যে কিছু অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধে। মনে হয় না, কুঞ্জবিহারী সামন্তর ক্ষেত্রে সেরকম কিছু ঘটেছে। বরং মানুষটা অন্যদের জন্য করে। এই তো দু’বছর আগে, নার্সিংহোম করার সময় টাকা দিয়ে তাকেই সাহায্য করেছিল।

কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘আমি বরং স্বপ্নের কথাটা বলি ডাক্তার সেন।’

‘অবশ্যই বলুন।’

কুঞ্জবিহারী মুহূর্তখানেক মাথা নিচু করে ভাবলেন। তারপর মাথা নিচু করেই বলতে শুরু করলেন। যেন স্বপ্নটা দেখতে দেখতেই বলছেন—

‘জায়গাটা সম্ভবত পার্ক সার্কাসের মোড় ছিল। চড়া রোদের দুপুর। ছাতা মাথায় দিয়ে দু’-একজনকে হাঁটতে দেখেছি। আমি একটা পান সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পান কিনছিলাম। যদিও পান আমি কখনও খাই না। চুনে অ্যালার্জি আছে। মুখ চুলকায়। তবু স্বপ্নে কিনলাম। পান কেনার পর মুখ ফিরিয়ে দেখি, ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি-টাড়ি সব আটকে আছে। আমার গাড়িটাও রয়েছে। বাঁদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। জানলার কালো কাচগুলো তোলা। ভেতরে এসি চলে বলে গাড়ির কাচ আমার সবসময়ই তোলা থাকে। নিজের গাড়ি দেখতে পেয়ে আমি অবাক হই, ব্রজেশ্বরকেও দেখি।’

ডাক্তার সেন বললেন, ‘ব্রজেশ্বর কে?’

‘আমার ড্রাইভার। অনেকদিন ধরে আছে। এফিশিয়েন্ট লোক। ছোট গাড়ি দিয়ে কাজ শুরু করেছিল। তখন আমার সেকেন্ড হ্যান্ড একটা গাড়ি ছিল। এখন ও বড় গাড়িতেও হাত পাকিয়েছে। যাই হোক, স্বপ্নের ঘটনায় আসি, আমি ভাবলাম এই ভরদুপুরে গাড়িতে কে? আমিই কি কোথাও থেকে আসছি? নাকি আমার মিসেস শপিং-এ গিয়েছিল? প্রতিমা প্রায়ই দুপুরের দিকে শপিং-এ বেরোয়। তার ওপর ওর কোন এক আত্মীয়র যেন বিয়ে-থা’র ব্যাপার আছে। সেই কারণেও বেরোতে পারে। যদিও তার গাড়ি আলাদা। আলাদা ড্রাইভার। সেই ড্রাইভার ছোকরা ধরনের ছেলে। সেই ছেলেকে কিছুদিন হল প্রতিমা ডিসকন্টিনিউ করেছে। কারণটা ঠিক জানি না। সে নাকি আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটির সঙ্গে গল্প করছিল।’

ডাক্তার সেন বুঝতে পারছেন, পেশেন্ট মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছে। অন্য কেউ হলে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া যেত। এক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। এই পেশেন্ট যদি মূল বিষয় ছেড়ে হাজার শাখা উপশাখাতেও ঘোরাফেরা করে, আগ্রহভরে শুনতে হবে। তা ছাড়া ব্যাপারটা খানিকটা গোলমেলে বলে মনে হচ্ছে। বলার ভঙ্গিটা বেশি গোলমেলে লাগছে। একজন বয়স্ক মানুষ স্বপ্ন নিয়ে এত সিরিয়াস হবে কেন? ডাক্তার সেন চুপ করে রইলেন। কুঞ্জবিহারী আবার বলতে শুরু করলেন, ‘গাড়িতে কে আছে দেখার জন্য আমি ফুটপাথ থেকে নেমে কয়েক পা এগিয়ে যাই। আর তখনই ঘটনাটা ঘটে। বুকের কাছে একটা ধাক্কা খেলাম। তীক্ষ্ণ ধরনের ধাক্কা। কনুই দিয়ে গুঁতো মারলে যেমন হয়। আমি মুখ ফিরিয়ে দেখি, ধাক্কাই, একটা লোক আমাকে ধাক্কা মেরেছে। ধাক্কা মেরে আমার আগে গাড়িটার কাছে পোঁছোতে চাইছে।’

কুঞ্জবিহারী থামলেন। ডাক্তার সেন এবারও চুপ করে রইলেন। মানুষটার যে একটা সমস্যা হয়েছে এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর সেই সমস্যা কতটা শরীর আর কতটা মানসিক সেটা আগে বুঝতে হবে। পেশেন্ট নিজের মতোই বলুক।

‘লোকটার গায়ে ঢলঢলে নোংরা পায়জামা। ওপরে জোব্বা ধরনের জামা। মনে হল বস্তা দিয়ে তৈরি। বুকে পিঠে তাপ্পি। মাথার চুলগুলো আঁকড়া, জট পাকানো। কাঁধে আড়াআড়িভাবে ঝোলা মতো কিছু রয়েছে। সেটার অবস্থাও শোচনী। ভিখিরিদের যেমন হয়। লোকটা আবার তার বাঁ হাতের কনুই দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিল। আমি রেগে লোকটার কাঁধটা চেপে ধরি। রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই গাড়ি আমার, আমি যাব। অন্য লোক আমাকে ধাক্কা মারার কে? লোকটা ঝটকা দিয়ে আমার হাত সরিয়ে দেয়। ভিখিরির গায়ের জোর সম্পর্কে আমার আগে কোনও ধারণা ছিল না। এবার হল। সে আমাকে পিছনে ফেলে গাড়ির দিকে ছুটে গেল। তখন দেখলাম ব্যাগ থেকে বের করে হাতে একটা টিনের কৌটো নিয়েছে।’

ডাক্তার সেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বিড়বিড় করে বললেন, ‘টিনের কৌটো!’

কুঞ্জবিহারী মুখ তুললেন। একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, টিনের কৌটো। যাকে আমরা বলি ভিক্ষাপাত্র। লোকটা আসলেই একটা ভিখিরি। ভিক্ষের জন্যই আমার গাড়ির দিকে ছুটছিল। ওই মোড়টায় এরকমই হয়। সিগনালে গাড়ি দাঁড়ালে দু’-একজন ভিখিরি ছুটে আসে। ছোট ছেলেপিলে হলে গাড়ির জানলা ধরে ঝোলে। বড় হলে কাজে হাত বোলায়। ডাক্তার সেন আপনি কি জিনিসটা কখনও লক্ষ করেছেন?’

ডাক্তার সেন এবার সামনে বসা মানুষটার চোখ লক্ষ করলেন। মণি দুটো অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। তবে চোখের তলায় ক্লান্তি রয়েছে। রাত জাগার ক্লান্তি। তিনি ফিসফিস করে বললেন, ‘হবে হয়তো। আমি ঠিক খেয়াল করিনি।’

‘ওই আধ-বুড়ো ভিখিরিটা এবার আমার গাড়ির বন্ধ জানলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের কৌটোটার ওপর রোদ পড়ে চকচক করছিল।’

পরিস্থিতি হালকা করার জন্য ডাক্তার সে হেসে বললেন, ‘বাঃ আপনি তো খুব মাইনিউটলি সবকিছু লক্ষ করেছেন মিস্টার সামন্ত। ভিখিরির ভিক্ষাপাত্রটি পর্যন্ত মনে রেখেছেন দেখছি।’

কুঞ্জবিহারী চেয়ারে হেলান দিলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘রাখতে বাধ্য হয়েছি ডাক্তার সেন। কারণ এর অল্প পরেই লোকটাকে আমি চিনতে পারি।’

‘চিনতে পেরেছেন! পরিচিত কেউ? ছোটবেলার বন্ধু? মানুষ অনেকসময় ছোটবেলার বন্ধু, মৃত মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। সেরকম কিছু?’

কুঞ্জবিহারী এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বললেন, ‘তবে প্রথম পর্যায়ে চিনতে পারিনি। কারণ সেইসময় আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। রাস্তায় এক নোংরা ভিখিরির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি এই দৃশ্য দেখার পর ঘুম ভাঙাটাই স্বাভাবিক। ঘুম ভাঙার পর ভীষণরকম একটা আনকমফর্ট ফিল করি। ভিখিরিটা কে ছিল সেটা দেখতে পেলাম পরের পর্যায়ে। জল-টল খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়বার পর।’

‘কে ছিল?’

‘আমি লোকটাকে স্পেয়ার করলাম না। পিছন থেকে জোব্বাটা ধরে টান দিলাম। লোকটা এক হাত দিয়ে ছাড়াতে চেষ্টা করল, অন্য হাতে টিনের কৌটোটা দিয়ে আমার গাড়ির জানলার কাচে টোকা মারতে লাগল ক্রমাগত। ভিক্ষের জন্য যেমন করে আর কী। আমি এবার দু’হাত দিয়ে তার কাঁধের ঝোলাটা টানলাম। এই টানাহ্যাঁচড়ার মাঝখানেই সিগনাল ছেড়ে দেয়, গাড়িগুলো চলতে শুরু করে। আমার গাড়িটাও গড়িয়েছে। লোকটা গাড়ির পাশে পাশে দৌড়োয়। এটা ভিখিরিদের একটা কমন প্র্যাকটিস। অনেক সময় লাস্ট মোমেন্টে মানুষের মন দুর্বল হয়ে ওঠে, গাড়ির কাচ নামিয়ে পয়সা ছুড়ে দেয়। সম্ভবত লোকটা সেই সুযোগই নিতে চেষ্টা করেছিল। আমি তখনও ছাড়িনি। লোকটাকে আরও জোরে টেনে ধরলাম। টানাহ্যাঁচড়ায় বেচারির হাতের কৌটোটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ভেতরের সিকি, আধুলি, এক-দু’টাকার কয়েন ছড়িয়ে পড়ল ট্রামলাইনে। ততক্ষণে আমার গাড়ির পিছনের চাকা পড়ে থাকা কৌটোটা তেবড়ে দিয়ে স্পিড তুলে ফেলেছে। ডাক্তার সেন, আপনাকে আগেই বোধহয় বলেছি, ব্রজেশ্বরের হাত ভাল। স্পিড় তোলার সময়েও সে চমৎকার স্টিয়ারিং কাটাতে পারে। সে যদি কৌটোটা দেখতে পেত কিছুতেই তার ওপর গাড়ির চাকা তুলত না। যাই হোক, এর পরেই সেই ভিখিরি আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। ভয়ংকর দুটো চোখ। পাথরের মতো কঠিন। আমাকে যেন ফালা ফালা করে দেখছে। এই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি শিউরে উঠে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ততক্ষণে আমি লোকটাকে চিনতে পেরেছি।’ দম নেওয়ার জন্য থামলেন কুঞ্জবিহারী।

ডাক্তার সেন বলেন, ‘কে লোকটা?’

‘আমি।’

ডাক্তার সেন বিস্মিত গলায় বললেন, ‘আপনি। লোকটা আপনি! ওই ভিখিরিটা?’

কুঞ্জবিহারী খানিকটা আপন মনেই বললেন, ‘এইখানেই ঘটনাটা শেষ হয়ে গেল হলে বোধহয় এতটা সমস্যা ছিল না। কিন্তু তা হয়নি। গাড়ি বাঁক ঘোরার সময়ে আমি ভেতরটা একঝলক দেখতে পেয়েছিলাম ডাক্তার সেন। মজার কথা হল, সেখানেও আমি ছিলাম! ব্যাক সিটে মাথা এলিয়ে বসে ছিলাম। এরপরই ঘুম ভেঙে উঠে পড়তে চেষ্টা করি, পারি না। ঘুমের মধ্যেই ছটফট করতে থাকি, ঘামতে থাকি।’

কুঞ্জবিহারীর গলা কি সামান্য কাঁপছে? তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘এক গ্লাস জল পাওয়া যাবে? ঠান্ডা জল?’

ডাক্তার সেন ইন্টারকমে চাপা গলায় জলের কথা বললেন। পেশেন্টের সমস্যাটা তিনি বুঝাতে পেরেছেন বলে মনে হচ্ছে। সহজ সমস্যা। গরিব মানুষ যেমন ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে, ধনীরও তেমন ভিক্ষে করে বেড়ানোর ভয় থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কোনও এক ধরনের ইনসিকিউরিটি সেন্স মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই জাতীয় মানুষ বেশিরভাগ সময়েই ব্যাবসাপাতি নিয়ে টেনশনের মধ্যে থাকে। টেনশন বাইরে দেখা যায় না, ভেতরে জমা হয়। সময় সুযোগ পেলে কোনও না কোনওভাবে প্রকাশ পেতে চেষ্টা করে। এটাও সেরকম৷ নার্ভ ঠান্ডা করার কোনও হালকা ধরনের ঘুমের ওষুধেই কাজ হবে। তিনি প্রেসক্রিপশনের প্যাড টেনে নিয়ে শান্ত গলায় বললেন, ‘কুঞ্জবিহারীবাবু, আপনি যতটা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন অত চিন্তা করার মতো কিছু ঘটেনি। স্বপ্নের আসল রহস্য লুকিয়ে আছে রেম বা র‍্যাপিড আই মুভমেন্টের মধ্যে। ঘুমের মধ্যে মণির ঘোরাফেরার ওপর নির্ভর করে আপনি কী ধরনের স্বপ্ন দেখবেন বা আদৌ দেখবেন কিনা। তার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক নেই। আসলে আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। টেনশন কমাতে হবে।’

জলের গ্লাসে চুমুক দিয়ে কুঞ্জবিহারী মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি তো বিশ্রামেই থাকি ডাক্তারবাবু। টেনশনও কিছু নেই। আর আপনি যদি ভাবেন, আমি হঠাৎ করে পথের ভিখিরি হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছি, সেটাও বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আপনাদের শুভেচ্ছায় যেটুকু বিষয়সম্পত্তি, টাকাপয়সা করেছি তাতে আর যাই হোক, কোনও অবস্থাতেই ভিখিরি হয়ে যাওয়া মুশকিল।’

ডাক্তার সেনও হাসলেন। বললেন, ‘সেইজন্যই তো বলছি, এটা কিছু নয়। কোনও একটা চাপা স্ট্রেস থেকে হয়েছে। ভিখিরি দেখেছেন তাই ভিখিরি, রাজা-মহারাজা দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। দিন কয়েক রাতে ভাল করে ঘুম হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যাকে বলে সাউন্ড স্লিপ। দেখবেন ভিখিরি-টিখিরি সব ভ্যানিশ, স্বপ্ন একেবারে ক্লিয়ার।’

কথাটা সত্যি। স্বপ্ন ভ্যানিশ হতে দিন কয়েক লাগল না। প্রথম রাতেই ওষুধ খেয়ে চমৎকার ঘুম হল কুঞ্জবিহারী সামন্তর। স্বপ্ন-টপ্নর কোনও বালাই নেই। সকালে ঝরঝরে শরীর। ব্রেকফাস্টে কিছুদিন হল ফল চালু করেছেন প্রতিমা। কলা বা আপেল। সঙ্গে একটু পাকা পেঁপে। প্রতিমাদেবী বাড়িতে নেই। মাসতুতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে বেরিয়ে পড়েছেন। হাতে খবরের কাগজ নিয়ে পেঁপের টুকরো মুখে তুলতেই কুঞ্জবিহারীর মোবাইল বেজে উঠল। মেয়ে ফোন করেছে।

‘বাপি, কেমন আছ?’

‘ভাল আছি মা। তুই কেমন আছিস?’

সৌমী প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিন্তিত গলায় বলল, ‘ভাল নেই। তোমার নাকি রাতে ঘুমের সমস্যা হচ্ছে?’

কুঞ্জবিহারী চুপ করে রইলেন। প্রতিমার কাজ। মেয়েকে বলেছে। তিনি বললেন, ‘আরে বাবা না না, তেমন কিছু নয়, তোর মা তিলকে তাল করে। একদিন একটু গোলমাল হয়েছিল।’

‘কী গোলমাল!’

কুঞ্জবিহারী হেসে বললেন, ‘কিছু গোলমাল নয়। ডোন্ট ওয়ারি মামণি। ডাক্তার সেনের এক সেরাটিভেই এভরিথিং গন। কাল রাতেই ফার্স্ট ক্লাস ঘুমিয়েছি।’

‘তুমি নাকি দুঃস্বপ্ন দেখেছ! কী স্বপ্ন বাপি?’ আদুরে গলায় বলল সৌমী।

কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘দেখলাম হাউ মাউ খাঁউ বলে একটা রাক্ষস আমায় খেতে আসছে। হা হা।’

সৌমীও হাসল খানিকটা। একসময় হাসি থামিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘বাপি তুমি কি মায়ের কাছ থেকে কিছু শুনেছ?’

কুঞ্জবিহারী ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী ব্যাপারে ডার্লিং?’

সৌমী আদুরে গলায় বলল, ‘জানি না যাও।’

কুঞ্জবিহারী হেসে বললেন, ‘শুনেছি এবং খুব খুশি হয়েছি।’

‘রিয়েলি বাপি?’

‘সত্যি। শুনলাম তোর ওই ছেলে নাকি লেখাপড়া নিয়ে থাকে?’

সৌমী আধো গলায় বলল, ‘তা থাকে, তবে আমি অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করিয়েছি।’

‘কীসে রাজি করিয়েছিস?’

সৌমী লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘অর্ক বলেছে বিয়ের পর সে তোমাকে বিজনেসে হেল্‌প করবে। অত বড় বিজনেস, সব তো আর মাইনে করা লোকজন দিয়ে হয় না, তোমার তো একজন নিজের লোকও চাই। আরে বাবা, পড়াশোনা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না, বিজনেস দেখতে দেখতেই না হয় করবে। হি এগ্রিড। ঠিক করেছে, গবেষণা-টবেষণার কাজ সেরকম হলে কিছুদিন বন্ধ রাখবে। ভাল হল না বাপি?’

কুঞ্জবিহারী অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘ভাল হল, খুবই ভাল হল।’

মেয়ের ফোনটা ছেড়ে মনটা খুশিই হল কুঞ্জবিহারীর। সত্যি তো এত বড় ব্যাবসার দায়িত্ব যদি জামাই বুঝে নেয়, সেটা তো ভালই। আরও খুশি হলেন অফিসে পৌঁছে। জাপানি কোম্পানির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার ব্যাপারে যে গিঁটটা তৈরি হয়েছিল সেটা কেটে গেছে। দিল্লি থেকে জেনারেল ম্যানেজার মুন্সি ফ্যাক্স পাঠিয়েছে, ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। মন্ত্রী-আমলাদের ‘দেওয়া থোওয়া’র পরিমাণটা খানিকটা বাড়াতে হয়েছে এই যা। বিকেলে অফিস থেকে বেরোনোর মুখে প্রতিমাদেবী ফোন করলেন— হ্যাঁগো, কাল তোমার অফিসে একবার বদ্যিকে যেতে বলেছি। বেচারির কিছু টাকা ধার লাগবে, বিজনেসে নামছে, দোকান না রেস্তোরাঁ কী যেন ছাই করবে বলেছে। তবে যা চাইবে তার হাফ দেবে। হারামজাদা আগে কাজ করে দেখাক, তারপর বাকিটা হবে। আর হাঁগো, তোমার শরীর কেমন? স্বপ্ন-টপ্ন কিছু দেখোনি?’

কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘না কিছু দেখিনি। তোমার ভাইকে অফিসে আসতে হবে না। অ্যামাউন্ট বলে দিয়ে, পাঠিয়ে দেব।’

পার্কসার্কাস মোড়ের কাছে ব্রজেশ্বরকে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন কুঞ্জবিহারী। গাড়ি থেকে নেমে সামনের পানের দোকানে গিয়ে অর্ডার দিলেন। মিঠেপাতা, সঙ্গে মিষ্টি মশলা। পান নেওয়ার সময় নজর পড়ল ফুটপাথের একপাশে গুটিকতক ছেঁড়া চটি বই, পত্রিকা, পুরনো খবরের কাগজ সাজিয়ে এক ছোকরা বসে। কুঞ্জবিহারী সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘কী লাগবে স্যার?’

টাইতে হাত বুলিয়ে সামান্য ঝুঁকে কুঞ্জবিহারী নিচু গলায় বললেন, ‘স্বপ্নের ওপর কোনও বই আছে ভাই?’

‘কীসের ওপর!’

‘স্বপ্ন, খোয়াব? আছে? কী স্বপ্ন দেখলে কী হয় তার বই থাকে না?’

ছোকরা দাঁত কামড়ে হাসল। বাঁ চোখ টিপে বলল, ‘স্বপ্ন নেই, স্বপ্নসুন্দরী আছে স্যার। একদম টাইট মাল। দেখবেন?’ বলতে বলতে ফুটপাথে বিছোনো প্লাস্টিকের তলা থেকে দ্রুত হাতে একটা পত্রিকা বের করল সে। মলাটে ভরাট নগ্ন বুক বের করা তরুণী হাসছে। মুখে পান দিয়ে ভাল করে চারপাশে তাকালেন কুঞ্জবিহারী। শেষ বিকেলের ঝলমলে আলোয় শহর ছুটছে ধোপদুরস্ত হয়ে। ঝকঝকে গাড়ি ছুটছে একে অপরকে পাল্লা দিয়ে। সুন্দর সুন্দর সাজগোজের মানুষও ছুটছে। নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়িতে ফিরে গেলেন কুঞ্জবিহারী। ব্রজেশ্বর সেলুট ঠুকে দরজা খুলে দাঁড়াল। এটা তার নতুন কায়দা। গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার পর কুঞ্জবিহারী বললেন, ‘একটু খেয়াল করে চলো তো ব্রজেশ্বর। রাস্তার পাশে নজর রেখো।’

‘কাউকে খুঁজছেন স্যার?’

চুনের কারণে জিভে একটা হালকা অস্বস্তি শুরু হয়েছে। কুঞ্জবিহারী সেই অস্বস্তি সামলে বললেন, ‘না, তেমন কেউ না… একটা আধবুড়ো টাইপের ভিখিরি, হাতে দেখবে একটা টিনের কৌটো রয়েছে। তেবড়ানো কৌটো। দেখলেই আমাকে বলবে।’

শারদীয়া আনন্দবাজার, ১৪১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *