পালিয়ে

পালিয়ে

নার্ভাস ভাব গোপন করার যে ক’টি সহজ পদ্ধতি আছে তার মধ্যে সহজতমটি হল মুখটাকে হাসি হাসি করে রাখতে হবে। যেন ‘কিছুই ঘটেনি’। সোহম সেই নিয়ম মেনেছে। সে-ও মুখটাকে হাসি হাসি করে রেখেছে, কিন্তু সেই হাসি ফুটছে না। মুখ কাঁচুমাচু লাগছে। সম্ভবত নার্ভাস হলে যে নিয়ম খাটে, অতিরিক্ত নার্ভাস হলে সেই নিয়ম কাজ করে না। তাকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে কোনও বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়েছে। এমন বিপদ যা আগে কখনও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবার সম্ভাবনা কম।

ইশিকা কচুরিতে কামড় দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘সোহম, মনে হচ্ছে তুমি যে-কোনও মোমেন্টে কেঁদে ফেলবে। তার আগে আর একবার তরকারিটা দিতে বলো। কচুরির তরকারির জন্য এদের মজার কোনও রেসিপি আছে বলে মনে হয়। খাওয়ার সময় ঝাল বোঝা যাচ্ছে না, পরে ধরা পড়ছে। ফ্যান্টাস্টিক!’

সোহম চমকে উঠে বলল, ‘কাঁদব! কেন, কাঁদব কেন?’

ইশিকা সুন্দর হেসে বলল, ‘সে তো জানি না, মুখ দেখে মনে হচ্ছে। অসুবিধে কিছু নেই এখানে লোকজন কম, আমরাও বসেছি দোকানের একেবারে কোণে। তুমি নিশ্চিন্তে কাঁদতে পারো।’

সোহম খানিকটা রাগ, খানিকটা অসহায় গলায় বলল, ‘ঠাট্টা করছ? তোমার কি মনে হচ্ছে, এটা ঠাট্টা করবার মতো উপযুক্ত সময়? ডু ইউ থিঙ্ক সো?’

ইশিকা তার বড় চোখ আরও বড় করে বলল, ‘ওমা! ঠাট্টা করব কেন? সিরিয়াস কথাই তো বলছি। কান্নাকাটির ব্যাপারে তুমি লজ্জাই বা পাচ্ছ কীসের জন্য? বিয়ের পর সব পুরুষমানুষই কাঁদে। হোয়াটস রং উইথ ইট? মেয়েদেরটা দেখা যায়, ছেলেদেরটা দেখা যায় না এই তো ডিফারেন্স। আমার এক মাসির বিয়ের সময় কেলেঙ্কারি হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িটাড়ি সব রেডি, মাসি সেজেগুজে ঘোমটা টেনে বসে আছে ফিল্মি কায়দায়, কিন্তু ঘর ছেড়ে বেরোতে পারছে না। বিদায়বেলার লগ্ন প্রায় যায় যায়। কিন্তু করবার কিছু নেই। নাথিং টু ডু। মাসি বেচারির কিছুতেই কান্না পাচ্ছে না! চোখভরা জল ছাড়া সে পতিগৃহে যাত্রা করবে কী করে? বিরাট টেনশন।হি হি। শেষপর্যন্ত!…।’

‘উইল ইউ প্লিজ স্টপ? আমাকে একটু মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে দেবে?’

ইশিকা কচুরিতে মন দিতে দিতে বলল, ‘কী ভাববে? যা হওয়ার হয়ে গেছে। অলরেডি ডান। ভাবনাচিন্তা করেই হয়েছে। এমন তো নয় যে, আমরা দুম করে কিছু করেছি।’

সোহমের খুব ইচ্ছে করল, টেবিলের উলটোদিকে বসা রূপবতী তরুণীটিকে একটি জোর ধমক দেয়। ইশিকার সঙ্গে সে আগে কখনও ঝগড়া করেনি এমন নয়, বহুবারই করেছে। কিন্তু ছোটখাটো ঝগড়ায় এই মেয়ে বড় ধরনের রি-অ্যাকশন দেখায়। সামনে ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, মোটরবাইক, রিকশা যা পায় তাতে ফট করে উঠে পড়ে। প্রেমিকা এই কাণ্ড করলে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু ইশিকা এখন আর তার প্রেমিকা নয়, বিয়ে করা বউ। মাত্র আধ ঘণ্টা হল রেজিষ্ট্রি অফিসে সই করে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। স্ত্রীর রেগেমেগে অচেনা কারও মোটরবাইকের পিছনে চেপে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? কেমন দেখাবে সেটা? এখন মাথা ঠান্ডা রাখা দরকার। কচুরি খাওয়া শেষ করে ইশিকা বলল, ‘এবার রসগোল্লা খাব।’

‘রসগোল্লা!’

‘ইয়েস রসগোল্লা। ফিগার নিয়ে আমার যতই খুঁতখুঁতানি থাক, বিয়ের দিন মিষ্টিমুখ না করাটা অপরাধ। রসগোল্লা বলো। তোমার জন্যও বলো।’

সোহম বুঝতে পারছে, এই মেয়ে এখন যা খুশি তাই করবে। বিয়ের পর কিছুদিন ‘যা খুশি’ করে বিরাট আনন্দ পায়। সে অনিচ্ছার সঙ্গে রসগোল্লার অর্ডার দিল। এরকম একটা তেলচিটে মার্কা দোকানে ঢোকার ব্যাপারেই তার তীব্র আপত্তি ছিল। সহকারী রেজিস্ট্রার লোকটা ফিচেল প্রকৃতির। টাকা-পয়সা গুনে নেওয়ার পর ছোপ ছোপ দাঁতে হেসে বলল, ‘যান, বিবাহের কার্যাদি ওভার, এবার সবাই মিলে পাশের দোকানে গিয়ে কচুরি শিঙাড়া সাঁটান। এখানে বিয়ে করতে এলে সবাই পাশের দোকানে কচুরি শিঙাড়া খায়’

ইশিকা অতি উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘লেটস গো সোহম।’

সোহমের প্ল্যান ছিল অন্যরকম। ভেবেছিল, ঝামেলা শেষ হয়ে গেলে ট্যাক্সি নিয়ে চায়না টাউন বা পার্ক স্ট্রিটের কোথাও যাবে। সেখানে লাঞ্চ করতে করতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। ইতিমধ্যে ধরে আনা সাক্ষী দু’জন পালিয়েছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, দু’জনেরই নাকি ‘ভীষণ জরুরি কাজ’ পড়ে আছে। একেবারে ডাহা মিথ্যে। আসলে তারা পরিকল্পনা করে নবদম্পতিকে একা থাকার সুযোগ দিল। সেটা খারাপ নয়, তবে তার এই পরিণতি কে ভাবতে পেরেছিল?

সোহম মিনমিন করে বলল, কোথাও লাঞ্চ করব ভেবেছিলাম যে।

ইশিকা সে কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘শুনলে না, এখানে বিয়ে করলে পাশের দোকানে কচুরি খেতে হয়? কে জানে হয়তো পাপ-পুণ্যির একটা ব্যাপার আছে। হোলি কচুরি। এদের সঙ্গে কমিশনের ব্যবস্থাও থাকতে পারে। না খেলে বেচারিরা দুঃখ পাবে।’

সোহমকে বিস্মিত করে চারটে কচুরির পর ইশিকা রস টিপে দু’-দুটো রসগোল্লাও খেয়ে ফেলল। রুমালে হাত মুছতে মুছতে হাসিমুখে বলল, ‘নাও এবার বলো হোয়াই ইউ আর সো নার্ভাস? প্রবলেমটা কোথায়? শুধু নার্ভাস নয়, মনে হচ্ছে, তুমি ভয় পেয়েছ। আমাকে কি তোমার পেনি বলে মনে হচ্ছে। পেতনি বউ?’

সোহম চাপা বিরক্ত গলায় বলল, ‘কথায় কথায় হাসছ কেন? লোকে শুনতে পাবে।’

ইশিকা কৌতুকভরা চোখে চারপাশে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘সরি সোহম, আর হাসব না। নতুন বউয়ের হাসাহাসি ভাল দেখায় না। তবে আমাকে মোটেও নববধূর মতো লাগছে না। জিনস আর টপ পরে আছি, পায়ে স্নিকার। সঙ্গে ল্যাপটপ। ল্যাপটপ কাঁধে নিয়ে কনে কখনও বিয়ে করতে আসে? কী করব বলো? অফিসে যেতে হবে না? এটা হল ফাউ বিয়ে, মেন বিয়ের দিন মারকাটারি সাজব।’

সোহম বুঝল, ইশিকার সহজে হাসি থামবে না। গোপনে বিয়ে করার কারণে তাকে যেমন ভয় চেপে ধরেছে, এই মেয়ে সম্ভবত আক্রান্ত হয়েছে হাসিতে। একই ঘটনায় ছেলেমেয়ে দু’জনের দু’রকম এফেক্ট! যদিও বিয়ের আগে পর্যন্ত তার নার্ভ যথেষ্ট শক্ত ছিল। শ্যামবাজারের মোড়ে যখন ইশিকার জন্য সে অপেক্ষা করছিল, তখন ভেতরে ভেতরে একটা শক্তি অনুভব করে। বীরের শক্তি। নিজেকে রূপকথার রাজপুত্র টাইপ লাগছিল। রাজকন্যেকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছে। কিন্তু সইসাবুদ শেষ হওয়ার পরই ফট করে কী যেন ঘটে গেল! নিমেষে সব যেন পালটে গেল। হাত-পা ঠান্ডা হতে লাগল, কপালে ঘাম, বাঁ হাঁটুতে কাঁপুনি। হাঁটু কি এখনও কাঁপছে? সোহম টেবিলের তলায় হাত দিয়ে দেখল। হ্যাঁ, কাঁপছে। বাঁ, ডান দুটো হাঁটুই কাঁপছে।

ইশিকা উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, ‘তোমার কি হাঁটু কাঁপছে? শিভারিং?’

সোহম অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কী করে বুঝলে?’

‘বিয়ের পরপর ছেলেদের হাঁটু কাঁপা একটা স্বাভাবিক সিম্পটম। ফুলদির হাজব্যান্ডের সমস্যা হয়েছিল দাঁতে। বিয়ের পিড়িতে বসেই ঠকঠকানি শুরু হল। ফুলদি জোর বকা দিল, তাতে কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল।’

সোহম ফস করে কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরাল। বলল, ‘বাজে কথা বন্ধ করো, এতক্ষণ মনে হয়নি, কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হল না। এভাবে লুকিয়ে… বরং আমরা আরও কয়েকটা দিন ওয়েট করতে পারতাম। ইউ কুড কনভিনস ইয়োর ফ্যামিলি। দরকার হলে আমি নিজে যেতাম, তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলতাম।’

ইশিকা তার ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে দ্রুত হাতে চুল আঁচড়াতে থাকে। তার অফিসের সময় হয়ে গেছে। বিদেশি কোম্পানিতে হুট করে হাফ ছুটি পেয়েছে এই অনেক। বলল, ‘প্রবলেম কোথায় বলবে? বাবার সঙ্গে কথা বলতে তো অসুবিধে নেই। তবে রিস্ক হাফ হয়ে গেল।’

‘রিস্ক হাফ হয়ে গেল!’

ইশিকা আবার তার সুন্দর হাসি হেসে বলল, ‘বাঃ, হল না! ডকুমেন্টারি বানানো, কবিতা লেখা, গ্রুপ থিয়েটার করা বেকার এবং ভিতু পাত্রের সঙ্গে আমার বাবা তাঁর সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, চাকুরিরত কন্যার বিবাহ দেবেন কি না, সে বিষয়ে তোমার কি কোনও সংশয় ছিল না? আমার তো বালু ছিল। নাউ দ্য সংশয় ইজ ওভার। বিয়ের ঝামেলা শেষ, এখন শুধু রাজি করানোর পালা। রিস্ক আদ্দেক। এই সময় ঝুঁকি কমানোটাই আসল ম্যানেজমেন্ট। আর তাড়াহুড়োর কিছু নেই। ঠান্ডা মাথায় গিয়ে একদিন কথা বললেই চলবে। আমার বাবা খুবই চমৎকার একজন মানুষ, নাইস পার্সন। মেয়ের পছন্দ অপছন্দকে তিনি যথেষ্ট মূল্য দেন। প্রেমিকের ব্যাপারে কঠিন হলেও, জামাইয়ের বিষয়ে তিনি নিশ্চয় নরম হবেন। মনে হয় না উনি তোমাকে দু’-চারটের বেশি ধমক-ধামক দেবেন।’

ধমক! ঢোঁক গিলল সোহম। বান্ধবীর বাবা ধমক দেবে শুনলে খানিক আগে পর্যন্ত লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে অবশ্যই সে একটা কাণ্ড করে ফেলত। শ্বশুরমশাইয়ের বেলায় কি তা করা যায়? মনে হয় না যায়। সোহম আরও মিইয়ে গেল। কাঁধে ল্যাপটপ তুলে ইশিকা উঠে দাঁড়ায়। ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এই যে স্বামী সাহেব, আমি এখন চললাম। আপনি বসে বসে বুকে বল আনুন। আর শুনুন স্যার, সারাদিন যে চুলোয় থাকুন রাত দশটার মধ্যে বাঁধনদের ফ্ল্যাটে চলে আসবেন। ও আর ওর বর আজ ওদের ফ্ল্যাটটা তমাদের ছেড়ে দিচ্ছে।’

সোহম চোখ কপালে তুলে বলল, ‘ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছে। মানে?’

ইশিকা হেসে বলল, ‘মানে আর কী, তুমি বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দেবে, সারারাত এডিটিং চলবে বলে ফিরতে পারবে না। আর আমি বলে দেব, বাঁধনদের বাড়িতে পার্টিতে আটকে গেছি। গাড়ি পাঠিয়ে লাভ হবে না। ওরা কিছুতেই ছাড়ছে না। সেরকম হলে বাঁধনের সঙ্গে মাকে কথা বলিয়ে নেব। বাঁধন খুব সুন্দর করে মিথ্যে বলতে পারে। ও হল মিথ্যে এক্সপার্ট।’

সোহমের মনে হল, এবার সত্যি সত্যি সে কেঁদে ফেলবে। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

ইশিকা আরও ফিসফিস করে বলল, ‘আজ আমাদের ফুলশয্যা না? হাঁদা কোথাকার।’

গোপন বিয়ের কথা ফাঁস করা যায়, কিন্তু গোপন ফুলশয্যা গোপন থাকাই ভাল। সে খবর আমরা ফাঁস করব না। বলার মতো শুধু একটাই কথা, কোনও এক আশ্চর্য কারণে মাঝরাতের দিকে সোহম দুম করে সাহস পেয়ে যায় এবং তার স্ত্রীকে গভীর ভালবাসায় কাছে টানে।

বাঁধন শুধু তার ফ্ল্যাট ফাঁকা করে চলে যায়নি, একটা ঝলমলে লাল রঙের বেনারসি উপহার দিয়ে বন্ধুকে চমকে দিয়েছে। খাটের ওপর প্যাকেটে সেই বেনারসি রাখা ছিল। সঙ্গে দু’লাইনের চিরকুট—

ইশিকা, বিয়ের রাতে বউ বেনারসি পরায় তাবড় তাবড় স্মার্ট বরেরাও ঘাবড়ে যায়। ঘাবড়ে গিয়ে ‘কাণ্ড’ ঘটায়। আমি চাই, তুই আজ রাতে এই শাড়ি পড়ে সোহমকে ঘাবড়ে দিবি। সে কাণ্ড ঘটাবে। সেই কাণ্ডের গল্প কাল শুনব। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

ইশিকা বন্ধুর দেওয়া শাড়ি পড়েছে। নিয়মমতো ঘাবড়ানোর কথা সোহমের। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল ঘটনা ঘটেছে উলটো। সোহমের বদলে ঘাবড়েছে সে নিজে! বেনারসির আড়ালে সাহসী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী এই মেয়ের হাঁটু কাঁপছে। শুধু হাঁটু কাঁপছে না, চোখেও জল! মুখ ঘুরিয়ে সেই জল সে লুকোতে চেষ্টা করল। আনন্দের কান্না স্বামীকে দেখাতে তার খুবই লজ্জা করছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার তত্ত্ব-তালাস-এ রসগোল্লা নামে প্রকাশিত হয়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *