গৃহত্যাগী

গৃহত্যাগী

দিব্যকান্তিবাবুর ইচ্ছে করছে পাশের ঘরে গিয়ে এখনই ছোকরার গালে একটা চড় লাগান। সাধারণ চড় নয়। ঠাঁটিয়ে চড়। ঠাঁটিয়ে চড়ের অনেক রকম গুণ আছে। সব থেকে বড় গুণ হল, ঠিকমতো মারতে পারলে ব্রেনে সরাসরি অ্যাকশন হয়। যে চড় খায়, সে দ্রুত বুঝতে পারে কেন মারা হল৷ আলাদা করে কারণ বলতে হয় না। দিব্যকান্তিবাবুর বিশ্বাস, এই ছোকরার বেলাতেও একই ঘটনা ঘটবে। চড় মারামাত্র সে চড়ের কারণ বুঝতে পারবে।

কিন্তু এই ছোকরাকে চড় মারা যাবে না। কারণ ছোকরা এ বাড়ির জামাই। শুধু জামাই নয়, একমাত্র জামাই। কয়েক বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে এ বাড়ির মেয়ে তপস্যার (ডাক নাম তপু) সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। ‘ঢাকঢোল’ শুধু কথার কথা নয়, বৈদ্যবাটী থেকে সত্যি সত্যি ঢাকি আনিয়েছিলেন দিব্যকান্তি। বিষয়টি নিয়ে মেয়ের মায়ের সঙ্গে তাঁর টেনশনও হয়।

‘মেয়ের বিয়ে বলে মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোমার? মনে হচ্ছে সেটাই হয়েছে। চিন্তা কোরো না, অনেক সময় এরকম হয়। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হলে, মেয়ের বাবার মাথা গরম হয়ে যায়। এই সময়টায় বেশি করে ঠান্ডা খাওয়া দরকার। আজ থেকেই শুরু করে দাও। দাঁড়াও নমিতার মাকে বেলের শরবত দিতে বলছি।’

দিব্যকান্তিবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকেন। বলেন, ‘আমার মাথা খারাপ হয়েছে এমন খবর তোমায় কে দিল জয়া?’

‘কে আবার দেবে? আমি নিজেই বুঝতে পারছি। পাগল না হলে কেউ বিয়েবাড়িতে ঢাক বাজানোর কথা ভাবে? তুমিই বলো না, ভাবে কেউ?’

দিব্যকান্তি বললেন, ‘কেন? ভাবে না কেন? অসুবিধে তো কিছু নেই। শাস্ত্রে বারণ আছে নাকি?’

জয়াদেবী রাগী গলায় বললেন, ‘বাজে কথা বোলো না। বিয়েবাড়িতে মাইক বাজে, সানাই বাজে। রাতের দিকে বাসরে ছেলেমেয়েরা গানবাজনাও করে। তা বলে ঢাক! তপু যদি শোনে কী কাণ্ড করবে ভেবেছ একবার? বিয়ে ফেলে বাড়ি ছেড়ে পালাবে। আজকালকার দিনের ছেলেমেয়েদের চেনো না তো। মেয়েকে ডেকে কথাটা একবার বলে দেখো না।’

ডাকতে হল না। তপু নিজেই ঘরে ঢুকল। ঢাকের কথা শুনে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠল ছেলেমানুষের মতো। ‘দারুণ হবে বাবা। ফ্যান্টাস্টিক! ইউনিক আইডিয়া। আমি তো ঠিক করেছিলাম, বিয়েতে কিছুতেই সানাই বাজাতে দেব না। সানাই শুনলেই আমার কান্না পায়। বুনির দিদির বিয়েতে কী বিচ্ছিরি কাণ্ডটাই হল। খেতে বসে খানিকটা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদলাম। মেকআপ, টেকআপ থেবড়ে একাকার কাণ্ড। বিয়ের মত আনন্দের একটা দিনে কান্নাকাটির কোনও মানে আছে?’

দিব্যকান্তি জয়াদেবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। বিজয়ীর হাসি। তারপর এগিয়ে এসে মেয়ের কাঁধে একটা হাত রাখলেন। স্নেহের গলায় বললেন, ‘না কাঁদবি না। হাসবি। হাসতে হাসতে বিয়ে করবি। তিনজন ঢাকি আসছে রে মা। তিনটে শিফটে বাজাবে। সকাল, বিকেল, সন্ধে। এদের মধ্যে একজনের নাম মহেশ্বর। শুনেছি মহেশ্বর একজন ওস্তাদ বাজিয়ে। সে নাকি এক কাঠিতে বাজায়। ঝড়ের মতো হাত চলে। কাঠি দেখা যায় না, শুধু বাজনা শোনা যায়। ভেবেছি, বর আসার সময় মহেশ্বরকেই বাজাতে বলব। তোর শ্বশুরবাড়ির লোকেদের তাক লেগে যাবে।’

বিয়ের মুখে মুখে ‘বর’ এবং ‘শ্বশুরবাড়ি’ শুনলে যে-কোনও মেয়েই লজ্জা পায়। তপুও পেল। তার ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে গেল। গাল লাল হল জয়াদেবীরও। তবে লজ্জায় নয়, রাগে। তিনি বললেন, ‘তিনজন! তিনজন মিলে বাড়িতে ঢুকে ঢাক পেটাবে? আমি নেই। আমি এই বিয়েতে নেই। তোমরা বাপ-মেয়েতে যা খুশি করো। ঢাক বাজাও, ধুনুচি নৃত্য করো, যা খুশি। কালই আমি সুটকেস গুছিয়ে দাদার ওখানে চলে যাব। বাবা-মা নেই বলে তোমরা ভেবো না বাপের বাড়িতে আমার কোনও যাওয়ার জায়গা নেই। তুমি আজই অফিসে গিয়ে পাটনার টিকিট কেটে দিতে বলবে।’

মেয়ের বিয়ের আগে বাড়ির গিন্নিকে রাগানো একটা ঝুঁকির কাজ। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া যায় না। দিব্যকান্তিবাবুও সেই ঝুঁকি নিতে পারলেন না। তিনি ঢাকির সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে একে নিয়ে এলেন। সেই লোককেও বাড়াবাড়ি কিছু করতে দেওয়া হয়নি। সে প্যান্ডেলের মুখে দাঁড়িয়ে হালকা কাঠি মেরেছে মাত্র। বলাই ছিল, আওয়াজ যেন দোতলা পর্যন্ত না যায়। সেখানে জয়াদেবী ছিলেন। তিনি ঢাকের প্রতিবাদে একতলায় নামেননি। দোতলাতেই অতিথিদের ‘আসুন, বসুন’ করেছেন।

তবে আস্তে হলেও ঢাক তত বেজেছে। সেই ঢাক বাজানো জামাইকে চড় মারা যায়? যতই হাত নিশপিশ করুক, মারা যায় না।

দিব্যকান্তি নিজেকে শান্ত করবার চেষ্টা করলেন। আড়চোখে তাকালেন পাশের ঘরে। ঘরে আলো জ্বলছে। ভেতর থেকে নানারকম আওয়াজ ভেসে আসছে। মানুষের কথা, গাড়ির শব্দ, এমনকী গানবাজনাও! দিব্যকান্তির ভুরু কুঁচকে গেল। টিভি চলছে? পরদার ফাঁক দিয়ে ইডিয়টটাকেও দেখা যাচ্ছে। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরে বসে আছে চেয়ারে। পাঞ্জাবির রং হালকা গেরুয়া, কাপড় নরম। তবে পাজামা পাঞ্জাবির একটাও তার নিজের নয়। কী করে হবে? সে তো এসেছে একবস্ত্রে। দুটোই দিব্যকান্তিবাবুর। জয়া আলমারি থেকে বের করে দিয়েছে। পাজামা মাপে মোটামুটি হলেও, পাঞ্জাবিটা একটু ঢলঢল করছে। আরে! গাধাটা হাসছে না? হ্যাঁ, হাসছে। হাসির সঙ্গে পা-ও নাড়াচ্ছে। দিব্যকান্তিবাবুর এবার মনে হল, শ্বশুরমশাইয়ের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পা দুলিয়ে দুলিয়ে যে গাধা হাসতে পারে তাকে একটা না, একসঙ্গে দুটো চড় মারা উচিত। তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

জয়াদেবী ঘরে ঢুকলেন। হাতে বই। বইয়ের মলাটে একটা ফুলকপি আর দুটো বড় গাজরের ছবি। ওপরে লেখা— ‘মাছ, মাংস, বিরিয়ানি।’ রান্নার বইগুলোতে অনেক সময়েই এই সমস্যা হয়। বিষয়ের সঙ্গে মলাটের কোনও মিল থাকে না। বিষয় একরকম, তো ছবি অন্যরকম। জয়াদেবীর কাছে ‘নিঃশব্দে নিরামিষ’ নামে একটা বই আছে। তার মলাটে ভাবুক ধরনের একটা বড় গলদা চিংড়ি বসে আছে শুঁড় বাগিয়ে।

জয়াদেবী স্বামীর উলটোদিকের সোফায় বসে পড়লেন। মুখের সামনে রান্নার বই তুলে বললেন, ‘আজ রাতে চিকেন কোপ্তা করলে কেমন হয় বলো তো? এমনি কোপ্তা নয়, জিঞ্জার কোপ্তা। সঙ্গে গরম খিচুড়ি। ভুনি খিচুড়ি। জিঞ্জার কোপ্তা দেখছি করা খুবই সহজ। প্রথমে চিকেনটাকে বলের মতো করে কাটতে হবে। তারপর আদার রসে ডুবিয়ে রাখতে হবে আধ ঘণ্টা। তারপর…।’

দিব্যকান্তিবাবু মুখ নামিয়ে নিলেন। এই আর এক বিপদ। বাড়িতে জামাই এলে, জয়াদেবী রান্নাঘরে যাবেন। রান্নার লোককে সরিয়ে নিজের হাতে রান্না করবেন। বেশি নয়, একটা-দুটো শৌখিন প্রিপারেশন। নিজের রান্না জামাইকে খাওয়াতে না পারলে তাঁর নাকি মন ভরে না। বিপদ হল, জয়াদেবীর রান্নার হাতে সমস্যা আছে। বিচ্ছিরি সমস্যা। নুন ঝালের মেজারমেন্টে গোলমাল হয়ে যায়। এমনকী সময় সম্পর্কেও তাঁর ধারণা দুর্বল। তেল কই এবং মাটনকোরমা যে আলাদা আলাদা সময় ধরে আগুন চায়, এই হিসেব আজও রপ্ত হয়নি। ফলে মাঝে মধ্যেই রান্না, হয় সামান্য কাঁচা থাকে, নয় পুড়ে যায়। জয়াদেবী অবশ্য এতে বিচলিত নন। বাড়িতে জামাই এলে তিনি বই খুলে বসে পড়েন। বিপদের কথা হল, সেই জিনিস শুধু একা জামাই নয়, দিব্যকান্তিবাবুকেও খেতে হয়। গত তিন দিন ধরেই হচ্ছে।

‘কী গো, বললে না প্রিপারেশনটা কেমন হবে?’

খানিকটা গদগদ ভঙ্গিতেই জয়াদেবী স্বামীর কাছে জানতে চান।

দিব্যকান্তিবাবু মুখ তোলেন। তাঁর মুখ থমথম করছে। কঠিন চোখে তাকান স্ত্রীর দিকে। বলেন, ‘ওই গাধাটা আর কতদিন এখানে থাকবে বলে তোমার মনে হচ্ছে?’

‘গাধা! গাধা কে? কার কথা বলছ তুমি? পলাশ?’ জয়াদেবী অবাক গলায় জানতে চান।

‘তা ছাড়া বাড়িতে এই মুহুর্তে আর ক’টা গাধা আছে বলে তোমার মনে হচ্ছে জয়া? ওটা তিনদিন ধরে শ্বশুরবাড়িতে বসে কী করছে?’

জয়াদেবী ফিসফিস করে ওঠেন, ‘অ্যাই, আস্তে বলে। কী হচ্ছেটা কী? পলাশ শুনতে পাবে না?’

পরদার ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে এল। দিব্যকান্তিবাৰু একবার মুখ ঘুরিয়ে সে দিকে তাকালেন, তারপর দাঁত কিড়মিড় ধরনের আওয়াজ করে বললেন, ‘ওই ছেলে হাসছে কেন? হাসি-মশকরার মতো কোনও ঘটনা ঘটেছে কি? শ্বশুরবাড়িতে বসে খাওয়াদাওয়া, ঘুমের মধ্যে হাসির কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।’

জয়াদেবী মুখের সামনে থেকে বই সরালেন। এক গাল হাসলেন। ভাবটা এমন যে শ্বশুরবাড়িতে শুয়ে বসে খাওয়াটা একটা আনন্দের বিষয়।

‘ওমা, হাসবে না তো কী করবে? কাঁদবে? কী যে বলো তুমি!’

এবার গলা আরও নিচু করলেন। বললেন, ‘জামাই তোমার হাসির সিনেমা দেখছে। কমেডি ছবি। বিকেলে বলল, মা, সিনেমা দেখব। আমি বললাম, দেখো না। অসুবিধে তো কিছু নেই। ডিভিডি চালিয়ে সিনেমা দেখো। জামাই বলল, কী সিনেমা দেখব মা? আমি বললাম, হাসির কোনও ছবি দেখো। আমি বরং তোমাকে ক’টা লুচি ভেজে দিই। গরম লুচি খেতে খেতে হাসির ছবি ভাল লাগবে। লুচি কী দিয়ে খাবে? আলু ভাজা না আলুর দম? জামাই বলল, না মা, আলু খাব না। আলুতে ফ্যাট হবে। মা, আপনি ক’টা পটল ভেজে দিন। বেশি করে তেল দিয়ে ডুমো ডুমো করে ভাজবেন। আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে। বাড়িতে পটল নেই। নমিতার মাকে বললাম, ছি ছি, কী কাণ্ড, জামাইমানুষ মুখ ফুটে পটল খেতে চেয়েছে, তুই আগে বাজারে যা। ঠিক করেছি, আর কিছু না রাখি, ঘরে সব সময় পটল রাখব।’

আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তীক্ষ স্বরে স্ত্রীকে ধমকে উঠলেন দিব্যকান্তি, ‘স্টপ, স্টপ। চুপ করো। চুপ করো বলছি।’

জয়াদেবী ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘ইস, পলাশ নিশ্চয় শুনতে পেল। বলছি না আস্তে বলো।’

দিব্যকান্তি গলার ভল্যুম এক রেখে একই সঙ্গে নাক এবং মুখ দিয়ে ‘ফোঁস’ জাতীয় একটা শব্দ করতে গেলেন। রাগের শব্দ। শব্দ বের হল না। এতে রাগ আরও বেড়ে গেল।

‘শুনতে পেলে কী হবে? কিছুই হবে না। চলে যাবে ভেবেছ? যাবে না। অপমানিত হওয়ার জন্যে আলাদা মেটেরিয়াল লাগে। তোমার জামাই সেই মেটেরিয়াল নয় জয়া। গোড়া থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, এখন আমি নিশ্চিত। সেন্ট পারসেন্ট শিয়োর। বুঝতে পারছি, এটি একটি নির্লজ্জ জিনিস। দুটো কানই কাটা। ভাবছি একবার ডেকে কানগুলো দেখতে চাইব। কেমন হবে বলো তো?

‘উফ, চুপ করবে? চুপ করবে তুমি? নিজের জামাই সম্পর্কে কী এসব ছাইভস্ম বলছ! তপু যদি শোনে?’ জয়াদেবী ভয়ে ভয়ে বললেন।

‘চুপ করব? কেন, চুপ করব কেন? একটা ধেড়ে ছেলে নিজের কাজকর্ম ফেলে, বাড়িঘর ফেলে, বউ ফেলে, বাবা-মাকে ফেলে শ্বশুরবাড়িতে বসে পা দোলাচ্ছে আর লুচি-পটলভাজা খেতে খেতে হাসির সিনেমা দেখছে, আর আমি চুপ করব? তাও যদি একটা প্রপার কারণ থাকত।’

ইস, শুনতে পাচ্ছে নাকি? জয়াদেবী মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। এখন আর পলাশের মুখ দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় চেয়ারে হেলান দিয়েছে। পরদার আড়াল থেকে এখন শুধু তার পা দুটো দেখা যাচ্ছে। দুটো পা সামনে ছড়ানো। নিশ্চিন্ত এবং আরাম করে বসলে যেমন হয়। পায়ে হাওয়াই চটি। চটি দুটো পায়ের তুলনায় বেশ ছোট। তবে জিনিস খুবই ভাল। সাধারণ হাওয়াই নয়। স্ট্র্যাপে পাতার কাজ করা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে পাতার চটি। অবশ্য চটি জামাইয়ের নয়। চটি তার বউ তপুর। তপু বাপের বাড়িতে এলে পরে। এখন পলাশ পরছে। কী করবে বেচারি? সে তো আর সঙ্গে করে ঘরে পরার চটি নিয়ে আসেনি। রাগ করে গৃহত্যাগের সময় কেউ সঙ্গে হাওয়াই চটি নিয়ে বের হয় না।

জয়াদেবী বিরক্ত ভঙ্গিতে স্বামীকে বললেন, ‘তুমি জানো না ছেলেটা কেন এখানে আছে? নাকি জেনেও না জানার ভান করছ?’

দিব্যকান্তি দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠলেন,‘জানি, অবশ্যই জানি। আর জানি বলেই মাথায় আগুন জ্বলছে। ফাজলামো হচ্ছে? ন্যাকামি। তোমার জামাই কি ছেলেমানুষ? কচি খোকা সে?’

জয়াদেবী কোলের ওপর রাখা রান্নার বইয়ের পাতা উলটোতে উলটোতে বললেন, ‘আহা, রাগ করছ কেন? দু’দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া। দুধে আমে মিশে যেতে কতক্ষণ?’

‘তিনদিন তো হয়েই গেল।’

‘দুদিন মানে কি আর দু’দিন? তোমার আবার সবটাতে বেশি বেশি। তবে তুমি যাই বলো, আমি ওকে সাপোর্ট করেছি। বলেছি, ঠিক করেছ বাবা। বেশ করেছ। স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে শিক্ষা দিতে হয়। এমনিতেই তারা মাথায় উঠে বসে থাকে। মাঝেমধ্যে শিক্ষা না পেলে তখন আর শুধু বসে থাকবে না, উঠে দাঁড়িয়ে নাচতেও শুরু করে। তুমি তপুকে শিক্ষা দিয়ে ভাল কাজ করেছ।’

দিব্যকান্তি নাকমুখ কুঁচকে বললেন, ‘আমি জানি, আমি জানি তুমি ওই গাধাটাকে সাপোর্ট করছ। ছি ছি, লোককে বলা যাচ্ছে না জামাই এসেছে। ওটাকে ঘরের বাইরে বেরোতে বারণ করে দেবে।’

‘কেন? বারণ করব কেন? পলাশ চোর-ডাকাত নাকি?’ জয়াদেবী মুখ তুলে বললেন।

দিব্যকান্তিবাবু লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘এখন মনে হচ্ছে চোর-ডাকাত হলে ভাল হত। তারা আর যাই করুক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে শ্বশুরবাড়িতে এসে শেলটার নেয় না। প্রয়োজন হলে হাজতে যায়। বিয়ের পর পুরুষমানুষের নানারকম অধঃপতনের কথা আমার জানা আছে, কিন্তু এমন অধঃপতনের কথা শুনিনি কখনও।’

জয়াদেবী হাতের বই মুড়ে সামনের টেবিলে রাখলেন। এক গাল হেসে বললেন, ‘ও মা, তা কী করবে? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে বেচারি যাবে কোথায় বলো? আমরা, মেয়েরা না হয় বাক্সটাক্স গুছিয়ে বাবার কাছে, দাদার কাছে দু’দিন কাটিয়ে আসি। ওরা কী করবে? রাগ করে রাস্তায় রাস্তায় কতক্ষণ ঘুরবে? ঝগড়া করে তো আর হোটেলে গিয়ে ওঠা যায় না। পলাশ ঠিকই করেছে। আমাদের এখানে এসে উঠেছে। ক’দিন থাকুক। রাগ কমলে যাবেখন। তপুরও বোঝা উচিত জামাইয়ের পাশে তার শ্বশুরবাড়ি আছে। এখানে যত্ন কিছু কম পাবে না। শুধু ঝগড়া নয়, আমি শুনেছি, তোমার মেয়ে নাকি পলাশ বেচারিকে বাড়ি থেকে বিদায় করেছে।’

ঝগড়ার ব্যাপারটা দিব্যকান্তি জানেন। আজ বিকেলে অফিস থেকে মেয়েকে মোবাইলে ধরেছিলেন তিনি।

তপু, ‘ভাল আছিস?’

তপস্যার গলায় উচ্ছ্বাস। বলল, ‘খুবই ভাল আছি বাবা। শাশুড়ি মোমো বানিয়েছেন, এখন বসে বসে স্যুপ দিয়ে সেই মোমো খাচ্ছি। অলরেডি গাদাখানেক খেয়ে ফেলেছি। আরও খাব। মনে হচ্ছে, আজ শাশুড়ি আর আমি দু’জনে মিলে মোমো খাওয়ায় রেকর্ড করব। তুমি কেমন আছ বাবা? হাঁটুর ব্যথা কমেছে?’

বর ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে আর মেয়ে শাশুড়ির সঙ্গে বসে মোমো খাওয়ার রেকর্ড গড়ছে শুনলে কোনও বাবার পক্ষেই ভাল থাকা সহজ নয়। দিব্যকান্তিবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, ‘না, হাটুর ব্যথা কমেনি।’

‘সে কী! সে দিন মাকে যে আমার শ্বশুরমশাই বলে দিলেন, দাদাকে ঠান্ডা-গরম ট্রিটমেন্ট দেবেন। ফার্স্ট সাতদিন প্রথমে ঠান্ডা, পরে গরম। নেক্সট সাতদিন আগে গরম পরে ঠান্ডা। বলেননি? মা নিশ্চয় শোনেনি। এই হয়েছে মুশকিল। মা এ বাড়ির কোনও ভাল পরামর্শ শুনতে চায় না। ভেরি ব্যাড। আমার শ্বশুরমশাইয়ের কী এসে যায় বলো তো বাবা? কিছু এসে যায় না। তিনি তো তোমাদের ভালর জন্যেই বলেছিলেন।’

তপস্যার গলায় একই সঙ্গে শ্বশুরমশাইয়ের প্রতি গদগদ ভাব এবং মায়ের ওপর বিরক্তি ঝরে পড়ে।

দিব্যকান্তিবাবু চুপ করে রইলেন। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া তো বটেই, মায়ের সঙ্গেও গোলমাল! সেটাই স্বাভাবিক। পলাশকে জয়া শেলটার দিয়েছে, গোলমাল তো হবেই।

‘তপু, পলাশের ঘটনা কী? কী হয়েছে তোদের? ও এখানে এসে আছে। এসব কী ছেলেমানুষি তপু? ও বাড়ির লোকজন কী মনে করছেন। কোনও পুরুষমানুষ এই কাজ করে? করেছে কোনওদিন? স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে শ্বশুরবাড়িতে! ইউ শ্যুড টক উইথ পলাশ।’

ও পাশে তপস্যাও চুপ করে রইল মিনিট খানেক। মনে হয় চামচ দিয়ে স্যুপ তুলে মুখে দিল। ‘সুড়ুৎ’ ধরনের একটা শব্দও পাওয়া গেল। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘বাবা, প্লিজ। প্লিজ বাবা, আর যার কথা বলো, তোমার জামাইয়ের সম্পর্কে কোনও কথা আমাকে বলবে না। আমি নিজেই ওকে বলেছি, যদি আমাকে তোমার না পোয়, ক’টা দিন অন্য কোথাও গিয়ে থাকো। ওর কোনও কথা আমি শুনতে চাই না। যাক, এখন আমি ফোন ছাড়লাম বাবা, একটু পরেই ননদের সঙ্গে শপিং-এ যাব। ওরা গাড়ি নিয়ে আসবে। ননদাই বলেছে, একেবারে রাতে খাইয়ে তবে ছাড়বে।’

এরপর আর কিছু বলা চলে না। শ্বশুরবাড়ি নিয়ে মেয়ের হ্যাংলামো এই পর্যায়ে গেছে, দিব্যকান্তিবাবু জানতেন না। তিনি হতাশভাবে ফোন রেখে দেন।

পলাশ পরদার আড়াল থেকে মুখ বের করল। জয়াদেবী ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, ‘কী হল বাবা, খিদে পেয়েছে?’

পলাশ এক পা এগিয়ে এল। তবে পুরোটা এল না। তার শরীরের আদ্দেকটা রইল পরদার আড়ালে। সেই অবস্থাতেই বলল, ‘না খিদে পায়নি। এক কাপ চা হবে মা? লিকার চা। দেখবেন লিকার যেন হালকা হয়।’

জয়াদেবী জামাইয়ের চায়ের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। দিব্যকান্তিবাবু ভেবেছিলেন মুখ ফিরিয়ে নেবেন। যে জামাই প্রতি কথায় শাশুড়িকে ‘মা, মা’ করছে, সেই জামাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা কঠিন একটা ব্যাপার। শরীরের মধ্যে জ্বালা জ্বালা করতে থাকে। মনে হয়, খুব শিগগিরই ফোসকা বের হবে। সেই ফোসকার সাইজ হবে বড় বড়। তাবে ভাবলেও মুখ ফেরালেন না দিব্যকান্তিবাবু। কারণ জামাইয়ের দিক থেকে অত সহজে মুখ ফেরানো যায় না। একটি মাত্র জামাই হলে তো কথাই নেই।

পলাশ বলল, ‘বাবা, ভাল আছেন? অফিস থেকে কখন ফিরলেন বাবা? তপু তো প্রায়ই বলে, এই বয়েসে বাবা যা খাটেন তোমরা পারবে না। আমি তখন বিশ্বাস করিনি। এখন করছি। আপনি সত্যি একজন পরিশ্রমী মানুষ।’

না, এই ছেলের অবস্থা খুবই খারাপ। শুধু ‘মা’ নয়, ‘বাবা’ও শুরু করেছে! এখন কী করা উচিত? ধমক দেওয়া? কীরকম ধমক? ঘর কাঁপিয়ে জোরে? নাকি দাঁত চিপে নিচু স্বরে? অনেক সময় জোরের থেকে নিচু গলার ধমক কাজ বেশি দেয়। তাদের স্কুলে হেডমাস্টারমশাই নিচু গলায় ধমক দিত। অন্য কেউ শুনতে পেত না। যে শুনতে পেত, তার প্যান্টে ইয়ে হয়ে যেত। তখন সবাই বুঝতে পারত, এই ছেলে হেডমাস্টারের ধমক খেয়েছে।

দিব্যকান্তিবাবু ধমক দিলেন না। দিতে পারলেন না। জামাইকে যেমন চড় মারা যায় না, তেমন ধমক দেওয়াও যায় না। অনেক কষ্ট করে তিনি ঠোঁটে হাসি আনলেন। বললেন, ‘তুমি ভাল আছ পলাশ? আমাদের এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

পলাশ হাসল। লাজুক ধরনের জামাই হাসি। বলল, ‘হচ্ছে বাবা, অসুবিধে হচ্ছে। বেশ অসুবিধে হচ্ছে। ভেবেছিলাম কথাটা বলব না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বলাটা জরুরি।’

দিব্যকান্তিবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘অসুবিধে! অসুবিধে কীসের?’

‘ঘটনা কী হয়েছে জানেন বাবা, দু’দিন ধরেই দেখছি কাক ভোরে ঘুমটা যাচ্ছে ভেঙে। আমি ভাবলাম ব্যাপারটা কী! ভোরে তো কখনও আমার ঘুম ভাঙে না। আমি হলাম লেট রাইজার। ছোটখাটো নয়, বড় লেট রাইজার। দশটায় বেড টি নিই। তা হলে! তা হলে ঘটনাটা কী? তখনই দেখলাম পুব দিকের জানলায় পরদাটা ছোট। ভোর হতে না হতে সেই পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরে আলো ঢুকছে। কড়া রোদ। ব্যস, তাতেই ঘুম যাচ্ছে ভেঙে। আমি আবার ঘর অন্ধকার না থাকলে ঘুমোতে পারি না। গাঢ় অন্ধকার। পিচ ডার্ক। অথচ এখানে রোদ এসে একেবারে ডাইরেক্ট মুখে পড়ছে।’

একটু থেমে পলাশ সেই লাজুক হাসি হাসল। বলতে শুরু করল আবার।

‘প্রথম দিন পরদা টেনেটুনে রোদ আটকানোর চেষ্টা করলাম, হল না। দ্বিতীয় দিন খাট সরাতে চেষ্টা করলাম। খাট সরল কিন্তু রোদ সরল না। এই কারণেই অসুবিধে।’

দিব্যকান্তিবাবু খুশি হলেন। একটু খুশি নয়, শ্বশুরবাড়িতে বেলা করে ঘুমোনোর শাস্তি হাড়ে হাড়ে টের পাক গাধাটা। আহা, সারারাত যদি এই ছেলের ঘরে রোদ ঢোকানো যেত তা হলে বেশ হত। তিনি খুশিভাব লুকিয়ে গলায় উদ্বেগ এনে বললেন, ‘ছি ছি। কী কাণ্ড বলো দেখি পলাশ। ইস আমি যদি আগে জানতাম। ঠিক আছে, আজই দেখছি। তুমি মোটেও চিন্তা কোরো না। সামান্য পরদার কারণে তুমি ঘুমোতে পারছ না, এটা হতে পারে না। আমি নিজে বিষয়টা দেখছি পলাশ।’

জামাই লাজুক হাসি দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতে খুশিভাব সরে মাথার আগুন জ্বলে উঠল দিব্যকান্তির। কত বড় আবদার! শ্বশুরমশাইকে বলছে পরদা টাঙান। কে জানে এ ছেলে যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে আর ক’টা দিন থাকলে হয়তো বলবে, বাবা আপনিই বরং সকালের দিকটা পরদা সেজে জানলার সামনে দাড়িয়ে থাকুন। রোদ সরে গেলে চলে যাবেন। ইচ্ছে করছে, গাধাটার ঘাড় ধরে পুব দিকের ওই জানলাটা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে। সাততলার ফ্ল্যাট থেকে একতলায় পড়লে গাধাদের কী হয়? হাড়গোড় ভাঙে? ভাঙলে ক’টা ভাঙে? একে আর কতদিন সহ্য করতে হবে?

বেশি দিন নয়। ঘটনা ঘটল পরদিনই।

পলাশ বিছানা ছাড়ল বেলা করে। ততক্ষণে দিব্যকান্তিবাবু অফিসে রওনা দিয়েছেন। হালকা লিকার চা, কড়কড়ে দুটো টোস্টের সঙ্গে আস্ত একটা মর্তমান কলা, খান চার-পাঁচ পাকা পেঁপের টুকরো দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারল পলাশ। কাল রাতেই শাশুড়িকে সে জানিয়ে রেখেছিল, ব্রেকফাস্টে ফলের কোয়ান্টিটি একটু বেশি রাখলে ভাল। খাবার খেয়ে বাথরুমে ঢুকে কুসুম কুসুম গরম জল দিয়ে ভাল করে স্নান সারতে সময় নিল প্রায় ঘণ্টাখানেক। সাবান মাখল, শ্যাম্পু করল। শেষে চুলটুল আঁচড়ে, জামা জুতো পরে হাসি হাসি মুখে জয়াদেবীকে বলল, ‘মা আজ তা হলে আসি? বাবার পাঞ্জাবিটা একটু বড় হলেও কী হবে পরে কিন্তু খুব আরাম। কাপড়টা ভাল।’

জয়াদেবী আপ্লুত ধরনের গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। তোমার জন্যে একটা পাঞ্জাবি কিনে তপুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেবখন।’

পলাশ হাসল। ঘাড় কাত করে অনুমতি নেওয়ার ঢঙে বলল, ‘তা হলে আসি মা?’

দিব্যকান্তিবাবু সুখবরটা পেলেন অফিসে বসেই। খুশি হলেন। এতটাই খুশি হলেন যে, সন্ধে সাতটার জরুরি মিটিং বাতিল করে দ্রুত ফিরে এলেন বাড়িতে। ড্রাইভারকে বললেন, ‘ভজন, তুমি পাশে বসো। আজ আমি গাড়ি চালাব।’

ড্রইংরুমেই বসে ছিলেন জয়াদেবী। ঘর অন্ধকার। দিব্যকান্তিবাবু আলো জ্বালিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, অন্ধকার করে বসে আছ কেন? চলো আজ দু’জনে কোথাও বাইরে খেয়ে আসি। বেশি কিছু নয়, স্যুপ আর মোমো। কেমন হবে?’।

জয়াদেবী মুখ তুললেন। মুখ থমথম করছে।

‘কী হল শরীরটরির খারাপ নাকি?’ উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, দিব্যকান্তিবাবু। ঝুঁকে স্ত্রীর কাঁধে হাতও রাখলেন। ঝটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলেন জয়াদেবী। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তপু ফোন করেছিল।’

‘এই রে আবার ওদের ঝগড়া নাকি?’ দিব্যকান্তির গলায় আতঙ্ক।

জয়াদেবী মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘না, তা নয়। মেয়ে খুব রাগারাগি করল।’

দিব্যকান্তিবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘রাগারাগি! কেন, রাগারাগি কেন? আমার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে নিশ্চয়?’

‘না তোমার হাঁটুর ব্যথা নিয়ে নয়। বলল, মা, পলাশ আমার সঙ্গে ঝগড়া করে ওখানে গিয়ে কদিন ছিল বলে সে কি তোমাদের জামাই নয়? আমি বললাম, কেন কী হয়েছে? মেয়ে বলল, কী হয়েছে তুমি জানো না? ছিল মাত্র দুটো না তিনদিন। এই ক’টা দিন তাকে ঠিকমতো যত্ন করতে পারলে না? আমি বললাম, কী অসুবিধে হয়েছে? তপু বলল, কী অসুবিধে বাবাকে জিজ্ঞেস করো। মানুষটার যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে। ছি ছি, তোমাদের জামাই আমাকে এসে যখন সব কথা বলল, আমি তো লজ্জায় মরে যাই।’

দিব্যকান্তিবাবু ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। এ সবের মানে কী? এই এত ঝগড়া, এখন বরের জন্যে মেয়ের প্রেম একেবারে উথলে উঠছে! কমপ্লেন পর্যন্ত করছে! গলার টাই আলগা করতে করতে তিনি বললেন, ‘মানে! যত্ন হয়নি মানে কী? লুচি, পটল, সিনেমা, পাঞ্জাবি কী পায়নি গাধাটা? তার পরেও কমপ্লেন! শুধু ওই ছেলেকে নয়, আমার এখন মনে হচ্ছে, তোমার মেয়ের গালেও ক’টা চড় দেওয়া উচিত।’

জয়াদেবী ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘তুমি আমাকে বললেই পারতে। আমি ব্যবস্থা করতাম।’

‘কী বলিনি তোমায়? আমি এর মধ্যে কোথায়? আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছ কেন?’

জয়াদেবী রাগের চোটে উঠে দাঁড়ালেন। আবার বসলেন। বললেন, ‘আমার ব্যাপার? মেয়ে তো তোমার বিরুদ্ধে বলল। আমি তাকে সাপোর্ট করেছি। জামাই নাকি তোমাকে কাল রাতে বলছিল, পুবদিকের জানলাটায় তার অসুবিধে হচ্ছে। পরদা ছোট। পরদার ফাঁক দিয়ে ভোরবেলা আলো ঢুকছে, ঘুম ভেঙে যাচ্ছে বেচারির। শুনে তাকে তুমি বলেছিলে, এক্ষুনি দেখছি। কোনও চিন্তা নেই। বলোনি? বলোনি তুমি? আমার মেয়েজামাই মিথ্যে বলছে?’

‘বলেছি তো, মিথ্যে হবে কেন?’

‘তারপর? তারপর কোনও ব্যবস্থাই নিয়েছ? নাওনি। কিছুই করোনি। নিজে নাক ডেকে ঘুমোতে চলে গেছ। টেলিফোনে তপুর তো কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। বলল, বাড়িতে কি একটা এক্সট্রা বড় পরদাও নেই মা? নাকি জামাইয়ের ঘরে পরদা টাঙাতে বাবার লজ্জা করল? ছি ছি, ছেলেটার নাকি তিনদিন ভাল করে ঘুমই হয়নি এখানে। তপু বলছিল, চোখ দুটো একেবারে লাল করে বাড়ি ফিরেছে।’

দিব্যকান্তিবাবু চুপ করে বসে আছেন। মাথা নিচু। হিসেব মতো স্ত্রীর বকুনিতে তাঁর রেগে যাওয়ার কথা। তা হয়নি। তিনি আনন্দিত হয়েছেন। ওই ছেলে এ বাড়িতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি, তাই আনন্দ। একটা শিক্ষা দেওয়া গেছে। এখন তাঁকে আরও একটা কাজ করতে হবে। এই মহিলাকেও একটু শিক্ষা দিতে হবে। কথাটা সত্যি, স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে শিক্ষা দিলে মাথায় চড়ে নাচে। জয়াও মাথায় চড়ে নাচছে।

দিব্যকান্তিবাবু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন দ্রুত। তিনি জামাইয়ের পথই অনুসরণ করবেন। গৃহত্যাগী হবেন। পাটনায় গিয়ে শালার বাড়িতে আশ্রয় নেবেন দিন কয়েকের জন্যে। শ্বশুরশাশুড়ি বেঁচে না থাকলে কী হবে, ওখানে যত্নআত্তি একেবারে শ্বশুরবাড়ির মতোই। কাল রাতের ট্রেনেই রওনা হবেন। পরদিন ভোরে পৌঁছে গরম লুচি খেতে খেতে শালার ডিভিডিতে হাসির সিনেমা দেখবেন। কটা চার্লি চ্যাপলিনের ছবি নিয়ে গেলে কেমন হয়?

সানন্দা, ১৫ মে ২০০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *