আহা! আজি এ বসন্তে

আহা! আজি এ বসন্তে

কৃষ্ণ বলিল, ‘হুঁ।’

রাধা তার গোলাপি উত্তরীয়টি মাথার উপর টানিয়া সামান্য আড় ঘোমটা দিয়া মিষ্টি হাসিয়া বলিল, ‘হুঁ নয়, উহুঁ।’

আসলে সে ঠিক করিয়া আসিয়াছে আজ কৃষ্ণের সঙ্গে খেলিবে। তাহার চিত্ত অস্থির করিয়া তুলিবে। মিলনের তাড়নায় সে ছটফট করিবে, রাগিবে, হাসিবে। তথাপি নিজেকে সমর্পণ করিবে না।

সেই খেলাই চলিতেছে।

কৃষ্ণ অভিমানারত মুখ ফিরাইয়া বলিল, ‘আমি কতটা তৃষ্ণার্ত, সে কথা কি তুমি বুঝতে পারছ না রাধিকে? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করো?’

কৃষ্ণের কথা শুনিয়া রাধার যেমন লজ্জা হইল, তেমন আমোদও হইল। মুখ টিপিয়া বলিল, ‘কীসের তৃষ্ণা?’

কৃষ্ণ কহিল, ‘জানোও না বুঝি?’

রাধা অধর দংশন করিয়া কহিল, ‘না, জানি না। তবে আজ কিছুতেই নয়।’

‘কেন? নয় কেন? সমস্যা কোথায় প্রিয়তমে।’

‘সমস্যা সর্বত্র। গোটা বৃন্দাবনে যে ঢি ঢি পড়ে গেল।’

বসন্তের এই মনোরম বৈকালে সূর্যাস্তের নিস্তেজ আলো যমুনা নদীর উপর দিয়া লঘু পদক্ষেপে পশ্চিম দিগন্তে মিলাইয়া যাইতেছে। দূর কাননের সুগন্ধি ভাসিয়া আসিতেছে। অস্তমান সূর্যের কনকচ্ছটা প্রথমেই বিচ্ছুরিত হইতেছে বৃক্ষরাজির পত্রে পত্রে, তাহার পর ঝরিয়া পড়িতেছে অলস ভঙ্গিমায়। দেখিলে মনে হইতেছে, যেন আলো নয়, স্বর্ণকণা। সেই কণার কিছু পড়িতেছে এই কদমতলেও।

রাধা হাসি গোপন করিয়া বলিল, ‘বুঝলে?’

কৃষ্ণ ক্রোধে গরগর করিয়া বলিল, ‘না বুঝলাম না। বুঝতে চাইও না। লোকনিন্দার ভয় আমি করি না।’

‘তুমি না করো, আমি তো করি। তা ছাড়া কী?’

রাধা মুহূর্তকাল নিশ্চুপ থাকিল। চক্ষু ভূমি সংলগ্ন করিয়া বলিল, ‘আমি সম্পর্কে তোমার কে হই, তুমি জানো না যেন। এই সম্পর্কে মিলন মহাপাপ।’

কৃষ্ণ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া বলিল, ‘কে বলে?’

কৃষ্ণের তর্ক শুনিয়া রাধার আরও হাসি পাইল। ভালমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, ‘অত সব তর্কের কথা আমি বুঝি না।’

কৃষ্ণ গজগজ করিল, ‘এ সব তোমার ছলনা। প্রত্যাখ্যানের ফন্দি। স্পষ্ট করে বলো দেখি রাধা তুমি কি মিলন চাও না?’

রাধার লজ্জা বাড়িল। অস্ফুটে বলিল, ‘না চাই না। যাও।’

‘তবে আজ এসেছ কেন?’

‘এসেছি এই কথাটুকুই বলতে।’

কৃষ্ণ এবার ক্রুদ্ধ গলায় বলিল, ‘বাজে কথা রাখো। এ তোমার বড় নিষ্ঠুর খেলা রাধিকে। শুধু এখন নয়, আগেও তুমি এই খেলায় মেতেছ। এর শাস্তি জানো? একেক দিন একেকটা বাহানা তোমার।’

রাধা আর পারিল না। হাসিয়া বলিল, ‘শাস্তি জানি না, তবে খেলায় যে মজা আছে, সেটা জানি।’

দূর আকাশে নবীন চাঁদের ফলক উঁকি মারিতেছে। যমুনা তীরের স্নিগ্ধ বাতাসে দুইটি মন ভরিয়া উঠিতেছে ধীরে ধীরে। কদমতলে সুনিবিড় ছায়া নামিয়াছে। নীড়ে ফেরা পক্ষীকুলের কুহুতানে চারিপাশ সংগীতমুখর।

কৃষ্ণ কঠিন মুখে বলিল, ‘অনেক সহ্য করেছি, আর নয়। এখনই যদি আমার আলিঙ্গনে না আসো, তোমার কপালে দুঃখ আছে প্রাণেশ্বরী। আমি কিন্তু এবার জোর দেখাব। তোমার কলসের দধি দুধ নষ্ট করব, সনাতনী হার কেড়ে নেব, কাঁচুলি ফেলব ছিঁড়ে। তখন বুঝবে মজা কাকে বলে এবং কয় প্রকার। তার আগেই ভালয় ভালয় আমার আলিঙ্গনে এসো।’

রাধা কাজলে ভাসা ভাসা চোখে অধর ঈষৎ স্ফুরিত করিয়া বলিল, ‘না।’

‘আবার না! কেন? এত করে যে চাইছি তোমায়, আমার আলিঙ্গনে আসতে তোমার বাধা কোথায়? তা হলে জোর খাটাই।’

রাধার বুকে শিহরন জাগিল। আনন্দের শিহরন। এত রং ঢঙে সে যে এই জোরই কামনা করিতেছিল এতক্ষণ। ইতিমধ্যেই আড় চোখে সে দেখিয়াছে প্রিয়তমের হরিণায়ত চক্ষু দুটি কামনার ছটায় আরও মধুর, আরও আপন হইয়া উঠিয়াছে। মিলন আকাঙ্ক্ষায় অধর হইয়াছে পক্ক-বিল্বফলের ন্যায় পুষ্ট, গাঢ়, রক্তাভ। সরল মুখখানিতে সৌন্দর্য ছাড়াও যেন আরও কিছু যুক্ত হইয়াছে। সেই ‘আরও কিছু’ স্নায়ু-শরীরে আগুন ধরাইয়া দিতে জানে।

রাধা মুখ নামাইল। বুবিল, পালাইবার পথ নাই আর। খেলা সাঙ্গ হইবে এখনই। এবার শুরু সর্বনাশের পালা। যে সর্বনাশের জন্যই এত ছলচাতুরি, এত সাজ। প্রাণাধিক বড় বেশি কামোন্মত্ত হইয়া পড়িয়াছে। রাধার রাঙা মুখখানি দ্রুত রাঙা হইল। ওষ্ঠাধর ঈষন্মুক্ত, আঁখিতারকা নিশ্চল। পল্লবে আসিল কাঁপন। হায় রে, সে নিজেও বুঝিতে পারে নাই, কামনার শিখা কখন তাহার মনেও সঞ্চারিত হইয়াছে! কিছু করিবার নাই আর।

নিজের ওপর যেমন ক্রোধ হইল, তেমন তৃপ্তির আগাম আনন্দে অন্তরে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল রাধা। স্খলিত আঁচলটি তুলিয়া কাঁচুলির উপর রাখিল। হাঁটু মুড়িয়া, কোলের উপর রাঙা হাত দুটি রাখিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘সে আর নতুন কথা কী? এতকাল যেন জোর খাটাওনি।’

কৃষ্ণ মৃদু হাসিয়া রাধার হাত ধরিল। গাঢ় স্বরে কহিল, ‘আজ এত সাজ কীসের প্রিয়া?’

রাধা অস্ফুট বলিল, ‘ওমা, সাজ কই!’

সত্যি রাধা সাজিয়াছে। মথুরা হাট হইতে ফিরিবার পথে দীর্ঘ সময় ধরিয়া রাধা সাজিয়াছে পুষ্প সাজে। পথের ধারে ফুলের সাজি লইয়া বসিয়া ছিল মালিনী। সে রাধার দুই বেণিতে জড়াইয়া দিয়াছে কুন্দকলি। স্বর্ণ অঙ্গে পুষ্পভূষা আর কর্ণে দিয়েছে শিরীষের কাঁপন। কণ্ঠে ফুলহার রাখিয়াছে এমনভাবে, যাহাতে সে দুলিতে পারে বক্ষযুগলের মৃদু ছন্দে। নিতম্ব অশোকপুষ্পের কাঞ্চীতে সুন্দর। তবে চরণে ফুলের অলংকার দেয় নাই মালিনী। সেখানে আছে অলক্তরাগের উপর সোনার গুঞ্জরী নূপুর। সুন্দরীর অঙ্গে ফুলের আভরণ শোভা বৃদ্ধি করে ঠিকই; কিন্তু পায়ে গুঞ্জরী নূপুর না থাকিলে প্রতি পদক্ষেপে ঝংকার উঠিবে কেমন করিয়া? রাধার নিতম্ব, জঘন, পয়োধর যুগল পত্রপুষ্পে ঝলমল করিতে লাগিল। জীবন্ত কানন যেন! রূপ, সৌরভ আর মন ভোলানোর মায়া লইয়া গুঞ্জরীতে রিনিঝিনিতে আওয়াজ তুলিয়ে হাঁটিতেছে।

মালিনী রাধার মৃণালভুজে ফুলের অঙ্গদ পরাইতে পরাইতে হ্রস্বস্বরে বলিল, ‘কোন ভ্রমরের কাছে যাবে গো দিদি?’

রাধা কিল তুলিয়া দেখাইল। হাসিয়া বলল, ‘চুপ কর মুখপুড়ি।’

মালিনী ঝরঝর করিয়া হাসিয়া উঠিল।

কদমতলে কৃষ্ণ শুইয়া ছিল ঊর্ধ্বমুখে। বিরহে মনমরা। দীর্ঘদিন রাধার সহিত তাহার দেখা নাই। মনে হইতেছিল কোমল শুষ্কপত্রের শয্যায় কে যেন কন্টক বিছাইয়াছে। কন্টক গোধূলির স্নান আলোতে মনমরা ভাব আরও বাড়িয়াছে। কেবলই মনে হইতেছে সে কি আসিবে? নাকি, সে আসিবে না? ভাবিতে ভাবিতে খানিকটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়াছিল কৃষ্ণ। হঠাৎই গুঞ্জরীর রিনিঝিনি শব্দ! চারিপাশের বাতাস সুগন্ধ! ব্যাকুল চিত্তে উঠিয়া বসিল কৃষ্ণ। চমকিয়া উঠিল। সে পত্রপুষ্পে সজ্জিত অপরূপা রাধাকে দেখিয়া তাহার নিশ্বাস বহিতে লাগিল ঘনঘন।

এত সুন্দর! এ কি সত্য? নাকি এ মায়া?

‘রাধিকা! কোথায় ছিলে এতদিন? কোথায় ছিলে প্রাণাধিকা?’

নতচক্ষুতে অল্প হাসিয়া রাধা কৌতুক করিল। বলিল, ‘কোথায় আর ছিলাম? তোমার পাশেই।’

কৃষ্ণ আরও ঘন হইয়া রাধার হাত ধরিল। সেই মুঠিতে শুধু প্রেম নয়, জোরও রহিয়াছে। এই জোর ভাঙিয়া ফিরিয়া যাওয়া অসম্ভব। যাওয়া অনর্থক। রাধার অন্তর বাজিয়া উঠিল। ফিসফিস করিয়া বলিল, ‘আঁধার নামুক।’

খানিক পরেই রাত্রি আসিল। আসিল তারা নক্ষত্রের রত্ন খচিত নীল আঁচলের মতো। ঘন হয়ে আসা প্রণয়ী যুগলকে সযত্নে, স্নেহভরে আবৃত করিল। কৃষ্ণ চক্ষু দিয়া প্রাণেশ্বরীকে আহ্বান করিলে, রাধা তাহার লজ্জা-ভূষণের বাধা সরাইয়া বলিল, ‘তুমি বড় দুষ্ট’। বলিয়া কোমল পেলব বাহু দিয়া জড়াইয়া ধরিল কৃষ্ণের কণ্ঠ। দুরন্ত আবেগে চক্ষু, গ্রীবা, অধর ও সর্বাঙ্গে চুম্বন করিতে লাগিল প্রেমে ও পরম আশ্লেষে। আর কৃষ্ণ? সে অতি যত্নে একটি একটি করিয়া পুষ্প আভরণ থেকে মুক্ত করিতে লাগিল রাধাকে। তাহার পর প্রতিদান দিল চুম্বনে।

‘চলো পালাই।’

‘কোথায়?’

‘যেখানে দু’চোখ যায়। যমুনায় নৌকো ভাসাই।’

‘উঁ উঁ চলো, চলো, চলো…।’

নব নব অনুভবের বিস্ময়-পুলক-ভরা মোহ বিহ্বল সন্ধ্যা থমকিয়া দাঁড়াইল। যেন সময় দিল। মিলন ঘটিল দুটি শরীরের।

আর এই সময়েই এক কাণ্ড হইল!

রাধা কৃষ্ণের শিহরিত, চঞ্চল, উদ্বেলিত শরীরের ধাক্কায় একপাশে রাখা কৃষ্ণের মোহনবাঁশিটি গড়াইয়া পড়িল নিঃশব্দে। পড়িল কদমতলা হইতে। তাহার পর পড়িতে লাগিল। পড়িতে লাগিল। পড়িতেই লাগিল…।

আকাশ পথে স্বর্গের সীমানা বড় কম পথ নহে, সেই সীমানা শেষ করিয়া মোহনবাঁশি যখন মর্তের আওতায় ঢুকিল, তখন সে তাহার রত্নখচিত রূপ, মুক্তার ঝালর, হীরক শোভিত মকর মুখ, স্বর্ণের আভা— সবই হারাইয়া ফেলিয়াছে।

তখন সে একটি অতি সাধারণ খেলনা বাঁশি মাত্র!

আজ ভোরের গাড়িতে বাবা-মা আর বোন ইতি গিয়েছে জামশেদপুর। মামাতো দাদার বিয়ে। দিতিরও যাওয়ার কথা ছিল। সেইমতো গোছগাছ কমপ্লিট করেছিল। বিয়ে বলে শাড়ি বেশি। দুটো টাঙাইল, একটা তসর, ধনেখালি একটা, শিফন আর সুতি একটা করে। তারপরেও মন খুঁতখুঁত করছিল। জিনস, টপস, সালোয়ার আর ক্যেপরি নিয়ে খুঁতখুতানি। ডিসিশন নিতে পারছিল না। ব্যাগে জায়গা নেই, কোনটা বাদ দেবে? এমন সময় খবর এল। সেই খবর জানার পরই দিতি প্রোগ্রাম বাতিল করেছে। খবর ভয়ংকর।

জামশেদপুরে মামাতো দাদার বিয়ের আড়ালে দিতির বিয়ের তোড়জোড় চলছে!

এই তোড়জোড়ের মূল উদ্যোক্তা দিতির মেজমামিমা। তিনি সেখানে পাত্রী ‘দেখানো’র ব্যবস্থা করেছেন। পাত্র অতি লোভনীয়। ইঞ্জিনিয়র এবং সুপুরুষ। হাইট একটু শর্টের দিকে তবে গায়ের রং ফরসা। অতিরিক্ত ফরসা। মাথা ভরতি ঘন চুল। নাক টিকলো। শুধু রূপ নয়, পাত্র গুণেও মনভোলানো টাইপ। খুব অল্পদিনের মধ্যে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। সবথেকে বড় কথা হল, ছেলের চা-কফি, মদ, সিগারেট কোনও কিচ্ছুর নেশা নেই। মেজমামিমার মতে, এত বড় পৃথিবীতে ভাল-মন্দ অনেক ধরনের পাত্র পাওয়া যায়, কিন্তু নেশাহীন পাত্র পাওয়া যায় না। মেজমামিমা এতেই মজেছেন। মজেছেন এবং খেপেছেন। দিতির মাকে ফোনে বললেন—

‘তুমি শুনলে খুব আনন্দ পাবে, তোমার হবু জামাইয়ের নেশা শুধু সুক্ততে। ছোটবেলা থেকেই শ্রীমান তেতোর ভক্ত। সুক্ত ছাড়া উনি খেতেই বসবেন না। পরশুদিনই তো নাকি এক কাণ্ড হয়েছে। ভাতের পাতে নিমপাতা না পেয়ে বাবু তো রেগে আগুন। এক বিচ্ছিরি অবস্থা। বোঝো কাণ্ড একবার! হা হা। নিমের জন্য রাগ! সত্যি কথা বলতে কী, এই কারণেই বাইরে যাওয়ার আগে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে। বুঝলে সীমা, বিদেশে সব পাওয়া যায়, সুক্ত পাওয়া যায় না। পাত্রের শখ, লাঞ্চে বউ সুক্ত রেঁধে খাওয়াবে।’

দিতির মা আমতা আমতা করে বলে, ‘কিন্তু, কিন্তু দিতি তো রান্নাবান্নার তেমন কিছুই জানে না। সুক্ত তো দুরের কথা…।’

মামিমা চাপা গলায় ধমক দেন।

‘চুপ, এসব একদম বলবে না। সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। ওরকম পাত্রের জন্য সুক্ত কেন, শিম বেগুন দিয়ে আরশোলার ঝোল পর্যন্ত শিখিয়ে দেব। এখন কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, দিতিকেও নয়। ওকে সারপ্রাইজ দেব।’

এই খবর জানার পরই জামশেদপুর ক্যানসেল করল দিতি।

কাল রাতে মা ঘরে এল। থমথমে মুখে।

‘শুনলাম, তুমি নাকি জামশেদপুরে যাচ্ছ না, ঘটনা কি সত্যি?’

দিতি শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাগ খালি করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ মা সত্যি।’

‘কেন?’

‘ওমা! বললাম না, পরীক্ষা পড়ে গিয়েছে।’

‘পরীক্ষা কি হঠাৎ পড়েছে?’

দিতি মুখ তুলে হেসে বলল, ‘কেন হঠাৎ পড়লে আপত্তি কোথায়? ইউনিভার্সিটি তার পরীক্ষা হঠাৎ নেবে, না রয়ে-সয়ে নেবে, সেটা তারা বুঝবে।’

মা কঠিন মুখে বলল, ‘ওসব বাজে কথা রাখো, পরীক্ষা টরিক্ষা কিছু নয়। আমি জানি, তুমি কেন যাচ্ছ না।’

দিতি তার ব্যাগ থেকে শাড়িগুলো বের করে মন দিয়ে ওয়ার্ডরোবে ঢোকাতে লাগল। শাড়ি পরতে একবারে ভাল লাগে না দিতির। নেহাত বিয়েবাড়ি বলে শাড়ি নিয়েছিল।

মা বলল, ‘কী হল, উত্তর দিচ্ছ না কেন?’

দিতি চুপ করে থাকে।

‘দিতি, তুমি কি জানতে ওখানে তোমার মামিমা তোমার জন্য…?’

দিতি হেসে বলল, ‘জানতাম না মা, জেনেছি। শুনেছি, ছেলে খুব ভাল। একটু বেঁটের দিকে, কিন্তু ফরসা। আজকাল ফরসা ছেলেদের খুব ডিমান্ড। একসময় আমেরিকায় ব্ল্যাকদের জন্য এমন ছিল।’

মা চাপা গলায় হিসহিস করে উঠল।

‘চুপ। একদম চুপ। সবকিছু রসিকতা করার জিনিস নয় দিতি। এরকম একটা ভাল সুযোগ তুমি হারাতে পারো, আমরা হারাব না। সামনের অক্টোবরে ওই ছেলের পেনসিলভেনিয়া চলে যাওয়ার কথা পাকা। ততদিনে তোমার ফাইনাল হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি এম বি এ পড়তে চাও, সেখানে গিয়েও পড়তে পারো। সবদিক ভেবেই আমরা রাজি হয়েছি। ইতিমধ্যেই তারা তোমার ফটো দেখে পছন্দ করে ফেলেছে। এবার তোমাকে দেখবে। তারপর একটা…’

দিতি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি শুনেছি মা, মোট তিন পর্যায়ের পরীক্ষা। শেষে একটা ইন্টারভিউ হবে তো? সুক্তর ওপর ইন্টারভিউ।’

মা কঠিন গলায় বলল, ‘চুপ করো। দিতি, স্বাধীনতা মানে নিজের গলা কাটার স্বাধীনতা নয়। আমরা চাই তুমি এই বিয়ে করো। আশা করি, তুমিও চাইবে। কারণ তুমি বুদ্ধিমতী। নিজের ভাল বোঝার সঙ্গে বুদ্ধি, স্বাধীনতা বা আধুনিকতার কোনও ঝগড়া নেই। যাক, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। হাতে ক’টা দিন সময় রইল। ঠান্ডা মাথায় ভাবো। আমি এখনই কাউকে কিছু বলছি না। আমি চাই না, এটা নিয়ে একটা শোরগোল বাধুক। ভাবা হয়ে গেলে, তোমার বাবাকে একটা ফোন কোরো। সে এসে তোমাকে জামশেদপুরে নিয়ে যাবে।’ এই পর্যন্ত বলে মা থামল। তারপর চশমার ফাঁক দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনেক খবর পেয়ে গিয়েছ দেখছি। ছেলের নাম কী, জেনেছ? মনে হয় না জেনেছ। খুবই সুন্দর নাম। সিঞ্চন। ভোম্বল, কম্বল বা ডাম্বেলের থেকে যে সুন্দর, সেটা তো মানবে?’

কথা শেষ করে মা ঘরের বাইরে চলে গেল।

দিতি ঠান্ডা মাথায় ভেবেছে এবং ফোন করেছে। তবে বাবাকে নয়, ভোম্বলকে।

‘অ্যাই, তুমি বিকেলে একবার আসবে।’

‘ইমপসিবল, বিকেলে তিন-তিনটে টিউশন দিতি। আর মধ্যে একটা বাড়িতে মাইনে দেওয়ার কথা। দু’মাসের মাইনে বাকি।’

দিতি ঠান্ডা গলায় বলল, ‘টিউশন কামাই করবে। মাইনে আমি দেব। কত টাকা? হাউ মচ?’

ভোম্বল হাল ছাড়া গলায় বলল, ‘ঠিক আছে, কোথায় যাব?’

দিতি বলল, ‘আমার বেডরুমে। কী চুপ করে আছ কেন? ভয় পেলে? ঠিক আছে বেডরুম দরকার নেই ডার্লিং, তুমি আমাদের ড্রইংরুম পর্যন্ত এসে, তা হলেই চলবে।’

ভোম্বল অবাক গলায় বলল, ‘তোমার বাড়িতে! মাথা খারাপ হল নাকি?’

‘মনে হচ্ছে, হয়েছে। মাথা খারাপ হয়ে তোমাকে জড়িয়ে বসে থাকব ঠিক করেছি।’

‘এসব কী বলছ দিতি! আমার তো ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে চলে যাই।’

দিতি এতক্ষণ নিজের খাটে শুয়ে ছিল হাত পা ছড়িয়ে। বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই সে শুয়ে আছে। শুয়ে শুয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কাল সকালেই ভোম্বলকে নিয়ে ম্যারেজ রেজিষ্ট্রি অফিসে যাবে। সেখান থেকে বেরিয়ে বাইরে কোথাও লাঞ্চ করবে। তারপর, মামিমাকে মোবাইলে ধরবে।

‘মামিমা, সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বলতে লজ্জা করছে, কিন্তু ছেলে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। আমি তার জন্য উচ্ছে বেগুন আর নিমপাতা দিয়ে সুক্তর একটা চমৎকার প্রিপারেশন শিখেছি। প্রথমে উচ্ছের বিচি বের করে পেট চিরে নিতে হবে, তারপর, বেগুনগুলো ডুমো ডুমো করে কেটে কড়াইতে অল্প তেলে সাঁতলে… থাক, তুমি কলকাতায় এলে রেঁধে দেখাব। একেবারে হাতেকলমে পরীক্ষা দেব। আমি শিয়োর, আমার রাঁধা সুক্ত পাত্রের খুবই পছন্দ হবে। সমস্যা শুধু একটাই। ঘণ্টাখানেক আগে আমি হুট বলতে নিজের পছন্দমতো একটা বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছি। পাত্র ভাল নয়, বেকার, টিউশন মাস্টার। তবে কম্পিউটার শিখছে, মনে হয় একটা কিছু হয়ে যাবে। খুব শিগগিরই ফটো পাঠাব। ফটোতে গায়ের রং ময়লা মনে হবে, তবে আসলে ময়লা নয়, কাজের ধান্দায় রোদে ঘুরে… নাম শুনে তো হাসতে হাসতে মরে যাবে। ভোম্বল। এই যুগে একটা রেয়ার নাম। যাক, বাবা-মাকে এখনই কিছু বোলো না। বিয়ে টিয়ে মিটে আমি নিজে ফোন…।’

দিতি উঠে বসল। ফোনে হেসে বলল, ‘ভয়ের এখনই কী দেখছেন ভোম্বলবাবু, আরও ভয় আসছে। কামিং। তবে তুমি যা ভাবছ, সেরকম কিছু নয়। বাড়ি ফাঁকা। বাবা-মা, ইতি জামশেদপুরে গিয়েছে আজ সকালে। তাড়াতাড়ি চলে এসো, একটা মারাত্মক পরিকল্পনা করেছি।’

ভোম্বল ওপার থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘চুমু খাওয়ার পরিকল্পনা থাকলে বলো।’

‘অসভ্য কোথাকারে, আগে জরুরি কথা।’

‘কেন আগে মিষ্টি মুখ দিয়ে শুরু করলে ক্ষতি কী?’

দিতি খিলখিল করে হেসে বলল, ‘মিষ্টি না ঝাল বুঝতে পারবে স্যার। আরও বেশি হতে পারে।’

ভোম্বল বলে, ‘ফ্যানটাস্টিক। এখন যাব?’

দিতি গম্ভীর গলায় বলে, ‘না, এখন নয়। এখন আমি সুক্তর প্রিপারেশন শিখব। তারপর তোমার জন্য একটা নাম ভাবব।’

শ্রীমান ভোম্বল আসে বিকেলের একটু পরে পরে। চোখ মুখে আনন্দ, চাপা উত্তেজনা। এই প্রথম সে প্রেমিকার বাড়িতে এত স্বচ্ছন্দে ঢুকছে। যে এক-দু’বার এসেছে, দিতির মা তার সঙ্গে খুবই ঠান্ডা আচরণ করেছেন। তার মতো একটা বেকার, অপোগণ্ড ছেলের সঙ্গে প্রেমিকার মা হেসে হেসে কথা বলবে, আশা করাটা ঠিক নয়, তবু…।

দিতি সেজেছে। আকাশ নীল জিনসের সঙ্গে ‘স্যান্ডেল উড’ রঙের টপ। থাই পর্যন্ত ঝুল। চাইনিজ কলার, থ্রি কোয়াটার স্লিভস। এই টপ বাছতে তার সময় লেগেছে। টপের কোমর, গলা আর হাতে সুতো দিয়ে ফুল আঁকা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে ফুলের সাজ। গলায় ব্ল্যাক স্টোনসের মালা। মালায় বিডস আর মেটাল। কানেও তাই। বড় বড় স্টোন। খুব দুলছে। দক্ষিণাপণ ঘুরে কিনতে হয়েছে। সময় লেগেছে। দিতির খুব ইচ্ছে ছিল, মাথাতেও একটা কিছু দেয়। ব্যান্ড ধরনের কিছু। কিন্তু মনের মতো কিছু পাওয়া যায়নি। যে দু’-একটা ভাল ছিল, ইতি নিয়ে চলে গিয়েছে।

ভোম্বল গদগদ মুখে বলল, ‘এত সেজেছ কেন মাইরি?’

দিতি হেসে বলল, ‘শাট আপ, ডোন্ট ইউজ স্ল্যাংস।’

‘সরি, ভেরি সরি। হেভি লাগছে কিন্তু। স্লিম অ্যান্ড সেক্সি।’

দিতি চোখ পাকিয়ে বলল, ‘খুব সাহস, না?’

ভোম্বল পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘বেশি নয়, একটু।’

‘আজ যে কথাটা তোমাকে বলব সেটা না সেজে বলা যায় না। নাও কফি খাও। আমি নিজে হাতে করেছি।’

বাইরে সন্ধে নামছে। আজকাল আর যাদবপুরের এদিকটায় সন্ধে অন্ধকারে বোঝা যায় না। বোঝা যায় ঝলমলে আলোয়।

ভোম্বল কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে, ‘কথা পরে, আগে পাশে এসে একটু বসো দেখি। বাড়িতে কেউ নেই তো?

দিতি উঠে গিয়ে ভোম্বলের পাশে বসল। ভোম্বলের নাকটা ধরে এক গাল হেসে বলে, ‘আছে। ভূত আর পেতনি। রান্নার মাসিকে পর্যন্ত ছুটি দিয়ে দিয়েছি।’

ভোম্বল দিতির কোমরে হাত রাখে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘একটা চুমু খাব?’

দিতি চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খেপেছ? এখন কী ঋতু জানো।’

‘কী?’

‘একটা গাধা। এখন হল বসন্ত ঋতু। এইসময় ওসব করলে কেলেঙ্কারি হয়।’

ভোম্বল চট করে দিতির রসিকতা ধরতে পারে না। ভুরু কুঁচকে বলে, ‘কী কেলেঙ্কারি হয়?’

দিতি ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘কী আবার, সব উলটেপালটে যায়।’

‘মানে? ইয়ারকি হচ্ছে? আমাকে বোকা পেয়েছ না? আগে এসো, এসো বলছি। নইলে কিন্তু জোর করব।’

ভোম্বল মুখ বাড়ায়।

দিতি হেসে ফেলে। নিজের মুখ সরিয়ে হাত তুলে হাসতে হাসতে বলে, ‘অনেক সময় পাবে, হাঁদারাম। এখন কাজের কথাটা শোনো। কাজের কথা হয়ে গেলেই…।’

ভোম্বল সোফায় হেলান দেয়। আবছা অন্ধকারেই তার চোখ চকচক করে ওঠে।

‘ঠিক তো। প্রমিস?’

‘প্রমিস। বসন্তকালের প্রমিস। সব প্রমিস ভাঙা যায় কিন্তু সিজনের নামে প্রমিস ভাঙা যায় না। নাও এবার শোনো দেখি। একটা বিপদে পড়েছি। মা আর মেজমামিমা মিলে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’

‘বিয়ে!’ ভোম্বল সোজা হয়ে বসে।

‘হ্যাঁ, পাত্র লেখাপড়ায় খুবই ভাল। সুক্তর ওপর ডক্টরেট আছে। এবার মন দিয়ে শোনো’

মন দিয়ে শোনার পর মিনিট খানেক সময় নেয় ভোম্বল। প্রথমে নাকটা ফুলে ওঠে। তারপর ঠোঁট কাঁপতে থাকে। চোখ বিস্ফারিত হয়। মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে নিজে থেকেই। কফির মাগ হাতে লাফিয়ে ওঠে সে। কফি চলকে পড়ল সোফায়, কার্পেটে।

‘খেপেছ? পাগল হয়েছ? বিয়ে! ওরে বাবা! অসম্ভব… ইমপসিবল। জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি… আমার বাবা, তোমার মা…। তোমার মা… আমার বাবা…। একটা সামান্য সুক্তর জন্য তুমি এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছ দিতি? আমাকে বিয়ে করতে বলছ দিতি… ফরগিভ মি, ফরগেট মি… উফস…। না, নো, নেভার…।’

দিতি অবাক হয়ে দেখে ‘স্মার্ট ভোম্বল’-এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য একটা ভোম্বল!

অবাক ভাব কেটে গেলে দিতির দুঃখ হতে থাকে। চোখ ফেটে জল আসে। কী হবে? গলার ব্ল্যাক স্টোনসের হার আঙুল দিয়ে পেঁচাতে পেঁচাতে কান্না কন্ট্রোল করে দিতি। উঠে দাঁড়ায়। বানানো হেসে বলে, ‘কফি শেষ করো। তোমার টিউশনে দেরি হয়ে যাচ্ছে না?’

ভোম্বল গুম মেরে বসে থাকে এবং একসময় ঠান্ডা কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে উঠে পড়ে।

রাত পর্যন্ত ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে দিতি। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস আসা-যাওয়া করে। বসন্তের বাতাস? বেশ লাগে দিতির। একা একা বাড়িতে থাকা তো হয় না।

সে অন্ধকারেই জামশেদপুরে বাবাকে টেলিফোনে ধরে।

‘হ্যালো বাবা, পরশু বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে যদি রওনা হই? তুমি আসতে পারবে না?’

কথা শেষ করে খাট থেকে নেমে পড়ে দিতি। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দেয়। পেনসিলভেনিয়ায় এম বি এ এন্ট্রাসের পরীক্ষা কেমন? হার্ড? শুধুই কি রিট্‌ন? নাকি ভাইভাও দিতে হয়? বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে গুনগুন করে গান ধরে। ঘরের আলো জ্বালায়। আর তখনই দরজার গোড়ায় জিনিসটা চোখে পড়ে!

আরে ওটা কী! এখানে এল কী করে!

একটা বাঁশি! অতি সাধারণ একটা বাঁশি।

বাঁশরী ধ্বনিতে রাধা চমকিয়া উঠিল। ডাক আসিয়াছে, ডাক আসিয়াছে।

রাধা চারপাশে তাকাইল সচকিত ভঙ্গিতে। সখি ও মাঝিদের আড়াল করিয়া ঘাটের পাশে সরিয়া আসিল দ্রুত। কেহ যেন দেখিতে না পায়, বুঝিতে না পারে।

লাজুক নয়নে, রাঙা মুখে কাঁচুলির ভিতর হইতে মোবাইলটি বাহির করিল রাধা। রিংটোনে মধুর বাঁশরী ধ্বনি বাজিয়া উঠিল ফের।

প্রতিদিন রোববার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *