হলুদ গোলাপ

হলুদ গোলাপ

আমি খুবই বিপদের মধ্যে পড়েছি।

শুরুতে বিপদের চেহারা ছোট ছিল, কিন্তু যত সময় যাচ্ছে বিপদ বড় আকার ধারণ করছে। চৈত্র মাসের এই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে কারও হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসার কথা নয়। তবু মনে হচ্ছে, আমার ঠান্ডা হয়ে আসছে। কী করব বুঝতে পারছি না। একটাই সান্ত্বনা, এই বিপদের সঙ্গে খুব সুন্দর একটা জিনিস জড়িয়ে আছে। সেদিক থেকে বলা যেতে পারে, আমার এই বিপদ হল সুন্দর বিপদ।

আগে করলেও আজকাল বিপদ নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করি না। কারণ বেশিরভাগ সময়েই বিপদ থেকে আমি বেরোতে পারি না। কারণ বিপদের হাত থেকে বাঁচতে পথ খুঁজে পাওয়া দরকার। এর জন্য মাথা খাটাতে হয়। ইদানীং আমাকে বিপদ থেকে বের করার জন্য আমার মাথা কোনও পরিশ্রম করতে চায় না। একটা বেকার, ফালতু এবং অলস ছেলের জন্য মাথা খাটবে কেন? ‘মরুক গে যাক’ বলে সে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকবারই এরকম হয়েছে। আমাকে বিপদে ফেলে আমার মাথা ঘুমিয়ে পড়েছে। এটা খুবই অপমানের একটা ব্যাপার। নেহাত আমি মান অপমান তেমন গায়ে মাখি না। ফলে বিপদে আমি চিন্তাহীন থাকতে চেষ্টা করি। বিপদ যত বাড়তে থাকে আমার মন তত ফুরফুরে হয়ে ওঠে। বিপদ কাঁধে নিয়ে দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াই আর গুনগুন করে আওড়াই— ‘আমারে সে ভালবাসিয়াছে, আসিয়াছে কাছে…।’

কিন্তু আজকের এই বিপদ থেকে আমাকে বেরোতে হবে। না পারলে আমার যতটা না সমস্যা তমালের সমস্যা অনেক বেশি। এই ঘটনার সঙ্গে তমালের অফিসের প্রোমোশন জড়িয়ে আছে। তমাল আমার অনেকদিনের বন্ধু। তাকে সমস্যায় ফেলা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি তাকে কথা দিয়েছি, কাজটা করে দেব। যদিও আজকাল কথা দেওয়া কোনও ব্যাপার নয়। কথার দাম এখন খুবই নীচের দিকে। খবরের কাগজগুলো যদি নিয়মিত বাজারদরের লিস্টে আলু, পটল, মুসুর ডালের সঙ্গে কথার পাইকারি এবং খুচরো মূল্য ঘোষণা করত তা হলে ব্যাপারটা সকলের কাছে স্পষ্ট হত। দাম হুড়মুড় করে পড়ছে। তবে এক্ষেত্রে শুধু ‘কথা’ নয়, অন্য ঘটনাও আছে।

কাজটা করে দেওয়ার জন্য তমাল আমাকে কিছু টাকা দিয়েছে। তার এই বেকার বন্ধুকে সে সুযোগ পেলেই নানা কায়দায় খানিকটা করে টাকা পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এটা তার অনেকগুলো বাজে অভ্যেসের একটা। আমাকে বহুবার চাকরি-বাকরিতেও ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি দু’-একবার ঢুকেছিও। টিকতে পারিনি। একবার অফিসে যাওয়ার বদলে এসপ্ল্যানেড় থেকে বাস ধরে ঝাড়গ্রাম চলে গিয়েছিলাম। যেতাম না। আমি বিরাট কোনও প্রকৃতিপ্রেমিক নই, কবিও না। তাদের মতো কাঁধে ঝোলা নিয়ে দুমদাম বেরিয়ে পড়ার মতো সাহস বা ক্ষমতা কোনওটাই আমার নেই। বাস গুমটির কাছে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরাব, তারপর রাস্তা টপকে অফিসের দিকে হাঁটা দেব— এই ছিল পরিকল্পনা। হঠাৎ পাশে একটা দুরপাল্লার বাস এসে দাঁড়ায়। সেই বাসটার গা থেকে দেখি কেমন যেন গন্ধ আসছে। বুনো গাছপালার গন্ধ। বাস থেকে আসবে ধোঁয়া, ডিজেলের গন্ধ, গাছপালার গন্ধ আসবে কেন! আমি খানিকটা অবাক হয়েই বাসটায় উঠে দেখতে যাই এবং ঝাড়গ্রাম চলে যাই। সেখান থেকে কাঁকড়াঝোড়ের জঙ্গল। ব্যাগে জামা-কাপড়ের বদলে অফিসের জরুরি তিনটে ফাইল ছিল। ফেরার সময় ঘাটশিলা হয়ে ফিরছিলাম। সুবর্ণরেখার জালে ব্যাগ পড়ে গেল এবং ফাইলগুলো ভিজে ঢোল হয়ে গেল। কলকাতায় ফিরে আমি সেই ভেজা ফাইল অফিসে জমা দিতে গেলে… যাক সে অন্য গল্প।

আসলে বাঁধাধরা চাকরি জিনিসটা আমার ধাতে সয় না। নিজেকে ক্রীতদাসের মতো মনে হয়। আমি একজন অলস মানুষ। আমার শুয়ে থাকতে বেশি পছন্দ। শুয়ে শুয়ে পা নাড়ানোর মতো আনন্দ কিছুতেই খুঁজে পাই না। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু না করলেই নয়, সেটুকু করলেই যথেষ্ট। এর বেশি আমার দ্বারা হবে না। নিজের এই আলসেমির সপক্ষে তমালকে অনেক লেকচার দিয়েছি। জ্ঞানগর্ভ সব লেকচার। তাতে বড় বড় ঋষি মনীষীদের উদাহরণ আছে। বলেছি, শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে কেউ ইতিহাসে নাম রাখতে পারেনি। ‘শ্রেষ্ঠ চাকুরে’ বলে কোনও পদক চালু হয়নি দুনিয়াতে। তমাল বুঝতে চায় না। ধমক লাগায়।

‘চোপ। এসব তোর আলসেমির কথা। ফালতু ছেলের কুঁড়েমি। এসব শোনার মতো সময় আমার হাতে নেই।’

আমি চোখ দুটো আধবোজা করে ‘চুক চুক’ আওয়াজ করি। বলি, ‘ছি ছি তমাল, তুই আলসেমিকে তুচ্ছ করছিস! হেয় জ্ঞান করছিস! এ কাজও করিস না ভাই। আলস্যকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ছোট করে দেখেননি। বরং উলটোটাই করেছেন। আলস্য তিনি মহান করেছেন।’

তমাল ভুরু কুঁচকে বলে, ‘মহান করেছেন!’

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বলি, ‘ছিন্নপত্র পড়িসনি? নিশ্চয় পড়িসনি। পড়লে একথা বলতিস না। মন দিয়ে শোন। সেটা ছিল নিঝুম দুপুর। কালিগ্রাম নামের একটা জায়গায় নদীর ওপর বোট ভাসছে। সেই বোটের ওপর বসে কবি লিখছেন…।’

তমাল হাত তুলে ধমক মারে, ‘থাক, আর বলতে হবে না। সাগর, তুই রবি ঠাকুর নোস, তুই হলি অকর্মণ্য ফাজিল প্রকৃতির একটা ছেলে। এটা তোর ওই কালিগ্রাম না কলমগ্রাম নয়, এটা অফিসপাড়া, আর আমার অফিসটাও নদীর ওপর ভেসে বেড়ানোর বোট নয়। কাজ করবি না সেটা বল। রবীন্দ্রনাথ কপচাচ্ছিস কেন? তুই কি ভেবেছিস ছিন্নপত্র আওড়ে আমাকে ঘাবড়ে দিবি আর আমি তোকে মাথায় করে নাচব? আমাকে গাধা পেয়েছিস?’

তমালের কথায় আমি মুখটা এমন করি যেন খুবই আহত হয়েছি। আহত গলায় বলি, ‘ঠিক আছে, তা হলে তুই বরং দেখ আমার আলসেমির যোগ্যতায় যদি কোনও চাকরি পাওয়া যায়। পরিশ্রমের জন্য যা মাইনে আলসেমির জন্য তার হাফ হলেও চলবে। আমি না হয় তখন দুটো আলসেমির চাকরি করব। আদ্দেকে আদ্দেকে এক হয়ে যাবে। সহজ পাটিগণিত।’

তমাল চোখ পাকিয়ে বলে, ‘অসহ্য! সাগর, তুই কি চাস এখনই তোকে ঘর থেকে বের করে দিই? আমাদের অফিসের দারোয়ান পাণ্ডে অর্ডার পেলে চমৎকার ঘাড়ধাক্কা দিতে পারে। তুই যদি বলিস ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে পাঠাই।’

আমি এবার খুশি মুখে বলি, ‘হ্যাঁ, চাই। খুবই চাই। তোর যেমন আমাকে অসহ্য লাগছে, আমারও তেমন তোকে অসহ্য লাগছে। একশোটা টাকা দে। ধার হিসেবে দিবি না। ফেরত দিতে পারব না। ছিন্নপত্র পড়িসনি বলে ফাইন হিসেবে দে। টাকা নিয়ে আমি নিজেই কেটে পড়ছি। আর যদি তুই ঘাড়ধাক্কার জন্য পাণ্ডেকে ডাকতে চাস তাও ডাকতে পারিস। তবে দশ টাকা বেশি দিতে হবে। ঘাড়ে ধাক্কা খাওয়ার পর তাকে টিপ্‌স দেব। আমি টিপ্‌স ছাড়া কোনওরকম সার্ভিস নিই না।’

তমাল আরও রেগে যায়। দাঁতে কিড়মিড় জাতীয় আওয়াজ করে বলে, ‘একশো টাকা কেন? একশো পয়সাও পাবি না। গত সপ্তাহে তোকে মিস্টার রামদাস পানুড়িয়ার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলাম না? মনে আছে? ওদের আক্রাফটকের গোডাউনে একজন ম্যানেজার লাগবে বলেছিল। আমি তোর কথা বললাম। পানুড়িয়াজি মানুষটা আমাকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করে। আমার বন্ধু শুনে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। তুই গেলি না কেন?’

লোকে চাকরি পাওয়ার জন্য যে-কোনওরকম মিথ্যে বলতে পারে। আমি চাকরি না পাওয়ার জন্য যে-কোনওরকম মিথ্যে বলতে পারি। এবারও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মিথ্যে বললাম।

‘কে বলল যাইনি? আলবাত গিয়েছিলাম। পানুড়িয়াজি সত্যি একজন চমৎকার মানুষ। অফিসে যেতেই আমাকে খাতির করে বসাল। ওর দিকে একটা টেবিল-ফ্যান ঘুরছিল। সেটা আমার দিকে ঘুরিয়ে দিল। তোর নাম শুনে বরফের কুচি দেওয়া ছাতুর শরবত খাওয়াল। লেবু দেওয়া। ফ্যানটাস্টিক খেতে। এক গ্লাস খেয়ে আমি আরও এক গ্লাস চাইলাম। বললাম, পানুড়িয়াজি, অসুবিধে না হলে গ্লাসে ডবল লেবু মেরে দিতে বলুন। ভিটামিন সি শরীরের পক্ষে অতি জরুরি। উনি তাই দিতে বললেন। আমি অবাক। চাকুরিপ্রার্থীকে এত যত্ন, এত সম্মান কেউ করে!’

তমাল গর্ব মেশানো হাসি দিয়ে বলল, ‘এ আর এমন কী, খাতির তো করবেই। তুই আমার লোক না? যাক, কাজের কথা কী হল?’

‘উনি বললেন, সাগরজি আমাদের এখানে কিন্তু খাটনি আছে।’

তমাল চোখ গোল করে বলল, ‘সে তো হবেই, চাকরি করবি, মাইনে নিবি, খাটনি থাকবে না? কেউ কি বসে থাকার জন্য মাইনে দেয়? যতই তুমি আমার বন্ধু হও, কাজ তোমাকে করতেই হবে বাছাধন।’

‘অবশ্যই করতে হবে। একশোবার করতে হবে। পানুড়িয়াজি কাজের কথা বললেন। খুবই হালকা কাজ। ম্যানেজারের হিসেবপত্র, স্টক মেলানো, চালান লেখার কাজ তো আছেই, দরকার পড়লে মাঝেমধ্যে বস্তা, ড্রাম, পেটি টানাহেঁচড়াও করতে হবে।’

‘মানে!’

আমি হেসে বললাম, ‘মানে সামান্য। অনেক সময় লেবাররা অ্যাবসেন্ট করে। বাড়িতে গেলে ব্যাটারা ফিরতে চায় না। তিনদিনের জায়গায় সাতদিন পার করে দেয়। তখন গাড়িতে মাল লোড করা আর কী। বিকেলের দিকটায় ঘাড়ে করে টেম্পোতে মাল তুলে দেব।’

তমাল খানিকক্ষণ থম মেরে রইল। তার বন্ধুকে মালবাহকের কাজ করতে বলায় সে যে অপমানিত হয়েছে তার চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। আমি মনে মনে খুশি হলাম। তমাল বলল, ‘হারামিটার এত বড় সাহস! তোকে কুলিগিরি করতে বলল? তুই কী বললি? মুখের ওপর না বলে চলে এসেছিস তো?’

‘ছিঃ অমন কথা বলতে নেই তমাল। পানুড়িয়াজি খুবই ভাল মানুষ। তাঁকে খামোকা গাল দিচ্ছিস কেন? আর আমিই বা না বলে আসব কেন? বসে বসে বেতন নেব নাকি? বললাম, অবশ্যই মালপত্র বইব, তবে ঘাড়ে করে পারব না পানুড়িয়াজি। ঘাড়ে ব্যথা আছে, যদি ঝুড়ির ব্যবস্থা করে দেন, মাথায় করে তুলে দেব।’

তমাল আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ফাজলামি করছিস?’

আমি চুপ করে রইলাম। তবে বেশ কিছুদিন তমালের চাকরি দেওয়ার অত্যাচার থেকে রক্ষা পেলাম। সে কথা বলা তো দূরের, আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎই বন্ধ করে দিয়েছিল। বহুদিন পর আবার সেদিন অফিসে ডেকে পাঠাল। আমিও সকাল সকাল চলে গেলাম। টাকা পয়সার ভয়ংকর টানাটানি চলছে। পরীক্ষা সিজন শেষ করে যাওয়ায় তিনটে টিউশন গন। ছেলেমেয়ের মায়েরা গদগদ গলায় মাসখানেক ছুটি দিয়েছে। একমাস মাইনে বাঁচানোর ফন্দি আর কী। বইপাড়ায় প্রুফ দেখার কাজও সামান্য। আগে বাংলা নববর্ষে নতুন বই হত। এখন সে পাট নেই। সব মিলিয়ে অবস্থা জটিল। বিভিন্ন পর্যায়ে ধার-বাকির মধ্যে ঢুকে পড়েছি। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে ডালভাতের রেস্টুরেন্ট, সিগারেটের দোকান থেকে কাপড়কাচা, চুল কাটা সর্বত্র ঋণ। কোনও কোনও রাতে চা বিস্কুট দিয়ে ডিনার সারছি। বিস্কুট না থাকলে শুধু চা। বিছানায় শুয়ে নিজেকে ধনী মানুষ হিসেবে কল্পনা করি। ধনী মানুষের ধার-বাকিতে কোনও সমস্যা নেই। যার যত টাকা তার তত ঋণ। উলটোদিক দিয়ে দেখলেও সত্যি। যার যত ঋণ সে তত ধনী। সেই হিসেবে আমি ক্রমশ একজন ধনী মানুষ হয়ে উঠছি।

শেষ ধার পেয়েছি রামেশ্বরের কাছ থেকে। রামেশ্বর আমাদের পাড়ার মুচি। গলির মুখে, ফুটপাথের ধার ঘেঁষে বসে। পাশে সবসময় একটা ছাতা খোলা। রোদ-বৃষ্টি থাকলেও খোলা, না থাকলেও খোলা। তাতে ছোট বড় মেজ সেজ নানা আকার-প্রকারের তাপ্পি। গরিবের ছাতায় তাপ্পি থাকবে এতে অবাক হওয়ার কী আছে? কিন্তু রামেশ্বরের তাপ্পিগুলোর মজা হল সবকটার রংই হলুদ। নানান শেডের হলুদ। কোনওটা লেমন ইয়েলো, কোনওটা ইয়েলো অকার, কোনওটা আবার ক্যাডমিয়াম ইয়েলো বা গ্যামবোজ। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, গোটা ছাতাটাই হলুদ। রামেশ্বর কেন যে শুধু হলুদ কাপড় দিয়ে ছাতায় তাপ্পি বসায়। অনেকদিন ধরে ভেবে রেখেছি, জিজ্ঞেস করব। করা হয়নি। পরে নিজেই ভেবে ভেবে বের করলাম। ঠিক করেছি, একদিন রামেশ্বরকে বলে চমকে দেব।

বিষন্ন ধরনের মানুষ রামেশ্বর। এই বিষন্নতার কারণ আমি জানি। তার মুখ থেকেই শোনা। তার একমাত্র মেয়ে মেরুদণ্ডে বড় ধরনের গোলযোগ নিয়ে জন্মেছে। স্নায়ুর যে অংশগুলো মানুষকে সোজা হয়ে বসতে দাঁড়াতে শেখায় এই মেয়ের সেগুলো অকেজো। মেয়ের বয়স নয় হতে চলল। জন্ম থেকেই শয্যাশায়ী। শুয়ে শুয়েই সে পৃথিবী দেখছে। গোটা দুনিয়া জুড়ে মানুষ যখন ছেলেমেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করছে, দরিদ্র রামেশ্বর তখন তার শুয়ে থাকা একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বেঁচে রয়েছে লড়াই করে। এই মানুষটার মন বিষন্ন থাকবে না তো কার থাকবে?

কোনও দরকার ছাড়াই আমি রামেশ্বরের কাছে মাঝেমধ্যে চলে যাই। সে আমাকে ‘সাগরভাই’ ডাকে। কলকাতায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে হিন্দিভাষী হলেও ভারী সুন্দর বাংলা বলে। আমি গেলে ফুটপাথের একপাশে রাখা ব্যাটারির খোল টেনে দেয় রামেশ্বর। আমি সেখানে বসে তার কাজ দেখি। সত্যি কথা বলতে কী কাজ দেখি না, মানুষটাকে দেখি। দেখি, মনখারাপ করা একজন মানুষ কীভাবে পালিশ করে, পেরেক মেরে, সেলাই ফুঁড়ে অন্যের মন ভাল করে দেয়। অবাক লাগে। রামেশ্বর কথা প্রায় বলে না বললেই চলে। আমি পাশে বসে থাকি, সে নিজের মনে কাজ করে। একসময় জিজ্ঞেস করে, ‘সাগরভাই চা বলি?’ আমি মাথা নাড়ি। সামনের দোকান থেকে ছোট ভাঁড়ে চা আসে। আমি অতিরিক্ত সময় নিয়ে সেই চা খাই। বেলা বাড়লে রামেশ্বর শান্ত গলায় বলে, ‘এবার যান। বাড়ি গিয়ে মাথায় জল ঢেলে দুটো মুখে দেন।’ প্রথম প্রথম সে বিস্মিত হত। আমার মতো একজন চেহারায় মোটামুটি ‘ভদ্রলোক’ ধরনের মানুষ ফুটপাথে মুচির পাশে বসে থাকে, চা খায়, এটা তার কল্পনার মধ্যে ছিল না। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত বুঝে গিয়েছে, চেহারা যা-ই হোক, আমি আসলে সত্যিকারের ‘ভদ্রলোক’ নই।

এই রামেশ্বরই শনিবার আমার চটিতে উঠে যাওয়া পেরেকে হাতুড়ি মেরে দিল। আমি পয়সা দিতে গেলে বিরক্ত গলায় বলল, ‘যান দেখি।’

আমি হেসে বললাম, ‘কী হল?’

রামেশ্বর আরও বিরক্ত হয়ে বলল, ‘বললাম তো যান।’

‘তা কী করে হয় রামেশ্বর? কাজ করে পয়সা নেবে না? তা ছাড়া এইটুকু পয়সা আমার আছে। নাও রাখো।’

রামেশ্বর এবার যেন ধমক দেয়। বলে, ‘এখন ধার থাক, পরে দেবেন।’

আমি নরম গলায় বলি, ‘রামেশ্বর আজ তোমার মন কি বেশি খারাপ? তোমার মেয়ে আছে কেমন?’

রামেশ্বর আমার কথার উত্তর দেয় না। সামনে পড়ে থাকা জুতোয় সুচ গাঁথে। আমি বলি, ‘একদিন তোমার মেয়েকে দেখতে যাব।’ রামেশ্বর এতেও কিছু বলে না। আমি সামান্য হেসে বলি, ‘তোমার মেয়ের বুঝি হলুদে রং খুব পছন্দ?’ এবার সে মুখ তোলে। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। বলে, ‘আপনি বুঝলেন কী করে?’

আমি আবার অল্প হাসি। বলি, ‘আমি বুঝতে পারি। তোমার মেয়ের প্রিয় রং হল হলুদ। আর সেই কারণে তুমি তোমার ছাতা ভরতি করে হলুদ রঙের কাপড় লাগিয়ে রেখেছ। তাই না?’

রামেশ্বরের চোখে গভীর বিস্ময়। আমার ভাল লাগে। অন্তত কয়েক মুহুর্তের জন্য হলেও এই সামান্য মানুষটার বিষণ্ণতা কাটাতে পেরেছি। বড় মানুষদের শোক দুঃখ ভোলানোর আয়োজন অজস্র। সামান্য মানুষের বেলায় সেরকম কিছু নেই। তাকে ছোট ছোট আয়োজন করে মন ভাল করতে হয়। রামেশ্বর ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলে, ‘ঠিক বলেছেন সাগরভাই। মেয়েটা হল গিয়ে আমার হলুদ পাগলা মেয়ে। হলুদ জামা চাই, হলুদ রঙের বিছানার চাদর চাই, হলুদ রঙের দরজা জানলা চাই। বলুন দেখি ভাই কী পাগলামি, দরমা বেড়ার ঘরে থাকি, হলুদ দরজা জানলা পাই কোথা থেকে? ওর মা তো খুবই রাগারাগি করে।’

আমি দেখলাম মেয়ের পাগলামির কথা বলতে বলতে রামেশ্বরের চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠছে। আচ্ছা, এই পৃথিবীতে কি এমন কোনও বাবা আছে মেয়ের পাগলামির কথা বলতে গিয়ে যার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে না? আমি নিশ্চিত এমন কাউকে পাওয়া যাবে না।

আমি মিটিমিটি হেসে বললাম, ‘ও কিছু নয়, সব ছোট ছেলেমেয়েদেরই একটা করে পছন্দের রং থাকে। আমার ছিল বেগুনি। সবাই আমাকে বেগুনি বলে খেপাত। তবে যতই পয়সাকড়ির অসুবিধে হোক রামেশ্বর, আমি কিন্তু জানি তুমি ওই বেড়ার ঘরেই কয়েক পোঁচ হলুদ রং লাগিয়ে দিয়েছ। সেই রং খুব ভাল হয়নি, আধাখেঁচড়া হয়েছে, তবু তোমার মেয়ে খুব খুশি হয়েছে। ঠিক না?’

রামেশ্বর আরও বিস্মিত হল। মুগ্ধ গলায় বলল, ‘এই খবরটা আপনি জানলেন কী করে? আপনি তো আমার বাড়ি কোনওদিন যাননি।’

আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘সব খবর কি গিয়ে জানতে হয় রামেশ্বর? তা হলে তো মানুষের মনের খবর কেউ কোনওদিনও জানতে পারত না। মানুষের মনের ভেতর কি যাওয়া যায়? বাদ দাও ওসব, ঠিক করেছি, এবার একদিন তোমার মেয়ের সঙ্গে দেখা করে আসব। খানিকটা হলুদ রং নিয়ে দুম করে একদিন চলে যাব।’

রামেশ্বর আমার দার্শনিক ধরনের কথা বুঝতে পারল বলে মনে হয় না, শান্ত গলায় বলল, ‘আমাদের মতো ছোট মানুষের ঘরে কি আপনি যাবেন? আপনার কথা ওকে অনেক বলেছি। ওর আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করে।’

আমি কৌতূহলে বলি, ‘কী বলেছ?’

রামেশ্বর কাজে মন দিতে দিতে লজ্জা ধরনের হাসে। বলে, ‘বলেছি, সে একটা মানুষ বটে, তোর মতো শুয়ে না থাকলেও মনে হয় সবসময় শুয়েই আছে। কুঁড়ের বাদশা একটা। হা হা। ভুল বলেছি?’

তমালের অফিসে গিয়ে দেখলাম কেলেঙ্কারি কাণ্ড। পুরনো ঘরদোর ভেঙেচুরে ভোল একেবারে পালটে ফেলেছে! এসি-র ফিনফিনে ঠান্ডা। ঝকঝকে টেবিল। ওপরে চকচকে কম্পিউটার। সবথেকে মারাত্মক হল, বাড়ির অনেকটাই এখন কাচে কাচে ছয়লাপ! বড় বড় কাচের জানলা দরজা, মাঝে মাঝেই উঁচু কাচের দেওয়াল। ‘আছে কিন্তু নেই’ কায়দায় সেই দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমি তো একটায় ধাক্কাই খেলাম। তিনতলায় তমাল পর্যন্ত পৌঁছোতেও অনেকরকম কসরত করতে হল। খাতায় নামটাম লিখে বিস্তর হ্যাপা। তমাল দেখলাম টাই পরেছে। মুখটাও গম্ভীর গম্ভীর। এটাই স্বাভাবিক। অফিসবাড়ির ভোল পালটেছে আর ভেতরের মানুষগুলোর ভোলও পালটাবে না? আচ্ছা, মানুষগুলোও খানিকটা করে কাচের হয়ে যায়নি তো? দেওয়ালের মতো?

আমি তমালের টেবিলের উলটোদিকের গদি আঁটা চেয়ারে গা এলিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার, ডেকেছিস কেন?’

তমাল চাপা গলায় দাঁত কিড়মিড় করে উঠল, ‘ওভাবে বসেছিস কেন? ঠিক করে বোস। এটা তোর ঘরের তক্তপোশ নয়। অফিসের চেয়ার।’

আমি চমকে ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম। বললাম, ‘এই রে, চেয়ারটাও কাচের নাকি?’

তমাল আরও গলা নামিয়ে বলল, ‘বাজে কথা বন্ধ কর। সাগর, তোকে একটা কাজ করতে হবে।’

আমি কুঁকড়ে গেলাম। খেয়েছে, আবার কাজ! চাকরি নাকি? নিশ্চয় তা-ই হবে। কী জ্বালাতন। আবার পালাতে হবে। একবার চাকরির তাড়ায় জঙ্গলে পালিয়েছি, এবার কোথায় যাব? সমুদ্রে? শুধু পালালে হবে না, পালানোর আগে তমালের কাছ থেকে কিছু টাকাপয়সা বাগাতে হবে। অবস্থা খুবই কঠিন। এখন ডিনারে চা-বিস্কুট চলছে, এরপর লাঞ্চেও হয়তো একই মেনু হয়ে যাবে। কাঁচুমাচু গলায় বললাম, ‘আবার চাকরি? ঠিক আছে তুই যখন বলছিস আই এগ্রি। কিছু অ্যাডভান্স পাওয়া যাবে? ধার হিসেবে দে। কথা দিচ্ছি প্রথম মাসের বেতন পেয়েই শোধ। টাকাপয়সার বিচ্ছিরি কন্ডিশন চলছে। মনে হয়, ওয়ার্ল্ড রিসেশনে ধাক্কা খেয়েছি।’

তমাল কটমট চোখে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে উঠল।

‘তিনটে কথা বলব। ওয়ান, টু, থ্রি। এক নম্বর, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি তোর সঙ্গে আর কখনও চাকরির ব্যাপারে কোনও কথা বলব না। দু’নম্বর, মন্দা তোকে কড়ে আঙুল দিয়েও ছুঁয়ে দেখবে না। তার একটা ডিগনিটি আছে। ভিখিরিদের সে টাচ করে না। তিন নম্বর হল, আমার কাজটা করে দিলে কিছু টাকা পাবি। রাজি কি না এবার চটপট বল।’

আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। যাক বাবা, চাকরি ছাড়াই টাকা। একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে বললাম, ‘রাজি।’

তমাল হাত বাড়াল। শুধু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী রাজি!’

‘কাজটা করব।’

তমাল মুখ পাকিয়ে বলল, ‘আগে শুনবি তো।’

‘শোনার দরকার নেই। বললাম তো আমি রাজি। নে এবার চা বল। না চা নয়, কফি বল। এ ঘরে ছেঁদো চা মানাবে না।’

‘অফিসের ভেতরে চা কফি খাওয়ার নিয়ম নেই। করিডরে কিয়স্ক আছে। ওখানে গিয়ে খেতে হবে।’

আমি বললাম, ‘বাপ রে! করেছিস কী কাণ্ড! অ্যাঁ, এ তো ডালহৌসিতে জাপান বানিয়ে বসে আছিস রে!’

তমাল হাত বাড়িয়ে খিমচি দিল, বলল, ‘চুপ৷ নো ফাজলামি। চল চা খেতে খেতে কাজটা বলছি।’

‘তোদের করিডরে ব্যাটারির খোল আছে?’

‘মানে!’

আমি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলি, ‘না কিছু নয়। থাকলে ভাল হত। খোলে বসে চা খেতাম। ব্যাটারির খোলে বসলে চায়ের টেস্ট বাড়ে। যাক, কাজ কি কঠিন?’

‘হ্যাঁ কঠিন।’ তমাল থমথমে মুখে বলে।

না কাজ কঠিন নয়, কাজ অতি সহজ এবং সংক্ষিপ্ত।

তমালের বসের মেয়ে লেখাপড়ায় মারাত্মক। এখানকার কলেজ-ইউনিভার্সিটিকে চমকে দিয়ে এবার চলল আমেরিকা। সেখানকার কোনও এক নামজাদা ইউনিভার্সিটিতে ভজকট বিষয় নিয়ে গবেষণা করবে। গবেষণা শেষে সে-দেশেই বিবাহ এবং বসবাস। গবেষণা মাঝখানে বন্ধ করেও বিয়ে হতে পারে। পাত্র সেমিফাইনাল স্তরে রয়েছে। মেয়ে নিজের চোখে ছেলের ফ্ল্যাট দেখে ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে ফ্ল্যাট দক্ষিণমুখী না উত্তরমুখী তার ওপর। উত্তরমুখী হলে মেয়ে এখনই বিয়ে করে সংসার পাতছে না। ভাবী বরকে নতুন ফ্ল্যাট কিনতে হবে। দক্ষিণমুখী হলে সে ঝামেলা নেই। গবেষণা মাঝপথেই মুলতুবি রেখে ঘর গোছাতে ব্যস্ত হবে। রবিবার দুপুরে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে মেয়েটির একই সঙ্গে শিক্ষাযাত্রা এবং বিবাহযাত্রা শুরু। আমার কাজ হবে এয়ারপোর্টে পৌঁছে তার হাতে একটি ফুলের তোড়া পৌঁছে দেওয়া। তোড়ার গায়ে একফালি কার্ড ঝুলবে। তাতে লেখা থাকবে ‘বিদায়। দেশের মুখ উজ্জ্বল করো। তমালরঞ্জন সেনগুপ্ত, ডেপুটি চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। কলকাতা শাখা।’

কফির কাপ কাগজের। আমি সেই কাপ ফেলে বললাম, ‘আমার তিনটে কথা আছে তমাল। ওয়ান টু থ্রি।’ তমাল কিছু বলল না। শুধু ভুরু তুলল। আমি বললাম, ‘এক নম্বর হল, তুই নিজে যাচ্ছিস না কেন? সকাল সকাল বাড়ি গিয়ে বসের মেয়েকে নিজের হাতে ফুল তুলে দিবি। যদি বলিস আমিও না হয় তোর সঙ্গে থাকলাম। ফুল ক্যারি করাও হল, আবার গুণী মেয়ে দর্শনও হল। হ্যাঁরে, মেয়ে দেখতে কেমন?’

তমাল খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘মেয়ে কেমন দেখতে তা দিয়ে তোর দরকার কী? তবে বাড়ি-ফাড়ি যাওয়া যাবে না। বস একেবারেই গায়ে পড়া পছন্দ করে না। তা ছাড়া অন্য ব্যাপারও আছে।’

আমি গলা নামিয়ে বললাম, ‘কী ব্যাপার? ওই মেয়ের সঙ্গে তোর প্রেম-ফ্রেম চলছে নাকি? বসের মেয়ের সঙ্গে প্রেম হিন্দি সিনেমার ফেভারিট থিম। তবে মিউজিক ঠিকমতো দিতে হবে। আজকাল প্রপার মিউজিক ছাড়া ছবি চলে না। ছবি না চললেও মিউজিক যেন চলে যায়।’

তমাল আর পারল না। ফিসফিসে গলায় আমাকে গাল দিয়ে বলল, ‘শালা থামবি? আসলে আমার সামনে একটা প্রোমোশনের চান্স এসেছে। দেখলি না বললাম ফুলের কার্ডে ‘বিদায়’-এর সঙ্গে নিজের পোস্টটাও লিখব? ডেপুটি চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। ডেপুটি বাদ দিয়ে ফুলফ্লেজেড চিফ্‌ হওয়ার চেষ্টা করছি। এখন আমি যদি নিজে ফুল নিয়ে যাই তা হলে অফিসে জানাজানি হয়ে যাবে। ঝামেলা লেগে যাবে। অফিস পলিটিক্স তো জানিস না। হাড় ভাজা ভাজা করে দেয়। তাই ঠিক করেছি ফুলও দেব, নিজেও যাব না।’

‘বিউটিফুল। কোয়েশ্চেন নাম্বার টু। আজকাল যে-কোনও ফ্লাওয়ার শপ বা বুটিকে ফোন করলেই তারা গিয়ে ফুল পৌঁছে দেয়। তুই সেরকম কিছু করছিস না কেন?

তমাল চক্রান্ত করার ঢঙে গলা নামিয়ে বলল, ‘গাধার মতো কথা বলিস না। তোর কি ধারণা এটা আমি জানি না? আমি কেন, অফিসের সবাই জানে। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর অফিসের সবাই এই কাজটা করবে। ফোনে অর্ডার দিয়ে ফুল, গিফট পাঠাবে। সকাল থেকে বসের বাড়িতে গাদা ফুল পৌঁছোবে। যত পৌঁছোবে স্যার তত বিরক্ত হবে। মেয়েটা নাক সিঁটকোবে। এমন একটা সময় আসবে যখন ঘরে ফুলের বুকে ঢুকতেই দেওয়া হবে না, বাইরে বারান্দায় হেলাফেলা করে পড়ে থাকবে। কার্ড খুলে দেখা তো দূরের কথা, ফুলের দিকেও কেউ তাকাবে না’।

‘সে কী! তা হলে তুই পাঠাচ্ছিস কেন?’

তমাল ঠোঁটের ফাঁকে বিজয়ীর হাসি দিল। বলল, ‘সেইজন্যই তো পাঠাচ্ছি না। তোকে ডেকে পাঠিয়েছি। ফুল নিয়ে যাবি তুই। নিয়ে যাবি ওই মেয়ের বাড়িতে নয়, একেবারে এয়ারপোর্টে। আমি হব সেই ব্যক্তি যার বিদায়-ফুল একেবারে শেষ মুহূর্তে হাতে গিয়ে পৌঁছোবে। আগেও না, পরেও না। কথায় আছে লাস্ট মোমেন্ট ইজ দ্য বেস্ট মোমেন্ট। শেষ মুহূর্তই সেরা মুহূর্ত।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এ কথা কোথায় আছে।’

তমাল চাপা ধমক দিল, ‘যেখানেই থাকুক, তোর কী? তুই তোর কাজ করবি। এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি। পাঁচটা বাইশের ফ্লাইট। হিসেবমতো সিকিউরিটিতে এই মেয়ে ঢুকবে তিনটে বাইশে। তুই ঠিক তিনটে কুড়িতে গিয়ে ফুলের তোড়া হাতে তুলে দিবি। মেয়ে চমকে উঠবে। আমি নিশ্চিত বিদায়বেলায় পাওয়া পুষ্পস্তবকের প্রতি কোনও মেয়ে অবহেলা দেখাতে পারে না।’

তমালের গলায় কি আবেগ? মনে হচ্ছে আবেগ। আমি বললাম, ‘তুই কি বলছিস তোর বসের মেয়ে এই ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে আমেরিকা পর্যন্ত চলে যাবে!’

তমাল গম্ভীর গলায় বলল, ‘তা বলিনি। মেয়েটি ছলছল চোখে এই ফুল তার বাবার হাতে তুলে দেবে। তার বাবা আমাকে মনে রাখবে। মেয়েকে যে শেষ শুভেচ্ছা জানায় তার কথা বাবারা ভুলতে পারে না। কার্ডটা এমনভাবে ফুলের ওপর রাখবি যাতে বস চট করে পড়তে পারে।’

‘এত ঘোরপ্যাঁচ কি ঠিক হবে তমাল? বুকেটা সরাসরি তোর বসকে দিলেই হত না? প্রোমোশন তো তোর বসই তোকে দেবে, তার মেয়ে তো দেবে না। বিষয়টা খামোকা এত জটিল করা কি ঠিক হচ্ছে?’

তমাল ফের ধমক দিল, ‘চোপ। ঠিক-ভুল তোকে বুঝতে হবে না। যা বলছি তুই তা-ই করবি। মনে রাখবি, ফুলটা এখানে আসল নয়। টাইমিংটাই আসল। বিদায়বেলার টাইমিং। আগেও নয়, পরেও নয়। কত টাকা দেব বল?’

আমি বুঝতে পারছি, প্রোমোশনের লোভে তমাল একটা বিচ্ছিরি গোলমালে ঢুকে পড়ছে। এটাই হয়। কেরিয়ার অতি ভয়ানক জিনিস। শয়তানের মতো। যে-কোনও মানুষকে সে গোলকধাঁধায় ঢুকিয়ে দিতে পারে। সেখান থেকে মানুষ বেরোতে পারে না। ঘুরতে থাকে, ঘুরতে থাকে, ঘুরতেই থাকে। সাধে কি আমি চাকরিবাকরির মধ্যে যেতে চাই না! যাক, তমাল যা ভাল বোঝে করুক। আমার টাকা পেলেই হল।

‘কী রে বললি না কত টাকা দেব?’

আমি একটা ছোট করে হাই তুললাম। ঠোঁটে চাপড় মেরে বললাম, ‘সময় নিয়ে কারবার। খরচাপাতি তো একটু বেশিই হবে মনে হচ্ছে। আগে হলে একরকম রেট হত, পরে হলে আরেকরকম। এটা তো আগে পরে কোনওটাই নয় দেখছি। একেবারে লাস্ট মোমেন্ট। শেষ মুহূর্ত অতি কঠিন জিনিস রে তমাল। শেষ মুহূর্তের জন্য পৃথিবীতে কত বড় বড় সব কাণ্ড ঘটেছে এবং ঘটছে না। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত হচ্ছে না বলেই তো থার্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার শুরু হয়েও হতে পারছে না, তেমনি শেষ মুহূর্তের বায়োলজিক্যাল চেঞ্জে শুঁয়োপোকার মতো কদাকার একটা কটি প্রজাপতির মতো সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। শেষ মুহুর্ত নিয়ে কাজ করা অত সহজ নয়।’

‘বাজে কথা বলিস না সাগর। আমার টেনশন হচ্ছে। যত খরচ হয় হোক। কাজটা হওয়া চাই।’

‘আমার তিন নম্বর প্রশ্ন এবং শেষ প্রশ্ন, ফুল কি আমাকে কিনতে হবে? না কি তুই কিনে দিবি? যদি আমাকে কিনতে হয়, ফুলের রং কী হবে?’

তমাল ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় বলল, ‘ফুল তুই কিনবি। হলুদ গোলাপ। বসের মেয়ের কোন রং ফেভারিট জানার জন্য আমি গোপনে স্পাই লাগিয়েছিলাম। সে খবর দিয়েছে, হলুদ। এটাও অফিসের আর কেউ জানেনা।’ কথাটা বলে তমাল দুলে দুলে হাসতে লাগল। যেন বসের মেয়ের ফেভারিট রং বের করে সে বিরাট একটা কৃতিত্ব করেছে। আমি কিন্তু থমকে গেলাম। হলুদ!

এই ঝাঁ ঝাঁ চৈত্রের দুপুরে হলুদ গোলাপ কোথাও পাচ্ছি না। আমি পড়েছি বিপদে। যেহেতু গোলাপের মতো সুন্দর একটা জিনিস এই বিপদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাই এই বিপদ হল বড় সুন্দর বিপদ। সুন্দর বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমার পকেটে টাকা কচকচ করছে। হাতে ধার করা ঘড়ি। আমি ট্যাক্সি নিয়ে শহরের বাজারে বাজারে ঘুরছি গত দু’ঘণ্টা ধরে। ফুলের দোকান দেখলেই ছুটে যাচ্ছি। শপিং মল, ফুটপাথ, বুটিক, শ্মশানের আশপাশ কিছু বাদ দিচ্ছি না। পার্ক স্ট্রিটে কবরস্থানের চারপাশেও চক্কর দিলাম। লাল, সাদা, মেজেন্টা, মেরুন, এমনকী বাইপাসের শপিং মলে অসম্ভব দামি কালো গোলাপও পেলাম। কিন্তু হলুদ নেই! কোথাও নেই। কী হল! বেছে বেছে আজই কি দেশে হলুদ গোলাপ ফোটেনি? নাকি শহরে সাপ্লাই নেই? বেলেঘাটার মোড়ের এক দোকানে দোকানদার বলল, ‘দাদা প্লাস্টিকের হবে। দেব?’ ইচ্ছে করল, ছোকরার মুখে একটা চড় কষাই। প্লাস্টিকের ফুল দেওয়ার মানে তমালের প্রোমোশনও হবে প্লাস্টিকের। ঘড়ির কাঁটা বাঁইবাঁই করে ঘুরছে। আর সময় নেই। তিনটে বাইশ হতে বাকি মোটে অল্পক্ষণ। সময় এত তাড়াতাড়ি ছোটে! নাকি আজ সে স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে? হতে পারে। একটা অলস মানুষকে এতদিনে বাগে পেয়েছে। পেয়ে খেলছে।

‘দেখ ব্যাটা কেমন লাগে। এতদিন আমাকে নিয়ে খেলেছিস, এবার ঠেলা বোঝ।’

আমি জামার হাতা দিয়ে ঘনঘন কপালের ঘাম মুছছি। না, কাজটা নেওয়া উচিত হয়নি। একেবারেই উচিত হয়নি। এতক্ষণে নিশ্চয় তমালের বস মেয়েকে নিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। কান্নাকাটির পাটও শেষ। চূড়ান্ত বিদায়ের সময় এল বলে। সবকিছুর সঙ্গে ফাজলামি চলে, বিদায়বেলার সঙ্গে ফাজলামি চলে না। হাসি এবং চোখের জলে সে খুবই পবিত্র একটা জিনিস। সামান্য ক’টা টাকার লোভে আমার মতো অপবিত্র একটা মানুষ তার মধ্যে ঢুকে পড়তে চেয়েছিল। এখন সে আমাকে শাস্তি দিচ্ছে। শহর থেকে হলুদ গোলাপ লুকিয়ে ফেলে শাস্তি দিচ্ছে।

ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার উদ্বেগ জেনে গেছে। বলল, ‘একবার হাওড়ার দিকে যাব স্যার? মঙ্গলাহাটে খোঁজ করে দেখতেন।’ আমি হাত ঘুরিয়ে ঘড়ি দেখলাম। অসম্ভব। হাওড়া পৌঁছোনোর আগেই ওই মেয়ে আকাশ দিয়ে শহর টপকে যাবে। তার থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছোই। দেখিনি কখনও, শুনেছি এয়ারপোর্টের ভেতরেও ফুলের দোকান আছে। বিদায় এবং স্বাগতম— দু’ধরনের ফুল পাওয়া যায় সেখানে। তবে আমি নিশ্চিত আজ সেখানেও হলুদ গোলাপ পাব না। না পাওয়া যাক। যা পাই তাই কিনব। লাল, সাদা, মেজেন্টা। কালো পেলে কালো। তারপর তমালের বসের মেয়ের সামনে গিয়ে বলব, ‘ম্যাডাম ক্ষমা করবেন, তমালের কোনও দোষ নেই। দোষ আমার…।’

আমি ট্যাক্সিচালককে বিড়বিড় করে বললাম, ‘দরকার নেই। আপনি জোরসে চালান। এয়ারপোর্ট।’

ট্যাক্সি জোরে ছুটল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে উলটোডাঙার মোড়ে এসে ব্রেক কষল। সামনে কয়েকশো গাড়ি জট পাকিয়ে আছে। নড়াচড়ার উপায় নেই। না সামনে, না পিছনে। চালক খবর আনল, সামনে গোলমাল শুরু হয়েছে। অটো এবং বাসের ধাক্কাধাক্কিতে প্রথমে ঝগড়া, পরে হাতাহাতি এবং শেষ পর্যন্ত পথ অবরোধ শুরু হয়েছে। তবে অবরোধ হচ্ছে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে। প্রথমে অটোচালকরা করছেন, তাঁদেরটা শেষ হলে বাসের কর্মীর নামবেন। এর মাঝখানে যাত্রীরাও পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছেন। সেরকম হলে তৃতীয় পর্যায়ে তাঁরা অবরোধ শুরু করতে পারেন। মনে হচ্ছে, সব মিলিয়ে ঘন্টা তিনেকের মামলা।

আমি ট্যাক্সির সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। মনে মনে নিজেকে বললাম, ছি সাগর, এ তুমি কী করছ! তুমি বিপদ থেকে পালিয়ে যেতে চাইছ! বিপদ থেকে তোমার মতো ছোট মানুষরা কখনও পালাতে পারে? পারে না। সেই বিপদ সুন্দর হলেও পারে না, অসুন্দর হলেও পারে না। বিপদ সঙ্গে নিয়েই হাসিমুখে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। থাকতেই হবে।

আমি বসের মেয়ের বিদায়বেলার সময় মানলাম। ধার করা ঘড়ি দেখে ঠিক তিনটে কুড়িতে ট্যাক্সির সিটে মাথা রেখে পরম নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমের মধ্যে ডুবে গেলাম।

বসে আছি ভাঙা মোড়ার ওপর। যে-কোনও মুহূর্তে মোড়া একপাশে কাত হয়ে পড়তে পারে। আবার নাও পড়তে পারে। সামনের তক্তপোশের ওপর শুয়ে আছে আট বছরের এক ফুটফুটে বালিকা। তার বড় বড় চোখ। চোখের তলায় থ্যাবড়ানো কাজল। একমাথা চুল ছড়িয়ে আছে তেলচিটে বালিশের ওপর। মেয়েটি পরে আছে একটা হলুদ-রঙা ফ্রক। বহুবার ধোয়ার ফলে রং ফ্যাকাশে মেরে গেছে। দরমা বেড়ার ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের আলো ছিটকে এসে পড়েছে এই সুন্দর মেয়েটির মুখে। তাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

আমি ঝুঁকে পড়ে বললাম, ‘তুমি কেমন আছ?’

মেয়েটি হেসে মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, ‘ভাল। তুমি কেমন আছ?’

আমিও হাসলাম। বললাম, ‘আমিও ভাল আছি। একটু আগে পর্যন্ত ছিলাম না, এখন খুব ভাল আছি।’

রামেশ্বর এবং রামেশ্বরের বউ আমাকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রামেশ্বর গিয়েছে চা আনতে। ঘরে চা-পাতা নেই। রামেশ্বরের বউ গিয়েছে সেই চায়ের জন্য কাপ জোগাড় করতে। অতিথিকে তো আর মাটির ভাঁড়ে চা দেওয়া যায় না। আমারও আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। উলটোডাঙার অবরোধ শেষ হওয়ার পর ট্যাক্সি ছাড়ল। মাঝখানে তমালের দেওয়া টাকায় কিছু কেনাকাটা করলাম। এক বাক্স মিষ্টি, কিছুটা বিস্কুট, লজেন্স, আচার এক শিশি, হজমিগুলি কয়েক প্যাকেট, চানাচুর খানিকটা আর খানকতক পুতুল। এমন পুতুল যা নিয়ে শুয়ে শুয়ে খেলা যায়। এন্টালি মোড়ে ট্যাক্সি থেকে নামলাম।

নামতেই দেখি…! চমকে উঠলাম। এ কী! ফুটপাত আলো করে বসে আছে ফুলওয়ালা! যেন আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

পুতুলগুলো মেয়েটার হাতের কাছে রেখে বললাম, ‘তুমি খেলবে। কেমন?’ মেয়েটা একগাল হেসে মাথা নাড়ল। আমি বললাম, ‘আর একটা জিনিসও তোমার জন্য এনেছি।’

‘কী’

‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’

আমি শুধু গাদাখানেক গোলাপই কিনিনি, একটা সুন্দর ফুলদানিও কিনেছি। সাদা চিনামাটির ফুলদানি। শালপাতার মোড়ক থেকে বের করে হলুদ গোলাপগুলো সেখানে রাখতেই গোটা ঘরটা ঝলমল করে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘বিদায় নয়, আমি আবার আসব। বারবার আসব।’

প্রতিদিন রোববার, ১২ এপ্রিল ২০০৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *