নদী

নদী

দূরে কোথায় যেন ঢাক বাজছে।

কোথায় বাজছে? ওপারে? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। নদীর কাছে এরকম হয়। আলো, বাতাস, শব্দরা অনেক সময় ধাঁধায় ফেলে। কোনটা কোন পারের বোঝা যায় না। এই নদীটা তেমন চওড়া নয়। ওদিকের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। এই তো খানিক আগে সাইকেল চালিয়ে একটা লোক চলে গেল। যাওয়ার সময় হাঁক দিল—

‘ফকির। অ্যাই ফকির…’।

কে ফকির, ফকির কোথায় থাকে, কিছুই জানা গেল না, তবু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই হাঁক জলে ভেসে এদিকে চলে এল। ওপারের ‘ফকির’ কাউকে কিছু না বলে এপারের হয়ে গেল!

ঢাকের বেলাতেও সেরকম কিছু হচ্ছে। পাড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

তবে যেখানেই বাজুক, দুর্গাপুজোর দিনে ঢাকের আওয়াজ খুবই সুন্দর একটা জিনিস। শুনলেই আনন্দ হয়। এখন কিন্তু হচ্ছে উলটোটা।

ঢাকের বাজনায় মন তেতো হয়ে যাচ্ছে। শুধু তেতো নয়, রাগে গা চিড়বিড় করছে। বাবলুর ইচ্ছে করছে, খানিকটা তুলো জোগাড় করে দুটো কানে ভাল করে গুঁজে বসে থাকে। তা হলে আর এই বাজনা শুনতে হবে না।

বাবলু বাংলোর বারান্দা থেকে সরে এল। আসার সময় শুনল সাহেব চিৎকার করে বলছে, ‘মা, মা নদীতে একটা হিপোপটেমাস! বিগ হিপোপটেমাস। দেখো দেখো। বাইনোকুলারটা দিয়ে একবার তাকাও। দেখো… ওই তো… ওই যে।’ সাহেব তপনদা-চন্দনাবউদির ছেলে। ক্লাস ফোরে পড়ে। চোখে একটা দুরবিন লাগিয়ে ঘুরছে এবং কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস দেখছে।

চন্দনাবউদি ছেলের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘চুপ, একদম চুপ। আর একটা কথা বললে চড় মেরে দূরবিনটা কেড়ে নেব, তারপর নদীর জলে ফেলে দিয়ে আসব।’

বাবলু আরও নার্ভাস হয়ে দরজার আড়ালে সরে গেল। বলা ভাল লুকিয়ে পড়ল। সেখান থেকেই শুনল শর্মিষ্ঠা গম্ভীর গলায় বলছে, ‘আঃ দিদি, ওকে কেন বকছিস? ছোট ছেলে। যাকে বকা উচিত তাকে বক। দরকার হলে তাকে নদীতে ফেলে দিয়ে আয়। দে সাহেব আমাকে বাইনোকুলারটা দে তো। দেখি তোর হিপোপটেমাস কী বলছে। সে কি মানুষ খেতে চাইছে?’

বাবলু চমকে উঠল। ভয়ংকর! এই মেয়েকে যতটা ভয়ংকর ভাবা গিয়েছিল এ তার থেকেও ভয়ংকর! শুধু নদীতে ফেলে দিতে চায় না, জলহস্তি দিয়ে খাওয়াতেও চাইছে।

বাবলুর হাত পা ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। এই কার্তিকে সে চব্বিশ বছরে পা দেবে। চব্বিশ বছর বয়সের কোনও যুবকের ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসাটা মোটেই কাজের কথা নয়। কিন্তু উপায় নেই। ঘটনা যা তাতে শুধু হাত-পা কেন, বাবলুর সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কথা। উফ! কেন সে এই দায়িত্ব নিতে গিয়েছিল? তখন বোঝেনি। এখন বুঝতে পারছে, বোকামি হয়ে গেছে। বিরাট বোকামি হয়ে গেছে।

অথচ খানিক আগেই পরিস্থিতি ছিল একেবারে অন্যরকম। কলকাতা ছাড়াতেই তপনদা জোরে গান চালিয়ে দিলেন। চন্দনাবউদি গুনগুন করতে লাগলেন। সাহেব হাততালি দিয়ে উঠল। পথে দু’বার চা আর একবার কচুরি খাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নামা হল। অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে গোটা পথটাই বাবলু হাত টাত নেড়ে বিভিন্ন বিষয় ভাষণ দিতে থাকে।

একসময় শর্মিষ্ঠা গম্ভীর মুখে বলে, ‘বাবলুবাবু, আপনার কি কোনও সমস্যা হয়েছে?’

মেয়েটা পিছনের সিটে তার দিদির পাশে বসেছে। কী যেন খাচ্ছে। কী খাচ্ছে? চুইংগাম? চুইংগাম হলে ঠিক আছে কিন্তু পান হলে খুব খারাপ হবে। একটা সুন্দরী মেয়ে প্যান্ট শার্ট পরে করমচর করে পান খাবে এটা মানা যায় না। বাবলুর খুবই জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাহস হচ্ছে না। শর্মিষ্ঠাকে সে মোটে দু’দিন হল দেখছে। দিল্লিতে পড়াশোনা করে। পুজোর ছুটিতে কলকাতায় দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। বাবলুর অভিজ্ঞতা বলছে, বাইরে একা থেকে পড়াশোনা করা মেয়েরা রাগী ধরনের হয়। তার চণ্ডীগড়ে পড়া এক ভাগনি এরকম ছিল। রগচটা। তার ওপর ক্যারাটে জানত।

এই মেয়েও কি সেরকম? রাগী আর ক্যারাটে জানে?

‘কী হল বললেন না? আপনার কি কোনও সমস্যা হচ্ছে?

বাবলু নার্ভাস হয়ে হাসল। বলল, ‘সমস্যা! কই না তো! সমস্যা কী? চমৎকার রাস্তা।’

শর্মিষ্ঠা কঠিন গলায় বলল, ‘সমস্যা না হলে একটু চুপ করে বসুন এবং চমৎকার রাস্তা দেখুন।’

বাবলু নিশ্চিত হল, এই মেয়ে রগচটা। সম্ভবত ক্যারাটেও জানে। সে দ্রুত তার ভাষণ বন্ধ করে।

শরতের কিছু কিছু সকালে আকাশ এক ধরনের নীল রং গায়ে মেখে বসে থাকে। বৃষ্টি ধোয়া নীল। হাত বাড়ালেই সেই রং খানিকটা আঙুলে লেগে যায় এবং চট করে তোলা যায় না। আজও সেরকম একটা সকাল। সেই সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া হয়েছে। তপনদাই গাড়ি চালাচ্ছেন। দূরের কোনও ট্যুরিস্ট স্পট নয়, মাত্র ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। একদিনের বেড়ানো। আজ রাত কাটিয়ে কাল বিকেলে ফেরা হবে। ঠিক হয়েছে, ফেরার পথে আরতি দেখা হবে গ্রামের কোনও পুজো মণ্ডপে বসে। সেই মণ্ডপ বাছাইয়ের সময় লক্ষ রাখা হবে যাতে খানিকটা পথ আল দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। শর্মিষ্ঠা দিল্লিতে গল্প শুনে এসেছে, আলপথ ধরে হেঁটে পুজো দেখতে যাওয়া নাকি একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং ঘটনা। আলপথে হাঁটার রোমাঞ্চ এবং পুজো দেখার মজা দুটোই একসঙ্গে পাওয়া যায়।

তপনদা চন্দনাবউদিদের এই পারিবারিক ভ্রমণে বাবলুর জায়গা হওয়ার কোনও কারণ নেই। সে এই পরিবারের কেউ নয়। একজন সামান্য পরিচিত মাত্র। ছুটিছাটার দিনে তাদের বাড়িতে ঘুরঘুর করে। তপনদা বড় চাকরি করেন। যদি একটা কিছু যোগাযোগ হয়ে যায় এই আশায় ঘুরঘুর। তপনদা প্রশ্রয় দিলেও চন্দনাবউদি বাবলুকে একেবারেই পছন্দ করেন না। তিনি মনে করেন, বাবলু একটি বড়সড় অপদার্থ। এই ছেলের চাকরি বাকরি জোটা তো দূরের কথা, এই ধরনের অপদার্থ ছেলের আশেপাশে থাকাটাও বিপদের। একদিন বড় বিপদ হলে তার স্বামীর শিক্ষা হবে।

মনে হচ্ছে, আজ সেই বিপদই হয়েছে।

বাবলুকে আজ সঙ্গে নেওয়ার কারণ বেড়ানোর এই জায়গাটা তারই ব্যবস্থা করা। শর্মিষ্ঠা দুম করে আবদার করে বসছে, পুজোর মধ্যে একদিন সে কলকাতার ভিড় থেকে পালাতে চায়। চন্দনাবউদিদের মাথায় হাত পড়ল। সর্বনাশ! কোথায় পালাবে? এইসময় সব পাওয়া যায়, কিন্তু হুট করে বেড়ানোর জায়গা পাওয়া যায় না।

ড্রইংরুমে বসে বাবলু চা খাচ্ছিল। এমনি দিনে তাকে শুধু চা দেওয়া হয়। পুজোর সময় বলে একটা সন্দেশও দেওয়া হয়েছে। ঘটনা শুনে সন্দেশটা হাতে নিয়ে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল। বলল, ‘আমি দেখছি।’

বাবলু বেরিয়ে যাওয়ায় চন্দনাবউদি মুখ বেঁকিয়ে বললেন, ‘দূর, ওই ছেলে কী পারবে? ও গাধা বেড়ানোর কী জানে?’

তপনদা বলেন, ‘আহা, দেখা যাক না।’

সত্যি দেখা গেল। বিকেলে একগাল হাসি নিয়ে বাবলু হাজির। জানাল, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মোটে তিন ঘণ্টার ঝাঁ চকচকে গাড়ির পথ। পথ যেখানে শেষ সেখানেই নদী। নদীর নামটা মনে পড়ছে না, তবে নদী বড় নয়, ছোট। বড় কথা হল, চারপাশে কিছু নেই। কেউ নেই। ঠিক যেমনটি চাওয়া হচ্ছে। শুধু একটা বাংলো আছে। একতলা বাংলো। সেই বাংলো ছবির মতো সুন্দর। বড় বড় ঘর। প্রতিটি ঘর থেকে শুধু নদীই দেখা যায় না, ঘরের পিছনে নদী পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আলাদা সিঁড়িও আছে। প্রাইভেট সিঁড়ি। ইচ্ছে করলে মাঝরাতে পা টিপে টিপে বেরিয়ে নদী পর্যন্ত ঘুরে আসা যাবে। কেউ জানতে পারবে না।

চন্দনাবউদি চোখ সরু করে বললেন, ‘এই বাংলো তুমি কী করে জোগাড় করবে?’ তাঁর গলা শুনেই বোঝা গেল, তিনি বাবলুর কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না।

বাবলু গদগদ ভঙ্গিতে জানায়, ‘জোগাড় করব কী? অলরেড়ি জোগাড় হয়ে গেছে। এই জায়গার খোঁজ লোকজন বিশেষ জানে না। সবসময়ই ফাঁকা পড়ে থাকে। আমার ছোটমামার এক বন্ধু ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে বালির বস্তা সাপ্লাই করেন। তিনিই খবর দিলেন। ওখানেও খবর চলে গেছে। বাংলো এখন একদিনের জন্য আমাদের। শুধু আমাদের।’

তপনদা চিন্তিত মুখে বলল, ‘দেখো বাবা শুধু তোমার ছোটমামার বন্ধুর ভরসায় চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? গিয়ে যদি দেখি…’

বাবলু আবার হাসল। এবার হাসির মধ্যে একটা যুদ্ধজয়ের কায়দা আছে। বলল, ‘গিয়ে দেখবেন গঙ্গা মুরগির ঝোল আর ভাত করে রেখেছে। আমি রান্নায় ঝাল কম দিতে বলেছি। সঙ্গে ছোট ছেলে আছে।’

শর্মিষ্ঠা চোখ সরু করে বলল, ‘গঙ্গা! গঙ্গা কে?’

বাবলু উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘গঙ্গা হল বাংলোর কেয়ারটেকার কাম রাঁধুনি কাম চৌকিদার। একটা খবর শুনলে আপনারা সবাই খুশি হবেন।’

শর্মিষ্ঠা চোখ আরও সরু করে বলল, ‘কী খবর?’

‘গঙ্গা ভাটিয়ালি জানে।’

চন্দনাবউদি বিস্মিত গলায় বলল, ‘ভাটিয়ালি জানে! ভাটিয়ালি জানে মানে?’

‘ভাটিয়ালি মানে ভাটিয়ালি গান। ফোক সঙ। এখন নিয়ম হয়েছে, নদীর পাশের বাংলোর কেয়ারটেকার হতে গেলে ভাটিয়ালি গান জানা মাস্ট। ইন্টারভিউয়ের সময়তেই গান শুনে নেওয়া হয়। চন্দনাবউদি আপনার জন্য সাউথ ফেসিং ঘরটা রেডি করতে বলেছি। ছোটমামার বন্ধুর কাছে শুনলাম, ওই ঘরটা নাকি বেস্ট। রাতে শোওয়ার পর একটা দুলুনি এফেক্ট আসে। মনে হয় নদীর ওপরই আছি।’ বাবলু একটু থামল। তারপর শর্মিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি নিশ্চয় রাতে পড়াশোনা করবেন। সামনেই ফাইনাল। সেই কারণে আপনার জন্য ব্যবস্থা করতে বলেছি পশ্চিমের ঘর। রাত জাগার পর বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারবেন। পুবদিকের আলোয় অসুবিধে হবে না। আপনার কী মনে হয়?’

কথা শেষ করে বাবলু হাসিমুখে শর্মিষ্ঠার দিকে তাকায়। শর্মিষ্ঠা গম্ভীর মুখে বলল, ‘মনে হয় আপনার এবার চুপ করা উচিত। আপনি একটু বেশি কথা বলছেন।’

দুপুরের মুখে মুখে পৌঁছে দেখা গেল, বাবলুর কথা সত্যি। সত্যি পথের শেষে নির্জন নদী আছে। নদীর পাশে ছবির মতো নয়, ছবির থেকেও সুন্দর একটা বাংলো আছে। সেই বাংলোর ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, বাবলুর কথা আরও খানিকটা সত্যি। বাংলোতে ঘরও আছে। ঘরগুলোও বড় বড়। কিন্তু তারপর? তারপরটাই ভয়াবহ। সেই ঘরের অবস্থা মারাত্মক। রাত্রিবাস তো দূরের কথা। সেখানে দিন কাটানোই অসম্ভব। দেয়ালে উই। একটা জানলাতেও ছিটকিনি লাগছে না। খাট শুধু নড়বড়ে নয়, দুটো ঘরে ভাঙাও। একদিকে কাত হয়ে আছে। মাঝরাতে ভেঙে পড়ার জন্য একেবারে তৈরি। বিছানার চাদর-টাদরের দিকে তো তাকানোই গেল না।

চন্দনাবউদি আর শর্মিষ্ঠা ছিটকে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এসে বসেছে বারান্দায়।

বাংলো থেকে কয়েক হাত দূরে তখন নদী উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে রোদের সোনালি আঁচল বিছিয়ে স্নানে বসেছে। একসঙ্গে এতগুলো মানুষ দেখে সে বুঝি লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি আঁচল তুলতে গিয়ে জলে ঢেউ উঠল।

ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের একটা স্টিমার ভোঁ তুলে, জল কেটে চলে গেল নদীর মাঝবরাবর।

সাহেব দূরবিন চোখে চিৎকার করে উঠল, ‘পাইরেটস, পাইরেটস।’

চন্দনাবউদি জানিয়ে দিলেন, তিনি ঘরে ঢুকবেন না। এই মুহূর্তে কলকাতায় ফিরে যাবেন। তপনদা বললেন, অসম্ভব এখনই ভাবার অতটা গাড়ি চালানো অসম্ভব। গাড়িকে বিশ্রাম দিতে হবে। বিকেলটা এখানে কাটিয়ে সন্ধে নাগাদ রওনা দেওয়া যেতে পারে। শর্মিষ্ঠা বলছে, তা হলে সন্ধে পর্যন্ত সে বারান্দাতেই বসে থাকবে। এই জঘন্য বাংলোর বিরুদ্ধে এটাই হবে তার প্রতিবাদ। ব্যালকনি প্রোটেস্ট। বারান্দা প্রতিবাদ।

তপনদা গলা নামিয়ে বললেন, ‘কী ছেলেমানুষি করছ তোমরা? ছেলেটা শুনতে পাচ্ছে। আহা, ওর কী দোষ? বাবলু কি আগে এখানে এসেছে না এই বাংলোয় থেকে গেছে। তোমাদের জন্যই তো ব্যবস্থা করল। একটা রাতের তো মামলা। বেড়াতে এসে অত খুঁতখুঁতুনি চলে না।’ তারপর গদগদ গলায় চন্দনাবউদিকে বললেন, ‘আহা, কী সুন্দর নদী দেখেছ চন্দনা? ভাল করে তাকিয়ে দেখে একবার।’

চন্দনাবউদি কোলের ওপর রাখা হাতব্যাগটা চেপে ধরে বিড়বিড় করে বললেন, হ্যাঁ, দেখছি। খুবই ভাল লাগছে। এত ভাল লাগছে যে ইচ্ছে করছে, তোমার ওই বাবলু আহাম্মকটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নদীতে কুড়িবার চুবিয়ে আনি।’

সাহেব হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘কী মজা বাবলুমামাকে চোবানো হবে, কী মজা, কী মজা।’

প্রথমদিকটায় গঙ্গাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে আবিষ্কার করা গেল খানিক পরে। রান্নাঘরে। সে খুবই লাজুক প্রকৃতির মানুষ। অতি বিনয় এবং লজ্জার সঙ্গে সে অতিথিদের তিনটি তথ্য জানায়।

তথ্য নম্বর এক. মুরগি পাওয়া যায়নি। তবে চিন্তার কোনও কারণ নেই। ডিমের ঝোল চাপানো হয়ে গেছে। খরচ একটু বেশি পড়েছে এই যা। তথ্য নম্বর দুই. ঘর পছন্দ হয়নি তো কী হয়েছে? ঘরেই যে থাকতে হবে এমন মাথার দিব্যি তো কেউ দেয়নি। দশ-বিশ টাকা পেলে গঙ্গা রাতে হলঘরে মেঝেতে চমৎকার বিছানা পেতে দিতে পারে। ঢালা বিছানা। আরও দশ-বিশ টাকায় কাচা চাদর-টাদরও সব বেরিয়ে আসবে। কোনও সমস্যা নেই। শুধু একটু সাবধানে ঘুমোতে হবে। কারণ হলঘরে ‘ইন্দুর’ আছে। সেই ইন্দুর নাকি আবার রাতে বিছানায় উঠে পড়ে। তবে দু’-পাঁচ টাকা খরচ করলে ‘ইন্দুর’ ঠেকানোর ব্যবস্থাও হবে। সে পথও নাকি আছে। সম্ভবত হ্যামলিনের বাঁশিওলা ধরনের কাউকে ডেকে আনা হবে। তথ্য নম্বর তিন. এই একমাত্র বিষয় যাতে গঙ্গা কোনও অতিরিক্ত টাকা পয়সার কথা বলেনি এবং বলার সময় লজ্জায় মুখ-টুখ নামিয়ে একাকার কাণ্ড করে। তার খুবই ইচ্ছা, ডিমের ঝোল শেষ হওয়ার আগেই অতিথিদের দু’লাইন ভাটিয়ালি শোনায়।

বাবলু আঁতকে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে গান! তপনদা ফিসফিস করে বলেন, ‘বুঝতে পারছ না, গান না শুনলে বেটা রান্না শেষ করবে না। কোনও উপায় নেই। তুমি ওদের একটু বুঝিয়ে বলো।’

হলঘরে আসর বসেছে। বাইরে কড়কড়ে রোদের দুপুর। নদী ঝলসাচ্ছে খাপ তোলা তলোয়ারের মতো। অতিথিদের জন্য শতরঞ্জি পেতে গঙ্গা মাটিতে বসল। হাত রাখল কোলের ওপর। তারপর চোখ বুজে বিকট চিৎকার দিল ‘ও মাঝি ভাই রে……’

শর্মিষ্ঠা কঠিন চোখে তাকাল বাবলুর দিকে। চন্দনাবউদির মুখ দেখে মনে হল, তিনি শোকে পাথর হয়ে গেছেন।

গান শুনতে শুনতেই বাবলু সিদ্ধান্ত নিল, অনেক হয়েছে। অনেক বেশি হয়েছে। আর নয়। এই অপরাধের সাজা তাকে পেতে হবে। নিজেই নিজেকে শাস্তি দেবে। সেই শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। হারিকিরির কায়দায় একটু পরেই সে গিয়ে নদীর জলে ডুবে আত্মহত্যা করবে। ভালই হবে। ফালতু মানুষের জন্ম মৃত্যুর দিনক্ষণ কারও মনে থাকে না। থাকার কথাও নয়। তবে তারটা মনে থাকবে। উৎসবের দিনে, আনন্দের দিনে মৃত্যু তো, তাই মনে থাকবে। ডুব দেওয়ার সময় ঢাকের আওয়াজ কি পাওয়া যাবে? পেলে ভাল। একটা বিসর্জন বিসর্জন এফেক্ট হবে। আত্মহত্যার সময় একটা চিঠি লিখে যাওয়া উচিত। কাকে লিখবে? শর্মিষ্ঠাকে লিখলে কেমন হয়? সাহস হচ্ছে না। মেয়েটা খুবই রগচটা। বাবলু ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। এইজন্যই বলে উৎসবের সময় কখন যে কী ঘটে কেউ বলতে পারে না।

না, পারে না। পারলে এরকম একটা ভয়াবহ গানের পরও গঙ্গার ডিমের ঝোল ‘দারুণ, দুর্দান্ত, ফ্যান্টাস্টিক’ বলে সবাই হাপুস হুপুস করে খেয়ে নিতে পারত না। শুধু তাই নয়, বিকেলে রগচটা শর্মিষ্ঠা আবদার করল, ‘জামাইবাবু নৌকো চড়ব। ফিরে যাওয়ার আগে নৌকো চড়ে নদীতে খানিকক্ষণ ঘুরব।’

তপনদা বললেন, ‘অসম্ভব। দেরি হয়ে যাবে।’ চন্দনাবউদি ধমকে বললেন, ‘হোক দেরি। লজ্জা করছে না বলতে? এরকম একটা জঘন্য জায়গায় নিয়ে এসেছ…… যাও এখনই ওই গাধাটাকে নৌকো ঠিক করতে বলো। নৌকো যেন ভাল হয়।’

বাবলু আত্মহত্যার প্রোগ্রাম স্থগিত রেখে এখন নৌকো খুঁজছে। খুবই উৎসাহের সঙ্গে খুঁজছে। বাংলো কেলেঙ্কারির পরেও যে তাকে এরকম একটা দায়িত্ব দেওয়া হবে সে ভাবতেও পারেনি। সমস্যা এই নদীতে নৌকোও তেমন নেই। থাকলেও ছোট ছোট ডিঙি ধরনের জিনিস। এসবে চলবে না। হাবিজাবি কিছুতে ওদের তোলা যাবে না। নৌকো সাবধানে বাছতে হবে। বাংলোর মতো যেন না হয়। একটা ভেলকি দেখিয়ে দিতে হবে। লাস্ট চান্স। শেষ সুযোগ। একটা বড় নৌকো চাই। সাজানো গোছানো নৌকো। পাল তোলা কি পাওয়া যাবে? পেলে খুব ভাল হয়। শর্মিষ্ঠা চমকে যেত। এই মেয়েকে চমকে দেওয়া দরকার।

পছন্দমতো নৌকো পাওয়া গেল সন্ধের মুখে। পাল না থাকলেও গায়ে নকশা আছে। রঙিন নকশা। ছইয়ের মাথায় খড়। ভেতরে পাতলা গদি। তাতে সাদা চাদর, তাকিয়া। বাইরে পাটাতনের ওপর বসার জায়গাও সুন্দর। তপনদা, চন্দনাবউদি সেখানে বসলেও শর্মিষ্ঠা বসেনি। সে ছইয়ের ওপাশে গেছে। গিয়ে বসেছে নৌকোর গায়ে। নৌকোর গায়ে না বসলে দুলুনির মজাটাই নাকি পাওয়া যায় না। আপত্তি করায় বলেছে, সে নাকি ইউনিভার্সিটির সুইমিং চ্যাম্পিয়ন। বাবলুর একথা পছন্দ হয়নি। জলে পড়লে ঠেলা বুঝবে। চ্যাম্পিয়নগিরি বেরিয়ে যাবে।

সাহেব দূরবিন চোখে লাগিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘পঙ্খিরাজ! পঙ্খিরাজ।’

নৌকো ছাড়লে চন্দনাবউদি তাঁর স্বামীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘গাধাটা, ব্যবস্থা খারাপ করেনি।’

নৌকোর এদিকটায় কেউ নেই। সাহেব ঢুকেছে ছইয়ের ভেতর। শর্মিষ্ঠা আর বাবলু ওদিকে। তাদের দেখা যাচ্ছে না। তপনদা চন্দনাবউদির দিকে সরে এলেন।

সন্ধে নামছে। জলের রং এখন স্লেটের মতো। মাথার ওপর দিয়ে ব্যস্ত হয়ে উড়ে গেল কয়েকটা পাখি। চন্দনাবউদি মুখ তুলে উড়ে যাওয়া পাখি দেখতে দেখতে বললেন, ‘ভাবছি রাতটা ওই হতচ্ছাড়া বাংলোতেই থেকে যাব।’

‘ওই বাংলোয়! পাগল নাকি!’

‘তোমাদের পাল্লায় যখন পড়েছি, পাগল না হয়ে উপায় আছে? গঙ্গা তো বলল, টাকা পেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বেশি করে দিয়ো। দেখবে ইঁদুর-টিদুর সব পালিয়েছে। রাতে কিন্তু চিকেন খাব। এই দেখো, দেখো পাখিগুলো আবার ফিরে আসছে। মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে। তাই না গো? আরে, দেখবে তো। কী আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছ। ন্যাকা।’

তপনদা মুচকি হেসে মুখ তুললেন। অন্ধকার আকাশে সত্যি সত্যি উড়ে গেল ক’টা সাদা পাখি! আচমকা দুলুনি সামলাতে তপনদা স্ত্রীর হাত ধরলেন এবং ছাড়লেন না।

ছইয়ের ওপাশে তখন শর্মিষ্ঠা বাবলুকে ধমক দিচ্ছে। চোখ পাকিয়ে বলছে, ‘অ্যাই, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জোরে একটা ঢেউ এলেই টুপ করে জলে পড়বেন। আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে পাখি দেখা বেরিয়ে যাবে তখন। কায়দা না করে চলে আসুন, এখানে এসে বসুন।’

বাবলু আমতা আমতা করে বলল, ‘বাপ রে এখানে বসব? আমি তো সাঁতার জানি না। পড়ে টড়ে যাই যদি?’

শর্মিষ্ঠা কঠিন গলায় বলল, ‘কোনও অসুবিধে নেই। আমিও সাঁতার জানি না। আসুন।’

ছই ধরে নিজেকে সামলে বাবলু ভয়ে শর্মিষ্ঠার পাশে গিয়ে বসে।

একটা চাঁদ উঠছে নদীর ওপর। মস্ত বড় চাঁদ। নদীর চাঁদ। হাসি হাসি মুখে সে তাকিয়ে আছে চুপিচুপি ভেসে যাওয়া এই নৌকোটার দিকে। নদীর চাঁদের মজা হল, যেদিন তার মন খুব ভাল হয়ে যায় সেদিন সে লম্বা সিঁড়ি নামিয়ে দেয় একেবারে সেই জল পর্যন্ত। কেউ চাইলে সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারে। ঘুরে আসতে পারে তার কাছে।

আজ মনে হচ্ছে সেই ঘটনাই ঘটবে। এই নৌকোর মানুষগুলোর জন্য খানিক পরেই চাঁদ নদীতে নামিয়ে দেবে তার রুপোলি আলোর সিঁড়ি।

দূরে কোথায় যেন ঢাক বাজছে। উৎসবের ঢাক। কোথায় বাজছে? কোন পাড়ে?

বর্তমান রবিবাসর, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *