পেঁচা

পেঁচা

মন্দিরার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। বেশি নয়, হালকা একটা অস্বস্তি। কীসের অস্বস্তি? একটা গ্রাম্য, রোগাভোগা ছেলেকে দেখে অস্বস্তি হবে কেন? অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে মুখ তুলে ভাল করে তাকাল।

ছেলেটার বয়স চোদ্দো-পনেরো, নাকি আর একটু বেশিই হবে? অত্যাধিক রোগা হলে বয়স ঠিকমতো বোঝা যায় না। একতলার এই ড্রইংরুমে আলোর শেডগুলো কায়দার। মন্দিরা নিজে বেছে কিনেছিল। কায়দার আলো তেমন উজ্জ্বল হয় না। এ ঘরেও তাই ঘটেছে। তবে তার মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা পরেছে খয়েরি রঙের ফুলপ্যান্ট আর একটা বেখাপ্পা হলুদ রঙের জামা। দুটোই যথেষ্ট সস্তার। জামা সস্তার হলেও হাতায় বোতাম আছে। সেই বোতাম যত্ন করে লাগানো। সঙ্গে একটা পেটমোটা ব্যাগ। ব্যাগ না বলে পুঁটলি বলাই ভাল। হাতলওয়ালা পুঁটলি। সেই পুঁটলি মাটিতে রেখে, ঝাঁকড়া চুলের রোগা ছেলে মাথা নামিয়ে, জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটার কাঁধগুলো কি একটু উঁচু? নাকি দাঁড়ালে উঁচু লাগে? গা থেকে কেমন একটা পাড়াগাঁয়ের বুনো বুনো গন্ধ আসছে।

মন্দিরা বিরক্ত হল। কল্যাণ ছেলেটাকে একেবারে ড্রইংরুমে নিয়ে এল কোন আক্কেলে? এরা রোগের ডিপো হয়। কল্যাণের কি খেয়াল নেই, বাড়িতে তার একটা ছ’বছরের মেয়ে আছে?

কল্যাণ টেবিলের ওপর অফিসের ব্যাগ রাখল। পকেট থেকে মোবাই়লটা বের করতে করতে সোফায় বসে পড়ল গা এলিয়ে। বলল, ‘মন্দিরা, এর কথাই তোমায় ফোনে বলেছি। অনন্তকাকা পাঠিয়েছে। এই, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই টুলটা টেনে বসো৷’

ছেলেটা বসল না। দরজার পাশে যেমন দাঁড়িয়ে ছিল, তেমন দাঁড়িয়ে রইল।

মন্দিরা ছোট করে বলল, ‘ও।’

কল্যাণ পকেট হাতড়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করল। স্ত্রীর দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘এই দেখো, অনন্তকাকার চিঠি। অনন্তকাকাকে তোমার মনে আছে? বাবার কাজের সময় এসেছিল?’

মন্দিরা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘না, মনে নেই। আমি চিঠি দেখে কী করব?’

মন্দিরার চিঠি দেখার কোনও ইচ্ছে নেই। কী হবে দেখে? শ্বশুরমশাই মারা যাওয়ার আগেই দেশের জমি-জমা সব বিক্রি করেছেন। দেশই নেই, সেই দেশের আবার কাকা-জেঠা! তাও নিজের হলে একটা কথা ছিল। কবে কোথায় ঘর-বাড়ি দেখত, সম্পত্তি পাহারা দিত তার জন্য পাতানো সম্পর্ক। এইসব আজকাল চলে নাকি! যত্তসব গোঁইয়া ব্যাপার।

কল্যাণ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘আহা, দেখোই না। দেখলে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে।’

মন্দিরা বুঝতে পারল, তার স্বামী কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করছে। বোঝাতে চাইছে, খানিকটা বাধ্য হয়েই সে এই ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। এটা কোনও কথা হল? আজকালকার দিনে কেউ জোর করে কারও ঘাড়ে একটা আস্ত মানুষ গছিয়ে দিতে পারে না। কল্যাণের মতো চালাকচতুর মানুষের এরকম একটা ভুল হয় কী করে! সন্ধের মুখে যখন অফিস থেকে ফোন করে বলল, তখনই মন্দিরার একবার মনে হয়েছিল, বারণ করি। তারপর ভাবল, থাক, ওর বাবার সেন্টিমেন্ট। তা ছাড়া বলছে, দিন কয়েকের মামলা, যা ভাল বোঝে করুক।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মন্দিরা হাত বাড়িয়ে কল্যাণের হাত থেকে চিঠিটা নিল।

এক টুকরো লাইন টানা কাগজে কাঁপা হাতে, খুদে খুদে হরফে লেখা। কাগজটা যথেষ্ট নোংরা। জায়গায় জায়গায় কালি ধেবড়ে আছে। ভাষাতেও গোলমাল। মন্দিরার পড়তে বেশ অসুবিধেই হল।

স্নেহের কল্যাণ, তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা অনুযায়ী মহাদেবকে পাঠাইলাম। আগেই বিস্তারিত সব বলেছি, আবার জানাই, মহাদেবের পিতামাতা অল্প বয়েসে মারা যাওয়ার কারণে সে তার জেঠার কাছে মানুষ। মহাদেবের জেঠা তোমার পিতার বাল্যবন্ধু ছিলেন। তিনি এখন বৃদ্ধ হয়েছেন। শরীরের অবস্থা খারাপ। আর্থিক অবস্থাও ভয়ংকর। ভাইপোর খরচ চালানো আর তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ক’টা দিন নিজের কাছে রেখে ছেলেটিকে যদি কোনও কাজকর্ম জুটিয়ে দিতে পারো তা হলে উপকার হয়। তুমি মহাদেবকে কলকাতায় পাঠাতে বলেছ শুনে উনি অনেকটাই চিন্তামুক্ত হয়েছেন। এখন দেখো যদি কোনও ব্যবস্থা হয়। ছেলেটি খারাপ নয়। এ বৎসর মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেছে। শান্তশিষ্ট প্রকৃতির। নিজের মনে থাকতে ভালবাসে। তোমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। আর কী? ভাল থাকো। ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। তোমার মা কেমন আছেন? ওনাকে আমার প্রণাম জানিয়ো। বউমাকে আমার আশীর্বাদ দিবে। তোমাদের দেখিতে খুব ইচ্ছা হয়। ইতি অনন্তকাকা।

চিঠি ভাঁজ করতে করতে মন্দিরা প্রথমে ঠোঁট বেঁকাল। তারপর চোখ তুলে বলল, ‘ও তাই বলো। তুমিই আসতে বলেছিলে? কই এ কথাটা তো আমাকে বলোনি?’

কল্যাণ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। আমতা আমতা করে বলল, ‘না, মানে ক্যাজুয়ালি বলেছিলাম। অনেক সময় হয় না, কেউ কোনও রিকোয়েস্ট করল, আর আমরা দুম করে বলে ফেললাম, ঠিক আছে, পাঠিয়ে দেবেন, দেখব। সেইরকম আর কী। ফোন করল, ব্যস্ততার মধ্যে বলে দিলাম। অনন্তকাকা যে সত্যি সত্যি পাঠিয়ে দেবে বুঝতে পারিনি। যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে। ক’টা দিন দেখি কী করা যায়।’ কল্যাণ এক মুহূর্ত থামল। সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘একটা সময় অনন্তকাকা অনেক করে দিয়েছে। অত জমিজমা, বাবারা তো যেতে পারত না। অনন্তকাকা না দেখলে হয়তো বেহাতই হয়ে যেত। সেই জমি টমি বেচেই তো বাবা এত বড় বাড়িটা করে গেছেন। তা ছাড়া মন্দিরা, সামনের সপ্তাহে আমি ট্যুরে যাচ্ছি। বড় অ্যাসাইনমেন্ট। একসঙ্গে তিনটে কোম্পানির কাজকর্ম ইনস্পেকশন করে ফিরব। প্লিজ, এই ক’টা দিন একটু ম্যানেজ করে নাও। ফিরে এসে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলব।’

ট্যুরের কথা বলার সময় কল্যাণের চোখ চকচক করে। মন্দিরাও খুশি হল। কল্যাণের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ছুটকো ছাটকা নয়, এবার বড় দাঁওয়ের ব্যাপার আছে। হলেই ভাল। সবাই করে নিচ্ছে, তার স্বামীটি বাদ যাবে কেন? তা ছাড়া কল্যাণ বাইরে গেলে অতীনের সঙ্গে একদিন প্রোগ্রাম করা যেতে পারে। অনেকদিন ওর সঙ্গে প্রোগ্রাম হয় না। যেবার কল্যাণ নর্থবেঙ্গল গেল, অতীন ওর কোন এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাটের চাবি জোগাড় করেছিল। উফ, খুব জ্বালিয়েছিল। এবার কি পারবে?

মন্দিরা নিজের খুশি চেপে রেখে বলল, ‘আমি কী ম্যানেজ করব? আমাকে এসবের মধ্যে একদম জড়াবে না। পশুপতি আছে, ওকে বলে দাও।’

মন্দিরার কথায় খানিকটা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল কল্যাণ। বলল, ‘আমার সব ভাবা হয়ে গেছে। এই ক’টা দিন মহাদেব একতলায় পশুপতির ঘরেই থাকবে।’

মন্দিরা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাই তুলল। দুপুরের ঘুমটা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে আজকাল রাত দশটা বাজতে না বাজতেই হাই ওঠে। মাঝে মধ্যে মনে হয়, মৌ স্কুল থেকে ফেরার আগে একটু গড়িয়ে নিলে হয়। কিন্তু উপায় নেই। দুপুরে দশ মিনিটের ঘুমও একেবারে বিষের মতো। ইস, পেটের কাছটা কীরকম ভারী হয়ে আসছিল। কোনওরকমে সামলানো গেছে। বাপ রে, এই বয়েসে একবার শরীর গেলেই হয়েছে।

মন্দিরা সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘এই ছেলে, তুমি রাতে ক’টা রুটি খাও? চারটে? পাঁচটা? সেইমতো গৌরীকে বলে দিই। কথা বলছ না কেন? বলো, ক’টা রুটি খাবে?’

ছেলে মাথা নামিয়ে চুপ করে রইল।

বিরক্ত মন্দিরা এবার ধমকের সুরে বলল, ‘তুমি কথা বলতে পারো না? মুখ তোলো, বলো।’

মন্দিরার ধমক শুনে শীর্ণকায় গ্রাম্য কিশোরটি চকিতে একবার মুখ তুলেই নামিয়ে নিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘বেশি খাই না। অল্প ক’টা হলেই হবে।’

মন্দিরার শরীরটা শিরশির করে উঠল। ছেলেটার চোখ দুটো অদ্ভুত তো! বড্ড বড়। টানা টানা বড় নয়, অতিরিক্ত গোল। একটুখানির জন্য মুখ তুলল, তাতেই মনে হল, মুখের অনেকটা জুড়ে কেবল চোখ। মণি দুটোও কেমন যেন। ফ্যাকাশে। মনে হল, সে দুটো যেন চোখের মাঝখানে চেপে বসে আছে! নড়াচড়া নেই। সেই স্থির মণি দিয়ে ছেলেটা এক মুহূর্তের জন্য তাকে দেখল!

মন্দিরা গায়ের হাউসকোটটা ভাল করে টেনে নিল।

কল্যাণ বুঝতে পারে মন্দিরার অসুবিধে হচ্ছে। সে উঠে পড়ল। বলল, ‘অ্যাই, তুমি আমার সঙ্গে এসো তো৷ পশুপতির ঘরটা দেখিয়ে দিই।’

এতক্ষণ বোঝা যায়নি, এবার বোঝা গেল, এই ছেলের চটিজোড়া তার পায়ের থেকে বড়। লম্বায় বড় নয়, চওড়ার দিকে বড়। হাঁটার সময় সে সেই চটি আঁকড়ে আঁকড়ে ধরছে। আঁকড়ানোর কারণে কেমন একটা খরখর ধরনের আওয়াজ হয়।

রাতে খেতে বসে মন্দিরা কল্যাণকে কথাটা বলল।

‘ছেলেটার চোখগুলো দেখছ?’

কল্যাণ অন্যমনস্ক। সে ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। সেটাই স্বাভাবিক। খাওয়া শেষ হলেই সে কাগজপত্র নিয়ে বসবে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনটে কোম্পানির ফাইল ঘেঁটে তাদের গোলমাল বের করবে। তারপর টেলিফোন করে তাদের জানাতে হবে, ‘আমি আসছি। গিয়েই তোমাদের ক্যাঁক করে গলা টিপে ধরব।’ ব্যস তা হলেই চলবে। এরপর ঘনঘন ফোন করবে ওরাই। দরদাম শুরু হবে। এ কাজ অফিসে বসে হয় না। রাতে বাড়িতে বসে, গোপনে করতে হয়। হাতে মাত্র ক’টা দিন। সে মন্দিরার চোখ সংক্রান্ত প্রশ্ন শুনতে পেল না।

মন্দিরা আবার বলল, ‘ছেলেটার চোখগুলো খেয়াল করেছ?’

কল্যাণ জল খেল। বলল, ‘কার চোখ?’

‘ছেলেটার চোখ। ইস কী বিচ্ছিরি! বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। মনে হয়, সব দেখে ফেলছে!’

কল্যাণ টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে হাসল। বলল, ‘ছেলেটার চোখ দেখব কেন সোনা? দেখলে তোমার চোখ দেখব। তা ছাড়া ওর চোখ তোমাকেই বা দেখতে হবে কেন? নীচে থাকবে, ওর সঙ্গে দেখাই হবে না তোমার।’

মন্দিরা খানিকটা নিজের মনে বলল, ‘সে জানি না। আমার বিচ্ছিরি লাগল তাই বললাম। মানুষের আবার অত বড় চোখ হয় নাকি? তাকানোটা বিচ্ছিরি। গা ঘিনঘিন করে।’

কল্যাণ হেসে বলল, ‘আমাদের স্কুলে একটা ছেলে ছিল। তার কানগুলো ছিল বেশি বড়। বেচারি সবসময় কানঢাকা টুপি পরে থাকত। গরমেও পরত। সবাই খুব খেপাতাম। মহাদেবকে না হয় বলব, তুমি বাবা এই বাড়িতে যতদিন থাকবে, ততদিন একটা সানগ্লাস পরে থেকো। তোমার পুরনো সানগ্লাস আছে?’

মন্দিরা বিরক্ত গলায় বলল, ‘সবকিছু নিয়ে রসিকতা কোরো না। ভেবেছিলাম, মৌকে আজ তিনতলায় ওর ঠাকুমার কাছে শুতে পাঠাব না। ও রাজি হল না। বলল, ঠাম্মার কাছেই শোব। একটা বাজে হ্যাবিট হয়েছে। আমার ভয় করছিল।’

খাওয়ার টেবিলের পাশেই মুখ ধোওয়ার ছোট্ট বেসিন। ডাইনিং টেবিলের সঙ্গে ম্যাচ করিয়ে সেটার রংও গোলাপি। হালকা গোলাপি। কল্যাণ সেখানে মুখ ধুতে ধুতে দেয়ালের একফালি আয়না দিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল। বলল, ‘ভয় করছে! দূর, ও একটা বোকা, গেঁয়ো ভূত। মুখ তুলে তাকাতেই পারে না। ওকে আবার ভয় কী? দেখলে না নিজেই কেমন সিঁটিয়ে আছে? তুমি একদম চিন্তা কোরো না। পশুপতিকে বলে দিয়েছি, আমি যতদিন বাইরে থাকব, ততদিন গাধাটাকে যেন চোখে চোখে রাখে, ওপরে আসতে না দেয়। ফিরে এসে একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। দেখি কাজকর্ম জোটাতে পারলে ভাল, নইলে ফেরত। আসলে কী জানো, অনন্তকাকা বলেছে যখন, চেষ্টা একটা করতে হবে। প্লিজ মন্দিরা, এটা নিয়ে তুমি আর আমাকে বিরক্ত কোরো না।’

মন্দিরা উঠতে উঠতে বলল, ‘আমি কিন্তু ওকে বেশিদিন এ বাড়িতে অ্যালাউ করছি না। সেটা তোমাকে আগে থেকেই বলে রাখলাম। তোমার সেন্টিমেন্ট নিয়ে তুমি থাকো। মনে রাখবে বাড়িতে একটা ছোট মেয়ে আছে।’

মন্দিরা ঘরে শুতে চলে গেলে, কল্যাণ ফাইল ঘুলে বসল। দোতলার এই বসবার জায়গাটা ছোট। তবে মন্দিরা মন দিয়ে সাজিয়েছে। নিচু নিচু বেতের চেয়ার। বেতের টেবিল। পাশে লম্বা আলোর স্ট্যান্ড। সেটাও বেতের। জ্বালালে একটা আলোছায়া ভাব হয়। দেয়ালে বেতের ফ্রেমে সারি সারি রাজস্থানি পেন্টিং। রাধা-কৃষ্ণের অনেকরকম মুড। ঘর সাজানোর সময় কল্যাণ বলেছিল, ‘বাড়াবাড়ি কোরো না। লোকে কিন্তু সন্দেহ করবে। বলবে, ঘর সাজানোর মতো এত টাকা কোথা থেকে পেল?’ মন্দিরা বলেছে, ‘ছাড়ো তো তোমার সন্দেহ। রাজ্যের লোক কত কী করে নিল! তা ছাড়া দোতলায় তো আর যাকে তাকে তুলছি না।’

বেতের আলো জ্বেলে কল্যাণ কাজে মন দিল। তিনটে ফাইলের মধ্যে দুটো দেখা শেষ করে ঘড়ি দেখল সে। রাত বেশি হয়নি। কাজ ভাল এগিয়েছে। তিনটেরই হিসেবে অনেক গোঁজামিল। হিসেবে প্রচুর জল। এটা খুব ভাল। ভুল যত বেশি, কাজ তত সহজ। সিগারেট ধরিয়ে কল্যাণ তিন নম্বর ফাইলটা কাছে টানল। আর তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল! চাপা, খরখর ধরনের আওয়াজ। কেউ কি হাঁটছে?

সামান্য চমকে পিছনে ফিরল কল্যাণ। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে তাকাল। এ বাড়ির দোতলা আর তিনতলার সিঁড়ির মুখে বড় বড় দরজা। দরজার বেশিটা জুড়ে কাচ। কাচের গায়ে বাহারি গ্রিল। ফুল পাতা আঁকা গ্রিল। দিনেরবেলা দরজা খোলা থাকে। রাতে ভেতর থেকে লক করা হয়।

আবার আওয়াজটা হল। খর্‌ খর্‌ খর্‌…।

কল্যাণ হাতের কাগজপত্র টেবিলের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। সে কি ভুল শুনছে? মনে হচ্ছে, কেউ পা টেনে টেনে হাঁটছে! হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসছে! কে আসছে? পশুপতি। এক পা এগোতেই কল্যাণ বুঝতে পারল, না পশুপতি নয়। এ আওয়াজ তার পায়ের নয়। তবে? ছেলেটা নয় তো? কী যেন নাম? সহদেব না জয়দেব? নামটা মনে পড়ছে না। এত রাতে ওই ছেলেটা অচেনা বাড়ির মধ্যে হাঁটবে কেন? আর অন্ধকারে হাঁটবেই বা কী করে? চেয়ার ছেড়ে উঠে কল্যাণ ঘরের বড় আলোটা জ্বালিয়ে দিল। তারপর এগিয়ে গিয়ে কাচের দরজা খুলল। সিঁড়ির মুখের আলোটা জ্বালাল। না, কেউ নেই। ঝুঁকে দেখল। একতলার ল্যান্ডিং অন্ধকার। আওয়াজটাও থেমে গেছে। তা হলে ভুলই শুনেছে। দরজা আটকে ফিরে আসতে আসতে নিজের মনেই সামান্য হাসল কল্যাণ। আজ সারাটা দিনে অনেক পরিশ্রম গেছে। বেশি পরিশ্রমের পর মানুষ অনেকসময় ভুল শোনে। তার ওপর মন্দিরাটা মাথার মধ্যে হাবিজাবি জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে। না, আজ আর কাজ হবে না।

কল্যাণ কাগজপত্র গুছিয়ে নিল।

দুই

‘বউদি, একটা কথা বলব?’

পশুপতি দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজায়। মৌ-কে স্কুলবাসে তুলে দিয়ে সে বাজার করে ফিরেছে। গৌরী এলে মন্দিরা তাকে রান্না বুঝিয়ে দেবে। তার আগে সে দ্রুত হাতে কল্যাণের ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে। গৌরী সারাদিনের রান্নাবান্না করলেও কল্যাণের ব্রেকফাস্ট মন্দিরা নিজেই বানায়। সে স্যান্ডুইচের শশা কাটতে কাটতে ‘বলো, বলো, বলো কী বলবে?’

পশুপতি মাথা তুলে বলল, ‘বউদি, ওই ছেলের সঙ্গে আমি থাকব না।’

পশুপতি এই তিনতলা বাড়ির একই সঙ্গে পাহারাদার, কেয়ারটেকার, মালি এবং ম্যানেজার। মাঝারি বয়সের গম্ভীর ধরনের মানুষ। এ বাড়িতে আছে অনেক বছর হয়ে গেল। একতলায় গ্যারেজের পেছনে তার জন্য একটা আলাদা ঘর তুলে দিয়েছে কল্যাণ। অ্যাসবেসটসের চাল। গত বছর যখন নতুন টিভিটা কেনা হল, তখন দোতলার ছোট সেটটা তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজকর্ম শেষ হলে পশুপতি ঘরের দরজা আটকে টিভি দেখে। অনেক রাত পর্যন্ত সেই টিভির আওয়াজ পাওয়া যায়।

মন্দিরা অবাক হয়ে মুখ তুলল। সে পশুপতির কথাটা বুঝতে পারছে না। বলল, ‘কোন ছেলের কথা বলছ পশুপতি! কার সঙ্গে থাকবে না?’

‘ওই যে দাদাবাবু সেদিন যে ছেলেটাকে নিয়ে এল। ওর সঙ্গে থাকব না বউদি।’

এতক্ষণে মন্দিরার মহাদেবের কথা মনে পড়েছে। ওহ, সেই বড় বড় চোখের ছেলেটা। মন্দিরা মনে মনে হাসল। তাই তো, দু’দিন ধরে ছেলেটা যে এ বাড়িতে আছে সে কথা যেন মনেই নেই! মন্দিরা কেন, কল্যাণও আর প্রসঙ্গটা তোলেনি। কোনও সাড়াশব্দও পাওয়া যায় না। সারাদিন মনে হয় পশুপতির ঘরেই বসে থাকে। যাতায়াতের পথেও চোখে পড়ে না। কিংবা কে জানে হয়তো পড়েছে, খেয়াল হয়নি।

মন্দিরা পশুপতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কেন, থাকবে না কেন? দু’দিন তো থাকলে।’

‘হ্যাঁ, থেকেছি, আর থাকব না। আপনি দাদাবাবুকে বলুন।’

মন্দিরার মজা লাগল। পশুপতিও নিশ্চয় তার মতো মহাদেবের গোল চোখ আর উঁচু কাঁধ দেখে ভয় পেয়েছে। ট্রে-তে স্যান্ডুইচের প্লেট, চায়ের কাপ-ডিশ সাজাতে সাজাতে বলল, ‘ছেলেটাকে দেখতে কেমন যেন। কোনও গোলমাল করেছে নাকি?’

‘না, ওসব নয়। অন্য ব্যাপার।’

মন্দিরা থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ব্যাপার! কী ব্যাপার?’

পশুপতি গলা নামিয়ে বলল, ‘মহাদেব রাতে ঘুমোয় না।’

‘ঘুমোয় না!’

পশুপতি ফিসফিস করে বলল, ‘না, ঘুমোয় না। প্রথমদিন ভেবেছিলাম, নতুন জায়গায় বলে ঘুম হচ্ছে না। সেদিন কিছু বলিনি। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, ঘটনা অত সহজ নয়। এই ছেলে শুধু জেগে থাকে না, সারারাত তক্তপোশের ওপর বসে থাকে। বসে বড় বড় চোখ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।’

মন্দিরা ভুরু কুঁচকে বলল, ‘দেখে! কী দেখে? অন্ধকারে কী দেখবে পশুপতি?’

‘সে জানি না বউদি। কাল রাতে ঘুমের মধ্যেই আমার কেমন একটা অসুবিধে হল। শরীরের অসুবিধে। অম্বল হলে যেমন হয়, অনেকটা সেরকম। গলা জ্বালা, বুকে একটা চাপ মতো। ঘুম ভেঙে গেল। জল খাব বলে উঠে পড়লাম। উঠে দেখি, ও মা, এ ছেলে আজও কাঁধ উঁচু করে বসে আছে! চোখ এতখানি করে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে সে দুটো যেন আরও বড় লাগে! আমি কেমন জানি ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু ঘাবড়ালে তো চলবে না। তখন ধমক দিয়ে বললাম, অ্যাই, বসে আছিস কেন? ঘুমা। সে বলল, ঘুম আসে না। আমি বললাম, ঘুম আসে না তো বসে থাকবি? চোখ বন্ধ করে, ঘাপটি মেরে শুয়ে থাক। জল খাবি? সে বলল, না, খাব না। তারপর দলা পাকিয়ে তক্তপোশের কোণে শুয়ে গেল। আমিও শুলাম। কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। খানিক পরে বউদি, কেমন একটা সন্দেহ হয়। মনে হল, গায়ের কাছে কী যেন নড়ে! পাশ ফিরে দেখি, ছেলে ফের উঠে বসেছে। চোখ টান টান করে তাকিয়ে রয়েছে। সেগুলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে, আর…।’

মন্দিরা জিজ্ঞেস করে, ‘আর! আর কী?’

পশুপতি বিড়বিড় করে বলে, ‘আর ঘাড় নাড়ে বউদি। একবার এদিক, একবার ওদিক। বউদি, আমি ওর সঙ্গে শোব না। আপনি আজই দাদাবাবুকে জানিয়ে দেন।’

চা ঢালতে ঢালতে মন্দিরা সংক্ষেপে কল্যাণকে পশুপতির ঘটনা বলল। এমনকী ঘাড় নাড়ার ঘটনাটাও।

কল্যাণ বিরক্ত গলায় বলল, ‘কী হল আবার? বেশ তো চলছিল। আসলে পশুপতি গল্প বানাচ্ছে। ওর অন্য জায়গায় লেগেছে। পশুপতি আজকাল রাতে ঘরে বসে একটু-আধটু খায়টায়। আমি একদিন ওর ঘরে মদের গন্ধ পেয়েছি। পুরনো লোক, কিছু বলি না। সারাদিন খাটাখাটনি করে।’

মন্দিরা চোখ বড় করে বলল, ‘ও মা, সে আবার কী! বাড়ির মধ্যে বসে নেশাভাং করবে কী গো?’

কল্যাণ হাত নাড়িয়ে বলল, ‘সে আর কী বলব বলো। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে দরজা বন্ধ করে খাচ্ছে। এসব লোককে ছোটখাটো কারণে কিছু বলতে নেই। আফটার অল বিশ্বাসী। ছেড়ে চলে গেলে মুশকিল। এত বড় বাড়ি কে সামলাবে বলো? তা ছাড়া, অসুবিধে তো কিছু করছে না। তবে এবার ওর নিজেরই অসুবিধে হয়ে গেছে। ঘরের মধ্যে আর একটা মানুষ এসে গেছে। এখন তাকে তাড়াবার জন্য আজগুবি গল্প ফেঁদেছে। তুমি ওসব একদম কানে নেবে না।’

মন্দিরা অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কিছুই জানতাম না।’

কল্যাণ চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিল। বলল, ‘ফালতু জিনিস তুমি জেনে কী করবে? আর তা ছাড়া তোমাকে বললাম না, ক’টা দিন একদম বিরক্ত কোরো না। এবারের মাছগুলো বড়। আমিও জমিয়ে ছিপ ফেলেছি।’ কথা শেষ করে কল্যাণ চওড়া করে হাসল।

মন্দিরা খানিকটা নিশ্চিন্ত হল। বলল, ‘তোমার মায়ের চোখের ছানিটা এবার সমস্যা করছে। সকালে বলছিলেন।’

কল্যাণ মুখ তুলে বলল, ‘শুয়ে আছে নাকি?’

‘না, শুয়ে নেই। ঠাকুরঘরে আছেন। বাইরে যাওয়ার আগে একবার ডা. নন্দীকে দেখিয়ে দিয়ো।’

‘এখন হবে না, ফিরে এসে অপারেশনের ব্যবস্থা করব। তুমি বরং আজ থেকে মৌকে নীচে এনে শুইয়ো।’

মন্দিরা বলল, ‘নাতনি তো ঠাকুমা ছাড়া রাতে ঘুমোতেই চায় না। অসুবিধে নেই, গৌরীকে রাতে ক’টা দিন এসে থাকতে বলেছি। ও রাজি হয়েছে। কিছু হলে ডাকবে। তবে তুমিও বড্ড বাড়াবাড়ি করছ, যেভাবে রাত জেগে কাজ শুরু করেছ।’

কল্যাণ হেসে বলল, ‘ডার্লিং, কিছু কাজ রাতেই করতে হয়। অন্ধকারে। যখন কেউ দেখতে পাবে না সেই সময়। হা, হা। আমি বরং চট করে একবার ওপর থেকে মাকে দেখে আসি।’

কল্যাণ ওপরে যেতেই মন্দিরা উঠতে উঠতে দ্রুত হাতে মোবাইলের নম্বর টিপল। অতীন কি কোনও ব্যবস্থা করতে পেরেছে? না পারলে বলছে, এখানেই আসবে। কল্যাণ যেদিন রওনা দেবে সেদিন সন্ধেতেই আসতে চায়। সেটা কি ঠিক হবে? বাড়িতে এত লোক থাকবে।

মন্দিরা অতীনকে ধরতে পারল না। তার নম্বর ব্যস্ত।

খানিক পরে কল্যাণ যখন তিনতলা থেকে নেমে এল তখন তার মুখ গম্ভীর। মন্দিরা বলল, ‘কী হল? মায়ের সমস্যা বেড়েছে নাকি?’

‘না, বাড়েনি। বুঝলে মন্দিরা, ভাবছি, একতলায় সিঁড়ির মুখে একটা কোলাপসেবল বসিয়ে দেব।’

মন্দিরা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

কল্যাণ বলল, ‘না কিছু নয়। দুমদাম কেউ ওপরে উঠে আসতে না পারে। একটা প্রিকশান বলতে পারো। আজকাল যা সব হচ্ছে। পশুপতি বাইরে গেলে তো নাচটা ফাঁকাই পড়ে থাকে।’

মন্দিরা বিরক্ত মুখে বলল, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম। ভাল, তাও আজ হঠাৎ মনে হল।’

কল্যাণ চুপ করে থাকে। কেননা, জিনিসটা তার হঠাৎ মনে হয়নি। খানিক আগেই তার বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধা মা তাকে জানিয়েছেন, ক’দিন ধরে রাতে তিনি নাকি কেমন একটা আওয়াজ শুনছেন। অদ্ভুত আওয়াজ! মনে হয়েছে, বাগানে কে যেন হাত পায়ের নখ দিয়ে গাছ আঁচড়ায়!

আওয়াজ হয়, খর্‌, খর্‌…।

তিন

‘অন্ধকারে কী করছ মৌ?’

‘খেলা করছি মা।’

‘কী বোকার মতো কথা বলছ। তুমি ওপরে ঠাকুমার কাছে যাও। নয়তো ড্রইংরুমে গিয়ে খেলো। অন্ধকারে কখনও খেলা করা যায়?’

‘কেন যাবে না?’

মন্দিরা বিরক্ত হল। কী সব শিখছে মেয়েটা? ধমকের ভঙ্গিতে বলল, ‘আবার বোকার মতো কথা। অন্ধকারে কি কিছু দেখা যায়? কেউ দেখতে পায়?’

‘কেন পারবে না? মহাদেবদা তো পায়।’

মন্দিরা অবাক হয়ে বলল, ‘কে পায়?’

মৌ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘মহাদেবদা পায়। অন্ধকারে দেখতে পায়। আমাকে বলেছে, মৌ তুমিও চেষ্টা করো। চেষ্টা করলে, তুমিও দেখতে পাবে। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। একবার শিখে গেলে দেখবে, আর অসুবিধে হচ্ছে না, অন্ধকারের সব দেখতে পাচ্ছ। তাই আমি চেষ্টা করছি মা।’

বিকেল থেকে আজ মন্দিরার কপালের মাঝখানটা টিপটিপ করছিল। এটা পুরনো অসুখ। অন্ধকারে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে এই ব্যথা সেরে যায়। সেই কারণেই খানিক আগে মন্দিরা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। শুধু কপালে ব্যথা নয়, এই মুহুর্তে মন্দিরার মেজাজও ভাল নেই। আজ সে সারাদিন অনেক কাজ নিয়ে বেরিয়েছিল, একটা কাজও ঠিকমতো হল না। দুপুরে গিয়েছিল বালিগঞ্জে বাবার ওখানে। অঞ্জুও এসেছিল। বাবা চেয়েছিল, বারাসাতের জমিটা নিয়ে একটা কিছু ফাইনাল হয়ে যাক। সেই কারণেই যাওয়া। কল্যাণের ইচ্ছে, জমিটা অঞ্জু তার দিদিকে ছেড়ে দিক। কল্যাণ ওখানে ফ্ল্যাটের ব্যাবসা করবে। ব্যাবসা নিজে করতে পারবে না, সামনে অন্য লোক থাকবে। যাকে বলে ফ্রন্টম্যান। মন্দিরা আজ বাবার সামনে এই কথাটাই পেড়েছিল। অঞ্জু চেঁচামেচি শুরু করল। বলল, ‘এটা কেমন কথা দিদি? জামাইবাবু আমার অংশটুকু সস্তায় কিনে নিয়ে একগাদা লাভ করবে? আমার বর কী অপরাধ করল? ইচ্ছে করলে সেও ভো ফ্ল্যাটের ব্যাবসা করতে পারে। পারে না? জমি তো আমাদের দু’জনেরই। তুই কি তোর বোনকেও ঠকাতে চাস?’

সেই ঝগড়া গড়ল অনেকক্ষণ। সেখান থেকে মন্দিরা গেল গড়িয়াহাট। মৌ-এর একটা ফ্রক পালটানোর ছিল। সেখানে আবার একচোট ঝগড়া। অত বড় দোকান, অথচ কী খারাপ ব্যবহারই না করল। এর মাঝখানে আবার অতীন মোবাইলে ধরে জানাল, এবার কারও ফ্ল্যাট ট্যাট পাওয়া যায়নি। সুতরাং কল্যাণ চলে গেলে সে এ বাড়িতেই আসবে। এটাও একটা টেনশনের ব্যাপার। অতীন যতই বলুক, রিস্ক একটা থেকেই যায়। মেয়েটার জন্যও খচখচ করছে। এদিকে আবার অতীনকে না বলতেও ইচ্ছে করছে না। অতীনের জন্য এখনও মাঝেমধ্যে বোঝা যায়, শরীরটা ঠিক আছে। সুন্দর আছে।

মৌ হাসি হাসি গলায় বলল, ‘মা, দু’দিন ধরে চেষ্টা করছি। মহাদেবদা বলেছে, আরও কয়েকটা দিন চেষ্টা করলেই হবে।’

মেয়ের কথা শুনে মন্দিরা উঠে বসল। দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো এসে মৌ-এর মুখে পড়েছে। হালকা নীল আলোয় ছ’বছরের মেয়েটাকে ভারী সুন্দর লাগছে। এই মেয়েকে তার বাবার মতো দেখতে হয়েছে। মেয়ের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় মন্দিরা বলল, ‘কী বললে মৌ? কী হবে?’

‘ওমা! শুনলে না? ওই যে বললাম, মহাদেবদার মতো অন্ধকারে দেখতে পারব।’

মন্দিরা কড়া গলায় বলল, ‘কী যা তা বলছ মৌ? কে তোমায় বলল মহাদেবদা অন্ধকারে দেখতে পায়?’

মৌ অভিমানে ঠোঁট উলটে বলল, ‘কে আবার বলবে? ওই তো একদিন অন্ধকারে বাগান থেকে আমার বল কুড়িয়ে এনে ওপরে দিয়ে গেল। বিশ্বাস না হলে গৌরী মাসিকে জিজ্ঞেস করো। গৌরী মাসি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধমক দিয়ে বলল, ‘অ্যাই ছেলে, তুই ওপরে এসেছিস কেন? যা নীচে যা। খবরদার ওপরে আসবি না।’ মৌ ঝুঁকে পড়ে তার মায়ের গায়ে হাত দিল। বলল, ‘জানো তো মা, মহাদেবদা খুব মজার। এই বড় বড় চোখ। আর খালি ঘাড় ঘোরায় এপাশে ওপাশে। এপাশে ওপাশে। হি হি।’

মন্দিরা বিস্ফারিত চোখে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, আবছা অন্ধকারে মৌ তার ঘাড় নাড়াচ্ছে! একবার এপাশে, একবার ওপাশে। নাড়াচ্ছে আর হাসছে!

মন্দিরা বিড়বিড় করে বলল, ‘স্টপ ইট মৌ। স্টপ ইট।’ তারপর বালিশের তলা থেকে হাতড়ে মোবাইলটা টেনে কল্যাণের নম্বর টিপল।

চার

কল্যাণ সোফায় হেলান দিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘নাও বোসো, ওই চেয়ারটায় বোসো। তুমি বিকেলে কিছু খেয়েছ মহাদেব?’

মহাদেব বসল না। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই বলল, ‘হ্যাঁ, খেয়েছি।’

‘কী খেয়েছ? বসে বসে কথা বলো। কী খেয়েছ?’

মহাদেব এবারও বসল না। বলল, ‘পশুপতিদা বাড়ি করে মুড়ি দিয়েছিল। মুড়ি খেয়েছি।’

ছেলেটার গলা ফ্যাসফেসে। এই বয়সে ছেলেদের গলা ফ্যাসফেসে, ভাঙা ভাঙাই হয়।

‘আর কী খেয়েছ? বোসো না মহাদেব, লজ্জা কীসের? আমি তো বলছি।’

‘আর চা খেয়েছি।’

বারবার বলা সত্ত্বেও ছেলেটা বসছে না। এটা একটা বিরক্তির বিষয়। কল্যাণ নিজেকে সামলাল। তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মন্দিরার টেলিফোন শোনার পর থেকেই সে ঠিক করেছে, সে মাথা ঠান্ডা রাখবে। একটা ছ’বছরের মেয়ের কথা শুনে মন্দিরা মাথা গরম করে লাফাতে পারে, সে পারে না। কাল বিকেলে সে ট্যুরে বেরিয়ে যাচ্ছে। এখনই সে এই সমস্যাটার মোটামুটি একটা সমাধান করে ফেলতে চায়। পাকা সমাধান করতে আর একটু সময় লাগবে। একটা পার্টির সঙ্গে কথা হয়েছে। ওদের অফিসে পিয়ন দরকার। প্রথমদিকে মাইনেপত্র কম। তবে অফিসে থাকতে দেবে। কল্যাণ টুর থেকে ফিরে এলে কাজটা ফাইনাল হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এই ক’টা দিন বাড়ির লোকদের একটু সামলে সুমলে রাখতে হবে। তবে ছেলেটাও গোলমাল পাকিয়েছে। রাতে জেগে থাকাটা না হয় ছেড়ে দেওয়া যায়, কিন্তু অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার গল্পটা? হয়তো ছোট মেয়েকে মজা করেই বলেছে, কিন্তু এ ধরনের গ্রাম্য মজা শহরে চলে না। মন্দিরার রেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

একতলার ঘরে মহাদেবকে ডেকে নিয়েছে কল্যাণ। মন্দিরাকেও আসতে বলেছিল। সে রেগে বলেছে, ‘আদিখ্যেতা করছ? আমি কেন যাব? হয়, ওকে এই মুহূর্তে ঘাড় ধরে বের করে দাও, নয়তো কড়াভাবে বলে দাও যে ক’টা দিন এখানে থাকবে যেন স্বাভাবিক আচরণ করে। আমার মেয়েকে বলে কিনা অন্ধকারে দেখতে শেখাবে! এত সাহস সে পেল কোথা থেকে?’

কল্যাণ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি মাধ্যমিকে কোন ডিভিশনে পাশ করেছ মহাদেব?’

‘সেকেন্ড ডিভিশন।’

‘সেকেন্ড ডিভিশনে! বাঃ। ভেরি গুড। শোনো মহাদেব, এর মধ্যেই তোমার জন্য একটা কাজের কথা বলেছি। ক’টা দিনের জন্য আমি বাইরে যাচ্ছি। ফিরে এসে কাজটা ঠিক করে ফেলব। বেশি ছোটাছুটির ব্যাপার নেই। অফিসে পিয়নের কাজ। পারবে তো?’

মহাদেব এবার মুখ তুলল। হ্যাঁ, কথাটা ঠিকই। চোখ দুটো বড্ড বড়। ভুরু ঘন। মণিগুলোও কেমন যেন। ওগুলো নড়ছে কি? নাকি স্থির?

মণি নড়া দেখা হল না। তার আগেই মহাদেব মাথা নামিয়ে দিল এবং ঘাড় কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ, পারব।’ তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়াল। কল্যাণ একটু থামল। দেশের ছেলে বলে দরদ কি একটু বেশি দেখানো হয়ে যাচ্ছে? কথা কি আরও কঠিনভাবে বলা উচিত? মনে হচ্ছে তাই উচিত। এবার খানিকটা গম্ভীর করে কল্যাণ বলল, ‘মহাদেব, রাতে তোমার ঘুমের অসুবিধে হয়?’

মহাদেব এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘রাতে আমি ঘুমোই না।’

‘ঘুমোও না!’ কল্যাণ চমকে উঠেও নিজেকে সামলাল। বলল, ‘ঘুমোও না, তো কী করে?’

মহাদেব বিড়বিড় করে বলল, ‘কিছু করি না। এমনি, ঘুমোই না।’

ইনসমনিয়া? অনিদ্রা? তাই হবে। এর চিকিৎসার ভার তাকে দেওয়া হয়নি। বরং ভালই হল, যার সঙ্গে কথা হয়েছে, তাকে বলে দেওয়া যাবে, এই ছেলে পিয়নের সঙ্গে রাতে পাহারাদারের কাজও করতে পারবে। কল্যাণ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। ঘুম না হতে চাইলে জোর করে ঘুমোতে হবে না। তবে এ বাড়িতে যতদিন থাকবে খেয়াল রাখবে, তুমি রাতে না ঘুমোলেও অন্যরা রাতে ঘুমোয়। তাদের যেন অসুবিধে না হয়। এটা পাড়া গাঁ নয়, যে ঘুম হল না বলে মাঝ রাতে মাঠে গিয়ে খানিকটা হাওয়া খেয়ে এলে। এখানে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকবে।’

মহাদেব ঘাড় নাড়ল। কল্যাণ খুশি হল। ছেলেটা মনে হচ্ছে, বুঝছে।

কল্যাণ ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তুমি রাতে হাঁটাচলা করো নাকি? স্লিপ ওয়াকিং?’

মহাদেব মুখ তুলল। মনে হয়, প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। না, এ ছেলের চোখ দুটো সত্যি সত্যি অস্বস্তিকর। কে জানে, সেই কারণেই হয়তো বেশিরভাগ সময় মাথা নামিয়ে থাকে। মানুষের যে কতরকম কিছু হয়! কল্যাণ উঠে পড়ল। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ফাইলগুলো নিয়ে বসতে হবে। আজ শুধু বসা নয়। পার্টিগুলোকে এক-এক করে টেলিফোনে ধরতে হবে। কথা চলছে। ফাইনাল দরদাম হবে আজ রাতেই। এই ছেলের পিছনে আর সময় নষ্ট নয়। যা বলবার বলে দেওয়া হয়েছে। বেশ কঠিনভাবেই বলা হয়েছে। বাকি রইল শুধু একটাই। সে কথা আরও কড়াভাবে বলবার জন্য কল্যাণ মনে মনে প্রস্তুত হল।

‘মহাদেব, আজ তুমি একটা খুব বড় অন্যায় করেছ। আমার মেয়েকে মিথ্যে কথা বলেছ। তুমি কি সেটা জানো?’

মহাদেব চুপ করে রইল।

‘শুনলাম, তাকে বলেছ, তুমি নাকি অন্ধকারে দেখতে পাও। শুধু দেখতে পাও না, তুমি নাকি তাকে অন্ধকারে কী করে দেখতে হবে তার কায়দা শিখিয়ে দেবে। বলেছ তুমি?’

মাথা নামানো অবস্থায় একদিকে ঘাড় নাড়ল মহাদেব।

কল্যাণ ধমকের ভঙ্গিতে চোখ কুঁচকে বলল, ‘ছি, ছি। একটা ছোট মেয়েকে এমন একটা আজগুবি কথা কী করে বললে? তুমি নাকি অন্ধকার বাগান থেকে তার বল কুড়িয়ে দিয়েছ? মৌ তার মাকে বলেছে।’

‘আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।’

কল্যাণ থমকে গেল। চোখ দেখতে না পেলেও সে মহাদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখতে পাও মানে!’

‘আমি অন্ধকারে দেখতে পাই। অন্ধকার দেখতে পাই।’

ছেলেটা বলছে কী! মাথা খারাপ নাকি? কই এরকম কিছু তো অনন্তকাকা বলেনি। কল্যাণ কষ্ট করে হাসল। সেই হাসিতে একটা ঘাবড়ে যাওয়া ভাব আছে। গলা নামিয়ে বলল, ‘সে আমরা সকলেই অল্পবিস্তর দেখতে পাই। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অন্ধকারে চোখসওয়া হয়ে যায়। আর অন্ধকারে দেখতে পাওয়াটা আবার কী ব্যাপার? তুমি যখন বাগানে মৌ-এর বল খুঁজছিলে তখন নিশ্চয় বিকেলের সামান্য আলো ছিল। সেই আলোতেই তুমি জিনিসটা দেখতে পেয়েছিলে। এই কথাটা তুমি তাকে বলোনি। গোপন করে গিয়েছিলে। সে বেচারি ভাবল, সত্যি সত্যি তুমি অন্ধকারেই বল দেখতে পেয়েছ। কাল মৌ-এর সঙ্গে দেখা হলে, ওকে বলবে, তুমি মোটেই অন্ধকারে দেখতে পাও না। সেও যেন এই খেলাটা আর না খেলে। কেমন?’

সামনের মানুষ একটু যেন নড়ল না। বিড়বিড় করে আবার বলল, ‘আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।’

এবার কল্যাণের রাগ হচ্ছে। আচ্ছা ঠেঁটা ছেলে তো। সে খুব জোরে একটা ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলাল। বলল, ‘আবার একই কথা বলছ? তুমি না লেখাপড়া শিখেছ! লেখাপড়া শিখে এমন বোকার মতো কথা কেউ বলে? না তোমাকে দেখছি কাজকর্ম দেওয়া মুশকিল আছে। ভাববে একটা পাগলকে পাঠিয়েছি। এসব আর যেন না শুনি। বুঝতে পারলে? যাও এখন।’

মহাদেব মাথা নাড়ল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

সেদিকে তাকিয়ে কল্যাণের মনে হল, ছেলেটাকে এত সহজে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। একে আরও একটু শিক্ষা দেওয়া উচিত। সে গলা তুলে বলল, ‘অ্যাই, দাঁড়াও তো। দেখি তুমি কেমন অন্ধকারে দেখতে পাও। তুমি নিজেই জেনে যাও, তুমি যেটা বলছ সেটা একটা আজগুবি, মিথ্যে কথা।’

মহাদেব দাঁড়িয়ে পড়ে।

ক্রুদ্ধ কল্যাণ এগিয়ে গিয়ে দ্রুত হাতে ঘরের জানলা দরজাগুলো বন্ধ করে। দেয়ালের কাছে গিয়ে একের পর এক সুইচ টিপে ঘরের সব আলোগুলোও নিভিয়ে দেয় কয়েক মিনিটের মধ্যে। ঘর অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই কল্যাণ সরে আসে ঘরের কোণে। আরও অন্ধকারে। আসতে গিয়ে টেবিলে অল্প ধাক্কা খায়। এবার ডান হাতটা তুলে চ্যালেঞ্জের সুরে বলে, ‘নাও এবার বলো, ক’টা আঙুল? বলো, বলে ফেলো। দেখি কেমন অন্ধকারে দেখতে পাও তুমি।’ কল্যাণের গলা চড়া এবং উত্তেজিত।

কল্যাণের এই আচরণে মহাদেব কতটা অবাক হয়েছে বোঝা গেল না। কারণ, অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাকে অস্পষ্ট একটা শরীরের মতো লাগছে। সেই শরীর চুপ করে আছে।

কল্যাণ শব্দ করে হাসল। বলল, ‘কী হল? পারলে না তো? এটাই স্বাভাবিক। অন্ধকারে দেখা যায় না মহাদেব। কাল সকালেই তুমি মৌ-এর ভুল ভাঙাবে। আচ্ছা নাও, আর একটা চান্স দিচ্ছি। নাও, এবার বলো। বলো, ক’টা আঙুল?’ মজার খেলার মতো করে কল্যাণ এবার তার তিনটে আঙুল মেলে ধরল অন্ধকারে।

নিমেষে সামনের থেকে ফ্যাসফেসে গলায় উত্তর এল— ‘তিন, তিনটে।’

কল্যাণ অবাক হল। ঘর এতই অন্ধকার যে সে নিজেই নিজের হাত ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। ছেলেটা নিশ্চয় আন্দাজে মিলিয়ে দিল। আর একটু পিছনে সরে গেল কল্যাণ। দেয়ালে প্রায় পিঠ ঠেকে গেছে তার। বলল, ‘এবার বলো।’

‘দুটো।’

কল্যাণ চমকে উঠল। আশ্চর্য! ছেলেটা বলছে কী করে! সত্যি সত্যি দেখতে পাচ্ছে নাকি? কল্যাণ চারটে আঙুল তুলল।

‘চার।’

কল্যাণের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। মনে জোর এনে সে আবার একটা আঙুল তুলল। তার আঙুল কি কাঁপছে? হ্যাঁ, কাঁপছে।

খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার মাখা কিশোর চাপা গলায় বলল, ‘এক। একটা আঙুল।’

কাঁপা হাতে কল্যাণ দেয়ালে আলোর সুইচ খুঁজছে। পাচ্ছে না… কল্যাণ আলো জ্বালাতে পারছে না।

পাঁচ।

মন্দিরা মৌ-এর গায়ে চাদরটা টেনে দিতে দিতে শুকনো গলায় বলল, ‘তুমি সিঁড়ির দরজা ভাল করে আটকে দিয়েছ তো?’ তার চোখে আতঙ্ক।

শুধু আটকে দিয়ে আসেনি, মৌ-কে নীচে নিয়ে আসার সময়ই কল্যাণ সেই দরজায় চাৰি লাগিয়ে দিয়ে এসেছে। সেই চাবি এখন তার পাঞ্জাবির পকেটে। মৌ তার ঠাকুমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কোলে করে দোতলায় নামাতে হয়েছে। সেই অবস্থায় ঘ্যানঘ্যান করছিল, ‘ঠাম্মার কাছে শোব। ঠাম্মার কাছে শোব। কেন আমায় নিয়ে যাচ্ছ?’

মন্দিরাকে ঘটনাটা জানানোর পর কল্যাণ শান্তভাবে ডাক্তার নন্দীকে টেলিফোন করে। মায়ের ছানি নিয়ে কথা শেষ হলে বলে, ‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, অন্ধকারে দেখা যায়?’

ডাক্তার নন্দী হেসে বললেন, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন? আপনার মা কি এই বয়েসে অন্ধকারেও দেখতে চাইছেন নাকি? হা হা।’

কল্যাণ গলা যতটা সম্ভব হালকা করে বলল, ‘না, আমার মেয়ে কোথা থেকে সব শিখে এসেছে। বলছে প্র্যাকটিস করলে নাকি অন্ধকারেও দেখা যায়। কী বলি বলুন তো!’

‘উফ, আজকালকার বাচ্চারা যে কতরকম প্রশ্ন করে। আমার এক পেশেন্ট সেদিন বলছিল, তার ছেলে নাকি বায়না ধরেছে পা লম্বা করবে। স্কুলের হাই জাম্পে ফার্স্ট হতে হবে। হা হা। আপনার মেয়ে কতটা অন্ধকারের কথা বলছে?’

‘মানে?’

‘মানে অন্ধকারের পরিমাণ কত। অল্প অন্ধকার হলে দেখা যায় বই কী! আলোর কোনও সোর্স আছে?

‘না, বেশ অন্ধকার। একদম অন্ধকার।’

‘মেয়েকে বলবেন, কোনও চান্স নেই। অন্তত মানুষ পারবে না। নিশাচর জন্তুজানোয়ারদের চোখের সেল খুব সেনসেটিভ হয়। স্পর্শকাতর। তারা চোখের মণি বড় টড় করে খুব অল্প আলোতেও অনেকটা দেখতে পারে। এদের আলাদা মেকানিজম আছে। মানুষ পারবে কী করে? তবে এক ধরনের নাইট বাইনোকুলার আছে… আপনি একটা কাজ করুন কল্যাণবাবু, একদিন ছুটির দিন দেখে মেয়েকে নিয়ে চলে আসুন। গল্প করে বুঝিয়ে দেব।’

এরপরই কল্যাণ পশুপতিকে ডেকে বলে, ‘কাল খুব সকালে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে পশুপতি। পারলে মহাদেবকে নিয়ে সোজা শ্যামবাজারে চলে যাবে। দেখবে সেখান থেকে বাদুড়িয়া যাওয়ার বাস ছাড়ে। ছেলেটাকে টিকিট কেটে বাসে উঠিয়ে দেবে। আমি ওকে বলেছি, তুমি এখন ফিরে যাও। আমি ট্যুর থেকে ফিরে এসে আবার না হয় ডেকে নেব। মনে হল, দেশে যাওয়ার কথায় ও খুশিই হয়েছে। যাক, পশুপতি এই নাও, টাকা রাখো। সকালে ফাঁকা রাস্তা, ট্যাক্সিতে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে।’

মহাদেবকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শুনে পশুপতি খুবই আনন্দিত। সে অনেকটা মাথা হেলিয়ে বলল, ‘সে আপনাকে কোনও চিন্তা করতে হবে না দাদাবাবু। আপনাদের ঘুম ভাঙার আগেই আমি ওই ছেলেকে রওনা করিয়ে দিয়ে আসব। তারপর গলা নামিয়ে বলল, ‘কিছু হয়েছে নাকি দাদাবাবু? চুরি টুরি করেছে? আমি বউদিকে বলেছিলাম, ছেলে সুবিধের নয়। রাতে জাগে।’

কল্যাণ অন্যমনস্ক হয়ে বলছে, ‘না, কিছু হয়নি। তুমি এখন যাও।’

মন্দিরা মেয়ের গায়ে একটা হাত রেখে বলল, ‘আজ কিন্তু ঘরে আলো জ্বালিয়ে ঘুমোব।’

একটু আগে কল্যাণ ভেবেছিল বেডরুমে বসেই ফাইলগুলো নিয়ে কাজ করবে। এখন মনে হচ্ছে, থাক, দরকার নেই। কাল ছেলেটা চলে যাক তারপর সকালে দেখা যাবে।

মন্দিরা গলা নামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁগো, সত্যি সত্যি ছেলেটা অন্ধকারে দেখতে পায়?’

কল্যাণ হাসার চেষ্টা করল। পরিস্থিতি হালকা করার ঢঙে বলল, ‘দূর, তা কখনও হয়? নিশ্চয় কোনও ভেলকি টেলকি দেখিয়ে আমাকে ঘাবড়ে দিয়েছে। পাড়াগাঁয়ের মানুষ নানারকম বুজরুকি পারে। যাই হোক, পশুপতি কাল সকালেই ওকে বাসে তুলে দিয়ে আসবে। আমি অনন্তকাকাকে চিঠি লিখে দেব, মাপ করবেন, আমার মেয়েকে অঙ্ক, ইংরেজি শেখানোর জন্য গৃহশিক্ষক রাখতে পারি, কিন্তু অন্ধকারে দেখা শেখানোর জন্য কোনও গৃহশিক্ষককে রাখতে পারছি না। শুধু অন্ধকারে দেখতে পায় না, বেটা বলছে, সে নাকি অন্ধকারও দেখতে পায়! একদম পাগল।’

কল্যাণ গলা খুলে হাসল। কিন্তু সে হাসিতে যেন জোর নেই।

মন্দিরা মনে মনে শিউরে উঠল। ভাগ্যিস কল্যাণ আজ ছেলেটার সঙ্গে কথা বলেছে। নইলে কী হত? কিছু না জেনে ও তো বাইরে চলে যেত। তারপর? তারপর অতীন যদি সত্যি সত্যি এ বাড়িতে আসত? এই ছেলে কি সেই অন্ধকারেও…

ঘটনাটা কল্পনা করতে গিয়ে মন্দিরার মুখ আতঙ্কে, লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কল্যাণ সেদিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল, ‘কী হল আবার? তুমি অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? বললাম তো ও কিছু নয়। ঘুমোও তো।’

দু’জনের কেউ ঘুমোতে পারল না অনেকক্ষণ। ঘুমন্ত মেয়েকে মাঝখানে রেখে চুপ করে শুয়ে রইল। গোটা বাড়ি নিঃশব্দ। শুধু এসি মেশিনের চাপা আওয়াজ ফিসফিস, ফিসফিস করে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরের ভেতর।

দুপুরে কল্যাণ রওনা হওয়ার সময় মন্দিরা ঝুঁকে পড়ে তার গালে চুমু খেল। সুটকেসটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আই, পৌছে ফোন কোরো। সাবধানে থাকবে। কাগজে ভিজিলেন্স টিজিলেন্সের কতরকম খবর পড়ি। ভয় করে।’

কল্যাণ চোখ নাচিয়ে বলল, ‘আমি সাবধানেই থাকি ম্যাডাম। প্লিজ নো টেনশন। কোনও দুশ্চিন্তা কোরো না।’

না, মন্দিরার আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। কল্যাণ বেরিয়ে যেতে মন্দিরা গেল শাশুড়ির চোখের খোঁজ নিতে। চোখ ভালই আছে। আরও নিশ্চিন্ত মনে মন্দিরা নেমে এল দোতলায়। গৌরীকে চা দিতে বলে সিডি প্লেয়ারে হালকা করে রবীন্দ্রসংগীত চালাল। অনেকদিন গান শোনা হয় না।

মন্দিরা টেলিফোনটা কাছে টেনে নিয়েছে। সে এখন পরপর দুটো ফোন করবে। অঞ্জুকে একটা কথা বলতে হবে। কল্যাণ বলে গেছে, ওই জমিটার জন্য বাজারের থেকে কিছুটা বেশি দাম দিতে সে রাজি আছে। এই কথাটাই জানাতে হবে অঞ্জুকে। অঞ্জুর সঙ্গে কথা সেরে দ্বিতীয় ফোনটা করবে অতীনকে।

কে বলবে, গত দু’দিন ধরে মহাদেব নামের একটা গ্রাম্য কিশোরকে নিয়ে এ বাড়িতে কিছু ঘটে গেছে? সে নেই। তার কথা কারও মনেও নেই। সব আবার স্বাভাবিক, আবার আগের মতো। এমনকী ছোট্ট মৌ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনকার মতো আপন মনে খেলছে। খেলতে খেলতে খানিক আগে সে দোতলার সিঁড়ির কোণে একটা অদ্ভুত জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছে। একটা লম্বা, ধূসর পালক। শালিখ, চড়ুইয়ের পালক নয়, অন্যরকম পালক। এমন পালক সে আগে কখনও দেখেনি। পশুপতিকাকাকে দেখাতে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এ মা, এই জিনিস বাড়ির ভেতর এল কী করে? এ তো মনে হয়, পেঁচার পালক!’

কোথা থেকে এল তা নিয়ে মৌ-এর কোনও মাথাব্যথা নেই। সে এখন মহা আনন্দে পেঁচার পালক নিয়ে খেলছে।

শারদীয় দেশ, ১৪১২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *