চোরের বউ

চোরের বউ

গান হচ্ছে। নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগল…।

কিছুদিন হল, বিশ্বনাথ তার মোবাইল ফোনে রবীন্দ্রসংগীত নিয়েছে। এখন কেউ ফোন করলেই ভেতরে এই গান শুনতে পায়। অবশ্য পুরো গান নয়। ঘুরে-ফিরে দুটো লাইন। নেওয়ার সময় ভয় ছিল। কে জানে, এই গান শিখার পছন্দ হবে কি না। পছন্দের ব্যাপারে শিখা খুবই খুঁতখুঁতে। দু’বছর হয়ে গেল তারা নতুন ফ্ল্যাটে এসেছে। শিখার এখনও সবটা পছন্দ হয়নি। দক্ষিণে নাকি আর একটা জানলা থাকা দরকার ছিল। বারান্দাটা বড্ড ছোট। ফ্ল্যাট তিন তলার বদলে চার তলায় হলে ভাল হত। এইরকম আরও নানা কিছু। তবে মোবাইলের গান শিখার পছন্দ হয়েছে। সে তার স্বামীকে বলেছে, ‘আমি যখন ফোন করব তুমি কিন্তু চট করে ধরতে পারবে না। আগে আমি কিছুক্ষণ গান শুনব, তারপর কথা বলব।’

আজ গান শুনেই শিখা রেগে গেল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘এত দেরি করো কেন? আমি কি গান শুনতে ফোন করেছি?’

বিশ্বনাথ চাপা গলায় বলল, ‘আঃ বাজে কথা বোলো না। আবার কী হল?’

শিখা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কী আবার হবে? এখন ওই মেয়ে বলছে, দুপুরে নাকি সেদ্ধ খাবে।’

‘সেদ্ধ খাবে!’

শিখা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘মানে কী জানো না? ন্যাকা! ফোনটা ওকে দিচ্ছি, তুমি বরং জিগ্যেস করে নাও।’

বিশ্বনাথ চারপাশটা একবার দেখে নিল, তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, ‘আঃ শিখা, কী হচ্ছে কী? এত অধৈর্য হয়ে পড়ছ কেন?’

শিখা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘অধৈর্য হব না? রান্নাবান্না সব হয়ে গেছে, এখন বলছে শরীরটা কেমন টিসটিস করে বউদি। মনটাও ঠিক নেই। আজ আর অন্য কিছু খাব না। ভাতের সঙ্গে আলু, কুমড়ো আর বড় দেখে একটা উচ্ছে সেদ্ধ করে দিন। তেল, লঙ্কা দিয়ে দু’গেরাস খেয়ে নেব। আর কী বলছে শুনবে? বলছে, ঘরে মুসুর ডাল আছে? থাকলে ভাতের মধ্যে এক মুঠো ফেলে দেন। না থাকলে অসুবিধে নাই। অন্য ডাল হলেও চলবে। ভাবো কাণ্ড! এমনভাবে কথা বলছে, যেন সত্যি সত্যি আমার ননদ এসেছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাকে নিয়ে শপিং-এ যাবে! উফ!’

বিশ্বনাথ খানিকটা নিশ্চিন্ত গলায় বলল, ‘ভালই তো, পরিস্থিতি সহজ হয়ে গেলে সুবিধে। তুমি ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে পারবে।’

‘সুবিধে! এর মধ্যে সুবিধের কী দেখলে? এই ভরদুপুরে উচ্ছে চাইছে, সেটা সুবিধের হল!’

বিশ্বনাথ বলল, ‘উফ, সামান্য উচ্ছে নিয়ে তুমি ভাবছ শিখা? ঘটনা যা, তাতে এই মহিলা এক লাখ টাকা দিয়ে শুরু করলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’

শিখা অবাক হয়ে বলল, ‘এক লাখ টাকা! বলো কী! আমরা কিছু করলাম না…।’

‘একটা মানুষ মরলে এক লাখ আর কী? বেশ কমই। দিনকাল বদলে গেছে শিখা। আমি এমনি এমনি মেয়েটাকে ভুজুংভাজুং দিয়ে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসিনি। ওসব এখন ছাড়ো। তুমি রান্নার মাসিকে চট করে বাজার থেকে একটু ঘুরে আসতে বলো না। একটা সামান্য উচ্ছে পাবে না? ঠিক পাবে। উচ্ছে-টুচ্ছে অনেক বেলা পর্যন্ত পাওয়া যায়।’

‘কী ব্যাপার বলো তো? তুমি কি চাও আমি গৌরীকে তাড়িয়ে দিই? এই দুপুরে বাজারে গিয়ে উচ্ছে আনতে বলাও যা, মাইনে হাতে ধরিয়ে চলে যেতে বলাও তাই। আমি পারব না। বলার হলে তুমি বলো। টেলিফোনটা দেব?’

বিশ্বনাথ সোজা হয়ে বসল। আড়চোখে বাঁদিকে তাকাল। বাঁদিকের টেবিলটা অদিতি পালের। এই ধেড়ে বয়সেও মহিলার একটা বিচ্ছিরি অভ্যেস আছে। আশেপাশে কেউ ফোন করলেই হল। কথা শুনবে। আড়ি পেতে শোনা নয়, একবারে হাঁ করে শোনা। একদিন তো অ্যাকাউন্টসের মনোময় রেগেমেগে রিসিভার কান থেকে নামিয়ে বলল, ‘অদিতিদি, কিছু বলবেন?’

মহিলা হেসে বলল, ‘না ভাই, কিছু বলব না। তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ তাই শুনছি।’

এর পরে আর কী বলা যায়?

অদিতি পাল আজ অবশ্য কথা শুনছে না। শুনলেও অন্তত এদিকে তাকিয়ে নেই। মাথা নামিয়ে ফাইল দেখছে। বিশ্বনাথ ঝুঁকি নিল না। সে যেমন গলা নামিয়ে কথা বলছিল সেভাবেই বলতে লাগল।

‘শিখা, যা হোক একটা কিছু করে ম্যানেজ করো। উচ্ছে, পটল যা চাইছে দিয়ে দাও। খাইয়ে-টাইয়ে কথা বলার চেষ্টা করো। ট্রাই টু টক উইথ হার। যে ঝামেলাটা হয়ে গেছে, সেখান থেকে টাকাপয়সা ছাড়া বেরোনোর কোনও পথ নেই। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছি, প্রত্যেকেই একই কথা বলছে। বলছে, ঝামেলা বাড়াবেন না, মুখ বন্ধ করে দিন। অ্যামাউন্টটা কত, সেটাই এখন কথা। তোমার ওপর সেটুকুই এখন দায়িত্ব। পাঁচকান হওয়ার আগেই…। একটু আগে হাসপাতালে ফোন করেছিলাম। ওয়ার্ডে সিস্টার নেই। ঠিকমতো বলতে পারল না। তবে বলল, লোকটা এখনও ঘুমোচ্ছে। ওরা ব্যথার জন্য কড়া কোনও ইঞ্জেকশন দিয়েছে। বিকেলে ডাক্তার রাউন্ডে আসবে। এক্স-রে হবে। ক’টা হাড় আস্ত আছে তখন বোঝা যাবে। আমি চাইছি, তার আগেই লোকটার ফ্যামিলির সঙ্গে একটা সেটলমেন্টে চলে আসতে।’

হিসহিস করে একটা দাঁত ঘষা ধরনের শব্দ করল শিখা। রাগের শব্দ। বলল, ‘আমি কী করব?’

‘ওই মহিলার সঙ্গে তুমি কথা বলবে। সেইজন্যই বাড়িতে দিয়ে এসেছি। আমি যে বলতে পারতাম না, তা নয়। মহিলা বলেই তোমার হাতে ছেড়েছি, বাবা-বাছা বলে বারগেনটা ভাল পারবে। এই মেয়ে যদি বাইরে থাকত সমস্যা হত শিখা। গুন্ডা-মস্তানরা সব এদের চেনাজানা। তারা চাপ বাড়ানোর জন্য পাঁচ রকম পথ শিখিয়ে দিত। সেইজন্যই মেয়েটাকে চোখের আড়াল করতে বারণ করছি।’

শিখা সামান্য গলা তুলে বলল, ‘এর মধ্যে দরাদরির কী আছে? আমাদের কী দোষ? তুমি এমনভাবে বলছ, যেন আমরা মাথায় রডের বাড়ি মেরে, লোকটাকে আমাদের তিন তলার বারান্দা থেকে ফেলে দিয়েছি!’

বিশ্বনাথ টেলিফোন কানে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। না, এখান থেকে কথা বলা যাবে না। এবার একজন-দু’জন করে তাকাতে শুরু করেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে সে বারান্দায় এল। শিখা এখনও বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। লোকটার সত্যি সত্যি যদি বড় কিছু হয়ে যায়, তা হলে থানা-পুলিশ অনেক দূর পর্যন্ত গড়াবে। কীভাবে মরল, কে মারল, কেন মারল—হাজার কথা। সেসব সামলানোর মানে জলের মতো খরচ। লোকটার ফ্যামিলি তো টাকা নেবেই, পুলিশও টাকা নেবে। তার ওপর আজকাল নানা ঝামেলা হয়েছে। মহিলা সমিতি, হিউম্যান রাইটস্, পাড়ার ক্লাব, লোকাল কমিটি আছে। দোষগুণের বিচার হবে না। ঘটনা যত জানাজানি হবে বিপদ তত বাড়বে। সকালে কোনওরকমে মিথ্যে বলে হাসপাতালে ভরতি করা গেছে। এখন এই মহিলাকে টাকাপয়সা দিয়ে রাজি করাতে হবে। ও হাসপাতালে জানাবে, যা ঘটেছে লোকটার নিজের বাড়িতেই ঘটেছে।

লম্বা বারন্দার এককোণে দাঁড়িয়ে বিশ্বনাথ বলল, ‘শিখা তোমাকে আমি আবার বুঝিয়ে বলছি। দয়া করে তুমি মন দিয়ে শোনো।’

শিখা চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘আমার কিছুই মন দিয়ে শোনার দরকার নেই। আসল ঘটনা কী? ঘটনা কিছুই নয়। ভোররাতে একটা চোর কার্নিশ বেয়ে আমাদের তিন তলার ফ্ল্যাটে উঠে আসছিল। আওয়াজ পেয়ে তুমি দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে গেলে। বেরিয়ে দেখলে, লোকটা রেলিং টপকে বারান্দায় উঠি উঠি করছে। তোমাকে দেখে ভয় পেয়ে চোরটা পিছনে লাফ দিল। ব্যস, এই তো ঘটনা। তারপর চোরটা নীচের চাতালে পড়ে পা ভাঙল, না পাঁজর ভাঙল তাতে তোমার কী? কিছুই নয়। মরুক, মরে জাহান্নামে যাক। আসলে তোমার অত দরদ দেখানোটাই বিরাট বোকামি হয়েছে। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে। নিয়ে গিয়ে এখন ফেঁসে গেছ। পুলিশকে একটা ফোন করতে, তারা আসত। এসে যা ভাল বুঝত করত। তুমি ওই পরিমল আর কল্যাণটার কথা শুনে নাচলে। এখন ঠেলা সামলাও।’

না, শিখা বুঝতে চাইছে না। এখন পুলিশকে অ্যাভয়েড করা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। পরিমল কল্যাণরা ঠিক পরামর্শই দিয়েছে। বিশ্বনাথ খানিকটা হুকুমের ভঙ্গিতেই বলল, ‘আগে তুমি ওই মেয়েটার খাবারের ব্যবস্থা করো।’

‘দুঃখিত, একটা চোরের বউয়ের জন্য আমি এখন গাছ থেকে উচ্ছে পাড়তে যেতে পারব না। ইচ্ছে হলে তুমি পেড়ে দিয়ে যাও। উফ, কোন আক্কেলে যে মেয়েটাকে এখানে এনে তুললে? অচেনা, অজানা একটা মহিলাকে কেউ বাড়িতে নিয়ে আসে? ছি ছি। আর যে-সে মহিলা নয়। চোরের বউ। যত ভাবছি, তত অবাক হয়ে যাচ্ছি।’

বিশ্বনাথ রেগে গিয়ে বলল ‘আঃ, আস্তে বলো শিখা। চোরের বউ, চোরের বউ করছ কেন? শুনতে পাবে। অন্য কেউ তো আর জানছে না যে তোমার বাড়িতে কে রয়েছে। চোরের বউ না রাজার বউ! বলছি তো, একটা বেলার ব্যাপার। লাস্ট যেটুকু খবর পেয়েছি তাতে মনে হচ্ছে, সন্ধের মধ্যে লোকটা অনেকখানি সুস্থ হয়ে যাবে। ইনজুরি কতটা জানার আগেই মহিলার সঙ্গে টাকাপয়সার কথা শেষ করে নাও। মোটামুটি একটা অ্যামাউন্টে রাজি করিয়ে ফেলো। ফাইনাল আমি দেখব। সাবধানে কথা বলবে। মেয়েটা চালাকচতুর আছে। দেখলে না কেমন খবর পেয়ে হাসপাতালে এসে হাজির হল? দেখি এমারজেন্সিতে ঢুকে বেডের পাশে বসে আছে। শুধু বসে থাকলে কথা ছিল। ফিচফিচ করে কান্নাকাটিও করছিল। বানানো কান্না। তখনই পরিমল আর আমি ঠিক করলাম, একে আগে এখান থেকে সরাতে হবে। মেয়েটার কান্নাকাটি দেখে অনেকেই তাকাচ্ছিল। নেহাত হাসপাতালে কান্না একটা নরম্যাল ব্যাপার।’

শিখা বলল, ‘সরাতে হবে মানে? সরিয়ে একেবারে বাড়িতে এনে তুলতে হবে?’

‘আর কোথায় নিয়ে যাব? মেয়েটা যে লোকটার বউ প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। পরে জিগ্যেস করায় বলল। বোধহয় কাছাকাছি কোনও বস্তিটস্তিতে থাকে। হাসপাতালের এক ঝাড়ুদার নাকি তার স্বামীকে চিনতে পেরে খবর দিয়েছে। ডাহা মিথ্যে। এদের সব আগে থেকে ঠিক করা থাকে। গোটা বস্তি যে বাড়িতে উঠে আসেনি তাই যথেষ্ট।’

‘মানে!’ শিখার গলায় বিস্ময়।

বিশ্বনাথ পিছন দিকটা একবার দেখে নিল। কেউ শুনছে না তো? না, বারান্দা ফাঁকা। এই সময়টা সবাই নিজের টেবিলে থাকে। স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর বিশ্বনাথ নিজেও ঠিক জানে না। কল্যাণ বলছিল ও নাকি কোথায় শুনেছে, এই ধরনের ঘটনায় দলবল আশেপাশে লুকিয়ে থাকে। ক্রিমিনালের গা থেকে একটু রক্ত বেরোলেই ব্যস। একেবারে রে-রে করে উঠবে। গণপিটুনি, মানবাধিকার বলে তুলকালাম কাণ্ড করবে। কে আর পুলিশ-টুলিশের হাঙ্গামার মধ্যে যেতে চায়!

শিখা ফোঁস করে উঠল, ‘চুপ করে আছ কেন? যাই হোক, একটা কথা বলে রাখছি। আমি কিন্তু কিছু পারব না। একটা চোরের বউকে কোলে বসিয়ে, গায়ে হাত বুলিয়ে কথা বলতে পারব না। একে যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ি থেকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করো।’

শিখা ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর বিশ্বনাথ নিজের টেবিলে এসে বসল। ব্যাগে রাখা জলের বোতলটা বের করে দু’ঢোক জল খেল। শিখা যেরকম বলছে, ঘটনা পুরোটা তা নয়। চোরটা তিন তলায় উঠে এসেছিল ঠিকই, তবে হঠাৎ করে লাফ দেয়নি। খসখস আওয়াজ পেয়ে বিশ্বনাথ ঘর থেকে বেরোনোর সময় দরজার পাশে রাখা লোহার রডটা হাতে নিয়েছিল। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। কোথা থেকে যেন একটা চাপা হলুদ আলো এসে বারান্দায় পড়েছে। সম্ভবত রাস্তার আলো। সেই আলোতে বিশ্বনাথ দেখল, কালো, গোল একটা মুখ। ছোট ছোট করে চুল কাটা। তখনই বিশ্বনাথ রডটা মাথার ওপর তুলে হুংকার দেয়—‘অ্যাই কে রে?’ কালো মাথাটা বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলবার চেষ্টা করে। বিশ্বনাথ দু’পা এগিয়ে আসে।

আর তখনই ঘটনাটা ঘটল।

লোকটা হাত ফসকাল। যত দূর মনে হচ্ছে, তিন তলা থেকে নীচের চাতালে পড়ার আগে দোতলার কার্নিশে ধাক্কা খেয়েছে। মাঝপথে একটা শব্দ হয়েছিল।

বিশ্বনাথ রুমাল বের করে ঘাম মুছল।

আচ্ছা, লোহার রডটা কোথায়? মনে পড়ছে না। ঘরেই রয়েছে নিশ্চয়? ইস্, খুব ভুল হয়ে গেছে। জিনিসটা ঘরে রাখা ঠিক হয়নি। শিখাকে একটা ফোন করলে কেমন হয়? রডটা কাপড়ে মুড়ে পিছনের বাগানে-টাগানে কোথাও ফেলে দিয়ে আসুক। ছাদেও রেখে আসতে পারে। থাক, এতটা দুশ্চিন্তার কোনও মানে হয় না। রড দিয়ে তো আর সে খুন করেনি। শুধু মাথার ওপর তুলেছিল। নাকি একটা বাড়ি মেরেছিল? মনে পড়ছে না। ঠিক মনে পড়ছে না বিশ্বনাথের। আসলে টেনশনে সব গুলিয়ে আছে।

বিশ্বনাথ আবার ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করল। গলাটা শুকনো লাগছে। মনে হচ্ছে, আরও কয়েক ঢোক জল খাওয়া দরকার।

একটা ভাল কাজ হয়েছে। ঘটনাটার কথা তেমন কেউ জানে না। অফিসে তো নয়ই, এমনকী ফ্ল্যাটেও নয়। শুধু দোতলার পরিমল, চার তলার কল্যাণ আর দারোয়ান ঝন্টু সিং জেনেছে। ঝন্টুকে পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে, খবর যেন না বেরোয়। বেটা শুনলে হয়। হাতে দশটা টাকা দিলে হত।

লোকটা পড়ে যাওয়ার পর, ঘরে ঢুকে পরিমলের ফ্ল্যাটে ফোন করেছিল বিশ্বনাথ। ফোন বেজে যাচ্ছিল। তখন নিজে গিয়ে দরজা ধাক্কে পরিমলকে ঘুম থেকে তোলে। এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে ডোরবেল বাজানোর কথা মনে ছিল না। চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এল পরিমল। ঘটনা শুনে বলল, ‘বলছেন কী বিশ্বদা! লোকটা বেঁচে আছে তো? তিন তলার ওপর থেকে পড়েছে। বেঁচে থাকা টাফ্‌।’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। খুব জোরে আওয়াজ হল। একা নীচে যেতে সাহস হচ্ছে না। পরিমল, তুমি একবার আসবে?’

‘আপনি কি ঠেলাটেলা দিয়েছিলেন?’

‘না না, সেরকম কিছু নয়। শুধু এগিয়ে গিয়েছিলাম।’

পরিমল জামা গলাতে গলাতে বলল, ‘চলুন চলুন, আগে গিয়ে দেখি। পুলিশে একটা ফোন করলে হত। থানার নম্বর জানা আছে?’

বিশ্বনাথ পরিমলের একটা হাত চেপে ধরে বলে, ‘থানার নম্বর? কই না তো। কী হবে ভাই? ভীষণ ভয় করছে। কী ফ্যাসাদে পড়লাম দেখুন তো!’

একতলায় নামতে নামতে কল্যাণের সঙ্গে দেখা। সে অন্ধকার থাকতে থাকতে মর্নিংওয়াকে বের হয়। সিঁড়ির মুখে দেখা। চালাকচতুর ছেলে। সংক্ষেপে ঘটনা শুনেই বলল, ‘পুলিশ? খেপেছেন নাকি! আগে একটা ট্যাক্সি ডেকে লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। এখানে মরে পড়ে থাকলে তো কেলেঙ্কারি!’

ঝন্টু সিং পিছনে নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। তাকে ডাকা হল। চাতালে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটাকে পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সিতে যখন তোলা হল, তখন সামান্য আলো ফুটেছে।

দুই

‘তোমার নাম কী?’

মহিলা মুখ তুলে অল্প হাসল। বলল, ‘কনকচাঁপা বউদি। আপনে কনকও ডাকতে পারেন, চাঁপাও ডাকতে পারেন।’

হাসলে এই মহিলার অনেকগুলো দাঁত দেখা যায়। মনে হয়, মাড়িতে কোনও সমস্যা আছে। বয়স কত! তিরিশের কাছাকাছি। আবার একটু বেশিও হতে পারে। গরিব মেয়েদের বয়স চট করে বোঝা যায় না। কালো আর রোগা হলে তো কথাই নেই। তবে এর গায়ের রং একেবারে কালো নয়। ময়লা ময়লা একটা ভাব। নীল পাড়ের রংচটা শাড়ি পরায় সেই ভাবটা আরও বেশি লাগছে।

হাসপাতালে এই মেয়ে নাকি কাঁদছিল? কই সেরকম কোনও লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না! বরং বেশ দিব্যি আছে। একেবারে গোড়ার দিকে যে জড়সড় ভাবটা ছিল সেটা পুরো না কাটলেও অনেকটা কেটেছে। প্রথমটায় ঘরে ঢুকে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল খানিকক্ষণ। এখন বসার ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। পা ছড়িয়ে বসে পান চিবোচ্ছে। তাকে পান দিয়েছে রান্নার মাসি, গৌরী। নিজেই চেয়ে নিয়েছে।

‘এই যে মাসি, একটা পান দাও দেখি। জর্দা দিয়ো না। জর্দা খেলে বিল্টুর বাবায় আবার রাগ করে। বলে, নেশাভাং হল পুরুষের জিনিস। মেয়েমানুষের নেশাভাং করা ভাল না।’

গৌরী ভুরু কুঁচকে তাকায়। রান্নাঘরে এসে শিখাকে ফিসফিস করে জিগ্যেস করে, ‘মেয়েছেলেটা কে গো? বসে বসে হুকুম মারে। পাগল-টাগল নাকি? চাউনি তো ভাল না।’

শিখা একটু চুপ করে থেকে, বিশ্বনাথ যেমন শিখিয়ে দিয়ে গেছে সেরকমই বলল, ‘ও তোমার দাদাবাবুর অফিসের চেনাজানা। পিয়ন না কেয়ারটেকারের বউ। বেচারির স্বামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছে। দেশ থেকে দেখতে এসেছে। বিকেলেই চলে যাবে। বেশি কথা-টথা বলার দরকার নেই। একটা পান থাকলে দিয়ে দাও।’

গৌরী মুখ বেঁকিয়ে বলে, ‘বয়ে গেছে আমার বেশি কথা বলতে! দাদাবাবুরও বলিহারি, কাকে না-কাকে বাড়িতে এনে তোলে।’ তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘সময় ভাল নয় বউদি। কে চোর আর কে ছ্যাঁচড় বোঝা মুশকিল। এই মেয়ের মধ্যে একটা ছ্যাঁচড় ভাব আছে। পাগল আর ছ্যাঁচড়। চোখে চোখে রেখো বউদি। দুপুরে আবার ঘুমিয়ে পোড়োনা যেন। উঠে দেখবে সব সাফা।’

‘আঃ গৌরী, এত কথা বলো কেন? তোমার কাজ হলে যাও এখন।’

খানিক আগে উচ্ছেসেদ্ধ ছাড়াই লাঞ্চ সেরেছে কনকচাঁপা। তার তরিবত করে খাওয়া দেখে শিখা বেশ অবাকই হয়েছে। ‘অল্প করে দেন’ বলে শুরু করলেও ভাত নিয়েছে দু’বার। কে বলবে এই মেয়ের স্বামী হাসপাতালে হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে! কে জানে হয়তো এরা এরকমই হয়। অভ্যস্ত। ভাতের মধ্যে ডাল আর কুমড়ো সেদ্ধ মাখতে মাখতে বলল, ‘বউদি একটা মাছ ভাজা হবে নাকি? হলে দেন দেখি। পেটির দিক দেখে দেবেন। গাদার মাছ খেয়ে আর গলায় কাঁটা ফুটাতে চাই না। এখন হল গিয়ে আমার সংসারে বিপদের টাইম। এই টাইমে সাবধান থাকাটাই হল আসল কাজ। ঠিক কি না?’

শিখা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ঠিক।’

‘তা হলে দেন একটা। ভাজা না হলে ঝোল থেকেই তুলে দেন। আপনার রান্নার লোকের হাত কীরকম বউদি! চিনির হাত না ঝালের হাত? চিনির হাত হলে তেমন ক্ষতি নাই। ঝালের হাত হলে ক্ষতি। বিল্টুর বাবায় বলে ঝাল বেশি খেলে পেটে ঘা হয়।’

শিখার মনে হল, এবার একটা ধমক দেওয়ার সময় এসেছে। বড্ড বকছে। শুধু বকছে না, গৌরী মনে হচ্ছে ঠিকই বলে গেল। মেয়েটার ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। একটু পাগলাটে। না কি ভান করছে! দুটোই মারাত্মক। ধমক দিতে গিয়ে, শিখা থমকে গেল। না, থাক। কী থেকে কী হয়ে যাবে! কে জানে, হয়তো ধমক খেয়ে আবার কান্নাকাটি শুরু করে দিল। বিশ্বনাথ যেরকম ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

ফোন বাজছে। শিখা শোওয়ার ঘরে গেল ফোন ধরতে। মাধবী। মাধবী ঘটনা সবই জানে। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর সে উদ্বিগ্ন হয়ে তার দিদিকে ফোন করছে।

‘কী হল দিদি, বউটা কী করছে?’

শিখা ফিসফিস করে বলল, ‘কী আবার করছে। খুব ঝামেলা শুরু করেছে।’

মাধবী ভয় পেয়ে বলল, ‘বলিস কী? চোরটা মারা গেল নাকি?’

‘চোর মারা গেছে কি না জানি না, তবে আমি মারা গেছি। চোরের বউকে এখন আমি মাছের কাঁটা বেছে খাওয়াচ্ছি।’

‘কাঁটা বেছে মাছ খাওয়াচ্ছিস মানে! কী বলছিস? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

শিখা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘তুই বুঝবি কী করে, আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না। বউদি বউদি বলে ওই মেয়ে যা অর্ডার শুরু করেছে তাতে মনে হয় একটু পরে আমাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে বলবে। মাথায় গোলমাল আছে মনে হচ্ছে। তোর জামাইবাবু ভয় পেয়ে আমার ঘাড়ে একটা পাগল গছিয়ে দিয়ে গেছে।’

‘তোকে বউদি বউদি করছে! সাংঘাতিক তো! নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। আমার তো ভীষণ ভয় করছে রে দিদি।’

‘আমার ভয় করছে না। রাগ হচ্ছে। ঠিক করেছি ওর খাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর ঘাড় ধরে বিদায় দেব।’

‘খবরদার দিদি, ও কাজও করিস না! বুবুনের বাবা অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেছে, তোমার জামাইবাবু খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। মহিলাকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে না আনলে বিপদ আরও বাড়ত। এরা বিরাট গোলমাল পাকাতে জানে। দলবল ডেকে হাতে থানা-টানাও ঘেরাও করে বসত। বলত লোকটাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। এবার ক্ষতিপূরণ চাই।’

শিখা অবাক হয়ে বলল, ‘থানা ঘেরাও! চোরেরা থানা ঘেরাও করবে কী রে! কী যা-তা বলছিস মাধবী? তোরও মাথাটা গেছে মনে হচ্ছে।’

মাধবী রাগ রাগ গলায় বলল, ‘আমাকে বলছিস কেন? সেসব বুবুনের বাবা জানে! সে যা-বলেছে, আমি সেটাই তোকে বললাম। জামাইবার তোকে যেমন বলছে, তুই সেইভাবে কর। টাকাপয়সার কথাটা বল। দুম করে বলবি না। আস্তে আস্তে বলবি। গল্প করতে করতে।’

শিখা উঠে দাঁড়াল। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘আমাকে এখন একটা চোরের বউয়ের সঙ্গে বসে গল্প করতে বলছিস! কী গল্প করব? ওর শাশুড়ি কেমন? ননদ কেমন? আমার এবার কান্না পাচ্ছে মাধবী। সকাল থেকে কী কাণ্ড চলছে! আমার মনে হচ্ছে, বাড়ি ছেড়ে পালাই।’

মাধবী ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘দিদি, মাথা ঠান্ডা রাখ। প্লিজ, জামাইবাবু আসার আগে তুই কিছু করে বসিস না। বউদি বলুক, মাসি বলুক, পিসি বলুক একদম রাগারাগি করিস না। ভাল ব্যবহার কর। আমি যাব?’

শিখা ধমকে বলল, ‘খবরদার কেউ আসবি না। তোরা ভেবেছিসটা কী? মজা হচ্ছে! বাবাও ফোন করে বলছিল আসব। বারণ করে দিয়েছি। কী দেখতে আসবে? চোরের বউ দেখতে আসবে? তা ছাড়া আর কত ভাল ব্যবহার করব? ঘরে বসতে দিয়েছি, খেতে দিয়েছি। গাদার বদলে পেটির মাছ দিয়েছি। এবার কি টিভি চালিয়ে দেব?’

শিখা ফোন শেষ করে বসার ঘরে এসে দেখল তাকে টিভি চালাতে হবে না। কনকচাঁপা নিজেই টিভি চালিয়ে নিয়েছে। মাটিতে বসে, সোফায় হেলান দিয়ে টিভি দেখছে। মুখে মিটিমিটি হাসি। শিখাকে দেখে পা গুটিয়ে বলল, ‘আসেন বউদি আসেন। বসেন। একটা মজার বই হচ্ছে।’

শিখা একটু দুরে সোফার ওপর বসল। রাগ হলে তার মাথার মাঝখানটা কেমন জ্বালা জ্বালা করে। জ্বালাটা শুরু হয়েছে। না, এরকম হলে চলবে না। ঠান্ডা মাথায় থাকতে হবে। ঘাড়ে এসে যখন পড়েছে…।

‘হি হি।’

শিখা চমকে উঠে দেখল, কনকচাঁপা হাসছে।

আশ্চর্য তো! কী নিশ্চিন্তে বসে সিনেমা দেখছে! মেয়েটা সত্যি সত্যি চোরটার বউ তো? এইসব ক্রিমিনালদের আবার অনেকগুলো মেয়েমানুষ থাকে। বউ সেজে ঘুরে বেড়ায়। মওকা বুঝে এসে হাজির হয়েছে। টাকাপয়সা দিয়ে দেওয়াই ভাল। যত দেরি হবে সমস্যা বাড়বে। এই মেয়ে এখন টিভি চালিয়ে হাসছে, এরপর হয়তো বিছানায় নাক ডেকে ঘুমোবে। দু’-চারশোতে যদি আপদ ঘাড় থেকে নেমে যায় যাবে। খেসারতের কপাল ছিল। দু’-চারশোতে হবে?

শিখা গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘তোমার বাড়ি কোথায় কনকচাঁপা?’

টিভির থেকে মুখ না ঘুরিয়ে মহিলা বলল, ‘কিছু বললেন বউদি? একটু দাঁড়ান। এই সিনটা শেষ হোক। দেখেন দেখেন লোকটা কেমন লাফায় দেখেন। এক্কেবারে হনুমান। হি হি।’

শিখা চুপ করে রইল। মেয়েটা মনে হচ্ছে পাগলই। যত সময় যাচ্ছে, স্পষ্ট হচ্ছে।

সিন শেষ হতে কনকচাঁপা ঘুরে বসল। বলল, ‘হ্যাঁ, বলেন বউদি।’

শিখা একটু হাসার চেষ্টা করল। ম্যানেজ করতে হলে দরকার হাসিমুখ। তবে মনে হচ্ছে, হাসিটা ঠিক হল না। থতমত অবস্থায় বলল, ‘না, তেমন কিছু নয়। বলছিলাম, তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘কী যে বলেন বউদি, আমাদের আবার বাড়ি! লাইনের ওপাশে থাকি। রোজই তো বলে তুলে দেব, তুলে দেব। অবস্থা এমন হয়েছে যে তুলে দেব না শুনলে, এখন আর রাতে ঘুম হয় না। আপনের যদি অভ্যেস হয়ে যায় তা হলেও একই কাণ্ড হবে। তুলে দেব শুনলে তবে ঘুম আসবে।’

শিখা কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ‘তুমি চিন্তা কোরো না। তোমার স্বামী খুব তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে।’

কনকচাঁপা তার শাড়ির আঁচল গুছিয়ে বসল। বলল, ‘আজকাল আমি চিন্তা করি না বউদি। আগে করতাম! খুব করতাম। এই রাতে বেরোলে চিন্তা করতাম। এই পুলিশে ধরল কি না চিন্তা করতাম। এই মার খেয়ে হাত-পা ভাঙল কি না চিন্তা করতাম। এখন করি না। বুঝে গেছি, এই দু’-চারটা দিন এদিক-সেদিক হবে তারপর আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনে কী বলেন, ঠিক হয়ে যাবে না?’

শিখা বুঝতে পারছে না, কী বলা উচিত। সে একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক হয়ে যাবে। নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বরের তেমন কিছু হয়েছে বলে তো মনে হয় না।’

কনকচাঁপা হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘আমারও তাই মনে হয় বউদি। তেমন কিছু হয়নি। লোক মারফত খবর পেয়ে হাসপাতালে যখন গেলাম, তখন দেখি বিল্টুর বাপে ইঞ্জেকশন নিয়ে ঘুমায়। আমি নার্সকে চুপিচুপি জিগ্যেস করলাম, ক’টা ইঞ্জেকশন? সে বলল, একটা। তখনই বুঝেছি, মোটে একটা ইঞ্জেকশন নিয়ে যখন অমন নিশ্চিন্তে ঘুমায় তখন তেমন কিছু হয় নাই। আপনি বলেন না বউদি, তেমন কিছু হলে একটা ইঞ্জেকশনে ঘুমাত?’

কথা শুনে মনে হচ্ছে, মাত্র একটা ইঞ্জেকশনে স্বামীর ঘুমিয়ে পড়ায় এই মেয়ে খুশি নয়। সে চাইছে আরও বেশি কিছু। আরও খারাপ। কেন? বেশি টাকা পাওয়া যেত? কী ভয়ানক!

শিখার অস্বস্তিটা বড়ছে। এ কী বিচ্ছিরি ফ্যাসাদ রে বাবা। এরকম কখনও ঘটে? বিশ্বনাথ যাই বলুক, কখনও ঘটে না। মনে জোর আনার চেষ্টা করল শিখা। গলা নামিয়ে বলল, ‘চিকিৎসার খরচাপাতি নিয়ে তুমি ভেবো না কনকচাঁপা। ঘটনা যখন আমাদের বাড়িতেই হয়েছে…। তোমার কী মনে হয়? কেমন টাকাপয়সা লাগতে পারে? তুমি তো হাসপাতালে গিয়েছিলে।’

মহিলা নড়েচড়ে বসল।

শিখা আড়চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ওষুধ-বিষুধের তো একটা খরচ আছে। আছে না?’

কনকচাঁপা মুখ নামিয়ে শাড়ির আঁচলটা আঙুলে পাকাতে পাকাতে বলল, ‘তা আছে। খরচাপাতি তো একটা আছেই।’

শিখা একটু থামল। আচ্ছা, এই মেয়ের কাছে কোনও অস্ত্র-টস্ত্র নেই তো? চোরের বউরা কি ছুরি-টুরি নিয়ে ঘোরে? ঘোরাটাই স্বাভাবিক। এই ফাঁকা ফ্ল্যাটে পেয়ে, তাকে যদি এখন আক্রমণ করে! ঠান্ডা একটা ভয় শিখার শরীরে বয়ে গেল। ঘরে একটা লোহার রড ছিল না? সেটা কোথায় গেল? বিশ্বনাথ কোথাও সরাল? ইস, গৌরীকে আজ দুপুরে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। কিন্তু রাখলেও তো সমস্যা। ঘটনা জানাজানি হয়ে যেত। শিখা শক্ত মনেরই মেয়ে, কিন্তু কী যেন হচ্ছে! ভয়? না, এখন ভয় পেলে চলবে না। এই মেয়ে যদি বোঝে সে ভয় পেয়ে গেছে, তা হলে আরও বড় কোনও বিপদ ঘটে যেতে পারে। কে জানে হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝাঁপিয়ে পড়লে কী করবে? চিৎকার করবে?

শিখা কাঁপা গলায় বলল, তোমার দাদাবাবু আমাকে বলেছে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। দু’-তিনশো টাকা যা খরচা লাগে…।’

শিখা চুপ করল। টাকার পরিমাণ কি কম হয়ে যাচ্ছে? হোক, কম থেকে শুরু করাই ভাল।

‘চা খাবে কনক? খাও না এক কাপ চা? করি? তুমি খেলে আমিও এক কাপ খেতে পারি।’

আসলে শিখা এ ঘর থেকে খানিকক্ষণের জন্য সরে যেতে চায়। বিশ্বনাথকে এখনই একটা ফোন করতে হবে। তাকে দুটো কথা জিগ্যেস করা দরকার। এক, কত টাকার কথা বলবে? আর দুই, লোহার রঙটা কোথায়?

‘বাড়িতে আদা আছে বউদি?’

কনকচাঁপা দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, হাত তোলার পর এবার শিখা বুঝতে পারল, মেয়েটার শরীরের গড়নটা খারাপ নয়। রোগা হলেও কোমরে, বুকে মাংস আছে। হাতে জোর কেমন?

কাঁপা গলায় শিখা বলল, ‘কেন, তুমি কি আদা চা খাবে?’

‘না, আদা চা খাব না। আদার সঙ্গে দুইটা তেজপাতাও জলে ফেলে দেন। আদা-তেজপাতা চা খাব। বিল্টুর বাবায়ে বলে, গা ম্যাজম্যাজ হলে আদা-তেজপাতা চা হল গিয়ে দারুণ উবকারি। সেরকম খাটাখাটনি হলে আমি সক্কালে বিল্টুর বাবারে আদা-তেজপাতা চা করে দিই।’

‘আচ্ছা, দেখছি।’

শিখা রান্নাঘরের দিকে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আমি চা বানিয়ে আনছি। তুমি ততক্ষণে মনে মনে একটা হিসেবপত্র করে নাও কনকচাঁপা। কত খরচ-টরচ হবে সেই হিসেব। বিকেল তো হয়েই এল। একটু পরেই তোমাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে। ভিজিটিং আওয়ার চারটে থেকে। চারটে থেকে না?’

কনকচাঁপা হাই তুলে বলল, ‘চারটে না পাঁচটা কে জানে! কিছু একটা হবে। ও নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই।’

রান্নাঘরে গিয়ে দ্রুত মোবাইলের নম্বর টিপল শিখা। একবার, দু’বার, তিনবার। তিনবারেও বিশ্বনাথকে ধরা গেল না। তবে ফোন বন্ধ। ফোন বন্ধ কেন? নিশ্চয় মিটিং করছে। উফ, মানুষটার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! আজকের দিনে মিটিং কীসের? ওর উচিত এখুনি বাড়ি চলে আসা।

চায়ে কয়েক কুচি আদা দিলেও তেজপাতা ফেলতে ভরসা পেল না শিখা। কনকচাঁপা হাতল ভাঙা কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘বউদি বড় লজ্জা লাগে।’

শিখাও চা নিয়েছে। তবে তার খেতে ইচ্ছে করছে না। নিতে হয়, তাই নিয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল, ‘লজ্জা লাগে! লজ্জা লাগবে কেন?’

‘বা, লজ্জা লাগবে না! এত যত্ন-আত্তিতে লজ্জা লাগবে না?’

শিখা যেন খানিকটা নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, ‘না না, তা কেন?’

মেয়েটা হাসল। বলল, ‘বউদি আমরা আরাম করে বসে ভাত, মাছ, চা খাওয়ার মানুষ নই। আমরা হলাম গিয়ে লাথিঝাঁটা খাওয়া মানুষ। মিথ্যে লাথিঝাঁটা নয় বউদি, সত্যিকারের লাথিঝাঁটা। হি হি।’

শিখা মনে মনে সতর্ক হল। মেয়েটা হয় পাগল, নয় সিমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা করছে। টাকা বেশি পাওয়ার মতলব। সাবধান। এখন পাগলের মতো হাসছে, এরপর নিশ্চয় কাঁদবে। কেঁদে পা জড়িয়ে ধরবে। পাগলরা হাসির পরেই কাঁদে। শিখা কিছুটা সরে বসল। কথা ঘোরানোর জন্য বলল, ‘চা কেমন হয়েছে কনকচাঁপা?’

কনকচাঁপা কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বলল, ‘চা সুন্দর হয়েছে। ভাগ্যিস, কাল রাতে বিল্টুর বাপে আপনার এই ফেলাট থেকে পড়েছিল। নইলে কি দাদায়ে এমন খাতির-খুতির করে ঘরে নিয়ে আসত? না আপনে এমন যত্ন করে খাওয়াতেন? আপনিও দুইটা লাথি দিতেন। চোরের বউরে লাথি দেওয়ার মজা অনেক।’

শিখার ইচ্ছে ছিল না, তবু সে গলা নামিয়ে বলে ফেলল, ‘ছিঃ, অমন করে বলে না। কত বড় বিপদ হতে পারত!’

কনকচাঁপা দাঁত দেখানো হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। ফের হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। বলল, ‘রোজই বিপদের মধ্যে আছি। ঘরে মার খাওয়ার বিপদ, বাইরে স্বামী মরার বিপদ। আমার আবার বড় বিপদ, ছোট বিপদ। তবে চিন্তা করেন না বউদি, আর বেশিদিন নয়। একটা ফন্দি করেছি। চেন্‌স একটা পেলেই দেখিয়ে দেব।’

না, আর কোনও সন্দেহ নেই। এই মেয়ে পাগলই। পাগল হলে সুবিধে বেশি না কম? বেশি হওয়াই উচিত। পাগল মানুষ টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলায় যায় না।

শিখার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ‘কী ফন্দি?’

কোনও উত্তর দিল না কনকচাঁপা। মাথা নামিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল। সময় নিয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করল। তারপর মুখ তুলে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘সে একটা জিনিস আছে। আগে বলা যাবে না। ছাড়েন ওসব কথা। বউদি যাওয়ার আগে একটা শাড়ি দেবেন তো। পুরনো হলে ক্ষতি নাই, তবে জমিটা যেন ভাল হয়। ভদ্রলোকের বাড়ি যাওয়ার মতো কোনও শাড়ি নেই ঘরে। ইস দেখেন না, আপনার এখানে কী পরে এসেছি। আপনে খরচাপাতির কথা কী যেন বলছিলেন?’

শিখা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলছিলাম তো। তুমি বলো, কত দিলে মোটামুটি তোমার… বলো না লজ্জা পাচ্ছ কেন? আহা, ঘটনা যখন একটা ঘটেই গেছে। তোমার দাদাবাবু আমায় বলে দিয়েছেন, যতই হোক গরিব মানুষ। তোমার দাদাবাবুও একবার হাসপাতালে যাবেখণ। আজ না পারলে কাল-পরশু তো যাবেই।’

কনকচাঁপা সত্যি সত্যি যেন লজ্জা পেল। বলল, ‘না না, দাদারে আর ব্যস্ত করবেন না। উনি অনেক করেছেন। নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল পুলিশ থানায়, তার বদলে নিয়ে এসেছেন ঘরে। এর বেশি আর কী করবেন? বউদি আপনের ওই ইস্পটটা একবার দেখা যাবে?’

শিখা অবাক হয়ে বলল, ‘স্পট! কীসের স্পট!’

‘ওই যে, যেখান থেকে বিল্টুর বাবা পড়ছে সেই ইম্পটটা? দেখা যাবে একবার?’

শিখা বিরক্ত হল। মেয়েটা তো বড্ড ফ্যাচাং করে। সহ্যের একটা সীমা আছে!

শিখা বিরক্ত গলায় বলল, ‘বারান্দা দেখে কী করবে?’

কনকচাঁপা হেসে বলল, ‘রাগ করেন না বউদি। একটু দেখতাম। জায়গাটা কত উঁচু না দেখে টাকাপয়সা ঠিক করি কী করে? মানুষটা বাঁচবে না মরবে, এক পা ভাঙবে না দুই পা-ই ভাঙবে, পায়ের সঙ্গে হাত ভাঙবে না মাথা ফাটবে। সবেরই তো একটা হিসেব লাগে। লাগে না?’

উফ, আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে তো। যাক, কাজটা গুটিয়ে আনার মুখে ভেস্তে দিয়ে লাভ নেই। যা খুশি করুক।

‘যাও দেখে এসো। ওই যে দরজা। বেরোলেই ডানদিকে বারান্দা। তোমার বিল্টুর বাবা কি এই কাগুই করে? চুরি করতে লোকের বারান্দা বেয়ে ওপরে ওঠে?’ গলায় ইচ্ছে করেই একটা চাপা হুমকির ভাব আনল শিখা।

সেই হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে কনকচাঁপা নির্লিপ্ত মুখে বলল, ‘এখন তাই ওঠে। বারান্দা দিয়েই ওঠে। তবে সেদিন বলছিল, এবার আগে ছাদে উঠে যাবে। তারপর নামবে। আর তাড়া খেলে ছাদ থেকেই লাফ দেবে নীচে। ছাদ থেকে নীচে পড়লে, পাবলিক নাকি বেশি ঘাবড়ায়। আমার কী মনে হয় জানেন বউদি, বেশিদিন এই টেকনিক বিল্টুর বাবায়ে চালাতে পারবে না। দু’-একবারের পরই ফটাস করে মরে যাবে। আপনে কী বলেন?’

কনকচাঁপা বারান্দার দিকে চলে যাওয়ার পর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল শিখা। যা ঘটছে, যা শুনছে তা কি সত্যি? নিশ্চয় সত্যি নয়। এমন কখনও হতে পারে না।

শিখার চমক ভাঙল মোবাইলের আওয়াজে।

‘কী হল, ধরছ না কেন?’ বিশ্বনাথের গলায় বিরক্তি।

‘এই তো ধরলাম। তুমি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলে?’

‘হাসপাতালের ভেতরে ছিলাম। লোকটার এক্স-রে হল। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম।’

শিখা অবাক হয়ে বলল, ‘হাসপাতালে! হাসপাতালে গেলে কখন!’

‘অফিস থেকে চলে এসেছি। পরিমলও সঙ্গে এসেছে। গুড নিউজ আছে শিখা। মিরাক্যাল বলতে পারো। ভগবান আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। হারামজাদাটার কিছুই হয়নি। নো হাত-পা ভাঙা, নাথিং। শুধু একটু মাথা ফেটেছে। তিনটে মাত্র স্টিচ। কোনও ব্যাপারই নয়।’

শিখা উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘বলো কী! সত্যি!’

বিশ্বনাথ হাসতে হাসতে বলল, ‘সত্যি না তো কী? হাসপাতাল আজই লোকটাকে ছেড়ে দিচ্ছে। উফ, বেটা যে কী চিন্তায় ফেলেছিল! এখন বেডে বসে গরম দুধ খাচ্ছে আর পা নাড়ছে শালা।’

সারাটা দিন চোরের মতো ফিসফাস করে কেটেছে। আর দরকার নেই। শিখা জোরগলায় বলল, ‘লোকটার দলবল কিছু দেখলে? গুন্ডা-টুন্ডা?’

‘ধুস, কেউ নেই। একেবারে ভিখিরি। মিছিমিছি ভয় পেয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, শুধু বউটাকে নিয়ে এসব করে বেড়ায়। হারামজাদাটার হাতে একশো টাকা দিয়ে পরিমল বলল, যা, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। তাকে পুলিশের হাতে দিচ্ছি না। ফের যদি…। লোকটা আমাদের পা-টা ধরে এক্কাকার কাণ্ড। ওই মেয়েটা কোথায়? চোরের বউটা?’

শিখা এবার গলা একটু নামাল। বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যা, ওরকম করে বোলো না। কনকচাঁপা একটা পাগলি।’

‘কনকচাঁপা! কনকচাঁপা আবার কে!’ বিশ্বনাথের গলায় বিস্ময়।

শিখা হেসে বলল, ‘লোকটার বউ। বারান্দায় গেছে। মনে হচ্ছে, ফিতে হাতে মাপছে বর কত উঁচু থেকে পড়েছে। সেই বুঝে টাকার অ্যামাউন্ট ঠিক করবে বলেছে।’

‘অ্যামাউন্ট ঠিক করাচ্ছি। এখনই ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। ট্যাঁ-ফুঁ করলে বলো পুলিশ ডাকব। পুলিশ এসে লাথি মারতে মারতে নিয়ে যাবে। দেখবে এইটুকু বললেই কাজ দেবে। ভয়ে কুঁকড়ে যাবে।’

শিখা হালকা ধমক দিয়ে বলল, ‘অ্যাই বলছি না ওরকম করে বোলো না। বিপদ কেটে গেছে বলে হম্বিতম্বি খুব বেড়েছে দেখছি! মেয়েটাকে আমি বের করে দিচ্ছি, তবে হাতে কয়েকটা টাকা দিয়ে দেব কিন্তু। বেশি না, এই দশ-কুড়ি টাকা। বেচারি আশা করে আছে।’

বিশ্বনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছ তুমি! টাকা দেবে! খবরদার একদম প্রশ্রয় দেবে না। একটু পরেই আমি আসছি। উফ, বিরাট ফাঁড়া কাটল। অ্যাই শোনো, পরিমল খেতে চাইছে। প্রনপকৌড়া আর দু’পেগ করে ইয়ে। আজ পারমিশান দিতে হবে কিন্তু।’

শিখা খুশি খুশি গলায় বলল, ‘যাও, যা খুশি করো।’

বিশ্বনাথের মোবাইল কেটে দিতে দিতে শিখা ঠিক করল, টাকা নয়, কনকচাঁপাকে সে একটা শাড়িই দেবে। ইচ্ছে করলে একটা ভাল শাড়ি সে দিতে পারে। কিন্তু দেবে না। মোটামুটি ধরনের একটা দেবে। ভাল শাড়ি দিলে এই মেয়ে লাই পেয়ে যাবে ছোটলোকদের সব করতে হয়, লাই দিতে নেই।

শাড়ির জন্য শিখা তার শোওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়াতেই বিকট আওয়াজটা হল। ঠিক যেন ভোররাতের সেই আওয়াজ! বারান্দা থেকে ছিটকে কেউ নীচের চাতালে গিয়ে পড়ল! পড়বার আগে ধাক্কা খেল দোতলার কার্নিশে।

অন্য দিন এই বিকেল হব-হব সময়টার ফ্ল্যাটের সামনেই দু’-একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। আজ নেই। ঝন্টু সিং-এর ডেকে দেওয়া রিকশাতেই হাসপাতালে যাচ্ছে শিখা। তার কাঁধে কনকচাঁপার মাথা। সেই মাথার মাঝখানে থেকে চুঁইয়ে আসা রক্তে শিখার জামা ভিজে যাচ্ছে। রিকশায় ওঠা পর্যন্ত মেয়েটার জ্ঞান ছিল। এখন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তার আগে ফিসফিস করে বলেছে, ‘ইস, লাফটা ঠিকমতো হল না বউদি। মনে হচ্ছে, এবারও বেঁচে যাব। আপনের কী মনে হয়?’

দু’হাত দিয়ে কনকচাঁপাকে জড়িয়ে রেখেছে শিখা। তার দু’চোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়ছে। সে খুব চেষ্টা করছে কান্না থামাতে পারছে না। রিকশাওলাকে বিড়বিড় করে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো। আর একটু তাড়াতাড়ি চলো ভাই।’

দেশ, ২ নভেম্বর ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *