১১. শিখা ও রাজকন্যা

শিখা ও রাজকন্যা

এক – পূর্ব্বাভাস

বোম্বের মালাবার হিলে বেড়াতে বেড়াতে কথা হচ্ছিল দু’জন লোকের মধ্যে। দু’জনের একজন তরুণ, আর একজন যৌবনের সীমা অতিক্রম করেছে। বয়স্ক লোকটিকে দেখলেই মনে হয় সে চীনা।

তরুণটির কণ্ঠস্বর উত্তেজিত।

সে বললো—আমি তোমার মতলব বুঝতে পেরেছি। তোমরা আমার বাবাকে যে কোনো উপায়ে হাতের মুঠোয় এনেছো।

চীনা লোকটি বললে—ছিঃ ছিঃ! এ তুমি কি বলছো?

—ঠিকই বলছি আমি। তোমরা বুঝতে পেরেছিলে যে, আমি বাড়ীতে থাকলে তোমাদের অসুবিধা হবে, তাই আমাকে বোম্বে নিয়ে এসেছো।

—আমরা আনবো কেন? তোমার বাবাই তোমাকে এখানে পাঠিয়েছেন।

—হ্যাঁ, মৌখিক হুকুম তিনিই দিয়েছেন বটে; কিন্তু আমি ভালো করেই জানি যে অন্তরের সঙ্গে বাবা চাননি, আমি তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাই।

—তার মানে?

—মানে, আমাকে তোমরা তোমাদের পাপ কাজের অন্তরায় মনে করেছিলে। তোমরা বুঝতে পেরেছিলে যে, বাবার মতো আমাকে হাতের মুঠোয় আনতে তোমরা পারবে না।

—আমরা পাপ কাজ করি এরকম উদ্ভট ধারণা তোমার হ’ল কেন বলোতো?

—উদ্ভট ধারণা! আমার ধারণাকে তুমি উদ্ভট বলে উড়িয়ে দিতে চাও? বেশ, তাহলে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও দেখি?

—কি প্রশ্ন, বলো?

—তুমি মাঝে মাঝে কোথায় চলে যাও?

—সে কথা আমি তোমাকে বলতে পারি না। তোমার বাবার আদেশেই আমাকে মাঝে মাঝে বাইরে যেতে হয়।

—বাবার আদেশে বাইরে যেতে হয়! বলো কি! আমাদের এমন কোনো ব্যবসা—বাণিজ্য আছে বলে তো জানা নাই, যার জন্য তোমার মাঝে মাঝে ডুব দেওয়া দরকার হয়ে পড়ে। যাই হোক। এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দাও।

—কি তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন?

—আমাদের বাড়ীতে যে মেয়েছেলেটি এসে জুটেছে, ও তোমার কে?

—উনি আমার কেউ নন।

—কেউ নন যদি, তাহলে ওর সঙ্গে তোমার অতো গুজ—গুজ ফুস—ফুস হয় কেন?

—কথাগুলো একটু ভদ্রভাবে বলতে চেষ্টা করো। তোমার এই জাতীয় অভদ্র ইঙ্গিত আমি বরদাস্ত করতে রাজী নই।

—আঁতে ঘা লেগেছে বুঝি? তাতো লাগবারই কথা।

তরুণটির এই কথায় চীনা লোকটির মুখ—চোখ লাল হয়ে গেল। সে বললে—তোমাকে আমি বেশী বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করছি, নইলে…

—নইলে কি করবে তুমি আমার?

—কি করবো দেখবে?

এই বলে হঠাৎ সে তরুণের গালে একটা চড় কষে দিয়ে বললো—এবার বুঝতে পারলে কি করবো?

ছেলেটির আর ধৈর্য্য থাকলো না। অপমানে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে সে সেই চীনাম্যানটিকে আক্রমণ করলো। প্রথমেই সে তার গালে প্রচণ্ডবেগে এক চড় মারলো, তারপর তাকে প্রস্তুত হবার সময় না দিয়েই আরম্ভ করলো ঘুষিবৃষ্টি।

হঠাৎ এইভাবে আক্রান্ত হয়ে চীনাম্যানটি প্রথমে কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। কিন্তু মনস্থির করতে দেরী হ’ল না তার।

সেও তখন পাল্টা আক্রমণ করলো ছেলেটিকে। শারীরিক শক্তিতে চীনাম্যানটাই ছিল বেশী বলবান। তাই অল্পক্ষণের মধ্যেই সে ছেলেটিকে কাবু করে ফেললো। সে তাকে নীচে ফেলে তার বুকের উপর চেপে বসে গলার উপরে চাপ দিতে দিতে বললো—আজ তোকে আমি শেষ করবো শয়তানের বাচ্চা! সেদিনও তুই একবার আমার গায় হাত তুলবার সাহস পেয়েছিলি। আজ তাই তোকে আমি হত্যা না করে ছাড়বো না। তুই আমাদের পথের একমাত্র বাধা। মনে করেছিলাম, এখানে এসে তুই ভদ্রভাবে থাকতে চেষ্টা করবি, কিন্তু এখন দেখছি, সে আশা ভুল। তোকে আজ আমি হত্যা করে নীচের ঐ সমুদ্রের জলে ফেলে দেব।

এই বলে সে আরও জোরে গলা টিপতে লাগলো ছেলেটির।

ছেলেটির অবস্থা তখন রীতিমতো কাহিল হয়ে পড়েছে। তার জিভ বেরিয়ে পড়েছে এবং গলা দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বের হচ্ছে।

আর একটু পরেই সে জ্ঞান হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়লো।

ছেলেটিকে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে চীনাম্যানটি তার বুকের উপর থেকে নেমে দাঁড়ালো। তারপর তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল পাহাড়ের কিনারে।

পাহাড়ের কিনারে এসে সে বার কয়েক এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখলো যে, কেউ তাকে লক্ষ্য করছে কি না।

ধারে—কাছে কোনো লোক দেখতে না পেয়ে সে তখন ছেলেটির অচেতন দেহটি ঠেলে নীচে ফেলে দিল।

ছেলেটি গড়িয়ে গড়িয়ে নীচে পড়তে লাগলো সমুদ্রের দিকে।

চীনাম্যানটা আর এক মুহূর্ত্ত ওখানে দেরী না করে তাড়াতাড়ি ফিরে চললো যে পথে এসেছিল সেই পথে।

দুই – ইডেন উদ্যান

পূর্ব্বোক্ত ঘটনার কয়েক বছর পরের কথা। সেদিন রাজকুমারী রুমা ইডেন গার্ডেনে বেড়াতে এসেছিল তাদের এক কর্ম্মচারীর সঙ্গে। কর্ম্মচারীকে সে মামাবাবু বলে ডাকতো।

ইডেন গার্ডেন থেকে বেরুবার মুখে হঠাৎ তার দেখা হয়ে গেল শিখার সঙ্গে। শিখাকে এখানে দেখবে এ তার স্বপ্নেরও অতীত ছিল।

শিখাও দেখতে পেয়েছিল তাকে। তার দিকে এগিয়ে যায় শিখা। ডাকে, ”রুমা!”

সে ডাকে রুমা ফিরে তাকায়। তার মুখে আনন্দের দীপ্তি। পাশের ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে সে বলে—”একটু দাঁড়ান মামাবাবু, শিখার সঙ্গে কথা কয়ে আমি এখনই আসছি।”

কথাটা বলতে বলতে রুমা এগিয়ে আসে শিখার পাশে। মামাবাবু বিস্ময়ভরে তাকান দু’জনের দিকে।

কলহাস্যে রুমা এসে শিখার হাত দু’খানা চেপে ধরে বলে—”আশ্চর্য্য! কতকাল পরে দেখা শিখা! জীবনে আবার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি ভাই! আমার ভাগ্য, আজ ইডেন গার্ডেনে এসেছিলুম—তাই তো!”

শিখার মুখেও আনন্দের দীপ্তি। হেসে শিখা বলে—”ভাগ্য আমার বলো রুমা। তাছাড়া আমাকে এখনো মনে রেখেছো। তুমি তো বহুদিন কলকাতা ছাড়া; বোম্বেতে ছিলে, সেইখানেই পড়াশুনো করো শুনেছি। তোমার বাবা রাজা বাহাদুর অবশ্য এখানে আছেন—কিন্তু আমাদের মতো মানুষ ত তাঁর কাছে গিয়ে তোমার খবরাখবর নিতে পারে না।”

রুমার চোখে কেমন যেন সজল মেঘের ছায়া। রুমা কোনো জবাব দেয় না—শিখার পানে মলিন চোখে চেয়ে থাকে।

শিখা ভাবে, তার চেয়ে রুমা বয়সে হয়ত কিছু ছোট, তার উপর রাজার দুলালী। হয়তো শিখার কথায় মনে ব্যথা পেয়েছে। রুমা বড় শান্ত মেয়ে, ভারী ঠাণ্ডা। ঐশ্বর্য্যের গর্ব্ব তার মনকে এতটুকু স্পর্শ করেনি। শিখা তার পরিচয় একদিন পেয়েছে—তাই ব্যাপারটাকে হালকা করে নেবার জন্য রুমার কাঁধে হাত রেখে শিখা আবার বলে—”তুমি এতদিন বোম্বাইয়ে ছিলে, তুমি তো কখনো ভাই আমাকে একাট চিঠি লিখেও তোমার খবর দাওনি….আমারও খবর নাওনি।….”

কথাটা বলে শিখা হাসলো—মৃদু মধুর হাসি।

রুমা বললে—”সে কথা বলতে পারো। কিন্তু ভাই সে কথা এখন থাক। তোমাকে চিঠি না লিখলেও তোমাকে ভুলিনি। সেখানে তোমার কথা কতদিন মনে হয়েছে।”

শিখা বললে—”তোমার কথা আমারো কতদিন মনে হয়েছে—মনে হয়েছে চিঠি লিখে খবর নেবো কেমন আছো, কি করছো…শুধু ঠিকানা জানতুম না বলে…”

রুমা বাধা দেয়। বলে,—”কিন্তু তুমি আমার বাবাকে চেনো না শিখা, বড় মানুষ হলেও তাঁর মনটি ঠিক সাধারণ লোকের মতো, এতটুকু অহঙ্কার তাঁর নেই। যে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথাবার্ত্তা বলতে পারে। যাক তুমি কবে আসছো বলো আমাদের ওখানে? সেদিন আমি তাহলে আরো দু’চারজনকে নেমন্তন্ন করে একটু পার্টির আয়োজন করবো, আর আমার বাবার সঙ্গেও সেদিন তোমার আলাপ করিয়ে দেব।”

শিখা হেসে বলে—”না, না, এর জন্য আয়োজন আবার কি? ও সব পার্টির মধ্যে আমি নেই ভাই, যে কোনো দিন আমি হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হব—তখন রাজাবাহাদুরের সঙ্গে আলাপ হবে। তা—তুমি এসেছো কবে—থাকবে তো কিছুদিন?”

রুমা উত্তর দিলে—”হপ্তাখানেক হ’ল এসেছি, আর মাসখানেক থাকবার কথা। তবে তার আগেও যেতে পারি—মিসেস্ লিংয়ের মরজির ওপর সেটি নির্ভর করছে শিখা। আমার মা যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি বাবা আমায় বাংলাদেশ থেকে বাইরে পাঠাতে পারতেন?”

তার কণ্ঠ আর্দ্র হয়।

রুমা মাতৃহীনা শিখা তা জানে। এক বৎসর বয়সে রুমা মাকে হারিয়ে পরের করুণায় নির্ভর করে মানুষ হচ্ছে।

সান্ত্বনার সুরে শিখা বলে—”সে কথা আর কেন রুমা! কিন্তু আমি ভাবছি কে এই মিসেস্ লিং; যাঁর ইচ্ছার বশে তোমায় চলতে ফিরতে হবে!”

রুমা উত্তর দেয়—”বাবা যখন চীনে ছিলেন, তখন তাঁরা সঙ্গে এঁদের পরিচয় হয়। বাবা ওখানে অনেক দিন ছিলেন। দু—দুবার বাবার প্রাণ সংশয় হয়। এই মিসেস্ লিং তখন অনেক কিছু করে বাবাকে বাঁচান। বাবা তাই কৃতজ্ঞ। ওঁর ভাই সি আউলিং বাবার খুব বিশ্বাসী সেক্রেটারী। মিষ্টার আউলিং এখন বাবাকে বিশেষ সাহায্য করেন।”

বলতে বলতে সে থেমে যায়। মামাবাবু কাছে এসে বলেন—”এসো, ফিরে যেতে হবে না রুমা; এদিকে যে সন্ধ্যা হয়ে এলো। তোমার আবার—”

—”কৈফিয়ৎ দিতে হবে, তাই না মামা?”

রুমার কণ্ঠ তিক্ত বিরক্তিতে পূর্ণ।

মামাবাবু যেন থতমত খেয়ে যান। আমতা আমতা করে বলেন,—”না, না, তা নয়—আমি কি তাই বলছি? তবে তোমার ভালোর জন্যেই—”

শিখা দেখে, রুমার চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই সে আগুন নিবে গিয়ে তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে! কান্না—ঝরা কণ্ঠে রুমা বলে—”তোমরা এমনি করেই আমায় বেঁধে বেঁধে মারো মামা। এর চেয়ে আমায় একেবারে মেরে ফেল না কেন? যেমন করে দাদা গেছে, আমিও তেমনি করেই চলে যাই!”

মামাবাবু বিব্রত হয়ে পড়েন। দু’হাত কচলান, কি বলবেন, ভেবে পান না। তাঁর অসহায় অবস্থা শিখা লক্ষ্য করে।

অকস্মাৎ চঞ্চল হয়ে শিখা বলে—”আজ থাক রুমা, তুমি বাড়ী যাও; আমারও বিশেষ কাজ আছে—আমি আসি।”

রুমা তার হাত দু’খানা চেপে ধরে বলে—”কিন্তু কবে তুমি আসছো,—আমার বিশেষ কথা আছে তোমার সঙ্গে। কাল বিকেলের দিকে আসতে পারবে না?—আমি তাহলে গাড়ী পাঠিয়ে দেব তোমার বাড়ীতে।”

শিখা বলে—”না, গাড়ী পাঠাতে হবে না। আমি কথা দিচ্ছি, কাল নিশ্চয়ই যাব তোমার বাড়ী—বিকেলে; তুমি বাড়ীতে থেকো।”

মামাবাবু বলতে যান—”কিন্তু কাল গ্রেট ইষ্টার্ণে পার্টি আছে, ভুলে যাচ্ছো রুমা?”

রুমা বলে উঠলো—”সে বাবার পার্টি—আমার নয় মামা। তোমরা সবাই যেয়ো—আমি বাড়ী থাকবো; আচ্ছা বিদায় শিখা, কাল তোমার অপেক্ষায় থাকবো। তোমার আসা চাই—ই কিন্তু!”

সামনেই পথে সুদৃশ্য মোটর। রুমা তাতে উঠে পড়লো। মামাবাবু ড্রাইভারের পাশে বসলেন। মোটর চলে গেল।

শিখা তবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ইডেন গার্ডেনে বেড়াবার জন্য শিখা আসেনি। সে এসেছিল যে জন্য—তা সফল হয়নি—ব্যর্থ হয়েই শিখা ফেরে।

সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকার তখন ছড়িয়ে পড়েছে, পথের বাতিগুলি জ্বলে উঠেছে। চলতে চলতে শিখা দেখে রতন একটা লাইটপোষ্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। শিখাকে দেখে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলো; পাশে পাশে চলতে চলতে মৃদুকণ্ঠে বললে—”নাঃ, লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না দিদিমণি, কোথায় হাওায় হয়ে উড়ে গেল।”

শিখা বললে—”আমি তা জানি।”

তিন – হাওয়ার পিছনে অভিযান

পুলিশের কাছে খবর এসেছে প্রচুর কোকেন আসছে কোলকাতায়। আবগারী ডিপার্টমেণ্ট বহু চেষ্টা করে—নানা ভাবে ফাঁদ পেতেও কিনারা করতে পারছে না। আবগারী সুপারিনটেনডেণ্ট তখন পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করলেন।

ব্যাপার শুনে পুলিস কর্ত্তৃপক্ষ চঞ্চল হয়ে ওঠেন। বেঙ্গল পুলিশের আই.জি.ও কোলকাতার পুলিশ কমিশনারকে আদেশ দেন—”ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে পাহারা রাখতে হবে, যে কোনো লোককে সন্দেহ হবে, তাকেই গ্রেপ্তার করা চাই।”

শিখার কাছেও এ—খবর এসে পৌঁছায়।

দমদম এরোড্রোমে পাহারাদারীর ভার নিয়েছেন চব্বিশ পরগণার পুলিশ সুপারিনটেনডেণ্ট মিষ্টার ব্রহ্ম—মিষ্টার নিকোলাস রাসবিহারী ব্রহ্ম, হাওড়া ষ্টেশনে যতীন্দ্রনাথ আর শিয়ালদহ ষ্টেশনে অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট কমিশনার মৃন্ময় গুপ্ত। তাছাড়া আরও নানা জায়গায় মোতায়েন হয়েছেন ছদ্মবেশে ক’জন ইনস্পেক্টর।

কিন্তু এত জায়গায় পাহারা থাকা সত্ত্বেও প্রচুর কোকেন কোলকাতায় এসে পৌঁছালো। পাঁচদিন নিরন্তর পাহারায় থেকে পুলিশ হিমসিম খেয়েছে—তবু হদিশ মেলে না। কখন কোন পথে চীন থেকে কোকেন এসে কোলকাতায় অবাধে প্রবেশ করছে।

পাঁচদিন পরে কমিশনারের কাছে খবর আসে, পাহারা দেওয়া মিথ্যা হয়ে গেছে। যে কোনো রকমেই হোক, কোকেন এসে পৌঁছেছে। এক জায়গায় সামান্য কোকেন ধরাও পড়েছে।

সেদিন রতন গিয়েছিল কদমতলা লাইনে আঁটপুরে। সেখানে সম্প্রতি তার এক মাসীমা আবিষ্কৃত হয়েছেন। মাসীমা রতনকে পত্র দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, এবং সেই পত্র পেয়েই রতন গিয়েছিল মাসীর বাড়ীতে। মাসীমা ছিলেন ঢাকার ব্রাহ্মণদি গ্রামে। সেখান থেকে কবে আঁটপুরে এসে বাড়ী তৈরী করে আস্তানা পেতেছেন—রতন তা আগে জানতো না। মাসীমাও জানতেন না অতবড় যুদ্ধে কলকাতায় ঘন ঘন বোমা পড়ার পরেও রতন বেঁচে আছে এবং সে কোলকাতাতেই আছে। হঠাৎ মেসোমশাই একদিন কোলকাতায় এসে রতনকে দেখে খবর দেওয়ায় মাসীমা বোনপোকে যাবার জন্য অনুরোধ জানিয়ে পত্র দিয়েছিলেন। মেসোকে ঠিকানাটা অবশ্য রতনই দিয়েছিল।

শিখাও বাধা দেয় নি, নিজে ভাড়া দিয়ে রতনকে মাসীমার কাছে পাঠিয়েছিল দু’দিনের ছুটি দিয়ে।

মাসীর বাড়ী থেকে ফিরে এসে রতন এক আশ্চর্য্য খবর দেয়। তার যাবার দু’দিন আগে অকস্মাৎ একখানা প্লেন বিকল হয়ে বাধ্য হয়ে ওখানকার এক মাঠে নামে। আশেপাশে যারা ছিল, তারা ভয়ে পালিয়েছিল। দূর থেকে তারা দেখেছিল আরোহীরা নেমে এলো। এবং তাদের সঙ্গে যে সব মালপত্র ছিল, সেগুলোও নামিয়ে নিলে। ভাগ্যক্রমে পথে দু’খানা মোটর এসে পড়ে এবং আরোহীরা তাদের মালপত্র নিয়ে মোটরে উঠে কোলকাতা বা আর কোথাও চলে যায়। প্লেনখানা একঘণ্টার মধ্যে মেরামত করে পাইলট আবার তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

রতন আরও জানায়, সেই প্লেনে যারা ছিল, তাদের মধ্যে শুধু দু’জন নাকি বাঙালী ছিল। তারা গ্রামে গিয়ে ডবল দাম দিয়ে ক’ছড়া পাকা কলা আর দুধ সংগ্রহ করে এনে চীনে সাহেবদের খাইয়েছে।

”চীনে সাহেব!”

শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে—”চীনে সাহেব ওখানে নামলো কি করে? না রতন, তোমার মাসীমার গাঁয়ের লোকেরা হয়তো ভুল করেছে—বুঝতে পারে নি!”

রতন বলে—”না দিদিমণি, মাসীর গাঁয়ের লোকেরা চীনে সাহেব খুব চেনে। তারা চ্যাং চুং করে কথা বলছিল, মুখ চ্যাপ্টা, গায়ের রং হলদে, তাদের নাকি আবার চিনতে দেরী হয়! কি যে তুমি বলো দিদিমণি!”

রতনের একথা হয়তো শিখা ভুলে যেতো, কিন্তু সহরে যেভাবে কোকেন এসে পৌঁছেছে সে খবর জানা থাকায় তার মনে হ’ল রতনের কথা মিথ্যে নয়। তার আরও মনে হ’ল যে, এ খবর যতীন্দ্রনাথকে দেওয়া দরকার। শিখা তখুনি রতনকে সঙ্গে নিয়ে একখানা ট্যাক্সিতে করে পৌঁছালো যতীন্দ্রনাথের কাছে।

যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হতেই শিখা জিজ্ঞাসা করলো—”কি হ’ল যতীনবাবু, কোকেনের কোনো সন্ধান পেলেন? ধরতে পারলেন কাউকে?”

যতীন্দ্রনাথ বিষণ্ণভাবে উত্তর দিলেন—”না, কিছুই হল না শিখা দেবী; চাকরী আর থাকবে বলে মনে হয় না। সরকারী মহলে ভয়ানক হুলস্থুল পড়ে গেছে! যুদ্ধের সময় জাপানী বোমার ভয়ে সকলে যেমন চঞ্চল হয়েছিলেন, প্রায় তেমনি অবস্থা। আই. জি. সাহেব আর পুলিশ কমিশনার সাহেব যা হুমকী দিচ্ছেন, তাতে মনে হয় চাকরী ছেড়ে ঘরের ছেলে ঘরে না ফিরতে হয়। তা—ও মানে মানে যেতে পারলে বাঁচি। সাহেব শুনেছেন কয়জন বড় বড় পুলিশ অফিসার ও হোমরা—চোমরা ব্যক্তি নাকি বেশ কিছু হাতাচ্ছে, সে জন্য তারা এই কোকেন—ব্যবসায়ীদের সব দিকে সুযোগ—সুবিধা করে দিচ্ছে। এর জন্যে হয়তো তোমাকেও এঁরা ডাকাবেন শিখা—”

”আমাকে ডাকাবেন! তার মানে? আমি কি করবো?”

শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে।

যতীন্দ্রনাথ বলেন—”পুলিশের কর্ত্তারা জানেন, মেয়েদের দিয়ে যত সহজে কাজ হয়, পুরুষদের দিয়ে তেমন হয় না। জানো তো, জার্ম্মাণ স্পাই মাতা হরির কথায় কত—কি কাণ্ড ঘটে গিয়েছিল! দেখা গেছে মেয়েরা যে ভাবে কাজ হাসিল করে অপরাধীদের যাদুমন্ত্রে ভুলিয়ে—”

বাধা দিয়ে শিখা বলে—”থাক থাক যতীনবাবু, আর বলতে হবে না।”

আরক্তিম হয়ে ওঠে শিখার সুগৌর মুখ। সে দম নেয়, তারপর বলে—”এ সম্বন্ধে আর কোনো কথা না বললেও চলবে। যাই হোক, আমি যে জন্য এসেছি শুনুন। রতন আঁটপুরে তার মাসীমার বাড়ী গিয়েছিল—সেখানে কি ব্যাপার হয়েছিল, ওর মুখেই তা শুনুন।”

দম দেওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের মতোই এক নিঃশ্বাসে রতন চীনে সাহেবদের সেই এরোপ্লেনের গল্প বলে—এতটুকু থামে না।

যতীন্দ্রনাথ নিঃশব্দে সে কাহিনী শোনেন। তারপর হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ান, বলেন—”চলো, এখনই যাবো সেখানে। তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে শিখা; রতনও চলুক। একটুও দেরী নয়, ওঠো।”

শিখা বলতে যায়—”কিন্তু আমি গিয়ে—”

যতীন্দ্রনাথ দৃঢ়কণ্ঠে বলেন—”তুমি যাব না বললে চলবে না—তোমায় যেতেই হবে। না গেলে কোনো কাজ হবে না। মেজর রায়কে আমি ফোন করে দিচ্ছি, তোমার মাও সঙ্গে সঙ্গে খবর পাবেন—তুমি বিকেলে বাড়ী ফিরবে।”

আপত্তি চলে না—যতীন্দ্রনাথের জীপ সব সময় তৈরী থাকে—তাতে তিনি উঠে পড়লেন শিখাকে নিয়ে। সঙ্গে চললো তাঁর শ্যালক অপূর্ব্ববাবু, আর রতন।

জীপ ছুটলো নক্ষত্রের বেগে।

চার – বিকল প্লেন

কখনও এবড়ো—খেবড়ো পল্লীর পথে, কখনও সরল মসৃণ পথ বেয়ে তীরবেগে ছুটে চলেছে যতীন্দ্রনাথের মোটর। যতীন্দ্রনাথ খবর নেন রতনের কাছে—সে আজই ফিরেছে। পরশু সে মাসীর বাড়ী গিয়েছিল। তার যাবার দু’দিন আগে প্লেন নেমেছিল দুপুরের দিকে। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক পাঁচদিন আগের কথা।

যতীন্দ্রনাথের ললাট কুঞ্চিত হয়।

দুর্দ্ধর্ষ লি চংয়ের পরিচয় তিনি পেয়েছেন—তার সম্বন্ধে অনেক কাহিনী বাংলার পুলিশ সংগ্রহ করেছে। পিকিংয়ের পুলিশ তাকে ধরবার জন্য ঘুরছে, তাদের চোখে ধুলো দিয়ে সে চরকীর মতো ঘুরছে। মাস খানেক আগে খবর পাওয়া যায় লি চং ভারতের দিকে রওনা হয়েছে। কিন্তু কোথায় কি বেশে আস্তানা নিয়েছে, সে খবর কেউ পায় নি।

উঁচু—নীচু এবড়ো—খেবড়ো পথ বেয়ে আঁটপুরে জীপ পৌঁছাতে বেশ একটু দেরী হয়ে গেল।

রতনের মেসো পরাণহরি দাস তার রোয়াকে বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে হুঁকোয় তামাক টানছিল। একেবারে সামনা—সামনি পুলিশের জীপ থামতেই সে সচকিত হয়ে উঠলো। তার হাতের হুঁকো নীচে গড়িয়ে পড়লো, সেদিকে তার হুঁশ রইলো না।

পুলিশ দেখে ঘাবড়াবারই কথা! যতীন্দ্রনাথ আর তাঁর শ্যালক পুলিশের পোষাকে এসেছেন। গ্রামের লোক স্বভাবতঃই পুলিশকে এড়িয়ে চলতে চায়। কাজেই পুলিশ দেখে ভয় পাওয়া বিচিত্র নয়।

পরাণের সঙ্গে আলাপ করতে যতীন্দ্রনাথের দেরী হ’ল না কিন্তু।

অত্যন্ত সরল সাদাসিধে মানুষ পরাণহরি। নিজের দুঃখের কথাই তার পাঁচ কাহন, এরোপ্লেন বা চীনে সাহেবদের ব্যাপারে সে মাথা ঘামায় না। নিজের দুঃখের কাহিনী সবিস্তারে বলে সে পুলিশ—সাহেবকে।

”কত দুঃখের কথা সায়েব—নিজের ঘর—বাড়ী হারিয়ে আজ এলাম কিনা এই এক ভাগাড়ের দেশে বাস করতে! এখানে কেউ কাউকে মুখের কথা বলে শুধায় না—তাই ভাবি, এর চেয়ে নিজের গাঁয়ে ভিটে কামড়েও যদি পড়ে থাকতাম, আর কিছু না হোক—শান্তিতে থাকতে পারতাম।”

বিব্রত হয়ে ওঠে রতন। মেসোর দুঃখের কাহিনী থামিয়ে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে সকলের পরিচয় দেয়। কি জন্য এঁরা এসেছেন, তাও জানায়।

পরাণহরির বাড়ীতে পুলিশের আগমনের কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে লোক এসে জোটে। যেন একটা মজার ব্যাপার কিছু ঘটে গেছে।

প্লেনের বিশদ বিবরণ জানা যায়—স্থানটিও দেখা হয়।

জায়গাটা ধানের ক্ষেত। প্লেনখানা মাটিতে নেমে যতদূর পর্য্যন্ত চলে গিয়ে থেমেছে, চাকার চাপে ততদূর পর্য্যন্ত কচি ধান গাছগুলি নষ্ট হয়ে গেছে।

এ ব্যাপার যে সব লোক দাঁড়িয়ে স্বচক্ষে দেখেছিল তাদের কাছ থেকে খবর পাওয়া যায়, বেশ খানিকটা দূর থেকে প্লেনখানা গতিবেগ সংযত করতে করতে এখানে এসে নেমে পড়ে। প্লেনের দরজা খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একাট সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেই সিঁড়ি বেয়ে ঝপঝপ করে কয়েকজন চীনে সাহেব, আর ক’জন এদেশী সাহেব নেমে পড়ে। তারা নেমে খানিকক্ষণ এদিক—ওদিক করার পর মাঠের ওপারে কাঁচা রাস্তায় হঠাৎ সকলে দেখে, দু’খানা মোটর গাড়ী এসে থামলো। প্লেনের লোকেরা গিয়ে মোটরের লোকদের ডেকে আনে—তারা এলে সকলে মিলে প্লেন থেকে যে সব মালপত্র নামানো হয়েছিল, সেগুলো ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে মোটরে তোলে, তারপর তারা মোটরে চেপে বসে এবং মোটর দুখানা চলে যায়।

তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বিকল প্লেন মেরামত হয়ে যায়। প্লেন আবার উড়ে চলে যায়—এইটুকুই তারা জানে।

চীনে সাহেবদের ভাষা তারা কিছু বোঝেনি, তবে বাঙালী সাহেবদের কথা কিছু কিছু শুনেছিল। তারা বলছিল, প্লেনের কল হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাদের নেমে পড়তে হয়েছে। এখন তারা চলেছে বরাবর মুর্শিদাবাদ জেলায় কোন গ্রামে—সেইখানেই তাদের বাড়ী আর কাজ—কারবার।

কথাটা মিথ্যা—সকল গ্রামবাসীদের চোখে ধূলা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র, তা বুঝতে কারও দেরী হয়নি।

শিখা বললে—”এখানে অনর্থক সময় নষ্ট করে লাভ নেই যতীনবাবু, তার চেয়ে চলুন আমরা দমদম এরোড্রোমে গিয়ে খবর নিই—মানে পাঁচই অক্টোবর বিদেশী কোনো প্লেন সন্ধ্যার মধ্যে এসে পৌঁছেছে কিনা—খোঁজ নিলেই জানা যাবে। এ প্লেন কাদের, কোথা থেকে এসেছে—কারা এতে ছিল।”

”ঠিক বলেছো শিখা!”

যতীন্দ্রনাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অপূর্ব্ব মিত্রের পানে তাকিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে তিনি বললেন—”বুঝলে অপূর্ব্ব, এই জন্যই শিখার সাহায্য নিই—ধরতে গেলে আমার খাতিরে শিখা আমার কত কাজ করে দেয়। অথচ ও বেচারার এতে লাভ নেই—যশের কিরীট বন্ধুত্বের খাতিরে আমার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে।”

পুলিশ প্রভুরা চলে যাচ্ছে দেখে পরাণহরি বিব্রত হয়ে ওঠে—অনুনয়ের সুরে বলে—”আজ্ঞে কিছু জলযোগ….মানে একটু চা বাতাসা মুখে দিয়ে গেলে হতো না হুজুরেরা?”

যতীন্দ্রনাথ কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যান—শিখা পরাণহরিকে বলে—”থাক, এরপর একদিন ওঁরা না আসুন, আমি নিশ্চয়ই আসবো। আপনি আমাদের রতনের মেসোমশাই—সময় পেলেই আসবো।”

মোটরে উঠে বসলো শিখা।

তীরের বেগে ছুটলো জীপখানা। এবং দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে কলকাতা পার হয়ে দমদম এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালো। এখানে খবর পাওয়া গেল নির্দ্দিষ্ট তারিখের নির্দ্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো বাইরের প্লেন সেদিন এখানে আসেনি।

পাঁচ – রাজার বাগান

দরজায় কে আঘাত করে, সজোরে কড়া নাড়ে। নিতান্ত বিরক্ত হয়েই রতন গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়।

দরজায় দাঁড়িয়ে এক যুবক। আধা—ভদ্র বেশভূষা। দেখে রতন খুশী হয় না। দু’বার তার পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত বেশ করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে অপ্রসন্ন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে—”কি চাই আপনার? কাকে চাই?”

যুবক উত্তর দেয়—”আমি শিখা দেবীকে চাই—মানে অগ্নিশিখা দেবীকে দরকার।”

ভ্রূ কুঞ্চিত হয় রতনের। গম্ভীরভাবে সে বলে—”কি দরকার—আমাকে বললেই চলবে।”

যুবক মাথা নেড়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলে—”তাঁকে একখানা চিঠি দিতে এসেছি, সে চিঠি তাঁর হাতে ছাড়া আর কারও হাতে দেওয়া বারণ। তিনি যদি বাড়ীতে থাকেন, দয়া করে তাঁকে দু’মিনিটের জন্য ডেকে দিলেই বাধিত হবো।”

রতন অপ্রসন্ন কণ্ঠে বলে—”তাহলে এখানে একটু দাঁড়ান, আমি তাঁকে খবর দিচ্ছি।”

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ভিতরের দিকে চলে গেল রতন। অচেনা—অজানা লোককে সে আর বৈঠকখানায় বসতে দিতে রাজী নয়। এই তো দিন পনেরো আগের কথা। একজন ভদ্রলোক শিখার সন্ধানে আসেন। রতন তাঁকে বৈঠকখানায় বসিয়ে খবর দিতে দোতলায় যায়। সেই ফাঁকে তিনি চমৎকার একটি বুদ্ধমূর্ত্তি নিয়ে সরে পড়েন—ফিরে এসে রতন আর তাঁকে দেখতে পায় না।

শিখার কাছে এজন্য তাকে কম লাঞ্ছনা সইতে হয় নি। কতটুকু বা সে বুদ্ধমূর্ত্তি—বিঘত প্রমাণ হবে। শ্বেতপাথরের তৈরী—কতই বা তার দাম। মূর্ত্তিটা মাসখানেক আগে এক চীনে সাহেবের কাছ থেকে মেজর রায় উপহার পেয়েছিলেন। চমৎকার মূর্ত্তিটি—শিখাকে তিনি সেটি উপহার দিয়েছিলেন, শিখা সেটি বৈঠকখানায় সাজিয়ে রেখেছিল সযত্নে। এর মধ্যে যে যে এসেছেন এবং মূর্ত্তিটি দেখেছেন, সকলেই সুখ্যাতি করেছেন খুব। কিন্তু কেউ এটি হস্তগত করেন নি। হঠাৎ সে ভদ্রলোক এসে যে মূর্ত্তিটি পকেটস্থ করে সরে পড়বেন, রতন তা জানবে কি করে?

তারপর থেকে সে সাবধান হয়েছে, জানা—চেনা লোক না হ’লে কাকেও সে আর বৈঠকখানায় বসতে দেয় না।

দোতলায় শিখা কাকিমার সঙ্গে কথা বলছিল। কথা চলছিল আঁটপুরের সেই প্লেনের ব্যাপার নিয়ে। শিখা বলছিল—”এরা বেআইনী কোনো কাজ—কারবার করে কাকিমা, তাতে আমার এতটুকুও সন্দেহ নেই। তবে এই কোকেন—”

শিখার কথা শেষ হবার আগেই রতন এসে খবর দিলে যে, এক ভদ্রলোক এসেছেন দিদিমণির নামে চিঠি নিয়ে। চিঠি যে এনেছে রতন তাকে কোনোদিন দেখে নি। পরিচয়ও দেয় নি কোথা থেকে এসেছে। বললে, সে—চিঠি শিখা ছাড়া আর কারও হাতে দেবে না।

কথাটা শুনে শিখা কৌতুক অনুভব করে। শিখা বললে—”চলো দেখি গিয়ে—কার কি এমন চিঠি নিয়ে কোন দূত এলেন!”

নীচে নেমে এসে বৈঠকখানায় প্রবেশ করে সে কাউকে দেখতে পায় না।

সঙ্কুচিত কণ্ঠে রতন বলে—”অচেনা—অজানা লোক বলে আমি ঘরে আনি নি দিদিমণি, দরজাতেই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। আপনি বললে তাকে ডাকবো।”

রতনের অতি—সাবধানতায় চমৎকৃত হয় শিখা! হাসি চেপে গম্ভীরভাবে বলে—”হ্যাঁ, তাকে ডাকো।”

মুহূর্ত্ত পরে যে যুবকটি এসে দরজায় দাঁড়াল, তাকে শিখাও কোনোদিন দেখে নি।

অভিবাদন করে যুবকটি বলে—”আপনিই শিখা দেবী নিশ্চয়! আপনার একখানা চিঠি আছে।”

তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে শিখা যুবকের আপাদমস্তক দেখে নেয়। তারপর বলে—”হ্যাঁ আমিই শিখা—অগ্নিশিখা রায়। কিন্তু কার চিঠি তুমি এনেছো, আগে তাঁর নাম বলো। তবে আমি চিঠি নেবো।”

যুবক চারিদিকে তাকায়; তারপর দু’ পা এগিয়ে আসে। চাপাসুরে বলে—”রাজকুমারী রুমা দেবী আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।”

”ও—রুমা! বটে!”

চকিতে মনে পড়ে রুমার কথা।

কাল তার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। রুমা তার পিতার টি—পার্টিতে যায় নি। শিখা যাবে বলে শিখার জন্য অপেক্ষা করে বাড়ীতেই ছিল। শিখা যে আঁাটপুরে গিয়েছিল, ফলে যাবার সময় পায় নি—সে সব কি রুমা কাণে তুলবে, না বিশ্বাস করবে?

লজ্জিত হয় শিখা। নিজেকে সামলে নিয়ে চিঠি নেয়। জিজ্ঞাসা করে—”তুমি কে? তোমার নামটা জিজ্ঞেস করতে পারি?”

যুবক উত্তর দেয়,—”আমার নাম রঞ্জিত; আমি কুমারীজীর ওখানে কাজ করি।”

খামখানা ছিঁড়তে ছিঁড়তে শিখা বলে—”তুমি একটু অপেক্ষা করো—আমি চিঠিখানা আগে পড়ি।”

পত্রে রুমা লিখেছে—

ভাই শিখা,

তোমার প্রতীক্ষায় কাল বসেছিলাম—বাবার সঙ্গে হোটেলে যাই নি। চমৎকার সুযোগ ছিল, কাল কেউ ছিল না বাড়ীতে—আমি একাই ছিলাম। মনে করো না শিখা, মিথ্যা আমোদ—অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তোমায় ডাকছি। আমি যে কত বড় চক্রান্তের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি, তা শুধু নিজেই বুঝছি—তোমায় বোঝাতে পারছিনে। মনে করো, আমি বড় বিপদে পড়ে তোমার সাহায্য চাইছি। আজ বাবা আর মিসেস্ লিং এখানে নেই—বাবার সেক্রেটারী আউলিংও বাবার সঙ্গে ডায়মণ্ডহারবারে কি দরকারে গেছেন, ফিরতে তাঁদের রাত হবে বলে গেছেন। যে লোক চিঠি নিয়ে যাচ্ছে এর নাম রঞ্জিত। চিঠি পড়ে এর সঙ্গে তুমি নিশ্চয়ই এখনি আসবে আমার এখানে—একটুও দেরী করো না ভাই। মনে রেখো বিপদে পড়ে আমি তোমার সাহায্য প্রার্থনা করছি। ভুলে যেও আমি রাজার মেয়ে—জেনো আমি দুঃখিনী ভিখারিণী।

 তোমার রুমা।

শিখার মুখ হয় বিমর্ষ—মলিন। চিঠিখানা সে ড্রয়ারে বন্ধ করতে যাচ্ছিল, রঞ্জিত বাধা দিয়ে বলে—”রাজকুমারী বলে দিয়েছেন চিঠিখানা পড়েই নষ্ট করে ফেলা হয় যেন। তাঁর হাতের লেখা তিনি রাখতে চান না।”

শিখা হাসে—বেদনা মলিন হাসি। দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়ে চিঠিখানা সে পুড়িয়ে ফেলে তারপর উঠে দাঁড়ায়। বলে—”গাড়ী এনেছো রঞ্জিত?”

একটু ইতস্ততঃ করে রঞ্জিত বলে—”না, এখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে যেতে বলেছেন।”

”বেশ। দাঁড়াও একটু, মাকে বলে এখনি তৈরী হয়ে আসছি।”

শিখা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

একটু পরেই প্রস্তুত হয়ে আসে। রতন উৎসুক দৃষ্টিতে তার পানে তাকায়—তাকে যেতে হবে কিনা শিখার সঙ্গে, সে কথা জিজ্ঞেস করতে সাহস পায় না।

তার ভাব দেখে শিখা বললে—”না, তোমায় সঙ্গে যেতে হবে না রতন, তুমি এখানেই থেকো। যদি কেউ আসে, তাকে আমার এ ঘরে না এনে বরং কাকাবাবুর ঘরে নিয়ে যেও। এ ঘরে যদিও আর বুদ্ধমূর্ত্তি নেই, যে কেউ এসে চুরি করবে, তবু টুকিটাকি অনেক জিনিষ আছে তো—বলা যায় না—কোনো মহাত্মা যদি ভুলে কিছু পকেটে ফেলেন।”

হেসে সে অগ্রসর হয়, পিছনে চলে রঞ্জিত। চলন্ত একখানা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে—শিখা তাতে উঠে পড়ে—পাশে বসায় রঞ্জিতকে।

রঞ্জিত জিজ্ঞেস করে—”অপরাধ নেবেন না—একটা কথা জিজ্ঞেস করছি! ওই যে বুদ্ধমূর্ত্তি চুরি যাবার কথা বললেন—সেটা কি?”

শিখা বলে—”ব্যাপারটা হল, একজন চীনা ভদ্রলোকের কাছে কাকাবাবু একটা পাথরের বুদ্ধমূর্ত্তি দেখেন। দেখে খুব সুখ্যাতি করেছিলেন। তাতেই সে চীনা ভদ্রলোক মূর্ত্তিটা দিয়ে দেন কাকাবাবুকে—দাম নেন নি! সে মূর্ত্তি তিনি কখনো আবার ফেরৎ নেবেন কিনা—তাও কিছু বলেন নি কাকাবাবুকে!”

রঞ্জিত নিজের পকেট হাতড়ায়—কতকগুলো কাগজপত্র বার করে তার মধ্যে থেকে একটি বুদ্ধের ফটো বার করে দেখায়। জিজ্ঞেস করে,—”দেখুন তো, এমনই মূর্ত্তি কি না?”

”দেখি—দেখি!”

ফটোখানা শিখা নেয়—বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তারপর মুখ তুলে বলে —”আশ্চর্য্য! আমার ঘরে নিতান্ত অবহেলায় যে বুদ্ধমূর্ত্তি পনেরো দিন পড়ে ছিল, সেই বুদ্ধমূর্ত্তির ফটো পর্য্যন্ত উঠেছে! আর সে ফটো চারিদিকে ছড়িয়েও পড়েছে। আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিনে রঞ্জিত। মনে হয় তুমি কিছু জানো—তোমার মুখ দেখে অন্ততঃ তাই মনে হচ্ছে। আমাকে এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারো যদি, আমি খুব খুশী হবো।”

ম্লান হাসি হেসে রঞ্জিত বলে—”জানতে পারবেন সব, কিন্তু এখন থাক—আমরা এসে পড়েছি। ড্রাইভার, গাড়ী রাখো।”

বলবামাত্র ট্যাক্সি থামে।

বিরাট উঁচু প্রাচীর—তার মাঝে ছোট একটি দরজা। প্রাসাদের গেট কৈ? পিছনে জন—বিরল পথ—লোক খুব কমই চলাচল করে। ওদিকে কয়েকটা কারখানা। আজ রবিবার—সেগুলো বন্ধ, কাজেই এ পথ প্রায় জনশূন্য।

শিখা সবিস্ময়ে বলে—”এখানে নামতে হবে?”

”হ্যাঁ, নামুন।”

কথাটা বলে রঞ্জিত ট্যাক্সির মিটার দেখে ভাড়া মিটিয়ে দিল। বাধ্য হয়ে শিখা নামলো। ট্যাক্সি গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লো।

শান্তমুখে রঞ্জিত বলে—”রাজকুমারী বলে দিয়েছেন, তাই আপনাকে বাগানের এই পথে নিয়ে যাচ্ছি। কেন, সে—কথা তিনি আমায় বলেন নি—তাঁর কাছেই শুনবেন। আমি চাকর মাত্র। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলাই আমার কর্ত্তব্য।”

দরজার বাইরে তালা দেওয়া। হয়তো রঞ্জিতই মনিবের কথায় এ ব্যবস্থা করে গেছে। দরজা খুলে শিখাকে নিয়ে সে প্রবেশ করে প্রাসাদের পিছনে প্রকাণ্ড বাগানে। তখন সন্ধ্যার কালো পর্দ্দা পৃথিবীর উপর ধীরে ধীরে বিছিয়ে পড়েছে।

ছয় – মন্ত্রণা

”চুপ চুপ, আস্তে আস্তে, শিখা—”

কথা বলতে বলতে শিখার কণ্ঠ উত্তেজনার বশে উঁচু পর্দ্দায় উঠতেই রুমা নিষেধ করে। কাতর কণ্ঠে বলে—”না না, অন্ততঃপক্ষে আমাকে বিপদে ফেলো না শিখা। আমি—”

শিখা শান্ত হয়ে বলে—”তোমায় বিপদে ফেলবার জন্য কি আমি এসেছি তোমার চিঠি পেয়ে! তোমার কি বিপদ, কি চক্রান্তে তুমি জড়িয়ে পড়েছো—তা জানতে চাই আমি। তুমি আমার সাহায্য চাও কেন, তা না জানলে কি সাহায্য আমি করবো?”

রুমার পাশে বেঞ্চে শিখা বসে।

আলিপুরে রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণের বিরাট প্যালেস। রুমা এখানে যখন ছিল, তখন তারই বন্ধুত্ব সূত্রে শিখা দু—একবার এই ”কুইন প্যালেসে” এসেছিল—অতি সঙ্কুচিতভাবে চলাফেরা করেছে দু—একটি ঘরের মধ্যে। তারপর রুমা বোম্বাই যাওয়ার পর আজ চার—পাঁচ বছর সে আলিপুরের এদিকে এলেও এ প্রাসাদে আসে নি।

রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণ বিহারের বেশ বড় জমিদার। পুরুষানুক্রমে তাঁরা রাজা উপাধিধারী। রাজা ছেলেবেলা থেকেই বাংলাদেশে আছেন, বাংলা ভাষা তাঁর মাতৃভাষার মতন। শিখা তাঁর মুখেই শুনেছিল—তিনি এখানে পড়াশুনা করেছেন। দেশের সঙ্গে সম্পর্ক, বছরে দু—তিনবার মাত্র তিনি চম্পারণে যান। রুমার কাছে শিখা শুনলো, রুমার পিতা প্রথমে এক বার্ম্মীজ মেয়েকে বিবাহ করেন। তারপর কি কারণে সে—মেয়েটির সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পিতার মুখে সে শুনেছিল, বার্ম্মীজ মেয়েটির খাদ্যাখাদ্য বিচার ছিল না। তা ছাড়া তার উগ্র স্বাধীনতাও পিতা সহ্য করতে পারেন নি। এর পর তিনি বাঙালী মেয়ে রুমার মাকে বিবাহ করেন এবং মনে প্রাণে বাঙালী হয়ে যান। রুমাকেও তিনি এ দেশী ভাষায় শিক্ষা দেন। যদিও তাকে কনভেণ্টে রাখা হয়েছিল শিক্ষার জন্য

দোতলার বারান্দা থেকে শিখা এ বাগান তখন দেখেছে, কোনদিন এখানে পদার্পণ করে নি।

এ দিকটায় ঘন বাঁশ—ঝাড়, তার ওপাশে ফুলের গাছ। বাগানের তেমন সেবা—পরিচর্যা হয় না—তাই ফুলগাছগুলোয় রীতিমত ঝোপঝাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে কেউ প্রাসাদ থেকে তাদের দেখতে পাবে না। রঞ্জিতকে রুমা বলে দিয়েছিল, শিখার জন্য সে বাগানের এইখানে অপেক্ষা করবে, রঞ্জিত তাই শিখাকে এখানে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে গেছে। হয়তো বাগানের এদিকে সে আছে পাহারায়।

বাঁশ—ঝাড়ের দিকে বেঞ্চে শিখাকে নিয়ে রুমা বসলো। বললে—”ওদিকে তোমায় নিয়ে যাব না শিখা, আমার সেই পাতানো মামাটি চারিদিকে নজর রেখেছে—এমনি কড়া নজর রাখা তার ডিউটি। তবে ওঁরা জানেন আমি রাত সাড়ে সাতটা পর্য্যন্ত বাগানে থাকি—এ সময় এদিকে কেউ আসবে না।”

শিখা জিজ্ঞেস করে—”কিন্তু ব্যাপার কি বল, তুমি দুঃখিনী, হতভাগিনী, মিসেস্ লিংকে তুমি এতো ভয় করো—ছাড়া ছাড়া কথা যা বলেছো—তাতে আমার কৌতূহল বেড়ে উঠেছে। ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলো শুনি।”

রুমা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে—”সত্যিই তাই। তুমি আমার বাবাকে দেখেছো, আমার দাদাকে দেখনি—আমার দাদা জিতেন্দ্রনারায়ণ…..” এই পর্য্যন্ত বলেই সে থেমে গেল।

শিখা বললে—”শুনেছিলাম পাঁচ বছর আগে তোমার দাদা বোম্বাইয়ে থেকে লেখাপড়া করতেন—আমি তাঁর ফটোটাই দেখেছি। তারপর হঠাৎ তিনি মারা যান, এ খবরও আমি তোমার কাছে শুনেছি রুমা।”

একটা নিঃশ্বাস ফেলে রুমা বললে,—”হ্যাঁ। এখন আমার যা কথা তোমায় বলি, শোন।”

গল্পের মতোই রুমা বলে,—

রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণ বাহাদুরের পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ কলকাতায় আলিপুরে এই বিরাট প্রাসাদ তৈরী করেন। চম্পারণে তাঁর জমিদারীতে তিনি থাকতেন। রাজাবাহাদুর কলকাতা ছেড়ে দেশে যেতে চান নি, এবং এইখানেই তাঁর পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়। পিতা বর্ত্তমান থাকতে রাজাবাহাদুর একবার বর্ম্মায় গিয়েছিলেন, এবং সেখানে এক বার্ম্মীজ মেয়েকে বিবাহ করে তাকে নিয়ে ফিরে আসেন। দেশে থেকে তাঁর পিতা এ কথা শুনতে পান এবং পুত্রকে তিরস্কার করে পত্র দেন—যদি তিনি বার্ম্মীজ মেয়েটিকে ত্যাগ না করেন, তাহলে তিনি তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন।

বার্ম্মীজ মেয়ে উ—পান ছিল অত্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির, আর এইজন্যই রাজাবাহাদুর তাকে ডিভোর্স করেন। শোনা যায় কিছুকাল সে এখানেই ছিল, তারপর রাজাবাহাদুর বিবাহ করেন রুমার মা শিবানীকে। বিবাহের সাত বছর পরে—পুত্র জিতেন্দ্রনারায়ণের বয়স তখন ছ—বছর, এবং রুমার বয়স সাত মাস—তখন অকস্মাৎ এই বাগানে বেড়াতে বেড়াতে তিনি মারা যান। ডাক্তারী রিপোর্টে জানা যায় তিনি হার্টফেল করে মারা গেছেন, অথচ তাঁর হার্টের কোনো অসুখই ছিল না।

পুত্র ও কন্যার ভার বৃদ্ধ পিতার উপর দিয়ে রাজাবাহাদুর তখন বিদেশ যাত্রা করেন। তাঁর পিতাও তাতে আপত্তি করেন নি। রুমার মা মারা যাওয়ায় রাজাবাহাদুর প্রায় পাগল হয়েছিলেন। এ অবস্থায় দেশ পরিভ্রমণই শ্রেষ্ঠ ঔষধ বলে তাঁরা পিতা জানালেন।

রাজাবাহাদুর ফিরলেন দীর্ঘ ছয় বছর পরে। তখন নরেন্দ্রনারায়ণ মারা গেছেন। কাজেই দেশে ফেরা ছাড়া উপায় ছিল না। জমিদারী রক্ষার ব্যবস্থা দরকার। তিনি কোথায় ছিলেন—কিভাবে জীবনের পথে চলেছেন, রুমা তা জানে না।

জিতেন্দ্রনারায়ণ রুমার চেয়ে ছয় বছরের বড়। পিতার সঙ্গে তার মতের মিল কোনোদিনই হয়নি। ছেলেবেলা থেকেই সে ছিল অত্যন্ত জেদী। পিতাকে একদিন সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো, কিন্তু তার মনের সে—ভাব বদলে যাওয়ার কারণ রুমা জানে না—সেও তাকে কিছুই বলে নি।

ষোল বছর বয়সে পিতা যখন তাকে বোম্বাইয়ে পাঠাবার প্রস্তাব করলেন—সে তখন বেঁকে বসলো—স্পষ্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করলে—বললে, সে এখান থেকে কিছুতেই যাবে না।

পিতা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে শাস্তি দিলেন, তারপর জোর করে তাকে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীর সঙ্গে বোম্বাইয়ে পাঠিয়ে দিলেন। জিতেন্দ্রনারায়ণকে বোম্বাই—এ রেখে সেক্রেটারী ফিরে এলেন।

বলতে বলতে রুমার কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে ওঠে। সে বলে—”জানো শিখা, দাদা যেতে চায় নি কিছুতে। দু’ হাতে আমার গলা ধরে দাদার কি কান্না। বললে—”তোর সঙ্গে আর দেখা হবে না রুমা। বাবা ওই চীনে সাহেবটার সঙ্গে পরামর্শ করে আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দিচ্ছে। রাজাবাহাদুরের প্রাইভেট সেক্রেটারী মিষ্টার আউলিং—বাবা যখন চীনে ছিলেন, তখন সেখানে দু’জনের আলাপ। সেখান থেকে সেই যে উনি পিতার স্কন্ধে ভর করেছেন কু—গ্রহের মতো—মুহূর্ত্তের জন্যও ঘাড় থেকে নামেন না। পিতার সঙ্গে চীন থেকে এসেছেন এবং বরাবর সঙ্গে সঙ্গে আছেন। পিতা যেন ঐ আউলিং—এর হাতে কলের পুতুল।”

রুমা বলতে বলতে চুপ করে। যেন দম নেয়। শিখা প্রশ্ন করে,—”এত প্রতিপত্তি কি করে হলো ওর?”

রুমা আবার বলতে সুরু করে—”পিকিং—এ থাকতে পিতার দু’বার সাংঘাতিক অসুখ হয়—বলেছি তো। শেষবারের অসুখে—প্রাণের আশা ছিল না। তখন এই আউলিং আর তার বোন মিসেস্ লিং, দুজনে সেবা—পরিচর্যা করে তাঁকে বাঁচিয়ে তোলে। তারপর আর একবার কি না কি বিপদে—কিন্তু সে কথা থাক। এরপর পিতা যখন দেশে ফিরে আসেন, ঐ আউলিং আসে তাঁর সঙ্গে। এসে পিতার সঙ্গে কিছুকাল এদেশে থেকে চীনে ফিরে যায়। তিন বছর পরে সে আবার ফিরে আসে পিতার কাছে। এসে সেই থেকে পিতার সঙ্গে বাস—তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারী হয়ে।”

রুমা বলে—”নামেই প্রাইভেট সেক্রেটারী—কিন্তু কাজে যেন পিতার দণ্ডমুণ্ডের বিধাতা!”

এই ফিরে আসবার পর থেকে রুমা লক্ষ্য করে ক’জন চীনা সাহেব পিতার কাছে প্রায়ই আসা—যাওয়া করে। আউলিং—এর পরামর্শ ছাড়া পিতা কোনো কাজ করেন না। এমন কি ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে যা কিছু কথাবার্ত্তা আউলিংয়ের সঙ্গেই হয়।

এমনই সময় হঠাৎ জিতেন্দ্রনারায়ণ কলকাতায় আসে। বছরে সে দু’বার করে আসতো। রুমা লক্ষ্য করেছে, যে ক’দিন সে এখানে থাকতো মিঃ আউলিং অন্যত্র চলে যেতেন, এবং সে সময় বাড়ীতে কোনো চীনা সাহেব আসতো না।

কিন্তু এবার হঠাৎ এসে জিতেন্দ্রনারায়ণ এখানে আউলিংকে আর তার সঙ্গীদের দেখতে পায়। ব্যাপার অনেকদূর গড়িয়েছিল—উদ্ধত তরুণ যুবক নাকি আউলিং—এর গালে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করেছিল একদিন।

এর ক’দিন পরই জিতেন্দ্রনারায়ণ বোম্বাইয়ে ফিরে যায়—তারপর শোনা যায় সে মালাবার হিলে একদিন বেড়াতে গিয়ে আর বাড়ী ফেরে নি। পিতা সে খবর পেয়ে তখুনি প্লেনে বোম্বাইয়ে যান। তিনি ফিরলে রুমা শোনে যে, তার দাদা পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছে।

শুনে পাথর হয়ে যায় রুমা।

তবু তাকে পড়াশুনো করতে হয়। গভর্ণেস হিসাবে মিসেস্ লিংকে রাখা হ’ল এর পর থেকে।

সব সহ্য হয়—এই বিদেশী মহিলার কর্তৃত্ব রুমা সহ্য করতে পারে না। সে কলেজে পড়ছে, বয়স তার সতেরো বছর, নিজের ভালো—মন্দ বোঝে, তা সত্ত্বেও এই মহিলা তাকে তাঁর কথামতো চলতে আদেশ করবেন, রুমার তা অসহ্য।

পিতাকে সে একেবারে পায় না—এ বেদনা তার দুঃসহ। কি এত কাজ পিতার, রুমা তা বোঝে না। এর মধ্যে হঠাৎ তাকে বোম্বাই—এ পড়তে পাঠানো হলো, তার আপত্তি টিকলো না। তার সঙ্গে গেলেন ঐ মিসেস্ লিং।

এই মহিলা সর্ব্বদা তার পাহারাদারী করে—তার এতটুকু স্বাধীনতা নেই। মিসেস্ লিং—ই তাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন—তিনি যখন না থাকেন…রাজাবাহাদুরের বিশ্বাসী কর্ম্মচারী শোভনলাল করে তার চৌকিদারী। রুমা তাকে মামা বলে ডাকে।

রুমার চোখে জল ঝরে এসব কথা বলতে বলতে। শিখা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে—”এর মধ্যে যে মস্ত বড় চক্রান্ত আছে, তা বুঝতে পারছি। তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি রুমা—চম্পারণে তোমার বাবার জমিদারী আছে এখনও?”

রুমা আর্দ্রকণ্ঠে বলে—”দেনার দায়ে সব নাকি বিক্রি হয়ে গেছে শুনেছি। এই ক’বছর বাবাকে আর চম্পারণে যেতে দেখি নি। জিজ্ঞাসা করে জেনেছি তাঁর আর কিছু নেই। এক লাখ টাকা নিয়ে তিনি সে জমিদারীর স্বত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।”

শিখা কি ভাবে। তারপর শান্তকণ্ঠে বলে—”তুমি আর কতদিন আছ রুমা?”

রুমা আর্দ্রকণ্ঠে বলে—”মাসখানেক থাকবার কথা। কিন্তু মাস দু’য়ের আগে কিছুতেই যাব না। বাবার শরীরের যা অবস্থা হয়েছে, তাতে আমার সর্ব্বদা ভয়—হয়তো—”

বলতে বলতে সে ঝর ঝর করে চোখের জল ফেলে। শিখা বলে—”হয়তো ওঁরা ডায়মণ্ডহারবার থেকে এখনই ফিরবেন, কাজেই আমি এখন উঠব। তোমার কানে কানে একটা কথা বলছি শোন—আমার কথামতো যদি চলো, আমি যতদূর পারি তোমার কাজ করবো, তোমার ভালো হবে।”

রুমার কানে কানে সে কি বলে।

অকস্মাৎ খুশী হয়ে রুমা দু—হাতে শিখাকে জড়িয়ে ধরে।

এর পর রঞ্জিতের সঙ্গে শিখা আসে বাগানের বাইরে—সেই ছোট দরজা দিয়ে পথে। পথে রঞ্জিতই ট্যাক্সিতে করে পৌঁছে দেয় শিখাকে শিখার বাড়ীতে। এ ব্যাপার এমন নিঃশব্দে হলো—প্রাসাদের কেউ বিন্দুবিসর্গও জানলো না।

সাত – জাহ্নবী বাঈ

বেলা দশটা।

পড়বার ঘরে টেবিলের ধারে বই নিয়ে রুমা বসেছে। দাসী এসে খবর দিলে—”মেমসাহেব আপনাকে ডাকছেন কুমারীজী।”

পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত জ্বলে উঠলো রুমার। নিজের অবস্থার কথা ভাবে রুমা। আজ মিসেস্ লিং তাকে ডেকে পাঠায়—এতখানি কর্তৃত্ব করবার অধিকার এই বিদেশিনীকে কে দিয়েছে? নিঃশব্দে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে রুমা।

এ দুঃখের কথা কাকেই বা সে বলবে? পিতা বাড়ীর সর্ব্বময় কর্ত্তা; কিন্তু তাঁকে সে কোথায় পাবে? আউলিং সর্ব্বদা পিতার কাছে কাছে থাকে, কোনো সময় সে পিতাকে একান্তে পায় না। দেখা করতে চাইলে শোনা যায়, এর পর দেখা হবে—রাজাবাহাদুর এখন ভয়ানক ব্যস্ত।

কি এত কাজ, রুমা জানে না।

অথচ এই পিতাকেই সে আগে একান্ত সান্নিধ্যে পেয়েছে—কত স্নেহময় তার পিতা। জিতেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুসংবাদে এই পিতাই আছড়ে পড়েছিলেন—নারীর মতো কেঁদেছিলেন। সেইটুকু সময়ই তিনি ছিলেন একান্ত নিজের—আউলিং—এর প্রভাব থেকে মুক্ত। পিতা তাকে বোম্বাইয়ে পাঠাতে চান নি—কিন্তু আউলিং বাধ্য করে। মনে হয়, যেন তাঁকে আদেশ করলে!

আশ্চর্য্য! একেবারেই আশ্চর্য্য। রুমার নিজের এতটুকু স্বাধীনতা নেই। পিতার সঙ্গে দেখা করবে—পিতার সময় হবে না—ব্যস্ত! এমন ব্যাপার কেউ কল্পনা করতে পারে? এর অর্থ—আউলিং আদেশ দেয়নি, তাই পিতা দেখা করতে পারেন না। তারই দক্ষিণহস্ত মিসেস্ লিং আজ আদেশ করে রুমাকে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। এর পর? এর পর অদৃষ্টে আরও কি আছে কে জানে?

মুহূর্ত্তে রুমা শক্ত হয়ে ওঠে। দাসীর পানে তাকিয়ে বললে—”গিয়ে তাঁকে বল, দরকার থাকে নিজে এসে বলে যান—আমি পড়ছি। সামনে পরীক্ষা, পড়ার ক্ষতি করে আমি যেতে পারবো না।”

দাসী চলে গেল।

ক্রোধে স্ফীত হয় রুমা।

না, আজ সকল বাধা অগ্রাহ্য করে সে পিতার সঙ্গে দেখা করবে। একদিন জিতেন্দ্রনারায়ণ পিতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাধা পেয়ে দুর্ব্বার হয়ে উঠেছিল। বাধা দিয়েছিল ঐ আউলিং। সে—বাধা সহ্য করতে না পেরে জিতেন্দ্রনারায়ণ আউলিং—এর গালে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিয়েছিল।

”রুমা, ঘরে আসতে পারি?”

মুহূর্ত্তে নিজেকে সংযত করে রুমা—মিসেস্ লিং এসেছেন।

ইংরাজীতেই সে জবাব দেয়,—”নিশ্চয়! আসুন মিসেস্ লিং।”

মিসেস্ লিং ঘরে প্রবেশ করেন।

অতি সাধারণ মহিলা—গাউন পরেন। চেহারায় স্পষ্ট চেনা যায় চীনা মহিলাকে।

রুমা সোজা হয়ে বসে—”ধন্যবাদ মিসেস্ লিং, আমি পড়াশুনো নিয়ে ভারী ব্যস্ত—সামনে পরীক্ষা কিনা—তাই।”

মিসেস্ লিং একখানা চেয়ার টেনে বসলেন, মুখে মৃদু হাসি—কি অমায়িক সারল্য! তিনি বললেন—”যাক, তাতে ক্ষতি হয়নি। তোমারই কাজে এসেছি। কাল অনেক রাত্রে ফিরেছি। সেদিন রাজাবাহাদুরের কাছে তুমি তোমার নিজস্ব একটি সঙ্গিনী চেয়েছিলে—কম্পানিয়ন!

অসন্তুষ্ট কণ্ঠে রুমা বললে—”আপনি কি বাবার হয়ে কথা বলতে এসেছেন? তা যদি হয় আপনি আপনার মনিব অর্থাৎ আমার বাবাকে জানিয়ে দেবেন, বাবার সঙ্গে আমার কথাবার্ত্তায় কারো মধ্যস্থতা আমি পছন্দ করি না—এবং তা আমি মানবো না। আমি রাজকন্যা, সে সম্বন্ধ ধরে কথা বলছি নে; আমি বলছি আমাদের পিতা আর কন্যার মধ্যে কেউ যেন না দাঁড়ায়। আমাদের কথাবার্ত্তা আলাপ—আলোচনার মধ্যে তৃতীয় লোক না থাকে, এইটেই আমি চাই মিসেস্ লিং।”

মিসেস্ লিংয়ের হরিদ্রাবর্ণের মুখখানা অকস্মাৎ কালো হয়ে গেল। তিনি মুহূর্ত্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। পরমুহূর্ত্তেই হেসে উঠে বললেন,—”ঠিক কথা, সত্যি কথাই তুমি বলেছো রুমা। তোমার পিতা আর তোমার মাঝখানে দাঁড়াবে এতখানি স্পর্দ্ধা কার? অথচ আমি তাঁর কথাই বলতে এসেছি রুমা, এবং এইজন্যে অত্যন্ত কুণ্ঠা বোধ করছি—আমার মুখে তুমি এ—কথা শুনছো! হ্যাঁ, একটি মেয়ে—জাহ্নবী বাঈ—বাঙালী নয়—বিহারী, তোমার পিতা মহামান্য রাজাবাহাদুর তাকে তোমার সহচরী হিসাবে নেবার কথা আমায় বলেছেন। মেয়েটিকে আমি বিশেষ পরীক্ষা করে খুশী হয়েছি, এখন তাকে রাখা না রাখা তোমার ইচ্ছা!”

রুমা বিরস কণ্ঠে বলে—”আপনার সেই জাহ্নবী বাঈ এসেছে? এসে থাকে যদি তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন—আমি তার সঙ্গে কথা কয়ে দেখে তবে আপনাকে কথা দেব।”

ভাবলেশহীন মুখে মিসেস্ লিং দাঁড়িয়ে উঠে বললেন—”আমি এখনই তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

তিনি বেরিয়ে গেলেন।

একটু পরেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে—তার সঙ্গে প্রাসাদের দু’জন দাসী।

রুমা তার পানে তাকাতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রণতি জানালো।

পলকের দৃটি তার সর্ব্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। মাথার চুলগুলি রক্ষ, মনে হয় কতদিন মাথায় তেল পড়েনি। পরণে অতি জীর্ণ—শাড়ী।

রুমা ডাকলো—”ভিতরে এসো, তোমার সঙ্গে কথা কয়ে জানতে চাই, তুমি কেমন—তোমাকে নিতে পারবো কি না? তোমার অভাব শুনছি। প্রথমে খুঁটিয়ে তোমার সব পরিচয় জানতে চাই—এসো।”

মেয়েটি কম্পিতপদে ঘরে প্রবেশ করলে। রুমা পরিচারিকাদের আদেশ দিলে—”তোমরা বাইরে থাকো, দরকার হলে ডাকবো।”

পরিচারিকা দু’জন বাইরে গেল। রুমা উঠে এসে দরজা বন্ধ করে দিলে।

তারপর ফিরে দু—হাতে জাহ্নবী বাঈকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললে—”চমৎকার—চমৎকার শিখা—একেবারে চেনা যায় না! আশ্চর্য্য তোমার সাজ! মনে হয়, তোমার মা—কাকিমাও চিনতে পারবেন না এ মূর্ত্তিকে।”

শিখা সচকিতে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সরে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললে—”আঃ, সব মাটি করে দেবে নাকি রুমা! আমি তোমার দাসী—আমার সঙ্গে সেই রকম ব্যবহার করো। মনে রেখো, দেয়ালেরও চোখ আছে, কান আছে।”

রুমা বুঝতে পারে—শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে।

সেই দিনই দাসীরূপে নিযুক্ত হ’য়ে গেল শিখা।

পিতার কর্ত্তব্য শেষ করে রাজাবাহাদুর খুশী হলেন। যাক, মেয়েটা শান্তিতে থাকবে, একটা মানুষের সঙ্গে একটু কথাবার্ত্তা বলতে পারবে।

কিন্তু মিসেস্ লিং যে খুশী হন নি, তা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা গেল।

আট – লি চং

যে মোটরটাকে অনুসরণ করে তার পিছনে যতীন্দ্রনাথের মোটর চললো—সেখানা ধীর মন্থর গতিতে যেতে যেতে হঠাৎ ফাঁকা পথ পেতেই গতির বেগ বাড়িয়ে যেন বাতাসের বেগে উড়ে চললো।

যতীন্দ্রনাথের জীপও গতির বেগ বাড়িয়ে ছুটলো।

জীপে যতীন্দ্রনাথ বসে আছেন, উন্মনা ভাব—দারুণ চিন্তায় নিমগ্ন! গাড়ীতে তাঁর সঙ্গে আছেন ইনস্পেক্টর অবনীশ—তাঁর বোধ হয় ক্লান্তিতে একটু ঝিমুনির ভাব।

জীপখানা হঠাৎ লাফিয়ে উঠেই কাত হয়ে ছিটকে পড়লো পথের ধারে—একটা গাছের গা ঘেঁষে। দারুণ আঘাত পেয়ে যতীন্দ্রনাথ মূর্চ্ছিত হয়ে পড়লেন,—অবনীশ ছিটকে বাইরে পড়লেন—আঘাত পেলেও তিনি মূর্চ্ছিত হন নি।

ড্রাইভার সূরয সিং একেবারে চাপা পড়ে গেছে, তার মুখে একটা অস্ফুট শব্দও শোনা যায় না।

জনবিরল পথ—দুই দিকে বিরাট মাঠ। সন্ধ্যার পর এদিকে লোকজনের সংখ্যা কম। যাদের এখানে বাস তারা অনেকটা দূরে থাকায় এসে পৌঁছাতে পাঁচ—সাত মিনিট সময় লাগলো।

জায়গাটায় তেমন আলো নেই—স্পষ্ট কোনো সূক্ষ্ম জিনিষ চোখে পড়ে না।

পাঁচ—সাত মিনিটেই জায়গাটা লোকে ভরে গেল—মোটর সরিয়ে সূরয সিংকে বার করা হ’ল। মূর্চ্ছিত সূরয সিং—এর নাক—মুখ দিয়ে অবিশ্রান্ত রক্ত পড়ছে।

অ্যাম্বুলেন্স এলো—যতীন্দ্রনাথ আর সূরয সিংকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হ’ল।

অবনীশ আহত হলেও চলৎশক্তি হারান নি! পুলিশের গাড়ীতেই তিনি এলেন হাসপাতালে।

খবর পেয়ে মিষ্টার ব্রহ্ম ছুটে আসেন হাসপাতালে। অবনীশকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালের বাইরে এসে মিঃ ব্রহ্ম জিজ্ঞেস করেন—”ঘটনাটা কিভাবে কোথায় ঘটলো অবনীশবাবু—এর মধ্যে শত্রুপক্ষের চক্রান্তের আভাস পাওয়া যায় কি?”

অবনীশ উত্তর দিলেন—”আমার তাই মনে হয় স্যর। সন্ধ্যার সময় লালবাজার থেকে সোজা বউবাজার ষ্ট্রীট ধরে আসছি, এমন সময় দেখা গেল পথের ওদিকে ঐ মোটরখানা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। এ মোটরখানা দেখেই যতীনবাবু তার পিছনে যাবার আদেশ দিলেন। খিদিরপুরের দিকে আগের মোটরখানা চলেছিল বেশ আস্তে—আমাদের জীপও আস্তে আস্তে ফলো করছিল। খানিকদূর গিয়েই সে গাড়ী এতো জোরে চললো—যেন তার নাগাল পাওয়া যাবে না। আমাদের গাড়ীও জোরে চালানো হ’ল। চলবার মুখে মনে হ’ল কিসে ধাক্কা খেয়ে লাফিয়ে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়লুম।”

চিন্তিত মুখে মিঃ ব্রহ্ম বললেন—”কিন্তু সে মোটরে কে ছিলেন দেখেছেন?”

অবনীশ বললেন—”একজন ইউরোপীয়ানকে শুধু আমি দেখেছি, আর কাউকে দেখতে পাই নি।”

”ইউরোপীয়ান!”

চিন্তিতভাবে মাথা নাড়েন মিঃ ব্রহ্ম।

সকালের দিকে যতীন্দ্রনাথের জ্ঞান ফিরল। তিনি চোখ মেলে চাইলেন—দু—একটি কথাও বললেন। এ—খবর পেয়ে মিঃ ব্রহ্ম ছুটে এলেন হাসপাতালে।

যতীন্দ্রনাথ হেসে বলেন—”মরতে মরতে ফিরে এসেছি মিষ্টার ব্রহ্ম। হয়তো এমনি ভাবেই মরণ বরণ করতে হবে একদিন। কিন্তু তার জন্যে ভাবি নে, জীবন তো উৎসর্গই করেছি—যা হবার হোক, তার আগে, যদি ওই লি চংকে গ্রেপ্তার করতে পারি, জানব আমার সব কষ্ট সার্থক হয়েছে!”

”লি চং! তাকে আপনি কোথায় দেখলেন?”

মিঃ ব্রহ্ম বিস্ময় দমন করতে না পেরে বলেন—”দেখতে ভুল করেন নি তো?”

দৃঢ়কণ্ঠে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”মোটেই না। আমি লি চংয়ের ফটো দেখে তার ছবিটা আমার মনে এমনভাবে এঁকে নিয়েছি যে, তাতে ভুল হ’তে পারে না। কাল মোটরে তাকেই ফলো করেছিলাম মিঃ ব্রহ্ম।”

অবনীশ মাথা চুলকে বললেন,—”কিন্তু একজন ইউরোপীয়ান ছাড়া সে মোটরে আর কেউ ছিল কি যতীনবাবু? লি চংকে দেখিনি তো?”

”আমি যদি বলি ওই ইউরোপীয়ানই লি চং?”

মিঃ ব্রহ্ম নির্ব্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকেন। অবনীশ মাথা নাড়েন।

যতীন্দ্রনাথ এক গ্লাস জল পান করে আবার বলেন—”হ্যাঁ, আমি বলছি লি চংকে দেখে কেউ চীনে ম্যান ভাবতে পারবে না। তার কারণ লি চংয়ের বাবা চীনা হলেও তার মা ছিলেন ইউরোপীয়ান। মায়ের চেহারাই পেয়েছে ও। তাই কেউ তাকে চীনেম্যান বলে বুঝতে পারে না। ইউরোপীয়ানের বেশেই সে এসেছে এখানে—স্বচ্ছন্দে চলাফেরাও করছে, —আমার কথা মিথ্যা নয়।”

এর পর যতীন্দ্রনাথকে আরও তিনদিন হাসপাতালে থাকতে হলো—তিনদিন পরে তিনি বাড়ীতে ফিরেই শিখার একখানা চিঠি পেয়ে আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন।

আজই এ—চিঠি এসে পৌঁছেছে।

শিখা তাঁর অসুস্থতার খবর পেয়েছে। লিখেছে—ইচ্ছা থাকলেও সে তাঁকে দেখতে যেতে পারে নি। পাছে চেনা—জানা কোনো লোক তাকে দেখতে পায়—সেটা মোটেই উচিত হবে না এখন। সে এক অলৌকিক রহস্যের সন্ধান পেয়েছে। আশা করে শীঘ্রই সব রহস্যের সমাধান হবে। সে কোথায় আছে, এখন জানাবে না—তাতে বিপদ আছে। তবে বেশ নিরাপদে এবং স্বচ্ছন্দেই সে আছে। কাকাবাবুকেও সে জানিয়েছে, তার জন্য চিন্তার কারণ নাই—কার্য্য উদ্ধার করে শীঘ্রই সে ফিরবে।

এ মেয়ে যে অসাধ্য সাধন করতে পারে, যতীন্দ্রনাথ তা বিশ্বাস করেন।

কোকেন সম্বন্ধে সন্ধানের ভার সে নিয়েছে—তাঁকে নিশ্চিন্ত করবে, ভরসাও দিয়েছে শিখা।

কিন্তু লি চং? সে এসেছে কোলকাতায়। তাকে চিনতে যতীন্দ্রনাথের ভুল হয় নি। তার সম্বন্ধে অনেক কিছু তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখে রেখেছেন। মাথায় আঘাত পেয়েই বোধহয় মনে করতে পারছেন না—যতীন্দ্রনাথ ডায়েরী খুললেন।

লি চংয়ের নানা অবস্থার ফটো তিনি সংগ্রহ করে তাঁর ফটোর অ্যালবামে রেখেছেন। শুধু লি চং নয়—আরও বহু অপরাধীর পরিচয় তাঁর ডায়েরীতে লেখা আছে।

লি চংয়ের পরিচয়—চীনে অভিজাত বংশে তার জন্ম। বেশ শিক্ষিত। জীবনের বেশীর ভাগ সময় বিদেশেই কাটিয়েছে সে। বছর পাঁচেক আগে সে পিকিংয়ে আসে, তখন কপর্দ্দকহীন। বুদ্ধি অসাধারণ—সাহসও সেই রকম। তাই এক বছরের মধ্যেই সে বিরাট একটা দল তৈরী করে এবং তাদের নিয়ে কাজ করে সে প্রচুর বিত্তশালী হয়ে ওঠে। তাদের নেতৃত্ব করে একেবারে গোলাম বানিয়ে ফেলে। লি চংয়ের কথায় তারা বেপরোয়া—লি চংয়ের হুকুমে পাহাড় থেকে ঝাঁপ খেতে, বা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করতেও দ্বিধা করে না—চিন্তা করে না। গভর্ণমেণ্ট বহুদিন তাকে সন্দেহ করতে পারেন নি—অকস্মাৎ তার স্বরূপ প্রকাশ পায়, এবং দেশের লোক সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই শিক্ষিত দস্যুসর্দ্দার তার শিক্ষা এবং সুন্দর চেহারার সহায়তায় সমাজে বরেণ্য—স্থান গ্রহণ করেছিল। শেষ পর্য্যন্ত এমন অবস্থায় এসেছিল, যে কোনো অনুষ্ঠানে তার যোগ দেওয়া চাইই এবং সম্ভ্রান্ত অভিজাত বংশের মেয়েদের মধ্যে সকলেই তাকে স্বামীরূপে লাভ করবার জন্য উদগ্রীব ছিল।

অকস্মাৎ প্রকাশ পায়, বিরাট চীন দেশের বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে যা কিছু খুন, চুরি, ডাকাতি আর লুটপাট চলছে, তার প্রায় প্রত্যেকটির নেতা ঐ লি চং। পুলিশ কিছুদিন থেকে তাকে সন্দেহ করলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে সাহস পায় নি। উপযুক্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে পুলিশ যখন ব্যস্ত ছিল, সেই সময় লি চং গোপনে দেশ ত্যাগ করে এবং মান্দালয়ে তার নূতন ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখান থেকে সে কোথায় উধাও হয়, জানা যায় নি। অকস্মাৎ এই কোকেনের সংস্রবে এ—দেশের পুলিশ তার সন্ধান পেয়েছে। বুঝেছে সে এবারে ভারতে পদার্পণ করেছে।

যতীন্দ্রনাথ একটা নিশ্বাস ফেলে ফটোর অ্যালবাম আর পরিচয়—লিপি একপাশে সরিয়ে রাখলেন।

নয় – বাঘের মুখে

পা টিপে টিপে শিখা এসে দাঁড়ায় জানালার পাশে।

প্রকাণ্ড হলঘর…সেই ঘরে চলেছে রাজ্যের জল্পনা—কল্পনা—মন্ত্রণা।

জানালার খড়খড়ি বন্ধ—ভিতরে কে কে আছে দেখা যায় না। শুধু কথাগুলোই কানে আসে। ভিতরেকে গর্জ্জন করছিল—”আমি জানতে চাই, আমার কথার জবাব দিতে আপনি নিশ্চয়ই বাধ্য—নিজের মনেই তা বুঝে দেখুন। আমি জানতে চাই, আপনি কেন আমার কথামতো কাজ করেন নি, কেন ওই অচেনা মেয়েটিকে আপনার পরিবারের মধ্যে জায়গা দিয়েছেন? দিন—জবাব দিন!”

কৌতূহল জাগে অনেকখানি—শিখা জানালার আশপাশে খোঁজে—যদি কোথাও একটু ফাঁক—ছোট একটা ফুটো পায়।

হ্যাঁ, একটু ফাঁক পাওয়া গেছে। সেখান থেকে সবটা না হোক, খানিকটা দেখা যায়। দেখা যায় রাজাবাহাদুরকে আর আউলিংকে। আরও ক’জন লোক দেখা যায়—এদের মধ্যে পোর্ট পুলিশের পদস্থ অফিসার মিঃ চক্রবর্ত্তী, এবং আবগারীর একজন ইনস্পেক্টরকে দেখে শিখা যেন আকাশ থেকে পড়লো। যতীন্দ্রনাথের কথা মনে হ’ল, তিনি বলেছিলেন এখানকার ক’জন অফিসার, তাছাড়া বিভিন্ন কোম্পানীর নামকরা ক’জন লোকও এই চোরাকারবার আর কোকেন ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছে।

কথাটা তাহলে সত্য।

এমনই রাত্রে প্রায় এদের বৈঠক বসে এবং কাজের চর্চা আর পদ্ধতি নির্দ্দিষ্ট হয়। দিনে এরা কর্ম্মতৎপর, ধর্ম্মভীরু, কর্ত্তব্যনিষ্ঠ কর্ম্মচারী আর রাত্রির অন্ধকারে এরা এই!

শিখা এসেছে দিন পনেরো। এর মধ্যে একদিনও রাজাবাহাদুরকে সে দেখতে পায় নি। শিখা বেশ জানে মিসেস্ লিং তার উপর সব সময়ে নজর রেখেছেন—রুমার পাশে থাকলেও তাদের যা কথাবার্ত্তা হয়, তা তাঁর কানে পৌঁছাতে দেরী হয় না। অত্যন্ত সতর্ক হুঁশিয়ার হয়ে শিখা চলাফেরা করে—রুমাকেও সতর্ক করে দিয়েছে। বুদ্ধিমতী রুমা তার কথায় আর পরামর্শে চলে।

এই বৈঠকী আসরের সন্ধান সে পেয়েছে মিসেস্ লিংয়ের টেবিলের উপর একখানা চিঠি পড়ে। মিসেস্ লিংয়ের ঘরে কেউ যায় না—যাবার অধিকার নেই। সেদিন দৈবাৎ কি কারণে মিসেস্ লিং ঘরে ছিলেন না, এবং মিসেস্ লিংয়ের অতি বিশ্বাসী দাসী হয়তো ভুলে কিংবা কিছুমাত্র সন্দেহ না করে কোথায় গিয়েছিল। শিখা এই মুহূর্ত্তটুকুই খুঁজছিল, এবং সুযোগ পেতেই সে সুযোগটুকু সার্থক করে নিয়েছে।

চিঠিখানা পেয়েই সে বুকে ব্লাউজের মধ্যে গুঁজে চারিদিকে চেয়ে নিঃশব্দে মিসেস্ লিংয়ের আধখোলা ড্রয়ারটা টেনে তার মধ্যে দেখতে পায় একটি বুদ্ধমূর্ত্তি! চকিতের বিস্ময়! এটি তারই সেই চুরি যাওয়া মূর্ত্তি! কিন্তু ভাববার সময় নেই। মূর্ত্তিটি তুলে নিয়ে ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে চকিতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে।

চিঠিখানাতে লেখা ছিল—”জরুরী অধিবেশন—মিসেস্ লিংকেও উপস্থিত থাকতে হবে।”

এখন কতই বা রাত্রি। সবে এগারোটা। রাজবাড়ী এখনই নিঝুম নিস্তব্ধ। ঘড়ি ধরে রাত্রি আটটায় আহারাদি হয়—দশটার মধ্যে সব ঘরের আলো নিভে যায়।

রুমার পাশের ঘরে শিখা থাকে। রুমাকে বলে এসেছে বিশেষ কাজে বাইরের মহলে যাচ্ছে—ফিরে এসে তাকে সব বলবে।

অগ্রসর হওয়ার মুখেই বাধা পায় শিখা। সামনে একজন মানুষ। সে কাছে এলো। ফিস ফিস করে বললো—”ভয় নেই মিস্ রায়, আমি রঞ্জিত, আপনাকেই খবর দিতে এসেছিলাম। আজ এদের সর্দ্দার লি চং এসেছে—আপনি আমার সঙ্গে আসুন….নিজের কানে অনেক কিছু শুনতে পাবেন।”

শিখা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়।

জানালার সেই ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি পড়ে আর একটা লোকের ওপর—বেশ সুপুরুষ, বয়স চল্লিশের মধ্যে। পোষাক—পরিচ্ছদে তার আভিজাত্য…কণ্ঠস্বরে কি দাম্ভিকতা! এই লোকটিই রাজাবাহাদুরের সামনে বসে, এবং কৈফিয়ৎ চাচ্ছে সেই!

সেই লি চং? মহামান্য লি চং?

এমন সুন্দর চেহারার আড়ালে এক দুর্দ্ধর্ষ শয়তান দুনিয়ায় যত রকম অসৎকাজ আছে সব করে আসছে—আরও করবে। অথচ এই লোকটা প্রচুর শিক্ষালাভ করেছে, জ্ঞানী! দুঃখের কথা—তার শিক্ষা হয়েছে বিকৃত, এবং জ্ঞান তাকে হিংসা আর ধ্বংসের মন্ত্রেই দীক্ষিত করে তুলেছে। ভাবতে কষ্ট হয় শিখার।

রাজাবাহাদুরের কথা শোনা গেল—”কিন্তু আমি এমন কিছু অন্যায় করি নি লি চং। আপনাদের হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে দুনিয়ায় এমন নোংরা কাজ নেই যা করছি না। এর জন্য আমার সুখ—শান্তি—আনন্দ চিরদিনের জন্য দূর হয়ে গেছে—দুঃসহ আতঙ্কে আমার দিন কাটছে। আমার একমাত্র বংশধর—জিতেন্দ্রনারায়ণ—সে আজ নেই। আমি জানি, তার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয় নি—আপনাদেরই কোনো লোক তাকে চিরদিনের মতো সরিয়ে দিয়েছে। যাতে—”

বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে আউলিংয়ের কর্কশ কণ্ঠ শোনা যায়,—”এ আপনার ভুল ধারণা রাজাবাহাদুর। আপনার ছেলের দেহ পাওয়া যায় নি—একথা সত্য। আমরাও অনেক খুঁজেছি, একথা আপনিও স্বীকার করবেন। তার দেহ যদি পেতেন, দেখে তাহলে বুঝতেন—খুন নয়—পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েই তার…”

হাত তোলেন রাজাবাহাদুর—”থাক, সে কথা চিরদিনের জন্য ঢাকাই থাক মিঃ আউলিং। একথা কোনোদিনও বলতাম না—কিন্তু রুমার সম্বন্ধে কথা বলছো বলেই বলছি। একটি মাত্র মেয়ে আমার; ভায়ের মতোই তার তেজ, ন্যায় আর সত্যের পথে সে চলে—তাকে তোমরা জোর করে আমার কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছো। একই বাড়ীতে থাকি, অথচ আমার এমন অধিকার নেই যে, আমি তার সঙ্গে দেখা করি—কথা বলি।”

তাঁর কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে ওঠে। তিনি আবার বলেন, ”সেই মেয়ে যখন আমাকে জানালো, তার একজন সাথী হলে ভালো হয়, তখনই আমি সকলকে সেকথা বলেছি, বিজ্ঞাপন দিয়েছি—এবং জাহ্নবী বাঈকে পেয়েছি। মিসেস্ লিং এ মেয়েটিকে সন্দেহ করছেন, কিন্তু আমি জেনেছি মেয়েটি ভদ্র গৃহস্থ ঘরের মেয়ে!”

”হ্যাঁ, ভদ্র গৃহস্থ ঘরের মেয়ে! জন্মপত্রিকা দেখেছেন আপনি!”

হাসে লি চং—”মিসেস্ লিং ঐ মেয়েটির সম্বন্ধে যা জেনেছেন, আমি তা শুনেছি। আপনিও মিসেস্ লিংয়ের কাছে শুনেই সব জানবেন। তবে আমি একথা স্পষ্ট বলছি—আপনি আমাদের সঙ্গে বেইমানী করবেন, ঠিক করেছেন। কন্যাস্নেহে অন্ধ হয়ে নিজেকে এখন বাঁচাতে চাইছেন—কিন্তু তা চাইলেও মনে রাখবেন আমরা আপনাকে ছাড়বো না। পুলিশে আমাদের সব কথা বলে আমাদের ধরিয়ে দেওয়ার মতলব করছেন—সেই পুলিশ আপনার আসল পরিচয় পেলে আপনাকেও ফাঁসিতে ঝুলাবে—একথা ভুলবেন না!”

অকস্মাৎ বিবর্ণ হয়ে যান রাজাবাহাদুর! আর একটু এগিয়ে আসে শিখা। ঘরের মধ্যে চাপা সুরে কি সব কথাবার্ত্তা চলছে, শোনবার চেষ্টা করে।

হঠাৎ চমকে উঠে পিছনে তাকায়। কার একখানা হাত শিখার কাঁধে—বেশ কঠিন স্পর্শ! অন্ধকারেও শিখা বুঝতে পারে—তার ঠিক পাশে একজন মানুষ।

কিন্তু কে?…এ প্রশ্ন মনে জাগবার সঙ্গে সঙ্গে শিখা শোনে শ্লেষভরা কণ্ঠস্বর,—”চমৎকার মিস্ রায়, ব্রেভো! বাঙালীর মেয়ের এমন সাহস—দু’শো সেলাম জানাই তোমাকে মিস্ রায়!”

লি চং!

সঙ্গে সঙ্গে দপ করে মাথার উপর আলো জ্বলে ওঠে—শিখা দেখে সামনে দাঁড়িয়ে লি চং—তার মুখে কুটিল হাসি।

”হ্যাঁ, বহুৎ তারিফ করছি বাঙালী মেয়ে, কিন্তু আর নয়, এবার এসো।”

শিখার একখানা হাত লি চং চেপে ধরে। শিখা হাতখানা ছাড়াবার চেষ্টা করে।

সঙ্গে সঙ্গে কণ্ঠে পেষণ অনুভব করে। ক্রমশঃ তার অনুভব শক্তি লোপ পায়—অজ্ঞান হয়ে শিখা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

দশ – লি চং সংবাদ

যখন জ্ঞান হলো—শিখা প্রথমে কিছু মনে করতে পারে না—ভাবতে পারে না কোথায় এসেছে—কে তাকে এখানে নিয়ে এলো।

কণ্ঠে দারুণ ব্যথা,—নিশ্বাস নিতে হাঁফ ধরছে।

ক্রমে ধীরে ধীরে মনে পড়ে সব ঘটনা। সে মন্ত্রণা শোনবার জন্য জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল—লি চং কখন তার অবস্থিতি জানতে পেরে তাকে আক্রমণ করেছে…তারপর সে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখন তাকে তুলে এখানে এনে রেখেছে।

ওঠবার চেষ্টা করে শিখা—দু—একবার চেষ্টার পর উঠে বসে। অত্যন্ত দুর্ব্বল, একান্ত অসহায় মনে হয়।

পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে,—এদিক—ওদিক তাকায়—পাশেই ছোট গোলাকার টেবিলের উপর জলের কুঁজো আর গ্লাস দেখতে পায়।

প্রায় হামা দিয়ে শিখা এগিয়ে যায়—কম্পিত—দুর্ব্বল হাতে কোনোরকমে এক গ্লাস জল ঢেলে নিয়ে এক নিশ্বাসে জলটা পান করে।

আঃ—

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মনে হয়, বাঁচবার আশা এখনো আছে।—যুদ্ধ করতে পারবে। আর এক গ্লাস জল নিয়ে সে চোখে—মুখে দেয়, সারা দেহ যেন জুড়িয়ে যায়।

অন্ধকার ছোট একখানি ঘর,—এর অস্তিত্ব সে কোনোদিন জানে না। হয়তো রাজবাড়ীতেই আছে—অলি—গলি তার অপরিচিত, এ ঘরের অস্তিত্ব তার অজানা রয়েছে।

উৎকর্ণ হয়ে সে শোনবার চেষ্টা করে কোনোদিক থেকে কোনো শব্দ আসে কিনা? নাঃ, কোন শব্দই শোনা যায় না।

শ্রান্ত দেহে ক্লান্ত মনে সে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মেঝের ওপর বিছানা পাতা আছে—ঠাণ্ডা মেঝেয় ফেলে রাখা হয় নি। মনে মনে হাসে শিখা—ভাবে, এত করুণা!

সে বেশ বুঝতে পারছে, হতভাগ্য রাজাবাহাদুরকে মাঝখানে রেখে এই দুর্দ্দান্ত দলটি নিপুণভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। যে কোনোরকমেই হোক, রাজাবাহাদুরকে তারা আইনের প্যাঁচে জড়িয়েছে। এমন কোনো গূঢ় রহস্য আছে, যা প্রকাশ হ’লে হয়তো রাজাবাহাদুরকে সত্যিই ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হবে—সেই মৃত্যুবাণ ওদের হাতে। তাই ইচ্ছা না থাকলেও রাজাবাহাদুরকে ওদের সঙ্গে চলতে হচ্ছে, তাঁর মুক্তির কোনো উপায়ও হয়তো নেই।

কি ভীষণ অবস্থা! একমাত্র পুত্র—বংশধর এদের হাতে খুন হয়েছে,—একথা জেনেও তা প্রকাশ করার উপায় তাঁর নেই। নিজের বিপুল ধনসম্পত্তি তিনি হারিয়েছেন, এদের সাহায্যেই আজ তাঁর সম্ভ্রম রক্ষা সম্ভব হয়েছে। একমাত্র কন্যার সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পর্ক এরা রাখতে দেয় নি। পিতা আর কন্যার মাঝখানে এরা তুলেছে দুর্ভেদ্য প্রাচীর—দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান!

কখন চোখে নিদ্রা নেমে আসে শিখা জানতেও পারে না। অকস্মাৎ দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে শিখা উঠে বসে।

ওদিকে অন্ধকারের মধ্যে যে একটি দরজা আছে, তা সে লক্ষ্য করে নি। দরজা খোলার শব্দে সেই দিকে তাকায়—দেখতে পায় লি চংকে।

দরজা খুলতে ঘরে আলো আসে। বাইরের দিকে উপরে উঠবার সিঁড়ি দেখা যায়। শিখা বুঝতে পারে, এ ঘর বাড়ীর সব নীচের তলায়—তাই এমন ঘোর অন্ধকার। ভ্যাপসা একটা গন্ধও পাওয়া যায়।

”নমস্কার মিস্ রায়—আশাকরি ভালোই আছ। খবর না দিয়ে এসেছি, সেজন্য ক্ষমা করবে।”

শিখা তার পানে তাকায়—উত্তর দেয় না।

লি চং পাশে চেয়ে দেখে—”একি, তোমার খাবার পড়ে রয়েছে, তুমি কিছু খাওনি দেখছি। মিসেস্ লিং তোমায় ডেকে দেয় নি—বুঝছি।”

পিছন ফিরে কর্কশকণ্ঠে ডাকে,—”মিসেস্ লিং! তোমাকে কি আদেশ দেওয়া হয়েছিল, মনে আছে?”

পিছনে দেখতে পাওয়া যায় মিসেস্ লিংকে। হাত দুখানা বুকের উপর রেখে নত নেত্রে সে মাথা কাত করে।

একখানা হাত তোলে লি চং—”যাও, মনে রেখো তোমার এ শাস্তি তোলা রইলো।”

বিবর্ণ—পাংশু মুখে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় মিসেস্ লিং। লি চং দু—পা এগিয়ে আসে—শান্ত কণ্ঠে বলে,—”এ—ঘরে তোমায় রাখা হয়েছে আমি জানতাম না মিস্ রায়—এসব আউলিং—এর কাজ। আমি তোমায় এখনই এখান থেকে নিয়ে যেতে চাই—আশাকরি আমাকে বিশ্বাস করে তুমি এই নোংরা বিশ্রী ঘর থেকে বাইরে আসবে।”

শিখা হাঁফিয়ে উঠেছিল—সেই মুহূর্ত্তেই রাজী। শান্তকণ্ঠে বললে,—”এ অনুগ্রহের জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মিষ্টার লি চং।”

নামটা শিখা জানে—লি চং চমকে উঠে তার পানে তাকায়; নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,—”এসো—”

সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে—তার পিছনে আসে শিখা। খানিকদূর উঠে বাঁদিকে মাঝারি সাইজের একখানি ঘর—চমৎকার সাজানো। শিখাকে নিয়ে লি চং সেই ঘরে ঢোকে।

শান্তকণ্ঠে লি চং বলে,—”এই ঘরে তুমি থাকবে মিস্ রায়। এ—ঘরে তোমার কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হবে না। তুমি বসো—দাঁড়াতে তোমায় হবে না।”

একখানা চেয়ারে ভর দিয়ে শিখা দাঁড়ায়, বলে—”অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু একটা কথা—”

লি চং বলে—”বলো।”

শিখা বলে—”আমায় কতকাল এমনভাবে বন্দী থাকতে হবে?”

লি চং একটু হাসে, বলে—”খুব বেশী দিন নয় মিস্ রায়। আমাদের এখানকার জাল গুটোবার সময় হয়ে এসেছে। হয়তো মাসখানেকের মধ্যেই আমাদের এখানকার কাজ শেষ হয়ে যাবে। যতদিন না হয় তোমাকে একটু….মানে….তোমার কোনো চিন্তা নেই! মেয়েদের আমি কোনো অনিষ্ট করি না—কাকেও করতে দিই না। তুমি এখানে যাতে এতটুকু কষ্ট বোধ না করো—সে ব্যবস্থা করেছি। শুধু ঘরের গণ্ডীর মধ্যে তুমি আটকে থাকবে—এই! তুমি বাইরে থাকলে আমাদের নানা ঝঞ্ঝাটে পড়তে হতে পারে—তাই শুধু তোমাকে কষ্ট দেওয়া—আশা করি এজন্য তুমি কিছু মনে করবে না, এবং এ—ক’টা দিন কাটিয়ে দেবে লক্ষ্মী মেয়ের মতো।”

তার কথা শুনে যে সঙ্কোচ শিখার মনে ছিল, তা দূর হয়ে গেল। সে বললে ”আপনার এ—কথায় আমি সত্যিই বড় খুশী হয়েছি। কিন্তু একটা কথা, আমাকে কোথায় রাখা হয়েছে জানতে পারি?”

লি চং উত্তর দিলে—”তুমি রাজবাড়ীতেই আছ, অন্য কোথাও তোমায় সরানো হয় নি।”

শিখা শান্তকণ্ঠে বললে—”আমি আপনার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছি। মাপ করবেন—আপনার কাছে ভরসা পেয়েই প্রশ্ন করবার সাহস পাচ্ছি। আমি শুধু জানতে চাই, আপনি নিজে জন্মেছেন অভিজাত ঘরে—পণ্ডিত, জ্ঞানী, তবে কেন এসব কাজ করেন—কেন এই আউলিংয়ের মতো লোকদের দিয়ে কাজ করান?”

হেসে ওঠে লি চং—পকেট থেকে সিগারেট বার করে সেটি ধরাবার সঙ্গে সঙ্গে বলে—”শোন মিস্ রায়, লি চংয়ের কাজের বিচার করবার শক্তি এ পর্য্যন্ত কারও হয় নি; লি চং দুর্দ্ধর্ষ, লি চং দুনিয়ার অসাধ্য সাধন করতে পারে—এই কথাটা দেশ—বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি কাকেও কৈফিয়ৎ দেই নি সত্য—দেবও না। তুমি একটুখানি মেয়ে, আমি জানি—বড় কম অত্যাচার লাঞ্ছনা তোমাকেও সইতে হয় নি, আর সেইজন্যই পরের উপকার ব্রত তুমি গ্রহণ করেছো। এই জন্য—শুধু এই জন্যই তোমার তারিফ করছি—বন্ধু রুমার বিপদ বুঝে তার কাজ করতে তুমি দাসীরূপে এখানে এসেছো। হ্যাঁ, তোমায় বলছি—তুমি যা বলছো সব সত্য, আমিই এখানে কোকেনের ব্যবসা করছি—এই রাজাবাহাদুরকে যে কোনোরকমেই হোক হাতে রেখেছি। তুমি সেই ক’জন পুলিশ অফিসার নিয়ে একটা গ্রামে প্লেনের খোঁজ করতে গিয়েছিলে তাও জানি। তুমি জানো না মিস্ রায়, ও রকম বহু পুলিশ অফিসার আমার হাতে ঢিট হয়ে গেছে—”

সে হেসে উঠলো—তার মুখ কদর্য্য দেখাচ্ছিল। একবার তাকিয়ে দেখে শিখা মুখ ফিরালো।

লি চং উঠে দাঁড়ায়—”আচ্ছা, আমি যাচ্ছি এখন মিস্ রায়। হ্যাঁ, যাওয়ার সময় বলে যাচ্ছি, তোমার ঘর থেকে আমাদের বংশের প্রতীক মহাজ্ঞানী বুদ্ধের মূর্ত্তিটি আমি নিয়েছি। অনেকদিন আগে গ্ল্যাসগো হতে ফিরবার সময় ও—মূর্ত্তি আমার কেবিন থেকে চুরি যায়, তারপর ওটি পাওয়ার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। আমার দলের লোক সুধীরবন্ধু তোমার ঘরে ওটি দেখতে পেয়ে এসে জানায়। শুনেছি একজন লোক ওটি তোমার কাকাকে উপহার দিয়েছিল,—তিনি আবার তোমাকে দিয়েছিলেন। সুধীর একদিন তোমার বাড়ী থেকে ওটা সরিয়ে এনে দেয় আমার দলের লোক মিসেস্ লিং—এর কাছে। সে ওটাকে তার ড্রয়ারে রেখেছিল, তুমি আবার ওটা সরিয়ে ছিলে। যাই হোক,আমি আবার সেটা পেয়েছি, আমার সৌভাগ্য। আচ্ছা আজ এই পর্য্যন্ত। তোমায় বলে যাচ্ছি মিস্ রায়, খাওয়া—দাওয়া করো, আমার লোক সর্ব্বদা দরজায় থাকবে—তোমার যা দরকার তাকে জানিও।”

সে বিদায় নিয়ে বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

এগারো – ফটক-পার

দিন চলে যায়। কিন্তু শিখার দিন যেন আর কাটতে চায় না। কথা বলার একটি লোক নেই। একজন চীনা নিত্য দু’বেলা তার খাবার দিয়ে যায়, চা—রুটি দিয়ে যায়, তার ভাষা যেমন শিখা বোঝে না, শিখার ভাষাও তেমনি সে বোঝে না।

তিন—চারটি আলমারি ঠাসা বই। কিন্তু একঘেয়ে বই পড়তে ভালো লাগে না।

ঘরটা অনেক ভালো। যে ঘরে আগে শিখাকে রাখা হয়েছিল, সে ঘরের কথা মনে হ’লে শিখার যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।

এ—ঘরের বাইরে কি হচ্ছে কে জানে? আটক হওয়ার আগে রুমার সঙ্গিনী হয়ে এসে প্রায় প্রতি দিন সে রঞ্জিতের হাত দিয়ে গোপনে মাকে পত্র পাঠিয়েছে। আজ কয়দিন মা কোনো খবর পান নি। কত দুর্ভাবনা তাঁর মনে—কাকা হয়তো যতীন্দ্রনাথকে খবর দিয়েছেন,—সকলে ভাবছে, অথচ কেউ জানে না সে কোথায় আছে?

রাত্রে নীল বালবের মৃদু আলো জ্বলে ঘরে—সে আলোয় লেখাপড়ার কাজ চলে না, শিখা তাই আহারের পর শয্যার আশ্রয় নেয়।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে আসছে, হঠাৎ একটা শব্দে তন্দ্রার ভাবটা দূর হয়ে যায়,—মনে হলো সন্তর্পণে কে দরজা খুলছে।

”কে—কে দরজায়?”

দরজা ততক্ষণে খুলে যায়, মৃদু নীল আলোয় দেখা যায় আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা এক মূর্ত্তি। আতঙ্কে বুকের রক্ত জমাট বেঁধে ওঠে। শিখা উঠতে যায়—কিন্তু মুহূর্ত্তে যেন শক্তি হারিয়ে যায়—মূঢ়ের মতো চোখ মেলে শুধু চেয়ে থাকে।

মূর্ত্তি এগিয়ে আসে—মুখের আবরণ খোলে, বলে—”ভয় পাবেন না মিস্ রায়, আমি সুধীর—সুধীরবন্ধু।”

”সুধীরবন্ধু!”

এতক্ষণে শিখা সাহস পায়—সে উঠে বসে।

”আপনাকে একদিন আমার বাড়ীতে দেখেছিলাম বটে, সেদিন আপনি চরের কাজ করতে গিয়েছিলেন। অবশ্য চুরি যেদিন করেছিলেন, সেদিন আমি আপনাকে দেখি নি। যাক, এ রাত্রে এ—বেশে আমার ঘরে কি মতলবে?”

সুধীরবন্ধু কি বলতে গিয়ে থেকে যায়, মুহূর্ত্ত নীরব থেকে বলে—”যদি বলি আপনাকে মুক্তি দিতে এসেছি?”

শিখা দারুণ অবজ্ঞায় মাথা নাড়ে।

সুধীরবন্ধু আর এক পা এগিয়ে আসতেই শিখা তীক্ষ্ন কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে—”খবরর্দ্দার—আর এক পা—ও এগুবেন না! জানেন, আপনার মালিক লি চং আমার সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা করেছেন? আপনাদের উপর কি তাঁর হুকুম?”

”আমার মনিব লি চং!”

হেসে ওঠে সুধীরবন্ধু—”আপনি থামুন মিস্ রায়, ও কথা আর বলবেন না। আপনি জানেন না, আমি তাকে কতখানি ঘৃণা করি, কতখানি ঘৃণা করি ওর সহকর্ম্মী আউলিংকে। কিন্তু এখন সে কথা থাক, দু—একদিনের মধ্যে সবই প্রকাশ পাবে। হ্যাঁ, আপনি আসুন মিস্ রায়, আপনাকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমি এসেছি।”

শিখা জিজ্ঞেস করলে—”কিন্তু দরজায় পাহারা?”

”সে এতক্ষণ ইহজন্মের হিসাবের জন্য তৈরী হচ্ছে। আসল কথা শুনুন, আপনি এর আগে যে ঘরে ছিলেন—সেই ঘরে সে মহা আরামে পড়ে আছে। কাল আপনি তাকে মুক্তি দিতে পারবেন। আসুন, দেরী করলে আমরা দু’জনেই বিপদে পড়বো। লি চং আজ বোম্বাই গেছেন—মহামতি আউলিং অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। বাকি যারা, কাল সকাল সাতটার আগে জাগবে না—আপনি এখন স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে আপনার পরিচিত রঞ্জিতের সঙ্গে বাড়ী যেতে পারবেন!…”

”রঞ্জিত! তাকে কোথায় পেলেন?”

শিখা বুঝতে পারে না, মনে হয় সুধীরবন্ধু তাকে উপহাস করছে।

সুধীরবন্ধু হাসে, বলে,—”রঞ্জিত বাইরে অপেক্ষা করছে। কিন্তু আপনি আর দেরী করবেন না মিস্ রায়, এর পর সব আয়োজন পণ্ড হয়ে যাবে। যে দেবতার কথা বলেন, সেই দেবতার নামে আমি শপথ করছি, বিশ্বাস করুন মিস্ রায় সত্যিই আপনাকে এখান থেকে মুক্তি দিতে এসেছি।”

শিখা বললে,—”কিন্তু লি চং কথা দিয়েছে, একমাস পরে আমায় সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হবে। সে একমাস পূর্ণ হতে মাত্র আর দশদিন বাকি—এই দশটা দিনের জন্যে আবার কেন নিজেকে বিপন্ন করি বলুন?”

সুধীরবন্ধু বললে—”তা নয়, আমি বেশ বুঝছি আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাবছেন, আপনাকে আরো বেশী বিপদে ফেলবার জন্যই আমি আপনাকে সরাবার চেষ্টা করছি। জানি না, কি করলে আপনার বিশ্বাস হবে—আমি—”

বলতে বলতে হঠাৎ সে উৎকর্ণ হয়ে কি শোনে, তারপর ত্রস্তে বেরিয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ হয়।

একটু পরেই বাইরে ভারী জুতার শব্দ শোনা যায়। কে যেন মস মস করে কাছে এলো। তারপরই আউলিংয়ের কর্কশ কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়—বাঁকা হিন্দিতে সে কাকে সম্বোধন করে বলে,—”রামরতন—হুঁসিয়ার রহো!”

”জী—হুঁসিয়ার।”

আউলিং চলে, তার ভারী জুতার শব্দ শোনা যায়। সে শব্দ দূরে—আরো দূরে মিলিয়ে যায়—রাজবাড়ীর পেটা—ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজে।

দরজাটা আবার আস্তে আস্তে খুলে যায়। সুধীরবন্ধুর চাপা কণ্ঠ কানে আসে—”শীগগির চলে আসুন মিস্ রায়—এরপর আর মুক্তি পাবেন না। আপনি বাঙালী, আমিও বাঙালী, তাই আমি নিজের জীবন বিপন্ন করেও আপনাকে বাঁচাতে চাই। সেই জন্যেই রামরতনকে নেশায় বেহুঁশ অবস্থায় পাতালপুরীর ঘরে বন্ধ করে রেখে তার বেশে আমি পাহারা দিচ্ছি। লি চং ফেরার পরে আপনার আর মুক্তি হবে না, এরা আপনাকে আর রুমাকে নিয়ে যাবে কোথায় কে জানে। আপনাকে মিনতি করছি আপনি নিজে বাঁচুন আর রুমাকে বাঁচান, রাজাবাহাদুরকে মানুষ হয়ে বাঁচতে দিন।”

শিখা সচকিত হয়ে ওঠে, সুধীরবন্ধুকে আর অবিশ্বাস করতে পারে না।

এক পা এক পা করে অগ্রসর হয় সে—”চলুন, আমি যাচ্ছি—”

দুজনে আসে বাগানে। বাগানে অপেক্ষা করছিল রঞ্জিত। তাকে দেখে সুধীরবন্ধু বললে—”একটুও দেরী নয় রঞ্জিত, মিস্ রায়কে নিয়ে সোজা লালবাজারে গিয়ে উঠবে। ওখানে গেলে মিস্ রায়ই সব ব্যবস্থা করে দেবেন, যাও। দেরী করো না।”

”আর তুমি? তুমি কি করবে? তুমিও এসো।”

রঞ্জিত সেই অন্ধকারেই সুধীরবন্ধুর হাত চেপে ধরে। সুধীরবন্ধু বলে—”পাগল! আমি গেলে রুমা, রুমার বাবা—ওদের কে দেখবে? তাছাড়া ভয়ের কিছু নেই। আমি এমন কোনো চিহ্ন রাখি নি, যাতে ধরা পড়বো।”

গুড়ুম—! কোথা হতে রিভলভারের শব্দ কানে আসে।

”সর্ব্বনাশ! পালাও—পালাও তোমরা—”

প্রাচীরের মাঝখানকার সেই ছোট দরজাটা খুলে একরকম ধাক্কা দিয়েই সুধীরবন্ধু শিখা আর রঞ্জিতকে বার করে দিলে!

বারো – সম্ভাবনা

ক্রিং—ক্রিং—ক্রিং—ফোন বাজে।

আচমকা ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে পড়েন যতীন্দ্রনাথ।

এত রাত্রে কে ডাকে?

দ্রুত তিনি রিসিভার ধরেন।

”কে? শিখা! সত্যই তুমি? কখন ফিরলে?….এখনই? ও, হুঁ…আর্ম্মফোর্স? কোথায়? আলিপুরে কুইনস প্যালেসে? অর্থাৎ রাজা বিজয়েন্দ্রনারায়ণের প্যালেস ঘিরে ফেলতে হবে? নাঃ—কারণটা ঠিক বুঝছি না কিনা। ও—আচ্ছা, আমি এখনই ব্যবস্থা করছি। আমি এখনই লালবাজারে কনট্রোলে ফোন করে দিচ্ছি….এখুনি রেডি হবে।”

উঠে পড়লেন তিনি। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে শ্যালক অপূর্ব্বকে ডাক দেন—তিনি পাশের কামরায় ঘুমোচ্ছিলেন। স্ত্রী শারীরিক অসুস্থতার জন্য পিত্রালয় বীরভূমে গেছেন, এখানে যতীন্দ্রনাথ আর অপূর্ব্ববাবু থাকেন।

”আরে, উঠে পড় হে, এখুনি বেরুতে হবে—অস্ত্র—শস্ত্র নিয়ো—রিক্ত হাতে নয়।”

বিরক্ত হয়ে অপূর্ব্ব উঠে বসলেন। বললেন—”রাতদুপুরে হঠাৎ সাজগোজের ধুম কেন, এই তো শোবার সময় বললে, আজ ডিউটি নেই, একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে।”

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কথায় বলে, ভগবানের মার দুনিয়ার বার। সাংঘাতিক কাণ্ড এদিকে—”

”কি! খুন? আগুন—ডাকাতি—”

সচকিত হয়ে ওঠেন অপূর্ব্ব—শয্যা ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়েন।

যতীন্দ্রনাথ বললেন—”কি ব্যাপার জানি নে। মোটকথা তুমি তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও, আমার সঙ্গে এখুনি লালবাজারে যেতে হবে।”

অপূর্ব্ব চটপট প্রস্তুত হয়।

উভয়ে জীপে করে যখন লালবাজারে এসে পৌঁছালেন, রাত তখন দুটো।

তাঁরা যখন গেটের কাছে, পাশ দিয়ে উল্কাগতিতে একখানা মোটর ছুটে গেল লালবাজারের সামনে দিয়ে।

বিস্ময়ে যতীন্দ্রনাথ তাকিয়ে থাকেন, একটি মাত্র শব্দ তাঁর মুখে ফুটলো—”আউলিং!”

তাঁর জীপ তখন থেমে গেছে।

অপূর্ব্ব জিজ্ঞাসা করেন—”আউলিং মানে?”

যতীন্দ্রনাথ উত্তর দেন,—”আলোটা ঠিক আউলিংয়ের মুখের উপর পড়ায় ওকে চিনতে পেরেছি। এখন বুঝছি, শিখা পালিয়ে এসেছে—সে খবর ওরা পেয়েছে। আর কোথাও শিখা যাবে না—সোজা লালবাজারে আশ্রয় নেবে জেনেই সে এখান দিয়ে ঘুরে গেল। যেটুকু তার সন্দেহ ছিল, আমাকে এখানে দেখে তার সে সন্দেহ ঘুচে গেছে।”

অপূর্ব্বকে নিয়ে সোজা তিনি উঠে পড়লেন।

শিখা আর রঞ্জিত সোজা এখানে চলে এসেছে। নিজেদের বাড়ীতে যাওয়ার সাহস হয়নি শিখার—কে জানে দুর্দ্দান্ত আউলিংয়ের পক্ষে সেখানে এই রাত্রে হানা দেওয়া বিচিত্র নয়।

যতীন্দ্রনাথ সংক্ষেপে যেটুকু শুনতে পান তাই যথেষ্ট।

সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সহ তিনি আলিপুরের দিকে সেই মুহূর্ত্তে রওনা হন। শিখা তাঁর সঙ্গে চললো। তাকে তিনি নিতে চান নি—বলেছিলেন—”তুমি অত্যন্ত ক্লান্ত মিস্ রায়, সকাল পর্য্যন্ত এখানে অপেক্ষা কর, বড় জোর একঘণ্টা পরেই সকাল হয়ে যাবে, এখানেই তুমি সব জানতে পারবে।”

শিখা জিদ করে—”আমি মোটেই ক্লান্ত নই, তাছাড়া আমি সঙ্গে না থাকলে আপনার কোনো কাজ হবে না,—রাজবাড়ীর কোথায় কি আছে তা আপনি জানতে পারবেন না যতীনবাবু—।”

পুলিশ কমিশনারের নির্দ্দেশে শিখাকে সঙ্গে নিতে হ’ল।

তেরো – শ্মশানে

আশ্চর্য্য! রাজবাড়ী একেবারে নিঝুম—নিস্তব্ধ। ঘরে বাইরে আলোর একটুও রশ্মি দেখা যায় না।

পুলিশ বাহিনী নিঃশব্দে বিরাট রাজপুরীটা ঘিরে ফেলেছে—গেটের দু’জন সশস্ত্র নেপালী দ্বারোয়ানকে আগেই গ্রেপ্তার করে পুলিশভ্যানে তুলে নেয়।

ক’জন পুলিশ নিয়ে যতীন্দ্রনাথ, অপূর্ব্ব, শিখা ও মিষ্টার ব্রহ্ম সদর গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। নিস্তব্ধ প্রাঙ্গণ—পুলিশের ভারী জুতার শব্দে শব্দায়িত হয়ে উঠলো।

কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। মাত্র ঘণ্টাখানেক আগে মোটরে আউলিংকে না দেখলে হয়তো সন্দেহের কারণ থাকতো না। সেইজন্যই শিখা বললে,—”আমার মনে হয়, ওরা সরে পড়েছে। যে কোনোরকমেই হোক, আমার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আউলিং জানতে পেরেছে, এবং একঘণ্টা সময়ের মধ্যে সরে পড়াটা কিছু বিচিত্র নয় যতীনবাবু!”

যতীন্দ্রনাথের আদেশে একজন কনষ্টেবল সদর দরজায় আঘাত করে—দরজা খুলে দেওয়ার আদেশ জানায়।

ভিতর থেকে দরজা খুলে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে রাজাবাহাদুরের সরকার ব্রিজনন্দন—সামনে পুলিশ দেখে সে থতমত খেয়ে যায়—দু’হাতে চোখ মুছে ভালো করে তাকায়।

মিঃ ব্রহ্ম বললেন,—”এই যে ঘুম ভেঙেছে! নাও বাপু, আড়মোড়া ছেড়ে একটু সিধে হয়ে দাঁড়াও! যা জিজ্ঞেস করি, সোজা জবাব দাও।”

সরকার ব্রিজনন্দন এতখানি হাঁ করে চেয়ে থাকে মাত্র।

শিখা এগিয়ে আসে—বুঝতে পারে ব্রিজনন্দন সদ্য ঘুম ভেঙে পুলিশ দেখে ভয় পেয়েছে। শান্তকণ্ঠে সে বললে,—”তুমি রাজাবাহাদুরকে খবর দাও ব্রিজনন্দন—আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। জানাও পুলিশ কমিশনারের হুকুমে আমরা এসেছি।”

সারা বাড়ীতে আলো জ্বলে ওঠে। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উপরে রুমার আর্ত্ত চীৎকার শোনা যায়—”ও বাবা, বাবা—বাবা—বাবা—গো”

ত্রস্ত হয়ে ওঠে শিখা—রুমা কাঁদছে—নিশ্চয় রাজাবাহাদুরের কিছু হয়েছে; হয়তো রুমা যা আশঙ্কা করেছিল তাই—

দ্রুত সে উপরে উঠে যায়। সঙ্গে সঙ্গে চলেন মিঃ ব্রহ্ম আর যতীন্দ্রনাথ।

রাজাবাহাদুরের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে স্তম্ভিতভাবে দাঁড়ায় শিখা।

চেয়ারশুদ্ধ মেঝেয় পড়ে আছেন রাজাবাহাদুর। আর রুমা তাঁর বুকের ওপর ঝুঁকে পড়ে আর্ত্তরবে কাঁদছে।

রাজাবাহাদুরের বুকে রক্ত….গুলি বিঁধেছে। দেখে বোঝা যায় অনেক আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ছে।

শিখার সান্ত্বনায় রুমা প্রবোধ মানে না, দু’হাতে শিখার গলা জড়িয়ে ধরে ফুলে ফুলে সে কাঁদে—”বাবা আর বেঁচে নেই শিখা! এত চেষ্টা করেও তোমরা আমার বাবাকে বাঁচাতে পারলে না?”

শিখার চক্ষুও শুষ্ক ছিল না—তবু কর্ত্তব্যবোধেই সে রুমাকে তার নিজের ঘরে নিয়ে, তার দাসীর জিন্মায় তাকে রেখে যখন সে রাজাবাহাদুরের ঘরে এলো, তখন মিঃ ব্রহ্ম ও যতীন্দ্রনাথ ঘর আতিপাতি করছেন।

মৃতের ঘরের কোণে একখানা খাতা পড়ে আছে, সে দিকে কেউই তাকান নি। শিখা খাতাখানা দেখতে পেয়ে তুলে নেয়।

রাজাবাহাদুরের হাতের লেখা শেষ পৃষ্ঠাটা দেখে মনে হয়—এই পর্য্যন্ত লিখতে লিখতে দুশমন এসে খাতাখানা কেড়ে তলায় ছুড়ে ফেলে দেয়—ক’খানা পাতা তাই দুমড়ানো মচকানো—

স্তব্ধ বাড়ী মুখর হয়ে ওঠে। ডাক্তার আসেন। মৃতদেহ পরীক্ষা করে জানান—অন্ততঃ চার ঘণ্টা আগে—রাত্রি বারোটা থেকে একটার মধ্যে কেউ তাঁকে হত্যা করেছে।

খুনের লাশ! ময়না তদন্ত হবে। এমন শোচনীয় মৃত্যু—তার উপর পোষ্টমর্টেমের অপমান—সংস্কারে কতখানি বাধবে!

পুলিশ লাশ নিয়ে যাবে শুনে রুমা আরো কাঁদে—সে বলে,—”এর উপর ওঁকে নিয়ে আবার কাটা—ছেঁড়া করবেন!” শিখাকে সে জড়িয়ে ধরে। শিখা তাকায় যতীন্দ্রনাথের পানে।

মিঃ ব্রহ্ম নির্দ্দেশ দেন—ডাক্তার দেখেছেন—সব নোট করে নিয়েছেন—তাছাড়া বুক থেকে গুলি বার করা হয়েছে। খুনের প্রমাণ তো পাওয়া গেছে—তিনি দেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে জ্বালাবার আদেশ দিলেন।

তখন বেলা আটটা বেজে গেছে—খবর শুনে পুলিশ কমিশনার চললেন শ্মশানে।

মুখাগ্নি করবার সময় হ’য়ে এলো। কে করবে মুখাগ্নি! হঠাৎ একটি যুবক এগিয়ে এসে বলে—”আমি মুখাগ্নি করবার অনুমতি চাইছি স্যার, সে অধিকার আমার।”

শিখা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো, সে যুবক সুধীরবন্ধু!

যতীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন—”তোমার অধিকার?”

দৃঢ়তার সঙ্গে সুধীরবন্ধু বললে,—”আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার অধিকার। তার কারণ রাজাবাহাদুর আমার পিতা, আমার নাম জিতেন্দ্রনারায়ণ।”

”জিতেন্দ্রনারায়ণ!”

শিখা মাথা নাড়ে—”কিন্তু আপনি তো সুধীর—সুধীরবন্ধু!”

সুধীরবন্ধু উত্তর দেয়—”হ্যাঁ, আমিই জিতেন্দ্রনারায়ণ। রুমা আমাকে জানে, আর জানে আমার বন্ধু সোমনাথ—রুমার বাগদত্তা স্বামী—যাকে আপনি রঞ্জিত বলে চেনেন মিস্ রায়। পাঁচ বৎসরের মধ্যে আমি অনেক চেষ্টায় ছদ্মবেশে লি চংয়ের দলে যোগ দিয়ে ওদের বিশ্বাসযোগ্য অনেক কাজ করেছি—যাতে ওরা আমাকে মোটেই অবিশ্বাস করতে পারে নি। রুমাকে আমি দিন কয়েক আগে জানিয়েছি—পাছে আমার বিপদ হয় সেইজন্যে সে একথা একেবারে গোপন করে গেছে। আমি আমার অধিকার নিয়ে আমার পিতার মুখাগ্নি করবো বলে প্রার্থনা করছি, আশা করছি আপনাদের বিশ্বাস হবে।”

আত্মীয়স্বজনেরা জিতেন্দ্রনারায়ণের স্বমূর্ত্তিতে সন্দেহ করেন না। ছদ্মবেশে তাকে যে রকম দেখেছিল—শিখার সেই মূর্ত্তিই ছিল পরিচিত,—আজ সুধীরবন্ধু ও রঞ্জিতের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে সে বিস্মিত হলেও খুশী হ’ল কম নয়।

আসামীদের সন্ধান পাওয়া যায় না। রাত্রিতে সুচতুর আউলিং জেনেছে রঞ্জিতের সঙ্গে শিখা পলায়ন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে মিসেস্ লিং ও সে—বাড়ীতে তাদের দলের যত লোক ছিল সকলকে নিয়ে পিছনে বাগানের দ্বারপথে পলায়ন করেছে।

এখানে তাদের কাজের বহু নিদর্শন পাওয়া গেল। ভূগর্ভস্থ একটা ঘরে পাওয়া গেল জাল নোট তৈরী করবার যন্ত্রাদি, নানা উপকরণ, রাশীকৃত নোটও সেখানে পাওয়া গেল। আর একটা ঘরে পাওয়া গেল প্রচুর পরিমাণ কোকেন—যা সম্প্রতি আমদানী হয়েছে। এগুলি এখনও ছাড়া হয়নি, গোলমালটা একটু মিটলে লি চংয়ের অনুমত্যানুসারে আউলিং এগুলির ব্যবস্থা করবে, নির্দ্দিষ্ট ছিল।

শিখা বললে—”চমৎকার ঘাঁটি এরা তৈরী করেছিল। রাজাবাহাদুরের নাম আছে, সবাই তাঁকে সম্ভ্রম করে। তাঁকে সামনে খাড়া রেখে অতি সহজে এরা যে কোনো কাজ করেছে—কেউ সন্দেহ মাত্র করতে পারে নি।”

পুলিশ কমিশনার বললেন—”এসব কথা চিরদিনই গোপনে থেকে যেত মিস্ রায়, যদি আপনি কোকেনের তদন্তভার না নিতেন। এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ—এই দলটিকে গ্রেপ্তার করা। না হলে এরকম কাজ বন্ধ হবে না—ওদের ব্যবসা অব্যাহত থাকবে। ওরা এখনও কলকাতা ছেড়ে যেতে পারে নি, এ গোলমাল না মিটলে যেতে পারবে না, কাজেই চেষ্টা করলে আজ না হোক—কালও ধরা পড়তে পারে।”

বাড়ীতে উপযুক্ত পাহারার ব্যবস্থা করে পুলিশ দল বিদায় নিলেন—শিখাও মায়ের কাছে ফিরলো।

চৌদ্দ – কর্ম্মফল

লি চংকে পাওয়া গেল না। খবর পেয়ে বোম্বাই থেকে সে সরে গেছে সোজা আমেরিকায়।

দমদমের উপকণ্ঠে একটা বাড়ীতে ধরা পড়লো আউলিং, মিসেস্ লিং, এবং দলের বহুলোক।

এও ঘটলো শিখার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফলে। রাজাবাহাদুরের ডায়েরীতে সে এখানকার সবগুলো ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছে। তাই বিলম্ব না করে সে সেইদিনই যতীন্দ্রনাথ আর পুলিশ বাহিনী সহ সে বাড়ীতে হানা দিয়ে একসঙ্গে সকলকে গ্রেফতার করতে পেরেছে। ধরা পড়বার পর বাঘের মতো গর্জ্জন করে আউলিং বলেছিল—কোনোদিন না কোনোদিন সে মুক্তিলাভ করবেই, তখন দেখে নেবে বাঙালী মেয়ে অগ্নিশিখা রায়কে—তিলে তিলে তাকে সে হত্যা করবে।

শিখা অবজ্ঞার হাসি হাসে।

আসামীদের বিচার হয়।

বিচারালয়ে প্রধান সাক্ষী কুমার জিতেন্দ্রনারায়ণ। তিনি জানান, পাঁচ বৎসর আগে এই দুর্ব্বৃত্ত আউলিং—এর আদেশে তার অনুচর কুমারকে হত্যা করার জন্যই পাহাড়ের উপর থেকে ফেলে দেয়, কিন্তু নেহাৎ বরাত জোর, পাহাড়ের গায়ে ঝাঁকড়া একটা গাছ ছিল, সেই গাছের ডালে কোনোমতে তিনি আটকে থাকেন, নীচে পড়েন নি! এমনি করে সে যাত্রা তিনি রক্ষা পান। পরে অতিকষ্টে পাহাড় থেকে নেমে কোনোমতে তিনি গোপনে এসে এক জায়গায় আশ্রয় নেন—কিন্তু আত্মপ্রকাশ করে আবার সকলের সামনে উদয় হতে ভয় হয়। ওরা যখন মারবে পণ করেছে, তখন ছাড়বে না। এইজন্য ছদ্মবেশে ছদ্মপরিচয়ে এতকাল বাস করে আসছেন। তবে তিনিও মনে মনে পণ করেছিলেন, এদের ধরিয়ে সাজা দেওয়াবেন! তাই এদেরই দলে ছদ্মবেশে ছদ্মপরিচয়ে যোগ দেন। এমনভাবে আত্মগোপন করেছিলেন, লি চং—এর মতো ধূর্ত্ত ব্যক্তিও কোনোদিন তাঁকে সন্দেহ করতে পারে নি। এদের দলে মিশে দেখেন—পিতাজীকে এরা এমনভাবে সমস্ত কাজে জড়িয়েছে যে, এদের ধরাতে গেলে পিতারও বিপদ অনিবার্য্য! জিতেন্দ্রনারায়ণ জানেন, পিতাজী সত্যই দোষী নন। তিনি শুধু নিমিত্তের ভাগী ছিলেন। যত কিছু অন্যায় এরা করেছে, পিতাজী তার সব খবর জানতেনও না—এমন ঘটনাও আছে।

সুধীরবন্ধু নাম নিয়ে তিনি এখানে এসেছেন—রুমাকে গোপনে তাঁর পরিচয় দিয়ে আশ্বস্ত করেছেন। পিতাকে এদের কবল হতে রক্ষা করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। শিখার পলায়ন জানা মাত্রই আউলিং রাজাবাহাদুরের কাছে যায়, এবং শিখার পলায়ন তাঁর দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে—এই সন্দেহে তাঁকে গুলি করে রাজবাড়ী ত্যাগ করে।

কুমার বাহাদুরের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। রুমাকে আসতে হয় নি, তার সাক্ষ্য বাড়ী হতেই গৃহীত হয়েছে। তারপর সাক্ষী শিখা।

রাজাবাহাদুরের ডায়েরীখানা শিখা কোর্টে দাখিল করলে এ ডায়েরীতে এদের ষড়যন্ত্রের কথা এবং কোন দিন কি ঘটনা কোথায় ঘটেছে সবের উল্লেখ ছিল।

আদালতের বিচারে আউলিংয়ের হয় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ। দলের প্রত্যেকে যথাযথ দণ্ডিত হয়। মিসেস্ লিং দীর্ঘকালের জন্যে কারাবাস দণ্ড পান।

বন্দীরা প্রহরী বেষ্টিত অবস্থায় কারাগারে যায়।

দর্শকদের সঙ্গে শিখাও বাইরে আসে।

মোটরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুমার বাহাদুর। এগিয়ে এসে শিখাকে অভিনন্দন জানান। বলেন—”আপনাকে এখন আমার ওখানে একবার নিয়ে যেতে চাচ্ছি মিস্ রায়, রুমার একান্ত অনুরোধ, আশা করছি অমত করবেন না।”

ধন্যবাদ জানায় শিখা, বললে—”আজ আমি বড় ক্লান্ত কুমার বাহাদুর, রুমাকে বললেন—কাল সকাল সাতটায় আমি আপনাদের সঙ্গে চা পান করতে যাব। দয়া করে তাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন, সে যেন আমায় ক্ষমা করে।”

কুমার বাহাদুরকে অভিবাদন করে শিখা যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মোটরে উঠে বসলো।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *