০৬. দুর্গম পথে শিখা

দুর্গম পথে শিখা

এক – টেলিগ্রাম

কলেজে এক বিরাট অভ্যর্থনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন, প্রাক্তন ছাত্রী অগ্নিশিখা রায়কে সম্বর্দ্ধনা জানাবার উদ্দেশ্যে।

পর পর অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর অপরাধের কিনারা করে ভারতের বহু দুর্দ্ধর্ষ অপরাধীদের দণ্ডের ব্যবস্থা করায় শিখার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশ জুড়ে।

বাঙালী মেয়ের এই অভাবনীয় কৃতিত্বে প্রত্যেক বাঙালীই আজ গর্ব্ববোধ করে। শিখা যে কলেজে পড়তো সেখানকার ছাত্রীরা ও অধ্যাপকমণ্ডলীও তার জন্য গর্ব্ববোধ করে থাকেন। এই জন্যই ষ্টুডেণ্ট ইউনিয়ন থেকে যখন শিখাকে সম্বর্দ্ধনা জানাবার প্রস্তাব উত্থাপিত হলো তখন বিনা প্রতিবাদেই গৃহীত হলো সে প্রস্তাব। অধ্যাপকমণ্ডলীও খুশী হ’লেন ছাত্রীদের এই প্রস্তাবে। তাঁরাও যোগ দিলেন সেই সভায়।

শিখার গাড়ীখানা কলেজ—প্রাঙ্গণের মধ্যে ঢুকতেই ছাত্রীদের সে কি জয়ধ্বনি! কুমারী শিখা জিন্দাবাদ—আমাদের অগ্নিশিখা দীর্ঘজীবিনী হোক—শিখার কীর্ত্তির দীপ্ত কিরণ দিকে দিকে আলোর ফুলঝুরি ইত্যাদি…ইত্যাদি।

ক্লাশে শিখার পাশেই বসতো বিনতা। শিখার কণ্ঠে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে সে বলে উঠলো—

 এসো এসো গো বিজয়—লক্ষ্মী

 দিব জয়মালা তব কণ্ঠে!

কলেজে শাঁখ কোথায় পাবে? মেয়েরা করতল পুটবদ্ধ করে উলু দিয়ে উঠল।

কাগজে—কাগজে শিখার কীর্ত্তির কথা প্রকাশিত হচ্ছে আজকাল। কাগজে—কাগজে ছাপা হয়েছে শিখার ছবি।

এর পর সভায় আসেন প্রফেসর রাজকুমার সেন। শিখাকে উদ্দেশ্য করে তিনি দেন বিরাট এক লেকচার—শিখার আদর্শে বাঙলার মেয়েরা উদ্বুদ্ধ হোক—অন্যায়—অধর্মের বিরুদ্ধে চলুক তাদের অভিযান! মঙ্গলময়ী নারী রূপে করুক তারা সমাজের মঙ্গল—দেশের মঙ্গল!

এমনি ভাবে চললো শিখার সম্বর্দ্ধনা। সভা শেষ হলে তার কয়েকজন সহপাঠিনী একজোট হয়ে শিখাকে ধরে বসে—রাত্রে তোমার ওখানে আমরা আজ খাবো। এর আর ছাড়ান চলবে না!

রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই!

কলেজ থেকে ফেরবার সময় সঙ্গে এসেছে এরা চারজন,—বাকিরা আসবে সন্ধ্যার পর।

বৈঠকখানায় বন্ধুদের বসিয়ে শিখা মায়ের কাছে যায়।

দোতলার ঘরে মা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন জানালার কাছে—হাতে একখানা টেলিগ্রাম।

উৎসুক হয়ে ওঠে শিখা, জিজ্ঞাসা করে—”কার টেলিগ্রাম মা? কোথা থেকে এল?”

মা শুষ্ক—কণ্ঠে বলেন—”টেলিগ্রাম করেছেন তোমার কাকা। বিশেষ দরকারে তোমাকে যেতে লিখেছেন।”

কাকা। কাকা তো এখন রয়েছেন রায়পুরে—সি—পি—তে। তাঁর শরীরটা কিছুদিন থেকে ভেঙ্গেছে। রায়পুরে তাঁর বন্ধু গভর্ণমেণ্ট—প্লীডার চৌধুরী সাহেব আছেন। তিনিই জোর করে তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। সেখানে মাসখানেক অন্ততঃ তিনি মেজর রায়কে আটকে রাখবেন।

টেলিগ্রামখানা দেখল শিখা।

আজ এসেছে তার বন্ধুরা—তাদের আবদার, এখানে সকলে খাবে। শুনে মা সব ভাবনা শিকায় তুলে আয়োজন করতে ছুটলেন।

একটা কিছু ঘটেছে! না—হলে কাকা কখনও এমন জরুরী টেলিগ্রাম করতেন না! তাকে যাবার জন্য টেলিগ্রাম! আজকের দিনের হাস্য—কৌতুকের মধ্যে বার—বার সেই কথাই শিখার মনে হচ্ছিল। তবে কি সেই—শিখার মনে পড়ে যায় মেজর রায়ের মুখ থেকে শোনা একটা কাহিনী।

মাসখানেক আগে কাকা এখানে এসেছিলেন। সে—সময় একদিন কথায়—কথায় তিনি জালিমের কথা বলেছিলেন। তিনি তখন আরাকানে—জালিম নামে একটা লোক কাজ করতো তাঁর অধীনে মিলিটারীতে। সেখানকার ঘটনা। কিন্তু কি সে ঘটনা, তিনি ঘুণাক্ষরেও তার আভাস দেননি। নিশ্বাস ফেলে ক্লান্ত—কণ্ঠে শুধু বলেছিলেন—”জালিম আমাকে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবে না দেখছি! আমার পিছনে ও ছায়ার মত লেগে আছে। তার হাতে দেখছি, আমার নিস্তার নেই! অতিষ্ঠ করে তুলল!”

শিখা জিজ্ঞাসা করেছিল—”কেন কাকাবাবু, আপনি তার কি করেছেন, যার জন্য সে আপনাকে সর্ব্বত্র ‘ফলো’ করছে?”

মেজর রায় সে—কথার কোন উত্তর দেননি—উত্তরটা যেন ইচ্ছা করেই এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

খাওয়া—দাওয়ার পর বন্ধুরা তুমুল কোলাহলে শিখার দীর্ঘ—জীবন কামনা করে বিদায় নিল।

রাত তখন দশটা বেজে গেছে।

শ্রান্ত শিখা ঘরে ঢুকে শোবার উদ্যোগ করছে, এই সময় হঠাৎ ক্রিং—ক্রিং শব্দে টেলিফোন বেজে ওঠে। বিরক্ত হয়ে শিখা ফোন ধরে—”হ্যালো—কে? ও, বিমলদা…কি খবর?”

ফোন করছে বিমলেন্দু। বিমল বলল—”তোমার সঙ্গে একটা বিশেষ পরামর্শ আছে দিদি। হঠাৎ লালবাজার থেকে এসেছে একটা ফোন। ডেপুটি—সাহেব, কমিশনার—সাহেব দুজনের জরুরী আহ্বান—’এখনি আসতে হবে।’ গিয়েছিলুম। কাজ আছে। তোমাকে আমার দরকার। আসবো? সময় হবে কথা কইবার?”

শিখা বিরক্ত হয়। শিখা বলে—”বড় ক্লান্ত বিমলদা—আমি এখন শুতে যাচ্ছি। তুমি বরং কাল সকালে এসো। কাল সকাল সাতটায়। এখানে এসেই চা খাবে, কেমন! তোমার নিমন্ত্রণ রইল।”

বিমল জবাব দিল—”বেশ, তাই হবে। কাল সকাল সাতটায়—যত কাজ থাকুক, বেরিয়ে পড়ো না যেন!”

শিখা বলে—”না। যত কাজ আসুক, আমি কোথাও বেরুব না।”

শিখা ফোন ছেড়ে দেয়।

দুই – সহযাত্রী

সকালে ঠিক সাতটায় এসে হাজির হয় বিমলেন্দু চৌধুরী,—তরুণ পুলিশ—অফিসার।

শিখার মামার বাড়ীর দিক থেকে কি—একটু সম্পর্ক আছে,—সেই সম্পর্কে শিখার মাকে সে বলে মাসিমা এবং বয়সে বড় হলেও শিখাকে দিদি বলে ডাকে।

ভারী চটপটে চালাক চতুর ছেলে। এম—এ পাশ। গেল বছর পুলিশে কাজ পেয়েছে এবং এরই মধ্যে ক’টা কাজে বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে বেশ সুখ্যাতি লাভ করেছে।

মোটর—বাইকটা দরজার সামনে থামতেই শিখা বুঝতে পারে, বিমল এসেছে। জানালা দিয়ে চেয়ে শিখা দেখে, সে একলা আসেনি—বাইকের ‘সাইড কারে’ বসিয়ে এনেছে তার পপি—কুকুরটাকে।

এ কুকুরের সুখ্যাতিতে সে একেবারে পঞ্চমুখ। এমন কুকুর নাকি আর হয় না! অদ্ভুত এর ক্ষমতা। গন্ধ শুঁকে শুঁকে আসামীর পাত্তা খুঁজে বার করে। এ—সম্বন্ধে বিমলের মুখে শিখা কত গল্প যে শুনেছে তার ইয়ত্তা নেই। এমন সব গল্প—যা তার নিতান্ত অন্তরঙ্গ ছাড়া অপরে শুনলে বিশ্বাসই করবে না!

বিমলের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল পপি।

পপির সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনলেও পপিকে শিখা এর আগে কোনদিন দেখেনি—আজ এই প্রথম তাকে দেখল। ছোট্ট কুকুর—পুঁয়ে রোগা—দেখতে অতি সাধারণ কুকুরের মত। এতটুকু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না।

হেসে বিমল বলে—”এই আমার পপি, ভারী বুদ্ধিমান আর অত্যন্ত চালাক। চালাকিতে মানুষকেও এ হার মানায়। আমাদের বড়—সাহেব বিলেত যাবার সময়—আমি তখন ট্রেনিং—এ—এটা আমায় দিয়ে গেছেন।”

শিখা গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করে—”দেশী না বিলাতী কুকুর বিমলদা?”

বিমলের চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ সে কথা বলতে পারে না।

তারপর ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলে—”তুমি মনে করেছ কি দিদি? খাস বিলিতি কুকুর পপি। এ—দেশী লেড়িকুত্তো! কি করে তুমি এমন ভাবলে, আমি শুধু তাই ভাবছি! পপি খাস—বিলেতী! ওর জন্ম কোথায়, জানো? স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে। পপির মা এখনো সেখানে কত কাজ করছে।”

বলতে বলতে সস্নেহে সে পপির গায়ে হাত বুলোয়, বলে—”চেহারাটা হয়তো খারাপ, কিন্তু জেনো, রূপটাই সবচেয়ে বড় জিনিস নয়। আসল জিনিস হলো গুণ! ছেলেবেলায় পদ্য পড়নি…’রূপেতে কি করে বাপু, গুণ যদি থাকে।’ পপির গুণের পরিচয় যদি কখন পাও, তখন বলবে, হ্যাঁ!”

যার সম্বন্ধে এত ব্যাখ্যানা সেই পপি কিন্তু তখন পরম নিশ্চিন্তভাবে টিকটিকির মত লেজটা তরতর করে নাড়ছে আর মনিবের দিকে তাকিয়ে যেন তার কথা শুনছে—চোখের দৃষ্টিতে যেন কৃতজ্ঞতা!

শিখা তখন পপির দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল—”আচ্ছা, সুযোগ পাই তো তোমার পপির কেরামতিটা দেখে নেবো। যাক, এখন তোমার কি কথা বলো তো, যার জন্য রাত্রে ফোন করতে হয় দেখা করবার দরকার মনে করে?”

বিমল একখানা চেয়ার শিখার কাছে টেনে এনে বসে পড়ে বলে—”ভয়ানক জরুরী কথা, দিদি। কাল লালবাজারে ডাক পড়েছিল, বলেছি না? গিয়ে দেখি, শুধু আমাকে নয়—আরও কয়েকজনের ডাক পড়েছে। তাঁরাও হাজির। কমিশনার—সাহেব, ডেপুটি—সাহেব—দুজনকেই দেখলুম বেশ চিন্তিত! শুনলুম, ওঁরা খবর পেয়েছেন, বর্মা থেকে একদল ডাকাত বাংলা—মুল্লুকে এসে ভয়ানক উৎপাত সুরু করেছে। এর মধ্যেই ক’—জায়গায় ডাকাতিও করেছে ওরা; বিশেষ করে পরশু বেলা তিনটে নাগাদ ক্লাইভ ষ্ট্রীটের ডাকাতিটা। কাগজে সে—খবর পড়েছো নিশ্চয়?”

শিখার মনে পড়ে কালই ক্লাইভ ষ্ট্রীটের ডাকাতির খবরটা পড়েছে সে। কোন মিলের মাইনে দেওয়ার জন্য বাইশ হাজার টাকা মোটরে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পথের মাঝখানে গাড়ী থামিয়ে সে—টাকা লুঠ করেছে দস্যুরা।

বিমল বলে—”জালিম দুর্দ্দান্ত ডাকাত। তার সম্বন্ধে এর মধ্যেই অনেক রিপোর্ট পাওয়া গেছে।”

”জালিম!”

শিখা সবিস্ময়ে নামটা উচ্চারণ করে। তার মনে পড়ে, কাকাও এই নামটা করেছিলেন! কালকের টেলিগ্রামখানাও খুব সম্ভব এই জালিমেরই অত্যাচারের ফলে!

বিমলের কাছ থেকে শিখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জালিমের খবর জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে থাকে। বিমল পকেট থেকে একতাড়া কাগজ আর একখানা ফটো বের করে শিখার হাতে দেয়, ফটোখানা দেখিয়ে বলে—”এই জালিম।”

ফটোখানা ভাল করে লক্ষ্য করে শিখা।

বেশ জোয়ান চেহারা। দেখলেই মনে হয়, এ—লোক না পারে, এমন কাজ নেই!

বিমল ততক্ষণে রিপোর্টগুলো পড়তে সুরু করেছে—”জালিম উত্তর—ভারতের অধিবাসী। আগে মিলিটারীতে কাজ করতো। সে—কাজে তার সুখ্যাতিও ছিল। নানা কাজে সে থাকত কখন দিল্লীতে, কখন মীরাটে। গত যুদ্ধের সময় য়ুরোপেও গিয়েছিল সে। ইণ্ডিয়ান—এয়ার—ফোর্সে ছিল। তারপর তাকে যেতে হয় বর্মায়। সেখানে কি কারণে রেগে সে লেফটেনাণ্ট এয়ার মার্শালকে গুলি করে মারে। মেজর রায়কেও আক্রমণ করেছিল সে—কিন্তু তাঁর কিছু করতে পারেনি। তারপর থেকেই সে ফেরার হয়। এর পর বহুকাল আর তার কোন পাত্তা ছিল না। সম্প্রতি ছ’মাস হলো, সে আবার দেখা দিয়েছে। এই ছ’মাসে সে যা করে বেড়াচ্ছে, তাতে স্তম্ভিত হতে হয়! সে একটা দল গড়ে চুরি, ডাকাতি, লুঠ, খুন এই সব করে বেড়াচ্ছে! পুলিশের সঙ্গে দুবার খণ্ডযুদ্ধও হয়ে গেছে এর মধ্যে; কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। সম্প্রতি বর্দ্ধমানে আর হুগলিতে দুটো—আর সর্ব্বশেষ ক্লাইভ ষ্ট্রীটে যে ডাকাতি হলো, এগুলো সবই ঐ জালিমের দলের কাজ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে!”

এই পর্য্যন্ত শুনেই শিখা মুখ তোলে—”থাক বিমলদা, যতটা শুনেছি, তাতেই বুঝেছি। এখন বল, আমাকে কি করতে হবে?”

বিস্ফারিত চোখে তার পানে চেয়ে বিমল বলে—”বুঝতে পারলে না? তোমাকেই এ কাজে হাত দিতে হবে। মোটা টাকা রিওয়ার্ড—যে এই জালিমকে ধরিয়ে দিতে পারবে, সে পাবে।”

শিখা মাথা নাড়ে—”উঁহু, হবে না বিমলদা। আমাকে আজই বম্বে মেলে রায়পুরে যেতে হচ্ছে। কাল কাকাবাবুর এক টেলিগ্রাম এসেছে, আমি যেন টেলিগ্রাম পাবামাত্র যাই। আমায় আজই যেতে হবে, বিমলদা।”

বিমল কাগজপত্র গুছিয়ে পকেটে রাখতে রাখতে বলে—”আজই তোমাকে দরকার নেই দিদি। তুমি ফিরে এস। তবে ফিরে আসবার পরেই জালিমরূপ দনুজ—দলনে আমি চাই দনুজ—দলনী শিখা রায়ের সাহায্য!”

শিখা মৃদু হেসে বলে—”দনুজ—দলনীই বটে! যাই হোক, ফিরে আসি তো আগে।”

এই বলে শিখা পপির পানে তাকায়, সকৌতুকে বলে—”তোমার পপি থাকতে ভাবনা কিসের? পপিই তো দলকে—দল ধরে দিতে সাহায্য করতে পারবে। তবে আর আমায় কি দরকার?”

মলিন মুখে বিমল বলে—”ওকে ঠাট্টা করো না দিদি। পপি সত্যিই তা পারে। দরকার পড়লে ওর কাজ দেখিয়ে তোমাকে ও অবাক করে দেবে—এ আমি বাজি রেখে বলতে পারি।”

চা জল—খাবার আসে। বিমল তার সদ্ব্যবহার সুরু করে।

চিন্তিত মুখে শিখা বলে—”কাকাবাবুও কিন্তু এই জালিমের কথা বলেছেন। জালিম নাকি তাঁকে সর্ব্বত্র ফলো করে বেড়াচ্ছে। কিন্তু লোকটির সম্বন্ধে তিনি বিশেষ কিছু বলেননি। আমার মনে হয়, জালিম তাহলে রায়পুরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছে আর এর জন্যই কাকাবাবু হয়তো আমাকে ডেকেছেন!”

”অসম্ভব কিছুই নয়।”

খেতে খেতে বিমল আবার বলে—”আমি ভাবছি, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। কোনদিন রায়পুর যাইনি। রায়পুর কেন, ও অঞ্চলটাই দেখিনি। তার উপর তুমি বলছ, জালিম ওখানে গেছে। জালিমের সম্বন্ধেই যখন আমার উপর উপর—ওয়ালার আদেশ—তখন লাগে তুক, না লাগে তাক!—আমি যদি তোমার সঙ্গে যাই, তাতে তোমার অসুবিধা হবে?”

শিখা বলে—”না, অসুবিধা আর কি! তুমি সঙ্গে থাকলে তো খুব ভালোই হয়। দুজনের বুদ্ধি এক করে মিলিয়ে—তাতে অনেক সুবিধা হবে।”

মহা—উৎসাহে বিমল বলে—”বহুৎ আচ্ছা! তাহলে আমি আর বসব না। এখনি লালবাজারে গিয়ে কর্ত্তাদের বলে অনুমতি নেব—তারপর তোমার সঙ্গে যাত্রা।” এই বলেই পপিকে নিয়ে বিমল বেরিয়ে পড়ল।

তিন – ট্রেনের কামরায়

সেকেণ্ড ক্লাশের টিকিট কেটে বম্বে মেলে উঠে পড়ল শিখা আর বিমল। পপিকে সঙ্গে আনা সম্ভব হলো না, সেজন্য বিমলের দুঃখের সীমা নেই। শিখাও রতনকে সঙ্গে নিতে পারেনি—মা একা থাকবেন! তাই তাকে রেখে আসতে হলো।

বম্বে মেল তীরবেগে ছুটেছে।

কামরায় বেশী লোক নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে একটা কোণ নিয়ে বসেছে শিখা। তার মনে চিন্তার রাশি। বিমল একখানা বেঞ্চে তার হোল্ড—অলটা খুলে বিছানা পেতে শুয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে।

খড়্গপুর ষ্টেশনে ট্রেন থামতে দরজা খুলে উঠে পড়ল দুজন লোক।

শিখা সোজা হয়ে বসে।

লোক দুজন সামনের বেঞ্চে বসে কথাবার্ত্তা সুরু করে। কথার শব্দই কাণে আসে, কিন্তু তাদের দুর্ব্বোধ্য ভাষা শিখা বুঝতে পারে না।

ওদিকে বেঞ্চে আর বাঙ্কের উপর যে দুজন লোক এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল, তাদের মধ্যে একজন উঠে বসল।

উজ্জ্বল আলো তার মুখে পড়তে শিখা বিস্ময়ে বলে উঠল—”এ কি, সুন্দরলালবাবু যে! কোথায় যাচ্ছেন?”

বাঙ্ক থেকে ঝপ করে নেমে পড়েন সুন্দরলাল জালান। তাঁর মুখে অপার বিস্ময়!

”মিস্ রায়!—আপনিও এ—ট্রেনে চলেছেন! আশ্চর্য্য ব্যাপার!”

ধড়মড় করে উঠে বসে বিমল।

ধনী ব্যবসায়ী রামেশ্বর জালানের জ্যেষ্ঠ পুত্র সুন্দরলাল জালান। বিমল তাঁকে বেশ চেনে। কলকাতায় বড়বাজারে রামেশ্বর জালানের কারবার। আসল অফিস আর মূল কারবার দিল্লীতে। কারবারের অনেক ব্রাঞ্চ ভারতের প্রায় সব ক’টা শহরেই ছড়িয়ে আছে।

ভাগ্যবান পুরুষ রামেশ্বর জালান। তিনি নিজেও তা স্বীকার করেন। একদিন পথে—পথে ঘুরে দিন কেটেছে তাঁর, কতদিন অনাহারে গেছে। তারপর হঠাৎ ভাগ্য ফিরে গেল! ছাই মুঠো ধরতে হাত সোনায় ভরে ওঠে!

আজ তাঁর ফার্মের নাম শুধু ভারতে নয়, ভারতের বাইরেও অনেকে জানে। রামেশ্বরের দুই পুত্র—সুন্দরলাল আর জওহরলাল। সুন্দরলাল ইউনিভার্সিটির ডিগ্রীধারী। কিন্তু জওহরলাল কলেজের চৌকাঠে পা দিতে পারেনি—অসৎ সঙ্গে মিশে সে একেবারে অধঃপাতে গেছে।

সুন্দরলালের মুখেই শিখা এ—সব কথা শুনেছে।

শরীর অসুস্থ হওয়ায় রামেশ্বর জালানকে ডাক্তারেরা বিদেশ যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। ছ’মাস পূর্ণ—বিশ্রাম। বোম্বাইয়ে বা আর কোথাও সমুদ্রের ধারে তাঁকে থাকতে বলেছেন তাঁরা। রামেশ্বর তাই বোম্বাইয়ে তাঁর মালাবার হিলসের বাড়ীতে গিয়ে বাস করছেন। সুন্দরলাল কলকাতা থেকে বোম্বাই যাচ্ছেন পিতাজীকে দেখতে। তিনি বললেন, আপাততঃ দিন—দশেক তিনি থাকবেন সেখানে।

শিখা জিজ্ঞাসা করে—”আপনার ছোট ভাই এখন কোথায়? তাঁকে অনেক দিন দেখিনি।”

সুন্দরলাল হতাশার ভঙ্গীতে বলেন—”তার কথা আর বলবেন না। পিতাজী তাকে কলকাতার গদিতে রেখেছিলেন। গদি থেকে পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে সে কোথায় পালিয়েছে আজ তিন দিন। এখানে পুলিশে খবর জানিয়েছি। বিমলবাবু নিশ্চয় জানেন সে—কথা!”

বিমল সোৎসাহে বলে—”হ্যাঁ, লালবাজারে এ—কথা হচ্ছিল বটে। ডেপুটি সাহেবের বিশ্বাস, তিনিও ঐ জালিমের পাল্লায় পড়েছেন।”

”জালিম!”

উত্তেজিত হয়ে ওঠেন সুন্দরলাল। তিনি বলেন—”জালিম আমাদের চিটাগং ব্রাঞ্চের জুট ডিপার্টমেণ্টে কাজ করতো ক’—বছর আগে। সেই সূত্রে আমাদের সঙ্গে তার জানাশোনা। এ লোকটাকে পিতাজী কেন যে এত বিশ্বাস করতেন, আজও আমি তা বুঝতে পারিনি বিমলবাবু! তার চড়া মেজাজ—কড়া কথা—অশিষ্ট আচরণ—লোকটাকে আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। পিতাজীকে কতবার বলেছি, ওকে সরান। তিনি সে—কথা শোনেননি। সেই জালিম শেষে জওহরলালকে নিজের খর্পরে আটক করে—”

বিমল বলে—”আটক করেছে, এমন প্রমাণ অবশ্য পাইনি আমরা। শুধু জেনেছি, জওহরলাল জালিমের দলে যোগ দিয়েছেন অর্থাৎ তারা তাঁকে যোগ দিতে বাধ্য করেছে। এই দলটিকেই আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি আজ ছ’মাস। এরা আমাদের রীতিমত ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। তা’ছাড়া বড় সাহেবের কাছে যা শুনলুম, তাতে আশ্চর্য্য হয়ে গেছি! একদিন নাকি জালিম কমিশনার সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা ক’রে গোপনে অনেক কথা বলে এসেছে। সাহেব তখন কিছু বুঝতে পারেন নি। তারপর জালিম চিঠি লিখে জানিয়েছে, সে নিজে তাঁর কাছে গিয়ে ও সব কথা আলোচনা ক’রে এসেছে। সাহেব বললেন—’ভাবো, লোকটার সাহস কতখানি!”

নিশ্বাস ফেলে সুন্দরলাল বলেন—”আমার ভাই এই সব লোকের সঙ্গে মিশেছে। দু’—দুবার জেলে যাচ্ছিল, কি করে যে তাকে বাঁচিয়েছি, সে আমিই জানি! দুবারই সে চোখের জল ফেলতে—ফেলতে প্রতিজ্ঞা করেছিল—’নাকে—কাণে খৎ….আর কুসংসর্গে থাকবো না’, কিন্তু কাজের বেলায় আবার যে—কে সে—ই!”

কথাটা শেষ করে সুন্দরলাল বড় একটা নিশ্বাস ফেলেন।

সামনের বেঞ্চের দুজন লোকের মধ্যে একজন তখন হাত—পা গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ভোঁস—ভোঁস করে নাক ডাকাচ্ছে, আর অপর জন বসে বসে ঝিমোচ্ছে।

শিখার মনে হলো, ও—লোকগুলোর সামনে এ—সব কথা আলোচনা করা উচিত হচ্ছে না। ওরা কে—কেমন লোক, কে জানে!

শিখা বললে—”আমাদের কথা শেষ হয়ে গেছে সুন্দরলালবাবু, আপনি এবার শুয়ে পড়ুন। আমরা যখন নামব, তখন সকাল হয়ে যাবে, আপনাকে না জানিয়ে আমরা যাব না।”

সুন্দরলালবাবু একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন—”কিন্তু আর একটা কথা—পিতাজীকে সব কথা জানাবার জন্যে আমি আবার বোম্বাই যাচ্ছি। কি যে তাঁর অসুখ—কলকাতার নামকরা ডাক্তারদের কাউকেই আর দেখাতে বাকি রাখিনি। ব্লাড এগজামিন…এক্স রে…সব কিছুই হয়েছে। ট্রপিকাল স্কুলে প্রায় মাসখানেক ছিলেন—কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কি অসুখ, কোন ডাক্তারই বলতে পারেন না। তাই এই চেঞ্জ। তিনি কিছু দেখতে—শুনতে পারেন না, নামেই শুধু বেঁচে আছেন। আমার নামে পাওয়ার—অব—এ্যাটর্ণি দেওয়া থাকলেও জওহরলালের সম্বন্ধে নিজে সব কিছু করতে পারব না আমি। পাঁচজনে পাঁচ কথা বলতে পারে তো?”

সুন্দরলাল চুপ করলেন।

শিখা লক্ষ্য করে, যে লোকটি হাত—পা গুটিয়ে আড়ষ্ট ভাবে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে, তার চোখ যেন ঈষৎ—উন্মীলিত! ওইটুকু ফাঁক দিয়ে সব কিছু ও যেন দেখে নিলে।

চার – কাকার ডায়েরি

বম্বে মেল যখন রায়পুর ষ্টেশনে পৌঁছুল, তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে।

ভোরের দিকে শিখার একটু তন্দ্রা মত এসেছিল। যখন সে—ভাব কাটল, তখন ধড়মড় করে উঠে বসল। বসে তাকিয়ে দেখে, কাল রাত্রে যে দুজন লোক সে—কামরায় উঠেছিল, তারা নেই। কখন কোন ষ্টেশনে নেমে গেছে! সুন্দরলাল বাথ—রুম থেকে বেরিয়ে আসতে শিখা জিজ্ঞাসা করল—”সামনের বেঞ্চের লোক দুজন কোন ষ্টেশনে নেমে গেল, জানেন?”

সুন্দরলাল বললেন—”তারা নেমেছে বিলাসপুরে। আমিও ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, কখন ট্রেন থেমেছে, কখন প্যাসেঞ্জার নেমেছে, জানি না। হঠাৎ যেমন ঘুম ভেঙে গেল, দেখি, ওরা দুজনে নেমে যাচ্ছে। হাতে একটা ছোট সুটকেস। অথচ যখন ওঠে, মনে হয়, ওদের হাতে কিছু ছিল না!”

”সুটকেস!”

শিখার দুই চোখ বিস্ফারিত হয় সুন্দরলালের কথা শুনে। সে তার নিজের সুটকেসটা যেখানে রেখেছিল সেই দিকে তাকায়। কিন্তু কোথায় তার সুটকেস? নেই তো!

বিমল উঠে বসল—”ও, হ্যাঁ, আমিও তাদের নামতে দেখেছি দিদি, সুটকেস হাতে। কিন্তু ওটা যে তোমার সুটকেস তা ভাবতে পারিনি। এতটুকু সন্দেহও হয়নি। হ’লে তখনই ধরতে পারতুম! আশ্চর্য্য, এ কামরায় আরো এত জিনিসপত্র পড়ে আছে, তাতে হাত দিল না…তোমার সুটকেসটাই নিয়ে গেল! আশ্চর্য্যের কথা তো!”

শিখা বলে—”ওতে শুধু কাপড়—জামাই ছিল না বিমলদা। কাকার একখানা পুরানো ডায়েরি ছিল। আর জালিমের যে ফটোখানা তুমি দিয়েছিলে, সেখানাও ছিল ওতে। ফটোর জন্যে ভাবছি না—ভাবছি কাকার ডায়েরিখানার কথা। কে জানে, তাতে কি সব লেখা ছিল!”

বিমল বললে—”বটে!”

সুন্দরলাল জিজ্ঞাসা করেন—”মেজর রায় রায়পুরে আছেন বলছেন, অথচ তাঁর ডায়েরি কলকাতায় ছিল?”

শিখা বলে—”হ্যাঁ। কাকা কলকাতায় ক’দিন ছিলেন আমাদের ওখানে। হয়তো ডায়েরিখানা তখন দেখেছিলেন! দেখে আলমারির উপরে রেখে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছেন! সেদিন দ্বিতীয় টেলিগ্রামে ডায়েরিখানা নিয়ে যাবার কথা বলেছেন। তাই কাল অনেক খুঁজে বের করে ওখানা আমি নিয়ে যাচ্ছিলুম!”

বিমল উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে—”নিশ্চয় ডায়েরিতে এমন কিছু লেখা আছে, যা তাঁর কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়! তুমি পাতা উল্টেও দেখনি দিদি?”

শিখা মাথা নাড়ে। বিমল আর কিছু বলে না।

এদিকে ট্রেন ছাড়বার সময় হয়ে আসে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে ওরা।

ওদের নামবার সময় সুন্দরলাল বললেন যে, তিনি দিন পনেরোর মধ্যে কলকাতায় ফিরবেন। এর মধ্যে মিস্ রায় আর বিমলবাবু নিশ্চয় ফিরে যাবেন—তখন দেখা হবে এবং সব খবর পাওয়া যাবে। তিনিও বম্বের খবর জানাবেন।

ষ্টেশনের বাইরে এসে ট্যাক্সির খোঁজ করে দুজনে। একটি ছেলে এগিয়ে এসে অভিবাদন করে বলে—”আপনারা নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে আসছেন! টাউনেই যাবেন বোধ হয়?”

সন্দিগ্ধভাবে শিখা তার পানে তাকায়, বলে—”তোমার সে—খোঁজে দরকার?”

ছেলেটি সসম্ভ্রমে বলে—”না, আমাকে আমার জ্যাঠামণি মানে, এখানকার গভর্ণমেণ্ট—প্লীডার উমাপতি চৌধুরী ষ্টেশনে পাঠিয়েছেন—কলকাতা থেকে এই ট্রেনে মেজর রায়ের ভাইঝির আসবার কথা আছে কিনা! তাঁকে বাড়ীতে নিয়ে যাব বলে এসেছি।…আমি গাড়ী এনেছি। আপনারা আসুন।”

ছেলেটির বয়স হবে পনেরো—ষোল বছর। নাম রবি।

শিখা আর বিমল তার সঙ্গে এসে মোটরে বসে। ছেলেটি শিখার পাশে বসল।

পথে যেতে যেতেই শিখা রবির কাছে অনেক খবর পায়।

”মেজর রায় এখানে এসে ক’দিন বেশ ভালো ছিলেন। মনে স্ফুর্ত্তি, দেহেও শক্তি পেয়েছিলেন। বাড়ীর কাছে অত—বড় বুড়া—তালাও—প্রত্যহ সকালে অন্ততঃ পাঁচবার সে—তালাও চক্র দিয়ে বেড়াতেন। জ্যাঠামণি উমাপতি চৌধুরী ভারী খুশী হয়েছিলেন এবং আরও দু—এক মাস তাঁকে এখানে থাকবার কথা বলতেন। তিনিও থাকতে রাজী হন। কিন্তু হঠাৎ সেদিন তালাওতে সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে গিয়ে আর ফেরেন না—রাত ওদিকে বাড়তে থাকে। কাকিমা…মানে, ওঁর স্ত্রী ভয়ানক ভাবিত হন। তারপর জ্যাঠামণি ক্লাব থেকে বাড়ী ফিরে ব্যাপার শুনে গাড়ী নিয়ে তখন খুঁজতে বেরোন।”

রবি বলে চলে—”খুঁজতে—খুঁজতে দেখেন, একধারে একটা ঝোপের কাছে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তখনি ধরাধরি করে তাঁকে বাড়ী আনা হয়। ডাক্তার আসেন। তিন দিন পরে ওঁর জ্ঞান হয়। কিন্তু জ্ঞান হলে হবে কি? কথা বলতে পারেন না স্পষ্ট করে। জড়ানো—জড়ানো কথা। আর ফ্যাল—ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। অতি—কষ্টে জ্যাঠামণিকে শুধু বলেন—শিখা—টেলিগ্রাম—এখানে আসবে—আমার ডায়েরিখানা, শুধু এই কথা! তাও কতবার করে বলতে তবে সকলে বুঝতে পারেন। কাকিমা তখনি আপনাকে টেলিগ্রাম করে দেন।”

বিমল বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলে—”এ নিশ্চয়ই সেই জালিমের কাজ দিদি—তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুনেছি, এমনি করে কটা কেস—”

শিখা তার কথায় কাণ দেয় না, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে—”তাই আমি দুখানা টেলিগ্রাম পেয়েছি! প্রথম টেলিগ্রামে শুধু আমার আসবার কথা। সেটা পাবার পাঁচ—ছ’ ঘণ্টা পরে দ্বিতীয়খানা; তাতে ডায়েরি নিয়ে যাবার কথা! তা এখন তিনি কেমন আছেন? কথাবার্ত্তা বলছেন?”

অত্যন্ত ম্লান বিষণ্ণ কণ্ঠে রবি বলে—”কথা বলবার জন্য চেষ্টা করেন—দু—একটা কথা বোঝা যায় শুধু—জড়িয়ে—জড়িয়ে—স্পষ্ট বলতে পারেন না। কথা বলতে বেশ কষ্ট পাচ্ছেন মনে হয়। ডাক্তাররা বলছেন, ব্রেনে খুব বেশী শক পেয়েছেন! পাগল না হন শেষে!”

শিখা শিউরে ওঠে!

বাবাকে সে জানে না, জ্ঞান হয়ে তাঁকে দেখেনি—দেখেছে পিতৃতুল্য এই কাকাকে। তিনি অসীম স্নেহে তাকে মানুষ করে তুলেছেন। তাঁর নিজের সন্তান নেই, শিখাই তাঁর সব! সরকারী কাজে যে—মানুষ অমন খ্যাতি অর্জ্জন করেছেন, যাঁর মনুষ্যত্ব, সকলের উপর যাঁর স্নেহ—মমতা—দরদ—সে—মানুষ আজ এমন!

শিখা স্তম্ভিত হয়ে যায়।

পাঁচ – বুড়া-তালাওয়ের বিড়িওয়ালা

নির্ব্বাক—দু’চোখে অপলক দৃষ্টি—শুধু চেয়ে থাকেন মেজর অতুল রায়। জ্ঞান বেশ আছে। কিন্তু মিথ্যা এ—জ্ঞান। দেহ চালনা করবেন, সে শক্তি নেই।

আজ তিনদিন শিখা রায়পুর এসেছে। তার হাত দুখানা চেপে ধরে কাকিমা শুধু নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছেন। শিখা তাতে বাধা দেয়নি। সে বোঝে, এই সব অপরিচিতের মাঝখানে কাকিমা কেঁদে নিজেকে হালকা করতে পারেননি! উদ্বেগের পাহাড় জমে আছে কাকিমার বুকে! অসীম ধৈর্য্যে তিনি শুধু স্বামীর সেবা করে চলেছেন। এখন শিখাকে দেখে নিজেকে আর সম্বরণ করতে পারলেন না—অশ্রুর ধারায় পুঞ্জিত উদ্বেগ আর বেদনা উৎসারিত হয়ে উঠল! কাকিমা শুধু একটি কথা বলেছেন শিখাকে—”নে মা, তুই এসেছিস, তোর কাকাবাবুকে সারিয়ে ভালো করে তোল!”

তারপরই তিনি কান্নায় ফেটে পড়েছেন! শিখা যেন এতক্ষণে তাঁকে কাঁদবার অবকাশ দেয়!

কাকাবাবুর শিয়রে বসে শিখা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তিনি বিড়—বিড় করে কি যেন বলেন। মুখের কাছে কাণ এনে শিখা জিজ্ঞাসা করে—”কিছু বলছেন কাকাবাবু? একটু ভালো করে বলুন।”

”ডা—ডা—ডা…ডায়েরি।”

শুধু এই একটি কথাই শিখার কাণে আসে। মনে শান্তি পায় না শিখা, তবু মুখে বলে—”বুঝেছি কাকাবাবু।”

”কৈ?” সঙ্গে সঙ্গে তিনি কম্পিত করতল মেলে দেন।

বোঝা যায়, বেশ জ্ঞান আছে।

শিখা বলে—”আপনি একটু সুস্থ হয়ে উঠুন, তখন দেব।”

মেজর রায়ের মুখ বিকৃত হয়ে ওঠে। তিনি চোখ বোজেন। দেহ কুঞ্চিত হয়, নাড়তে পারেন না।

শিখার জিজ্ঞাসার উত্তরে ডাক্তার জানান যে, মেজর রায়ের চিকিৎসা তাঁর আয়ত্তের বাইরে হলেও প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে তবু যতটুকু পারছেন, করে যাচ্ছেন। আজ ছ—সাত দিন হলো, মেজর রায়ের এই অবস্থা হয়েছে। তিনি প্রচুর ইনজেকশন দিয়েছেন, ওষুধ খাওয়াচ্ছেন, তিন দিন বসে তাঁকে সব—সময়ে লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছেন না। দেহের কোথাও কোন আঘাতের চিহ্ন নেই,—কোন অসুখ নেই। ডাক্তার কেমন হতাশ হয়ে পড়েছেন। তবে হতাশ হলেও চেষ্টা ছাড়েননি তিনি। আর ক’দিন দেখে মেজর রায়কে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলবেন।

শিখা বলে—”তাহলে আর ক’টা দিনই বা কেন? কাল—পরশু নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে ফেলুন। আমার মনে হয়, যত শীঘ্র সম্ভব কলকাতায় নিয়ে যাওয়াই ভালো। এখানে রেখে কোন লাভ হবে না যখন—”

”আগামী—কাল বম্বে থেকে ডক্টর যোশী এসে পৌঁছুচ্ছেন! তিনি খুব ভালো ডাক্তার। খুব নাম—ডাক। এইখানে তাঁর বাড়ী। মেডিকেল কনফারেন্স হচ্ছে বম্বেতে; তাই তিনি সেখানে গেছেন।”

তাঁকে একবার দেখিয়ে কাকাকে নিয়ে শিখা কলকাতায় ফিরবে, কথা রইল।

চৌধুরী সাহেব বলেন—”মানুষ ভাবে এক, ভগবান করেন আর এক! এখানে এসে তোমার কাকা খুব ভালো ছিলেন মা, মনের সঙ্গে দেহেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু কি যে হলো সেদিন—কিছু বুঝতে পারলুম না!”

এখানকার পুলিশ—অফিসার কৃষ্ণ রাও আসা—যাওয়া করছেন। সেদিনকার ব্যাপার নিয়ে তিনিও খুব খোঁজ—খবর করছেন।

তিনি বলেন—”সন্ধ্যা সাতটার পর তালাওয়ের মধ্যে প্রায় লোক থাকে না। চৌধুরী সাহেব মাঝে মাঝে তালাওয়ে বেড়াতে যান, আর এখন যান মেজর রায়। কিন্তু কোনদিনই রাত সাড়ে আটটার বেশী তিনি দেরী করতেন না। ঘটনার দিন অত রাত পর্য্যন্ত তিনি তালাওয়ে রয়েছেন, কেউ তা জানে না। সন্ধান করে জানতে পারা গেছে, একজন লোকের সঙ্গে মেজর রায় কথা বলছিলেন। এক দোকানদার এ—কথা জানিয়েছে।”

বিমল বলে—”সে—দোকানদারকে পাওয়া যাবে কি মিষ্টার রাও? তার মুখে সব কথা শুনলে ভালো হয়। যদি আততায়ীর সম্বন্ধে কিছু সন্ধান আমরা পাই!”

কৃষ্ণ রাও বললেন—”আমি তাকে এখনি আনতে পাঠাচ্ছি।”

মিনিট পনেরো পরেই এক কনষ্টেবলের সঙ্গে নিরীহ দোকানদার রামু এসে হাজির। এখানকারই লোক। দেখে মনে হয়, অত্যন্ত ভীরু। মুখ তার শুকিয়ে গিয়েছে। সে কাঁপছে।

আভূমি প্রণত হয়ে সে করযোড়ে দাঁড়ায়।

শিখা তাকে সাহস দেয়—”কোন ভয় নেই তোমার। আমরা পুলিশের লোক নই। যাঁর অসুখ, তিনি আমার কাকা! আমি শুধু জানতে চাই, তুমি সেদিনকার কথা কি জানো। কি দেখেছো—আর কি কথাবার্ত্তা শুনেছো, শুধু সেই কথা জানতে চাই।”

রামু সাহস পায়।

সে জানায় : সেদিন মেজর সাহেবের বেড়াতে যেতে দেরী হয়েছিল। তিনি সন্ধ্যার অনেক পরে এসেছিলেন। পাশেই রামুর বিড়ি—পানের দোকান—দোকানে সে সর্ব্বদাই থাকে। সন্ধ্যার আগে থেকে দু’জন লোককে সে ওখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল। তারা রামুর দোকান থেকে বিড়ি—পান কিনেছিল। চৌধুরী সাহেবের বাড়ীর সম্বন্ধে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছিল তারা। কথায় কথায় মেজর সাহেবের খোঁজ নেয়। তিনি কে, কোথায় থাকেন, কখন বেড়াতে আসেন—এই সব। রামুর এতটুকু সন্দেহ হয়নি। সে যা জানত, বলেছিল। এর পর প্রায় সাতটা সাড়ে—সাতটার সময় মেজর সাহেব আসেন। রামু এদিকে আর নজর দেয়নি, নিজের খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। রাত প্রায় নটার সময় লোক দুটো তার দোকানে আবার আসে; এসে এক—প্যাকেট বিড়ি কিনে নিয়ে চলে যায় সামনের পথ ধরে। তার খানিক পরেই একজন লোকের চীৎকার শোনা যায়। চীৎকার শুনে অনেক লোক ছুটে আসে। সে—ও যায়। গিয়ে দেখে, মেজর সাহেব উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।

শিখা জিজ্ঞাসা করে—”কিন্তু কত লোকই তো ওখানে বেড়াতে যায়, এ দু’জন লোকের উপর তোমার নজর পড়ল কেন?”

রামু বললে—”এরা আমার দোকানে বসে ফিস—ফিস করে অনেকক্ষণ কথা বলছিল। ওরা বাংলায় কথা বলছিল। ভেবেছিল, আমি বাংলা জানি না! কিন্তু অনেক বাঙ্গালী আমার দোকানে আসেন, সেজন্যে আমি কিছু বাংলা শিখেছি—বাংলা কথা বুঝতেও পারি।”

শিখা বললে—”কি—কি কথা তুমি শুনেছিলে?”

রামু বললে—”ওরা মেজরের নাম করছিল। বলছিল, ‘ডায়েরি! শিখা রায়! কলকাতা! আরাকান!’ এই সব। বলছিল, ‘ডায়েরিখানা চাই—ই!” এমনি সব কথা হচ্ছিল, এমন সময় রায় সাহেব এসে তালাওয়ের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকেন। সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠে গেল। কেবল এইটুকুই জানি। আর কিছু জানি না।”

বিমল বললে—”তাদের দেখলে চিনতে পারবে?”

রামু সোৎসাহে বলে—”খুব পারব। দুজনের মুখেই এত বড় বড় দাড়ি, গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। খুব লম্বা নয়, বেঁটেও নয়, মাঝারি গড়ন।”

শিখা বললে—”মাঝারি গড়ন! কিন্তু ওদের দাড়ি—গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল—সে—সব আসল নয়, ও—গুলো লাগিয়ে এসেছিল। যাই হোক, তোমার কথায় বুঝছি রামু, তারা বাঙ্গালী, অন্য দেশের লোক নয়। যাক, এরা তাহলে আগে থেকেই ফলো করছিল! শুধু সুযোগ পায়নি বলে কোন অনিষ্ট করতে পারেনি। এই দিন সুযোগ পেয়েছিল, করেছে। দেখা যাক, কাল যোশী সাহেব দেখে কি বলেন! তারপর ওঁকে নিয়ে আমি আর বিমলদা কলকাতায় ফিরব। তুমি কি বল বিমলদা?”

বিমল বললে—”নিশ্চয়। আমি ভাবছি দিদি, আমার পপিটাকে যদি এখানে আনতুম, আসামীর সন্ধান হয়তো খানিকটা পেতুম। গন্ধ শুঁকে সে ঠিক ধরতে পারতো।”

ছয় – মেঘনাদী আক্রমণ

এখানে দেখবার মত যা—কিছু আছে দেখবে, বিমলের খুব ইচ্ছা। কে জানে, বাংলা দেশ ছেড়ে এই মধ্য—প্রদেশে আর কখনো আসবার সুযোগ হবে কিনা। যখন এসেছে, দু’দিন থাকতেও হচ্ছে—তখন দেখেই সে যাবে।

চৌধুরী সাহেব বললেন—”আপনি যাবেন, শিখাকেও নিয়ে যান। এ অঞ্চলে মারাঠা আমলের অনেক কীর্ত্তি দেখবেন। মারাঠাদের কীর্ত্তি। সেগুলো দেখে যাওয়া উচিত।”

এপ্রিলের রৌদ্রে বেরুনো সহজ নয়। এ সময়ে বারোটা থেকে লু চলে। সারা দুপুর কেউ ঘরের বার হতে পারে না। কাজেই বেড়াতে গেলে বিকেল পাঁচটার আগে বেরুনো চলে না।

বিমলের জিদে এবং চৌধুরী সাহেবের কথায় শিখাকেও বেরুতে হলো।

চৌধুরী সাহেবের মোটরে শিখা এবং বিমল দুজনে উঠে বসল। রবি বাড়ী ছিল না—তার যাওয়া হলো না।

বাজি রাওয়ের বহু কীর্ত্তি—এক জায়গায় নয়, নানা জায়গায় এখনও রয়েছে। নদীর ধারে বাজি রাওয়ের প্রতিষ্ঠিত বহু শিব—মন্দির। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।

শিখা বলে—”এবার ফেরা যাক।”

বিমল একটু হেসে বলে—”হলোই বা একটুখানি রাত, আমরা তো হারিয়ে যাব না।”

শিখা অপ্রসন্ন মুখে বলে—”রবি যদি আসত, অনেকটা ভরসা পেতাম বিমলদা। জায়গাটা শহরের বাইরে—তায় এমন নিরিবিলি—লোকের বসতি প্রায় নেই বললেই হয়।”

বিমল বললে—”তুমি এত ভাবছো কেন দিদি? বাড়ীর মোটর—পুরোনো ড্রাইভার—ভয় কি, বাড়ী পৌঁছে যাব ঠিক।”

গুড়ুম!

হঠাৎ কোন দিক থেকে বন্দুকের একটা গুলি এসে বিমলের পায়ে লাগে।

সঙ্গে সঙ্গে বিমল মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

অতর্কিত আক্রমণে থতমত খায় শিখা, তখনই নিজের রিভলবার বার করে।

নদীর ধারে মস্ত বাগান। বাগানের মধ্যে মন্দির। বাগানে কেয়া আর কলিকা ফুলের ঝোপ—ঝাড়—এ ঝোপে কোথায় শত্রু আছে লুকিয়ে, কে জানে?

আন্দাজে রিভলবারের ট্রিগার টিপে গুলি ছোড়ে শিখা। পর—পর দুটো। তারপর ফায়ার করতে করতে খানিক এগিয়ে যায়।

খানিক দূরে পথের উপর মোটর নিয়ে ড্রাইভার অপেক্ষা করছিল। গুলির শব্দ শুনে টর্চ নিয়ে আরও লোকজন জোগাড় করে সে এসে বাগানে ঢোকে।

বিমল অজ্ঞান, অচেতন! খানিকটা জায়গা রক্তে রাঙা হয়ে ভিজে উঠেছে। কিন্তু শিখার দেখা পাওয়া যায় না।

ড্রাইভার তাড়াতাড়ি করে লোকজনের সাহায্যে বিমলকে গাড়ীতে তোলে—তারপর শিখাকে খোঁজে।

শিখার সন্ধান তবু মেলে না। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন জমাট বেঁধে উঠেছে।

শহর এখান থেকে অনেক দূরে।

ড্রাইভার পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে দু—তিনজন লোককে সেখানে পাহারায় রেখে মূর্ছিত বিমলকে নিয়ে মোটর চালিয়ে দেয়।

উপকণ্ঠ ছাড়িয়ে শহর। শহরে ঢুকে আগেই সে যায় থানায়।

ইনস্পেক্টর কৃষ্ণ রাও ছুটে আসেন—বিবরণ শুনে তিনি স্তম্ভিত! চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে খবর দিতে লোক পাঠিয়ে বিমলকে তিনি হাসপাতালে পাঠান এবং নিজে ক’জন কনষ্টেবল সঙ্গে নিয়ে তখনই ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন।

লছমন ড্রাইভারকে তিনি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কৃষ্ণা—চতুর্থীর চাঁদ উঠেছে আকাশে—তার আলোয় মন্দির এবং চারিদিককার গাছপালা দেখা যাচ্ছে।

নীরব নিস্তব্ধ স্থান লোকজনের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে। উজ্জ্বল আলোয় চারিদিক আলোকিত হয়। কিন্তু শিখার কোন সন্ধানই পাওয়া যায় না।

ততক্ষণে এসে পৌঁছুলেন চৌধুরী সাহেব, আর তাঁর সঙ্গে পুলিশ—সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মিঃ ধীলন।

চৌধুরী সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন—”কোন খোঁজ পেলেন, রাও?”

অভিবাদন করে কৃষ্ণ রাও বললেন—”না, এখনও পাইনি চৌধুরী সাহেব। এই নির্জ্জন জায়গা—সন্ধ্যার দিকে এদিকে আসা ওঁদের মোটেই উচিত হয়নি। এরকম সময়ে ওঁদের আসতে বারণ করা উচিত ছিল।”

বিষণ্ণভাবে চৌধুরী সাহেব বললেন—”আমার জন্যেই এ কাণ্ড ঘটেছে! আমি যদি সকালের দিকে আসতে বলতুম, তাহলে আর এমন হতো না। দুপুরে অসম্ভব লু চলে। ওরা নিশ্চয় এদিক—ওদিক দেখে তার অনেক পরে এখানে এসেছিল!”

মিঃ ধীলন বললেন—”আমার মনে হয়, শত্রুপক্ষ এই সুযোগেরই প্রতীক্ষায় ছিল। বরাবর ফলো করেছে…ওঁদের উপর তীক্ষ্ন নজর রেখেছে—তারপর যেমন সুযোগ পাওয়া, ব্যস। কে এমন শত্রু—আপনারা সে সম্বন্ধে কিছু বলতে পারছেন না, কিন্তু বেশ বুঝছি, এরা পরিকল্পনা মত চলেছে। প্রথমে দেখুন, মেজর রায়—অন্ধকারে তাঁকে পেয়ে ঐ ব্যাপার। তারপর এঁরা মেজর রায়ের আপনার লোক। এ থেকে আমার ধারণা, এই ফ্যামিলির উপরই এদের আক্রোশ!”

চৌধুরী সাহেব বললেন—”হুঁ! তাই তো মনে হচ্ছে! আশ্চর্য্য ব্যাপার! এরা মেজর রায়ের আপনার লোক—শুধু এ খবর রাখা নয়—এরা এখানে এসেছে, সে খবরও রেখেছে! রেখে এমন ভাবে নজর রাখা—মতলব মত কাজ…ভেবে আমি আশ্চর্য্য হচ্ছি! কিন্তু এখন এ চিন্তা নয়—দুজনের একজনকে তবু পাওয়া গেছে! কিন্তু শিখা? শিখার কি হলো? তাকেও কি গুলি করলো? না তাকে ধরে নিয়ে গেল?”

মিঃ ধীলন বললেন—”আমি শহরের প্রত্যেক ঘাঁটিতে পাহারার ব্যবস্থা করেছি চৌধুরী সাহেব। ষ্টেশনে প্রত্যেকটি ট্রেন সার্চ করা হবে। কোন দিক দিয়ে সহজে পালাবার উপায় নেই। এখন আসুন রাও সাহেব, এখানে থেকে আর কি হবে? শহরে গিয়ে বরং সন্ধান করা যাক।”

বিষণ্ণ মুখে কৃষ্ণ রাও মোটরে উঠলেন। এস—পির মোটর চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে আগে চললো।

অকৃতকার্য্যতায় কৃষ্ণ রাও অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উঠেছেন। ক’দিন আগে শহরের বুকে বুড়া—তালাওয়ের ধারে মেজর রায়ের উপর ঐ আক্রমণ—তারপর আজ আবার এই!

খানিক দূরে পুলিশ থাকা সত্ত্বেও এমন স্বচ্ছন্দে বদমায়েসগুলো কাজ হাসিল করে নিঃসাড়ে সরে পড়ল! এমন ওৎ পেতে থাকা! এখানে কলকাতার এক পুলিশ—অফিসারের উপর আক্রমণ!

চোখের সামনে তিনি দেখছেন নিবিড় অন্ধকার!

যাবার পথে হাসপাতালে একবার বিমলের খোঁজ নিয়ে জানলেন, এখন তিনি কতকটা সুস্থ, কৃষ্ণ রাও ইচ্ছা করলে দেখা করতে পারেন।

এমন সময় দেখা না করে, কৃষ্ণ রাও থানার দিকে ফিরলেন।

সাত – আজব পুরীর বন্দিনী

চারিদিকে তাকিয়ে আশ্চর্য্য হয়ে যায় শিখা! কোথায় সে এসেছে, বুঝতে পারে না। চমৎকার ঘর। একপাশে একটি টেবিল, একখানি চেয়ার, বই—ঠাসা আলমারি, সব আছে। সুন্দর পালঙ্কে নরম গদিতে সে শুয়ে—তার মাথার কাছে একখানি চেয়ারে বসে একটি মেয়ে। মেয়েটি অপরূপ সুন্দরী। সে একখানা বই পড়ছিল।

শিখা ভাবতে থাকে—এ কোথায় রয়েছে সে! কোথায় সে ছিল, এখানেই বা কি করে এল? কোন জায়গা এটা? তবে কি স্বপ্ন দেখছে সে! কিন্তু না! স্বপ্ন তো নয়। এইতো বেশ জ্ঞান আছে তার। তবে?

সে কথা বলতে যায়…জিজ্ঞাসা করতে চায়, কোথায় সে এসেছে? কেন এসেছে?

কিন্তু তার মুখ দিয়ে ভাল করে কথা বের হয় না। শুধু কয়েকটা অস্ফুট শব্দ।

মেয়েটি সেই অস্ফুট শব্দ শুনে বই বন্ধ করে উঠে শিখার কাছে আসে। শিখার মাথায় হাত রেখে বলে—”এই যে, আপনি চোখ মেলে চেয়েছেন! জ্ঞান হয়েছে, দেখছি।”

সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে টেবিলের উপরে ফোন ধরে।

ফোন—এ মেয়েটি বলে—”হ্যাঁ, আমি…সোহানি—রুম নম্বর থার্টি, রোগী চোখ মেলে চেয়েছেন। হ্যাঁ, জ্ঞান হয়েছে। ও, আপনি আসছেন? বেশ!”

রিসিভার রেখে মেয়েটি আবার ফিরে আসে শিখার কাছে; তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে—”এবার একটু কিছু খান।”

শিখা কোন কথা বলে না, শুধু মেয়েটির পানে চেয়ে থাকে। মেয়েটিকে তার ভালো লাগে! মেয়েটিকে দেখে মনে হয়, তাহলে ভালো জায়গায় আছে—কোন শত্রুর খর্পরে নয়! কিন্তু কি করে এমন হলো? সব কথা মনে করবার চেষ্টা করে শিখা, কিন্তু মনে পড়েও পড়ে না যেন?

মেয়েটি তখন একটা ফীডিং—কাপে করে ওভালটিন এনে শিখার হাতে দেয়। শিখা খেতে পারে না। মেয়েটি তখন খাইয়ে দিতে থাকে—এক—চামচ এক—চামচ করে।

একটু পরেই বাইরে ভারী জুতার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। ঘরে ঢোকেন সাহেবী পোষাক—পরা এক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক। শিখা তাকায় তার পানে। কি কদর্য্য কুৎসিত মুখ—কুচকুচে কালো রঙ—বিশ্রী মোটা দুটো ঠোঁট উলটোনো—পানা, কুৎকুতে ছোট চোখ, নাক যেন নেই! দেখলে ভয় হয় এমনি বিশ্রী চেহারা। শিখা চোখ বন্ধ করে!

ঘরে এসেই তিনি শিখাকে দেখলেন; বললেন—”ইনি ঘুমিয়ে পড়েছেন, দেখছি।”

মেয়েটি বললে—”না, ঘুমোননি! বড্ড ক্লান্ত—বেশীক্ষণ চোখ চেয়ে থাকতে পারছেন না। এক মাস হলো তো! এত বড় একটা—”

—”আঃ!” বলে ভদ্রলোক চীৎকার করলেন। সোহানি একেবারে চুপ।

শিখা ডান হাতখানা তুলতে যায়, থর—থর করে হাত কাঁপে, অনেক চেষ্টায় হাতখানা তুলে চোখের সামনে ধরে। চোখ মেলে চায় সে।

হাতের আঙুলগুলো কেমন বেঁকে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে ঘোলাটে।

কথা বলবার চেষ্টা করে শিখা, কিন্তু জিভটা কেমন জড়িয়ে যায়! হাবার মত অস্পষ্ট শব্দ বের হয় শুধু।

সোহানি তাকায় লোকটির পানে, বলে—”একটা কথা আছে ডাক্তার।”

তিনি তীব্র দৃষ্টিতে তাকান সোহানির পানে।

বিবর্ণ হয়ে যায় সোহানির মুখ।

নিষ্পলক নেত্রে শিখা তাকিয়ে থাকে। তার ঠোঁট কাঁপে, জিভটা নড়ে মুখের মধ্যে।

”আ—আ—মি কোথায়?”

অনেক চেষ্টার পর তার মুখে শুধু এই কথাটুকু স্পষ্ট হয়ে ফোটে।

”সোহানি, সোহানি, রোগী কথা বলেছে, শুনেছো?”

আনন্দে ডাক্তার চীৎকার করে উঠলেন। মনে হয়, তিনি যেন লাফিয়ে উঠবেন! হয়তো নৃত্য আরম্ভ করে দেবেন।

সোহানি এগিয়ে আসে। তার মুখের বিবর্ণতা তখনও কাটেনি।

ডাক্তার নিজেকে সামলে নিয়েছেন, শিখার দিকে খানিকটা নীচু হয়ে তিনি উত্তর দিলেন—”তুমি খুব ভালো জায়গায় আছ। আর দু—তিনদিনের মধ্যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে, আশা করছি। আমি আশা করতে পারিনি—হ্যাঁ, সত্যই আশা করতে পারিনি, নির্ব্বাক জগৎ থেকে তোমায় উদ্ধার করতে পারব মিস্ রায়!”

আবার চোখ বোজে শিখা।

একটা ঝিমুনো—ভাব। বাঁ হাতে ছুঁচ ফুটোনোর ব্যথা। ডাক্তারের কথায় সোহানি তাকে ইনজেকশন দিচ্ছে। ডাক্তারের সঙ্গে সোহানির যে কথা হয়, তার দু—চারটে আসে শিখার কাণে ভেসে—”না, না, তোমার ভয় পাবার কোন কারণ নেই। সামনের হপ্তায় বম্বে মেলে ব্যবস্থা করব। হ্যাঁ, হ্যাঁ—ট্রেনেই! প্লেনের ধকল সহ্য করতে পারবে না! তাছাড়া আজকাল প্লেন তেমন নিরাপদ নয়।”

এর বেশী শিখা আর কিছু শুনতে পায় না—তার চোখ বুজে আসে, সে ঘুমিয়ে পড়ে।

আট – উদ্যোগ-পর্ব্ব

সারা শহরে নয় শুধু, সারা দেশে হুলুস্থূল পড়ে যায়। বাংলা, ইংরাজী, হিন্দী, গুজরাটি সমস্ত খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হয় শিখার নিরুদ্দেশের সংবাদ।

তারপর প্রকাশ হয় সেদিনকার ঘটনা—মেজর অতুল রায়ের অবস্থা এবং শিখার অন্তর্দ্ধানের কাহিনী।

মা জানলেন এ খবর। আহার—নিদ্রা ঘুচে গেল তাঁর—চোখের জল হলো সার।

কলকাতার পুলিশ—বিভাগ চঞ্চল হয়ে ওঠে। পুলিশ কমিশনার রায়পুর পুলিশ—সুপারকে ট্রাঙ্ক কল করে জানালেন—ওখানকার কাজের জন্যেই কলকাতা পুলিশ থেকে কুমারী রায় আর বিমলেন্দু চৌধুরীকে রায়পুরে পাঠানো হয়েছে। এঁদের জন্য কি করা হচ্ছে, তা যেন কলকাতা পুলিশকে অবিলম্বে জানানো হয়।

বিমলের অবস্থা তখন অনেকটা ভালর দিকে। পায়ের ঘা শুকিয়ে এসেছে। একদিন লাঠিতে ভর করে সে হাসপাতাল থেকে বাইরে এল এবং চৌধুরী সাহেবের বাড়ীতে এসে উপস্থিত হলো।

রবি আনতে গিয়েছিল। রবির কাছেই প্রথম সে শোনে শিখাকে পাওয়া যাচ্ছে না সেদিন থেকে; পুলিশ সন্ধান করছে। তারা বলছে—যেমন করেই হোক, কুমারী রায়কে তারা খুঁজে বের করবেই।

বিমল হাসপাতাল থেকে ফিরতেই পুলিশ ইনসপেক্টর কৃষ্ণ রাও এলেন তার সঙ্গে দেখা করতে।

তিনি বললেন—”আমরা এটুকু জানতে পেরেছি, মিস্ রায়কে মোটরে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মোটরের নম্বরও আমরা পেয়েছি। আপনি যদি আমার সঙ্গে আসতে চান—আসুন। আপনাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবার জন্য আমাদের সুপার নির্দ্দেশ দিয়েছেন, তাই আমি আপনার কাছে এসেছি।”

বিমল বললে—”নিশ্চয় যাবো মিষ্টার রাও। আস্তে আস্তে চলাফেরা করতে পারছি। কোথায় যেতে হবে?”

রাও উত্তর দিলেন—”এখান থেকে মাইল কয়েক দূরে, দেওপুরা গ্রামে।”

বিমলের সঙ্গে রবিও উঠে পড়লো গাড়ীতে।

কৃষ্ণ রাও বললেন—”একটা কেসের ভার নিয়ে কাজ করতে না করতে আর একটা কেস! মেজর রায়ের ব্যাপারটা আপাততঃ একেবারে চাপা পড়ে গেল মিষ্টার চৌধুরী! উনি কেমন আছেন? এ—সব কথা শুনে কিছু বুঝেছেন?”

রবি উত্তর দিলে—”বুঝতে পারেননি, বোধ হয়। কেবল আঁ—আঁ ছাড়া আর কোন শব্দ তাঁর মুখে বেরুল না রাও সাহেব। আজকের রাত গেলে কাল আমার বাবা ডাক্তার যোশীকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার ইস্পাহানির কাছে যাবেন।”

”ডাক্তার ইস্পাহানি! তিনি আবার কে?”

বিমল বিস্ময়ে প্রশ্ন করে।

কৃষ্ণ রাও বলেন—”তিনি একজন মস্ত ডাক্তার। সম্প্রতি এখানে এসেছেন। থাকেন বোম্বাইয়ে। মাস তিনেক আগে দেওপুরাতে এক বাংলোয় এসেছেন। শুনলুম, এখানে এই নির্জ্জন জায়গায় থেকে তিনি সাপের বিষ সম্বন্ধে রিসার্চ করছেন। বেশ বড় ডাক্তার। নানারকম বিষের সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান নাকি অসাধারণ।”

বিমল বললে—”কিন্তু তাঁর কাছে আমরা কেন যাচ্ছি বলুন তো? নিশ্চয় তাঁর মোটরের নম্বরের সঙ্গে সে রাত্রের মোটরের নম্বর মিলতে পারে না—মিললেও তাঁকে আসামী সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করা উচিত হবে কি?”

কৃষ্ণ রাও হাসলেন, বললেন—”আগু—পিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি করতে গেলে বিপদ আছে। আপনি এঁর পরিচয় জানেন না। ইনি বিখ্যাত ডাক্তার। বিলাতে নানারকম রিসার্চ করে দেখিয়েছেন, কি থেকে কি ফল পাওয়া যায়। এখনও ওঁর পরীক্ষার শেষ নেই। উনি দিন—রাত কাজে ডুবে আছেন। হঠাৎ আমরা যেদিন শুনলুম, উনি এখানে দেওপুরার একটা বাংলোতে এসেছেন। শুনে আশ্চর্য্য হয়েছিলুম খুব। এত রাজ্য থাকতে ঐ অজ—গাঁ দেওপুরায়!”

বিমল গম্ভীরভাবে বললে—”আশ্চর্য্য বটে! অত বড় একজন লোক অত্যন্ত সামান্য ভাবে এলেন এক নগণ্য পল্লীতে বাস করতে!”

কৃষ্ণ রাও বললেন—”আমরাও প্রথমে অদ্ভুত ভেবেছিলুম। কিন্তু তার পরে যা শুনলুম—মানে, এ অঞ্চলের যত সাপুড়ে সাপ ধরে নিয়ে তাঁর কাছে যায়। তিনি বেশ মোটা দাম দিয়ে বিষাক্ত সাপ কিনে নেন। এর পর একদিন তাঁকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি নিজেই আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। দেওপুরায় এক আসামীর সন্ধানে গিয়েছিলুম। সে ছিল তাঁর চাকর। আগের দিনই নাকি তাঁর ওখানে কাজে যোগ দেয়।”

বিমল বললে—”সর্ব্বনাশ! সে নিশ্চয় তাঁরও সর্ব্বনাশ করত যদি দু’দিন তাঁর কাছে থাকত।”

কৃষ্ণ রাও বললেন—”সেই কথাই তিনি বললেন। এ দেশের কোন লোককে তিনি চেনেন না। এখানকার একজন লোক ছিল বোম্বাইয়ে তাঁর এ্যাসিষ্টাণ্ট। তার বাংলোতেই এঁর থাকবার ব্যবস্থা করে সে নিজে এসে এঁকে রেখে যায়। আপনি গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে সত্যই খুশী হবেন মিষ্টার চৌধুরী। এত পণ্ডিত অথচ এমন অমায়িক মানুষ বড় দেখা যায় না। তবে চেহারার দিক দিয়ে আপনি হতাশ হবেন। চেহারা অতি কুৎসিত। ভারতের লোক তিনি নন। তাঁর বাবা আদ্দিস আবাবার মানুষ। তাঁরা কাজের জন্যে বোম্বাইয়ে এসে বাস করেছিলেন। ইস্পাহানির জন্মও বোম্বাইয়ে। কিন্তু চেহারাটা—”

তিনি থেমে যান।

বিমল বললে—”বুঝেছি, চেহারায় তিনি ন্যাশনালিটি রক্ষা করেছেন! যাই হোক, এখন যখন তিনি ভারতের মানুষ, তখন তাঁকে ভারতবাসী বলতে হবে। চলুন, দেখা যাক তাঁর সঙ্গে আলাপ করে। কিন্তু ওই মোটরের নম্বর—ও—নম্বরের মোটরের সঙ্গে তাঁর কি সম্পর্ক?”

কৃষ্ণ রাও বললেন—”আমি যে নম্বর পেয়েছি, সে নম্বরের সঙ্গে ডাক্তার ইস্পাহানির গাড়ীর নম্বর মিলে যাচ্ছে। ভুলও হতে পারে তো! তাই সেটা মিলাতে আর খোঁজ নিতে আমার যাওয়া—গিয়ে একবার দেখা যাক।”

বাঁধা পথ ধরে মোটর বেশ জোরে চলেছে।

বিমল ভাবছে পপির কথা। কোন রকমে পপিকে একবার যদি আনা যেত!

কাল সে কলকাতার চিঠি পেয়েছে—পপি নাকি বড় অবাধ্য হয়েছে। স্নানাহার নিয়মিত করতে চায় না, বিশেষ করে আহার সে যেন বর্জ্জন করতে চায়।

মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। বিমল কলকাতায় ফেরবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছে, অথচ কলকাতার পুলিশ—কমিশনারের নির্দ্দেশ—এখান থেকে তার যাবার উপায় নাই।

সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।

নয় – নার্স সোহানি

প্রভাতের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ছড়িয়ে পড়বার সঙ্গে শিখার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

অত্যন্ত সহজ ভাবেই উঠে বসে সে!

স্বপ্নের মত মনে হয়! হাত—পা অবশ হয়ে গিয়েছিল, আঙুলগুলো বেঁকে গিয়েছিল!

হাতখানা শিখা তোলে।

স্বাভাবিক হাত। স্বাভাবিক আঙুল। মনে হয়, একদিন কে যেন তার সামনে দাঁড়িয়েছিল—নিগ্রোর মত চেহারা! ইংরাজীতে কথা বলছিল লোকটা! সে স্বপ্ন? না, সত্য?

ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে আসে একটি মেয়ে। নার্স সোহানি।

শিখা উঠে বসেছে দেখে সে বলে—”এই যে আপনি উঠেছেন! ভালো বোধ করছেন?”

শিখা স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়—”কিন্তু আমার তো কিছুই হয়নি। কাজেই ভালো—মন্দের কোন কথাই ওঠে না।”

মেয়েটির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। সে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে; বলে—”আপনি জানেন না, আপনার খুব অসুখ হয়েছিল। আমরা ভাবতে পারিনি, আপনি ভালো হয়ে উঠবেন! ভগবানকে ধন্যবাদ যে আপনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, আবার মানুষ হতে পেরেছেন।”

শিখা বিস্মিত চোখে মেয়েটির পানে তাকায়, বলে—”আমি কোথায় আছি—কতদিনই বা আমার অসুখ হয়েছে, জানতে পারি? আর আপনি কে?”

মেয়েটি বলে—”আমার নাম সোহানি। আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন আপনি। হ্যাঁ, কতদিন আপনি অসুস্থ, বলছি। কাল এক মাস চার দিন গেছে, আজ পাঁচ দিন।”

”এতদিন! অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি!”

শিখা আশ্চর্য্য হয়ে যায়।

তার মনে হয়, যেন গতকাল সন্ধ্যার কথা। নদীর ধারে শিবমন্দিরের কাছে গাড়ী থেকে নেমেছিল সে আর বিমলেন্দু। ভারী সুন্দর জায়গা। সুন্দর নদী। সেই নদীর কূলে সারি—সারি শিব—মন্দির—ওদিকে প্রকাণ্ড সুন্দর বাগান—অসংখ্য কেয়া আর কলিকা ফুলের গাছ এবং এই ফুলেই বিশেষ করে শিবপূজা হয়ে থাকে।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে—ফেরবার কথা সে বলেছিল—গা কেমন যেন ছমছম করছিল তার! অকারণে!

বড় বড় গাছগুলো নিমেষে যেন অন্ধকারে মিলিয়ে আসে! ফেরবার জন্য তারা অগ্রসর হয়। এমন সময়ে বন্দুকের গুলি লেগে বিমল পড়ে যায়।

শিখা চমকে উঠেছিল—কিন্তু সে চকিতের জন্য! তখনি সে নিজেকে সম্বরণ করে নিয়ে যেদিক থেকে গুলির শব্দ হয়েছিল, সেই দিক লক্ষ্য করে দুবার গুলি ছোড়ে। কারও গায়ে লাগলো কিনা, জানে না! গুলি ছুড়তে ছুড়তে সে এগিয়ে চলেছিল। হঠাৎ কে যেন পিছন দিক থেকে শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকে লোকটার বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে কিন্তু সামনের দিক থেকে কে যেন তার নাকে কি একটা ধরে! তারই উগ্র উৎকট গন্ধ নিশ্বাসে নেবার সঙ্গে সঙ্গে শিখা মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ে! তার পৃথিবী যেন মুছে মিলিয়ে যাচ্ছিল—তখনো একটু চেতনা—বুঝেছিল, ক্লোরোফর্ম্মের গন্ধ নয়—অন্য কিসের গন্ধ। মনে পড়ে ফুলের মত নরম স্পর্শ—কিন্তু কঠিন বাঁধন যেন। তারপর সে আর কিছু জানে না!

কিন্তু এত দিন? এই দীর্ঘ একমাস পাঁচ দিন তার এমনই ভাবে কেটেছে?

শিখা মুখ তোলে।

সোহানি তার মুখের পানে চেয়েছিল, বলল—”এবার উঠুন। মুখ—হাত ধুয়ে চা—খাবার খেয়ে নিন, তারপর কথাবার্ত্তা হবে। আপনার সব কথার উত্তর পাবেন।”

উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে ওঠে, পা দুখানা কাঁপে। পড়তে পড়তে দেয়াল ধরে ফেলে শিখা, তারপর সোহানির সাহায্যে পাশের বাথরুমে যায়।

বাথরুমে চমৎকার আয়োজন। সাবান, তোয়ালে, টুথপেষ্ট, টুথব্রাশ, আয়না, চিরুণী—সৌখীনতার চরম।

হাত—মুখ—মাথা ধুয়ে শিখা কতক প্রকৃতিস্থ হয়—নিজের চেষ্টায় আবার ফিরে আসে।

টেবিলের উপরের ছোট ঘণ্টাটা বাজায় সোহানি। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে একজন লোক এসে চা আর খাবার দিয়ে যায়।

সোহানি বলে—”খেয়ে নিন মিস্ রায়।”

শিখা চায়ের কাপ মুখে তোলে।

সামান্য দুর্ব্বলতা অনুভব করে! বিশ্বাস হয় না, দীর্ঘ এক মাসের উপর সে জীবন্মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল! অতদিন পড়ে থাকলে তার শরীর যতখানি দুর্ব্বল হওয়ার কথা, তা হয়নি! মনে হয়, সোহানি মিথ্যা কথা বলেছে! হয়তো দু—চারদিন সে এখানে আছে! কিন্তু এরকম মিথ্যা কথা বলবার কারণ? মেয়েটির ব্যবহার যত বেশী ভালো হোক—শত্রুপুরী নিশ্চয়! নাহলে তাকে চেপে ধরে ক্লোরোফর্ম্মের মত উগ্র বিষ শুঁকিয়ে এখানে আনবার আয়োজন কেন?

কিন্তু এ শত্রু কে? কে এই মেয়েটি? সে—কথা জিজ্ঞাসা করা চলে না। শিখা একটা নিশ্বাস চাপে—ভাবে—ও বলেছে, সব কথার জবাব সে দেবে! দেখা যাক।

চা খেয়ে কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সে জিজ্ঞাসা করে—”আমি কোথায় আছি, জানতে পারি এখন?”

সোহানি উত্তর দেয়—”আপনি রায়পুরেই আছেন। তবে শহরে নয়, উপকণ্ঠে।”

শিখা বলে—”আমাকে এরকম ভাবে এনে আটক করে রাখার কারণ?”

সোহানি বলে—”মাপ করবেন, সে—কথা আমি জানি না। ডাক্তার যেদিন আসবেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন।”

”ডাক্তার! তিনি কে?”

শিখা বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করে।

সোহানি উত্তর দেয়—”ডাক্তার ইস্পাহানি। তিনি আপনাকে দেখছেন, মানে, আপনার চিকিৎসা করছেন। সব খবর তিনি জানেন।”

এ—কথা এইখানেই শেষ করে সে বললে—”আপনি ভাল হয়ে উঠেছেন, এতে তিনি যে কতখানি খুশী হবেন সে আর কি বলবো! এ—রকম কেস তাঁর হাতে এই প্রথম!”

শিখা বলল—”বুঝেছি। এও বুঝেছি, সেদিনকার যা—কিছু অর্থাৎ বিমলদাকে গুলি করা, আমাকে এরকম ভাবে নিয়ে আসা, এসব তাঁরই কাজ! অর্থাৎ তিনিই সব করেছেন! নয় কি?”

বিব্রত হয়ে সোহানি বলে—”আমি কিছু জানি না মিস্ রায়। আপনার সেবা—শুশ্রূষা আর আপনাকে দেখার ভার তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। আমি প্রাণপণে নিজের কাজ করে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে এইমাত্র সম্পর্ক।”

শিখা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে; তারপর বলে—”ডাক্তার এখন কোথায়?”

সোহানি উত্তর দিলে—”পরশু বম্বে গিয়েছেন। আজ—কালের মধ্যে ফেরবার কথা। আপনার যা—কিছু জানবার, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। তাঁর কাছেই আপনার নাম আমি শুনেছি। মোটামুটি আপনার পরিচয়ও আমি পেয়েছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি যখন আপনার ভার নিয়েছি, তখন আপনার এতটুকু অনিষ্ট আমি হতে দেব না, বরং যাতে আপনার ভাল হয়, সেই চেষ্টাই করবো।”

শিখা নরম সুরে বলে—”আপনি যদি মনে করেন, তাহলে এখান থেকে আমি বাড়ী যেতে পারি, বোধ হয়?”

সোহানির মুখ মলিন হয়। হাত যোড় করে ক্লান্ত—কণ্ঠে সে বলে—”ওইটি শুধু পারবো না—আমাকে মাপ করবেন। সে অধিকার আমার নেই। আপনার খাওয়া—থাকা, আপনাকে দেখা—শুনা করা, আপনার সেবা—এই আমি করতে পারব। আমার সঙ্গে আপনি বেড়াতে যেতেও পারেন। পারব না শুধু আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে দিতে। এ অনুরোধ আমায় করবেন না।”

মুহূর্ত্ত নীরব থেকে সে আবার বলে—”আপনি ডাক্তারের পরিচয় পাননি, আমি পেয়েছি। আমি তাঁকে চিনি—তাঁকে জানি। জীবনে আমি অনেক লোক দেখেছি, কিন্তু ডাক্তার? তিনি—”

একটা ভীষণ কর্কশ হাসি!

সোহানি, শিখা দুজনেই চমকে ওঠে! সোহানি নিমেষে যেন পাথর হয়ে যায়। শিখা জানালা দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখে, কাকেও দেখতে পায় না।

ফিরে সে তাকাল সোহানির পানে। স্খলিত—কণ্ঠে সোহানি বলল—”উনি এসেছেন—ডাক্তার ইস্পাহানি!”

দশ – একই ধারা

ইনস্পেক্টর কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে বিমল যেদিন বম্বে পৌঁছুল, সেদিন আকাশ সেখানে মেঘে কালো—ঝমঝম করে অবিরাম বৃষ্টি পড়ছে।

কলকাতা থেকে একেবারে তাঁরা বম্বে পৌঁছেছেন। রায়পুর থেকে মেজর রায়কে ডাক্তার যোশীর পরামর্শে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মেডিকেল কলেজে একটা কেবিনে তাঁকে রাখা হয়েছে। ডাক্তার যোশী সঙ্গে এসেছিলেন; তাঁর নির্দ্দেশেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে।

মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে পড়েছে। সেইজন্যই তাঁর এই অবস্থা। এ—কথা ডাক্তাররা পরীক্ষা করে বলেছেন। ডাক্তার যোশীর মতে দীর্ঘকাল চিকিৎসার প্রয়োজন এবং এর পর সুস্থ হলেও তাঁর বিশ্রামের দরকার।

কলকাতায় পৌঁছে বিমল বড়বাজারে সুন্দরলাল জালানের সন্ধানে গিয়েছিল। গদিতে খবর পাওয়া গেল, সুন্দরলাল তখনও ফেরেননি। রামেশ্বর জালানের অবস্থা খারাপ দেখে তিনি বম্বে ত্যাগ করতে পারেননি। টেলিগ্রাম করেছেন—ফিরতে আরও দিন পনেরো দেরী হবে—যদি এর মধ্যে পিতাজী অবশ্য সুস্থ হন।

ম্যানেজার সুন্দরলালের ভগ্নীপতি মোহনপ্রসাদ জানালেন, সুন্দরলাল বম্বে যাওয়ার ক’দিন পরেই জওহরলাল এসেছিল। এখানে ক’দিন সে ছিল। বলেছিল, আবার সে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। পঁচিশ হাজার টাকা তাতে ঢেলেছে—তার দরকার এক লাখ। বাকি টাকার জন্য সে এসেছিল সুন্দরলালের কাছে। পিতাজী তাকে দিয়েছেন আমমোক্তারনামা—তার জোরে সুন্দরলাল যা খুশী করতে পারেন। সুন্দরলালের জন্য সে অপেক্ষা করেছিল। সুন্দরলালের টেলিগ্রাম আসে পরশু। সে টেলিগ্রাম আসবার পরের দিনই জওহরলাল বম্বে রওনা হয়েছে। পিতাজী বর্ত্তমান থাকতেই সম্পত্তিতে তার অংশ সে আলাদা করে নেবে এবং নিজের অর্দ্ধাংশ নিয়ে ব্যবসা করবে।

জওহরলালের স্বভাব—চরিত্র বিমলের অজ্ঞাত ছিল না। ধনীর সন্তান হয়ে অসৎ সংসর্গে মিশে সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াচ্ছিল! দু—বার ফৌজদারী মামলায় আসামী হয়ে হাজতবাসও করেছিল। সুন্দরলাল দুবারই তাকে সে দায় থেকে উদ্ধার করেছেন।

কলকাতায় পৌঁছে জওহরলালের সম্বন্ধে পুলিশের আরও যে রিপোর্ট বিমল পেল, তাতে সে আশ্চর্য্য হয়ে গেল! সম্প্রতি রাণাঘাট লাইনে ভীষণ এক ডাকাতির ব্যাপারে সুন্দরলালের গদির এক দরোয়ান ধরা পড়ে অনেক কথা প্রকাশ করে দিয়েছে। তার কথার উপর নির্ভর করে জওহরলাল, সৈফুদ্দীন, ধরমচাঁদ প্রভৃতি ক’জনকে আসামী করে কোর্টে মামলা চালান গেছে—ফেরারী আসামী বলে সৈফুদ্দিন আর জওহরলালের নামে হুলিয়া জারি হয়েছে এবং তাদের গ্রেফতারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।

কৃষ্ণ রাও বিমলকে বললেন—”কৈ, এদের মধ্যে আপনার জালিমের নাম তো দেখতে পাচ্ছি না।”

বিমল বলল—”লোকটা নিশ্চয় নাম বদলেছে। আপনি ওর রেকর্ড দেখুন মিঃ রাও। কিছুদিন সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিল—তারপর হঠাৎ উধাও—কোন পাত্তা ছিল না। তারপর তাকে দেখা যায় রামেশ্বর জালানের কাছে কাজ করতে। আরও আশ্চর্য্য ব্যাপার—রামেশ্বর জালানের কাছে ও কাজ করতে আসার সঙ্গে সঙ্গে জালানের ভাগ্য ফিরে যায়। তারপর ওখানে কাজ করবার সময় সুন্দরলালের সঙ্গে ওর কি হয়—তার ফলে দুজনে হাতাহাতি পর্য্যন্ত! সুন্দরলালকে ছুরি মেরে জালিম পালিয়ে যায়। সুন্দরলালের চোট তেমন গুরুতর না হওয়ায় দু—চারদিনেই তিনি সেরে ওঠেন। পুলিশ জালিমকে খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু সে একেবারে গায়েব! বহুকাল পরে এই ক’মাস আগে বাংলা দেশে যে ক’টা ডাকাতি হলো, তাতে আবার জালিমের নাম শোনা যায়। আমরা, মানে, বাংলার পুলিশ এখন যে রকম হুঁশিয়ার আছি তাতেই সে বাংলায় আর দন্তস্ফুট করতে পারেনি—এখন অন্যত্র টাকা—কড়ির চেষ্টায় আছে। জওহরলালকে সে জানে। জানে, তাকে বাগাতে পারলে কারবার চলবে—তাই আমার মনে হয়, বোম্বাইয়ে গিয়ে একবার দেখা যাক।”

বম্বে পৌঁছে একখানা ট্যাক্সি নিয়ে মালাবার হিলসে রামেশ্বর জালানের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় যখন তাঁরা পৌঁছুলেন, তখন বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

দরোয়ান বিমলের কার্ড নিয়ে সুন্দরলালের কাছে দিতেই ব্যস্তভাবে তিনি ছুটে এলেন।

—”মিঃ চৌধুরী! আপনি এখানে হঠাৎ কোন খবর না দিয়ে! আসুন, আসুন—আপনাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাচ্ছি!”

বিমল আর কৃষ্ণ রাওকে এনে তিনি নিজের খাস—কামরায় বসালেন। তাঁদের স্নানাহারের ব্যবস্থা হলো সঙ্গে সঙ্গে—তাঁদের এতটুকু অসুবিধা না হয় কোন বিষয়ে—বাড়ীর সকলকে বেশ ভালো করে বলে দিলেন।

তারপর প্রশ্ন করলেন—”মিস্ রায়? তাঁর কি খবর? সন্ধান পেলেন? খবরের কাগজে আমি তাঁর খবর পড়ে অত্যন্ত ভাবিত হয়েছি। রায়পুরে আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক আছেন। তাঁকে চিঠি লিখেছিলুম। তিনি লিখেছেন, এখনও কোন খবর পাওয়া যায়নি। আশ্চর্য্য কথা, তাঁকে সরানো হলো—অথচ কেন, কোথায়, কে তাঁকে নিয়ে গেল, আজও আপনারা কোন খোঁজ পেলেন না!”

বিমলের মুখ লাল হয়ে ওঠে। কৃষ্ণ রাও মাথা নীচু করেন।

একটু পরে বিমল রামেশ্বর জালানের অবস্থার কথা জানতে চাইলে সুন্দরলাল বললেন, ”পিতাজী একটি কথাও বলতে পারেন না। কেবল মুখ দিয়ে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ বেরোয়! আপনারা দেখতে পাবেন, কিন্তু দেখে আপনাদের কষ্ট হবে। মনে হয়, তিনি আর বেশী দিন বাঁচবেন না!”

কৃষ্ণ রাও জিজ্ঞাসা করলেন, ”কলকাতায় শুনে এলুম, আপনার ভাই এখানে এসেছেন। তিনি সম্পত্তি ভাগ করে নিতে চান। আর—”

সুন্দরলালের মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো। তিনি বললেন—”হ্যাঁ, সে এসেছিল কিন্তু আমি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। পিতাজীর পাওয়ার—অব—এ্যাটর্নির বলে আমিই এখন মালিক। আমি চাই না তার সঙ্গে পিতাজীর এখন দেখা হয়। কি সে করবে, ঠিক নেই! সে কি আর সে—মানুষ আছে? পুলিশ তাকে ধরবার জন্যে ঘুরছে। যে তাকে ধরে দিতে পারবে, সে পুরস্কার পাবে। এমন আসামীকে বাড়ীতে জায়গা দিতে পারি? হোক সে ভাই—মানুষ হতো যদি, তাহলে কথা ছিল না! কাল সন্ধ্যার পরও সে এসেছিল। আমাকে শাসিয়ে গেছে, এর ফল নাকি আমাকে শীঘ্রই পেতে হবে!”

তিনি একবার ঘড়ির পানে তাকিয়ে বললেন,—”আপনাদের এখানে কোন অসুবিধা হবে না। যে ক’দিন ইচ্ছা, এখানে থাকতে পারেন, সে ব্যবস্থা রইল। তবে আপনারা দেরী করবেন না। কাল সকালের দিকে যাতে হতভাগাকে গ্রেফতার করতে পারেন, দেখবেন। সে যেখানে আছে, আমি জানি। এখানকার পুলিশকে আমি সব কথা জানিয়েছি। তাদের সাহায্যে আপনারা অনায়াসে তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। এখন আমার পিতাজীকে দেখবেন, আসুন।”

দোতলার এক কক্ষে বিছানায় তাকিয়া ঠেস দিয়ে কোনমতে বসে আছেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী কোটীপতি রামেশ্বর জালান।

বিমল দেখে, মেজর রায় এবং রামেশ্বর জালানের অবস্থা সমান। মেজর রায়ের মতই জালানের হাত—পা বেঁকে গেছে, আঙুলগুলো বাঁকা—চোরা। চোখে পলক একেবারে পড়ে না। সর্ব্বদাই মুখ দিয়ে একটা ঘড়—ঘড় শব্দ হচ্ছে, বিস্ফারিত চোখে তিনি তাকিয়ে আছেন।

কৃষ্ণ রাও ফিস—ফিস করে বললেন—”সম্পূর্ণ একই লক্ষণ!”

কথাটা সুন্দরলাল শুনতে পেলেন না। পিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ধীর—কণ্ঠে বললেন—”পিতাজী, কলকাতার পুলিশ অফিসার মিষ্টার চৌধুরী আর রায়পুর পুলিশের মিষ্টার কৃষ্ণ রাও আপনাকে দেখতে এসেছেন। কিছু বলবেন?”

শয্যাগত জালান শুধু আঁ—আঁ শব্দ করেন। হঠাৎ তার ফাঁকে একটি শব্দ বেরোয়,—”উইল!”

সুন্দরলাল বললেন—”বলুন, সে—সম্বন্ধে কি বলতে চান?”

কথা বলবার ব্যর্থ চেষ্টায় জালানের দেহ আরো বেঁকে যায়। তিনি হাত তুলতে চান, পারেন না।

ব্যথিত কণ্ঠে বিমল বললে—”থাক, কাল সকালে কথা হ’বে। ওঁকে ঘুমোতে দিন সুন্দরলালবাবু।”

—”ঘুম!”

ম্লান হাসি হাসলেন সুন্দরলাল, বললেন—”দিন—রাত এমনি ভাবেই চেয়ে আছেন। কলকাতায় শরীরটা খুব খারাপ হয়েছিল। ডাক্তার ভয় পেয়েছিলেন। এখানে সে ধাক্কাটা একটু সামলে উঠেছেন।”

তিনি নিশ্বাস ফেলেন।

সুন্দরলাল উত্তর দিলেন—”শুনতে পাই, এ—সব রোগের ধন্বন্তরি ডাক্তার ইস্পাহানি।”

বিমল যেন চমকে ওঠে!

সুন্দরলাল বললেন—”মাস কয়েক আগে ইস্পাহানি সাহেব বিলাত থেকে ফিরেছেন—অন্য কোন অসুখের চিকিৎসা তিনি করেন না। মস্তিষ্কের যে—কোন অসুখে তিনি নাকি ধন্বন্তরি! সাপের বিষ সম্বন্ধে তিনি রিসার্চ করছেন। এখানে তাঁর মস্ত বড় লেবরেটরি। কিন্তু তিনি সব সময়ে এখানে থাকেন না। সম্প্রতি রায়পুরে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে আনানো হয়েছে।”

”ও!”—স্তব্ধ হয়ে যায় বিমল।

সেদিন মোটরের নম্বর মিলোতে কৃষ্ণ রাওয়ের সঙ্গে সে দেওপুরায় গিয়েছিল। ডাক্তার ইস্পাহানির মোটরের নম্বর সেই সময়ে দেখতে পেয়েছিল। আশ্চর্য্য, মোটরখানি যেন তাদের দেখাবার জন্যই বাইরে রাখা হয়েছিল!

মোটরের নম্বর মেলেনি এবং সে—সম্বন্ধে কোন কথাবার্ত্তাও হয়নি। ডাক্তার ইস্পাহানির সঙ্গে নানা গল্প করে চা পান করে আপ্যায়িত হয়ে তারা ফিরেছিল।

এখানেও সেই ইস্পাহানি!

কালো মেঘ জমে বিমলের মনে। সে ভাবে, এ সময় শিখা থাকলে তার বুদ্ধিতে হয়তো কিছু রহস্য উদ্ধার হতো!

এগারো – পরিচয়

সোহানির হাতখানা চেপে ধরে স্নিগ্ধ কণ্ঠে শিখা বলে—”আমি কিছু কিছু বুঝেছি। আপনি গোপন করতে চাইলেও পারেননি মিস্ সোহানি। আমাকে কেন বলবেন না আপনি? বলেন যদি, বিশ্বাস করুন, আমি তাহলে হয়তো আপনার কিছু ভালো করতে পারব। এটুকু বিশ্বাস আমাকে করতে পারেন!”

সোহানি নিঃশব্দে ফুলে—ফুলে কাঁদছিল। এতক্ষণ পরে সে মুখ তোলে।

সোহানির দু—চোখ বাষ্পে ভরে আছে। বাষ্পের বেগ রোধ করে সে বলে—”সব কথাই আপনাকে বলব মিস্ রায়! তবে আপনি কথা দিন, আপনাদের দেবতার নাম করে শপথ করুন, আমার স্বামীর কোন অনিষ্ট আপনি করবেন না?”

—”আপনার স্বামী!”

শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে!—”আপনার স্বামী! কে আপনার স্বামী? আপনার বিবাহ হয়েছে?”

আর্ত—কণ্ঠে সোহানি বলে—”হ্যাঁ। কিন্তু আপনি আগে শপথ করে বলুন, সব কথা শুনে যদি আপনি মনে করেন, আমার স্বামী গুরুতর অন্যায় করেছেন, তবু আপনি তাঁর অনিষ্ট করবেন না—তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করবেন?”

এ—কথা বলে সোহানি দু—হাতে মুখ ঢাকে। কান্নার বেগ সে রোধ করতে পারে না।

শিখার মন আর্দ্র হয়। মমতায় স্নেহে কণ্ঠ ভরে ওঠে। শিখা বলে—”আমি শপথ করছি, আপনার স্বামী যদি এর পরে ভালো ভাবে থাকেন, কারো উপর জুলুম না করেন—তাঁকে বাঁচাবার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। কিন্তু কে? আপনার স্বামী কে? জালিম?”

অত্যন্ত অবজ্ঞার সুরে সোহানি বলে—”জালিম আমার নোকর। আমার স্বামীর তাঁবেদার। তাঁর হুকুমে জালিম কাজ করে। আমার স্বামী ডাক্তার ইস্পাহানি!”

ইস্পাহানি! ঐ কালো কুৎসিত রুক্ষ নিষ্ঠুর ইস্পাহানি!

শিখা যেন বিশ্বাস করতে পারে না! এ কি সম্ভব? ওই কাফ্রী ডাক্তার ইস্পাহানি—এই অপূর্ব্ব—সুন্দরী তরুণী সোহানির সে স্বামী!

কিন্তু অসম্ভব হবে কেন? ওথেলো—ডেসডেমনা। তেমনি ইস্পাহানি—সোহানি! সংসারে এমন কত ইস্পাহানি আছে—কত সোহানি আছে!

শিখা বলে—”কিন্তু ডাক্তার ইস্পাহানি নিগ্রো, না? আপনি তো নিগ্রো নন!”

শিখার স্বরে প্রচুর বিস্ময়।

সোহানি বলে—”আমার দেশ সিরিয়ায়। আমার বাবা সেখানকার বিখ্যাত ধনী। এখনও তিনি বেঁচে আছেন। আমার বিমাতার জন্যই আজ আমার এই অবস্থা, মিস্ রায়।”

সে এক বিস্তারিত কাহিনী! সোহানির বাবা আলি আহম্মদ বিখ্যাত ধনী। কাজ—কারবারের জন্য তাঁকে প্রায়ই বোম্বাইয়ে আসতে হতো। সেইখানেই হয় ইস্পাহানির সঙ্গে তাঁর পরিচয়।

সোহানিকে তার বিমাতা মোটে সহ্য করতে পারতেন না। সোহানিকে নিয়েই স্বামীর সঙ্গে তাঁর নিত্য কলহ—বিবাদ। আলি আহম্মদ স্ত্রীকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন, এমন সময় হঠাৎ তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হন। সারা দেহ অবশ—কথা কইতে পারেন না—দারুণ পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতন—এবং সেই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

এর পর কি ভাবে কেমন করে সোহানি ইস্পাহানির হাতের মুঠোয় গিয়ে পড়ে, সে কথা বলতে গিয়ে সোহানি থেমে যায়।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সোহানি আবার যা বলে,—তা হল এই : বিমাতার এক ভাইয়ের ছিল সোহানির উপর লোলুপ দৃষ্টি এবং একদিন নিতান্ত বিপদে পড়ে আত্মরক্ষার জন্য সোহানি তাকে গুলি করে। কিন্তু স্বপ্নেও সে ভাবতে পারেনি, সে—গুলিতে লোকটা মরে যাবে! সোহানিকে সে—বিপদে বাঁচিয়েছিলেন ডাক্তার ইস্পাহানি। পুলিশ—হাঙ্গামা হয়নি। সোহানিকে নিয়ে ইস্পাহানি তার পরই ইয়োরোপে যান এবং সেইখানেই হয় তাঁদের বিবাহ।

শিখা বলে—”নিজের ইচ্ছায় যাকে বিবাহ করেননি, যাকে জানেন, ভালো লোক নয়—তার জন্য এত মায়া, এত দরদ আপনার!”

সোহানির কণ্ঠ করুণ হয়ে ওঠে। সে বলে,—”তবু তিনি আমার স্বামী। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তারপর তাঁর যে—পরিচয় পেয়েছি, আমি জানি তিনি অনেক অন্যায়, অনেক পীড়ন, অনেক অত্যাচার করেছেন—করছেনও; তবু সে সবের বিচারও আমি করেছি। করে দেখেছি, তাঁর মধ্যে শয়তান যেমন আছে, তেমনি ভগবানও আছেন। তবু সব দেখে, সব জেনে আমি তাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, পূজা করি। উনি বড় হতভাগ্য। কত লোক—উনি তর্জ্জনী তুললে সকলে মাথা নোয়ায়। উনি যা বলেন, নির্ব্বিচারে তা পালন করে। তবু আমি জানি, দুনিয়ায় ওঁকে ভালোবাসার কেউ নেই! কেউ ভালোবাসে না ওঁকে—সবাই ভয় করে। ভক্তি করে শুধু ভয়ে। কিন্তু ওঁর উপরও মানুষের অত্যাচার বড় কম নয়, মিস্ রায়। ঐ জালানরা ওঁর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার ফলে বুড়ো জালানকে উনি সাজা দিয়েছেন।”

শিখা বলে—”কিন্তু আমার কাকা—মেজর রায়, তাঁর উপর এ—অত্যাচার?”

সোহানি বললে—”বলব, সবই বলব। মেজর রায় যখন বর্ম্মায়, তখন তাঁর তাঁবে কাজ করত এই জালিম। জালিম মিলিটারী কানুন ভেঙ্গে অপরাধ করেছিল, সেজন্য মেজর রায় তাকে সাবধান করে দেন। সে আবার অন্যায় করে। দ্বিতীয়বারে মিলিটারী কানুনে জালিমের সাজা হয়। জালিম তখন আক্রোশে তার উপরওয়ালা সাহেবকে গুলি করে মারে। মেজর রায়কেও মারবার চেষ্টা করে, কোনমতে তিনি সে—যাত্রা রক্ষা পান। আমার স্বামী তখন বোম্বাইয়ে। জালিমকে উনি আশ্রয় দেন। তারপর তাকে তুলে দেন রামেশ্বর জালানের হাতে। রামেশ্বর জালানের সঙ্গে আমার স্বামীর খুব বন্ধুত্ব ছিল।”

এই পর্য্যন্ত বলে সোহানি চুপ করে।

শিখা শোনে—যেন আরব—রজনীর গল্প! জিজ্ঞাসা করে—”তারপর?”

সোহানি বলে—”একদল দুর্দ্দান্ত দস্যুর সঙ্গে ছিল রামেশ্বর জালানের পরিচয়। লুঠপাট করে তারা যে টাকা—কড়ি আনত, সে—সব জমা রাখত রামেশ্বরের কাছে। তাদের সেই লুঠের টাকায় জালানের কারবারের পশার হতে লাগল। ক্রমে ভারতের সর্ব্বত্র কারবারের এত ব্রাঞ্চ, এমন প্রতিপত্তি! এই দুর্দ্দান্ত জালিম ছিল জালানের ডান হাত। আমার স্বামীর অসাধারণ শক্তি। সাপের বিষ নিয়ে তাঁর রিসার্চ—এ যেন তাঁর নেশা! এর জন্য লাখ—লাখ টাকার দরকার। কেউ দেয়নি। অনেক চেষ্টা করেছিলেন, ভিক্ষে চেয়েছিলেন, তবু পাননি। তখন উনি ডাকাতের দলে যোগ দেন। অসাধারণ বুদ্ধি! সকলে ওঁকে মানতে লাগল গুরুর মত। ওঁর নির্দ্দেশে এরা ডাকাতি করত আর সে—অর্থ জমা হতো রামেশ্বর জালানের গদিতে। সেইজন্যই জালিমের সব অন্যায় বাধ্য হয়ে সহ্য করত রামেশ্বর। স্বামীর যখনই যত অর্থের প্রয়োজন হতো, রামেশ্বরকে তখনি সে—অর্থ দিতে হতো।”

সোহানি বলতে থাকে, ”জালিমের সম্বন্ধে সন্ধান করে মেজর রায় সব সংবাদই সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর ডায়েরিতে সব লেখা ছিল। হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এ—ডায়েরি পুলিশের হাতে দিতে পারেননি। আশা ছিল, সুস্থ হয়ে রায়পুর থেকে ফিরে তিনি এখানা পুলিশের হাতে দেবেন। তাহলে আমার স্বামী থেকে আরম্ভ করে কোটীপতি রামেশ্বর জালান পর্য্যন্ত সবাই ধরা পড়ে সাজা পাবে।”

সোহানি বলে—”সে ডায়েরি স্বামীর হাতে এসেছে। রায়পুর থেকে যখন টেলিগ্রাম করা হয়, তখন এরা জানতে পারে, ডায়েরি আপনার কাছে আছে এবং সেখানা নিয়ে আপনি রায়পুরে আসছেন। যেদিন আপনি রওনা হন, স্বামীর নির্দ্দেশে দলের দুজন লোক সেদিন আপনাকে ফলো করেছিল এবং আপনার ঘুমের সুযোগে সুটকেসশুদ্ধ ডায়েরি এনে ওঁকে দিয়ে বহু টাকা পুরস্কার নিয়ে গেছে।”

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে শিখা। তারপর বলে—”ডাক্তার ইস্পাহানি কি করে লোককে এমন জীবন্মৃত করে ফেলেন? আপনি নিশ্চয়ই তা জানেন, মিসেস্ ইস্পাহানি!”

সোহানির মুখে জানা যায়, ডাক্তার ইস্পাহানি এক—জাতের সাপের উগ্র বিষ থেকে এক ঔষধ তৈরী করেন, তার গন্ধে মানুষ অজ্ঞান হয়—জীবন্মৃত হয়ে থাকে। এ—রকম অবস্থায় মানুষ এক বছর পর্য্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। ডাক্তার ইস্পাহানি প্রথমে যত বিড়াল—কুকুর—ছাগল—এ সবের উপর সে—বিষ পরখ করতেন। তারা বেশী দিন বাঁচত না। তখন তিনি আরও পড়াশুনা করেন, আর বহু পরীক্ষা করেন—মানুষকে কি রকমে এই অবস্থায় এনে তারপর আবার তাকে সুস্থ স্বাভাবিক করা যেতে পারে—এই সম্বন্ধে। এ—ব্যাপারে তাঁর প্রথম পরীক্ষা চলে শিখার উপর এবং শিখাকে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ করতে পেরেছেন। এতে তাঁর খুবই আনন্দ হয়েছে—যেন রাজ্য জয় করেছেন!

মেজর রায় আর রামেশ্বর জালানের স্বাভাবিক অবস্থা কোন ডাক্তার ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। ইস্পাহানি দুটি নতুন ওষুধ তৈরী করেছেন। সে—দুটি ইনজেকশন দিলে তবে ফল পাওয়া যাবে।

শিখা বলে—”কিন্তু এ—আবিষ্কারে দুনিয়ার কোন উপকারই তো হলো না! এত মাথা খাটিয়ে কি তবে লাভ? এত পরিশ্রম করেন, তার কি ফলই বা পৃথিবী ভোগ করবে? পৃথিবীর কি উপকার হবে?”

কি ভেবে সোহানি উত্তর দিল—”এ সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কোন কথা হয়নি।”

এ—জবাবে শিখা খুশী হয় না। শিখা ভাবে, এত কষ্ট করে যিনি এমন ঔষধ আবিষ্কার করলেন, তিনি শুধু মানুষের উপর জুলুম আর অত্যাচার করবেন নিষ্ঠুর জল্লাদের মতন? এ কি অদ্ভুত স্বভাব এই ডাক্তার ইস্পাহানির!

আর এই সোহানি? বেচারী! স্বামীকে দেবতা বলে মানে, অথচ স্বামীর এ পৈশাচিকতা কি করে সে সয়ে থাকে? সোহানি কেন বুঝিয়ে স্বামীর এ পৈশাচিকতা শোধরাবার চেষ্টা করে না? সমস্যা!

বারো – সাপের বিষ

সোহানির সঙ্গে শিখা যায় ইস্পাহানির লেবরেটরি দেখতে।

বাংলোর এক পাশে মোটা কাঁচের ছোট ঘর। দেওয়ালগুলো কাঁচের, ছাদ পাকা। মোটা কাঁচের পরিষ্কার ঘর। এই ঘরে ছোট—ছোট ক’টা কাঁচের কেসে নানা জাতের সাপ রয়েছে।

সাপগুলো বড় নয়, প্রায় বিঘত—প্রমাণ। সবচেয়ে বড় সাপটি বড়—জোর এক হাত লম্বা। সোহানি পরিচয় দেয়—কোনটা কি সাপ, কত টাকায় কোন সাপ কেনা হয়েছে—সব হিসাব একেবারে কণ্ঠস্থ তার! এ সাপগুলি অত্যন্ত বিষধর—এদের বিষ একটি সূচের ডগায় দেহে ঢুকিয়ে দিলে বেঁচে মরে থাকার মত পড়ে থাকতে হবে!

পাশের কামরায় এক আলমারিতে ক’টা শিশি দেখিয়ে সোহানি বলে, ”এই শিশিতে যে সব বিষ—আরক, এগুলি পরের হপ্তায় বম্বে লেবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হবে। আর এদিকে এই যে লেবেল—দেওয়া শিশি ক’টা দেখছেন, এতে আছে প্রতিষেধক ঔষধ। এর ইনজেকশনে জীবন্মৃতভাব কেটে মানুষ আবার সুস্থ স্বাভাবিক হবে।”

শিখা এতটুকু ঔৎসুক্য বা চাঞ্চল্য প্রকাশ করে না। গম্ভীরভাবে বলে, ”কতটুকু মাত্রায় দিতে হয়?”

সোহানি ইনজেকশনের ক’টা ছোট শিশি দেখায়। এক একটি বাক্সে বারোটি করে রাখা। সে বলে—”সামনের ডিসেম্বরে জেনেভায় মেডিকেল কংগ্রেসের অধিবেশন হবে। ইস্পাহানি সেখানে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আর এই ঔষধ প্রচুর তৈরী করার জন্য তিনি বহু কষ্ট সহ্য করে এখানে পড়ে আছেন। কারণ, এ—জাতের সাপ এই অঞ্চলেই তিনি পেয়েছেন। নির্জ্জনে তাঁর এই একাগ্র সাধনার ফল যেদিন বিশ্বজগতে প্রকাশ হবে, সেদিন তিনি শ্রেষ্ঠ সম্মান লাভ করবেন। এই সম্মানলাভই তাঁর জীবনের একমাত্র কামনা।”

বলতে বলতে স্বামীর গর্ব্বে সোহানির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বলে—”স্বামী বলেন, তারপর তিনি আর ভারতে থাকবেন না। ইয়োরোপে থেকে অন্যান্য বিষয়ে রিসার্চ করবেন। তাঁর এই রিসার্চের ফলে সম্মান সম্পদ—কোন কিছুর অভাব থাকবে না তাঁর। এ—কাজে প্রচুর অর্থের দরকার। কিন্তু কেউ তাঁকে দিল না। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁকে অবৈধ উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁর অন্য উপায় নেই।”

দুজনে আবার বসবার ঘরে ফিরে আসে।

শিখা বলে—”ডাক্তার আর জালিমের সব কীর্ত্তি কাকা জানতে পেরেছিলেন—পাছে তিনি প্রকাশ করে দেন, তাই কাকাকে এ—রকম রাখা হয়েছে, বুঝেছি। কিন্তু জালান?”

সোহানি বলে, ”তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমার স্বামী মাস তিনেক আগে টাকা চেয়ে পাননি। জালান জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে আর কিছু করেন না, তাঁর বড় ছেলে সুন্দরলাল সব ভার নিয়েছেন। জালিমের পরামর্শমত জওহরলাল পঁচিশ হাজার টাকা এনে দেয়। সুন্দরলাল পুলিশে ডায়েরি করেন, আর বম্বেতে এসে রামেশ্বরের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সব জানান। সুন্দরলালকে এই সময় রামেশ্বর সব কথা বলেছিলেন—চুপি—চুপি উইল করে সব সম্পত্তি তিনি দেন সুন্দরলালকে। আমার স্বামী একথা জানতে পারেন। জানবার সঙ্গে সঙ্গে রামেশ্বরের সাজা হয়। জওহরলালকে পাঠানো হয় বম্বেতে—পৈত্রিক সম্পত্তির অর্দ্ধেক ভাগ আদায় করবার জন্য। কিন্তু—”

এই পর্য্যন্ত বলে সোহানি চুপ করে।

শিখা জিজ্ঞাসা করে—”কিন্তু—কি?”

নিশ্বাস ফেলে সোহানি বলে,—”কিন্তু ওখানে গিয়ে জওহরলাল খুন হয়। খুন হয় সুন্দরলালের হাতে। গুলি করে মেরে তার দেহ সুন্দরলাল সমুদ্রের জলে ফেলে দিয়েছে। তার পথ নিষ্কণ্টক হলো! আপনি আশ্চর্য্য হচ্ছেন। কিন্তু এ কথা সত্য। আপনি খবর নিতে পারেন, এ কথা ঠিক কি না?”

শিখা বলে—”বাড়ীতে গুলি করে খুন! এ—কথা প্রকাশ হলো না! পুলিশ কিছু করল না?”

সোহানি বলল—”পুলিশ খবর পেলে তবে তো কিছু করবে! বাড়ীর লোকজন জানাল না কেন বলছেন? টাকায় তাদের মুখ বন্ধ করা কি শক্ত, মিস্ রায়?”

এরপর সোহানি ক্ষণকাল চুপ করে থাকে। শিখাও চুপ করে কত—কি ভাবে।

সোহানি আবার বলে,—”কিন্তু সুন্দরলাল মুক্তি পাবেন বলে মনে হয় না। আমার স্বামীকে তিনি জানেন না—এর ফল তাঁকে ভোগ করতেই হবে!”

শিখা ভাবছিল, ইস্পাহানি রিসার্চের ফল যা দেখেছে, সত্যই অতি অদ্ভুত!

অদ্ভুত প্রতিভা! স্বীকার করতেই হবে! কিন্তু এমন করে এ—প্রতিভার অপমৃত্যু হবে? এ—প্রতিভার দানে পৃথিবীর কোন উপকার হবে না?

সোহানি বলে উঠল—”আপনি কিন্তু ভুলবেন না, আপনি আমাকে কথা দিয়েছেন, আমার স্বামীকে আপনি রক্ষা করবেন!”

সোহানি বিদায় নেয়। দরজা বাহির থেকে বন্ধ হয়ে যায়।

শিখা ভাবে, কি সরল বিশ্বাস এই সোহানির মনে!

তেরো – সর্প-যজ্ঞ

শিখা ভাবে—অনেক কিছুই সে ভাবে। ভাবে, এ—বন্দিত্বের অবসান করতেই হবে—এবং অচিরে। সে শুনেছে, ডাক্তার ইস্পাহানি এখানে নেই—এই তো সুযোগ! এ—সুযোগ হারালে কে জানে, পরে কি হবে! বিলম্ব করা ঠিক নয়!

কিন্তু কি করে? একটা ফন্দি জাগে শিখার মনে। সে ভাবে, তা কি সম্ভব হবে? তবু চেষ্টা করতে হবে। এ—ছাড়া অন্য উপায়ই বা কি আছে!

বাথরুমের জানালার মোটা কাঁচখানা ভাঙতে চেষ্টা করে শিখা।

মস্ত বড় কাঁচ—কোন রকমে ভেঙে যদি খুলে ফেলতে পারা যায়, তাহলে ও—পাশে ডাক্তারের লেবরেটরিতে যেতে পারবে। এ—দিকে কোন লোক থাকে না। সোহানি তাকে বিশ্বাস করে। হাবে—ভাবে শিখা এতটুকু চাঞ্চল্য দেখায় নি! এখান থেকে পালাবার বাসনা আভাসেও সে প্রকাশ করে নি সোহানির কাছে! তা—ছাড়া শিখার উপর তার অনেকখানি বিশ্বাস—তার স্বামীকে শিখা রক্ষা করবে।

শিখার হাসি পায়, দুঃখও হয়। হাসি পায়—সোহানি তাকে বিশ্বাস করেছে দেখে। যাকে ধরে এনে আটক করে রেখেছে, তারই সাহায্য চায় সোহানি! আর দুঃখ হয় এই ভেবে যে,—লোকটাকে মূর্ত্তিমান শয়তান জেনেও সোহানি তাকে এত ভালোবাসে!

একটু চেষ্টা করতেই কাঁচ ফেটে যায়। তারপর বেশ বড় একটা অংশ খসে পড়ে। তবু সে নিরাপদে বার হওয়ার জন্য যথাসাধ্য নিঃশব্দে আরও খানিকটা কাঁচ ভেঙে ফেলে।

আজ এ—বেলা সোহানি এখানে থাকবে না, বলে গেছে। কি দরকারে বাইরে যাবে। কোথায়, তা বলেনি।

বাথরুমের জানালা গলে’ সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে শিখা।

সোহানির শয়ন—কক্ষ। সেই কক্ষে এসে পড়েছে শিখা। এ—ঘর সে জানে। টেবিলের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি পড়ে সোহানির চকচকে রিভলভারটার উপর। শিখার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রিভলভারটা সে তুলে নেয়।

অনেকখানি ভরসা হয় অস্ত্র হাতে পেয়ে।

দরজা খুলে সে যায় লেবরেটরিতে।

দিন শেষ হয়ে আসে। এখনই সন্ধ্যা নামবে। অন্ধকারে কিছু করা যাবে না।

এদিকে কেউ নেই! আশ্চর্য্য! গেল কোথায় লোকজন?

শিখা তাড়াতাড়ি প্রতিষেধক—যাতে রোগ সারে—সেই ইনজেকশনের ওষুধের ক’টা শিশি তুলে নেয়। বিষাক্ত শিশিও একটা নেয়। তারপর সে ফেরে।

হঠাৎ পায়ের শব্দ যেন! শিখা চমকে ওঠে।

”চমৎকার মিস্ রায়! কিন্তু ধরা পড়ে গেলে!”

এ—কথা বলে সামনে যে লোকটা এসে দাঁড়াল, সে ডাক্তার ইস্পাহানির অনুচর জালিম। শিখা বহুবার তার ফটো দেখেছে, তাই সে দেখেই চিনতে পারে তাকে।

উদ্ধত ভঙ্গিতে জালিম এসে শিখার সামনে দাঁড়ায়, বলে—”মিসেস্ আমাকে পাহারায় রেখে গেছেন। বেশ ছিলে, তাই পাহারা ছিল না তোমার। ভেবেছিলে, তুমি শার্শি ভেঙে…থামো, ওদিকে পা বাড়িও না!”

মরিয়া হয়ে ওঠে শিখা।

জালিম তার সামনে আসতেই সে দৃঢ় হস্তে রিভলভার তুলে ট্রিগার টেপে। সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলি ছুটে জালিমের বুকে বেঁধে।

”ও—! শয়তানি!”

দু—হাতে বুক চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুর্দ্দান্ত জালিম।

কারা যেন ছুটে আসছে না? হ্যাঁ। একজন নয়, দুজন নয়, অনেক লোক। বহু লোকের দ্রুত পদ—শব্দ শোনা যায়।

মুহূর্ত্ত ভাবে শিখা। তারপর একটু তফাতে সরে গিয়ে সাপ—ভর্ত্তি কাঁচের ঘর লক্ষ্য করে পর—পর দুটো গুলি ছোঁড়ে! ঝনঝন শব্দে কখানা কাঁচ খসে পড়ে।

এখন যা হবে, শিখার বুঝতে দেরী হয় না। ঐ সব কাঁচের কেসে বিষাক্ত সাপের মেলা—কেস খোলা পেয়ে এখনি তারা—

ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে শিখা সামনের মাঠে গিয়ে পড়ে। এ—দিকটা ফাঁকা—যারা পাহারা দিচ্ছিল, এ—দিকে তারা চট করে আসবে না! তারা শিখার সন্ধানে ছুটেছে ঐ লেবরেটরির দিকে!

মাঠে পড়েই শিখা এক দিক লক্ষ্য করে ছোটে।

এতক্ষণে সাপগুলো বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে—যারা তার জন্য ছুটে আসছে, তাদের কি হবে, মনে করতে শিখা শিউরে ওঠে!

চৌদ্দ – কর্ম্মফল

কিছুদিন পরের কথা—

মেজর রায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

শিখা ইনজেকশন এনে দিয়েছে। ডাক্তাররা প্রথমে নূতন ইনজেকশন দিতে চাননি। শিখা তাঁদের ডাক্তার ইস্পাহানির বিবরণ আগাগোড়া বলেছে—নিজের কেসে এ ইনজেকশনে যে—ফল পাওয়া গেছে, তাও শিখা তাঁদের বলেছে। তখন তাঁরা রাজী হন। বিশেষ করে যখন আর কোন উপায় নেই, তখন দেখা যাক!

দুটি ইনজেকশনেই তিন মাসের জীবন্মৃত রোগীর স্বাভাবিক ভাব ফিরে আসে। অলৌকিক ব্যাপার! ডাক্তাররা অবাক হন!

রামেশ্বর জালানের মৃত্যু হয়েছে। সুন্দরলাল কলকাতায় ফিরলেন। ফিরতেই গ্রেফতার হয়ে বোম্বাইয়ে চালান হন। শিখার কথায় পুলিশ থেকে জওহরলালের সম্বন্ধে তাঁকে নানা প্রশ্ন করা হয়। সুন্দরলাল জানান, জওহরলাল গদির টাকা তছরূপ করে ফেরার। তিনি জওহরলালের কোন খবর জানেন না। পুলিশ তাঁকে জেরা করে। বিমল বলে—”বম্বেতে আপনি বলেছিলেন জওহরলাল কোথায় থাকে, আপনি জানেন। তার ঠিকানা দিয়ে তাকে চটপট গ্রেফতার করতে বলেছিলেন সুন্দরলালবাবু! আর এখন বলছেন, তার খবর জানেন না!”

বম্বে—পুলিশকে এ সম্বন্ধে তদন্ত করতে বলায় বম্বে—পুলিশ মালাবার হিলসের বাড়ীর লোকজনকে ধরপাকড় করে। তারা জান বাঁচাবার জন্য আসল কথা পুলিশের কাছে প্রকাশ করে। তার উপর সমুদ্রের ধারে পাওয়া যায় জওহরলালের লাশ। জলে ফুলে ঢোল! মুখ দেখা চেনা যায় না—শুধু বেশভূষা দেখে সেখানকার লোকজন সনাক্ত করে। পোষ্টমর্টেমে জানা যায়—বুকে গুলির চোট লেগে তার মৃত্যু হয়েছে!

সুন্দরলালকে খুনের চার্জে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। বিচারে তিনি যোগ্য শাস্তি পেয়েছেন।

কিন্তু ডাক্তার ইস্পাহানি কোথায় গেলেন? সুন্দরী সোহানি?

তাঁদের দেখা শিখা পায়নি। কৃষ্ণ রাও পাননি। বিমলও পায়নি। তারা যেন বাতাসে মিশে জন্মের মত হারিয়ে গেছে!

সোহানির স্মৃতি শিখার মন থেকে মিলিয়ে যায়নি। শিখা কেবলি ভাবে—কোথায় সোহানি? তার কি হলো? সে কেমন আছে? স্বামীর সঙ্গ—সাহচর্য্য!—স্বামীকে সোহানি কত ভালোবাসে!

এক—একবার মনে হয়, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে—কোথায় আছো সোহানি। শিখাকে এক ছত্র লিখে শুধু জানাও, ভালো আছ!…যে—ভাবে শিখা নিজেকে উদ্ধার করেছে—জানে, তাতে সোহানির আর ইস্পাহানির অনেক অনিষ্ট হয়েছে হয়তো! তবু সোহানিকে সে ভুলতে পারেনি—পারবে না! শিখার মনে সোহানির কথা চিরদিন জেগে থাকবে!

বছর—খানেক পরে…

সোহানির পত্র আসে সুদূর নাইজিরিয়ার ছাপ বুকে নিয়ে শিখার নামে। রেজেষ্ট্রী পত্র।

সোহানি লিখেছে—

যেদিন শিখা পলায়ন করে, সেইদিন ডাক্তার ইস্পাহানির ফেরবার কথা ছিল, সেইজন্যই সোহানি রায়পুর ষ্টেশনে গিয়েছিল। ইস্পাহানির ট্রেনে আসবার কথা ছিল—প্লেনে নয়।

ট্রেন সেদিন অনেক লেট করে আসে। রায়পুর ছাড়িয়ে মোটর যখন দেওপুরায় আসে, তখন দলের বহু লোকের মুখে বাংলোর খবর শোনেন, বন্দিনী পালিয়েছে—ডাক্তারের এত দিনের পরিশ্রমে তৈরী যত রকম ঔষধ সব নষ্ট করে! সাপগুলোর কাঁচের কেস ভাঙ্গা। সাপগুলো বেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কাজেই দেওপুরায় না যাওয়াই উচিত।

ডাক্তার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকেন। তারপর সোহানিকে নিয়ে মোটরে চলে যান রায়গড়। তিনি জেনেছিলেন, রায়পুর পুলিশ তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে; সেজন্য রায়পুরে অপেক্ষা করতে পারেননি।

রায়গড়ে ট্রেন ধরে তাঁরা বম্বে আসেন এবং সেখান থেকে প্লেনে চড়ে একেবারে নাইজিরিয়ায়।

সোহানি লিখেছে—

আমার স্বামীর স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। সর্ব্বদাই তিনি অন্যমনস্ক। প্রায় কথা বলেন না। তাঁর কত বড় আশা তুমি নষ্ট করেছো মিস্ রায়, তা তুমি বুঝতে পারছ? এখানে এসে খবর পেয়েছি, মেজর রায় সুস্থ হয়েছেন—বিশ্বাসঘাতক জালানের মৃত্যু হয়েছে আর সুন্দরলাল খুনের চার্জে চরম দণ্ড পেয়েছে।

তুমি বলবে—তোমায় পত্র লিখছি কেন? তার উত্তর, সত্যই তোমাকে আমি আমার ছোট বোনের মত ভালবেসেছি মিস্ রায়। তোমায় আটক করে রাখবার ইচ্ছা আমার স্বামীর ছিল না। তিনি ঠিক করেছিলেন পরের হপ্তায় আমরা বম্বে ফিরব এবং সেখান থেকে ইউরোপ যাব—তখন তোমায় মুক্তি দিয়ে যাবেন। তোমার উপর আমার স্বামীর এতটুকু বিদ্বেষ ছিল না, বিশ্বাস কর। তোমার শক্তি আর সাহসের জন্য তোমাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। তোমাকে ভয় করতেন বলেই আটক করে রেখেছিলেন।

মানুষ ভাবে এক, ভগবান করেন আর এক। তাই আমার স্বামীর জীবনের সাধনা নষ্ট হয়ে গেল। আজ তিনি নিজেই অমানুষ হতে চলেছেন। জানি না, আশা—ভঙ্গের এ বেদনা তিনি সহ্য করতে পারবেন কি না!

আজ আসি। আমার শুভ—কামনা নাও।

 সোহানি ইস্পাহানি

.

শিখা চিঠিখানা নাড়াচাড়া করে। তার দু—চোখ জলে ভরে ওঠে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *