০১. অগ্নিশিখা

অগ্নিশিখা

এক. সাহসিকার অভিযান

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুন তখন ভারতের পূর্ব্ব সীমান্ত পর্য্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ব্রহ্মদেশ অধিকার করে দুর্দ্ধর্ষ জাপানী বাহিনী তখন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। লক্ষ্য তাদের ভারতবর্ষ। দিনের পর দিন খবর আসছে তাদের অগ্রগতির। জাপানী বাহিনীর ভারতের মাটিতে প্রবেশ করবার স্থলপথে দুটি মাত্র রাস্তা—এক মণিপুর রাজ্যের কোহিমার পথে, আর একটা হচ্ছে চট্টগ্রামের পথে।

ব্রহ্ম সীমান্ত থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব বেশী নয়। তাই জাপানী বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সুরু হয়ে যায় চট্টগ্রাম থেকে পালাবার ধুম। সবাই পালাতে ব্যস্ত। বাড়ীঘর, ব্যবসা—বাণিজ্য সব কিছু ফেলে রেখে মানুষ তখন পালাচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে—প্রাণরক্ষার স্বাভাবিক তাগিদে।

কিন্তু ঠিক এই পরিস্থিতিতেই শিখা ঠিক করলো যে সে যাবে চট্টগ্রামে, তার কাকার কাছে। যুদ্ধের ভয়াবহতাকে এতকাল শুধু বইতেই পড়েছে শিখা। আজ যখন হঠাৎ সুযোগটা এসে গেল, তখন সে কেন চুপচাপ বসে থাকে ঘরের কোণে? সে দুচোখ ভরে দেখবে যুদ্ধের তাণ্ডব নৃত্য…তার প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসলীলা! সুযোগটা হঠাৎই এসেছে। তার কাকা মেজর অতুলকৃষ্ণ রায় উচ্চপদস্থ মিলিটারী অফিসার। এতদিন তিনি ভারতের নানা জায়গায় কাটালেও কিছুদিন আগে তিনি বদলি হন দূরপ্রাচ্য—সীমান্তে। সৌভাগ্যক্রমে চট্টগ্রামেই পোষ্টেড হন তিনি। চট্টগ্রাম সহরে তাঁদের নিজস্ব বাড়ী থাকায় সেখানেই তিনি উঠেছেন বলে চিঠি লিখেছিলেন শিখার কাছে। এই কারণেই শিখা ভাবলো যে সে যদি চট্টগ্রামে তার কাকার কাছে গিয়ে হাজির হয় তাহলে বহুদিন পরে কাকাকেও দেখা হবে, আবার যুদ্ধটাও হয়তো দেখা যাবে। শিখার দুঃসাহসী অভিযানপ্রিয় মনটা নেচে ওঠে। সে চট্টগ্রামে যাবে ঠিক করে।

শিখার কলেজের বন্ধুরা অবাক হয়ে যায় তার কথা শুনে। এসময়ে সকলেই নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে চায়, আর শিখা যেতে চায় কিনা সব চেয়ে বিপদের সম্ভাবনা যেখানে বেশী সেইখানে!

শিখা বলে, চট্টগ্রাম তার জন্মভূমি, বাল্যের ক্রীড়াভূমি। চট্টগ্রামের গাছপালা, নদ—নদী, পাহাড়—পর্ব্বত সকলের সঙ্গেই তার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। এই চট্টগ্রাম যদি জাপানীদের বোমায় বিধ্বস্ত হয়—তার আগে একবার দেখে নেবে না সে তার জন্মভূমিকে!

বন্ধুরা বলে, ”ধন্যি মেয়ে বাবা তুই—বুকে একটু ভয়ও নেই!”

শিখা হেসে বলে, ”কিসের ভয়? মৃত্যুর?—সে ত’ একদিন হবেই! তা বলে মনের ইচ্ছা চেপে থাকি কি করে বল?”

মীরা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে বলল, ”আমিও যাবো শিখা, তোর সঙ্গে—”

”বেশ ত—চলনা। কিন্তু তোর মা—বাবার কি মত হবে?”

”তাঁদের না জানিয়েই যাবো—তাঁরা এখন, দিল্লী থেকে ফিরছেন না। কলেজেরও ছুটি রয়েছে—তোদের দেশ দেখবার প্রচুর সুযোগ। আর তোদের যখন বাড়ী রয়েছে সেখানে, তুইও সঙ্গে রইলি, তখন আর ভয়টা কিসের?”

শিখা বলল, ”তবে গোছগাছ করে নে, কালই রওনা হব।”

* * * *

চট্টগ্রামের নিজের বাড়ীতে এসেছে শিখা। সঙ্গে তার কলেজের বন্ধু মীরা। সারাদিন ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে শিখা দেখাল দোকান, বাজার, তাদের ইস্কুল, তাদের নিজেদের হাতে গড়া ক্লাব। কিন্তু দেখিয়ে যেন আনন্দ পায় না শিখা। দোকান বেশীর ভাগই বন্ধ, বাজারে লোক নেই, বাড়ীগুলোও সব ফাঁকা ফাঁকা। ছেলেবেলাকার বন্ধু—বান্ধবেরাও কেউই নেই। প্রায় প্রত্যেকেরই বিয়ে থাওয়া হয়ে গেছে। আর যারা ছিল, তারা প্রাণ—ভয়ে ভিটে—মাটি ছেড়ে কোথায় কে পালিয়েছে কে জানে? নেহাৎ যেসব অধিবাসীদের যাবার কোন উপায় নেই তারাই ভগবানের নাম স্মরণ করে পড়ে আছে এখানে।

শিখা তার শৈশবের গল্প বলে। গল্প বলা যেন শেষ হয় না শিখার। মীরারও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে না, বরং আনন্দই পায়—চুপ করে শুনে যায় শিখার বাল্য—জীবনের গল্প।

রাত্রে শুয়ে শুয়েও গল্প চলল অনেকক্ষণ। গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মীরা। শিখাও ঘুমাবার চেষ্টা করছে। হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠে—”ভোঁ ও ও ও—ও”…

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে শিখা। মীরাকেও ডেকে তোলে। সাইরেনের শব্দ সেও শুনতে পায়। কোন কথা বলবার অবসর পায় না শিখা। তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে শেলটারের খোঁজে। পরিত্রাহি রবে লোক ছুটে আসছে শেলটারের দিকে। ভিড়ের মাঝে ছিটকে পড়ে ওরা দুজনে দুদিকে। তখনও সাইরেন বেজে চলেছে। বিপন্ন নরনারীর করুণ বিলাপের অনুকরণ করেই বিপদের সঙ্কেত জানিয়ে চলেছে ওটা! সচকিত হয়ে উঠেছে সহরবাসী। ঘুমন্ত লোকের ঘুম ভেঙ্গে গেছে। সদ্য জাগ্রত শিশুর কান্না শোনা যায়। মা তাকে বুকে তুলে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থলের দিকে ছুটে চলে…

সাইরেন থামবার আগেই বোমা ফাটার শব্দে কান বুঝি ফেটে যায়। আকাশের বুক থেকে ভেসে আসে জাপানী বোমারু বিমানের ঘর্ঘর শব্দ।

একখানা দুখানা নয়—অনেকগুলি। নিষ্প্রদীপ সহরের অস্তিত্ব তারা কি করে জানতে পেরেছে কে জানে! উপর হতে ইচ্ছামত গোটাকতক বোমা ফেলে প্লেন কয়টি চক্রাকারে সহরের উপর ঘুরে বেড়ায়।

ব্রিটিশ বাহিনীও নিশ্চেষ্ট থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে সুরু হয়ে যায় বিমানধ্বংসী কামান থেকে গোলাবর্ষণ। আরও একটু পরেই ছুটে আসে ব্রিটিশ জঙ্গী বিমানের ঝাঁক। শত্রুর বোমারু বিমান দ্রুত প্রস্থান করে, যেদিক থেকে এসেছিল সেই দিকে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর।

এই এক ঘণ্টা যাবৎ সহরবাসী অন্ধকার আশ্রয় স্থলে কোনরকমে মাথা গুঁজে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে প্রতি মুহূর্ত্তে। আবার এল কয়েকখানা শত্রুবিমান। নিকটেই কোথায় একটা বোমা পড়লো। বিদ্যুতের মত আলো চমকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণবিদারী ভীষণ শব্দ হল। শিশু মায়ের বুকের মধ্যে পড়ে রইলো অর্দ্ধমূর্চ্ছিতাবস্থায়, সমর্থ পুরুষেরা সশঙ্কিত হয়ে কানে হাত চাপা দিলেন।

অল ক্লীয়ার—

আবার সাইরেন বাজে—ভো ও ও ও—

একটানা শব্দ। বিপন্নের বিলাপ—ভরা নামা—ওঠা সুর নয়।

বাঁচা গেল। একে একে লোকেরা বাইরে আসে—পরস্পর আত্মীয়—স্বজনকে নাম ধরে কম্পিত চাপা গলায় ডাকে। কে কোথায় গেছে ঠিক নেই। বিভিন্ন শেলটারে যে যেখানে পেরেছে আশ্রয় নিয়েছে। এক ঘণ্টা সময় তাদের উপর দিয়ে যেন পাঁচটা বৎসর টেনে নিয়ে গেছে।

মৃত্যুর মুখোমুখি এমন একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি কেউ কোনদিন কল্পনাও করেনি!

এমনই একটা শেলটার হতে বার হয়ে আসে শিখা। চীৎকার করে ডাকে মীরাকে। কিন্তু কোন সাড়া পায় না।

উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে শিখা। কলকাতার মেয়ে মীরা—কলকাতার বাইরে কখনও যায়নি সে। ভাবনার কথা তো—গেল কোথায় সে?

অন্ধকারের মধ্যে সে মীরাকে খোঁজে।

সাহস তার যথেষ্ট,—অচেনা অজানা লোকের মাঝে সে ডাকে মীরাকে, প্রত্যেক শেলটারের সামনে দাঁড়িয়ে খোঁজ করে।

এ. আর. পি.র লোকেরা ধমক দেয়। বলে, ”ফিরে যান নিজের বাড়ীতে, এ সময় পথে পথে ঘুরবেন না।”

তারা জানায় মিলিটারী গোরার দল চারিদিকে ঘুরছে, যে কোন মুহূর্ত্তে তার যে কোন বিপদ ঘটতে পারে। নিজেকে নিরাপদে রাখা এখন তার কর্ত্তব্য।

চিন্তিত মনে ক্লান্ত পদে শিখা বাড়ীর দিকে ফেরে। এ. আর. পি.র লোকেরা তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়। মীরার আকৃতি প্রকৃতি বয়স সব জেনে নিয়ে খোঁজ করবার আশ্বাস দিয়ে তারা চলে যায়।

দুই. মংপোর পরিচয়

শত্রুপক্ষের বোমারু বিমান যখন সহরের উপরে হানা দেয় মেজর রায় তখন বাড়ীতে ছিলেন না। সৈন্য বিভাগের পদস্থ অফিসার তিনি। সুতরাং শত্রু বিমানের আক্রমণের সময় তিনি কিছুতেই বাড়ীতে আসতে পারেন না, তা যত বিপদই ঘটুক না কেন বাড়ীতে।

তাই পরদিন সকালে বাড়ীতে এসে তিনি যখন শুনতে পেলেন যে তাঁরই ভাইঝির বন্ধু মীরা নিখোঁজ হয়েছে, তখন প্রথমটা তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তারপর তাঁর চোখ দুটো জ্বলে উঠলো হিংস্র শ্বাপদের মত! যেন এই মুহূর্ত্তে তিনি কারুর টুঁটি ছিঁড়ে রক্তপান করবেন!

তিনি বললেন, ”আমি বুঝতে পেরেছি শিখা এটা কার কাজ। কিন্তু মংপো যদি ভেবে থাকে যে উপকূল পাহারা দেবার কাজ পেয়েই সে সরকারের পোষ্যপুত্র হয়ে গেছে তাহলে সে মস্ত ভুল করেছে।”

মেজর রায় কি বলতে চান কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে শিখা বললো, ”আপনি কার কথা বলছেন, কাকা?”

মেজর রায় বললেন, ”বলছি মংপোর কথা। শয়তানটা যে কি করে মিলিটারী ওয়াচম্যানের কাজ জোগাড় করলো তাই ভাবছি। ওর সম্বন্ধে আমি অনেক কিছুই শুনতে পেয়েছি। কিন্তু ওযে আমার বাড়ীর কোন মেয়েকে অপহরণ করতে সাহস করবে তা আমি ভাবতেও পারছি না।”

—”কিন্তু কাকা, মংপোই যে মীরাকে অপহরণ করেছে তা আপনি কি করে বুঝলেন?”

—”ঠিক বুঝি নি, তবে অনুমান করছি। আমার কাছে এর আগেও মংপোর বিরুদ্ধে এইরকম কয়েকটা খবর এসেছে। তাছাড়া একমাত্র মংপোর দলবলই বিমান আক্রমণের সময় রাস্তায় ঘুরতে পারে মিলিটারীর হুকুমে। সুতরাং এটা যে মংপোরই কাজ এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।”

—”এখন তাহলে আমাদের কর্তব্য কি কাকা? মীরাকে মংপোর দলের হাতে ছেড়ে দিয়ে তো কলকাতায় ফিরতে পারবো না আমি। যেমন করেই হোক মীরাকে উদ্ধার করতেই হবে আমাকে।”

মেজর রায় শিখার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত ভাবে সামনের টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে বললেন, ”নিশ্চয়ই। মীরাকে উদ্ধার করতেই হবে আমাদের। কিন্তু—”

—”কিন্তু কি কাকা?”

—”কিন্তু আমি তো মিলিটারীর কাজ ছেড়ে এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু করতে পারবো না মা। যাই হোক, আমি এখনই যাচ্ছি পুলিশ সুপারের কাছে। তিনি যাতে এ ব্যাপারে তাঁর সর্ব্বশক্তি নিয়োগ করেন, সে ব্যবস্থা আমি করবো।”

* * * *

এখানে মংপোর কিছু পরিচয় না দিলে কাহিনী অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। বংশানুক্রমে ওরা দস্যু। শোনা যায় অতীতে নাকি মংপোর পূর্ব্বপুরুষদের ছিল অসীম ক্ষমতা—অসাধারণ প্রতিপত্তি। সমুদ্রের উপরে তাদের আধিপত্য নাকি ছিল অসীম। কিন্তু সে অতীতের কথা এখন অতীত হয়ে গেলেও বংশানুক্রমিক সেই দস্যুবৃত্তির ধারাটা এখনও রক্ষা করে চলেছে ওরা।

মংপোর বাবার নাম ছিল লো—অন। সমুদ্রের বুকে দস্যুবৃত্তি করাই ছিল তার পেশা। আর এই দস্যুবৃত্তি করতে গিয়েই সে ধরা পড়ে শেষ পর্য্যন্ত। বহু নরহত্যা ও ডাকাতির অপরাধে ফাঁসির হুকুম হয় লো—অন—এর। মংপো তখন কিশোর।

পিতার বীরত্ব, পিতার সাহস—শক্তি সে উত্তরাধিকার—সূত্রে পেয়েছিল। তবে পিতার মত সে অদূরদর্শী নয়। পিতার মনে সমুদ্রের সম্রাট বলে যে অহঙ্কার ছিল সে অহঙ্কার সে করে না। নিজেকে বাঁচিয়ে কাজ করতে জানে এবং করেও আসছিল সে। সেইজন্য কোনও দিন সে ধরা পড়েনি।

বৎসরের কয়টা মাস সে থাকে তার নিজের দেশে,—পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্গত সে—দেশ। মাছ ধরবার সময় কয়টা মাস সে চট্টগ্রামে আসে। দলের লোকেরা তাকে পেয়ে খুসি হয়ে ওঠে কম নয়। মংপোকে তারা সম্রাটের আসন দেয়, দেবতার মত ভক্তি করে।

বঙ্গোপসাগরের সর্ব্বত্র তার অবাধ গতি। প্রবল ঝড়—তুফানকেও সে গ্রাহ্য করে না। জল—পুলিশ, স্থল পুলিশ সবাই তার নাম জানে।

নামে সে মাছধরার ব্যবসা করে, অথচ তার পরিচয় কারও অজানা নেই। সে দস্যু, একথা সকলেই জানে বটে, কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে এ পর্য্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয় নি। তবুও সে গভর্ণমেন্টের কাছে কাজ বাগিয়েছে। বিপদের সময় বুঝে, যুদ্ধের সময় এই দুর্দ্দান্ত লোকটিকেই বৃটিশ গভর্ণমেন্ট কাজ দিয়েছেন।

বঙ্গোপসাগরের উপকূল চৌকি দেওয়ার ভার পড়েছে তার ওপর।

মংপো ইচ্ছামত সাগরের বুকে টহল দেয়, ইচ্ছামত নৌকা ষ্টীমার আটক করে, সার্চ করে, সন্দেহজনক দেখলে জলপুলিশের সাহায্য নেয়। বেশীর ভাগ নিজেই শাস্তি দেয় বন্দীদের, লুটপাও করে। সে রক্ষক কি ভক্ষক তা তখন চেনা দুষ্কর।

মাঝে মাঝে সে তার লঞ্চ তীরে বাঁধে, সহরে খুসীমত ভ্রমণ করে।

আজ তাকে গোপনে চলাফেরা করতে হয় না, সগর্ব্বে সদম্ভে পথ চলে। সে সাগরপথের রক্ষী, এই তার বর্ত্তমান পরিচয়।

কাকা শিখাকে সুস্থির হতে বলে ক্যাম্পে ফিরে যান। যাওয়ার সময় উপদেশ দিয়ে যান, সে যেন মীরার জন্য কোন বিপদের ঝুকি মাথায় না নেয়। তিনি পুলিশ—সুপারকে বলে যত তাড়াতাড়ি পারেন, এর একটা বিহিত ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন।

কাকার কথা শুনে শিখা মনে মনে হাসে। বন্ধুর এমন বিপদে সে চুপ করে থাকবে, কাকা তাকে এমন মেয়ে ভাবলেন কি করে?

বাড়ীতে একমাত্র রতন চাকর ছাড়া আর দ্বিতীয় লোক নেই। কিশোর রতন,—সব কাজে উৎসাহ তার অত্যন্ত বেশী। মাঝে মাঝে সহরে টহল দিতে যায়, সেদিনও সে গিয়েছিল।

ফেরে সে হাঁপাতে হাঁপাতে। দেখেই বুঝা যায় একটা কোন খবর সংগ্রহ ক’রে ফিরেছে সে।

—”জানো দিদিমণি, মীরা দিদিমণিকে নিয়ে গেছে মংপোর লোকেরা। সেই রাত্রে অল—ক্লীয়ার দেওয়ার পর আর সকলের সঙ্গে যেমন তিনি বার হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে মংপোর লোকেরা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে—রহিম বললে একথা।”

—”রহিম কে?” শিখা জিজ্ঞাসা করে।

রতন উত্তর দেয়, ”সে পুলিশে কাজ করতো, এখন ছুটিতে আছে।”

শিখা বললে, ”তাকে একবার আমার কাছে ডেকে আনতে পারবে রতন? দেখি যদি তার কাছ থেকে কোন কথা জানতে পারি।”

উৎসাহিত হয়ে রতন ছুটে যায়।

খানিকক্ষণ পরেই রহিম এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়ায়। শীর্ণ চেহারা—দেখে তাকে পুলিশের লোক বলে মনেই হয় না। তার মুখে শিখা শুনতে পায় সব কথা।

কয়জন লোক অন্ধকারে একটি মেয়েকে বয়ে নিয়ে সাগরের ধারে মংপোর লঞ্চের দিকে যাচ্ছিল। তারা দুর্ব্বোধ্য কি এক ভাষায় কথাও বলছিল। সন্দেহ হওয়ায় রহিম তাদের পিছনে পিছনে খানিকটা দূরে থেকে অনুসরণ করেছিল। পথে কয়জন এ. আর. পি.র লোকের সঙ্গে দেখা হয় এবং সে তাদের কাছে মেয়েটিকে উদ্ধার করার প্রার্থনা জানায়। কিন্তু কেউই সেদিকে এগুতে সাহস করেনি। ওরা সকলেই মংপোকে ভাল করে চেনে।

শিখা নীরবে তার কথা শুনে যায়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, ”কোথায় তাকে নিয়ে গেছে আন্দাজ করতে পারো কি?”

রহিম উত্তর দিল, ”কক্সবাজারে ওদের একটা খাঁটি আছে জানি। জায়গাটা নিরাপদ। যদি কোন গোলমাল হয়, সেখান হতে চটপট বর্ম্মায় চলে যেতে পারে।”

শিখা বললে, ”বুঝেছি, কিন্তু তুমি এত কথা জানলে কি করে?”

সে কথার উত্তরে রহিম যা জানায়, তা হল এই :

রহিম আগে নৌকার মাল্লার কাজ করতো। যৌবনের প্রারম্ভে সে গিয়ে পড়ে বিখ্যাত দস্যু সর্দ্দার মংপোর দলে। বাধ্য হয়ে তাকে নানা অসৎ কাজও করতে হয়। একবার একটা জলডাকাতি করতে গিয়ে সে দলের সঙ্গে ধরা পড়ে। সে দলে যে কয়জন লোক ছিল, সকলেরই দীর্ঘদিনের জন্য কারাদণ্ডের আদেশ হয়। তার বয়স তখন মাত্র সতেরো বৎসর বলে হাকিম তাকে কম দিন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন এবং সে মুক্তি পাওয়ার পর পুলিশের কাজ পেয়েছে। অবশ্য বেতনভুক পুলিশ হিসাবে সে কাজ করে না। অনেক গোপন সংবাদ সে জোগাড় করে এনে থানায় ভারপ্রাপ্ত দারোগাকে দেয় আর এই কাজের জন্য মাসে মাসে কিছু টাকাও সে পায়। আসলে সে একজন পুলিশের ‘ইনফরমার’।

শিখা এতক্ষণে বুঝতে পারে কিভাবে পুলিশের কাজ করে রহিম। তার মনে হয়, এই লোকটাকে দিয়ে অনেক কাজ হবে। তাছাড়া মংপোর দলের গতিবিধিও যখন ওর জানা, আর মীরার সন্ধান করতে এই মংপোর দলের বিরুদ্ধেই যখন তাকে যেতে হবে, তখন এ লোকটাকে কিছুতেই হাত—ছাড়া করা ঠিক নয়।

সে তখন রহিমকে বলে, ”তোমার সাহায্য আমার খুবই দরকার হবে রহিম। অবশ্য বিনা টাকায় তোমার সাহায্য আমি চাই না। তোমাকে আমি উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব এজন্য।”

বলতে বলতে সে ব্যাগ খুলে দুখানা দশ টাকার নোট বার করে। রহিমের হাতে দিয়ে বললে, ”আজ এই টাকাটা নিয়ে যাও, তারপর আবার দেব। হয়তো কালই তোমাকে আমার দরকার হবে, তুমি কোথাও যেন যেয়ো না।”

খুসি হয়ে ওঠে রহিম।

তিন. সাগরের বুকে

বঙ্গোপসাগরের বুকে ভাসে নৌকাখানা। সাদা পাল তার হাওয়ায় ফুলে ওঠে। সাঁ সাঁ করে জল কেটে নৌকা চলে দক্ষিণ দিকে।

পুলিশের সাহায্য চেয়েছিল শিখা, সাহায্য পায়নি। কাল সন্ধ্যায় সে থানায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল রতনকে সঙ্গে নিয়ে। পুলিশ অফিসার সোজা জবাব দিয়েছেন এসময়ে তিনি কিছু করতে পারবেন না।

দুদিন আগেকার জাপানী বোমা দেশের কত বড় সর্ব্বনাশ করেছে। শহরে শান্তি রক্ষা করাই এখন তাঁদের প্রধান কাজ। কে কোথায় কোন মেয়েকে চুরি করেছে—করেছে কিনা সে প্রমাণও ঠিক পাওয়া যায় না, মিথ্যা সন্দেহে তাঁরা বর্ত্তমান সময়ে কালক্ষেপ করতে চান না।

শিখা কাকাকে জানাতে চেয়েছিল ব্যাপারটা, কিন্তু যুদ্ধের তাগিদে তাঁকে অকস্মাৎ চলে যেতে হয়েছে রেঙ্গুণে।

মর্ম্মাহত শিখা অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবে। তারপর রতনকে নিয়ে যুক্তি করে—সে নিজেই বেরুবে মীরার সন্ধানে…যেমন করে হোক তাকে নিয়ে ফিরবে।

রতন মাথা চুলকায়। একবার বলতে যায়—”কিন্তু তুমি কি পারবে দিদিমণি, সে বড় শক্ত জায়গা—”

শিখা জোর করে বলে, ”নিশ্চয়ই পারব রতন—না পারি মরব। তা বলে মীরাকে ডাকাতের হাতে দিয়ে একা আমি কলকাতায় ফিরতে পারব না।”

কিশোর রতনের উৎসাহ বড় কম নয়, নেহাৎ একবার ভবিষ্যতের কথাটা ভেবে সে বাধা দিতে গিয়েছিল। শিখার কথায় সে দৃপ্ত হয়ে ওঠে। বলে, ”আর কেউ না যায়, আমি ঠিক তোমার সঙ্গে যাব দিদিমণি। একা গিয়ে কোন ফল হবে না, আমায় নিয়ে গেলে আমি তোমায় সব দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব। অনেক কাল আমি কক্সবাজারে ছিলাম তো, পথঘাট সব আমার চেনা। তোমার কোন ভাবনা নেই, তা ছাড়া রহিমও যাচ্ছে।”

আকাশে পাতলা মেঘ করে আছে কাল রাত হতে। নৌকা চলবার মুখে সে মেঘ কালো হয়ে এসেছিল, তারপরই উঠলো ঝড়।

পুলিশ অফিসার নিজে কিছু করতে না পারলেও দুজন কনস্টেবল সঙ্গে দিয়েছেন। তাদের হুকুম দেওয়া আছে—শিখার যে কোন আদেশ তারা নির্ব্বিচারে মেনে যাবে।

অনেক চেষ্টায় নৌকাখানিও পাওয়া গেছে। প্রথমে নৌকার কথা বলতে গিয়ে রতন দাঁড়িমাঝিদের কাছে অপমানিত হয়ে ফিরে এসেছিল। কেউ তার কথা কানে নেয়নি। কনস্টেবল দুজন যেতে তবে তারা নৌকা দিতে রাজী হয়েছে।

আকাশ এবং সমুদ্রের অবস্থা দেখে শিখা ভয় পায়। রতন সাহস দেয়, ”ভয় কি দিদিমণি, আমি যখন সঙ্গে আছি, কোন ভয় করতে হবে না। তাছাড়া আমাদের রহিম ভাই যাচ্ছে, সে তোমায় ঠিক ঘাঁটিতে পৌঁছে দেবে।”

দাঁড়িমাঝিরা খাস চট্টগ্রামের ভাষায় কি সব বলাবলি করছিল, আর মাঝে মাঝে শিখার পানে তাকাচ্ছিল। ওদের ভাষা শিখা বোঝে না। যদিও সে এখানকারই মেয়ে, তবু এদের গেঁয়ো ভাষা তার কাছে সম্পূর্ণ দুর্ব্বোধ্য বলেই মনে হয়।

সোঁ সোঁ করে নৌকা ভেসে চলেছে। এমনই সময় আকাশের বুকে ভীষণ শব্দ শোনা যায়—প্লেন আসছে।

নিশ্চয়ই জাপানী প্লেন! এগুলি চলেছে চট্টগ্রামের দিকে।

প্রকাশ্য দিনের বেলা চলবে হয়তো আক্রমণ। জাপানীরা ভেবেছে কি? দিনের বেলাতেও তারা আক্রমণ করবার সাহস পেলে কি করে?

শিখা পলকহীননেত্রে তাকিয়ে থাকে।

গুম গুম গুম!

বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ কয়েকটা শব্দ—পিছনে ফেলে আসা চট্টগ্রামের দিকে শোনা যায়।

রতন চেঁচিয়ে ওঠে, ”ওরা বোমা ফেলছে দিদিমণি! চট্টগ্রামকে ওরা বোধহয় নিশ্চিহ্ন করে দেবে!”

সঙ্গে সঙ্গে বৃটিশের মেশিনগানের শব্দ কানে আসে। দেখা গেল জাপানী প্লেনগুলি বহু উপরে থেকে পলায়ন করছে, আর তাদের পিছনে ছুটে যাচ্ছে এক ঝাঁক বৃটিশের প্লেন।

জ্বলতে জ্বলতে একখানা প্লেন তীরবেগে নেমে আসে নীচে সমুদ্রের দিকে,—নৌকা হতে চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দূরে সেখানা বিক্ষিপ্ত হয়। তার বেগে নৌকাখানা টলমল করে, কাত হয়ে পড়ে, মাঝি অদ্ভুত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সে ধাক্কা সামলে নিলে।

—”হায় ভগবান”—রতন আবার চেঁচিয়ে ওঠে।

চার. দুর্ব্বৃত্তের হাসি

কুতুবদিয়া বাতিঘর ছাড়িয়ে গিয়ে শিখাদের নৌকাখানা বাধ্য হয়ে থেমে যায়। তিন পাশে তিনখানা লঞ্চ সেটা ঘিরে ফেলেছে।

বজ্রকঠিন কণ্ঠে আদেশ শোনা যায়—”নৌকা রাখো।”

কনস্টেবল সুন্দরীলাল দৃঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, ”কার হুকুমে নৌকা রাখা হবে—কে তুমি?”

—”আমি—হা হা হা হা—একটু পরেই জানতে পারবে।”—তার হাসির শব্দে চারিদিক পূর্ণ হয়ে যায়। গা ছমছম করে ওঠে শিখার। বক্তার পানে তাকায় সে। লোকটা বেশ জোয়ান।…লঞ্চের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে, হাতে তার উদ্যত রিভলভার। এক পলকের দৃষ্টিতে শিখা দেখে নেয়, পরনে তার সিল্কের লুঙ্গি, ধবধবে একটা সাদা জামা তার গায়ে, মাথায় বার্ম্মিজদের মত রঙিন কাপড় বাঁধা।

কনস্টেবলদের সাহস অন্তর্হিত হয়ে গেছে, তারা আর দাঁড়াতে পারেনি, বসে পড়েছে। রহিম দুহাতে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে পড়েছে, আর রতন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে। ফিস ফিস করে রতন বলে, ”ঐ শয়তানটাই মংপো। কি হবে দিদিমণি?”

দাঁড়িমাঝিরা বিনা প্রতিবাদে নৌকা থামাবার চেষ্টা করে।

শিখা গর্জ্জন করে ওঠে, ”নৌকা থামিও না—চালাও!”

‘হা হা হা হা—’

আবার সেই হাসি। সে হাসিতে শিখার সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। মানুষ যে এমন করে হাসতে পারে, তা সে জানে না।

লঞ্চখানা এসে নৌকার গায়ে লাগে। রিভলভারধারী বলে, ”মনে রেখো মেয়ে, বহু মেয়েদের এপর্য্যন্ত দেখেছি—তোমাকেও দেখছি। ওকি, ফেল—ফেল বলছি রিভলভার—”

তার কথা বলার মাঝখানে শিখা কনস্টেবল সুন্দরীলালের রিভলভারটা তুলে নিয়েছে। গুলিভরা রিভলভার!

অন্য দুখানি লঞ্চ এগিয়ে আসে। শিখার নৌকার তিনদিকে বেশ ভাল ভাবেই ঘিরে ফেলে।

মংপো তখন এ নৌকায় লাফিয়ে পড়বার মতলব করছে।

গুড়ুম—

রিভলভার গর্জ্জে ওঠে শিখার হাতে। গুলি লাগে মংপোর পায়ে। মংপো পা ধরে বসে পড়ে।

—”শয়তানী!”

মংপো গোঁ গোঁ করে। তার সঙ্গীরা ততক্ষণে শিখার নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে, দুজন শুধু মংপোর পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবার উদ্যোগ করে।

আদেশ শোনা যায় মংপোর—”শয়তানীটাকে বাঁধো, পুলিস দুটোকে জলে ফেলে দাও—ঘায়েল কর আগে।”

শিখা সরতে সরতে একপাশে এসে দাঁড়ায়। ছয়ঘরা রিভলভার হতে ছয়টি গুলি নিঃশেষ হয়ে যায়।

ততক্ষণ সুন্দরীলাল, ও শিউরতন দস্যুদলের সঙ্গে লড়ছে—নৌকা টলমল করছে।

পর পর দুটি ফায়ার—

দেখা গেল না কনস্টেবলদের আর। আহত অবস্থায় তারা ছিটকে পড়েছে বঙ্গোপসাগরের নীলজলের বুকে।

সঙ্গে সঙ্গে গাছ কোমর বেঁধে শিখাও লাফিয়ে পড়ে।

সমুদ্র—মেখলা চট্টগ্রামের মেয়ে সে, জলকে ভয় করে না।

পাঁচ. এ মেয়ে কে?

শিখা আত্মগোপন করে পাশের লঞ্চের একেবারে পিছন দিকে, সেদিকে লক্ষ্য ছিল না কারও। সবাই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।

জলের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে জন চার পাঁচ শক্তিশালী লোক। মংপোর আদেশ—জীবিত বা মৃত ওই মেয়েটাকে তার চাই। তার দলের পাঁচজন লোককে অব্যর্থ লক্ষ্যে সে গুলি করে হত্যা করেছে, মংপো নিজে আহত হয়েছে। এ মেয়ে কে? এ মেয়ে যে এত চতুর তা মংপো আগে ভাবেনি। রাগে ফুলতে থাকে মংপো।

চট্টগ্রাম মংপোর ক্রীড়াভূমি। সারা অঞ্চলটা তার নখদর্পণে। এখানকার অলিগলি, পাহাড়, জঙ্গল, নদী—নালা কিছুই তার অজানা নয়। উপরন্তু জলের পোকা সে।

একবার সমুদ্রে গিয়ে পড়লে আর কেউ তার সন্ধান পাবে না। দুর্দ্ধর্ষ মংপোকে গভর্ণমেণ্ট করতলগত করবার চেষ্টা বহুদিন ধরে করছেন। বর্ত্তমানে কিন্তু শত্রুভাবে নয়—বন্ধুভাবে। এটাও গভর্ণমেন্টের একটা চাল। জাপানী শত্রুর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে মংপোর মত একটা সাহসী অভিজ্ঞ লোকের সাহায্য খুবই কাজে আসবে। তারপর বিপদ কেটে গেলে তাকে ফাঁদে ফেলতে কতক্ষণ মংপো সরকারের এ উদ্দেশ্য বুঝতে পারেনি। মংপো একান্ত অনুগত ভৃত্যের শপথ গ্রহণ করেছে, সমুদ্রে দিনরাত টহল দিচ্ছে মোটর লঞ্চে করে,—সমস্ত জলযান আজ তার আদেশে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছে।

বীর—দর্পে সরকারী আদেশ পালন করে যাচ্ছিল মংপো। তারই মাঝে মাঝে নিজের কাজও হচ্ছিল গোপনে গোপনে। জাপানী বিমান যখন বোমা ফেলতে আরম্ভ করে, বুকটা তার আনন্দে নেচে ওঠে। দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ে সহরের মাঝে। ভীতসন্ত্রস্ত সহরবাসীর কাতর ক্রন্দনের মাঝে তাদের যথাসর্ব্বস্ব লুঠপাট করতে করতে পৈশাচিক আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে সে। আবার ‘অলক্লীয়ার’ সঙ্কেত পাওয়া মাত্রই সদলবলে ফিরে যায় তার নিজের ঘাঁটিতে। কর্তব্যপরায়ণ পদস্থ কর্ম্মচারীর মত কর্ত্তব্যকর্ম্মে অবহেলা করে না একটুও।

সেই রাত্রে লুন্ঠিত মালপত্রের সঙ্গে মীরাকেও বন্দিনী করে নিয়ে মংপো যাচ্ছিল কক্সবাজারের দিকে। ঐখানটাই এখন তার গুপ্ত বাসস্থান।

অনেক ভয় দেখিয়ে মীরার মুখ থেকে সে অনেক কথা বের করে নিয়েছে। কলকাতার ধনী বাপ—মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। তার কলেজের বন্ধু অগ্নিশিখার সঙ্গে এখানে প্রথম এসেছে। শিখা এদেশেরই মেয়ে। যে শেলটারে সে আশ্রয় নিয়েছিল, তার কাছেই তাদের বাড়ী।…

ক্রোধে জলে ওঠে মংপো। শিখাকেও তার চাই। নইলে তার খোঁজা—খুঁজিতে মংপোর বিপদ ঘটতে কতক্ষণ? শত্রুর শেষ রেখে কাজ করতে শেখেনি মংপো। লুন্ঠিত মালের সঙ্গে মীরাকে কক্সবাজারে পাঠিয়ে ফিরে আসছিল সে শিখার সন্ধানে। পথে নৌকায় মেয়েটিকে দেখে মীরার বর্ণনা মত শিখা বলেই মনে হল তাকে। শিখাকে যে এ রকমভাবে পাওয়া যাবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।

কিন্তু শিখা যে অগ্নি শিখাই বটে।

মংপো বা তার দলের লোকেরা স্বপ্নেও ভাবেনি শিখা কনস্টেবল সুন্দরীলালের রিভলভার হস্তগত করে এমনভাবে ফায়ার করতে পারবে।

হয়তো সে নিজেও ওই পাঁচজন লোকের মত মরতো। নেহাৎ গুলিটা পা ঘেঁষে গেছে, তাতেই সে বেশ আহত হয়েছে।

দাঁতের উপর দাঁত ঘষে সে গর্জ্জন করে ওঠে, ”শয়তানী বাঙ্গালী।” অনুচরদের আদেশ দেয়, ”জল তোলপাড় করে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে এসো। জীবন্ত হোক, মৃত হোক, মেয়েটাকে আনা চাই—ই। কাঁটাটাকে উপড়ে ফেলতেই হবে।”

ছয়. শয়তানের কবলে

উপুড় হয়ে পড়ে ছিল রতন।

দস্যুদের লাঠির চোট সে সামলাতে পারেনি, মাথায় ভীষণ চোট লেগে খানিকটা কেটে গিয়ে রক্তে তার জামাকাপড় লাল হয়ে গেছে।

শীর্ণ রহিম দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে ছিল। দস্যুরা তাদের দুজনকে টেনে তুলে মংপোর লঞ্চে নিয়ে গিয়ে ফেললে।

—”একি—রহিম—তুমি।”

মংপো বিস্ময়ে খানিকক্ষণ রহিমের পানে তাকিয়ে থাকে। সে যেন নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

যে শাস্তি তার অদৃষ্টে নাচছে রহিম তার কথা আগেই ভেবে রেখেছে। বুক তার কাঁপছিল। তবু সে মুখ তুলে মংপোর পানে তাকালো। কম্পিত—কণ্ঠ যথাসম্ভব সংযত করে উত্তর দেয়, ”হ্যাঁ, আমি রহিম জনাব—”

—”তুমি রহিম!”

মংপো ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চীৎকার করে ওঠে, ”তুমি রহিম! বিশ্বাসঘাতক! তুমি আমার অনেক ক্ষতি করেছো। দুবার তোমায় হাতে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছি, এবারও কি তুমি ছাড়া পাবে ভেবেছো?—এবার পুলিশ নেই, কে তোমায় বাঁচাবে?”

রহিম মরিয়া হয়ে উঠেছে। মরতে তো হবেই! মংপোর ক্রোধানলে ক্ষুদ্র পতঙ্গের মত তাকে পুড়তে হবে, সে তা জানে। মরণ নিশ্চিত জেনে সে ভয়কে জয় করবার চেষ্টা করছে।

বললে, ”জানি জনাব, এবার আমার মুক্তি নেই, আমি সেজন্য প্রস্তুতও রয়েছি।”

মংপো কি বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। একটু নরম সুরে বললে, ”তুমি একদিন আমার দলের লোক ছিলে,—আজও থাকলে আমি যাতে তোমার ভালো হয় সেই চেষ্টাই করতাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশের কাছে আমার সব কথা বলে দিয়েছিলে। আমার কয়েকজন বিশ্বাসী অনুচর তোমার জন্যে কেউ ফাঁসিতে মরেছে, কেউ আজীবন জেলে রয়েছে। আমার অনিষ্ট করে তোমারই বা কি লাভ হয়েছে রহিম,—পুলিশ তো তোমায় কিছু বড়লোক করে দেয়নি? বরং আমাকে একটা দায়িত্বপূর্ণ কাজের ভার দিয়েছে।”

রহিম শান্তকন্ঠে বললে, ”আমি তো টাকা পাওয়ার জন্যে পুলিশের কাছে যাইনি হুজুর। ডাকাতের কাজ আমি ঘৃণা করি, তাই—”

বিদ্রূপপূর্ণ কণ্ঠে মংপো বললে, ”তাই তুমি সাধু হয়ে পুলিশের দলে গেছ—ঘৃণিত গুপ্তচর। দুবার তোমায় হাতে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছি, এবার তোমার মুক্তি নেই!”

রুগ্ন রহিম হাসে, বলে, ”আমি বাঁচতে চাইনে হুজুর, যে করেই হোক মরব,—আপনাদের গুলিতেই হোক—আর অসুখে ভুগেই হোক! মরব জেনে আমি প্রস্তুত আছি। আপনার যা শাস্তি অভিরুচি তা দিন, আমি মাথা পেতে নেব।”

মংপোর মুখখানা বিকৃত হয়ে ওঠে। বললে, ”কিন্তু তোমার শাস্তি গুলিতে দেব না, জীবন্ত তোমার গায়ের ছাল ছাড়ানো হবে—বিশ্বাসঘাতকের এই পুরস্কার।”

”আঁ—”

রতন আর্তনাদ করে ওঠে। নিষ্ঠুর মংপোর পানে তাকাতে পারে না, থরথর করে কাঁপে সে।

—”ওটা কে?”

মংপো জিজ্ঞাসা করে তার অনুচর লিয়াংকে। সে হাসছিল রতনের পানে তাকিয়ে।

গোঁ গোঁ করে সে উত্তর দিলে, ”ওটা ওই মেয়েটির সঙ্গে এসেছে হুজুর, মেজর সাহেবের খাস খানসামা।”

রতনের দিকে চেয়ে মংপো বললে, ”এই, তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো, পুরস্কারও দেবো অনেক, কিংবা আমারই একজন অনুচর করে রাখবো—সত্যি করে বল, ওই মেয়েটা কে—যে আমার পায়ে ফায়ার করেছে?”

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রতন বলে, ”মেজর রায়ের ভাইঝি।”

—”ওরই নাম তাহলে শিখা?” মংপো রতনের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

রতন ঘাড় নেড়ে বলে, ”হ্যাঁ।”

মংপো আবার বলে, ”কলকাতা থেকে এসেছে—ওর সঙ্গে একজন বন্ধুও ছিল, খুব বড়লোকের একমাত্র মেয়ে সে—নয় কি?”

—”হুজুর যা জেনেছেন সবই সত্যি। তাকে বোমা পড়ার দিন থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেলটারের ভেতর থেকেই সে নিখোঁজ হয়।”

হা হা করে হেসে ওঠে মংপো। পরক্ষণেই তার মুখের ভাব বদলে যায়। চোখদুটো তার জ্বলতে থাকে। বজ্রকণ্ঠে অনুচরদের সে আদেশ দেয়, ”মেয়েটা যেন পালাতে না পারে। জল তোলপাড় করেও তাকে খুঁজে বার করতে হবে। জীবন পণ করে তোমরা জলে নেমে যাও। চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তোলো। তারপর তাকে কি রকম সাজা দিতে হয় তা আমার জানাই আছে!”

মংপোর লঞ্চ শিখার অণ্বেষণে আবার আঁতিপাঁতি অনুসন্ধান সুরু করে।

সাত. দস্যুর প্রেম

”ওই—ওই যে দেখা যায়—”

কতক্ষণ জলের মধ্যে ডুবে থেকে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছিল শিখা, একবার দম নেওয়ার জন্য সে ভেসে উঠেছিল।

লঞ্চ তার দিকে ফিরতেই সে আবার ডুব দেয়।

জলের মধ্যে বহুদূর ডুবে গিয়ে সে মাথা তোলে। পায়ের তলায় যেন মাটি পাওয়া যায়। অত্যন্ত শ্রান্ত সে, একটু দাঁড়াতে পারলে বাঁচে।

এদিক ওদিক অনেক দূর দেখা যায়। বহুদূরে লঞ্চ দেখা যায়—তার ওদিক দিয়ে কয়েকখানা যুদ্ধ—জাহাজ চলেছে, সম্ভব সেই জন্যই দস্যুদল তাঁকে খুঁজে পায়নি।

হাঁপাতে হাঁপাতে শিখা জল ভেঙ্গে ডাঙ্গার দিকে এগিয়ে চলে।

ধু ধু করছে বালি। তার ওদিকে অনেকদূরে গাছপালা দেখা যায়।

পা চলছে না—

কাঁপতে কাঁপতে শিখা শুয়ে পড়ে সামনের ধু ধু করা বালির উপরে। সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয় তার।

কোথায় এসেছে সে—তা জানবার ঔৎসুক্য আর রইলো না। মাথার ভেতরটা তার ঝিম ঝিম করতে থাকে। শেষকালে সত্য সত্যই সে জ্ঞান হারায়।

জ্ঞান ফিরল তার অনেকক্ষণ পরে। দুহাতে চোখ রগড়ে উঠে বসে সে।

এ কি! কোথায় এসেছে? এ কোন স্থান?

সে দেখছে একখানা ঘর! সে ঘরে জ্বলছে একটা মাটির প্রদীপ। একটা মাদুরের উপর সে শুয়ে আছে, মাথার শিয়রে বসে কে যেন তার মাথায় বাতাস করছে।

শিখা অনুভব করে—তার পরনে শুষ্ক বস্ত্র, গায়ের উপর একখানা কাঁথাও চাপা দেওয়া। সে উঠতে যায়, কিন্তু সমস্ত গায়ে অসহ্য ব্যথা, মাথাটাও তোলবার ক্ষমতা যেন তার আর নেই। ক্ষীণ কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করে, ”আমি কোথায়?”

শিয়রে যে মেয়েটি ছিল, সে ঝুঁকে পড়ে তার মুখের ওপরে। আনন্দপূর্ণকণ্ঠে কি যেন সে বললে, শিখা তার ভাষা বুঝলো না।

এমনই সময়ে প্রবেশ করলে একজন লোক। প্রদীপের মৃদু আলোয় তার মুখের পানে তাকিয়ে শিখা স্তম্ভিত হয়ে যায়!

হ্যাঁ, চিনতে পেরেছে সে লোকটিকে। চিনতে তার বিলম্ব হয়নি। মংপোর লঞ্চে সে এই লোকটিকে দেখেছিল।

অবশেষে মংপোর হাতেই পড়তে হল তাকে। ক্ষোভে দুঃখে শিখা অধর দংশন করে।

এখন তার কাছে রিভলভারটাও নেই। জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়বার সময়ে রিভলভারটা কোথায় ছিটকে পড়েছে। সেটা কাছে থাকলে শিখা এতটা ভাবতো না। নিজেকে অনেকটা শক্তিশালিনী মনে করতো।

আগন্তুক এগিয়ে আসে। শিখার মাথার কাছে যে বার্ম্মিজ মেয়েটি বসে বাতাস করছিল, লোকটির আদেশে সে বাইরে চলে যায়।

দু’হাতের ওপর ভর দিয়ে শিখা উঠবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে। এরকমভাবে পড়ে থেকে লাঞ্ছনা সে সইবে না,—শুধু হাতেই সে যতটুকু পারে আত্মরক্ষা করবার জন্য লড়বে।

শিকার মনের ভাব বুঝি খানিকটা উপলব্ধি করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে লোকটি বললে, ”ভয় পেয়ো না। আমি মা চীন। আমি মংপোর ডান হাত বটে, কিন্তু দস্যুবৃত্তি করবার আর আমার ইচ্ছা নেই। আমি তোমার অনিষ্ট করবার জন্যে তোমায় বাঁচাইনি। আমাদের সর্দ্দার তোমায় জীবিত বা মৃত যে কোন অবস্থায় তাঁর কাছে হাজির করতে বলেছেন। আমি তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোটা টাকা পুরস্কার পেতে পারি। কিন্তু আমি তা চাইনে মিস্ রায়, আমি তোমায় বাঁচাতে চাই। আমি তোমায় চাই। দস্যুবৃত্তি ছেড়ে আমি তোমায় নিয়ে সুখের বাসা বাঁধব। আমার নিজস্ব প্রচুর ধনরত্ন আছে। তাই দিয়ে তোমাকে রাজরাণী করে রাখব। অনেকদিন থেকেই দস্যুতা ছেড়ে দেবো ভাবছি। কিন্তু এমন কিছু আকর্ষণই আমার ভাগ্যে এ পর্য্যন্ত জোটে নি যার জোরে আমি এই হীন বৃত্তিটাকে ভুলতে পারি। এখন তোমায় পেলে আমি আবার মানুষ হয়ে উঠবো, এ আমি মনে—প্রাণে বিশ্বাস করি।”

কোন কথা বলল না শিখা। আস্তে আস্তে উঠে বসল সে। তারপর শান্তকণ্ঠে বললে, ”আমি তোমাকে চিনি মা চীন,—কাকার কাছে তোমার নাম শুনেছি। শুধু তাই নয়, মংপোর লঞ্চে তুমি ছিলে তাও আমি দেখেছি। একদিন তুমি কাকার কাছে মিলিটারীতে কাজের জন্যে এসেছিলে। সত্যি নয় কি?’

হো হো করে হেসে ওঠে মা চীন। বললে, ”হ্যাঁ, তারপর একটা সাংঘাতিক ডাকাতির কেসে জড়িয়ে পড়ি। কেবল ডাকাতিই করিনি, নরহত্যাও করেছি। আর সে জন্যে গভর্ণমেন্ট ঘোষণা করেছিল, যে কেউ আমার ধরিয়ে দিতে পারবে সে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার পাবে। সে কথাও শুনেছো নিশ্চয়।”

শিখা হতাশভাবে তার পানে তাকিয়ে থাকে।

মা চীন বলে চলে,—”আমি জানি, তুমি পুলিশের কাজ কর, তাই আমাদের ধরতে এসেছো—না?”

শিখা না হেসে পারে না। বললে, ”কি করে জেনেছো আমি পুলিশের কাজ করি?”

মা চীন মাথা দুলায়। গম্ভীরমুখে বললে, ”তোমাদের টিকটিকির জাতটা মা চীনের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না মিস্ রায়। একটা মেয়েকে এর আগে আমরা ধরে এনেছি। সে অবশ্য নিরাপদ জায়গাতেই রয়েছে। তার জন্যে মুক্তিপণ দশ হাজার টাকা পেলেই মংপো তাকে ছেড়ে দেবে। শুনেছি সে বড়লোকের মেয়ে। তার বাবার কাছে দশ হাজার টাকা এমন কিছু নয়। টাকার বিনিময়ে সে ছাড়া পেয়ে কলকাতায় ফিরে যাবে, এদিকে আমরাও সুখে—স্বচ্ছন্দে ভদ্রভাবে দিন কাটিয়ে দেবো।”

”দশ হাজার টাকা পণ চায় মংপো?” শিখা যেন আকাশ থেকে পড়ে।

মীরার বাবা স্যার অশোক মিত্র ধনী লোক বটে। বেশীর ভাগ তিনি দিল্লীতে থাকেন—গভর্ণমেন্টের বড় অফিসার। একমাত্র কন্যা মীরা কলকাতায় কলেজে পড়ে। মংপো নিশ্চয় মীরার পরিচয় পেয়েছে, আর মুক্তিপণ দশ হাজার টাকাও ধার্য্য করে নিয়েছে।

একমাত্র কন্যার মুক্তির জন্য দশ হাজার টাকা স্যার অশোক মিত্র অনায়াসে দিতে পারবেন। কিন্তু তার কি হবে? এরা তাকে হয়ত পুলিশের লোক সন্দেহে বন্দী করেছে। এ সন্দেহ হবারই কথা। কারণ তার নৌকায় দুজন কনস্টেবল ছিল, পুলিশের স্পাই রহিমও ছিল। তাছাড়া সে যে মীরারই অম্বেষণে এসেছে—একথাটা তাদের বুঝতে কি বাকী আছে?

শিখা কিছু বলবার জন্য মুখ তুলল। দেখল মা চীন তার চোখ দুটো দিয়ে যেন শিখার সর্ব্বাঙ্গটা গিলে ফেলতে চায়। দস্যুর চাহনি ত’ এ নয়। কামনার আগুন জ্বলে উঠেছে তার বুকের ভেতর, সেইটাই ফুটে উঠেছে তার চাহনিতে।

চোখে চোখ পড়তেই মা চীন বললে, ”বল শিখা, আমাকে একটিবার বল, তুমি রাজী আছো…”

শিখা বলে, ”মা চীন, মানুষের জীবনে বিয়ে হয় একবার। কাজে কাজেই একটু ভেবে চিন্তে জবাব দেওয়াই ভাল নয় কি? তোমার কথায় যে আমি বিশ্বাস করতে পারি, এমন কিছু প্রমাণ পেলেই তোমার কথায় আমি রাজী হবো।”

—”এই দণ্ডেই আমি তোমাকে মুক্ত করে দিতে পারি!”—সোৎসাহে বলল মা চীন।

—”কিন্তু আমার মুক্তির জন্য ত ততটা আমি ভাবছি না। কেননা তুমি যখন আমার সহায় রয়েছ তখন ভয়টা কিসের? আমি ভাবছি মীরার মুক্তির কথা। তাকে কলকাতায় তার হোস্টেলে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারো? তাহলে আমি তোমারই…”

মা চীন চুপ করে কি ভাবতে থাকে। শিখা আবার বলে, ”আমি তাকে সঙ্গে করে কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছি। এখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও আমার—”

মা চীন গম্ভীরভাবে বলে, ”শুধু তোমারই কেন শিখা, বল আমাদের দুজনেরই।”

ফিক করে হেসে ওঠে শিখা। হাসির রেশ টেনে বলে, ”আগে কাজ উদ্ধার হোক—”

মা চীন চলে গেছে, দরজা বাহিরে থেকে বন্ধ।

দুর্ব্বল শিখা আবার শুয়ে পড়ে। ভাবে, দেখাই যাক না—টোপটা গেলে কিনা? তারপর ওর মুণ্ডপাত আমিই করতে পারব!…

আট. মংপোর কথা

শিখার পাহারায় যে মেয়েটি ছিল, তার নাম আ পান।

কয়দিন থাকতে থাকতে আ পানের সঙ্গে শিখার পরিচয় হয়ে যায়। আ পানকে মা চীন শিখার তত্ত্বাবধান করবার জন্য নিযুক্ত করেছে। মেয়েটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরাজীতে কথা বলতে পারে। ভালো ইংরাজী না জানলেও কথাবার্ত্তা কোন রকমে চালানো যায়।

তার কাছে শিখা জানতে পারে, মূর্চ্ছিতাবস্থায় সে সমুদ্রের তীরে পড়ে ছিল। এখানকার লোকেরা তাকে দেখতে পায় ও তুলে নিয়ে আসে। এমনই সময় আসে মা চীন। শিখাকে সে চিনতে পারে। গ্রামেই একটা বাড়ীতে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে সে শিখাকে রেখেছে। তার উদ্দেশ্য শিখাকে ভেঙ্গেই বলেছে।

শিখা মা আ পানের কাছ থেকে মংপোর আরো পরিচয় পায়।

বিখ্যাত দস্যু—সর্দ্দার সে। জলের উপরটা আয়ত্তে রাখবার জন্য বৃটিশ গভর্ণমেন্ট তার পূর্ব্বের সমস্ত অপরাধ এখন ক্ষমা করেছেন।

কিন্তু বিশ্বাসঘাতক মংপো।

সে ভিতরে ভিতরে জাপানীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে। ও দিক হতেও সে বহু উৎকোচ পেয়েছে, এখনও পাচ্ছে। তার পিতা বর্মার লোক। বহুকাল আগে দেশ ত্যাগ করে পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের হারলংয়ে বিবাহ করে সেখানেই বসবাস করতে থাকে। সে হিসাবে মংপো বার্মিজ হলেও উপস্থিত পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী।

এই গ্রামের বুকে বেশ একটি বর্মী উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। কথাবার্তায় বেশ বুঝতে পারা যায়, এরা ইংরাজ গভর্ণমেন্টকে ঘৃণা করে। শিখাকেও পুলিশের গোয়েন্দা হিসাবে তেমনই ঘৃণা করে।

আ পানের কাছে শিখা অনেক কথাই শুনতে পায়।

মাঝে দু একখানা জাপানী প্লেন অতি গোপনে এখানে এসেছিল। তাতে ছিলেন জাপানীদের দুজন অফিসার। গ্রামের সমস্ত লোকই তাঁদের পক্ষে। কারণ তাঁরা জানিয়েছেন, জাপানীরা এ দেশ জয় করে তাদেরই রাজত্ব দিয়ে যাবেন। এশিয়া হতে ইংরেজদের তাঁরা দূর করবেন এবং সেই জন্যই এদেশের লোকদের সাহায্য তাঁদের দরকার।

এঁদের একজন প্রধান সহায়ক মংপো।

এরই ফাঁকে সে নিজের কাজ স্বচ্ছন্দে করে যাচ্ছে। লুটপাট, ডাকাতি কিছুই তার বাদ যাচ্ছে না।

আ পান সগর্ব্বে বলে, ”তিনি একটা মানুষের মত মানুষ, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। উপস্থিত তিনি বর্মায় যাচ্ছেন। হয় তো গিয়েছেন, নইলে আপনি তাঁকে দেখতে পেতেন। আপনার সকল ভার আমাদের সর্দ্দার মা চীনের ওপর আছে। মা চীন একটু খিটখিটে বদমেজাজী লোক হলেও আসলে লোক ভালো। আপনি ক্রমেই তাঁর পরিচয় পাবেন—তখন বুঝতে পারবেন।”

শিখা নিঃশব্দে প্রশংসাবাণী শুনে যায়।

আজ পাঁচদিন যাবৎ শিখা এদের হাতে বন্দিনী। বন্দী অবস্থায় কারো সঙ্গে কথা বলতে না পেরে আ পান—এর সঙ্গেই সে গল্প করে। প্রথম প্রথম আ পান তার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো না। কিন্তু হাজার হলেও তার নারীর প্রাণ।

শিখাকে খাবার দিতে এলে বা তার খোঁজখবর নিতে এলে শিখা যখন তাকে বসতে অনুরোধ করতো, তখন তার অনুরোধ সে প্রত্যাখ্যান করতে পারতো না। কথায় কথায় অনেক কথাই সে জানিয়েছিল শিখাকে। আর শিখাও এমন ভাব দেখাতো যে, সে যেন আর যেতে চায় না এখান থেকে। শিখা বলতো যে বাঙালী ঘরের মিনমিনে মেয়ে হয়ে থাকার চাইতে ওদের দলে মিশে পাহাড় পর্ব্বতে আর সাগরের বুকে ঘুরে বেড়ানোটাই সে বেশী পছন্দ করে।

এই সব কথা বলে আ পান—এর কিছুটা বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম হয় শিখা।

আ পান বলে যে শীগগিরই নাকি মংপো রাজা হবে এখানকার।

মীরার খবর জেনে নেয় শিখা তার কাছে। আ পান জানায় যে মীরাকে খুব বেশী দিন ধরে রাখা যাবে না। তার বাবার কাছে দশহাজার টাকা মুক্তিপণ দাবী করে চিঠি গেছে। টাকাটা এলেই নাকি ছাড়া পাবে মীরা।

শিখা জিজ্ঞাসা করে, ”আচ্ছ, বলতে পার আ পান, সেই বাঙালী মেয়েটিকে কোথায় রাখা হয়েছে?”

আ পান হাসে, সতর্ক হয় সঙ্গে সঙ্গে। বললে, ”কিন্তু আমি সে কথা বলতে পারবো না—আমি জানিনে।”

সে যে সব জানে, সে সম্বন্ধে শিখার সন্দেহ নেই। যে পর্য্যন্ত না সে দেহে একটু শক্তি পাচ্ছে, সে পর্য্যন্ত সে কিছুই করতে পারছে না। রতন আর রহিমের খবর জানবার জন্য সে উৎসুক হয়, কিন্তু কে তাদের খবর দেবে?

নয়. বন্দিনীর বিপদ

মীরা বুঝতে পারে না, কারা কি উদ্দেশ্যে তাকে ধরে নিয়ে এসেছে। শেলটার হতে সে রাত্রে বাইরে আসবার সঙ্গে সঙ্গে সে আক্রান্ত হয়েছে। ভয়ে সে মূর্চ্ছিতা হয়ে পড়েছিল সে সময়।

যখন জ্ঞান হয়েছে, দেখেছে তাকে একখানা মোটর লঞ্চে তোলা হয়েছে এবং লঞ্চখানা কোন একদিকে ছুটে চলেছে সোঁ সোঁ করে।

একবার সে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিল, তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? উত্তরে ধমক খেয়েছে। তখন থেকেই নিঃশব্দ হয়ে গেছে সে।

যে লোকটি তার পাহারায় ছিল, তার মুখের পানে তাকিয়ে সে সভয়ে চোখ বুজেছিল। এমন ভয়ানক চেহারা মীরা জীবনে কোন দিন দেখেনি। সুদীর্ঘ দেহ, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ,—উপরের ঠোঁটটা না থাকায় সাদা বড় বড় দাঁত কয়টা সর্ব্বদাই বার হয়ে রয়েছে। নাকটা চ্যাপ্টা,—একটি চোখ ঠেলে বার হয়ে এসেছে—অত্যন্ত বীভৎস মূর্ত্তি। কণ্ঠস্বরটাই বা কি কর্কশ, মাথা ঝিম ঝিম করে!

মূর্চ্ছিতার মতই পড়ে থাকে মীরা।

কতক্ষণ পরে কোথায় লঞ্চ থামলো, ধরাধরি করে তাকে কোথায় এরা নিয়ে এলো, তাও সে জানে না।

আজ কতদিন—কতদিন সে এসেছে, হিসাব করতে গিয়ে সব গোলমাল হয়ে যায়! এমন কি মাসের নামটাও তার মনে আসছে না। পনেরো দিন—এক মাস, অথবা একবৎসর—হতাশ হয়ে পড়েছে মীরা।

দিল্লীতে বাবা মা নিশ্চয়ই শুনেছেন এতদিন। শুনে অধৈর্য্য হয়ে উঠেছেন। চট্টগ্রামে বোমা পড়ার সংবাদ সমস্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বোমা পড়ার সময়ে কয়েকজন লোক তাকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে উধাও হয়েছে—এ কথা কে আর জানে? সকলেই জেনেছে বোমার ঘায়ে তার মৃত্যুই হয়েছে। তাহলে তো ভালই ছিল। এই দস্যুদের কবলে পড়ে মৃত্যু—যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না।

মা হয়তো কত কাঁদছেন। আর তার প্রিয়তম বন্ধু শিখা—

সে নিশ্চয়ই নিশ্চিন্ত নেই। সে কি শোনেনি কয়েকজন লোক তার বন্ধু মীরাকে অপহরণ করেছে? বন্ধুকে খুঁজে বার করবার জন্যে সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে না কি?

শিখাকে মীরা ভালভাবেই চেনে। সাধারণ মেয়ে হতে এ মেয়ে একেবারেই পৃথক। বাল্যে সে পিতাকে হারিয়েছে, কাকা তাকে ছেলের মতই শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছেন। সাহসে, শক্তিতে, বুদ্ধিতে, জ্ঞানে শিখা সাধারণ মেয়েদের চেয়ে অনেক উপরে।

মীরা জানে, শিখার শারীরিক শক্তি অনেক বেশী। ছেলেদের মত সে দুর্দ্দান্ত, মেয়েদের মতো নুয়ে পড়ার ভাব তার মধ্যে মোটেই নেই। তার ওপর আছে তার কর্ম্মশক্তি, অসম্ভব প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। সেবার তাদের হোষ্টেলে চুরি হয়েছিল। সেই চুরি ধরা পড়েছিল একমাত্র শিখার অসাধারণ পরিশ্রমের ফলেই। পুলিশ তো হাল ছেড়ে দিয়েছিল—হাল ছাড়েনি কেবল শিখা। কি অসাধারণ সাহসে নির্ভর করে সে বড়বাজারে একটা বাড়ী তল্লাসী করে কয়েকজন লোককে শুধু ধরাই নয়, গহনাপত্র যা যা চুরি গিয়েছিল, প্রায় সবই উদ্ধার করেছিল।

শিখা যদি তাকে খুঁজে বের করবার ভার নেয়—

সে পারবে। জাপানী আক্রমণে গভর্ণমেন্ট বড় বিব্রত হয়ে পড়েছেন।

এ সময় এতটুকুও সাহায্য হয় তো শিখা সেখান থেকে পাবে না, সম্পূর্ণ নিজের উপর তাকে নির্ভর করতে হবে।

দস্যুরা মীরার পরিচয় চায়। প্রথমে মীরা নিজের পরিচয় কিছুতেই দেয়নি। তাহলে শিখা হয়ত বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু দস্যুরা ছাড়বার পাত্র নয়। নানা রকম নির্যাতনের ভয় দেখায় তাকে। তখন সে শুধু বলেছিল, সে ধনীর কন্যা এবং একমাত্র কন্যা। ব্যস—আর কিছু বলতে হয়নি তাকে। তারপর একদিন এদের সর্দ্দার মংপো এসেছিল। তার প্রস্তাব ছিল—স্বহস্তে মীরা তার পিতাকে একখানা পত্র লিখে দেবে। সে পত্র মংপো তার পিতার কাছে পাঠাবে। যদি মীরার পিতা তার মুক্তি—পণ হিসাবে টাকা দিতে রাজী হন, তবে সেই টাকা পেলে মংপো তাকে মুক্তি দেবে, তার আগে ছাড়বে না।

মীরা তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে, অনেক অনুনয়—বিনয় করেছে। কিন্তু মংপো হেসেছে। তার বিকট হাসি তাকে অধিকতর আতঙ্কিত করে তুলেছিল। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সে।

কঠিন হৃদয় মংপোর! দয়া মায়া তার মধ্যে নেই। তার এক কথা—যদি মীরা স্বহস্তে পত্র লিখে না দেয়, তাহলে তার উপর সে যা নির্যাতন করবে মীরার তা কল্পনারও বাইরে!

তবুও মীরা পত্র লিখতে রাজী হয়নি…শুধুই কেঁদেছে মংপোর পা দুটো ধরে। কিন্তু নিষ্ঠুর দস্যুসর্দ্দার সবেগে পা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে!

সন্ধ্যার পরে আবার এলো মংপো। সঙ্গে তার সেই অনুচর।—যে ভীষণ মূর্ত্তির জীবটি মোটর লঞ্চে তার পাহারায় ছিল। তার মুখখানা দেখলেই ভয়ে আঁতকে উঠতে হয়।

একটা অট্টহাসি হেসে মংপো একখানা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ”এই আমার কাগজ আর এই আমার অনুচর। যেটা ইচ্ছা বেছে নাও। হয় আমার কথামত চিঠি লিখে দাও, নইলে তোমাকে অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হবে। কোনটা পছন্দ হয়?”

মীরা আর দ্বিরুক্তি করেনি। কাগজটাই টেনে নিয়েছে। পিতাকে লিখে জানিয়েছে—পিতা যেন এদের কথামত দশহাজার টাকা দেন, নইলে সে মুক্তি পাবে না। এখানে তিলে তিলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।

সেই পত্র রেজিষ্ট্রীযোগে মীরার পিতার নামে প্রেরিত হয়েছে। টাকা কি ভাবে কোথায় পাঠাতে হবে, সে নির্দ্দেশও তাতে দেওয়া আছে।

অন্ধকার কারাকক্ষে মীরার দিন কাটে—

কত কথাই মনে হয় তার। সে ভাবে, কি ভুলই না সে করেছে শিখার সঙ্গে চট্টগ্রাম এসে। চট্টগ্রাম যে এত ভয়ঙ্কর জায়গা এ ধারণা তার ছিল না।

সে—রাত্রে শেলটার থেকে বেরিয়ে সে যখন ”শিখা! শিখা!” বলে ডাকছিলো, সেই সময় হঠাৎ কোথা থেকে দুটা ষণ্ডা মত লোক ছুটে এসে তার মুখ চেপে ধরে।

তার মনে পড়ে, একটু পরেই একখানা মিলিটারী জীপগাড়ী এসে দাঁড়ায় তাদের পাশে। ঐ ষণ্ডা লোক দুটোর একজন তখন তার নাকের উপরে একখানা ভিজে রুমাল চেপে ধরে। একটা মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ পায় সে, তারপরই আর তার কিছু মনে থাকে না।

এরপর জ্ঞান হয়েই সে বুঝতে পারে, সে এক দুর্ব্বৃত্তদলের হাতে ধরা পড়েছে।

বাবার কাছে টাকার জন্য চিঠি লিখে দিয়ে তার মনে হয়, বাবা কি পাবেন আমার চিঠি? যদি তিনি চিঠি না পান, যদি টাকা না আসে—তাহলে?—

মীরা আর ভাবতে পারে না। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে।

দশ. প্রেমের অভিনয়

শিখা পলায়নের সুযোগ খোঁজে, একবার কোনরকমে বাইরে যেতে পারলে যেমন করেই হোক সে চট্টগ্রাম পৌছোতে পারবে। সেখান হতে এবার উপযুক্ত লোকজন এনে এই বিশ্বাসঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

আ পান প্রায়ই একখানা করে ইংরাজী সংবাদপত্র আনে। শিখাকে কাগজটা দিয়ে খবর শোনে দুনিয়ার।

ইদানীং শিখার উপর তার অনেকটা বিশ্বাস জন্মে গেছে। শিখা অত্যন্ত নম্রভাবে থাকে। এমন ভাব দেখায়, যেন সে কিছু জানে না, কিছুই বোঝে না।

সংবাদপত্র সে প্রায়ই নিয়ে আসে। শিখাকে পড়তে দেয়, নিজেও শিখার মুখে সব খবর শোনে। নিজে সে পড়তে পারে না বললেই চলে, তার সামান্য বিদ্যা দিয়ে খবরের কাগজ পড়া চলে না।

মংপো বিশেষ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। পনেরো কুড়ি দিনের মধ্যে সে এদিকে আসতে পারেনি।

সংবাদপত্র দেখতে দেখতে অকস্মাৎ শিখা থেমে যায়। বারবার লাল দাগ দেওয়া খবরটার উপর চোখ বুলায়। খুব সম্ভব এই খবরটা যাতে চট করে চোখে পড়ে তাই লাল পেনসিল দিয়ে স্থানটি চিহ্নিত করা হয়েছে।

তাতে লেখা আছে—রহিমের মৃত্যু—সংবাদ। অতি নির্ম্মমভাবে রহিমকে হত্যা করে একটি গাছের ডালে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পুলিশ সনাক্ত করেছে সে রহিম। শুধু মুখটা ছাড়া তার সারা দেহের ছাল ছাড়ানো।

খবরটা পড়ে আঁতকে ওঠে শিখা!

রহিম—বেচারা রহিম—তার মৃত্যুর জন্য দায়ী শিখা, নিজের কাছে নিজেই সে কৈফিয়ৎ চায়, কেন সে ওই রুগ্ন লোকটিকে সঙ্গে এনেছিল?

রতনের খবর সে কিছুই পায়নি।

পাছে সন্দেহ হয় এজন্য আ পানকেও জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।

কাগজখানা পাশে ফেলে রাখে সে।

আ পান উৎসুক হয়ে বললে, ”কই, আজতো তুমি কিছু পড়ে শোনালে না দিদি?”

শিখা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, ”না, মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল আ পান। রহিম ছাড়া রতন নামে একটি ছেলেকে আমি এনেছিলাম। খবরে পেলুম, রহিমকে নির্ম্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু রতনের যে কি হল—?”

আ পান বললে, ”রতনের কিছু হয়নি। সে দিব্যি এখন সর্দ্দারের দলে ভিড়ে গেছে। রহিমকে হত্যা করা হবে তা আমরা জানতুম।”

শিখা চুপ করে যায়। চোখ দুটো তার ছল ছল করে ওঠে। তার নিজের ভাগ্যেই বা কি আছে কে জানে?

বিকালের দিকে আসে মা চীন।

জিজ্ঞাসা করে, ‘কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?”

শিখা বিকৃত মুখে হাসে। বলে, ”আমাকে এরকমভাবে আবদ্ধ করে রেখে কষ্ট হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা মানে উপহাস করা মা চীন। তুমিই না বলেছিলে সেদিন যে আমাকে তুমি ভালবাসো? এই বুঝি ভালোবাসার নমুনা?”

—”ভালবাসি, সত্যই ভালবাসি। সর্দ্দারও জানেন, আমি তোমায় ছাড়া বাঁচব না। তাই তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে আসছেন। পরশু আসবেন তিনি। সে পর্য্যন্ত তোমাকে এ কষ্টটুকু ভোগ করতেই হবে।”

শিখা বুঝতে পারে তার কথার মর্ম্ম। শয়তানটা মংপোর বিরুদ্ধে যেতে ভরসা পায়নি। তাই সে সোজাসুজি মংপোকে হাত করে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চায়।

শিখা চুপ করে থাকে।

—”আর দুটো দিন বইত নয়। একটু কষ্ট করে থাকো মিস্ রায়।”—খুব মোলায়েম স্বরে বলে মা চীন। মংপো এসে পৌঁছবে পরশুদিন। শিখা বিবর্ণ হয়ে ওঠে। সেদিন লঞ্চের উপর মংপোকে সে একবার দেখেছে,—বন্য মহিষের মত তার আকৃতি, প্রকৃতিও তেমনই। গুলিটা তার বুক লক্ষ্য করেই ছুড়েছিল সে, কিন্তু অদৃষ্টক্রমে লাগলো গিয়ে তার পায়ে।

অধর দংশন করে শিখা।

যেমন করেই হোক মংপো ফেরবার আগেই তাকে পালাতে হবে।

মতলব করতে থাকে মনে মনে। কি ভাবে সে মুক্তি পাবে?

এগার. চেড়ীর শাস্তি

ঘরের একপাশে একখানা খাটিয়ায় ঘুমায় আ পান।

এ পাশের খাটিয়ায় থাকে শিখা।

আ পানকে মা চীনের আদেশে ঐ ঘরেই রাত্রে থাকতে হয়। মা চীন রাত্রেও শিখাকে একা রাখতে ভরসা করে না। নিজেও তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করে বেড়ায়।

শিখা ভাবে—”এ আবার কি জ্বালা? যদি বা পালাবার কোন চেষ্টা করে সে, মা চীনের জ্বালায় তা হবার জো নেই। শয়তানটা আবার প্রেমে পড়ে গেছে।” এত দুঃখেও হেসে ওঠে শিখা।

কয়দিনই শিখা ভাবছে পালাবার কথা।

আজ রাত্রে সে যা হয় কিছু করবেই। কাল রাত্রে আ পান মোটেই ঘুমায়নি, মাঝে মাঝে প্রায়ই টর্চ জ্বেলেছে। শিখা ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে আ পানের কীর্ত্তি—কলাপ লক্ষ্য করেছে।

আজ কিন্তু আ পানের এতটুকু সাড়া নেই। বাইরে দুর্যোগ চলেছে, সোঁ সোঁ করে সমুদ্রের বাতাস বইছে, মাঝে মাঝে জোর বৃষ্টি নামছে। ঠাণ্ডা পেয়ে আ পান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার নাসিকাগর্জ্জন শোনা যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে শিখা উঠে বসলো।

আজকের এই রাত্রি এনেছে মহা সুযোগ। অন্ধকার—বৃষ্টি—ঝড়। আজই তার মুক্তির লগ্ন, লগ্ন বয়ে গেলে তার মৃত্যুকে বরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।

খাটিয়াটা ক্যাঁচ করে শব্দ করে।

সঙ্গে সঙ্গে আ পানের নাসিকাগর্জ্জন থেমে যায়। সতর্ক শিখা তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিন্তু আ পানের হাতে আলো জ্বলে না, বরং আড়ামোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শোয় সে। আবার তার নাক ডাকে।

এবার অতি সন্তর্পণে শিখা উঠলো। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে চললো আ পানের দিকে। বাইরে বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে দরজার ফাঁকে যেটুকু আলো পাওয়া যায়, তাতেই আ পানের অবস্থান বুঝে হাত দুখানা এগিয়ে দেয় সে।

অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে যায় আ পানের। সদ্য—জাগ্রত আ পান—বুঝতে পারে কে দু’হাতে তার গলা টিপে ধরেছে। সাঁড়াসীর মত চাপে কণ্ঠনালী তার রুদ্ধ হয়ে আসে। সে দু’হাতে বজ্র—পেষণরত হাত দু’খানাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে; কিন্তু সে—পেষণ এতটুকুও শিথিল হয় না।

অসীম শক্তি দিয়ে শিখা তার গলা টিপে ধরেছে।

হয় জীবন, নয় মৃত্যু!

মরতে কেউ চায় না, সবাই চায় বাঁচতে। শিখাও বাঁচবে, বাঁচার চেষ্টাই করছে সে।

কয়েকবার হাত পা ছোঁড়ে আ পান। তারপর ক্রমেই সে নিস্তেজ হয়ে আসে। তার জ্ঞান তিরোহিত হয়, মরার মত পড়ে থাকে।

উপায় নেই—এছাড়া আত্মরক্ষার আর কোন উপায় নেই। আ পানের উপর শিখার কোন বিদ্বেষ নেই। বরং আ পান তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করেছে। উপকারী বন্ধুর মতই ছিল সে। তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করতে অন্তরে ব্যথা লাগে, কিন্তু নিরুপায় সে!

আ পানের পোষাকটা ক্ষিপ্রহস্তে খুলে নিয়ে পরে ফেলে শিখা।

তারপর নিজের পরণের শাড়ী ছিঁড়ে শিখা সেই শাড়ীর একদিক দিয়ে আ পানের মুখ বেঁধে ফেলে। আর একদিক দিয়ে তার হাত দুখানাও শক্ত করে বাঁধে। বিছানার চাদরখানা তুলে সেইটা দিয়ে খাটিয়ার সঙ্গে শক্ত করে আ পানকে বেঁধে ফেলে।

এরপর রুদ্ধ দ্বারে সে করাঘাত করে। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে আ পান এই ভাবেই রক্ষীকে ডাকে, শিখা তা দেখেছে।

রক্ষী ঢুলতে ঢুলতে এসে দরজা খুলে দেয়।

আ পান রূপিণী শিখা বের হয়ে যায়। প্রহরী একবার তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করে দেয়।

বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে—

অপরিচিত স্থানে, অপরিচিত পরিবেশে, ধোঁকা লেগে যায় শিখার।

একটা ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছিল, সেই ঘরের ভিতর দিয়ে বাইরে যাওয়ার পথ। মা চীন সেই রাত্রেও ঐ ঘরে বসে লেখাপড়া করছে।

বুকের রক্ত জমাট হয়ে আসে শিখার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে দরজার বাইরে।

—”কে—কে ওখানে?”

মা চীন সন্ত্রস্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করে। আলোটাকে ফিরিয়ে নিয়ে দেখে। তারপর নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বললে, ”ও, আ পান? তা এই বৃষ্টিতে যাচ্ছো কোথায়? আচ্ছা যাও, এখনই ফিরে এসো। আমি কিন্তু এখনই শুয়ে পড়ব। ঘর বন্ধ করিয়ে এসেছো তো? ও কিন্তু ভারী চালাক মেয়ে, ধরা দিয়েও দিচ্ছে না। সর্দ্দার কথা দিয়েছেন মেয়েটা আমার। আমার পাশেই শুয়ে থাকবে সে। এই ঝড় বাদলের রাত আবার আসবে। তখন সে থাকবে আমার বুকের ভেতরে। তার গরম নিশ্বাস আমাকে পাগল করে তুলবে”… নিজের মনেই বিড় বিড় করে বকতে থাকে মা চীন। লেখাপড়া আর তার সে দিন হল না। নিজের বিছানায় ধপ করে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রইল।

আর শিখা মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ দেয়,—স্বীকার করে ভগবান আছেন।

কম্পিত বক্ষে, কম্পিত পদে মা চীনের পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় সে। মা চীন তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আ পান মাঝে মাঝে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যায়, খানিকক্ষণ বাদে আবার ফিরে আসে, একথা সে জানতো।

আ পানের প্রতি করুণায় বিগলিত হয়ে ওঠে মা চীনের মনটা। সত্যিই মেয়েটা খুব করছে। শিখার জন্য সেও প্রায় বন্দিনী হয়ে গেছে। মা চীন ভাবে যে সর্দ্দার এলেই এবার সে আ পানকে মুক্তি দেবে। বড় ভাল মেয়ে আ পান। কিন্তু সর্দ্দার কবে আসবে কে জানে? সর্দ্দার এলেই সে লাভ করবে শিখাকে। আনন্দে অধীর হয়ে ওঠে মা চীনের মনটা।

বার. উড়ো পাখীর পিছনে

বাড়ী থেকে বেরিয়েই ছুটতে থাকে শিখা।

ওধারে দেখা যাচ্ছে কালো পর্ব্বতশ্রেণী,—এদিকে খানিক দূরে সমুদ্র। ঝড়ের বেগে তার তরঙ্গ বহু দূরে ছড়িয়ে পড়ছে; বিদ্যুতের আলোয় তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি নামে। সেই বৃষ্টি তুচ্ছ করে শিখা দৌড়ায়।

উঁচু নীচু পাথরে বেধে কতবার সে পড়ে যায়, বৃষ্টির জলে সে স্নান করছে, আর্দ্র পোষাক, গায়ে গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে।

লক্ষ্য তার দক্ষিণে—পর্ব্বত শ্রেণী।

তার ধারণা ওখানে আছে সৈন্যদের ছাউনি। কোনরকমে ওখানে পৌঁছোতে পারলেই সে নিরাপদ।

তার সৌভাগ্য, এই সময়েই বৃষ্টিটা জোর নেমেছে। বৃষ্টিধারায় সৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

দূরে একটা আলো দেখা যায়। থমকে দাঁড়ায় শিখা। বুঝতে পারে না এ আলো কোথায় জ্বলছে। এই গভীর রাত্রে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে কেউ কি আলো নিয়ে পথ চলছে? অথবা কোনও সাঙ্কেতিক চিহ্ন? পাহাড়ের সানুদেশে দাঁড়ায় শিখা।

মাথা উঁচু করে তাকায় সে। ছোট পাহাড় সোজা উঠেছে। এর ওধারে কি আছে, কে জানে। যাই থাক, তাকে এ—পাহাড় পার হতেই হবে। বাঁ দিকে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র—ওদিকে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

বৃষ্টি ধরে এসেছে। সামান্য গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে মাত্র। ওদিকে আকাশটাও যেন ফর্সা হয়ে আসছে! সর্ব্বনাশ, ভোর হয়ে আসছে নাকি?

আশ্চর্য্য নয়। শিখার সময়ের হিসাব নেই। কত রাত্রে সে বের হয়ে এসেছে, তারপর দীর্ঘ পথ চলেছে—রাত্রি শেষ হওয়া বিচিত্র নয়। ভোর হতেই খোঁজ পড়বে তার। বন্দিনী আ পানকে রক্ষীরা দেখতে পাবে, মা চীনের কাছে খবর যাবে, তারপর ছুটবে শিখার অন্বেষণে কত লোক! তারা আতিপাতি করে খুঁজবে এবং যদি শিখা ধরা পড়ে, তার শাস্তি যে কি হবে তা ভাবতেই শিখার আতঙ্ক হয়!

রতনটাকেও যদি এ সময় পাওয়া যেতো—

কিন্তু তাতেই বা কি? বিশ্বাসঘাতক রতন মংপোর প্রিয় অনুচর পদে বহাল হয়েছে! সব কথাই সে বলে দিয়েছে মংপোকে—অনেক সন্ধান দিয়েছে। রতনকে পেয়ে মংপোর লাভ ছাড়া লোকসান হয়নি বোঝা যাচ্ছে।

সকাল হয়ে আসে—

ক্লান্ত শিখা আর হাঁটতে পারে না। তার ক্ষতবিক্ষত পা দুখানা স্ফীত হয়ে উঠেছে, সারারাত্রি বৃষ্টির ঠাণ্ডা জল গায়ে বসেছে। শিখা তার ক্লান্ত পা দুখানাকে আর টানতে পারছে না।

একটু বসতে পারলে, একটু বিশ্রাম নিতে পারলে শিখা আরাম পায়। কিন্তু একবার বসলে সে উঠতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।

পূর্ব্ব আকাশে সূর্য্য উঠছে—

—”এই দিকে—এই দিকে কয়েকজন যাও, আর ও’দিকটায় তোমরা যাও—”

দূরে ঝোপ জঙ্গলের আড়াল থেকে মা চীনের রুক্ষ কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যায়। সন্ধান পেয়েছে,—হ্যাঁ, সন্ধান পেয়ে তারা শিখাকে অন্বেষণ করতে বার হয়েছে। মুহূর্ত্তে শিখা নিজেকে প্রস্তুত করে।

আত্মরক্ষা তাকে করতেই হবে। সারা রাত্রির কষ্ট যেন ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত না হয়।

শিখা অধীর হয়ে ওঠে।

সামনে পাহাড়ের একটি উচ্চ শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। কোন রকমে শিখা তার পিছনে আত্মগোপন করতে চায়, ধীরে ধীরে সন্তর্পণে সে এগিয়ে যায়।

চমৎকার জায়গা। পিছনে ঝোপ, সামনে শৃঙ্গের আড়াল। এখানে বসে পড়ে শিখা। বসে পড়া ছাড়া উপায়ও নেই, দাঁড়াবার শক্তি তার তখন ছিল না।

দূরের কথার আওয়াজ কাছে এগিয়ে আসে ক্রমশঃ।

মা চীনের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়—”সমুদ্রের দিকে পালাতে পারেনি,—কাল সারারাত যা তুফান গেছে তাতে ওদিকে যেতে পারেনি। এই দিকেই এসেছে। এ দিক দিয়ে নিশ্চয়ই চট্টগ্রামের পথে যাচ্ছে। উঃ, বাঙ্গালী মেয়ের কি সাহস দেখেছো। সাংঘাতিক মেয়ে!”

আর একজনের কথা শোনা যায়, ”গেলেও খুব বেশী দূর যেতে পারবে না, শীঘ্রই তাকে আমরা ধরে ফেলব।”

তারা অগ্রসর হয়ে যায়—দ্রুত পদে ক্ষুদ্র পাহাড় অতিক্রম করে।

নিঃশব্দে ঝোপের আড়ালে বসে শিখা লক্ষ্য করে—তারা কোন দিকে গেল।

বেলা বাড়তে থাকে।

পিছনে ঝোপের মধ্যে হঠাৎ খস খস শব্দ হয়। শিখা সচকিত ভাবে মুখ ফিরায়।

আস্তে আস্তে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে তার দিকে।

শিখার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে যায়!

সামনেই যে বড় পাথরখানা হাতের কাছে পায়, সেইখানা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। কঠিন মুখে সে অপেক্ষা করে—অন্বেষণকারী হাতের নাগালের মধ্যে আসবামাত্র সে তার মস্তক লক্ষ্য করে হাতের পাথর ছুঁড়বে!

—”দিদিমণি—শিখা দিদিমণি!”

কে ডাকে? কার কণ্ঠস্বর এ!

অন্বেষণকারী দুহাত তুলে দাঁড়ায়—

—”আমি—আমি রতন, দিদিমণি—”

—”রতন!”—শিখা হাতের উদ্যত পাথরখানা নামিয়ে ফেলে। ততক্ষণে রতন কাছে আসে।

বাঙ্গালীর পোষাক ছেড়ে খাঁটি বর্মীর পোষাক পরেছে সে। দূর থেকে তাকে দেখে চেনাই দুঃসাধ্য।

বিদ্রুপের সুরে শিখা বলে, ”তাহলে গুপ্তচরের কাজও করছো বুঝি রতন? এই মতলব নিয়ে মংপোর হাতে আমায় দেওয়ার জন্যেই বুঝি তুমি গাইড হয়ে আমায় এখানে এনেছিলে? তাই ওরা আমাদের নৌকা আক্রমণ করেছিল?”

ক্রোধে ক্ষোভে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে।

আর্দ্রকণ্ঠে রতন বললে, ”না দিদিমণি, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। বলবে ওদের দলে গিয়েছি। কিন্তু আত্মরক্ষা করতে ওদের দলে যোগ দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না দিদিমণি, নইলে ওরা রহিমের মতই আমার অবস্থা করতো।”

শিখা একবার মাত্র জিজ্ঞাসা করে—”তারপর?”

রতন একান্ত নিরুপায়ভাবেই হাত দুখানা কচলায়, কিশোর রতনের চোখ দিয়ে নিঃশব্দে শুধু অশ্রুধারা নামে।

তের. চতুর রতন

রতনের কাহিনী শোনা যায়। বাধ্য হয়ে কেবল আত্মরক্ষাই নয়, মীরার সন্ধান এবং শিখার মুক্তি কামনা নিয়েই রতন মংপোর দলে ভর্ত্তি হয়েছে।

মংপো প্রথমে তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু পর পর কয়েকটা দুঃসাহসিক কাজ করে রতন এদের বিশ্বাস অর্জ্জন করেছে।

আজ সকালে সে শিখার খোঁজ নেবে ঠিক করেছিল। কাল অনেক রাত্রে সে বর্মা হতে ফিরেছে মংপোর সঙ্গে। আজ কয়দিন আগে বর্মায় ভীষণ বৃষ্টি হয়ে গেছে, এই সুযোগে তারা যা লুঠপাট করেছে—তাতে তিনপুরুষ কেন, সাতপুরুষ পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খাওয়া চলে। রতন এই লুঠের সময় বিশেষ অংশ গ্রহণ করেছিল এবং নিজে কিছুমাত্র না রেখে সব কিছু সে মংপোকে দিয়েছে। ফলে মংপো অত্যন্ত খুসি হয়ে তার হাতের হীরার আংটিটি তাকে উপহার দিয়েছে।

বলতে বলতে রতন হাসে।

—”হাজার হোক বার্মিজটা একদিক দিয়ে বোকা দিদিমণি। নইলে আমায় কখনো বিশ্বাস করতে পারে? লোকে ভয়ে ভজে আর ভক্তিতে ভজে। আমি ভক্তিতে যে ভজিনি সেটা তো জানা কথা। দু—হাতে লুঠ করেছি, সন্ধান দিয়েছি, তাতেই সে আমায় ভীষণ বিশ্বাস করেছে। শীঘ্রই আবার আমায় মা চীনের সঙ্গে পাঠাবে চট্টগ্রামে। সেখানে মীরার বাবা টাকা পাঠাবেন। আমরা টাকা পেয়ে ফিরে এলে তবে মীরাদিদিকে তাঁর কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে।”

ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে শিখা, ”মীরার খবর পেয়েছো রতন?—সে কোথায় আছে জানো?”

রতন বাহাদুরির হাসি হাসে। বলে, ”তবে আর বলছি কি দিদিমণি! আমি সব জানি—সব খবর আমি রাখি। মংপো বাঙ্গালীকে তো চেনে না—”

শিখা বাধা দেয়, বলে, ”বাহাদুরির কথা এখন থাক রতন, আমাকে তুমি মীরার কাছে নিয়ে যেতে পারবে?”

রতন মাথা চুলকায়, বলে, ”নিয়ে যাব কি করে দিদিমণি,—সে যে বড় কঠিন ঠাঁই! মংপো এমন পাহারা রেখেছে যে সেখানে একটা মাছি গলবারও উপায় নেই। আর মীরা দিদিমণিটাও এমন মেয়ে যে শুধু কাঁদতেই জানে, আর কিছু পারে না। তোমার মত যদি হতো, ওই বুড়িটাকে গলা টিপে মেরে এতদিন কবে বের হয়ে পড়তো।”

রতন শিখাকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে একবার চারিদিকটা দেখে আসে।

মা চীনের অনুচররা কতক গেছে চট্টগ্রামের দিকে, কতক গেছে উত্তর দিকে, কতক পার্ব্বত্য চট্টগ্রামের দিকে। এদিকে জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

কিন্তু শিখা উঠতে পারে না, রতনের সাহায্য নিয়ে অতি কষ্টে কোন রকমে দাঁড়ায়। রতন বলে, ”যত কষ্টই হোক, তোমাকে যে কোথাও আশ্রয় নিতেই হবে দিদিমণি। এই পাহাড়ের ওদিকে আমার বেশ জানা একটা বুড়ীর বাড়ী আছে। তোমাকে আমি এখন সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি। তারপর সুযোগমত সব কিছু করা যাবে।” শিখা অতি কষ্টে রতনের সঙ্গে সেই বুড়ীর বাড়ীতে যায়।

রতন জানায় বুড়ী আগে চট্টগ্রামে ছিল। তাঁতের কাজ সে খুব ভালো জানে এবং কাপড় তৈরী করে কোনরকমে জীবিকা নির্ব্বাহ করে।

চট্টগ্রামে থাকতেই রতনের সঙ্গে তার পরিচয়। রতন তাকে আয়িমা বলে ডাকে।

রতন শিখাকে আয়িমার কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। বললে, ”কোন ভয় নেই দিদিমণি, এখানে থাকো কয় দিন, পায়ের ব্যথাটা একটু কমে আসুক, এর মধ্যে আমি আবার আসছি—দেখি, হয় তো রাত্রেই ফিরে আসব।”

শিখা বললে, ”তোমার রিভলভার আর ছোরাটা আমায় দিয়ে যাও রতন। মংপোকে জানিও হারিয়ে গেছে। অবশ্য যদি সে জিজ্ঞাসা করে।”

পরমোৎসাহে রতন নিজের ছোরা আর রিভলভার শিখার হাতে তুলে দেয়।

বললে, ”মংপো জানতেই চাইবে না এসব কোথায় গেল। তা ছাড়া আর একটা জিনিস দিয়ে যাই দিদিমিণি—”

সে কুটিরের এককোণ হতে একটি ছোট সুটকেশ বের করে এনে শিখার সামনে রাখে। বলে, ”এই যে দিদিমণি, এর নাম ষ্টেনগান। তুমি নিশ্চয়ই এর নাম জানো। ব্যবহারটাও শিখে রাখো—এটা যাতে দরকার মত চালাতে পারো।”

গুলি ছুঁড়বার প্রণালী শিখিয়ে দিয়ে বিদায় নেয় রতন।

যাওয়ার সময় বলে যায়—”ওই যে দূরে পাহাড়ের উপরে ছোট বাড়ীখানা দেখছো, ওইখানে ওরা মীরাদিদিমণিকে আটকে রেখেছে। তবু তোমায় বারণ করে যাচ্ছি দিদিমণি, একা তুমি যেন ওদিকে যেয়ো না, বিপদ ঘটবে।”

শিখা একটু হাসে তার আতঙ্ক দেখে।

বললে, ‘ওখানে বুঝি অনেক লোকজন আছে?”

রতন তার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না, বললে, ”তা হয় তো আছে। কাল তো কেউ ছিল না। শুধু সেই বুড়িটা…তাই তো বলছিলাম—মীরাদিদির কোন ক্ষমতা নেই, কেবল কাঁদতেই জানেন।’

রতন চলে যায়।

বৃদ্ধা আয়িমা শিখার সেবা—শুশ্রূষা করে। গরম জল এনে পায়ের ক্ষত ধুইয়ে দেয়। এক জাতীয় ঘাসের পাতা ছেঁচে তার রসটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলে, ”তোমরা মা, ডাক্তারের ওষুধটাই জানো, আমাদের পাহাড়—জঙ্গলে কত গাছপালা আছে, তার রস লাগালে কত বড় বড় ঘা পর্য্যন্ত একদিনে শুকিয়ে যায়। এই ঘাসের রস লাগিয়ে দিলাম, সন্ধ্যের সময় তুমি একেবারে ভালো হয়ে উঠবে দেখো।”

এতক্ষণ পায়ে যে অসহ্য জ্বালা করছিল, এই রস লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে সে জ্বালা জুড়িয়ে গেল।

আয়িমা তাড়াতাড়ি রান্না করে তাকে খেতে দেয়। ক্লান্ত শিখা সামান্য কিছু আহার করে মাত্র, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।

কখন জানে না—গোলমালে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।

মা চীনের কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যায়—”এতখানি পথ অনর্থক খুঁজে এলাম, কোথাও দেখা পেলাম না। সর্দ্দারকে কি বলা যাবে, তাই ভাবো একবার—আমাদের আর বাঁচতে হবে না দেখছি।”

বৃদ্ধা আয়িমাকে ধমক দিচ্ছে সে—

—”নিশ্চয় তুমি জানো—তুমি দেখেছো সে মেয়েটি কোনদিকে গেছে। যদি মিথ্যে কথা বল তোমায় কুকুর দিয়ে খাওয়াব।”

আয়িমা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে। কুটীরের এককোণে পিণ্ডাকারে কম্বল চাপা দিয়ে পড়ে থাকে শিখা। তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে থাকে।

মনে হয় মা চীন দরজার দিকে আসছে। শিখার বুকটা কেঁপে ওঠে।

রতনের দেওয়া সুটকেশটা তার কাছেই ছিল।

সে তাড়াতাড়ি সুটকেশটা খুলে ষ্টেনগানে গুলি ভর্ত্তি করে তৈরি হয়ে থাকলো। যদি মা চীন ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করে তাহলেই সে ষ্টেনগান থেকে গুলি চালাবে। মরবে সে, তবু ধরা দেবে না।

কিন্তু গুলি করবার আর দরকার হয় না। মা চীনের দল ফিরে যায়।

বাইরে তার স্বর শোনা যায়—”চল চল, বুড়ি সত্যিই দেখেনি। চোখে দেখে না, কানে শোনে না, ওকে আর নির্যাতন করে কি হবে?”

একসঙ্গে বহু পদশব্দ শোনা যায়।

মা চীনের দল ফিরে যাচ্ছে, শিখাকে তারা পেয়েও পেলো না।

মুখের ঢাকাটা খুলে ফেলে শিখা।

মুক্ত বাতাস নিয়ে সে বাঁচে।

চৌদ্দ. গুপ্ত বৈঠক

রাত্রি কেটে গেল, কিন্তু রতন ফিরলো না।

শিখা দুর্ভাবনায় পড়লো। এখানে বেশী দিন থাকা চলবে না, যে কোনো দিন যে কোনো মুহূর্ত্তে সে ধরা পড়তে পারে এখানে থাকলে।

সারাদিন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে।

আয়িমাকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করে, ”দূরে পাহাড়ের ওপর ওই যে বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে, আজ সন্ধ্যার দিকে আমায় ওখানে পৌঁছে দিতে পারবে তুমি।”

বৃদ্ধা শিউরে ওঠে!

—”ওরে বাপরে, সে আমি পারব না মেয়ে—উঃ”,—তার দুই চোখ কপালে ওঠে!

—”যদি ওরা কোনরকমে জানতে পারে, আমি তোমায় এখানে রেখেছি, আমায় কুচি কুচি করে কেটে কুকুর দিয়ে খাওয়াবে। আমাদের এখানে সেদিন ইয়ানিনকে এমনি করে কুকুর দিয়ে খাইয়েছে। সে সায়েবদের জানিয়েছিল, এরা কেবল ডাকাতিই করে না, জাপানীদের সঙ্গে মিলেছে। না বাপু, রতন আসুক, তুমি তার সঙ্গে যেয়ো, আমি পারব না।”

শিখা জানে কিভাবে এদের মত লোককে হাত করতে পারা যায়।

নিজের গলার স্বর্ণহারটা খুলে সে আয়িমার হাতে দিয়ে বললে, ”তোমায় কিছু করতে হবে না আয়িমা, তুমি আমার কাছ হতে দূরে থেকো, আমি তোমাকে অনুসরণ করে চলব, শুধু পথটা একটু চিনিয়ে দিয়ে তুমি চলে আসবে। তোমার এই কাজের জন্যে আমি তোমায় এই হার দিচ্ছি আয়িমা, দয়া করে তোমায় এ কাজ করতেই হবে।”

স্বর্ণহার চক চক করে ওঠে বৃদ্ধার হাতে। লোভ সামলাতে পারে না সে।

অনিচ্ছার সুরে বললে, ”তা তুমি যখন বলছো, তখন করব বই কি। তবে নেহাৎ সন্ধ্যে বেলায় নয়। ওপথে লোকজন যাওয়া আসা করে। আবার কার চোখে পড়ব—দুজনকেই এরা কুকুর দিয়ে খাওয়াবে। রাত একটু বেশী হোক,—নিয়ে যাব—হ্যাঁ, নিয়ে যাব বই কি।”

কি দিন আর কি রাত্রি—

ঘরের মধ্যে বন্দিনী শিখা, তার কাছে দিন রাত্রি সমান।

রাত্রি হয়েছে এবং বেড়েও চলে—

আয়িমা ডাকে, ”এসো মেয়ে, এই বেলা তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

তিন দিন পরে শিখা বাইরে আসে।

উন্মুক্ত নক্ষত্রখচিত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে খোলা বাতাস প্রাণভরে গ্রহণ করে সে।

আশ্চর্য্য—পায়ের ব্যথা একেবারেই নেই।

আকাশে উঠেছে একফালি চাঁদ,—পাহাড়ের মাথার উপর জেগে আছে,—তার মৃদু আলোয় অন্ধকার অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে।

দূরে কোথায় মাদল বাজছে—কারা গান গাইছে। মাথার উপর দিয়ে টহলদার বিমান উড়ে যায়।

বৃদ্ধা আগে আগে চলে, পিছনে খানিক দূরে চলে শিখা।

ঝোপের আড়ালে খস খস শব্দ হয়। চতুষ্পদ কোন নিশাচর প্রাণী চলে বেড়াচ্ছে হয়ত। বড় বড় গাছগুলো অন্ধকার সৃষ্টি করে দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে আছে!

ছপাস করে একটা শব্দ হয়।

একটা বড় গাছের ডাল হতে বৃহদাকার একটা প্রাণী নিচে ছিটকে পড়ে!

—”সাবধান—সাবধান মেয়ে! সাপ—মস্ত বড় সাপ!”

বৃদ্ধা আয়িমা আতঙ্কে দশহাত পেছিয়ে আসে, শিখা থমকে দাঁড়ায়।

বৃহদাকার একটি পাহাড়িয়া সাপ!

শিখাদের কাছ হতে বারো চৌদ্দ হাত দূরে সে আস্তে আস্তে চলতে সুরু করে।

কি দারুণ জীব, বিরাট তার দেহ!

সুটকেশে রাখা স্টেনগান—একবার ছুড়তে পারলে এই মুহূর্ত্তে ওর ভবলীলা সাঙ্গ করা যায়—রিভলভারটাও রয়েছে। হাতটা নিস—পিস করে শিখার, কিন্তু তাতে তার বিপদই ঘটবে। যে কাজের জন্য যাচ্ছে তার কিছুই হবে না। রিভলভারের শব্দে হয়ত চতুর্দ্দিক থেকে শত্রুর দল ছুটে এসে তাকে ঘিরে ধরবে।

চলতে চলতে আয়িমা থামে। ফিস ফিস করে জিজ্ঞাসা করে—”মেয়ে, তুমি কি পুলিসের লোক?”

বৃদ্ধার মনের কথা শিখা বোঝে। গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়, ”হ্যাঁ, আমি পুলিসের লোক।”

বৃদ্ধা আপন মনে কি যেন বকে। একটি মাত্র কথা কানে আসে শিখার—”পুলিস জাতটাই ভারী খারাপ, ছিনে জোঁক, একবার ধরলে আর ছাড়ে না।”

শিখা বুঝতে পারে বৃদ্ধা আর যেতে চায় না, এখান হতেই সরে পড়তে চায়। বুঝতে পারে সে অত্যন্ত ভয় পেয়েছে।

খপ করে সে বৃদ্ধার হাত চেপে ধরে। ষ্টেনগানটা নামিয়ে রেখে কটিবদ্ধ রিভলভারটা বার করে তার ললাট লক্ষ্য করে শক্ত কণ্ঠে বললে, ”শোন, এতদূরে এসে তুমি যদি ভরাডুবি করবে ভেবে থাকো, তার আগে আমি তোমায় খুন করব।”

বেশ বোঝা যায় আয়িমা কাঁপছে।

কম্পিতকণ্ঠে আয়িমা বললে, ”না না, আমি সরে যাব না, তোমাকে ওই বাড়ীর কাছে পৌছে দিয়ে আমি ফিরে যাব, কথা যা দিয়েছি তা রাখবো; তুমি এসো।”

মাঝে মাঝে জঙ্গল বেশ ঘন হয়ে আছে। আবার মাঝে মাঝে পরিষ্কার স্থানও দেখা যায়। কয়েকটি চড়াই উতরাই ভেঙ্গে শিখা এসে দাঁড়াল একটা জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে। সামনেই নির্দ্দিষ্ট বাড়ীখানা আবছা দেখা যাচ্ছে।

আয়িমা চুপি চুপি বললে, ”আজ ওদের মিটিং আছে দেখছি, লোকের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে! মেয়ে, আমার কাজ শেষ হয়েছে, আমি এবার যেতে পারি?”

শিখা আপত্তি করবার আগেই বৃদ্ধা পিছন ফেরে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে আর তাকে দেখা যায় না।

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে শিখা।

অন্ধকারে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে বাড়ীটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে চেষ্টা করে। বাড়ীটা কাঁচা বাড়ী হলেও বেশ বড়। অনেকগুলো ঘর বাড়ীটাতে। সে বুঝতে পারে না, কোন ঘরে ওরা মীরাকে আটক করে রেখেছে।

শিখা আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ইতস্ততঃ তাকায়,—কোনদিকে যদি এতটুকু ফাঁক দেখা যায়।

ভিতরে তখন তুমুল বাদানুবাদ চলছে।

মা চীনের কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যায়—

”আমি বলছি সর্দ্দার, বার বার বলেও আবার বলছি, বাঙ্গালী ছেলে রতনকে অতখানি বিশ্বাস করে তুমি ভালো কাজ করনি। টাকা আনতে তাকে তুমি পাঠিয়েছো। মনে করতে পারো না কি যে সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সে অস্ত্রধারী পুলিস এনে আমাদের এ দেশ ঘিরে ফেলবে, পিঁপড়ের মত আমাদের এক একটি করে মারবে?”

মংপোর উচ্চহাসি কানে আসে।

খানিকক্ষণ হেসে সে থামে। বলে, ”হ্যাঁ, এ সন্দেহ তুমি করতে পারো মা চীন। কিন্তু জানো না, তার মাথা বাঁধা রয়েছে আমার কাছে। রতনের মা, বাপ, ভাইবোন সকলকে আমি আমার নিজের কাছে এনে রেখেছি। রতন জানে, যে মুহূর্ত্তে তার বিশ্বাসঘাতকতার একটু বার্তা আমি পাব, সেই মুহূর্ত্তে ওর আপনার বলতে যে কেউ আছে সবাইকে আমি হত্যা করব। কেবল সেইজন্যই রতন কিছু করতে পারবে না।”

আর একজন লোকের কণ্ঠস্বর শোনা যায়,—”কিন্তু এই যে মেয়েটি আ পানকে এমন ভাবে বন্দী করে রেখে পালালো—”

মংপো গর্জ্জন করে ওঠে—”সে দোষ কার? আমি আগে হতেই সতর্ক করে দিয়েছিলাম—সাবধান! বুদ্ধিমতী এ মেয়ে সব কিছু করতে পারে! যেমন করেই হোক সে পালাবার চেষ্টা করবে! তবু তোমরা তাকে সাধারণ একটি মেয়ে ভেবে সতর্ক হওনি! সে দোষ কার?”

মা চীন ধীর কণ্ঠে বললে, ”আমি বলব—এ তোমার রতনেরই কীত্তি সর্দ্দার! তার সাহায্য না পেলে এ মেয়ে কিছুতেই পালাতে পারতো না। আর পালালেও ধরা পড়ে যেতো। সে ওইটুকু সময়ের মধ্যে এমন ভাবে উধাও হয়ে গেল—আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও পেলাম না। নিশ্চয়ই রতন তাকে নিয়ে গেছে। রতনকে পীড়ন করলেই মেয়েটার সন্ধান মিলতো। কিন্তু তুমি তা করলে না সর্দ্দার। বরং—”

মংপো গম্ভীর কণ্ঠে বললে, ”আমি নিশ্চয়ই জানি—রতন সেদিন এখানে ছিল না। আমার সঙ্গে বর্মা হতে সে ফিরছে অনেক রাত্রে। সে রাত্রি সে আমার কাছেই ছিল। সকালে তোমাদের মুখে এ কথা শুনে সে তোমাদের সঙ্গেই বার হয়েছিল। ঘণ্টা দুই আপ্রাণ খুঁজে সে আমার কাছে ফিরে গেছে। আমি জানি মা চীন, তোমরা কেউই সেই বাঙ্গালী ছেলেটাকে দেখতে পারো না। সে যে আমাদের কত কাজ করছে সেটাও তোমরা মানতে চাও না। এটা কিন্তু মোটেই ভালো নয়।”

সকলে নিশ্চুপ হয়ে যায়—কারও একটি কথা শোনা যায় না।

শিখা বোঝে, এই সুযোগে মীরার সন্ধান করা তার পক্ষে সহজ হবে। প্রত্যেকে তর্ক বিতর্কে মশগুল হয়ে আছে। শিখা লক্ষ্য করে, সবগুলো ঘরই অন্ধকার—কেবল দুখানা ঘরে লণ্ঠনের লালচে মৃদু আলো জ্বলছে। এই দুখানা ঘরের মধ্যেই একখানায় ওদের মিটিং চলছে। অপর ঘরখানায় কি মীরাকে আটকে রাখা হয়েছে?—সন্দেহ হয় শিখার।

পা টিপে টিপে শিখা ঘরখানার পিছনদিকের ছোট জানলাটার গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।

পনের. স্বপ্ন না সত্য

শিখা জানলা দিয়ে ঘরের ভিতর উকি দেয়।

একটা লণ্ঠন ঘরের এক কোণে মিট মিট করে জ্বলছিল। লণ্ঠনের সেই মৃদু আলোতে সে দেখতে পেলো যে মীরা একখানা খাটিয়ার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

মীরাকে ঐ অবস্থায় দেখে দুঃখে বুক ফেটে যেতে লাগলো শিখার। তার মনে হ’ল যে তার জন্যই মীরার আজ এই অবস্থা। সে যদি মীরাকে সঙ্গে নিয়ে না আসতো তাহলে তো তাকে এভাবে বন্দিনী হ’তে হ’তো না মংপোর দলের হাতে।

সে তখন চুপি চুপি ডাকলো, ”মীরা!”

মীরা সভয়ে চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো একবার। সে দেখতে চেষ্টা করলো কে তাকে নাম ধরে ডাকে?

শিখা আবার ডাকলো, ”মীরা! এদিকে আয়!”

—”কে? কে তুমি?”

শিখা বললো, ”চুপ! আমি শিখা। জোরে কথা বলিস না, ওরা শুনতে পাবে।”

মীরা ফিস ফিস করে বললো, ”কোথায় তুই শিখা?”

শিখা বললো, ”এই যে, এদিকে, জানলার কাছে।”

মীরা তাড়াতাড়ি খাটিয়া থেকে উঠে এগিয়ে এল জানলার কাছে।

শিখা বললো, ”ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দে, বুঝলি?”

মীরা বললো, ”ভেতর থেকে বন্ধ করবার ব্যবস্থা যে নেই ভাই।”

—”আচ্ছা, তা হলে চুপ করে দাঁড়া, আমি এই জানলাটা কেটে তোর আসবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গেই শিখা ছোরা দিয়ে জানলার শিকগুলো কাটতে সুরু করলো। লোহার শিক নয়—বাঁশের শিক। অল্প কয়েক মিনিটের চেষ্টাতেই শিকগুলো কাটা শেষ হল। এবার অনায়াসেই একটা মানুষ এই খোলা জানলা দিয়ে যাতায়াত করতে পারে।

শিখা বললো, ”আর দেরী নয় মীরা, শীগগির বেরিয়ে পড়।”

মীরার বুক কাঁপে। কম্পিতকণ্ঠে বলে, ”কিন্তু এরা—এদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে তুমি এলে কি করে? আবার আমরা যাবই বা কি করে? ধরা পড়বো যে!”

শিখা বলে, ”সাহস করে চলে আয় আমার সঙ্গে এই মুহূর্ত্তে—একটুও দেরী করিসনে। ওদিকে ওদের মিটিং হচ্ছে। এক মিনিটও নয়—তাড়াতাড়ি আয়। হাঁটতে পারবি তো—”

—”খুব পারবো—”

মুক্তির আনন্দে মীরা অধীর হয়ে ওঠে—”এখনই আমায় নিয়ে চল শিখা, এখনই—”

অতি সন্তর্পণে মীরা বের হয়ে আসে।

ওদিকে তখন তর্ক বিতর্ক সপ্তমে চড়েছে। মংপোর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে—”আমি যা বলছি তোমাদের তাই করতে হবে। যে আমার আদেশ না শুনবে—তাকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। আমার হাত থেকে তার মুক্তি নেই—”

মীরা সভয়ে দাঁড়ায়, তার পা আর উঠে না।

শিখা তার হাত ধরে টানে। কথা বলবার সময় নেই,—কথার শব্দ যদি কোন রকমে ওরা শুনতে পায়, তাহলে তাদের দুজনকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে।

জঙ্গলের মধ্য দিয়ে মীরাকে নিয়ে ছোটে শিখা। এতক্ষণে কথা বলবার অবকাশ হয়। মীরা তখন হাঁফাচ্ছে।

শিখা বললো, ”এখনই এত ক্লান্ত হলে চলবে না। কাছেই কুতুবদিয়া, ওখানে যতক্ষণ না পৌঁছাচ্ছি, ততক্ষণ আমরা নিরাপদ নই। হয় তো এখনই ওদের মিটিং শেষ হয়ে যাবে। তারপর ওরা যখন দেখতে পাবে যে বন্দিনী নেই, তখন আমাদের অবস্থা কি হবে তা ভেবেছিস কি?”

মীরার পা ভেঙে পড়েছিল ভয়ে, দুর্ব্বলতায়। কিন্তু নিজের অবস্থা মনে করে সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে, ”না, না, আমি পারব—পারব শিখা, যেমন করেই হোক আমায় তুই উদ্ধার করে কলকাতায় নিয়ে চল!” মীরার দুই চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ে।

সন্তর্পণে মীরাকে ধরে শিখা চলে।

সরু পথটা সে পেয়েছে। রাত্রে এ পথে লোকজন চলাচল করে না। যারা করে, দল না বেঁধে চলতে সাহস পায় না। পার্ব্বত্য দেশবাসীরা নিতান্ত নিরীহ লোক নয়। চুরি, ডাকাতি, হত্যা আর লুণ্ঠন এদের নিত্যকার কাজ। এখন এদের মধ্যে সমর্থ ছেলেরা সৈন্যদলে ভর্ত্তি হয়ে চলে গেছে, যারা আছে তাদের মধ্যে বেশীর ভাগই বৃদ্ধ, স্ত্রীলোক এবং শিশু। তাই রাত্রে তারা প্রায়ই ঘর থেকে বের হয় না।

দূরে দেখা যায় কুতুবদিয়ার বাতি—ঘর। আলো আর জ্বলে না সেখানে, বিমান আক্রমণের জন্য নিষ্প্রদীপ হয়ে আছে।

কুতুবদিয়ায় সৈন্যদের ঘাঁটি আছে, শিখা তা জানে। কোনো রকমে আর খানিকটা গেলে তারা আশ্রয় পাবে।

অবসন্ন মীরা আর হাঁটতে পারছিল না। তাকে কোন রকমে টানতে টানতে নিয়ে শিখা পথ চলে।

ষোল. আবার বন্দী

—”দাঁড়াও! এগিয়ো না আর!—থামো!”

হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় শিখা।

চোখের উপর এসে পড়ে উজ্জ্বল তীব্র আলো!

সঙ্গে সঙ্গে কানে আসে কর্কশ অট্টহাসি!

মংপো!

মুহূর্ত্তে শিখার সমস্ত শক্তি যেন অন্তর্হিত হয়ে যায়। মীরা বসে পড়ে। আর এক পাও চলবার ক্ষমতা তার নেই। যদিও শিখা অত্যন্ত ক্লান্ত, তবুও সে বিপদের সামনে এসে সাহসে ভর করে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল।

মংপোর কন্ঠস্বর শোনা যায়—

”খুব পালিয়েছো মিস্ রায়! আজ কয়েকদিন তুমি আমাদের যা হয়রানি করছো তা আর বলবার নয়। আজ আবার সুযোগ বুঝে আমাদের মিটিংয়ের অবকাশে আমাদের বন্দীকে মুক্ত করে নিয়ে চলেছো। ভাগ্যিস সঙ্গে সঙ্গে জানতে পেরেছি, নইলে তুমি তো যেতেই—আমার অতগুলো টাকাও আর পেতুম না!”

পার্ব্বত্য পথে এত তাড়াতাড়ি মংপো দশ বারো জন লোক নিয়ে আসতে পারে তা শিখা ভাবতেও পারে না। সৈন্যদের ঘাঁটি আর বেশী দূরে নয়—হয়তো মাইল খানেক হবে। এতদূর এসে সে মুক্তি পেল না! ক্ষোভে, দুঃখে হতাশায় সে অধর দংশন করে।

কিন্তু না! এত সহজে এমনভাবে আত্মসমর্পণ করবে না শিখা! সে মরবে, কিন্তু মেরে মরবে।

হাতে তার সুটকেশের মধ্যে ষ্টেনগান। অনেকবার ফায়ার করা চলবে। তার শব্দ পেয়ে নিকটবর্ত্তী ঘাঁটির সৈন্যদল যদি আসে—

এগিয়ে আসে মংপো। বন্দিনী দুটি মেয়েকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করে।

গুড়ুম—গুড়ুম—গুড়ুম—

ষ্টেনগান গর্জ্জন করে ওঠে মুহুর্মুহু।

একটা নয়…ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয় ষ্টেনগানের গুলি। প্রথমেই গুলি বিঁধলো মংপোর এক অনুচরের কপালে, আর একজনের বুকের পাশে।

মীরার হাতে শিখার রিভলভার গর্জ্জন করে।

স্তম্ভিত হয়ে গেছে মংপো আর তার সঙ্গীরা! কিন্তু ভাববার সময় তখন নেই!

চীৎকার করে ওঠে মংপো—”হত্যা করো—গুলি করে মারো ওদের!”

কিন্তু গুলি করবে কে? পর পর পাঁচটি গুলিতে পাঁচজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মংপোর সঙ্গীরা পালাতে থাকে।

কিন্তু একি—

পিছনে স্রোতের মত দস্যুদল ছুটে আসছে। তারাও ইতস্ততঃ ফায়ার করতে করতে আসছে।

—”হাত তোল, অস্ত্র ফেল—হাত তুলে দাঁড়াও!” মংপোর কণ্ঠস্বর।

পিছনে ফিরে চায় শিখা।

সর্ব্বনাশ—আর বুঝি রক্ষা নেই।

দলের অধিকর্ত্তা মংপো আবার আদেশ দেয়—”গ্রেপ্তার করো, যে পালাতে যাবে তাকে গুলি কর।”

শিখা দু—হাতে মুখ ঢাকে।

ভয়ার্ত্তকণ্ঠে মীরা চীৎকার করে ওঠে।

অথচ মাত্র এক মাইল দূরে রয়েছে সৈন্যদল।

তারা কি ঘুমিয়ে আছে? এতগুলি ফায়ারের শব্দেও কি তারা বুঝতে পারল না, এত কাছে দুটি অসহায়া তরুণীকে দস্যুদল বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তাদের ভাগ্যে কি আছে, ঈশ্বর ছাড়া কেই বা বলতে পারে?

অতঃপর দস্যুরা ওদের দুজনকে ঘিরে নিয়ে বনপথে এগিয়ে চললো।

শিখা বুঝতে পারে কোন দিকে তারা চলেছে। ঐ যে দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, এটাই নিশ্চয় এদের লক্ষ্যস্থল। জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম পথ হলেও, যে পথে ওরা চলেছে, সে পথে মানুষের যাওয়া আসা আছে বলেই মনে হয়।

শিখার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে মীরা বলে, ”কি হবে ভাই শিখা, এবারে বোধ হয় আমাদের আর রক্ষে নেই! কেন মরতে এসেছিলুম ভাই—”

শিখা বলে, ”বিপদে ধৈর্য্য ধরতে হয় মীরা। এত সহজে নার্ভাস হলে বিপদ থেকে কোন দিনই উদ্ধার পাওয়া যাবে না। আর তোর ভাবনাটা কিসের? ওরা দশহাজার টাকা আদায় করবার চেষ্টা করবে। টাকাটা পেয়ে গেলেই তোকে কলকাতায় নিরাপদে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আমার মুক্তিপণ তো আর টাকা নয়! আমার মুক্তিপণ যা আঁচ করে বসে আছে তারা, সেটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। তবে এইটুকু ভরসা, ওরা সহজে আমাদের হত্যা করবে না। বন্দী করে রেখে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করবার চেষ্টা করবে।”

পাহাড়ের সানুদেশে ওরা পৌঁছে গেছে। এখান থেকেই বলতে গেলে ঐ ছোট পাহাড়টা আরম্ভ। ছোট বড় শিলাখণ্ডে পদে পদে ওরা হোঁচট খেতে লাগল।

”সামালকে—ধীরে চল।” দস্যুদলের মধ্যে একজন হাঁক দিল।

ওরা তখন পাহাড়ের ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে।

শিখার ধারণাই ঠিক। ঐ পাহাড়ের ওপরেই ওদের কোন গুপ্ত ঘাঁটি আছে।

সেখানেই ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর যত দিন না মীরার মুক্তিপণ দশহাজার টাকা এসে পৌঁছায়, ততদিন ওদের ওখানেই বন্দীজীবন যাপন করতে হবে।

পাহাড়ের অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে ওরা। শিখা ভাবে, আশ্চর্য্য! এত কাছে সৈন্যদলের ছাউনি, অথচ তার পাশেই রয়েছে দস্যুদলের গুপ্ত ঘাঁটি! দস্যুদের সাহস তো বড় কম নয়। রতনকে যদি একবার পাওয়া যায় তাকেই চর পাঠাতে হবে। যদি কোন মিলিটারী অফিসারের কাছে গিয়ে ঘটনাটা একবার জানাতে পারে সে, তাহলে তাদের উদ্ধারের একটা উপায় হতে পারে। কিন্তু রতন—প্রাণ বাঁচিয়েই তাকে কাজ করতে হবে। সে কি ভরসা করবে এই দুঃসাহসিক কাজে এগিয়ে যেতে? তার সমস্ত পরিবারবর্গ রয়েছে মংপোর মুঠোর মধ্যে। আমাদের জন্য তার পরিবারবর্গকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে রাজীই বা হবে কেন সে? উপরন্তু রহিমের শাস্তি সে নিজের চোখে দেখেছে। দয়া মায়ার লেশ নেই এদের মনে, রতন তা ভালই জানে। তবুও ছেলেটা চালাক—চতুর। তাকে দিয়ে কিছুটা কাজ হয়ত হতে পারে…

পাহাড়টার সবটাই পার হতে হল। তারপর তার ওপিঠ দিয়েও অর্দ্ধেকটা প্রায় নামা হয়ে গেল। কোথাও কিছু নেই। কেবল এবড়ো খেবড়ো শিলারাশির স্তূপ। তবে কি এরই একটা গুহার মধ্যে ওদের বন্দিনী করে রাখা হবে? ভাবতে গিয়ে আঁতকে ওঠে শিখা। দস্যুদলের হাত থেকে রেহাই আছে তো বন্য জন্তুর হাত থেকে রেহাই নেই এখানে। বিশেষ করে বিরাট বিরাট সাপের রাজত্ব এটা। এরই মধ্যে অনেকগুলি বিষধর সাপের দর্শন পেয়েছে সে। নিজের মনে নানা রকম ভয়ের উদয় হলেও মীরাকে সে কিছু বলে না। তাকে শুধু সাহস দিয়ে দিয়ে দস্যুদের অনুসরণ করে চলে শিখা।

পাহাড় থেকে নেমেই একটা বাঁক ঘুরল দস্যুদল। দূরে একটা বাংলো ধরণের কুটীর দেখা গেল। গাছ—পালায় ঘেরা কুটীরখানি। দূর হতে কোন দিক থেকেই কুটীরখানি নজরে পড়ে না। পাহাড় ডিঙিয়ে কেন তারা যাচ্ছে এখন বুঝতে পারে শিখা। পাহাড় ঘুরে যাবার পথ নেই। গভীর জঙ্গলে আর ছোট ছোট কাঁটা গাছে ঘিরে রেখেছে পাহাড়টা। একপাশে একটা প্রকাণ্ড খাদ। শুধু যে পথে তারা পাহাড়ে উঠেছে সেটুকু পথ কে যেন নিজের হাতে জঙ্গল কেটে তৈরি করে নিয়েছে।

বাংলো—বাড়ীটাকে একটা ছোট—খাটো দুর্গ বললেই চলে। কোন দিক দিয়েই সেখানে যাবার রাস্তা নেই। এত ঘন জঙ্গলে ভরা যে সূর্য্যের আলোও বোধ হয় তার মধ্যে ঢুকতে পারে না। মানুষের দৃষ্টি তো কোন কথা! একটিমাত্র পথ শিখা দেখলো, যে পথে ওরা এসেছে পাহাড় ডিঙিয়ে। পালাতে হলে এই পথেই পালাতে হবে। কিন্তু অতখানি পাহাড় ডিঙিয়ে পালিয়ে আসার কথা ভাবতেই পারে না শিখা। উপরন্তু পাহাড় পথে কেউ যে এসে দস্যুদের আক্রমণ করবে সেটাও তাদের পক্ষে খুব সহজ হবে না। অনেক দূর থেকেই দস্যুরা শত্রুদের বন্দুক দিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারবে।

তাহলে কি তার বরাতে শেষ পর্য্যন্ত মা চীন…

আর ভাবতে পারে না শিখা।

সতেরো. দস্যুর দুর্গ

পাহাড়ের লাগোয়া কুটীরে বন্দিনী শিখা আর মীরা। তবে হাত—পা বাঁধা অবস্থায় বন্দিনী নয় এখানে। কুটীরের বাইরে কড়া পাহারা আছে, আর পাহারা আছে পার্ব্বত্য পথের ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে। কুটীর থেকে বেরিয়ে এলেও তারা পালিয়ে যেতে পারবে না কোন দিক দিয়ে।

শিখা ভাবে একবার বেরুতে পারলে সে পাহাড়ের পথে যাবে না। যাবে জঙ্গলের দিকে। একবার জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে আর তাদের সন্ধান করতে কেউ পারবে না। যদি বন্যজন্তুদের হাত এড়িয়ে যেতে পারে, তাহলে হয়ত মুক্তি পেলেও পেতে পারে।

তিন দিন পরে রতনের সঙ্গে দেখা হল। রতন এখন ওদের দলের একজন গণ্যমান্য পদস্থ ব্যক্তি। আজকালের মধ্যেই সে রওনা হবে মীরার মুক্তিপণের টাকাটা আনতে। মীরার বাবা টাকা দিতে রাজী হয়েছেন। মংপো রতনকেই সেই টাকা আনতে পাঠাবে ঠিক করেছে। যদিই বা কোন বিপদ ঘটে, রতনের ওপর দিয়েই সে ফাঁড়াটা কেটে যাক, এটাই তার ইচ্ছা। তার ওপর মীরা তো তার হাতের মধ্যেই রয়েছে—টাকা না দিয়ে তার বাবার উপায় কি? চিঠিতে স্পষ্টই লিখেছে মীরা, তার বাবা যেন দস্যুদের ধরতে চেষ্টা না করেন বা পুলিসে খবর না দেন। তাহলে এরা তাকে হত্যা করবে!

এক ফাঁকে শিখা রতনকে বললে, ”একটি কাজ তোমায় করতে হবে রতন।”

রতনের মুখ শুকিয়ে আসে। জানায়, মুক্তিপণের টাকাটা না নিয়ে এসে, কোন সাহায্যই সে করতে পারবে না। তবে তাদের কোন বিপদ হবার সম্ভাবনা বুঝলেই আগে খবরটুকু জানিয়ে দেবে। কিংবা তখন একবার মরিয়া হয়ে উদ্ধারের চেষ্টাও করবে।

—”তোমাকে আমাদের উদ্ধার করতে হবে না রতন। শুধু তুমি একটি রিভলভার বেশ ভাল দেখে বেছে আর গুলি ভরে আমাকে দিয়ে যাবে—কেমন?”

—”এ আর শক্ত কথা কি? আমার হাতে সর্দ্দার অনেক রিভলভার দিয়েছে। কিন্তু খুব সাবধানে রাখবেন দিদিমণি, নইলে আমাদের কারুরই রেহাই নেই।”

পরের দিন রাত্রেই একটা রিভলভার দিয়ে গেল রতন। আর বলে গেল কয়েকদিন তার আর দেখা পাওয়া যাবে না। টাকা আনতে যাচ্ছে সে। সে ফিরে না আসা পর্য্যন্ত সর্দ্দার দলবল নিয়ে এখানেই আমার অপেক্ষা করবে। এখন খুব সাবধানে থাকতে হবে শিখাকে।

শিখা কোন জবাব দেয় না। রিভলভারটা শুধু পরীক্ষা করে নেয়। বেশ আধুনিক ধরণের রিভলভার। হঠাৎ তা থেকে গুলি ছুটে যাবার আশঙ্কা নেই এবং গুলি ছুটবার সময় বিন্দুমাত্র শব্দ হবে না—নিঃশব্দে গুলি বেরিয়ে যাবে!

শিখা মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়। বুকের জামার ভিতর লুকিয়ে রাখে সেটা।

আঠারো. বুদ্ধির খেল

কয়দিন থেকেই শিখা লক্ষ্য করছে, দূরে পাহাড়ের ওপর মিলিটারী গোরারা মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে। বোধ হয় ছুটির দিনে ওরা পাহাড়টাকেই বেড়াবার জায়গা পছন্দ করে নিয়েছে।

সেদিন দুপুরের সময়ে একদল গোরা এসেছে এই রকম পাহাড়ে বেড়াতে। গোরারা পাহাড়ের এপিঠেও অনেকটা চলে এসেছিল। শিখা বোধ হয় এই সুযোগই খুঁজছিল। তার ঘর থেকে জানলার ভিতর দিয়ে গোরাদের ঠিক একহাত পাশে টিপ করে গুলি ছুঁড়ল। তারপর পরপর রিভলভারের সব কয়টা গুলিই একেবারে শেষ করে দিল গোরাদের দিকে। গুলিগুলো সব নিঃশব্দে ছুটে গেল!

হঠাৎ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হচ্ছে দেখে গোরার দল মাটিতে শুয়ে পড়ল। গুলিগুলো তাদের কান ঘেঁসে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপদ বুঝে তারা শুয়ে শুয়ে তাদের বিপদের সঙ্কেত জানিয়ে বাঁশী বাজিয়ে দিল।

পাহাড়ের ওপিঠেও বোধ হয় একদল গোরা ছিল। পাহাড় পার হয়ে তারাও ছুটে এল। সঙ্গে সঙ্গে একদল সৈন্য সেখানে জড় হয়ে গেল। তারা রিভলভার ষ্টেনগান নিয়ে কুটীরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।

মংপো প্রথমে বুঝতে পারেনি কিছু। কিন্তু যখন দেখল গোরার দল তার ঘাঁটি আক্রমণ করতে আসছে, তখন তার শিবিরেও সাজ সাজ রব পড়ে গেল। শিখা ইতিমধ্যে জানলা দিয়ে তার রিভলভার ফেলে দিয়েছে।

কোথা থেকে কি হল বোঝা গেল না। সৈন্যদল মংপোর কুটীর ঘিরে ফেলেছে। কিন্তু তারা অপেক্ষা করে রইল কিছুক্ষণ। বোধ হয় শত্রুর শক্তির কথাই ভাবছিল।

মংপোর একজন অনুচর দরজার ফাঁক দিয়ে ব্যাপারটি দেখতে এসে সৈন্যের এক গুলিতেই ভবলীলা সাঙ্গ করে লুটিয়ে পড়ল সেখানে।

শীঘ্রই দলে দলে সৈন্য এসে সেখানে জমা হল। একজন মিলিটারী অফিসার সৈন্যদল পরিচালনা করতে লাগলেন। মংপোর কুটীর আক্রমণ করল ওরা। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোক নিয়ে অতগুলো সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার ক্ষমতা দস্যুদের কোথায়?

তবুও সাহসী মংপো ও তার অনুচরেরা প্রাণপণে ওদের সঙ্গে খানিকক্ষণ লড়াই করলো। কিন্তু যখন বুঝলো যে, জয়ের আশা একেবারেই অসম্ভব, তখন মংপো ও তার সঙ্গীরা অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত তুলে দাঁড়ালো।

এগিয়ে আসে শিখা। মিলিটারী অফিসারকে ইংরাজীতে সব বুঝিয়ে দেয়। আরো বলে, এরা জাপানীদের গুপ্তচর।

বিশ্বাসঘাতক মংপোকে তারা চিনেছে। চিরদিনের দস্যুবৃত্তি যার ব্যবসায়, সে বৃটিশের বেতন নিয়ে জাপানীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেছে, তার সকল চাতুরী ধরা পড়ে গেছে।

নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মংপো।

মুহূর্তের মধ্যে নিজের পরিণাম চিন্তা করে নেয় সে। সামরিক বিচারে তার হবে চরম দণ্ড! আর সে দণ্ড নিতে হবে—যাদের সে আজীবন ঘৃণা করে এসেছে সেই বৃটিশের হাতে! অসম্ভব!

সমস্ত দস্যুদলটিকে ঘিরে মিলিটারী অফিসার নিয়ে চলেন পাহাড়ের ওপর দিয়ে। শিখা আর মীরাও চলে তাঁদের সঙ্গে।

হাঃ হাঃ হাঃ—

ভীষণ অট্টহাসির শব্দে সচকিত শিখা ও আর সবাই তাকিয়ে দেখলে, মংপো সেই পাহাড়ের পাশের দিকে যে ভীষণ খাদ ছিল সেই খাদে লাফিয়ে পড়লো।

—”সর্ব্বনাশ—”

শিখা আতঙ্কে চীৎকার করে ওঠে। এমন ভাবে আত্মপ্রাণ বিসর্জ্জন দিলে মংপো! এত উপর হতে ওই খাদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত অস্থি চুরমার হয়ে গেছে।

অফিসার দুঃখের সঙ্গে বললেন, ”লোকটাকে জীবন্ত বন্দী করে নিয়ে যেতে পারার কৃতিত্ব হতে বঞ্চিত হতে হল—মস্ত বড় ক্রেডিটটা হারালাম।”

কিন্তু মংপোকে ধরে নিয়ে যেতে না পারলেও মংপোর অনুচরদের সবাইকে নিয়ে গেল ওরা।

সৈন্যদের সদর ঘাঁটিতে পৌঁছে শিখা যখন তার কাকার পরিচয় দিয়ে আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলো, তখন কমান্ডিং অফিসার দুই চোখ আগুনের মত করে মংপোর অনুচরদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”গুলি করে মারো এই কুত্তাগুলোকে।”

তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে শিখার সঙ্গে করমর্দ্দন করে তিনি বললেন—”তোমার সাহস আর বুদ্ধি দেখে আমি খুবই খুশী হয়েছি মিস্ রায়। আমি গভর্ণমেন্টের কাছে লিখবো তোমার কথা, যাতে তাঁরা তোমাকে যথেষ্ট পুরস্কৃত করেন।”

বলা বাহুল্য, ঐ দিনই কমাণ্ডিং অফিসার শিখা আর মীরাকে একদল গোরা সৈন্যের পাহারায় চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন।

উনিশ. প্রত্যাবর্ত্তন

কয়েকদিন পরে শিখাদের প্লেনখানা চক্রাকারে ঘুরে যখন দমদম বিমান ঘাঁটিতে নামলো, তখন মীরা আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছে।

বিমানঘাঁটিতে এসেছেন, মীরার বাপ স্যর অশোক মিত্র,—দিল্লীতে থাকেন, ভারত গভর্ণমেন্টের একজন বড় অফিসার। এসেছেন মীরার মাতা কমলা দেবী আর বহু আত্মীয় বন্ধু।

প্লেন থেকে নামলো শিখা ও মীরা। শিখার জিনিসপত্র নিয়ে রতনও নামলো।

”মা—মাগো—”

মীরা ছুটে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।

স্যর অশোকের পায়ের ধুলা নেয় শিখা। আর্দ্রকণ্ঠে স্যর অশোক বললেন, ”তোমায় আশীর্ব্বাদ করছি শিখা, তুমি যে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে মীরাকে উদ্ধার করেছো সত্যিই তার তুলনা নেই।”

শিখার মুখখানা লাল হয়ে ওঠে।

বললে, ”কিন্তু এই রতনের সাহায্য না পেলে কিছুই হতো না কাকাবাবু। মংপো যখন আমাদের বন্দী করে রেখেছিল, তখন আমরা একেবারেই নিঃসহায়। সাহস করে রতন একটা রিভলভার না দিলে আমি ফায়ার করতে পারতাম না, ফলে সৈন্যরাও আসতো না।”

কমলা দেবী বললেন, ”সে জন্যে নিশ্চয়ই আমরা ওকে পুরস্কৃত করব শিখা। এই ছেলেটার জন্যই যে তোমরা উদ্ধারলাভ করেছ, খবরের কাগজে তা আমরা পড়েছি।”

শিখা বললে, ”হ্যাঁ, সে সব কথা সত্যি। ওখানকার পুলিস অফিসার আগে মীরার পরিচয় পাননি; পরে পরিচয় পেয়ে কি করে যে আমাদের উপকার করবেন তাই ঠিক করতে পারেন না। যাই হোক, আপনাদের মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে আমার ছুটি—আমার দায়িত্ব ফুরোলো।”

সহাস্যে স্যার অশোক বললেন, ”ও কথাটি বলো না শিখা, আমাদের সম্পর্ক আরও গভীরতর হল বলতে পারো। সামনের সপ্তাহেই আমি তোমাকে আর রতনকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করব। সেদিনে নিশ্চয়ই আসবে আশা করছি।”

তাঁরা বিদায় নেন।

রতনকে নিয়ে শিখাও মোটরে উঠে পড়ে।

—”তুমি আর কোথাও যাবে না রতন, আমার ছোট ভাইয়ের মত আমার কাছেই থাকবে। তোমার মা—বাপ ভাই—বোন সকলেই মুক্ত হয়েছে, নিরাপদ জায়গায় তারা আশ্রয় পেয়েছে। কাজেই তাদের জন্য তোমার আর ভাবনা নেই। তুমি এখন থেকে আমার কাছে থেকে আমাকে সাহায্য করবে—কেমন?”

রতনের দুটি চোখ সজল হয়ে ওঠে। কৃতজ্ঞতায় সে খানিকক্ষণ নির্ব্বাক হয়ে রইল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *