১১. কৃষ্ণার জয়যাত্রা

কৃষ্ণার জয়যাত্রা

এক. মিস রাবেয়া আদমজী

চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে খবরের কাগজের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই আশ্চর্য্য হয়ে যায় কৃষ্ণা। বেশ বড় হেড লাইনে ছাপা হয়েছে স্যর আদমজীর মৃত্যুসংবাদ।

খবরটি যে ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল তা এইরকম :-

কোটিপতি ব্যবসায়ীর রহস্যজনক মৃত্যু

লেকের ধারে একটি গাছে গলায় দড়ি অবস্থায় স্যর আদমজীর ঝুলন্ত মৃতদেহ। ভারতের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের অন্যতম স্যর আদমজীকে লেকের ধারের একটি গাছের ডালে গলায় দড়ি-বাঁধা অবস্থায় ঝুলিতে দেখা যায়। সংবাদে প্রকাশ যে, স্যর আদমজীকে আগের দিন গভীর রাত্রি পর্য্যন্ত তাঁহার বালিগঞ্জ প্লেসের নিজস্ব বাসভবনের একতলার অফিসকক্ষে কার্য্যরত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায়। কর্ম্মচারী ও বাড়ীর লোকজনদের নিকট জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিতে পারা যায় যে, কিছুদিন যাবত স্যর আদমজীর মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণ দেখা যাইতেছিল। তাঁহার স্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর হইতেই নাকি তাঁহারও মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটিতে থাকে।

খবরে আরও প্রকাশ যে, মৃত্যুকালে তাঁহার একমাত্র কন্যা মিস রাবেয়া পিতার নিকট ছিলেন না। তিনি বোম্বাই-এর একটি পার্শী হোস্টেলে থাকিয়া ওখানেই কলেজে পড়াশুনা করেন। স্যর আদমজীর একান্ত সচিব মিঃ রুস্তমজীর নিকট জানা গেল যে, মিস রাবেয়াকে এই দুঃসংবাদ জানাইয়া তার করা হইয়াছে।

সংবাদ পাইয়াই পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং যথারীতি তদন্ত করে। পুলিশের ধারণা, স্যর আদমজী আত্মহত্যা করিয়াছেন।

কৃষ্ণা আরও দেখলো, স্যর আদমজীর মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হয়েছে। সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়েছে :

”পুলিশ ঘটনাটাকে আত্মহত্যা বলিয়া উড়াইয়া দিতে চেষ্টা করিলেও আমরা সন্দেহ করি যে, ইহার পশ্চাতে কোন গভীর ষড়যন্ত্র লুক্কায়িত আছে। কারণ স্যর আদমজীর যদি আত্মহত্যা করাই ইচ্ছা ছিল, তাহা হইলে তিনি বালিগঞ্জ প্লেস হইতে গভীর রাত্রে দড়ি ইত্যাদি সঙ্গে লইয়া লেক পর্য্যন্ত যাইয়া গাছে চড়িয়া গলায় দড়ি লাগাইয়া আত্মহত্যা করিতে যাইবেন কেন? বালিগঞ্জ প্লেস হইতে লেক প্রায় এক মাইল পথ। এই দীর্ঘ পথ দড়ি হাতে লইয়া গভীর রাত্রে স্যর আদমজী আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়াছেন, ইহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। তাছাড়া মৃতদেহের পায়ে জুতা ছিল। জুতা পায়ে দিয়া গাছে ওঠাও সহজ বলিয়া মনে হয় না। আমরা জানি, তাঁহার নিজের রিভলভার ছিল। আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছা থাকিলে নিজের ঘরেই তিনি তাহা করিতে পারিতেন। রিভলভারের সাহায্য না লইয়াও আত্মহত্যা করা তাঁহার পক্ষে কঠিন ছিল না। বিষ পান করিয়াও তিনি উহা পারিতেন।

এইসব নানা কারণে আমাদের সন্দেহ হইতেছে যে, ঘটনাটি আত্মহত্যা নয়-ইহা হত্যা। তাই আশা করি, পুলিশ বিভাগ ঘটনাটাকে আত্মহত্যা বলিয়া ধামাচাপা দিবার চেষ্টা না করিয়া ইহার মূল অনুসন্ধান করিতে চেষ্টা করুন।

স্যর আদমজীকে আমরা অজাতশত্রু বলিয়াই জানিতাম। তাঁহার মত একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও শিল্পপতির মৃত্যুতে শিল্প জগতেরও বিশেষ ক্ষতি হইবে। আমরা তাঁহার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে, এবং বিশেষ করিয়া তাঁহার কন্যা মিস রাবেয়াকে আমাদের আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি।”

খবরটা পড়ে কৃষ্ণারও মনে হ’ল যে স্যর আদমজীর মৃত্যুটা হয়তো আত্মহত্যা নয়। খবরের কাগজ ঠিকই মন্তব্য করেছে। আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা থাকলে নিজের বাড়ীতেই তিনি….

হঠাৎ তার চিন্তায় বাধা পড়লো। বাইরের কলিং বেলের সুইচটা কে যেন টিপে ধরেছে। এলার্ম ঘড়ির মত তীব্র শব্দে বেজে চলেছে কলিং বেলটা।

কৃষ্ণা নিজেই উঠে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই সে আশ্চর্য্য হয়ে গেল। একটি সতের আঠার বৎসর বয়সের সুন্দরী পার্শী তরুণী আর একজন প্রৌঢ় পার্শী ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে।

মেয়েটিই প্রথমে কথা বললো। সে ইংরেজীতে জিজ্ঞাসা করলো, ”আমি কৃষ্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

কৃষ্ণা বললো, ”আসুন। আমারই নাম কৃষ্ণা।”

মেয়েটি তখন যুক্তকরে নমস্কার করে বললো, ”আমি….”

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কৃষ্ণা হেসে বললো, ”মিস রাবেয়া আদমজী আর আপনার সঙ্গী এই ভদ্রলোক মিঃ রুস্তমজী-কেমন ঠিক কি না?”

রাবেয়া আশ্চর্য্য হয়ে বললো, ”আপনি আমাদের চিনলেন কি করে! আমি তো….”

কৃষ্ণা বললো, ”সে কথা পরে হচ্ছে। আপনারা ভিতরে আসুন।”

মিস রাবেয়া আর মিঃ রুস্তমজী আসন গ্রহণ করলে কৃষ্ণা বললো, ”আপনারা একটু বসুন, আমি ভেতর থেকে আপনাদের চায়ের কথা বলে আসছি।”

রাবেয়া বাধা দিয়ে বললো, ”না, কৃষ্ণা দেবী। এখন আর চা খাওয়ার মত মনের অবস্থা নেই আমার। আপনি বসুন।”

কৃষ্ণা একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে রাবেয়ার সামনে বসে বললো, ”আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি মিস আদমজী। আমি আপনার জন্য দুঃখিত। কিন্তু খবরের কাগজে পড়লাম যে আপনি বোম্বাই-এ ছিলেন, আপনি কি….’

-হ্যাঁ কৃষ্ণা দেবী, আমি আজ সকালেই এসে পৌঁছেছি। বাড়ীতে এসেই মিঃ রুস্তমজীকে সঙ্গে নিয়ে আমি আপনার এখানে চলে এসেছি।

-আমার নাম আপনি কি ক’রে জানলেন মিস আদমজী?

-আপনার নাম কে না জানে? বোম্বাই থেকেই আপনার নাম আমি জানি। কয়েকটা জটিল কেসের তদন্তে আপনার কৃতিত্বের কথা খবরের কাগজে পড়েছিলাম আমি। তাই আমার ইচ্ছে যে, আপনার হাতেই এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের ভার দিই।

-ঘটনাটাকে আপনিও তাহলে হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করেন?

-সন্দেহ করি কি বলছেন কৃষ্ণা দেবী, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এটা হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়।

-আপনার এরকম বিশ্বাসের কারণ?

কৃষ্ণার এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন মিঃ রুস্তমজী।

তিনি বললেন, ”কারণ ব্যাখ্যা করতে বললে অবশ্য খুবই কঠিন হবে আমাদের পক্ষে। কারণ, সত্যি কথা বলতে কি, এটা যে হত্যাকাণ্ডই, এরকম কোন প্রমাণ দেখাতে আমরা পারবো না। তাছাড়া আপনাদের আইনের ভাষায় যাকে বলে ‘Reasons to believe’ বা বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ-তাও হয়তো আমরা দিতে পারবো না। তবে একটি কথা এই সম্পর্কে বললে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কিছুদিন আগে নওরোজী নামে একজন লোকের লেখা একখানা চিঠি আমার হাতে পড়ে। চিঠিখানা এসেছিল স্যর আদমজীর নামে; কিন্তু তিনি তখন কলকাতায় না থাকায় ব্যবসা-সংক্রান্ত চিঠি মনে ক’রে সেখানাকে আমি খুলে পড়ি। চিঠিখানা পড়ে, সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেবারে অবাক হয়ে যাই। নওরোজী মোটা টাকা দাবী ক’রে স্যর আদমজীকে ভয় দেখিয়েছে যে যদি টাকা না দেওয়া হয় তাহ’লে স্যর আদমজী যেন তার পরবর্ত্তী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকেন।”

কৃষ্ণা বললো, ”তারপর?”

-তারপর স্যর আদমজী এলেই আমি চিঠিখানা তাঁর হাতে দিই।

চিঠিখানা যে ব্যবসা-সংক্রান্ত চিঠি মনে করে খুলে ফেলেছিলাম আমি, সে কথাও বলি তাঁকে।

-চিঠিখানা পড়ে স্যর আদমজী কিছু বলেছিলেন কি?

-না। আমাকে তিনি কিছুই বলেননি। তবে আমি লক্ষ্য করি যে, চিঠিখানা পড়ে তাঁর মুখখানা যেন আঁধার হয়ে যায়।

-এই নওরোজী লোকটাকে আপনি চেনেন কি?

-না।

-আচ্ছা, পুলিশ ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বলে সন্দেহ করছে কেন বলতে পারেন?

-কেন করছে তা ঠিক বলতে পারি না, তবে মনে হয় যে, স্যর আদমজীর মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণের কথা শুনেই বোধ হয় ঐ রকম অনুমান করেছে তারা। ওঁর স্ত্রীর সন্দেহজনক মৃত্যুর পর থেকেই আমরা ওঁর মানসিক অবস্থার অবনতি লক্ষ্য করি।

-সন্দেহজনক মৃত্যু বলছেন কেন?

-বলছি তার কারণ, যে-রাত্রে তাঁর মৃত্যু হয় সেদিন সন্ধ্যার সময়ও আমি তাঁকে সুস্থ অবস্থায় দেখি। হঠাৎ গভীর রাত্রে শুনলাম তিনি মারা গেছেন। ডাক্তার ডাকবার সময় পর্য্যন্ত পাওয়া যায়নি।

এই পর্য্যন্ত শুনে কৃষ্ণা মিস আদমজীর দিকে তাকিয়ে বললো, ”আমাকে তাহলে কি করতে বলছেন?”

রাবেয়া বললো, ”আপনি দয়া ক’রে এই কেসের ভার নিন। আমার বাবার হত্যাকারীকে আমি বিচারালয়ে হাজির করতে চাই। কিন্তু পুলিশের দ্বারা তা সম্ভব হবে ব’লে মনে হয় না। এর জন্য যে পারিশ্রমিক আপনি চাইবেন, আমি দিতে রাজী আছি কৃষ্ণা দেবী।”

কৃষ্ণা হেসে বললো, ”পারিশ্রমিকের লোভে আমি এ-কেস হাতে নিচ্ছি এরকম মনে করবেন না মিস আদমজী। আমারও আপনার মত সন্দেহ হচ্ছে যে, স্যর আদমজীর মৃত্যুর পেছনে গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। আপনার কেস আমি সেইজন্যই হাতে নিচ্ছি। আপনারা এখন যান, আমি পুলিশ মর্গ থেকে মৃতদেহটা দেখে এবং সম্ভব হলে ডাক্তারের মতামতটাও জেনে নিয়ে আপনার ওখানে যাচ্ছি। আজ থেকেই আমি কাজ আরম্ভ করতে চাই।”

কৃষ্ণার কথায় আশ্বস্ত হয়ে রাবেয়া আর রুস্তমজী চলে গেলেন।

দুই. আত্মহত্যা না ঘুম?

তদন্ত ক’রে ফিরে আসে কৃষ্ণা। বাড়ীতে আসতেই দেখে পুলিশ ইনসপেক্টর ব্যোমকেশবাবু বসে আছেন।

বেলাও যথেষ্ট হয়ে গেছে-সকাল বেলায় চা ও দুখানা টোষ্ট রুটি মাত্র খেয়ে কৃষ্ণা বার হয়েছিল। স্যর আদমজীর বিরাট বাড়ী খুঁজে পেতে তাকে কষ্ট করতে হয়নি। প্রায় আড়াই তিন ঘণ্টা কৃষ্ণার সে-বাড়ীতে কেটে গেছে। রাবেয়া তাকে চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। ধন্যবাদ জানিয়ে কৃষ্ণা প্রত্যাখ্যান করেছে। এনকোয়ারী শেষে ফেরবার সময় রুস্তমজী তাদের মোটরে আসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণা সে-অনুরোধ রাখতে পারেনি। সে জানিয়েছে, তার বান্ধবীর বাড়ী কাছেই, বিশেষ দরকারে তার বাড়ীতে সে একবার যাবে।

অথচ সে কারও বাড়ীতেই যায়নি, সোজা বাসে উঠে চলে এসেছে নিজের বাড়ীতেই।

গম্ভীর মুখে ব্যোমকেশ সেদিনকার সংবাদপত্রখানা পড়ছিলেন। কৃষ্ণা প্রবেশ করলেও তিনি মুখ তুললেন না।

”একি, কাকাবাবু যে, আপনি কখন এলেন”-বলতে বলতে কৃষ্ণা একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো।

ব্যোমকেশ কাগজখানা ভাঁজ করতে করতে গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন, ”এসেছি অনেকক্ষণ, তা প্রায় আড়াই ঘণ্টার উপরই হবে। তুমি যে সকাল বেলায় বার হয়ে গেছো, তা তো জানতাম না।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, ”কেন কাকাবাবু, কোন দরকার আছে কি আমার কাছে?”

ব্যোমকেশ বললেন, ”দরকার আছে বৈকি! তোমরা মনে কর কেবল তোমরাই দরকারের বোঝা বয়ে মর, আমাদের কোন দরকার থাকতে পারে না। এটা যে কত বড় ভুল আর কত বড়……..”

কৃষ্ণা বাধা দিয়ে একটু হেসে বললে, ”পরম শত্রুতেও ওকথা বলতে পারবে না কাকাবাবু-দরকার আমার যেমন আছে, আপনারও তেমনি আছে বৈকি! বলুন কি দরকার, আমি নিশ্চয়ই শুনব আর সাধ্যমত যা কাজ করবার তা করব।”

ব্যোমকেশ বললেন, ”আজকের কাগজটা পড়েছো? দেখেছো, কালকের খুনের কেসটা সম্বন্ধে আমাদের কি রকম গালাগালি করেছে?”

-কালকের খুনের কেস?

কৃষ্ণা তাঁর পানে তাকায়।

বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে ব্যোমকেশ বললেন, ”একেবারে আকাশ হ’তে পড়লে যে কৃষ্ণা! তোমার তো সবই জানা উচিত। কালই তো স্যর আদমজীর মেয়ে এসে তোমায় কেসের ভার দিয়ে গেছেন, সঙ্গে সঙ্গে হাজার দশেক টাকা….”

”আপনি কি বলছেন কাকাবাবু-” কৃষ্ণা জ্বলে ওঠে-”হাজার দশেক টাকা দিয়েছেন বলতে চান? হ্যাঁ, শুনেছি তাঁরা দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, যে স্যর আদমজীর হত্যাকারীকে ধরে দিতে পারবে সেই এই পুরস্কার পাবে। আমি কেন, আপনি চেষ্টা করুন, আপনার সহকারী যারা তারা চেষ্টা করুক, হত্যাকারীকে ধরে দিয়ে দশ হাজার টাকা নিন, আমি তাতে একটি কথাও বলবো না।”

নিমেষে ব্যোমকেশবাবু জল হয়ে যান। শান্তকণ্ঠে বললেন, ”না না, আমি সে কথা তোমায় বলছিনে কৃষ্ণা। আমি বলতে চাচ্ছি-হত্যা মোটেই হয়নি। একে বরং আত্মহত্যা বলতে পারো।”

কৃষ্ণা বললো, ”আত্মহত্যা কি ক’রে হবে? যতদূর জানা যায় তাতে হত্যাই মনে হচ্ছে।”

ব্যোমকেশ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ”মোটেই নয়। করোনারের তদন্তেই শুধু নয়, স্যর আদমজীর কর্ম্মচারীরা পর্য্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছে, কিছুদিন ধরে তাঁর মস্তিষ্ক-বিকৃতি লক্ষ্য করেছে তারা। মাঝে মাঝে উদভ্রান্ত হয়ে হেঁটে চলতেন পথ দিয়ে, নিজের মনে আবোল তাবোল বকে যেতেন। এইরকম অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় গভীর রাত্রে সকলের অজ্ঞাতসারে বার হয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় আত্মহত্যা করাটা কিছু কি আশ্চর্য্য, কৃষ্ণা?”

কৃষ্ণা বললে, ”যারা এসব কথা বলেছে, তারা মিথ্যা কথা বলেছে কাকাবাবু। আমি এইমাত্র স্যর আদমজীর বাড়ী হ’তে ফিরছি। সেখানে যা জেনেছি তাতে মনে হয় তো, স্যর আদমজীকে নিঃসন্দেহে অচৈতন্যাবস্থায় ঘর হতে বার ক’রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁকে দিয়ে কোন কিছু করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এর জন্য নিশ্চয়ই তাঁকে বহু নিৰ্য্যাতনও সইতে হয়েছে এবং শেষকালে তাঁকে মৃত্যু পর্য্যন্ত বরণ করতে হয়েছে।

তাঁর আততায়ীরা তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা প্রমাণ করবার জন্যই তাঁর গলায় দড়ি বেঁধে লেকের বাইরে নির্জ্জন জায়গায় একটা গাছে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে।”

ব্যোমকেশ চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে বসে একটা মোটা সিগার ধরালেন, বললেন,”কিন্তু পুলিশ তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে এই ব্যাপারটা আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। তুমি তদন্তের ভার নিয়েছো শুনে আমি খুশী হতে পারলাম না কৃষ্ণা, কারণ গভর্ণমেণ্টের তরফ থেকে আমায় এ কাজের ভার নিতে হয়েছে। তোমার আমার সঙ্গে যে সম্পর্ক তাতে এ রকম বিপক্ষ মনোভাব কি ভালো?”

কৃষ্ণা হেসে বললে, ”বেশ তো, তাই হোক না কাকাবাবু, মোটের উপর ব্যক্তিগতভাবে আমরা সেই কাকা-ভাইঝিই থাকবো। কার্য্যক্ষেত্রে বিরুদ্ধাচরণ করতে হলেও সম্পর্কটা তো ঘুচবে না। এই যে রাজনীতি ক্ষেত্রেই বলুন, ধর্ম্মনীতি ক্ষেত্রেই বলুন, প্রত্যেক ক্ষেত্রে পিতা পুত্র, স্বামী স্ত্রী, ভাই বোন, প্রত্যেকেরই আলাদা মত আর তা প্রকাশ করবার সমানাধিকার আছে। তবু তারা বাড়ীতে অভিন্ন। আমাদের কর্ম্মক্ষেত্রে যদিও সে রকম কোনদিন হয়নি, তবু আজ যদি হয় তাতে আমাদের স্নেহের যোগসূত্র তো ছিঁড়বে না কাকাবাবু।” এক মুহূর্ত্ত কি ভেবে নিয়ে কৃষ্ণা বললে, ”তাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা সম্ভব, তারপর গাছে ঝুলিয়ে দেওয়াও বিচিত্র নয়।”

ব্যোমকেশের মুখ থেকে এই একটি মাত্র শব্দই শোনা যায়-”হুম।”

কৃষ্ণা হাত বাড়িয়ে কাগজখানা তুলে নেয়। ভাঁজ খুলতে খুলতে বলে, ”তবু যখন দরকার পড়বে আমি আপনাকেই চাইব কাকাবাবু। আশা করছি বরাবরকার মত সাহায্য পেতে বঞ্চিত হব না।”

ব্যোমকেশ একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। বললেন, ”অবশ্য যতখানি পারব করব বই কি। আজকের তদন্তে তুমি কতদূর কি জানলে সেটা যদি একটু বলতে কৃষ্ণা তাহলে…”

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ”এখনও তদন্তের বিশেষ কিছুই হয়নি কাকাবাবু, মামা না ফেরা পর্য্যন্ত আমাকে চুপচাপ করেই থাকতে হবে।”

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ”প্রণবেশবাবু কোথায় গেছেন,-সেদিনও তো তাঁকে এখানে দেখেছিলাম।”

বিরক্তির সুরে কৃষ্ণা বললে, ”আর বলেন কেন, এই এক বুড়ো খোকাকে নিয়ে সামলাতে সামলাতে আমার জীবন গেল। পরশু দিন কোথা থেকে একটা সাইকেল যোগাড় করে তাতে চড়বার চেষ্টা করছিলেন। না হোক পঞ্চাশবার বারণ করে বাইরে গেছি, দু’টি ঘণ্টাও যায়নি, ফিরে এসে দেখি সর্ব্বনাশ ব্যাপার! মামাবাবু সাইকেল উল্টে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছেন। তখনই ডাক্তার ডাকি। ডাক্তারের পরামর্শমত তাঁকে তখনই পাঠাতে হয় মেডিকেল কলেজে। দিব্য আরামে একটি কেবিনে হাতে পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে শুয়ে আছেন আর কি। কতদিনে যে ভাল হবেন-কবে বাড়ী আসবেন ভগবান জানেন!”

দুঃখিত কণ্ঠে ব্যোমকেশ বললেন, ”তাই নাকি-বেচারা প্রণবেশ; আমি সমরকে একবার জানাব, হাজার হোক ওরা দুজন অকৃত্রিম বন্ধু তো-শুনেই ছুটে দেখা করতে আসবে, আমিও দেখি, আজ যদি সময় পাই একবার যাব এখন।”

একটা হাই তুলে আড়ামোড়া ছেড়ে তিনি বললেন, ”অনেক বেলা হল,-তোমারও এখন স্নানাহার হয়নি, তুমি যাও-আমিও উঠি।”

তিনি উঠবার উদ্যোগ করেন।

কৃষ্ণা বললে, ”একটু চা খেয়ে গেলে হতো না কাকাবাবু!”

ব্যোমকেশ বললেন, ”না, না, এই দুপুর বেলা আর এই গরমে চা না খাওয়াই ভালো। বরং প্রণবেশ বাড়ী ফিরলে একদিন সন্ধ্যের দিকে এসে চা খাওয়া যাবে এখন।”

তিনি অগ্রসর হন। কৃষ্ণা তাঁকে সদর পর্য্যন্ত এগিয়ে দেয়।

তিন. অদৃশ্য শত্রুর হানা

সন্ধ্যার পরে কৃষ্ণা একটু বিশ্রাম করবার আশায় খাটে উঠেছে, হঠাৎ টেলিফোন বেজে ওঠে। ফোন ধরে কৃষ্ণা বলে, ”হ্যালো! কে? যমুনাবাই? না, আপনাকে আমি তো দেখিনি। কি বলছেন-মিস আদমজী খুব ভয় পেয়েছেন,-আমায় ডাকছেন জ্ঞান ফেরার পরে? হ্যাঁ, বলুন, আমি যাচ্ছি-”

বনমালীকে দিয়ে একখানা ট্যাক্সি ডাকিয়ে এনে সেই ট্যাক্সিতেই বালিগঞ্জ প্লেসের দিকে চলতে লাগলো কৃষ্ণা।

স্যর আদমজীর বাড়ীর গেটের নেপালী দ্বারোয়ান কৃষ্ণাকে চিনে রেখেছিল। মিলিটারী কায়দায় স্যালিউট দিয়ে সরে দাঁড়ালো।

ভিতরে প্রবেশ করতেই কৃষ্ণা দেখলো একটি সুন্দরী তরুণী দাঁড়িয়ে আছে আগ্রহাকুল দৃষ্টি নিয়ে।

কৃষ্ণাকে দেখে সে এগিয়ে এসে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে বললো, ”নমস্কার কৃষ্ণাদেবী, আমি আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি।”

প্রতি-নমস্কার জানিয়ে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”আপনার নামই বোধ হয় যমুনাবাই! আমাকে একটু আগে ফোন করেছিলেন আপনিই তো?”

অত্যন্ত বিনীতভাবে সে উত্তর দিলে, ”হ্যাঁ, সেই থেকেই আমি এখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। আসুন, মিস আদমজী আপনার জন্যে অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছেন।”

-চলুন।

যমুনাবাইয়ের পেছনে চলতে চলতে কৃষ্ণা বললে, ”মিস আদমজী হঠাৎ এরকম ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন কেন, কিছু জানেন?”

যমুনাবাই বললে, ”না। হঠাৎ তাঁর একটা ভয়ার্ত্ত চীৎকার শুনে আমি পাশের ঘর থেকে ছুটে এসে দেখলাম তিনি মূর্চ্ছিত হয়ে পড়েছেন। আমি তখনই মুখে-চোখে জল-বাতাস দিতে তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। তাঁর কাছে লোক রেখে আপনাকে ফোন ক’রে আমি তখন হতে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছি আপনার প্রতীক্ষায়। আপনি নিজে তাঁকে জিজ্ঞাসা ক’রে জানতে পারবেন কি হয়েছে।”

কৃষ্ণা একবার হাতঘড়ির পানে তাকিয়ে দেখলে-রাত প্রায় নয়টা বাজে।

বারান্দা পার হয়ে সে যে সুসজ্জিত ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো, সেইটেই মিস রাবেয়ার শয়নকক্ষ। যমুনাবাই পরদা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ ক’রে রাবেয়াকে জানালো, ”কৃষ্ণা দেবী এসেছেন।”

পালঙ্কের উপর শয়ন করেছিলো রাবেয়া, কৃষ্ণা ঘরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলো, অভিবাদন করে বললে, ”বসুন কৃষ্ণা দেবী, বিশেষ দরকারেই আপনাকে এই রাত্রে ডাকতে হয়েছে, এর জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি।”

কৃষ্ণা একখানা চেয়ারে বসে স্মিতহাস্যে বললে, ”তাতে আমার কোন অসুবিধা হয়নি মিস আদমজী। এর চেয়ে কত রাত্রেও আমায় একা বার হতে হয়েছে, তার তুলনায় এখন ত সন্ধ্যা। হঠাৎ কি হল আপনার? শুনলাম ভীষণ ভয় পেয়েছেন, অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন,-”

রাবেয়া বললে, ”সব বলছি কৃষ্ণা দেবী। আপনার কিছু ভাবতে হবে না, যখন বাড়ী ফিরবেন, আমার গাড়ী আপনাকে নিয়ে যাবে।” যমুনাবাই ও দাসীকে ঘর থেকে চলে যেতে আদেশ দিয়ে চাপা সুরে রাবেয়া বললে, ”আপনাকে বিশ্বাস করে আমি সব কথা বলতে পারি কৃষ্ণা দেবী, কিন্তু যারা সর্ব্বদা আমার কাছে আছে, আমি তাদের মোটেই বিশ্বাস করতে পারি না।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”যমুনাবাই আপনার কে হন জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?”

রাবেয়া উত্তর দেয়, ”কেউ নয়, এই মেয়েটি আমার বাবার কাছে টাইপিষ্টের কাজ করতো। অথচ কি ক’রে আমার বাবার কাছে এসে জুটলো তা আমি জানিনে। আমি তো এখানে থাকি না, মাঝে মাঝে দু-পাঁচদিনের জন্যে এলেও সে সময়টা আমি হাসি-গল্পের মধ্যেই কাটিয়ে গিয়েছি। লোকজন কাউকে চিনি না, সাংসারিক ব্যাপারও কিছুই আমার জানা নেই।”

কৃষ্ণা বললে, ”তা আমি আপনাকে দেখেই বুঝেছি মিস রাবেয়া, বাংলাদেশ এমন কি কলকাতাও আপনার অপরিচিত। আপনি এখানকার কিছুই চেনেন না-জানেন না। কিন্তু ও-সবের কথা এখন থাক। আগে আমি কি জন্যে এখানে এসেছি, সেই কথাটা শুনি। কি হয়েছিল আপনার, ভয় পেয়ে চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছিলেন কেন, তাই বলুন দেখি।”

রাবেয়া মুহূর্ত্ত নীরব থাকে, তারপর বললে, ”সেই কথা বলবার জন্যেই আপনাকে ডাকবার কথা বলেছি কৃষ্ণা দেবী, আমার মনে হয়নি রাত এত বেশী হয়েছে। যাই হোক, বলছি শুনুন। প্রথম কথা বলছি আমার বাবা, স্যর আদমজীকে হত্যা করা হয়েছে তাতে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি আজই বাবার ড্রয়ারের গোপন একটা জায়গায় কতকগুলো কাগজপত্র, মূল্যবান দলিল ইত্যাদি পেয়েছি। আমি জানি, সেদিন আমি যখন আপনার বাড়ীতে গিয়েছিলাম, সেই অবকাশ পেয়ে দুর্ব্বৃত্তেরা আমাদের আলমারী, ড্রয়ার সব আতিপাতি করেছে সেই কাগজপত্রের সন্ধানে, কিন্তু সেগুলো এমন জায়গায় ছিল যা তারা পায়নি।”

একটা সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সে।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”যখন তারা এ সব খুঁজেছে, এ বাড়ীতে তখন আর কি কেউ ছিল না?”

রাবেয়া উত্তর দিল, ”বাবার এ মহলটায় তাঁর বিনানুমতিতে কারও আসবার যো ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর আমি স্বহস্তে সব দেখা-শোনা করেছি, নিজে সমস্ত পরিষ্কার করেছি। ওদিককার ঘরগুলোতে থাকে যমুনাবাই, আমাদের অন্য আত্মীয় দু-একজন, একজন আমার বৃদ্ধা পিসিমা আর একজন তাঁর ছেলে-ছেলেটি চির রুগ্ন। বাইরের দিকে থাকেন কয়েকজন,-রুস্তমজী তাঁদের মধ্যে একজন। আমি যখন রুস্তমজীকে নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলাম, এসব দরজা নিজের হাতে বন্ধ ক’রে দ্বারোয়ানকে দৃষ্টি রাখতে বলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখতে পাই, কেউ বা কারা ঘরের তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে সব কিছু আতিপাতি ক’রে খুঁজে গেছে। পায়নি কিছুই কারণ বাবার যা সব গোপনীয় দলিলপত্র-তা যেখানে থাকে, আমি ছাড়া আর কেউই তা জানে না।”

দীর্ঘ বর্ণনায় অধৈর্য্য হয়ে ওঠে কৃষ্ণা, বললে, ”কিন্তু এর মধ্যে আপনার ভয় পাওয়ার কারণটা যে কি সে কথাটা বললে হতো না?”

শুষ্ক হাসি হেসে রাবেয়া বললে, ”সেই কথাই বলছি কৃষ্ণা দেবী, বাবার যে দলিলপত্রাদির জন্যে আজ তাঁকে জীবন হারাতে হল, সন্ধ্যার সময় সেইগুলো আমি এই ঘরে ওই চেয়ারে বসে দেখছিলাম, এমন সময় ওই জানালার কাছে দেখলাম দৈত্যের মত একটা লোককে। হ্যাঁ, তাকে দেখেই আমি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠি। আমি স্বচক্ষে দেখেছি, তার চোখ দুটো ভাঁটার মত জ্বলছে।”

রাবেয়া থেমে যায়, আতঙ্কে তার মুখ দিয়ে আর কথা বার হয় না।

কৃষ্ণা বললে, ”সেই দলিলপত্রগুলো আমি একবার দেখতে পারি কি,-সে সব আছে তো আপনার কাছে?”

-এই যে আমার কাজেই রয়েছে।

রাবেয়া নিজের বস্ত্রের অন্তরালে বুকের ভেতর হতে লম্বা এনভেলাপখানা বার করে কৃষ্ণার হাতে দিলে, বললে, ”আপনি এখানা নিয়ে যান কৃষ্ণা দেবী, আর অন্য যা কিছু আছে আমি পরে আপনাকে দিয়ে আসব-কিন্তু-”

অকস্মাৎ আলোটা দপ দপ করে নিবে গেল। কেবল এ ঘরেই নয়, সমস্ত বাড়ীর আলো নিবে যাওয়ায় বোঝা গেল মেন খারাপ হয়ে গেছে। ওদিককার ঘর হতে রাবেয়ার পিসিমার আর্ত্ত চীৎকার শোনা গেল, তাঁর পুত্র দাদাভাইয়ের হাঁকডাক শোনা যায়-”ইব্রাহিম। রহিম! রামসিং!”

অন্ধকারেই রাবেয়ার আর্ত্ত চীৎকার শোনা গেল। কৃষ্ণা সভয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শত্রু অন্ধকারেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার গলাটা দুই হাতে টিপে ধরলো। কৃষ্ণা রিভলভার বের করবার চেষ্টা করে, কিন্তু আততায়ী তাকে যেভাবে জাপটে ধরেছিল, তাতে সে হাত নাড়তে পারে না। এই সময় হঠাৎ তার মাথায় কে যেন সজোরে আঘাত করে।

কোন ভারী জিনিসের আঘাত বলে মনে হয় কৃষ্ণার। তারপরেই সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

চার. যমুনাবাই

সে রাত্রে কি যে ব্যাপার ঘটে গেল কৃষ্ণা তা এখনও বুঝতে পারে না। তার বেশ মনে পড়ে, রাবেয়া তার হাতে কতকগুলো কাগজপত্র দিয়েছিল। তবে কি ঐ অভিশপ্ত কাগজপত্রগুলোর জন্যই আদমজী খুন হয়েছেন? সেগুলো দেখবার অবকাশও তার হয়নি। সেই মুহূর্ত্তে সমস্ত বাড়ীর আলো নিবে যায়। দুপ দাপ করে কয়েকজন লোক ঘরে প্রবেশ করে! রাবেয়ার আর্ত্ত চীৎকারও তার কানে আসে।

কৃষ্ণার শরীর তখনও খুব দুর্ব্বল। কিন্তু এই দুর্ব্বল অবস্থায়ই সে মনে করে যে, এখনই একবার রাবেয়ার কাছে যাওয়া দরকার। এই মনে ক’রে স্যর আদমজীর বাড়ীতে যাবার জন্য যখন সে প্রস্তুত হচ্ছিল, এমনই সময় হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পড়লেন রুস্তমজী।

বিবর্ণ মলিন তাঁর মুখ, মনে হচ্ছে তাঁর উপর দিয়ে ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে।

কৃষ্ণা বললো, ”বসুন মিঃ রুস্তমজী, আমি এখনই আপনাদের ওখানে যাচ্ছিলাম! সে রাত্রে আমাকে যে কারা নিয়ে গিয়ে পথের ধারে ফেলে রাখলে, মিস আদমজীর কি হল, কোন খবরই আমি পাই নি। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা ঘটেছে।”

রুস্তমজী একখানা চেয়ারে বসে হাঁফাচ্ছিলেন, শুষ্ককণ্ঠে বললেন, ”সর্ব্বনাশ হয়ে গেছে কৃষ্ণা দেবী, মিস আদমজী মানে রাবেয়াকে সেই রাত থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্দ্দান্ত শত্রুরা তাকে অপহরণ করেছে।”

”অপহরণ করেছে। বলেন কি!”-কৃষ্ণা গম্ভীর হয়ে যায়। মুহূর্ত্ত নীরব থেকে সে আবার বলে, ”কি ব্যাপার বলুন তো?”

রুস্তমজী রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ”আমি এখানে ছিলাম না, থাকলে হয়তো এরকম ঘটনা ঘটতো না। কয়দিন আগে বোম্বাই অফিস থেকে আমাদের ম্যানেজারের একখানা জরুরী টেলিগ্রাম আসে। টেলিগ্রামে তিনি জানিয়েছিলেন আমাদের বোম্বাই অফিসে ভীষণ গোলযোগ বেধেছে। তার পাওয়া মাত্র আমি যেন ওখানে যাই। আমি তাই রাবেয়াকে সাবধানে থাকবার উপদেশ দিয়ে আমাদের কোম্পানীর প্লেনে বোম্বাই চলে যাই।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”ওখানে গিয়ে গোলমাল দেখেছিলেন কি?”

রুস্তমজী উত্তর দিলেন, ”ভীষণ রকম! স্যর আদমজীর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই নওরোজী এসে তাঁর পুত্র-পরিচয়ে সবকিছুর মালিকানা সত্ত্ব দাবী করছে। অথচ এ-লোকটির সঙ্গে স্যর আদমজীর কোনদিন কোন সম্পর্কই ছিল না। আমরা শুধু নই, মিস আদমজী পর্য্যন্ত এ কথা জানতেন না। নওরোজীর সেই চিঠির কথা আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম। বোম্বাই গিয়ে খবর পেলাম যে, ঐ লোকটাকে তিনি নাকি দু’তিন দফায় বেশ মোটা রকম টাকা পাঠিয়েছিলেন। বোম্বাইয়ের ম্যানেজারের কাছে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। এই লোকটা কে, আর কেনই বা তাকে টাকা পাঠানো হয় সে কথা তিনিও সাহস ক’রে স্যর আদমজীকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন নি। কেননা তিনি মনিব আর আমরা তাঁর চাকর ছাড়া কেউ নই।”

কৃষ্ণা বললে, ”বুঝেছি, কিন্তু আপনি যাওয়ার পর কি হল, আমাকে সে কথাগুলো বলুন। নওরোজীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল কি?”

রুস্তমজী বললে, ”হ্যাঁ হয়েছিল। নওরোজীকে আমি স্পষ্টই জানালাম, সে যে স্যর আদমজীর পুত্র, সে প্রমাণ দাখিল করতে না পারলে তার মুখের কথায় আমরা কিছুই করতে পারবো না। এর পর আমাকে শাসিয়ে সে চলে যায়, আর এই কয়দিনের মধ্যে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।”

কৃষ্ণা বললো, ”আপনি কবে এখানে এসেছেন?”

রুস্তমজী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, ”আমি পরশুদিন মাত্র এসেছি। এসে আমাদের টাইপিষ্ট যমুনাবাই-এর কাছে শুনলাম, এখানকার এই ক্যালামিটির কথা। আমি হসপিটালে আপনার খোঁজ নিতে গিয়ে ফিরে এসেছি, আমায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। কাল রাত্রে খোঁজ পেলাম, আপনি বাড়ী এসেছেন, তাই আজ সকাল হতেই আমি চলে এসেছি।”

কৃষ্ণা রুস্তমজীর মুখের পানে তাকিয়ে বললো, ”আপনাদের এ কেস পুলিশের হাতে গেছে মিঃ রুস্তমজী। বালিগঞ্জের মত জায়গা-স্যর আদমজীর প্রহরী-রক্ষিত বাড়ীতে অজ্ঞাতশত্রু ঢুকে মেন ফিউজ ক’রে দিল, তার একমাত্র কন্যা অপহৃত হল! এ যে একেবারেই আশ্চর্য্য ব্যাপার! তাছাড়া আমার উপর আক্রমণটাও পূর্ব্ব-পরিকল্পিত বলেই মনে হয়। আমার আশ্চর্য্য লাগছে যে, আপনি টেলিগ্রাম পেয়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ীখানা যেন শত্রুদলের দখলে এসে গিয়েছিল। যাই হোক, আমার শরীর এখনও খুব দুর্ব্বল। দু-চার দিন বিশ্রাম না নিয়ে আমি কিছুই করতে পারবো না।”

রুস্তমজী ব্যাকুলকণ্ঠে বললেন, ”জানি আপনার বিশ্রাম করা প্রয়োজন কৃষ্ণা দেবী, কিন্তু একটা দুর্ভাগিনী মেয়ে যার পিতা আত্মহত্যা করেছেন, যার বিরাট সম্পত্তি থাকতে যে সব হারাতে বসেছে, এমন কি যার জীবন পর্য্যন্ত বিপন্ন-”

বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, মুহূর্ত্তে সে-দুর্ব্বলতা পরিহার করে রুস্তমজী বললেন, ”পুলিশ যে কিছুই করতে পারবে না, তা আমি জানি কৃষ্ণা দেবী। আমি জানি, এ ব্যাপারটা হয়তো এমনই ভাবে ধামাচাপা পড়ে যাবে, পাপিষ্ঠ নওরোজী যেমন ক’রেই হোক সম্পত্তি দখল করবে আর দুর্ভাগিনী ওই মেয়েটি নিঃসহায়া ভিখারিণীর মতই-”

অসহিষ্ণু কৃষ্ণা বাধা দেয়, ”থামুন মিঃ রুস্তমজী! আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে, মিস আদমজীকে আমি খুঁজে বার করবই। আজ আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে দিন। হ্যাঁ, একটা কথা আপনাদের যমুনাবাইয়ের সম্বন্ধে আমি কিছু জানতে চাচ্ছি। ইনি কতদিন এখানে কাজ করছিলেন জানেন?”

রুস্তমজী উত্তর দিলেন, ”প্রায় বছর দুই-তিন হবে! স্যর আদমজী এঁকে সিন্ধুপ্রদেশ হতে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। শুনেছিলাম যমুনাবাই একবার একটা বড় বিপদ থেকে তাঁকে বাঁচিয়েছেন, সেই উপকারের প্রত্যুপকারের জন্যই এই সর্ব্বহারা দুঃস্থা মেয়েটিকে তিনি আশ্রয় দেন। আশ্রয়ই শুধু নয়, নিজের কাছে চাকরীও দিয়েছিলেন।”

কৃষ্ণা চিন্তিত মুখে বললে, ”একজন অজ্ঞাতকুলশীলা যুবতী মেয়েকে তিনি তাঁর সংসারে পর্য্যন্ত অনেকখানি স্থান দিয়েছিলেন, কথাটা যেন কি রকম মনে হয়। এই যে কয়বছর যমুনাবাই আপনাদের এখানে আছে এর মধ্যে তাঁর কোন আত্মীয় বা বন্ধু কেউ এসেছিলেন কি?”

রুস্তমজী মাথা নাড়েন, বললেন, ”সে সব আমি খোঁজ রাখিনি কৃষ্ণা দেবী। যমুনাবাইকে আলাদা কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে, একমাত্র অফিসসংক্রান্ত কাজ ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার বা আদমজীর কোন সম্পর্কই নেই। আরো স্পষ্ট করে বলছি, তাঁর ওপর কারুরই কোন দুর্ব্বলতা ছিল না।”

এই বলেই রুস্তমজী বিদায় নিয়ে চলে যান ওখান থেকে।

পাঁচ. অভিযান আরম্ভ

এরোড্রোমে ব্যোমকেশকে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যায় কৃষ্ণা।-”একি, কাকাবাবু, চলেছেন কোথায়?”

ব্যোমকেশ গম্ভীরভাবে বললেন, ”আমাদের গতিবিধির কি সীমা আছে মা! পুলিশের চাকরী করি। যেখানে যখন যেতে হুকুম হবে, হাজার কাজ ফেলে রেখে সেখানে ছুটতে হবে। কিন্তু সে কথা যাক, এখন কোথায় যাচ্ছ বলো তো? হঠাৎ মিঃ রুস্তমজীর সঙ্গে তোমাকেই বা এখানে দেখছি কেন?”

কৃষ্ণা বললো, ”আমি যাচ্ছি বোম্বাই। বিশেষ একটা কাজেই আমাকে যেতে হচ্ছে ওখানে। দুই-তিন দিনের মধ্যেই ফিরবো। কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন বললেন না তো?”

ব্যোমকেশ বললেন, ”আমি পুণায় যাচ্ছি। সেখানে একটা বিশেষ দরকার পড়েছে।”

একটু থেমে ব্যোমকেশও আবার বললেন, ”আর পারি না মা। এই টানা-পোড়েন আর সহ্য হচ্ছে না। মনে করছি এবার ছুটি নেব, আর কাজ করব না।”

হাসি চেপে কৃষ্ণা বললো, ”সে কি কাকাবাবু! আপনার এখন উন্নতির সময়, এ সময় ছুটির কথা? শুনছি এবার আপনার প্রমোশন হবে, সে কথা নিশ্চয়ই গুজব নয়।”

একটা নিঃশ্বাস ফেলে ব্যোমকেশ বললেন, ”আগে এই কেসটার সুরাহা করব তবে তো। কিছুদিন আগে একটা ব্যাঙ্ক লুঠ হয়ে গেছে, জানো তো, তার তদন্তের ভার পড়েছে আমার ওপর। এখানকার তদন্তে যা খবর পেলুম তাতে জেনেছি এদের এই দলের নেতা একজন পার্শী। নাম তার জানতে পারিনি তবে একখানা ফটো সংগ্রহ করেছি।”

”ফটো!” রুস্তমজী যেন চমকে ওঠেন-”আপনার কাছে সে ফটো আছে মিঃ ইনস্পেক্টর? আমি একটু দেখতে পারি?”

ব্যোমকেশ বললেন, ”নিশ্চয়ই, হয়তো আপনি তাকে চিনলেও চিনতে পারবেন।”

মাস খানেকের মধ্যে ব্যাঙ্ক লুঠ হয়ে গেছে সংবাদটা আর সকলের মত কৃষ্ণাও জানে। হংকং ব্যাঙ্কে সেদিন দুপুরে যখন পুরাদমে কাজ চলছিল, সেই সময় কয়েকজন লোক টাকা জমা দেওয়ার নাম ক’রে এসে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ব্যাঙ্ক লুঠ করে। কয়েকজন কর্ম্মচারী তাদের গুলিতে নিহত হয়, কয়েকজন আহত হয়। পুলিশ আসবার আগেই তারা পালায়! তাদের সন্ধান এ পর্য্যন্ত কেউ পায়নি। পুলিশ জোর তদন্ত চালিয়েছে। কলকাতার মত সহরে দুপুরবেলায় চৌরঙ্গীর মত জায়গায় একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হওয়া সামান্য কথা নয়। সারা শহরে শুধু নয়, সমস্ত দেশে হুলুস্থুল পড়ে গেছে। কলকাতার পুলিশকে লোকে ধিক্কার দিচ্ছে।

ব্যোমকেশ পকেট থেকে ফটোখানি বের করতে করতে বললেন, ”শুনেছি লোকটা নাকি পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরে এসব কাজে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেছে। দেশ বিদেশে তার নামও খুব। ফিলিপ, নওরোজী, সিমসন, ইসমাইল, গোলাম প্রভৃতি নামে সে পরিচিত। আরও যে কত নাম আছে তাই ঠিক কে জানে। সে এই আছে কলকাতায়, পরক্ষণে সে গেছে বোম্বাই, তারপরই তাকে দেখা যাবে পাটনায়-এক কথায় গোটা ভারতবর্ষটাই যেন তার লীলাক্ষেত্র।”

কৃষ্ণা বললো, ”মক্কেল লোক মনে হচ্ছে।”

ব্যোমকেশ বললেন, ”মক্কেল বলে মক্কেল! শুনেছি পুণায় কোন একটা গ্রামে সে এখন বাস করছে, বোম্বাইতে থাকে না কারণ ওখানকার অনেকেই তাকে চেনে।”

ফটোখানা তিনি মিঃ রুস্তমজীর হাতে দেন-

ফটোখানা হাতে নিয়ে রুস্তমজী অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করে সেখানা তারপর ফিরিয়ে দেন।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ”চিনতে পারলেন কি?”

রুস্তমজী উত্তর দিলেন, ”না,-তবু একবার দেখলাম যদি পরিচিত কেউ হয়।”

স্যর আদমজীর নিজস্ব প্লেনে উঠলো কৃষ্ণা ও রুস্তমজী।

বেচারা প্রণবেশের জন্য দুঃখ হয় কৃষ্ণার। এরকমভাবে কৃষ্ণা একা কোথাও যায়নি। মামাবাবুকে না হলে তার চলে না। প্রণবেশ ডাক্তারের নিষেধ উপেক্ষা করে কৃষ্ণাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল, যার ফলে পায়ের যন্ত্রণাটাও আবার বেড়ে গেছে। তাই আবারও তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। বাড়ীতে রয়েছে কেবল বনমালী আর মানদা।

প্রণবেশকে কৃষ্ণা বোম্বাই যাওয়ার কথা বলতে পারেনি; বলেছে দু’ একদিনের জন্য সে কাছাকাছি এক জায়গায় যাচ্ছে, তারপর ফিরে এসে মামাকে দেখতে আসবে।

তবু প্রণবেশ সন্দেহ করেছে, সজল চোখে বলেছে ”পরের ব্যাপারে নিজেকে এতটা জড়িয়ো না কৃষ্ণা, শেষটায় এমন কোন বিপদে পড়বে যা থেকে মুক্তি পাওয়াই কঠিন হবে। দরকার কি বলো, এ সব ঝামেলার? তার চেয়ে লেখাপড়া কর, জীবনের এদিক দিয়ে উন্নতি কর যাতে ভবিষ্যতে উপকার হবে।”

সস্নেহে দুর্ব্বল প্রণবেশের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কৃষ্ণা বলেছে, ”আচ্ছা মামাবাবু! আমি এই যে পরের কাজ করি, এটা কি সত্যই খারাপ? যাদের কাজ সফল হয়, তারা যে আশীর্ব্বাদ করে, সে আশীর্ব্বাদের কি কোন মূল্যই নেই?”

প্রণবেশ বলে, ”নিশ্চয়ই আছে, তবু নিজের স্বার্থটা যাতে বজায় থাকে তা করাও তো উচিত। এই পরের কাজ করতে তোমায় কতবার কত বিপদে পড়তে হয়েছে সে কথাটা ভুলে যেয়ো না কৃষ্ণা।”

কৃষ্ণা হেসেছে, মামার প্লাস্টার করা পায়ের ধূলা মাথায় নিয়ে বলেছে, ”তুমি গুরুজন মামাবাবু, আমায় শুধু এই আশীর্ব্বাদই করো-নিজের ছোট-বড় ক্ষতি তুচ্ছ করেও যেন পরের উপকার করতে পারি, পরের মুখে হাসি ফোটাতে পারি। একজন কবি বলেছেন,

‘সকলের তরে সকলে আমরা-

প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’

কথাটা আমি আজও ভুলতে পারি না।”

এর উত্তরে আর একটি কথাও প্রণবেশ বলতে পারেনি।

প্লেনে বসে মনে হচ্ছে-মামাবাবুকে বলে এলে ভালো হতো, সে বোম্বাই যাচ্ছে। বনমালী বৈকালে দেখা করতে যাবে, তার মুখে মামাবাবু নিশ্চয়ই এ কথা শুনতে পাবেন। যদিও সে বনমালীকে বারণ করে দিয়েছে, তবু বৃদ্ধ বনমালী যে একথা প্রণবেশের জেরায় চেপে রাখতে পারবে না, সে জানা কথা।

প্লেনের ভেতর তাকিয়ে সে দেখতে পায়-রুস্তমজী পেছনে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন, তাঁর কর্ম্মচারী দু’জন যারা সঙ্গে এসেছিল, তারাও ঝিমোচ্ছে।

একখানা বই তুলে নিয়ে পড়বার চেষ্টা করে কৃষ্ণা।

যমুনাবাইকে সে সন্দেহ করে, এই সুন্দরী মেয়েটি নিজেকে গুজরাটের মেয়ে বলে পরিচয় দিলেও সে কথা সে বিশ্বাস করতে পারেনি। স্যর আদমজীর এমন কি উপকার সে করেছিল যার জন্য তিনি তার সমস্ত ভার গ্রহণ করেছিলেন! আবার সন্দেহজনক ভাবে তাঁর পত্নীবিয়োগও ঘটে গেল। সমস্ত রহস্যের মধ্যে যমুনাবাইকে বাদ দেওয়া যায় না। কেননা, যমুনাবাই কলকাতায় আসবার মাসখানেক পরেই মিসেস আদমজী অকস্মাৎ মারা যান, তাঁর মৃত্যুর কারণ আজও অজ্ঞাত। স্যর আদমজী এ মৃত্যুর ব্যাপার একেবারে গোপন করে গেছেন-এমনকি পারিবারিক ডাক্তারকে পর্য্যন্ত ডাকেননি। যমুনাবাই আগাগোড়া কৃষ্ণার কাছে একটা রহস্য হয়ে রইলো।

প্লেনটা হুস হুস করে ভেসে চলেছে আকাশপথে। রুস্তমজীর তন্দ্রা ভেঙ্গে যায়, অপ্রস্তুত হয়ে তিনি সোজা হয়ে বসলেন,-অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন, ”ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কৃষ্ণা দেবী, বসবামাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি সে জন্যে-”

কৃষ্ণা বললে, ”সে জন্যে আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না মিঃ রুস্তমজী। আমি জানি, আপনি কতটা আঘাত পেয়েছেন, দিনরাত কতখানি পরিশ্রম আপনি করেছেন, তাতে একটু বিশ্রামের অবসরে ঘুম এসে পড়াটা বিচিত্র নয়।”

হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে রুস্তমজী বললেন, ”আর বেশীক্ষণ নয়, আধ ঘণ্টার মধ্যে খুবসম্ভব আমরা বোম্বাইতে নামবো কৃষ্ণা দেবী। আমাদের প্লেনখানা এরোড্রমে রেখে আমরা মোটরে ‘বাড়ীতে যাব। অবশ্য সে বাড়ীতে স্যর আদমজী বহুকাল আসেননি, কয়েকজন কর্ম্মচারী সেখানে আছেন। রাবেয়া বোর্ডিংয়ে থাকতো, মাঝে মাঝে নিজেদের বাড়ীতে দু-এক ঘণ্টার জন্য বেড়াতে আসতো।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”আপনি যে নওরোজীর কথা বলেছিলেন, সে এখন কোথায়?”

-বোম্বাই-এ নেমে আপনি হয়তো তার দেখা পাবেন। লোকটা নাকি প্রায়ই আসা-যাওয়া করছে এখন।

ছয়. আলিভাই

বোম্বাই আসিয়া ম্যানেজার আলিভাই রুস্তমজী ও কৃষ্ণাকে অভ্যর্থনা করলেন।

রুস্তমজী আগে কোন খবর পাঠাননি; সেজন্যও তিনি অনুযোগ করলেন। রুস্তমজী অপরাধ স্বীকার করে বললেন, ”এমন অকস্মাৎ আমাকে আসতে হল যাতে আমি কোন খবর দিতে পারিনি।”

আলিভাইকে তিনি কৃষ্ণার সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দিলেন, ”ইনি আমার বাংলা দেশের এক বান্ধবী, কৃষ্ণাবাই, ওখানে আমাদের বাড়ীর পাশেই বাড়ী, মিস রাবেয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”

এই ফাঁকে কৃষ্ণা একবার তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে আলিভাইয়ে মুখ আগাগোড়া দেখে নিয়ে বললো, ”মিস আদমজী অনেকবার আমাকে বোম্বাই আসবার নিমন্ত্রণ করেছে। অথচ এবারে চলে আসবার সময় আমাকে একবার বলেও এল না। মিঃ রুস্তমজী বোম্বাই আসছেন শুনে তাঁর সঙ্গে এসে পড়ায় তাঁর সঙ্গটাও পাওয়া গেলো আর বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করাও হলো!”

”কিন্তু মিস আদমজী তো বোম্বাই আসেননি”-বলেই আলিভাইয়ের মুখের ভাবটা যেন কিরকম হয়ে গেল। আশ্চর্য্য হ’য়ে বললেন, ”এখানে এসেছেন?-কই আমি তো তার কিছুই জানি না। হোষ্টেল থেকে সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মিস জোহরা আজ তিনদিন আগে পত্র দিয়েছেন, মিস আদমজী ফিরলে তিনি নিশ্চয়ই খোঁজ নিতে চাইতেন না!”

কৃষ্ণা আকাশ থেকে পড়ল, ”সে কি, তাহ’লে মেয়েটা গেল কোথায়? এই সেদিন তার বাপকে হারিয়েছে, মনটাও ভাল নেই, -কি হবে মিঃ রুস্তমজী?”

”সেই কথাই তো ভাবছি।” রুস্তমজীকে চিন্তিত বলেই মনে হল!

আলিভাই বললেন, ”মিস রাবেয়ার সবই ভাল, কেবল এই একগুঁয়েমীটা ছাড়া। আমি জানি, স্যর আদমজীর কথাও সে শুনতো না। এই দেখুন না, বলা নেই কওয়া নেই, কোথায় হঠাৎ ডুব দিল সে। বলতে গেলে তার দেখাশুনার ভার এখন তো আমাদেরই; কিন্তু সে যদি এইভাবে নিজের ইচ্ছামত চলাফেরা করে তাহ’লে আমরা কি করতে পারি আপনিই বলুন না! এই তো দেখুন, আপনি এসেছেন তার নিমন্ত্রণে অথচ তারই নেই খোঁজ। যাই হোক, এসেছেন যখন, আপনার কোন অসুবিধা যাতে না হয় সে দিকে আমি দৃষ্টি রাখবো।”

কৃষ্ণা এতক্ষণ আলিভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে তার মুখের ভাব লক্ষ্য করছিল একান্ত দৃষ্টিতে। রুস্তমজীর মুখে ”তাই তো ভাবছি” কথাটা শুনবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির একটা রেখা ফুটে উঠে তখনই মিলিয়ে যায়। চকিতের জন্য হলেও সেটা কৃষ্ণার দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। কিন্তু কৃষ্ণা যেন কিছুই দেখতে পায়নি এবং আলিভাইয়ের কথায় সে খুব খুশী হয়েছে, এই রকম ভাব দেখিয়ে বললো, ”ধন্যবাদ মিঃ আলি, আমি এসে আপনাদের বিব্রত করার জন্য দুঃখিত। আমি ভাবছি যে, কালই আমি কলকাতায় ফিরে যাবো।”

আলিভাই বললেন, ”সে কি হয়! আপনি মিস আদমজীর বন্ধু। তিনি উপস্থিত না থাকলেও আপনার আদর-যত্নের কোনই ত্রুটি হবে না। আপনি যে ক’দিন ইচ্ছা থাকুন এখানে!”

এই বলেই একজন চাকরকে ডেকে মিস আদমজীর ঘরগুলো খুলে দিতে বলে কৃষ্ণাকে বললেন, ”আপনি এর সঙ্গে যান। যা দরকার হবে, কলিং বেল টিপে ঝি-চাকর যাকে হয় বলবেন।”

সত্যিই কৃষ্ণার কোন অযত্ন হল না। বাড়ীর সবচেয়ে ভাল দুখানা ঘর তাকে দেওয়া হল। ঘরের মধ্যে বিছানাপত্র, টেবিল, চেয়ার, আলমারী, সোফা, কৌচ সব কিছুই সাজানো ছিল। ভৃত্যেরা সেগুলো তাড়াতাড়ি ঝেড়ে-পুঁছে পরিষ্কার ক’রে দিল কৃষ্ণার জন্য।

আহারাদি শেষ হলে রুস্তমজী কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

রুস্তমজী বললেন, ”আপনি এখন কি করতে চান কৃষ্ণা দেবী?”

-তার মানে?

-মানে, এখানে রাবেয়ার খোঁজ পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না আমার। তাই ভাবছিলাম যে আপনি বরং কলকাতায় ফিরে গিয়েই তদন্ত আরম্ভ করুন। তাছাড়া আমরা এখন কিছুদিন খুবই ব্যস্ত থাকবো। ডকে ভীষণ গোলমাল আরম্ভ হয়ে গেছে। গোলমালটা মিটলেই আমি কলকাতা ফিরে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করবো।

কৃষ্ণা হেসে বললো, ”এসেছি যখন, সহরটা দুদিন দেখেই যাই। চলুন না, আপনাদের সঙ্গে ডকটাও একবার দেখে আসি। তাছাড়া মিস আদমজীর হোষ্টেলেও একবার যাবো আমি।”

রুস্তমজী বললেন, ”আজ থাক কৃষ্ণা দেবী। ডকের গোলমাল এখনও মেটেনি। পুলিশ দিয়ে ডক ঘিরে রাখা হয়েছে। বলা যায় না, ভয়ে যারা শান্ত হয়ে আছে আবার তারা কোন মুহূর্ত্তে গোলমাল বাধিয়ে বসে। আপনি এ বেলাটা বিশ্রাম করুন, সন্ধ্যার মধ্যে আমরা ফিরে এসে আপনাকে মিস রাবেয়ার হোষ্টেলে নিয়ে যাব।” কৃষ্ণা ক্লান্তও হয়েছিল বড় কম নয়-সে আর জোর করলো না।

টেবিলের উপর সেদিনকার কাগজখানা পড়েছিল, সেখানা দু’একবার নাড়াচাড়া করে সে উঠে পড়লো।

প্রকাণ্ড বড় বাড়ীখানা সত্যই যেন একখানি ছবির মতই দেখায়। অসংখ্য বড় বড় ঘর, তেমনই সুন্দরভাবে সাজানো। স্যর আদমজী বহু লক্ষ টাকায় এ বাড়ীখানা কিনেছিলেন। লেডি আদমজী তখন এখানে ছিলেন, মনের মত সুন্দর ক’রে এ বাড়ী তিনি সুসজ্জিত করেছিলেন।

তিনি কলকাতায় যাওয়ার পর এ বাড়ীর সামনের অংশটা অফিসে পরিণত হয়। পেছনের দিকটায় ম্যানেজার ও কর্ম্মচারীরা বাস করেন। অফিসের সামনে মস্ত বড় লন, ও-পাশে একটি সুন্দর ফুলের বাগান। পিছনের অংশে অফিসের বেয়ারা দরোয়ানেরা সপরিবারে বাস করে।

কৃষ্ণা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে বাড়ীখানা। তাকে দেখানোর জন্য সঙ্গে ছিল একটি ছোট ছেলে, তার নাম জনি-এখানকারই কোন কর্ম্মচারীর ছেলে।

বছর দশ বারো বয়স, সুন্দর ফুটফুটে চেহারা, কনভেণ্ট স্কুলে পড়ে, প্রতিদিন এখান থেকে মোটরে যাতায়াত করে। তার সঙ্গে দুটি-একটি কথা বলেই কৃষ্ণা বুঝতে পারে যে, জনি শুধু অস্থির চঞ্চলই নয়, অত্যন্ত চালাক চতুরও বটে। তার তীক্ষ্ন বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে কৃষ্ণা ভারি খুশী হয়ে ওঠে।

কথায় কথায় সে জেনে নেয়-জনির মা নেই। মাত্র এক বৎসর হল সে তার পিতার কাছে এসেছে। পিতা তাকে অত্যন্ত ভালবাসেন, নিজের হাতে কোনদিন তাকে শাসন করেন না-মারেন না। কিন্তু ওই যে ম্যানেজার আলিভাই, ওঁর জন্যেই মাঝে মাঝে একেবারে বিনাদোষে জনিকে শাস্তি পেতে হয়।

কৃষ্ণাকে সে সাবধান করে-”আপনি যেন আলিভাইয়ের সঙ্গে বেশী কথা বলবেন না। ও লোকটা একটা শয়তান, একদিন একটা কুলিকে এমন লাথি মেরেছিল যে দু’হাতে পেট চেপে ধরে শুয়ে পড়েছিল সে। তার মুখ দিয়ে সে কি রক্ত! আমি জানালার বাইরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম-লোকটা কাঁপতে কাঁপতে একেবারে শান্ত হয়ে গেল, তার মানে-”

কৃষ্ণা শিউরে ওঠে-”তার মানে মরে গেল!”

জনি বললে, ”ঠিক তাই। তারপর জানেন, আলিভাইয়ের হুকুমে আমাদের দুজন আরদালী সেই মড়াটা তুলে নিয়ে ওই বাগানে একটা গর্ত্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেললো।”

কৃষ্ণা তার নির্দ্দেশিত স্থানের দিকে তাকায়।

জনি বললে, ”আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না বুঝেছি। আলিভাইয়ের কাছে মাঝে মাঝে একজন লোক আসে, সে আবার ভীষণ শয়তান। একদিন ডকের ধারে কারখানার একটা ঘরে কয়েকটা কুলিকে এমন চাবুক মেরেছিল-যার জন্য কেউ আর কোন কাজ করেনি। সেই জন্যে এদের দলের লোকদের দিয়ে ওদের বাড়ী ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”সে খবর পুলিশ পায়নি?”

জনি বিজ্ঞের মত উত্তর দিলে, ”পেয়েছিল বৈকি! কিন্তু কে আগুন দিয়েছে প্রমাণ হয় না। আমি কিন্তু জানি সে কথা! আমাদের কারখানা থেকে পেট্রোল নিয়ে গিয়ে রাত দুপুরে সেই পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া হয়েছিল। তাতে লোকও মরেছিল বেশ-আর কি সে চিমসে গন্ধ মানুষ পোড়ার, সেই গন্ধে আমি কতদিন কিছু খেতে পারিনি।”

খানিকক্ষণ গুম হয়ে থেকে কৃষ্ণা বললো, ”এ সব কথা তুমি পুলিশকে বলনি কেন?”

চোখ বিস্ফারিত করে জনি বললে, ”ওরে বাপরে! এসব কথা বলতে গেলে কি আর রক্ষা থাকতো! এরা তাহলে আমার গা থেকে ছাল তুলে নিতো। তা ছাড়া আমার বাবা….”

বলতে বলতে সে চুপ করে যায়।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে ”তোমার বাবা কি করলেন আবার….”

বালকের মুখখানা বিকৃত হয়ে ওঠে, কতক্ষণ সে কথা বলে না। তারপর অস্ফুটকণ্ঠে বললে, ”এসব কথা পুলিশকে জানালে ওরা যে আমার বাবাকেও ফাঁসি দেবে। এ কথা আলিভাই আমাকে বলে দিয়েছেন।”

এতক্ষণে কৃষ্ণা বুঝতে পারে কেন জনি এত কথা জানা সত্ত্বেও কাউকে কিছু বলতে পারে না। আলিভাই আগেই ঘোড়া মেরে রেখেছেন। যদি জনির মুখ থেকে কোন কথা প্রকাশ পায়, তাহলে তার বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

স্যর আদমজীর মৃত্যু আর রাবেয়ার অন্তর্দ্ধানেরও কোন সন্ধান যদি মেলে, সেজন্য কৃষ্ণা জনির মুখে আরও কিছু শুনতে চায়।

জনির মা অত্যন্ত ধর্ম্মশীলা মেয়ে ছিলেন। তিনি পার্শী ছিলেন না, খাঁটি মুসলমান ছিলেন। এই ধর্ম্মঘটিত ব্যাপার নিয়েই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বরাবর ঝগড়া বিবাদ চলতো। এরই মধ্যে একদিন জনির মা স্বামীর আরও কি সব কথা জানতে পারেন, তাই মনের দুঃখে ও বিজাতীয় ঘৃণায় তিনি ছেলেকে নিয়ে এখান থেকে চলে যান ও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে বাস করেন।

বলতে বলতে জনির মুখখানা দীপ্ত হয়ে ওঠে, চোখ দুটি তার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ”জানেন আপনি, আমার মা ক্ষেত-খামারের কাজ করেছেন, লোকের বাড়ীতে কাজ করেছেন, তবু তিনি বাবার একটা পয়সাও নেননি। আমারও এখানে ভাল লাগে না। মা যদি বেঁচে থাকতেন, আমি কিছুতেই এখানে আসতাম না। এই এক বছর ধরে আমার যে কি করে দিন কাটছে-”

বলতে বলতে তার দুই চোখ দিয়ে জল ঝরে। ক্ষুদ্র বালকের কান্নায় কৃষ্ণা বিচলিত হয়ে ওঠে, সে জনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সান্ত্বনার সুরে বললে, ”তুমি আমার সঙ্গে বাংলায় চল না জনি, ওখানে রুস্তমজী আছেন, তোমাদের এখানকার আরও কত লোক আছেন, কোন দুঃখ ভাবনা থাকবে না।”

জনি দু’হাতে চোখ মোছে, নিঃশব্দে মাথা নাড়ে।

কৃষ্ণা বললে, ”কেন যাবে না? এখানে তোমার কত দুঃখ লাঞ্ছনা সইতে হয়, কলকাতায় সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকবে, লেখাপড়া শিখবে, মানুষ হবে, সেটা কি ভাল নয়?”

জনি আর্দ্রকণ্ঠে বললে, ”কিন্তু বাবা-বাবা যে যাবেন না, এরা বাবাকে যেতে দেবে? আমি আছি তাই বাবা বেঁচে আছেন, নইলে বাবার কি হবে?”

বলতে বলতে সে দৃঢ় হয়ে ওঠে, ”না না, আমি বাবাকে ফেলে কোথাও যাব না। আমি আছি তাই বাবা ঘরে ফেরেন, নইলে বাবা ঘরেও ফিরতেন না। নাঃ, আমার কোথাও যাওয়া হবে না।”

কৃষ্ণা সপ্রশংস দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র বালকের পানে তাকিয়ে থাকে, আর তাকে কোন কথা বলতে পারে না।

সাত. রুক্মিণীবাই

রুস্তমজী কৃষ্ণাকে নিয়ে গেলেন স্যর আদমজী কোম্পানীর ডক দেখানোর জন্য। কোম্পানীর একটি নিজস্ব জাহাজ আছে, যে জাহাজে আমদানী-রপ্তানীর কাজ চলে।

বিরাট প্রতিষ্ঠান দেখে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হ’য়ে যায়। জিজ্ঞাসা করে, ”এসব ছেড়ে স্যর আদমজী কলকাতায় বাস করতেন কেন? এখানে তাঁর বাড়ী ব্যবসা-বাণিজ্য এসব ভার পরের হাতে ছেড়ে দিয়ে-”

রুস্তমজী বাধা দেন, ”না-না, পরের হাতে ছেড়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হ’য়ে কলকাতায় বাস করতেন না কৃষ্ণা দেবী, প্রায়ই তিনি এখানে আসতেন, অফিস পরিচালনা করতেন, সব দেখা-শোনা করতেন। নিজেদের প্লেন-আসা-যাওয়ার কথা ঢাক পিটিয়ে প্রচারিত হয়নি কোন দিন।”

কৃষ্ণা বললে, ”মিস রাবেয়াকে বাড়ীতে না রেখে, হোষ্টেলে রেখে পড়াবার দরকারই বা কি ছিল? ওঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পড়ালেই তো ভাল হতো।”

বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে রুস্তমজী বললেন, ”আর বলেন কেন, মেয়ে অত্যন্ত জেদী আর আদুরে কিনা! তা-ছাড়া কলকাতা নাকি ওর ভাল লাগে না, আপনাকে সত্য কথাই বলি কৃষ্ণা দেবী, মোটের উপর এ মেয়ে পিতার বশে ঠিক চলতে চাইত না। তিনি যা বলতেন ঠিক তার বিপরীত কাজ ক’রে যেতো।”

আশ্চর্য্য হয়ে কৃষ্ণা বললো, ”কিন্তু আমি তো তাঁকে সে রকম দেখিনি মিঃ রুস্তমজী। সামান্য পরিচয় হলেও তাঁর সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছি তাতে মনে হয়, বাবাকে তিনি অত্যন্ত বেশী ভালবাসেন। এ রকম মেয়ে যে বাপের অবাধ্য হতে পারে তা তো আমার মনে হয় না।”

রুস্তমজী মৃদু হেসে বললেন, ”মিস রাবেয়ার ব্যক্তিগত জীবনের পরিচয় আপনি কতটুকু জানেন কৃষ্ণা দেবী? আমি বহুকাল থেকে এই পরিবারে বাস করছি। এঁদের কাউকেই চিনতে আমার বাকী নেই। যাক চলুন, আমাদের জাহাজখানা একবার দেখে আসবেন।”

কৃষ্ণা বললে, ”আমি একবার মিস রাবেয়ার হোষ্টেলে যেতে চাই যে রুস্তমজী।”

রুস্তমজী বললেন, ”আপনাকে সেখানে আমি নিজেই নিয়ে যাব-এসেছেন যখন, তখন সবই দেখে যাবেন বৈকি।”

লোকটিকে চিনেও যেন চিনতে পারে না কৃষ্ণা। সেদিন জাহাজ দেখাতে যথেষ্ট সময় তিনি কাটিয়ে দিলেন। থানায় নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণার পরিচয় দিলেন। জানালেন মিস রাবেয়া অপহৃতা হয়েছেন, তাঁকে পাওয়া যাচ্ছে না, সেই তদন্তেই ইনি এসেছেন।

রাত্রে হোষ্টেলে আর যাওয়া হ’ল না। রুষ্ট মনেই কৃষ্ণা ফিরে এলো।

রাত্রে আহারাদি সেরে তার নির্দ্দিষ্ট ঘরে শয়ন করতে যাওয়ার সময় আলিভাই বললেন, ”অপরিচিত জায়গা হলেও আপনার কোন ভয় নাই কৃষ্ণা দেবী, আমাদের দরোয়ানের স্ত্রী রুক্মিণীবাই আপনার ঘরের বারাণ্ডায় থাকবে, আপনার দরকারমত ডাকলেই তাকে পাবেন।”

হিন্দুমেয়ে রুক্মিণীবাইকে দেখে খুশী হয় কৃষ্ণা। সসঙ্কোচে বারাণ্ডাতে বসেছিলো রুক্মিণী, কৃষ্ণা তাকে ডাকলো, ”ঘরে এসো রুক্মিণী, তোমার সঙ্গে একটু আলাপ পরিচয় করা যাক।”

রুক্মিণী বারাণ্ডার দরজা বন্ধ করে কৃষ্ণার কাছে এসে মেঝেয় বসলো।

পরিচয় পাওয়া যায় তার-বহুকাল সে বাংলা মুল্লুকে ছিল, সেজন্য বাংলা কথা বুঝতে পারে যদিও খুব ভাল, বলতে পারে না। তার পিতা বড় সাহেব আদমজীর সঙ্গে বাংলায় গিয়েছিল, বাংলা মুল্লুকে শেওড়াফুলিতে সে জন্মেছে, মানুষও হয়েছে বাংলাদেশে, বাংলার সব কিছুই তাই তার কাছে ভাল লাগে।

কৃষ্ণা বললে, ”তোমার স্বামী ওখানে স্যর আদমজীর বাড়ীতে কি অফিসে কাজে লাগলেই তো তুমিও ওখানে থাকতে পারতে। যাক এখানে তুমি কতদিন আছ?”

রুক্মিণী হিসাব করে বলে, ”তা দুই বছরের বেশী হবে। মেজ সাহেব মারা যাওয়ার আগে আমি এখানে চলে এসেছি। তিনি মারা গেছেন শুনে আমি কলকাতায় ফেরবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। আমায় কেউ নিয়ে যায়নি, সেই হতে আমি এখানেই আছি বাই-”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”মেজ সাহেবকেও নাকি খুন করা হয়েছে শুনেছি। তোমাদের বড় সাহেবও ঠিক এমনি ভাবে গেলেন। মেয়েটিকেও কারা চুরি করে নিয়ে গেল, সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না।”

-চুরি করে!

রুক্মিণী চমকে বিবর্ণ হয়ে যায়। ”চুরি করে-মানে সেদিন রাত্রে মেয়েটিকে ওরা নিয়ে এল আমি তাই ভাবছিলাম-” বলতে বলতে হঠাৎ সে থেমে যায় তারপরেই বলে ওঠে, ”না-না আমি কিছুই জানি না বাই, আমার কথা ঠিক হল না। সে অন্য কোন মেয়ে হবে, ব্যাপারটা আমিও ঠিক জানি না।’

কৃষ্ণা অন্তরে অন্তরে খুশী হয়ে ওঠে, মুখে সে শান্তভাবে বললো, ”আমি কি বলছি তুমি জানো। আমি জানি তুমি কিছুই জানো না, সে কথা আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আট দশদিন আগে অজ্ঞান অবস্থায় একটি বোরখাপরা মেয়েকে এরা ধরাধরি করে খুব সম্ভব এই ঘরেই এনে রেখেছিল, তাই তো!”

নিরুপায়ভাবে রুক্মিণী কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে থাকে, কি বলবার চেষ্টা করে সে, কথা তার মুখে ফোটে না।

কৃষ্ণা বললে, ”আসল কথা, তুমি মুখখানা দেখতে পাওনি বলে চিনতে পারোনি। আর পাছে তোমরা কেউ চিনতে পারো, সেই জন্য বোরখা পরানো হয়েছিল তাকে তাও আমি বুঝেছি।”

বিস্ফারিত চোখে রুক্মিণী বললে, ”সত্যই তাই বাই, আমরা কেউ চিনিনি। তাকে অর্দ্ধেক রাতে মোটর হতে ধরাধরি করে এনে এই ঘরে শোয়ান হয়; আমাকে আলিসাহেব জল এনে দিতে হুকুম করায় আমি জল এনে দিই মাত্র। আলিসাহেব আমায় চলে যাওয়ার হুকুম করায় আমি সে রাত্রে চলে যাই! কিন্তু বিশ্বাস করুন বাই, আমি এতটুকুও সন্দেহ করিনি যে, সে মেয়েটি আমাদের মিসিবাবা হতে পারেন। ভেবেছিলাম, কোন মেয়ে নেশা ভাঙ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, তাই আলিসাহেব এখানে এনেছেন।”

রুক্মিণী কাঁপছিলো।

আন্দাজে ঢিল মেরে যে সত্য আবিষ্কার হয়ে পড়বে কৃষ্ণা তা ভাবতে পারেনি। মনে মনে সে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, মুখে সে ভাব তার ফুটলো না।

কৃষ্ণা বললো, ”হ্যাঁ বড়লোকের খেয়াল তো, অমন কত কি হয়। যাক তারপর সকালে তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পাওনি তাকে?”

রুক্মিণী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, ”আমাকে সেই রাত্রেই আমার জায়ের বাড়ী যেতে হয়েছিল, হঠাৎ খবর পেলুম আমার বুড়ীমার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। আমায় এখনই তাঁর সেবা করতে যেতে হবে। শুনবামাত্র আমি যে লোক খবর দিতে এসেছিল তার সঙ্গে চলে গেলাম!”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”তোমার মায়ের কি অসুখ হয়েছে দেখলে?”

রুক্মিণী গালে হাত দেয়, ”কোথায় অসুখ ভাই? কিছু হয়নি, মা তো আমায় দেখে অবাক হয়ে গেল! যা হোক, গেছি যখন সে দিনটা থেকে, তারপর দিন ফেরবার ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার দাদী সেই সময় গেলেন ভালই হল, সাতদিন পরে আমরা ফিরে এলাম।”

কৃষ্ণা বললে, ”এসে আর সে মেয়েটিকে দেখনি?”

রুক্মিণী বললে, ”না, শুনলাম জনি সাহেবের কাছে, তিন চারদিন পর সে মেয়েটি চলে গেছে। যে কয়দিন এখানে ছিল, জনি রোজ বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে দেখে গেছে।”

কৃষ্ণা খানিক চুপ করে থাকে, ”আচ্ছা রুক্মিণী, এবার তুমি পাশের ঘরে শোও গিয়ে, রাত হয়ে গেছে। আবার কাল সকালে দেখা হবে! আজ বিদায়।”

রুক্মিণীকে বিদায় দিয়ে কৃষ্ণা দরজা বন্ধ করে দেয়। নিজের রিভলভারটা এতক্ষণে সে বার করে এবং বালিসের তলায় রেখে সুইচ অফ করে দিয়ে সে শুয়ে পড়ে।

চোখে ঘুম আসে না। এখানে আসাটাই হয়ত তার ভুল হয়েছে। এখানে কাউকে, এমন কি রুস্তমজীকেও সে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্যর আদমজীর হত্যা ব্যাপারে রুস্তমজীর যে হাত আছে সে বিশ্বাস করে না। স্যর আদমজী বেঁচে থাকলে, তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী মিস রাবেয়ার সঙ্গে যে রুস্তমজীর বিবাহ হতো, তাতে আজ কারো সন্দেহ নাই। মিস রাবেয়া রুস্তমজীর উপরেই নির্ভর করতো, তাকে বিশ্বাস করতো, কৃষ্ণা তা জানে। রাবেয়া যখন কৃষ্ণাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, সে সময় রুস্তমজী বোম্বাই এসেছিলেন, সে কথাও কৃষ্ণা জানে। রাবেয়ার অন্তর্দ্ধানের পর, বাড়ীতে ফিরে সে কথা জেনে রুস্তমজী যেভাবে তার কাছে গিয়ে পড়েছিলেন, তাতে তার আন্তরিকতাই ফুটে উঠেছিল। কিন্তু এ কথাও সত্য, কৃষ্ণা যখন বোম্বাই আসবার প্রস্তাব করেছিল, তখন তিনি অসম্মতি জানিয়েছিলেন।

বলেছিলেন, ”বোম্বাইতে গিয়ে কিই বা হবে কৃষ্ণা দেবী। দেখছেন, বোম্বাইতে কোন ব্যাপারই হয়নি, ঘটনা যা ঘটেছে সবই এই কলকাতায়। স্যর আদমজীর কাজকর্ম্ম ব্যবসা সবই এখানে, অফিস এখানে, বোম্বাইয়ে যা আছে তা আমার ও আলিভাইয়ের উপর দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন। তবু মাঝে মাঝে তিনি বোম্বাইয়ে আসতেন কাজকর্ম্ম দেখবার জন্য মাত্র। বোম্বাইতে এমন কিছু নেই যাতে আপনার সূত্র পাওয়া যাবে।”

কৃষ্ণা তবু জোর করে এসেছে-স্যর আদমজীর আসল পরিচয় সে জানতে চায়।

নওরোজী নামে একজন লোকের নাম রুস্তমজী করেছিলেন, সম্পত্তির ওয়ারিশরূপে যিনি এসে দাঁড়িয়েছিলেন তারপর যে কোন কারণেই হোক তিনি সরে গেছেন।

কোন তদন্তের ভার নিলে আনুপূর্ব্বিক খবর আগে নিতে হবে, তা কৃষ্ণা জানে; এবং এই ভেবেই চলেছে সে, যাতে এ পর্য্যন্ত কোন কাজ হাতে নিয়ে ব্যর্থ হয়নি।

আলিভাইকে সে মোটেই বিশ্বাস করতে পারেনি। জনির কথা তার মনে হয়। ক্ষুদ্র জনি সব না বুঝলেও, এটুকু বুঝেছে এরা লোক ভাল নয়।

ভাবতে ভাবতে কখন কৃষ্ণার চোখে তন্দ্রা লাগে।

আট. রহস্যের বেড়াজাল

ঘুমিয়ে ছিল কৃষ্ণা, হঠাৎ কি একটা শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল। তার মনে হ’ল জানালার বাইরে যেন খুট খুট করে শব্দ হচ্ছে।

সে নিঃশব্দে বিছানার উপর উঠে বসলো। তারপর বালিসের নীচে থেকে রিভলভারটা বের করে হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে ইলেকট্রিকের সুইচটার কাছে গেল।

ঘরের মধ্যে তখন জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই সে হাতড়ে হাতড়ে সুইচটা বের করলো। তারপর সুইচটা টিপে দিতেই ঘরটা উজ্জ্বল আলোকে আলোকিত হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জানালার বাইরে ঝুপ করে একটা শব্দ হ’ল।

রিভলভার হাতে কৃষ্ণা জানালার কাছে ছুটে গেল। তাড়াতাড়ি জানালাটা খুলে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে নীচের বাগানটা দেখতে চেষ্টা করলো। সে দেখতে পেলো যে একটা ছায়ামূর্ত্তি বাগানের পাশে প্রাচীরের উপরে উঠে বসেছে। হয় ত এখনই প্রাচীরের বাইরে লাফিয়ে পড়বে।

”গুড়ুম!”-

কৃষ্ণার হাতের রিভলভার গর্জ্জে ওঠে, অন্ধকার রাত্রে তার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। লোকটা প্রাচীরের ওপর থেকে ওদিকে লাফিয়ে পড়ে।

রিভলভারের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে ছুটে আসেন আলিভাই, রুস্তমজী আরও দু-চারজন লোক।

দরজা খুলে দেয় কৃষ্ণা-

”কি-কি হয়েছে কৃষ্ণাদেবী? ব্যাপার কি? হঠাৎ রিভলভারের শব্দে আমরা ভয় পেয়ে গেছি। কেউ এসেছিল নাকি-কোন লোকজন-”

রুস্তমজী এই সময় মুরুব্বীর চালে বলে ওঠেন, ”এই সব কারণেই আমি বলেছিলাম-আপনার বোম্বাইয়ে এসে কাজ নাই। এ সবই নওরোজীর কাজ। নওরোজী আমাদের পেছনে লেগেই আছে দেখছি।”

কৃষ্ণা বললো, ”জোর ক’রে এসে হয়তো ভালই হলো মিঃ রুস্তমজী। আমি নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছি। যাই হোক, একজন লোক এই জানালায় এসেছিল, হয়ত ঘরে ঢোকবার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু আমি জেগে উঠে আলো জ্বালতেই সে পালিয়েছে। পাঁচিলের ওপর তার ছায়াটাকে আমি দেখেছি, সেই ছায়া লক্ষ্য করেই আমি গুলি ছুড়েছি।”

গোলমালে ও রিভলভারের শব্দে রুক্মিণীরও ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। সে এসে দরজার এককোণে দাঁড়িয়েছিল। আলিভাই তাকে দেখে সগর্জ্জনে বলে উঠলেন, ”আমি তোমাকে এই ঘরে শোবার কথা বলেছিলাম-সে কথা না শুনে তুমি অন্য ঘরে শুয়েছিলে কেন?”

কৃষ্ণা বললো, ”আমিই ওকে পাশের ঘরে শুতে বলেছিলাম, মিঃ আলিভাই। আমার ঘরে আর কেউ থাকে, এ আমি পছন্দ করি না।”

হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে রুস্তমজী বললেন, ”রাত আর বেশী নেই, তিনটে বেজে গেছে। বাকি সময়টা আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারেন কৃষ্ণা দেবী, আমরা জেগেই রইলাম। আর কেউ সহজে আসতে পারবে না।”

রুক্মিণীবাই সামনের বারাণ্ডায় বিছানা পাতে। আলিভাই সদলবলে প্রস্থান করেন। কৃষ্ণাও আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ে।

সকালে যখন কৃষ্ণার ঘুম ভাঙ্গলো তখন বেলা যথেষ্ট হয়ে গেছে। দেওয়ালের বড় ঘড়িটার পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা দেখলো আটটা বেজে গেছে। হিন্দু মেয়ে বলে কৃষ্ণার খাওয়া-দাওয়ার ভার রুক্মিণীর উপর ছিল-চা এনে সে দাঁড়ালো। কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে জানলো যে, রুস্তমজী ও আলিভাই বের হয়ে গেছেন। কারখানায় আবার নাকি গোলমাল সুরু হয়ে গেছে, তাঁদের আজ কতক্ষণ ওখানে কাটাতে হবে ঠিক নেই।

নিশ্চিন্ত হয় কৃষ্ণা।

কাল রুস্তমজীর সঙ্গে থানায় গিয়েছিল। ওখানে ইনস্পেক্টর নারায়ণ রাওয়ের সঙ্গে মৌখিক আলাপই হয়েছে তার। নিজের কাজ কিছুই হয়নি। তাই সে মনে মনে স্থির করে যে জনিকে নিয়ে থানায় যাবে সে। আজকের মধ্যেই এখানকার যা কিছু জানা এবং খবর সংগ্রহ করা সম্ভব তা তাকে করতে হবে।

ইনস্পেক্টর নারায়ণ রাও সাদর অভ্যর্থনা ক’রে বসালেন কৃষ্ণাকে।

তিনি বললেন, ”কলকাতা থেকে আমাদের কাছে খবর এসেছে ওখানে নাকি একটা বড় ব্যাঙ্ক লুঠ হয়ে গেছে, দু-তিন লাখ টাকা উধাও হয়েছে। ওখানকার একজন পুলিস অফিসার এখানে কাল এসে পৌঁছেছেন-হয়ত দু-চারদিন এখানে থাকবেন তিনি।”

-পুলিশ অফিসার!

ইনি নিশ্চয়ই ব্যোমকেশবাবু, নয়! তিনি পুণায় এসেছেন, সে কথা কৃষ্ণা জানে, এখন বুঝছে, ব্যোমকেশবাবু তাকে সত্য কথা বলেননি। তিনিও বোম্বাই এসেছেন, ব্যাঙ্ক লুঠের সম্বন্ধে কোন সূত্র পেয়ে।

সে জিজ্ঞাসা করলো, ”তিনি কোথায় আছেন জানেন কি?”

নারায়ণ রাও বললেন, ”কোথায় আছেন সে খবরটা এখনও জানতে পারিনি। বলেন তো খোঁজ নিয়ে জানতে পারি।”

কৃষ্ণা বললো, ”আমি তাহলে খুবই খুশী হবো মিঃ রাও। কিন্তু তার আগে আমার নিজের দরকারী প্রশ্ন দু-একটা করছি। দয়া করে উত্তরটা দিলে খুব খুশী হব।”

নারায়ণ রাও বললেন, ”আমি যতটুকু জানি, নিশ্চয়ই বলবো। কি জানতে চান বলুন?”

কৃষ্ণা বললো, শুনেছি আপনি তো বোম্বাই পুলিশে বহুদিন কাজ করছেন, সুতরাং এখানকার অনেক মানুষকেই আপনি চেনেন নিশ্চয়ই?”

নারায়ণ রাও হেসে বললেন, ”তা কিছু কিছু চিনি বৈ কি? আপনি কার কথা জানতে চাইছেন, বলুন?”

কৃষ্ণা বললো, ”আপনার কৃতিত্বের কথা অনেক শুনেছি, সেই জন্যই আপনার কাছে এসেছি। আলিভাই বা রুস্তমজী কেউই আমার সঙ্গে এখন নেই, একটা ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে আমি এসেছি।”

নারায়ণ রাও স্থির দৃষ্টিতে কৃষ্ণার মুখের পানে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ”আপনার নামই শুনেছি কৃষ্ণা দেবী, বিশ্বাস করতে পারিনি, বাংলাদেশের মেয়ে হয়ে এত কম বয়সে আপনি সত্যই এতখানি কৃতিত্বের অধিকারিণী হয়েছেন। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশের লোকেরা আপনাকে অত্যন্ত বাড়িয়ে বর্ণনা করে; কিন্তু এখন দেখছি সত্যই আপনার মধ্যে সে কৃতিত্ব অর্জ্জন করার শক্তি আছে। আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করুন কি বলবেন।”

কৃষ্ণা বললো, ”স্যর আদমজীর পরিচয়টা ভালভাবে জানতে চাই আমি। আপনি যদি তাঁর সম্বন্ধে সব কথা আমাকে জানান, আমি তাহলে ভারি উপকৃতা হই। এখানকার বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েও তিনি এখানে থাকতেন না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরটা আমি ঠিক পাই না। আমি খোঁজ করে জেনেছি-তিনি যে এখানে আসতেন সে খবর একমাত্র আলিভাই ছাড়া কেউ জানতো না। কলকাতাতেও তিনি খুব কমই তাঁর অফিসে যেতেন। ওখানকার যা কিছু কাজ কর্ম্ম তা মিঃ রুস্তমজীই চালাতেন। এরকম ভাবে আত্মগোপন করার কি কারণ ছিল তাঁর?”

কৃষ্ণার কথা শুনে নারায়ণ রাও আশ্চর্য্য হয়ে যান! তাঁর বয়স কৃষ্ণার চাইতে প্রায় তিনগুণ। পুলিশে কাজ ক’রে তাঁর অভিজ্ঞতাও বড় কম বাড়েনি। তবু এই মুহূর্ত্তে স্বীকার করেন, কৃষ্ণার জ্ঞান তাঁর চাইতে বেশী ছাড়া কম নয়!

তিনি বললেন, ”সত্যিই কৃষ্ণাদেবী, স্যর আদমজীর পরিবর্ত্তনটা খুবই লক্ষণীয়। পনেরো বছর আগে এই বোম্বাই সহরে এমন কোন সভাসমিতি বা খেলাধূলা ছিল না, যাতে তিনি যোগদান করেননি। আমাদের পুলিশ ক্লাবেও কতবার তিনি এসেছেন; নিজের হাতে প্রাইজ বিতরণ করেছেন। এমন অমায়িক সরল উদার প্রকৃতির লোক আমরা খুব কমই দেখেছি। বৎসর তের-চোদ্দ আগে তিনি ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে ইউরোপ যান, এ রকম প্রায়ই তাঁকে যেতে হত, দু-তিন বৎসর পরে তিনি এখানে ফিরলেন। খবর পেয়ে আমি একদিন আমাদের ক্লাবে তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে যাই, কিন্তু আমি আশ্চর্য্য হয়ে যাই তাঁর সেদিনের ব্যবহারে। আমার অনুরোধ তো রাখলেনই না তিনি, এমন কি তিনি আমার সঙ্গে দেখা পর্য্যন্ত করলেন না। এই ব্যাপারে নিজেকে যথেষ্ট অপমানিত মনে ক’রে আমি সেদিন চলে এসেছিলাম; এরপর আর তাঁর কাছে কোনদিন যাইনি। আমারই এক বন্ধু ব্যারিষ্টার পেষ্টনজীর মুখে শুনলাম, স্যর আদমজী এবার ইউরোপ হতে ফিরে একেবারেই বদলে গেছেন, কারো সঙ্গেই ভাল করে কথা বলেন না। সভাসমিতি এড়িয়ে চলেন তিনি! আমরা মনে করলাম, ধনীর খেয়াল, অথবা কোন রকম আঘাত পেয়ে তিনি সম্পূর্ণ বদলে গেছেন। এর পরই শুনলাম তিনি কলকাতায় চলে গেছেন। বিশেষ কারণে অর্থাৎ নানা রকম কাজের জন্য বোম্বাই বাস করা তাঁর আর হয়নি।”

কৃষ্ণা নিঃশব্দে তাঁর কথা শুনে যায়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, ”সরল ও অমায়িক প্রকৃতি আদমজীর এই অস্বাভাবিক পরিবর্ত্তন দেখে, আপনাদের কারও এতটুকু সন্দেহ হয়নি? ধরুন আমি যদি বলি, ইনি আপনাদের পরিচিত সে আদমজী নন, অন্য কেউ আদমজী পরিচয় নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, আদমজীর একটা খোলস পরে!”

নারায়ণ রাও হেসে বললেন, ”আপনার এ রকম কথা যে শুনবে, সে আপনার সঙ্গে একমত হবে না। কেননা, স্যর আদমজী সর্ব্বজন পরিচিত, তাঁকে এখানকার সবাই চিনতো। সুতরাং তাঁর বদলে অন্য কেউ এসে দাঁড়ালে সহজেই সে ধরা পড়ে যেতো।

”যাই হোক। এরকম উদ্ভট কল্পনার পেছনে ঘুরবেন না। এতে অনর্থক পণ্ডশ্রমই হবে। তা ছাড়া লোকের কাছে হাস্যাস্পদও হবেন।”

কৃষ্ণ বললে, ”অনুমানের উপরই ত আমরা তদন্ত আরম্ভ করি, আবার এই অনুমানগুলোর উপর নির্ভর করেই আমরা এগিয়ে যাই; আবার এগুলি বিশ্লেষণ করেই আমরা শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হই। এর জন্যে যদি কেউ হাসে আমাদের কিছু যায়-আসে না। আচ্ছা ধন্যবাদ।”

নয়. মিস জোহরা

বোর্ডিং সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মিস জোহরা পরম সমাদরে অভ্যর্থনা করলেন কৃষ্ণাকে। কৃষ্ণার সঙ্গে মিঃ রুস্তমজী ছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে বেশীক্ষণ বসতে পারলেন না। কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ”আমাদের কারখানায় ধর্ম্মঘট সুরু হবে, কাল সকাল থেকে কুলিরা কেউ কাজ করবে না জানিয়ে দিয়েছে। আপনাকে এখানে রেখে আমায় যেতে হচ্ছে। মিস জোহরাই আপনাকে বাড়ী পৌঁছে দেবেন আশা করি।” শেষের কথাগুলো তিনি মিস জোহরার দিকে তাকিয়ে বললেন।

মিস জোহরা বললেন, ”সে জন্য আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না মিঃ রুস্তমজী, আমি আমার গাড়ীতেই ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

রুস্তমজী বিদায় নিলে কৃষ্ণাকে বসিয়ে মিস জোহরা বললেন, ”আপনার নাম মাঝে মাঝে কাগজে পড়ে থাকি। ফটোও দেখেছি, কিন্তু চাক্ষুষ আপনাকে আজ প্রথম দেখলাম। আপনি কেবল বাঙ্গালী মেয়েদেরই নন, সমস্ত ভারতীয় মেয়েদেরই গৌরব কৃষ্ণা দেবী। এ পর্য্যন্ত এদেশের কোন মেয়েই এই ডিটেকটিভ লাইনে যাননি, অবশ্য আর সব দিকে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন, কেবল এই একটি লাইন ছাড়া।”

একটু চুপ করে থেকে মিস জোহরা আবার বলেন, ”এখনও পড়ছেন নিশ্চয়ই-?”

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, হ্যাঁ, বি. এ ডিগ্রি নিয়েছি, এবার এম. এ দেবার ইচ্ছা আছে; জানিনে কতদূর কি হবে। নানা ঝামেলায় পড়াশুনা ভাল হচ্ছে না।”

সে হাসে।

বৃদ্ধা মিস জোহরা তার কথা কানে তোলেন না, নিজের মনেই বলে যান, ”আপনার কিন্তু একবার ইউরোপটা ঘুরে আসা উচিৎ কৃষ্ণা দেবী। এই লাইন যখন নিয়েছেন, তখন পাশ্চাত্ত্যের বিশেষজ্ঞগণ অপরাধতত্ত্ব নিয়ে কি আলোচনা করেন, কি কি নতুন পদ্ধতি তাঁরা আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো জেনে নেওয়া ভাল। আমার মতে বিদেশ ভ্রমণ না করলে কেউ কোন বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে না, আপনি আমার সঙ্গে নিশ্চয় একমত হবেন কৃষ্ণা দেবী!”

কৃষ্ণা সোৎসাহে বলে, ”নিশ্চয়, আমারও একবার যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে, দেখি কতদূর কি হয়। হ্যাঁ, মিস রাবেয়ার মুখে শুনেছিলাম, তাঁরও নাকি ইউরোপ যাওয়ার কথা ছিল-”

বাধা দিয়ে মিস জোহরা বললেন, ”কথা শুধু নয়, সব ঠিকঠাক পর্য্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। এই সামনের মার্চ মাসে তার লণ্ডনে যাওয়ার কথা, ওখান থেকে সে পড়বে স্যর আদমজীর সেই ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু সার আদমজীর মৃত্যুর আগে সে একখানা পত্র পেয়ে একেবারে মুষড়ে পড়েছিল। তাতে সে ইউরোপ যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেছিল জানি। ইদানীং মেয়েটার কি যে হয়েছিল জানি না, কারো সাথে মিশতো না, কি রকম মন-মরা হয়ে থাকতো।”

এই পর্য্যন্ত বলে একটু চুপ ক’রে থেকে মিস জোহরা আবার বলেন, ”দৈবক্রমে সেই চিঠিখানা আমার পড়বার সুযোগ হয়। সত্যি কথা বলতে কি, আমি একেবারে অবাক হয়ে যাই চিঠিখানা পড়ে।”

ব্যগ্র হয়ে ওঠে কৃষ্ণা! জিজ্ঞাসা করে, ”কি রকম?”

মিস জোহরা বললেন, ”সবটা আমি পড়তে পাইনি। চিঠিখানা লিখেছিল নওরোজী নামে একজন লোক। প্রথমেই নিজের পরিচয় দিয়েছিল, সে স্যর আদমজীর একমাত্র ছেলে বলে। সে লিখেছিল যে, তার মা ইউরোপীয়ান, এবং সে তার মায়ের সঙ্গে লণ্ডনেই থাকতো। পিতা আদমজী বৎসরে দু-একবার করে ওখানে যেতেন। নওরোজী ওখানেই পড়াশুনা করতো। কিছুদিন আগে তার মা মারা গেছেন, এবং সে ভারতে পৌঁছে নিজের পরিচয় নিয়ে, স্যর আদমজীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। গত তের চোদ্দ বৎসর আদমজী লণ্ডনে যাননি, এবং কি কারণে যাননি, তা সে জানে না, এতদিন জানতেও সে চায়নি।”

একটু থেমে মিস জোহরা বললেন, ”এইটুকুই আমি শুধু পড়েছি, তারপরেই রাবেয়া এসে প’ড়ে টেবিল থেকে চিঠিখানা তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলেছিল। একটুখানির ভুলে সে হয়ত চিঠিখানা টেবিলে ফেলে বাথরুমে গিয়েছিল। ভাবতে পারেনি, ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমি তার ঘরে যাব, এবং চেয়ারে বসতেই সেই খোলা চিঠিখানা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।”

কৃষ্ণা বললে, ”এর পরই বোধহয় মিস রাবেয়া কলকাতা যান?”

মিস জোহরা উত্তর দিলেন, ”না। সে কলকাতায় চলে যায়, তার বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে।”

এই পর্য্যন্ত বলে মুহূর্ত্তকাল চুপ করে থেকে, তিনি আবার বললেন, ”লোকটিকে যে যাই বলুক, আমি কিন্তু ভালই বলব। মেয়েকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। মাঝে মাঝে যখন বোম্বাইয়ে আসতেন আগেই রাবেয়াকে বাড়ী নিয়ে যেতেন। তারপর যে ক’দিন তিনি বোম্বাইয়ে থাকতেন রাবেয়া তাঁর কাছেই থাকতো। আগে আলিভাই, মানে এখানকার কাজের সমস্ত ভার যাঁর হাতে আছে, তাঁকে রাবেয়া বিলক্ষণ শ্রদ্ধা ভক্তি করতো। কিন্তু ইদানীং দেখতাম, আলিভাইকে সে একেবারই দেখতে পারতো না। এমন কি সে এখানে এলে দেখা পর্য্যন্ত করতো না।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”রুস্তমজীর সঙ্গে তাঁর নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছিল।”

কৃষ্ণার এই কথায় হেসে উঠে মিস জোহরা বললেন, ”অনেকে এ সন্দেহ করে বটে। কিন্তু তা কি সম্ভব কৃষ্ণা দেবী? রুস্তমজীর সঙ্গে রাবেয়ার বয়সের পার্থক্যটা দেখুন। রুস্তমজীর বয়স প্রায় চল্লিশ আর রাবেয়ার মাত্র সতেরো। তাছাড়া রুস্তমজী চাকর ছাড়া কেউ নয়! যতই বড় কাজ করুন আর স্যর আদমজীর যতই প্রিয়পাত্র হোন, তাঁর সঙ্গে স্যর আদমজীর একমাত্র মেয়ের বিয়ে কখনই হতে পারে না। আমি একবার এই সব গুজব শুনে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাতে তিনি হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। তবে, একথা সত্যি যে রুস্তমজীকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন, তাঁর কলকাতার সমস্ত কাজই করতেন রুস্তমজী। শুনেছি আগে নাকি সমস্ত কাজ তিনি দেখাশুনা করতেন, কিন্তু গত দশ-বারো বছর তিনি নিজে আর কিছুই করেননি। এখানকার যা কিছু সব আলিভাই করেন; বাংলা বিহার ও আসামের যা কাজ সব রুস্তমজী করেন।”

আরও খানিকক্ষণ কৃষ্ণা সেখানে থাকে, যা যা জানবার ছিল, সবই প্রশ্ন করে মিস জোহরার কাছ থেকে জেনে নেয় সে।

স্কুল ও হোস্টেলে রাবেয়ার পরম বন্ধু ছিল মরিয়ম। একই ঘরে তারা থাকত। মিস জোহরা মরিয়মকে ডেকে কৃষ্ণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

মরিয়মের মুখে কৃষ্ণা অনেক খবর জানতে পারে। মরিয়ম বললো যে, রাবেয়া তাকে সব কথাই জানাতো। তার জীবনের কোন কথাই মরিয়মের কাছে গোপন নাই। কিন্তু বিদেশাগত এই পত্রখানির কথা রাবেয়া তাকেও জানায়নি। হঠাৎ রাবেয়া খেলাধূলা, হাসি, আলাপ সব ছেড়ে দিয়ে ভীষণ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল, কোন কথা জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলতো না। কোন আনন্দ উৎসবে যোগ দিত না-কি রকম যেন হয়ে গিয়েছিল। আমাদের সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট তাই আলিভাইকে খবর দিলেন-কি জানি হয়ত কি হয়েছে তাই। আমাদের ডাক্তার প্রতিদিনই আমাদের দেখেন, কোন অসুখই তিনি ধরতে পারেন নি। আলিভাই এলেন কিন্তু রাবেয়া তাঁর সঙ্গে দেখা পর্য্যন্ত করলে না।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলো, ”কলকাতা যাবার সময় সে আপনাকে কিছু বলেছিল কি?”

মরিয়ম বললে, ”হ্যাঁ বলেছিল। যাওয়ার সময় সে চোখের জল ফেলে বলে গিয়েছিল-এই হয়ত শেষ দেখা, আর তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।”

মিস জোহরা এই সময় হঠাৎ বলে উঠলেন, ”কই, তুমি তো একদিনও একথা আমাকে বলোনি!”

মরিয়ম নীরবে থাকে।

কৃষ্ণা বললো, ”হয়ত মিস রাবেয়া নিষেধ করেছিলেন তাই বলেন নি। যাক আপনারা জানেন কি যে, আজ দশ বারোদিন যাবৎ মিস রাবেয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না? তাঁর ঘর হতে কে বা কাহারা তাঁকে সম্ভবতঃ অজ্ঞান অবস্থাতেই নিয়ে গেছে?”

রুদ্ধ কণ্ঠে মরিয়ম উত্তর দেয়, ”শুনেছি।”

কৃষ্ণা বললে, ”স্যার আদমজীর মৃত্যুর তদন্তের ভার মিস রাবেয়া ও রুস্তমজী আমার হাতেই দিয়েছেন, তাও বোধ হয় শুনেছেন?”

মিস জোহরা বললেন, ”হ্যাঁ, শুনেছি।”

-আপনি বোধ হয় আরও শুনেছেন যে রুস্তমজী ও আলিভাই সন্দেহ করেন যে, এই হত্যাকাণ্ডটা নওরোজীর দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। এই নওরোজী লোকটি কে, কোথায় থাকে, এবং কেমন করে সে আদমজীর পুত্র নামে পরিচয় দিলে জানিনে। রুস্তমজীর মুখে শুনেছি কিছুদিন আগে সে বোম্বাই এসেছে। এখানে এসে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছে, কিন্তু আলিভাই তাকে যথেষ্ট অপমান করায়, সে শাসিয়ে চলে গেছে। বলে গেছে যথাযোগ্য প্রমাণ সে উপস্থিত করবে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল সেই লোকটির সঙ্গে দেখা করবার। হয়তো তাহলে এই হত্যাকাণ্ড আর মিস রাবেয়ার অপহৃত হওয়ার সন্ধানটা পাওয়া যেত। আচ্ছা আর নয়, এবার আমায় উঠতে হবে, রাত অনেক হয়ে গেছে, বিদায়।

মিস জোহরা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ”একটু অপেক্ষা করুন কৃষ্ণাদেবী, আমি ড্রাইভারকে গাড়ী বের করতে বলে আসি। মরিয়ম আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক।”

কৃষ্ণা হাসিমুখে বললো, ”ধন্যবাদ, আমাকে পৌঁছে দেবার দরকার হবে না। একা যাওয়া-আসা করার অভ্যেস আমার আছে।”

দশ. নওরোজীর পরিচয়

সমুদ্রের ধার দিয়ে মোটর ছুটে চলে। বাঁ দিকে পড়ে সাগরের অথৈ জল-নৌকা জাহাজ ষ্টিমারে জ্বলছে কত আলো। পথের ধারের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সাগরের উপর, ছোট বড় ঢেউগুলি আলোয় চিকমিক করছে। শব্দময় সাগরতীর।

একা কৃষ্ণা চিন্তানিমগ্ন। কোন সৌন্দর্য্যই তার চিত্ত আকর্ষণ করতে পারেনি, সে ভাবছে রাবেয়ার কথা।

জটিল-সম্পূর্ণ জটিল ঘটনাবলীর মধ্যে সে এসে পড়েছে। আজ তিন দিন সে বোম্বাই এসেছে, এই তিনদিনের মধ্যে এমন কোন সূত্র আবিষ্কার করতে পারেনি যা নিয়ে জোর তদন্ত চালানো যায়। স্যার আদমজীর কি দুটো বিয়ে ছিল? নওরোজী কি তার ইউরোপীয়ান পরিবারের সন্তান? ছায়ার পেছনে পেছনে সে কেবল ঘুরছে, স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারছে না।

টুকরো টুকরো অনেক খবর সংগ্রহ করেছে সে; কিন্তু এ সব খবরে কোন কাজই হবে না। রাবেয়ার কাছে সে অনেক খবর পেতে পারে। হয়তো সেই দিনই পেতে পারতো। কিন্তু অকস্মাৎ আক্রান্ত হওয়ায় কিছুই জানা গেল না। এখন সে বুঝতে পারছে-পাছে রাবেয়া তাকে কোন কথা বলে সেই জন্যই তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

যমুনাবাই।

কৃষ্ণার মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে-হ্যাঁ। যমুনাবাই এই দুর্দ্দান্ত দলেরই একজন। সে আদমজীকে সর্ব্বদা পাহারা দেওয়ার জন্যই তাঁর কাছে টাইপিষ্টের কাজ নিয়েছিল।

কিন্তু স্যার আদমজী!

এই লোকটিকেই কৃষ্ণা সন্দেহ করছে। কথাটা সে ইনস্পেক্টার নারায়ণ রাওয়ের কাছে বলে ফেলে হাস্যাস্পদ হয়েছে-এর পর আর কারও কাছে বলা চলে না। ব্যোমকেশবাবু কি-একটা কাজে সহরের বাইরে গেছেন, কথা আছে কাল সকালে আসবেন। কৃষ্ণা ভাবে, তিনি এলে গোপনে তাঁর সঙ্গে এ সব আলোচনা করা যাবে।

হঠাৎ ব্রেকের শব্দে চমকে ওঠে কৃষ্ণা। মোটর এমন একটা জায়গায় এসে থেমে যায় যে জায়গাটা সে চেনে না! ড্রাইভার মোটর থেকে নেমে দরজা খুলে দিয়ে সবিনয়ে এক পাশে সরে দাঁড়ায়।

একি, এ কোন জায়গা? নিশ্চয়ই কারুর দুরভিসন্ধি আছে।

কৃষ্ণা দেখল একটা বিরাট বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মোটরখানা।

ড্রাইভার সেলাম করে বললে, ”আপনি আসুন বাই সাহেবা, কোন ভয় করবেন না, এখানে আপনার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।”

চমৎকার ইংরাজী উচ্চারণ, সাধারণ ড্রাইভার এমন সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারে না।

কৃষ্ণা দৃঢ়কণ্ঠে বললো, ”এখানে নামবো কোন দুঃখে? তুমি আমাকে স্যার আদমজীর বাড়ীতে দিয়ে আসবে চল; না হলে আমাকে বাধ্য হয়েই পুলিশ ডাকতে হবে।”

-পুলিশ!

ড্রাইভার হাসে।

কৃষ্ণা এদিক ওদিক তাকায়। কথায় কথায় রাত হয়ে গেছে তা সে এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি। বিস্তীর্ণ পথের কোনো দিকে পুলিশ আছে কিনা কৃষ্ণা দেখতে পায় না।

এই মুহূর্ত্তে অতর্কিতে দু’দিক হতে দুজন লোক এমনভাবে তাকে চেপে ধরলো যে, কৃষ্ণা নিজেকে রক্ষা করবার এতটুকু সময়ও পেলো না। কৃষ্ণা প্রাণপণে ওদের কবল থেকে মুক্তিলাভের চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তিনজন বলবান পুরুষের সঙ্গে সে পেরে উঠবে কেন? তার মুখের ভেতর তারা শাড়ীর অঞ্চল খানিকটা পুরে দিয়েছে, যাতে সে চীৎকার না করতে পারে। এইটুকু সময়ের মধ্যে চোখের উপর পুরু আচ্ছাদন দিয়েছে যাতে সে কিছু দেখতে না পায়, হাত পাও বেঁধে ফেলেছে। সে বেশ বুঝতে পারলো যে, তাকে বহন করে নিয়ে চলেছে দুজন লোক। কোথায় নিয়ে চলেছে তা সে জানে না। ফিসফিস করে তারা কথা বলছে, সব কথা কানে না এলেও দু-একটি কথা কানে আসে,-কান চাপা থাকায় বুঝতে পারা যায় না।

সিঁড়ি দিয়ে তারা উপরে উঠছে, অনুভবে কৃষ্ণা বুঝতে পারে। হাত দু-খানা তার পিছুমোড়া করে বাঁধা, পা-দুখানাও বাঁধা। পায়ে তত যন্ত্রণা না হলেও হাতের যন্ত্রণায় কৃষ্ণা অস্থির হয়ে ওঠে।

অনুভবে বুঝতে পারে সে;-একখানা সোফার উপর তাকে বসানো হল। তারপর তার হাত-পায়ের বাঁধন খোলা হয়, চোখের পরদা সরিয়ে মুখের ভেতরকার কাপড় তারা টেনে বার করে নেয়।

নড়ে চড়ে সোজা হয়ে বসলো কৃষ্ণা, দুই হাতে চোখ ডলে সে বিস্ফারিত চোখে তাকায়।

চমৎকার একখানি ঘর, ছবির মত সুসজ্জিত। মাঝখানে মস্ত বড় একটি গোলাকার শ্বেত পাথরের টেবিল। টেবিলের চারধারে খান-কতক আরামকেদারা। টেবিলের ওদিকে একখানি চেয়ারে যিনি বসেছিলেন, তাঁর পানে চেয়ে কৃষ্ণা নির্ব্বাক হয়ে যায়।

মোটরের ড্রাইভার!

কৃষ্ণা বিস্ময়ে নির্ব্বাকভাবে এই লোকটির পানে তাকিয়ে থাকে। দৃঢ়ভাবে বাঁধার জন্য হাত দু’খানা তার অবশ হয়ে গিয়েছিল, শিথিল-ভাবে দু’হাত দু’পাশে ঝুলছিল।

চেয়ারে উপবিষ্ট লোকটিকে ইউরোপীয়ান জাতের বলেই মনে হয় কৃষ্ণার। তবুও সে ভারতীয় পদ্ধতিতে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করে।

শান্ত কণ্ঠে বললে,-”নমস্কার কৃষ্ণা দেবী। অপরাধ নেবেন না, আপনাকে এরকমভাবে আনার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। এরকমভাবে আনা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। বাধ্য হয়েই আমায় বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে।”

কৃষ্ণা গুম হয়ে থাকে। যে লোক এরকমভাবে প্রতারণা করে, বলপ্রয়োগ করে বেঁধে এনে তারপর ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাকে ক্ষমা করা দূরে থাক, তার সঙ্গে কথা বলতেও তার ঘৃণা করে।

লোকটি তা বুঝতে পারে; টেবিলের উপরিস্থিত কলিংবেল বাজাতেই একজন লোক দরজার পরদা সরিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে।

তার পানে তাকিয়ে লোকটি আদেশ করে, ”চা!”

নিঃশব্দে সে সরে যায়।

লোকটি সহৃদয়তার সুরে বললে, ”আমি জানি আপনাকে আমরা নিৰ্য্যাতন করেছি, কিন্তু এখনই বলেছি এরকমভাবে আনা ছাড়া আপনাকে আমি পেতাম না। আপনি অত্যন্ত ক্লান্ত হয়েছেন কৃষ্ণা দেবী, আগে একটু চা খেয়ে নিন তারপর কথাবার্ত্তা হবে।”

একজন লোক নিঃশব্দে চা বিস্কুট কৃষ্ণার সামনে টেবিলে রেখে গেল; কিন্তু কৃষ্ণা চায়ের কাপ স্পর্শ করলে না।

উপবিষ্ট লোকটি একটু হেসে বললো, ”আমি নিজে ডিটেকটিভ তাই হয় তো আপনার মনে হবে আমি চা বা বিস্কুটে বিষাক্ত কিছু মিশিয়ে দিতে বলেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন কৃষ্ণা দেবী, আমি আপনাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, কারণ আপনি বেঁচে থাকলে আর কারও না হোক, আমার অনেক উপকার হবে।”

তার কণ্ঠস্বরে এমন একটি ভাব ফুটে উঠলো যাতে কৃষ্ণা সচকিত হয়ে উঠলো।

এতক্ষণে সে কথা বললো, ”হয়তো কোন কারণে আমায় বাঁচিয়ে রাখায় আপনার লাভ আছে, কিন্তু এরকমভাবে হাত-পা মুখ-চোখ বেঁধে নিয়ে এসে বন্দিনী করে রাখবার কারণ তো বুঝছি নে?”

”বন্দিনী”-লোকটি যেন মর্ম্মাহত হয়, ”ভগবান সাক্ষী, আমি আপনাকে বন্দিনী করে রাখবার অভিপ্রায়ে আনিনি কৃষ্ণা দেবী। আপনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আপনি যে দিন এখানে এসেছেন আমি সেই দিনই আপনাকে দেখেছি, আপনার পরিচয় জেনেছি। কিন্তু আপনি চা খেয়ে নিন কৃষ্ণা দেবী, অনেকটা অবসাদ আপনার দূর হয়ে যাবে।”

হাত তুলতে পারে না কৃষ্ণা, বহু কষ্টে আস্তে আস্তে সে হাতখানি সরিয়ে এনে চায়ের কাপ তুলে নেয়। এতক্ষণে তার হাতের পানে লোকটির চোখ পড়ে, ”ইস, কি করে বেঁধেছিল হাত দু’খানা, সাংঘাতিক হয়েছে যে।”

কৃষ্ণা বিকৃত হাসি হেসে বলল, ”হ্যাঁ আমার কিছু দিন মনে থাকবে। আপনি আমাকে রীতিমত বন্দিনী করে নিয়ে এসেছেন, অথচ বলছেন আমি বন্দিনী নই। আপনার অভিপ্রায় আমি কিছুই বুঝছি না-কোনটা যে আপনার প্রকৃত বেশ আর কোনটা যে আপনার প্রকৃত কথা তাই ভাবছি। সকলের উপরে কথা-আপনার নাম কি তাও আমি জানিনে।”

সে হাসে, তারপর গম্ভীর হয়ে বললে, ”নাম বললে হয়ত বুঝবেন। নিশ্চয়ই রুস্তমজীর কাছে আমার নাম শুনেছেন;-আমার সম্বন্ধে অনেক কুৎসাও শুনেছেন। আমার নাম নওরোজী। আশা করি নামটা আপনার পরিচিত।”

”আপনিই নওরোজী?” কৃষ্ণা বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকায় তার দিকে। এর সম্বন্ধে যেটুকু আলাপ আলোচনা কৃষ্ণা শুনেছে, তাতে জানা যায় এর মত দুর্দ্দান্ত লোক দুনিয়ায় নাই। সামনা সামনি নওরোজীকে দেখে সে বিশ্বাস কৃষ্ণার শিথিল হয়ে পড়ে।

এতক্ষণে সে অভিবাদন করে বললে, ”আপনাকে যে আমার বিশেষ দরকার, আমি আপনার নাম শুনেছি। এই খানিক আগেও মিস জোহরার ওখানে আপনার কথা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।”

নওরোজী হেসে বললেন, ”আমি তা জানি কৃষ্ণা দেবী, আমি ওখানেই দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম।”

কৃষ্ণা বললো, ”আপনি তা হলে ড্রাইভার নন!-”

নওরোজী বললেন, ”তা নই বটে। কিন্তু হতে কতক্ষণ? স্কুলের মেয়েদের ড্রাইভার আমারই লোক-আমার বন্দোবস্ত মত আমি তাকে সরিয়ে রেখে, নিজে তার কাছে গেছি।”

কৃষ্ণা বললো, ”আপনার এইটুকু মাত্র পরিচয় পেয়েছি মিঃ নওরোজী-স্যর আদমজীর হত্যাকাণ্ড আপনার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিস রাবেয়াকে আপনিই কলকাতার বাড়ী হতে অপহরণ করেছেন, এখানে কুলি মজুরদের উত্তেজিত করেছেন, নিজেকে স্যর আদমজীর উত্তরাধিকারী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। এতগুলি অপরাধ আপনার মাথায় নির্বিচারে চাপানো হয়েছে। তা ছাড়া আমি বলব কাল রাত্রে আমার দ্বিতলের ঘরের জানলায় উঠে আপনি দাঁড়িয়েছিলেন। আমি গুলি করেছিলাম-”

বাধা দেন নওরোজী, বললেন, ”আপনার এতগুলি কথার মধ্যে একটি মাত্র ছাড়া আর সব মিথ্যা, এ কথা আমি জোর করেই বলব কৃষ্ণা দেবী। স্যর আদমজীর উত্তরাধিকারী একমাত্র আমি, এ কথা সত্যি। আর এটা আমি প্রমাণও করবো। হ্যাঁ, এ অধিকার একমাত্র আমারই আছে কৃষ্ণা দেবী, কারণ আমি স্যর আদমজীর একমাত্র পুত্র।”

-আপনি তাঁর পুত্র! তাঁর কি দুটো বিয়ে ছিল?

কৃষ্ণা নির্ব্বাকে তাঁর পানে তাকায়।

নওরোজী বললেন, ”মোটেই নয়। তাঁর একমাত্র স্ত্রী আমার ইউরোপীয়ান মায়ের গর্ভের একমাত্র সন্তান আমিই। মিস রাবেয়া কোথায় আছেন আমি সন্ধান পেয়েছি কৃষ্ণা দেবী। আপনি তাঁকে পেলে নিশ্চয়ই জানতে পারবেন কে তাঁকে এমন ভাবে অপহরণ করে বন্দিনী করে রেখেছে।”

কৃষ্ণা প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, ”কি বললেন! রাবেয়ার সন্ধান আপনি পেয়েছেন! দুর্ভাগিনী রাবেয়া কোথায় আছে? তার পরিচয়ই বা কি? সব কথা আপনি আমাকে খুলে বলুন।”

শান্তকণ্ঠে নওরোজী বললেন, ”চীৎকার করবেন না। আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব, আপনি সেখানেই সব ঘটনা শুনতে পাবেন। আজ এই পর্য্যন্ত থাক, দেখুন রাত দশটা বেজে গেছে, আপনার সন্ধানে হয়তো বোম্বাইয়ের পুলিশ এতক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ রাবেয়ার সন্ধানে যাওয়া হবে না; যদি সুযোগ পাই কাল আপনাকে শুধু নয়, পুলিশ নিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে হবে। আমি আজ কয়দিন এখানকার বিখ্যাত ডিটেকটিভ স্বামীনাথনকে ভার দিয়েছি-যাতে সে মিস রাবেয়ার সন্ধানটা করতে পারে। সেজন্য তাকে যথেষ্ট সুযোগ এখানকার পুলিশ কমিশনার দিয়েছেন। আজই তিনি ফিরে এসে আমায় জানিয়েছেন যে রাবেয়ার সন্ধান পাওয়া গেছে।”

এই পর্য্যন্ত বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ”আমার সম্বন্ধে অনেক কুৎসা আপনার কানে পৌঁছেচে কৃষ্ণা দেবী। শত্রুর ষড়যন্ত্রে একবার আমি জেল খেটেছি। আরো বড় বড় খুন-ডাকাতির সঙ্গে আমাকে জড়িত করবার জন্য ওরা চেষ্টা করছে। আমার নাকি অনেক ছদ্মনাম আছে। আর একবার দীর্ঘ কালের জন্য জেলে পাঠাতে পারলে-ব্যস।”

কৃষ্ণা বিস্মিতনেত্রে তাঁর পানে তাকিয়ে থাকে। দুর্দ্দান্ত নওরোজীর যে পরিচয় সে পেয়েছে, এঁকে দেখে ঠিক তার বিপরীত মনে হয়। মনুষ্য-চরিত্রে অভিজ্ঞা কৃষ্ণা এই মুহূর্ত্তে মনে করে-হয় সে নওরোজীর সম্বন্ধে মিথ্যা অপবাদই শুনেছে, নয়তো তার মানুষ চিনবার শক্তি আজও হয়নি।

মুখে বললো, ”হ্যাঁ, আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনার সম্বন্ধে অপবাদ বা কুৎসা শুনেছি। মিস জোহরার কাছে শুনলাম-আপনি মিস রাবেয়াকে ভয় দেখিয়ে একখানা পত্র দিয়েছিলেন এবং-”

বাধা দেন নওরোজী, তাঁর শুভ্র মুখখানা আরক্ত হয়ে ওঠে; উত্তেজিত কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে তিনি বললেন, ”মিস জোহরা সত্য কথা বলেননি কৃষ্ণা দেবী, রাবেয়াকে আমি ভয় দেখিয়ে চিঠি দিইনি। তার, আমার এবং শত্রুদের আসল পরিচয় তাকে দিয়েছিলাম মাত্র। সম্পূর্ণ পত্রখানা হয়ত মিস জোহরা নিশ্চয়ই পড়েননি। তাহলে তার আসল পরিচয় তিনিও জানতে পারতেন।”

চমৎকৃত হয়ে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”আপনি রাবেয়াকে সব কথা জানালেন কেন? সে কি সব জানতো না?”

নওরোজী মৃদু হাসলেন, বললেন, ”আমার পিতা স্যর আদমজীকে ইংলণ্ডের ইয়র্কসায়ারে এরা হত্যা করেছে-”।

কৃষ্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ে হাঁপিয়ে উঠে বললে, ”আপনি কি বলছেন, মিঃ নওরোজী!”

নওরোজী উত্তর দিলেন, ”হ্যাঁ, সেই কথা জানাব বলে, আপনার ভুল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যই আপনাকে এখানে এনেছি কৃষ্ণা দেবী, জানি আপনি আলিভাইয়ের ওখানে থাকলে আমি আপনাকে পাবো না। ওরা সর্ব্বদাই আপনাকে ঘিরে রেখেছে। আপনি ওদের দ্বারা অনুসন্ধানের কাজে নিযুক্ত হয়েছেন, ওদের কথায় বিশ্বাস করে আমাকেই অপরাধী ঠিক করে আমার অনুসন্ধান করছেন। আপনার সেই ভ্রান্তি আমি দূর করতে চাই। আমার পরিচয় শুনুন,-স্যর আদমজী ইয়র্কশায়ারে আমার মাকে রীতিমত বিবাহ করেন, তারপর আমি জন্মগ্রহণ করি। আমার মা আমার শিক্ষার জন্য ওখানে ছিলেন, পিতা যাতায়াত করতেন। আমি বোর্ডিংয়ে থেকে পড়াশুনা করেছি, মাঝে মাঝে মায়ের কাছে গিয়েছি। শিশুকালে আমার মা দুইবার ভারতে এসেছিলেন-এখানে তিনি দু’চার মাস করে কাটিয়েও গেছেন। আমার শিক্ষার জন্য তিনি এখানে থাকতে পারেননি।”

মুহূর্ত্ত নীরব থেকে তিনি কৃষ্ণার পানে তাকালেন, বললেন, ”আজ তেরো চৌদ্দ বছর আগে আমার পিতাকে ইয়র্কশায়ারে শিকার করবার অছিলায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।”

”তাহলে কলকাতায় আদমজী নামে যে লোকটা খুন হল সে কে?” -কৃষ্ণা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

-তা আমি ঠিক জানি না-রাবেয়া জানে। বোম্বাইতে রাবেয়ার সঙ্গে আমার খুব গোপনে দেখা সাক্ষাৎ হত। এবারে কলকাতায় যাবার আগে একদিন গভীর রাত্রে এখানে আমার সঙ্গে সে দেখা করেছিল। যতক্ষণ ছিল শুধু কেঁদেছে আর বলেছে, ‘এই আমাদের শেষ দেখা। ওরা জোর করে রুস্তমজীর সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেই, আর রুস্তমজীর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আত্মহত্যা করব।’

কৃষ্ণা একটু ভেবে বললে, ”তাহলে ঐ সাজানো আদমজী এদেরই দলের কেউ আর রাবেয়া তারই মেয়ে?”

নওরোজী কৃষ্ণার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বললে, ”সত্যিই আপনার প্রশংসা না করে আমি থাকতে পারছি না কৃষ্ণা দেবী। আমার অনুমানও তাই আর সেই শয়তানটাই আমার পিতৃহন্তা। রাবেয়া অবশ্য একথা কোন দিনই ভাঙ্গেনি। বেচারা রাবেয়ার কোন দোষ নেই।”

-তাহলে আর দেরী করছেন কেন? রাবেয়া কোথায় আছে বা তার সম্বন্ধে আপনি যতটুকু খবর পেয়েছেন সেটা আমাকে বলুন। আমি তাকে উদ্ধার করতে চাই।

-আর একটু দেরী করতে হবে কৃষ্ণা দেবী। আপনি আর দুটো একটা দিন এখানে থাকুন-আপনার সাহায্য পেলেই তাকে উদ্ধার করা বা আমার বাবার সম্পত্তি উদ্ধার করা সহজেই সম্ভব হবে।

কৃষ্ণা একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল, বললে, ”রাবেয়ার পিতাটি কে? তাকে হত্যাই বা করলে কে? তার মায়ের মৃত্যুও রহস্যজনক।”

নওরোজী বললেন, ”ওদের দলের কোন লোক ত বটেই। শুনেছি আলিভারের কোন নিকট আত্মীয়ই তাকে খুন করেছে। তারপর থেকে রাবেয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তবে তার মায়ের মৃত্যুর কারণ আমি জানি। রাবেয়ার বিয়ে তিনি রুস্তমজীর সঙ্গে কিছুতেই দেবেন না। এই নিয়ে ঝগড়া-ঝাঁটি অশান্তি পরিবারের মধ্যে খুবই হয়। তখন তাঁকে বিষ খাইয়ে কৌশলে সরিয়ে সকল অশান্তি দূর করে ঐ রুস্তমজী।”

কৃষ্ণার মুখে হাসি ফুটল, বললো, ”আপনার সব কথাই আমার অনুমানের সঙ্গে মিলেছে মিঃ নওরোজী। কিন্তু একটা কথা-”

-বলুন, আমার সাধ্যমত আপনার সাহায্য করব।

-আপনি তো রাবেয়াকে ভালবাসেন, অপর পক্ষ থেকে কি রকম ‘রেসপন্স’ পেয়েছেন সেটাতো জানতে পারলুম না।

নওরোজীর মুখটা লাল হয়ে উঠল। বললে, ”একদিন আমি রাবেয়াকে বলেছিলুম, ‘রাবেয়া, তুমি আমাকে চাও, কিন্তু তুমি জানো আমার জীবন নিরাপদ নয়। প্রথমতঃ একটা বিরাট ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য আমি। তার ওপর ওদেরই চক্রান্তে বোম্বাইয়ের পুলিশ ছায়ার মত আমার পেছনে ঘুরছে। ওদেরই দয়ায় একবার আমি জেল খেটেছি। আর একবার যে খুনী-আসামী প্রতিপন্ন হব না, একথা কে বলতে পারে?’

”এ কথার পর রাবেয়া কি করল জানেন কৃষ্ণা দেবী-সে ঝাঁপিয়ে এসে আমার বুকের ওপর পড়ল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘শত্রুর গুলিতেও তুমি যদি প্রাণ হারাও আমার নিজের গুলিতে তোমার অনুগমন করব। পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই, তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে জানি না।’ সেদিন আমি রাবেয়ার কাছে দুর্ব্বল হয়ে পড়লুম। বুঝলুম আমার ভালবাসা অপাত্রে পড়েনি। তাকে জানতে দিলুম আমিও তাকে ভালবাসি। সে নিজেকে নিঃস্ব করে আমার কাছে ধরা দিয়েছে।

”রাবেয়াকে পেয়ে যেন আমার মাথা খুলে গেল। দিনের পর দিন সে আমাকে উদ্দীপনা ও উৎসাহ জুগিয়েছে। ওদের ষড়যন্ত্রের জাল ভাঙ্গবার জন্য নাচিয়ে তুলেছে। আমি দশটা মানুষের মত কাজ করতে লাগলুম। ওদের শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুললুম। আমাকে ওরা মনিব স্বীকার না করলেও রাবেয়াকে ত ওরা অস্বীকার করবে না। শেষ পর্য্যন্ত ওরাই বর্ত্তমান অত্যাচারী কর্ত্তৃপক্ষকে উৎখাত করে রাবেয়াকে যখন চাইবে তখনই আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। এইভাবে পিছন দিক দিয়ে আক্রমণ করে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।”

কৃষ্ণা স্তম্ভিত হয়ে যায়। বলে, ”আপনি পেছনের দিকে আর আমরা সামনের দিকে-এ আক্রমণের বেগ ওরা সামলাতে পারবে না।”

নওরোজী হেসে উঠলেন, বললেন, ”দেখবেন, সাবধান। আপনি আবার মেয়েছেলে, সাবধানে লড়বেন।”

কৃষ্ণা পাল্টা জবাব দেয়, ”যখন আমি একাজে নামি তখন আর আমি মেয়েছেলে থাকি না। আমার মূর্ত্তি বদলে যায়-আমি হই পুরুষ। যাকগে, এখন আমি আর বন্দিনী নই। এবার আমাকে যেতে দেবার ব্যবস্থা করুন।”

-হ্যাঁ একখানা প্রাইভেট ট্যাক্সি আনিয়ে দিচ্ছি।

এগার. ক্ষুদে ইঁদুর

রুস্তমজী কলকাতায় ফিরবেন দু-একদিনের মধ্যে, কৃষ্ণাকেও তাঁর সঙ্গে ফিরতে হবে। নওরোজীর সঙ্গে সে রাত্রে কথাবার্ত্তা বলে কৃষ্ণা যা জেনেছে তাতে তার কাছে রহস্য সরল হয়ে গেছে। এখন শুধু নওরোজীর সাহায্যে রাবেয়াকে উদ্ধার করে শয়তানদের বোম্বাই পুলিশের হাতে সমর্পণ করতে পারলেই হয়।

জনি কৃষ্ণার কাজ করে, দু-একদিনের মধ্যে কৃষ্ণা চলে যাবে শুনে সে দুঃখিত হয়! বলে, ”আপনি যাদু জানেন-আপনাকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না।”

কৃষ্ণার চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে সে বলে, ”আপনি চলে যাবেন শুনে আমি লুকিয়ে পালিয়ে এসেছি বাই। আলিভাই দেখতে পেলে আমাকে আর আস্ত রাখবেন না। তিনি আমার কি নামকরণ করেছেন জানেন-ক্ষুদে ইঁদুর।”

কৃষ্ণা হাসে, বললে, ”চমৎকার নাম রেখেছেন। ক্ষুদে ইঁদুরের অগম্য জায়গা যেমন কোথাও নেই, তোমারও তেমনি অগম্য স্থান নেই-”

জনি বিজ্ঞের মত বললে, ”তা ছাড়া উনি বলেন ক্ষুদে ইঁদুর যেমন সব কেটে তছনছ করে, আমিও তেমনি সব কিছু কেটে নষ্ট করে দেব। অর্থাৎ ওদের সব কীর্ত্তি আমি বার করে দেব। পাছে আমি আপনার কাছে কোন কথা বলে দেই বাই, সেইজন্যে আপনি আসার পরে বাবার সঙ্গে আমাকে আমাদের গাঁয়ের বাড়ীতে আলিভাই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।”

কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু আমি তো আজও যাইনি, তুমি এখনই এলে কি করে?”

জনি সকৌতুকে বলে, ”ওই তো মজা। আমার বাবা আজ তিনদিন আগে আমাকে মাসীর বাড়ী রেখে বাংলা মুল্লুকে চলে গেছেন। মাসী এখানে এক কারখানায় কাজ করে কিনা, সে যেমন কারখানায় চলে গেছে, আমি তেমনই পালিয়েছি। পকেটে পয়সা ছিল, তাই দিয়ে বাসে উঠে চলে এসেছি।”

সহাস্যে কৃষ্ণা বললে, ”পয়সা তোমার পকেটে ছিল না জনি। নিশ্চয় তোমার মাসীর বাক্স হতে নিয়েছো, এ কথা আমি ঠিক বলছি। বল আমার কথা সত্য কিনা।”

জনি মুখ টিপে হাসে।

কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু এরকম ভাবে মাসীর পয়সা নিয়ে সকলকে লুকিয়ে চুরি করে হঠাৎ এখানে আসবার কারণ কি বল দেখি জনি ভাই?”

জনি এদিক ওদিক তাকায়, তারপর কৃষ্ণার কানের কাছে মুখ এনে চুপি চুপি বললে, ”আমি মিস রাবেয়াকে দেখতে পেয়েছি বাই, সেই খবর দিতে এসেছি।”

-মিস রাবেয়াকে দেখেছো?

সোজা হয়ে উঠে বসে কৃষ্ণা জনিকে টেনে সামনে নিয়ে আসে, ”কোথায়,-কোথায় দেখলে জনি ভাই?”

জনি সামনের টেবিলটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, চুপি চুপি বললে, ”আমার মাসী যে বস্তীতে থাকে, সেই বস্তীতেই গোলাম মহম্মদ নামে একজন লোক থাকে, সেই নাকি ওই বস্তীর মালিক। বস্তীর পাশে দোতলা বাড়ী তার। মাসী শুধু নয়-এখানকার সকলেই জানে সে নাকি মস্ত বড় গুণ্ডার সর্দ্দার, যেখানে যা লুটপাট চুরি ডাকাতি হয় সব গোলাম মহম্মদের হুকুমেই তার দলের লোকেরা করে। জানেন বাই, এদের মধ্যে অনেক বড় বড় লোক আছে, যারা এরা ধরা পড়লে অনেক টাকা দিয়ে মামলা চালায়, জেলে গেলে এদের পরিবারকে দেখে। আপনাদের বাংলায় আমাদের বোম্বাইয়ের মত বড়লোক নেই, এরকম গুণ্ডাও নেই সেখানে, সেই জন্যেই আপনি খুঁজতে এসেছেন বোম্বাইতে, তা আমি বুঝতে পেরেছি।”

কৃষ্ণা একটু হাসে, বললে, ”আমি যে এই রকম চোর ডাকাত গুণ্ডা খুঁজতে বাংলা ছেড়ে এখানে এসেছি, এ কথা তোমায় কে বললে জনি ভাই। মেয়েরা কেউ চোর ডাকাত গুণ্ডা ধরে বেড়ায়-একথা কোন দিন শুনেছো?”

জনি মাথা কাত করে বললে, ”আগে শুনিনি, এখন শুনছি। একদিন আলিভাই আমার বাবাকে তাঁর অফিসঘরে ডেকে ফিস ফিস করে আপনার কথা বলছিলেন, আমি জানালার বাইরে থেকে সব শুনেছি।”

কৃষ্ণা বললে, ”চোর ডাকাত গুণ্ডা কেবল তোমার মুল্লুকেই নেই জনি ভাই বাংলা মুল্লুকেও ঢের আছে। এইতো মাস দুই আগে তোমাদের এখানকার কয়জন লোক বাংলা মুল্লুকের কয়জন লোকের সঙ্গে মিলে একটা ব্যাঙ্ক লুঠ করলে-একেবারে প্রকাশ্যে দিনের বেলায়, হাজার লোকের চোখের সামনে। বদলোক সব দেশেই আছে, যখন ধরা পড়ে তখন লোকে জানতে পারে। যাক, তুমি মিস রাবেয়াকে দেখলে কোথায়-সেই কথাটা আগে বলতো।”

জনি যা বললে তা এই :

তার মাসী বস্তীতে বাস করে। মাসী গতকাল কারখানায় কাজ করতে গেলে জনি বার হয়ে ঘুরছিল। গোলাম মহম্মদের বাড়ীর একটি ছোট ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে, তার সঙ্গেই সে সেই বাড়ীতে যায়। দোতলার একটা ঘরের খোলা জানলায় মিস রাবেয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জনি একেবারে আশ্চর্য্য হয়ে যায়। সে জানে মিস রাবেয়াকে কলকাতা হতে কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সহরের এক প্রান্তে এই বস্তী অঞ্চলে গোলাম মহম্মদের বাড়ীতে দরজা-বন্ধ ঘরে সেই মিস রাবেয়াকে দেখে সে তাজ্জব হয়ে যায়। মিস রাবেয়াকে সে বেশ চেনে, তিনি মাঝে মাঝে নিজেদের বাড়িতে যখন বাপের কাছে আসতেন, জনিকে কত ভালবেসে খেলনা দিতেন, গল্প করতেন।

সে চেঁচিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল, কি মনে করে ডাকেনি। মিস রাবেয়াও তাকে দেখতে পেয়েছিলেন, হাতছানি দিয়ে ডাকতে সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। মিস রাবেয়া জিজ্ঞাসা করেন, কৃষ্ণাবাই আজও এখানে আছেন কি না। তিনি এখানে আছেন শুনে খুব তাড়াতাড়ি একখানা কাগজে একটু লিখে তার কাছে দিয়ে বলেছেন এখানা যেন কৃষ্ণাবাইকে শীঘ্র সে পৌঁছে দেয়, একটুও দেরী না করে।

ব্যগ্র কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”কই সে পত্র তুমি এনেছো জনি ভাই, দেখি!”

পকেট হতে ছিন্ন কাগজের টুকরাটা বার করতে করতে জনি বললে, ”সেই জন্যে আজ মাসী কাজে যেতেই আমি তার বাক্স হতে একটা আধুলী নিয়ে চলে এসেছি বাই। মিস রাবেয়ার যে রকম চেহারা হয়েছে এ রকম ভাবে আর কয়দিন থাকলে তিনি নিশ্চয় মরে যাবেন। এই কয়দিনে রোগা একেবারে কাঠ, কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলেছে। আমার বন্ধু বাইরে এসে চুপি চুপি আমায় বললে, ঐ মেয়েটার এখানে বিয়ে হবে। তার বরকেও সে দেখেছে। মেয়েটা রাজী হচ্ছে না কিনা তাই জোর করে এখানে বিয়ে হবে। বরটা মোটা হত। রোজ আসে। তখনই মেয়েটা কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়।”

কৃষ্ণা তার হাতে কাগজটা নিয়ে পড়ে, রাবেয়া দ্রুত হস্তে পেনসিল দিয়ে লিখেছে-

”আমাকে এরা কোথায় এনে রেখেছে জনির কাছে খবর পাবেন। রুস্তমজীকে বিবাহ করতে রাজী না হওয়ার জন্য এরা আমার উপর যথেষ্ট নিৰ্য্যাতন করছে। আপনি যত সত্বর পারেন পত্রপাঠ পুলিশ নিয়ে এসে আমায় উদ্ধার করুন। আর এক কথা…নং হর্ণবি রোডে নওরোজী নামে এক ভদ্রলোক আছেন, এরা আজ রাত্রে তাঁকে হত্যা করবার ষড়যন্ত্র করেছে। তাঁর পরিচয় আপনি তাঁর কাছেই পাবেন। অন্ততঃপক্ষে তাঁকে সাবধান করে দিন। আপনাকে যদি ওরা আটকে ফেলে যে কোন উপায়ে চিঠিখানা তাঁর কাছে পৌঁছে দিন।

-রাবেয়া।

চিঠিখানা মুড়ে কৃষ্ণা তার ব্যাগের মধ্যে পুরলো। তারপর ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ”আমার সঙ্গে তোমায় যে একবার যেতে হবে জনি ভাই, তুমি না হলে মোটেই চলবে না।”

জনি তো প্রস্তুত, সে উঠে দাঁড়ায়। বললে, ”একখানা ট্যাক্সি ডাকবো তো? কিন্তু আলিভাই যদি জানতে পারে-”

কৃষ্ণা বললে, ”জানতে পারলেও ভয় নেই, আমি তোমায় নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি, এতে তিনি বাধা দেবেন না।”

লাফাতে লাফাতে জনি বার হয়ে গেল।

এর একটু পরেই আলিভাইয়ের সাড়া পাওয়া যায়-”রুক্মিণী বাই, কৃষ্ণাদেবী ঘরে আছেন? তাঁকে জানাও, আমি একবার দেখা করতে চাচ্ছি।”

রুক্মিণী জানাবার আগে কৃষ্ণা বাইরে এসে দাঁড়ায়।

সহাস্যমুখে আলিভাই বললেন, ”এই যে, আপনি নিজেই এসেছেন। আপনি কোথাও যাবেন না কি? ট্যাক্সি কি হবে?”

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ”কাল তো এমন সময় প্লেনে উড়বো। মিস জোহরা খবর পেয়ে নিমন্ত্রণ করেছেন। তিনি সি-সাইডে বেড়াতেও নিয়ে যাবেন বলে রেখেছেন।”

ভ্রূকুঞ্চিত করে আলিভাই বললেন, ”নতুন জায়গা, একজন লোক আপনার সঙ্গে দিচ্ছি-একা বেরুনো ঠিক হবে না।”

সবিনয়ে কৃষ্ণা বললে, ”মিস জোহরার বোর্ডিং আমি চিনি; জনিকে সঙ্গে নিচ্ছি- সেই আমার পক্ষে যথেষ্ট। আপনার যত সব গোঁফ-দাড়িওয়ালা কর্ম্মচারী, বড্ড অস্বস্তি করে।”

কুঞ্চিত মুখে আলিভাই বললেন, ”ওই বিচ্চু ছেলেটা আপনাকে নিয়ে পৃথিবী ঘুরিয়ে আনতে পারবে।”

কৃষ্ণা হাসলো, বললে, ”হ্যাঁ, ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান।”

অপ্রসন্নমুখে আলিভাই বললেন, ”বুঝেছি, আপনি ছেলেপুলেদের ভালবাসেন। আর একটা কথা,-ট্যাক্সি কি হবে? আমাদের কোম্পানীর কত মোটর আছে, একবার আদেশ করলেই যেখানে গাড়ী পান, সেখানে ট্যাক্সিই বা কি দরকার?”

কৃষ্ণা বললে, ”দরকার এমন কিছুই নয় মিঃ আলিভাই, ওখান হতে আমি ট্যাক্সি ছেড়ে দেব! আমরা কখন ফিরব ঠিক নেই, ততক্ষণ আপনার গাড়ী আটকে রেখে লাভ কি?”

নিতান্ত অপ্রসন্নভাবেই অভিবাদন করে আলিভাই বিদায় নেন।

বার. মন্ত্রণা

ট্যাক্সি হর্ণবি রোডের সেই বাড়ীখানার সামনে দাঁড়াবামাত্র কৃষ্ণা দরজা খুলে নেমে পড়লো। ট্যাক্সি-চালককে অপেক্ষা করতে বলে সে জনিকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুতপদে দ্বিতলে উঠে নওরোজীর নম্বরযুক্ত দরজায় বেল টিপলো।

ভেতর হতে দরজা খুলতে দেখা গেল নওরোজীকে।

-একি কৃষ্ণা দেবী আপনি! এমন সময়ে?

কৃষ্ণা হাঁফাচ্ছিল, বললে, ”ঘরে চলুন, এখানে কথা বলব না, বিশেষ দরকার-”

নওরোজীর কক্ষে প্রবেশ করে সে আশ্চর্য্য হয়ে যায়, ইনস্পেক্টার নারায়ণ রাও একা নন, আরও কয়েকজন লোকও উপবিষ্ট ছিলেন, যাঁদের দেখে বেশ সম্ভ্রান্ত লোক বলেই বুঝা যায়।

নওরোজী স্বহস্তে আবার দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরলেন, বললেন, ”বসুন কৃষ্ণা দেবী। এঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেই-এঁকে চেনেন, আমাদের বোম্বাই পুলিশের সুযোগ্য পুলিশ ইনস্পেক্টার, মিঃ নারায়ণ রাও-। আর এঁরা-ইনি ডেপুটি কমিশনার মিঃ প্যাটেল। ইনি আমার পিতৃবন্ধু ব্যারিষ্টার পেস্টনজী, ইনি আলমভাই, আমার পিতার সহকর্ম্মী-”

কৃষ্ণা সকলকে অভিবাদন করে।

নওরোজী কৃষ্ণার পরিচয় দেন, ”ইনি বাংলাদেশের সুবিখ্যাত মেয়ে কৃষ্ণা দেবী। স্বেচ্ছায় ইনি ডিটেকটিভের কাজ করছেন। কলকাতায় স্যর আদমজীকে কে বা কাহারা সম্প্রতি হত্যা করেছে, তাঁর মেয়ে এঁর উপরে সেই তদন্তের ভার দিয়েছেন। আপনারা জানেন সে মেয়েও সম্প্রতি অপহৃতা হয়েছেন এবং ইনি সন্দেহ করেছেন তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় এই বোম্বাইতে এনে কোথাও বন্দিনী করে রাখা হয়েছে, সেইজন্যই ইনি এসেছেন।”

কৃষ্ণা বললে, ”মিস রাবেয়াকে বোম্বাইয়ের দক্ষিণ প্রান্তে শহরতলীর একটি বস্তীতে গোলাম মহম্মদ নামে একজন সর্দ্দারের ঘরে আটক রাখা হয়েছে, এখবর আমি পেয়েছি।”

”গোলাম মহম্মদ-”

নারায়ণ রাও চমকে উঠলেন, বললেন, ”মিঃ নওরোজীর খবরের যেটুকু বাকী ছিল সেটা আপনার কাছে পাওয়া গেল, ধন্যবাদ। এর পরের ব্যবস্থাটা আমরাই করতে পারবো।”

কৃষ্ণা বললে, ”আমার সৌভাগ্য যে এখানে আজ আমি আপনাদের সকলকেই পেয়েছি যাঁরা সত্যই স্যর আদমজীর অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। গোলাম মহম্মদের পরিচয় আমি বিশেষ জানিনে। শুধু এটুকু জেনেছি মিঃ নারায়ণ রাও প্রায়ই তার বাড়ীতে হানা দেন কিন্তু প্রমাণাভাবে তাকে কোনদিনই গ্রেপ্তার করতে পারেন নি। এই শহরের বুকের উপর বসে সে নিত্য কত অপরাধমূলক কাজ করে যাচ্ছে, কয়েকজন বিখ্যাত ধনী তাকে অহরহ রক্ষা করে আসছেন। তাদের আজকের প্রোগ্রাম আছে-আজ রাত্রে হোটেল প্যারিসে এসে যে কোন রকমেই হোক মিঃ নওরোজীকে হত্যা করবে। আমি সেইজন্যেই আগে এখানে এসেছি।”

চমৎকৃত হয়ে যায় সকলেই, কারও মুখ দিয়ে একটা কথা বার হয় না।

অনেকক্ষণ পরে বৃদ্ধ নারায়ণ রাও কথা বলেন, ”আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি, আপনার ক্ষমতা অলৌকিক, কোনও পুরুষের মধ্যে আমি যা দেখতে পাইনি, আপনার মধ্যে তা দেখেছি কৃষ্ণা দেবী। আপনি প্রথম একদিন বলেছিলেন স্যর আদমজী-যিনি সম্প্রতি কলকাতায় নিহত হয়েছেন তিনি ছদ্মনামধারীও হতে পারেন। এখন জানা গেছে সে লোকটার নাম ডি-সুজা, সেই রাবেয়ার পিতা।”

মিঃ পেস্টনজী বললেন, ”আমার মতে আজ নওরোজী থানায় থাকবে, এখানে থাকবে না, বলুন মিঃ রাও।”

কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু তার আগে মিস রাবেয়াকে মুক্ত করে আনা এবং ওদের দলশুদ্ধ গ্রেপ্তার করাই সবচেয়ে ভালো কাজ নয় কি মিঃ পেস্টনজী। এই নিন মিস রাবেয়ার পত্র, এই জনি ভাই আমায় রাবেয়ার সন্ধান দিয়েছে।”

মিস রাবেয়ার পত্রখানা সে নারায়ণ রাওয়ের হাতে দেয়-

”হুররে এই ছেলেটিকে আমরা সরকার থেকে সোনার মেডেল দেবো।”

এরই ঘণ্টা-খানেকের মধ্যে পুলিশবাহিনী প্রস্তুত হয় গোলাম মহম্মদের বাড়ী ঘেরাও করবার জন্য।

কৃষ্ণা বললে, ”শুনুন, আমার মনে হয়, এ সময় হানা দেওয়ার চেয়ে সন্ধ্যার পর হানা দেওয়াই সঙ্গত হবে, সেই সময় গোলাম মহম্মদের ওখানে অনেককেই পাওয়া যেতে পারে।”

ডেপুটি কমিশনার মিঃ প্যাটেল বললেন, ”ঠিক কথা, কৃষ্ণা দেবী। যা বলেছেন আমার কাছে তা সঙ্গত বলেই মনে হচ্ছে। নওরোজীকে হত্যা করবার সময় ওরা ঠিক করেছে, যে যে যাবে ঠিক করতে আজ নিশ্চয় অনেকেই গোলাম মহম্মদের বাড়ীতে জমা হবে। এখন গেলে আমরা হয়তো মিস রাবেয়াকেই শুধু পাব অপরাধীদের পাব না; এবং ভবিষ্যতেও যে সহজে পাওয়া যাবে সে আশাও করিনে। অপরাধীরা যে কোনদিকে ছড়িয়ে পড়বে, উপরন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে! একটা কাজ করা যাক, রাত্রি আটটার সময় আমরা যাব, আমাদের এই প্রোগ্রাম ঠিক থাক।”

সর্ব্বসম্মতিক্রমে এই প্রস্তাবই গৃহীত হল।

তের. শত্রুর মুখোমুখি

বোম্বাই সহরের দক্ষিণ প্রান্তে বস্তী অঞ্চলে সারি সারি কয়েকটি পুলিশলরী প্রবেশ করায়, বস্তীবাসীরা সচকিত হয়ে ওঠে।

গোলাম মহম্মদের বাড়ীর অনতিদূরে লরী থেকে সশস্ত্র পুলিশের দল নিঃশব্দে গোলাম মহম্মদের বাড়ী ঘেরাও করে ফেলে।

উদ্যত রিভলভার হস্তে প্রবেশ করেন প্রথমেই ইনস্পেক্টার নারায়ণ রাও, তাঁর সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার, কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল এবং কৃষ্ণা।

সামনেই মস্ত বড় হল ঘর, ভিতরে আলো জ্বলছে। সদর দরজার সামনে প্রহরী বসে ঝিমোচ্ছিল, অকস্মাৎ সামনে এতগুলি সশস্ত্র লোক দেখে সে চমকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে সাব-ইনস্পেক্টার বলশালী বাজিরাও তাকে চেপে ধরেন। হতভাগ্য প্রহরীর মুখ দিয়ে একটি শব্দমাত্র বার হয় না। রিভলভারের গুলির ভয় দেখিয়ে নিঃশব্দে তাকে বেঁধে ফেলা হয়। একজন সশস্ত্র প্রহরী সেখানে মোতায়েন হল।

হল ঘরে অন্ততঃপক্ষে কুড়ি বাইশজন লোক ছিল। কাঁচের জানালার ওধার হতে কৃষ্ণা দেখতে পায়। মাঝখানে বসে আছেন আলিভাই,-তাঁর পাশে আছেন রুস্তমজী। এই দুইজন মাত্র কৃষ্ণার পরিচিত, আর সকলেই তার অপরিচিত লোক।

আলিভাই বলছিলেন, ”বন্ধুগণ, যে কোন রকমেই হোক, আজ নওরোজীকে সরানো চাই। তোমরা সবাই জানো, আমাদের প্রধান লক্ষ্য আমরা যাতে সম্পূর্ণভাবে স্যর আদমজীর কারবার, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি করায়ত্ত করতে পারি। তিন বৎসর আগে যখন নওরোজী বোম্বাই আসে, তখন তাকে দেখে সত্যই আমি আশ্চর্য্য হয়ে যাই। গোলাম মহম্মদের উপর ভার দেওয়া ছিল সে আরদালীর ছদ্মবেশ ধরে স্যর আদমজীর সঙ্গে ইউরোপে যায়। ইউরোপে আমাদেরই এক বন্ধু স্যর আদমজীকে আমাদের পথ থেকে সরিয়েছে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করার দরুণ শেষ পর্য্যন্ত তাকেও শাস্তি পেতে হয়েছে। তোমরা তাকে সবাই চিনবে। সে হচ্ছে ডি-সুজা। আমার আত্মীয় হয়েও সে রেহাই পায়নি। এর পর গোলাম মহম্মদ সুষ্ঠুভাবেই তার কর্ত্তব্য পালন করেছে। মিসেস আদমজীও তার প্রদত্ত বিষপ্রয়োগে মারা যান। সে মৃত্যুর তদন্ত হয়নি, স্বাভাবিক মৃত্যুরূপেই তা প্রকাশ হয়েছে।”

ভীমমূর্তি একটি লোক উঠে দাঁড়াল, সেই গোলাম মহম্মদ।

সে বললো, ”আমি নওরোজীকে বিষ দিয়েছিলাম। সেদিন একটা রেষ্টুরেণ্টে যখন সে খেতে বসেছিল, আমি তখন কৌশলে তার গ্লাসের জলে বিষ দিয়ে সরে পড়ি। এরপর খবরের কাগজ পড়ে জানলাম, সেই রেষ্টুরেণ্টে একটি ছাত্র বিষাক্ত জল খেয়ে তৎক্ষণাৎ মারা গেছে। নাম বা পরিচয় সেদিন না থাকলেও আমার মনে সন্দেহ রইলো না নওরোজী সাহেবই মারা গেছেন। নিশ্চিন্ত হয়ে আমি তারপর এখানে চলে আসি। তাতে কোন ক্ষতি নেই-সেই কাঁটাটা এখানেই উপড়ে ফেলব।”

রুস্তমজী বললেন, ”আমাদের ইউরোপের বন্ধু ডি-সুজা ছিল একজন শিকারী, স্যর আদমজীরও শিকারের নেশা ছিল, তার গুলিতেই স্যর আদমজী প্রাণ হারান। আশ্চর্য্য সাদৃশ্য ছিল এঁদের দুজনের মধ্যে। ডি-সুজা কিছুদিন স্যর আদমজীর ছদ্মরূপে আমেরিকার বিভিন্ন কন্টিনেণ্ট ঘুরে যখন ইয়র্কশায়ারে ফিরে আসে তখন মিসেস আদমজী মৃত এবং প্রতিবেশী কেউই তাঁকে সন্দেহ করেনি। পাছে নওরোজী চিনতে পারে এই জন্য ডি-সুজা বোম্বাই চলে আসে। কিন্তু এখানেও স্যর আদমজীর বন্ধুদের কাছে ধরা পড়বার সম্ভাবনায় আলিভাই তাকে কলকাতায় পাঠান।”

দলের মধ্য হতে একজন বললে, ”কিন্তু কলকাতাতেও স্যর আদমজীর বন্ধুবান্ধব অনেক আছেন তাঁরাও নকল আদমজীকে চিনতে পারেন নি কি?”

রুস্তমজী বললেন, ”ডি-সুজা অফিসে খুব কমই যেতো। তার কাজকর্ম্ম যা কিছু আমিই করে দিতাম। আমার জীবনে একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল-তার সুন্দরী মেয়ে রাবেয়াকে বিয়ে করা; ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমাদের ভয়ে তাঁকে সম্মতি দিতে হয়েছিল। কিন্তু লোকটা শেষের দিকে বিগড়ে ছিল। তার স্ত্রীও বিগড়ে ছিল। দু’ জনকেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলুম। মেয়েটা এখন আমাদের কবলে। সে নওরোজীকে ভালবাসে। তার ভালবাসার দুর্গতি আজ সে দেখবে। নওরোজীর ছিন্নমুণ্ড এনে তাকে আজ উপহার দেব। তারপর….হাঃ হাঃ হাঃ….বন্ধুগণ তোমাদের সামনেই সে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে।”

রুস্তমজী ললাটের স্বেদধারা মুছে ফেলেন। মৃদু গুঞ্জনে ঘরখানি ভরে উঠল।

তিনি তখন আবার বলতে আরম্ভ করলেন :

”আলিভাই এখন আনন্দ করবার সময় নয়, এখনও আমাদের অনেক কাজ বাকী রয়েছে। আমাকে কাল আবার কলকাতায় চলে যেতে হচ্ছে। কৃষ্ণা নামে যে মেয়েটিকে আমি এখানে এনে উল্টো ট্যাঁকে গুঁজে তিনটে পাক দিয়ে ঘুরিয়ে দিলুম, তাকে কাল পৌঁছে দেওয়ার কথা আর তাকে এখানে আমি রাখতে চাচ্ছিনে। মেয়েটা অত্যন্ত তীক্ষ্নবুদ্ধি, আমি সন্দেহ করছি জনির কাছে সে অনেক কিছু খবর পেয়েছে। রাবেয়া যেদিন তার বাপের কাগজপত্র তার হাতে দিতে যায়, আমাদের লোকই সেদিন একটা ভীষণ কাণ্ড করে মিস রাবেয়াকে অচৈতন্যাবস্থায় এখানে নিয়ে আসে। আমরা আশঙ্কা করি সুযোগ পেলেই মিস রাবেয়া সব কথা ব্যক্ত করে দেবে, কারণ নওরোজীর সঙ্গে তার ভালবাসা, তার কাছ থেকে কিছু আর তার জানতে বাকী নেই। আমি কৃষ্ণাদেবীকে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে রাবেয়াকে নিয়ে আমেরিকা চলে যাচ্ছি। কারণ-”

”আর সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হল না রুস্তমজী-” বলতে বলতে সদলবলে উদ্যত রিভলভার হস্তে সদর্পে দরজার পরদা সরিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন নারায়ণ রাও।

ঘরের মধ্যে হঠাৎ পুলিশের আবির্ভাবে ওরা প্রথমটায় হতচকিত হয়ে যায়। পরক্ষণেই আলিভাই চীৎকার করে ওঠে, ”বন্ধুগণ হাতিয়ার নাও, লড়তে হবে।”

কঠোর কণ্ঠে নারায়ণ রাও বললেন, ”আর লড়তে হবে না। আমাদের দলটা অনেক ভারী। রিভলভার নামাও আলিভাই, গুলি ছুঁড়লেও তোমাদের নিস্তার নেই, পাঁচশো পুলিশ এবাড়ী ঘিরে ফেলেছে। এইবার লক্ষ্মীছেলের মত হাত তুলে দাঁড়াও দেখি সবাই।”

সবাই তখন বিবর্ণমুখে হাত তুলে দাঁড়ালো।

তারপরই পড়লো সব হাতে হাতকড়া, এমনই সময় সশস্ত্র পুলিশ-পরিবেষ্টিত শীর্ণ রাবেয়াকে নিয়ে কৃষ্ণা এসে পৌঁছলো। চোখ দুটো তার কোটরে ঢুকে গেছে। সারা দেহ কালিবর্ণ।

চোদ্দ. ঘটকালি

থানায় যেতেই ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কৃষ্ণার।

নারায়ণ রাও সাদরে অভ্যর্থনা করলেন, ”আসুন, আসুন, আপনার সব কেসের কিনারা হয়ে গেছে ব্যোমকেশবাবু। ব্যাঙ্ক লুটের অপরাধীকেও আপনি এখানে পাবেন।”

ব্যোমকেশবাবু বিস্মিতমুখে বললেন, ”কি ব্যাপার বলুন তো? আপনাদের নির্দ্দেশে কলকাতায় স্যর আদমজীর বাড়ী ঘেরাও করে যমুনাবাই চাকর বাকর সকলকেই গ্রেপ্তার করে এখানে পাঠানো হয়েছে খবর পেলাম। ব্যাপার কি?”

নারায়ণ রাও কৃষ্ণাকে দেখিয়ে বললেন, ”আমি গুছিয়ে বলতে পারবো না ব্যোমকেশবাবু, আপনি কৃষ্ণা দেবীর কাছেই শুনুন, সব কথা! সত্যি কথা বলতে কি, এঁর জন্যেই আজ এই সব অপরাধী ধরা পড়েছে, নইলে কিছুই হতো না ব্যোমকেশবাবু!”

কৃষ্ণা বলে চলে, ”এই বিরাট দলটি বহুকাল থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বহু বে-আইনী কাজ করে চলেছিল কাকাবাবু। বেপরোয়াভাবে এরা বে-আইনী কাজ করেছে, খুন, চুরি, ডাকাতি এসব এদের নিত্যকার ব্যাপার। দীর্ঘকাল এদের কেউ ধরতে পারেনি; বাধাও এরা পায়নি কোন স্থানে।

স্যর আদমজী মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান ছিলেন, বাংলায় একটা রেলপথের কন্ট্রাক্ট নিয়ে ইনি প্রচুর বিত্তশালী হন। বোম্বাইতে এঁর বহু কারবার, নিজের দুইটি ব্যাঙ্ক, কলকাতাতেও বিরাট কারবার, অফিসে কয়টি জুট মিল, তা ছাড়া প্রায় পনেরো কুড়িটা কটন মিল, এই আদমজীর নিজের প্রতিষ্ঠিত। তিনি এখানে বিবাহ করেন নি। লণ্ডনে বিবাহ করেন এবং ইয়র্কশায়ারে একখানি বাড়ী কিনেছিলেন। স্ত্রী এবং পুত্রকে দু’একবার বোম্বাইতে এনেছিলেন, বড় হয়ে পুত্র নওরোজী আর আসেননি, লণ্ডনে একটা বোর্ডিংয়ে থেকে পড়তেন। আদমজী বৎসরে দু’তিনবার বিলাতে যেতেন এবং তাঁর প্রধান সহকারী-রূপে আলিভাই ও তাঁর সহকর্ম্মী রুস্তমজী ভারতের বোম্বাই ও কলকাতায় কাজ চালাতেন। নিজেরাই এই সব সম্পত্তির মালিক হবেন এই আশায় অন্ধ হয়ে আলিভাই তাঁর শ্যালক ডি-সুজাকে দিয়ে স্যর আদমজীকে হত্যা করান। ডি-সুজার সঙ্গে আদমজীর অনেকটা সাদৃশ্য ছিল। হত্যার পরে ডি-সুজা স্যর আদমজীর বেশে বাড়ী যান এবং স্ত্রীকে জানান এই মুহূর্তে তাঁকে আমেরিকা যেতে হচ্ছে। বেশীক্ষণ মিসেস আদমজীর সামনে থাকলেই ধরা পড়ে যাবেন এই ভয়ে তিনি ছয়মাসের মত আমেরিকায় চলে যান। ইতিমধ্যে তাঁর খানসামারূপী গোলাম মহম্মদ শ্লো পয়জন করে মিসেস আদমজীকে হত্যা করে। লণ্ডনে গিয়েও সে নওরোজীর পানীয় জলে বিষ মিশায়। সে জল পান করে অন্য একটি ছেলে মারা যায়।

এরা জানতো নওরোজী মারা গেছেন। এদিকে ডি-সুজাও ফিরে আসেন স্যর আদমজীর বেশেই। কন্যা রাবেয়াকে এখানে বোর্ডিংয়ে আলিভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে সস্ত্রীক কলকাতায় যান। আলিভাই এবং রুস্তমজী রাবেয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলেন, তাঁদের ভয়ে বাধ্য হয়েই ডি-সুজাকে রাবেয়ার সঙ্গে রুস্তমের বিবাহে মত দিতে হয়,অথচ রাবেয়া এ কথা জানতো না। রাবেয়ার মায়ের বিয়েতে মত ছিল না, সেজন্য তাঁকে হত্যা করা হল। গোলমাল হয়নি, সন্দেহ হলেও সাহস করে কেউ কোন কথা বলতে পারেনি। স্ত্রীর হত্যা দাঁড়িয়ে দেখলেন ডি-সুজা। তারপর তিনি কি রকম হয়ে গেলেন। দুর্ব্বৃত্তের হাতে মেয়ে দিতে বেঁকে বসলেন। সেইজন্য একদিন রাত দুপুরে লেকের ধারে নিয়ে গিয়ে গোলাম মহম্মদের দল সম্ভবতঃ গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করে এবং মৃতদেহ গাছে এমনভাবে ঝুলিয়ে দেয় যাতে যে কোন লোক জানবে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এ কথা সত্য ডি-সুজার মনে শান্তি ছিল না, সর্ব্বদা ভয়ে ভয়ে তিনি দিন কাটাতেন। পাছে তিনি কিছু প্রকাশ করে ফেলেন এই ভয়ে আলিভাই তার রক্ষিতা যমুনাবাইকে টাইপিষ্টরূপে তাঁর কাছে পাহারায় রেখেছিল।

তাঁর মৃত্যুর পরে রাবেয়াকে টেলিগ্রাম করে নিয়ে আসা হয়। তারপর রাবেয়া যে রাত্রে ভয় পায় এবং সে ও আমি আক্রান্ত হই, সেদিন রাবেয়া ডি-সুজার কাছে এদের যা চিঠি পত্র, নওরোজীর চিঠি সবই আমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। সেদিনই তাকে অচৈতন্যাবস্থায় এই যমুনাবাই লোকজন দিয়ে বোম্বাইতে পাঠিয়ে দেয়। নিজেকে নির্দ্দোষ প্রতিপন্ন করবার জন্যেই রুস্তমজী রাবেয়ার অনুসন্ধানের ভার আমার উপর দেয়। তার ধারণা ছিল যে, আমি যতক্ষণ কলকাতায় বা কলকাতার আশেপাশে তাকে খুঁজব, ততক্ষণ সে তাকে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে যাবে এবং কিছুদিন পরে দম্পতিরূপে ফিরে এসে যথানিয়মে কাজকর্ম্ম করবে।

ভগবানের কৃপায় আমি ওদের রহস্যজাল উন্মুক্ত করতে পেরেছি। আমাকে সাহায্য করেছে রুক্মিণী, জনি আর সবচেয়ে বেশী মিঃ নওরোজী। মূল অপরাধী আলিভাই; তারই প্ল্যানমত দীর্ঘকাল ধরে এই সব কাজ চলছে। গোলাম মহম্মদের মত দুর্দ্দান্ত লোককে সে প্রচুর অর্থ দিয়ে পায়ের গোলাম করে রেখেছিল। আমাকে জানে বলেই রুস্তমজী আমাকে প্রথমে বোম্বাই আনতে চায় নি; বলতে গেলে আমি জোর করেই এসেছি। এখানে এসে জনিকে না পেলে আমি কোন খবরই পেতাম না এবং পাছে সে আমায় কিছু বলে এজন্য আলিভাই আমি আসার পরই জনিকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।

এই দলের লোকেরা আমায় চিনলেও এরা আমার কোন অনিষ্ট করতে সাহস করেনি। তাদের কাছে থেকে আমি যে তাদেরই বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করছি, সেটা হয়তো তারা সন্দেহ করেছিল তাই তাড়াতাড়ি আমায় কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করছিল। জানি না আমাকে সে রকম বুঝলে হত্যাও করত। আমি সব সময়ে সাবধানে ওদের মন জুগিয়ে চলেছি বলে ওরা আমার কার্য্যকলাপ বুঝতে পারেনি।” কৃষ্ণা হাসে।

ব্যোমকেশবাবু প্রশংসার দৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”এবার তাহলে কলকাতায় ফেরা যাক, কি বলো?”

মৃদু হেসে কৃষ্ণা বললো, ”যেতে তো ইচ্ছা ছিল কাকাবাবু; কিন্তু রাবেয়ার বিয়েটা না দেখে কি করে যাই বলুন? আপনি বরং ব্যাঙ্ক লুঠের অপরাধীদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। আমি দু-চার দিন পরে আসছি।”

এই বলে একটু চুপ করে থেকে আবার বললো কৃষ্ণা-”তবে তার হয়তো দরকারও হবে না। গোলাম মহম্মদ আর তার সঙ্গীরা কেবল কলকাতার একটি ব্যাঙ্কই লুঠ করেনি, উপস্থিত আরও যে সব অপরাধ করেছে, সব একসঙ্গে মিলিয়েই বিচার হবে-কাজেই প্রাথমিক সাক্ষ্যের জন্যে আপনিও কয়েকটা দিন এখানে থেকে গেলেই ভাল হয়।”

ব্যোমকেশবাবু হেসে বলেন, ”নিমন্ত্রণগুলি আমার বাদ যাবে নাকি তাহলে?”

কৃষ্ণা হেসে বললো, ”নিশ্চয়ই নয়। এ বিয়ের ঘটকালীও আমিই করেছি।”

বিবাহের নিমন্ত্রণের নামে ব্যোমকেশবাবু পুলকিত হয়ে ওঠেন।

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। পরদিন মহাধূমধামে নওরোজীর সঙ্গে রাবেয়ার বিবাহ ব্যাপারে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন শহরের গণ্যমান্য ভদ্র সম্প্রদায়, মিস জোহরী, মরিয়ম, হোষ্টেলের মেয়েরা।

এসেছিল জনি, তার মাসীমা এবং পিতা। তার জন্যই পিতাকে কৃষ্ণা কোন অপরাধের মধ্যেই জড়ায়নি। অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করায় উদার হৃদয় নওরোজী নিজের কাজেই তাকে বহাল রাখলেন এবং জনির সমস্ত ভার গ্রহণ করলেন।

অপরাধীদের উপযুক্ত দণ্ড হল, তারপর কৃষ্ণা বিদায় চাইলে রাবেয়া ও নওরোজীর কাছে।

রাবেয়া সজলচোখে তার হাত দুখানা ধরে বললে, ”আমি যখন কলকাতায় যাব, আপনাকে খবর দিলে আপনি নিশ্চয়ই আসবেন তো কৃষ্ণাদেবী?”

কৃষ্ণা কথা দিলে, ”হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসব।”

নওরোজী আর্দ্রকণ্ঠে বললেন, ”আমাদের ভুলবেন না কৃষ্ণাদেবী, মনে রাখবেন।”

কৃষ্ণা বললে, ”নিশ্চয়ই মনে থাকবে মিঃ নওরোজী, কলকাতায় আপনারা গেলেই আমার দেখা পাবেন।”

সকলের কাছে বিদায় নিয়ে কৃষ্ণা প্লেনে উঠলো কাকাবাবুর সঙ্গে!

এরোড্রমে দাঁড়িয়ে রইলেন নওরোজী, রাবেয়া এবং বালক জনি। রুমাল উড়িয়ে তারা তাকে বিদায় অভিনন্দন জানালো।

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *