১০. মুক্তি-পথে কৃষ্ণা

মুক্তি-পথে কৃষ্ণা

এক – পত্র

পাশের ঘরে জোর তর্ক চলেছে-সেই সঙ্গে চেয়ার-টেবিল চাপড়ে খুব চড়া-গলায় প্রণবেশের উত্তেজিত চীৎকার।

এর সঙ্গে সমানে তাল রেখে চলেছে ভোর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি। বেলা দশটা-বৃষ্টির এতটুকু বিরাম নেই, বিচ্ছেদ নেই।

বৃষ্টির শব্দ আর ঐ তর্ক-চেঁচামেচি-মনে হচ্ছে, পৃথিবী বুঝি এবার ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। এ হট্টগোলে মানুষ কখনো পরীক্ষার পড়া পড়তে পারে?

কৃষ্ণা পারলো না। পাশের ঘরে বসে সে পড়ছিল-বই বন্ধ করে ও-ঘরের দরজার পর্দ্দা একটু সরিয়ে ভিতরে আসতে আসতে কৃষ্ণা বললে, ”তোমরা পাগল হয়ে গেছ মামাবাবু। সমানে চীৎকার চ্যাঁচামেচি চালিয়েছ। যদি বৃষ্টি না হতো, আমি নিশ্চয় ছাদে চলে যেতুম!”

প্রণবেশ আশ্চর্য্য রকম শান্ত হয়ে যান। সুজনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নীচে পথে এক-হাঁটু জমা জলের পানে তিনি তাকিয়ে থাকেন।

সুজন পুলিশে কাজ করে। আসামে এক জরুরি কাজে ঘুরে প্রায় চার বৎসর পরে সে ফিরেছে বাংলা দেশে। কলকাতায় কাল এসেছে, আজ বাড়ী যাবার কথা। কৃষ্ণনগরে বাড়ী। কিন্তু ভোর থেকে যে-রকম বৃষ্টি নেমেছে, এতে কুকুর-বেড়ালটা পর্য্যন্ত বেরুতে পারে না, তা মানুষ! সুতরাং তার যাওয়ার সম্ভাবনা আজ নেই।

সুজন বললে, ”কি করি বল কৃষ্ণা, তোমার মামার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তর্ক বাধবে! এ শুধু আজ নয়, চিরকাল। স্কুল-কলেজে একসঙ্গে পড়েছি, তখন থেকে এই একই ধারা চলে আসছে! আজ তর্কটা দ্যাখো না, অতি তুচ্ছ এক বিষয় নিয়ে! তাতে প্রণবেশ এতটা ক্ষেপে উঠবে-এমন চীৎকার করবে-যাতে তোমার পড়া পর্য্যন্ত নষ্ট! তোমায় উঠে আসতে হলো!”

সে খুব অপ্রতিভ। কৃষ্ণা তার মুখের পানে চেয়ে একটু হেসে বললে, ”না, পড়ার জন্য এমন কিছু হয়নি সুজন মামা। সেদিক দিয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। মামার গলার আওয়াজ এমনিতেই চড়া কি না, আস্তে কথা বললেও মনে হয়, যেন ঢাকে কাঠি পড়ছে!”

গোঁ-গোঁ করেন প্রণবেশ, ”যা-তা বল না কৃষ্ণা! তুমি আমায় অপমান করতে চাও!”

”অপমান!”

হাসতে যায় কৃষ্ণা, কিন্তু হাসি দেখলে প্রণবেশ আরো ক্ষেপে উঠবেন! এবং ক্ষেপে এই বৃষ্টি মাথায় করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেও পারেন।

কৃষ্ণা করুণ কণ্ঠে বললে, ”তা নয় মামাবাবু, বিশ্বাস করো। তোমায় আমি অপমান করব-এ-কথা তুমি স্বপ্নেও মনে করো না। আর এ-সময়ে পড়েই বা কি করব, দশটা বেজে গেছে। যে বৃষ্টি, তাতে কলেজে যেতে পারব, সে-আশাও নেই।”

বলতে বলতে সে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো; বললে, ”তবে একটা কথা সুজন মামা, আজকের দিনে ইলিশ মাছ যদি পাওয়া যেত-সত্যি, কি আরামই না হতো! বনমালীর বয়স হয়েছে, এই জলে সে বাজারে যেতে চাইলেও বিবেক বলে কিছু আছে তো-তাই তাকে পাঠাতে পারলুম না।”

প্রণবেশ ফিরে বসলেন, বললে, ”বনমালীকেই যে যেতে হবে তার কি মানে! আমায় দিলে আমিও আনতে পারি!”

কৃষ্ণা ধমক দেয়, ”হ্যাঁ, তুমি যাবে বৈকি? এই বৃষ্টি, পথে জল, এর মধ্যে তোমায় পাঠিয়ে দিই, তারপর অসুখ-বিসুখ হলে দেখবে কে, শুনি? ইলিশ মাছের কথা থাক, সুজন মামাকে আমি ততক্ষণ বরং একটা জিনিষ দেখাই।”

নিজের ঘরে ফিরে এসে ড্রয়ার খুলে একখানা এনভেলপে বন্ধ চিঠি নিয়ে সে এ-ঘরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বললে, ”কাল কলেজ থেকে ফিরে সন্ধ্যার সময় এই চিঠি পেয়েছি, সুজন মামা-কাল রাত্রে আপনারা সিনেমায় গেলেন, তাই এ চিঠি দেখাবার সময় পাইনি।”

”কার চিঠি?”

প্রণবেশ রীতিমত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন-”ধর, যদি সুজন আসাম থেকে কাল না আসত, তা হলে তোমায় যেতে হতো ব্যোমকেশ বাবুর কাছে! তিনি যা বুঝতেন, তাই নিয়ে তোমায় কাজ চালাতে হতো। ভুল হলেও মেনে নিতে হবে-ঠিক যদি হয়, তাহলে ত আর কথাই নেই। আমার শুধু দুঃখ হয় কৃষ্ণা, একে-তাকে তুমি ডাক তোমার কাজে সহায় হতে-কিন্তু আমাকে কখনো কিছু বল না!”

প্রণবেশের মুখখানা করুণ হয়ে ওঠে। সে-মুখের পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা হাসি সামলাতে পারে না। সে তাই অকারণে কাশতে সুরু করে।

ব্যাপারটা সুজন বুঝেছে। সে বললে, ”সত্যি, তোমার অত্যন্ত অন্যায় কৃষ্ণা, প্রণবেশ তোমার মামা-তাছাড়া তাঁরও যথেষ্ট বুদ্ধি, ব্যোমকেশবাবুকে জানাবার আগে প্রণবেশকে জানান উচিত। যাই হোক, চিঠিখানা দেখা যাক। সরে এস হে প্রণবেশ, দুজনে মিলে একসঙ্গেই চিঠিখানা পড়া যাক।”

মাত্র ক’টা লাইনের চিঠি। নীচে কোন নাম নেই। চিঠিতে লেখা আছে-

”সুচেৎ সিং যাচ্ছে কলকাতায়, তার সঙ্গে আছে আউলিং আর লছমী। এরা সুন্দরলালের মৃত্যুর শোধ নেবেই-এদের পণ! আপনাকে চিনি বলেই সাবধান করছি, সতর্ক হবেন। খিদিরপুরে লক্ষ্য রাখবেন। এরা কোথায় যাচ্ছে আর কোথায় আশ্রয় নেবে, আপনি জানেন। যেখানে সুন্দরলালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল-”

 ইতি-

সুজন মুখ তোলে, বলে, ”তোমার চিঠির মর্ম্ম তুমিই বোঝ কৃষ্ণা, আমি এর বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছিনে। সুন্দরলাল কে, আর কি কারণেই বা তার মৃত্যু হয়েছিল, তা শুনতে পাব?”

প্রণবেশ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন, ”সুন্দরলাল ছিল এক ডাকাত-দলের সর্দ্দার। আমাদের এই বাংলা দেশে অনেকগুলো ডাকাতি খুন করে পালিয়েছিল বেহারে। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে এখানে আনা হয়-আলিপুরে তার বিচার হয়।”

কৃষ্ণা বললে, ”আর এই মামলার ভার কিছুটা আমার হাতে ছিল, সুজন মামা। সুন্দরলালের এক মেয়ে ছিল লছমী। এই মেয়েকে এখন দলের পাণ্ডা বলা চলে। একে ধরবার জন্য আমি বড় কম চেষ্টা করিনি। ধরেও ছিলুম, কিন্তু কি আশ্চর্য্য ভাবে সে পালাল, বুঝতে পারলুম না!”

প্রণবেশ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ”আশ্চর্য্য ভাবে আবার কি! তাকে পালাবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তাই সে পালাল। এ-কথা বলতে তোমার বাধছে, বুঝি?”

সুজন বললে ”থাক, নাইবার-খাবার দেরী হবে-খেয়ে-দেয়ে তখন এ-কথা হবে। মনে হয়, বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে যাবে।”

প্রণবেশ বললেন, ”ধরলেও আজ যে তুমি কৃষ্ণনগরে যেতে পারবে, সে-আশা করোনা সুজন। দেখছ তো, লছমী সুচেৎ আসছে। তাদের সঙ্গে আছে সুন্দরলালের ডান হাত আউলিং। হয়ত তারা এসে পড়েছে। এলে তারা যে শান্ত ভাবে থাকবে, স্বপ্নেও ভেব না। আর দু-একদিন থেকে তারপর তুমি কৃষ্ণনগরে যেয়ো সুজন।”

সুজন হাসল।

লছমী, সুচেৎ সিং আর আউলিংয়ের নাম শুনে প্রণবেশ যে বিলক্ষণ ভীত হয়েছেন, তা বোঝা গেল।

সুজন বললে, ”মাভ্যৈঃ-দেখা যাক।”

দুই – অতীতের কাহিনী

খুব বেশী দিনের নয়-তিন বছর আগেকার কথা।

সুন্দরলাল থাকত বড়বাজারে। সেখানকার মস্ত কারবারী মানুষ। শোনা যায়, প্রথম যখন সে দিল্লী থেকে বাংলা-মল্লুকে আসে, তখন হাতে ছিল একটি লোটা, পরণে মোটা একখানা ধুতি, গায়ে একটি ফতুয়া। পথে পথে কতদিন এমনি ঘুরে বেড়িয়েছে-তারপর হয় ফেরিওয়ালা।

এখন সে বড়বাজারের একজন নাম-করা ব্যাপারী-সুন্দরলাল সিংয়ের নাম করলে কলকাতার অনেক লোকই তাকে চিনবে।

লোকে বলে-আঙুল ফুলে কলাগাছ! সুন্দরলালের অদৃষ্ট তাই হয়েছিল। কি ভাবে সুন্দরলাল ক’বছরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হলো, মস্ত বড় গদীয়ান ব্যবসায়ী হলো, বাড়ী গাড়ী করে ফেলল, সে-ইতিহাস কেউ জানতে পারল না। একমাত্র কন্যাকে দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল সে অনেক আগেই। কন্যা লছমীকে বেথুনে ভর্ত্তি করে দেয়। লছমী মেয়েটির বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল ভালো, লেখাপড়ায় ঝোঁকও তেমনি-বেথুনে সেজন্য তার নাম হয়েছিল বেশ।

একদিন যাকে ফুটপাথের ধারে পড়ে থাকতে দেখা গেছে, হঠাৎ তার এ ভাগ্য পরিবর্ত্তন অনেকেই লক্ষ্য করেছিল। কারো কারো বেশ হিংসাও হয়েছিল। কিন্তু তাতে সুন্দরলালের ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটেনি। ক্লাইভ স্ট্রীটে তার মস্ত বড় অফিস-কত লোক সেখানে কাজ করে-আমদানী-রপ্তানীর পাই-পয়সার হিসাব রাখা হয়। কলকাতাতেই কত জায়গায় তার কত-রকম কারবার চলেছে। যাতে হাত দেয়, তাতেই ফেঁপে ওঠে! এক কথায় ধুলো মুঠো ধরলে সোনা-মুঠো হয়।

হঠাৎ ধরা পড়ে গেল। তার কার্য্যকলাপ জানা গেল। সুন্দরলাল যে আমদানী-রপ্তানীর কাজ করে-তা সম্পূর্ণ বে-আইনী! কোকেন এবং আফিংয়ের চোরা ব্যবসা সে খাশা চালায়। শুধু তাই নয়, তার একটা মস্ত দল আছে-দলের লোকেরা তার নির্দ্দেশে জীবন পর্য্যন্ত দিতে পারে! সারা ভারতবর্ষে-কুমারিকা থেকে হিমাচল পর্য্যন্ত তাদের সীমানা। এ-দলের লোকেরা না পারে, এমন কাজ নেই। যেখানে সেখানে কাজ করে ফিরে তারা ফিরে আসে কলকাতায় হেড অফিসে ক্লাইভ স্ট্রীটে। সাধারণ ব্যবসায়ী হিসাবে তারা যাতায়াত করে, কোন দিন তাদের উপর কারো এতটুকু অবিশ্বাস বা সন্দেহ হয় না।

এত হুঁশিয়ারী সত্ত্বেও ধরা পড়ে গেল শুধু মেয়ে লছমীর বেহুঁশিয়ারীতে।

সুন্দরী শিক্ষিতা মেয়ে লছমী-হঠাৎ একদিন কৃষ্ণার সঙ্গে হয় তার পরিচয় এবং সেই পরিচয় ক্রমে বন্ধুত্বে দাঁড়ায়। কৃষ্ণার আসল পরিচয় লছমী জানত না। কলেজের ছাত্রী রূপেই শুধু জানত তাকে।

এ-সন্ধান ব্যোমকেশবাবু কৃষ্ণাকে বলে দিয়েছিলেন এবং সেই কারণেই কৃষ্ণা গায়ে পড়ে লছমীর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তুলেছিল।

দলটির আসল পরিচয় কৃষ্ণা পুলিশকে জানায়। তার-কথায় নির্ভর করে পুলিশ সন্ধান করে এবং উপযুক্ত প্রমাণ সমেত সুন্দরলালকে গ্রেপ্তার করতে যায়।

রীতিমত লড়াই চলে। গুলিতে দু’তিনজন পুলিশের লোককে ঘায়েল করে সুন্দরলাল পলায়ন করেছিল বেহারে। অতি অল্পের জন্য কৃষ্ণা সে-সময় বেঁচে গেছে। সুন্দরলাল গ্রেপ্তার হয়। আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী ছিল কৃষ্ণা এবং একমাত্র তার সাক্ষ্যেই জানা গিয়েছিল সুন্দরলাল ছাড়া এ-খুন আর কেউ করেনি।

ফাঁসির দড়িতে ঝোলবার আগে সুন্দরলাল শাসিয়ে যায়-সে গেলেও লছমী আর অনুচররা রইল। সুন্দরলালের এ ফাঁসির শোধ তারা নেবে।

তারপর তিন বৎসর কেটে গেছে।

এতদিনের মধ্যে সুচেৎ সিং বা লছমীর কোন খবর পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর ঘটনার প্রবাহে সেদিনকার কথা কৃষ্ণার মন থেকে মিলিয়ে গেছে।

হঠাৎ এই চিঠি পেয়ে কৃষ্ণা অত্যন্ত চিন্তিত হয়েছে। কাল রাত্রে চিঠিখানা দেখাবার ইচ্ছা থাকলেও দেখান হয়নি।

সুজন পুলিশের লোক, অনেকটা বোঝে, অন্ততঃ ব্যোমকেশ বাবুর চেয়েও তাঁর বুদ্ধি এবং জ্ঞান অনেক বেশী বলে কৃষ্ণার বিশ্বাস। আর প্রণবেশ?

প্রণবেশকে বলা আর বনমালীকে বলা-সমান। দুজনেই বিপদের ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। কল্পনায় প্রণবেশ আরও অনেক-কিছু গড়ে তোলেন তাঁর শিক্ষার সহায়তায়; বনমালী অবশ্য তা পারে না।

সুজন চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ”চিঠিখানা লিখল কে? নাম নেই তো!”

শঙ্কিত-কণ্ঠে প্রণবেশ বললেন, ”ওরাই কেউ লিখেছে নিশ্চয়। সেকালের বিশে ডাকাতের গল্প জান ত? অকস্মাৎ বাড়ী বয়ে ডাকাতি করতে বিশে লজ্জা বোধ করত। তাই চিঠি লিখে বীরের মত যেত। এই সুচেৎ সিং আর লছমী বিশে ডাকাতের চেয়ে বীরত্বে কম যায় না-

তার প্রমাণ এই চিঠি! নাহলে ভাব, যদি কোন হিতৈষী বন্ধু লিখত, তাহলে নাম গোপন করবার দরকার থাকবে কেন তার?”

বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”তুমি থামো মামাবাবু। বিশে ডাকাতের যুগ এ নয়, এ-কথাটা আগে মনে রেখ। তখনকার দিনের অস্ত্র ছিল লাঠি। একগাছা লাঠি হাতে সেকালের ডাকাতরা দিগ্বিজয় করে আসত। তারপর এখনকার মত তখন শাসন-শৃঙ্খলা ছিল না, যার যা খুশী, শক্তি-সাহসের জোরে করে যেত। কিন্তু এখনকার দিনে চিঠি লিখে দিন-ক্ষণ ঠিক করে কোন ডাকাত আসতে সাহস করবে না- মনে রেখ। দেখুন না সুজন মামা, চিঠিখানায় পোষ্ট অফিসের ছাপটা দেখুন আগে।”

সুজন এনভেলাপটা নেড়ে-চেড়ে ভালো করে দেখে- একটা ছাপ পড়েছে কলকাতারই, আর আর-একটা কোথাকার, বোঝা গেল না।

কৃষ্ণা বললে, ”তারপর দেখুন-চিঠিখানা মেয়েলি হাতের লেখা- পুরুষের হাতের লেখা নয়-এ কথা আমি জোর করে বলতে পারি। আপনি না বলতে পারেন, আমি বলব-এ-চিঠি আসছে বেলতলা রোড থেকে। দেখুন না, যে প্যাডের কাগজে চিঠি লেখা, তাতে উপরে ডান দিকে নম্বর লেখা ছিল। সেটা এত কাটকুট করা হয়েছে, কিছুতেই বোঝা যায় না। আমি ম্যাগনিফাইং-গ্লাস দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে এটুকু বুঝেছি। এখান থেকেই এ-চিঠি পোষ্ট হয়েছে।”

সুজন গ্লাস নিয়ে পরীক্ষা করে।

অপ্রসন্ন মুখে প্রণবেশ বললেন, ”হ্যাঁ, বেলতলা রোড থেকে চিঠি লিখেছে-খিদিরপুরের কথা জানিয়েছে। মনে করে দেখ। ওখানে তোমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব কে আছে, পার ত বৃষ্টি ধরলে সেখানে একবার যেয়ো। আমি চললাম বাজারে। বৃষ্টি কমেছে। দেখি, যদি ইলিশ মাছের সন্ধান পাওয়া যায়।”

প্রণবেশ উঠে দাঁড়ান।

সুজন বাধা দেয়, ”ক্ষেপেছো প্রণব! পথে হাঁটু-ভোর জল ভেঙ্গে তুমি যাবে বাজারে ইলিশ মাছের সন্ধানে! আমি বলছি, এ-বৃষ্টিতে বাজার জনশূন্য। না এসেছে মাছ, না এসেছে তরী-তরকারী। তার চেয়ে ঘরে বসে গল্প কর, গান গাও, রাজা-উজির মার-সে হাজার গুণে ভাল হবে।”

কৃষ্ণা রাগ করে, ”ওই ত মজা, মামাবাবুর মাথায় কোন কথা একবার জাগলে হয়, তখন ধরে আনতে বললে বেঁধে নিয়ে আসবেন। আপনি এবার যাওয়ার সময় আমার মামাবাবুটিকে অন্ততঃপক্ষে মাসখানেকের জন্য সঙ্গে নিয়ে যাবেন সুজন মামা। বেশী দিন নয়-সাত দিন রাখলেই বুঝবেন, মানুষটি কি রকম!”

প্রণবেশ বিরক্ত কণ্ঠে কি বলতে গিয়ে কৃষ্ণার গম্ভীর মুখখানার পানে তাকিয়ে থেমে যান-এ সম্বন্ধে আর একটি কথা বলার সাহস হয় না তাঁর।

তিন – সিনেমা-হাউস

সুজন বললে, ”আজ যখন আমার থাকতেই হলো কলকাতায়, চল, আজ একটা সিনেমায় যাওয়া যাক। শুনেছি, মেট্রোয় খুব ভালো একখানা বই এসেছে, দেখে আসা যাক।”

অত্যন্ত খুশী হয়ে ওঠেন প্রণবেশ। নূতন এই বইখানা দেখবার জন্য তাঁর ভারী ইচ্ছা ছিল। কৃষ্ণার কাছে কথাটা তোলবামাত্র সে তীব্রকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে, ”আমার সম্পূর্ণ অমত, মামা। পয়সা যদি দেবেন, আমাদের দেশী হলে ছবি দেখুন গিয়ে। তাতে দেশের পয়সা দেশে থাকবে, বিদেশীর পকেটে যাবে না।”

নাম-করা বই গুড আর্থ-এ-কথা তিনি বোঝাতে পারেননি কৃষ্ণাকে।

আজ সুজন বললেও কৃষ্ণা প্রথমে আপত্তি তুলেছিল; শেষে সুজনের কথা তাকে রাখতে হলো।

তৃতীয় শোতে যাওয়ার ব্যবস্থা হলো-বেচারা রাঁধুনি মানদার জন্য। সন্ধ্যার পরই আহারাদি সেরে নিলে ছুটি পায়, নচেৎ তাকে অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

মেট্রোয় গুড আর্থ।

নাম-করা বই এবং বহুদিন ধরে এই ফিলমটির পাবলিশিটি চলেছে। সব সিট আজ ক’দিন ধরে বুক করা থাকা সত্ত্বেও সুজন যে কি ভাবে তিনখানি সিট সংগ্রহ করেছে-দেখে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হয়ে যায়।

সিনেমার সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে সুজন বললে, ”তোমরা একটু অপেক্ষা কর-আমি আসছি।”

সে সিনেমা হলে ঢুকলো।

প্রণবেশ অস্বস্তিকর ভাবে খানিক নড়াচড়া করে বললেন, ”ভয়ানক গরম। আমি একটু নেমে দাঁড়াই।”

অন্য দিককার দরজা খুলে তিনি নেমে পড়লেন।

একে চৌরঙ্গীর মত জায়গা, তার উপর সিনেমা-দর্শকের ভিড়। থার্ড শো হলেও পুলিশ ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে হাঁপিয়ে উঠছে! কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হয়ে ভাবে-দেশের লোক খেতে-পরতে পাচ্ছে না এ-কথা প্রায় পড়ি খবরের কাগজে-নানা পত্রপত্রিকায় চিন্তাশীল প্রবন্ধে। কিন্তু সিনেমার সামনে এলে সে-কথা মোটে বিশ্বাস হয় না।

অকস্মাৎ সে চমকে উঠল!

যেখানে তার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশে চমৎকার একখানা বড় মোটর এসে দাঁড়াল। মোটর থেকে যে-লোকটি নামল, তার মুখখানা আজও সে ভোলেনি-বহুদিন পরে দেখলেও সে বেশ চিনেছে। তবু ভালো করে আবার দেখল, মোটরের মধ্যে কে আছে।

আকাশে ওদিকে নিবিড় মেঘ ঘনিয়ে এসেছে-সেদিকে কৃষ্ণার দৃষ্টি পড়েনি! মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মুহূর্ত্তে চারিদিকে বিশৃঙ্খলা-বিপর্য্যয় ব্যাপার। পথে যারা ছিল, আশ্রয়ের জন্য তারা ছুটল যে যেদিকে পারে। মুহূর্ত্তে উধাও হয়ে গেল সকলে-পাশের মোটরখানাও হর্ণ দিয়ে চলতে সুরু করল।

একটা উগ্র হাসির শব্দ কাণে এল। পাশের মোটরে যেন একটি মেয়েকে দেখতে পাওয়া যায়!

সচকিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণা!

গাড়ী-বারান্দায় দেখল সুজনকে, ট্যাক্সি-ওয়ালাকে সে বারান্দার নীচে ট্যাক্সি আনবার আদেশ দিলে। কিন্তু প্রণবেশ? প্রণবেশ কোথায়? সেই বৃষ্টিধারার মধ্যেও মুখ বাড়িয়ে কৃষ্ণা দেখে, পথে জনপ্রাণী নেই! বৃষ্টির জন্য সকলেই পথ ছেড়ে মাথা বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছে।

অত্যন্ত বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে কৃষ্ণা।

নাঃ, এ-মানুষের যদি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান থাকে! মামাবাবুকে নিয়ে আর চলে না! তাড়াতাড়ি নামবারই বা কি দরকার ছিল? এবং বৃষ্টি আসবামাত্র গাড়ীতে না উঠে অন্যদিকে যাওয়ারই বা মানে কি?

ট্যাক্সি ততক্ষণে গাড়ী-বারান্দার নীচে দাঁড়িয়েছে, ড্রাইভার দরজা খোলবার আগেই কৃষ্ণা নিজে দরজা খুলে গাড়ী থেকে নেমে এলো।

সুজন বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, ”তুমি একা! প্রণবেশ?”

কৃষ্ণা উত্তর দেয়, ”বলছি। আপনি আগে ট্যাক্সি-ওয়ালাকে বিদায় করুন।”

মিটারে ভাড়া দেখে সুজন চালককে তার ভাড়া দিয়ে বিদায় করলে, বললে, ”প্রণব ট্যাক্সিতে ছিল-সে গেল কোথায়?”

বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”খামখেয়ালি মামাকে ত আপনি চেনেন না, সুজন মামা! আপনি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরম লাগছে বলে তিনি নেমে পড়েছেন। একটু আগে দেখলুম, তিনি ট্যাক্সির পাশে পায়চারি করছেন। এর মধ্যে বৃষ্টি এল, কোথায় যে উধাও হয়ে গেলেন, বুঝতে পারছি না?”

চিন্তিতমুখে সুজন বললে, ”দেখত বেকুবি! শো এখনই আরম্ভ হবে, এর মধ্যে গেল কোথায়? যাক এখনও মিনিট পাঁচেক দেরী আছে-দেখা যাক! এর মধ্যে নিশ্চয় ফিরবে। বেশী দূরে যায়নি, কাছেই কোথাও হয়তো-”

কৃষ্ণা বললে, ”মোটর থেকে নামবার কি দরকার ছিল, বুঝিনে!”

একটু হেসে সুজন বললে, ”হয়ত দরকার পড়েছিল! বেরিয়ে আর ফিরতে পারেনি! হঠাৎ বৃষ্টি এসে লোকের ঠেলাঠেলিতে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। আমারও দেরী হলো, সেইজন্যেই ঘটল এই কাণ্ড! হঠাৎ এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। এখানে ডিটেকটিভ-ডিপার্টমেণ্টে কাজ করে-হয়তো চিনতে পারবে-নাম রমেন চ্যাটার্জি।”

”ও-হ্যাঁ, তাকে চিনি।”

কৃষ্ণা বললে, ”কাকাবাবুর সঙ্গে-মানে, ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে তাঁকে দু-চারবার দেখছি, মনে হচ্ছে। তিনিও সিনেমা দেখতে এসেছেন না কি?”

সুজন বললে, ”না, সে এসেছে আসামীর সন্ধানে। এক দাগী আসামীর খোঁজে ফিরছে। ওর ইনফর্ম্মার খবর দিয়েছে, আসামীকে মেট্রোয় ঘুরতে দেখেছে। খুব সম্ভব টিকিট কাটতে এসেছিল এবং ইনফর্ম্মার খোঁজ নিয়েছে, সে চারখানা বালকনির টিকিট কেটেছে এই শোতে। তার কাছে খবর পেয়ে রমেন এসেছে এবং অনেক কষ্টে একখানা বালকনির টিকিটও সংগ্রহ করেছে।”

কৃষ্ণা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললে, ”কি খবর পেলেন তিনি-আসামীরা এসেছে?”

সুজন মাথা নাড়লো, ”এখনও আসেনি, তবে আসবার সময় এখনো যায়নি। হয়তো শো আরম্ভ হলে আসবে। সিট যখন রিজার্ভ করা আছে চিন্তা করবার কারণ তো নেই।”

বৃষ্টির বেগ ততক্ষণে একরকম কমে এসেছে। যারা যেখানে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল, পথে নেমে পড়েছে। বাসে-ট্রামে যে যাতে পারছে, উঠে পড়ছে।

কিন্তু প্রণবেশ? বেচারা প্রণবেশ?

বিবর্ণ মুখে পথের পানে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণা। সিনেমার সামনে দর্শকরা আর নেই, সবাই ভিতরে চলে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে কেবল সুজন আর কৃষ্ণা।

বেশ চিন্তিত ভাবে সুজন বললে, ”তাই তো ব্যাপার কি? কি হলো প্রণবের? কোথাও যদি আশ্রয় নিত, বৃষ্টি থামবার সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়ত। হাজার-হাজার লোক নেমে পড়ল রাস্তায়-সে গেল কোথায়?”

বিদ্যুৎ-চমকের মত কৃষ্ণার মনে জেগে ওঠে-তার ট্যাক্সির পাশে একখানা দামী ঝকঝকে মোটর এসে দাঁড়িয়েছিল, সে গাড়ী থেকে নেমে যে-লোকটি কাউণ্টারের দিকে না গিয়ে সোজা উত্তর দিকে অগ্রসর হলো- তার চোখে গগলস-আঁটা থাকলেও পাশ থেকে মুখ দেখে সুচেৎ সিংকেই মনে পড়ে। আর সে মেয়েটি?

অন্ধকার গাড়ীর মধ্যে তার মুখখানা স্পষ্ট দেখা যায়নি। তবে তার তীক্ষ্ন হাসি কৃষ্ণার পরিচিত।

অপরিচিতের লেখা পত্রের কথা মনে পড়ল। ওরা এসেছে, তিন বৎসর পরে-সুন্দরলালের মৃত্যুর শোধ নিতে লছমী এসেছে তার পিতার অনুচরদের নিয়ে।

ফাঁসির দড়ি গলায় দেওয়ার আগেও সুন্দরলাল শাসিয়েছে, তার মৃত্যুতেই সব শেষ হবে না। রইল লছমী, রইল তার প্রধান সহকর্ম্মী সুচেৎ সিং, রইল তার অনুচরবর্গ; এরা উপযুক্ত প্রতিশোধ নেবেই।

কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে চাপা সুরে সুজন বললে, ”ব্যাপারটা নেহাৎ সোজা মনে হচ্ছে না। তোমার মুখের ভাব দেখে বেশ বুঝছি কৃষ্ণা প্রণবের হঠাৎ নিখোঁজ হওয়াতে আমার মনেও নানা সন্দেহ জাগছে কিন্তু!

হাত তোলে কৃষ্ণা, ”চুপ।”

নীচের ফুটপাথ দিয়ে এক খঞ্জ চীনা বিচিত্র সুরে গান গেয়ে ভিক্ষা চেয়ে চলেছে। তার পাশে-পাশে, চলেছে এক চীনা-তরুণী-হাতে তার সুদৃশ্য একটি ছোট ঝুলি। পয়সা যে যা দিচ্ছে, তার মধ্যে জমছে।

ফুটপাথের ধারে কৃষ্ণার সামনে এসেও খঞ্জচীনা-ভিখারী ভিক্ষা চায়।

কৃষ্ণা দ্বিরুক্তি করে না, হাতের ব্যাগ খুলে একটা দু-আনি বার করে মেয়েটির ঝুলিতে দেয়।

অভিবাদন করে মেয়েটি অগ্রসর হয়ে যায়, পাশে-পাশে লাঠিতে ভর দিয়ে খঞ্জ চীনাও চলতে থাকে।

একাগ্র দৃষ্টিতে কৃষ্ণা তাদের পানে তাকিয়ে থাকে। সুজন কি বলছে, সে-কথা তার কানে আসে না।

হঠাৎ সুজনের আহ্বানে সে চমকে ওঠে!

”তোমার কি হলো কৃষ্ণা, হঠাৎ কথা বলতে-বলতে চুপ করে গেলে? রমেন বাবু এসেছেন, তাঁর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কও!”

”ও!” ফিরে দাঁড়ায় কৃষ্ণা-”নমস্কার মিষ্টার চ্যাটার্জ্জি, সত্যই আমি বড় অন্যমনস্ক হয়ে গেছি! যাক, ফিলম দেখা আজ আমাদের অদৃষ্টে নেই সুজন মামা! চলুন, আমরা খানিকটা এগিয়ে চলি।”

বলতে-বলতে সে হন-হন করে হাঁটতে থাকে! মুখ ফিরিয়ে ডাকে, ”আসুন মিষ্টার চ্যাটার্জ্জি, আপনাকেও আমার দরকার। তাড়াতাড়ি হেঁটে আসুন।”

অদ্ভুত মেয়ে কৃষ্ণা!

সুজন বা রমেন কেউ আশ্চর্য্য হলেন না। কারণ, তাঁরা জানেন কৃষ্ণার প্রকৃতিই এমন! হয়তো এমন কিছু দেখেছে, যা সন্দেহজনক এবং সেইজন্যই সে ছুটেছে।

চীনা-ভিক্ষুকটি সমানে খুঁড়িয়ে চলেছে, কৃষ্ণা এতক্ষণে অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। তার পিছনে আসছে রমেন আর সুজন।

পাশের একটা সরু গলিতে অকস্মাৎ ঢুকে পড়ে খঞ্জ চীনা আর সেই তরুণী মেয়েটি। এত তাড়াতাড়ি তারা অদৃশ্য হয়ে যায়, কৃষ্ণার বিস্ময় সীমাহীন হয়ে ওঠে!

ততক্ষণে সুজন এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। সুজন বললে, ”বুঝেছি, তুমি ওই চীনেম্যানটাকে ফলো করে এসেছো। কিন্তু খোঁড়া লোক এত তাড়াতাড়ি অদৃশ্য হলো কি করে?”

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ”খোঁড়া নয়, সুজন মামা। অনেকক্ষণ থেকে ও-লোকটাকে আমি লক্ষ্য করছি। অবশ্য মেয়েটি তখন ওর কাছে ছিল না।”

রমেন বললেন, ”কিন্তু আসল কথা, এটা গলি নয়, দুখানা বাড়ীর পরেই গলি শেষ হয়ে গেছে। এরা নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো বাড়ীতে ঢুকেছে। খোঁজ করলে এখনই পাওয়া যাবে।”

ম্লান হেসে কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু তা যে আমরা পারবো না, রমেন-বাবু। বিনা-পার্মিশনে কারো বাড়ীতে ঢুকে কাউকে আমরা ধরতে পারিনে, আমাদের সে-অধিকার নেই। তারা কি অপরাধ করেছে তা আমরা জানিনে। বিনা-অপরাধে কাউকে ধরবার অধিকার আমাদের নেই, সে-কথা আপনারাও জানেন।”

একটা নিশ্বাস ফেলে সে ফিরল।

চার – চোখে দেখা

হাঁফাতে-হাঁফাতে এসে পড়েন ব্যোমকেশবাবু-প্রায় চীৎকার করেই বলেন, ”এ কি কথা শুনছি মা, আমাদের প্রণবেশবাবু নাকি ভ্যানিশ! সিনেমা দেখতে গিয়ে একেবারে নিখোঁজ হয়েছেন।

কৃষ্ণা ম্লান হাসি হাসে, বলে, ”বলছি সব কথা। আপনি বসুন কাকাবাবু।”

”বসবো?”

গর্জ্জন করেন ব্যোমকেশবাবু। তিনি বলেন, ”এখন কি বসবার সময় কৃষ্ণা? চায়ের পিপাসায় গলা-বুক শুকিয়ে গেলেও এখন আমার চা খাবার অবকাশ পর্যন্ত নেই। বলো কি-ভীষণ ব্যাপার যে! এতে বুকের রক্ত গরম হয়ে তোলপাড় করছে! কলকাতার মাঝখানে চৌরঙ্গী, সহরের সেরা জায়গা, সেখানে মেট্রোর সামনে থেকে প্রণবেশবাবুর মত মোটা-সোটা মানুষ একেবারে ভ্যানিশ। এ কল্পনা কেউ কোনদিন করতে পেরেছে? কেউ না! অন্ততঃপক্ষে আমি তো নয়ই।”

অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবেই তিনি একখানা আরাম-কেদারায় বসে ঘন-ঘন হাঁফাতে লাগলেন।

-কৃষ্ণা বললে, ”আপনি বড্ড বেশী উত্তেজিত হয়েছেন কাকাবাবু, একটু বিশ্রাম করুন-দম নিন, আমি আসছি।”

ভিতরদিককার দরজা দিয়ে এসে সে পাচিকা মানদাকে চটপট চা করে পাঠাবার কথা বলে আবার ঘরে ফিরে এলো।

ব্যোমকেশবাবুর সামনে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে সে বসল! বসে বললে, ”এবারে আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি কাকাবাবু। আপনি বোধ হয় রমেন বাবুর মুখে শুনছেন এ-খবর?”

ব্যোমকেশ বললেন, ”তাছাড়া আর কি? এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, তুমি তো বাপু, একটিবার আমায় খবর দিতে পারনি। এটা কিন্তু তোমার মোটেই উচিত হয় নি কৃষ্ণা। হতে পারে কর্ম্মক্ষেত্রে তুমি খুব নাম করেছ। আর কেবল বাংলাদেশে নয়, সব দেশেই বেশীর ভাগ লোক তোমায় না দেখলেও তোমার নাম জানে। তবু আমার কথা এই, আমায় একটিবার জানান উচিত ছিল। তোমার মামাকে আমি বহুকাল থেকে চিনি, অনেক দিন একসঙ্গে থেকেছি, চলাফেরা করেছি সেটা নিশ্চয় তোমার জানা আছে।

তাঁর কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে আসে।

কৃষ্ণা শশব্যস্ত হয়ে ওঠে, বলে, ”না, না, আপনি ও-কথা ভাববেন না কাকাবাবু। আমার যা-কিছু শিক্ষা, তা আপনার কাছে। আপনার সাহায্য না পেলে আমার কোন কাজই হতো না। কাল আমি বাড়িতে ফিরেছি রাত বারোটার সময়, অত রাত্রে আপনাকে খবর দিতে নিজে যেতে পারিনি। রমেন বাবুকে বলে দিয়েছিলুম, আজ ভোরবেলায় যেন তিনি আপনাকে একবার আসতে বলেন। পরের ব্যাপারে এতদিন খেটেছি কাকাবাবু, এবার নিজের গায়ে হাত পড়েছে, আপনার সাহায্য ছাড়া আমার চলবে না, তা আমি বেশ জানি।”

দরজার পর্দ্দার আড়ালে মানদাকে দেখা গেল। কৃষ্ণা এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে চা টোষ্ট আর ডিম-পোচ নিয়ে এসে ব্যোমকেশের সামনে টেবিলে রাখলো।

ব্যোমকেশ আর্ত্তনাদ করে ওঠেন, ”না, না, আমি কিছু খাবো না কৃষ্ণা, অনর্থক তুমি এ-সব করেছ। মাথার উপর এই বিপদ, এ-সময় খাওয়া-দাওয়া-না, না, না!”

কৃষ্ণা বললে, ”কিছু অন্যায় হয়নি। আপনি যা পারেন, সামান্য কিছু খেয়ে চা খান কাকাবাবু। আমি ততক্ষণে আপনাকে সব বলি।”

গত-রাত্রের ঘটনায় কৃষ্ণা রীতিমত বিব্রত হয়ে আছে। সব কথা সে বলছে-খেতে-খেতে ব্যোমকেশ শুনছেন, শুনতে-শুনতে অজ্ঞাতে কখন ডিস শেষ হয়ে গিয়ে চায়ের কাপে হাত পড়ে, সেদিকে তাঁর কোন খেয়াল থাকে না।

”হু-বোঝা যাচ্ছে, তোমরা যে মেট্রোয় যাবে বলে ঠিক করেছিলে ন’টার শোতে, সে-খবর তোমার শত্রুপক্ষ কোনরকমে জেনেছিল। আমার মনে হয়, তোমাদের বাড়ীর আশেপাশেই তারা নজর রাখছিল।’

কৃষ্ণা বললে, ”আমারও তাই মনে হয়, কাকাবাবু। সুজনমামা তাঁর এ্যাসিষ্টাণ্ট এক ভদ্রলোক পরেশ মিত্রকে টিকিট কিনতে পাঠিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকেই শত্রুপক্ষ এ-খবর সংগ্রহ করেছিল। হয়তো আমাদের ট্যাক্সির সঙ্গে-সঙ্গে তারাও আসছিল। কিছুই হতো না কাকাবাবু, যদি মামাবাবু হঠাৎ গাড়ী থেকে না নামতেন।”

ব্যোমকেশবাবু গম্ভীর ভাবে মাথা দোলান। বললেন, ”কিন্তু আমার মনে হয় কৃষ্ণা, প্রণবেশ তোমার উপর টেক্কা দিতে গিয়েছিল। সে নিশ্চয় গাড়ীর ভিতর থেকে বাইরে কাকেও দেখতে পেয়েছিল, দেখে তোমাকে না জানিয়ে চুপিচুপি নিজেই একটু গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছিল। বেচারা বোকা মানুষ, কত ধানে কত চাল, তা তো জানে না। তাই ওদের ফাঁদে সহজে পা পড়েছে। ওদেরও কোন কষ্ট করতে হয়নি। হয়তো কারও পিছনে ফলো করতে প্রণবেশ খানিকদূর গিয়ে পড়েছে, এমন সময় জোর বৃষ্টি এসে পড়তে তাদের সুবিধে হয়ে গেছে। সেই বৃষ্টিতে বিপর্য্যস্ত অবস্থায় একজন লোককে টেনে গাড়ীতে তুলতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি তাদের।”

কৃষ্ণা চুপ করে থাকে।

সত্য, কথাটা ঠিক হতে পারে। বৃষ্টি নেমেছিল মুষলধারে, প্রণবেশ ফেরবার সময় বুঝতে পারেন নি, নিজেদের মোটর ভেবে ভুল করে হয়তো অন্য মোটরে উঠে পড়েছিলেন।

শুষ্ক কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”যে চীনেম্যান আমার কাছে ভিক্ষা চাইলো, তাকে দেখে আমার মনে হলো, ও আউলিং ছাড়া আর কেউ নয়। সেই আউলিং-বিচার হওয়ার সময় সে পালায়-যাকে আর ধরতে পারা যায়নি।

নিজের মাথার চুলগুলো টানলেন ব্যোমকেশ। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন ”পুলিশের কলঙ্ক কৃষ্ণা, এখানকার হাজত থেকে আসামী পালিয়ে যায়, পুলিশ তাকে ধরতে পারে না।”

মুহূর্ত্ত নীরব থেকে কৃষ্ণা বললে, ”আমি খোঁজ পেয়েছিলাম, সে চীনা-মুল্লুকে সরে পড়েছে। সেখান থেকে তাকে ধরে আনা, সে প্রায় আকাশ থেকে চাঁদ পেড়ে আনার মত অসম্ভব হতো। জাহাজে উঠবার সময়েও আপনারা অনায়াসে তাকে ধরতে পারতেন। আপনাদের সামনে দিয়েই সে ছদ্মবেশে চলে গেল, আপনারা তাকে এতটুকু সন্দেহ করলেন না, এইটেই না আশ্চর্য্য!”

লজ্জিত কণ্ঠে ব্যোমকেশ বললেন, ”মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে, মানি। সেই কথা আছে না-চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। এখানকার পুলিশের তাই হয়েছিল। আউলিং সগর্ব্বে মাঞ্চুরিয়া থেকে চিঠি লিখে জানায়, পুলিশ-অফিসারদের চোখের সামনেই সে জাহাজে উঠেছে, কেউ তাকে চিনতে পারেনি! জাহাজে তার কথাবার্তা শুনেও কেউ বুঝতে পারেনি, সে আউলিং। বাংলাদেশ তার হাতে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিল ঠিক! তবু এ যে সেই আউলিং, সে-সম্বন্ধে সঠিক প্রমাণ পাওয়া গেছে এমন কথাও অবশ্য বলা চলে না।”

দৃঢ় কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”খুব নিশ্চয় করে বলা চলে, কাকাবাবু। আমার চোখ কোন দিন ভুল করেনি। যাকে একবার দেখবো, তাকে দেখে চিনবোই-সে-চেনায় কোন ভুল হবে না! মানুষকে একবার দেখলে পাঁচ বছর পরেও তাকে দেখে আমি চিনতে পারি। তবু কাল রাত্রে বাড়ী ফিরে ফটোর অ্যালবাম নিয়ে প্রায় দু-ঘণ্টা কাটিয়েছি। আউলিংয়ের যে-ফটো আমার কাছে আছে, অবিকল সেই মুখ, সেই চেহারা! আমার চিনতে কোন ভুল হয়নি, কাকাবাবু।”

চিন্তিত মুখে ব্যোমকেশ বললেন, ‘হু’! ভাবিয়ে তুললো। এদিকে এসেছে সুন্দরলালের দল, তার মেয়ে, প্রধান সঙ্গী সুচেৎ সিং- সব মিলিয়ে ব্যাপার বেশ জটিল হয়ে উঠলো কৃষ্ণা! তাই ভাবছি-”

বিষন্ন কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”এরা প্রথম আক্রমণ চালালো মামাবাবুর উপর, আমি তাই ভাবছি! জানিনে, তাঁকে কোথায় নিয়ে গেল, কি করলে? আমি প্রথমেই আপনার কাছে যাওয়ার উদ্যোগ করছিলুম। একবার সেই গলির মধ্যে বাড়ীটা দেখতে হবে, সেখানে সত্যই কোনো খোঁজ পায় কি-না।”

উৎফুল্ল হয়ে উঠেন ব্যোমকেশবাবু। বলেন, ”বেশ, তাহলে এখনি চল। দেরী নয়। তবে আমার মনে হয়, রাতারাতি তারা হয়তো সরে গেছে, প্রণবেশবাবুকে হয়তো সরিয়েছে! তবু একবার যাওয়া যাক, যদি কোন সন্ধান পাই।”

ভোরেই সুজন কোথায় বেরিয়ে গেছে, কৃষ্ণার সঙ্গে তার দেখা হয়নি।

কাল রাত্রেই কৃষ্ণা চৌরঙ্গীর সেই বাড়ীটা দেখবার জন্য উৎসুক হয়েছিল। যদি পুরুষ-মানুষ হতো, কারও সাহায্য নেওয়ার দরকার হতো না! বাধ্য হয়েই কাল তাকে ফিরে আসতে হয়েছে।

ব্যোমকেশ না এলে নিজেই সে তাঁর কাছে সকালে যেত এবং তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চৌরঙ্গীর সেই গলিতে যেত! একটা কোন সূত্র না পেলে কিছু করতে পাচ্ছে না, তার ব্যাকুলতা ক্ষণে ক্ষণে বেশ বেড়ে উঠছে।

পাঁচ – চৌরঙ্গীর গলি

যে-বাড়ীটাকে কৃষ্ণা কাল রাত্রে লক্ষ্য করেছিল, সে-বাড়ীর দরজা ভিতর দিক থেকে বন্ধ।

দরজার কড়া ধরে কৃষ্ণা সজোরে নাড়া দেয়, ভিতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায় না।

কৃষ্ণা আবার কড়া নাড়ে। এবার মনে হয়, কার সাড়া যেন পাওয়া যাচ্ছে।

ব্যোমকেশের পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা চাপা সুরে বললে, ”মনে হয়, তারা নেই কাকাবাবু। কোন একজন লোককে রেখে গেছে, যেন লোকে সন্দেহ না করতে পারে।”

সদম্ভে ব্যোমকেশ বললেন, ”যে-কোন একজন লোককে পেলেই আমাদের কাজ হবে কৃষ্ণা। দুজন কনষ্টেবল সঙ্গে এনেছি। দরকার হলে ওরাই আমাদের সাহায্য করবে!”

ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়।

বিস্মিত চোখে কৃষ্ণা দেখে, খোলা-দরজায় এক বৃদ্ধা চীনা-রমণী- স্থুলাঙ্গী-নিজের দেহের ভারে দাঁড়াতে পারে না যেন।

চীনা ভাষায় সে কি জিজ্ঞাসা করে।

ভাষা বুঝতে পারে না কৃষ্ণা, তাই ব্যোমকেশের পানে সে তাকায়।

গর্জ্জন করেন ব্যোমকেশ, ”পথ ছাড়, আমরা ভিতরে যাব।”

বৃদ্ধা ভাষা না বুঝলেও ভাব-ভঙ্গিতে বোঝে। দুটি স্থূল হাত দরজার দুদিকে দিয়ে সে মাথা নড়ে। বোঝায়, ভিতরে সে প্রবেশ করতে দেবে না।

ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ব্যোমকেশ।

‘শিউরতন, রামলাল-তোমরা এদিকে এসো, বুড়িটাকে একজন আটকাও-আর একজন আমাদের সঙ্গে ভিতরে চল।”

লাল-পাগড়ি পুলিশ দেখে বৃদ্ধা ভয় পায়, দরজা ছেড়ে এক-পাশে সরে দাঁড়ায়। একজন কনষ্টেবল তার পাহারায় থাকে, আর একজন যায় কৃষ্ণা আর ব্যোমকেশের সঙ্গে।

ছোট ছোট ঘরগুলি-প্রায় অন্ধকার! নীচে অন্ততঃপক্ষে পাঁচ-ছখানি ঘর-মাঝখানেও একটি ঘর। মনে হয়, এ ঘরটি এদের বৈঠকখানারূপে ব্যবহার হয়। মেঝেয় কার্পেট পাতা, তার উপর টেবিল চেয়ার প্রভৃতি। পিছন দিকে সরু প্যাসেজ পার হয়ে উপরে ওঠবার সিঁড়ি।

ঘর ক’খানা দেখে নিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ”চল, এবার উপরটা দেখে আসা যাক।”

কৃষ্ণা বললে, ”আপনি দেখে আসুন কাকাবাবু। আমি নীচের ঘরগুলো একটু দেখি ভালো করে।”

বিকৃত মুখে ব্যোমকেশ বললেন, ”বিশ্রী দুর্গন্ধ। বুঝছো না, এখানে ওরা থাকতো। এই গন্ধেই ভূতগুলো ভেগেছে! চীনাদের গায়ের গন্ধই আলাদা।”

কৃষ্ণা একটু হাসে।

পাশের ছোট ঘরটার দরজায় শিকল দেওয়া। শিকল খুলে কৃষ্ণা সে-ঘরে ঢোকে।

ইচ্ছাসত্ত্বেও তার জন্য ব্যোমকেশ উপরে যেতে পারলেন না, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে একখানা চেয়ারে বসে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন।

ছোট ঘরটিতে শুধু একটি ছোট জানালা-সেটিও অনেক উঁচুতে। সে-জানালা দিয়ে বাইরের-কিছু দেখা যায় না। মনে হয়, এ-ঘরটা ছিল বাসিন্দাদের ষ্টোর রুম। একপাশে কতকগুলো টিনের বাক্স, বস্তা, বড় বড় কৌটো প্রভৃতি পড়ে আছে। এদিকে-ওদিকে কাগজপত্র ছড়ানো- অন্ধকারে স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না।

উপরে ইলেকট্রিক বালব ঝুলছে দেখে বোঝা যায়, এ-ঘরে আলোর ব্যবস্থা আছে।

ঘরে সুইচের সন্ধান মিললো না, বাইরের দিকে সুইচ খুঁজে বার করে কৃষ্ণা!

সুইচ টিপতেই ঘর আলো হয়ে উঠলো।

ঘরটার সম্বন্ধে কৃষ্ণার মনে সন্দেহ জাগে।

প্রণবেশকে যারা বন্দী করেছিল, তারা এই নির্জ্জন ঘরেই তাকে রেখেছিল মনে হয়। চৌরঙ্গীর মত জায়গায় এ-রকম বাড়ী এবং সে-বাড়ীতে এ-রকম ঘর থাকতে পারে, এ যেন স্বপ্নের অগোচর!

হয়তো এই সব কাগজ-পত্রের মধ্যে প্রণবেশের নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে-কৃষ্ণা সন্ধান করে।

কোণের দিকে কি একটা চিক-চিক করছে যেন! কৃষ্ণা দেখে, প্রণবেশের রিষ্ট-ওয়াচ-চামড়ার ব্যাণ্ডশুদ্ধ ছিঁড়ে পড়ে আছে, পাশে প্রণবেশের নাম-লেখা ফাউণ্টেন পেনটাও আছে।

ঘড়ি আর পেন কৃষ্ণা কুড়িয়ে নেয়।

তাহলে এই ঘরেই প্রণবেশকে কাল রাত্রে আটক রাখা হয়েছিল। ঘরটি যে-কোন গোপনীয় কাজের জন্য ব্যবহার হয়, তাতে ভুল নেই! এর আলোর ব্যবস্থাও তাই আলাদা রকম।

ছিন্ন ব্যাণ্ড দেখে জানা যায়, প্রণবেশের সঙ্গে এদের রীতিমত ধস্তাধস্তি চলেছিল! হয়ত তখনকার মত প্রণবেশকে এই ঘরে আটকে রেখে মাঝ-রাত্রে বা শেষ-রাত্রে তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেই সময় ধস্তাধস্তির ফলে প্রণবেশের হাতের ঘড়ির ব্যাণ্ড ছিঁড়ে ঘড়িটা ছিটকে পড়েছে, পেনটাও পড়ে গেছে।

ঘড়ি আর পেন হাতে নিয়ে কৃষ্ণা আড়ষ্টভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

বেচারা মামাবাবু!

কৃষ্ণার চোখ জ্বালা করতে থাকে।

কিন্তু না, চোখের জল ফেলবার সময় নয়! যেমন করে হোক, প্রণবেশকে উদ্ধার করতে হবে! এত দিন কৃষ্ণা পরের কাজ করে এসেছে, এবার তার নিজের কাজ! প্রণবেশকে উদ্ধার করা-তার কাজ। এ-কাজ করতে নিজের প্রাণ যায় যদি-তবু!

খালি বাক্সগুলির পানে তাকায় কৃষ্ণা।

বছর দুই আগে কোকেনের ব্যবসা করতে গিয়ে আউলিং ধরা পড়েছিল। কে বলতে পারে, কলকাতায় ফিরে এবারও সে কোকেন আমদানী-রপ্তানী করছে কিনা! এই বাক্সগুলিতে হয়তো কোকেন ছিল, রাতারাতি বাক্স খালি করে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে আউলিং।

বাক্সক’টি সে একবার ভাল করে দেখলো, তারপর ঘর থেকে বেরুবে, হঠাৎ নজর পড়ল দরজার পাশে একখানা কাগজের উপর-কাগজখানা মেঝেয় পড়ে আছে। কাগজে কি সব লেখা!

প্রণবেশের হাতের লেখা।

কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি কাগজখানা কুড়িয়ে নেয়।

হয়তো আলোয় বা অন্ধকারে কাগজখানাতে সামান্য কিছু লিখেছে সে।

কৃষ্ণা আলোর কাছে এনে দোমড়ান-মোচড়ান কাগজখানা আস্তে আস্তে খুলল।

কাগজখানার চেহারা দেখে মনে হয়, লিখতে লিখতে লোকজন এসে পড়ায় লেখা শেষ হয়নি; পাছে কেউ দেখতে পায়-সেজন্য এরা ঘরে প্রবেশ করবার আগেই চিঠিখানা প্রণবেশ মুড়ে দরজার পাশে ফেলে দিয়েছেন।

কৃষ্ণা আলোয় চিঠি পড়ে-

এরা আমায় ধরে এনেছে বৃষ্টির সময় সুযোগ পেয়ে। আমি মোটর থেকে নেমে খানিক দূরে দেখি সুচেৎ সিং আর আউলিংকে। ওরাও আমায় দেখেছিল-আমি তা বুঝেনি, এখন বুঝছি। আমায় ফাঁদে ফেলবার জন্যই ওরা এগিয়ে চলে, বোকার মতন আমি ওদের পিছনে যাই-কোথায় ওরা যায়, দেখবার জন্য।

তারপর আমি আটক-কোথায়, জানি না। এর পর আমায় কোথায় নিয়ে যাবে, তাও জানি না। জানি, আমার জন্য সন্ধান হবে, হয়তো কৃষ্ণা এখানে আসবে। সে যদি এ লেখা পায়, তাই লিখছি। আউলিং আফিং আমদানী-রপ্তানী করছে। এত আফিং এ ঘরে-যা-চিঠি এইখানে শেষ।

কৃষ্ণার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। চিঠি, ঘড়ি আর পেনটা ব্যাগের মধ্যে পুরে সে বেরিয়ে এল-এল ব্যোমকেশের কাছে।

ব্যোমকেশ তখন বৃদ্ধা মা-পানকে নিয়ে পড়েছেন, তর্জ্জন-গর্জ্জন করছেন, ”এখনও বল, নাহলে তোমার যা হবে-তাতে তোমার ধড়ে জান থাকবে না। জীবন্ত কুকুর দিয়ে খাওয়াব, বেত লাগাব, আগুন দিয়ে ছেঁকা দেব গায়ে-মুখে।”

বৃদ্ধা মা-পান ব্যোমকেশের পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে ভাঙ্গা-ভাঙ্গা হিন্দীতে জানাচ্ছে, সে কিছু জানে না! কাল তাকে চিনেবাজার থেকে অনেক টাকা মাইনের লোভ দেখিয়ে এরা নিয়ে এসেছে। অবশ্য আগে থেকে সে আউলিংকে চিনত, আর এখানে ফিরে এসে আউলিং তাকে মাঝে মাঝে পয়সা-কড়ি দিয়ে সাহায্য করে। ইদানীং সে খেতে পাচ্ছিল না, তাই বেশী টাকার কথা শুনে চলে এসেছে।

কৃষ্ণা তাকে সান্ত্বনা দেয়, ”বুঝেছি, তুমি এখানে নতুন এসেছ-কাকাবাবু না বুঝুন, আমি বুঝেছি। আউলিং তোমাকে দিয়ে মাঝে মাঝে নানারকম কাজ করাত, তার বদলে তোমায় কিছু কিছু টাকা দিত-তাই না?”

মা-পান চোখ মুছে মাথা কাৎ করে, ”হ্যাঁ।”

কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে হতাশভাবে ব্যোমকেশ বললেন, ”নাঃ, তুমি সব মাটি করে দিলে কৃষ্ণা। এ-সব কি বলছ, জানিনে। দেখতে, সব কথা এ বলত-তুমি কিন্তু কাঁচিয়ে দিলে।”

কৃষ্ণা বলল, ”আমি যা বলছি, তা সত্য, কাকাবাবু। আমি বলছি আউলিং আফিংয়ের ব্যবসা করছিল, বহু আফিং সে ঐ ছোট ঘরটায় রাখত, এই মা-পানকে দিয়ে সে এখানে-ওখানে আফিং পাঠাত-তাকে কেউ কোনদিন সন্দেহ করেনি। তবে এ-কথা সত্য, মা-পান আগে কোনদিন এখানে কাজ করতে আসেনি। হয়ত কালই এসেছে।”

উষ্ণ কণ্ঠে ব্যোমকেশ বললেন, ”তুমি ত আমার সঙ্গেই এসেছ কৃষ্ণা, এইটুকু সময়ের মধ্যে এত কথা তুমি জানলে কি করে?”

তাঁর কণ্ঠে ব্যঙ্গের সুর, কৃষ্ণা বুঝল। শান্তকণ্ঠে সে বললে, ”যেমন করেই হোক জানতে পেরেছি, কাকাবাবু। এও জেনেছি, মামাবাবুকে এরা কাল এখানে নিয়ে এসেছিল, রাত্রে মামাবাবু ঐ পাশের ছোট ঘরটায় বন্ধ ছিলেন।”

ব্যোমকেশ হাসলেন-বিদ্রূপের সুরে বললেন, ”তুমি দেখছি এ-বাড়ীতে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে রোমান্স খুঁজে পেয়েছ কৃষ্ণা-আশ্চর্য্য! প্রণবেশবাবুকে এরা আর কোথাও নিয়ে যায়নি-এখানে এনেছিল, তার প্রমাণ?”

কৃষ্ণার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে, হাতের ব্যাগ খুলে সে প্রণবেশের চিঠিখানা বার করে বলে, ”প্রমাণ পেয়েছি বলেই জোর করে বলছি কাকাবাবু, বিনা-প্রমাণে বলছিনে। এই চিঠিখানা পড়ে দেখুন, আর এই দেখুন মামাবাবুর ঘড়ি আর পেন।”

”দেখি-দেখি, বটে।”

চিঠিখানা কৃষ্ণা ব্যোমকেশবাবুর হাতে দেয়।

প্রণবেশের লেখা কি না, ব্যোমকেশ পরীক্ষা করলেন। তাঁর মুখ অসম্ভব গম্ভীর হয়ে উঠল।

ছয় – শান্তার দৌত্য

সারা দিনের পর কৃষ্ণা সবে বাড়ী ফিরেছে, বনমালী এসে খবর দিলে, একজন মেয়ে-লোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন-প্রায় এক ঘণ্টা তিনি বসে আছেন।

”মেয়ে!”

কৃষ্ণা ভেবে নেয়-এমন সময় কে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে? বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এ-সময়ে-বেলা একটা না, দেড়টা-এ-সময়ে কে আসতে পারে?

বললে, ”তাঁকে খবর দাও, আমি আসছি।”

বনমালী চলে যায়।

মানদা বললে, ‘খাওয়া-দাওয়া সেরে গেলে হয় না-বেলা বড় কম হল না!’

কৃষ্ণা বললে, ”এখনি আসছি। তুমি আর একটু অপেক্ষা কর।”

নীচে বৈঠকখানা ঘরের পর্দ্দা একটু সরিয়ে কৃষ্ণা দেখে, একটি মেয়ে-দরজার দিকে পেছন ফিরে সে বসে আছে। তার মুখ দেখতে পাওয়া গেল না।

কৃষ্ণা ঘরে ঢুকতেই মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল, দু-হাত কপালে ঠেকিয়ে বললে ”নমস্তে।”

কৃষ্ণা প্রতি-নমস্কার করে, ”নমস্তে।”

তারপর সামনে এসে সে দাঁড়ায়, বলে, ”বসুন।”

মেয়েটি বসল।

কৃষ্ণা মেয়েটিকে দেখে চিনতে পারে না। আগে কোনদিন একে দেখেছে, মনে হয় না-সম্পূর্ণ অপরিচিতা।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত পলকের দৃষ্টিতে কৃষ্ণা দেখে নেয়। পোষাক-পরিচ্ছদে তাকে বাঙালী মনে হয় না, সুন্দরী। মেয়েটির মুখে বিষাদের ছায়া!

টেবিলের ও-পাশে একখানা চেয়ারে বসতে বসতে কৃষ্ণা বললে, ”আপনার নাম-ধাম-পরিচয় কিছুই জানিনে। নিশ্চয় কোন দরকারে এসেছেন, প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। কি দরকার, বলুন?”

মেয়েটি নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে একখানা কার্ড বার করে-কৃষ্ণার সামনে সেটা রাখে, তাতে নাম লেখা-কুমারী শান্তা খোটে বম্বে।

জাতিতে মারহাট্টী, থাকে বোম্বাইয়ে। কি প্রয়োজনে বাঙালী মেয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য একঘণ্টা বসে এখানে অপেক্ষা করছে-কৃষ্ণা বুঝতে পারে না।

শান্ত কণ্ঠে শান্তা বললে, ”আমার নাম পেলেন ত। বোম্বাইয়ে আমার বাড়ী হলেও আমি থাকি এখানে-বেলতলা রোডে।”

কৃষ্ণা বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, ”এখানে বেলতলা রোডে? আজ ক’দিন হলো, আমি বেলতলা রোড থেকে একখানা বেনামী চিঠি পেয়েছি। ঠিকানাটা এমন ভাবে কেটে ঘষে তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে হঠাৎ বোঝা যায় না। সে চিঠি তাহলে আপনি লিখেছেন?”

লজ্জানম্র কণ্ঠে শান্তা বললে, ”হ্যাঁ, আমিই সে-চিঠি লিখেছিলুম। আপনি জানেন না, এদের জন্যই আমি আজ দেশছাড়া হয়ে এখানে বাস করছি, হিন্দু হয়েও খৃশ্চান বলে পরিচয় দিয়ে ওদের এক হোষ্টেলে রয়েছি, যাতে কেউ আমার পরিচয় না পায়। সেজন্য দিন-রাত আমায় কি ভয়ে ভয়ে যে থাকতে হয়! আমায় রক্ষা করুন আপনি। ওরা আমার সর্ব্বনাশ করবে! শুধু বর্ত্তমান নয়-ভবিষ্যৎ পর্য্যন্ত মসীময় করে তুলছে। সে-সব কথা কাকেও বলবার নয়!”

দু-হাতে মুখ ঢাকে শান্তা, তার করাঙ্গুলির ফাঁক দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ে।

কৃষ্ণা স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললে, ”কিন্তু আপনি আপনার কথা না বললে আমি জানব কি করে মিস খোটে? ওরা, মানে কারা আপনার সর্ব্বনাশ করছে? আমি তাঁদের কি করে চিনব?”

মুখ থেকে হাত সরায় শান্তা। আর্দ্র কণ্ঠে বলে, ”আমাকে ওরা এমন করেছে, যেন ওদের হাতের পুতুল আমি! ওরা মানে লছমী আর তার প্রধান চর আউলিং-চীনাম্যান। আমি জানি, এরা আপনার সর্ব্বনাশ করবার চেষ্টায় আছে। যেদিন এদের ঐ সব সাঙ্কেতিক ভাষা আর তার অর্থ জানতে পেরেছি, তার ক’দিন পরে সুযোগ পেতেই আপনাকে তা জানিয়েছি। আমার চিঠি আপনি পেয়েছেন নিশ্চয়?”

মুখে-চোখে উদ্বেগ, কৃষ্ণা বললে, ”পেয়েছি। কিন্তু চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণ সুরু হবে, তা বুঝিনি! আরো দু-একদিন আগে যদি এ-চিঠি পেতুম-হুঁশিয়ার হতে পারতুম হয়ত!”

একটা নিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণা।

অপরিচিতা শান্তা নিজেই পরিচয় দেয়-তার পিতা অনন্তরাম খোটে। বোম্বাইয়ে বাড়ী। কি করে কি ভাবে তাঁর সঙ্গে সুন্দরলালের ঘনিষ্ঠতা হয়, শান্তা তা জানে না। শিশুকালে তার মা ইহলোক ত্যাগ করেন, সম্পর্কীয়া এক মাসিমার কাছে সে মানুষ হয়। বাপকে শান্তা খুব কম দেখেছে। ক্বচিৎ কখনো তিনি আসতেন-তাও দু-চারদিনের জন্য-সেই সময়ে যা দেখাশুনা হতো। তখন মেয়ের সঙ্গে দু-একটা কথা বলতেন। ছেলেবেলা থেকে পিতাকে দেখে সে ভয়ই পেত-কোনদিন শ্রদ্ধা করতে বা ভালোবাসতে পারেনি।

তার বয়স যখন ছ-সাত বছর-তখন হঠাৎ মাসিমা মারা যান। মাসিমা মারা গেলে বাপ অনন্তরাম গিয়ে শান্তাকে নিয়ে আসেন এই কলকাতায়। কলকাতায় এনে বাপ তাকে রাখেন এক হোষ্টেলে। খৃষ্টান মেয়ে বলে পরিচয় দেন-হিন্দু নয়। নিজের নামও তিনি সেখানে দেননি। জোসেফ বলে একজনকে তার অভিভাবকরূপে পরিচয় করিয়ে দেন।

এর পর পিতাকে সে বহুকাল দেখেনি। তার যা-কিছু দরকার, জোসেফ দিয়ে যেতেন-তিনিই তাকে দেখা-শুনা করতেন। পিতার কথা জিজ্ঞাসা করলে জোসেফ বলতেন, অনন্তরাম ভারতের বাইরে গেছেন-ফিরলে শান্তার সঙ্গে নিশ্চয় এসে দেখা করবেন।

ক’বছর আগে পিতা ফিরে আসেন এবং তাকে বোম্বাইয়ে নিয়ে যান।

এই সময়েই পিতার পরিচয় সে পায়, জগতে এমন কোন কাজ ছিল না, তার পিতা যা করতে পারেন না। বাধ্য করে তাকে দিয়েও এমন বহু কাজ তিনি করিয়েছেন, যাতে শান্তার জীবন দুর্ব্বহ দুঃসহ হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণা তাকে না দেখলেও কৃষ্ণাকেও সে বহু জায়গায় দেখেছে। কোনদিন কৃষ্ণার সামনে আসবার ভরসা তার হয়নি, কোন কথা জানাবারও সাহস হয়নি। আজ সে সাহসে ভর করেই এসেছে, সব কথা সে কৃষ্ণাকে বলবে-কোন কথা গোপন রাখবে না। নিজের পাপের বোঝা সে আর বাড়াতে চায় না!

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”আপনি এখনও বেলতলা রোডের হোষ্টেলে আছেন?”

শান্তা উত্তর দিলে, ”না। আমার বাবা আমায় খিদিরপুরে নিয়ে গেছেন। হপ্তা-খানেক আমি সেখানে আছি। হোটেল তাজমহলে আমার বাবা থাকেন।”

চিন্তিত মুখে কৃষ্ণা বললে, ”সুন্দরলালের মেয়ে লছমীও নিশ্চয় ওখানে আছে! আপনি তার কথা কিছু জানেন?”

শান্তা বললে, ”না, লছমী ওখানে থাকেন না; তিনি থাকেন বালিগঞ্জে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ীতে। সে আত্মীয়ের অনেক টাকা। মস্ত কারবারী। তার নাম ঘনশ্যাম আগরওয়ালা। বড়বাজারে তাঁর কারবার-বেশীর ভাগই চোরাই মালের কারবার। দু-তিনবার নাকি আপনাদের হাতেও তিনি পড়েছিলেন, শুনেছি।”

”আমাদের হাতে।”

সকৌতুকে কৃষ্ণা হাসে, বলে, ”আমাদের নয়-পুলিশের হাতে, বলুন। আমি পুলিশের লোক নই। আমার পেশা ডিটেকটিভগিরি নয়, নেহাৎ দায়ে পড়ে সখের খেয়ালে এক-আধবার জড়িয়ে পড়ি। সামনে পরীক্ষা এসে পড়েছে-এর মধ্যে দেখুন না, আবার কি ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়েছি!”

শান্তা গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ”আপনার সে ক্ষমতা আছে বলেই লোকে আপনার সাহায্য চায় কৃষ্ণা দেবী। আমার জন্য আমি আপনাকে ধরছি-আমার যে-কোন রকমে হোক, এদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আপনি জানেন না, সেদিন মেট্রোর ওখানে মোটরে আমাকেই আপনার ভূমিকায় অভিনয় করে আপনার মামা প্রণবেশবাবুকে আটক করা হয়েছে!”

কৃষ্ণার মুখ কঠিন হয়ে ওঠে। সে শান্তার মুখের পানে তাকায়; জিজ্ঞাসা করে, ”আমার মামা এখন কোথায়, আপনি জানেন?”

শান্তা উত্তর দিলে, ”জানি। তিনি আমাদের আড্ডায় আটক আছেন। তাঁর জন্যই আপনার কাছে এসেছি। চেষ্টা করলে তাঁকে উদ্ধার করতে পারেন। দেরী করলে তাঁকে উদ্ধার করা শক্ত হবে-হয়ত তার সম্ভাবনাও থাকবে না তখন তার কারণ, কাল ভোরে হয়ত আমাদের জাহাজ ছাড়বে। আজ রাত্রেই আমরা জাহাজে উঠব- আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা সব ঠিক। আপনাকে আমি গোপনে আমাদের আড্ডা দেখাতে পারি- যদি আপনি বিশ্বাস করে আমার সঙ্গে আসেন।”

কৃষ্ণা শান্তার মুখের পানে তাকায়, বলে, ”কিন্তু বিশ্বাস করা শক্ত, মিস খোটে।”

শান্তা ম্লান হাসি হাসে, বলে, ”তা আমি জানি, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারবেন না। সঙ্গে না যান, বেশ, আমি আপনাকে ঠিকানা দিয়ে যাচ্ছি, আপনি সে ঠিকানায় গেলে সকলকেই এক-জায়গায় পাবেন। তখন জানতে পারবেন, আমি সত্য কথা বলেছি। যদি পারেন, আমাকেও উদ্ধার করবেন-এটুকু আশ্বাস আমাকে দিন।”

কৃষ্ণা বললে, ”সে-ভার আমি নিচ্ছি। কিন্তু আপনাকে যদি আর যেতে না দিই? ধরুন, আপনাকে যদি আমার বাড়ীতে এখন আটকে রাখি? অর্থাৎ, আপনার লোকেরা জানুক, আপনি গ্রেফতার হয়ে হাজতে আছেন। কেবল আপনি আর আমি শুধু জানব, আসলে তা নয়-আমার অতিথি হয়ে আমার কাছে আপনি আছেন!”

শান্তা হাসে, ”আপনি সুচেৎ সিংহকে এখনও চেনেননি, কৃষ্ণা দেবী। আজ সকাল থেকে তিনি আর লছমী কলকাতায় নেই; শুনেছি আগরওয়ালার সঙ্গে কাঁচরাপাড়া গেছেন-সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবেন। তাই সুযোগ পেয়ে আপনার কাছে আসতে পেরেছি। সন্ধ্যার সময় তিনি সকলকেই একত্র জড় করে জাহাজে নিয়ে যাবেন-কেবিন নেওয়া আছে। আমি যদি না যাই, ভাববেন না, লছমী বা সুচেৎ সিং নিশ্চিত থাকবে! সন্ধান নিয়ে তারা ঠিক আসবে আর বিশ্বাসঘাতকতার শান্তি তখন আমাকে যা দেবে, বোঝেন ত?”

কৃষ্ণা বললে, ”অর্থাৎ খুন করবে?”

শান্তা উত্তর দিলে, ”খুন ত বটেই! ফস করে গলা কেটে খুন নয়-তিলে তিলে মারবে-খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করবে?”

বলতে বলতে সে শিউরে ওঠে!

কৃষ্ণা বললে, ”আমি তা জানি। একখানা চিঠিতে আমাকে সে অনেক দিন আগে এই ভয়ই দেখিয়েছিল। আচ্ছা, আজ আপনি যান। আমি কিন্তু একা যাব না-যেতে গেলে পুলিশ নিয়ে যাব আর সন্ধ্যার পরে যাব-তখন সকলকেই এক-জায়গায় পাব, মনে হয়। হ্যাঁ, ঠিকানাটা আর ষ্টিমারের নামটা আমায় দিন। যেমন করেই হোক, আমি আজ মামাকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করব। আর এদের দলকে-দল যাতে গ্রেফতার হয়-সে-চেষ্টাও করব।”

ঠিকানা এবং জাহাজের নাম লিখে দিয়ে শান্তা উঠল।

সাত – তারপর

বৈকালের পরে সুজন ফিরে আসেন। এর মধ্যে কৃষ্ণা পুলিশ-কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে আদেশপত্র নিয়ে এসেছে। আবশ্যক-মত যে-কোন থানায় দিলে, থানার অফিসাররা তাকে সব ব্যাপারে সব রকম সাহায্য করবেন।

সুজন ফিরতে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, ”আমি বিছানা থেকে ওঠবার আগে কোথায় গিয়েছিলেন? খোঁজ নিয়ে জানলুম, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নাকি আসবেন, বলে গিয়েছেন!”

একখানা আরাম-কেদারায় হাত-পা এলিয়ে বসে সুজন বললেন, ”ভেবেছিলে, কোন খবর না দিয়েই হয়ত বাড়ী চলে গেছি?”

কৃষ্ণা মাথা নাড়ে, বলে, ”না। সে-কথা ভাবিনি, বন্ধুর খোঁজেই বেরিয়েছিলেন, তা জানি। তা, কি হলো? কোন খবর পেলেন?”

সুজন বললেন, ”সারা দিনটা মিথ্যা কাটাইনি কৃষ্ণা মায়ি, সারা খিদিরপুর চষে ফেলেছি! আমার এক বন্ধু আছে ওখানকার থানায়, তার কাছে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি। ওদের সে বাড়ীর কোন খোঁজ পাইনি, তবে খোঁজ পেয়েছি কাল সকাল আটটায় যে জাহাজ ছাড়বে, তাতে প্রণবেশকে নিয়ে ওদের দু-একজনের যাবার কথা আছে।”

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”এম্প্রেস জাহাজ?”

আশ্চর্য্য হয়ে সুজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘জাহাজটার নাম তুমি কি করে জানলে? এম্প্রেসই বটে! কিন্তু তুমি খবর পেলে কোথায়?”

কৃষ্ণা বললে, ‘যে করেই হোক, জেনেছি। আমি এই রাত্রে-না হয় কাল ভোর ছটায় সেই জাহাজ সাচ্চর্চ করতে চাই। সেজন্য সাচ্চর্চ-ওয়ারেণ্ট নিয়ে এসেছি। জাহাজ ছাড়বার একটু আগে সকলকেই ওখানে পাওয়া যাবে। এ-জাহাজে ঘনশ্যাম আগরওয়ালা কোম্পানির অনেক মালপত্র রপ্তানী হচ্ছে-সে খবরও পেয়েছি। কথাটা ঠিক নয়?”

সুজন ললাট কুঞ্চিত করে চেয়ে থাকেন কৃষ্ণার দিকে। এ-মেয়ের তীক্ষ্ন বুদ্ধি এবং অনুসন্ধিৎসা যে তাঁর পুলিশ-বুদ্ধিকে হার মানায়-তাঁকে তা মেনে নিতে হয়। এর আগে একবার তিনি শুধু কৃষ্ণাকে দেখেছেন। তার বুদ্ধি-চাতুর্য্যে তখন স্তম্ভিত হয়েছিলেন।

তাড়াতাড়ি আহারাদির পালা চুকিয়ে কৃষ্ণা রাত নটার মধ্যেই শুয়ে পড়ে। শোবার আগে সুজনকে সতর্ক করে, ”দেখবেন, একেবারে বেহুঁশ হয়ে ঘুমোবেন না! ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া রইল, রাত তিনটেয় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলেই আপনাকে ডাকব-ডাকব মাত্র যেন সাড়া পাই।”

সত্যই সুজনের ঘুমের কোন নিয়ম নাই। যতক্ষণ তিনি জেগে থাকেন-খুব কাজ করতে পারেন। কিন্তু একবার বিছানায় শুয়ে পড়লে, তারপর তাঁর আর জ্ঞান থাকে না, কৃষ্ণা তা জানে। সেই জন্যই হুঁশিয়ারীর নির্দ্দেশ।

ঘরের সুইচ অফ করে দিয়ে কৃষ্ণা বিছানায় শুয়ে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে।

অনেক রাত্রে-বোধ হয়, দুটো কি আড়াইটে-

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। একটু আগে পাতলা ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছিল, ঘরে যেন কতকগুলো লোক! তারা তার বিছানার চারিদিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে-অন্ধকারের মধ্যেও যেন তাদের হাতের ছোরাগুলো ঝকঝক করছে!

এ-স্বপ্নে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভাঙ্গতে দেখে, সত্যই মানুষ-বেশ উপলব্ধি হলো! হয়ত কেউ হাঁটছিল! কৃষ্ণা বিছানায় উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দ থেমে গেছে!

বেড-সুইচ টিপতে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন সজোরে তার গলা টিপে ধরে-যেন সাঁড়াশীর চাপ-চেপে পিষে ধরে!

কার হাতে টচ্চর্চ জ্বলে ওঠে কৃষ্ণার বিস্ফারিত চোখের সামনে। সে আলোয় কৃষ্ণা দেখে, একজন নয়-দু-চারজন লোক তার ঘরে প্রবেশ করেছে। মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করে অচেতন হয়ে পড়ে কৃষ্ণা। কলকাতার মত জায়গায় নিজের ঘরে বিছানার উপর এমন ভাবে আক্রমণ-কিছু ভাববার বা বলবার অবকাশ পেলে না, একটা চীৎকার পর্যন্ত্য করতে পারল না কৃষ্ণা!

বারান্দার ও-পাশের ঘরে সুজন-গভীর ঘুমে তিনি অচেতন। এদিককার ঘরে যে এমন একটা ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেল, তিনি তা জানতে পারলেন না। বারান্দার দরজার পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে মানদা, ঘরের ভিতরে কি হলো-সে একটুও শব্দ পায়নি।

বেশ বেলায় ঘুম ভাঙ্গলো সুজনের। আলো এসে পড়েছে ঘরে। জানা যায়, বেলা হয়ে গেছে।

আশ্চর্য্য, কৃষ্ণা তাঁকে ডাকেনি। কাল রাত্রে সে বলে রেখেছে, রাত্রি থাকতে রওনা হতে হবে-ঠিক ছটার মধ্যে জাহাজে যাওয়া দরকার-আটটায় জাহাজ ছাড়বে। তার আগে জাহাজ সাচ্চর্চ করলে হয়ত অনেক কিছু পাওয়া যাবে-কৃষ্ণার এই মতলব ছিল।

কেন সে ডাকল না, সুজন বুঝতে পারেন না। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন।

মানদা নীচে চলে গেছে নিজের কাজে, কৃষ্ণার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! সুজন বরাবর নীচে নেমে আসতে সামনে বনমালীকে দেখতে পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ”কৃষ্ণা চলে গেছে, বনমালী?”

আকাশ থেকে পড়ে বনমালী! সে বললে, ”না, তিনি ত ঘরেই আছেন। শেষ-রাত্রে আপনার সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা বলেছিলেন। ট্যাক্সি ঠিক করে রাখতে বলায় আমি ভুবনবাবুর ড্রাইভারকে ঠিক করেও ছিলাম। দিদিমণি না ডাকায় আমি ভেবেছি, তাহলে হয়ত তিনি যাবেন না, আপনার সঙ্গে কথাবার্ত্তা হয়েছে।”

সুজন চিন্তিত মুখে বললেন, ”না, আমার সঙ্গে ত কোন কথা হয়নি। কৃষ্ণাই আমাকে ডাকবে কথা ছিল, কিন্তু সে আমায় ডাকেনি। মানদা কিছু জানে না? সে ত দরজার সামনেই শুয়েছিল।”

মানদা উত্তর দিলে, ”আমি কিছু জানিনে দাদাবাবু। দরজা খোলা থাকে রোজ, আজ দেখছি দরজা বন্ধ-আমিও তাই সেই কথাই ভাবছি।”

ত্রস্ত পদে উপরে উঠে আসেন সুজন।

কৃষ্ণার রুদ্ধ দ্বারে বার-বার আঘাত করেন, বার-বার ডাকেন, ”কৃষ্ণা-কৃষ্ণা-”

উত্তর পাওয়া যায় না।

শঙ্কিত হয়ে উঠলেন সুজন।

এ-অবস্থায় ব্যোমকেশবাবুকে সংবাদ দেওয়ার কথা তাঁর মনে পড়ে। তাই তাড়াতাড়ি তাঁকে ফোন করেন, ”বড় বিপদ, যেমন অবস্থায়, আছেন চলে আসুন।”

ব্যোমকেশবাবুর উৎকন্ঠিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ”কি হলো সুজনবাবু? হঠাৎ এমন কি বিপদ ঘটল, বুঝছিনে ত! আমি এখনই যাচ্ছি। অপেক্ষা করুন।”

একটু পরে ব্যোমকেশ এসে পড়লেন।

ঘটনা শুনে তিনিও চিন্তিত হলেন, বললেন, ”নিশ্চয় কিছু হয়েছে! দরজা ভেঙ্গে ফেলতে হবে সুজনবাবু।”

দরজা শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গতে হলো।

ঘরের মেঝেয় পড়ে আছে কৃষ্ণার মূর্চ্ছাতুর দেহ! ঘরের বাক্সগুলি খোলা, জিনিষপত্র সব ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত!

বিস্ময়ে আতঙ্কে সুজনের দু চোখ বিস্ফারিত! তিনি চীৎকার করে উঠলেন, ”এ কি ব্যাপার! এ-ব্যাপার এ-ঘরে ঘটল কখন, কিছুই জানতে পারিনি।”

ব্যোমকেশ বললেন, ”পাশের ঘরে শুয়েও জানতে পারেননি! আশ্চর্য্য! পুলিশ-অফিসারের ঘুম বটে!”

তাঁর কণ্ঠে বিদ্রূপ! সুজন সেদিকে কান দিলেন না। বনমালীকে ডাক্তার ডাকতে পাঠিয়ে তিনি মানদার সাহায্যে কৃষ্ণার শুশ্রূষায় লাগলেন।

কৃষ্ণার গলা দেখিয়ে বললেন, ”দেখুন, যারা এসেছিল, গলা টিপে ধরেছিল-তার দাগ! সাংঘাতিক ব্যাপার!”

ব্যোমকেশ বললেন, ”দেখছি সবই। এদিককার জানালার তিনটি গরাদও নেই। যেই আসুক, সে এই গরাদ খুলে কোনরকমে নেমে পড়েছে এই সরু গলিটার মধ্যে। নাহলে যাবে কি করে?”

জানালার নীচে অত্যন্ত সরু একটা গলি-কোনরকমে একজন লোক এ-গলি দিয়ে চলতে পারে। গলিটা সামনের বড় রাস্তা থেকে খানিক দূর গেছে-ক’খানা বাড়ীর পিছনে গলি বন্ধ হয়ে গেছে। সে-পথে ক্বচিৎ কখনও লোক-চলাচল করে, বিশেষ দরকার না পড়লে এ-পথে কেউ বড় হাঁটে না।

ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, ”শুধু গলা টিপে দেওয়ার জন্য নয়, খুব কড়া ক্লোরোফর্ম্ম-সেইজন্য এখনও জ্ঞান হয়নি।”

তিনি একটা ইনজেকশন দিলেন। কৃষ্ণার জ্ঞান না হওয়া পর্য্যন্ত অপেক্ষা করবেন, বললেন।

আস্তে আস্তে কৃষ্ণার জ্ঞান হলো।

চোখ মেলে ঘরে এত লোক দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেল কৃষ্ণা! ওঠবার চেষ্টা করতে ব্যোমকেশ সস্নেহ কণ্ঠে বললেন, ”থাক মা, এখন ওঠবার দরকার নেই! আর খানিকক্ষণ শুয়ে থাক, তারপর উঠো।”

কৃষ্ণা মনে করবার চেষ্টা করে-কাল রাত্রে কি হয়েছিল। মনে পড়ে, ঘরে সে ক’জন লোককে যেন দেখতে পেয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন তার গলা টিপে ধরেছিল। তবু সে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল, ওদের বেশ কায়দায় ফেলেছিল। ঠিক সেই মুহূর্ত্তে কে তার নাকের উপর ক্লোরোফর্ম্ম-সিক্ত খানিকটা তুলা চেপে ধরে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও কৃষ্ণা তাদের সে আক্রমণ থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। অন্ধকারে সে তাদের চিনতে পারেনি। তাকে অচেতন করে রাখার উদ্দেশ্যও সে এখনও বুঝতে পারল না।

সুজন বললেন, ”থাক, ও নিয়ে এখন আর ভাবতে হবে না কৃষ্ণা, খানিক বিশ্রাম করে নাও। তারপর ভেবে-চিন্তে কাজ করা যাবে।”

কৃষ্ণা চোখ বুজে পড়ে থাকে।

আট – তাজমহল হোটেল

খিদিরপুরের বস্তী-অঞ্চল।

সন্ধ্যার অন্ধকার তখন দিকে-দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, বস্তীর খানিক দূরে মোটর থেকে নামে কৃষ্ণা আর সুজন। পিছনে পুলিশ-ভ্যান থেকে দশ-বারো জন কনষ্টেবল নামে।

দুপুরেই খবর নিয়েছে কৃষ্ণা-খিদিরপুরের সে-জাহাজ ছাড়েনি। জাহাজের এঞ্জিন অকস্মাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় মেরামত করার জন্য দু-একদিন বিলম্ব হবে।

কৃষ্ণা জাহাজ সাচ্চর্চ করবার জন্য পুলিশ-কমিশনারের কাছ থেকে ম্যাজিষ্ট্রেটের সহি-মোহর-করা যে ওয়ারেণ্ট নিয়ে এসেছিল, সেখানা হস্তগত করবার জন্যই যে নিশীথ-রাত্রে তার দ্বিতলের শয়ন-গৃহে লোক প্রবেশ করেছিল তা বুঝতে কৃষ্ণার বিলম্ব হয়নি।

যে কোন রকমে হোক, সুচেৎ সিংয়ের দলের লোকরা জেনেছে, জাহাজ ছাড়বার আগেই কৃষ্ণা ওয়ারেণ্টের বলে জাহাজ সাচ্চর্চ করবে। সে-ওয়ারেণ্ট তাই হস্তগত করবার চেষ্টা করেছে; তাছাড়া আরও উদ্দেশ্য ছিল। কৃষ্ণার ফাইলে সুচেৎ সিং আর আউলিংয়ের সমস্ত রেকর্ড আছে, লছমীর ফটো আছে-কৃষ্ণা কথা-প্রসঙ্গে এ-কথা পুলিশ-কমিশনারকে জানিয়েছিল। নিশ্চয় কমিশনারের অফিসে এমন কোন লোক আছে, যে এ-সব কথা জানতে পেরে সুচেৎ সিংকে জানিয়েছে। নিজেদের অপরাধের রেকর্ড হস্তগত করাও ছিল ওদের মতলব এবং সেইজন্যই গতরাত্রে অতর্কিত আক্রমণ।

সকালে সন্ধান করে জানা গেছে, দোতলার ঘরের নীচে যে সরু গলি, ঐ সরু গলি-পথে তারা প্রবেশ করেছিল-দড়ির মইয়ের সাহায্যে জানালা পেয়েছিল। জানালার কপাট খোলা ছিল এবং সেই সুযোগে কোনরকমে নিঃশব্দে তিনটি রড সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছিল।

কৃষ্ণার নিদ্রা অকস্মাৎ না ভাঙ্গলে হয়ত তার উপর এ-আক্রমণ হতো না। ঘুমন্ত অবস্থায় তারা কৃষ্ণাকে ক্লোরোফর্ম্ম দিয়ে অচেতন করবার সময়েই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফটো আর রেকর্ড তারা হস্তগত করেছে, ওয়ারেন্টও তারা ড্রয়ার খুলে বার করে নিয়েছে। কিন্তু নিয়ে কোন ফল হয়নি। জাহাজের এঞ্জিন খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাদের রওনা হওয়া ঘটেনি।

নিশ্চয় তারা সেই বস্তীর আড্ডাতেই আছে-হয়ত প্রণবেশকেও সেখানে আটকে রেখেছে।

শান্তা যে-ঠিকানা দিয়ে গেছে, সেটা কৃষ্ণার বালিশের তলায় ছিল। সেই ঠিকানাতেই সে এসেছে- যদি সন্ধান মেলে!

সুজন সন্দিগ্ধ ভাবে মাথা নেড়েছেন, বলেছেন, ”এখনও পর্য্যন্ত তারা সেখানে আছে, আমার তা মনে হয় না, কৃষ্ণা। ক্রিমিনলজিতে তা বলে না। তাই বলছি হয়ত কেন, নিশ্চয় তারা ওখান থেকে সরে গেছে।”

কৃষ্ণা বলেছে, ”গেলেও সেখানে অনেক কিছু জানতে পারা যেতে পারে সুজন মামা।”

সুজন আর তাকে বাধা দেননি।

খিদিরপুর থানার ইনস্পেক্টর মিষ্টার রাও সঙ্গে এসেছেন, কমিশনারের নির্দ্দেশে কৃষ্ণা পুলিশ-সাহায্য পেয়েছে।

এতগুলি পুলিশের আগমন বস্তীর লোকদের রীতিমত শঙ্কিত করে তুলবে জেনে তাদের পথে রেখে এসেছে।

সরু গলি-পথ দিয়ে ঢুকতে থাকে-কৃষ্ণা, তার পিছনে চলেন সুজন আর মিষ্টার রাও।

কাছাকাছি এসে কৃষ্ণা থামে। অন্ধকার পথ, ইলেকট্রিক আলো নেই-দূরে-দূরে এক-একটা গ্যাসপোষ্ট-তাতে জ্বলছে গ্যাস-বাতি।

পাশে একটা হোটেল। এই হোটেলের সামনে একটা গ্যাসপোষ্ট-তার আলোয় হোটেলের নম্বর কৃষ্ণা দেখতে পায়। ব্যাগ থেকে নম্বর-লেখা কাগজখানা বার করে সে একবার মিলিয়ে নেয়।

সোৎসাহে সে বলে, ”এই বাড়ী সুজন মামা। শান্তা আমায় এই নম্বরই দিয়েছে। দেখুন, হোটেলের নাম তাজমহল হোটেল।”

রাও বোম্বের লোক-হাসি-মুখে তিনি বললেন, ”ঠিক কথা, হোটেল তাজমহলই বটে! চলুন, এখানে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের মনে পাঁচটা সন্দেহ জাগিয়ে না তুলে-হয় ফেরা যাক, না হয়-”

বাধা দেয় কৃষ্ণা, ”ফিরব না মিষ্টার রাও। চলুন, ভিতরে যাওয়া যাক। এর সঙ্গে একটা চায়ের ষ্টলও রয়েছে-ওখানে চা খাওয়া যাবে।”

সুজন বললেন, ”চা না খেয়ে আমি এক পা নড়ছিনে, মিষ্টার রাও। চলুন, ঢোকা যাক।”

সাধারণ পোষাক-পরা রাওকে পুলিশের লোক বলে চেনা যায় না। এ-থানায় তিনি সদ্য এসেছেন-কাজেই এ-অঞ্চলের লোকেরা তাঁকে এখনও চেনেনি; সেই ভরসাতেই তিনি বেউর্দ্দি সাধারণ বেশে এসেছেন।

কনষ্টেবল ক’জনও সাদা পোষাকে এসেছে, তারা রাওয়ের আদেশে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে। কথা আছে, যদি কিছু ঘটে, রাও হুইশল দেবেন-সঙ্গে-সঙ্গে তারা অমনি সেখানে আসবে।

হোটেলের মধ্যে চায়ের ষ্টল। তার উপরে লেখা-তাজমহল রেস্তঁরা।

পিছনে তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, ”আসুন!” বলতে-বলতে সে এগিয়ে যায়।

নয় – আজব খানা

মাঝখানে লম্বা একটা বড় টেবিল-তার চারপাশে ক’খানা চেয়ার। যেমন টেবিলের চেহারা, চেয়ারগুলিও তেমনি-রং-চটা, বিবর্ণ। কতকাল আগে এগুলি এখানে স্থান নিয়েছে, বোঝা দায়!

চারটি কোণের দু-কোণে দু’জন করে বসবার চেয়ার আর একটি করে ছোট টেবিল পাতা। কৃষ্ণা যখন এই রেস্তঁরায় ঢুকলো, তখন ক’জন লোক চেয়ারে বসে চা পান করতে করতে গল্প করছিল-তাদের দেখে জাহাজের খালাসি বলে মনে হয়। এক সুন্দরী মহিলার সঙ্গে দু’জন পুরুষকে প্রবেশ করতে দেখে তারা বেশ আশ্চর্য হলো-তাদের কথাবার্তা মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।

রেস্তঁরার মালিক সসম্ভ্রমে এগিয়ে আসে। তার এখানে সাধারণতঃ কুলি ক্লাশের লোকই আসে, সম্ভ্রান্ত মহিলা বা পুরুষ আসেন ক্বচিৎ কখনও।

সুজন জিজ্ঞাসা করেন, এ-রেস্তোরার ম্যানেজার কে? কার সঙ্গে কথা বলব?”

মালিক দু-হাত কপালে ঠেকায়, বিনীত কণ্ঠে বলে, ”আজ্ঞে স্যার, আমি ম্যানেজার-আমি মালিক। যা বলতে চান, আমায় বলতে পারেন।”

লোকটির রঙ যেমন মিশ কালো-তেমনি জোয়ান চেহারা। মাথায় বেশ লম্বা-বুকের পাটাও বেশ চওড়া। তাকে দেখলে ভয় হয়! চোখ ছোট, লাল-নাকটা উঁচু-কাফ্রীর মত ঠোঁট-মোটা উল্টানো! গায়ে একটা হাত-কাটা বেনিয়ান-পরনে সবুজ-ডোরা লুঙ্গি, পায়ে একজোড়া চটি।

একদৃষ্টিতেই কৃষ্ণা তার মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত দেখে নিলে। পলকের দৃষ্টিপাতে লোকটির প্রকৃতিও বেশ উপলব্ধি হলো।

সুজন বললেন, ”আমাদের একটু আলাদা ভাবে বসবার ব্যবস্থা করতে হবে, আর চা-টোষ্টের বন্দোবস্ত যাতে ভাল হয়, করে দিতে হবে।”

”এখনি, এখনি স্যার।”

মালিক একেবারে শশব্যস্ত হয়ে ওঠে, ”হরিরাম লছমন-চটপট এঁদের আলাদা বসবার ব্যবস্থা করে দে-একটুও না দেরী হয়।”

চটপট ব্যবস্থা হয়ে গেল। একপাশে একটি টেবিল পরিষ্কার ভাবে মুছে তার সামনে তিনখানি চেয়ার দেওয়া হলো।

রং-চটা টিনের চেয়ারে বসতে ঘৃণা হয়, তবু না বসা ছাড়া উপায় নাই। একবার মুছে দেওয়া সত্ত্বেও রুমাল দিয়ে আর একবার মুছে কৃষ্ণা বসল।

বসতে বসতে সুজন চাপা-গলায় বললেন, ”কৃষ্ণার যত আজগুবি খবর আর সে-খবর পাবামাত্র হাওয়ায় ভর করে ছোটা! এ-রকম জায়গায় কোন ভদ্রলোক কখন আসে-না বসে?”

ততক্ষণে মালিক এসে কাছে দাঁড়ায়, বিনীত হাসি হেসে বলে, ”আপনাদের কষ্ট হচ্ছে এই নোংরা জায়গায়, তা জানি। তবু আমি আমার ক্ষমতায় যতখানি কুলোয়, আপনাদের খাতির করে যাব। আমার রেস্তঁরা দেখতে খারাপ হলেও জিনিষ খারাপ পাবেন না, এ-কথা আমি জোর করে বলতে পারি, স্যার। সহরের সেরা জিনিষ আপনারা এখানে পাবেন, তা আমি লিখে দিতে পারি। আমার রেস্তঁরায় খাবারের নাম আছে, স্যার। গ্রেভি, চপ, কাটলেট, কারি, ডিম, রোষ্ট, ক্রোকে, পুডিং-এখানে যা হয়-এক চৌরঙ্গীর বড় হোটেল ছাড়া তেমন আর সহরের কোথাও পাবেন না। এখানে আপনাদের মত বড় বড় রইস লোক মাঝে-মাঝে পায়ের ধূলা দেন, তাঁদের জন্য ভাল জিনিস আমায় রাখতে হয় কিনা-আপনারা নিজেরাই দেখে নেবেন।”

যে-সব কুলি শ্রেণীর লোক চা খাচ্ছিল, তাদের কাছ থেকে দাম আদায় করবার জন্য সে তার সহকারীকে নির্দ্দেশ দিতে ওদিকে যেতেই কৃষ্ণা চাপা সুরে বললে, ”লোকটা সুবিধার নয়, সুজন মামা। মিষ্টার রাও নিশ্চয়ই জানেন-ওঁর এলাকায় এ-রেস্তঁরা-এর মালিক কি ধরণের হয়। একে দেখে আমার সুচেৎ সিংয়ের কথা মনে পড়ে!”

কথা শেষ হওয়ার আগেই রাও বললেন, ”কিন্তু মনে রাখবেন কৃষ্ণা দেবী, আমি পাঁচ-ছ’দিন মাত্র এখানে এসেছি। কাজেই প্রত্যক্ষ ভাবে এদের পরিচয় পাবার সুযোগ-সুবিধা আমার হয়নি। কাগজে-পত্রে যা জেনেছি, লোকের মুখে যা শুনেছি, তাতে বুঝেছি, মালিক এমদাদ লোক হিসাবে অদ্বিতীয়-ওর জুড়ি মেলা ভার! এ-অঞ্চলে এমদাদ ভয়ানক নামডাকওয়ালা। মাঝে-মাঝে ওর জন্য এখানে পুলিশ আসে। সেই জন্যই ঐ কথাটা বললে যে রইস-লোক মাঝে-মাঝে এখানে পায়ের ধূলা দেন!”

সুজন সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ”তাহলে আমাদের চিনতে পেরেছে?”

রাও বললেন, ”না। সে-সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ। আপনি কলকাতার লোক নন, আমিও সম্প্রতি এসেছি, আর কৃষ্ণা দেবী যদিও বহু কাজ করে আসছেন, তবু অনেকে ওঁকে এখনও চোখে দেখেনি।”

সুজন বললেন,”তবু সাবধান থাকা ভাল। আপনার কনষ্টেবলরা কোথায় রইল? তাদের কাছাকাছি রাখলে ভাল হতো।”

কৃষ্ণা বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললে, ”আপনি বড় বেশী বাজে বকছেন, সুজন মামা! বাঘের গর্ত্তে জেনে-শুনেই আমরা এসেছি, তা ত স্বীকার করবেন! আর প্রস্তুত হয়েই আমরা এসেছি। তাই বলছি, এ-সব কথা এখন থাক, অন্য কথা বলুন।”

অদূরে যারা বসেছিল, তারা মাঝে-মাঝে-এঁদের দিকে তাকাচ্ছিল! তাদের গল্পের বিষয় ছিল-খেলার মাঠে কে জিতেছে! ভারতবর্ষে শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দ্দশা, অসুখ-বিসুখ, অসুবিধা ইত্যাদি ধরণের বহু আলোচনাই চলছিল তাদের মধ্যে।

ওদিককার চেয়ার থেকে যে লোক উঠে দাঁড়াল, তার দিকে দৃষ্টি পড়তেই কৃষ্ণা অস্ফুটে বলে ওঠে, ”রঘুনাথ না?”

রঘুনাথ তার পরিচিত। রঘুনাথও তাকে চেনে। কিন্তু এতক্ষণ রঘুনাথ প্রত্যক্ষ ভাবে একবারও তার পানে তাকায়নি! রঘুনাথ দাগী আসামী, সম্প্রতি দশ-বারো দিন মাত্র জেল থেকে খালাস পেয়েছে- কৃষ্ণা সে-খবর পেয়েছে।

মালিক কাছে এলো, তার পিছনে কাপ-ডিস, চা, টোষ্ট প্রভৃতি নিয়ে দু’জন লোক। মালিক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চা, টোষ্ট প্রভৃতি পরিবেষণ করায়।

প্রশান্ত হাসি হেসে মালিক বলে, ”আপনারা দয়া করে যে আমার এখানে এসেছেন, আপনাদের বহুৎ মেহেরবাণি-আমারো নসিব, স্যর। একবার এখানে চা খেয়ে গেলে আর, ভুলবেন না-মেহেরবাণি রাখবেন-আমার অনুরোধ।”

”নিশ্চয়, নিশ্চয় মনে রাখব।”

বলতে-বলতে সুজন চায়ের কাপ তুলে নেন।

কৃষ্ণা টোষ্ট স্পর্শ করেনি, চা পান করতেও তার প্রবৃত্তি ছিল না। কেবল রাও তার হাতে কাপ তুলে দেওয়ার জন্য ভদ্রতা রাখতে সে এক-চুমুক চা পান করলে।

ঘরটা কখন জনশূন্য হয়ে গেছে, কেউ তা লক্ষ্য করেননি। সামনের গলি-পথ একেবারে নিস্তব্ধ। দূরে বস্তির কোন ঘরে কে গান গাইছে-তার জড়ানো স্বর ভেসে আসছে।

চা টোষ্ট খেয়ে সুজন পকেট থেকে মণিব্যাগ বার করে দামটা টেবিলে রেখে উঠবেন-মাথা কেমন ঘুরে উঠল যেন! তিনি দাঁড়াবার চেষ্টা করেও দাঁড়াতে পারেন না।

রাওয়ের অবস্থাও সেই রকম। ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে এসেছে-টেবিলের উপর মাথা রেখে সত্যই তিনি চোখ বুজলেন। সুজনের অবস্থাও তাই!

কৃষ্ণা বুঝতে পারে, চা বা টোষ্টে এমন কিছু দেওয়া হয়েছে-যাতে তাঁদের চৈতন্য বিলুপ্তপ্রায়! সে টোষ্ট স্পর্শ করেনি, চা এক চুমুক মাত্র খেয়েছে, তাই তার কিছু হয়নি।

”সুজন মামা-সুজন মামা! মিষ্টার রাও, এ কি! আপনাদের এমন ঘুম এলো কেন! উঠুন, বাড়ী যেতে হবে না?”

”হা-হা-হা-হা-”

পিছনে কদর্য্য কর্কশ অট্টহাস্য!

কৃষ্ণা মুখ ফেরায়-দেখে, এমদাদ হাসছে!

”ডাকুন কৃষ্ণা দেবী, ডাকুন! ডাকলেও ওঁদের জ্ঞান অন্ততঃ পাঁচ ঘণ্টার আগে ফিরবে না! এখন যদি ইনস্পেক্টর রাওয়ের আর সুজন-বাবুর হাত-পা কেটে বাদ দিই, বুকে ছুরি বসাই-তাতেও ওঁরা সাড়া দেবেন না, কৃষ্ণা দেবী!”

কৃষ্ণা হাঁফায়, ”তুমি-তুমি-কে তুমি?”

”আমি সুচেৎ সিং, কৃষ্ণা দেবী।”

মাথার পরচুলা সে টেনে খুলে ফেলে, রুমালে মুখের রং মুছে ফেলে-অমনি কয়েক বৎসর আগেকার পরিচিত সুচেৎ সিংয়ের মুখখানা কৃষ্ণার চোখের সামনে ফুটে ওঠে।

রোষে গর্জ্জন করে কৃষ্ণা দাঁতে ঠোঁট চাপে, ”আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম!”

সুচেৎ সিং বললে, ”কিন্তু আপনি ত জেনে-শুনেই এসেছেন কৃষ্ণা দেবী। বেইমানী করে শান্তা একদিন আমার অজানতে আপনার বাড়ীতে গিয়ে আমাদের এখানকার ঠিকানা আপনাকে দিয়ে এসেছে-আমাদের জাহাজের নাম, জাহাজ ছাড়বার সময়-সব জানিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, আজ সকালেই আমাদের জাহাজ ছাড়ত! তা হলো না শুধু শান্তার শয়তানীর জন্য।”

তার চোখের দৃষ্টিতে যেন আগুনের হলকা!

কৃষ্ণা বুঝতে পারে-জাহাজের এঞ্জিন বিকল করার মূলে তাহলে শান্তার হাত আছে! কিন্তু তা নিয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করে না।

সুচেৎ সিং বলে, ”যাই হোক, আজ আপনাকে আমি আমার এখানে অতিথি হিসাবে পেয়েছি-আমার বরাতজোর। এঁরা এখানে এমনি পড়ে ঘুমোন-আমার লোকজন এঁদের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আপনাকে আমার দরকার-আপনি উঠুন।”

কৃষ্ণা তাকিয়ে দেখে, রেস্তরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে! মনে-মনে শঙ্কিত হয়ে ওঠে সে। কনষ্টেবল ক’জন এসেছে-তারা সাঙ্কেতিক শব্দের অপেক্ষায় এদিক-ওদিক ঘুরছে-জানে না, কৃষ্ণারা কোথায় এসেছে!

মুখে সাহস দেখায় সে, বলে, ”কোথায় যেতে হবে?”

সুচেৎ সিং হাসে, বলে, ”এখানে আপনাকে রাখব না। ভালো কথায় আপনি না ওঠেন, বাধ্য হয়ে আমায় অন্য উপায় করতে হবে।”

কৃষ্ণা দৃঢ়কণ্ঠে বললে, ”তুমি আমাকে চেন না সুচেৎ সিং, তাই আমায় হুকুম করতে এসেছ!”

”খুব চিনি কৃষ্ণা দেবী। তার প্রমাণ চান?”

সুচেৎ সিং এগিয়ে আসে কৃষ্ণার দিকে।

কৃষ্ণা বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়ায়-রিভলভারটা বার করে বাগিয়ে ধরে সে বলে, ”না, চেন না আমাকে। জেনে রেখ, সহজে আমায় নিয়ে যাওয়া তোমার কাজ নয়। আর এক-পা এগোও যদি-গুলি করব!”

অকস্মাৎ পিছন দিক থেকে কে যেন তাকে দু-হাতে চেপে ধরে-তার নিষ্ঠুর পেষণে কৃষ্ণার হাত থেকে রিভলভার খসে পড়ে।

”শয়তান!”

প্রাণপণ চেষ্টায় নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে কৃষ্ণা।

সামনে এগিয়ে আসে সুচেৎ সিং।

তরুণী মেয়েটিকে পরাস্ত করতে দেরী হয় না। সুচেৎ সিং নিজে জোয়ান-তার উপর যে চর তার এলো, সেও বেশ জোয়ান। দু’জনে কৃষ্ণাকে ধরে কায়দা করে তার হাত-পা বেঁধে ফেলে!

চীৎকার করে ফল নেই জেনে কৃষ্ণা নিঃশব্দে কেবল চেয়ে থাকে।

কপালের ঘাম মুছে সুচেৎ সিং বলে, ”হাঁ, বাহাদুর মেয়ে বটে! চোট দিয়েছ-তাতে রীতিমত ঘায়েল হয়েছি, এ-কথা স্বীকার করব। নারাণ সিং, একে নিয়ে সেই কুঠরীতে রাখ গিয়ে। তারপর ব্যবস্থা করব।”

মুহূর্ত্তে কৃষ্ণার মুখের উপর কি একটা এসে পড়ে! মনে হয় যেন দম বন্ধ হয়ে এলো! নিশ্বাস নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা-কৃষ্ণার সংজ্ঞা লোপ পায়।

দশ – লছমী বাঈ

কতক্ষণ পরে-

ধীরে ধীরে কৃষ্ণার চেতনা ফেরে।

শরীর অত্যন্ত দুর্ব্বল মনে হয়। সেদিন তাকে ক্লোরোফর্ম্ম বা এমন কোন কিছু দিয়ে অচেতন করে এরা, আজও ঠিক তাই করেছে। পর-পর দুবার অজ্ঞান হয়ে থাকার ফলে আজও তার শরীরে এতটুকু শক্তি নাই যেন!

চোখ মেলে তাকায় কৃষ্ণা।

ছোট একখানা অন্ধকার ঘর। ঘরের একদিকে একটি ছোট দরজা, উপর-দিকে খানিকটা ফাঁকা, খুব সম্ভব একটা জাল বসানো। সেখান থেকে যে-টুকু আলো বাতাস এ ঘরে আসে, তাতে মনে হয়, উপরে কোন ঘর নেই।

এ কোন জায়গা? খিদিরপুর অঞ্চলের হোটেল তাজমহলের অংশ? না, সে যখন অজ্ঞান ছিল, তখন তাকে আর কোথাও নিয়ে এসেছে এরা?

এখন দিন, না রাত্রি-তাও বুঝতে পারছে না! অনুভবে বুঝছে, হয়ত দিন! উপরে জালতির ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো আসছে, তাতে ঘরের অন্ধকার পাতলা হয়ে আছে।

মনে পড়ছে রাত্রির কথা। সুজন আর মিষ্টার রাও অচৈতন্য অবস্থায় লুটিয়ে পড়েছিলেন! তাঁদের দু’জনকে এরা কি করলে? খুন করেনি ত?

খুনের কথা মনে হতে কৃষ্ণার বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসে! পর-মুহূর্ত্তে নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দেয়-তাঁদের খুন করা লছমী বাইয়ের উদ্দেশ্য নয়, এমন কি তাকেও লছমী প্রাণে মারবে না। হত্যার উদ্দেশ্য থাকলে যখন তাকে আক্রমণ করেছিল, তখন একখানা ছোরা তার বুকে বসিয়ে দিলেই পারত, তাকে বন্দিনী করবার প্রয়োজন ছিল না!

হাত-পায়ের বাঁধন কখন এরা খুলে দিয়েছে। অসহ্য পিপাসায় গলা-বুক শুকিয়ে জ্বালা করছে। এদিক-ওদিক চাইতে সে দেখে, দেয়ালের কোণ-ঘেঁষে একটি কুঁজো, তার মুখে একটা কাঁচের গ্লাসও আছে।

না, এদের মনে দয়া আছে-মনগুলা একেবারে পাথর নয়!

জ্ঞান হলে পিপাসা অনুভব করবে সে, তা জেনে, জলের কুঁজো আর গ্লাস তার পাশেই রেখে দিয়েছে।

এক গ্লাস জল এক-নিশ্বাসে পান করে কৃষ্ণা এতক্ষণে ভাববার অবকাশ পায়-অনেকটা শান্তি অনুভব করে।

চারিদিকে একবার চেয়ে দেখে। চওড়া-মোটা কাঠের দেওয়াল-নীচে থেকে একেবারে ছাদ পর্য্যন্ত টানা। এই মোটা কাঠের আস্তরণ ভেদ করে বাইরের কোন শব্দ কাণে এসে পৌঁছায় না।

দরজায় খট-খট করে শব্দ। মনে হয়, কে দরজার বাইরে তালা-চাবি খুলছে।

আস্তে-আস্তে দরজা খুলে যায়। সেই খোলা দরজার উপরে দাঁড়ায় একটি মেয়ে! তার পিছনে গলি, গলিটা অন্ধকার মনে হয়।

কৃষ্ণা বিস্মিত চোখে তাকায়, আবছা-অন্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। তবু চেহারা দেখে মনে হয়, লছমী ছাড়া আর কেউ নয়।

বিদ্রূপের সুরে মেয়েটি বলে, ”এই যে, উঠে বসেছ কৃষ্ণা দেবী। আশা করি, এখন একটু সুস্থ বোধ করছ!”

কৃষ্ণা কোন জবাব দেয় না।

মেয়েটি এক-পা অগ্রসর হয়ে আসে, বলে, ”আমার আজ ভারী আনন্দ হয়েছে কৃষ্ণা দেবী। তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা হলো! আমার অনার্ড গেষ্ট হয়ে আমার এখানে থাকতে তোমার আপত্তি হবে না, আশা করি।”

কৃষ্ণা বললে, ”আটকে বন্দী করে রেখে তার সঙ্গে তামাসা-কোন সভ্য শিক্ষিত লোকের উচিত নয়, লছমী বাই, আশা করি, এ-জ্ঞানটুকু তোমার আছে!”

খিল-খিল করে হেসে ওঠে লছমী বাই। ”ও, তুমি আমায় চিনেছ কৃষ্ণা। আমি ভেবেছিলাম, চিনতে পারবে না। অনেক দিন-প্রায় চার বছর পরে আবার দেখা! আশা করি, ভালোই আছ।”

কৃষ্ণা স্বাভাবিক ভাবে বলে, ”হ্যাঁ, এ-অবস্থায় মানুষ যেমন সুখে-স্বচ্ছন্দে ভালো থাকে, আমিও তেমনি ভালো আছি। হ্যাঁ, অনেক দিন পরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা। অনেক দিন পরে তুমি বাংলা দেশে এসেছ, আনন্দের কথা খুবই।”

লছমী বাই বললে, ”ভারতবর্ষে ছিলুম না, থাকলে অনেক আগেই কলকাতায় ফিরতাম। গিয়েছিলাম কন্টিনেন্ট ঘুরতে, একটু ভালো রকম শিক্ষা লাভ করতে। দেখলাম, এখানকার শিক্ষা ঠিক তোমাদের শায়েস্তা করবার মত নয়। তোমরা আঁচ করেল বুঝতে পারো, তাই খানিকটা বৈদেশিক শিক্ষার প্রয়োজন হলো বই কি। হ্যাঁ, আজ তোমার এগজামিন না? এ-বছরটাই মাটি করলে!”

দাঁতে ঠোঁট চাপে কৃষ্ণা।

আজই বি, এ এগজামিন আরম্ভ! দু-বছর প্রাণপণ পড়ার ফল তার এমনি ভাবেই নষ্ট হয়ে গেল!

মাথাটা দু-হাতে সে টিপে ধরে।

কথায় অনেকখানি দরদের ভাব মিশিয়ে লছমী বলে, ‘সত্যি, বিশ্বাস কর কৃষ্ণা দেবী-তোমার এ-বছরটা নষ্ট হলো, পরীক্ষা দেওয়া হলো না-তার জন্য আমি মর্ম্মান্তিক দুঃখিত। যাক, সামনের বছর আর এ-রকম কোন ফ্যাসাদে নিজেকে জড়িয়ো না-যাতে পরীক্ষা দিতে পার, বি, এ, ডিগ্রী নিতে পার, তার চেষ্টা করো।”

কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে!

কৃষ্ণা সেই রকম জ্বলে ওঠে-বেশ তিক্ত কণ্ঠে বলে, ”থাক, তোমাকে আমার জন্য মাথা ঘামাতে হবে না, লছমী। দয়া করে আমার একটি কথার জবাব দেবে? আমাকে তোমরা কোথায় এনেছ? এ খিদিরপুরের সেই তাজমহল হোটেল?”

লছমী বাই হাসে বলে, ”আমার এতখানি সাহস নেই যে, তোমাকে হোটেল তাজমহলেই রাখব। এতক্ষণে তোমার মামাবাবু, রাও সাহেব আর তোমার সুজন মামা বোধ হয় হোটেল তাজমহল চষে ফেলেছেন পুলিশ এনে। তোমাকে কোথায় এনেছি জানো না? এ-জায়গার নাম পেনিটি-ঘনশ্যাম আগরওয়ালার বাগান-বাড়ী। চেনো, বোধ হয়, এ বাগান-বাড়ী? আমার বাবা-সুন্দরলালকে গ্রেপ্তার করবার জন্য তুমি একবার এখানে এসেছিলে ত!”

ঘনশ্যাম আগরওয়ালার বাগান-বাড়ী!

কৃষ্ণা মুহূর্ত্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ”বুঝেছি-চিনেছি। আমাকে আটক-বন্দী করে রেখেছ। শুনলাম, এর মূলে তোমার প্রতিহিংসা নেবার সাধ-যার জন্য তোমায় ইউরোপ পর্য্যন্ত গিয়ে শিক্ষা নিতে হয়েছে! কিন্তু একটা কথা, আমার মামা বেচারা কি অপরাধ করেছেন, যার জন্য তাঁকে তোমরা ধরে এনে আটক করেছ! কোথায় তাঁকে রেখেছ-কি ভাবে রেখেছ, কে জানে!”

লছমী বাই বললে, ”সোজা কথায় বলছি, তাঁকে ধরে আটক করা হয়েছিল তোমায় ফাঁদে ফেলবার জন্য। নাহলে ঐ গোবেচারা লোকটিকে অনর্থক আটক করে রাখায় কোন লাভ হয়নি-উল্টে লোকসান দিতে হয়েছে। একদিক দিয়ে তিনি বোকাসোকা ভালো মানুষ, অন্যদিক দিয়ে এমন ভয়ানক যে, তার কল্পনা করা যায় না। প্রথম রাত্রেই চৌরঙ্গীর বাড়ী থেকে আনবার সময় তিনি আমাদের দু’জন লোককে এমন জখম করেছেন-যার ফলে তাদের বিছানা নিতে হয়েছে। যাই হোক, তাঁকে আটক করার ফল ভালোই হয়েছে-তুমি নিজে এসে ফাঁদে পা দিয়ে জড়িয়ে পড়েছ। আমি আর যাই হই, মানুষ বলেই তোমার এখানে আনার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছি। এমন কি, তাঁকে সোজা বাড়ীতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে! এ-কথা বিশ্বাস করবে?”

এরা এ-সব ক্ষেত্রে মিথ্যা কথা বলে না। তাই কৃষ্ণা লছমী বাইয়ের কথা বিশ্বাস করে অনেকটা আশ্বস্ত হয়। নিজের জন্য সে ভাবে না, এ-রকম ঢের বিপদে সে পড়েছে। কিন্তু আশ্চর্য্য বুদ্ধির জোরে সে সব বিপদ থেকে উদ্ধারও পেয়েছে। এখান থেকে সে যে-কোন উপায়ে মুক্তি পাবে, তা জানে। তার যত ভাবনা ছিল শান্ত প্রকৃতি মামাবাবুর জন্য।

নিতান্ত নিরীহ ভাবে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে ”যাক, তোমার কথা শুনে সত্যই খুশী হয়েছি লছমী বাই। মামাবাবুকে আটক করে ফাঁদ ফেলে আমায় ধরেছো, তা বুঝেছি। এও বুঝেছি, কিছুদিন আগেই তোমরা এসেছ। তুমি, তোমার সঙ্গী-কি, মস্ত পেট্রন ঘনশ্যাম আগরওয়ালার বাড়ীতে রয়েছে, আর তোমার লোকজন সহরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে? সেদিন আমরা যাব বলেই তোমরা চারজন মেট্রোয় ব্যালকনিতে টিকিট কেটেছিলে-নয় কি?”

লছমী বাই হাসলো, তারপর গম্ভীর মুখে বললে, ”তুমি অনেক খবরই পেয়েছ দেখছি। কিন্তু এখন তোমার সঙ্গে গল্প করবার সময় আমার নেই। এরপর সময় হবে কথা বলবার, মনে হয়। তোমার কোন অযত্ন হবে না! কেবল যা একটু অন্ধকার! তা দুদিন থাকলেই এ-অন্ধকার সয়ে যাবে। এখন আসি, কৃষ্ণা দেবী।

লছমী বেরিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে ঝনাৎ করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

এগারো – জালতির ফাঁকে

সময় কেটে যায়।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা-রাতের পর দিন-আবার দিনের পর রাত।

নিঃশব্দে কৃষ্ণার আহার্য্য দিয়ে যায় একজন স্ত্রীলোক।

প্রথম দিন কৃষ্ণা ঘুমিয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারেনি, কে কখন নিঃশব্দে এসে খাবার আর জল রেখে গেছে।

শুকনো ক’খানা রুটি, তার সঙ্গে ডাল আর সামান্য কিছু তরকারী। বাধ্য হয়ে তাই খেতে হয়েছে কৃষ্ণাকে।

দ্বিতীয় দিনে সে সতর্ক ছিল। দেখে, নিঃশব্দে আসে এক বৃদ্ধা আস্তে-আস্তে খাবার রেখে বেরিয়ে যায়।

কৃষ্ণা তার সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোন কথাই সে বোঝে না। কৃষ্ণা যতগুলি ভাষা জানে, সব ক’টিই ব্যবহার করেছে। বৃদ্ধা শুধু তার পানে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হয়, বৃদ্ধা কাণে শুনতে পায় না।

এই বয়সেই কৃষ্ণা অনেক মানুষ দেখেছে-মানুষের অনেক আচরণ দেখেছে! সে জানে, এ-রকম কাজে বদমায়েসরা এই বুড়ীর মতন লোক রাখে-কালা-বোবা-কাণা দেখে। তার কারণ, তাদের অন্দি-সন্ধির কোন হদিশ জানবে না-কারো কাছে ইঙ্গিতে ভঙ্গীতে কিছু ফাঁস করতে পারবে না! বাইরের লোককে এরা দলের কোন কাজে রাখে না-রাখলে বিপদ!

তবু সে ভাবে, মামাবাবু যদি বাড়ীতে পৌঁছে থাকেন। বাড়ীতে আছে বৃদ্ধ বনমালী আর মানদা। তারা দু’জনে কি যে করছে, কে জানে! হয়ত অসহায়ের সহায় ব্যোমকেশবাবুর কাছেই তারা দৌড়াদৌড়ি করছে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে!

কলকাতায় হয়ত আসামীর সন্ধানে খুব তোড়জোড় চলেছে-কৃষ্ণার সন্ধানের জন্য হয়ত পুরস্কার ঘোষণা হয়েছে! কৃষ্ণা যে পানিহাটিতে আগরওয়ালার বাগানে আটক আছে, এমন কথা স্বপ্নেও কারো মনে হতে পারে না।

ঘনশ্যাম আগরওয়ালাকে কৃষ্ণা চেনে। আগে তিনি যাই থাকুন এখন লক্ষপতি-কোটিপতি মানুষ। একদিন সুন্দরলালের সঙ্গে ব্যবসাক্ষেত্রে নেমেছিলেন, সুন্দরলালের মৃত্যুর পর তার যা-কিছু ব্যবসা-সবই তিনি নিজের নামে করে নিয়েছেন। লছমী বাই তার সব কিছু তাঁর উপর ছেড়ে দিয়েছে। ঘনশ্যাম শুধু তার পিতৃ-বন্ধু নন, তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-এ-কথাও কৃষ্ণা শুনেছে।

নিজের নির্ব্বুদ্ধিতার জন্য-বেহুঁশিয়ারী আর অতিদর্পের জন্য নিজের উপর কৃষ্ণার রাগ হচ্ছে। এ-কথাটা ভাবেনি এমন নয়। প্রণবেশকে চুরি করবার মূলে কারও কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না-প্রণবেশকে সকলে চেনে! কৃষ্ণাকে হস্তগত করতে হলে প্রণবেশকে হস্তগত করা চাই, বুদ্ধিমতী লছমীর ফন্দী-তাতে ভুল নেই!

কিন্তু শান্তা? সে মেয়েটি কে? কোথায় গেলো? কৃষ্ণা তার জন্যও কম উৎকণ্ঠিত নয়!

যদিও সে এদের মানুষ-তবু কৃষ্ণার বিশ্বাস, শান্তা সম্পূর্ণ নির্দ্দোষ। নিষ্ঠুর পিতা হাতের পুতুল করে তাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে, তার সর্ব্বনাশ করছে!

কৃষ্ণা ভাবে, জগতে এমন বাপও থাকে-সন্তানের অনিষ্ট করে যে সম্পদ চায়-সুখে থাকতে চায়! শান্তাকে দেখে-শান্তার কথা শুনে তার বিশ্বাস, শান্তা কোন দোষে দোষী নয়! তার মুখে মুক্তির ব্যাকুলতা দেখেছে কৃষ্ণা। এখানে সে ফিরে এসেছে-কিন্তু কোথায়? একদিন মাত্র সুচেৎ সিংয়ের মুখে সে শুনেছিল, শান্তার কৌশলে যে-রকমেই হোক জাহাজের এঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে! দুর্ভাগিনী শান্তাকে নিশ্চয় এদের হাতে শাস্তি নিতে হয়েছে! কে জানে? তিলে তিলে মৃত্যুর বিভীষিকায় সে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, সেই মৃত্যু-দণ্ডই তার উপর অর্পিত হয়েছে কি না!

দু-দিন-চার দিন, এক সপ্তাহ কেটে যায়, আবার নতুন সপ্তাহ আসে-সে সপ্তাহও চলে যায়!

সেদিন তখন গভীর রাত-আকাশে বোধ হয় মেঘ জমেছিল। সন্ধ্যার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে চারিদিক জলময় হয়ে উঠেছে। উপরের জালতির ফাঁক দিয়ে খানিকটা বৃষ্টির জল ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতেই কৃষ্ণা বুঝেছিল, নাহলে এ-ঘরে থেকে বাইরের বৃষ্টি পড়ার সম্ভাবনা সে জানতে পারত না।

কৃষ্ণা অনেকক্ষণ জেগেছিল-উপরের জালতি-পথে আকাশের বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল ছোট ঘরের মধ্যে। সেই দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা ভাবছিল নিজের ভবিষ্যতের কথা।

রাত্রি বাড়ে-চারিদিক নিস্তব্ধ-কোনদিকে জনমানবের সাড়া-শব্দ দিনের বেলাতে যেমন পাওয়া যায় না, এখনও তেমনি পাওয়া যায় না!

ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে।

”কৃষ্ণা দেবী-কৃষ্ণা, জেগে আছেন?”

কার যেন কণ্ঠস্বর শোনা যায়! কৃষ্ণার তন্দ্রার আবেশ কেটে যায়।

কিন্তু না, শত্রুপুরীতে দুর্গের মত সুরক্ষিত এ-ঘরে কে তাকে ডাকবে? গভীর রাত্রে উত্তেজিত মস্তিষ্কের বিকার হয়ত!

”কৃষ্ণা দেবী-কৃষ্ণা দেবী-”

না, সত্যই কে ডাকছে! উপর-দিক থেকে চাপা কণ্ঠ শোনা যায়। মনে হচ্ছে, উপরের জালতির উপর থেকে কে ডাকছে!

”কে? কে?”

কৃষ্ণা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।

উপরের দিক থেকে কথা শোনা যায়, ”আমি ডাকছি। আমি শান্তা।”

”শান্তা!”

কৃষ্ণা যেন আকাশ থেকে পড়ে! ”কোথা থেকে তুমি কথা বলছ?”

উপর থেকে শোনা যায়, ”ছাদ থেকে কথা বলছি। বহু কষ্টে আপনার সন্ধান পেয়েছি। এরা মানে, লছমি বাই আজ আমাকে এখানে রেখে গেছে। কলকাতায় আমাদের আড্ডায় পুলিশ আজই তল্লাসি করবে, লছমী বাই ঘণ্টা-তিনেক আগে জানতে পেরেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে সে শুধু আমাকেই পাঠায়নি, ওদের নোট জাল করার সরঞ্জাম-পত্র-যা-কিছু ওখানে ছিল, সব নিজে এনে এখানে রেখেছে। আশ্চর্য্য ক্ষমতা এ মেয়ের! দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। আপনাকে এখানে রেখেছে-এ-খবর আমি এসে আগে জেনেছি। কিন্তু কি করে কোনদিক দিয়ে আপনার কাছে আসব, বুঝতে পারছি না।”

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ”আমিও জানি না, আমি কোথায় আছি। দরজা খুলে রাখে না-তবু ঘর থেকে যেটুকু দেখা যায়, তাতে মনে হয়, সামনে একটা গলি আছে-উপরে ছাদ দেখা যায়। এই ঘরেরই বাইরের দিক। আমি ঠিক ধরতে পারছি নে, তাই তোমায় বলতে পারলাম না।”

শান্তার কণ্ঠ শোনা যায়, ”আমি কালকের মধ্যে যেমন করে পারি, পথ ঠিক করে নেব-অবশ্য যদি সুযোগ পাই। আমাকেও লছমী বাই আটকে রেখেছে। আপনার ঠিক উপরের পাশের ঘরে আমি আছি। তবে আপনার মত অত পাহারা আমার উপর নেই। শুধু বাইরে যেতে পারব না, এই যা!”

হঠাৎ তার কণ্ঠ থেমে যায়। মনে হয়, কেউ আসছিল, তাই বিপদের আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি সরে পড়েছে।

কৃষ্ণা উৎকর্ণ হয়ে থাকে। অনেকখানি সময় কেটে যায়, শান্তার সাড়া পাওয়া যায় না আর।

কৃষ্ণা ক্লান্তভাবে শুয়ে পড়ে-তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে।

বারো – শান্তার দুঃসাহস

সারাদিন দারুণ উৎকণ্ঠায় কেটে যায়-রাত্রির প্রথম দিকটাও তেমনি!

কৃষ্ণা জানে, বন্দিনী শান্তা সারাদিন এবং প্রথম রাত্রে কিছুতেই ছাদে আসতে পারবে না।

ক্রমে রাত্রি বাড়ে।

উপরে একটা শব্দ-খস-খস-খস-কে যেন কি কাটছে! শব্দটা উপরে হয়তো ততখানি ছড়িয়ে পড়তে পারছে না-বাতাসে শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ঘরের মধ্যে শব্দ বেশ জোরে পাওয়া যাচ্ছে!

”কৃষ্ণা দেবী-”

কৃষ্ণা তাকায় উপর দিকে।

শান্তা বলে, ”জেগে আছেন?”

কৃষ্ণা জবাব দেয়, ”ঘুম আমার আসে কৈ, শান্তা! এ-অবস্থায় মানুষ ঘুমোতে পারে না।”

শান্তা বলে, ”এই ফাঁক দেখছেন, আমি একটা দড়ির মই ফেলে দিচ্ছি, মইয়ের এ-দিকটা আমি বেশ শক্ত করে বেঁধেছি-পড়বার ভয় নেই। আপনি এটা ধরে উপরে উঠে আসুন। তারের জালতি আমি কেটে ফেলেছি উকো ঘষে। পথ খোলা। আপনি সরে কোণে গিয়ে দাঁড়ান-আমি মইটা ফেলে দিচ্ছি।”

কৃষ্ণা সরে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে দড়ির মই ঝুলতে-ঝুলতে নেমে আসে।

অন্ধকারে আন্দাজে কৃষ্ণা দড়ি ধরে; তারপর পাকগুলো খুলে পরখ করে, উপর দিকে বাঁধন বেশ শক্ত কি না।

তারপর সেই সিঁড়ি ধরে অবলীলায় সে উপরে উঠে আসে।

উপরে দাঁড়িয়ে শান্তা। শান্তা কালো শাড়ী পরেছে-রাতের অন্ধকারে শান্তার শাড়ীর কালো রঙ মিশে গেছে!

কৃষ্ণা ছাদে উঠে দাঁড়ায়। ধরণীর মুক্ত বাতাস-আরাম বোধ করে। তারপর আপনা থেকে দু-হাত অঞ্জলিবদ্ধ হয়-ভগবানের উদ্দেশে সে জানায় প্রণাম।

ফিরে আবেগভরে শান্তার হাত-দুখানা চেপে ধরে আর্দ্র কণ্ঠে বলে, ”তোমার এ-উপকার জীবনে ভুলব না, শান্তা! মায়ের পেটের বোনও এমন করত কি না, জানি না! একদিন তোমাকেই আমি বিশ্বাস করিনি! সে-কথা মনে করতে আমার লজ্জা হচ্ছে শান্তা, তোমার পানে চোখ তুলে আমি চাইতে পারছি না।”

মৃদু হেসে নম্র কণ্ঠে শান্তা বলে, ”ও-সব কথা কেন? আপনি এখনও নিরাপদ নন। এদের ব্যবস্থা জেলখানার মত-পাহারা বদল হয়-তারা রীতিমত ওয়াচ করে। আপনার দরজার পাশে ছোট একটু ফাঁক আছে-দেখেছেন কখনো? আমি জালতির ফাঁক দিয়ে দেখেছি, ঐ ফাঁক দিয়ে বাতির আলো আপনার ঘরে পড়েছে-সব সময়ে আপনার উপর নজর রাখে! আপনার পাহারাদার খুব সম্ভব ঘুমিয়ে পড়েছে। মানুষের শরীর ত, না ঘুমোলে পারে কখনও? ঘুমিয়েছে বলেই বুঝতে পারেনি। জেগে আলো ফেলে যখন দেখবে, ঘরে আপনি নেই-তখন মহা হুলস্থুল বাধিয়ে তুলবে। তা বুঝছেন?”

কৃষ্ণা বললে, ”খুব বুঝেছি। কিন্তু ছাড়া যখন একবার পেয়েছি, সহজে আমাকে ধরতে পারবে না, শান্তা। আমার নিজের উপর সে-বিশ্বাস খুব আছে।”

দড়ির মইটা জড়িয়ে গুটিয়ে সে হাতে রেখেছে। যদি দরকার হয়, এই সিঁড়ি বেয়ে বাড়ীর বাহিরে কোন-রকমে নামতে পারবে।

ছাদের একেবারে শেষে একখানি ঘর। এই ঘরে থাকে শান্তা।

ছাদ থেকে ঝুঁকে কৃষ্ণা সেই অন্ধকারেই চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখবার চেষ্টা করে। শুধু অন্ধকার! অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না কোনদিকে।

হঠাৎ নীচে ঝনঝন শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। ঘড়ির ঘণ্টা নয়- রাত ক’টা বাজল, তা জানানো নয়! কৃষ্ণা জানে, বন্দী পালিয়েছে-এ-খবর চারিদিকে রটনা করা হলো! পাগলা-ঘণ্টি।

সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত-পুরী জেগে ওঠে!

ভয়ে শান্তা বিহ্বল! এখন উপায়?

কৃষ্ণা বললে, ”এতক্ষণ ভয়ানক সাহসের পরিচয় দিয়ে এমন ভয় হঠাৎ! না, চলো তোমার ঘরে। ছাদে এক-সেকেণ্ড নয়! তারপর ভেবে-চিন্তে বিহিত করা যাবে।”

চটপট দুজনে মিলে তারের সেই জালি টেনে ফিট করে চাপা দেয়। তারপর ছুরি আর উকো নিয়ে কৃষ্ণা ঢোকে শান্তার সঙ্গে শান্তার ঘরে।

সারা বাড়ী-বাড়ীর কম্পাউণ্ড ততক্ষণে জোর আলোয় আলো হয়ে উঠেছে! অন্ধকারের চক্র ভেদ করে আলোর লহর-লোকজন ছুটাছুটি করছে। তবে চেঁচামেচি নেই-সোরগোল নেই!

দুজনে শান্তার ঘরে-দরজায় হুড়কো বন্ধ-দুজনে উৎকর্ণ হয়ে শুনছে, বাহিরে কি হচ্ছে! বুকের মধ্যে যেন কামানের গাড়ী চলেছে!

শান্তার ঘরের দরজায় করাঘাত-শান্তা যেন কাঠ! কৃষ্ণার হাতখানা সে জোরে চেপে ধরে। নিঃশব্দে শান্তার হাত ছাড়িয়ে পাশের দরজা দিয়ে কৃষ্ণা ঢোকে পাশের ঘরে। বাথরুমে। কৃষ্ণা বাথরুমে ঢুকলে শান্তা নিঃশব্দে এদিক থেকে সে-ঘরের দরজায় শিকল টেনে দেয়, তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ে নিঃশব্দে।

দরজার বাহিরে ডাক, ”শান্তা-শান্তা-”

সুচেৎ সিংয়ের কণ্ঠ! শান্তা জবাব দেয় না, যেন ঘুমোচ্ছে।

আবার ডাক।

তারপর ঘুমন্ত লোকের হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলে যেমন ভাব, তেমনি ভাবে-ভঙ্গীতে দু-চোখ অর্দ্ধস্তিমিত-শান্তা খুলে দেয় ঘরের দরজা।

সুচেৎ সিংয়ের হাতে বড় টচ্চর্চ-দরজায় দাঁড়িয়ে-ঘরের মধ্যে টচ্চের্চর আলো ফেলে সে চারিদিক দেখে ভালো করে। তারপর ভ্রু কুঞ্চিত করে শান্তার পানে চেয়ে রুক্ষ কণ্ঠে বলে, ”ঘর থেকে তুমি বেরিয়েছিলে?”

বিস্মিত কণ্ঠে শান্তা বলে, ”বেরিয়েছিলুম! আমি? কোথায়? কখন? কৈ, না ত! কেন বলুন দিকি, এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন?”

সুচেৎ সিংয়ের ললাট কুঞ্চিত। অর্দ্ধস্ফুট কণ্ঠে সে বলে, ”বেরোওনি?”

”না। কেন? কি হয়েছে?”

সুচেৎ সিং বলে, ”সেই শয়তানীটা পালিয়েছে!”

”শয়তানী। কে?”

”কৃষ্ণা!”

”সে কি! কোথায় ছিল? পালালো কি করে?”

”তা জানি না, তবে পালিয়েছে। তার ঘর খালি। ঘরে সে নেই!”

যাবার সময় সুচেৎ সিং বলে যায়, ”দরজা বন্ধ করো। ফিরে এসে দরজা যেন খোলা না দেখি!”

সুচেৎ সিং চলে যায়।

শান্তা দরজা বন্ধ করে। তারপর এসে নিঃশব্দে খোলে বাথরুমের দরজা।

কৃষ্ণা বেরিয়ে আসে।

কৃষ্ণা বলে, ”সব শুনেছি। সুচেৎ সিং?”

”হ্যাঁ। খুঁজতে চললো। এখন আর থাকা নয়, কৃষ্ণা দেবী। যেমন করে হোক, আজ রাত্রে-”

কৃষ্ণা বোঝে। নাহলে তারই বিপদ নয় শুধু, শান্তারও!

শান্তা বললে, ”লছমীর কাছে খবর দিতে এখনি লোক ছুটবে। খবর পেয়ে সে এখনি ছুটে আসবে। কিন্তু বাহিরে অত লোক-অত আলো-আমি বলি, আমার ঘরেই থাকুন।”

”পাগল!” কৃষ্ণা হাসে। হেসে কৃষ্ণা বলে, ”যে বিপদে পড়েছিলুম, একবার ভেবে দ্যাখো-তার চেয়ে বিপদ! এ-বিপদ কাটিয়ে উঠেছি। আমাকে আটকে রাখার মানে, আমার যতদূর মনে হয়, সুন্দরলালের ফাঁসির শোধ তোলা।”

শান্তা বললে, ”সে-শোধ কি ভাবে তুলবে, ভেবে এখনো ঠিক করতে পারেনি, মনে হয়। তবে এ-কথা ঠিক, মোটা রকম শোধ তুলবে। আমি শুনেছি, আগরওয়ালা মেয়ে-বিক্রীর কারবার সুরু করেছে। বাঙালী মেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবে বিক্রী করছে, কখনও ভারতবর্ষের বাহিরে পর্য্যন্ত চালান দিচ্ছে! সেই হোয়াইট-শ্লেভ-ট্রাফিক ছিল যেমন, তেমনি!”

ভিতরে ভিতরে শঙ্কিতা হয় কৃষ্ণা। কিন্তু বাহিরে ভয়ের ভাব প্রকাশ পায় না। কৃষ্ণা বলে, ”সেজন্যে আমাকে যদি আটক করে থাকে। কিন্তু তোমাকে? তোমাকে আটক রাখার মানে?”

শান্তা বলে, ”সেদিন জাহাজ ছাড়বার কথা-জাহাজ ছাড়লো না, এঞ্জিন খারাপ হয়েছে। সুচেৎ সিংয়ের সন্দেহ, আমি কোনরকমে জাহাজের এঞ্জিন বিগড়ে দিয়েছি। সেই সঙ্গে পরের দিন আউলিংয়ের অনেক কোকেন ধরা পড়ে গেছে। আপনার কে মামা নাকি দুজন ইনস্পেক্টরকে নিয়ে গিয়ে জাহাজ সাচ্চর্চ করিয়ে সে-কোকেন উদ্ধার করেছিলেন।”

কৃষ্ণার দু-চোখ জ্বলে ওঠে আগ্রহে। সে বলে, ”সত্যি? তারপর?”

শান্তা বলে, ”অনেক রকম মতলব। আমি আভাসে যা জেনেছি, আগরওয়ালা আর সুচেৎ সিং বলে, আপনাকে কাফ্রীর দেশে কিংবা আরবে নিয়ে গিয়ে বেচে দেবে। এখন এ-ব্যবসা নাকি বেশ জোর চলেছে। লছমী বলে, না, কালাপাণিতে চুবিয়ে মারা হবে, কেউ জানবে না। ওরা চিরকালের মত নিষ্কণ্টক হবে। আপনি ওদের অন্দিসন্ধি যত জানেন, এমন আর কেউ নাকি জানে না। তাছাড়া ওদের উপর নাকি আপনার আক্রোশ আছে। আর-”

বলতে বলতে শান্তা থেমে গেল।

কৃষ্ণা বলে, ”আর কি?”

শান্তা নিশ্বাস ফেলে বললে, ”জানেন, ঐ আউলিঙের শুধু আপত্তি। ও বলে, হুজুর, ও-বাইটাকে আমায় বখশিস করুন। ও যেমন বাঘিনী আছে-আমি ওকে বশ করে সাদী করব।”

রাগে কৃষ্ণার মুখ-চোখ রাঙা হয়ে ওঠে। একটা নিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণা বলে, ”বুঝেছি, আমার সত্যই জাতক্রোধ আছে এ-দলটার উপর। এমন জাতক্রোধ আর কারও উপরে নয়। বহুৎ বদমায়েস দেখেছি, কিন্তু এদের মতন? দলকে দল ধরাতে পারি যদি। একবার কলকাতায় যাওয়ার ওয়াস্তা। আমার মনে পড়ছে সেই সেকসপীয়রের রিচার্ড-দী লর্ডের কথা-এ হর্শ মাই কিংডম ফর এ হর্শ! যদি বেরুতে পারি, জেনো, তোমাকে খালাস করবোই। আমার প্রথম কাজ হবে- তোমাকে মুক্তি দেওয়া।”

তেরো – গঙ্গাবক্ষে

দুজনে পথে এসে দাঁড়াল।

রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সুচেৎ সিং শুধু ভাবছে, কখন ভোর হবে! ভোর হলেই লছমী এসে হাজির হবে! সকলকে সে ধমক-চমক দেবে খুব! কি করে কৃষ্ণা পালালো? পাহারাদারের গাফিলতি নিশ্চয়! সুচেৎ সিংয়ের তাই বিশ্বাস।

দুজনে বেশ জোর-পায়ে পথ চলেছে।

শান্তা বয়সে কৃষ্ণার চেয়ে কিছু ছোট-বুদ্ধিও কৃষ্ণার মত এতখানি তীক্ষ্ন নয়। ঝোঁকের মাথায় শান্তা অনেক সময় অনেক কাজ করে, তারপর সামাল রাখতে পারে না। তার অভিজ্ঞতাই বা কতটুকু।

কৃষ্ণা তাকে বলে, ”তোমার ঘরে তুমি আমাকে রাখতে পারতে না, শান্তা। লছমী এসে ঠিক ধরত। প্রথমেই তোমার উপর জুলুম করত। তখন? তার চেয়ে বরাত ঠুকে বেরিয়ে এসে ভালোই করেছি।”

ছাদ থেকে নেমে দড়ির সিঁড়িটা সেইখানেই ফেলে এসেছে কৃষ্ণা। শান্তা বলেছিল, ”ওটা?”

কৃষ্ণা বললে, ”বোঝা বয়ে পালানো শক্ত হয় না? থাক ওটা ওখানে। তুমি ভাবছ, ঐ দড়ি দেখে ওরা হদিশ পাবে?”

শান্তা বললে, ”হ্যাঁ।”

কৃষ্ণা হাসল, বললে, ”বুঝি। কিন্তু কোথায় যাব, জানি না। এখানে কারও বাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া ঠিক হবে না, কাণাঘুষা চলবে। তবে তাতে একটা আশা-যেখানে আশ্রয় নেব, সেখানকার কাকেও দিয়ে পুলিশে খবর দেওয়া যেত! একথাও আমি ভেবেছি! কিন্তু তাতে আশ্রয় যে দেবে, তারও বিপদের ভয়! এরা জানতে পারলে, কেউ-না-কেউ তার উপর ভয়ানক শোধ নেয় যদি! তাই কারও আশ্রয়ে নয়, সোজা সরে যাওয়া-নিজে থেকে যদি বিপদের গণ্ডী পার হতে পারি! তবে পায়ে-চলা সরু পথ ধরে যাব।”

তাই হলো। সরু গলিঘুঁজি ধরে চলা। দৌড়ানো নয়। জানে, যদি কেউ দেখে-দেখে চোর মনে করে চীৎকার তুলবে!

দুজনে বেশ হুঁশিয়ার হয়ে চলেছে।

চলে চলে গঙ্গার ধার-কৃষ্ণা বললে, ”একখানা নৌকা পাব না!”

গঙ্গার ধার দিয়ে দিয়ে দুজনে এল এক ঘাটে। নিস্তব্ধ ঘাট-জন-প্রাণীর চিহ্ন নেই! ঝাঁকড়া গাছপালার মাঝে মাঝে প্যাঁচার ডানা-ঝাড়ার শব্দ। অনেক দূরে কোথায় ক’টা কুকুর ডেকে উঠল!

এতদিন আটক থাকা, তার উপর এমন করে চলে আসায় কৃষ্ণা অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ করছে। ঘাটে বসে সে চেয়ে আছে গঙ্গার বারি-প্রসারের দিকে। কুলুকুলু জলস্রোত-তার মনেও তেমনি চিন্তার স্রোত!

হঠাৎ নজরে পড়ল একটু দূরে দু’খানা ছইওয়ালা নৌকা। কৃষ্ণা উঠল, বললে, ”তুমি বসো শান্তা, আমি দেখি, একখানা নৌকা পাই কি না!”

কৃষ্ণা এলো-নৌকা দু’খানা নিঝুম-নিস্তব্ধ! দাঁড়ি-মাঝিরা ঘুমে অচেতন। নৌকার কাছে নেমে এসে মৃদু কণ্ঠে কৃষ্ণা ডাকল, ”মাঝি আছ? মাঝি?”

কোন সাড়া নেই।

কিন্তু সাড়া পেতেই হবে। নৌকা পেয়ে যদি তাতে করে না সরে পড়ে, বিপদের সীমা থাকবে না। নিজের জন্য ভয় তত নয়, তার ভয় আরো শান্তার জন্য! ধরা পড়লে শান্তার যে ওরা কি করবে, মনে করতে কৃষ্ণা শিউরে ওঠে।

কৃষ্ণা আবার ডাকল, ”মাঝি-মাঝি-”

কোন জবাব নেই।

আবার-আবার-আবার ডাকল, ”মাঝি-”

এবারে গলা বেশ উঁচু।

সাড়া পাওয়া গেল নৌকার ভিতর থেকে। জড়িত কণ্ঠ! ”কে গা?”

”একবার বেরোও। বড্ড দরকার।”

অন্ধকারে একজন লোক এসে দাঁড়াল নৌকার বাহিরে-তক্তা-বাঁধানো জায়গাটায়। বললে, ”কি চাই?”

কৃষ্ণা বললে, ”ভাড়া যাবে? আমাদের ভারী বিপদ।”

মাঝি একটু অপ্রতিভ কণ্ঠে বললে, ”এত রাত্রে! না মায়ি, জল-পুলিশ ধরবে।”

”কোন ভয় নেই।” কৃষ্ণা বললে, ”আমাদের একজনের বড় অসুখ-বাঁচে কি না বাঁচে। বাগবাজারের যে-কোন ঘাটে পৌঁছে দেবে। তার জন্য যে-ভাড়া তুমি চাও, দেব। জল-পুলিশ ধরলে অসুখের কথা বলবো। কোন ভয় নেই।”

একজন দাঁড়িও ঘুম ভেঙ্গে বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বললে, ”দশ টাকা নেব, মায়ি।”

”দশ কেন, কুড়ি টাকা দেব। চল এখনি, দেরী নয়। আমার সঙ্গে আমার বোন আছে-ঐ-তাকে নিয়ে আসি।”

শান্তাকে নিয়ে কৃষ্ণা নৌকায় ওঠে।

মাঝি বললে, ”ভিতরে বসো মায়ি।”

কৃষ্ণা বলে, ”না, বাইরেই থাকি। চমৎকার হাওয়া।”

মাঝি বললে, ”না মায়ি, ভিতরে যান। বললুম ত, জল-পুলিশ।”

কথায় কথা বাড়ে। শান্তাকে ছইয়ের মধ্যে পাঠিয়ে কৃষ্ণা বসল বাহিরে-ছইয়ের ঠিক বাহিরে ছইয়ে ঠেস দিয়ে।

পরিশ্রমে উদ্বেগে দেহ-মন অবসাদে অত্যন্ত ক্লান্ত। তার উপর নদীর বুকে স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস। ছইয়ের গায়ে মাথা হেলিয়ে কৃষ্ণা চোখ বুজল।

হঠাৎ কৃষ্ণার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। নৌকা চলেছে বেশ জোরে। দাঁড়ের ছপ-ছপ শব্দ। চোখ খুলে চারিদিকে তাকাল কৃষ্ণা। ও কে! আউলিং? তাই ত, তার কাছ থেকে একটু দূরে-আউলিংই!

আশ্চর্য্য! ও এলো কোথা থেকে? চুপচাপ বসে আছে আউলিং-দু-চোখের দৃষ্টি কৃষ্ণার উপর!

চকিতে মনে হলো, আশ্চর্য্য হবার কি আছে! নিশ্চয় খবর জেনে পিছু নিয়ে ওরাও এসেছে ঘাটে-এসে নৌকায় উঠে দাঁড়ি-মাঝিদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।

তাই! দাঁড়ি-মাঝিরা ঐ গুম হয়ে বসে আছে, যেন পুতুল! কৃষ্ণার মনে হলো, একটা রিভলভার কিংবা একখানা ছোরা যদি কাছে থাকত!

আউলিং এলো সামনে, তার পিছনে তার সাকরেদ উপো!

উপোর হাতে রিভলভার!

ভাঙ্গা-ভাঙ্গা বাঙলায় উপো বললে, ”তোমাকে চিনি। আমাকে জানো ত? আমি উপো। দুনিয়ায় হেন কাজ নেই, যা আমি করতে পারি না!”

কৃষ্ণা বললে ”তোমায় চিনি উপো। নিজের পরিচয় নিজে নাই বা দিলে আর!”

উপো এগিয়ে আসে।

কৃষ্ণা উঠে দাঁড়ায়, রুক্ষ কণ্ঠে বলে, ”আর এক-পা এদিকে এগিয়েছ কি দেখবে, কি হয়।”

নির্বিষ সর্পিণীর ফোঁস-ফোঁসানিতে উপো হো-হো করে অট্টহাস্য করে ওঠে!

উপো বলে, ”কাকে ভয় দেখাও, বাইজী! তোমার চোখরাঙানির তোয়াক্কা রাখে উপো? হা-হা-হা-আমার যে হাল তুমি করেছ, দেশে ফেরবার উপায় আমার আর নেই! বর্ম্মার মাটিতে পা দিলেই বর্ম্মা-পুলিশ! আমার বৌ-নিজের হাতে বুকে ছুরি বিঁধে মরেছে! আর আমার ছেলে, ঐ এক ছেলে-ডাগর ছেলে সে-আজ জেলে। এ-সব তোমার জন্য! তোমাকে টুকরো-টুকরো করে কাটলেও আমার মনের ঝাল যাবে না! তোমায়-তোমায়-তোমায়-”

আক্রোশে উপো দাঁত কিড়মিড় করে।

কৃষ্ণা বেশ সহজ শান্ত কণ্ঠে বলে, ”আমার জন্য নয়, এ-সব হয়েছে তোমার দোষে-তোমার পাপে। এতখানি বয়স পর্য্যন্ত দুনিয়ায় কি আগুন না জ্বালিয়ে বেড়িয়েছ তুমি। সে আগুনে কত ঘর শ্মশান করেছ, কত জীবন পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছ। তোমার দলের সকলেই প্রায় ধরা পড়েছে, বাকি শুধু তুমি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। তোমাকে যে কখনো কোন দিন পাব-”

বাধা দিয়ে উপো বললে, ”ভেবেছিলে, আমি মরে গেছি?”

উপো আবার হাসে-অট্টহাসি! তার হাসির শব্দে ছইয়ের মধ্যে শান্তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। শান্তা উঠে বসে।

উপো তাকায় শান্তার দিকে। বোধ হয় তিন সেকেণ্ড-তিন সেকেণ্ড উপোর নজর কৃষ্ণার উপর থেকে সরেছে এবং ঠিক সেই মুহূর্ত্তে উপো কিছু বোঝবার আগেই কৃষ্ণা তার উদ্যত হাত থেকে ঝপ করে তার রিভলভারটা টেনে নেয়! নিয়ে উপোর বুকের উপরে কৃষ্ণা সে-রিভলভার উচিয়ে ধরে!

”এবার!” কৃষ্ণা বলে, ”তোমার অস্ত্র আমার হাতে! খবর্দ্দার, চুপ করে দাঁড়াও, মাথার উপর দু-হাত তোলো। হ্যাঁ, তোলো-”

উপোর দু-চোখে বিদ্যুতের ঝলক! কিন্তু মিথ্যা! আক্রোশে সে ফুঁশছে। কিন্তু মিথ্যা! প্রাণের উপর মানুষের বড় মমতা! উপো আস্তে আস্তে দু-হাত উঁচু করে তুললো মাথার উপর।

সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণার নজর আউলিংয়ের উপর। নৌকার হাল ছেড়ে সে কোমরের বেল্টে হাত চালিয়েছে। তার কোমরের বেল্টে ছোরা! কৃষ্ণা হুঙ্কার তুললো, ”খবর্দ্দার! হাত তোলো আউলিং, নাহলে এখনি গুলি করবো। মাথার উপর দু-হাত তোলো-এখনি!”

উপায় নেই! আউলিং মাথার উপরে দু-হাত তুললো।

তারপর দুজনের দিকে পিস্তল উঁচিয়ে কৃষ্ণা বললে, ”ঢোকো নৌকার ছইয়ের মধ্যে। ঢোকো। নাহলে-”

উদ্যত রিভলভারের সামনে দুজনে ঢুকল ছইয়ের ভিতরে।

শান্তা বেরিয়ে এসে কৃষ্ণার পাশে দাঁড়ায়।

ওদের দিকে চেয়ে কঠিন কণ্ঠে বলে, ”একটু নড়েছ কি, গুলি ছুটবে! খবর্দ্দার!”

আউলিং হাসে, বলে, ”তুমি ভেবেছ, তোমার মত একটা পুঁচকে মেয়ের হুমকিতে আমারা ভয় পেয়েছি! একটু ভুল হয়েছে, তাই! নাহলে অন্য রকম হতো, কৃষ্ণা দেবী।”

কৃষ্ণা কোন জবাব দেয় না।

কৃষ্ণা হুকুম দেয় দাঁড়ি-মাঝিকে। তার হুকুমে দাঁড়ি বসেছে দাঁড়ে, মাঝি বসেছে হালে।

নৌকা চলেছে-দাঁড়ের বেগে। ওদের উপর নজর রেখে কৃষ্ণা দাঁড়িয়ে আছে হুঁশিয়ার হয়ে ছইয়ের বাহিরে-পাশে শান্তা।

একখানা ষ্টীমার আসছে-পিছন দিক থেকে। কৃষ্ণা ভাবল, ডাকবে-সাহায্য চাইবে।

ষ্টীমার এলো কাছে। ষ্টীমার থেকে মানুষের কণ্ঠ শোনা গেল, ”এই মাঝি, রোখো। সবুর।”

পাশে এসে ষ্টীমারখানা হঠাৎ থামলো। কৃষ্ণা দেখে, সামনে ডেকে সুচেৎ সিং। ষ্টীমারে আরও অনেক লোক!

শান্তাও দেখল। তার মুখ মরার মত সাদা!

কৃষ্ণা শান্তা-দুজনে যেন পাথরের মূর্ত্তি! আর ঠিক সেই সময় উপোর দাঁড়ের ঘায়ে কৃষ্ণার হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে জলে পড়লো এবং আউলিংয়ের শক্ত দু’খানা হাত কৃষ্ণার কণ্ঠ চেপে ধরলো সাঁড়াশির মত। শান্তা যায় বাধা দিতে, উপো তাকে সবেগে ঠেলে ছইয়ের মধ্যে ফেলে দেয়। কৃষ্ণা প্রাণপণ চেষ্টা করছে আউলিংয়ের কবল থেকে মুক্তির জন্য।

কিন্তু চকিতে চোখের সামনে অমানিশার ঘন অন্ধকার!

চৌদ্দ – কালাপানি

ঘড়র-ঘড়র-ঘড়র কর্কশ শব্দে কৃষ্ণা চোখ মেলে চায়। তখনও চেতনা নেই-কেমন যেন আচ্ছন্ন-ভাব! মনে হয়, যেন স্বপ্ন দেখছে!

অদূরে বসে ঐ লছমীবাই, তার একটু দূরে সুচেৎ সিং, ঐ আউলিং! শান্তা? শান্তা কোথায়?

শান্তা বসে আছে একান্তে-দু-হাতে মুখ ঢেকে-নিথর নিস্পদ!

চেতনা হয়েছে-তন্দ্রাবিষ্টের মত পড়ে আছে কৃষ্ণা-চোখ খুলে পড়ে আছে। আর তার চোখের সামনে স্বপ্নের মত মনে পড়ে, নদীর বুকে নৌকা-রিভলভার-ষ্টীমার! তারপর-

তারপর কি-মনে পড়ে না।

আর একটু পরে হঠাৎ মনে হলো, নৌকা নয়! এবং স্বপ্ন নয়! ঘর! নৌকায় ছিল সে আর শান্তা-তারপর-

কিন্তু এখন কোথায় তারা? এ-ঘর?

চোখ মেলে কৃষ্ণা তাকায় চারিদিকে। এ-ঘর তার সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা! অনেক দিনের পুরানো বাড়ীর ঘর। দেয়ালে কোন যুগে যে চুণকাম করা হয়েছিল! চূণের পালিশ ময়লা-দেয়াল কালো হয়ে আছে-ছাদের কাঠের কড়ি-বরগা-কতকালের পুরানো। পাড়াগাঁয়ের ঘর বলে মনে হয়।

শান্তা? শান্তা কৈ? ঘরে তক্তাপোষ পাতা। তার উপর বিছানা-একখানা তোষক পাতা-তোষকের উপর একখানা আধ-ময়লা সুজনি আর একটা বালিশ। এই বালিশে মাথা দিয়ে কৃষ্ণা শুয়েছিল। সে নিজে শোয়নি-তাকে শুইয়ে দিয়েছিল।

লছমী আর সুচেৎ সিংয়ের কাণ্ড, তাতে ভুল নেই। কিন্তু কি করে? ঠিক! মনে পড়ে, নৌকায় সেই আউলিং-উপো-তারপর একখানা ষ্টীমার এসে দাঁড়ায় নৌকার পাশে! সে-ষ্টীমারের ডেকে সুচেৎ সিং!

নিশ্চয় কৃষ্ণা অজ্ঞান হবার পর তাকে ষ্টীমারে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে! পেনেটির সে বাগান-বাড়ী নয়, অন্য বাড়ী! কিন্তু শান্তা? শান্তা কোথায়? তার কি করলে?

ঘরের দরজা বন্ধ। দুটো জানলা-জানলা দুটো খোলা। একটা বাহিরের দিকে খোলা আর একটা ভিতরের দিকে-কৃষ্ণা এসে দাঁড়াল বাহিরের দিককার জানলার সামনে। বাহিরে জঙ্গল আর জঙ্গল- জঙ্গলের ফাঁকে দেখা যায় একটি পুকুর। পানায় পুকুরের অর্দ্ধেকটা ঢেকে আছে-বাকি অর্দ্ধেকটুকুতে জল। মানুষের কোন সাড়া পাওয়া যায় না কোন দিকে। ভিতরের দিকের জানলার ধারে এলো। ওদিকে উঁচু পাঁচিল-পাঁচিলে শ্যাওলা, তাছাড়া বট অশথের কতকগুলো চারা মাথা খাড়া করে উঠেছে। ক’টা পায়রার বকবকম শোনা গেল। তাহলে বিজন পুরী নয়! মানুষ আছে। কৃষ্ণা জানে, যে-পুরীতে মানুষ থাকে না-সেখানে পায়রা জাত কখনও বাস করে না। তেমন পুরীতে থাকে শুধু বাদুড়, চামচিকে আর প্যাঁচা।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ।

কৃষ্ণা ফিরে তাকায়।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো লছমী, আউলিং আর সুচেৎ সিং।

দেখে কৃষ্ণা ভ্রূ কুঞ্চিত করে মুখ ফেরায়।

শ্লেষভরে লছমী বাই বললে, ”তারপর কৃষ্ণা দেবী-এ কি হয়ে গেল! তোমার অত বুদ্ধি-সবার উপর টেক্কা দাও! এমন অসাবধানেও তুমি বেরোও!”

কৃষ্ণা গর্ব্বভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইলো-লছমীর দিকে ফিরলো না, তার কথার জবাবও দিলে না।

লছমী বললে, ”অভিমান হয়েছে? বটে! একটি কথা মানো কৃষ্ণা দেবী? গ্রহ বলে উপসর্গ আছে! সেই গ্রহ আমাদের জীবনে কখনও তুঙ্গী হয় আবার কখনও হয় বক্র। এখন আমাদের গ্রহ তুঙ্গী আর তোমার বক্র। নাহলে ক’দিনে তিন-তিনবার তোমার এমন হয়-দী গ্রেট লেডি ভ্যাংকুইশড! এবারে এখান থেকে কি করে আবার কাকে ভুলিয়ে হাত করবে-এ্যাঁ? কি মতলব ঠাওরালে?”

অসহ্য! দৃপ্ত ভঙ্গীতে কৃষ্ণা ফিরে দাঁড়ালো। লছমীর মুখে দু-চোখের অগ্নি-দৃষ্টি বর্ষণ করে কঠিন স্বরে বললে, ”যা করবার সোজাসুজি করে ফ্যালো লছমী বাই! তোমার এ-তামাসা ভালো লাগে না। আমাদের বাঙলায় একটা কথা আছে-বেরালের ছানা নাড়া-নাড়ি। তেমনি! কি চাও তোমরা? আমার সম্বন্ধে কি করবে? কি মতলব?”

লছমী চাইলো সুচেৎ সিংয়ের দিকে। সুচেৎ সিংয়ের চোখের দৃষ্টিতে ইঙ্গিত! লছমী বললে, ”তুমি লেখাপড়া শিখেছ-আই-এ পাশ করেছ ফার্ষ্ট-ডিভিসনে-বড়-বেশী মেয়ে যা পারে না। কাজেই তুমি বুঝবে, দুনিয়ার পথে প্রত্যেকে যে যেমন চায়, তেমনি কাজ করে জীবন কাটাবে-ব্যক্তিগত এ-অধিকার সকলের আছে। তুমি যে পাশের পর পাশ করতে চাও, তাতে কেউ তোমাকে বাধা দিয়েছে? তাছাড়া যার যা পেশা-সে তা করবে নির্ব্বিবাদে। আমরা যে পেশা করি, পুলিশের তাতে চোখ টাটায়। বেশ, পুলিশ লড়ুক আমাদের সঙ্গে। কিন্তু তুমি পুলিশ নও, তুমি কেন আমাদের কাজে মাথা গলাতে আসো! শুধু মাথা গলানো নয়, ঈঙ্গিতে আমাদের কথা জানতে পারলে বাঘের মত ঝাঁপ দিয়ে পড় কেন আমাদের উপর? আমরা তোমার সঙ্গে কখনও কোন শত্রুতা করিনি!”

এত বিপদেও কৃষ্ণা না হেসে থাকতে পারলো না। কৃষ্ণা বললে, ”উত্তম কথা। কিন্তু তোমার তর্কের গোড়াতেই গলদ। আইন-মোতাবেক যে পেশা করবে-তাতে কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু যে-কাজ বে-আইনী, যে-কাজে অন্য লোকের শুধু অনিষ্ট হয়, সর্ব্বনাশ-সে-কাজও মেনে নিতে হবে? আশ্চর্য্য যুক্তি লছমী! তোমরা বে-আইনী কাজে যে-টাকা রোজগার করছো-সহ্য করতে পারো, আর কেউ যদি তাতে ভাগ বসায়? কিম্বা তাতে ছোঁ মারে? তোমাদের জাহাজে অনেক কোকেন পাওয়া গিয়েছিল শুনেছি। সে-কোকেন জাহাজ থেকে যদি আর কেউ সরাতো, কি করতে তোমরা? তার চুরির ব্যাপারে মাথা গলাতে না?”

লছমী কি বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে সুচেৎ সিং বললে, ”ও-সব বাজে কথার সময় নেই। এখন চটপট এ-মেয়েটার ব্যবস্থা। আমি বলি, আরবে চালান দেওয়া-মহম্মদ আলি সেখানে খুব ফলাও ব্যবসা চালিয়েছে। এর জন্য পাঁচ হাজার টাকা এখনি দেবে নগদ। আমাদেরও আপদ বিদায় হবে।”

লছমী বললে, ‘না। ও যা মেয়ে, সেখান পর্য্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে না! যেমন করে হোক, পালিয়ে আসবে জাহাজ থেকে!”

সুচেৎ সিং বললে, ”জাহাজে নয়, প্লেনে।”

”উঁহু।” ”লছমী বললে, ”ওতে নিশ্চিন্ত হবো, মনে হয় না। ফেরে যদি, আমাদের পিছনে সারা ভারতবর্ষের পুলিশ লেলিয়ে বেড়াবে। তা নয়!”

এই পর্য্যন্ত বলে লছমী তাকালো আউলিংয়ের দিকে। আউলিং সতৃষ্ণ নয়নে চেয়েছিল লছমীর পানে। লছমী তার পানে চাইবামাত্র সে একেবারে বিনয়ে কাকুতিতে কুঁকড়ে দু-হাত জোড় করে বললে, ”আমার হাতে দাও। আমার বৌ ওর জন্যই নিজের হাতে ছুরি মেরে আত্মঘাতী হয়েছে। এর জন্য আমি দেশছাড়া-দেশে যাবার উপায় নেই। ওকে পেলে বুঝবো আমার বৌয়ের খেসারৎ-ওকে বাগিয়ে ঠিক দলের করে নেবো।”

লছমীর মুখে কৌতুকের হাসি। সে তাকালো কৃষ্ণার দিকে।

কৃষ্ণা যেন ফুঁশছে! তার চোখে গনগনে আগুন যেন-ঘৃণায় কৃষ্ণা অন্য দিকে মুখ ফেরালো।

লছমী বললে, ”এ-সব নয়, এ-জড় আমি রাখতে চাই না। জাহাজে করে হোক আর প্লেনে করে হোক, আন্দামানের দিকে বেরিয়ে ঝুপ করে কালাপানির জলে-”

এই পর্য্যন্ত বলে লছমী তাকালো কৃষ্ণার দিকে। আবার বললে, ”কি বলো কৃষ্ণা, যেমন হিরোইক মেয়ে তুমি, তেমনি হিরোইক ডেথ! ইতিহাসে নাম থেকে যাবে!”

কৃষ্ণা বললে, ”কৃতার্থ হলুম তোমার সুবিচারে। কি বলবো, নেহাৎ নিরুপায়! নাহলে-”

”নাহলে কি করতে, শুনি?”

”থাক। এখন কালাপানিতেই চলো আমায় নিয়ে। এ-প্রহসন আমার অসহ্য বোধ হচ্ছে।”

লছমী বললে, ”একটু সবুর করো। সবুরে মেওয়া ফলে, কৃষ্ণা দেবী।”

পনেরো – বিনা-মেঘে

পরের দিন-বেলা তখন দশটা।

খাওয়া-দাওয়া একরকম চুকেছে। কৃষ্ণা এদিকে বোকামি করেনি! রাগ করে না-খেয়ে থাকা-সে-জাতের মেয়ে কৃষ্ণা নয়। যুঝতে হবে, শরীরের শক্তি ক্ষয় করা হতে পারে না। নোটিশ পেয়েছে, আজ এখান থেকে বেরুতে হবে বেলা বারোটা বাজবার আগে। কোথায় যাবে জানে না, জানতে চায়ওনি।

বসে বসে সে ভাবছে, এখন? এখন? যেখানেই নিয়ে যাক, শেষ চেষ্টা! প্রাণ যদি যায়, তবুও! এদের কাছে মাথা নীচু করে পরাজয়-তাতে মান থাকবে না। প্রাণের চেয়ে মানের দাম কৃষ্ণার কাছে অনেক বেশী!

আউলিং এলো, বললে, ‘নীচে আসুন কৃষ্ণা বাইজী, সকলে নীচে জমা হয়েছেন! এবার বেরুনো হবে।”

এ-কথায় কৃষ্ণা যেন বর্ত্তে গেল! কোথায় এসেছে-এ-ঘরের বাহিরে কি-কিছু জানে না। জানবার উপায় ছিল না। এখন যদি-

কৃষ্ণা উঠলো। ঘরের বাহিরে লম্বা দালান-ঢাকা দালান-জানলা বন্ধ। অন্ধকার পথ! সেই বারান্দা দিয়ে এসে সিঁড়ি-সিঁড়ি দিয়ে নেমে বড় একটা হল-হলের মেঝেয় ছেঁড়া ময়লা একখানা কার্পেট পাতা-ক’খানা ভালো চেয়ার-একটা টেবিল। চেয়ারে বসে সুচেৎ সিং, লছমী, আউলিং, ঘনশ্যাম, উপো। সুচেৎ সিং মেক-আপ করে বাঙালী-সাহেব সেজেছে-মুখে সিগার!

আউলিং কথা কইছে। সুচেৎ সিংকে বলছে, ”তোমার মেয়েই, জানলে, জাহাজের এঞ্জিন বিগড়ে দিয়েছিল! সেবার প্লেনে তুলে নিয়ে যাবো-এয়ার-পোর্টে নামতেই চীৎকার করে বলে উঠলো, আমায় বাঁচান-এরা আমাকে ধরে কোথায় চালান করে দিচ্ছে। এরা ডাকাত, ধরে নিয়ে যাচ্ছে। শুনে আমি ভয়ে আঁৎকে উঠলুম। ক-জন লোক এলো ছুটে। আমি বললুম, মাথা খারাপ মশায়, চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! কত কষ্টে বুঝিয়ে তাদের থামাই!”

সুচেৎ সিংয়ের মুখ কঠিন হয়। তার ভ্রু কুঞ্চিত! সুচেৎ সিং বললে, ”হুঁ, তাই? ওকে ঢিট করতে হবে, সেইজনেই ওকে নিয়ে যাবো-আমার সঙ্গে সঙ্গে রাখবো। কিন্তু জাহাজের এঞ্জিন কি করে ও বিগড়োবে? পুলিশে খবর দেওয়া-এ’ও তাহলে শান্তার কাজ?”

শান্তা-সুচেৎ সিংয়ের কন্যা? কৃষ্ণা চমকে ওঠে! এ সে কল্পনা করেনি-কল্পনার অতীত!

ঘনশ্যাম বললে, ”আমরা বেরুচ্ছি, কেউ জানে না তো? ফলো করবে না কেউ?”

লছমী বললে, ”না” বলে সে তাকালো কৃষ্ণার দিকে, বললে, ”বসো কৃষ্ণা। কোন খবর পাঠাতে পারলে তোমার পুলিশ-কমিশনারকে-তোমাকে উদ্ধার করবার জন্য?”

কৃষ্ণার ভ্রু কুঞ্চিত হলো, কৃষ্ণা তাকালো তার পানে।

লছমী হাসল, বললে, ‘কোথায় আছো জানো? ক্যানিঙ বলে জায়গা আছে, এ সেই ক্যানিঙ। এখানে পথে তেমন লোক পাবে না। তাছাড়া আমরা যাবো বন্ধ ট্রাকে-ট্রাকের জানলা নেই-ওতে করে মালপত্র চালান যায়। তোমাকে নৌকা থেকে কাশীপুরের ঘাটে নামিয়ে ট্রাকে তুলে এখানে এনেছি। এখন আবার সেই ট্রাকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৌকায়। তারপর-”

কৃষ্ণা বললে, ”যা করবার, করো। বক্তৃতা আমার কোন দিন ভালো লাগে না।”

সুচেৎ সিং বললে, ‘লছমী বাইয়ের এখানে রইলো উপো, কিষেণজী, ধ্যানচাঁদ এদের উপরে আউলিংয়ের চার্জ্জে থাকবে এখানকার মাল। সে মাল ডেলিভারী দিয়ে ফিরে আসবে। পুলিশ ওকে পাবেও না, এর মধ্যে যদি খোঁজ করে। তার উপর ক্যানিঙ হলো বেঙ্গল-পুলিশের হুদ্দো, সেখানে তোমার কলকাতার পুলিশ-কমিশনার বা তার চ্যালা-চামুণ্ডা আসতে পারবে না।”

আগরওয়ালা বললে, ”আর আমি বলি, আমাদের ঐ নোট-তৈরীর কাজ আপাততঃ বন্ধ রাখা যাক। পুলিশ তক্কে-তক্কে আছে-সন্দেহ করেছে, বহুত জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে তো! হ্যাঁ, তুমি এখন কলকাতায় ফিরো না। এ-কাজ সেরে তুমি সোজা দিল্লী চলে যাবে! তুমি কি বলো লছমী?”

লছমী বললে, ”সরঞ্জামপত্র সব আমি দিল্লীতে পাঠিয়ে দিয়েছি খিদিরপুরের হোটেলে সেই পুলিশের হানার পর। কলকাতায় নোটের সরঞ্জাম কিছু নেই এখন।”

আউলিং বললে, ”খিদিরপুরের সে-হোটেলের উপর পুলিশ ভয়ানক কড়া নজর রেখেছে-একজন আর্মড কনষ্টেবল সব সময় মোতায়েন!”

লছমী হাসলো, হেসে বললে, ”ভরসার মধ্যে এই, এরা আমাদের পুলিশ! চোর পালাবার আগে এ-পুলিশের মাথা খোলে না, বুদ্ধি হয় না। নাহলে আমাদের জিনিষপত্র, লোকজন চলে আসতে পারে নির্ব্বিবাদে? কাজ-কর্ম্ম চুকে যাবার এক ঘণ্টা পরে পুলিশ এসে ঘেরাও করে, তর্জ্জন-গর্জ্জন করে।”

বাহিরে ট্রাকের হর্ণ বাজে-সকলে সচকিত হয়।

আগরওয়ালা বলে, ”নৌকা তোমাদের কোথায় নামিয়ে দেবে?”

”অছিপুরে। ওখানে থাকবে ছোট প্লেন, তাতে করে বেরুবো।”

”সোজা একেবারে মাদ্রাজ?”

”হ্যাঁ। সেখানে বহুৎ কোকেন চায়, দাম দেবে চার-ডবল। তুমি মোদ্দা সাবধানে থেকো-আমরা না ফিরলে কোন কাজ নয়। একা মানুষ সামলাতে পারবে না। খাতাপত্রগুলো সরিয়ে ফেলো আজই বাড়ী ফিরে।”

”হ্যাঁ।” আগরওয়ালা দেয় জবাব। ”তবে আমি প্রমাণ রেখে এমন কোন কাজ করিনি, যার জন্য পুলিশ আমাকে ধরতে পারে। তিনবার বিপদে পড়েছিলুম, সেই থেকে আমি ভয়ানক হুঁশিয়ার হয়ে কাজ-কর্ম্ম করছি।”

বলতে বলতে আগরওয়ালা তাকায় সুচেৎ সিংয়ের দিকে। বললে, ”তোমার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সিংজী, তাকে ডেকে এসো।”

কৃষ্ণা এখনও ভাবছে, এরা চলেছে মাদ্রাজ-বললে, চলেছে কোকেন নিয়ে! কিন্তু শান্তাকে নিয়ে চলেছে কেন?

শান্তা ঘুমোচ্ছে!

একটা মতলব জাগলো কৃষ্ণার মনে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে থর-থর করে কাঁপতে লাগলো। তারপর আঁ-আঁ করে চীৎকার এবং সঙ্গে-সঙ্গে দুম করে সে পড়লো সেই ছেঁড়া কার্পেট মোড়া মেঝেয়।

এমন চমৎকার অভিনয়-কেউ বুঝতে পারলো না। সকলে ভাবল, কৃষ্ণা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

‘জল-জল’ করে চেঁচিয়ে লছমী বলে উঠলো, ”বেরুবার সময় এ আবার কি হাঙ্গামা! জ্বালাতন না করে এ-মেয়ে চলে না!”

মুখে-চোখে জল ছিটুনো, পাখার বাতাস-পরিচৰ্য্যা চললো কৃষ্ণার। সুচেৎ সিং এলো-সঙ্গে শান্তা। চেহারা যা হয়েছে, সে শান্তার ছায়া যেন! কৃষ্ণাকে মূর্চ্ছিত পড়ে থাকতে দেখে শান্তা থমকে দাঁড়ালো! সুচেৎ সিং বললে, ”এ আবার কি ব্যাপার।”

লছমী বললে, ”অজ্ঞান হয়ে গেছেন বীরবালা। অজ্ঞান হবার আর সময় পেলেন না! বেরুবার সময় দ্যাখো ফ্যাসাদ!”

লছমী তাকালো আগরওয়ালার দিকে বললে, ”আপনি কি করবেন পিতাজী? সোজা ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরবেন?”

আগরওয়ালা বললে, ”পাগল! ট্রেনে গিয়ে নামবো সেই বেলেঘাটায়? যদি পুলিশ থাকে? ষ্টেশনে ষ্টেশনে ওরা পাহারা মোতায়েন রাখেনি? তাই ভাবছি, তোমাদের নৌকায় যাবো- অছিপুরে, তারপর-বাসে চড়ে, সেখান থেকে ট্যাক্সি।”

”বাড়ীতে?”

”হ্যাঁ। একবার বাড়ীতে পৌঁছুতে পারলে ভয় কি! বলেছি তো-আমার সম্বন্ধে কোন প্রমাণ পাবে না পুলিশ।”

কৃষ্ণা শুনছে সব কথা-আধ ঘণ্টা পরে সে চোখ মেলে চাইলো, কম্পিত কণ্ঠে বললে, ”জল খাবো।”

জল খাওয়ানো হলো-তারপর কৃষ্ণা আর শান্তাকে ধরে ট্রাকে তোলা হলো। সঙ্গে চললো লছমী।

লছমী বললে, ”দুজনে দু কোণে বসো।”

তাই হলো। একে একে সকলে এসে উঠলো ট্রাকে-তারপর ট্রাক চললো।

কৃষ্ণা হেলান দিয়ে বসে আছে দু-চোখ বুজে-যেন তার চৈতন্য পুরোপুরি এখনো ফিরে পায়নি। মাথায় তার চিন্তার চাকা ঘুরছে।

গাড়ী এল নদীর ধারে-কোন পথে, কেমন পথ, পথে কি আছে, কিছু জানা গেল না।

নদীর নাম মাৎলা। গাড়ী থেকে সকলে নামলো। কৃষ্ণার তখনো চলেছে অভিনয়-টলতে টলতে এসে উঠলো নৌকায়। মস্ত নৌকা, প্রকাণ্ড ছই টাঙ্গানো। সকলে ছইয়ের মধ্যে ঢুকলো। তারপর নৌকা ছাড়লো। আট দশজন দাঁড়ি। জোয়ার। তার উপর পাল তোলা-নৌকা চলেছে তীরের বেগে।

অছিপুরে পৌঁছুলো নৌকা-ঘাটে নয়, আঘাটায়। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। শান্তা আর কৃষ্ণা দুজনকে হাত ধরে নৌকা থেকে নামানো হলো।

হাঁটতে হাঁটতে আসা-বনের মধ্যে প্লেন, সেইখানে। পাইলটের কি চেহারা-যেন যমদূত!

পাইলট বললে, ”প্লেনে সকলে থাকবেন এখন থেকে?”

লছমী বললে, ”নাহলে কোথায় থাকবে?”

পাইলট বললে, ”একটু দূরে একটা খালি ঘর আছে-কে কবে আড়ৎ করেছিল, চেল গেছে ঘরখানা এমনি খালি পড়ে আছে। এখনো আমার ট্যাঙ্ক ভরতে দেরী-পেট্রোল ভরেনি।”

পাইলট সকলকে নিয়ে সেই ঘরে পৌঁছে দিল। ঘরখানা বড়। ইটের দেয়াল-ছাদ করোগেট টিনের। একটা হ্যারিকেন লণ্ঠন পাইলট কোথা থেকে যোগাড় করে এনে রেখেছে।

কৃষ্ণা মেঝেয় বসে পড়লো, তারপর শুয়ে পড়লো, যেন তার মূর্চ্ছার ঘোর এখনো কাটেনি।

লছমী বললে, ”ভোরে বাস ছাড়ে কখন?”

পাইলট বললে, ”বেলা সাতটায় ঐ অছিপুর ফেরি-ঘাট থেকে ছাড়ে।”

”প্লেন কখন ছাড়বে?”

পাইলট বললে, ”সাতটা আন্দাজ।”

”হ্যাঁ। যত চটপট পারো। ছাড়া না পর্য্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারবো না।”

অনেকক্ষণ পরে-হ্যারিকেনের কাঁচ ঝুল-কালি! কালো অন্ধকার নিবিড় হয়ে ওঠে। শান্তা ঘুমে অচেতন, সুচেৎ সিং ডাকলো কবার- শান্তার জবাব পেলো না।

আগরওয়ালা বললে, ”ঘুমোচ্ছে। ঘুমোতে দাও লছমী। যে ধকল চলেছে! ছেলেমানুষ।”

লছমী ডাকে, ”কৃষ্ণা দেবী।”

কৃষ্ণা শোনে-সাড়া দেয় না। লছমী আবার ডাকে-”কৃষ্ণা দেবী!”

এবারও সাড়া পায় না।

লছমী বলে, ”এই মশায় দিব্যি ঘুমচ্ছে দুজনে। ঘুমোক। একবার দেখে আসি পাইলট কতদূর কি করল। ও বলেছে, সাতটায় প্লেন ছাড়বে! আমি বলি আরো আগে-ছটায় ছাড়ো! বাঙালা দেশের মাটী যত শীগগির ছাড়তে পারি।”

সুচেৎ সিং বলে, ”পাগল! এখানে কে পাবে আমাদের সন্ধান?”

ঘর থেকে বেরিয়ে কজনে চললো প্লেনের কাছে। ঘরে শান্তা আর কৃষ্ণা। শান্তা চোখ মেলে চাইলো-আলো-অন্ধকারে যতটুকু দেখা যায়, মনে হয়, ঘরে কেউ নেই। তবু সে বললে, ”জল খাবো।” কোনো সাড়া মিলল না। তখন কণ্ঠ আর একটু বড় করে বললে, ”কে আছো? জল দেবে?”

এবারও সাড়া নেই। ঘরে কেউ নেই তাহলে!

তখন শান্তা ডাকলো, ”কৃষ্ণা দেবী।”

কৃষ্ণা সাড়া দিলে, ”শান্তা!”

শান্তা বললে, ”ক্যানিংয়ে আসবার আগে এদের পরামর্শ আমি শুনেছিলুম-অজ্ঞান হয়ে আছি যেন এমনি ভাব করে। তারপর একখানি চিঠি লিখে এ-খবর জানিয়ে ডাকে দিয়েছি-লিখেছি অছিপুরের ধার থেকে প্লেন ছাড়বে-ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বেয়ারিং চিঠি। পথের একটা লোককে সে চিঠি ডাকে দিতে দিয়েছিলুম। তার জন্য তাকে দিয়েছি আমার হাতের আংটি। তাই ভাবছি, সে চিঠি কি ডাকে সে দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে এখনো আশা আছে।”

বাইরে গলা শোনা গেল। কৃষ্ণা বললে ”চুপ!”

দুজনে আবার তফাতে-তফাতে কাঠ হয়ে শুয়ে আছে। বাহিরে উষার আলো-গাছে-গাছে ক’টা পাখী ডেকে উঠলো।

শান্তা ভাবলো, ভোর হলো, প্লেন ছাড়বে। কৈ, কেউ এলো না তো!

কৃষ্ণা ভাবছে, যদি কেউ না আসে, শেষ বারের মত একবার চেষ্টা…মরিয়া হয়ে!

সকলে এলো। সুচেৎ সিং ঠ্যালা দিয়ে তুললো শান্তাকে-লছমী তুললো কৃষ্ণাকে।

উঠে কৃষ্ণা দেখে, রিভলভার। লছমীর রিভলভার-মেঝেয় পড়ে আছে! যেমন দেখা, বাঘের মতো ঝাঁপ দিয়ে কৃষ্ণা পড়লো রিভলভারের উপর। সেটা নিয়ে উঁচিয়ে ধরলো লছমীর দিকে, বললে, ”এবার।”

লছমী আর কৃষ্ণা ছাড়া আর সকলে তখন ঘরের বাহিরে-লছমী চেঁচিয়ে ডাকলো, ”পিতাজী।”

আগরওয়ালা জবাব দিলে, ”চলে এসো।”

কৃষ্ণা বললে, ”আবার ডেকেছো কি গুলি ছুটবে! খবর্দ্দার!”

লছমী স্তম্ভিত! কৃষ্ণা বললে, ”চুপ করো।”

বাহিরে ওদিকে বিপর্য্যয় গোলমাল-হঠাৎ! চীৎকার চেঁচামেচি, আর্ত্তনাদ, সঙ্গে সঙ্গে ক’টা গুলির আওয়াজ-ধুরুম ধুরুম ধুম।

লছমীর দিকে রিভলভার উচিয়ে কৃষ্ণা বললে, ”চলো বেরিয়ে।”

নিরুপায় লছমী এলো ঘরের বাহিরে, এসে দেখে, সর্ব্বনাশ! পুলিশ! আর্ম্মড পুলিশ অসংখ্য!

ধরা পড়লো সকলে-সুচেৎ সিং, আগরওয়ালা, আউলিং। ব্যোমকেশবাবু ছুটে এলেন, ”কৃষ্ণা!”

কৃষ্ণার রিভলভার তখনো উঁচোনো লছমীর দিকে-কৃষ্ণা বললে, ”একে এ্যারেষ্ট করুন। এক নম্বর আসামী-দলের চাঁই।”

লছমী তখনি গ্রেফতার হলো। দু-চোখে আগুন-লছমী বললে, ”এর শোধ তোলা রইলো। ফাঁসিতে মরবো না। ক’বছরের জেল! যেমন করে পারি জেলে বেঁচে থাকবো। তারপর জেল থেকে বেরিয়ে এসে কৃষ্ণা দেবী-তোমায়-আমায় আবার দেখা হবে তখন।”

শান্তার বেয়ারিং চিঠি পৌঁচেছিল। সে চিঠি পেয়ে সুজন আর প্রণবেশ ছোটে ব্যোমকেশের কাছে এবং ব্যোমকেশ তখনি পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর নির্দ্দেশে আর্ম্মড-পুলিশ-ফোর্স নিয়ে ডেপুটি কমিশনার আর চব্বিশ পরগণার ডিষ্ট্রীক্ট পুলিশ-সুপার এসেছেন কৃষ্ণাকে উদ্ধার করতে এবং দুর্দ্দান্ত আসামীদের ধরতে।

* * *

ঘরে বসে কথা-কৃষ্ণা, সুজন, প্রণবেশ।

সুজন বললে, ”প্রণবেশকে বলো ভীতু! কিন্তু শুধু প্রণবেশের জন্য লোকগুলো ধরা পড়লো। ও যদি মেট্রোর সামনে সে রাত্রে ট্যাক্সি থেকে না নামতো, তাহলে ও-গলির কেউ সন্ধান পেতো না! আর তাই থেকে এ দলের সন্ধানও কেউ পেতুম না!”

হেসে কৃষ্ণা বললে, ”তারপর আমরা যে-ভোগ ভুগেছি!”

সুজন বললে, ”তুমি সেধে এ কাজ নিয়েছো যখন, তখন ভোগান্তির ভার জেনে-শুনেই তো ঘাড়ে নেয়া! ভোগান্তির জন্য তুমি সিমপ্যাথি দাবী করতে পারো না। তবে হ্যাঁ-এত বিপদেও যে মাথা ঠিক রাখতে পেরেছো-তার জন্য তোমার বহুৎ তারিফ করি।”

বেচারী শান্তা! বাপ এমন দুর্ব্বৃত্ত। শান্তা লেখাপড়া শিখেছে- বাপের এ দুর্ব্বুদ্ধির জন্য মাথা তুলে দাঁড়াতে তার লজ্জা হয়। ঐ বাপ ছাড়া শান্তার কেউ নেই। সে আছে কৃষ্ণার কাছে, কৃষ্ণার ছোট বোনের মত-তেমনি স্নেহে, তেমনি যত্নে। তবে মলিন ছায়ার মত সে আছে-হাসতে ভুলে গেছে যেন! বাপের কথা ভাবে-তার দু’চোখ ছলছলিয়ে ওঠে।

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *