০৭. কৃষ্ণার অভিযান

কৃষ্ণার অভিযান

এক

প্রণবেশ বাড়ী ঢুকলেন, অত্যন্ত উত্তেজিত ভাব।

দোতলায় নিজের ঘরে টেবিলের ধারে একখানা চেয়ারে বসে কৃষ্ণা নিবিষ্ট মনে বই পড়ছে। সামনে এগজামিন। থার্ড ইয়ার থেকে এবার সে উঠবে ফোর্থ ইয়ারে-সেজন্য বেশ একটু পরিশ্রম করছে কৃষ্ণা।

প্রণবেশ সশব্দে ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর পায়ের শব্দে চমকে কৃষ্ণা বই থেকে মুখ তুললো।

পাশের চেয়ারখানা টেনে নিয়ে বসলেন প্রণবেশ, বসে তীক্ষ্নকণ্ঠে বললেন-‘নাঃ, আর পারা যায় না! অসহ্য! বুঝলে কৃষ্ণা, এর জন্য একটা ব্যবস্থা আর না করলে নয়!’

কৃষ্ণা মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। প্রণবেশ যে বিশেষ কোনো খবর বহন করে এনেছেন এবং তা নিয়ে কৃষ্ণার পড়ায় বিঘ্ন উৎপাদন করবেন, কৃষ্ণা বুঝলো। বুঝলেও মুখে-চোখে শান্ত সহজ ভাব রক্ষা করে সে প্রশ্ন করে-‘কি হয়েছে মামা?’

পকেট থেকে একখানা টেলিগ্রাম বার করে কৃষ্ণার সামনে দিয়ে প্রণবেশ বললেন, ‘এটা পড়ে দেখ।’

কৃষ্ণা পড়লো। টেলিগ্রামে লেখা-

কৃষ্ণাকে নিয়ে এসো। বড় বিপদ। উদ্বিগ্ন। প্রতীক্ষায় রইলাম।

নীচে নাম-

 রাজেন্দ্রপ্রসাদ

কৃষ্ণা বললে-‘রাজেন্দ্রপ্রসাদকে আবার পেলে কোথায়? কে এ?’

প্রণবেশ যেন আকাশ থেকে পড়েন! ‘সে কি, রাজেন্দ্রর নামটা পর্য্যন্ত ভুলে গেলে! আশ্চর্য্য! সেই যে সেবার পুরীতে গিয়ে তুমি যখন প্রায় ডুবে যাচ্ছিলে, তখন যে-ভদ্রলোক নিজের প্রাণের মায়া ভুলে জলে পড়ে তোমাকে উদ্ধার করেন! নাম বলেছিলেন, রাজেন্দ্রপ্রসাদ। মনে পড়ছে না?’

কৃষ্ণার মনে পড়লো।

গত বছর কৃষ্ণা পুরী গিয়েছিল, মামাও গিয়েছিলেন সঙ্গে। ব্যোমকেশবাবু তখন সপরিবারে স্বর্গদ্বারে বাস করছেন, তিনিই একরকম জোর করে কৃষ্ণাকে পুরীতে নিয়ে যান। হাওয়া-বদল, সেই সঙ্গে সমুদ্র-দর্শন-চমৎকার লাগবে কৃষ্ণার! ছ’দিনের জন্য যাওয়া-কিন্তু গিয়ে কৃষ্ণা সেখানে ছিল প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন। এতদিন থাকতে তাকে হয়েছিল অবশ্য বাধ্য হয়ে।

আর সকলের মতো সমুদ্রে সাঁতার দেওয়ার ঝোঁক সে সামলাতে পারেনি। রোজ সাঁতার দিত। যেদিন পুরী থেকে চলে আসবে, সেদিনও; এবং বিপদটা ঘটেছিল এই শেষের দিনে। সাঁতার দিতে দিতে কখন নিজের অজ্ঞাতে ঢেউয়ে পড়ে কতদূর গিয়েছিল! হাত-পা অবশ-ঢেউয়ের চুবন-সাঁতার দেবার সামর্থ্য আর নেই!…প্রমত্ত ঢেউগুলো তার অবশ দেহটাকে নিয়ে রীতিমতো লোফালুফি করছে! মরণ নিশ্চিত বুঝে কৃষ্ণা এলিয়ে পড়েছে, ঠিক সেই সময়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ তাকে উদ্ধার করে তীরে আনেন।

বিহারের ছেলে রাজেন্দ্রপ্রসাদ! বাড়ী পাটনায়। কি কাজে গিয়েছিলেন সি-পি-র রায়পুরে। জগন্নাথের রথযাত্রায় তিনি এসেছিলেন পুরীতে। স্বর্গদ্বারে তাঁর নিজের বাড়ী, সেইখানে ছিলেন।

মূর্চ্ছিতা কৃষ্ণাকে তুলে তিনি সাগরের কূলে নিজের বাড়ীতে নিয়ে যান। এর পর কৃষ্ণার জন্যই বাধ্য হয়ে প্রণবেশকে ক’দিন রাজেন্দ্রপ্রসাদের আতিথ্য স্বীকার করতে হয়েছিল।

বিদায় নিয়ে আসবার সময় রাজেন্দ্রপ্রসাদ বহু অনুরোধ করেছেন, মামা-ভাগিনেয়ী যেন একবার সি-পি-তে আসেন। দেখবার যা-যা আছে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ দেখাবেন। এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ্য বা অসুবিধা হবে না-এ আশ্বাস বার-বার দিয়েছেন।

জীবনদাতা রাজেন্দ্রপ্রসাদ! তাঁকে কৃষ্ণা ভুলে গেছে, প্রণবেশের বিস্ময়ের সীমা নেই! বিস্মিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘সত্যি কৃষ্ণা, রাজেন্দ্রকে তুমি ভুলে গেলে দেখে আমি একেবারে অবাক হয়ে যাচ্ছি! সেদিন নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে তিনি যদি সেই ঢেউ থেকে তোমায় উদ্ধার না করতেন-কোথায় ভেসে যেতে, কি, ডুবে যেতে, কেউ জানতে পারতো না! আজ তোমার জীবনদাতা রাজেন্দ্রর বিপদ। নিশ্চয় বিষয়-সংক্রান্ত কিছু ঘটেছে! আর তুমি তাঁকে চিনতে পারলে না! ছি!’

কৃষ্ণার মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। রাগ করেই সে বলে, ‘হ্যাঁ মানছি, আমার ভুল হয়েছে। কিন্তু তুমি? তোমার সে-কীর্ত্তির কথা মনে হলে লজ্জায় আমার মাথা নুয়ে পড়ে। ঐ ঢেউয়ে ঢেউয়ে আমি কোথায় চলেছি, কখন যাবো তলিয়ে-আর তুমি ডাঙ্গায় ছুটোছুটি করছো, একে তাকে ধরে মাথা খুঁড়ছো! নিজের এমন ক্ষমতা নেই, সাঁতার কেটে গিয়ে আমাকে তোলো! ছি! নিজেকে এমন ননীর পুতুল করে রেখো না মামা-সত্যি! এই তো সাঁতার শেখাবার জন্য কত ক্লাব হয়েছে। তার একটার মেম্বার হয়ে সাঁতারটা শিখে ফ্যালো-কাউকেও জল থেকে না তোলো, অসময়ে নিজের উপকার হবে!’

প্রণবেশ একেবারে যেন নিভে যান! মাথা চুলকোতে সুরু করেন-কৃষ্ণা আবার বইয়ের দিকে তাকায়। খানিক চুপ করে থেকে প্রণবেশ আবার বললেন, ‘সে যা হয় হোক, কিন্তু এখন কি করি বলো? এঁকে কি জবাব দেবো?’

মুখ না তুলেই কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু এ ভারি অন্যায় কথা মামা,-সামনে আমার এগজামিন!’

তেতে ওঠেন প্রণবেশ! রুক্ষ কণ্ঠে বলেন, ‘এগজামিন আর এগজামিন! ভারী তো এগজামিন! ইউনিভার্সিটির এগজামিন হলেও কথা ছিল। তা নয়! ওদিকে ও ভদ্রলোক নিজের জীবন তুচ্ছ করে-আমার তো ঐ জন্যই মাথা বিকিয়ে আছে! কতখানি ওবলিগেশন! তা যত মাথা-ব্যথা আমারই, না রে? তোর কোনো কর্ত্তব্য নেই?’

কৃষ্ণা কোনো জবাব দিলে না-বইয়ের পাতায় তার দৃষ্টি নিবদ্ধ।

প্রণবেশ বললেন একটু ঝঙ্কার দিয়ে-‘বয়ে গেছে আমার! এ কালের মেয়েগুলো সো আনগ্রেটফুল!-যাক, আমার কি? রইলো ঐ টেলিগ্রাম। করো, যা তোমার খুশী।’

এ-কথা বলে যেমন সশব্দে তিনি ঘরে ঢুকেছিলেন, ততোধিক শব্দ করে প্রস্থান করলেন। দরজার পর্দ্দাটা তাঁর সবেগ হস্তচালনায় খসে পড়লো-সেদিকে তাঁর দৃকপাতমাত্র নেই!

দরজার পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা হাসে। মামা একেবারে ছেলেমানুষ! সংসার সম্বন্ধে এতটুকু জ্ঞান নেই! অভিজ্ঞতাও নেই! অতি ছোট ব্যাপারেও এমন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন, হাসি পায়!

কৃষ্ণা টেলিগ্রামখানা তুলে নিলে।

রায়পুর থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ তার করেছেন। তিনি কি প্রকৃতির মানুষ, কৃষ্ণা তার কোনো পরিচয় পায়নি। শুধু জানে, তিনি তার প্রাণরক্ষা করেছিলেন। দাস-দাসী কর্ম্মচারীদের কাছে যেটুকু শুনেছে, তাতে জেনেছে, তিনি মস্ত কারবারী মানুষ। খুব বড় জুয়েলার। কেবল রায়পুরে নয়, বম্বে নাগপুর জব্বলপুর-এসব জায়গাতেও তাঁর জুয়েলারী দোকান আছে।

কিন্তু এ-সব এড়িয়ে একটা কথা মনে জাগে। তিনি কৃষ্ণার প্রাণ বাঁচিয়েছেন!

সত্যই কৃষ্ণার অস্তিত্ব পাওয়া যেতো না-জীবনহীন দেহখানা পড়ে থাকতো বিশাল সমুদ্রতীরে-কোনখানে, কে জানে!

না! কৃতজ্ঞতা! ঋণ! তাঁর যে-কোনো কাজ কৃষ্ণা করবেই-প্রণবেশকে অনর্থক চটিয়ে ফল নেই।

কলিং-বেল বাজাতে দাসী মঙ্গলা এসে দাঁড়ালো। কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘মামাবাবু বাড়ী আছেন, না, বেরিয়ে গেছেন?’

মঙ্গলা বললে,-‘তিনি বেরিয়ে গেছেন মা। বলে গেছেন, ফিরে আসতে দেরী হবে। চা তিনি বাইরেই খাবেন, আপনাকে বলতে বলে গেছেন।’

তাহলে রাগ করেই বেরিয়েছেন! চিন্তার কারণ নেই। কৃষ্ণা হাসলো। সন্ধ্যার মধ্যে তিনি ফিরবেনই, জানা কথা।

দুই

হু-হু বেগে ট্রেণ চলেছে-।

বম্বে-মেল ছুটছে, মাঝে মাঝে এক-আধটা ষ্টেশনে দাঁড়ায়, সেখানে লোক ওঠে, লোক নামে।

একই কামরায় কৃষ্ণা উঠেছে মামার সঙ্গে। মেয়েদের গাড়ীতে যেতে চেয়েছিল, প্রণবেশ রাজী হননি। রাত্রের ট্রেণ,-কত ষ্টেশনে কত লোক ওঠা-নামা করবে, হয়তো মেয়েদের কামরায় কোনো মেয়ে থাকবে না-সে অবস্থায় বিপদ ঘটা অসম্ভব নয়!

অনেক রাত্রে কি একটা ষ্টেশনে ট্রেণ দাঁড়াতে পাঁচ-সাতজন লোক হুড়মুড় করে উঠে পড়লো এ কামরায়। ঘুমন্ত চোখে প্রণবেশ একবার তাকিয়ে দেখে আবার বেঞ্চে পাশ ফিরে চোখ বুজলেন। কৃষ্ণা ধড়মড় করে উঠে বসলো-ট্রেণ তখন আবার ছুটেছে।

কামরায় বেশী লোক ছিল না। বেঞ্চগুলো প্রায় খালি। যারা উঠলো, তারা এক জায়গায় বসে পড়লো। কাজেই, যারা ঘুমোচ্ছিল তাদের ঘুম ভাঙ্গাবার দরকার হলো না।

এরা নিতান্ত সাধারণ লোক। যাদের বলে, গরীব। কৃষ্ণা দু-একবার তাদের দিকে চেয়ে আবার শুয়ে পড়লো-অনর্থক বসে থাকবার কারণ নেই।

চোখ আপনি ঘুমে বুজে আসছিল। চোখ বুজে নিঃসাড়ে কৃষ্ণা পড়ে রইলো।

যে ক’জন লোক উঠেছিল, তারা এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল-এতক্ষণে তাদের কথার মৃদু কল-গুঞ্জন শোনা গেল। কৃষ্ণা অর্দ্ধমুদ্রিত চোখের দৃষ্টি দিয়ে দেখলো, ও লোকগুলো তার পানে তাকিয়ে আছে!

কৃষ্ণা কেমন অস্বস্তি অনুভব করে। তবু সে ওদের চেহারা দেখে নেয়।

ঠিক তার সামনের বেঞ্চে যে লোকটি বসে-মনে হয়, সে এদের নেতা। তাকে এরা রীতিমত সম্ভ্রম করে। তার সঙ্গে কথা কইছে সসম্ভ্রমে।

‘-রামজী-‘

আহ্বানটুকু কৃষ্ণার কানে আসে। একটা ষ্টেশন আসছে। কথাবার্ত্তার গুঞ্জন শুনে কৃষ্ণা বোঝে, এখানে ট্রেণ কয়েক মিনিট থামবে। নেতা লোকটি ইঙ্গিতে তাদের কি নির্দ্দেশ দেয়।

অর্দ্ধ-নিমীলিত চোখে কৃষ্ণা দেখে, দু’জন লোক উঠে দাঁড়ালো, একজন প্রণবেশের দিকে আসছে, আর একজন তার দিকে-তার হাতে একটা শিশি।

তড়িদাহতের মত কৃষ্ণা ধড়মড় করে উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের কটিবন্ধ থেকে রিভলভারটা টেনে বাগিয়ে ধরে, চীৎকার করে ওঠে-‘মামা, ওঠো, ওঠো-সামনে বদমাস।’

শুধু প্রণবেশ নন, কামরার সকলেই জেগে ওঠে। জেগে স্তম্ভিত!

‘রিভলভার বার করো মামা-বদমায়েসের দল।’

ট্রেণের গতি মন্থর হয়ে এসেছে। ধড়মড়িয়ে উঠে প্রণবেশ রিভলভার বার করবার সঙ্গে সঙ্গে লোকগুলো কামরার দরজা খুলে নীচে লাফিয়ে পড়ে। প্রণবেশ কিছু বুঝতে পারেন না। কামরার জন্য যাত্রীরাও বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে।

প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কি কৃষ্ণা? ওরা-মানে, কি করছিল?’

রিভলভারটা পাশে রেখে কৃষ্ণা বললে,-‘ট্রেণে ডাকাতি করা ওদের পেশা। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে পড়ি, অমুক জায়গায় ট্রেণে ডাকাতি হয়েছে! এ সেই রকম বলে মনে হচ্ছে।’

প্রণবেশ মাথা দুলিয়ে সন্দিগ্ধভাবে বললেন, ‘কিন্তু এদের সাধারণ ডাকাত বলে তো মনে হয় না কৃষ্ণা। কামরায় এত লোক আছে, এরা আর সকলকে বাদ দিয়ে তোমাকে আর আমাকেই লক্ষ্য করেছিল-। এটা তুমি দেখনি বোধ হয়?’

ঠিক! মামার বুদ্ধি-চাতুর্য্যে কৃষ্ণা চমৎকৃত হয়! মামা তাকে বুঝিয়ে দেন-কামরায় এত লোক থাকতে তাদের দুজনকেই কেন? কৃষ্ণার মনে হলো, রাজেন্দ্রপ্রসাদের ব্যাপারে এরা তাহলে জড়িত আছে? কিন্তু তারা এ ট্রেণে রায়পুরে চলেছে, এ খবর এরা পেলে কি করে?

প্রণবেশ তার কাছে সরে এসে বসলেন; চাপা-গলায় বললেন, ‘ওরা কি করতে এসেছিল, মনে হয়?’

কৃষ্ণা অন্যমনস্কভাবে বললে, ‘খুব সম্ভব তোমায় আর আমায় গুম করবার মতলব ছিল। আচ্ছা, তুমি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে টেলিগ্রাম করেছো যে আমরা যাচ্ছি?’

বিস্ফারিত চোখে প্রণবেশ বললেন, ‘তা না করলে চলে? তিনি জানবেন কি করে যে, আমরা যাচ্ছি? পরশু বিকেলে তার পেয়ে সন্ধ্যাবেলা তোমার মত নিয়ে তখনই তাঁকে টেলিগ্রাম করেছি যে, আমরা যাচ্ছি। তারপর আমরা রওনা হবার সময় আর একটা তার করেছি-আমরা এই ট্রেণে রওনা হচ্ছি বলে। এ না করলে অন্যায় হতো। আমাদের পক্ষেও কষ্ট হতো। মনে করো, রায়পুরে নেমে আমাদের কত খুঁজতে হবে-ঘুরতে হবে-‘

অপ্রসন্ন কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘বুঝেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, পরশু না হয় টেলিগ্রাম করেছো আমরা যাচ্ছি খবর জানিয়ে! সে টেলিগ্রাম পেয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিশ্চিন্ত হবেন। কিন্তু কাল আমরা বেরুবার আগে আবার তার করবার কি দরকার ছিল যে, আমরা এই ট্রেণে যাচ্ছি? রাজেন্দ্রপ্রসাদের কেস কি, তা আমরা এখনও জানি না,-কোনো খবর আর আমরা পাইনি। কে বলতে পারে, সেই টেলিগ্রামের খবর নিয়ে তাঁর শত্রুপক্ষ পথের মাঝখানে এ ট্রেণে উঠেছে আমাদের যাতে রায়পুরে না যাওয়া হয়, তার জন্য। গুম করা তো ছোট কথা-বুকে ছোরা বসিয়ে দিতে পারতো অনায়াসে। নাঃ, তোমার যত বয়স হচ্ছে, তত তুমি যেন ছেলেমানুষ হচ্ছো! এত বয়সেও বুদ্ধি পাকলো না!’

প্রণবেশ বোকার মত হাসবার চেষ্টা করেন-টেনে টেনে তিনি বলেন, ‘কিন্তু সে টেলিগ্রাম তো পথের মাঝখানে কেউ ধরতে পারে না কৃষ্ণা, সে কথা ভাবো। এরা একসঙ্গে উঠেছে মাঝখান থেকে, এখন সবে ভোর হয়ে আসছে, সে টেলিগ্রাম পৌঁছুতে দু-তিন ঘণ্টা! রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাছে পৌঁছে গেছে। হেঁঃ! আমার কিন্তু অন্য রকম সন্দেহ হচ্ছে! আমার টেলিগ্রাম কোথাও আটকায়নি, সেটা যে পৌঁছেছে, তাতে সন্দেহ নেই।’

কৃষ্ণা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললে, ‘তুমি বলতে চাও, টেলিগ্রাফ- অফিসে এমন কেউ আছে যে এদের দলে এবং তুমি যে টেলি করেছো, সেও সেই মুহূর্ত্তে এদের টেলিগ্রামে খবর দিয়েছে-এমন হতে পারে না?’

প্রণবেশ কথাটা ভেবেছিলেন মাত্র, গুছিয়ে বলতে পারেননি! উৎফুল্লকণ্ঠে তিনি বললেন, ‘ঠিক কথা! আমিও তাই বলছি।’

কৃষ্ণা সংশয়িত চিত্তে মাথা নাড়ে-‘কিন্তু এমন হতে পারে-তুমি তোমার কোনো বন্ধুকে বলেছো, সে আবার এ-কথা অন্য কাকেও বলেছে!’

হতবুদ্ধির মতো প্রণবেশ কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে আছেন-কথাটা মিথ্যা, তা তিনি বলতে পারেন না।

কৃষ্ণা বললে, ‘আমি বুঝেছি, ব্যাপার ঠিক এই। টেলিগ্রাফ-অফিস থেকে কিছু হয়নি। যাক, ভোর হয়ে আসছে, আপাততঃ ভয় নেই। রায়পুর পৌঁছুতে মনে হয় খুব দেরী হবে না। শুনেছি, ওখানে ট্রেণ অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। তুমি একটু শুয়ে নাও মামা, আমি বসে ঐ সব পাহাড়-পর্ব্বত দেখি।’

কৃষ্ণা জানলা খুলে দিয়ে বসলো।

তিন

রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজেই মোটর নিয়ে ষ্টেশনে এসেছিলেন। পরম সমাদরে তিনি কৃষ্ণা ও প্রণবেশকে সম্বর্দ্ধনা করলেন।

‘পথে কোনো কষ্ট হয়নি তো?’ তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

প্রণবেশ কি বলতে যাচ্ছিলেন, বাধা দিয়ে ক্লান্ত কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘না, না, কষ্ট কি! লঙ জার্নি, এই যা! আর কিছু না।’

প্রণবেশ একবার কৃষ্ণার পানে তাকান, কোনো কথা বলবার ভরসা পান না।

রায়পুর টাউনের উপর রাজেন্দ্রপ্রসাদের বিরাট অট্টালিকা। প্রকাণ্ড গেট। দরজায় সশস্ত্র দরোয়ান। ঐশ্বর্য্যের পরিচয় চতুর্দ্দিকে। গেটের মধ্য দিয়ে গাড়ী ভিতরে ঢুকে গাড়ী-বারান্দায় দাঁড়ালো।

বারান্দায় উঠতে উঠতে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে-‘আমাদের আসার খবর-‘

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘কেন, প্রণবেশবাবু তার করেছিলেন, আপনারা আসছেন। সে তার আমি এগারোটার মধ্যে পেয়েছি। সারা রাত উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছি, কখন সকাল হবে, কখন আপনারা আসবেন।’

প্রকাণ্ড হল-ঘরে তিনি অতিথিদের বসালেন।

ঘরে শুধু এরা তিনজন-। আর কেউ নেই। ঘরে বসে কৃষ্ণা পথের কাহিনী বিবৃত করলে। রাজেন্দ্রপ্রসাদের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। খানিকক্ষণ তিনি কোনো কথা বলতে পারলেন না।

কৃষ্ণা বললে, ‘আমার মনে হয়, পথে সে টেলিগ্রাম খোয়া গেছে কিম্বা টেলিগ্রাফ- অফিসের কেউ টেলিগ্রামে খবর জানিয়েছে। শেষের কথাটাই মনে লাগছে। টেলিগ্রাফ-অফিসের কেউ করতে পারে কিম্বা মামার কোনো বন্ধু কাকেও বলেছেন-তাঁর মুখ থেকে খবর বেরিয়েছে! যাই হোক, আমি যদি ঘুমিয়ে থাকতুম, ওই ক্লোরোফর্ম দিয়ে আমাকে বেহুঁশ করে কোথাও নামিয়ে নিতো! তারপর কি হতো, ভগবান জানেন!’

গম্ভীর কণ্ঠে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘ভগবান শুধু আপনাদেরই রক্ষা করেননি- আমাকেও রক্ষা করেছেন! পথে আসতে আপনাদের কোনো বিপদ ঘটলে আমিও যেতুম! আমি কি-বিপদে পড়েছি বলছি। আগে আপনারা চা খান।’

চা-পানের পর রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাহিনী :

কিছু দিন-দু’মাস আগে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বম্বেতে ছিলেন। বম্বের কারবারের ভার দেওয়া আছে তাঁর শ্যালক রামলালের উপর। মাসে একবার করে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বম্বে যান দেখাশুনা করতে। দু’মাস আগে যখন যান, পোড়বন্দরের এক ধনী জুয়েলার তাঁর কাছে হীরার একছড়া নেকলেস নিয়ে আসেন বিক্রয়ের জন্য। সে নেকলেসে যে ক’খানা হীরা আছে, তার দাম কত রাজেন্দ্রপ্রসাদ তখনই ঠিক করতে পারেন না। তিনি নিজে জুয়েলার-তবু তিনি যাচাইয়ের জন্য নিজের কাছে রাখেন। দিন- কয়েক বাদে তিনি আর-ক’জন হীরার কারবারীকে সে হার দেখাতে গিয়ে দেখেন, তাঁর সর্ব্বনাশ হয়েছে! সে হার চুরি গেছে।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘এ হার আপনি কোথায় রেখেছিলেন?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ উত্তর দিলেন-‘যেখানে আমার জহরতের গহনাপত্র থাকে, সেইখানে ছিল। যাই হোক, সেজন্য আপনাকে আনবার দরকার হতো না কৃষ্ণাদেবী, দরকার হয়েছে অন্য কারণে। সে নেকলেসের দাম যতই হোক, দেবার ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু মুস্কিলে পড়েছি-সেই হারের লকেটে ছিল একটি চক্র…রূপোর টাকার চেয়েও বড় এবং তাতে লক্ষ্য করবার মতো তেমন-কিছু ছিল না। সেই চক্র নিয়েই হয়েছে মুস্কিল!’

কৃষ্ণা সোজা হয়ে বসলো, বললে, ‘মহাকালের চক্র?’

চমৎকৃত হয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘আপনি জানলেন কি করে?’

ব্যাগ খুলে কৃষ্ণা একখানা কাগজ বার করে ভাঁজ খুলে রাজেন্দ্রপ্রসাদের সামনে খুলে দিয়ে বললে-‘দেখুন, মহাকালের চক্রের নকশা। এখানা আমি ট্রেণের কামরায় কুড়িয়ে পেয়েছি। আমাদের কামরায় যারা উঠেছিল, খুব-সম্ভব তাদের যে সর্দ্দার-তার নাম রামজী-সেই লোকটার কাছে এই নকশা ছিল-পালাবার সময় তাড়াতাড়িতে ফেলে গেছে।’

‘ঠিক, ঠিক, এই সে চক্রের নকশা।’ রাজেন্দ্রপ্রসাদ চীৎকার করে উঠলেন যেন!

কৃষ্ণা বললে, ‘চেঁচাবেন না মিষ্টার প্রসাদ। তারপর এর বিবরণ আমি পেলুম কি করে? এর পিছনে লেখা আছে, দেখুন।’

নকশার সঙ্গে আর একখানা কাগজ ছিল আঁটা; তাতে নকশার বিবরণ লেখা,-

পুনার কাছে মহাকালের মন্দির!

রাজেন্দ্রপ্রসাদ সন্তর্পণে চেয়ারখানা সরিয়ে আনলেন, চাপাগলায় বললেন-‘এক বছর আগে আমি এই প্রভিন্সের এক গ্রামে গিয়েছিলুম। সেখান থেকে ফেরবার সময় মোটরে আসছি, হঠাৎ বাধা পেলুম,-একটি লোক মোটরের ঠিক সামনে হাত তুলে দাঁড়িয়ে। বাধ্য হয়ে গাড়ী থামাতে হলো। লোকটি পাশে সরে গিয়ে গাড়ীর মধ্যে কি একটা ছুড়ে দিয়ে, ছুটে পালিয়ে গেল। তাকে আর দেখতে পাইনি। কি ফেলে দিলে, দেখবার জন্য নীচু হয়ে দেখি, আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটি চক্র!’

-‘চক্র!!’

কৃষ্ণা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘হ্যাঁ! অদ্ভুত গড়নের একটি চক্র। এটি যে কোন ধাতুতে তৈরী, তখন বুঝতে পারিনি। হীরার মতো চক্রটি জ্বলছে। আমার পায়ের কাছে আলোয় আলো হয়ে আছে। হাতে তুলে নিতে প্রথমটা ইতস্ততঃ করলুম, তারপর নিলুম তুলে। অন্ততঃ পক্ষে বারো ইঞ্চি হবে,-চমৎকার নকশা-কাটা আর তার সরু সরু লাইনে কোন ভাষায় কি লেখা আছে, বুঝতে পারলুম না।’

প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সে চক্র আছে আপনার কাছে?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ মলিন হাসি হাসলেন, বললেন, ‘তা হলে আর বলছি কি? শুনুন আগে-তারপর বুঝবেন, কি হলো! সে চক্র আমি বাড়ী নিয়ে এলুম। এবং তারপর বেশ বুঝতে পারলুম, কে বা কারা সর্ব্বদা আমায় ফলো করছে। এ চক্র পাবার পর থেকে আমার অসম্ভব উন্নতি হতে লাগলো-যে-কাজে হাত দিই, লাভ! আপনাদের বলবো কি-আমি কোনোদিন কিছু মানতুম না, সেই আমি সব কিছু মানতে আরম্ভ করলুম। সে চক্র পবিত্রভাবে রাখলুম আমার আয়রণ-চেষ্টে। এই চক্রের কথা বাড়ীতে আমার স্ত্রী ছাড়া আর কেউ জানলো না।’

কৃষ্ণা নিঃশব্দে শুনছিল-সে বললে, ‘কিন্তু চক্রের গায়ে কি লেখা, কাকেও দেখাননি বোধ হয়?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখিয়েছি। সাহস করে কিছুদিন কাকেও দেখাতে পারিনি। আমার মনে সংশয় জেগেছিল-এ চক্র কোনো দেবালয়ের প্রতীক! যে-লোকটি আমার মোটরে এটা ফেলে দিয়েছে সে কোনো রকমে চুরি করে এনেছে। তারপর কোনো রকমে সামলাতে না পেরে আমার গাড়ীতে ফেলে পালিয়ে বেঁচেছে! যাক, আমি এক সাধুকে আমার বাড়ীতে নিয়ে আসি। তাঁকে আমি সেই মঙ্গল-চক্র পরীক্ষা করতে দিই। অনেক কষ্টে তিনি লেখার মর্ম্মোদ্ধার করেন। গুপ্ত রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় দেশে দেশে অনেক দেব-মন্দির তৈরী হয়। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল মহাকালের মন্দির-দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যখন শক দমন করে আসেন, তখন এই মন্দির আর বিগ্রহ স্থাপনা হয়। মহাকালের মঙ্গলপ্রতীক এই চিহ্ন এ পর্য্যন্ত বহু যত্নে রক্ষিত আছে। চক্রের মধ্যে যে লেখা, তাতে এইটুকু মাত্র জানা গেল। মহাকালের মন্দির কোথায়, আমি জানতুম না।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘তারপর?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘মাস তিন-চার আগে বম্বে থেকে বেনামী একখানা চিঠি আমি পাই-যত শীঘ্র পারো মঙ্গল-চক্র আমাদের ফিরিয়ে দাও! পনেরো দিন মাত্র সময় আছে, এর মধ্যে আমি যদি তাদের নির্দ্দিষ্ট নদীর ধারে শিব-মন্দিরে নিয়ে গিয়ে না রেখে আসি, তাহলে তারা আমায় সবংশে ধ্বংস করবে। এ চিঠি পাবার পর আমি মঙ্গল-চক্র ফিরিয়ে দিয়ে আসবো বলে দিন ঠিক করি, আর ঠিক এই সময়ে মঙ্গল-চক্রটি চুরি যায়।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে-‘চুরি গেল কি করে?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘আমার স্ত্রী সেটি বার করে তাঁর বোনকে দেখাচ্ছিলেন- ঠিক সেই সময় তিনি শুনলেন আমার ছেলের পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে ভীষণ রক্ত পড়ছে। শুনে তিনি তাড়াতাড়ি চক্রটি টেবিলে রেখে ছুটে যান। ফিরে এসে সে মঙ্গল-চক্র দেখতে পান নি।’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ চুপ করলেন।

চার

ঘর থেকে মঙ্গল-চক্র চুরি হয়েছে-নিশ্চয় এমন লোক নিয়েছে, যে এই মঙ্গল-চক্রটি কি, তা জানে।

মহাকালের মঙ্গল-চক্র!

কৃষ্ণা মনে করবার চেষ্টা করে মহাকালের মন্দির কোথায়?

সন্ধান অবশ্য পাওয়া যায়।

মহাকাল শিবের মন্দির জব্বলপুর ছাড়িয়ে কুড়ি-পঁচিশ-মাইল দূরে। বহু পুরাকালে সেখানে যে মন্দির ছিল, আজ তা ধূলিসাৎ হয়েছে। ধনকুবের রাজারা অনেক টাকা খরচ করে মন্দিরের পাশে আর একটি মন্দির তৈরী করিয়ে দিয়েছেন।

মহাকালের মঙ্গল-চক্র সম্বন্ধে অনেক গল্প চলিত আছে-রাজেন্দ্রপ্রসাদের বৃদ্ধ কর্ম্মচারীর মুখে কৃষ্ণা অনেক কথা শুনলো।

এই মঙ্গল-চক্রের সম্বন্ধে কিম্বদন্তী দূর-দূর অঞ্চলের লোকেরাও বিশ্বাস করে! যে কোনো কঠিন ব্যারাম হোক, এই মঙ্গল-চক্রের স্পর্শে আরোগ্য হবেই। কত বন্ধ্যা নারী এই চক্র ধুয়ে জল খেয়ে পুত্রবতী হয়েছেন। মঙ্গল-চক্রের কল্যাণে কত মামলা- মকদ্দমায় কত লোকের জয় হয়েছে!

বিষণ্ণ মুখে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন,-‘এ কথাও শুনেছি, এই মঙ্গল-চক্র যার কাছে থাকবে, তার কোনো দিন কোনো কাজ নিষ্ফল হবে না। কথাটা যে সত্য, তার প্রমাণ আমিও পেয়েছি প্রণবেশ বাবু।’

কৃষ্ণা বললে, ‘একটা কথা, ওটা পেয়েছিলেন, আবার গেছে, তাতে আপনার কি এমন বিপদ হলো-যার জন্য আমাদের আসতে বলেছেন?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘সেই কথাই বলছি। মহাকালের মালিক এখন রাজা রাও। লোকটা ভয়ানক দুর্দ্দান্ত। এ অঞ্চলে ভয়ানক প্রতিপত্তি। কোনো কিছু করতে সে ভয় পায় না। খুব বড় জায়গীরদার বা জমিদার, সরকারও তাকে রীতিমতো মেনে চলে। শুনতে পাই, তার নামে ওয়ারেণ্ট ঝুলছে। কখন কোথায় সে থাকে, কেউ জানে না। এবং এ পর্য্যন্ত তাকে কেউ ধরতে ছুঁতে পারেনি। মধ্যপ্রদেশে যেমন প্রতিপত্তি, তেমনি প্রভাব। সকলে তাকে যমের মতো ভয় করে। মঙ্গল-চক্র পাবার অনেকদিন পরে ত্রিশূল-আঁকা একখানা চিঠি আমি পাই। তাতে সে আমায় জানিয়েছিল- মঙ্গল-চক্রটি আমি যেন মহাকালের মন্দিরে সাত দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিই, নাহলে আমায় সে সাজা দেবে। কিন্তু আমি তা করিনি। মঙ্গল-চক্রের মোহ আমায় অভিভূত করেছিল। দিন কতক পরে আবার একখানা চিঠি পাই-এ চিঠিতে রীতিমতো শাসানো-আরও একমাস সময় দেওয়া হচ্ছে-এক মাসের মধ্যে অমরকোট থেকে ফিরে মঙ্গল-চক্র যদি না পাই, তা হলে সাজা যা দেবো-তার তুলনা নেই! এ চিঠি পাবার পর আমি আর দ্বিধা রাখলুম না! মঙ্গল-চক্র ফেরত পাঠাবার আয়োজন করেছিলুম। পাঠাবো বলে লোক পর্য্যন্ত ঠিক করেছি, সেই দিনই ওটা চুরি গেল।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে-‘সে চিঠি আপনার কাছে-‘

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘না। সে সব চিঠি আমার ফাইল থেকে সরে গেছে। কে সরিয়েছে, আন্দাজ করতেও পারছি না।’

প্রণবেশ বললেন, ‘কতদিন হারিয়েছে?’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ জবাব দিলেন-‘আজ পঁচিশ দিন। আমি এখানকার পুলিশে খবর দিয়েছি। ইনস্পেক্টর সদাশিব রাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আপনারা এসেছেন, এ খবর তাঁকে আমি পাঠিয়েছি। তাঁর কাছে আরো অনেক কিছু শুনতে পাবেন।’

উদাস নেত্রে তিনি একদিকে তাকিয়ে রইলেন। শোনা গেল, দু’দিন আগে তাঁর স্ত্রী পিতার অসুস্থতার খবর পেয়ে একমাত্র পুত্রকে নিয়ে নাগপুরে গেছেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদ যে-লোককে তাঁর সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন সে-লোক আজও ফিরে আসেননি! সেজন্য রাজেন্দ্রপ্রসাদ অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদের শ্বশুর বৈজুলাল বহুকাল থেকে নাগপুরে আছেন। জামাইকে তিনিই রায়পুরের কারবারে বসিয়েছেন।

আহারাদির পর কৃষ্ণা খানিক বিশ্রাম করে নিলে। কলকাতা থেকে আসবার সময় সে একখানা বার্ষিকী সঙ্গে এনেছিল, অবসর-কালে পড়া চলবে,-সেগুলো গুছিয়ে রাখলো।

মারহাট্টাদের দেশ,-তবু রায়পুরে অনেক বাঙ্গালী আছেন। সগর্ব্বে প্রণবেশ বললেন-‘জানো কৃষ্ণা, আজ-কাল এমন দেশ নেই, যেখানে তুমি বাঙ্গালী পাবে না! প্রত্যেক দেশে-শুধু সহরে নয়, গ্রামেও বাঙ্গালীর বাস। প্রত্যেকে কাজ-কর্ম্ম করছে।’

মৃদু হেসে কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ, তবু বাঙগালীকে নিন্দা কুড়োতে হচ্ছে! সব দেশের লোকজন তাদের দেশ থেকে বাঙ্গালীকে উৎখাত করবার চেষ্টা করছে! হয়তো একদিন তারা তা পারবেও। এর পর শুনবে প্রত্যেকটি রাজ্য সেই সব রাজ্যের আদিম বাসিন্দাদের,-বিহার বিহারীর, আসাম আসামীর, সিন্ধু সিন্ধীর।’

প্রণবেশ উৎসুক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন-‘আর বাঙলাদেশই শুধু বাঙ্গালীর নয়-সকলের লুঠের ক্ষেত্র!’

কৃষ্ণা মাথা নাড়ে-‘যা বলেছো! বাঙলার বুকে সকলের স্থান, বাঙলায় সকলের সমান অধিকার। বাঙলার বুক থেকে কোনো জাতকে সরানো চলবে না,-বাঙলার বুকে শিকড় গেড়ে সব থাকবে।’

প্রণবেশ খানিক চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, ‘রাজেন্দ্রপ্রসাদের এই চক্র সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?’

কৃষ্ণা বললে, ‘গল্প নয়-নিছক সত্য, মামা। ভদ্রলোকের মুখ দেখলে না? রীতিমতো শুকিয়ে গেছে। এর পর শ্বশুরের অসুখের খবর পেয়ে উনি নিজের বিশ্বাসী লোকের সঙ্গে স্ত্রীকে আর ছেলেকে নাগপুরে পাঠালেন-তাঁর সে-লোক আজ দু-তিন দিনের মধ্যেও ফিরে এলো না! এতে উনি বিলক্ষণ চিন্তিত হয়েছেন। আজ লোক পাঠাচ্ছেন নাগপুরে। সে খবর নিয়ে এলে তবে উনি কিছু শান্তি পাবেন।’

প্রণবেশ বললেন, ‘এই চক্র হারানোর সঙ্গে রাজেন্দ্রপ্রসাদের শ্বশুরের সংযোগ-আশ্চর্য্য নয় কৃষ্ণা! আমার তাই মনে হচ্ছে!’

কৃষ্ণা তাকালো প্রণবেশের পানে-তার দু’চোখে বিস্ময়! ঠিক, এ কথা সে ভাবেনি। কৃষ্ণা চুপ করে রইলো-মুখে কিছু বললো না।

পাঁচ

সহর দেখবার জন্য কৃষ্ণাকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ একখানা মোটর দিয়েছিলেন। শোনা গেল খানিকদূরে প্রসিদ্ধ এক মঠ আছে, দেখবার মতো। প্রণবেশ উৎসুক হলেও কৃষ্ণা মোটেই ব্যগ্র হলো না। বরং মাতুলকে সে বাধা দিয়ে বললে, ‘তার চেয়ে আমাদের মহাকালের মন্দির দেখতে যাওয়া উচিত। এ মঠ দেখে এখন লাভ? তার চেয়ে আমি বলি, নাগপুর থেকে রাজেন্দ্রবাবুর সে-লোক যে ক’দিন না ফিরে আসে, তার মধ্যে আমরা বরং সে-মন্দিরটা দেখে রাখি, মামা!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদকে এ-অভিপ্রায়ের কথা কৃষ্ণা জানালো।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ এ-প্রস্তাবে আপত্তি করলেন। তিনি বললেন, ‘আপনি সেখানে যাবেন কৃষ্ণা দেবী? না। সে ভয়ানক জায়গা। চারিদিকে পাহাড়, বন; তা ছাড়া ওখানে রাজ্যের জঙলীর বাস। আপনাদের ভাষা বুঝবে না। হয়তো ওদের মধ্যে কেউ আপনাদের মতো লোককে চোখে দেখেনি! তবু দেখতে চান, আমি ইনস্পেক্টর সদাশিব রাওকে বলি। তিনি যদি বোঝেন, বিপদ হবে না, তাহলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।’

অগত্যা সেই ব্যবস্থাই হলো। ইনস্পেক্টর সদাশিব রাও সন্ধ্যার দিকে এলেন। বহুদিন তিনি এ অঞ্চলে কাজ করছেন। পুনায় বাড়ী। অভিজ্ঞতা প্রচুর।

তাঁর সঙ্গে কৃষ্ণার পরিচয় করিয়ে দিলেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ।

হাসি-মুখে সদাশিব বললেন, ‘আপনার নাম শুনেছি কৃষ্ণা দেবী,-বাঙলাদেশের মেয়ে-ডিটেকটিভ! নতুন ব্যাপার! আপনিই প্রথম এ কাজে নেমেছেন। আপনার খ্যাতি শুনে শুধু আমরা নই, আরও অনেকে ভাবে, আপনার বয়স হয়েছে। কিন্তু আপনি ছেলেমানুষ, তা ভাবতে পারিনি। আমার মেয়ে আপনার চেয়ে বয়সে বড়। এই বয়সে আপনি এমন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, সত্যই আশ্চর্য্য!’

কৃষ্ণার মুখে সলজ্জ হাসি। কৃষ্ণা বললে, ‘তা বলে পেশা-হিসাবে এ কাজ করি না। আমি কলেজে পড়ছি। শক্তি চচ্চর্চা করেছি এই ভেবে যে বিপদে পড়লে নিজেকে রক্ষা করতে পারবো। এ কাজে নামার কারণ, আত্মীয়-স্বজন যদি কোনো বিপদে পড়েন তাঁদের সাহায্য করবো যথাসাধ্য-নিজের ক্ষতি করেও। রাজেন্দ্রবাবুর টেলিগ্রাম পেয়েই তাই চলে এসেছি। ওঁর কাছে আমি আমার প্রাণের জন্য ঋণী। সে কৃতজ্ঞতার খাতিরে আরো এসেছি। একবার পুরীতে উনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন।’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বাধা দেন, ‘ও সব কথা কেন কৃষ্ণা দেবী? আমি যা করেছি, মানুষ মাত্রেই তা করে থাকে। কর্ত্তব্যের বেশী কিছু করিনি।’

সদাশিব বললেন, ‘ও সব কথা থাক মিষ্টার প্রসাদ। হ্যাঁ, কৃষ্ণা দেবী মহাকালের মন্দির দেখতে চান, তা বেশ,-আমি কাল ওদিকে যাচ্ছি-আমার সঙ্গে যেতে পারেন।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘ওদিকে কাজের জন্য যাওয়া? না, আমাকে মন্দির দেখানোর জন্য?’

সদাশিব হাসলেন; বললেন, ‘না, না, আমাদের এখানকার এক দাগী আসামী ক’দিন আগে জেল থেকে পালিয়েছে-একা যায়নি, আরও ক’জনকে সঙ্গে নিয়ে গেছে। খবর পেয়েছি, সে-দলের একজন ওখানে ধরা পড়েছে, বাকিরা পালিয়েছে। সেইজন্যই আমি যাচ্ছি কাল সকালে! আপনি গেলে আপনাকে ওদিকটা দেখাতে পারবো। তা ছাড়া মহাকালের মন্দির দেখবার মতো! এখানে যখন এলেন, দেখবেন বৈ কি।’

কৃষ্ণা এবং প্রণবেশ তখনই প্রস্তুত।

ট্রেণে আসবার সময় যে ঘটনা ঘটেছে, শুনে সদাশিবের মুখ গম্ভীর হলো।

তিনি বললেন, ‘এতে বুঝচেন কৃষ্ণা দেবী, আপনি হাওড়া ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা আপনাকে ফলো করেছে! আমি বলতে পারি, রাজা রাওয়ের দলের লোক ছাড়া আর কেউ নয়! এমন শক্তি খুব কম দেখা যায়! সারা ভারতে, শুধু ভারতে বলি কেন-পৃথিবীর নানা দেশে এ-দলের লোক ছড়িয়ে আছে। তারা কি মতলব হাসিল করতে কি বেশে কোথায় কখন ঘুরছে, কেউ জানে না! এই কিছুদিন আগে একটা গ্রাম ঘিরে সব জ্বালিয়ে দিয়েছে! অপরাধ, গ্রামের ক’জন লোক রাজা রাওয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল! গ্রামের শিশু নারী বৃদ্ধ-কেউ বাঁচেনি,-কাকেও পালাতে দেয়নি। যে পালাতে গেছে, গুলি করে তাকে মেরেছে।’

কৃষ্ণার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত…সে বলে উঠলো, ‘কি পিশাচ!’

প্রণবেশ চোখ বুজলেন।

সদাশিব বললেন, ‘শুধু এই নয়। আমরা যেখানে যাচ্ছি, সে থানার সাব-ইনস্পেক্টর আমার বিশিষ্ট আত্মীয়…আমার স্ত্রীর ভাই। আজ তাঁর চিঠি পেয়েছি, তিনি লিখচেন-চিঠি পাবামাত্র আমি যেন সেখানে যাই। শুনছি কাল নাকি রাজা রাও ক’জন লোককে তাদের গায়ের ছাল ছাড়িয়ে পিশাচের মতো মেরেছে।’

‘গায়ের ছাল ছাড়িয়ে!’ কৃষ্ণা শিউরে উঠলো!

সদাশিব বললেন, ‘লোকটা পশুর চেয়ে নিষ্ঠুর! কিছু বাধে না তার। পুলিশের কত লোক ওকে ধরতে গিয়ে মরেছে, তার ঠিক নেই!-কত বংশ নির্ব্বংশ হয়েছে। গভর্ণমেণ্ট ওকে ধরবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এই পাঁচ হাজার টাকার লোভে কত লোক যে প্রাণ দিয়েছে!’

গুড়ুম!

রিভলভারের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে জানলা দিয়ে একটা গুলি এসে সদাশিবের কানের পাশ ঘেঁষে গিয়ে সামনের দেয়ালে বিদ্ধ হলো।

‘সর্ব্বনাশ!’

সদাশিব তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন। নিজের রিভলভার বার করে তিনি খোলা জানলার পাশে ছুটলেন-সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাও ছুটলো। চীৎকার করে প্রণবেশ তার হাতখানা চেপে ধরলেন, ‘না না কৃষ্ণা, ওরা ঐখানেই আছে।’

তিনি কাঁপছেন! জোর করে কৃষ্ণা হাত ছাড়িয়ে নিলে। সে বললে, ‘যে গুলি করেছে, সে কখনো ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে? পুলিশের গাড়ী বাইরে-পুলিশ ফায়ার করছে-শুনছো না?’

জানলার নীচে বাগানে তখন ফায়ারিং চলেছে। পুলিশের টচ্চের্চর আলোয় বাগান আলো। সদাশিব বেরিয়ে গিয়েছিলেন-ফিরে এসে কপালের ঘাম মুছে শ্রান্ত ভাবে চেয়ারে বসে পড়লেন।

কম্পিত কণ্ঠে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘কি ব্যাপার, রাও?’

সদাশিব বললেন, ‘রাজা রাওয়ের লোক কোথায় নেই মিষ্টার প্রসাদ? আপনার বাড়ীর আনাচে-কানাচে তারা ঘুরছে। কৃষ্ণা দেবীকে পথে ধরে সরাবার চেষ্টায় ছিল, আজ সন্ধ্যার অন্ধকারে কোনো মতে বাগানে ঢুকেছে গুলি করে আমাকে মারবার জন্য।’

ক্ষীণকণ্ঠে প্রণবেশ বললেন, ‘কিন্তু আপনাকে মেরে লাভ?’

কৃষ্ণা দিলে প্রশ্নের জবাব, ‘লাভ আছে বৈ কি মামা। আমাদের নিয়ে কাল সকালে মহাকালের মন্দির দেখাতে যাবেন, বললেন, উনি যাতে সঙ্গে না যান, সেই উদ্দেশ্যে।’

সদাশিব বললেন, ‘ঠিক বলেছেন কৃষ্ণা দেবী। আপনার আশ্চর্য্য চিন্তাশক্তি। এই জন্যই এ-বয়সে আপনি এতখানি খ্যাতি লাভ করেছেন। রাজা রাওয়ের লোক এই জানলার ধারেই ছিল। আমি আসবার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে, হয়তো! এসে আমাদের কথা শুনেছে। এদের উদ্দেশ্য, আমি আপনাদের নিয়ে না যাই! আপনারা এখানে সকলের অপরিচিত-এখানকার কিছু জানেন না! এখানকার কাকেও না নিয়ে আপনারা একা-একা গেলে ফাঁদে ফেলা শক্ত হবে না, তাই। আমি এ অঞ্চলের প্রত্যেকটি দাগীকে চিনি,-তারাও আমায় চেনে। যাই হোক, ভয় পাবেন না! ট্রেণে যাবো না, আমরা মোটরে যাবো। সকালে আসবো মোটর নিয়ে-এসে আপনাদের নেবো এখান থেকে তুলে। সঙ্গে তিনজন আর্মড গার্ড নেবো। কৃষ্ণা দেবীর রিভলভারে হাত আছে, নিশ্চয়।’

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ‘আমার রিভলভার আছে।’

সদাশিব বললেন, ‘আপনার মামা?’

প্রণবেশের মুখের দিকে সকৌতুক তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘খুব ভালো না পারলেও মামা রিভলভারের তাগ-বাগ জানেন।’

একটু হেসে সদাশিব বললেন, ‘তা হলেই হবে। ওঁর জন্য আমি রিভলভার নিয়ে আসবো! কিন্তু দেখবেন, যেন রামকে মারতে শ্যামকে মারবেন না! ওদের মারতে গিয়ে যেন আমায় বা কৃষ্ণা দেবীকে মেরে বসবেন না!’

সকলে হেসে উঠলেন।

প্রণবেশ গম্ভীর হয়ে রইলেন।

ছয়

ঘন বনের পাশে মোটর থামলো। গাড়ী থেকে নামলেন সদাশিব রাও, কৃষ্ণা, প্রণবেশ এবং সশস্ত্র দুজন রক্ষী। সাব-ইনস্পেক্টর রামস্বামী মোটর লক করে নেমে এলেন। বনের এ-পাশে দীর্ঘ পর্ব্বত-শ্রেণী-মাঝে মাঝে গা বয়ে ঝর্ণার জল পড়ছে। অনেক নীচে সে জলের স্রোত বয়ে চলেছে ঝির-ঝির ধারায়-তরল রূপোর মতো! হয়তো এই জীর্ণ ধারা দূরে কোথা প্রসারিত হয়ে নদী সৃষ্টি করেছে!

কৃষ্ণা মুগ্ধ নেত্রে দেখছে।

মুগ্ধ কণ্ঠে প্রণবেশ বললেন, ‘কি চমৎকার! বাঃ! যেন স্বর্গ।’

সদাশিব হাসলেন, বললেন, ‘যা বলেছেন, স্বর্গই বটে! এ স্বর্গের দেবরাজ এখন আমাদের কিভাবে অভ্যর্থনা করেন, দেখা যাক! তাঁর অনুচর-দেবতারা আশে-পাশে আছন নিশ্চয়-

আমাদের মোটর কি আর দেখছে না? হয়তো আমাদের আসার খবর দেবদূতের দল এতক্ষণে দেবরাজের কর্ণগোচর করেছে! এখন অভ্যর্থনার জন্য-‘

‘না, না, এত সপ্রতিভ!…’ প্রণবেশ বললেন।

দীর্ঘ পথ-মাঝে মাঝে ছোট বসতি…কোথাও শুষ্ক প্রান্তর খাঁ-খাঁ করছে। ছোট ছোট অসংখ্য পাহাড়। জব্বলপুর থেকে এ-পথে আসতে যে-সব ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে, সদাশিব পরিচয় দিচ্ছেন। এখানে সকলে এরা রাজা রাওয়ের প্রজা,-রাজা রাওকে সর্দ্দার বলে মানে, দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে।

প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ বনে বাঘ আছে?’

রামস্বামী বললেন, ‘তা মাঝে মাঝে দেখা যায় বৈ কি। তা বলে ভয় পাবেন না, এ পর্য্যন্ত তারা তেমন অনিষ্ট করেছে বলে শুনিনি। এ অঞ্চলের লোক বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে। এদের ভয়ে বাঘ পালিয়ে যায়!’

স্মিত হাস্যে সদাশিব বললেন, ‘অত খাতির করবেন না। কারণ গল্পগুলো সত্য নয়। মানুষকে বাঘ ভয় করে, কিন্তু সামনাসামনি হলে দু-একটা থাবা মারতেও এগিয়ে আসে! আপনি মাঝখানে থাকুন প্রণবেশবাবু, আমাদের ঘায়েল না করে আপনার কিছু করতে পারবে না!’

কৃষ্ণার পাশে পাশে চলেছেন প্রণবেশ।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পথের সরু রেখা…জঙ্গলের মাঝে মাঝে খানিকটা করে ফাঁকা জায়গা। জায়গায়-জায়গায় ধূ-ধূ প্রান্তর চোখে পড়ে।

দীর্ঘ সরু পথ এঁকে-বেঁকে চলেছে। একখানা পাতার কুঁড়ের চিহ্ন নেই! দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের উঁচু বুকে মন্দিরের চূড়া। সূর্য্যের আলো পড়ে সাদা চূড়া ঝকঝক করছে!

কৃষ্ণা বলে ওঠে-‘ঐ মন্দির দেখা যাচ্ছে। না, মিষ্টার রাও?’

সদাশিব বললেন, ‘ওখানে পৌঁছুতে আরও মাইলখানেক হাঁটতে হবে। এ পথে চলতে আপনার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে, বুঝতে পারছি! কিন্তু-‘

উত্তর দিলেন প্রণবেশ-তিনি রীতিমতো খোঁড়াতে সুরু করেছেন। রুক্ষ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘থাক, আর শান্তিপুরি-লৌকিকতায় কাজ নেই, মিষ্টার রাও। মোটরেই হাড়গোড় কতক চূর্ণ হয়েছে। পথ আগাগোড়া উঁচু-নীচু, এবড়ো-খেবড়ো! তারপর সেই মোটর থেকে নেমে হাঁটছি তো হাঁটছিই! হাঁটা আর শেষ হতে চায় না! আপনাদের দেশের মাইল নিশ্চয় সতেরশো ষাট গজে নয়! এর নাম হাড়ভাঙ্গা মাইল!’

তিনি আরও কি বলতেন, কৃষ্ণা বাধা দিলে-‘থামো, মামা, তুমি এত বকতে পারো!’

রুক্ষ কণ্ঠেই প্রণবেশ বললেন, ‘কিন্তু এটা যে পুলিশের ত্রুটি, তা তুমি বুঝছো না, কৃষ্ণা। রাওয়ের উচিত ছিল না, ডুলি বা ঐ রকম কিছু ব্যবস্থা করা?’

কৃষ্ণা এবার রীতিমতো ধমক দিলে-‘কি বকছো, মামা? তোমাকে নিয়ে দেখছি কোথাও যাওয়া চলবে না! বড় যা-তা বকো তুমি।’

সদাশিব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘হয়তো দোষ আমারই! আমি ভেবেছিলুম, এই সামান্য পথ আপনারা হাঁটতে পারবেন। তাছাড়া আমি একটা কথা ভেবে ডুলি রাখার ব্যবস্থা করিনি। ডুলি করে এ পথে চলতে গেলে জানাজানি হবে। কারণ এ হলো রাজা রাওয়ের রাজ্য। যারা ডুলি বইবে, তারা রাজা রাওয়েরই রেয়ৎ। আমরা যেভাবে এসেছি, যেন অত্যন্ত সাধারণ লোক…পূজা দেবার জন্যই যেন এসেছি! কারো সন্দেহ হবে না!’

কৃষ্ণা বললে, ‘মামার কথায় কিছু মনে করবেন না। মামাকে নিয়ে এ রকম হয়। অথচ মামাই আমাকে এখানে টেনে এনেছেন! আমি আসত চাইনি। তার কারণ, সামনে আমার একজামিন। আমি বেশ বুঝছি পূজা দিতে এসেছি যেন-এ পরামর্শ আপনি কেন দিচ্ছেন! অর্থাৎ রাজা রাওয়ের চোখে ধূলো দেওয়া!’

একটু থেমে সে আবার প্রশ্ন করলে, ‘আপনি রাজা রাওকে দেখেছেন কখনো?’

সহাস্যে সদাশিব উত্তর দিলেন, ‘সে সৌভাগ্য থেকে শুধু আমি নই, আমরা সকলেই বঞ্চিত! লোকের মুখে তার আকৃতি-প্রকৃতির যেটুকু পরিচয় পেয়েছি, তাই আমাদের সম্বল! আমরা শুনেছি, রাজা রাওয়ের বয়স প্রায় সত্তর বছর! লোকটা বেঁটে-মুখের ভাব রুক্ষ। মানে তাকে দেখলে গা ছমছম করে!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আর তার ব্যবহার যা শুনেছি-‘

‘আ-আ-আ-মেরা জান গেলই রে বাপ-‘

মনে হলো, হাজার হাজার লোক একসঙ্গে চীৎকার করে উঠলো পাশের পাহাড়ের গহ্বর থেকে!-সমস্ত পাহাড়-প্রান্তর ঝনঝন করে উঠলো! পাশের জঙ্গলে গাছের উপর পাখীগুলো ভয়ে চীৎকার করে ঝটাপটি করতে করতে উড়লো! জন্তু-জানোয়াররা চীৎকারে ভয় পেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটোছুটি করতে লাগলো।

আটজন লোকের গতি রুদ্ধ। প্রণবেশ কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন। কৃষ্ণাও শঙ্কিত হয়ে উঠেছে। রামস্বামী তাকালেন সদাশিবের মুখের পানে, সদাশিব তখন কোমরবন্ধ থেকে রিভলভারটা টানবার চেষ্টা করছেন, কম্পিত হাত কিছুতে ঠিক হচ্ছে না! সহরের চারজন কনষ্টেবল পূজার উপচার বয়ে নিয়ে চলেছে,-তারা গাছের আড়ালে যাবার জন্য উৎসুক-শুধু চাকরির জন্য সরতে পারলো না!

কম্পিত কণ্ঠে রামস্বামী বললেন, ‘এই পাহাড়ের গুহার মধ্যে এ রকম শব্দ, চীৎকার প্রায় শোনা যায়। এ অঞ্চলের লোকেরা বলে, এদিকে মহাকালের পার্শ্বচর নাকি…মানে-‘

কৃষ্ণা হেসে ফেললো, বললে-‘সোজা কথায় বলুন-এখানে ভূত-প্রেতের আনাগোনা! মহাকালের মন্দিরের মধ্যে যাতে মানুষ না আসতে পারে, তারা তাই সব-সময় পাহারা দিচ্ছে!’

সদাশিব মাথা নত করেন-‘হ্যাঁ, তাই শুনেছি। আমাদের বড়সাহেব একবার এসেছিলেন-তিনি আর ফেরেননি! শুধু তিনি নন, আরও বহু লোক এসেছেন সন্ধানে, কেউ ফেরেননি! আমি অবশ্য মহাকালের মন্দিরের নাম শুনেছিলুম, আজ এই প্রথম আসছি মন্দির-দর্শনে!’

তাঁর স্বর একটু কম্পিত…কৃষ্ণা তা লক্ষ্য করলো। স্থির কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘আপনারা আমাকে এগিয়ে যেতে দিন, আমি এরকম অনেক দেখেছি-ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানার উপদ্রব অনেক শুনেছি। শেষে দেখেছি, বাজে কথা! মানুষের কীর্ত্তি ছাড়া সে-সব আর কিছু নয়! আপনারা আসুন। আমি একটু এগিয়ে যাই!’

প্রণবেশ চীৎকার করে উঠলেন, ‘কৃষ্ণা-‘

কৃষ্ণা জবাব দিলে না-জোর-পায়ে এগিয়ে চললো।

সাত

মন্দির-প্রাঙ্গণে পৌঁছে কৃষ্ণা দাঁড়ালো। বেশ হাঁফিয়ে উঠেছে সে!

তার পিছনে রামস্বামী, সদাশিব,-তাঁদের পিছনে কনষ্টেবলদের সঙ্গে প্রণবেশ।

খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হলো সকলকে। দম নিয়ে কৃষ্ণা মন্দিরের পানে তাকালো।

বিমুগ্ধ কণ্ঠে নিঃসৃত হলো অস্ফুট স্বর-‘চমৎকার!’

খুব সম্ভব এককালে এখানে বড় মন্দির ছিল, ভেঙ্গে পড়লেও বোঝা যায়। মহাকালের মন্দির ভেঙ্গে পড়েছিল, আবার গড়ে তোলা হয়েছে। হয়তো এককালে এ মন্দির অতুলনীয় কারুকলায় বিভূষিত ছিল-মন্দিরের গায়ে এখন তার চিহ্নও নেই!

পাহাড়ের উপরে মন্দির…মন্দিরে মহাকাল শিব।

সামনে খানিকটা জায়গা-কৃষ্ণা সেখানে দাঁড়ালো। রুদ্ধ-দ্বার মন্দিরের পানে তাকিয়ে বললে, ‘এতদূর এসে মহাকালের মূর্ত্তি না দেখে ফিরবো মিষ্টার রাও? দরজাটা কোনোরকমে খোলা যায় না?’

প্রকাণ্ড লৌহ-কপাট। সে কপাট ভিতর থেকে বন্ধ। মনে হয়, অন্য কোনো দিকে দরজা আছে। এ দিককার দরজা বন্ধ করে সেইদিক দিয়ে মন্দিরে যাওয়া-আসা চলে।

প্রণবেশ এতক্ষণে একটু চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন। বিপদের আশঙ্কায় তিনি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন-এখানে পৌঁছে এবং এতক্ষণ বিপদের আভাস না দেখে তাঁর সাহস ফিরেছে!

তিনি বললেন, ‘দরজাটা দেখেছো! পাহাড়ের গা কেটে মন্দির তৈরী হয়েছে, দরজাও পাহাড়ের গায়ে বসানো! এমন মজবুত যে হাতী দিয়ে ঠেললেও দরজা ভাঙ্গবে না!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আসুন মিষ্টার রাও, আমরা দেখি, কোনো দিক দিয়ে মন্দিরে যাওয়া যায় কিনা। এতদূর এসে ঠাকুর না দেখে, পূজা না দিয়ে ফিরে যাওয়া-এ হতে পারে না!’

কিন্তু কোনোদিকে যাওয়া গেল না, মন্দিরের তিন দিকে খাড়া পাহাড়।

প্রণবেশ বললেন, ‘পূজার জিনিষ দরজার কাছে নামিয়ে রেখে ঐখান থেকেই প্রণাম করে এসো। শুধু শুধু এই পাহাড়-পথে চড়াই-উতরাই ভেঙ্গে তিন মাইল, তিন মাইল ছ’মাইল হাঁটা মুখের কথা নয়।’

বোঝা গেল, তিনি বিলক্ষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন!

কৃষ্ণা ততক্ষণে লোহার দরজার উপর হাত বুলোচ্ছে।

রামস্বামী সকৌতুকে বললেন, ‘কি হচ্ছে?’

কৃষ্ণা বললে, ‘দেখছি, কোনোরকমে খোলা যায় কিনা। ধরুন-যদি কোনো স্প্রিং থাকে, চোখে দেখা যাচ্ছে না-হাত দিয়ে টিপলেই দরজা খোলে! এমন হতে পারে তো!’

‘তার দরকার হবে না! সরুন, আমি খুলছি!’

অকস্মাৎ পিছনে কার কথা শুনে কৃষ্ণা সচকিত হয়ে ফিরে তাকালো,-সঙ্গে সঙ্গে রামস্বামী, সদাশিব এবং প্রণবেশ ফিরলেন। রামস্বামী এবং সদাশিব সতর্ক ভাবে রিভলভারে হাত রাখলেন-কি জানি, সাবধানের মার নেই!

পিছনে অপরিচিত মানুষ! মানুষটি শুধু হাসলো। প্রায় ছ-ফুট তার দেহ, দীর্ঘ বলিষ্ঠ সুপুরুষ! মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাঁটা-পিছনে লম্বা শিখা। চওড়া বুকে সাদা পৈতের গোছা দেখা যাচ্ছে।

লোকাটা যেন এই পাহাড়ের বুক ফুঁড়ে উঠে এলো! সন্দেহাকুল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চেয়ে কৃষ্ণা দেখলো…পিছনে আসার পথে সশস্ত্র চারজন কনষ্টেবল! এদিকে-ওদিকে দুরারোহ পর্ব্বতশ্রেণী! লোকটি কোন দিক দিয়ে এলো, আশ্চর্য্য!

কৃষ্ণা আগন্তুকের পানে তাকিয়ে। এরকম সুদীর্ঘ সুঠাম আকৃতির মানুষ খুব কম দেখা যায়! শান্তি-স্নিগ্ধ মুখ, তবু চোখে যেন আগুনের হলকা-কৃষ্ণা তাও লক্ষ্য করলো!

লোকটি এগিয়ে এলো। দুখানা হাত তুলে বললে, ‘ভয় নেই। আপনাদের অস্ত্র বার করতে হবে না। এ দেবতার স্থান, আমি নিরস্ত্র,-আমার দ্বারা আপনাদের অনিষ্ট হবার কোনো আশঙ্কা নেই।’

অনাবৃত দেহ…ছোট একখানা ধুতি আঁট-সাঁট করে পরা,-কোনো কিছু লুকিয়ে রাখবে, উপায় নেই!

রামস্বামী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি?’

লোকটি সেলাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীত কণ্ঠে দারোগা সাহেবকে বললে, ‘নফর-এ মন্দিরের পুরোহিত। আজকের মতো পূজা শেষ করে গিয়েছিলাম। একজনের কাছে শুনলাম, আপনারা পূজা দিতে এসেছেন। শুনেই চলে এসেছি।’

সদাশিব বললেন, ‘তোমার ঘর কোথায়?’

হাত তুলে সে জানালো, ‘ওদিকে সাহেব, পাহাড়ের ওধারে,-সোজা পাহাড়ে উঠলেই দেখা যাবে। দয়া করে যদি গরীবের কুঁড়েয় আসেন পূজা দেবার পর, গরীব কৃতার্থ হবে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘যাবার কথা পরে। আপনি দয়া করে দরজা খুলে দিন। পূজা শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।’

পুরোহিত একটু হাসলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন।

আশ্চর্য্য! দরজার পাশে বোতামের মতো দেখতে ছোট একটি পেরেক। কৃষ্ণা বা আর কেউ তা লক্ষ্য করেনি! পুরোহিতের আঙ্গুলের চাপে দরজার ভারী কপাট দুখানা আস্তে আস্তে খুলে গেল। বিরাট পর্ব্বত-গুহা। ভিতরটা অন্ধকার। কোনো দিকে আলো আসবার পথ সেই। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না।

পুরোহিত বললেন, ‘আপনারা ভিতরে আসুন। বাইরে থেকে কিছু দেখতে পাবেন না।’

কৃষ্ণা ইতস্ততঃ করছে।

রামস্বামী ফিসফিস করে বললেন, ‘রাজা রাওয়ের লোক নয় তো? আমরা পুলিশ, এ তা জানে। আমরা আসবার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে খবর রটে গেছে। সকলেই জেনেছে মহাকালের মন্দিরে পুলিশ এসেছে। আমরা যদি পূজা দেবার উদ্দেশ্যে না আসতাম, পথেই সাবাড় করতো হয়তো!’

চাপা গলায় কৃষ্ণা বললে, ‘আর যাই হোক, রাজা রাও গোঁড়া হিন্দু, তা অস্বীকার করা যায় না। সেই জন্যই তার পরম-শত্রু পুলিশ মন্দিরে আসছে দেখেও সে বাধা দেয়নি, মনে হচ্ছে।’

কনষ্টেবলরা পিছনে এসে দাঁড়ালো পূজার উপচার নিয়ে।

চাপা গলায় কৃষ্ণা বললে, ‘মন্দিরের মধ্যে গিয়ে কোনো লাভ নেই মিষ্টার রাও, এখান থেকে মহাকালকে দেখে ফেরা যাক। কি বলেন?’

সদাশিব হাসলেন, বললেন, ‘নিরস্ত্র পুরোহিতকে ভয় করবার কারণ নেই, কৃষ্ণা দেবী। চলুন।’

প্রণবেশ আপত্তি তুললেন-‘না, না, হোক নিরস্ত্র। তবু এরা সব করতে পারে ওই খালি হাতে। এই দরজা থেকে তো বেশ দেখা যায়। ওর মধ্যে ঢোকবার দরকার কি?’

ভর্ৎসনার সুরে কৃষ্ণা বললে, ‘তুমি চুপ করো তো মামা,-ভিতরে আসতে তোমার ভয় হয় যদি, তা হলে তুমি এখানে থাকো। এখানে এরা আছে, ভয় নেই। আমি মন্দিরের ভিতরটা দেখে আসি-‘

মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলেন সদাশিব, কৃষ্ণা এবং রামস্বামী।

বাইরে রইলেন প্রণবেশ। কনষ্টেবলরা তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আট

কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে কৃষ্ণা এবং তার সঙ্গীরা দাঁড়ালো।

বিরাট শিবলিঙ্গ। অন্ধকারে পুরোহিত আগে নেমে গিয়ে দুটি প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন। প্রকাণ্ড দুটি পিলসুজের উপর বড় বড় দুটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। পূজার বাসন-কোসন ইতস্ততঃ ছড়ানো। এগুলি এখনও গুছিয়ে রাখা হয়নি।

সকালে পূজা হয়ে গেছে। ফুল-বেলপাতা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

সদাশিব বললেন, ‘আমাদের পূজার জিনিষগুলো এনে পূজা সেরে নিলে হতো!’

পুরোহিতের মুখে মৃদু হাসি ফুটলো। পুরোহিত বললেন, ‘পূজার জিনিষের জন্য আপনার ভাবনা নেই রাও সাহেব-এতক্ষণে আমার লোকজন সে সব জিনিষ নিয়েছে,-এখনই মন্দিরে নিয়ে আসবে।’

প্রদীপটা তিনি উঁচু করে তোলেন।

প্রদীপের ম্লান আলোয় পর্ব্বতের গুহার ভিতরটা দেখা যায়। মস্ত বড় গুহা,-এর উপরে গড়ে উঠেছে মন্দির।

পুরোহিত বললেন, ‘আমি শুনেছি, এই মহাকালের মূর্ত্তি বহুকাল আগে এ দেশের এক বড় রাজা স্বপ্ন দেখে গোদাবরীর তীরে কুড়িয়ে পান। তারপর তিনি এই মন্দির গড়ে লিঙ্গটিকে এনে স্থাপনা করেন। তখনকার দিনে এ জায়গা ভারতবর্ষের পবিত্র তীর্থ ছিল। কালে মুসলমান বাদশা আওরঙ্গজেব মারহাট্টা দেশ জয় করতে বেরিয়ে যখন তা জয় করতে পারলেন না, তখন তিনি বহু মন্দির ধ্বংস করেন। অর্থাৎ তাঁর আসার পথে যে-যে মন্দির পড়েছিল, তার একটাও রক্ষা পায়নি! সেই সময়ে মহাকালের মন্দিরও চূর্ণ হয়। মহাকাল শিব বহুকাল অযত্নে বিনা-পূজায় এই জঙলী পর্ব্বতে পড়ে থাকেন। তার অনেক বছর পরে মোগল রাজত্বের শেষ দিকে গোয়ালিয়রের মহারাজা এই মন্দির তৈরী করে এখানে মহাসমারোহে শিব প্রতিষ্ঠা করেন।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘আমি শুনেছি, মহাকাল শিবের মাথায় নাকি একটি মঙ্গল-চক্র ছিল!’

পুরোহিতের চোখ জ্বলে উঠলো! প্রদীপের মৃদু আলোয় কৃষ্ণা তা দেখতে পেলো না!

সুদৃঢ় স্থির কণ্ঠে পুরোহিত বললেন, ‘হ্যাঁ, মহারাজ অনেক যাগ-যজ্ঞ-স্বস্ত্যয়ন করে অগাধ টাকা খরচ করে সে-মঙ্গল-চক্র শোধন করেছিলেন। কেউ জানতো না এ কথা। জানতেন শুধু মহারাজা আর তাঁর পুরোহিত। এই মঙ্গল-চক্র কোন সাধু নাকি মহারাজাকে দিয়ে বলেছিলেন-মহাকালের অঙ্গে যে কোনো জায়গায় যেন এ চক্র স্থাপন করা হয়। এই মহাকালের মন্দির এবং এর আশে-পাশে বহু গ্রাম মহাকালের নিজস্ব সম্পত্তি বলে তিনি দান করেন। দেবোত্তর সম্পত্তি করে দেন। এখানকার রাজা যেন মহাকাল-রাজার প্রতিনিধির মতো থাকতেন তাঁর পরম বন্ধু মালি রাও। আজও তাঁর বংশধররা মন্দির দেখাশুনা করছেন,-তাঁরাই এ জায়গীরের মালিক।’

রামস্বামী জিজ্ঞাসা করেন, ‘এখন মালিক কে?’

পুরোহিতের মুখে বাঁকা হাসি! পুরোহিত বললেন, ‘মালিক কে, আপনি আর রাও সাহেব বেশ ভালোই জানেন তো, দারোগা সাহেব। এখন এ মন্দিরের মালিক রাজা রাও।’

সদাশিব হাঁফিয়ে উঠেছিলেন-গহ্বরের মধ্যে অসহ্য গরমে ঘেমে যেন নেয়ে উঠেছেন! তিনি বললেন, ‘মহাকালের দর্শন তো হলো-এখন?’

কৃষ্ণা বললে, ‘আর একটুও দেরী করবো না।’

পুরোহিতের দিকে ফিরে কৃষ্ণা বললে, ‘আপনি যখন পূজারী-নিশ্চয় জানেন, সেই মঙ্গল-চক্র মহাকালের অঙ্গে কোথায় ছিল!’

পুরোহিত প্রদীপ ধরে শিবলিঙ্গের মাথার দিক দেখালেন-শিবলিঙ্গের পিছন দিকটা ভাঙ্গা। পুরোহিত বললেন, ‘রাজা রাওয়ের এক দুশমন আছে-তার নাম ভাস্কর। এ সেই ভাস্করের কাজ। ভাস্কর এঁদের বিশেষ পরিচিত। বেশীর ভাগ সময় সে বম্বেতে থাকে। খুব বড় ব্যবসায়ী। সে কি করে জানতে পারে, মহাকালের মাথার মধ্যে মঙ্গল-চক্র আছে। সেই খবর পেয়ে প্রথমে সে রাজা রাওকে বলে পাঠায়, কত দামে সে এই জায়গীর-সমেত মহাকালের মন্দির বিক্রয় করতে পারে? রাজা রাও বিক্রয় করতে রাজী হয়নি। ভাস্করের লোক তখন তাকে নানা অপমানের কথা বলে। বিশ্রী অপমান! সে-অপমান রাজা রাও মাথা পেতে সহ্য করেনি! সে-অপমানের সাজা দিয়েছিল লোকটিকে-মৃত্যুদণ্ড।’

পূজারীর দু-চোখে যেন আগুন জ্বলছে!

মনে মনে শঙ্কিত হয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘চলুন, এবার উপরে ওঠা যাক। গরমে এর মধ্যে আর থাকা যাচ্ছে না। কিন্তু একটা কথা, আপনি এত কথা কি করে জানলেন?’

পূজারী হাসলেন,-বললেন, ‘মহাকালের নামে দেড়শো গাঁ। এই দেড়শো গাঁয়ের সমস্ত লোক এ-সব কথা জানে। যাকে জিজ্ঞাসা করবেন, সেই বলবে। তা এ কথা এখন থাক,-আপনারা আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠুন। ভয়ানক গরম, সত্য। এখানে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে।’

পূজারী সকলের পিছনে, কৃষ্ণা সকলের আগে-পর-পর চারজনে উপরে উঠে নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন! বাতাস রৌদ্রতপ্ত, তবু সে বাতাসে কত আরাম!

আশ্চর্য্যের কথা-চারজন কনষ্টেবল আর প্রণবেশকে দেখা গেল না। পূজার জিনিষপত্র পড়ে রয়েছে।

উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণা। সদাশিবের দিকে ফিরে ব্যাকুলকণ্ঠে বললে, ‘এরা কোথায় গেল, মিষ্টার রাও? আপনার চারজন কনষ্টেবল? আর মামা? এইখানেই ছিলেন, দেখে গেছি।’

সদাশিব এবং রামস্বামী চিন্তিত হলেন। ‘তাই তো-এরা গেল কোথায়? কাকেও দেখছি না।’

পূজারী বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘যেখানেই যাক, এইখানেই ফিরে আসবে। আপনাদের ফিরতে দেরী দেখে বাঙালী ভদ্রলোকটি বোধ হয় একটু ঘুরতে গেছেন। সঙ্গে কনষ্টেবলদের নিয়ে গেছেন-পাহারাদারী করতে।’

রামস্বামী বললেন, ‘আমার কনষ্টেবলরা এমন অর্বাচীন নয়। তারা জানে, আমরা মন্দিরে গেছি অপরিচিত লোকের সঙ্গে,-আর আমাদের ফেলে এখান থেকে তারা সরে যাবে? আমার মনে হয়, তাদের কোনো বিপদ ঘটেছে!’

কথাটা মনে লাগলো। কৃষ্ণার মুখ বিবর্ণ হলো।

করজোড়ে বিনীত কণ্ঠে পূজারী বললেন-‘আপনারা দয়া করে আমার কুঁড়েয় যদি একবার পায়ের ধূলো দেন! আমার ওখানে একটু বিশ্রাম করে তারপর যাবেন,-আমি নিজে গিয়ে আপনাদের মহাকালের সীমানায় পৌঁছে দিয়ে আসবো।’

পিপাসায় তিনজনের টাগরা শুকিয়ে জ্বালা করছে! এ অবস্থায় যার হাতে পড়েছেন সকলে, সন্দেহ বা অবিশ্বাসের বশে তার কথা যদি না রাখেন, তাহলে বিপদের সীমা থাকবে না! তার চেয়ে একে একদম অবিশ্বাস নয় যেন! সন্দেহ নয়! বিশ্বাস-এমনি ভাব দেখিয়ে এর কথা মানা ভালো!

ক’জনে চারিদিকে তাকালেন-যতদূর দেখা যায়, জলের চিহ্ন নেই! যে দারুণ পিপাসা-জল না খেলে হাঁটতে পারবেন না! বাধ্য হয়ে তাঁরা পূজারীর সঙ্গে চললেন।

নয়

অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ।

সদাশিব রাওয়ের সঙ্গে কৃষ্ণা আর প্রণবেশ মহাকালের মন্দির দেখতে গেছে,-দু’দিন কাটলো, আজও তাদের দেখা নেই!

তিনি থানায় গেলেন।

থানার কর্ম্মচারী সসম্ভ্রমে তাঁকে বসালেন।

উৎকণ্ঠিত ভাবে রাজেন্দ্রপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইনস্পেক্টর সদাশিব রাওয়ের খবর কি?’

কর্ম্মচারী সবিনয়ে জানালেন, সদাশিব রাও ফেরেননি। জব্বলপুর থেকে তার করেছেন ফিরতে দু-চার দিন দেরী হতে পারে। ওখানকার দুর্দ্দান্ত সর্দ্দার রাজা রাও একখানা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর আর দুজন কনষ্টেবলকেও নিষ্ঠুর ভাবে খুন করেছে-জীবন্ত তাদের গায়ের ছাল ছাড়িয়েছে! ময়না তদারক আর রাজা রাওকে গ্রেফতার করার ভার পড়েছে ওঁর উপর-সেই কারণে আসতে পারছেন না!

বিবর্ণ মুখে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বাড়ী ফিরে এলেন। বাড়ী ফিরে শ্বশুরের টেলিগ্রাম পেলেন। শ্বশুর জানিয়েছেন, তাঁর কন্যা সেখানে পৌঁছোননি! রাজেন্দ্রপ্রসাদ যেন অবিলম্বে সন্ধান নেয়। তিনিও থানায় খবর দিয়ে যথাবিহিত করছেন।

মাথায় হাত দিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বসে পড়লেন।

পুলিশকে খবর! খবর দিলেও পুলিশের শক্তি-সামর্থ্যে তাঁর বিশ্বাস নেই! তাই নিজে নাগপুর রওনা হলেন।

কিন্তু বৃথা অন্বেষণ! নাগপুরে তিনি কোনো সন্ধান পেলেন না।

শয্যাশায়ী বৃদ্ধ সজল চোখে তাঁর দুটি হাত ধরে বললেন, ‘আমার আদরের মেয়েকে-যেমন করে পারো, আনো প্রসাদ। সে শুধু আমার মেয়ে নয়, তোমার স্ত্রী-তার সঙ্গে তোমার ছেলে আছে-যেমন করে পারো, উদ্ধার করা চাই। নিশ্চয় তাদের খুব বিপদ হয়েছে।’

কি করবেন, রাজেন্দ্রপ্রসাদ ভেবে পান না! সদাশিব রাওয়ের ক্ষমতা তিনি জানেন,-কৃষ্ণার খ্যাতিও তিনি শুনেছেন! কিন্তু দুজনের কেউ উপস্থিত নেই! রাত্রের ট্রেণে তিনি ফিরছিলেন-ফার্ষ্ট ক্লাশের প্যাসেঞ্জার। তাঁর কামরায় তিনি আর তাঁর দুজন গার্ড-এ ছাড়া চতুর্থ ব্যক্তি নেই!

ভাবছেন, নিশ্চয় এ রাজা রাওয়ের কাজ!

মঙ্গল-চক্র যে সত্যই অপহৃত হয়েছে, রাজা রাও তা বিশ্বাস করেনি! ভেবেছে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ সে-চক্র লুকিয়ে রেখেছেন এবং আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশের সাহায্য! তাঁর স্ত্রী-পুত্র রাজা রাওয়ের হাতে পড়ে থাকে যদি, তাহলে তাদের উদ্ধার-কি করে হবে? বৃটিশ শাসনকেও সে তুচ্ছ করে। বৃটিশ-অধিকারে বাস করেও বৃটিশকে গ্রাহ্য করে না,-খেয়ালখুশীমতো কাজ করে! এই যে একটা গ্রামের এত লোককে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে-গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলকে খুন করলো-সে শুধু তার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য নয় কি? গ্রামের লোক মোটা টাকা পুরস্কার পাবে, সেই-লোভে তারা পুলিশকে রাজা রাওয়ের খবর দেয়! তাকে ধরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত! তাই সেই অপরাধে তাদের এই সাজার ব্যবস্থা! নবাবী আমলেই এমন সাজার কথা শোনা যায়! যে পুলিশ-সাব-ইনস্পেক্টর সদলবলে রাজা রাওকে ধরতে গিয়েছিলেন, তাঁকেও শাস্তি নিতে হয়েছে।

ভাবতে ভাবতে রাজেন্দ্রপ্রসাদের একটু তন্দ্রার ভাব-গার্ডরাও মানুষ-ঘুমে তাদের চোখ আচ্ছন্ন।

একটা ষ্টেশনে ট্রেণ দাঁড়াতে দরজাটা এক-টানে খুলে যে-লোকটি কামরায় উঠে পড়লো-তার দরজা খোলার শব্দে রাজেন্দ্রপ্রসাদের তন্দ্রা ভাঙ্গলো। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। তাঁর গার্ড-দুজনও সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো-রিভলভার খাড়া করে।

‘প্রণববাবু!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ চেঁচিয়ে উঠলেন।

ট্রেণ তখন আবার চলতে আরম্ভ করেছে।

প্রণবেশ হাঁফাচ্ছেন। অত্যন্ত ক্লান্ত! তাঁকে দেখে মনে হয়, অনেকখানি পথ দৌড়ে এসেছেন।

প্রণবেশকে চিনতে পেরে গার্ডরা রিভলভার নামালো।

প্রণবেশ দম নিলেন, পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছলেন, তারপর ভীত কণ্ঠে বললেন, ‘কি কুক্ষণেই যে বাঙলা ছেড়ে আপনাদের এই পাহাড়ী দেশে এসেছি! কৃষ্ণা আসতে চায়নি, আমিই জোর করে তাকে নিয়ে এলুম! আপনাদের এখানে এ রকম ভূতের কাণ্ড ঘটে, জানতুম না। সাংঘাতিক ব্যাপার!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এদিকে কোথা থেকে এলেন? কৃষ্ণা দেবী আর সদাশিব রাওয়ের সঙ্গে আপনি মহাকালের মন্দির দেখতে গেছলেন তো-এখানে একা এমনভাবে ট্রেণে এসে উঠলেন। আর সকলে?’

প্রণবেশ বিকৃত মুখে বললেন, ‘তারা কোথায়, ভগবান জানেন! গেলুম মহাকালের মদির দেখতে, সেখানে আপনার দুশমনরা ডাল-পালা মেলে বসে আছে, তা কে জানে! জানলে কৃষ্ণাকে কখনও যেতে দিতুম না! কি যে হলো-এখনও ঠিক বুঝতে পারছিনে! পরশু গেছি, আর এই তিন দিন, মশায়-দুটো কলা ছাড়া আর কিছু মুখে দিইনি! খিদেয় চারিদিক অন্ধকার দেখছি!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, ‘কিছু খাননি? তাহলে এখন আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করবো না-আমার সঙ্গে খাবার আছে, জল আছে, আপনি আগে খেয়ে নিন প্রণববাবু!’

গার্ডদের আদেশ করতেই তারা রাজেন্দ্রপ্রসাদের যে খাবার সঙ্গে ছিল, বড় প্লেটে সাজিয়ে প্রণবেশের সামনে ধরে দিলে।

ক্ষুধার্ত্ত প্রণবেশ প্লেট থেকে খাবার তুলতে গিয়ে থামলেন, বললেন, ‘কিন্তু সব আমায় ধরে দিলে ওরা, আপনার?’

শুষ্ক হাসি হেসে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘আমি আসবার সময় প্রচুর খেয়ে এসেছি, রাত্রে আর আমি কিছু খাবো না! আপনি খেয়ে নিন!’

আর বলার অপেক্ষা নয়, প্রণবেশ পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে ছ’খানা মোটা পুরী আর এতগুলো লাড্ডু মিঠাই উদরস্থ করে দু’গ্লাস জল খেয়ে ধাতস্থ হলেন! খাওয়া শেষ হলে আরামের নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আঃ এবার মনে হচ্ছে, বাঁচবো! যে করে ট্রেণ ধরেছি, যদি শোনেন-‘

রাজেন্দ্রপ্রসাদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না-মহাকালের মন্দির দেখতে গেলেন-এদিকে এলেন কি করে? দু’দিনেই শুকিয়ে একেবারে আধখানা হয়ে গেছেন! মনে হচ্ছে, কোথায় কতদূরে গিয়েছিলেন-সেখানে খেতে পাননি! তাছাড়া আপনার উপর যেন ভয়ানক পীড়ন-নিৰ্য্যাতন-‘

বাধা দিয়ে প্রণবেশ বললেন, ‘বলেন কেন! যা হয়েছে, ভুক্তভোগী হলে বুঝতেন! আমাদের পাঁচজনকে বাইরে রেখে ওরা তিনজনে তো পূজারীর সঙ্গে মন্দিরে ঢুকলো। দেশোয়ালী-কনষ্টেবলগুলো…নিশ্চয় ওদের, মানে, ওরা ঐ রাজা রাওয়ের লোক! ওদের মধ্যে দুজন ছিল ভালো-তাদের অবস্থাও শোচনীয়।’

একটু থেমে দম নিয়ে প্রণবেশ আবার বললেন, ‘দিব্যি বসেছিলুম মশায়, পিছনের পাহাড় ফেটে যেন দশ-পনেরো জন লোক আমাদের উপর লাফিয়ে পড়লো। দুজন কনষ্টেবল দাঁত বার করে হাসতে লাগলো! আমরা তিনজন-আমাদের মুখে টুঁ-শব্দ নেই! আমাদের হাত-পা বেঁধে মুখের মধ্যে কাপড় গুঁজে দিলে তারপর ঘাড়ে করে নিয়ে চললো! কোথা দিয়ে কোথায় নিয়ে গেল, জানিনে মশায়। কাল একবার দুটো চিঁড়ে আর দই দিয়েছিল খেতে আর কিছু না! খিদেয় মরে যাই! কাল সেখান থেকে টেনে একখানা মোটরে তুললো-তারপর কি করলে, কে জানে! কি ঘুমই ঘুমিয়েছিলুম! ঘুম ভেঙ্গে দেখি, পথের ধারে ঘাসের উপর একা পড়ে আছি। কোনো মতে উঠে হাঁটতে হাঁটতে একে-তাকে জিজ্ঞাসা করতে করতে ষ্টেশনে এসে পৌঁছুই। উঃ, কি অশুভক্ষণেই কলকাতা থেকে বেরিয়েছি!’

দশ

পাহাড়-পথে চলতে একটা বাঁকের মুখে কৃষ্ণা থমকে দাঁড়ালো-পিছনে তাকিয়ে সদাশিব বা রামস্বামীকে দেখতে পেলো না! সে বেশ উৎকণ্ঠিত হলো!

পূজারী পিছন ফিরে দেখলো, সে দাঁড়িয়েছে। বললে, ‘আসুন-থামলেন কেন?’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘এঁরা কোথায়? কাকেও দেখতে পাচ্ছিনে তো!’

পূজারী বেশ শান্ত কণ্ঠে বললে, ‘হয়তো উঠতে পারেননি, পথে কোথাও বসে বিশ্রাম করছেন! আপনি চলে আসুন।’

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ‘না, আমি নেমে যাবো। একা যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়!’

সে পিছনে ফিরতে চায়।

‘দাঁড়ান!’

মনে মনে চমকে কৃষ্ণা ফিরে দাঁড়ালো!

পূজারী বললে, ‘আপনি নামলেও ওঁদের দেখতে পাবেন না। ওঁরা বন্দী। আপনিও বন্দিনী। নামবেন কি!’

‘বন্দিনী! তার মানে?’

পূজারী হাসলো, বললে, ‘হ্যাঁ, আপনি আমার বন্দিনী। তাঁরাও আমার বন্দী।’

কৃষ্ণা পূজারীর মুখের দিকে তাকায়, জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি পূজারী নন?’

পূজারী বললে, ‘যাকে আপনারা খুঁজছেন-আমি সেই রাজা রাও!’

কৃষ্ণা নিঃশব্দে খানিকক্ষণ রাজা রাওয়ের পানে তাকিয়ে থাকে, তারপর এদিক-ওদিক তাকায়।

রাজা রাও হাসলো। বললে, ‘ভাবচেন, আপনি এখন ছুটে পালাবেন! অসম্ভব! আমার দেড় হাজার লোক এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে আছে, আপনি কোনো দিকে যেতে পারবেন না। পালাবার চেষ্টা করলে বিপদে পড়বেন। তার চেয়ে সোজা আমার সঙ্গে আসুন। একটা কথা-আমি আপনার কোনো অনিষ্ট করবো না-যাতে আপনি স্বচ্ছন্দে থাকেন, এমন ব্যবস্থা করবো।’

উপায় নেই!-নিরুপায়ে কৃষ্ণা নিঃশব্দে ঠোঁট চাপলো।

আদেশের সুরে রাজা রাও বললে, ‘আসুন, দাঁড়াবেন না-

আসুন-না হলে আমাকে বাধ্য হয়ে’-এই পর্য্যন্ত বলে রাজা রাও দু’হাতে তালি বাজালো।

আশ্চর্য্য! চকিতে প্রায় পনেরো-ষোল জন লোক পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে!

জোয়ান কালো-কালো লোকগুলোর পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা কেঁপে ওঠে যেন! এরা এ অঞ্চলের আদি-বাসিন্দা এবং সকলেই রাজা রাওয়ের অনুগত!

রাজা রাও আবার তালি দিতে তারা অদৃশ্য হলো। কৃষ্ণাকে লক্ষ্য করে রাজা রাও বললে, ‘দেখলেন, আমায় নিরস্ত্র ভেবে যদি পালাবার চেষ্টা করেন-তাতে ফল হবে না। উলটে যথেষ্ট নিগ্রহ সহ্য করতে হবে। এরা আপনাকে চিনে রাখলো-কোথাও গিয়ে আপনি নিস্তার পাবেন না।’

কৃষ্ণা শান্তকণ্ঠে বললে, ‘চলুন, কোথায় নিয়ে যাবেন।’

খুশী হয়ে রাজা রাও বললে, ‘হ্যাঁ, আশা করি, আপনি কোনো দিনই আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। আপনি বলতে পারেন, আপনি আমার কোনো অনিষ্ট করেননি, তবু আপনাকে ধরবার কি প্রয়োজন? আপনাকে আমি সব কথা বুঝিয়ে বলবো। চলুন, পথেই বলতে বলতে যাই।’

রাজা রাও অগ্রসর হলো। বাধ্য হয়ে কৃষ্ণাকেও সঙ্গে যেতে হলো।

লোকটাকে দেখে মনে হয় না, ডাকাতদলের দুর্দ্ধর্ষ সর্দ্দার সে! এমন কোনো কাজ নেই যা সে করতে পারে না! এমন সুন্দর চেহারা অথচ মন এমন পশুর মতো! তা কখনো সম্ভব?

চলতে চলতে ক্লান্ত কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো-আমার মামার আপনারা কি করলেন? তিনি কোনো অপরাধ করেননি, অত্যন্ত ভালো মানুষ, তাঁকেও বন্দী করে রেখেছেন?’

রাজা রাও বললে, ‘না, রাজা রাও মানুষ চেনে। আপনার মামা কি প্রকৃতির মানুষ, সে পরিচয় সে পেয়েছ। আপনার মামাকে আমার লোকেরা নিয়ে গেছে, তাঁর কোনো অনিষ্ট হবে না। একটু কষ্ট পাবেন মাত্র। একদিনের মধ্যেই তিনি রায়পুরে পৌঁছে যাবেন। তাঁর জন্য ভাবনার কারণ নেই।’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘আমাকে এরকম বন্দী করবার কারণ বুঝতে পারছি না। আমিও আপনার কোনো অনিষ্ট করিনি।’

রাজা রাও হাসলো! বললে, ‘প্রত্যক্ষ ভাবে না হোক, পরোক্ষ ভাবে তাই করতে এসেছেন! নয় কি? রাজেন্দ্রপ্রসাদকে আপনি চেনেন না। কবে সে আপনাকে বাঁচিয়েছিল-তাই তার সম্বন্ধে কিছু না জেনেই আপনি এসেছেন তার কাজে-সেই অপরাধে আপনাকে বন্দিনী হতে হলো! আপনি বাঙলায় ফিরে যান রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাজ ছেড়ে দিয়ে-আমিও আপনাকে এখনি ছেড়ে দেবো। শুধু তাই নয়-আপনার মেহনতীয়ানা আর কষ্টের জন্য বহু টাকা দেবো আপনাকে।’

কৃষ্ণা মতলব বুঝলো, দৃঢ়কণ্ঠে বললে, ‘আপনি ভুল বুঝেছেন, বাঙালীকে আপনি চেনেন না! বাঙালী নিমকহারাম নয়, জানবেন! যে-লোক আমার প্রাণ রক্ষা করেছেন, তার কাছে আমি আজীবন ঋণী। যাতে তার ভাল হয়, তা করবো। টাকার লোভ দেখাবেন না। টাকার লোভে রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাজ করতে আসিনি, কৃতজ্ঞতার খাতিরে এসেছি। আপনার হাতে পড়েছি, মনে করলে আমায় চিরকাল আটকে রাখতে পারেন-যেমন খুশী নিগ্রহ করতে পারেন! বাধ্য হয়ে আমাকে সব সহ্য করতে হবে।’

চমৎকৃত হয়ে রাজা রাও তার পানে চাইলো। এ মেয়ের নাম সে শুনেছে! বহু জনশ্রুতি কানে এসেছে। চোখে দেখে মনে হলো, এ আগুনের শিখা। দাহিকা-শক্তি আছে এর! কৃষ্ণা তার নাম জানে, পরিচয় জানে-জেনেও এ বয়সের বাঙালী মেয়ে নির্ভয়ে এখানে এসেছে-মনে যেমন তেজ, তেমনি সাহস! আশ্চর্য্য!

উঁচু-নীচু পাহাড় উত্তীর্ণ হয়ে দুজনে এলো নীচে সমতল জমিতে-নীচে গ্রাম। সামনে একটা বাড়ী দেখিয়ে রাজা রাও বললে, ‘আমার কুঁড়ে। আপনাকে এখন এখানে থাকতে হবে। বন্দিনীভাবে নয়। যা চান-সঙ্গিনী পাবেন-বই-পিয়ানো-সব পাবেন। পাবেন না শুধু বদ্ধ-সীমানার বাইরে যেতে!’

কৃষ্ণা নির্ব্বাক-ভ্রূ কুঞ্চিত করলো।

এগারো

নির্জ্জন গৃহে কৃষ্ণা বন্দিনী!

সঙ্গিনী রমাবাঈ। বয়স পঞ্চাশের উপর। দিন-রাত সে এইখানে থাকে।

প্রকাণ্ড বাড়ী। এদিককার অংশে দু-খানি ঘর। ওদিকে আরও ঘর আছে দেখা যায়-মাঝখানকার দরজা বন্ধ-তাই ওধারের কোনো সন্ধান মেলে না।

সামনে উঁচু পাঁচিল-পাথর কেটে তৈরী। পাঁচিলের ওধারে কি আছে, কে জানে!

কৃষ্ণার ঘরের মাঝখানের দেয়ালে একটি দরজা। সে দরজা বন্ধ। ওদিকে চাবি দেওয়া আছে, মনে হয়! দরজা খোলা থাকলে ওদিকটা দেখা যেতো। কোনো লোক ওখানে থাকে কিনা, জানা যেতো।

কৃষ্ণার ঘরেই রমাবাঈ আলাদা খাটিয়ায় শোয়। পাশের ঘরটা বাথ-রুম হিসাবে ব্যবহার হয়!

সেদিন কোথা থেকে খান-কতক ইংরাজী বই সে কৃষ্ণাকে এনে দিয়েছে! কৃষ্ণার সঙ্গে কথাবার্ত্তা কয়ে জানতে পেরেছে, কৃষ্ণা ইংরাজী জানে। তার এই সদয় ব্যবহারে কৃষ্ণা বহু ধন্যবাদ দিয়েছে।

কিন্তু বই পড়তে ভালো লাগে না! বইয়ের পাতা খুলে সে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে।

রাজা রাও এখানে নেই। রমাবাঈয়ের কাছে কৃষ্ণা শুনেছে, রাজা রাও কোনো দিনই এখানে থাকে না। কখন কোথায় থাকে, কেউ জানে না!

রাজা রাওকে এরা দেবতার মতো শ্রদ্ধা-ভক্তি করে। রাজা রাওয়ের নাম বলতে উদ্দেশে নতি জানায়! রমাবাঈয়ের মুখে কৃষ্ণা শুনলো, রাজা রাও মন্দিরের সেবায়েত- বংশধর-মহাকালের মন্দিরের মালিকানা তারই। সেবায়েত-হিসাবে বংশ-পরম্পরায় এরা হাজার লোকের উপর প্রভুত্ব করে আসছে। রাজা রাওয়ের যে-কোনো আজ্ঞা-অন্যায় হলেও দেবতার আদেশ বলে এরা মানে!

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘কিছুদিন আগে রাজা রাও একখানা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, জীবন্ত মানুষের গায়ের ছাল তুলে ফেলেছে, এ সব তোমরা মেনে নিলে কি করে? এ কাজ অন্যায় হয়নি?’

সসম্ভ্রমে রমাবাঈ উত্তর দেয়, ‘আমাদের মনিব অন্যায় বা ভুল করতে পারেন না। কোনোদিনই তাঁর ভুল হয় না, বাঈ।’

এদের অন্ধ-বিশ্বাস দেখে কৃষ্ণা রাগ করবে কি হাসবে, ঠিক পায় না। রাজা রাওয়ের সব অন্যায়ই এরা ন্যায় বলে মেনে নেবে? শ্রদ্ধা-ভক্তি এতটুকু তাতে ক্ষুণ্ণ হবে না?

মহাকালের সম্বন্ধে অনেক গল্প কৃষ্ণা শুনলো-রাজেন্দ্রপ্রসাদের মুখে এ-সব শোনেনি।

মঙ্গল-চক্র বহু যুগ-যুগান্তর ধরে মহাকাল শিবলিঙ্গের মাথায় ছিল। এই মঙ্গল-চক্র থাকার জন্যই মহাকালের খ্যাতি দেশ-বিদেশে প্রসার লাভ করেছে। প্রধান সেবায়েত রাজা রাও এখানে প্রায় থাকেন না, তাঁর নিযুক্ত পুরোহিত নিত্য পূজা করেন।

কিছুদিন আগে হঠাৎ মহাকালের মাথার মঙ্গল-চক্র খোয়া যায়-সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত রঘুয়াও অন্তর্দ্ধান। কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। রাজা রাও রাগে আগুন হলেন। তাঁর হুকুমে কত লোক ছুটলো দিক-দিগন্তে তার সন্ধানে।

রঘুয়াকে পাওয়া গেল কিছুকাল পরে। বিহারের গোরখপুর জেলায় সে লুকিয়ে ছিল। রাজা রাওয়ের চরেরা সেখান থেকে তাকে এখানে নিয়ে আসে। তার মুখে জানা গেল প্রচুর টাকার লোভ দেখিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ মহাকালের মঙ্গল-চক্র তাকে দিয়ে সরিয়েছেন!’

‘রাজেন্দ্রপ্রসাদ!’

কৃষ্ণার বিশ্বাস হয় না! সঙ্গে সঙ্গে রাজেন্দ্রপ্রসাদের কথা মনে ভেসে ওঠে! তিনি বলেছিলেন, একজন লোক তাঁর মোটরে এই চক্র ফেলে দিয়ে ছুটে পালায়! তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন বলে মনে হয় না!

রমাবাঈ দৃঢ়কণ্ঠে বললে, ‘হ্যাঁ বাঈ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এ-চক্রের কথা জানেন। তিনি এক সাধুর কাছে শুনেছিলেন-এ-চক্র যার কাছে থাকবে, সে কোটি-কোটি টাকার মালিক হবে, তার কোনো অমঙ্গল হবে না। মঙ্গল-চক্র তাঁকে দিয়ে রঘুয়া টাকা-কড়ি নিয়ে কিছুকালের মতো দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিল। ভেবেছিল, কিছুদিন কাটলে মনিব পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, তখন নিশ্চিন্ত হয়ে সে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতে পারবে। রাজেন্দ্রপ্রসাদও মনিবকে পুলিশের হাতে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু আমাদের মনিবের ক্ষতি একটা রাজেন্দ্রপ্রসাদ কেন-অমন একশো রাজেন্দ্রপ্রসাদ কিছু করতে পারবে না!’

কথা শেষ করে রমাবাঈ সগর্ব্বে কৃষ্ণার পানে তাকালো।

কৃষ্ণার মনের সন্দেহ তবু যায় না! সে জিজ্ঞাসা করলে, ‘রঘুয়ার কি ব্যবস্থা হলো?’

রমাবাঈ হাসলো। বললে, ‘তার যা হয়েছে, বুঝতেই পারছেন বাঈ! মনিব এমনিতে থাকেন মহাদেবের মতো, কিন্তু রাগ হলে নিস্তার নেই! শুধু রঘুয়া নয়, রঘুয়ার বংশে তিনি কাকেও আর রাখেননি।’

কৃষ্ণার সর্ব্বাঙ্গ কণ্টকিত হয়ে উঠলো।

রমাবাঈ বললে, ‘একখানা গাঁ মনিব এমন জ্বালিয়ে দিয়েছেন, সে গাঁয়ে একটি মানুষ নেই! কেন, জানেন? সে গাঁয়ের লোকেরা বেইমানী করেছিল, মনিবকে ধরিয়ে দেবার জন্য পুলিশ এনেছিল। সেই পাপে তাদের গাঁ গেল! পুলিশের লোকরাও মরলো।’

বিবর্ণ মুখে কৃষ্ণা বললে, ‘আমার সঙ্গে যে দু’জন পুলিশের লোক ছিলেন, তাঁদের কি হলো, জানো?’

রমাবাঈ বললে, ‘আমি জানি না বাঈ। যেদিন বিচার হবে, জানতে পারবেন। আমাদের মনিব বিনা-বিচারে কাকেও সাজা দেন না। ছোট-মন তাঁর নয়। রাজেন্দ্রপ্রসাদকেও যদি হাতে পান, বিনা-বিচারে তাকে সাজা দেবেন না!’

কৃষ্ণা নির্ব্বাক!

বারো

আকাশ সে-দিন রণরঙ্গে সেজে নিবিড় কালো মেঘের পোষাক পরেছে-মাঝে মাঝে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।

বৃষ্টি তখন একটু থেমেছে!

পাশের খাটিয়ায় রমাবাঈ ঘুমোচ্ছে। কৃষ্ণার চোখে ঘুম নেই।

আজ যা হয়, কিছু সে করবে। এমন দুৰ্য্যাগের রাত-হয়তো শীঘ্র আর আসবে না! আজই রমাবাঈয়ের কাছে শুনেছে, রাজা রাও কাল সকালে আসবে, এসে বন্দীদের ব্যবস্থা করবে।

নিঃশব্দে কৃষ্ণা বিছানায় পড়েছিল। গজ-গজ করতে করতে রমাবাঈ ঘুমিয়ে পড়েছে।

কৃষ্ণা আস্তে আস্তে উঠে বসলো!

পাশ ফিরে ঘুমোচ্ছে রমাবাঈ-তার নাক ডাকছে। কৃষ্ণা খাটিয়া থেকে নেমে দাঁড়ালো।

বুক কাঁপছে। যদি ধরা পড়ে, কি ব্যবস্থা হবে, জানে! ভালোভাবেই জানে! রাজা রাও এই বিদেশী মেয়েটির কাছে ছোট হতে চায় না হয়তো! বন্দিনী হলেও তাকে ভালো ঘর দিয়েছে। রমাবাঈকে দিয়েছে। ভালো খাবার, এমন কি, বই পড়বার ব্যবস্থা করেছে।

পালাতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে, তাহলে ব্যবস্থা যা হবে, জানা কথা!

ঘরের মধ্যে যে দরজা, সে দরজার ওদিকে কে এসেছে! নিশ্চয় বন্দী। কৃষ্ণা আজ তার সাড়া পেয়েছে।

রমাবাঈ দুপুরে ছিল না, তার কি কাজে ঘণ্টা দুইয়ের মতো নিজের বাড়ীতে গিয়েছিল-কৃষ্ণার ঘরে চাবি বন্ধ করে। তাতে হেসে কৃষ্ণা বলেছিল, ‘তুমি ভাবো, আমি পালাবো? উঁচু পাঁচিল পার হয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়!’

রমাবাঈ উত্তর দিয়েছিল, ‘মনিবের হুকুম শুনতে হবে বাঈ! তাঁর হুকুম-মতো আমি চাবি দিয়ে যাচ্ছি।’

ঘরে কৃষ্ণা তখন একা!

বইগুলো পড়া শেষ হয়ে গেছে। নূতন বই আর নেই!

কৃষ্ণা জানলার কাছে দাঁড়ালো। জানলা দিয়ে বাড়ীর বাইরে কি আছে, তা দেখবার বা জানবার উপায় নেই!

সে ফিরে এলো সেই বন্ধ দরজার পাশে। দরজায় দু-চারবার ঘা দিয়ে দিয়ে কান পাতে। ওধার থেকে শব্দ পাওয়া গেল।

দুটো কপাটের মাঝখানে মুখ রেখে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘কে? কথা বলুন। নাম?’

ওধার থেকে আওয়াজ এলো-‘আপনি কৃষ্ণা দেবী, না?’

রামস্বামীর কণ্ঠ! চমৎকৃত হয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ, কৃষ্ণা। আপনি রামস্বামী?’

উত্তর আসে, ‘হ্যাঁ, রামস্বামী। এরা কাল রাত্রে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এ ক’দিন আমাকে অন্য জায়গায় রেখেছিল। কাল রাত্রে এখানে এসেছি। আপনি আমার পাশের ঘরে আছেন, জানতে পারিনি। আপনি বরাবর এইখানেই আছেন?’

নিশ্বাস-ফেলে কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ। চেষ্টায় আছি, কোনোরকমে যদি পালাতে পারি! কাল রাজা রাও আসবে। আমাদের বিচার হবে। সে বিচারে কি হবে, বুঝতেই পারছেন! তাই আজই যেমন করে হোক, পালানো চাই। উপায় আমি ঠিক করবো। আপনাকে পেয়ে আমার মনে ভরসা হচ্ছে।’

সত্যই তাই! দুর্গাকৃতি দুর্গম বাড়ী থেকে বেরিয়ে রাজা রাওয়ের গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে-এইটুকুই শুধু জানে! পথ চেনে না! কোথা থেকে কোথায় যাবে, আবার রাজা রাওয়ের হাতে পড়তে হবে-এই ভয়! রামস্বামী এ-অঞ্চলে বহুকাল আছেন, পথ-ঘাট তাঁর জানা। কৃষ্ণা কোনোরকমে তাঁকে খালাস করতে পারে যদি-দু’জনেই যাবে-নিশ্চিন্ত হবে অনেকখানি!

সদাশিব রাওয়ের কথা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে থেমে গেল, পাশের ঘরে অন্য লোকের কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়। বোধ হয়, কেউ এসেছে বন্দীর পাহারাদারি করতে!

সারাদিনটা দারুণ উৎকণ্ঠায় কাটলো। রমাবাঈয়ের ঘুমোবার ওয়াস্তা! কৃষ্ণা আজ ক’দিন লক্ষ্য করেছে, রমাবাঈয়ের কাছে থাকে চাবির গোছা! সেটা লুকিয়ে রাখে-কৃষ্ণা না দেখতে পায়! ও-গোছায় পাশের ঘরের চাবি মিলবে, নিশ্চয়!

সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি হয়ে আকাশ এখন পরিষ্কার। জানলা দিয়ে আকাশে চাঁদ দেখে কৃষ্ণা বুঝলো, একাদশী বা দ্বাদশী তিথি।

আস্তে আস্তে খাটিয়া থেকে কৃষ্ণা নামলো।

রমাবাঈয়ের বিছানার পাশে দাঁড়ালো এক-মিনিট,-তারপর অকস্মাৎ দু-হাতে রমাবাঈয়ের কণ্ঠ চেপে ধরলো।

রমাবাঈয়ের ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে! কৃষ্ণার অতর্কিত অক্রমণে সে বিপর্য্যস্ত! শীর্ণ দুর্ব্বল হাতে কৃষ্ণার বজ্রমুষ্টি শিথিল করে মুক্তিলাভের প্রয়াস-সে- প্রয়াস ব্যর্থ হলো!

প্রাণপণ-শক্তিতে কৃষ্ণা আরও জোরে চেপে ধরে ওর গলা। বৃদ্ধা রমাবাঈ চেতনা হারায়!

রমাবাঈ বিছানার উপর লুটিয়ে পড়লো।

কৃষ্ণা তার কণ্ঠ ছেড়ে দিলে! না, রমাবাঈয়ের চেতনা নেই!

ক্ষিপ্র হস্তে রমাবাঈয়ের কাপড়খানা খুলে নিয়ে নিজে পরে, নিজের কাপড় রমাবাঈয়ের দেহে চাপিয়ে জড়িয়ে দিলে। রমাবাঈয়ের বালিশের পাশে চাবির গোছা-বড় একটা টচ্চর্চ-দুটোই কৃষ্ণা হাতে নিলে।

তারপর ক্ষিপ্রহস্তে মাঝের দরজার তালা দুটিতে চাবি লাগায়-শিকলে-লাগানো তালাটা খুলে যায়! কড়ায়-লাগানো তালা কিন্তু খুলতে চায় না!

কৃষ্ণা অধীর হয়ে ওঠে।

তালার মধ্য দিয়ে একটা চাবি জোর করে চাড় দিতে তালাটা খুলে গেল। ধাক্কা দিয়ে রুদ্ধ দ্বার খুলে ফেললো! টচ্চের্চর আলো ফেলে দেখে, একপাশে কতকগুলো বিচালির উপর রামস্বামী গভীর নিদ্রায় অচেতন।

‘রামস্বামী, রামস্বামী-‘ জোরে ঠেলা।

রামস্বামীর ঘুম ভাঙ্গে না!

আরো জোরে ধাক্কা-‘উঠুন, উঠুন।’

ধড়মন করে রামস্বামী উঠে বসেন। ঘুম চোখে বুঝতে পারেন না, কি হয়েছে! দু-হাতে চোখ রগড়ে তাকান!

কৃষ্ণা আবার ধাক্কা দেয়-‘শীগগির-উঠে পড়ুন-‘

এতক্ষণে রামস্বামীর চেতনা হলো। তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

কৃষ্ণা আগে, পিছনে রামস্বামী।

কৃষ্ণা নিজের ঘরের দরজা খুললো! দরজায় পাহারা থাকে না-সে জানে, রামস্বামীর ঘরের দরজা অন্যদিকে-সে-দরজায় পাহারা আছে হয়তো!

নিঃশব্দে দু’জনে নীচে নামলো। প্রকাণ্ড গেটের সামনে রক্ষী-এ-পথে নয়!

রামস্বামী চুপি চুপি বললেন, ‘আমি পাঁচিল টোপকে যেতে পারবো-আমার জন্য ভাবতে হবে না। আপনি কি করে বেরুবেন?’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনি পাঁচিলে উঠুন। আমার সম্বন্ধে আমি যা করবো, দেখতে পাবেন।’

রামস্বামী পাথরের তৈরী উঁচু পাঁচিলে ওঠবার চেষ্টা করলেন ক’বার-পারলেন না উঠতে। যতবার উঠতে যান, খাড়া পাথরে পা রাখবার মতো কিছু পান না!

এদিক-ওদিক ঘুরে এক-জায়গায় অতিকষ্টে তিনি পাঁচিলে উঠলেন-উঠে ওদিকে লাফিয়ে পড়ে দেখেন, কৃষ্ণা তাঁর আগে নেমেছে।

রামস্বামী বললেন, ‘আমার পিছনে আসুন। আমি এদিককার পথ না চিনলেও যেমন করে হোক জব্বলপুরের পথ খুঁজে বার করবো।’

কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু এদের গ্রামের ভিতর দিয়ে যেতে হবে তো-যে পথ দিয়ে এসেছি।’

রামস্বামী বললেন, ‘না, ওপথে যাবো না, অন্য পথে ঘুরে যাবো। আপনি আসুন।’

তেরো

ভোরের আকাশে আলো ফুটে পাহাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়েছে।

কৃষ্ণা বসে পড়েছে, চলবার সামর্থ্য নেই আর! পিছনে পর্ব্বতশ্রেণী-সামনে সমতল ভূমি…চাষের ক্ষেত।

রামস্বামীও বসে পড়েছেন। তিনিও অত্যন্ত ক্লান্ত।

কৃষ্ণার পায়ে জুতা নেই-পা ক্ষত-বিক্ষত। আসবার সময় জুতা পায়ে দেয়নি, পাছে শব্দ হয়! রামস্বামীর পায়ে একপাটি জুতা ঠিক আছে-অন্য পাটি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। জুতা তিনি খুলে ফেলেছিলেন-দেখে কৃষ্ণা বললে, ‘খুললে এর পর আর হাঁটতে পারবেন না। আমার পায়ের অবস্থা দেখুন!’

রামস্বামী বললেন, ‘কিন্তু এ জুতা পায়ে দিয়ে হাঁটা যাবে না! তলাটা একেবারে খসে গেছে! এর চেয়ে খালি-পায়ে হাঁটা ভালো! পায়ের তলায় একটু লাগলেও চলা আটকাবে না!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আর কত দূর গেলে গ্রাম পাবো?’

রামস্বামী বললেন, ‘জায়গাটা ঠিক করতে পারছি না! মনে হচ্ছে, এই পাহাড়টা পার হলেই ওদিকে পথ পাওয়া যাবে। হয়তো দু-একজন লোককেও দেখতে পাবো! জিজ্ঞাসা করলে পথের সন্ধান মিলবে।…রাও যদি থাকতেন!’

তিনি নিশ্বাস ফেললেন!

ব্যগ্র কণ্ঠে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘হ্যাঁ, ও কথাটা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেছি! রাওকেও তো বন্দী করা হয়েছিল। তাঁকে এখানে আনা হয়নি-আপনাকে শুধু নিয়ে এলো-এর কারণ?’

রামস্বামীর মুখে-চোখে বেদনার ছায়া যেন! নিশ্বাস ফেলে রামস্বামী বললেন, ‘যেদিন আমাদের ধরে, সেই দিনই রাজা রাও তাঁকে মেরে ফেলেছে!’

‘মেরে ফেলেছে!’ কৃষ্ণা চমকে উঠলো! তার সর্ব্বাঙ্গে রোমাঞ্চ-দু-চোখ যেন ছিটকে পড়বে!

রামস্বামী বললেন, ‘সেদিনকার কাহিনী-

কৃষ্ণাকে নিয়ে পূজারী চলেছিল এক গুহার পাশ দিয়ে…এমন সময় ক’জন লোক হঠাৎ তাঁদের উপর লাফিয়ে পড়ে। খুব অতর্কিত আক্রমণ! সদাশিব আর রামস্বামী হতভম্ব! রামস্বামীর আগেই সদাশিব রাও তাঁর রিভলভার নিয়ে গুলি করতে যান, কিন্তু রিভলভারে গুলি ছিল না-তাই ব্যর্থ হয়ে সদাশিব রিভলভারের ঘা মেরে যথাসম্ভব আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। দলের দু’জনকে রীতিমতো ঘায়েল করেন। কিন্তু উনি একা-নিরস্ত্র-ওরা দলে পুরু-তার উপর হাতে ছোরা-সেই ছোরার অবিরাম ঘা! সদাশিবের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়লো! রক্তে রক্ত একেবারে! ওরা তাঁর সে দেহটাকে ধরাধরি করে গুহার মধ্যে ফেলে দেয়। রামস্বামী চুপচাপ ছিলেন-তাই তাঁকে না মেরে ওরা বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে একটা বাড়ীর অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে রাখে। গতকাল রাত্রে সেখান থেকে ও বাড়ীতে নিয়ে আসে।

বেচারা সদাশিব রাও!

কৃষ্ণা নিশ্বাস ফেলে কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।

রামস্বামী বললেন, ‘কিন্তু এখানে বসে থাকা উচিত নয়, ওরা ভোরেই জানতে পারবে আমরা পালিয়েছি! সঙ্গে সঙ্গে সন্ধানে বেরুবে। সারারাত হেঁটে ঘুরে আমরা যেখানে এসেছি, ওদের ঐ পাহাড়ে হয়তো এমন পথ আছে, যে পথ ধরে চট করে এখানে এসে পৌঁছুতে পারে! আমাদের ধরতে পারলে সাজা যা দেবে-সে সাজার কল্পনা আমরা করতে পারবো না! যত কষ্টই হোক, চলতে হবে-যতক্ষণ না নিরাপদ জায়গায় পৌঁছুই!’

কৃষ্ণা উঠলো। আবার চলা সুরু। পা চলে না, টেনে টেনে তবু চলা।

ক্ষেত পার হতে আধঘণ্টার উপর সময় লাগলো। অপরিসর পথ। রামস্বামী আগে আগে চলেছেন, কৃষ্ণা তাঁর পিছনে।

চলতে চলতে পিছনে তাকালো কৃষ্ণা! পরে হঠাৎ বলে উঠলো, ‘বসে পড়ুন…বসে পড়ুন।’

সঙ্গে সঙ্গে সে বসে পড়ে। রামস্বামীও বসে পড়েন।

দূরে পাহাড়ের উপর বহু লোক-তাদের হাতে নানা রকম অস্ত্র…এদিকে না নেমে তারা নামলো ওদিকটায়। রাজা রাওয়ের দলের লোক, নিশ্চয়! সন্ধানে বেরিয়েছে তাতে এতটুকু সন্দেহ নেই!

কান পেতে চলে কৃষ্ণা। মনে হয়, দূরে যেন মোটরের শব্দ!

চাপা গলায় সে বললে, ‘হয়তো পথের কাছে এসেছি। মোটরের শব্দ শুনছি! রাজা রাওয়ের আজ সকালে ফেরবার কথা। সে আসছে কিনা, কে জানে! তবু চলুন…আরো এগিয়ে…রাজা রাওয়ের মোটর না হলে হয়তো সাহায্য মিলবে।’

ক্ষেতের উপর দিয়ে চলা। কৃষ্ণা আগে, পিছনে রামস্বামী।

ও-পাশে পথ। ক্ষেতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা মোটরখানা লক্ষ্য করে। বিপদ বুঝলে বসে পড়বে-না হলে মোটর থামাবার সঙ্কেত!

পাহাড়ের বাঁক ঘুরে পথে এলো পুলিশের একখানা ট্রাক।

কৃষ্ণা সানন্দে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এগিয়ে আসুন! পুলিশের ট্রাক।’

পায়ে বেদনা-গ্রাহ্য নেই! পথে এসে দাঁড়ালো কৃষ্ণা-দু’খানা হাত প্রসারিত করে! রামস্বামীও এসে পড়েছেন।

পুলিশ-ভর্ত্তি ট্রাক সামনে এসে থামলো-মিষ্টার রামস্বামী?

ট্রাক থেকে লাফ দিয়ে নামেন, দু’জন পুলিশ-অফিসার! রামস্বামীর হাত দু’খানা চেপে ধরেন-বলেন, ‘আপনি এখানে! এমন ভাবে! আমরা আপনাকে আর সদাশিব রাওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

কৃষ্ণাকে ডাকলেন রামস্বামী-‘আসুন, কৃষ্ণা দেবী, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই! ইনি আমার সিনিয়র অফিসার মুদালিয়র আর ইনি বাংলার বিখ্যাত ডিটেকটিভ কৃষ্ণা দেবী-আমায় মুক্ত করে এনেছেন রাজা রাওয়ের গারদ থেকে।’

মিষ্টার মুদালিয়র এবং কৃষ্ণা পরস্পরে অভিবাদন।

ট্রাকের কনষ্টেবলরা কৃষ্ণা ও রামস্বামীকে ট্রাকে তুলে নিলে।

শান্তির নিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণা। এতক্ষণে আশা হলো রায়পুরে পৌঁছুতে পারবে! মামার জন্য দুশ্চিন্তার সীমা নেই! তিনি ফিরেছেন কিনা-ফিরলেও কি অবস্থায় আছেন, কে জানে!

পথে ট্রাক চলেছে বেশ জোরে, পাশ দিয়ে একখানা মোটর গেল সাঁ করে তীরের বেগে বেরিয়ে। মোটরে যে লোকটিকে কৃষ্ণা দেখলো, রাজা রাও ছাড়া সে আর কেউ নয়!

চেঁচিয়ে ওঠে কৃষ্ণা-‘রাজা রাও ফিরেছে! পুলিশের গাড়ীতে আমাদের দেখে গেল।’

‘রাজা রাও!’

মুদালিয়র চীৎকার করে ওঠেন-‘রোখো…রোখো-‘

ট্রাক থামলো। রাজা রাওয়ের মোটরততক্ষণে বহুদূর পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয়েছে।

পুলিশের ট্রাক আবার আপন পথে পাড়ি সুরু করলো।

চৌদ্দ

জব্বলপুর পর্য্যন্ত ট্রাকে এসে কৃষ্ণা ট্রেণে চড়ে রায়পুর ফেরবার প্রস্তাব করলে।

মুদালিয়র বললেন, ‘না, ট্রেণে যাওয়া হবে না। দু-চার দিন এখানে বিশ্রাম। আপনার পায়ের আর দেহের যে-অবস্থা, তাতে দু-একদিন আপনার এখানে বিশ্রাম করা দরকার।’

সে কথা সত্য! কৃষ্ণা বললে, ‘এখানে দু-একদিন থাকতে পারবো। কিন্তু রায়পুরে রাজেন্দ্রপ্রসাদের ওখান থেকে খবর আনিয়ে দিতে হবে-আমার মামা প্রণবেশবাবু ফিরেছেন কিনা! যদি ফিরে থাকেন তাঁকে জানানো দরকার, আমি এখানে আপনাদের কাছে আছি।’

মুদালিয়র বললেন, ‘নিশ্চয় এখনই ফোন করবো। ওখানে পুলিশ-অফিসে ফোন করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আপনাকে সব খবর জানাবো।’

তখনই তিনি রায়পুর-পুলিশকে ফোন করলেন-কৃষ্ণার কথামতো।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খবর পাওয়া গেল, প্রণবেশ রায়পুরে ফিরেছেন। তাঁকে আর রাজেন্দ্রপ্রসাদকে কৃষ্ণা দেবীর কথা জানানো হয়েছে…তাঁরা ট্রেণে করে জব্বলপুরে আসছেন।

রামস্বামীর সম্বন্ধে কৃষ্ণা খবর শুনলো-পুলিশ-ব্যারাকে তিনি শয্যাগত। কোনো রকমে ট্রাক থেকে নেমে সেই যে শুয়েছেন, ওঠবার সামর্থ্য নেই আর তাঁর!

দুপুরের দিকে মুদালিয়রের লোক এসে একখানা চিঠি দিলে কৃষ্ণাকে।

খামে ইংরাজীতে কৃষ্ণার নাম লেখা।

সবেমাত্র কাল কৃষ্ণা এখানে এসেছে। এখানে কেউ তাকে চেনে না। এর মধ্যে চিঠি দিলে কে? কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হলো!

চিঠি খুলে কৃষ্ণা দেখে রাজা রাওয়ের চিঠি! রাজা রাও লিখেছে! কৃষ্ণা একেবারে যেন পাথর!

বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে কৃষ্ণা চিঠি পড়লো।

রাজা রাও লিখেছে-

বিশেষ কারণে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছি। আপনি এটুকু বিশ্বাস করতে পারেন, রাও নিষ্ঠুর ডাকাত এবং তাকে জীবন্ত ধরবার জন্য গভর্ণমেণ্ট মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, তবু তার এটুকু মনুষ্যত্ব আছে যে-কোনো মেয়ের উপর সে অত্যাচার করে না। ইচ্ছা করলে আপনার উপর পীড়ন করতে পারতুম-করিনি, তার কারণ আপনি শত্রু নন! তবু আপনাকে কষ্ট পেতে হয়েছে! সে আপনার স্বেচ্ছায় পাওয়া! আপনাকে সব কথা জানাবো মনে করেওে সময়াভাবে তা পারিনি। আপনাকে ওখানে রেখে সেই দিনই আমায় বম্বে যেতে হয়। ফেরবার সময় আপনাকে পুলিশের ট্রাকে দেখে বুঝতে পাচ্ছি-আপনি বন্দিনী হয়ে থাকবার মেয়ে নন! রমাবাঈকে মূর্চ্ছিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি এবং দারোগা রামস্বামীকেও আপনি নিয়ে গেছেন, বুঝলুম।

আপনার সঙ্গে দেখা করবো আজই-সন্ধ্যায়। রাজেন্দ্রপ্রসাদ এসে পৌঁছুবার আগে আপনাকে সব কথা যাতে বলতে পারি, সে-ব্যবস্থা আপনি করবেন। পুলিশের সাহায্য নেবেন না! পুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না! সে-ব্যবস্থা করলে মিথ্যা আপনি বিপন্ন হবেন এ-কথা বলে রাখছি।

রাজা রাও

চিঠি পড়ে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য! এর মধ্যে রাজা রাও জেনেছে মুদালিয়রকে দিয়ে রায়পুরে কৃষ্ণা খবর পাঠিয়েছে এবং সে-খবর পেয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ এখানে আসছেন!

ওর জানা আশ্চর্য্য নয়! সব দিকেই ওর লোক আছে, কৃষ্ণা জানে। কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম করবার সঙ্গে সঙ্গে রাজা রাও সে-খবর পেয়েছিল এবং ট্রেণ থেকেই তাকে সরাবার চেষ্টা করেছিল! পুলিশেও তার লোক আছে নিশ্চয়! সে-সব লোকের কাছে অনেক খবর পায়। ফোনেও লোক আছে, ফোনের খবর ওর কাছে ঠিক পৌঁছোয়!

কমিশনার মুদালিয়রের সুরক্ষিত গৃহে রাজা রাও আসবে, এ একেবারে ধারণাতীত! দুজনে ভক্ষক আর ভোজ্য সম্পর্ক! যে রাজা রাও সারা মধ্যপ্রদেশের বিভীষিকা-যাকে ধরবার জন্য গভর্ণমেণ্ট ব্যস্ত-পুলিশ সব সময়ে ওৎ পেতে আছে-সেই পুলিশের বড় অফিসারের সুরক্ষিত পুরীতে কি করে রাজা রাও আসবে, কৃষ্ণা ধারণা করতে পারে না।

চিঠিখানা বালিশের তলায় রাখলো। যে-ঘরে সে আছে, সাধারণতঃ, বৈঠকখানা- রূপে সেটা ব্যবহার হয়ে থাকে। বাড়ীর সামনে খানিকটা খোলা জায়গা-পাঁচিল ঘেরা-মাঝখানে ফটক। ফটকের সামনে অস্ত্রধারী দু’জন সেপাই সব সময়ে মোতায়েন আছে পাহারাদারির কাজে।

কৃষ্ণার পা দু’খানা ক্ষতবিক্ষত, ফুলে আছে বেশ! বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই! মুদালিয়রের কথামতো তাকে অনেক বই দেওয়া হয়েছে। তার একখানা পড়তে পড়তে কখন তন্দ্রা এসেছে!

দরজার পর্দ্দা সরিয়ে একজন লোক এলো ঘরে-এসেই সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মৃদু কণ্ঠে কৃষ্ণাকে ডাকলো।

কৃষ্ণার তন্দ্রা ভাঙ্গলো। চোখ মেলে সে তাকায়! লোকটিকে দেখে কৃষ্ণার দু’চোখ বিস্ফারিত! অস্ফুটে সে বলে উঠলো-‘রাজা রাও!’

রাজা রাওই…সাধারণ কনষ্টেবলের বেশে!

কৃষ্ণা ধড়মড় করে উঠতে যায়-পায়ে লাগে!

অভিবাদন করে রাজা রাও স্মিতমুখে বললে, ‘আপনার অবস্থা দেখে কষ্ট হচ্ছে। এ কষ্ট পেতে হতো না আমি যা বলেছিলুম যদি শুনতেন? আপনাকে আমি বাংলাদেশে পৌঁছে দিতুম!’

কৃষ্ণা নিষ্পলক নেত্রে তার পানে তাকিয়ে।

রাজা রাও বললে, ‘আপনাকে তারিফ করছি, কৃষ্ণা দেবী! আমার চিঠি আপনি মুদালিয়রকে দেখাননি, আমাকে ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থাও করাননি-শুধু তার জন্য নয়! আমার কথা শুনে বিপদ বুঝেও আপনি রাজেন্দ্রপ্রসাদকে ছেড়ে যাননি, এই জন্যই আপনার তারিফ করছি! তিনি যাই হোন আপনার শরণাগত। ভয়ে, প্রলোভনে কিছুতেই আপনি তাঁকে ত্যাগ করেননি! এতে বুঝছি, বড় উঁচু মন আপনার!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনি কি এই তারিফ জানাবার জন্যই এসেছেন?’

রাজা রাওয়ের মুখ রাঙা হলো! সে বললে, ‘রাজা রাও জীবনে কাকেও তারিফ জানাতে ছুটে আসে না! রাজেন্দ্রপ্রসাদের সম্বন্ধে আপনার ধারণা যে ভুল-সে ভুল আমি ভাঙ্গতে চাই! আর সেইজন্যই শত্রুপুরীতে এসেছি সাহস করে!’

চেয়ার দেখিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘বসুন। রমাবাঈয়ের মুখে আমি কিছু-কিছু যা শুনেছি, আপনিও সেই কথা বলবেন, বুঝি! কিন্তু রাজেন্দ্রপ্রসাদ যা বলেছেন-‘

রাজা রাও বললে, ‘থামুন! ও লোকটার দিক নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। আপনি জানেন না, আমার হাত থেকে বাঁচবার জন্য কি না ও করেছে! এই মঙ্গল-চক্র সম্বন্ধে আমি যদি প্রমাণ দিই, সে-চক্র রাজেন্দ্রপ্রসাদের কাছে আছে, আপনি বিশ্বাস করবেন?’

কৃষ্ণা একটু হাসলো, বললে, ‘না, বিশ্বাস করবো না। আমি তাঁর সঙ্গে মিশেছি, তাঁর কথা শুনেছি, তাঁকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি না। তিনি শুধু বিশিষ্ট ভদ্রলোক নন, বিখ্যাত কারবারী ধনী লোক। অহেতুক এ রকম কেন বলবেন? বাঙলাদেশ থেকে আমাকে কেন টেনে আনবেন? এখানকার পুলিশকে হয়রান করবেন…নিজে কেন উৎকণ্ঠিত ভাবে দিন কাটাবেন-এ কখনও সম্ভব? তারপর তাঁর শ্বশুরের অসুস্থতার খবর পেয়ে স্ত্রী-পুত্রকে নাগপুরে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে ট্রেণ থেকে হোক বা ষ্টেশন থেকে হোক, সরিয়েছেন! তাঁদের খুন করে থাকেন যদি, আশ্চর্য্য হবো না! কারণ মানুষ-খুন আপনি খেয়াল-খেলার মতো মনে করেন।’

রাজা রাও হেসে উঠলো, তারপর বললে, ‘আপনি বিশ্বাস করেন? আমি আগেই বলেছি, রাজা রাও যত নিষ্ঠুর কাজ করুক, আজ পর্য্যন্ত মেয়েদের উপর সে এতটুকু পীড়ন করেনি।’

কৃষ্ণা বললে, ‘তাই যদি, তবে একটা গ্রাম জ্বালিয়ে, সে গ্রামের সব পুরুষ মানুষের সঙ্গে মেয়েদের আর বাচ্চাগুলোকেও পুড়িয়ে মারলেন কি বলে?’

রাজা রাওয়ের মুখ কঠিন হলো। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সে বললে, ‘হ্যাঁ, এ-কথা বলতে পারেন। তবে আপনি ওইটুকুই জেনেছেন অর্থাৎ শুনেছেন! এ-কথা শোনেননি-রাজা রাও এ অন্যায় হুকুম দেয়নি! যারা দোষী, তাদেরই সাজার হুকুম সে দিয়েছিল! এ-কথা শোনেননি, মেয়েদের আর বাচ্চাদের উপর অত্যাচার করার দরুণ যারা দায়ী, রাজা রাও তাদের দিয়েছে চরমসাজা!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনার কথা বিশ্বাস করছি। কিন্তু এ-কথা বিশ্বাস করতে পারছিনে যে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ মঙ্গল-চক্র নিজে রেখেছেন, আর আমাদের মিথ্যা হয়রান করছেন।’

রাজা রাও বললেন, ‘বিশ্বাস করুন আর নাই করুন-আপনি যদি চেষ্টা করেন, দেখবেন, সে-মঙ্গল-চক্র রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজের কাছে রেখেছেন! তিনি যখন বাইরে-আমার লোক তাঁর বাড়ী আতিপাতি খুঁজেছে, বাড়ীতে সে-চক্র নেই! তাঁর স্ত্রী-পুত্রকেও তিনি নিজে লুকিয়ে রেখেছেন-আমি তার প্রমাণ দেবো।’

পনেরো

রাজা রাও অত্যন্ত সাহসী এবং বীর!

মহাবীর বাজী রাওয়ের বংশধর কেউ কখনো স্ত্রী বা শিশুর উপর অত্যাচার করেনি-এ কথা সে জোর করে বলে!

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে! রুদ্ধ-দ্বারে আঘাত।

রাজা রাওয়ের কথা শেষ হয়েছে। সে উঠে দাঁড়ালো।

‘আমি আসি। হয়তো চিরকালের মতো চলে যাচ্ছি। জীবনে বিরাগ হয়েছে। বোঝা বইতে আর ভালো লাগে না! ভালোভাবে যদি থাকতে পারতুম, আপনার মতো একটি মেয়ে যদি আমার পাশে থাকতো! কিন্তু তা সম্ভব নয়! যেদিন মহাকালের মন্দিরে আপনাকে দেখেছি, সেদিন থেকে কেবলই মনে হয়েছে, এ-কাজ ছেড়ে আপনাকে নিয়ে-‘

রুক্ষকণ্ঠে কৃষ্ণা চেঁচিয়ে উঠলো-‘থামুন, থামুন আপনি!’

রাজা রাও হাসলো। বললে, ‘কথাটা শেষ করতে দিন! যা হবার নয়, কোনোদিন যা হবে না, তা নিয়ে কেন চঞ্চল হচ্ছেন! হ্যাঁ, ঠিক এই উদ্দেশ্য নিয়েই আপনাকে যতদূর সম্ভব আরামে রেখেছিলুম! বন্দিনীর মতো রাখিনি! সেইদিনই হঠাৎ আমাকে বম্বে যেতে হলো। আমার এক লোক খবর দিয়েছিল তখনই রওনা হবার জন্য। ফিরেছি নিজের প্লেনে। এয়ারপোর্ট থেকে মোটরে আসবার পথে পুলিশের ট্রাকে আপনাকে দেখে বুঝেছিলুম, পাওয়ার আশা দুরাশা! কিন্তু যাক, আমি তাতে দুঃখ পেলেও ভেঙ্গে পড়িনি! আপনার সঙ্গে দেখা করার এমন দুঃসাহসও হয়তো আজ হতো না! দু-একদিনের মধ্যেই আমি চলে যাবো। যাবো আমেরিকায়-যেখানে কেউ আর আমার সন্ধান পাবে না! যতদূর সম্ভব দশজনের একজন হয়ে জীবন কাটাবো। আপনি জানেন না, আমার মা-বাপ, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র কেউ নেই! কাজেই কোনো বন্ধনও নেই!’

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘তবে কিসের জন্য আপনি ডাকাতি, লুঠ-পাট নর-হত্যা করেছেন? এ’ভাবে নর-হত্যা করতে আপনার কষ্ট হয় না?’

রাজা রাও হাসলো-বললে, ‘বীরের কাছে জীবন যা, মৃত্যুও তাই। ডাকাতি লুঠ-পাট করেছি নেশার বশে! আমার নিজের অর্থ যা আছে, তা প্রচুর! আমি চেয়েছিলুম দেশে আমরা একচ্ছত্র রাজ্য স্থাপন করবো, কিন্তু পরে বুঝেছি, তা সম্ভব নয়। আমারই দেশের লোক সামান্য ক-হাজার টাকা বখশিসের লোভে আমাকে সরকারের হাতে দিতে উদগ্রীব হয়েছে! আমার ঘৃণা ধরেছে কৃষ্ণা দেবী, মানুষের উপর-জীবনের উপর-সব কিছুর উপর! তাই চলে যেতে চাই! কিন্তু যাবার অগে আমার কুলদেবতা মহাকালের মঙ্গল-চক্র আমি পেতে চাই! হয়তো আজকের চেষ্টায় তা পাবো!’

‘আজকের চেষ্টায়!’

রাজা রাও বললে, ‘ভয় নেই, আপনার মামা নিরাপদে আসবেন! রাজেন্দ্রপ্রসাদকে আমার লোক হয়তো আটক করবে! আপনি-‘

দরজায় ধাক্কা! রাজা রাও উঠলো কথা শেষ না করে। শুধু বললে, ‘মুদালিয়র আসছেন নিশ্চয়! আমি আসি।’

উৎকণ্ঠিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণা! ‘কি করে যাবেন? তিনি যে দরজায় রয়েছেন! জানলা দিয়ে যাবার উপায় নেই! মোটা শক্ত রড।’

রাজা রাও নিজের পোষাক দেখিয়ে বলে, ‘এই পোষাক দেখে কেউ কিছু বলবে না। সামান্য কনষ্টেবল কেন আপনার ঘরে এসেছিল, তার কৈফিয়ৎ দেবার জন্য আপনি তৈরী থাকবেন।’

একটু হেসে অভিবাদন করে সে দরজা খুললো!

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুদালিয়র এবং প্রণবেশ।

কৃষ্ণার রুদ্ধ-দ্বার কক্ষ থেকে একজন কনষ্টেবলকে বেরুতে দেখে মুদালিয়র আশ্চর্য্য হলেন! কনষ্টেবল তাঁকে আর প্রণবেশকে সেলাম করে বিনীতভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

মূহূর্ত্ত স্তব্ধ থেকে মুদালিয়র ডাকলেন-‘আসুন প্রণবেশবাবু-‘

কৃষ্ণা তখন হাত বাড়িয়ে আলো জ্বেলে দিয়েছে।

‘কৃষ্ণা!’

আত্মবিস্মৃত প্রণবেশ আসেন কৃষ্ণার কাছে।

-‘মামা!’ কৃষ্ণার মুখে আর কথা নেই! তার দু’চোখ জলে ভরে ওঠে!

কৃষ্ণার হাত দু’খানা নিজের হাতে চেপে ধরে সজল চোখে প্রণবেশ তার পানে তাকান।

মাতুল-ভাগিনেয়ীর মিলনে মুদালিয়র বাধা দিলেন না। তিনি চুপ করে দাঁড়ালেন।

কৃষ্ণার মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে প্রণবেশ রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘আর দরকার নেই কৃষ্ণা! এবার কলকাতায় ফিরে যাই চল! পরের উপকার করতে গিয়ে এমন…এতে কারো লাভ বা মঙ্গল নেই! তোর এই অবস্থা! চেহারা যা হয়েছে, আয়না ধরে একবার দেখবি?’

কৃষ্ণা হাসলো-বললে, ‘আর তোমার চেহারা? তুমি তা দেখনি। অমন সুন্দর ভুঁড়ি কোথায় গেল? তোমায় দেখে চিনতে পারবে না কেউ! যাক, বসো। বসুন মিষ্টার মুদালিয়র।’

প্রণবেশ এবং মুদালিয়র দু-খানা চেয়ার টেনে বসলেন।

মুদালিয়র প্রশ্ন করলেন, ‘একজন কনষ্টেবলকে দরজা খুলে যেতে দেখলুম! লোকটাকে ঠিক চিনতে পারলুম না তো!’

কৃষ্ণা বললে, ‘ওকে নাকি আপনিই পাঠিয়েছিলেন! লোকটা এসেই দরজা ভেজিয়ে দিলে। কি তার দরকার ছিল, জানি না! আমি কেমন আছি, ডাক্তার ডাকতে হবে কি না-শুধু এই কথা জিজ্ঞাসা করলে।’

চিন্তিত মুখে মুদালিয়র বললেন, ‘কিন্তু আমি তো কাকেও পাঠাইনি! তা ছাড়া আমার সব কনষ্টেবলদের আমি চিনি! এ লোকটাকে কোনো দিন দেখেছি বলে মনে হয় না!’

সন্দিগ্ধভাবে প্রণবেশ বললেন, ‘লোকটাকে যেন মহাকালের মন্দিরে দেখেছিলুম! যে তোমাদের মন্দিরে নিয়ে গেল-তার মতো দেখতে না?’

কৃষ্ণা যেন মনে করবার চেষ্টা করে-‘ও! তাই কি? কিন্তু সে পূজারী তো রাজা রাও! সে কথা তুমি শোনোনি?’

‘রাজা রাও! না, শুনিনি তো!’

মুদালিয়র সচকিত এবং কণ্টকিত হলেন।

‘রাজা রাওয়ের এতখানি সাহস হবে, আমার বাড়ীতে আসবে? আপনার সঙ্গে কথা কয়ে গেল? তা যদি হয়, দেখলেন তো প্রণবেশবাবু, এ লোক তা হলে সব করতে পারে! এর অসাধ্য কাজ দুনিয়ায় নেই।’

হতাশ ভাবে তিনি ইজি-চেয়ারে হেলান দেন! তখনই আবার সোজা হয়ে উঠে টেবিলের উপর কলিং বেল বাজান। বাজাবার সঙ্গে সঙ্গে আর্দ্দালী এসে দাঁড়ালো।

মুদালিয়র বললেন, ‘রঘুনাথ! জরুরী-‘

নিমেষে সে অন্তর্হিত হলো।

মাথায় হাত বুলোতে-বুলোতে মুদালিয়র বললেন, ‘কি লজ্জা, আমার বাড়ীতে আমার ঘরে এলো রাজা রাও, আর আমার সামনে দিয়ে সে চলে গেল, তাকে ধরতে পারলুম না! এ লজ্জা রাখবো কোথায়?’

কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু রাজা রাওয়ের খোঁজ করলেই কি তাকে আর পাবেন মিষ্টার মুদালিয়র? এতক্ষণে সে কতদূরে গেছে-রাত্রের অন্ধকারে তাকে কি আর পাবেন?’

হেড-কনষ্টেবল রঘুনাথ এসে সেলাম করে দাঁড়ালো।

মুদালিয়র বললেন, ‘মিনিট দশ-বারো আগে বেশ লম্বা-চওড়া এক কনষ্টেবল আমার বাড়ীতে এসে চলে গেছে! তুমি তো বেলা পাঁচটা থেকে আমার গেটে ছিলে,-তাকে দেখেছো? সে কোনো পরিচয় দিয়ে এসেছিল?’

বিনীত কণ্ঠে রঘুনাথ বললে, ‘জানি হুজুর, আপনার সহি-করা কাগজ নিয়ে এসেছিল। বললে, জরুরী দরকার! কৃষ্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় যেন! সে কাগজে তাই লেখা ছিল! আপনার সহি-করা কাগজ।’

পকেট থেকে একখানা কাগজের শ্লিপ বার করে সে দিলে মুদালিয়রের হাতে।

সে-কাগজ দেখে মুদালিয়র স্তম্ভিত! তাঁরই হাতে লেখা-গেটপাশ!

বিনীত কণ্ঠে রঘুনাথ বললে, ‘খানিক আগে সে চলে গেছে। পথের ওদিকে একখানা মোটর ছিল। সেই মোটরে উঠে চলে গেল।’

একটু চুপ করে থাকেন মুদালিয়র…তারপর বলেন, ‘যাও, আর দরকার নেই।’

সেলাম করে রঘুনাথ চলে গেল।

প্রণবেশকে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ‘মিষ্টার রাজেন্দ্রপ্রসাদের আসবার কথা ছিল, তিনি এলেন না?’

প্রণবেশ বললেন, ‘বেরুবে, এমন সময় টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম পেয়ে তখনি তাঁকে কোথায় যেতে হলো। আমায় বার-বার বলে দিলেন, ফিরে যেন তাঁকে খবর দিই,-তিনি কাল সকালেই ফিরে আসবেন, বলেছেন।’

মুদালিয়র কি ভাবছিলেন-কৃষ্ণা বা প্রণবেশের কথায় কান দেননি। এতক্ষণে তাঁর হুঁশ হলো! প্রণবেশের কথা শুনে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমায় জানিয়েছেন তাঁকে রায়গড় যেতে হচ্ছে-এই মাত্র তাঁর টেলিগ্রাম পেয়েছি। কৃষ্ণা দেবী কেমন আছেন জানতে চেয়েছেন।’

কৃষ্ণা কেমন অন্যমনস্ক!

রাজা রাওয়ের কথা মনে হয়, রাজেন্দ্রপ্রসাদের হঠাৎ টেলিগ্রাম পাওয়া এবং রায়গড় যাওয়ার মূলে হয়তো রাজা রাওয়ের হাত আছে! কিন্তু এ কথা প্রকাশ করা চলে না!

মুদালিয়র উঠে পড়েন!

প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি উঠছেন। আমাদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা?’

কৃষ্ণাকে দেখিয়ে মুদালিয়র বললেন, ‘সেটা নির্ভর করছে এঁর উপর! একটু সুস্থ বোধ করলেই স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারবেন। এখন এ পা নিয়ে উনি হাঁটবেন কি করে, ভাবনার কথা!’

তিনি চলে গেলেন। আজ সকালে তাঁকে বেরুতে হয়েছিল, এই মাত্র ফিরেছেন।

প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওদিককার কথা মুদালিয়রের কাছে শুনলুম। রাজা রাওয়ের হঠাৎ তোর কাছে আসার কারণ বুঝতে পারলুম না কৃষ্ণা। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা যে! পুলিশ কমিশনার মুদালিয়রের বাড়ী…চব্বিশ ঘণ্টা যেখানে পুলিশ পাহারা! তার উপর আবার পুলিশের ছদ্মবেশে এসে হাজির। তাজ্জব ব্যাপার! এমন কি জরুরী কাজ?’

কৃষ্ণা হাসলো, বালিশের নীচে থেকে চিঠিখানা বের করে প্রণবেশের হাতে দিয়ে বললে, ‘এই চিঠিখানা আগে পড়ো মামা-তারপর তোমাকে সব বলছি। চিঠিখানা পড়ে আমি অবশ্য এ খবর কাকেও জানাইনি,-পুলিশকে জানানো মানে, বিপদ ডেকে আনা!’

‘বটেই তো!’

গম্ভীর ভাবে চিঠি পড়েন প্রণবেশ। তারপর মাথা হেলান-‘হুঁ! ছাতির জোর বটে! চিঠি পড়লেই বোঝা যায় মানুষটাকে! তারপর দেখা করে কি বললে?’

কৃষ্ণা বললে, ‘সে বলে, এ রাজেন্দ্রপ্রসাদের কারসাজি। শুনলুম বহুদিন থেকে মহাকালের মঙ্গল-চক্র হস্তগত করবার জন্য রাজেন্দ্রপ্রসাদ চেষ্টা করছিলেন। তার জন্য তাঁকে অজস্র অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এক ব্রাহ্মণকে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ পূজারীর কাজ করতে মহাকালের মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন। সেই পূজারী ও-চক্র চুরি করে এনে তাঁকে দেয়-পরে অবশ্য ধরা পড়ে। ধরা পড়ে চরম সাজা পেয়েছে! সে-চক্র নাকি রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজেই লুকিয়ে রেখে বাইরে রটিয়েছেন, চুরি গেছে! রাজা রাওকে ধাপ্পা দেবার মতলব! নিজের স্ত্রী-পুত্রকে তারপর রাজেন্দ্রপ্রসাদই নিজে সরিয়ে দিয়েছেন-পুলিশকে আর আমাদের জানিয়েছেন, রাজা রাও ওঁর স্ত্রী-পুত্রকে চুরি করেছে-তাঁর শ্বশুরও তাই জানেন।’

প্রণবেশ বিপুল বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন।

ষোল

ক’দিন পরের কথা…

কৃষ্ণা বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে, বেশ স্বচ্ছন্দ ভাবেই চলাফেরা করে।

রায়পুরে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে চিঠি লিখে জানিয়েছে, দু-চার দিনের মধ্যেই সে রায়পুরে ফিরবে; এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেনি, প্রণবেশ তাকে নিয়েই ফিরবেন!

তারপর বিদায়ের দিন। মুদালিয়রের কাছে বিদায় চাইলে তিনি বললেন, ‘আপনি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন-কিন্তু আরো দু-চার দিন এখানে থেকে গেলে ভালো হতো! মানে, সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বচ্ছন্দ হয়ে যেতেন!’

কৃষ্ণা হাত জোড় করে বললে, ‘আর নয় মিষ্টার মুদালিয়র, আপনার এখানে বারো-তেরো দিন আছি, রায়পুরে ক’দিন কেটেছে, কলকাতার বাড়ীতে কি হচ্ছে, জানি না! পরীক্ষাটা মাটি হয়ে গেল-আমাকে তৈরী হতে হবে তো!’

মুদালিয়র আর বাধা দিলেন না, শুধু বললেন, ‘রায়পুরে পৌঁছেই আমাকে একটা খবর দেবেন।’

কৃষ্ণার গার্ড-হিসাবে চারজন সশস্ত্র কনষ্টেবল তিনি সঙ্গে দিলেন। তাদের হুকুম দেওয়া রইলো-কৃষ্ণা যেখানেই যাক, সঙ্গে যাবে, এবং যা হুকুম করবে, শুনবে।

প্রণবেশ আর কৃষ্ণা রওনা হলেন…সঙ্গে সশস্ত্র চারজন রক্ষী।

বিলাসপুরে ট্রেণ থামলে কৃষ্ণা নামলো-প্রণবেশকেও নামতে হলো-সেই সঙ্গে রক্ষী চারজনকেও।

প্রণবেশ বেশ বিরক্ত হলেন। তিনি বললেন, ‘এখানে নামলে যে! আগে তো কিছু বলোনি!’

গম্ভীর মুখে কৃষ্ণা বললে, ‘তুমি চুপ করো তো। যা করি, শুধু দেখে যাও। ভয়ের কিছু নেই-সঙ্গে পুলিশ আছে।’

প্রণবেশ বললেন, ‘মহাকালের মন্দিরেও চারজন পুলিশ ছিল! তাদের মধ্যে কেউ রাজা রাওয়ের লোক ছিল না, তার প্রমাণ?’

কৃষ্ণা বললে, ‘প্রমাণ চাই না। আমাদের কাছে রিভলভার আছে-শুধু এদের ভরসাতে আসিনি! রায়পুর যাবার আগে একবার রায়গড় যাবো, সেখানে বিশেষ দরকার। আর সেখানে যাবো বলেই আমি কমিশনারের কাছ থেকে চারজন বিশ্বাসী লোক চেয়েছিলুম।’

-‘রায়গড়!’

প্রণবেশ আশ্চর্য্য হলেন! বললেন, ‘সেখানে তোমার কি দরকার? এই রায়গড় থেকে সেদিন রাজেন্দ্রপ্রসাদকে কে টেলিগ্রাম করেছিল-সেখানে তোমার আবার কি দরকার হলো, জানি না!’

রাগ করে তিনি মুখ ফেরালেন।

কৃষ্ণা তাঁর কথায় ভ্রূক্ষেপ করলে না। বম্বের ট্রেণ আসতেই ট্রেণের একটা কামরায় সে উঠে পড়লো, কনষ্টেবলরা উঠলো, প্রণবেশকেও উঠতে হলো।

এখান থেকে রায়গড় বেশী দূরে নয়।

প্রণবেশ ট্রেণে কথা বললেন না, অত্যন্ত রাগত ভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

রায়গড় ষ্টেশনে নেমে পড়লো কৃষ্ণা-সঙ্গীরাও নামলো। প্রণবেশকে দাঁড়াতে বলে কৃষ্ণা অগ্রসর হলো। টিকিট-চেকারকে সে ইংরাজীতে কি জিজ্ঞাসা করলো এবং সে কি জবাব দিলে-এ-কথাবার্ত্তা প্রণবেশ শুনতে পেলেন না!

ফিরে এসে কৃষ্ণা বললে, ‘এসো মামা! আশা হচ্ছে, সব রহস্য বোঝা যাবে। ঠিক জায়গায় এসেছি।’

প্রণবেশ হতাশ ভাবে বললেন, ‘ঠিক জায়গা হোক আর বেঠিক জায়গাই হোক, যা করবার করো, আমি কথাটি কবো না!’

গম্ভীর মুখে কৃষ্ণা বললে, ‘বেশ!’

আর বাক্যব্যয় না করে প্রণবেশ সঙ্গে চললেন!

পাহাড় জায়গা। উঁচু-নীচু পথ অতিক্রম করে কৃষ্ণা একটা বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো।

ছোট বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ী, লাল-টালির ছাউনি, সবুজ গাছ আর লতাপাতার মধ্যে চমৎকার দেখাচ্ছে।

কনষ্টেবল ক’জনকে দূরে প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকবার আদেশ দিয়ে কৃষ্ণা এসে দরজার কড়া নাড়লো।

ভিতর থেকে বিশুদ্ধ হিন্দীতে প্রশ্ন, ‘কে?’

কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ‘আমি রায়পুর থেকে আসছি।’

ভিতর থেকে দরজা খুললো।

প্রণবেশকে পিছনে থাকতে বলে কৃষ্ণা চৌকাঠে দাঁড়ালো। দরজার পাশে একটি মেয়ে-তাকে লক্ষ্য করে কৃষ্ণা বললে, ‘রাজেন্দ্রপ্রসাদ এসেছেন? কাল তাঁর আসবার কথা ছিল! আমাকে আজ এখানে আসবার কথা বলেছিলেন। তাই এসেছি।’

মেয়েটি বললে, ‘না। তিনি আসেননি। খবর দিয়েছেন, পুনা থেকে ফেরবার মুখে এখানে আসবেন।’

কৃষ্ণা কি বলতে যাচ্ছিল, ঘরের মধ্যে চাপা-কান্নার শব্দে সে-কথা বলা হলো না। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে কাঁদছে!’

মেয়েটি চোখ মুছে উত্তর দিলে, ‘আমার বোন। আজ পাঁচ দিন ওর ছেলেটি মারা গেছে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘সে-সময়…আচ্ছা, রাজেন্দ্রপ্রসাদবাবু এখানে ছিলেন?’

মেয়েটি মাথা নেড়ে আর্দ্রকণ্ঠে বললে, ‘অসুখের টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছিলেন। একটু নরম পড়লো দেখে চলে গেছেন। আজ-কালের মধ্যেই হয়তো আসবেন।’

বলতে-বলতে সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে-‘খেয়াল দেখুন, কোথাও কিছু নয়-আমাদের এখানে নিয়ে এলেন! ব্যবস্থা হলো, আমাদের এখন কিছুদিন এখানে থাকতে হবে! আমাদের না হয় থাকতে হলো! তাঁর বাচ্ছা? অমন বাড়ীতে তার জন্ম থেকে কাটছে, তাকে হঠাৎ এখানে নিয়ে এলেন! না পায় বাইরে যেতে-না পায় খেলা করতে! অসুখ হবে না?’

বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।

কৃষ্ণা তাকে সান্ত্বনা দেয়-‘কি করবেন, বলুন। সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই! তাঁর স্ত্রী! তিনি যেখানে যেমন ভাবে খুশী রাখবেন, বলবার কিছু নেই।’

চোখ মুছতে-মুছতে মেয়েটি বললে, ‘নেই কেন? নিশ্চয় আছে। আমাদের এতটুকু স্বাধীনতা নেই? বাইরে কারো সঙ্গে মেশবার উপায় নেই? বাড়ীর সামনে সব সময়ে দরোয়ান মোতায়েন! তার উপর কড়া হুকুম-যেন না বেরুই! এখন এক ঘণ্টার জন্য দরোয়ান কোথায় গেছে, আমাদের বলে গেছে, আমরা যেন বাইরে না বেরুই!’

কৃষ্ণা বললে, ‘এ-রকম ব্যবস্থা কেন-জেল-কয়েদীর মতন, আপনারা নিশ্চয় জানেন!’

‘না, আমরা জানি না।’

পাশের দরজা খুলে মেয়েটি বেরিয়ে এলো। তাকে দেখে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হলো! এ মেয়েটি রাজেন্দ্রপ্রসাদের স্ত্রী সন্ধ্যা! এর পরিচয় সে আগেই পেয়েছে, তাই চিনতে দেরী হলো না।

শান্তকণ্ঠে সে বললে, ‘আপনার বোন না জানতে পারেন, কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানেন! আপনার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও আপনি আমার অপরিচিত নন! আপনার আর আপনার স্বামীর সব পরিচয় আমি পেয়েছি, জেনেছি। আপনি আপনার স্বামীর যোগ্য সহধর্ম্মিণী। তার ছোট-বড় সব কাজের খবর আপনি রাখেন। এ কথা তো অস্বীকার করতে পারেন না!’

সন্ধ্যার মুখ বিবর্ণ, জোর করে হাসবার চেষ্টা করে সে বললে, ‘আপনি অনেক কিছু জানেন, আবার অনেক কিছু জানেন না! আমি বুঝেছি আপনি কৃষ্ণা দেবী, আমার স্বামীর অতিথি। ক’দিনে আপনি জেনেছেন তিনি সদাশয় লোক; ব্যবসায় উন্নতি করেছেন বুদ্ধিবলে, কাজেই তিনি বুদ্ধিমান। সৎ আর ধার্ম্মিক বলেই সহরের সব লোক তাঁকে জানে। আজ পর্য্যন্ত কেউ তাঁর সম্বন্ধে নিন্দার কোনো কথা বলতে পারেনি!’

‘সে কথা সত্য।’ কৃষ্ণা বললে, ‘এখন আমার কথা বলি। শুনলুম, আপনি ছেলে নিয়ে নাগপুরে যাচ্ছিলেন-পথে কে বা কারা আপনাদের নামিয়ে নেয়! অন্ততঃ আপনার স্বামী এ-কথা রাষ্ট্র করেছেন!’

‘আমার স্বামী?’

সন্ধ্যার মুখ কালো হয়ে আসে! সে কি বলতে যায়, মুখে কথা ফোটে না!

কৃষ্ণা বললে, ‘রাজেন্দ্রপ্রসাদবাবুর বিরুদ্ধে এখানকার পুলিশ অনেক প্রমাণ পেয়েছে। এমন প্রমাণ যে শীগগির হয়তো তাঁর নামে ওয়ারেণ্ট বেরুবে। ধরা পড়লে সাজা বড় কম হবে না! আবার যা শুনছি, ওঁর সম্বন্ধে এমন প্রমাণও নাকি মিলেছে যে তিনি চোরাই-মাল, আফিং-কোকেন…এ সবের কারবার করছেন! কাজেই-‘

সন্ধ্যা হাত জোড় করে বললে, ‘আমায় এ-সব কথা বলবেন না! তিনি আমার স্বামী-আমার পরম গুরু!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনার বোনের কাছে শুনছি, আপনারা এখানে বড় দুঃখ-কষ্টে কড়া পাহারার মধ্যে রয়েছেন! আমার সঙ্গে রায়পুরে যেতে চান? আমি সেখানে যাচ্ছি, আপনাকে তা হলে নিয়ে যেতে পারি।’

সন্ধ্যা বললে, ‘আমার স্বামী এসে যখন নিয়ে যাবেন, তখন যাবো। আপনি আর সে-কষ্ট নাই করলেন! আচ্ছা, নমস্কার, কিছু মনে করবেন না-আমি এখন বড্ড ক্লান্ত!’

কৃষ্ণাকে বিদায় দিতে চায়-বোঝা গেল! একটা নমস্কার করে কৃষ্ণা দরজার বাইরে এলো। আসার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

কনষ্টেবলদের মধ্যে দুজনকে ছদ্মবেশে সেখানে রেখে দূর থেকে বাড়ীটার উপর নজর রাখবার উপদেশ দিয়ে কৃষ্ণা ষ্টেশনের দিকে ফিরলো। পরের ট্রেণ আসবে আধ- ঘণ্টার মধ্যে।

প্রণবেশ রীতিমতো বিরক্ত! কৃষ্ণার মতলব বুঝতে পারেন না। কৃষ্ণা ফিরতে তিনি প্রশ্ন করলেন-‘কাজ হলো?’

কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ।’

‘কাজটা কি, শুনতে পাই না?’ প্রণবেশ রুক্ষকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন।

অন্যমনস্ক ভাবে কৃষ্ণা বললে, ‘সবই বলবো মামাবাবু, রায়পুরে গিয়ে বলবো। আমি পালাচ্ছি না, তুমিও পালাচ্ছো না!’

প্রণবেশ আরো চটলেন; কিন্তু রাগ প্রকাশ করলেন না!’

সতেরো

রায়পুরে রাজেন্দ্রপ্রসাদের বাড়ীতে ফিরে এলো কৃষ্ণা।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ সেই দিনই ফিরে এসেছেন, শোনা গেল। কৃষ্ণা এসেছে শুনে তিনি ভৃত্যকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠালেন। ভৃত্যের মুখে কৃষ্ণা শুনলো, রাজেন্দ্রপ্রসাদ অত্যন্ত অসুস্থ-ওঠবার সামর্থ্য নেই!

ভৃত্যের সঙ্গে কৃষ্ণা দোতলার ঘরে এলো, রাজেন্দ্রপ্রসাদ শুয়ে আছেন সেই ঘরে।

খাটের বিছানায় শুয়ে আছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। খাটের পাশে টেবিল। টেবিলের উপর ওষুধের একরাশ শিশি-ঘরে একজন নার্স-ফিডিং-কাপে করে নার্স তাঁকে কি পথ্য খাওয়াচ্ছে। কৃষ্ণা ঘরে ঢুকে একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো!

পথ্য খাওয়ানো হলে নার্স কাপ নিয়ে চলে যাচ্ছিল…যাবার সময় কৃষ্ণাকে মৃদু কণ্ঠে বলে গেল-‘উনি অসুস্থ! এখন এমন কথা বলবেন না, যাতে ওঁর ভয় বা উত্তেজনা হয়।’

কৃষ্ণার দিকে রাজেন্দ্রপ্রসাদের দৃষ্টি! দু’খানা হাত তুলে তিনি নমস্কার করলেন, ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘আপনি এই চেয়ারখানায় বসুন কৃষ্ণা দেবী। আপনার সঙ্গে কথা আছে।’

নার্সের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি একবার বাইরে যান। মিনিট পনেরো-কুড়ি সময় লাগবে কথা শেষ হতে! তখন আসবেন।’

নার্স চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘ডাক্তার আপনাকে বেশী কথা বলতে নিষেধ করেছেন, মনে রাখবেন।’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ হাসলেন, বললেন, ‘আমি জানি মিস, আমি শুধু কটি জরুরী কথা বলতে চাই। তাতে উত্তেজনা নেই!’

চেয়ারখানা সরিয়ে এনে কৃষ্ণা রাজেন্দ্রপ্রসাদের সামনে বসলো।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘ফেরবার সময় কাল রাত্রে আমার কি বিপদ যে গেল! কামরায় আমার সেক্রেটারি না থাকলে বোধ হয় খুন হতুম। আমি জানি, রাজা রাওয়ের লোক সর্ব্বদা আমায় ফলো করছে। সে জন্য ছদ্মবেশে দুজন পুলিশ সব সময় আমার সঙ্গে থাকে।-জীবন আমার সব সময় বিপন্ন বলে কমিশনারের কাছে আর্জি দেওয়ায় কমিশনার এ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’

কৃষ্ণা বললে, ‘তারা আপনার পাশের কামরায় ছিল! নিজের কামরায় তাদের রাখা উচিত ছিল। যাই হোক, বুঝেছি-আপনাকে ওরা কামরার মধ্যে আক্রমণ করে।’

শ্রান্তকণ্ঠে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘হ্যাঁ, ওদের ধারণা, আমিই সে-চক্র লুকিয়ে রেখেছি!’

এইটুকু বলে রাজেন্দ্রপ্রসাদ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন-তারপর বললেন, ‘আপনি জানেন, এই মঙ্গল-চক্র সন্ধান করতে আপনাকে সেই বাঙলাদেশ থেকে এখানে এনেছি-অনর্থক আপনাকে হয়রান করবার জন্য আনিনি নিশ্চয়! আমার জন্য আপনাকে কম কষ্ট পেতে হয়নি! কতদিন আটক থাকতে হয়েছে! বেচারা সদাশিব রাও এই মঙ্গল-চক্রের জন্য প্রাণ হারালেন। জব্বলপুরের সাব-ইনস্পেক্টর রামস্বামীর পা ভেঙ্গে চিরকালের মতো তিনি অকর্ম্মণ্য হয়ে রইলেন।’

বেচারা রামস্বামী!

বন্দী হবার সময় তাঁর পায়ে কে চোট মেরেছিল-তার দরুণ বেদনা নিয়েও কৃষ্ণার সঙ্গে আসতে কম পথ হাঁটতে হয়নি! কৃষ্ণা এখানে আসবার আগে একবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিল। সেই চোটের পর অতখানি হাঁটার ফলে তাঁর হাঁটুর কাছে যে ঘা হয়, সেই ঘা থেকে গ্যাংগ্রিন-এবং তার ফলে পা-খানি কেটে বাদ দিতে হয়েছে! রাজা রাওয়ের প্রতিহিংসার মাত্রা কৃষ্ণা জানে! কৃষ্ণার সঙ্গে সদয় ব্যবহারের কারণ কিছু থাকতে পারে, তবু কৃষ্ণার বিশ্বাস-বর্ব্বর দুর্দ্দান্ত ছাড়া সে আর কিছু নয়! দুনিয়ায় তার অসাধ্য কাজ নেই!

রাজা রাওয়ের কথা বিশ্বাস করেও সে করতে পারছে না! প্রণবেশ মোটে বিশ্বাস করেন না। রাজেন্দ্রপ্রসাদের সরল অমায়িক ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ! রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজে মঙ্গল-চক্র সরিয়ে রেখে রাজা রাওকে নিৰ্য্যাতন করবার চেষ্টা করবেন, অসম্ভব! কারণ দুর্দ্দান্ত রাজা রাওকে তিনি ভালো রকম জানেন!

তারপর নিজের স্ত্রী-পুত্রকে নিজে থেকে সরিয়ে রাখা-সেও খুব অসম্ভব! রাজেন্দ্রপ্রসাদের শ্বশুর ধনী, ব্যবসায়ী-অর্থের অপ্রতুল নেই তাঁর! রাজা রাওয়ের কাছে কৃষ্ণা শুনেছে, রাজেন্দ্রপ্রসাদের স্ত্রী বাপের এক সন্তান। বাপের অবর্ত্তমানে ঐ কন্যা তাঁর সম্পত্তি সমস্ত পাবে। রাজেন্দ্রপ্রসাদের যা-কিছু, সবই তাঁর শ্বশুরের। এই বাড়ী-ঘর, যেখানে যা করবার, রাজেন্দ্রপ্রসাদ শুধু দেখাশুনা করেন! এতে তাঁর কোনো অধিকার নেই! শ্বশুর আজ ক’মাস শয্যাগত, কোনো রকমে বেঁচে আছেন! কিছুকাল আগে রাজেন্দ্রপ্রসাদের স্ত্রী গিয়েছিলেন বাপের কাছে, সেখানে বাপের অবস্থা দেখে বম্বে থেকে ডাক্তার আনিয়ে দেখান। রিপোর্ট যা পেয়েছিলেন, তাতে স্তম্ভিত হয়ে যান। রায়পুরে ফিরে আসা-ইস্তক স্বামীর সঙ্গে তাঁর একদিনও বনি-বনা হয়নি, এ অবস্থায় আবার তিনি নাগপুরের পথে অন্তর্হিতা হয়েছেন!

রাজা রাওয়ের এ-সব কথা কৃষ্ণা বিশ্বাস করতে পারছে না! বিশ্বাস করা সম্ভব নয়!

জব্বলপুরে প্রণবেশের মুখে শুনেছে, রাজেন্দ্রপ্রসাদ রায়গড় থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছেন-এবং সেখানে যাবার ব্যবস্থা করেছেন। রায়গড় ছোট জায়গা। সেখানে রাজেন্দ্রপ্রসাদের সন্ধান পাওয়া কঠিন নয় বুঝেই কৃষ্ণা রায়গড়ে গিয়েছিল।

ভিতরে হয়তো কোনো রহস্য আছে এবং সে রহস্য কৃষ্ণা ভেদ করবেই-তার পণ!

রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজের ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পা-খানা দেখিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে দেখি, কামরার মধ্যে তিন-চারজন লোক! আলো নেবানো ছিল। ট্রেণ খুব জোরে ছুটছে। এরা রাজা রাওয়ের লোক, তাতে আমার সন্দেহ ছিল না। এ লোকগুলো আমাকে আক্রমণ করে নিৰ্য্যাতন করে মঙ্গল-চক্র আদায় করবে! তা ছাড়া কি একখানা কাগজ সই করিয়ে নেবে এই ছিল তাদের মতলব! আমি চীৎকার করতে গেলুম। ওরা আমার মুখ চেপে ধরলো, কিন্তু হুটোপাটিতে আমার সেক্রেটারির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গবামাত্র তখনি এ্যালার্ম-চেন ধরে টানে। সঙ্গে সঙ্গে তারা পালায়- পালাবার সময় আমাকে মেরে ফেলবে বলে গুলি ছুড়েছিল-সে গুলি তাগ ফসকে আমার পায়ে লাগে। প্রাণের ভয় নেই-তবে কতকাল বিছানায় পড়ে থাকতে হবে, কে জানে! কাজ-কর্ম্মের কত ক্ষতি হবে?’

কৃষ্ণা বললে, ‘না, সে ভয় করবেন না! হাড়ে গুলি বেঁধেনি তো!’

‘হ্যাঁ, এখানে আসবার খানিক পরে শুনলুম-আমার স্ত্রী জানিয়েছেন, আপনি নাকি তাঁর কাছে গিয়েছিলেন!’

কৃষ্ণা বিস্মিত হলো। বললে, ‘এর মধ্যে তিনি জানালেন কি করে?’

বলতে-বলতে সে নিজেকে সামলে নিলে-বললে, ‘হ্যাঁ, হঠাৎ জানতে পারলুম, তিনি রায়গড়ে একটা বাড়ীতে আটক আছেন! পুলিশ কমিশনার মুদালিয়রের কাছ থেকে চারজন কনষ্টেবল নিয়ে আমি রায়গড়ে যাই। অনেক খোঁজ করে সে বাড়ী পাই।-

শুনলুম আপনার ছেলেটি মারা গেছে! সেজন্য তিনি অত্যন্ত কাতর।’

ব্যথিত কণ্ঠে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও এইমাত্র সে খবর পেলুম।’

খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ রইলেন তিনি। কৃষ্ণা নির্ব্বাক।

তারপর কৃষ্ণা বললে, ‘আমি তাঁকে এখানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলুম, আপনার অনুমতি ছাড়া তিনি আসবেন না, বললেন।’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘তাই। আজ ক’দিন আগে-যেদিন আপনাকে জব্বলপুরে দেখতে যাবো বলে বেরুবো, সেই দিনই হঠাৎ রায়গড় থেকে টেলিগ্রাম এলো, আমার স্ত্রীর বোন টেলিগ্রাম করে জানিয়েছেন, আমার স্ত্রী-পুত্রকে পাওয়া গেছে কিন্তু ছেলে অত্যন্ত অসুস্থ। তখন আমি সেখানে যাই। রাজা রাও পাছে জানতে পারে-তাই ওখানেই তাদের রেখে পাহারার সুব্যবস্থা করে চলে আসি। আজ তাদের আনতে লোক পাঠাচ্ছি। আমার স্ত্রী ওখানে আছেন-এ কথা জানাজানি হয়ে গেছে। রাজা রাও যে কোনো মুহূর্ত্তে সর্ব্বনাশ করতে পারে!’

কৃষ্ণা বললে, দুজন ‘কনষ্টেবলকে ওখানে আমি পাহারায় রেখে এসেছি। তবে আমার মনে হয়, ওখান ওঁদের না রেখে বাড়ীতে নিয়ে আসাই উচিত। এখানে আপনার সুরক্ষিত বাড়ীতে হয়তো অনিষ্ট হবে না! কিন্তু সেখানে ও-রকম অবস্থায় ওঁদের একদিন রাখা উচিত নয়!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদ চোখ বুজলেন। তাঁকে বড় ক্লান্ত মনে হলো। নার্স এলো। নার্স আসতে কৃষ্ণা উঠলো।

আঠারো

নিজের ঘরে ফিরে এলো কৃষ্ণা!

প্রণবেশ চা নিয়ে বসে আছেন। কৃষ্ণাকে দেখে তাঁর রুদ্ধ আক্রোশ ফেটে পড়লো, ‘এ কি রকম আক্কেল কৃষ্ণা! বড়লোক হতে পারেন, তবু তাঁর মনে রাখা উচিত-আমরা তাঁর তাঁবেদার নই! টাকা খেয়ে কাজ করতে আসিনি! শুধু কৃতজ্ঞতার খাতিরে আসা!’

হাসিমুখে কৃষ্ণা বললে, ‘ঠাণ্ডা হও মামা! হঠাৎ এমন ক্ষেপে ওঠা ঠিক নয়!’

প্রণবেশ রুখে ওঠেন-‘ঠিক নয়, মানে? এই যে তুমি-ট্রেণ থেকে এসে একটু বিশ্রাম করতে না করতেই তিনি ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন! তারপর ঝাড়া দুটি ঘণ্টা সেখানে ওঁর খেয়ালে বসে থাকা-না খেলে চা, না কিছু! এক পেয়ালা চা-ও তিনি দেননি, নিশ্চয়!’

মাতুলের পাশের চেয়ারখানায় বসতে-বসতে কৃষ্ণা বললো, ‘স্থির হও মামা, তুমি এতক্ষণ চা খেয়ে নিলে পারতে। আমার জন্য কেন বসে থাকা?’

রাগে গর-গর করতে করতে প্রণবেশ এক-চুমুকে নিজের কাপ নিঃশেষ করে উঠে পড়লেন।

কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ, খানিকটা বেড়িয়ে এসো সামনের বাগানে। এক জায়গায় একভাবে বসে থাকলে তোমার মাথায় রাজ্যের আজগুবি ভাবনা চাপে!’

রাগতভাবে প্রণবেশ আড়-চোখে তার পানে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

অদ্ভুত প্রকৃতি কৃষ্ণার। সে কি ভাবে, কি বলে, কিছু বোঝা যায় না! প্রণবেশ চিরকাল কাছে থেকেও তাকে চিনতে পারেন না!

‘মামা…মামা…’

ঘরের ভিতর থেকে কৃষ্ণার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর!

কে জানে, আবার রাজা রাওয়ের কি ব্যাপার! প্রণবেশ ছুটে এলেন।

কৃষ্ণা উঠে দাঁড়িয়েছে, প্রণবেশকে দেখে বললে, ‘দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো মামা। ভয়ানক ব্যাপার! উঃ!’

ব্যাপার বুঝতে পারেন না প্রণবেশ, তবু তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দেন। জিজ্ঞাসা করেন, ‘কি হলো আবার? রাজা রাও না কি?’

‘না। এই দ্যাখো!’

টেবিলের উপর রাজেন্দ্রপ্রসাদের ঘর থেকে সদ্য-আনা বই। সেখানা খুলে দেখায়-বইয়ের মাঝামাঝি জায়গায় একটি চক্র, তার মাঝখানে যে পাথর, তা থেকে নীল আভা!

বিস্মিত কণ্ঠে প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা?’

‘চক্র! মঙ্গল-চক্র! বুঝচো না!’

উত্তেজিত কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘এ সেই মঙ্গল-চক্র মামা। যা নিয়ে চলেছে এই কুরুক্ষেত্র-পর্ব্ব!’

চক্রটা থেকে অদ্ভুত আলো বিকীর্ণ হচ্ছে! কোন ধাতু দিয়ে তৈরী, কে বলবে? চক্রের মাঝখানে বড় একটি নীলাপাথর-সেটা যে মহামূল্য হীরা, তা বোঝা যায়!

‘মঙ্গল-চক্র!’

প্রণবেশ চেঁচিয়ে উঠলেন।

কৃষ্ণা ধমক দেয়, ‘চুপ! কি করো? এখনই দু’জনের ভয়ানক বিপদ ঘটবে! কেউ যদি এসে এখন খুন করে যায়-আটকানো যাবে না! কেউ খবরও পাবে না।’

বইয়ের পাতাটা বন্ধ করে বইখানা কৃষ্ণা রাখে বিছানার গদির নীচে।

প্রণবেশ হাঁ-হাঁ করে ওঠেন-‘এ কি হচ্ছে? এখানে ও-জিনিষ রাখে? বাক্সে রাখো।’

কৃষ্ণা বললে, ‘না, যদি খোঁজ হয়-বাক্সটাই দেখবে। এ-সব জায়গা দেখবে না। আমি ঠিক জায়গায় রেখেছি মামা। তুমি চেঁচিয়ো না। আগে পুলিশকে খবর দিতে দাও-তারপর অন্য কথা।’

সেই মুহূর্ত্তে প্রণবেশকে সে পুলিশ-সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মণিলাল দেশাইয়ের কাছে পাঠালো। এখনই তাঁকে আসতে হবে। মঙ্গল-চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে!

হাঁফাতে হাঁফাতে প্রণবেশ বেরিয়ে গেলেন!

রাজা রাওয়ের কথা সেদিন অবিশ্বাস করলেও আজ কৃষ্ণার বিশ্বাস হলো! আজ মনে হলো, মানুষকে বিশ্বাস করতে নেই, সত্য! মানুষের মতো অবিশ্বাসী জীব আর নেই!

সন্ধ্যার একটু পরে মণিলাল দেশাই এসে পৌঁছুলেন।

কৃষ্ণার পত্রানুযায়ী তিনি দু-গাড়ী সশস্ত্র পুলিশ সঙ্গে এনেছেন। তাদের গাড়ীতে রেখে প্রণবেশের সঙ্গে তিনি রাজেন্দ্রপ্রসাদের বাড়ীতে ঢুকলেন।

‘খবর কি কৃষ্ণা দেবী? মঙ্গল-চক্রের সমাচার পেয়েছেন সত্য?’

তাঁকে বসিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘এই বাড়ীতেই পেয়েছি। সঙ্গে-সঙ্গে চোরকে চিনেছি। এতদিন চিনিনি! ক’জন পুলিশ নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে আসুন-আমি দেখিয়ে দেবো।’

মণিলাল দেশাইয়ের আদেশমতো আটজন পুলিশ এসে দাঁড়ালো।

মণিলাল দেশাইকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণা দোতলায় উঠলো, হাতে তার সেই বই-যার মধ্যে মঙ্গল-চক্র লুকানো ছিল।

রাজেন্দ্রপ্রসাদের ঘরের দরজার পর্দ্দা সরিয়ে কৃষ্ণা দাঁড়ালো চৌকাঠে।

নার্স মাথার কাছে বসে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে পাখার বাতাস করছে-কৃষ্ণাকে দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।

রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি আবার ফিরলেন যে! দরকার আছে?’

কৃষ্ণা হাসি-মুখে বললে, ‘দরকার আছে। পুলিশ সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট মণিলাল দেশাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

সঙ্গে-সঙ্গে মণিলাল দেশাই প্রবেশ করলেন।

‘ও-মোহন! হুঁশিয়ার!’

তড়িৎ বেগে রাজেন্দ্রপ্রসাদ উঠে বসলেন। তাঁর হাতে উদ্যত রিভলভার! তাঁর নার্শরূপী পার্শ্বচর মোহনও রিভলভার বাগিয়ে ধরলো!

দেশাই গর্জ্জে উঠলেন-‘সাবধান রাজেন্দ্রপ্রসাদ! গুলি করবার সঙ্গে-সঙ্গে তুমি মরবে! মঙ্গল-চক্র সরানো নয় শুধু, নাগপুরে সূরযমলের সর্ব্বস্ব আত্মসাৎ করা এবং তাঁকে শ্লো-পয়জনে সাফ করা-তা ছাড়া আরো অনেক জাল-জুয়াচুরির চার্জ্জে তোমাকে আমি অ্যারেষ্ট করচি!’

মুহূর্ত্তে স্তব্ধ থাকেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ,-তারপর হেসে ওঠেন-‘মরার ভয় করি না দেশাই! মরবার জন্য আমি প্রস্তুত আছি! এই দ্যাখো।’

‘গুড়ুম!’

রিভলভারের শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন। নিজের কপালে নিজে মেরেছেন গুলি!

মোহন রিভলভার তুললো! বাঘের মতো দেশাই পড়লেন মোহনের উপর ঝাঁপিয়ে! মোহনের কি বিক্রম! তবু রিভলভার ছোড়া-গুলি বিঁধলো মোহনের পায়ে! দুম করে মোহন পড়লো ছিটকে-রিভলভার খসে পড়লো তার হাত থেকে। মোহন হলো বন্দী।

হা-হা-হা-হা!

রাজেন্দ্রপ্রসাদের হাসি!-রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘আমায় ধরবে…তুমি মণিলাল! হা-হা-হা-হা, কৃষ্ণা দেবী-এদিকে একবার আসবেন!’

কৃষ্ণা এগিয়ে আসে। রাজেন্দ্রপ্রসাদ অকস্মাৎ আত্মহত্যা করবেন, তা সে ভাবেনি! চোখ তার সজল হয়ে ওঠে!

রাজেন্দ্রপ্রসাদের কণ্ঠে স্খলিত স্বর, তিনি বললেন, ‘আমি যাচ্ছি! হ্যাঁ, তোমার ক্ষমতা আছে! যাবার সময় তোমাকে বহুত তারিফ দিয়ে যাচ্ছি! সাবাস মেয়ে বটে! রাজা রাওয়ের কাছে নিশ্চয় অনেক কথা শুনেছো! যদি শুনে থাকো, জেনো, তার সব সত্য! মঙ্গল-চক্র যে-বইয়ের মধ্যে ছিল, সেখানা নিয়ে গেছ, তা যদি ঘুণাক্ষরে বুঝতুম! তা হলে ফিরে এসে এ ঘরে আমায় দেখতে পেতে না। ভয়ানক ভুল হয়ে গেছে। ওঃ-ভয়ানক ভুল!’

রাজেন্দ্রপ্রসাদের কণ্ঠ আসে জড়িয়ে…দু’চোখ আসে বুজে।

মণিলাল দেশাই নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, ‘খুব ফাঁকি দিয়ে গেল লোকটা! ছদ্মবেশের আড়ালে থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ যে-সব কাজ করেছে, তার যে-কোনো একটার জন্য অন্ততঃ দু-বছর জেল! বড় ভুল করেছিল-ভেবেছিল, একমাত্র মঙ্গল-চক্রই ওকে রক্ষা করবে! হয়তো হতো যদি ও-চক্র আপনার হাতে না গিয়ে পড়তো, কৃষ্ণা দেবী!’

আর্দ্র-কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘সে কথা সত্য। এমন অতর্কিতে এটা পাবো, স্বপ্নে ভাবিনি! আমার সঙ্গে কথা বলার পর দুর্ব্বলতার ভাণে ওঁর চোখ বুজে আসছে দেখে, এমনি একখানা বই টেনে নিয়ে তার পাতা উল্টোতে যাই! পাতা উল্টোতে চক্র দেখতে পেলুম। এমন ভাবে সাধারণ একখানা বইয়ের মধ্যে ও জিনিষ থাকতে পারে, কল্পনা করতে পারে কেউ?’

মণিলাল দেশাই বললেন, ‘বড় বেশী চালাক কি না, তাই প্রথমে আমাদের জানায়, চক্রটা কুড়িয়ে পেয়েছে! তারপর জানালো-চুরি হয়ে গেছে, অথচ একখানা বইয়ের মধ্যে চক্র সে ঘরেই রেখেছে! রাজেন্দ্রপ্রসাদ জানতো-সে সব সময়ে বাড়ীতে থাকে না-আর চাকর-দরোয়নদের মধ্যেও ক-জন হয়তো রাজা রাওয়ের চর, যে কোনো সময়ে তারা সব-কিছু খুঁজে দেখতে পারে! রাজা রাও আর তার চরেরা রাজেন্দ্রপ্রসাদকে কম জ্বালাতন করেছে! কম ভয় দেখায়নি! তাদের ভয়ে নিজের স্ত্রী-পুত্রকে পর্য্যন্ত এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।’

কৃষ্ণা নিঃশব্দে শোনে, কোনো কথা বলে না।

প্রণবেশ বললেন, ‘সে উদ্দেশ্য তো বটেই! তাছাড়া ওঁদের নাকি মতান্তর আর মনান্তর চলছিল খুব-স্বামী-স্ত্রীতে!’

মণিলাল দেশাই বললেন, ‘আপনি দেখছি, সব জানেন। হ্যাঁ, ওদিকেও অনেক ব্যাপার শুনেছি-কিন্তু সে-কথা থাক,-ওঁর স্ত্রীকে আনাবার ব্যবস্থা করতে হবে আগে! লাশ এখন থাকুক-পুলিশ সার্জ্জনকে খবর দিই-তিনি এসে দেখে যান। আমাদের চোখের সামনে রিভলভারের গুলিতে আত্মহত্যা! তবু লিগাল-ফর্মালিটি যা আছে! রায়গড়ে লোক পাঠাই আমি-ওঁর স্ত্রীকে আনবার জন্য।’

উনিশ

এখানকার কাজ শেষ!

কৃষ্ণা কলকাতায় ফেরবার উদ্যোগ করছে-সঙ্গে সঙ্গে ছদ্মনামে যে-ঠিকানায় তাকে চিঠি দিতে বলেছিল, সেই ঠিকানায় খবর দিলে-পত্রপাঠ রাজা রাও চক্র নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন যেন! পুলিশ আটকাবে না! কমিশনারের কাছ-থেকে আমি হুকুম নিয়েছি। মহাকালের চক্র-মহাকালের মন্দিরেই ফেরত যাবে।

প্রণবেশ বললেন, ‘তার মুখ চাইবার কি দরকার? পুলিশের হাতে দিয়ে যাও। পুলিশের কাছ থেকে সে নিয়ে যাবে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘আমি কথা দিয়েছি মামা, চক্র যদি পাই, রাজা রাওকে নিজে দিয়ে যাবো। রাজা রাওয়ের বংশ-পরম্পরায় মহাকালের মাথার ও-চক্র তাদের। আজও তাই থাকবে। দেবতার মাথার মণি-যার-তার হাতে দিতে পারবো না। তারপর দেখচো তো, এ-চক্র কি অমূল্য সম্পদ! ও জিনিষ বিশ্বাস করে কারো হাতে দেওয়া যায় না! পুলিশ-হেফাজত বলচো, সে হেফাজত থেকে চুরি যেতে পারে না, তার কি গ্যারাণ্টি আছে? পুলিশ যে গ্যারাণ্টি দেবে না-স্পষ্ট তা বলেছে।’

কলকাতায় ফেরবার আগের দিন সন্ধ্যার পরে রাজেন্দ্রপ্রসাদের স্ত্রী সন্ধ্যার সঙ্গে কৃষ্ণা গেছে দেখা করতে…সদ্য-স্বামী-পুত্র-বিয়োগ-বিধুরা!

কৃষ্ণার হাত দুখানা ধরে সজল-নেত্রে সন্ধ্যা বললে, ‘আমার সেদিনকার ব্যবহারের জন্য মনে কিছু করবেন না কৃষ্ণা দেবী। সমাজে আমার স্বামীর খুব নাম-যশ ছিল- দেশ-বিদেশের লোক তাঁকে চিনতো। আমি প্রথমে কিছু জানতুম না! শুধু জানতুম তিনি ধার্ম্মিক-সৎ-পথে চলেছেন। প্রথম যেদিন জানলুম, তা নয়-যে রাজা রাওকে আমরা ভয় করি, সে তার চেয়েও ভয়ানক, তার চেয়েও বদ-সেদিন আমি কত কেঁদেছিলুম! আমারই বাবার সম্পত্তি, তাঁর ব্যবসা, বুদ্ধি-চাতুর্য্যে স্বামী অবশ্য অনেক উন্নতি করেছিলেন। বাবার অসুখ শুনে আমি নাগপুরে গিয়ে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে জানলুম শ্লো-পয়জন! বাঁচবার আশা নেই! যে ক’দিন বেঁচে থাকবেন, অকর্ম্মণ্য হয়ে থাকতে হবে। এ পয়জন কে দিয়েছে জানেন? আমার স্বামী! এ কথা যখন জানলুম, তখন আর একদিন তাঁর সঙ্গে বাস করা চলে?’

খানিকক্ষণ নীরব থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে সন্ধ্যা বললে, ‘এর পর একদিন আমাদের বিবাদ হয়। আমার বোন আর ছেলেকে নিয়ে আমি নাগপুর যাবো বলে বেরুই। পথের মাঝখানে আমার স্বামী আমাদের নামিয়ে নেন। আমাদের সঙ্গে তিনি সেই ট্রেণেই যাচ্ছিলেন, আমি জানতুম না। পরের ট্রেণে আমাদের নিয়ে তিনি আসেন রায়গড়ে। নিজের অসহায়তা বুঝিয়ে তিনি আমাদের কিছুদিন রায়গড়ে থাকবার কথা বলেন। আমার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করেছিলেন, জীবনে তিনি কোনো দিন আর অন্যায় কাজ করবেন না!’

সন্ধ্যার দু-চোখে জলধারা!

‘সে কথা তিনি রক্ষা করতে পারলেন না! তাই পনেরো দিন গেল না, ছেলে ধড়ফড় করে মারা গেল! তিনিও চলে গেলেন!’

বিয়োগ-বিধুরা নারী!

সে নাগপুরে চলে যাবে সামনের হপ্তায়, এখানে আর থাকবে না, বললে।

কৃষ্ণার মনে বিষাদের ঘন মেঘ! কৃষ্ণা দোতলা থেকে নেমে এলো। নিজের ঘরে এলো! এসে যা দেখলো-বিস্ময়ে হতভম্ব। দেখলো, দরজার দিকে পিছন করে চেয়ারে বসে কে একজন বই পড়ছে।

‘কে?’

লোকটি ফিরলো।

‘রাজা রাও! আপনি এখানে?’

কৃষ্ণার বিস্ময় দেখে রাজা রাও হাসে-অভিবাদন করে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি এসেছি।’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনি কি-সাহসে এখানে এসেছেন? দেখছেন পুলিশে-ঘেরা, আপনাকে দেখতে পেলে ধরবে! চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে যাবে! এ জেনেও এখানে আসবার সাহস হলো আপনার?’

হাসি-মুখে রাজা রাও বললে, ‘রাজা রাওয়ের কোষ্ঠীতে ভয় কথাটি লেখা নেই, কৃষ্ণা দেবী। তা ছাড়া ভয় করলে চলবে না! আমার কুল-দেবতার মঙ্গল-চক্র আমাকেই নিয়ে যেতে হবে, আর কেউ নিয়ে গেলে হবে না! দিনে এলে লোকে চিনবে, তাই অন্ধকারে গা-ঢেকে এসেছি! আমার মন্দিরের পুরোহিত বাইরে আছেন, মঙ্গল-চক্র আপনার কাছ থেকে নিয়ে গিয়ে আমি তাঁর হাতে দেবো!’

কৃষ্ণা মঙ্গল-চক্র বার করলো।

উজ্জ্বল আলোয় ঝকঝক করে জ্বলে মঙ্গল-চক্র!

পরম শ্রদ্ধায় মঙ্গল-চক্র গ্রহণ করে রাজা রাও বললে, ‘আপনাকে পুরস্কার দিয়ে লজ্জা দেবো না কৃষ্ণা দেবী। আমার নূতন তৈরী এই আংটি-দয়া করে যদি এটি নেন! আপনার আঙুলে এ আংটি আমার মঙ্গল-চক্রের কথা আপনাকে ভুলতে দেবে না!’

কৃষ্ণা আংটি নিলে, নিয়ে বললে, ‘ধন্যবাদ! আমাদের কথা ভুলবেন না আপনি!’

রাজা রাও বললে, ‘কোনো দিন ভুলবো না কৃষ্ণা দেবী। জীবনে পরম শ্রদ্ধায় আপনার কথা মনে করবো।’

তারপর আবার বললে, ‘সামনের পূর্ণিমায় মহাকালের মাথায় মঙ্গল-চক্র আবার স্থাপিত হবে-সেদিন মন্দিরে বিশেষ সমারাহ। আপনি যদি সে-দিন পর্য্যন্ত থাকতেন-‘

সবিনয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘উপায় নেই রাজা রাও-জী!’

রাজা রাও বললে, ‘আমি জানি, সে-জন্য অনুরোধও করবো না। চক্র-স্থাপনের পর আমি আমেরিকায় যাবো। কাজেই আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আপনাকে অনেক দুঃখ-কষ্ট দিয়েছি, বাধ্য হয়ে অসদ্ব্যবহারও করেছি, আমার সে-সব অপরাধ ক্ষমা করবেন।’

কৃষ্ণাকে আবার অভিবাদন করলো রাজা রাও-তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যায়।

কৃষ্ণা দরজায় দাঁড়িয়ে…

অন্ধকারে রাজা রাও কোথায় মিলিয়ে গেল!

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *