০৬. মায়াবী ও কৃষ্ণা

মায়াবী ও কৃষ্ণা

এক

রেল-লাইনের উপর মেল ট্রেন ছুটে চলেছে দু’পাশের যা-কিছু পিছনে ফেলে।

বাইরে ফুটফুটে চাঁদের আলো। জানলার পাশে ব’সে একাগ্র দৃষ্টিতে সেই লুটিয়ে-পড়া ফিকে ভায়োলেট-আলোর দিকে তন্ময় হয়ে চেয়ে আছে কৃষ্ণা।

বেঞ্চের ওপাশে বসে ইনন্সস্পেক্টর ব্যোমকেশবাবু নিঃশব্দে মোটা সিগার টেনে যাচ্ছেন। মনের চিন্তা ওঁর মুখে ছাপ ফেলেছে…কি ভাবছেন উনিই জানেন।

ছোট কামরা। লোকও আজ বেশী নেই। পিছনের বেঞ্চের সীটে দু’জন লোক ঘুমোচ্ছেন, দেখে মনে হয় ওঁরা বিদেশী। এক ভদ্রলোক বিহারী, আর-একজন সিন্ধি। হাওড়া থেকে রাত্রের ট্রেনে ওঁরা দু’জনে উঠেছেন, গাড়ী ফাঁকা দেখে দু’দিকের দু’খানা বেঞ্চ দখল করে বিছানা পেতে বেশ নিশ্চিন্ত আরামে নাম ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। ভোরে গাড়ী বেনারস পৌঁছোবার আগে যে ওঁরা জাগবেন না, গাড়ীর চাকার কর্কশ-রাগিণীর তালে তালে মিশিয়ে ওঁদের নাক-ডাকার ঘর্ঘর-রাগ তা জানিয়ে দিচ্ছে বগীর কামরার এই অত্যল্প প্রতিবেশীদের।

এপ্রিলের শেষ। প্রচণ্ড গরম পড়েছে এ-প্রদেশে। ফার্ষ্ট-ক্লাশ কামরায় মাথার উপর সমানে পাখা চললেও সে-বাতাসে ক্লান্তি দূর হয় না।

ব্যোমকেশবাবু মাঝে-মাঝে ঝিমিয়ে পড়ছিলেন, পরক্ষণে সামলে উঠে-‘আঃ! উঃ!’ শব্দ করছিলেন, সে শব্দে মুখ ফিরিয়ে কৃষ্ণা মাঝে-মাঝে ওঁর পানে তাকাচ্ছিলো।

-‘কাকাবাবু!’

আধখানা চোখ মেলে ব্যোমকেশবাবু কৃষ্ণার দিকে তাকালেন-‘আমায় ডাকলে কৃষ্ণা?’

-‘হ্যাঁ। আপনি ওই বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়ুন।’

ব্যোমকেশবাবু হাই তোলার সঙ্গে তুড়ি দিতে-দিতে বললেন, ‘না মা, শোয়ার আমার সময় কোথায়? তাছাড়া রাত আর কতটুকুই-বা, নামতে পারলে এখন বাঁচি। কি যে একটা অস্বস্তি…’

কৃষ্ণা কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকে, তারপর বলে, ‘কাজটা হাতে নিয়ে ভালো করিনি কাকাবাবু।’ বলে ওদিককার সীটে ঘুমন্ত বিদেশী দুজনের দিকে ওঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।

ব্যোমকেশ একটু হাসলেন, বললেন, ‘অমূলক ভয় তোমার কৃষ্ণা!’ তারপর একটু থেমে মুখে বললেন, ‘আমরা বাঙালী’ আর হাত নেড়ে ইসারায় বোঝালেন আমাদের কথা ওরা মোটেই বুঝবে না।

কৃষ্ণা উঠে এসে ছোট গলায় বললে, ‘তবুও সাবধানের মার নেই। হয়তো ওরা ঘুমুচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কার মনে কি আছে কে জানে! দরকার কি এখানে ওসব কথা কয়ে? দেওঘরে পৌঁছে বাড়ী গিয়েই কথাবার্তা হবে’খন।’

ব্যোমকেশবাবুর সাময়িক ঘুম হয়ে গেছে, এখন বাকি সময়টুকু এইসব আলোচনার মধ্যে কাটিয়ে দেবেন ইচ্ছে ছিল, কিন্তু কৃষ্ণাকে চুপ করতে দেখে অগত্যা একটা সিগার ধরিয়ে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন।

ট্রেন চলার বিচিত্র শব্দ ছাড়া বাকি সব নিস্তব্ধ। জানলার বাইরে দূরে কাছে কোথাও এখন আর সে-রকম চোখ ঝলসানো আলোর মায়া নেই, আকাশে চাঁদের আলোর বিলীয়মান স্নিগ্ধ বর্ণচ্ছটায় চোখ ঝিমিয়ে আসে…

কিছুক্ষণ সেইদিকে চেয়ে থাকবার পর ব্যোমকেশ মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, জানলায় মাথা রেখে কৃষ্ণা কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পেছনের সীটে অস্ফুট মৃদু গুঞ্জন…অপরিচিত প্রতিবেশী দু’জন উঠে বসেছেন। হঠাৎ ট্রেনের কলের ভেঁপু বেজে উঠলো। দেখতে দেখতে যে ষ্টেশনটা পিছনে ফেলে গাড়ী এগিয়ে চললো-সেটা ‘মধুপুর’। এর পরেই ট্রেন থামবে জসিডিতে।

নামবার আগে ওঁদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে ব্যোমকেশ উসখুস করেন…ভগবান সুযোগও দেন…ও-পাশের ভদ্রলোকদের মধ্যে একজন তখন নস্যির কৌটো খুলছিলেন, হঠাৎ তাঁর হাত থেকে ডিবেটা গড়িয়ে এসে পড়লো ব্যোমকেশের পায়ের উপর। সেটা তুলে নিয়ে সহাস্যে ব্যোমকেশ হিন্দীতে বললেন, ‘রামরাম বাবুজী, আপনার কৌটোটা এইদিকে পড়েছে, এই নিন।’

সিন্ধি ভদ্রলোক উঠে এসে ধন্যবাদ দিয়ে কৌটোটি নিলেন, এরপর আলাপ-পরিচয় হতে বিলম্ব হলো না।

জানা গেল, সিন্ধি ভদ্রলোক গুজরাটে বড় ব্যবসা করেন, কাজের জন্যে তাঁকে কলকাতায় আসতে হয়েছিল, এখন দিল্লী যাবার পথে একবার দেওঘরে নেমে তিনি বৈদ্যনাথজীউকে দর্শন ক’রে যাবেন এইরকম ইচ্ছে আছে। সঙ্গের ভদ্রলোকটি তাঁর সেক্রেটারী। ওঁর নাম-জয়প্রকাশসিং।

অত্যন্ত অমায়িক ভদ্রলোক মিঃ ধরমচাঁদ দশ-পনেরো মিনিটের আলাপেই বেশ জমিয়ে নিলেন, ব্যোমকেশকেও নিজের পরিচয় দিতে হলো-তিনি কলকাতায় থাকেন, বিশেষ কাজে দেওঘরে যাচ্ছেন, সঙ্গে যাচ্ছেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী এই মেয়েটি। তিনিও খুব বেশীদিন থাকবেন না, খুব শীগগিরই ফিরবেন কলকাতায়।

ধরমচাঁদ বললেন, ‘বাবুজীর নামটা জানতে পারলে খুশী হবো।’

-‘নাম?’ ব্যোমকেশ নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার নাম হৃদয় চ্যাটার্জী। একটা ব্যাঙ্কে কাজ করি।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাসকাবারে যা পাওয়া যায় তাতে ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলোয় না মশাই, আর বলেন কেন।’ বলতে বলতে তিনি একটা নিশ্বাস ফেলেন।

ধরমচাঁদ মাথা দুলিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, সে তো ঠিক কথা। বাঁধা মাইনে আর কতটুকু, তাতে কিই বা হয়! আপনার সুটকেশের উপর ‘ব্যোমকেশ’ নামটা রয়েছে কি না; আমি ভেবেছিলাম অন্যরকম। মানে, পুলিশের একজন বড় অফিসার সেই ব্যোমকেশবাবুই হবেন হয়তো।’

সচকিত হয়ে উঠে, অর্দ্ধনিমীলিত চোখ দুটি মেলে ধরমচাঁদের মুখের দিকে তাকালেন ব্যোমকেশ। না, সন্দেহ করবার কিছু নেই-নেহাত গোবেচারা গোছের লোক। অত্যন্ত সাধারণ মুখের গড়ন..সরল চোখে ব্যোমকেশের দিকেই তাকিয়ে আছেন।

ব্যোমকেশ বললেন, ‘দুর্ভাগ্য আমার, আমি ব্যোমকেশ নই, বিখ্যাতও নই মোটেই। ঐ ব্যাগটা আমার ছোট ভাইয়ের। তার নামও ব্যোমকেশ বটে, কিন্তু সে পুলিশ অফিসার নয়, কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে। দেখছেন কাণ্ডকারখানা! নাঃ, চাকর- বাকরের দ্বারা আর চলবে না দেখছি। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বসে আছে-হেঁ-হেঁ-হেঁ, আমার সুটকেশটা রইলো বাড়ীতে পড়ে। সে ছোকরার একজামিন সামনে তাই রক্ষে, নইলে সে যদি আবার এইসময় বাইরে যেতো কোথাও-‘

ধরমচাঁদ হো হো করে হেসে উঠে কেবল ‘ও’ বলে আবার শুয়ে পড়লেন, তাঁর সঙ্গী এঁদের কথার ফাঁকে আগেই কোন সময় শুয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরমচাঁদের নাক ডাকার শব্দ শোনা গেল।

ব্যোমকেশ ভালো হয়ে বসলেন। বাঙ্কের উপর সুটকেশটা এদিকেই ফেরানো আছে বটে। কালো সুটকেশটার উপর সাদা অক্ষরে তাঁর নামটা জ্বলজ্বল করছে…

নিজের এই বোকামির জন্যে নিজের উপরেই রাগ হলো ব্যোমকেশের।

পুলিশের কাজে বাইরে বেরুবার সময় কখনো তিনি নিজের নাম লেখা সুটকেশ নিয়ে যান না, অথচ এবারে তাঁর কি মতিচ্ছন্ন হলো কে জানে! তাছাড়া তাঁর সুটকেশের গায়ে লেখা নাম যে কারুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এ-কথাটা তাঁর একবারও মনে হয়নি। তবে ধরমচাঁদকে নেহাত ভালোমানুষ আর বোকা বলেই মনে হয়।

পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে ব্যোমকেশ দেখলেন, তিনটে বাজতে এখনো দশ মিনিট দেরী। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন জসিডিতে পৌঁছোবে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি এতক্ষণে।

দুই

‘জসিডি’তে নেমে ব্যোমকেশ একটা ট্যাক্সি নিতে যাবেন এমন সময়ে একটি প্রিয়দর্শন যুবক ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে নমস্কার ক’রে দাঁড়ালো সামনে।

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে ব্যোমকেশ জিগেস করলেন, ‘তোমায় তো ঠিক চিনতে পারছিনে বাপু!’…

বিনীত-কণ্ঠে যুবকটি বললে, ‘আজ্ঞে, আমি নেহালসিংয়ের কাছ থেকে আসছি, আমার নাম দয়ালচাঁদ।’

-‘ও, তুমিই দয়ালচাঁদ?’

উৎফুল্ল হয়ে ব্যোমকেশ তার করমর্দ্দন করে, কৃষ্ণার দিকে ফিরে বললেন, ‘বুঝেছো কৃষ্ণা, আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে নেহালসিং তাঁর কথামত দয়ালচাঁদকে পাঠিয়েছেন।’

বিনয়ে বিগলিত হয়ে দয়ালচাঁদ বললে, ‘হ্যাঁ, তিনিই আমায় পাঠিয়েছেন, আমি রাত তিনটে থেকে অপেক্ষা করছি এখানে এই পাঞ্জাব মেলের জন্যে। গাড়ী বোধহয় আজ একটু লেটে এসেছে, আসুন, আর দেরী করবেন না।’

ট্যাক্সি লাইনের ওপাশে নেহালসিংয়ের মোটরটা ছিল, কৃষ্ণাকে নিয়ে ব্যোমকেশ গিয়ে সেই মোটরে উঠলেন, দয়ালচাঁদ গিয়ে ড্রাইভারের সীটে বসে ষ্টার্ট দিলে।

গাড়ীটা ঠিক ষ্টার্ট নিচ্ছে না। দয়ালচাঁদ নেমে সামনে গিয়ে বনেটের ডালাটা তুলে ভেতরের কল-কব্জা নাড়াচাড়া করে, মাঝে মাঝে ঝিকঝিক শব্দ করে উঠেই তখুনি আবার থেমে যায় যন্ত্রদানব।

ব্যোমকেশ বললেন, ‘একেবারে ঝরঝরে গাড়ী যে! চলবে না নাকি?’ দয়ালচাঁদ বললে, ‘না, ঠিক তা নয়; এখানা আমার হাতের গাড়ী নয় কিনা, তাই। এ-গাড়ীর পুরনো ড্রাইভার হাসপাতালে গেছে…গুলির আঘাতটা খুব সাংঘাতিক ভাবেই লেগেছে তাকে।’

শিউরে উঠে ব্যোমকেশ বললেন, ‘গুলি? গুলি কে মারলে তাকে?’

দয়ালচাঁদ বললে, ‘সেইটেই তো রহস্য। কে যে ছুঁড়েছে গুলি তা জানা যায়নি। তবে রক্ষে, যে, গুলিটা তার বুকের বাঁ-পাশ ঘেঁষে গেছে, নইলে তো সঙ্গে সঙ্গেই সাবাড় হয়ে যেতো। একজন তো মারাই গেছেন। নেহালচাঁদবাবুর এক বন্ধু ছিলেন সেই মোটরে, দুষ্টেরা নেহালচাঁদ ভেবে গুলি মেরে তাঁকে হত্যা করেছে।’

ব্যোমকেশ এবার ঘাড় ফিরিয়ে কৃষ্ণার দিকে চাইলেন। ঠিক এইসময়ে সিন্ধি ধরমচাঁদ তাঁর সেক্রেটারীকে নিয়ে একখানা ট্যাক্সিতে বসতেই গাড়ীখানা ষ্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল এঁদের সামনে দিয়ে।

দয়ালচাঁদের মোটরখানা এতক্ষণে শব্দ করতে করতে কেঁপে কেঁপে ষ্টার্ট নিলে।

ব্যোমকেশ পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করতে গিয়ে কোমরে আঁটা বেল্টে হাত পড়তেই চমকে উঠলেন। সার্টের নীচে কোমরে আঁটা বেল্টের সঙ্গে যে রিভলভার ছিল সেটা কই? অস্ফুট একটা আর্ত্তনাদ সামলে নিয়ে মৃদুগুঞ্জনে উনি কেবল ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে’ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা জিগ্যেস করলে, ‘কি হলো কাকাবাবু?’

ব্যোমকেশ চাপা সুরে বললেন, ‘আমার রিভলভারটা তো আমি কোমরেই…’

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা ওঁর হাতের উপর হাত রেখে বললে, ‘থামুন কাকাবাবু, যেতে দিন। আমার কাছে রিভলভার আছে, ভয় নেই।’

মোটরের কলের বিকট শব্দে এসব কথা দয়ালচাঁদের কানে পৌঁছোয়নি, আপন মনে উঁচু-নীচু পথ দিয়ে গাড়ী চালিয়ে চলেছে সে।

চারিদিককার প্রাকৃতিক দৃশ্য সুন্দর হলেও এখন কৃষ্ণার সেদিকে মন ছিল না। কৃষ্ণা ভাবছিল, কাজটা না নিলেই হতো। পিতৃবন্ধু নেহালসিংয়ের অনুরোধ রাখতে গিয়ে সে ভালো কাজ করেনি।

ব্যবসা উপলক্ষ্যে নেহালসিং বহুবার বার্ম্মা গেছেন, কৃষ্ণাদের বাড়ীতে আতিথ্য স্বীকার করেছেন, এখন বৈদ্যনাথধামে বাড়ী করে সপরিবারে এখানেই বাস করছেন। দিনকয়েক আগে নেহালসিংয়ের একটা জরুরী টেলিগ্রাম আসে কৃষ্ণার কাছে, তারপর আবার দেওঘরে আসবার অনুরোধপত্র সে যেমন পেয়েছে, ব্যোমকেশও তেমনি পেয়েছেন।

নেহালসিং বেশ শিক্ষিত অমায়িক লোক। ব্যোমকেশের সঙ্গেও বহুকালের বন্ধুতা। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে তাঁরা একসঙ্গে পড়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই ব্যোমকেশ কৃষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন। কৃষ্ণাকেও তিনি ওই কথা লিখেছেন যে, তিনি নিজে অসুস্থ, তাঁর পুত্র অসুস্থ, এমন অবস্থায় রোগা ছেলেকে ফেলে রেখে তাই কলকাতায় যেতে পারছেন না, নইলে নিজেই আসতেন।

তাঁর পত্রে বিচলিত হয়েই কৃষ্ণা অন্য কাজ ফেলে দেওঘরে আসছে এবং আসার আগে ব্যোমকেশ নেহালসিংকে ‘তার’ করেছেন, কৃষ্ণাকে সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছেন, ষ্টেশনে যেন লোক থাকে। পত্রে বিপদের তেমন-কিছু উল্লেখ নেই। হয়তো অনেক-কিছু ভেবেই তিনি সে সব লেখেননি, তবে পত্রপাঠ যাবার যে ইঙ্গিত করেছেন তাতেই বিপদের গুরুত্বের আভাস পেয়েছেন ব্যোমকেশ ও কৃষ্ণা।

ব্যোমকেশ মাঝে মাঝে দেওঘরে নেহালসিংয়ের অতিথি হন, তাঁর মুখেই কৃষ্ণা শুনেছে নেহালসিং বহু ধনের মালিক। বম্বে-অঞ্চলে দুটো জুটমিলের সিনিয়র পার্টনার তিনি, আরো অনেক ফ্যাক্টরী লোক রেখে চালাচ্ছেন, তাছাড়া নিজের একটা ষ্টীমারের ব্যবসাও আছে।

তাঁর প্রথম স্ত্রী বহুকাল আগে মারা গেছেন এক ছেলে আর একটি মেয়ে রেখে। ছেলে বৈজুনাথ এখন কুড়ি-একুশ বছরের স্বাস্থ্য-সবল যুবক, পিতার সব ব্যবসাই সে সময়মত দেখাশোনা করে, নেহালসিং তার হাতেই সমস্ত ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়েটি এই সতেরোয় পড়েছে, কিন্তু এখনো বিয়ে হয়নি। পরমাসুন্দরী এই রত্না মেয়েটির জন্যে চারদিক থেকেই পাত্রের সন্ধান আসছে, কিন্তু রত্নাকে বৈজুনাথ যার-তার হাতে তুলে দিতে পারে না, যতক্ষণ না নিজের মনের মত হয়।

কিছুদিন আগে নেহালসিং ভূপালে গিয়েছিলেন, সেখানে এই বয়সে তিনি আবার একটি দ্বিতীয়-সঙ্গিনী জানকীরাণীকে ধর্ম্মসাক্ষী রেখে বিয়ে করেছেন। জানকীরাণীর প্রথম এবং শেষ পরিচয় তিনি গরীবের মেয়ে।

জানকীর বর্ত্তমান অভিভাবক তাঁর মামা। তিনি বিখ্যাত ধনকুবের নেহালসিংয়ের সঙ্গে তাঁর ভাগনীর বিবাহ দিয়ে এখানে এসে ভাগনীজামায়ের একখানা বাড়ী দখল করে বসেছেন-এসব কথা কৃষ্ণা শুনেছে ব্যোমকেশের মুখে।

দয়ালচাঁদ নিজের মনে মোটর চালিয়ে চলেছে…উঁচু-নীচু অসমতল পথে মোটরের দোলা আরোহীদের মনে অতীতের হারানো স্মৃতির দোল দিয়ে যাচ্ছে এমন সময় সহসা একটা ঝাঁকানি! মোটরখানা হঠাৎ থমকে থেমে গেল! অসতর্ক মুহূর্ত্তটা সামলে নিয়ে সাবধান হবার সঙ্গে সঙ্গে দেখলে, দয়ালচাঁদ নেমে এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিয়ে বিনীতভাবে একপাশে সরে দাঁড়ালো।

পাশেই বিরাট প্রাসাদের ফটক। ফটকের দু’পাশে দু’জন দরোয়ান মিলিটারী-কায়দায় সেলাম দিয়ে হাত নামিয়ে কাঠের পুতুলের মত নিথর। সামনে লাল-কাঁকরের রাস্তা ধ’রে আগে আগে চললো দয়ালচাঁদ, পিছনে ব্যোমকেশ ও কৃষ্ণা। কৃষ্ণা পলকের দৃষ্টিতে দেখে নিলে, গেটের ডানদিকের থামের গায়ে পিতলের তকমায় চকচক করছে রায়বাহাদুর নেহালসিংহের নাম।

চলতে চলতে ব্যোমকেশ জিগ্যেস করলেন দয়ালচাঁদকে, ‘এখানে তুমি কদ্দিন কাজ করছো বাপু, গত নভেম্বরে যখন এসেছিলুম তখন তো দেখিনি তোমায়?’

স্মিত হাসি হেসে দয়ালচাঁদ জবাব দিলে, ‘আজ্ঞে, তখন আমি দিল্লী গিয়েছিলাম মনিবের কাজ নিয়ে। রায়বাহাদুরের কাছেই আমি মানুষ হয়েছি কিনা! তাঁর সব কাজেই তিনি তাই আমায় পাঠান।’

চিন্তিতমুখে ব্যোমকেশ বললেন, ‘তাঁর আগেও-তো আমি এসেছি কয়েকবার, কই, তখনো তো-‘

চাপা-হাসি আরো চেপে দয়ালচাঁদ বললে, ‘কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছি। শুধু দেখেছি নয়, আপনার সঙ্গে কথাও বলেছি। আপনাকে চিনি বলেই তো ষ্টেশনে কর্ত্তা আমাকে পাঠিয়েছিলেন…না-না ওদিকে নয়, এই দরজা দিয়ে আসুন!’

সিঁড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েবাঘের মত দুটো ভীষণাকৃতি কুকুর ছুটে আসে ওঁদের দিকে…সভয়ে কৃষ্ণা পিছিয়ে আসে ব্যোমকেশের গা ঘেঁষে…ব্যোমকেশ বৃথাই কোমরের বেল্টে হাত বুলোন কৃষ্ণাকে আড়াল করে।

সঙ্গে সঙ্গে হাত তুলে গর্জ্জন করে ওঠে দয়ালচাঁদ-‘ষ্টপ! ষ্টপ টাইগার…লায়ন… ফ্রেণ্ড…ফ্রেণ্ড…’

মুহূর্ত্তে কুকুর দুটি মন্ত্রমুগ্ধের মত নিশ্চল। আর একজন ছুটে এসে টাইগার-লায়নের গলার চেন চেপে ধরে।

রুখে ওঠে দয়ালচাঁদ-‘আটকাতে পারোনি এদের? আমি সামনে না থাকলে এঁদের অবস্থাটা কি হতো ভাবো তো? এরপর কি কৈফিয়ৎ দেবে মনিবের কাছে?’

ম্লান মুখে লোকটি বললে, ‘বাঁধাই ছিল হুজুর, কি জানি কে ছেড়ে দিলে, এই দেখুন না ওরা চেন ছিঁড়ে আসেনি।’

-‘বেশ, ওই কথাই বলো মনিবের কাছে।…আসুন কৃষ্ণাদেবী, ব্যোমকেশবাবু, এর বিচার পরে হবে কর্ত্তার কাছে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু লোকটির বিশেষ দোষ নেই, দয়ালবাবু, কেউ নিশ্চয় ছেড়ে দিয়েছে ওদের মজা দেখবার জন্যে।’

মৃদু হেসে কৃষ্ণার দিকে ফিরে দয়ালচাঁদ বললে, ‘মজা দেখবার লোক আর এ-বাড়ীতে কে আছে বলুন? থাকবার মধ্যে কর্ত্তাবাবু, তাঁর স্ত্রী, বৈজুনাথ-মানে বাবুর ছেলে। এই তো। এর মধ্যে আবার কুকুর লেলিয়ে দিতে আসবে কে তাঁদের আমন্ত্রিত অতিথিদের পেছনে!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আমরা কি এই বাড়ীতেই থাকবো?’

মোলায়েম হাসি হেসে দয়ালচাঁদ উত্তর দিলে, ‘সম্ভবত তাই। যদিও এখানে একটা ‘গেষ্ট হাউস’ আছে, সেখানে কি আর তিনি রাখবেন আপনাদের? আপনি তাঁর বন্ধুর মেয়ে, আর ব্যোমকেশবাবু নিজে তাঁর বন্ধু। আপনাদের নিমন্ত্রণ করে এনে তিনি নিজের কাছেই রাখবেন মনে হয়। তাছাড়া এখুনি তো তাঁর সঙ্গে দেখাই হবে, আপনাদের সম্বন্ধে কি করবেন তা তিনিই জানাবেন আপনাদের।’

কৃষ্ণা চুপ করে রইলো।

তিন

দরজার পরদা সরিয়ে দিয়ে দয়ালচাঁদ সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ালো। কৃষ্ণাকে নিয়ে ব্যোমকেশ ভিতরে ঢুকলেন। পিছনে দয়ালচাঁদ।

বিরাট হলঘর। আসবাবপত্রে বিলিতীর ছোঁয়াচ নেই কোথাও। জমিদারী-কায়দায় ঘর-জোড়া মস্ত-বড় পাটাতনের উপর আগ্রার নরম কার্পেট-মোড়া ঢালা বিছানা…চারদিকে মাফিকসই সাজানো তাকিয়াগুলি জড়-বস্তু হলেও মৌন ভাষায় অভ্যাগতদের সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছে যেন। মনোজ্ঞ পরিবেশ।

ফরাসের মাঝখানে তাকিয়ে হেলান দিয়ে সোনার আলবোলায় রুপোর স্প্রীং-নলে মুখ দিয়ে রাশভারী যে প্রৌঢ় জাঁদরেল-মূর্ত্তিটি অম্বুরী তামাকের চড়া মৃগনাভি-মেশানো খুশবু ছড়াচ্ছিলেন, এঁদের দেখেই নলটা নামিয়ে রেখে কপালে হাত ঠেকালেন- ‘রামরাম বাবুজী…আইয়ে…আইয়ে…নমস্তে!’

অক্ষম অপটু ভারী শরীর নিয়ে ওঠবার চেষ্টা করেন নেহালসিং, বাধা দেন ব্যোমকেশ-‘থাক থাক, আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না…হ্যাঁ, দেখেছি, ঐখানেই বসছি আমরা-আ-আ-আ! সারা রাত ট্রেন জার্নি! তারপর? ভালো আছেন বেশ? আপনার ‘তার’ পেয়ে কৃষ্ণাও চঞ্চল হয়ে উঠলো আসবার জন্যে তাই একসঙ্গেই এলুম।… বলো না কৃষ্ণা, তোমার কি বলবার আছে।… কৃষ্ণা আমাকে জিগেস করেছিল, কিন্তু আমিও তো কিছুই জানিনে, ভাবলুম দয়ালচাঁদকে জিগেস করবো’, বলে পিছন ফিরে দেখলেন, দয়ালচাঁদ চলে গেছে। শুধু দয়ালচাঁদ নয়; ঘরে ঢুকে যে কজন লোককে দেখেছিলেন ব্যোমকেশ তাঁরা কেউ নেই। এটা বোধহয় মনিবের অলক্ষ্য ইসারা।

কিছু বলবার জন্যে নেহালসিং এবার উসখুস করেন। এই সুযোগই হয়তো চাইছিলেন তিনি। এত-বড় হলঘরে এখন মাত্র এই তিনটি প্রাণী। থমথমে আবহ।

সে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন প্রথমে নেহালসিং, বললেন, ‘বড় খুশী হলুম ব্যোমকেশবাবু আপনাদের দেখে। কৃষ্ণা মায়ীকে তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। সে কি আজকের কথা! শেষ যেবার আমি বার্ম্মায় গেছলুম তখন কৃষ্ণা সাত-আট বছরের বাচ্ছা একটি ফ্রক-পরা মেয়ে। সেও তো আজ প্রায় বছর পনেরো আগে-না কৃষ্ণা?’

কৃষ্ণা মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লে-‘তাই হবে বোধহয়।’

-‘তারপর বছরখানেক আগে সংবাদপত্রে যেদিন তোমার ফটো দেখলুম, মনে হলো, একি আমাদের কৃষ্ণা? না বোধ হয়। বয়েস বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের চেহারা যে কত বদলে যায়…হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কাগজে পড়ি এক বাঙালী-মেয়ের অপূর্ব্ব সাহসের কথা…অবাক হয়ে যাই। নাম তার কৃষ্ণা…নামজাদা বড়-বড় গোয়েন্দারা যেসব রহস্য উদঘাটন করতে হিমসিম খেয়ে যান, বুদ্ধিমতী এই মেয়েটি নিজের সৎসাহস আর উপস্থিত-বুদ্ধির জোরে অবহেলায় সেইসব দুরূহ কাজ সম্পন্ন ক’রে, কত অসহায়া বিপন্না নারীকে দুরন্ত দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করে এনেছে…কত পুত্র-কন্যাহারা মা-বাপকে তাঁদের হারানো সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে মুমূর্ষু অভিভাবকদের নবজীবন দান করেছে…খবরের কাগজ মারফত সবই জানতে পারি, ভাবি, না হবেই বা কেন? মেয়েরা কি তুচ্ছ? ওঁরা যে আদ্যাশক্তি মহামায়ার অংশ। এই কথা মনে হওয়ার পর বন্ধুবর ব্যোমকেশবাবুকে পত্র লিখে জেনেছিলুম, সে তুমি। আমার পরম বন্ধুর কন্যা যোগমায়ার বরপুত্রী আমার কৃষ্ণা মায়ীই সেই কৃষ্ণা। তখন আর অবাক হলুম না…মুগ্ধ হয়ে গেলুম…নিশ্চিন্ত হলুম। যদি এসেছো মা কৃষ্ণা মায়ী, বিপন্ন ছেলেকে তোমার উদ্ধার করো…আমার মন বলছে তুমি পারবে।’

অনেকদিন পরে গম্ভীর প্রকৃতি প্রবীণ রায়বাহাদুর একসঙ্গে এতগুলো কথা একটানা বলে গিয়ে হাঁপাতে লাগলেন।

কথাগুলো অবশ্য তিনি বাংলায় বলেননি; বালিকা-কিশোরীদের পড়বার সুবিধার জন্যে তরজমা ক’রে দিলুম।

একটু হেসে কৃষ্ণা বললে, ‘অতটা নির্ভর করবেন না রায়বাহাদুর! খবরের কাগজ যেসব খবর দিয়েছে, ততখানি শক্তি আমার মোটেই-‘

-‘থাক থাক, মিছে কথা বোলো না কৃষ্ণা!’ বাধা দেন ব্যোমকেশবাবু, বলেন, ‘খবরের কাগজে আর কতটুকু প্রকাশ হয়েছে; প্রকাশ হতো যদি আমি খুঁটিয়ে বলতে পারতুম। কিন্তু তার আগেই তুমি আমার কণ্ঠরোধ করেছো, মানে, আসল কথা তুমি আমায় একটিও বলতে দাওনি-‘

এবারে কৃষ্ণা বাধা দিলে; বললে, ‘ওসব কথা এখন থাক কাকাবাবু, যে জন্যে এত কষ্ট স্বীকার ক’রে এখানে এসেছি আমরা সেইসব কথাই হোক আগে।’

ব্যস্ত হয়ে রায়বাহাদুর বললেন, ‘দেখেছো? হ্যাঁ হ্যাঁ, কষ্টই তো! বহুকাল পরে মাকে সামনে পেলে, বুড়োরাও সব ভুলে একেবারে কচি খোকা হয়ে যায়। এই যে একটু…এক সেকেণ্ড…’

কলিং বেল দু’বার ক্রীং-ক্রীং করতেই দরজার পরদা সরে গেল! টী-সেট হাতে বয় শুধু মাথা নত করলে, তার দু’হাত জোড়া।

দেহের ওজনের মৰ্য্যাদা রেখে একটা ভারী নিশ্বাস রায়বাহাদুরের নাক আর মুখ থেকে দু’ভাগ হয়ে বেরিয়ে এলো-‘সবই বলবো মা, আগে তোমরা চা খেয়ে নাও।’

কৃষ্ণার তৃষ্ণা ছিল খুব! কিন্তু সে মেয়ে। টী-পট থেকে সুরভিত লীকার ঢেলে, দুধ-চিনি মিশিয়ে তিন কাপ চা তৈরি করে, দু’কাপ রায়বাহাদুর আর ব্যোমকেশবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে, নিজের চায়ের বাটিটা কৃষ্ণা ট্রে’র উপর রাখলে।

রায়বাহাদুর ঘাড় নাড়লেন-‘আমি না, এখনকার চা শুধু তোমাদের জন্যে।’

চা পর্ব্ব শেষ হলো।

নেহালসিংয়ের দিকে চেয়ে কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘কতকাল আপনি এখানে আছেন রায়সাহেব?’

-‘বহুকাল। এই বাড়ীতেই আমি জন্মেছি, মানুষ হয়েছি। এখানে এসে বাবা প্রথমে একতলা তোলেন, তারপর এখন এই যে বিরাট প্রাসাদ দেখছো, এসব ভগবানের দয়ায় আমাকেই করতে হয়েছে। কিন্তু সে-কথা থাক। যে বিপদে পড়ে তোমাদের এখানে আনিয়েছি সেই কথাটাই শোনো আগে। এ-বিপদের বার্ত্তা এখনো কাউকে জানাইনি! এমন কি, দয়ালচাঁদকেও না।’

-‘ও। আচ্ছা, উনি-মানে, দয়ালচাঁদবাবু আপনার কে হন?’

-‘আত্মীয় কেউ না! ও আমার এক বন্ধুর ছেলে। ওর বাবা মৃত্যুকালে ওকে আমার হাতে সঁপে দিয়ে গেছলেন, সেই থেকে ও আমার তাঁবেই আছে। দিল্লীতেই এতদিন ছিল ও, মাঝে মাঝে যাওয়া-আসা করতো, সম্প্রতি কিছুদিন হলো আমার কাছে এখানেই রয়েছে।’

ব্যোমকেশ কথার মাঝে কি বলতে যাচ্ছিলেন, ইসারায় কৃষ্ণা বাধা দিলে।

বয় এসে চায়ের খালি পাত্রগুলো ট্রে’তে তোলবার সময় রায়বাহাদুর বললেন, ‘আরদালীকে খবর দাও, আমার হুকুম না পাওয়া পর্য্যন্ত কেউ যেন না এ-ঘরে ঢোকে।’

কায়দামত অভিবাদন জানিয়ে ভৃত্য আস্তে-আস্তে বেরিয়ে গেল।

চার

সেদিন রাত্রে।

ঠিক রাত্রি নয়, সন্ধ্যার কিছু পরে স্তব্ধ হলঘরে ব্যোমকেশের পাশে বসে কৃষ্ণা একাগ্র মনে রায়বাহাদুরের কথা শুনছে।

এ-কথা সে-কথা নিয়ে সুরু করবার পর রায়বাহাদুর যখন কাজের কথায় এলেন তখন কৃষ্ণা আর একটু সরে বসলো। নেহালসিং বললেন, ‘ওই যে বললুম, ভাগ্য ফিরলো আমার বিয়ের পরে। বিখ্যাত ধনীর একমাত্র আদরের দুলালী একেবারে লক্ষ্মীর ঝাঁপি মাথায় নিয়ে ঢুকলেন দরিদ্রের কুটীরে। ধুলো-মুঠো ধরতে, সোনা-মুঠো হতে লাগলো আমার।…যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সম্পত্তি দিনের পর দিন বেড়েই চললো। শ্বশুর ছিলেন বহু ক্রোড়পতি, বোম্বাই শহরে বিরাট জাহাজ-কোম্পানীর একেশ্বর মালিক। তাছাড়া আরো কত কল-কারখানা…উত্তরাধিকারসূত্রে ক্রমে ক্রমে সবই আমার হাতে একে একে আসতে লাগলো। এলো বটে, কিন্তু এ সবের ভবিষ্যৎ-অধিকারী তখনো আমি নই, আমার ছেলে বৈজুনাথ আর মেয়ে রত্নাদেবীর গার্জ্জেন হিসাবে আমি এই বিপুল সম্পত্তির ভার মাথায় নিলুম। নইলে বিয়ের আগে আমায় চিনতো কে? কিন্তু অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়। রত্না জন্মাবার চার-পাঁচ বছর পরে আমার স্ত্রী মারা গেলেন।’

দম নেবার জন্যে এই পর্য্যন্ত বলে রায়বাহাদুর থামলেন।

কৃষ্ণা কি বলতে যাচ্ছিলো, নেহালসিং বললেন, ‘কথাটা আগে আমায় শেষ করতে দাও মায়ী, তারপর তোমার দরকারমত প্রশ্ন কোরো।…হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর মা-হারা অনাথ শিশুদের লালন করতে হলো আমাকেই। ক্রমে তারা মানুষ হলো, ব্যবসা করতে গেলে সবরকম বিদ্যেই কিছু-কিছু আয়ত্ত করা দরকার তাই বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষার জন্য বৈজুনাথ পড়তো এই বৈজনাথের উত্তর সীমানায় ‘বিদ্যাপীঠ’-এ, আর রত্না-বাড়ীতে। বিদ্যাপীঠের পাঠ শেষ হবার পর বৈজুনাথকে আরো উচ্চশিক্ষা দেবার জন্যে পাঠালুম বোম্বাই, সেখানে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে ফিরে এসে সে আমার, মানে, তার দাদুর যাবতীয় মিল-ফ্যাক্টরীর তত্ত্বাবধান করতে লাগলো।… দেখেছো, আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। বৈজুনাথ যখন বোম্বায়ে পড়ছে, তখন রত্নার তো বয়েস বেড়েছে; এত বড় বাড়ীতে একজন মেয়েছেলে না থাকলে ওকে দেখবে কে সেজন্যেও বটে আমর আমার অপটু শরীরের যত্ন নেবার জন্যে আমি আবার বিবাহ করলুম। তিনি এখন এই বাড়ীতেই আছেন। তারপর শোনো, আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে হঠাৎ এক রাতে বৈজুনাথ আমার কাছে এসে বললে আগামীকাল সে বোম্বাই চলে যাচ্ছে…খুব সাবধান…যে-কোনো মুহূর্ত্তে দারুণ বিপদের সম্ভাবনা আছে, পেছনে শত্রু লেগেছে-‘

সহসা কৃষ্ণা ব’লে উঠলো, ‘মাপ করবেন। এক মিনিট। আচ্ছা, বিপদের আশঙ্কা আছে জেনেও আপনাকে এ অবস্থায় একা ফেলে রেখে তাঁর হঠাৎ বোম্বাই চলে যাওয়ার কারণ কি যদি দয়া ক’রে বলে তারপর অন্য-কথা বলেন তো-‘

-‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলবো বৈকি। কারণটা এই যে, বৈজুনাথ তার বিমাতাকে কোনোদিনই শ্রদ্ধা করতে পারেনি, বরং ঘৃণার চোখেই দেখতো, আর দ্বিতীয়পক্ষের এই স্ত্রী আসার পর থেকে সে আমাকেও এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে আরম্ভ করলে, যা যে-কোনো উচ্চশিক্ষিত ছেলের পক্ষেই একান্ত অশোভন। ইদানীং সে আমার সঙ্গে কথাও কইতো না। যাক, বোম্বাই তো গেল। তার কিছুদিন পরে খবর পেলুম, সেখানে অসৎসংসর্গে মিশে সে উৎসন্নে যেতে বসেছে; দুষ্টেরা তাকে দিয়ে অনেককিছু করিয়ে নেবার ফিকিরে আছে। স্থির থাকতে পারলুম না। খবর পাওয়া মাত্র নিজে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলুম। এখানে এসে দিনকতক সে বেশ ভালোই ছিল, আমার সঙ্গে এবারে ব্যবহারও মন্দ করছিল না, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রাঘাত! হঠাৎ তার মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটলো…রত্না মায়ী যেদিন নিখোঁজ হয়, সেই রাত্রি থেকেই সে কেমনধারা হয়ে গেল। বলো তো কৃষ্ণা মায়ী, বলুন তো বাবুজী, আমি অভাগা নই?…’

অতিমাত্রায় বিস্ময় প্রকাশ করে ব্যোমকেশ বললেন, ‘বলেন কি? রত্নাদেবী নিখোঁজ? কথাটা তো ঠিক বুঝলুম না রায়বাহাদুর?’

-‘প্রথমটায় আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি।’…রায়বাহাদুর বললেন, ”পরের দিন এলো একখানা চিঠি, তাতে লেখা ছিল : ‘নেহালজী! মেয়ের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত চিন্তিত। আশা করি, আপনার মেয়েকে আপনি ভালো করেই চেনেন…কিন্তু মুখ না দেখে কেবল দু’খানা কাটা-পা দেখে যদি কার পা চিনে পত্রে জানাতে পারেন, আর আমাদের বন্দিনীর দেহের সঙ্গে সে-পা ঠিক মিলে যায়, তাহলে আপনাকে লাখ টাকা পুরস্কার দিতে আমি প্রস্তুত। শুনেছি, মানুষের প্রাণের দাম-লক্ষ টাকা। সে-প্রাণ যদি আমার দ্বারা নষ্ট হয় তা’হলে তার ন্যায্য মূল্য দিতে আমি বাধ্য। কিন্তু জীবন্ত এবং অক্ষত সেই মেয়েকে যদি আপনি ফেরত পেতে চান তাহলে আপনিই-বা, যে ফেরত দেবে, তাকে পাঁচ লাখ টাকা দেবেন না কেন? আপনার অনেক টাকা…যারা নিঃস্ব, যাদের উদরান্নের সংস্থান নেই, তারা কি ছেঁড়া-কাঁথায় শুয়ে আপনার সিন্দুকের লাখ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেই খুশী থাকবে? না, তা কখনই হবে না! তাদের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করবার জন্যে অমরনাথ প্রাণপাত করবে। তাই টাকা আমার চাই-ই। যদি আপনার কাছে মেয়ের চেয়েও টাকা অধিক প্রিয় হয়, তা’হলে অবশ্য আমার কিছুই বলবার নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, আপনার মেয়েকে খুন ক’রে অমরনাথ ফাঁসি গেলে, আপনার কি লাভ হবে? ভাল ক’রে ভেবে এর উত্তর লিখে আগামী তৃতীয় অমাবস্যার রাতে আপনার মাথার বালিশের তলায় রেখে আপনি সুখনিদ্রা দেবেন, সে-চিঠি ঠিক আমার হাতে আসবে। ভাববার জন্যে এই পঁয়তাল্লিশ দিন সময়ই যথেষ্ট। ইতি অমরনাথ’।”

রায়বাহাদুর থামলেন। ব্যোমকেশ অবাক হলেন। কৃষ্ণা এতক্ষণ পরে সবাক হলো; বললে, ‘অমরনাথ? অমরনাথকে আপনি পেলেন কোথায়? সে তো ভূপালের একজন নামকরা দুর্দ্ধর্ষ দস্যু। তার নামে বাঘে-গরুতে এক-ঘাটে জল খায় শুনেছি! তার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হলো কি করে?’

পাশের ডেস্কের ড্রয়ারটা টানলেন নেহালসিং। একখানা লম্বা খাম খুলে একতবক কাগজের একটা বাণ্ডিল বের করে কৃষ্ণার হাতে দিয়ে বললেন, ‘চঞ্চল হয়ো না, ব্যস্ত হবার কাজ নয়, মন দিয়ে পড়ো।’

লাল ফুল-আঁকা চিঠির কাগজ! অমরনাথের দলের এ চিহ্ন কৃষ্ণা চেনে। সেই যে সেই একবার-যাক’, সে-কথা পরে। অমরনাথের চিঠিতে লেখা আছে : আজ নেহালসিং যে বিপুল সম্পত্তি ভোগ করছেন এ সবই অমরনাথের। নেহালসিংয়ের শ্বশুর ধনপৎসিং এককালে অমরনাথের পিতামহের জাহাজ-কোম্পানীতে ক্যাসিয়ার ছিলেন। পিতৃহীন অমরনাথ মাত্র তের বৎসর বয়সে পিতামহ লালা দুনিচাঁদের সঙ্গে বিদ্যার্জ্জনের জন্যে লণ্ডনে যান। সেই দীর্ঘ অবসরে অতি-লোভী ধনপৎসিং নানা উৎকোচ ও প্রলোভনের দ্বারা কর্ম্মচারীদের হাত ক’রে…বহু লোকসান দিয়ে খরিদ্দারদের কাছে সস্তায় নানারকম মাল বিক্রি করার ফলে তাদের বশীভূত করে যাবতীয় কারবার ও সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছিলেন।…

…দুনিচাঁদ ধনপৎসিংকে তার ভারতের সমস্ত কাজ-কারবার বিক্রি ক’রে দিয়ে নাতিকে নিয়ে লণ্ডনে চলে গেছেন এ-খবর মুখে-মুখে প্রচার হতে-হতে যখন কাগজে-কলমে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলো, সেইসময় দুনিচাঁদ বোম্বায়ে ফিরে এসে নিজের কপাল চাপড়ালেন, মামলা-মোকর্দ্দমা করলেন, কিন্তু একটিও সাক্ষী জোগাড় করতে না পারার ফলে মামলা তো হারলেনই, শেষপর্য্যন্ত নিঃস্ব দুনিচাঁদ দারুণ অনুশোচনায় নিজের অবিমৃষ্যকারিতার মূল্য দিলেন আত্মঘাতী হয়ে।…

…সেই থেকে আত্ম-গ্লানিতে ভরে উঠেছে অমরনাথের মন। প্রতিশোধ সে এর নেবেই। এত সহজে চোরকে এ ধনরাশি ভোগ করতে দেবে না সে। কিছুতেই না। দারিদ্র্য-শিক্ষিত-অমরনাথকে দীক্ষিত করেছে অনশনক্লিষ্ট দরিদ্রনারায়ণের প্রতিষ্ঠার জন্যে ধনীর সর্বস্ব লুণ্ঠন করতে! এর জন্যে যে কোনো হীন অপবাদ সে মাথা পেতে নেবে, কারণ সে নিজে নিষ্পাপ। এ তার দুশ্চর তপস্যা।

চিঠি প’ড়ে একটা সুচিন্তিত নিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ, একথা আমি শুনেছি। এ তার দুশ্চর তপস্যাই বটে। অমরনাথ ধনীর বিভীষিকা, কিন্তু দরিদ্রের পরম বন্ধু।’

ব্যঙ্গের হাসি হেসে ব্যোমকেশ বললেন, ‘মন্দ নয়। অমরনাথের এ একটা মস্ত-বড় সার্টিফিকেট।’

ব্যোমকেশের এই বিদ্রূপে কান না দিয়ে রায়বাহাদুরের মুখের দিকে চেয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু অমরনাথের এই চিঠির সঙ্গে আপনার মেয়ে হারানোর সম্পর্কটা কি আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না।’

-‘সম্পর্ক টাকার।’ ক্লিষ্টকণ্ঠে নেহালসিং বললেন, ‘প্রথম চিঠিতে লাখ টাকা পাঠাবার যে ইঙ্গিত করেছিল অমরনাথ, সে-টাকা সে পায়নি। টাকার জন্যে রত্নাকে চুরি করেও সে টাকা পেলে না… ভাববার জন্যে তিন সপ্তাহ সময় দিয়েছিল, তার মধ্যে দু’সপ্তাহ তো কেটেই গেছে… তোমরাও ঠিক সময়ে এসে পড়েছো… এখন বলো তো কৃষ্ণা মায়ী, আমার কর্ত্তব্য কি? টাকা যাক। লক্ষ টাকা অপচয় হলেও আমার কিছু যায়-আসে না। কিন্তু অমরনাথের লক্ষ্য যখন শুধু টাকা; তখন টাকাটা পেয়েও যদি রত্নাকে সে ফিরিয়ে না দেয়… ওকে ওইভাবে আটক করে বার-বার ওইরকম টাকার দাবি করে?… এই তো চারদিন আগে রত্নার গর্ভধারিণীর বহুমূল্যের জুয়েলারী গহনাগুলো আমার চাবি-বন্ধ আয়রণসেফের মধ্যে থেকে ম্যাজিকের মত বেমালুম গায়েব হয়ে গেল! কি করি!…কি করবো আমি এরপর!…একদিন না দেখতে পেলে যাকে পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যাবে ভাবতুম, সে আজ পনেরো দিন ডাকাতের কবলে… কি কষ্টেই যে রত্না আমার দিন কাটাচ্ছে…’

কৃষ্ণা বললে, ‘এখানকার পুলিশে খবর দিয়েছেন নিশ্চয়ই, তাঁরা কি বলেন?’

-‘তা তো দিয়েছি, শুনছি তাঁরা চেষ্টাও করছেন খুব। থানার দারোগা রামরাও, ইনস্পেক্টর লক্ষ্মণস্বামী এর মধ্যে দু’তিন দিন এসে রীতিমত এনকোয়ারীও ক’রে গেছেন, কিন্তু সুরাহা তো কিছুই হলো না!’ একটু থেমে রায়বাহাদুর আবার বললেন, ‘আমার বর্ত্তমান স্ত্রী সেদিন থেকে আহার-নিদ্রা একরকম ত্যাগ করেছেন বললেই হয়। তাঁর সর্ব্বদাই ঐ এক কথা-রত্নাকে যে এনে দিতে পারবে তাকে তিনি নগদ পাঁচহাজার টাকা পুরস্কার দেবেন।’

-‘পাঁচ-হা-জার!…একেবারে নগদ পাঁচহাজার টাকা-না?…হা-হা-হা হা-হা-হা! উঃ! একসঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি হাজার! দু’হাতে কি ধরবে? না ধরে, প্রথমে পকেটে, তারপর প্যাণ্টের জেবে তারপর বুক-পকেট-ইনসাইড পকেট-এইয-যাঃ! আমার পকেটগুলো সব গেল কোথায়? রত্না নিশ্চয় লুকিয়ে রেখেচে।…রত্না? রত্না?? রত্না???…’

নেহালসিং সোজা হয়ে উঠে বসলেন-‘একি! তুমি এখানে কেন? কে তোমায় এখানে আসতে দিলে? যাও! যাও! এখুনি চলে যাও এখান থেকে!…এই, কে আছিস?’

-‘সব্বাই আছে বাবা, নেই শুধু আমাদের রত্না। আমায় চলে যেতে বলছো? যাচ্ছি। যাচ্ছি। দেখি রত্না কোথায় আছে। আচ্ছা বাবা, রত্না আমাদের ছেড়ে কোথায় গেল? হ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়েছে, এই মেয়েটির সঙ্গে ‘ক্যারাম’ খেলতে গেছে এদের বাড়ী। এই? শীগগির রত্নাকে ডেকে আনো… ওঠো… ওঠো… নইলে গুলি করবো তোমায়।’ বলে আগন্তুক যুবকটি রিভলভারের ঘোড়া টেনে গুলি করবার ভঙ্গীতে শূন্য- হাতে কৃষ্ণার দিকে তাগ করতে-করতে এগিয়ে এসে মুখে ‘ধুরূম।’ শব্দ ক’রে, হাতে টুক ক’রে একটা তুড়ি দিলে।

তারপর পিতার দিকে ফিরে বললে, ‘এবার আমি পালাই বাবা। এখুনি পুলিশ আসবে…মানুষ খুন! রত্নার বন্ধুকে গুলি করলুম… আর কি আমি এখানে থাকি? তুমি কিন্তু কাউকে বোলো না বাবা… রত্নাকেও না।’… বলতে-বলতে প্রিয়দর্শন যুবকটি বেরিয়ে যেতেই রায়বাহাদুরের ইঙ্গিতে মঙ্গল আর ওলাপ দারোয়ান দু’জন ওর পিছু পিছু ছুটলো সাবধানে ওকে প্রহরা দেবার জন্যে।

সপ্রশ্ন-দৃষ্টিতে নেহালসিংয়ের দিকে চেয়ে কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘এ যুবকটি কি আপনার…’

-‘হ্যাঁ, ছেলে। উপস্থিত আমার একমাত্র সন্তান। রত্না হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে বৈজুনাথ একেবারে পাগল হয়ে গেছে।’

কৃষ্ণা চুপ। ব্যোমকেশের মুখে কথা নেই। হলঘর নিস্তব্ধ।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রায়বাহাদুর অন্যমনস্ক ভাবে আলবোলার নলটা মুখে তুলে নিলেন।

পাঁচ

মস্ত-বড় পাঁচ-মহল বাড়ী। আমন্ত্রিত অতিথি দু’জনকে প্রথম মহলের দু’খানা সাজানো ঘরে বাস করতে দেওয়া হয়েছে। এঁদের সুখ-সুবিধার খবরদারি করবার ভার আছে দয়ালচাঁদের উপর।

খাওয়ার টেবিলে বসে ব্যোমকেশ অপেক্ষা করছিলেন কৃষ্ণার জন্যে। স্নান সেরে এসে কৃষ্ণা বসলো কাকাবাবুর মুখোমুখি টেবিলের ওপাশের চেয়ারে।

-‘উঃ, কি নিস্তব্ধ বাড়ী! এ মহলে কোনো মানুষ থাকে না নাকি?’ কৃষ্ণা ভারি অস্বস্তি বোধ করে।

প্রচুর অন্ন-ব্যঞ্জনের থালা-বাটি সাজিয়ে দিয়ে পরিবেশনের আশায় চামচ-বাটি হাতে বাইরে যে লোকটি প্রতীক্ষায় ছিল, তাকে ডাকবার আর দরকার হলো না। অপৰ্য্যাপ্ত আহার্য্যের মধ্যে অভুক্ত অনেক-কিছুই বাসনে পড়ে রইলো।

খাওয়ার পরে ব্যোমকেশের ঘরে ফিরে এসে কৃষ্ণা বললে, ‘আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগছে না কাকাবাবু। এই ক’ঘণ্টাতেই আমি একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখনই এই, এরপর ক’দিন এখানে থাকতে হবে কে জানে! রায়বাহাদুরকে আপনি বলবেন, এখানে আমরা বেশীদিন থাকবো না।’

সহাস্যে ব্যোমকেশ বললেন, ‘তুমিও তো বলতে পারো কৃষ্ণা! উনি তো কেবল আমার পরিচিত নন, তোমার বাবারও বন্ধু। সে-হিসেবে উনি তোমার কাকাবাবু। কাজেই যা বলবার তুমিই-‘

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘বাবার ঠিক বন্ধু নন, তবে ব্যবসা উপলক্ষে বার্ম্মায় গেলে বাবা ওঁকে হোটেলে থাকতে না দিয়ে আমাদের বাড়ীতেই খাতির ক’রে রাখতেন। বাবা গত হবার পর ওঁর কথা আমি একেবারে ভুলেই গিয়েছিলুম। আমাদের বাড়ীতে যখন দেখেছি ওঁকে তখন রায়বাহাদুরের চেহারা এমন বিশ্রী-‘

-‘এরকম মোটা আর ওরকম ভুঁড়ি-‘

বলতে-বলতে ব্যোমকেশ হো-হো ক’রে হেসে উঠে বললেন, ‘বিধাতার অভিশাপ আর-কি! আমার চেহারাটার কথা ভাবো-আগে যা ছিলুম তার চেয়ে কতটা মেদ বৃদ্ধি হয়েছে…ভুঁড়িটাও চুপিসাড়ে সেই অনুপাতে কিরকম বাড় বেড়েছে? তবু আমি এই ব্যোমভোলানাথ শরীর নিয়েও চলাফেরা করি, কাজকর্ম্ম করি। আর-রায়বাহাদুর? ওঁকে বোধহয় চাকরের কাঁধে ভর দিয়ে অতি কষ্টে চলাফেরা করতে হয়। বেচারা! যাই-হোক, ভদ্রলোক খাইয়েছেন খুব বলতে হবে। আমার ছুটির মাসটা এখানে থেকে ভিটামিন খেয়ে-খেয়ে ভুঁড়ি সমেত এই ভোঁদা দেহটাকে বাগিয়ে বেশ আঁট-সাঁট ক’রে নিয়ে গিয়ে একমাস পরে যখন ষ্টাফের আর বড়সাহেবের সামনে আত্মপ্রকাশ করবো, কি মজাই যে হবে!’

-‘এক মাস?’ কৃষ্ণা শুনে আঁতকে ওঠে; বলে, ‘কমবে কি কাকাবাবু? এত খেলে এই এক মাসে আপনার ঐ ভুঁড়ি ফুলে-ফেঁপে একেবারে জয়ঢাক হয়ে যাবে যে! বরং ভেবে-ভেবে আমি এই এক মাসে পোড়া-কাঠ হয়ে যাবো। এ রহস্যের সমাধান করতে যাওয়া কি সোজা কথা? দেখলেন তো, ওঁর সেক্রেটারী এসে আমাদের পৌঁছে দিয়ে স’রে গেল, খাওয়ার সময় তদ্বির করবার জন্যে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো একটা বোবা-কালা-কানা অখদ্যে লোক!’

ব্যোমকেশ যেন আকাশ থেকে পড়েন-‘সে কি? হাবা-কালা-কানা? কৈ, তাকে দেখে তো তা মনে হলো না। সে তো দিব্যি চেয়েছিল বাইরে থেকে আমাদের দিকে।’

কৃষ্ণা একটু হাসলে, বললে, ‘আপনার আশীর্ব্বাদে আমার এ অভিজ্ঞতাটুকু আছে কাকাবাবু, মানুষের আকৃতি দেখলে তার প্রকৃতি বুঝে নিতে পারি সেই মুহূর্ত্তে। ভাবুন, খুব সন্তর্পণে পা-টিপে-টিপে সে খাবার টেবিলে এসে আমাদের থালা দু’খানায় আন্দাজ ক’রে ভাত দিলে…মাছ তরি-তরকারি চোখের খুব কাছে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা ক’রে পরিবেশন করলে…বাটিতে ডাল যখন বেশী ঢালছিল তখন আমি বারণ করা সত্ত্বেও শুনতে পেলে না… আবার খাবার শেষে ক্ষীর দিতে এসে-পাছে বে-আন্দাজী ঢেলে দেয় তাই হাত নেড়ে আমি যে কম দেবার ইঙ্গিত করলুম, বুঝতে না পেরে সে ক্ষীর না দিয়েই বাটি-চামচ হাতে আবার পায়ে-পায়ে আস্তে আস্তে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইলো। এইসব দেখেই আমি বুঝে নিয়েছি লোকটা বোবা, আর বোবা হলেই কালা হবে সে জানা কথা, তাছাড়া তার চলাফেরার সন্দিগ্ধ ভাবটাই আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে সে চোখে কম দেখে।’

কেশবিরল মাথায় ইনস্পেক্টর ব্যোমকেশ ঘন-ঘন হাত বুলোতে থাকেন। কৃষ্ণার কথা ফুরোয় না; বলে, সারা বাড়ীটা ঘিরে একটা রহস্য উঁকি দিচ্ছে, অথচ তার প্রকাশ নেই। চারদিকেই একটা থমথমে নিরানন্দ ভাব। না কাকাবাবু, এ আমার অসহ্য।’

কৃষ্ণা বলেছে মিথ্যে নয়। সত্যিই এ স্তব্ধতা সহ্য করা যায় না। অলস দুপুরে এই বিরাট বাড়ীটা ঘিরে যে পরিবেদনাময় পরিস্থিতির ইসারা,-ভাবলে মন হূ-হূ করে। যেন সমাধিক্ষেত্রের নীরবতা।

ব্যোমকেশ বললেন, ‘সেটা হওয়া বিচিত্র নয় কৃষ্ণা! একটি মাত্র বংশধর, সে হয়েছে উন্মাদ! স্নেহের দুলালী ঐ এক মেয়ে, তারও জীবন-মৃত্যু জাহাঁবাজ দস্যুর হাতে। কর্ম্ম-মুখর চঞ্চলতা এ পুরীতে আসবে কেমন করে?’

কৃষ্ণা বললে, ‘সে-কথাও মিথ্যে নয়। আপনি লক্ষ্য না করলেও আমি দেখেছি, গেটের ভেতর ঢোকবার সময় দূরে একটি প্রিয়দর্শন যুবককে দু’জন লোক টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলেছে জঙ্গলের দিকে; সে কিছুতেই যাবে না, তারাও ছাড়বে না। মনে হলো, দয়ালচাঁদকে জিজ্ঞেস করি ওই সৌম্যমূর্ত্তি যুবকটি কে, কি ওর পরিচয়, এমন সময় দুটো ভীষণ কুকুর ছুটে এলো আমাদের দিকে, আমি আঁকড়ে ধরলুম আপনাকে। তারপর আমার মন আমায় জানিয়ে দিলে, উনি আর কেউ নন, নিশ্চয় কুমারবাহাদুর। অমন সুন্দর রূপ এ-বাড়ীর সাধারণ কর্ম্মচারীর হতে পারে না। দেখুন, সন্দেহ আমার মিথ্যে হয়নি। কিন্তু কাকাবাবু, এও আমি ব’লে রাখছি যে, বৈজুনাথ স্বভাব-পাগল নয়। কোনো-কিছু বিষাক্ত ওষুধ বা ওইরকম কোনো প্রক্রিয়ায় ওঁকে পাগল করা হয়েছে।… ঠিক পাগল নয়, মানে, অর্দ্ধোন্মাদ আর-কি। যাক, ওঁর আরোগ্যলাভ চিকিৎসাসাধ্য। উপযুক্ত চিকিৎসা আর সেবা-শুশ্রূষায় কুমারবাহাদুরের পাগলামী সেরে যেতে পারে।’

একটু ভেবে নিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাও, রায়বাহাদুর তাঁর ঐ একমাত্র ছেলের জন্যে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি?’

কৃষ্ণা বললে, ‘নিশ্চয় করেছেন, কারণ তিনি ওঁর পিতা আর প্রভূত ধনের অধিকারী। কিন্তু তবু আমি বলবো, বৈজুনাথের রোগের উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। রায়সাহেব বৃদ্ধ-অথর্ব্ব। এসময় বৈজুনাথ ছাড়া তাঁর ব্যবসা বা বিষয়-সম্পত্তি দেখবার আর নিজস্ব লোক কেউ নেই, জানি, কিন্তু হ’লে কি হবে, বাপ শুধু অজস্র অর্থব্যয়ই করে যাচ্ছেন। বিশ্বাসঘাতকরা ইচ্ছে করেই ভুল চিকিৎসা চালাচ্ছে এবং সেটা রায়সাহেবের অজ্ঞাতেই চলেছে। আমার ধারণা, এর মধ্যে নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র আছে তার ফলেই রত্না আজ ডাকাতের খপ্পরে।’

ব্যোমকেশ যে কৃষ্ণার কথাগুলো সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেননি, তা ওঁর হাসি আর মাথা দোলানো দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল।…

আকণ্ঠ আহারের পর ইনস্পেক্টরের বড় আলস্য এসেছে। তুড়ি দিতে-দিতে উনি ক্রমাগত হাই তুলছেন। আধখানা-চোখে চেয়ে আরো গোটা-দুই হাই তোলবার পর ব্যোমকেশ বললেন, ‘যাকগে ওসব কথা, এখন একটু বিশ্রাম করোগে কৃষ্ণা। নেহালসিং ব’লে দিয়েছেন, ফের চারটের সময় তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে। সন্ধ্যের সময় এখানকার পুলিশ-ইনস্পেক্টর আসবেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে…তার আগে আবার রায়সাহেবের হুকুম-মত দয়ালচাঁদ আসবে দেওঘরের চারদিক ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনবার জন্যে, ততক্ষণ আমরা খানিকটা বিশ্রাম করে নিই।’

ব্যোমকেশ উঠলেন, বাধ্য হয়ে কৃষ্ণাকেও উঠতে হলো।

পাশাপাশি দু’খানা ঘর। একখানা ব্যোমকেশের, আর-একখানা কৃষ্ণার। ব্যোমকেশ নিজের ঘরে ঢুকে দরজায় খিল আঁটলেন, কৃষ্ণার ঘরে ঢুকে কৃষ্ণা সুটকেশ থেকে একখানা এনভেলাপ আর চিঠির কাগজ বের ক’রে নিয়ে পত্র লিখতে বসলো। কলকাতার বাড়ীতে আছেন প্রণবেশ। এখানকার ঠিকানা দিয়ে নিরাপদে পৌঁছোনো সংবাদটা তাঁকে জানানো কৃষ্ণার অবশ্য-কর্ত্তব্য কাজ। সব কাজেরই ভবিষ্যৎ কৃষ্ণাকে বর্ত্তমানে ভেবে নিতে হয়। যে-কাজে হাত দিয়েছে সে, তাতে জীবন অনিশ্চিত। যে-কোনো মুহূর্ত্তে প্রলয়ের সম্ভাবনা। যদি সে দুর্দ্দিন আসে মামাকে সে চোখে দেখতে পাবে না?

চিঠি লেখা শেষ হলো। বন্ধ-দরজার বাইরে সাবধানী-হাতের মৃদু আঘাত-দরজা খোলার সঙ্কেত…

-‘কে?’

-‘আমি কৃষ্ণাদেবী।’…উত্তর আসে।

স্মরণে আসে ক্ষণিকের-শোনা পরিচিত-স্বরের সুর।

-‘আপনি দয়ালচাঁদবাবু তো? দাঁড়ান, খুলছি।’

খিল খুলে কৃষ্ণা বাইরে আসে।…’তারপর? হঠাৎ এমন অসময়ে এই ভরা- দুপুরে…জরুরী খবর কিছু আছে নাকি?’

-‘এমন কিছু না। খাওয়ার সময়ে আমি থাকতে পারিনি, ভাবলুম, দেখে আসি কি করছেন আপনারা-এই। অসুবিধে হচ্ছে না তো কিছু আপনাদের? ঘুমোননি এখনো? খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম করছেন ভেবে চলেই যাচ্ছিলুম, বিরক্ত করলুম শুধু-শুধু। মাপ করবেন।’

-‘না না, ক্ষমা চাইবার কি আছে এতে? কাকাবাবু ঘুমিয়েছেন, আমি একখানা পত্র লিখছিলুম। এসেছেন যদি দয়া ক’রে দয়ালবাবু, একটা উপকার করুন আমার। আপনার ওপরেই তো আমাদের সব ভার দিয়েছেন রায়বাহাদুর। এই চিঠিখানা কাউকে দিয়ে যদি ডাকে দেবার ব্যবস্থা করেন এখন!’

কৃতার্থ হয়ে যায় দয়ালচাঁদ; বলে, ‘সঙ্কোচ করবেন না কৃষ্ণাদেবী। আপনাদের হেপাজতের জন্যেই তো বহাল হয়েছি আমি। যখন যা প্রয়োজন হবে আপনাদের, বিশ্বস্ত ভৃত্য ভেবে তখনি আদেশ করবেন। দিন চিঠি। গাড়ী এখনো তুলিনি গ্যারাজে। এখুনি পোষ্টঅফিসের ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে আসছি।’

দয়ালচাঁদের হাতে পত্রখানা দিয়ে কৃষ্ণা নিশ্চিন্ত হলো।

ছয়

চারটে বাজতে দশ মিনিট। চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে বোবা-‘বয়’ ঢুকলো ব্যোমকেশের ঘরে। স্বরে বেশ একটু জোর দিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ‘উ-ঘরসে মায়ীজী-কো বোলাও!’

পাশের ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে ইসারায় হাত নেড়ে বোঝালে হাবা- চাকর…মাঈজী নিকাল গিয়া, কুঠরি তালা-বনধ হ্যায় সাব।

অগত্যা একা-একাই বৈকালিক-চায়ের সম্মান রেখে, দু’জনের চা কেক পুডিং ফলের ডিস উদরস্থ করে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ইনস্পেক্টরসাহেব চললেন নির্দ্দিষ্ট সময়ে এনগেজমেণ্ট রাখতে-নেহালসিংয়ের অফিস-রুমে।

এখন চারটে বেজে দশ। একটু দেরী হয়ে গেছে সুষ্ঠুভাবে চা-পর্ব্ব সুসম্পন্ন করতে ব্যোমকেশের। তা হোক, এমন কিছু বাঁধা মাইনের গোলাম নন উনি তাঁর।

নেহালসিংয়ের কিন্তু অভ্যর্থনার ত্রুটি নেই-‘আসুন-আসুন ইনস্পেক্টরবাবু, এতক্ষণ আপনার কথাই হচ্ছিলো এঁর সঙ্গে…ইনি হচ্ছেন এখানকার পুলিশ-অফিসার রামরাও, আর উনি সীতাপতি, আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে এঁরা অপেক্ষা করছেন… হ্যাঁ, ইনিই ব্যোমকেশবাবু।’…রামরাওজীর দিকে চোখ ফিরিয়ে রায়বাহাদুর কথা শেষ করলেন।

ব্যোমকেশ রামরাওকে অভিবাদন করলেন। প্রত্যভিবাদন জানিয় রামরাও বললেন, ‘অনেকদিন থেকেই আপনার নাম শুনে আসছি, কিন্তু সাক্ষাতের সৌভাগ্য এই আজ প্রথম হলো।…বসুন।’

ব্যোমকেশ বসেই বললেন, ‘ওটা আপনার সৌজন্য। নইলে দূরের পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশের সাক্ষাৎ হওয়াটা দুর্ভাগ্যেরই পরিচায়ক। অবশ্য আমাদের উভয়ের তরফ থেকে এ-মিলনে আনন্দ আছে প্রচুর, অ-পরিচয়ের কুণ্ঠা নেই কিছু, কিন্তু সাহায্যের জন্যে যে, আপনাকেই আমাদের প্রয়োজন আছে ষোলো আনা। যাক, এখানে আপনি পোষ্টিং হয়েছেন কতদিন?’

রামরাও বললেন, ‘বেশীদিন নয়, মাস-পাঁচেক। এর আগে ছিলাম-দুমকায়। সাঁওতাল পরগনার ঐ দুমকা-থানায় বেশ আরামেই ছিলাম স্যর। আর-এখানে? এখানে চোর-ডাকাতদের কর্ম্মনাশা অ-কাজ কু-কাজ আর আমাদের কাজ এত বেশী মাত্রায় বেড় চলেছে যে, নিশ্বাস ফেলবার সময় পাইনে। এই তো সেদিন ‘রোহিণী’তে যে ভীষণ ডাকাতিটা হয়ে গেল, তার ঠেলা সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি! তারপর রগড়ে-রগড়ে যেই একটা সূত্র আবিষ্কার করেছি, অমনি এঁর কেসটা হাতে এসে পড়লো-হ্যাঁ-হ্যাঁ, আসল কথাটাই বেমালুম ভুলে গেছি…কৃষ্ণাদেবী কৈ? সখের পুরুষ- গোয়েন্দা অনেকের সঙ্গেই একসঙ্গে কাজ করেছি, কৃতকার্য্যও হয়েছি, কিন্তু মেয়ে- গোয়েন্দা…বাঙালী মেয়ের এমন সৎসাহসের দুঃসাহসিক কাহিনী বাংলাদেশের রেকর্ড ব্রেক! স্কটল্যাণ্ড-ইয়ার্ডের মেয়েদের কথা ছেড়ে দিন, তাদের অনেক কিছু সুযোগ-সুবিধে আছে…প্রয়োজনে তারা পুরুষের সঙ্গে সমান পাল্লা দিয়ে কুস্তী লড়তেও পিছপা নয়, কিন্তু আমাদের দেশের জলহাওয়ায় পুষ্ট বাঙালী-মেয়ে কৃষ্ণাদেবীর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার কথা যা পত্রিকায় পড়ি, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়ার সুযোগ এসেও বিলম্ব হ’লে মনটা খুবই চঞ্চল হয় বৈকি। তিনি কৈ? রায়বাহাদুরের কথা অনুযায়ী আপনাদের উভয়কে এখন একসঙ্গে দেখবারই আশা করেছিলাম যে!’

-‘আপনার আশা অপূর্ণ থাকবে না ইনস্পেক্টর।’… নিজের মাতৃভাষায় এই কথা বলবার পর দরজার দিকে চেয়ে নেহালসিং আবার বললেন, ‘ঐ তো কৃষ্ণা মায়ী। ভেতরে এসো মায়ী, তোমার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যে আমাদের রামরাওজী আর সীতাপতি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এতক্ষণ ছিলে কোথায়?’

-‘আপনার বাগানে।’ বলে লজ্জিত বিনয়ে কুণ্ঠিত-পায়ে ধীরে-ধীরে এসে প্র্যতকেকে অভিবাদন জানিয়ে কৃষ্ণা বসলো ওঁদের সামনে। এসেছে কৃষ্ণা কিছুক্ষণ আগেই, এসে সোজা ঘরেই ঢুকতো ও, কিন্তু এতখানি আত্মপ্রশংসা শুনতে পেয়ে কোনো মনীষী বা বিদুষী হ্যা-হ্যা করে হাসতে-হাসতে বক্তার সামনে উপস্থিত হতে পারে না, তাই সঙ্কোচে আড়ষ্ট হয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল বাইরে দরজার পাশে।

প্রথমেই রায়বাহাদুরকে উদ্দেশ্য করে কৃষ্ণা বললে, ‘চমৎকার বাগান আপনার রায়সাহেব। দুপুরে কাকাবাবু যখন নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমুচ্ছিলেন সেই সময় আমি একবার আপনার বাগানটা প্রদক্ষিণ করে এলুম।…জানেন কাকাবাবু, নেকড়েবাঘের মতন সেই জাঁদরেল কুকুর দু’টোকে একজায়গায় বাঁধা দেখলুম, একেবারে নিরীহ-শান্ত। ঠিক যেন ভিজে বেড়াল।’ …ব্যোমকেশের দিকে ফিরে কৃষ্ণা কথা শেষ করলে।

ব্যোমকেশ কিছু বলবার আগে রায়বাহাদুর জবাব দিলেন-‘হ্যাঁ, ঐ ভিজে বেড়াল দুটোই নিস্তব্ধ-রাতে বাড়ী পাহারা দেবার সময় নেকড়েবাঘের রূপ ধ’রে ডাকুদের মনে আতঙ্ক জাগায়।’

কৃষ্ণা বললে, ‘যাই হোক, আপনার পছন্দ আছে রায়সাহেব। বেশ কুকুর। অষ্ট্রেলিয়া থেকে আনিয়েছেন বোধহয়?’

-‘না। ঐ কুকুর দু’টোকে আমার স্ত্রী এনেছেন। বিবাহের আগে আমার শ্বশুরমশাই খুব ধনী না থাকলেও একেবারে নিঃস্ব ছিলেন না, তিনিই ওদের কোথা থেকে আনিয়ে নিজের কাছে রেখে পালন করেছিলেন। ওরা এখানে এসেছে বোধহয় মাস দুই-তিন আগে।’

কুকুরের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে এতক্ষণ পরে পুলিশ-অফিসার রামরাওয়ের দিকে চেয়ে বিনীতভাবে কৃষ্ণা বললে, ‘একটু আগে আপনি আমায় এত সম্মান দিচ্ছিলেন যে, তার সিকির-সিকি পাবার যোগ্যতাও আমার নেই, তাই নিরুপায় অবস্থায় প’ড়ে আমি প্রথম-সাক্ষাতের ভদ্রতাটাকুও রক্ষা করতে পারিনি। ক্ষমা করবেন। বাইরে অপেক্ষা করবার সময় ‘রোহিনী’-ডাকাতির দু-একটা টুকরো ছিটকে আমার কানে এসেছিল, যদি অসুবিধে না হয়, পুরো কাহিনীটা বললে আমার চঞ্চল মনটাকে আবার বশে আনতে পারি।’

রামরাও বললেন, ‘আর বলেন কেন। দিন পনেরো আগে কোথাকার এক জমিদার সপরিবারে এসে ঐ রোহিণীতে বাস করছিলেন, তাঁর বাড়ীতেই এই সেদিন ভীষণ ডাকাতি হয়ে গেছে। শুধু ডাকাতিই-বা বলি কেন, দুর্ব্বৃত্তেরা জমিদারকে ধ’রে নিয়ে গিয়ে তাঁকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহটা রাস্তার ধারে একটা গাছের গুঁড়িতে দড়ি দিয়ে বেঁধে লটকে রেখে গেছলো। তার পরদিন ভোরে খবর পেয়েই আমরা সদলবলে ছুটলুম, ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ নামিয়ে পাতি-পাতি ক’রে খুঁজে শবদেহের পকেট থেকে বের করলুম একটুকরো কাগজ, তাতে লেখা আছে :

 ‘বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি’

…ব্যাস। আর কোনো কথা না। কাগজখানার কোণে লাল গোলাপফুল-আঁকা একটা চিহ্ন। সেরকম চিহ্ন রায়বাহাদুরকে লেখা প্রত্যেক উড়ো চিঠির কাগজের কোণে আছে।’

-‘লাল গোলাপ?’… ব্যোমকেশ অস্ফুট একটা শব্দ করেন!

উৎসুক হয়ে কৃষ্ণা বলে, ‘রোহিণীর সেই বাড়ীতে একবার নিয়ে যেতে পারেন মিঃ রাও? আমার মনে হয়, ওখানকার ঘটনার সঙ্গে এইসব ব্যাপারের খুব নিকট সম্পর্ক আছে!…

লাল চিহ্ন…লাল চিহ্ন…একবার সেখানে যেতে পারলে ভালো হতো।’

মহা উৎসাহে রামরাও বললেন, ‘নিশ্চয় পারি…এখুনি…বাইরে গাড়ী তৈরী।’

নেহালসিং বললেন, ‘এখুনি? ব্যোমকেশবাবুও এঁদের সঙ্গে যাবেন নাকি?’

মুখ-ভর্ত্তি একটা হাই তুলে ব্যোমকেশ বললেন-‘হ্যাঁ। মন্দ কি? জায়গাটা তবু একবার দেখে আসা যাবে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘একটু অপেক্ষা করুন মিঃ রাও, আমি তৈরী হয়ে আসি।’

মোটরের আরোহী-রামরাও, ব্যোমকেশ, সীতাপতি আর কৃষ্ণা।

কৃষ্ণা আর ব্যোমকেশ ভিতরে, বাইরে ড্রাইভারের সীটে রামরাওয়ের পাশে সীতাপতি! রামরাও গাড়ীতে বসেই ষ্টার্ট দিলেন। গাড়ী ছুটলো তীরবেগে।

ব্যোমকেশ সিগার ধরিয়েছেন।…এক-মুখ ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে বললেন, ‘ব্যাপারটা খুব জটিল-না কৃষ্ণা?’

কৃষ্ণা অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল, কাকাবাবুর কথা ঠিক বুঝতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে বললে, ‘কিছু বললেন আমায়?’

দারুণ বিরক্তির সঙ্গে ব্যোমকেশ বললেন, ‘তুমি যেন কী! বললুম না তো কি করলুম? বলি, প্রস্তুত হয়ে এসেছো তো?’

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা অন্য কথা পাড়লে, বললে, ‘দেখুন দেখুন কাকাবাবু, কি সুন্দর ঐ ধূম্র পাহাড়!…’

ব্যোমকেশ বললেন, ‘তুমি দেখ ঐ ধুম্ব পাহাড়! ধুমসো পাহাড় দেখে কাব্য করবার সময় আমার এখন নেই।’

কৃষ্ণা মিথ্যে বলেনি। দূরে উত্তর-দিগন্তে দৃষ্টি-সীমা আচ্ছন্ন করে ত্রিকূট-পাহাড়ের ঐ গুরুগম্ভীর রুদ্র-রূপ সত্যিই মনকে আকৃষ্ট করে। যেন ধ্যানমগ্ন ধূর্জ্জটি।… প্রণাম তোমায় হে শিবসুন্দর! তোমাকে দেখেই জীবলোক শ্রীভগবানের অস্তিত্ব ধারণা করতে পারে…সভক্তি অন্তরে তোমায় বারবার শুধু প্রণাম করে ধন্য হই…

মনে-মনে আবৃত্তি করে কৃষ্ণা হাত দুটি জোর করে কুমারী জীবনের আরাধ্য-দেবতা কল্পতরু শিবের উদ্দেশে নতি জানিয়ে, ব্যোমকেশকে বললে, ‘আমি শুনেছি কাকাবাবু, বুঝেছি আপনি যা বলতে চাইছেন।… আচ্ছা, এখানকার সবই তো আপনার জানা। কোথায় এলুম বলুন তো?’

কৃষ্ণা যে এখন এ-প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইছে সেটা বুঝতে না পেরে, আত্মমৰ্য্যাদায় আঘাত পেয়ে ব্যোমকেশ চুপ করে বসে রইলেন, সাড়া দিলেন না।

দীর্ঘপথ চলে এসে মোটর থামলো এবার।

রামরাও বললেন, ‘এই সেই ‘রোহিণী’। সহর থেকে অবশ্য রোহিণী খুব বেশীদূর পথ নয়, কিন্তু দুর্ব্বৃত্তদের দৃষ্টি থেকে আত্মগোপন করবার জন্যে আমাদের অনেকটা ঘুরে আসতে হয়েছে বলেই এত দেরী হলো। ঐ সেই বাড়ী। এবার আমাদের নামতে হবে।’

আগাছায় ভরা ঝোপঝাড়ের মধ্যে সরু পায়ে-চলার পথ। সন্তর্পণে পা ফেলে- ফেলে ওঁরা চারজন এগিয়ে গিয়ে সদরের কাছে পৌঁছোলেন যখন, সন্ধ্যা তখন এগিয়ে এসেছে বাড়ীর কোল ঘেঁষে।

উঃ! কি নিস্তব্ধ পরিস্থিতি! বিরাট খাঁ-খাঁ বাড়ীখানা যেন গিলতে আসছে…গ্রাস করতে আসছে এঁদের, বহুদিনের বুভুক্ষা মেটাতে।

রামরাও বললেন, ‘এ-বাড়ীটা বেশীর ভাগ সময় খালি পড়ে থাকে। এ-অঞ্চলের লোকেদের বিশ্বাস, এ-বাড়ীতে নাকি উপদেবতা আছে, তাই কেউ এসে টিকতে পারে না। যে-কোনো পরিবারের বাসের পক্ষে এখানে সাতদিন সময়ই যথেষ্ট। যে ভদ্রলোক অপঘাতে মারা গেলেন, তিনি ছিলেন তবু পনেরো দিন। পরিবারবর্গ বলতে সংসারে তাঁর স্ত্রী, তিনি নিজে, দু’জন নেপালী দরোয়ান, একজন রাঁধুনী আর দুটি দাস-দাসী। ডাকাতির রাত থেকে চাকরটা নিখোঁজ, আহত হয়ে দরোয়ান দু’জন হাসপাতালে গেছে। জীবিতের মধ্যে, আছেন জমিদার-গৃহিণী, তাঁর জন্যে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা আছে, তাঁর সঙ্গে আলাপ করলে অনেক-কিছু জানতে পারবেন কৃষ্ণাদেবী। পুলিশের সাজে আদের দেখে অনেক কথাই গোপন করে গেছেন তিনি। দেখুন, আপনি কথা বলে তাঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য আদায় করতে পারেন কি না!’

চার-পাঁচটা সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে ওঁরা একতলার বারান্দায় উঠলেন। বারান্দার সামনে বিরাট হলঘর। ডাইনে-বাঁয়ে আর দুটো ঘরে ঢোকবার দুটো প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড সাবেককালের বন্ধ-দরজা। সামনের ঘরটা খোলা। সেই হলঘরের মধ্যে বাঁদিকে পাঁচিলের আড়ালে ব’সে এক ভদ্রলোক টেবিলে ঝুঁকে নিবিষ্ট মনে কি যেন পড়ছিলেন। পিছনে আগন্তুকদের কলগুঞ্জনে সচকিত হয়ে মাথা তুললেন।

অতিমাত্রায় বিস্মিত ব্যোমকেশ সহসা চীৎকার করে উঠলেন-‘ধরমচাঁদবাবু?’

স্মিতহাসি হেসে ধরমচাঁদবাবু দু’হাত একবার কপালে ঠেকিয়েই ডান হাতটা প্রসারিত ক’রে দিলেন, ব্যোমকেশের দিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ব্যোমকেশ তাঁর করমর্দ্দন করবার পর সেই হাত এগিয়ে এলো, কৃষ্ণার সামনে। চকিতে কৃষ্ণা এক-পা পিছু হটে এলো, তারপর কি মনে ক’রে খাপসমেত রিভলভার-ধরা ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে প্রত্যভিবাদন জানালে ধরমচাঁদকে।

ঈষৎ অবজ্ঞায় ভুরু কুঁচকে মিষ্টি-হেসে ধরমচাঁদ বললেন, ‘তাই নাকি? বেশ, বেশ।’

সাত

রোহিণীর এই ডাকাত-পড়া বাড়ীতে যে ট্রেনের যাত্রী ধরমচাঁদকে দেখতে পাওয়া যাবে, ব্যোমকেশ বা কৃষ্ণা তা মোটেই ভাবতে পারেননি।

সহযাত্রী ব্যোমকেশ-কৃষ্ণা আর পুলিশ অফিসার সীতাপতি-রামরাওকে ধরমচাঁদ খুব খাতির করেই বসালেন, তারপর তাঁর স্বভালসুলভ মিষ্টি-হাসি হেসে বললেন, ‘কি সৌভাগ্য আমার! সূৰ্য্যাদয়ের আগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হলেও সূৰ্য্যাস্তের পর আবার আমরা একত্র হলুম। কিন্তু কি আশ্চর্য! পুলিশের এই দু’জন ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনারা এ-বাড়ীতে এসেছেন কেন? কোনো বিপদ ঘটেনি তো আপনাদের হৃদয়বাবু? ব্যাপার কি? আপনার ভাইঝির হাতে আবার কোষবদ্ধ আগ্নেয়াস্ত্র…কিছু বুঝতে পারছি না যে!’

হৃদয়বাবু ঘন-ঘন মাথা চুলকোতে থাকেন…উত্তর দেন রামরাও, বলেন, ‘হৃদয়বাবু কাকে বলছেন আপনি? উনি তো কলকাতা-পুলিশের একজন নামকরা অফিসার-ব্যোমকেশবাবু, আর ইনি-এঁর নাম সংবাদপত্র পাঠক-পাঠিকা প্রত্যেকেরই মুখস্থ হয়ে গেছে, ইনি হচ্ছেন একডাকে-চেনা মহিলা-ডিটেকটিভ-বাঙালীমেয়ে কৃষ্ণাদেবী।’

ধরমচাঁদ মস্ত-বড় হাঁ করে রামরাওজীর বাক্য-বায়ু সেবন করতে-করতে সহসা উচ্চ-হাসি হেসে ঘাড় নাড়লেন-‘না, না, না। এ হতে পারে না। কি ক’রে বিশ্বাস করি বলুন? ইনি নিজের মুখেই নিজের পরিচয় দিয়েছেন ইনি ব্যোমকেশ নন। এঁর সুটকেশের গায়ে ‘ব্যোমকেশ’ লেখা দেখে যখন পরিচয় জিগেস করেছিলুম-হ্যাঁ, আমার ঠিক মনে আছে, ইনি পরিচয় দিয়েছিলেন নিজেকে হৃদয় চাটার্জ্জী ব’লে, আর এঁর ভায়ের নাম বলেছিলেন…’ব্যোমকেশ’।… হৃদয়বাবু ভুল ক’রে ব্যোমকেশের সুটকেশটা এনে ফেলেছেন… সেটা নাকি এঁর চাকরের গাফিলতি। আপনি কি বলতে চান, সে সব মিথ্যে? ব্যাঙ্কের কেরানী হৃদয় চাটার্জ্জীর পরিচয়ে এত মিছে-কথা বলবার কি প্রয়োজন ছিল এঁর, বলুন?’

ব্যোমকেশের বিপন্ন মুখের দিকে চেয়ে এবার কৃষ্ণা কথা কইলে-‘কাকাবাবুর সঙ্গে আপনাদের এত কথা হয়ে গেছে ট্রেনে তা আমি জানতুম না। সে-সময়টা আমার একটু তন্দ্রা এসেছিল। এখন সব শুনে বুঝছি, কাকাবাবু ঠিকই করেছিলেন। একটা জরুরী কাজের সন্ধানে আসবার পথে আসার কারণ আর-কাউকে না বলে উনি বুদ্ধির কাজই করেছিলেন। যাক, আপনার প্রশ্নের জবাব তো পেলেন, এবার আমার একটা বিনীত নিবেদনের উত্তরে অকাট্য প্রমাণ দেখিয়ে যদি ‘ভাইস-ভারসা’ করেন তাহলে ‘ব্যালেন্স’টা ঠিক তুল্য-মূল্য হয়। আচ্ছা ধরমচাঁদবাবু, প্রভু শ্রীশ্রীবৈদ্যনাথজীউকে একবার দর্শন করে, বিভূতি নিয়ে ফিরে যাবেন আবার কর্ম্মস্থলে, এইরকম একটা স্বীকৃতি দিয়ে তারপর হঠাৎ এই ভূতুড়ে-বাড়ীতে গেঁথে গেছেন কেন ব’লে আমার কৃতজ্ঞভাজন হতে আপনার আপত্তি আছে কি?’

ধরমচাঁদ বললেন, ‘আপত্তি? না না, মোটেই না। শুনুন না মন দিয়ে। ওই পর্য্যন্ত শোনবার পর নিশ্চয়ই আপনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন ট্রেনে, এবং প্রাইভেট কোনো কাজে যাবার পথে পথের-সাথী যে-কেউ ক্ষণিকের বন্ধুর কাছে কেউই কোনো আসল উদ্দেশ্য প্রকাশ করে না তাই তখন যে-কথা বলা হয়নি, এখন বলছি। কথাটা হচ্ছে এই যে, আমার সেক্রেটারী জয়প্রকাশসিংয়ের সহোদরা এই বাড়ীতে বাস করবার সময় একদল ডাকাতের দ্বারা আক্রান্ত, আর তাঁর স্বামী ডাকাতদের হাতে নিহত হন।…এ সংবাদ আমরা গতকাল দুপুরে কলকাতায় বসে পেয়েছি এবং কালই সন্ধ্যার পর পাঞ্জাব-মেলে রওনা হয়েছি!…শুনলেন?’

এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে ব্যোমকেশ ধাঁ করে বলে ফেললেন, ‘বা রে বা! এসব কথা তো আপনি কিছুই বলেননি মশাই! আপনি তো শুধু বললেন-‘

ধরমচাঁদই-বা ছাড়বেন কেন, বললেন, ”শঠে শাঠ্যং” ব্যোমকেশবাবু; ‘বুদ্ধিং যস্য বলং তস্য।’ আপনি যেমন ব্যাঙ্কের ক্লার্ক, দু’চার দিনের জন্যে দেওঘরে বেড়াতে এসেছেন, আমিও তদ্রূপ দিল্লী যাওয়ার পথে বৈদ্যনাথজীউকে প্রণাম করতে এসেছি। তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আমি কাল যে-কোনো ট্রেনে দিল্লী চলে যাবো, আর দু’চার দিন এখানে থেকে তারপর জয়প্রকাশ তাঁর ভগ্নীকে নিয়ে দিল্লী যাবেন।’

রামরাও বললেন, ‘কিন্তু জয়প্রকাশবাবুর এখন এখান থেকে চলে যাওয়া অসম্ভব। ডাকাতদের আমরা ধরবার চেষ্টা করছি, তাদের গ্রেপ্তার না করা পর্য্যন্ত ওঁকে আমরা এখান থেকে এক পাও-‘

গম্ভীর ভাবে ধরমচাঁদ বললেন, ‘আগে ধরুন তো, তারপর না হয় উনি দিল্লী থেকে চলে আসবেন।’

কৃষ্ণা বললে, ‘আমি একবার আপনার সেক্রেটারীর ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করতে চাই, আশা করি এতে তাঁর আপত্তি হবে না।’

কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে ধরমচাঁদ বললেন, ‘কিন্তু তিনি যে খুব অসুস্থ, কৃষ্ণাদেবী! স্বামীর হঠাৎ অপঘাত-মৃত্যুর শোকে তিন-চার দিন তিনি বিছানা ছাড়েননি যে!’

কৃষ্ণা বললে, ‘এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এর আরো একটা দিক আছে। স্ত্রীলোক-বর্জ্জিত এই ভূতের বাড়ীতে এই বিপদে তাঁকে সান্ত্বনা দেবারও কেউ নেই, যা শুনলুম। এমন অবস্থায় তাঁর সঙ্গে দুটো কথা কইলেও হয়তো শোকের কিছু উপশম হতে পারে! দয়া ক’রে আপনি সেই ব্যবস্থাই করুন ধরমচাঁদবাবু, এ আমার অন্যায় প্রার্থনা নয়।’

স্বভাব-হাসি হেসে ধরমচাঁদ বললেন, ‘আপনার ‘উইল ফোর্স’-এর কাছে আমি পরাজয় স্বীকার করছি কৃষ্ণাদেবী! ‘প্রয়োজন’ না ব’লে, ‘প্রার্থনা’র কথা তুলে আপনি আমার মনুষ্যত্বের পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। আমি কাপুরুষ নই।’

ধরমচাঁদ টেবিলের উপরের কলিং-বেল টিপলেন। সেই মুহূর্ত্তে একটি লোকের সঙ্গে যিনি এসে দাঁড়ালেন তিনি জয়প্রকাশসিং।

ধরমচাঁদ জিগেস করলেন, ‘সাবিত্রী একটু সুস্থ হয়েছে কি জয়প্রকাশ? ইনি, মানে, কৃষ্ণাদেবী এখন একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চান। পুলিশের লোক এঁরা। এঁদের বাধা দেওয়ার অর্থ, আবার নতুন ক’রে বিপদ ডেকে আনা-হয়তো পরোয়ানা জারী করেই বসবেন।’ ব’লে, কৃষ্ণার দিকে চেয়ে উনি এবার নীরব-হাসি হাসলেন।

জয়প্রকাশ বললেন, ‘বেশ তো। ভীমের সঙ্গে ভেতরে গিয়ে উনি দেখে আসুন না সাবিত্রীকে। কিন্তু আমার অনুরোধ, সাবিত্রীর এ-অবস্থায় ডাকাতির সম্বন্ধে যেন কোনো জেরা না করা হয়। হঠাৎ এই ‘শকটা’ পেয়ে এমন অভিভূত হয়ে পড়েছে সে, এখন তাকে প্রশ্ন ক’রে উত্তেজিত করা চলবে না।’

একটু ভেবে ধরমচাঁদ বললেন, ‘তা তো ঠিকই।’ তারপর জয়প্রকাশের দিকে ফিরে আবার বললেন, ‘লছমনিয়া সব-সময় সাবিত্রীর কাছে-কাছে আছে তো?’

-‘আছে।’ ব’লে কৃষ্ণার দিকে ফিরে জয়প্রকাশ বললেন, ‘এই ভীমের সঙ্গে আপনি যান কৃষ্ণাদেবী, তার বর্ত্তমান অবস্থা দেখে আমি নিজেও তাকে কোনো কথা জিগেস করতে পারিনি। আপনি শিক্ষিতা মহিলা, তার এ-সময় যদি কিছু সান্ত্বনা দিতে পারেন চেষ্টা করবেন, এর বেশী আর কি বলবো।…ভীম, মিসিবাবাকে একবার নিয়ে যাও মায়ের কাছে।’

কৃষ্ণাকে সসম্ভ্রম অভিবাদন জানিয়ে ভীম বললে, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’

সদর-মহল পার হয়ে অন্দর-মহল। ভীমের পিছনে-পিছনে চলেছে কৃষ্ণা। হঠাৎ একটু থেমে ভীম জিগেস করলে, ‘আপনি বুঝি পুলিশের ডিটেকটিভ?’

কৃষ্ণা থমকে দাঁড়ালো, বললে, ‘কেন?’

ভীম বললে, ‘না, এমনি জিগেস করছি।’

কিশোর-গাইড ভীমের প্রশ্নে কৃষ্ণা শান্ত-কণ্ঠে জবাব দিলে, ‘না ভীম, আমি পুলিশের ডিটেকটিভ নই। তবে আমি ডিটেকটিভের কাজ করি বটে। সেটা আমার খুশির খেয়াল। পুলিশের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ভয় নেই তোমার, কিছু বলবার থাকলে নির্ভয়ে বলতে পারো। কেউ বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধার করবারই ব্রত নিয়েছি আমি।’

ভীম হাত কচলায়, বলে, ‘সত্যি? বলবো? বলবো মিসিবাবা, আপনাকে আমার দুঃখের কথা? বড় ভয় করছে যে!’

-‘তাহলে বোলো না।’ তখুনি মৃদু হেসে কৃষ্ণা আবার বললে, ‘আচ্ছা, তুমি এখানে কতদিন আছো ভীম?’

এমন মধুমাখা কণ্ঠস্বর এর আগে ভীম শোনেনি কখনো। বিপন্ন সন্তান যেন মায়ের অভয়বাণী শুনলে; বললে, ‘সামান্য দিন। খুব অল্প দিনই আমি এঁদের কাছে আছি মিসিবাবা। কিন্তু…কিন্তু…’

-‘থাক ভীম, আর তোমায় বলতে হবে না।’

-‘বলতে আপনার কাছে আমায় হবেই মিসিবাবা! এতটুকু সময় এখানে আর থাকতে ইচ্ছে নেই আমার। মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করি, পারি না। এখন বুঝছি এখনো পরমায়ু আছে আমার…নইলে এমন দেবীর দর্শন পেতুম না…এখন জানছি স্বয়ং বৈদ্যনাথজীউ আপনাকে পাঠিয়েছেন আমায় উদ্ধার করতে। রক্ষা করুন আমায়…আমার জীবন দান করুন মিসিবাবা…’

কৃষ্ণা বললে, ‘বড় শক্ত কাজ হাতে নিয়ে ফেলেছি ভীম, এর একটা সুরাহা হলেই তোমার জন্যে চেষ্টা করবো।’

হাত জোড় ক’রে কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়লো ভীম।

-‘বাঁ-দিকের এই খোলা-ঘরটা কার, ভীম? আর ওটা-তার পাশের ঘরটা?’…

-‘এ খোলা-ঘরটা সেক্রেটারী-সাহেবের।’

তারপর কে কোন ঘরে থাকেন, পরিচয় দিতে-দিতে ভীম ঘর দেখাতে-দেখাতে এগিয়ে চললো।

কৃষ্ণা বললে, ‘এই খোলা ঘরটার ভেতর আমি একবার যাবো ভীম? কিন্তু কেউ দেখলে আমার ক্ষতি হবে।’

-‘আমি এখানে পাহারা দিলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না মিসিবাবা, স্বচ্ছন্দে আপনি যেতে পারেন, এদিকে কেউ আসবে না এখন।’

আশ্বস্ত হয়ে কৃষ্ণা সেক্রেটারীর ঘরে ঢুকে, দু’মিনিটের মধ্যেই আবার বেরিয়ে এসে চলতে-চলতে কি বলতে যাচ্ছিলো, ভীম বললে, ‘আর কিছু এখন বলা চলবে না মিসিবাবা, আমরা এসে পড়েছি।’

 * * * * *

ভীম পরদা সরাতেই কৃষ্ণা ঢুকলো ঘরের ভিতরে। চমৎকার সাজানো ঘর। খানকয়েক আমেরিকান-উডের ধবধবে সাদা ফোল্ডিং-চেয়ারের মাঝে পশ্চিম দেশের জমিদারের আভিজাত্য বজায় রেখে একখানা চওড়া ফিতে-মোড়া পালিস-করা খাটিয়া রাখা আছে, তার উপর নরম তোষকের বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে যে মহিলাটি, ও নিশ্চয়ই সাবিত্রী, আর খাটিয়ার পাশের টুলে-লছমনিয়া। ঘরের দেয়ালে ডজন-তিনেক আন্দাজ হরবেরঙের ছোট-বড় দেব-দেবীর ছবি টাঙানো..ঘরের মাথায় কড়ি-বরগা চেপে ঘরজোড়া একখানা নক্সা-কাটা চাঁদোয়া…একটা টিপয়ে নানারকম ওষুধপত্রের শিশি, ফিডিংকাপ আর পাশের দেয়ালের বড় কুলুঙ্গিতে ঢাকনা-আঁটা একটা সোরাই। এই ঘরের আসবাব। কোনো ডেকরেটরের কাছ থেকে ভাড়া ক’রে আনা মনে হলো। বোধ হলো, যেন দৈনন্দিন যুদ্ধ-অবসানে রণশ্রান্ত সৈনিকের নিভৃত-বিলাস তাঁবুর অন্তঃপুরে এসে পড়েছে কৃষ্ণা।

লছমনিয়া হাত-পাখা দিয়ে রোগিণীর মাথায় ধীরে-ধীরে বাতাস করছিল। হঠাৎ কৃষ্ণকে দেখে, পাখা নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

কৃষ্ণা লছমনিয়াকে কিছু বলতে যাবার মুহূর্ত্তে ঠোঁটে আঙুল রেখে ও ইসারা করলে-চুপ।…বাইরে চলুন।

বাইরে বেরিয়ে কৃষ্ণা ভীমকে আর দেখতে পেলে না। বেচারা! দুঃখ-জর্জ্জর কিশোর ভীম কি চেয়েছিল কৃষ্ণার কাছে? মুক্তি? দেখা যাক…

লছমনিয়ার আপাদমস্তক তীক্ষ্ন-দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘উনি কি ঘুমিয়ে আছেন? না অসুখের ঘোর?’

লছমনিয়া বললে, ‘ঘুমও নয়, ঘোরও নয় বাই, বাবু নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁর আশা-পথ চেয়ে উনি নাওয়া-খাওয়া ত্যাগ করে কেবলই কাঁদতে থাকেন, তারপর তিন দিন পরে যখন শুনলেন, বাবুকে খুন ক’রে কারা গাছে ঝুলিয়ে রেখে গেছে, অমনি চীৎকার ক’রে উঠেই মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েন…সেই থেকেই অজ্ঞান… এখনো জ্ঞান ফিরে আসেনি।’

-‘সেই থেকে এখনো জ্ঞান হয়নি? ডাক্তাররা কি বলছেন? ডাক্তার দেখানো হচ্ছে তো?’

ভিজে গলায় লছমনিয়া বললে, ‘তা আর হচ্ছে না? কাল বাড়ীতে কেউ ছিলেন না, আমি বুদ্ধি ক’রে এখানকার বড় বাঙালী-ডাক্তার প্রসাদবাবুক ডেকে এনেছিলুম, তিনি পরীক্ষা ক’রে বললেন, মাথায় পক্ষাঘাত হয়েছে! শুনে ভয়ে আঁতকে মরি…সঙ্গে- সঙ্গে ‘তার’ করে দিই কলকাতায় ওঁর ভাই জয়প্রকাশসিং সাহেবকে…খবর পেয়েই সাহেব আর সাহেবের মুনীব ডাকগাড়ীতে চলে এসেছেন এখানে।’

…মুহূর্ত্ত নিস্তব্ধ থেকে কৃষ্ণা বললে, ‘আমি একবার দেখতে চাই ওঁকে।’

আতঙ্কিত-স্বরে লছমনিয়া বলে উঠলো, উঁহু! তাই কি হয় বাইসাহেবা? ডাক্তারসাহেবের বারণ যে! ওঁর ভাইকে পর্য্যন্ত ঘরে ঢুকতে মানা ক’রে গেছেন তিনি। তার চেয়ে আমি টুলটা আনি; টুলের ওপর ব’সে আপনি আমায় জিগেস করতে থাকুন, আমি যা জানি তা বলতে থাকি।…হ্যাঁ, তাই করুন। ওঁর কাছে যাবার কথাটি মুখে আনবেন না।’

দৃঢ়কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ‘এমন কথা তুমি আর মুখে এনো না। বাধা দিও না আমায়, আমি যাবোই ওঁর কাছে। আমি কে জানো? পুলিশের লোক..ওঁকে দেখতে এসেছি।’

-‘এ্যাঁ? পুলিশের লোক? আপনি পুলিশ? আপনি তো মেয়েমানুষ বাইসাহেবা! মেয়েমানুষ নাকি আবার পুলিশ হয়? আমায় মেয়েমানুষ পেয়ে, ভয় দেখাচ্ছেন?..তা দেখান, কিন্তু যেতে আমি কিছুতেই দেবো না আপনাকে ওঁর কাছে।’

এর মধ্যে ভীষণ ষড়যন্ত্র আছে বুঝে, ড্রেসিংগাউনের ভিতর হাত ঢুকিয়ে খাপসমেত রিভলভারটা বের ক’রে কৃষ্ণা একবার ওর মুখের সামনে লুফে নিলে, তারপর জোর ক’রে লছমনিয়াকে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকলো।

রোগিণীর মুখ যেদিকে ফেরানো ছিল, সেইদিকে গিয়ে দাঁড়ালো কৃষ্ণা।…কৈ অজ্ঞান? সাবিত্রী তো সাধারণ মানুষের মতই তাকিয়ে আছেন…চোখে পলক পড়ছে…কৃষ্ণার দিকে ওঁর অবিচল দৃষ্টি…মাঝে-মাঝে পল্লব নড়ে, কিন্তু মুখে কথা সরে না। আরো এগিয়ে গেল কৃষ্ণা…ওঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নরম-সুরে বারবার ডাকতে লাগলো, ‘সাবিত্রীদেবী! সাবিত্রীবাই!…’

সাবিত্রীদেবী নির্ব্বাক। ফ্যাল-ফ্যাল ক’রে শুধু তাকিয়ে থাকা আর শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া জীবনের কোনো লক্ষণই পাওয়া যায় না ওঁর।

এইসময় কৃষ্ণা একবার মুখ তুলে লছমনিয়ার দিকে চাইতেই, চাপা-হাসি সামলে নিয়ে লছমনিয়া বললে, ‘মিছে চেষ্টা করছেন বাইসাহেবা, ডাক্তারসাহেবের কড়া হুকুম-‘মাইজীকে নাড়াবে না…জিব বের করলেই সোরাই থেকে ঠাণ্ডা জল দেবে মুখে…সন্ধ্যের পর রোজ চলবে ইনজেকসান…’ বুঝলেন বাইসাহেবা? আগের কাজগুলো করতে হবে আমায়, আর ঠিক সময়ে এসে শেষকালে ঐ যে বললুম, ইনজেকসান, সেটা ফুঁড়বেন ডাক্তারসাহেব নিজে।’

কৃষ্ণা বললে, ‘ও। ইনজেকসানও চলছে তাহলে! কৈ, কোথায় ডাক্তার ইনজেকসান দিয়েছেন, দেখি?…হাতে?’

-‘না গো বাইসাহেবা, না, হাতে নয়-কাঁধে।..এই যে এই দেখুন না!’ বলে লছমনিয়া সাবিত্রীর কাঁধের কাপড়টা একটু সরিয়ে দিলে।

বিস্মিত-চোখে কৃষ্ণা দেখলে, পিঠের দিকে মাথার নীচে ঘাড়ের শিরদাঁড়ার পাশে ইনজেকসানের পরের চিহ্ন-টিঞ্চার-বেঞ্জুইনে-ভেজা বোরিক-তুলো একটু শুকিয়ে চামড়ার সঙ্গে এঁটে আছে।

স্তম্ভিত হয়ে যায় কৃষ্ণা, বুঝতে পারে, এই ইনজেকসান বেঁধার ফলেই জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও আচ্ছন্নের মত প’ড়ে আছেন সাবিত্রীদেবী। রামরাও সাবিত্রীর এ অবস্থার কথা জানেন না তাই বাইরের ঘরে আশা ক’রে বসে আছেন, রুগ্নার সঙ্গে কথা ক’য়ে তাঁর তদন্তের সুবিধের জন্যে অনেক-কিছু তথ্য সংগ্রহ ক’রে ফিরে গিয়ে আমি জানাবো তাঁকে। হায় ভগবান!

ব্যথিত-দৃষ্টিতে সাবিত্রীদেবীর দিকে একবার তাকিয়ে কৃষ্ণা আস্তে-আস্তে বাইরে বেরিয়ে আসে।

আট

রায়বাহাদুরের প্রাসাদে কৃষ্ণাকে পৌঁছে দিয়ে, সেই গাড়ীতেই ব্যোমকেশকে নিয়ে রামরাও থানায় গেলেন।

পুলিশের থানা-বাড়ীতে আজ ইনস্পেক্টর ব্যোমকেশকে নৈশ-আহারের নিমন্ত্রণ করেছেন রামরাও।…যাবার আগে কৃষ্ণাকেও অনুরোধ করলেন তাঁদের সঙ্গে যেতে…এই কেস সম্বন্ধে অনেক-কিছু গোপন পরামর্শ আছে জানালেন, কৃষ্ণা হাত জোড় ক’রে বললে, ‘আজ থাক স্যর, আর-একদিন যাবো, কিছু মনে করবেন না। সাবিত্রীদেবী আর লছমনিয়ার সম্বন্ধে যা জেনে এসেছি, এতক্ষণ শুনলেন তো সব? সেগুলো ডায়েরীতে লিখতে হবে, তাছাড়াও এমন কতকগুলো ব্যাপার জট পাকিয়ে রয়েছে মাথায়, যার গ্রন্থি খুলতে এখন নির্জ্জন জায়গা দরকার। কাজেই আজকের মতন আপনারা ক্ষমা করবেন আমায়। কাকাবাবু খুব সম্ভব আজ রাত্রে ফিরতে পারবেন না, না ফেরাই ভালো। যদি বেশী রাত হয়ে যায়, তবে যদি সুবিধে হয় জন-দুই কনেষ্টবলকে পাহারার জন্যে এখানে পাঠাতে পারেন।…আচ্ছা, আসুন, নমস্কার!’

-‘নিশ্চয়।…নিশ্চয়। আমি থানায় গিয়েই সে-ব্যবস্থা করছি।’…ব’লে ওঁদের দু’জনকে নিয়ে রামরাও গাড়ীতে উঠলেন।

লন পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হয়ে গেল! সুটকেশের ডালাটা খোলা। তালা-বন্ধ তার ঘরে আবার ঢুকেছিল কে? তখুনি মনে হলো, এ বাড়ীও তার নয়, আর চাবি-কুলুপও এ-বাড়ীর মালিকের। কাজেই সব-কিছু ঘটা সম্ভব এখানে। যাকগে।

সুটকেশের প্রত্যেক জিনিসটি কৃষ্ণা মিলিয়ে নিলে। সব ঠিক আছে। অনুসন্ধানকারী ছিঁচকে-টিকটিকির দুঃখে কৃষ্ণার মুখে হাসি ফুটলো, আর টানা-টানা ভাসা-ভাসা জলভরা চোখ দুটি ওর শুকিয়ে উঠলো-আহা, বেচারা! তার কাদা ঘাঁটাই শুধু সার হয়েছে।…

রিভলভার কৃষ্ণার সঙ্গে থাকে…জরুরী কাগজপত্র যা-কিছু সবই হাত-ব্যাগে ওর সঙ্গে-সঙ্গে ফেরে। এত কাঁচা মেয়ে কৃষ্ণা নয়।

দরজায় খিল-এঁটে, কৃষ্ণা ডায়েরী খুলে লিখতে বসলো সারাদিনের ঘটনাগুলো।

রোহিণীতে সে যা দেখে এসেছে, গাড়ীতে ব’সে সেই কাহিনী ব’লে ব্যোমকেশকে মোটেই খুশী করতে পারেনি। ব্যোমকেশ বিশ্বাস করতে পারেননি, সাবিত্রীদেবীকে শুধু ইনজেকসান দিয়েই এইরকম আচ্ছন্ন ক’রে রাখা হয়েছে। ও একটা রোগ। ব্যোমকেশ বলেছেন, ও-রোগকে ‘ব্রেণ-প্যারালিসিস’ বলে ডাক্তাররা। অতিরিক্ত ‘শক’ পেলে যে-কোনো লোকেরই এ-রোগ হতে পারে। এখানকার বড় ফিজিসিয়ান প্রসাদবাবু যখন দেখছেন, তখন খুব শীগগিরই উনি আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবেন।

ব্যোমকেশের এ যুক্তি কৃষ্ণা মেনে নিতে পারেনি।

আজ বিকেলে রায়বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে কৃষ্ণা শুনেছিল, তাঁর কার্ম্মাটারের কারখানায় শ্রমিকরা ধর্ম্মঘট করায়, তাদের শান্ত করবার জন্যে তিনি দয়ালচাঁদকে পাঠিয়েছেন সেখানে।

ডায়েরী খোলবার আগে চেয়ারে ব’সে ঝরণা-কলমটা ঠোঁটে কামড়ে কৃষ্ণা তন্ময় হয়ে ভাবছে।..হুঁ। দয়ালচাঁদ গেছে কার্ম্মাটারে…রত্না নিখোঁজ…চক্রান্তে আক্রান্ত অর্দ্ধোন্মাদ বৈজুনাথ…রায়সাহেবেরই শুধু পাগল হতে বাকি। এদিকে আবার কাকাবাবু, রামরাও-ইন্সপেক্টর হাতকড়ি বাগিয়ে অপেক্ষা করছেন, রহস্য প্রকাশ হলেই ‘কালপ্রিট’কে ওঁরা শৃঙ্খলিত করবেন। তা না হয় করুন, কিন্তু সে তো আসামী ধরা পড়বার পর। কিন্তু সমাধান হবে কি ক’রে এ রহস্যের? কৃষ্ণা ভাবছে। চিন্তার শেষ নেই…

রোহিণীতে ডাকাত-পড়া বাড়ীর অন্তঃপুরে সাবিত্রীদেবীকে দেখতে যাবার পথে ভীমকে জিগেস করতেই ভীম জয়প্রকাশের ঘরখানা যখন দেখিয়ে দিয়েছিল, জয়প্রকাশ তখন বাইরের হলঘরে ধরমচাঁদ আর রামরাওয়ের সঙ্গে এইসব আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। সেই ফাঁকে ভীমকে উদ্ধার করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে হাত ক’রে কৃষ্ণা জয়প্রকাশের ঘরে ঢুকে একখানা ডায়েরী পেয়েছিল। নিজের প্রয়োজনীয় যা-কিছু সব ডায়েরীতে লিখে কৃষ্ণা এবার জয়প্রকাশের সেই ডায়েরীখানা খুললে।

ও যা ভেবেছে ঠিক তাই! জয়প্রকাশের ডায়েরীতে লেখা আছে :

‘বিশ্বাসঘাতক বেনোয়ারীলাল, ‘মহেশ্বরীপ্রসাদ’ নাম নিয়ে বৈদ্যনাথধামে রোহিণীতে বাসা নিয়েছে শুনলাম। বেনোয়ারীলালের শাস্তি-মৃত্যু!’

আর এক জায়গায় লেখা আছে :

‘বেনোয়ারীলালের সঙ্গিনী হয়েছে-সাবিত্রী। বেশ বুঝেছি, এই মেয়েটিই তার সর্ব্বনাশ করেছে। পরম বিশ্বাসী আমাদের বন্ধুকে সে চরম শত্রু ক’রে তুলেছে। করুক, কিন্তু আমার নাম সত্যিই ধরমচাঁদ নয়-অমরনাথ। সাবিত্রীকেও এর উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে। বন্ধু বা শত্রু যে-কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করুক, অমরনাথের হাত থেকে তার রেহাই নেই জেনো।’

আর একখানা পাতায় :

‘হুঁশিয়ার জয়প্রকাশ! তুমি নারায়ণদাস আর আমি অমরনাথ, এ-কথা যদি কোনোদিন প্রকাশ পায়, জানবো সে তোমার কাজ। এ-কথা বেনোয়ারীলাল জানতো, তাকে সরিয়েছি। অমরনাথ তোমাকে বিশ্বাস করে। আমার সে-বিশ্বাসের মূলে তুমি কুড়ুল হেনো না!’

-সে কি? ধরমচাঁদই অমরনাথ? তবে কি-তবে কি…

আপাততঃ এ-চিন্তা স্থগিত রেখে কৃষ্ণা ডায়েরীর পাতা ওল্টাতে লাগলো।

প্রত্যেক পাতাতেই এইরকম টুকরো-টুকরো ইঙ্গিত। তা হোক, একটা রহস্য এতক্ষণে জলের মত স্বচ্ছ হয়ে গেল, যে, ধরমচাঁদই-অমরনাথ। আর অমরনাথের সহকর্ম্মী পরম বিশ্বাসী নারায়ণদাসই ওই জয়প্রকাশ।

অতঃপর? এরপর কৃষ্ণার করণীয় কি?…

-‘কে? দরজা ঠেলছো কে? নাম বলো।’

দরজার বাইরে ধাক্কার মাত্রা আরো বাড়তে থাকে। কৃষ্ণা আন্দাজ করে; বলে, ‘ও, তুমি-বয়?’ আবার ভাবে, চীৎকার বৃথা। কালা মানুষ…খাবার নিয়ে এসেছে…’দাঁড়াও, খুলছি।’

জয়প্রকাশের ডায়েরীখানা বিছানার তলায় লুকিয়ে রেখে কৃষ্ণা খিল খুলতে-খুলতে আপন মনেই বলতে থাকে-‘এত শীগগির খাবার আনবার এত তাড়া কেন রে বাপু? আচ্ছা কালার পাল্লায় পড়া গেছে যা-হোক। দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভাঙবে নাকি দরজাটা?…য়্যাঁ! আপনি? আপনি বৈজুনাথবাবু? আপনি হঠাৎ আমার ঘরে ঢুকছেন কেন? চলে যান! সরে যান এখান থেকে!’…বলেই কৃষ্ণা দরজা আবার বন্ধ করতে যাবার মুহূর্ত্তে জোরে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকে বৈজুনাথ দরজা বন্ধ করেই পিঠ দিয়ে বন্ধ-দরজা আটকে কৃষ্ণার দিকে চাইলে, তারপর ঠোঁটে আঙুল রেখে ইসারা করলে-চুপ।

বৈজুনাথের সেই মৌন-মূক ইঙ্গিতে যে কাতরতা ফুটে উঠলো তখন, তা কোনো পাগলের মুখেই কোনো নিপুণ শিল্পী তাঁর রং-তুলি দিয়ে জীবন্ত করে তুলতে পারবেন না কোনোদিন।

আজকের এ বৈজুনাথ উন্মাদ নয়, সুস্থ…প্রকৃতিস্থ…প্রত্যক্ষ।

হাঁপাতে-হাঁপাতে বৈজুনাথ বললে, ‘জানেন? আমি পালিয়ে এসেছি। ওরা আমার পেছনে দুটো প্রকাণ্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, ঐ টাইগার-লায়ন কামড়ে এখুনি আমায় ছিঁড়ে ফেলবে…শীগগির আলোটা নিবিয়ে দিন! রত্না হারাবার দিন থেকে কী যে আমার হলো, কুম্ভকর্ণের ঘুম আমায় পেয়ে বসলো…কেমন করে জাগলুম সব বলবো আপনাকে, এখন শীগগির আমায় লুকিয়ে ফেলুন-ঐ ওরা এসে পড়লো। এসে আপনার ঘরে আমায় দেখলে, আমায় তো ওরা শেষ করবেই, আপনাকেও রেহাই দেবে না। আপনাকে দেখুন আমি চিনতে পারছি, আপনি কৃষ্ণাদেবী! বুঝছেন তো, আমি সুস্থ? দোহাই কৃষ্ণাদেবী, আমায় বাঁচান…’

বাইরে বাগানে ক্ষুধিত-কুকুরের হিংস্র গর্জ্জন! ভিতরে চোখের সামনে ভয়ার্ত্ত অতিথি। কৃষ্ণা বুদ্ধিমতী। যা হবার পরে হবে। আপাততঃ ঐ বাথরুম। হ্যাঁ, একজন মৃত্যুপথযাত্রীকে বাঁচাবার জন্যে ঐ বাথরুমটাই এখন সুরক্ষিত দুর্গ।

কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি বৈজুনাথকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ ক’রে চাবি দিলে। তারপর বিদ্যুৎ-আলোর বোতামে টুক করে একটা শব্দ…নিরন্ধ্র অন্ধকার।

দূরে কুকুরের সেই গুরুগম্ভীর হুঙ্কার ক্রমে স্পষ্ট হয়…সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে বন্ধ-দরজায় কড়া-নাড়ার ঝনঝনানি বেসুরো-সুরে ঘন-ঘন ধ্বনিত হতে থাকে-‘কৃষ্ণাদেবী? কৃষ্ণাদেবী কি জেগে আছেন?’

ঘুম ভাঙতে যেটুকু সময় দেরি হওয়া উচিত, মাত্র সেই সময়টুকু ধৈর্য্য ধ’রে থেকে কৃষ্ণা জড়িত-স্বরে উত্তর দিলে-‘কে?’

-‘আমি কৃষ্ণাদেবী, আমি দয়ালচাঁদ। দরজা খুলুন…দেরি করবেন না…বিশেষ দরকার।’

-‘বিশেষ দরকার? সবুর করুন, এখুনি খুলছি।’ বলে টচ্চর্চ জ্বেলে কৃষ্ণা দরজা খুলে দিয়ে বিস্মিত-কণ্ঠে বলে, ‘ব্যাপার কি দয়ালবাবু? আপনি তো শুনিছি, কার্ম্মাটারে গেছেন। হঠাৎ কোথা থেকে এমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন? আপনার সঙ্গে আবার এরা কারা?…ব্যাপারটা কি বলুন তো? রায়সাহেবের কোনো বিপদ হয়নি তো?’

দয়ালচাঁদ বললে, ‘না, রায়বাহাদুরের নিজের উপস্থিত কিছু হয়নি, কিন্তু বৈজুনাথকে পাওয়া যাচ্ছে না…সেটাও অবশ্য রায়বাহাদুরের বিপদ ধরতে হবে! কার্ম্মাটার থেকে সন্ধ্যের পর ফিরেই শুনলুম, পাগল কোথায় পালিয়েছে। অত উঁচু জানলা টপকে পাগলটা যে পালালো, কোথায় গেল সে? কিম্বা ডাকুরা আবার কোনো নতুন মতলবে তাকে নিয়ে সরে পড়লো! কি হবে কৃষ্ণাদেবী? এত-বড় বাড়ী, বাগান সব তন্নতন্ন করে খুঁজলুম, কোথাও তার চিহ্ন নেই! ভাবলুম, যদি আপনার এদিকে এসে থাকে, তাছাড়া আপনার সঙ্গে এ-বিষয়ে একটা যুক্তি করা-মানে, তাকে এখন পাবার সম্বন্ধে আপনি যদি কোনো সুপরামর্শ দিতে পারেন, এই আর-কি! জানেন কিছু বৈজুনাথের খবর?’

-‘তা আর জানি না; খুব জানি।’ গম্ভীর-মুখে শ্লেষের ভঙ্গি এনে কৃষ্ণা বললে, ‘আমার ওই ড্রেসিংগাউন-অলেষ্টারের পকেটে বৈজুনাথবাবুকে লুকিয়ে রেখেছি আমি।…ছি, ছি দয়ালচাঁদবাবু, এই রাত্রে একজন ভদ্র-মেয়ের শোবার ঘরের বন্ধ-দরজায় ধাক্কা দিয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে এ-কথা জিগেস করতে আপনার শ্লীলতায় বাধলো না? আশ্চর্য্য! বৈজুনাথবাবু যুবক, তার ওপর পাগল। ভদ্রঘরের কোনো কুমারী-মেয়ের পক্ষে অপরিচিত একজন যুবককে রাত্রে তার নির্জ্জন শোবার ঘরে গোপন ক’রে রাখা সম্ভব কি না, এ বোঝবার যার ক্ষমতা নেই, তার সঙ্গে আর কথা কইতে ইচ্ছে করি না। এ-সম্বন্ধে কিছু জানবার সময় এখন নয়। প্রয়োজন হ’লে কাল রায়সাহেবকে বলবো। আচ্ছা, আসুন আজ।’

অপ্রতিভ দয়ালচাঁদ একেবারে নিবে গেল। তারপর ক্ষমা প্রার্থনা করবার জন্যে হাত-জোড় করছিল, এমন সময় ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে কৃষ্ণা আলো নিবিয়ে দিলে।

অগত্যা সঙ্গীদের নিয়ে অপমানিত দয়ালচাঁদ জ্বালা-টচ্চর্চ নিবিয়ে তাড়াতাড়ি অন্ধকারে গা ঢাকা দিলে।

নয়

-‘বৈজুনাথবাবু! বৈজুনাথবাবু?’ বাথরুমের দরজার চাবি খুলে ভেতরে মুখ বাড়াতেই ঘরের কোণ থেকে শঙ্কিত বৈজুনাথ বেরিয়ে আসবার মুখে কৃষ্ণা বাধা দেয়-‘আর একটু। খাবার নিয়ে এখুনি বয় আসবে। তার চলে-যাওয়া পর্য্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণ ‘টুঁ’ শব্দটি না। ঠিক সময়ে আমি ডাকবো।’

নিশ্বাস বন্ধ ক’রে বৈজুনাথ ঘাড় নেড়ে সায় দেয়। দরজা বন্ধ ক’রে চাবি দিয়ে কৃষ্ণা নিজের চেয়ারে এসে বসে।

কিছুক্ষণ পরে বোবা-কালা বয় খাবার নিয়ে এলো।

ইঙ্গিতে বয়কে টেবিলে খাবার রেখে যাওয়ার কথা বুঝিয়ে কৃষ্ণা জানিয়ে দিলে, এখন খিদে নেই, এরপর এক-সময় খাবে, এখন ও যেতে পারে।

অভিবাদন ক’রে বয় চলে যেতেই কৃষ্ণা আবার দরজা বন্ধ করলে। বাইরে নিশীথিনী নিস্তব্ধ। কুকুরের তর্জ্জন নেই, জনমানবের সাড়া নেই, কান পেতে শুনলে শুধু কৃষ্ণার শ্বাসপ্রশ্বাসের আর ওর রেডিয়ম-রিষ্টওয়াচের তিক-তিক মৃদু শব্দের সঙ্গে একটানা ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ-ঝিঁ এত-বড় পুরীটায় জীবনের স্পন্দন জাগিয়ে রেখেছে, বাকি সব চুপ।

বাথরুমের দরজার চাবি খুলে কৃষ্ণা বললে, ‘বেরিয়ে আসুন এবার।’

কাঁপতে-কাঁপতে বৈজুনাথ এ ঘরে আসতেই, খাবারের ঢাকা খুলে কৃষ্ণা বললে, ‘খুব শ্রান্ত আপনি, কিছু খেয়ে নিন আগে, তারপর সব শুনবো।’

বেশী ভণিতা না ক’রে বৈজুনাথ শুধু বলতে পারলে, ‘আর, আপনি? আপনি খাবেন না?’

-‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমিও খাবো। আমার জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না, আপনি আগে কিছু মুখে দিন। সারাদিন যে আপনি অভুক্ত আছেন তা আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আর কথা নয়। দেরী করবেন না আর। অনেক কথা আপনার কাছ থেকে জানবার আছে বলেই সব কথা স্থগিত রেখে আগে এখন আপনার খেয়ে নেয়া দরকার।’

আর দ্বিরুক্তি না ক’রে বৈজুনাথ খেতে সুরু করলে।

-‘আ-আ-আ! কতদিন যে এসব খাইনি কৃষ্ণাদেবী! দু’খানা পোড়া রুটি, কোনোদিন কাঁকর-সুদ্ধু লাল চালের আধসেদ্ধ ভাত আর জোলো ডাল একটু, রাত্রে তো প্রায়ই অনাহারে থাকতে হয় আমায়-‘

বাধা দেয় কৃষ্ণা, ‘থাক, থাক, পরে শুনবো। পেট ভরে আগে খেয়ে নিন আপনি। আমার এখন মোটে খিদে নেই। তবুও যা খাবো, সে আমি আলাদা তুলে রেখেছি।’

জলভরা-চোখে বৈজুনাথ নীরবে খাওয়া শেষ করলে।

এতক্ষণ পরে কৃষ্ণা এবার প্রশ্ন করলে, ‘আচ্ছা আপনাকে তো এখন বেশ সুস্থ দেখছি। আপনার বাবা কিম্বা মাকে কোনরকমে এ অত্যাচারের কথা জানাবার সুবিধে পাননি বোধহয়? তাঁরা এসব কিছুই জানেন না? তাঁরা কি খোঁজ রাখেন না আপনার সম্বন্ধে কিছু?’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বৈজুনাথ বললে, ‘মা? যাকে আমার মা বলছেন কৃষ্ণাদেবী, যত নষ্টের মূল তো সেই মেয়েটিই। গত বৎসর ভূপালে গিয়ে পিতাজী ওকে সঙ্গে নিয়ে আসেন, তারপর থেকেই পিতাজীর মনের অবস্থা বদলে যায়। যে-পিতাজী একদণ্ড আমাদের চোখের আড়াল করতেন না, তিনি আমাদের বিষ নয়নে দেখতে লাগলেন, আমার বোন রত্নাকেও তিনি-ও-হো-হো! রত্না! আমার দুর্ভাগিনী বোন!’

বৈজুনাথ আর বলতে পারে না, দু’চোখ বেয়ে ধারার পর ধারা নামতে থাকে। বাধা দেয় কৃষ্ণা, বলে, ‘থাক, নাহয় পরেই বলবেন।’

বৈজুনাথ বলে, ‘না, না কৃষ্ণাদেবী, এরপর আর বলবার সময় পাবো না হয়তো, যা শোনবার এখনই শুনে নিন। বলুন, আর কি জিগেস করবার আছে আপনার?’

কৃষ্ণা বললে, ‘শুনেছি এক বিবাহের নেমন্তন্ন রাখতে জেসিডি গিয়ে রত্নাদেবী আর ফিরে আসেননি। এ-কথা কি সত্যি?’

চোখের জল মুছে বৈজুনাথ বললে, ‘একথা আপনি বিশ্বাস করেন কৃষ্ণাদেবী? না, না, না। আমার ঐ বিমাতার ষড়যন্ত্রের ফলে, ট্রেন থেকেই রত্না চুরি হয়ে গেছে! আমিও ছিলুম সেই বগীতে। জেসিডি থেকে একসঙ্গেই আমরা ট্রেনে উঠি, তারপর কি জানি কেন হঠাৎ একেবারে মরণ-ঘুম এসে গেল আমার, যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলুম, কামরায় আমি একা। রত্না নেই!’

মুহূর্ত্ত চুপ করে থেকে বৈজুনাথ আবার বলে, ‘গত বছর নতুন-মা এ-বাড়ীতে পা দেওয়ার পর থেকে এমন ভাবে আমায় চোখে-চোখে রাখতে আরম্ভ করলে যে, সেই সন্দেহের দায় এড়াতে আমি বম্বে চলে যাই, আর সেখানকার সমস্ত কারবারের ভার নিজের হাতে নিই। নতুন-মায়ের কিন্তু তাও সহ্য হলো না। পরে এসে শুনেছি, সেইসময় মা পিতাজীর কানে আমার নামে এমন সব মিথ্যে কলঙ্কের কথা ব’লে-ব’লে বিষ ঢালতে সুরু করেছিল যে, যার ফলে আমার ঐ সৎমায়ের জ্ঞাতি-ভাই দয়ালচাঁদকে পিতাজী বম্বে পাঠালে আমায় ফিরিয়ে আনতে।’

-‘দয়ালচাঁদ?’ কৃষ্ণা আশ্চর্য হয়ে যায়, বলে, ‘তবে যে রায়সাহেব বললেন, তিনি নিজে গিয়ে বোম্বাই থেকে আপনাকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে এসেছেন? আর, দয়ালচাঁদের পরিচয় দিয়েছিলেন, সে তাঁর বন্ধুর ছেলে, ছোটবেলা থেকে তাকে মানুষ করেছেন?’

ম্লান-হাসি হেসে বৈজুনাথ বললে, ‘বলেছি তো, পিতাজীকে নতুন-মা মন্ত্রমুগ্ধ করেছে! ওঁকে দিয়ে যখন যা খুশি তাই করাচ্ছে! পিতাজী বুঝছেন সব, কিন্তু কিছুই করবার নেই তাঁর। নতুন-মার মোহে প’ড়ে আমাদের কাজ-কারবার সব যেতে বসেছে, সেদিকেও পিতাজীর ভ্রূক্ষেপ নেই।’

কৃষ্ণা বললে, ‘কিন্তু রত্নাদেবীকে রায়সাহেব নিশ্চয়ই আগের মতন সমান স্নেহ করতেন, কেমন-তাই না?’

ভাসা-ভাসা ভিজে-চোখে বৈজুনাথ জবাব দিলে, ‘হ্যাঁ, রত্নাকে পিতাজী খুবই ভালোবাসতেন, মা-হারা মেয়েকে যেমন প্রত্যেক হৃদয়বান পিতাই ভালোবেসে থাকেন। কারুর কথায় রত্নার মনে আঘাত লেগেছে শুনলে তাকে তিনি ক্ষমা করতেন না। সেইটেই তো হলো নতুন-মায়ের আক্রোশ! দু’একদিন রত্নাকে একটু কড়া কথা বলার পর পিতাজী নতুন-মাকেও ক্ষমা করতে পারেননি। তার পর থেকেই সৎমা’র বিষের ক্রিয়া সুরু হলো, আর সেই জন্যেই সে কৌশল করে রত্নাকে কোথায় সরিয়েছে তা একমাত্র বৈদ্যনাথজীউ জানেন!’

কৃষ্ণা বললে, ‘প্রায় চারদিন হলো আপনাদের বাড়ীতে এসেছি, এর মধ্যে একবারও তো আপনার নতুন-মাকে দেখতে পেলুম না বৈজুনাথবাবু?’

মলিন-হাসি হেসে বৈজুনাথ বললে, ‘কি জানি, হয়তো নেই এখানে। পিতাজীর সঙ্গে ঝগড়া-ঝাঁটি ক’রে হয়তো মামার বাড়ী চলে গেছে! আমি অসুস্থ হয়ে পড়বার কিছু আগে এরকম হতো, আমি জানি। এসব খবর রত্নার বিশ্বস্ত ছোকরা-চাকর ভীম আমায় গোপনে দিতো, তারপর এ-ক’দিন তাকেও দেখতে পাচ্ছি না! আমার বিশ্বাস, ভীমকেও নতুন-মা গুম করেছে। তাছাড়া আরো একটা কারণ থাকতে পারে; আপনাদের এখানে আসাটা নতুন-মা মোটেই পছন্দ করেনি। দিনকয়েক আগে এ-কথা ভীমের মুখ থেকেই শুনিছি আমি, তারপর থেকেই ভীম নিরুদ্দেশ!’

সাগ্রহে কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘ভীম কি রত্নাদেবীর চাকর? ভীম…ভীম…ও, আচ্ছা আপনার মামার বাড়ী কোথায়?’

বৈজুনাথ বললে, ‘মামার বাড়ী ভূপালে, কিন্তু নতুন-মা আসার সঙ্গে মামাবাবুও এখানে আসেন, আর পিতাজী কাষ্টারটাউনে তাঁকে একখানা বাড়ী দিয়ে রেখেছেন। নতুন-মা বোধহয় সেইখানেই চলে গেছে।’

-‘আচ্ছা বৈজুনাথবাবু, আমি যখন এখানে এলুম, তখন আপনি ঠিক এখনকার মত প্রকৃতিস্থ ছিলেন না, এ-কথা কি ঠিক?’

বৈজুনাথ বললে, ‘তা তো জানি না! চার-পাঁচ দিন আগে আমার রক্ষীরা জোর ক’রে আমায় টেনে নিয়ে গেল আমাদের ঐ বাগানটার কোণে একটা ডোবা আছে, সেইখানে। তারপর সে কি মার! আমিও সেই পচা ডোবায় নামবো না, তারাও ছাড়বে না। শেষপর্য্যন্ত সেই জলে নামিয়ে আমায় এমন চুবোন দিতে লাগলো, যার ফলে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললুম, তারপর তারা কখন সেখান থেকে এনে আমায় আবার গারদে পুরেছে মনে নেই, ফের জ্ঞান হতে দেখলুম, চার-পাঁচটা জোঁক আমার দু’পায়ে কামড়ে ধ’রে আছে! আঁৎকে উঠে পা-ঝাড়া দিতেই দেখি, সেই ফুলো-ফুলো জোঁকগুলো আমার পা থেকে খ’সে মাটিতে পড়ে গেল…আমার দেহের অনেক রক্ত চুষে খেয়ে জোঁকগুলো ফুলে-ফেঁপে একেবারে টইটুম্বুর! তারপর আমি অঘোরে ঘুমিয়ে পড়লুম। ওঃ, কৃষ্ণাদেবী, সে কি তৃপ্তির ঘুম! আপনি ঠিকই বলেছেন। দেহে জোঁক বসবার আগে যে অপ্রকৃতিস্থ ছিলুম, এখন সে-কথা ভাবতে পারি। কিন্তু সে-কথা যাক। যে-কোনরকমে এখন এখান থেকে আমায় নিয়ে চলুন কৃষ্ণাদেবী, আজ এই রাত্রেই আমার যাহয় কিছু ব্যবস্থা করুন; নইলে কাল সকালে ওরা আমায় দেখতে পেলেই হত্যা করবে! আমায় বাঁচান, আমার জীবন দান করুন, কৃষ্ণাদেবী!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনাকে ওরা হত্যা করলে কি আপনার পিতাজী সহ্য করবেন?’

অধীর ভাবে বৈজুনাথ বললে, ‘সে-কথা পিতাজী জানতে পারলে তো? আর জানলেই-বা কি করবেন তিনি? নিজে তিনি অথর্ব্ব, তার ওপর আছে নতুন-মায়ের কূট মন্ত্রণা! নতুন-মা’র ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে, ভয়ে যখন আমি বম্বে পালাই, সেইসময় পিতাজীকে সাবধান ক’রে দিয়ে গেছলুম, কিন্তু তিনি আমার সে-কথা বিশ্বাস করেননি, বরং আমার ওপর আরো বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। দোহাই আপনার কৃষ্ণাদেবী, যেমন করেই হোক, আজ রাত্রেই আমার একটা ব্যবস্থা করুন। একাই আমি পালাতে পারতুম, কিন্তু ক্রমাগত অত্যাচার সহ্য করার ফলে দেহ আমার নিস্তেজ-শক্তিহীন।’

ব’লে করুণ দৃষ্টিতে সাহায্য পাবার আশায় বৈজুনাথ কৃষ্ণার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে।

বেচারা বৈজুনাথ। ওর কথা ভাবতে কৃষ্ণার চোখেও জল আসে। কি নিষ্ঠুর বাপ! আর নিষ্ঠুরই-বা তাঁকে বলা যায় কি ক’রে! হতভাগ্য পিতা জানেনই না, চিকিৎসার নামে তাঁর ছেলের শুধু অচিকিৎসাই হচ্ছে। দুর্ব্বৃত্তেরা যা বোঝাচ্ছে, তাই বুঝছেন তিনি। একদিন হয়তো সব রহস্যই প্রকাশ পাবে, কিন্তু সেদিন তিনি সব হারিয়ে ব’সে আছেন! ক্ষণিকের মোহে দ্বিতীয়বার বিবাহ করে এনেছেন যে কাল-সাপিনীকে, তার হলাহল তাঁকে আকণ্ঠ পান করতেই হবে। হা ভগবান! কিন্তু এসব ভাবনা পরে। এখন কি ক’রে এই রাত্রে বৈজুনাথকে উদ্ধার করা যায়?..কেমন ক’রে?…

বাইরে সজাগ-প্রহরায় দুটো মস্ত ‘গ্রেট ডেন’ কুকুর। ওদের সামনে কেউ পড়লে তাকে টুকরো-টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেলবে! নিরুদ্দিষ্ট বৈজুনাথের সন্ধানে চক্রীরা আজ সবাই জেগে পাহারা দিচ্ছে, শহরের সর্ব্বত্র লোক ছুটেছে ওকে খুঁজে বের করতে! এ-অবস্থায় বৈজুনাথকে নিয়ে এখান থেকে পালানো-পালানো…’হ্যাঁ, দেখুন বৈজুনাথবাবু, আজ রাতটার মতন এখানে আপনাকে থাকতেই হবে। ভয় নেই আপনার, আপনাকে আমি তালা-বন্ধ ক’রে লুকিয়ে রাখবো এই ঘরে, তারপর সকাল হলেই আপনার উদ্ধারের ব্যবস্থা যা হয় একটা হয়ে যাবে।’

শঙ্কিত বৈজুনাথ বললে, ‘এখনো এদের বিশ্বাস করছেন কৃষ্ণাদেবী? আপনি বেরিয়ে গেলেই এরা অন্য-চাবি দিয়ে আপনার ঘর খুলে,-পিতাজী জানতে পারবার আগেই আমায় খুন করবে! না না, তা করবেন না। আজ, এখুনি আপনি আমায় বাঁচাবার উপায় ঠিক করুন! নইলে কাল সকালে আর আমার চিহ্নও থাকবে না!’

কথাটা যে মিথ্যে নয় তা কৃষ্ণা বুঝতে পারে। আজই বন্ধঘর খুলে ওর সুটকেশ লণ্ডভণ্ড করার কথাটা মনে পড়ে যায়…

চিন্তিত-মুখে কৃষ্ণা বললে, ‘আজ আপনি এই ঘরেই থাকুন তো! আমি কাকাবাবুর ঘরে শোবো, সারা রাত জেগেই থাকবো আমি। ভাববার কিছু নেই আপনার। কথা যখন দিচ্ছি তখন যেমন করে পারি উদ্ধার আপনাকে করবোই।’

ওকে আশ্বাস দিলেও কৃষ্ণা নিজে একটুও ভরসা পেলে না। কিন্তু আজ রাত্রে এ-ছাড়া আর কি করবার আছে?

নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে মাঝের দরজাটা খুলে, ব্যোমকেশের ঘরে ঢুকে কৃষ্ণা খিল এঁটে দিলে।

শ্রান্ত দেহ বিছানায় এলিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা ভাবছে…ভাবছে…

বাইরে তিন-চার জন লোকের পায়ের শব্দ শোনা যায়। সেই অন্ধকারে কৃষ্ণা হাতের রেডিয়ম-ঘড়িটা দেখে নিলে-বারোটা বেজে গেছে।

খুব সম্ভব ওগুলো দয়ালচাঁদের দলের লোকের পায়ের শব্দ! বৈজুনাথের সন্ধানে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন তারা ফিরে আসছে।

বাইরে ক্ষুধার্ত্ত দুটি প্রকাণ্ড কুকুর…সামনে কাউকে একবার দেখলে হয়! তাকে তো ছিঁড়ে ফেলবেই, উপরন্তু বাড়ীসুদ্ধু ঘুমন্ত লোককে সচেতন ক’রে তুলবে!

দয়ালচাঁদের উগ্র কণ্ঠস্বর শোনা যায়-‘যাবে কোথায়? হয় এই বাড়ীর কোথাও, না হয়, বাড়ীর বাইরে কোথাও-না-কোথাও আছেই আছে। যাক, রাতটা তো কাটুক, তারপর বাছাধন কোথায় ঘাপটি মেরে থাকে দেখা যাবে!’

আর-একজন কে বললে, ‘সরবতের সঙ্গে সেই ওষুধটা খাওয়াতে আজ আপনারাই তো বারণ করলেন কর্ত্তা! সেটা খাওয়ালে কি আর জ্ঞান আসতো, না পালাতে পারতো?’

দয়ালচাঁদের নিষ্ফল গর্জ্জন শোনা যায়-‘আচ্ছা, আচ্ছা, কাল দেখা যাবে!’…

তারপর তাদের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায় শূন্যে বায়ুস্তরে!

কৃষ্ণা তখনো ভাবছে…

দশ

রায়বাহাদুরের টাওয়ার ক্লকে শব্দ হলো-ঢং!

রাত্রি একটা।

আস্তে-আস্তে কৃষ্ণা উঠলো। এতক্ষণে উপায় একটা আবিষ্কার করেছে ও। কাকাবাবু আজ এ বাড়ীতে থাকলে কিন্তু খুব অসুবিধে হতো! যাক, কথা তো চাবি নিয়ে; ব্যোমকেশের সুটকেশের চাবির ডুপ্লিকেট-কৃষ্ণার চাবির রিঙেই আছে।

ঘরের মেঝেয় টচ্চের্চর আলো ফেলে-ফেলে এগিয়ে গিয়ে কৃষ্ণা ব্যোমকেশের সুটকেশের পাশে দাঁড়ালো। তারপর খুব সন্তর্পণে চাবি ঘুরিয়ে সুটকেশের ডালাটা তুলে একখানা খাতার নীচেই দেখলে, ঠিক রয়েছে সেই শিশি-ভর্ত্তি নিকেল-করা ছোট বাক্সটা। বাক্সটা বের ক’রে টেবিলের ওপর রেখে, ঢাকনা খুলে আলো ফেললে তার ওপর, তারপর সাবধানে একটি-একটি করে শিশির গায়ের লেবল প’ড়ে, দরকারি শিশি দুটো টেবিলে রেখে, বাকিগুলো কৃষ্ণা বাক্স-বন্দী করে তুলে ফেললে।

এখন হাসবার সময় নয়, তবু হাসি আসে! কলকাতা থেকে আসার আগে সুটকেশ গুছোবার সময় এই নিকেল-বাক্সটা সঙ্গে নিতে বলায় কাকাবাবুর সে কি রাগ! ব্যোমকেশ বলেছিলেন, ‘গুচ্ছির বাজে জিনিসে সুটকেশ বোঝাই কোরো না কৃষ্ণা!’ কৃষ্ণা বলেছিল, ‘কি যে বলেন কাকাবাবু, এইটুকু একটা বাক্স এতে নিলে কি এমন বোঝা বাড়বে? দরকার না লাগে, ফিরিয়ে আনলেই হবে!’ ব্যোমকেশ বলেছিলেন, ‘বেশ, নাও, শেষপর্য্যন্ত দেখো, ফিরিয়েই আনতে হবে।’ কৃষ্ণা আর কথা না বাড়িয়ে ভাগ্যিস এনেছিল বাক্সটা! আর ভাগ্যে আজ কাকাবাবু উপস্থিত নেই এখানে! থাকলে হয়তো জেদ বজায় রাখতে, কাজে লাগাতে দিতেন না এগুলো।

শিশি দুটো হাতে নিয়ে, মেঝেয় টচ্চের্চর আলো ফেলে কৃষ্ণা এগিয়ে চললো। তারপর দুটো ঘরের মাঝখানের দরজাটা আস্তে-আস্তে খুলে নিজের ঘরে ঢুকে দেখলে, পরিশ্রান্ত বৈজুনাথের নাক ডাকছে। বেচারা! কৃষ্ণার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে নিশ্চিন্ত আরামে বৈজুনাথ গভীর ঘুমে ডুবে আছে। আহা, ঘুমোক! ঘুমোক!…

আর-একটু এগিয়ে দেয়ালের পাশে মিটসেফ। বিকেলের খাবার আজ কৃষ্ণা খায়নি, যেমন তেমনি বন্ধ করা আছে মিটসেফে। ওইটের তাক থেকে সন্দেশের ডিস বের ক’রে, সাবধানী-হাতে এক-একটি শিশি থেকে চার ফোঁটা ক’রে তীব্র বিষ প্রত্যেক সন্দেশটির ওপর ফেলে, টচ্চর্চ নিবিয়ে কৃষ্ণা দাঁড়ালো এসে জানলার ধারে :

-‘ঘেউ! ঘেউ!…ঘ্যেউ! ঘ্যেউ!…’

জানলা খোলার শব্দ পেয়ে ছুটে এসেছে টাইগার অর লায়ন!

সেই মুহূর্ত্তে অতি সাবধানে আলতো রুমালে জড়িয়ে দুটো সন্দেশ টাইগারের দিকে তাগ ক’রে ছুঁড়ে ফেলে, রুমালটা সরিয়ে এনে, আর-দুটো ওইভাবে লায়নের দিকে টিপ করে ফেলে দিলে কৃষ্ণা।

দুটো কুকুরই লাফ দিয়ে দু’ভাগ সন্দেশের পাশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো, তারপর একে অন্যকে খেতে না দিয়ে একা খাবার মতলবে দুটি বিরুদ্ধ-শক্তির সে কি সংঘর্ষ! কিন্তু অত যে ঝটাপটি মারামারি, এক লহমার মধ্যেই আবার কী ভাব-যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে মুখ নেড়ে-নেড়ে যে যার ভাগের সন্দেশ খেয়ে, পূর্ণ তৃপ্তির সঙ্গে জিব বের ক’রে সেখানকার মাটি পর্য্যন্ত লেহন করতে লাগলো…অল্প জানলা খুলে একাগ্র মনে অপলকে কৃষ্ণা এসব দেখলে। এবার বিষের ক্রিয়ার পরীক্ষা নিতে হবে।

সেই জমাট অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে, হাতে-বাঁধা রেডিয়ম-ঘড়িটার বিট গুণতে লাগলো কৃষ্ণা-এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সা-আত…

লায়ন টলছে…টাইগার গোঙাচ্ছে…বাইরের ঐ অল্প ঝাপসা-আলোয় এর বেশী আর কি দেখবে কৃষ্ণা? টচ্চের্চর মুখে হাত চাপা দিয়ে ও সুইচ টিপলে। হ্যাঁ, দুটো কুকুরই মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। ওদের মুখে ফেনার বুজকুড়ি! কিছুক্ষণ ছটফটানির পরেই চুপ!

টাইগার আর লায়ন নিঃসাড় হয়ে গেছে দেখে, টচ্চর্চ নিবিয়ে কৃষ্ণা জানলা বন্ধ করে, আন্দাজ ক’রে, ক’রে বৈজুনাথের বিছানার ধারে এসে আবার টচ্চর্চ জ্বাললে- ‘বৈজুবাবু!’ ব্যগ্র কণ্ঠে কৃষ্ণা ঢাকলে, ‘বৈজুনাথবাবু?’

ঘুম ভেঙে উঠেই বৈজুনাথ চমকে যায়, বলে-‘কে? কে?’

-‘আমি, আমি, আমি কৃষ্ণা। শীগগির উঠে আসুন, এখুনি আমাদের পালাতে হবে!’

-‘পালাতে হবে? একখুনি?’ বৈজুনাথ যেন আকাশ থেকে পড়ে!

-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই মুহূর্ত্তে। এ-সুযোগ ছেড়ে দিলে এরপর আপনার অপঘাত-মৃত্যু নিশ্চিত। উঠুন, আর দেরী করবেন না।’

বৈজুনাথ বললে, ‘পালাবো তো, কিন্তু বাইরে কুকুর দুটো আছে যে!’

একটু হেসে কৃষ্ণা বললে, ‘তারা এতক্ষণ জীবন-নদীর খেয়া পার হয়ে গেছে! সে-সব কথা পরে শুনবেন। তবে কুকুর না থাকলেও, দারোয়ানরা এখনো পাহারা দিচ্ছে। আমাদের পালাতে হবে ঐ পাঁচিলটা ডিঙিয়ে!’

দরকারি জিনিসগুলো হাত-ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে, ফিতে দিয়ে কৃষ্ণা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলে, তারপর হতবুদ্ধি বৈজুনাথকে একরকম জোর ক’রে টেনে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে পা টিপে-টিপে টচ্চর্চ হাতে এগিয়ে চলেছে কৃষ্ণা, পিছনে বৈজুনাথ। পাঁচিলের দিকে যাওয়ার সময় মরা কুকুর দুটোর ওপর একবার টচ্চের্চর আলো ফেলতেই বৈজুনাথ চমকে উঠলো-‘একি?’

কৃষ্ণা বললে, ‘ঐ তো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হয়ে দুটো জীব-হত্যা করতে হয়েছে শুধু আপনার জন্যে। যাক, এদিককার লাইন এখন ক্লীয়ার! আসুন, এবার পাঁচিলে উঠতে হবে।’

-‘পাঁচিলে? অত উঁচু পাঁচিলে আমি উঠবো কি ক’রে কৃষ্ণাদেবী! ধ’রে ওঠবার মত কিছু পেলে হয়তো চেষ্টা করতে পারি।’

ধমক দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘হ্যাঁ, আপনার জন্যে একখানা মই নিয়ে আসি ঘাড়ে ক’রে, আপনি ধ’রে-ধ’রে উঠবেন! দেখুন, বাজে কথা কইবার সময় নেই এখন। যা বলছি, হয় শুনুন, নইলে থাকুন এইখানে প’ড়ে, আমি পালাই।’

অসহায়ের মত বৈজুনাথ বললে, ‘রাগ করবেন না কৃষ্ণাদেবী, সত্যি এত উঁচুতে উঠতে পারবো না কিছু অবলম্বন না পেলে!…অভ্যেস নেই তো!’

-‘তাহ’লে যা বলছি শুনুন।’…বলে ব্যাগ থেকে ষ্টিলের একগাছা সরু পাকানো জাহাজী-তার বের ক’রে বৈজুনাথের হাতে দিলে-‘পাঁচিলের গা ঘেঁষে, এই যে গাছটা উঠে গেছে, আস্তে-আস্তে এর ওপর উঠে গিয়ে একটা মজবুত ডালে বেশ করে পাকিয়ে বেঁধে, তারের অপর-দিকটা পাঁচিলের ওপাশে ঝুলিয়ে দিন, তারপর সেই ঝোলা-তার ধ’রে ধীরে-ধীরে ওধারে নেমে যান। আপনি নামবার পর ওইভাবে আমিও নামবো।’

নিরুপায় বৈজুনাথের সর্ব্বাঙ্গ কাঁপতে থাকে। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কি? কাঁপতে-কাঁপতেই অতঃপর গাছে উঠতে থাকে…কৃষ্ণা সাহস দেয়…হ্যাঁ, বৈজুনাথের সাহস আছে। মাঝে-মাঝে আচ্ছন্নের মত থামলেও শেষপর্য্যন্ত গাছে উঠে, কৃষ্ণার নির্দ্দেশমত সব কাজগুলোই বেশ সুচারু-রূপে সম্পন্ন করতে পেরেছে বৈজুনাথ। ঝোলা তার ধ’রে এতক্ষণ নিশ্চয়ই ওপাশের মাটিতে নেমে পড়েছে বৈজুবাবু।

নিজের কাপড়টা বেশ আঁট-সাঁট করে জড়িয়ে, গুছিয়ে প’রে নিয়ে কৃষ্ণা গাছ বেয়ে উঠতে থাকে, বুঝতে পারে, বৈজুনাথকে ধমক দিলেও কাজটা খুব সোজা নয়! কৃষ্ণা গাছে উঠলো…হালকা তারটা হাতে নিয়ে বুঝলে, বৈজুনাথ ওপাশে পৌঁছে গেছে। হাতের কব্জিতে তারের এক-পাক জড়িয়ে তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ও ঝুপ করে ঝুলে পড়লো!

এগারো

অত উঁচু গাছ থেকে সরু তার বেয়ে নীচে নামা সহজ কথা নয়! সেই ঝোলা অবস্থায় ডান-হাতে তারটা পাকিয়ে একটু থেমে, বাঁ-হাতে নীচের তারে আর-এক পাক দিয়ে, তারপর ডান-হাতটা খুলে, আবার হাত বদলে নামতে নামতে কৃষ্ণা যেই মাটিতে পা দিয়েছে, অমনি পিছন থেকে সহসা দুটো শক্ত হাত এসে ওর গলা চেপে ধরলে!

প্রায় দম বন্ধ হয় এমন সময় সেই হাতের অদৃশ্য মালিকের স্বর জেগে উঠলো-‘খুব চালাকি-বুদ্ধি খাটিয়েছো ধুরন্ধর মেয়ে-চমৎকার! এখন লক্ষ্মীটির মতন চট ক’রে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ো তো মেয়ে-ডিটেকটিভ?’

এত সহজে কৃষ্ণা ধরা দেয় না। কিন্তু এখন আর কি করবে ও? তবুও খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তি করলে, তারপর নাকে শ্বাসরোধকারী উগ্রগন্ধী রুমাল চেপে ধরতেই ওর সংজ্ঞা লোপ হলো! কৃষ্ণাকে ক্লোরোফর্ম্ম করলে অদৃশ্য-শত্রুরা!

কতক্ষণ এ-অবস্থায় ছিল কৃষ্ণা জানে না, জ্ঞান ফিরলো অবিরাম ঘড়ঘড়ঘড়ঘড়- ধ্বনির আলোড়ন-বিলোড়নে!…বন্দিনী কৃষ্ণা এরোপ্লেনে উড়ছে!…

ধড়মড় করে উঠে বসবার উপক্রম করতেই একজন বাধা দিলে, ‘উঠবেন না, উঠবেন না, এইমাত্র আপনার জ্ঞান ফিরেছে। এখন ওঠবার চেষ্টা করলেই প’ড়ে যাবেন…প্লেনখানা কিরকম দোল খাচ্ছে, বুঝছেন তো?’

কৃষ্ণা বুঝলে, বুঝে মুখ ফিরিয়ে আবার শুয়ে পড়লো।

-‘এইদিকে একবার ফিরুন তো? মুখে-চোখে আপনার জলের ছিটে দেবো।’

বাধা দেয় কৃষ্ণা, ক্ষীণকণ্ঠে বলে, ‘থাক, দরকার নেই!’

আর-একজন কে আদেশের সুরে ব’লে উঠলো, ‘জলের মগ রেখে দাও রামদীন, আর দরকার হবে না। তুমি সীটে বোসো।’

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে কৃষ্ণা সেইদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলে, ওর কাছে ব’সে আছেন, মাথায়-পাগড়ি ধরমচাঁদবাবু।

অবাক-বিস্ময়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘এখানেও আপনি? কিন্তু আমায় নিয়ে চলেছেন কোথায় ধরমচাঁদবাবু? আপনার উদ্দেশ্য কি?’

-‘সবই ক্রমে জানতে পারবেন কৃষ্ণাদেবী, আগে সুস্থ হোন একটু।’

-‘বেশ সুস্থ আছি এখন আমি। অনায়াসে আপনি বলতে পারেন, যদি আপত্তি না থাকে।’

-‘আপত্তি তো থাকতেই পারে। তবুও শুনুন, আপাতত আপনাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-ভূপালে।’

আর্ত্তনাদ ক’রে ওঠে কৃষ্ণা-‘ভূপালে? কেন?’

শান্ত-স্বরে ধরমচাঁদ বললেন, ‘ভূপাল শুনেই ভয় পাবেন না! দেওঘরে আপনার থাকাটা আমাদের অমরনাথবাবু পছন্দ করেন না কিনা; তাই। সামান্য দিনের জন্যেই হয়তো বন্দিনী থাকতে হবে আপনাকে, তারপর আমাদের কাজ মিটে গেলেই তিনি মুক্তি দেবেন মনে হয়। আপনি কুমারী হলেও, চিরদিনের জন্যে আপনাকে আটক করা তো সোজা নয়! কী অসাধারণ বুদ্ধি আপনার! আমাদের অমরনাথবাবু যেমন মেধাবী, আপনিও তাঁর চেয়ে কম বুদ্ধিমতী নন। মানে, ‘যোগ্যং যোগ্যেন যুজ্যতে!’ তবুও আপনার ভয় পাবার কিছু নেই। চরিত্রবান হিসেবে বিশ্বাস করতে পারেন তাঁকে।’

ইঙ্গিতটা ইতরের মত হলেও কৃষ্ণা রাগ সামলে নিলে; বললে, ‘এইটুকু সময়ের মধ্যে অমরনাথবাবুর নাম আপনার মুখে বহুবার শুনলুম। এখন দয়া ক’রে বলুন তো ধরমচাঁদবাবু, আপনি আর অমরনাথবাবু, আপনারা দু’জন কি একই লোক?’

-‘এ-রকম অভিধান ছাড়া আজগবী প্রশ্নের কারণ?’

-‘কারণ, আমার দেওঘরে থাকাটা অমরনাথবাবুর পছন্দ না হলেও, আপনার কথার ভাবে মনে হচ্ছে, স্বয়ং আমাকে বোধহয় তাঁর খুব অপছন্দ হয়নি। অথচ তিনি বা আমি এখনো কেউ কাউকে চোখে দেখিনি! এদিকে অমরনাথবাবুর মনের ভেতর তলিয়ে দেখে আপনি নিশ্চিত হয়েছেন যে, চিরদিনের জন্যে আমায় বন্দিনী করবার তাঁর ইচ্ছে থাকলেও, উদারতা দেখিয়ে তিনি আমায় মুক্তি দেবেন,-আমি তাঁকে বিশ্বাস করতে পারি! আশ্চর্য্য!’

-‘আরো আশ্চর্য্য হবেন’-হাতঘড়িতে সময়টা দেখে নিয়ে ধরমচাঁদ বললেন, ‘আরো আশ্চর্য্য হবেন একটু পরেই অমরনাথবাবুকে দেখে। তবে অনুমান আপনার মিথ্যে নয়। সত্যিই তাঁর মনের খবর আমি জানি কৃষ্ণাদেবী!’

কানে তালা-লাগার মত বিকট শব্দ করতে-করতে পাক খেয়ে খেয়ে প্লেনখানা নীচের দিকে নামতে থাকে। দেখতে-দেখতে উড়োজাহাজটা মাটিতে নামতেই ওদের দলের নিজস্ব যাত্রীরা নামলো প্রথমে, তারপর কৃষ্ণাকে নিয়ে নামলেন ধরমচাঁদ।

পাইলট জিগেস করলে, ‘প্লেনখানা কি এখন এখানেই থাকবে?’

ধরমচাঁদ বললেন, ‘না। এখন হ্যাঙ্গারে রাখো, দরকার হ’লে বলবো।’

আগের লোকেরা আলো নিয়ে এগিয়ে চললো, তার পিছনে কৃষ্ণাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে-যেতে ধরমচাঁদ বললেন, ‘প্লেনটা অমরনাথবাবুর নিজের। তাঁর নামে লাইসেন্স করার অসুবিধে আছে বলে তিনি আবুর নামেই লাইসেন্স করিয়েছেন, আবুই সব-সময় প্লেন নিয়ে যাওয়া-আসা করে।…একটু সাবধানে আসুন কৃষ্ণাদেবী, এখানটা খুব উঁচু-নীচু আছে।’

মাঠটা পার হতেই সামনে উঁচু পাঁচিল-ঘেরা প্রকাণ্ড বাড়ীর ফটক। অত বড় গেটের মাথায় মিটমিট করে জ্বলছে একটা ঝোলা-লণ্ঠন! আলো-হাতে প্রভুর দলের লোকদের আর ধরমচাঁদকে দেখে প্রহরীরা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালো।

ধরমচাঁদ বললেন, ‘এই বাড়ীতেই আপনি থাকবেন কৃষ্ণাদেবী।’

কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘আর আপনি?’

ধরমচাঁদ বললেন, ‘আমি অন্য জায়গায় থাকি। তাহ’লেও আপনার চিন্তার কারণ নেই, কারণ, আরো একটি মেয়েকে আপনি পাবেন এখানে। মোট কথা, আপনার অসুবিধে হবে না কিছু। এখন চলুন, আগে আপনার আজগবী সন্দেহটা মিটিয়ে দিই। এই বাড়ীতেই অমরনাথবাবুর সঙ্গে দেখা হবে আপনার। খবর এর মধ্যেই দেয়া হয়েছে, তিনি হয়তো এতক্ষণ অপেক্ষা করছেন আপনার জন্যে।’

বাড়ীর মধ্যে ঢুকে কৃষ্ণাকে নিয়ে ধরমচাঁদ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে, সরু-বারান্দার সামনে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে একখানা চেযার দেখিয়ে ওকে বসতে বললেন।

ঘরখানার তিন দিক চাপা। শুধু ঘরে ঢোকবার সামনের দেয়ালের দু’পাশে দুটো জানলা, আর মাঝখানে একটা দরজা। সেই দরজা দিয়ে ঢুকে কৃষ্ণাকে ঘরে বসিয়ে ধরমচাঁদ বললেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন এখানে, খবরটা আমি অমরনাথবাবুকে দিয়ে আসি।’

বলে সেই একটি মাত্র দরজা দিয়েই আবার বেরিয়ে ধরমচাঁদ বারান্দা দিয়ে বোধহয় ভেতর-মহলের দিকে চলে গেলেন।

অ-দৃষ্ট ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে-ভাবতে কৃষ্ণা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কব্জি-ঘড়ির কাঁটা পাঁচ মিনিট এগিয়ে গেছে, এমন সময় মস্ত-বড় একটা সুটকেশ হাতে ধরমচাঁদ আবার সেই দরজাটা দিয়েই ঘরে ঢুকে বললেন, ‘একটু দেরী হয়ে গেল কৃষ্ণাদেবী। অমরনাথবাবু খেতে বসেছেন, এই এলেন ব’লে।’ বলে আর-একখানা চেয়ারে ব’সে, সুটকেশের ডালাটা খুলে একটা ফটো-এ্যালবাম বের ক’রে কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ততক্ষণ এই এ্যালবামটা দেখুন, আমি একটু বিশ্রাম করি। অমরনাথবাবু এলে, তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিয়ে আজকের মত বিদায় নেবো।’

সময় কাটাবার জন্যে সেখানা নিয়ে কৃষ্ণা পাতা ওল্টাতে লাগলো। ফটো-এ্যালবাম। পরিচিত-অপরিচিত অনেকগুলি মানুষের প্রতিকৃতি রয়েছে এর মধ্যে। প্রথম পাতায় রায়সাহেব নেহালসিংয়ের ফটো। তারপর বৈজুনাথের, তারপর পর-পর দয়ালচাঁদ, জয়প্রকাশসিং, একখানার নীচে লেখা-বেনোয়ারীলাল, তার পরের খানা-ইন্সপেক্টর রামরাওয়ের, তারপর বাঘের মত সেই দুটো প্রকাণ্ড গ্রেট-ডেন কুকুর-টাইগার আর লায়ন, আহা, দুঃখ হয় ওদের ছবি দেখে! তারপর সাবিত্রীদেবী, লছমনিয়া, ভীম-নেই কার? একখানি মদালস-দেহভঙ্গিমার নিখুঁত ফটোর নীচে লেখা-রত্নাদেবী, তারপর একি? ব্যোমকেশবাবু সিগার টানছেন! তারপর? কৃষ্ণা কি স্বপ্ন দেখছে? পরের ফটোখানা যে কৃষ্ণার!…

কৃষ্ণা মুখ তুললে; কি আশ্চর্য্য! ধরমচাঁদবাবু গেলেন কোথায়? তাঁর চেয়ারে বসে ঐ সৌম্য-সুন্দর সুপুরুষ যুবাটি কে? উনি কোন পথ দিয়ে ঢুকলেন এ-ঘরে? ঘরের দরজা তো মোটে একটি, তার পাশের পাঁচিল ঘেঁষে প্রায় দরজা আগলে তো কৃষ্ণাই ব’সে এ্যালবাম দেখছে এতক্ষণ ধরে! তবে?

-‘নমস্তে!’

দুটি হাত জোড় ক’রে কপালে ঠেকিয়ে মিষ্টিমধুর স্বরে যুবকটি বললেন, ‘নমস্তে!’

মুগ্ধ দৃষ্টিতে যুবকের মুখের দিকে চেয়ে দূরাগত বাঁশির সুরে ধীরে-ধীরে কৃষ্ণা বলবার চেষ্টা করলে, ‘আপনি…আপনি…’

-‘হ্যাঁ কৃষ্ণাদেবী, আমিই আপনাদের বহু কষ্টের কারণ, আর বহু আকাঙ্ক্ষিত দস্যু-অমরনাথ।’

অমরনাথ টেবিলের কলিং-বেল টিপলেন। একটি প্রৌঢ়া নারী হাসতে-হাসতে এসে সামনে দাঁড়াতেই কৃষ্ণার মুখ থেকে বেরুলো-‘একি! লছমনিয়া? তুমি কোথা থেকে এলে এখানে?’

সে-কথার জবাব না দিয়ে, মাথা নত করে লছমনিয়া বললে, ‘আসুন বাইসাহেবা, আপনাকে ভেতরে নিয়ে যাই। এ কি চেহারা হয়েছে আপনার? আসুন, আসুন, কাপড়-চোপড় বদলাতে হবে, চান করতে হবে, সব মোতায়েন ক’রে রেখে এসেছি, আর দেরী করবেন না।…ও, আমি কোথা থেকে আর কেন এসেছি এখানে? আমি এখানে না এলে আপনার সেবা করবে কে? কার সঙ্গে কথা কইবেন আপনি? অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে। উঠুন, উঠুন, আর দেরী করবেন না!’

কৃষ্ণা বললে, ‘এসে পড়েছি যখন, যেতেই হবে ভেতরে। আচ্ছা, তুমি এখন যাও লছমনিয়া, অমরনাথবাবুর সঙ্গে আমার দরকারি কথা আছে। একটু পরে যখন আমি যাবো ভেতরে, ইনি তোমায় জানিয়ে দেবেন।’

লছমনিয়া একবার মুনিবের দিকে চাইলে, বোধ হয় হুকুম পেলে চলে যাবার। তারপর অভিবাদন জানিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

তারপর অমরনাথের মুখের দিকে চাইতেই অমরনাথ বললেন, ‘বলুন কৃষ্ণাদেবী, কি বলতে চাইছেন?’

কৃষ্ণা বললে, ‘বলবার কথা অনেক থাকলেও আমার প্রথম জিজ্ঞাসা এই যে, এ-ঘরের মাত্র একটি দরজা। এই দরজা দিয়ে এইমাত্র ধরমচাঁদবাবু ঢুকে ঐ চেয়ারখানায় বসেছেন, তারপর আমি ছবি দেখছি এই দরজার দিকে মুখ ক’রে। এইটুকু সময়ের মধ্যে এ-ঘরে চোখের সামনে তৃতীয় ব্যক্তির আসবার আর অন্য পথ নেই, অথচ হঠাৎ ধরমচাঁদবাবুর অন্তর্দ্ধান আর আপনার আবির্ভাব হলো কেমন করে, এই কথাটা খুলে বলবেন কি?’

একটু হালকা হেসে অমরনাথ বললেন, ‘যা জানি এমন কথা কেউ জানতে চাইলে-বিশেষ ক’রে আপনার মতন বিদুষী ছাত্রী যদি প্রশ্ন করেন, তাহ’লে সে-কথাটা খুলে না বলা-অভদ্রতা। নিশ্চয়ই বলবো, কিন্তু তার আগে আর-একখানা এ্যালবাম দিচ্ছি, দেখে নিন। কারণ, আমার মতন দস্যু, আর আপনার মতন গোয়েন্দার বুদ্ধির যুদ্ধে অতঃপর এগুলো খুবই দরকার লাগবে। এই জটিল ক্লু আবিষ্কার করবার কাজে হাত দিয়ে, শত্রুর কাছ থেকে এতটা সুবিধে পাওয়া-ভাগ্যের কথা। আপনার এই আকস্মিক সৌভাগ্যে আমার ঈর্ষা হওয়া উচিত, কিন্তু সুন্দর মুখের জয় সর্ব্বত্র এ-কথা জানেন তো?’

-‘একা ঘরে পেয়ে আপনি কি আমায় এইভাবে অপমান করবেন অমরনাথবাবু?’

-‘অপমান? না না কৃষ্ণাদেবী, আপনার এ ভুল সংশোধন হবে একটু পরেই, যখন আমি এ-ঘর থেকে উঠে যাবো। তবে আপনার দেখবার ইচেছ না থাকে, বইখানা ফিরিয়ে দিতে পারেন!’…বলে হাত বাড়িয়ে এ্যালবামখানা অমরনাথ কৃষ্ণার দিকে এগিয়ে ধরলেন।

কোনোরকম আপত্তি না করে কৃষ্ণা এ্যালবামখানা হাতে নিতেই অমরনাথ আবার বললেন, ‘বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দেখুন, কারণ, দেখার শেষে যখন মুখ তুলবেন এবার, তখন আর আপনাকে চমকে দেবার মতন নতুন কোনো বৈদ্যুতিক-শক্তি আমার হাতে নেই। তাতে যদি সন্দেহ থাকে তো, ছবি দেখার ফাঁকে গোপনে আড়চোখে একবার দেখে নিতে পারেন যে, আবার কি নতুন ভেল্কি দেখাবার ফিকিরে আছি আমি!’ ব’লেই অমরনাথ এবার হাসির তুফান অর্গানের শেষ কোমল-পরদার সুরে তুলে ঢেউ খেলিয়ে মিলিয়ে দিলেন।

লজ্জিতা কৃষ্ণা বাধ্য হয়েই মাথা নীচু করে একাগ্র-মনে ছবির বই-এর পাতা ওল্টাতে লাগলো। এবারে-ধনপৎসিং, দুনিচাঁদ, রুক্মিণীবাই, বোম্বাইয়ে নেহালসিংয়ের কলকারখানা, জাহাজের কারখানা, এরোপ্লেন, পাইলটের ফটো, হাওড়া-জেসিডি-বম্বের ষ্টেশনের ফটো-সব শেষে একি! মামা প্রণবেশের ফটো এ-এ্যালবামে এলো কোত্থেকে? অমরনাথ কি যাদু জানে?-‘অমরনাথবাবু?’

কৃষ্ণা মুখ তুললে, কিন্তু কোথায় অমরনাথবাবু? তাঁর বদলে সেই চেয়ারে ব’সে পাকানো গোঁফে তা দিচ্ছেন ধরমচাঁদ! হ্যাঁ, কৃষ্ণা নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারে না।

ধরমচাঁদ বললেন, ‘একটু আগে ধরমচাঁদের অন্তর্দ্ধান আর অমরনাথের আবির্ভাব-রহস্য জানবার জন্যে আপনি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, আমি জানাবার স্বীকৃতি দিয়েছিলুম। এবারে আমি আমার শপথ রক্ষা করছি, এই দেখুন।’-বলেই প্রথমে মাথার পাগড়ি, তারপর গালপাট্টা আর গোঁফ আর চৌগোঁপপা, শেষে দু’কান থেকে দুটো বীরবৌলী খসিয়ে আস্তে-আস্তে পাতলা রেশমী পরচুলটা নামিয়ে ফেলতেই প্রৌঢ় ধরমচাঁদ-ত্রিশ-বত্রিশ বছরের প্রিয়দর্শন অমরনাথে রূপান্তরিত হয়ে পড়লেন।

কৃষ্ণা আর কতবার অবাক হবে? বললে, ‘বুঝিছি। কিন্তু, গলার স্বর? তারও কিছু কায়দা আছে নিশ্চয়, কিন্তু তার প্রক্রিয়া কি? শত্রুর কাছে সেটা প্রকাশ করতে বোধহয় আপনার উদারতার অপচয় হবে না!’

-‘অপচয়?’ অপরাজেয় দুর্দ্ধর্ষ দস্যু অমরনাথ বিহ্বলের মত মুগ্ধ-দৃষ্টিতে কৃষ্ণার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘অপচয়, কৃষ্ণাদেবী? অপচয় কিছু ক’রে যদি উদারতা দেখাতে হয়, আপনার মত শত্রুকে তা’হলে এই জিনিসটা দিতে পারলে বোধহয় সার্থক হবে তার। দেখুন তো, এটা চিনতে পারেন কি না?’

ব’লে সুটকেশের ভেতর থেকে ক্লোরোফর্ম্মে অজ্ঞান হবার আগে কাঁধে-ঝোলানো কৃষ্ণার সেই অতিপ্রয়োজনীয় হাত-ব্যাগটা বের করে অমরনাথ বললেন, ‘চিনতে নিশ্চয়ই পারছেন; আমাদের লুটের এই জিনিসটা আমি আপনাকে উপহার দিলুম।’

-‘মানে?’

-‘মানে, একটু উদারতা দেখানো, আর কি! যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় শত্রু যদি অস্ত্রচ্যুত হয়, তাহ’লে তাকে নিরস্ত্র-অবস্থায় আবার যুদ্ধে আহ্বান করা, কাপুরুষের নীচতা। বীরের ধর্ম্ম-তার হাতে আবার নতুন অস্ত্র তুলে দেওয়া। এক্ষেত্রে তারও প্রয়োজন হয়নি, মানে, আপনার অস্ত্র অটুটই আছে, ওতে হাত দেওয়া হয়নি। এবার আপনার সাগ্রহ-প্রশ্নের উত্তর দেবো, ঐ কণ্ঠস্বরের। এই স্বর-বৈচিত্র্যের সাধনা করতে দস্তুরমতন আমায় গুরুর কাছে শিক্ষা নিতে হয়েছে কৃষ্ণাদেবী! যাকে বলে, ভেন্ট্রিলোকুইজম ট্রেণিং নেওয়া। কিন্তু এসব ব্যাপার দেখে ভাববেন না, যে, শীগগির আপনাকে মুক্তি দেবো! ব্যক্তিগত শত্রুতা অবশ্য আপনার সঙ্গে কিছু নেই আমার, কিন্তু আমার সর্ব্বস্ব অপহরণ করে যে দুর্ব্বৃত্ত জুয়াচোর আমায় শুধু পথের ভিখিরী নয়, আমার মাথায় একেবারে দস্যুতার কলঙ্ক-ভার চাপিয়ে দিয়েছে, তাকে এবং তার সম্পর্কে যারা এসেছে তাদের আমি অল্পে রেহাই দেবো না। কিন্তু আজ অনেক হয়েছে, আর না। তার ওপর আজ আপনি আমার বাড়ীতে শ্রান্ত-অতিথি। দয়া ক’রে আহারাদি করে আজ রাতের মতন বিশ্রাম নিন, কাল সকালে চায়ের টেবিলে ব’সে মুখোসপরা ভণ্ড-সাধু নেহালসিংয়ের আসল রূপের পরিচয় নেবেন আমার কাছে।’

অমরনাথ বেল টিপলেন। লছমনিয়া এসে অভ্যর্থনা ক’রে কৃষ্ণাকে ভেতর-বাড়ীতে নিয়ে গেল।

বারো

ধূর্ত্ত নেহালসিং, অমরনাথের দাদামশায়ের বিরাট কারখানায় ক্যাসিয়ারের পোষ্টে বসে, তারপর ওঁদের লণ্ডন যাওয়ার অবসরে কেমন করে ফাঁকি দিয়ে কাজ-কারবার বিষয়-সম্পত্তি সব ঠকিয়ে নিয়েছিল, পরের দিন সকালে চা পান করতে-করতে তার ইতিহাস অমরনাথ বললেন কৃষ্ণাকে, যেসব কথা এর আগেই শুনেছিল কৃষ্ণা।

কাহিনী শেষ ক’রে অমরনাথ বললেন, ‘আমাকে ধ’রে দিতে পারলে গভর্ণমেণ্ট মোটা টাকা পুরস্কার দেবেন ঘোষণা করেছেন। আপনার বরাতেই সে প্রাপ্তিযোগটা আছে দেখছি। দেখুন চেষ্টা ক’রে! দস্যু অমরনাথকে আপনি ঘৃণা করেন জানি, কিন্তু তার মর্ম্মবেদনার গুরুত্বটা যদি উপলব্ধি করতে পারতেন কৃষ্ণাদেবী!’

কৃষ্ণা বললে, ‘আমার ঘৃণা বা শ্রদ্ধায় আপনার কি এসে যায় অমরনাথবাবু? কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, সম্ভ্রান্ত বংশে জন্মে, উচ্চশিক্ষিত হয়ে আপনি দস্যুবৃত্তি ক’রে কেন লোকের সর্ব্বনাশ করছেন! এ-কাজের জন্যে আপনার বিবেক আপনাকে বাধা দেয় না?’

উদাস-দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ একদিকে চেয়ে থাকবার পর কৃষ্ণার দিকে মুখ ফিরিয়ে অমরনাথ বললেন, ‘আমার বিপক্ষে আপনি অনেক কথাই শুনেছেন বুঝতে পারছি, কিন্তু সত্য যা, তা একদিন প্রকাশ পাবেই, এবং সেদিন বুঝবেন, অমরনাথ-ধনীর বিভীষিকা, কিন্তু গরীবের বন্ধু।’

কৃষ্ণা মাথা নীচু করলে। এ যদি সত্যি হয়, সত্যিই যদি এরকম সাধু উদ্দেশ্য থাকে অমরনাথের, তাহ’লে দস্যু জেনেও কৃষ্ণা ওর মঙ্গল কামনা করবে ভগবানের কাছে। কিন্তু কর্ত্তব্য পালন আগে। কৃষ্ণা বললে, ‘হয়তো তাই, কিন্তু একের অপরাধে অপরকে শাস্তি দেওয়া-কথামালার ‘বাঘ ও মেষশাবক’-এর দৃষ্টান্তের মতন নয় কি? রত্নাদেবী গরীব না হলেও, মেয়ে। বীরের মন নিয়ে এক তরলমতি তরুণীর ওপর এ উৎপীড়ন করা, কর্ত্তব্যনিষ্ঠ কোনো ‘গরীবের বন্ধু’র শোভা পায় না। এর স্বপক্ষে আপনার যুক্তি কি?’

একটু হেসে অমরনাথ বললেন, ‘যুক্তি আমার এখানে হার মেনেছে কৃষ্ণাদেবী! আপনার প্রশ্নের উত্তরে এখানে দস্যু অমরনাথের সেই কথামালার ব্যাঘ্ররাজের উক্তিই শুধু প্রযোজ্য হবে-‘তুই কর আর তোর বাপই করুক, একই কথা!’…পিতার পাপের সাজা সন্তান বৈদিক-যুগ থেকে ভোগ করে আসছে, আজও করবে। যাক, কথায়-কথায় অনেক দেরী হয়ে গেছে…আপনার এখন বিশ্রামের দরকার।’

কৃষ্ণা বললে, ‘আপনারও! কিন্তু আর-একটু বিরক্ত করবো আপনাকে। রত্নাদেবীকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন এ প্রশ্ন এখানে অবান্তর, শুধু জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, তিনি বহাল-তবিয়তে বেঁচে আছেন, না তাঁর হাত-পা কেটে তাঁর বাবার কাছে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা নিতে, তিনি সেই কাটা হাত-পা দেখে চিনতে পারেন কি না, যে, সেগুলো তাঁর মেয়ে রত্নাদেবীরই দেহের অংশ, না অন্য মানুষের!’

অমরনাথ বললেন, ‘আগেই তো বলিছি আপনাকে, যে, যা জানি, এমন কথা কেউ জানতে চাইলে তাকে আমি প্রত্যাখ্যান করি না? শুনে আশ্বস্ত হোন যে, রত্নাদেবী বেঁচে আছেন, এবং তাঁর ভাবী স্বামীর ফিরে আসার আনন্দে, বা ভয়ে দিন গুণছেন নিরালায় ব’সে।…ওকি? শুনে চমকে উঠলেন যে? সত্যি, আপনার ওই চমকানোমুখের ভঙ্গিটি বেশ! উপভোগ করবার মতন। আর-একটু ওইভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকলে বাধিত হবো!’

অমরনাথের স্বভাবের পরিচয় কৃষ্ণা আগেই পেয়েছে। হয়তো সত্যিই ভালো লাগে কৃষ্ণাকে দেখতে অমরনাথের! কিন্তু অমরনাথ যে ইতর নয় তা কৃষ্ণা জেনেছে। মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, একটা বেড়ালকে জয় করতে পারলেও মানুষ আনন্দ পায়। শুধু সেই আনন্দটুকু পাওয়া ছাড়া কৃষ্ণার মনে আর-কিছু ভাব এলো না। মৃদু হেসে কৃষ্ণা বললে, ‘আমার এখন বিশ্রামের দরকার। তবুও আর-একটু এই-ভাবেই চাইছি আপনার দিকে। চট করে মুখের ভঙ্গিটা দেখে নিয়ে আমায় ছুটি দিলে বাধিতা হবো।’

চট করে অমরনাথ বলে ফেললেন, ‘বাঃ, বেশ যে! খুব ভালো লাগলো কৃষ্ণাদেবী, আপনার এই কথাটা শুনে। অবশ্য, ছুটি এখন আপনাকে দিতে পারবো না; তবে শেষ দেখা আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই হবে আমার একদিন, কিন্তু সে আজ নয়। এখন আপনি যে-কথাটা জানতে চাচ্ছেন অথচ জিগেস করতে পারছেন না, সে-কথাটা নিশ্চয়ই এই যে, রত্নাদেবীর এই ভাবী স্বামীটি কে? কেমন, এই না?’

কৃষ্ণা বললে, ‘ধরেছেন ঠিক। কিন্তু সে ভাগ্যবানটি যে আপনিই, সেই কথাটা বলবার জন্যেই বোধহয় উসখুস করছেন?’

অমরনাথ বললেন, ‘আপনার কি মনে হয়? নিজেকে আপনি হঠাৎ এত শ্রীহীনা ভাবছেন কেন? রত্নাদেবীর চেয়ে সব দিক থেকেই কি আপনি অপৰ্য্যাপ্ত নন? যাক, একটা আপোষ করতে রাজী আছেন আমার সঙ্গে? অবশ্য তার সর্ত্ত এই নয় যে, আমার দলে আপনাকে যোগ দিতে হবে। আমি চাই, ভণ্ড নেহালসিংয়ের সংস্রব ছেড়ে দিয়ে আপনি কলকাতায় ফিরে যান। ওই দুষ্কৃতকারীকে দণ্ড দেবার যে ব্রত নিয়েছি আমি, তা আমায় উদযাপন করতে দিন। আপনি ওর সহায় থাকলেও তা পারবো আমি, কিন্তু তা’হলে আপনার ওপর যে অকরুণ ব্যবহার করতে হবে, তার জন্যে চিরদিন অনুতাপ করতে হবে আমায়। ভবিষ্যৎ আমি দেখতে পাচ্ছি কৃষ্ণাদেবী; খুব শঙ্কিত হচ্ছি। এখন বলুন, আমার এ প্রস্তাবে আপনি রাজী?’

-‘না। বিশ্বাসঘাতকতাকে আমি ঘৃণা করি। দস্যু-দলনের যে ব্রত নিয়ে পালন ক’রে যাচ্ছি আমি; স্বেচ্ছায় যে-কাজের ভার নিয়ে এতদূর এগিয়েছি, তার শেষ দেখতে হবে। ভুলে যাবেন না যে, এটা রণক্ষেত্র। দস্যু আর গোয়েন্দার এই যুদ্ধে হারি বা জিতি, পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবো না কোনো দিন। আপনি আপনার শক্তি প্রয়োগ করুন, আমি তার প্রতিরোধ করবার চেষ্টা করি, এই পর্য্যন্ত! ন্যায়যুদ্ধে আমায় বধ করলেও আপনাকে দোষ দেবো না; কিন্তু অযাচিত অনুগ্রহ করবেন না, এইটুকুই আপনার কাছে আমার অনুরোধ।’

এর উত্তরে দ্বিতীয় কথা না ব’লে অমরনাথ গলায় ঝোলানো কারটা টেনে, পকেট থেকে একটা ছোট বাঁশী বের ক’রে তাতে ফুঁ দিলেন।

হুইসল শুনেই লছমনিয়া আস্তে-আস্তে এসে সামনে দাঁড়ালো। অমরনাথ শুধু একটি কথা উচ্চারণ করলেন…’লঙ্গু।’

লছমনিয়া আবার ফিরে গিয়ে তখুনি যাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো, ওই কিম্ভূতকিমাকার লোকটাকে দেখে, কিষ্কিন্ধ্যার অধিবাসী ছাড়া আর-কিছু কারুর মনে হবে না। লোকটা কাফরী, নিগ্রো, হাবশী বা আফ্রিকার যে-কোনো জাতই হোক ওর ওই আলকাতরার মতন গায়ের রং, থিয়েটারের আবদালার মতন পোষাক, আর ছবিতে-দেখা রাক্ষস-খোক্ষসের মতন কালো মুখে রক্তরাঙা ঝোলা-ঠোঁট দেখলে সত্যি ভয় করে!

-‘গুডবাই!’ অমরনাথ সেনাপতির সেলামের ভঙ্গিতে হাতটা ঈষৎ তুলে গম্ভীরমুখে বললেন, ‘গুডবাই, কৃষ্ণাদেবী। অতঃপর এই খোজা-বান্দার সঙ্গে গিয়ে নিভৃতে আপনার ব্রত পালন করুন, কিন্তু সাবধান! এবারে আর পালাবার চেষ্টা করবেন না, করলে বিপদ হবে।’

তেরো

বন্দিনী কৃষ্ণা।

পাশের ঘরে যে একটি মেয়ে আছে তা কৃষ্ণা প্রথমে বুঝতে পারেনি।

দোতলার সরু বারান্দার ধারে মাটির টালি-ছাওয়া পাশাপাশি দু’খানা ঘর। সামনে প্রায় দশ বিঘা জমিতে ফল-ফুলের বাগান। বাগানের শেষে চারিদিক-ঘেরা পাঁচিলটা এত উঁচু যে, ওর বাইরে সুমেরু-কুমেরুর মতন মহাশূন্যতা ছাড়া বন্দীদের মাথায় আর কিছু কল্পনা করার চিন্তা আসে না। তবে এটা আন্দাজ করা যায় যে, ও-ঘরে যে আছে, সে পুরুষ নয়; তাহ’লে খোজা-প্রহরীর সঙ্গে অমরনাথ কখনো কৃষ্ণাকে এখানে পাঠাতেন না। ধরে নেওয়া গেল, ও-ঘরের বন্দীও বন্দিনী। মানে-মেয়ে। আচ্ছা, মেয়ে যদি হয় তো কে হতে পারে? অমরনাথ বলেছিল, এ-বাড়ীতে আর-একটি মেয়ে আছে। অবশ্য সে মেয়ে-রত্নাদেবী হতে পারেন না। কারণ, যাঁর জন্যে এত, তাঁকে অমরনাথ কখনো কৃষ্ণার এত কাছে রাখবে না। তাহ’লে সে মেয়েটি কে?…মেয়েটি…মেয়েটি…

ঠিক হয়েছে। সে মেয়েটি নিশ্চয়ই সাবিত্রীদেবী। লছমনিয়ার কাছ থেকে কৌশলে আজ সন্ধান নিতে হবে।

কৃষ্ণা ভাবছে-

বাইরে সজাগ খোজা-প্রহরী-লঙ্গু। খুট ক’রে বন্ধ দরজা খোলার একটা শব্দ; খাবারের থালা হাতে লছমনিয়া ঘরে ঢুকে, বন্ধ-দরজায় পিঠ আড়াল ক’রে সুদক্ষা অভিনেত্রীর সাধা-কায়দায় গলায় মিষ্টি সুর আনবার চেষ্টা ক’রে বললে, ‘একটু দেরী হয়ে গেছে বাইসাহেবা, মাপ করবেন।’

কোনোরকম গৌরচন্দ্রিকা না ক’রে কৃষ্ণা বললে, ‘খিদেও নেই আমার। তবু খাবো, কিন্তু তার আগে তোমায় একটি কথা জিগেস করছি লছমনিয়া, তোমাদের সর্দ্দার বলেছিলেন, এখানে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হবে, কিন্তু এখনো তো সাবিত্রীদেবীর সঙ্গে আমার দেখা হলো না। মেয়েদের মহলেই তো মেয়েরা থাকবে। পাশের ঘর থেকে মেয়েলীগলার কাশির আওয়াজও পেলুম একবার। সাবিত্রীদেবী কি আমার পাশের ঘরে আছেন?’

-‘আছেন নাকি? দেখেছেন? তাহ’লে তাঁরও তো খাবার নিয়ে আসতে হবে! না না, আর আমার দাঁড়াবার সময় নেই! ঢাকা খুলে ততক্ষণ আপনি খেতে থাকুন, আমি চট ক’রে সর্দ্দারকে জিগেস করে এখুনি ফিরে এসে খবর নেবো, আপনাকে আর কি-কি দিতে হবে!’-ব’লেই ঝড়ের বেগে লছমনিয়া বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজায় খুট ক’রে আবার কুলুপ এঁটে দিয়ে, দুপ-দুপ করে পায়ের শব্দ করতে-করতে চকিতে মিলিয়ে গেল!

কৃষ্ণা অবাক! অবাক হবার সঙ্গে সঙ্গে ওর এটাও বুঝতে বাকি রইলো না যে, লছমনিয়ার কাছ থেকে কথা আদায় করা সোজা নয়! অমরনাথও এ-ক’দিনের মধ্যে দেখা করা দরকার মনে করেনি। জয়প্রকাশসিংয়ের ডায়েরী থেকে সাবিত্রীদেবীর সামান্য পরিচয় পাওয়া গেলেও, বেনোয়ারীলালের কোনো ইতিহাসই জানা যায়নি। তবে, সাবিত্রীদেবী যে সাধারণ মেয়ে নয়, এদেরই দলভুক্তা, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।

পাশের ঘরের মেয়েটির পরিচয় নেবার জন্যে কৃষ্ণা অধীর হয়ে ওঠে। ওর ঘরের পার্টিশনের মাথায় অবশ্য টালি-ছাওয়া ঢালু-সেডের মাঝে এতটুকু একটু ফাঁক আছে, কিন্তু সেখানে মাথা গলবে না। তাহ’লে উপায়? উপায় এই হতে পারে যে, খাবার টেবিলের ওপর চেয়ারটা তুলে, তার ওপর দাঁড়িয়ে সাবিত্রীদেবীর নাম ধ’রে ডাকবে, তারপর সাড়া পেলে, নিজের সাড়ীর খুঁটে একখানা চিঠি বেঁধে ঐ ফাঁক দিয়ে ও-ঘরে কাপড়টা ঝুলিয়ে দেবে নিশুতি-রাতে। মতলবটা মন্দ নয়। তাই করবে কৃষ্ণা।

কতরকম ভাবনা যে জট পাকিয়ে রয়েছে মাথায়! কোনটা রেখে কোনটা ভাববে কৃষ্ণা? হঠাৎ আর-একটা জট খুললো-বেচারা বৈজুনাথ। সবেমাত্র সে একটু প্রকৃতিস্থ হয়েছিল, এমন সময়…

-‘কে?’

-‘আমি কৃষ্ণাদেবী।’

ঘরের দরজা খুলে গেল। শান্ত-হাসি হেসে ঘরে ঢুকে, নমস্কার ক’রে অমরনাথ বললেন, ‘ক’দিন আসতে পারিনি নানান ঝঞ্ঝাটে প’ড়ে, কিছু মনে করবেন না। আজ কি মনে হলো, ভাবলুম, একা-একা চুপচাপ ব’সে-ব’সে আপনি সময় কাটাবেন কি ক’রে, তাই খানকয়েক বিলিতী ডিটেকটিভ বই আপনার পড়ার জন্যে এনেছি। এগুলো পড়া শেষ হ’লে, লছমনিয়াকে বললেই সে আপনার দরকার মতন আরো বই এনে দেবে। এতে অবশ্য আপনার-আমার মাথায় নেই, এমন অনেক তথ্য, অনেক কিছু কৌশল আছে ডাকাত ধরবার এবং গোয়েন্দাকে জব্দ করবার, কিন্তু আপাতত এ বইগুলো আমার কোনো কাজে লাগবে না, বরং আপনার অনেক সুবিধে হতে পারবে। তাই ব’লে এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবেন না যেন! আমার উদ্দেশ্য, আপনি এখানে আটক থেকে যেমন আমার কাজের সাহায্য করছেন, আমারও তেমনি উচিত তার প্রতিদান দেওয়া, এই আর-কি। আমি জানি, বন্দীদের পালাবার নানারকম কৌশল স্কটল্যাণ্ড-ইয়ার্ডের এসব ডিটেকটিভ বইতে লেখা আছে, কিন্তু ইচ্ছে করলেই যিনি মুক্তি পেতে পারেন, আর ইচ্ছে করেই যখন তিনি এ-কাজ ছেড়ে দিয়ে তাঁর স্বস্থানে ফিরে না গিয়ে, স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব স্বীকার ক’রে নিয়েছেন, তখন তাঁকে বিশ্বাস করা যায়।’

একটু মুচকে হেসে অমরনাথ এইখানে থামলেন।

কৃষ্ণা বললে, ‘চমৎকার! অনেক কিছু শেখবার আছে আপনার কাছ থেকে। কিন্তু এগুলো ছবির এ্যালবাম নয় তো? এবারে কি দেখবো, ওর মধ্যে শৃঙ্খলিত নেহালসিংয়ের সামনে বিখ্যাত দস্যু-সর্দ্দারের বিয়ে হচ্ছে-রত্নাদেবীর সঙ্গে, আর লছমনিয়া বা সাবিত্রীদেবী উলুধ্বনি করছেন, অথবা শাঁখ বাজাচ্ছেন, তার ফটো? কি মতলব নিয়ে আজ হঠাৎ দেখা করতে এসেছেন অমরনাথবাবু?’

এ-কথা শুনে অমরনাথ এবার হাসলেন না; বললেন, ‘খুব মনে ক’রে দিলেন কৃষ্ণাদেবী। ওই নেহালসিংয়ের ইতিহাস কিছু-কিছু শুনলেও, সবটা আপনি জানেন না নিশ্চয়ই। এই অবসরে আরো কিছুটা জানিয়ে দিই। হ্যাঁ, আমার দাদুর ফার্ম্মে কাজ করতো ওই নেহালসিংয়ের শ্বশুর ধনপৎসিং। দাদুর কথা মনে হলেই আমি আত্মবিস্মৃত হই কৃষ্ণাদেবী। দাদু ছিলেন আমার করুণার অবতার। ধনপৎসিং তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিল অশেষ করুণা এবং প্রচুর ক্ষমা। কিন্তু সে তার মৰ্য্যাদা রাখতে পারেনি। জীবনে আমি কোনোদিন বাপ-মায়ের স্নেহ পাইনি, ওই দাদুই ছিলেন আমার সব। সেই দাদুর সর্ব্বস্ব ঠকিয়ে নিয়েছে ধনপৎসিং। যখন খবর পেলুম লণ্ডনে বসে, তখন আমি একেবারে ভেঙে পড়লুম। তারপর আমি ফিরে এসে দেখলুম, ধনপৎসিং আমার দাদুর প্রাসাদে রাজার হালে বাস করছে; কোম্পানী চলছে তার নামে; একেবারে আঙুল ফুলে কলাগাছ! কিন্তু ধর্ম্মের কল বাতাসে নড়ে। সে রাজার ঐশ্বর্য্য ধনপৎসিংকে বেশীদিন ভোগ করতে হয়নি! গুণধর জামাই নেহালসিং, শ্বশুরকে বিষ খাইয়ে হত্যা ক’রে সেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসেছে, যে-নেহালসিংয়ের পক্ষ নিয়ে আপনি আমায় ধরতে এসেছেন। একটু আগে আমার কথায় আপনি চমৎকৃত হয়েছেন, এবার আমার কথা জানিয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যাক, তারপর আমি বম্বে গিয়ে দল-তৈরীর কাজে লাগলুম। আইন অনুসারে সম্পত্তির দাবি চললো না, তাই নিৰ্য্যাতন সুরু করে দিলুম নেহালসিংয়ের ওপর। সে নিৰ্য্যাতন সহ্য করতে না পেরে নেহালসিং পালিয়ে এলো তার কলকাতার বাড়ীতে। তার জন্যে আমাকেও বহুদিন কলকাতায় থাকতে হয়েছে, তারপর সেখানেও অতিষ্ঠ হয়ে নেহাল পালিয়ে এলো দেওঘরের ওই বাড়ীতে, কিন্তু ওখানে এসেও সে একদিনের জন্যে শান্তিতে বাস করতে পারেনি। মোট কথা, যেখানেই থাক ধূর্ত্ত নেহালসিং, অমরনাথের হাত থেকে তার নিষ্কৃতি নেই। ছায়ার মতন আমি তার অনুসরণ করবো। এখন বলুন তো কৃষ্ণাদেবী, ওকে শাস্তি দিলে কি আমার অপরাধ হবে?’

কৃষ্ণা চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর বললে, ‘কিন্তু, তাঁর অপরাধে বেচারা বৈজুনাথ বা রত্নাদেবীকে শাস্তি দেয়াটা নিষ্ঠুরতারই পরিচয় ব’লে আমার মনে হচ্ছে অমরনাথবাবু, এবং এরা ভাই-বোন নিৰ্য্যাতিত না হ’লে আমি নিশ্চয়ই আপনার কথায় কলকাতায় ফিরে যেতুম। আচ্ছা, নেহালসিংয়ের বর্ত্তমান স্ত্রী-‘

বাধা দিয়ে অমরনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, সে আমারই দলের মেয়ে। তার নাম-রুক্মিণীবাই! আমার আদেশেই সে নেহালকে বিবাহ করেছে। আর আমার অতি-প্রিয় সেই গ্রেট-ডেন কুকুর দুটো, যাদের আপনি বিষ খাইয়ে মেরেছেন, সেই দুটো কুকুরের জন্যেই আমাকে প্রতি রাত্রে কিছুক্ষণের জন্যে ওই বাড়ীতে যেতে হতো। সে-রাত্রেও সেখানে ছিলুম আমি। তাদের হত্যা ক’রে বৈজুনাথকে নিয়ে পালাবার সময় সেইখানেই আপনি ধরা পড়েছিলেন।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে কৃষ্ণা বললে, ‘আর, রোহিণীতে বেনোয়ারীলালকে অমন নৃশংসভাবে হত্যা করা-‘

বেশ কঠিন-সুরেই অমরনাথ বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিফল আমরা এইভাবেই দিয়ে থাকি। তার স্ত্রীর নামে যে মেয়েটি পরিচয় দিয়েছিল, সে আই-বি-তে কাজ করতো। তারই মোহে প’ড়ে বেনোয়ারীলাল আমার বহু অর্থ আত্মসাৎ ক’রে দেওঘরে পালিয়ে গিয়ে সেখানে জমিদার সেজে, পুলিশকে আমাদের দলের অনেক গোপন সন্ধান জানিয়েছিল, তবুও আমি পত্র দিয়ে তাকে সাবধান করেছিলুম, কিন্তু যম যার শিয়রে, সে কি হিত কথা শোনে? সাবধান হওয়া দূরে থাক, সে ইনস্পেক্টর রামরাওয়ের সাহায্য নিয়েছিল আর পুলিশকে সব রকমে সাহায্য করছিল আমাদের দলকে ধরিয়ে দেবার জন্যে। তাই তার বীভৎস মৃতদেহ আতঙ্কিত ক’রে তুলেছিল দেওঘরের প্রত্যেক লোককে! এই অমরনাথের প্রতিশোধ কৃষ্ণাদেবী! জেনে রাখুন, নেহালসিংও আমার হাত থেকে রেহাই পাবে না।’

অমরনাথের ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়তে থাকে।

কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণার বিবর্ণ-মুখের দিকে চেয়ে অমরনাথ বললেন, ‘না, না, আপনি তাই ব’লে ভয় পাবেন না কৃষ্ণাদেবী! অমরনাথকে যত পাপিষ্ঠই মনে করুন, নারীজাতির এতটুকু অসম্মান বা লাঞ্ছনা কখনো অমরনাথের দ্বারা হয়নি, এ গর্ব্ব আমি করতে পারি। ওই সাবিত্রীদেবীকে স্বচ্ছন্দে আমি হত্যা করতে পারতুম,-ওই মেয়েটি প্রতি পদে আমার অনিষ্ট ক’রে আসছে, এবং নেহালসিংকে ও সব-সময় সতর্ক করছে, তাই আজ নেহালসিংয়ের বর্ত্তমান স্ত্রী রুক্মিণীবাইকে তার বাড়ীতে একটা অন্ধকার ঘরে বন্দিনী-অবস্থায় থাকতে হয়েছে। দলবল নিয়ে আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি তাকে উদ্ধার করবার জন্যে, কিন্তু পারিনি। আপনাকে সরাবার জন্যে সেদিন ব্যস্ত থাকতে না হ’লে, সেইদিনই সেই প্লেনে আমি রুক্মিণীকে সরিয়ে আনতে পারতুম, কিন্তু এখন আর সেদিকে যাবার উপায় নেই! টাকার জোরে নেহালসিং সশস্ত্র পুলিশ দিয়ে তার বাড়ী ঘেরাও ক’রে রেখেছে।’

কৃষ্ণা কিছুক্ষণ বইয়ের পাতা ওল্টায়, তারপর বিনয়ের সুরে বলে, ‘কিন্তু আমায় আর এরকম আটক রেখে আপনার কোনো লাভ নেই অমরনাথবাবু! কারণ, আপনার দ্বারা রত্নাদেবীর যে অন্তত জীবনের হানি হবে না, আপনার এখনকার কথায় তা বুঝতে পেরেছি, এবার আমায় কলকাতায় পাঠাবার ব্যবস্থা ক’রে দিন! কলকাতায় ব’সে আমার নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে মামাবাবু যে কি-রকম ছটফট করছেন তা তিনিই জানেন।’…বলে কৃষ্ণা বিমর্ষ ভাবে অমরনাথের মুখের দিকে তাকালে।

অমরনাথ বললেন, ‘আগেই তো বলেছি, আমাদের কাজ মিটে গেলেই আপনাকে মুক্তি দেবো? চাই-কি, আমি নিজেই কলকাতায় পৌঁছে দিতে পারবো তখন আপনাকে। মামাবাবুর কথা বলছেন? কিছুই করবেন না আপনার মামাবাবু, বড়জোর ছুটোছুটি করবেন পুলিশকে খবর দিতে। তার ওপর বুদ্ধিমান ব্যোমকেশবাবু আছেন, আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই।’…বলতে-বলতে অমরনাথ উচ্চহাসি হেসে ওঠেন, ওঁর হাসির শব্দে সচকিত হয়ে লছমনিয়া এসে দাঁড়ায় দরজার সামনে।

এতক্ষণ পরে অমরনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আজ তাহ’লে আসি কৃষ্ণাদেবী! বিশেষ কাজের জন্যে দিনকয়েক আসতে পারবো না, তাই নারায়ণদাসকে রেখে যাচ্ছি। সে-ই দেখা-শোনা করবে, কিছু অসুবিধে হবে না আপনার। বইগুলো শেষ হ’লে, লছমনিয়াকে বললেই সে আপনাকে নতুন বই এনে দেবে। রত্নাদেবীর ভাবি-স্বামীটি কে, এরপর যেদিন দেখা হবে, বলবো। এখন শুধু জেনে থাকুন, হত্যা আমরা রত্নাদেবীকে কোনো দিনই করবো না, কিন্তু সে তার স্বামীর সঙ্গে সুদূর দেশে চলে যাবে, নেহাল বা আপনি বা আর-কেউই কোনো দিন আর তার দেখা পাবেন না! আপনার খাতিরে এখুনি তাকে মুক্তি দিলে যে আমার প্রতিশোধ নেওয়া হবে না নেহালসিংয়ের ওপর! আচ্ছা, নমস্তে!’

অমরনাথ চলে যাবার পর কৃষ্ণা অনেকক্ষণ টেবিলে মাথা রেখে ভাবলে, তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে একখানা বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলো।

খাবার সময় বহুক্ষণ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে, আর বই-পড়া নয়। কৃষ্ণা উঠে, মুখ-হাত ধুয়ে সামান্য কিছু খেয়ে নিলে, তারপর আবার বই নিয়ে বসলো। শ্রান্ত দেহ এখন একটু বিশ্রাম চায়। অশান্ত মন আবার তাকে চাঙ্গা ক’রে তোলে…না, এই অবেলায় আর বিশ্রাম নয়, অনেক শ্রমসাধ্য কাজ তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। সেই নির্জ্জনতার প্রতীক্ষায় ওকে জেগে থাকতে হবে, ভাবতে হবে, ভেবে ঠিক করতে হবে-কি উপায়ে, কেমন ক’রে পাশের ঘরে অবরুদ্ধ অজানা-মেয়েটির সন্ধান আর পরিচয় পাবে। অমরনাথের কথায় যতদূর জেনেছে, তাতে ও-মেয়েটি সাবিত্রীদেবী না-ও হতে পারে! তবে? তাহ’লে ওই বন্দিনী কে?…

মিনিটের পর ঘণ্টা পার হতে-হতে একসময় সন্ধ্যা হয়ে এলো। তার কিছু পরেই বন্দিশালা নিস্তব্ধ। বাইরে কৃষ্ণার প্রহরী বান্দা-লঙ্গুর জুতোর শব্দ ছাড়া দস্যুদলের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই।

নিশ্চিন্ত হয়ে কৃষ্ণা ভেতর থেকে দরজায় ছিটকিনি এঁটে, টেবিলটা সরিয়ে নিয়ে গেল ঘরের মাঝখানের পার্টিশনের পাশে। তারপর টেবিলের ওপর সন্তর্পণে পর-পর দু’খানা চেয়ার তুলে, আস্তে-আস্তে শেষ চেয়ারখানায় উঠে উঁকি দিয়ে দেখলে, ও-পাশের ঘরে টেবিলে মাথা রেখে সত্যিই একটি মেয়ে পেছন ফিরে ব’সে আছে। কৃষ্ণা একবার কাসলে, একবার গলা-খাঁকারি দিলে, কিন্তু মেয়েটির কোনো খেয়ালই নেই, এত অন্যমনস্ক অথবা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে…

কৃষ্ণা আর-একবার কেসে, বাষ্পীয় আওয়াজে ডাকলে, ‘সাবিত্রীদেবী!’

‘-কে? কে ওখানে?’ শব্দ আন্দাজ ক’রে মেয়েটি পেছন ফিরে ওপর দিকে চেয়েই ভয়ে আঁৎকে ওঠবার মুহূর্ত্তে কৃষ্ণা আবার ফিস-ফিস ক’রে বললে, ‘এই, চুপ! চুপ! ভয় নেই, অল্প আলোতেই আমি তোমায় চিনেছি, তুমি রত্নাদেবী। তোমার ফটো দেখেছি আমি। ভয় নেই-তোমার বাবা রায়সাহেব আর দাদা বৈজুনাথবাবু আমায় পাঠিয়েছেন তোমায় উদ্ধার করবার জন্যে! আমি পুলিশের লোক-ডিটেকটিভ! আমিও তোমার মতন মেয়ে, আমাকে ভয় করতে হবে না, যা বলছি শোনো। আমাকে তোমার উপকারী বন্ধু ব’লে জেনো। তোমায় যারা ধ’রে এনেছে, আমাকেও এখানে এনে বন্দিনী করেছে তারা। তোমার হারিকেনের পলতেটা একটু বাড়িয়ে দাও, পার্টিশনের কাছ থেকে সরে দাঁড়াও।’

মেয়েটির চোখ দুটিতে আবার স্বাভাবিক দৃষ্টি ফিরে আসে। আস্তে-আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে সে নির্দ্দিষ্ট জায়গাটিতে দাঁড়ায়।

কৃষ্ণা এবার হারিকেনের জোর-আলোয় পরিষ্কার বুঝতে পারে, এ সাবিত্রীদেবী নয়, এ্যালবামে-দেখা রত্নাদেবীই ওর চোখের সামনে সশরীরে দাঁড়িয়ে আছে।

কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘তুমি এখানে কতদিন আছো বোন?’

মেয়েটি জলভরা চোখে জবাব দিলে, ‘কতদিন? কতদিন তা আমার মনে নেই দিদিভাই, ভুলে গেছি।’

বলার সঙ্গে-সঙ্গে ঝরঝর করে ওর দু’চোখ বেয়ে জল ঝরতে থাকে।

ব্যথিত-দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে চেয়ে সান্ত্বনা দেয় কৃষ্ণা, ‘কেঁদো না ভাই রত্না, সত্যিই আমি তোমার দিদিভাই। ভয় নেই, তোমায় আমি এখান থেকে উদ্ধার ক’রে নিয়ে যাবোই। বুঝতে পারছো না? আমি তোমার দিদিভাই না হ’লে তোমার নাম জানলুম কি করে?’

মেয়েটি বললে, ‘হ্যাঁ, এখন বুঝছি, বাবাই তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, নইলে তুমি আমার নাম জানতে না। এরাও বোধহয় কেউ আমার নাম জানে না, তাই লছমী ব’লে ডাকে। বাবা আর দাদা কিন্তু আমায় রত্না বলেই ডাকতেন। এখান থেকে আমায় কখন নিয়ে যাবে দিদিভাই? আজকেই নিয়ে যাবে তো? এরা কি আমায় ছাড়বে? সত্যি বলছি, আমি কিছুই দোষ করিনি এদের। বাবা যে আমায় এক মিনিট না দেখলে থাকতে পারতেন না, আর দাদা-‘

বলতে-বলতে এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে ওঠে রত্না।

আশ্বাস দেয় কৃষ্ণা, ‘তুমি মুষড়ে পোড়ো না রত্নাভাই। এরা ছেড়ে দেবে না বললেই হলো আর কি! ভগবান নিশ্চয় তোমার জন্যেই আমাকে এখানে এনেছেন। এতদিন যখন অপেক্ষা করেছো, আর দু’চার দিন ধৈর্য্য ধ’রে থাকো বোন, এর মধ্যে আমি একটা উপায় করবোই। আমি এখন নেমে যাচ্ছি রত্নাভাই, কারণ, লছমনিয়ার খাবার আনবার সময় হয়েছে। আজ এই পর্য্যন্ত। কাল আমি আবার এখান থেকে তোমার সঙ্গে কথা কইবো।’

কৃষ্ণা চেয়ার থেকে সন্তর্পণে নীচে নামলো। ও-পাশ থেকে করুণ-কণ্ঠে রত্না বললে, ‘আমার কথা ভুলবে না দিদিভাই, কোনরকমে তুমি আমায় বাবার কাছে পৌঁছে দিনও, তুমি যা চাইবে আমি তাই দেবো।’

ভয়ে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায় এ-কথা কৃষ্ণা জানে। নইলে শিক্ষিতা-ষোড়শীর মুখে কিশোরী-বালিকার মতন কথা শুনে ও অবাক হয়ে যেতো! রত্নার শেষ কথা শুনে কৃষ্ণা শুধু একটু হাসলে!

চৌদ্দ

একদিন পরে নারায়ণদাস এসে জিগেস করলেন, ‘কোনো অসুবিধে হচ্ছে না কৃষ্ণাদেবী? লছমনিয়া ঠিক সময়ে খাবার, বই-টই সব দিচ্ছে তো?’

কৃষ্ণা বললে, ‘না, অসুবিধে আর কি! বন্দিনীর পক্ষে এ যথেষ্ট অনুগ্রহ আপনাদের। অমরনাথবাবু বোধহয় কাল চলে গেছেন-ফিরবেন কবে?’

-‘কাজ শেষ হলেই ফিরবেন। ওঁদের সব রাজারাজড়ার কাণ্ড তো? মহীশূর ষ্টেটের ট্রাষ্টি-বোর্ডের সর্ব্বময় কর্ত্তা উনি। ওখানকার রাজা হঠাৎ হার্টফেল ক’রে মারা যাওয়ায় রাণীমা তাঁর নাবালক ছেলেকে নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে ওঁর শরণাপন্ন হয়েছেন, তাই এখানকার সব কাজ ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন সর্দ্দারজী। তাঁর জন্যে আপনার কিছু অসুবিধে হবে না, আপনার সমস্ত অভাব-অভিযোগ মেটাবার ভার তিনি আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে গেছেন।’

কৃষ্ণা বললে, ‘তা জানি। অভাব আমার কিছুই রাখেননি আপনারা, তবে অভিযোগ একটা আছে। ঐ লছমনিয়াকে আমি ঠিক পছন্দ করতে পারছি না। কিন্তু তাহ’লে কি হবে, ও তো আপনাদেরই দলের লোক!’

-‘হোক না আমাদের দলের লোক। তাই ব’লে সে অন্যায় করলেও সহ্য করতে হবে? আমি জানি ওই মেয়েলোকটির প্রকৃতি ওইরকমই। ওর জন্যে আমাদের অনেক জ্বালা সইতে হয়! কিন্তু আপনি সহ্য করবেন কেন? শিশুকাল হতে মানুষ করেছে বলেই সর্দ্দারজী ওর সব অপরাধ ক্ষমা ক’রে যান।’

হতাশভাবে কৃষ্ণা বললে, ‘তাহ’লে আর ওর সম্বন্ধে কিছু না বলাই ভালো নারায়ণদাসবাবু!’

অতিরিক্ত ব্যস্ততা দেখিয়ে নারায়ণদাস বললেন, ‘না বললেও আমি বুঝতে পারছি। আমাকে আপনি আপনার বন্ধু বলেই জানবেন কৃষ্ণাদেবী! রোজ আমি এসে আপনার খবর নিয়ে যাবো। কি যে আমার হয়েছে, আমি কিছুতেই মন ঠিক রাখতে পারছি না। সাবিত্রী সুস্থ হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু বিষের ক্রিয়ার ফলে বাকশক্তি হারিয়েছে সে। তার এই অবস্থায় সর্দ্দার তাকে দিল্লীতে পাঠিয়ে চকবাজারের পথে ছেড়ে দিয়ে আসবার হুকুম দিয়েছিলেন। তাঁর হুকুম তামিল ক’রে ফিরে এসেছে যারা, তাদের মুখে শুনলুম, নিরাশ্রয়া সাবিত্রী এখন দিল্লীর পথে-পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে! বলুন তো কৃষ্ণাদেবী, একি সহ্য করা যায়? আর ঐ একটি মাত্র বোন-‘

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘এ নিষ্ঠুরতা। অথচ অমরনাথবাবু আমায় বলেছিলেন, কোনো নারীকে নিৰ্য্যাতন করেছেন তিনি, এমন কোনো প্রমাণ কেউ কোনোদিন দেখাতে পারেনি-পারবেও না। ছি-ছি।’

নারায়ণদাস বললেন, ‘কথাটা তিনি মিথ্যে বলেননি। নারীজাতির ওপর তাঁর শ্রদ্ধা আছে খুবই। কিন্তু যার ওপর চটবেন, সে নারী বা পুরুষ যেই হোক, রেহাই দেবেন না তাকে। নইলে-নইলে আমার সহোদরা ভগ্নী সাবিত্রীকে, আমাকে দিয়েই বোবা করিয়ে দিলেন আমার নিজের হাতে বিষ-ইনজেকসন প্রয়োগ করবার হুকুম দিয়ে?’

-‘আর আপনি বুদ্ধিমান শিক্ষিত লোক হয়ে নির্ব্বিচারে তাঁর সে-আদেশ পালন করলেন?’

-‘উপায ছিল না কৃষ্ণাদেবী! তাঁর হুকুম না শুনলে-তিনি নিজের হাতে নারীহত্যা না করলেও, আমাকে দিয়েই বধ করাতেন সাবিত্রীকে!’

কৃষ্ণা শিউরে উঠলো-‘বধ? হত্যা? খুন? তাহ’লে আমাকেও-‘

বিকৃত-হাসি হেসে নারায়ণদাস ব’লে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, আপনাকেও। প্রয়োজন মনে করেন যদি অমরনাথ, মানে, শেষপর্য্যন্ত তাঁর মনের মত কাজ করতে যদি নারাজ হন কোনোদিন, বলতে লজ্জা হয়, তাঁর শেষ আশা পূর্ণ হবে না বুঝতে পারলেই তিনি আপনাকেও-‘

-‘থাক, থাক, আর শুনতে চাই না আমি। তাহ’লে-‘

-‘তাহ’লে আর কি? আমি তো এখনো বেঁচে আছি? ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে তো আমাকেই? না না কৃষ্ণাদেবী, আমার দ্বারা সে নিষ্ঠুর কাজ কোনোদিনই হবে না, তার আগেই এখান থেকে দু’মাইল দূরে এরোড্রাম আছে, রাতের অন্ধকারে আপনাকে নিয়ে সেখানে পালাবো আমি। মানে, আমি-আমি-আমি আপনাকে-‘

-‘ভালোবেসে ফেলেছেন, এই তো? আমি জানি মশাই, জানি। অমরনাথ মনে করেছেন, তাঁর চেয়ে সুপুরুষ বুঝি জগতে আর-কেউ নেই! যে-কোনো মেয়েই তাঁর রূপ আর বিত্তের লোভে তাঁকে আত্মদান করতে বাধ্য হবে। কিন্তু নারীচরিত্র এমন দুর্জ্ঞেয় যে, স্বয়ং সৃষ্টিকর্ত্তা ভগবানও নাকি তা বুঝতে পারেন না! কিন্তু এটা তো জানেন, যে, একজন যদি মনে-মনে কাউকে ভালোবাসে, যাকে ভালোবাসে তার কাছে তার মনের খবর গোপন থাকে না? মনস্তত্ত্বের এই তো আসল তত্ত্বকথা-এটা তো জ্যামিতিক-প্রামাণ্য! রোহিণীতে যেদিন প্রথম দেখি আপনাকে, সেই দিনই আমি আপনার মনের ইসারা বুঝে নিয়েছি, বুঝলেন মশাই?’

কিছু বোঝবারই আর শক্তি রইলো না নারায়ণদাস-মশায়ের! ওঁর চোখ দুটো ছোট হয়ে এলো। সেই ছোট-চোখে বিহ্বলের মত চেয়ে নারায়ণদাস শুধু বলতে পারলেন, ‘সত্যি?’

আর-একটু স’রে গিয়ে নারায়ণদাসের কাছ ঘেঁষে ব’সে হালকা হেসে কৃষ্ণা বললে, ‘আদিম যুগ থেকে আজ পর্য্যন্ত কখনো কোথাও শুনেছেন যে, কোনো মেয়ে মুখ ফুটে তার প্রণয়-নিবেদন জানাবার পর তা মিথ্যে হয়েছে? এ সত্যি। আপনার কৃষ্ণাদেবী মিথ্যে বলেনি কোনোদিন।’

সাবিত্রীদেবী বাকশক্তি হারিয়েছিল, বিষাক্ত ওষুধের ক্রিয়ায়-তার সহোদর নির্ব্বাক হয়ে গেলেন, কৃষ্ণার অমৃত-নির্ঝরিণী বাক্যসুধার মায়ায়!

তভাবে গদগদ নারায়ণদাস বললেন, ‘আর কিছুক্ষণ আপনার কাছে বসলে আমি পাগল হয়ে যাবো! আজ আসি দেবী, কাল সকালে আসবো আবার চা খেতে। সে চায়ের সরঞ্জাম লছমনিয়া আনবে না, পাঠাবো-লঙ্গুবান্দাকে দিয়ে, যে আমাদের কথার এক বর্ণও বুঝবে না, কেমন?’

কৃষ্ণা বললে, ‘ঠিক তো?’

-‘নিশ্চয়!’…বলে কৃষ্ণার করমর্দ্দন করবার জন্যে হাত বাড়াতেই কৃষ্ণা একটু পিছিয়ে বসলো; বললে, ‘একেবারে কি অত উতলা হয়? সে হবে। কাল চায়ের পর যখন চলে যাবেন, তখন আমিই আপনার হাতে হাত দিয়ে সেকহ্যাণ্ড করবো।’

এ-কথা শোনার পর নমস্কার করতে ভুলে গিয়ে, কৃষ্ণার দিকে সতৃষ্ণ-দৃষ্টিতে চেয়ে-চেয়ে পিছু হটতে-হটতে নারায়ণদাস বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

জানলায় মুখ রেখে কৃষ্ণা যখন দেখলে, মনের আনন্দে দরজা খোলা রেখেই চ’লে গেলেন নারায়ণদাস, তখন দম আটকে যাবার মতন হাসতে-হাসতে হাতের মুঠো খুলে, দুটো চাবি-গাঁথা একটা চাবির রিং বের ক’রে একবার লুফে নেবার সময় ওর মন থেকে যে কথাটা বেরুবার চেষ্টা করছিল, সেটা যেন ও শুনতে পেলে-‘ছি-ছি কৃষ্ণা, বিদুষী মেয়ে হয়ে তুমি শেষে পকেট মারলে?’

পনেরো

নারায়ণদাসের পকেট থেকে চাবি হাতিয়ে নিলেও, তখুনি রত্নাদেবীর ঘরে যাওয়া ও উচিত মনে করলে না। একমিনিট কৃষ্ণা কি ভেবে নিলে, তারপর সিদ্ধান্তে পৌঁছে, দরজায় ছিটকিনি এঁটে, আবার ঘরের পার্টিশনের গা ঘেঁষে টেবিল সরিয়ে, তার ওপর দু’খানা চেয়ার পর-পর সাজিয়ে সেই চেয়ারে উঠে পাশের কামরায় উঁকি দিয়ে দেখলে, হারিকেন-লণ্ঠনটা মিটমিট ক’রে জ্বলছে। রত্নাকে ওইটুকু ফাঁক দিয়ে দেখতে না পেয়ে ধীরে-ধীরে কৃষ্ণা ডাকলে, ‘রত্নাদেবী! বাইসাহেবা! জেগে আছো?’

ও-ঘর থেকে সাড়া এলো, ‘না দিদিভাই, ঘুমোইনি এখনো, জেগেই আছি। হঠাৎ এমন অসময়ে? নতুন কিছু বিপদ ঘটেছে নাকি?’

কৃষ্ণা বললে, ‘অসময় নয় বোন, এই ঠিক সুসময়। বিপদ নয়-মুক্তি পাবে। আজই। এখন যা বলছি শোনো। তোমার ঘরে তুমি একলা আছো তো? কে পাহারা আছে জানো?’

রত্না বললে, ‘ঘরে আমি একলাই আছি দিদিভাই! বাইরে যে পাহারা দিচ্ছে, সে আমারই বিশ্বাসী পুরনো চাকর-ভীম। কিন্তু বিশ্বাসী হ’লে কি হবে? ঘরের চাবি তো তার কাছে নেই! পরশু এদের দলের সর্দ্দারকে দেখেছি। তিনি নাকি কিছুদিনের জন্যে কোথায় বাইরে চলে যাচ্ছেন বিশেষ জরুরী কাজে। লোকটি বেশ। ডাকাত ব’লে মনে হয় না। তিনি এসে আমায় বললেন, ‘আপনার যদি কিছু দরকার থাকে তো বলুন, সম্ভব হ’লে আমি চেষ্টা করবো আপনার ইচ্ছে মেটাতে।’ তার আগের দিন আমি জানলা দিয়ে ঐ ভীমকে দেখে অবাক হ’য়ে গেছলুম, ও কি করে এলো এখানে! যাক, সর্দ্দারের কথা শুনে আমি বললুম, কি আর চাইবো আপনার কাছে, যদি আমার চাকর ঐ ভীমকে আমার কাছে থাকবার হুকুম দেন, তাহলে আর আমার কিছু চাইবার থাকে না। শুনে তিনি বললেন, ‘তা তো হয় না, আচ্ছা, তবু ভীমকে আমি আপনার পাহারায় রেখে যাবো।-কিন্তু ওই পর্য্যন্ত। তাকে দিয়ে আপনি কোনো কাজ পাবেন না। তার পাহারায় থাকবে আবার লছমনিয়া।’ বলে তিনি চলে গেছেন, কিন্তু ভীমকে তার পর থেকে সত্যিই আমার পাহারায় রেখে গেছেন!’

কৃষ্ণা মনে-মনে খুব খুশী হলো; বললে, ‘বেশ, এক কাজ করো। ঘুমিও না আজ তুমি। আজ একটু রাত হ’লে আমি তোমার ঘরে গিয়ে তোমায় ডাকলেই তুমি দরজা খুলে দেবে। চাবি এখন আমার হাতে। সে-সব কথা পরে বলবো। জেগে থেকো, বুঝলে?’

রত্না বললে, ‘বুঝিছি।’

কৃষ্ণা বললে, ‘আর-একটা কাজ করো। ভীমকে এখন একবার আমার ঘরের জানলায় আসতে বলো। আমার পাহারায় যে আছে, তাকে আমি এখন খাবার আনতে পাঠাচ্ছি; কিছুক্ষণ আমার ঘরের বাইরে কেউ থাকবে না। ভীম আমায় চেনে। তুমি শুধু বলো, রোহিণীর বাড়ীতে যে মায়িজী তোমায় উদ্ধার করবে বলেছিল, সে পাশের কামরায় আছে। তাকেও ধ’রে এনে বন্দী করেছে এরা। এখুনি যেন সে আমার ঘরের জানলায় আসে-এখুনি।’

রত্না বললে, ‘জানলা দিয়ে এখুনি বলছি আমি ভীমকে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’

চেয়ার থেকে নামলো রত্না। তারপর যথাস্থানে টেবিল-চেয়ার সাজিয়ে রেখে, জানলা খুলে লঙ্গু-বান্দাকে ডেকে বললে, ‘আজ কি খাবার দেবে না? ঘুম পাচ্ছে যে আমার! শীগগির খাবার আনো।’

সেলাম দিয়ে লঙ্গু খাবার আনতে ছুটলো। কৃষ্ণাকে আর অপেক্ষা করতে হলো না। তখুনি ভীম এসে হাজির হলো জানলার বাইরে। তারপর সে মনের আনন্দে কিছু বলতে যাবার মুহূর্ত্তে কৃষ্ণা বললে, ‘চুপ! এখন আর কথা নয়।’…ব’লে চাবির রিংটা ভীমের হাতে দিয়ে বললে, ‘এই দুটো চাবির মধ্যে যে-চাবিটা কুলুপে লাগে সেইটে দিয়ে বন্ধ ক’রে চাবিটা আমার হাতে ফেরত দিয়ে চট ক’রে তুমি এখান থেকে পালাও রত্নার ঘরের দিকে। সেখান থেকে নজর রাখবে, লঙ্গু কখন এখান থেকে বাসন নিয়ে চলে যায়। যেই দেখবে, লঙ্গু চলে গেল, অমনি আবার এসে চাবি নিয়ে ঘর খুলে দেবে আমার! যাও!’

দু’তিন বার খুট-খুট ক’রে শব্দ, তারপর জানলা দিয়ে চাবির রিংটা কৃষ্ণার হাতে দিয়ে ভীম চলে গেল সেখান থেকে।

কৃষ্ণা অপেক্ষা করছে। দশ মিনিটের মধ্যেই খাবার নিয়ে লঙ্গু এলো, তারপর খাবার মেঝেয় নামিয়ে রেখে, খুট ক’রে চাবি খুলে, খাবার বাসনগুলো ঘরে রেখে বেরিয়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো বাইরে, খাওয়া হ’লে বাসনগুলো নিয়ে যাবে। ডুপ্লিকেট-চাবি প্রহরীদের কাছেই থাকে।

কিছু-কিছু খাবার জিনিস থালা-বাটিতে রেখে, বাকি খাবারগুলো কৃষ্ণা ঘরের কোণে উপুড় করে ঢেলে জড়ো ক’রে রাখলে, তারপর আরো মিনিট-দশেক পরে লঙ্গুকে ডেকে ব’লে দিলে, ‘আজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আজ আর তোমায় আমার দরকার লাগবে না। তুমি ডেকে সাড়া না পেলেই বুঝবে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বিরক্ত করবে না, বুঝলে?’

লঙ্গু ঘাড় নেড়ে জানালে, সে বুঝেছে।

জানলা দিয়ে কৃষ্ণা দেখলে, লঙ্গু চলে গেল। এক মিনিট। ভীম এলো, কৃষ্ণা চাবি দিলে, ভীম দরজা খুলতেই কৃষ্ণা বললে, ‘রত্নাদেবীর ঘরের বাইরে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে?’

ভীম বললে, ‘না।’

-‘আচ্ছা, চট ক’রে তুমি চলে গিয়ে ওখানে দাঁড়াও, আমিও যাচ্ছি এখুনি। তারপর যা-যা বলবো, ঠিক-ঠিক করতে পারো তো আজ তুমি আর রত্নাদেবী, দু’জনেই মুক্তি পাবে।’

মনের আনন্দে লাফাতে-লাফাতে ভীম ছুটলো!

তখন হাতব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে, হারিকেনটা নিবিয়ে হাতে নিয়ে, খুব সন্তর্পণে পা টিপে-টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে ঘরে তালা লাগালে, তারপর সরু বারান্দা দিয়ে রত্নার ঘরের দিকে এগিয়ে চললো!

রত্নার ঘরের দরজার বাইরে ভীম অপেক্ষা করছে।

কৃষ্ণা গিয়ে ওই ঘরের চাবি খুলে ভেতরে ঢোকবার সময় ভীমকে সাবধান ক’রে দিয়ে গেল, ‘এদের দলের কেউ এসে যদি চাবি খুলতে বলে তোমায় তো বলবে, নারায়ণদাসের কাছে চাবি আছে; আজ তোমায় চাবি দেননি তিনি।’

কৃষ্ণা ঢুকতেই রত্না ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘এসেছো দিদিভাই? কি ক’রে মুক্তি পেলে তুমি?’

শশব্যস্তে রত্নার মুখে হাত চাপা দেয় কৃষ্ণা, ‘চুপ! চুপ! দেয়ালেরও কান আছে এখানে। শীগগির তৈরী হয়ে নাও, এখুনি পালাতে হবে! তৈরী হওয়া মানে, কাপড়-চোপড় গুছিয়ে আঁটসাঁট ক’রে প’রে নাও! এই পোষাক ছাড়া আর কিছু তোমার নেই তো এখানে?’

-‘আর কি থাকবে দিদিভাই? এক-পোষাকেই তো ওরা ট্রেন থেকে আমাকে ধ’রে এনেছে এখানে! শুধু বদলে পরবার জন্যে আর-এক সুট পোষাক আছে, তাছাড়া আছে-‘

বলেই রত্না বালিসের তলা থেকে বের করলে একখানা চকচকে ধারালো খোরাশানি-ভোজালি!

সবিস্ময়ে কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘এ ভোজালি তুমি পেলে কোথায় রত্না?’

রত্না জবাব দিলে, ‘ক’দিন আগে দয়ালচাঁদ এই ছোরাটা নিয়ে এসেছিল দিদিভাই। তার আগে রোজই সন্ধ্যের পরে এসে বলতো, তাকে বিয়ে করতে হবে। রোজই ওই কথা বলে, আমিও অস্বীকার করি, একদিন বিরক্ত হয়ে মুখখানা বিকৃত ক’রে এমন একটা কুৎসিত কথা বললে আমায়, যে, আমি রাগ সামলাতে না পেরে খুব জোরে তার পেটে একটা লাথি মারি। তারপর তার সে কি তর্জ্জন-গর্জ্জন! কোমরে আঁটা খাপ থেকে এই ছোরাটা বের ক’রে একেবারে আমার বুকের সামনে ধ’রে বললে, হয় স্বীকার কর যে, আমায় বিয়ে করবি, না হয় দিই তোর বুকে বসিয়ে, তারপর যা হয় তাই হবে’!’

-‘তারপর?’

-‘তারপর প্রাণের ভয়ে আমি রাজী হয়েছি তাকে বিয়ে করতে। আমার বাবার আর দাদার দিব্যি গালিয়ে তিন সত্যি করিয়ে নিয়েছে আমায়। আর দু’তিন দিন পরে নাকি একটা বিয়ের তারিখ আছে, তার আগেই মহীশূর না কোথা থেকে সর্দ্দারের সঙ্গে ফিরে এসে, বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে দয়ালচাঁদ আমায় বিয়ে করবে। আমার সম্মতি পাবার পর মনের আনন্দে ছোরাখানা নিয়ে যাবার কথা বোধহয় ভুলে গেছে দয়ালচাঁদ। কি হবে দিদিভাই?’

কৃষ্ণা বললে, ‘ভগবান রক্ষা করেছেন রত্না, তাঁর দয়াতেই দয়ালচাঁদের মতিভ্রম ঘটেছে! নইলে সে ভোজালি নিতে ভুলবে কেন? যাক, ভালোই হয়েছে। পথে যেতে ছোরাখানা আমাদের অনেক কাজে লাগবে। ততক্ষণ তুমি তৈরী হও, আমি একটা কাজ সেরে নিই।’…বলে হাতব্যাগটা খুলে রুমাল দু’খানা বের ক’রে,-যাতে নাকটা চাপা পড়ে এমন ভাবে নিজের মুখে একখানা রুমাল বেঁধে, আর-একখানায় শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা কি ওষুধ ঢেলে, একটা ছোট নিকেল-করা কেসে রুমালটা পুরে বন্ধ ক’রে জানলার দিকে এগিয়ে গেল কৃষ্ণা।

এদিক-ওদিক পায়চারি করতে-করতে ভীম পাহারা দিচ্ছে বাইরে…

ফিসফিস ক’রে ভীমকে ডেকে, অতঃপর যা করতে হবে তাকে সবিস্তারে বুঝিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলে, ‘যা-যা বললুম, ঠিক ঠিক পারবে তো ভীম? পারলে আজই মুক্তি পাবে, না পারলে আজীবন এদের বন্দী হয়ে থাকতে হবে। দেখবো তোমার বাহাদুরী! তোমার ‘মাসল’ দেখে মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করলে তুমি দুটো লঙ্গুকে কায়দা করতে পারবে। কেমন, পারবে না? হঠাৎ পেছন থেকে গিয়ে…’

আর দ্বিতীয় কথা না ব’লে ভীম ডুমোডুমো বাঁ-হাতের গুলিটা ডান হাতে পাকিয়ে, ছেড়ে দিয়ে শক্তির নমুনা দেখালে, তারপর বিজয়গর্ব্বে এগিয়ে গেল লঙ্গুকে ক্লোরোফর্ম্ম করতে!…

রত্না সায়া-ব্লাউজ প’রে তৈরী হয়ে নিয়েছে, কৃষ্ণার একটু দেরী আছে। ভীম না ফেরা পর্য্যন্ত ওকে অপেক্ষা করতেই হবে।…ঐ না কিসের শব্দ? হ্যাঁ, দুটো বিরুদ্ধশক্তির সংঘর্ষই তো! নিশ্বাস বন্ধ ক’রে কৃষ্ণা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো! কিছুক্ষণ পরেই সব চুপ।

আরো মিনিট-পাঁচেক পরে কৃষ্ণা দেখলে ভীম ফিরে আসছে। জয় ভগবান! ভীমের হাতে লঙ্গুর পোষাক…ঠিক যা ব’লে দিয়েছিল কৃষ্ণা।

কৃষ্ণার হাতে লঙ্গুর পোষাক তুলে দিয়ে ভীম হাঁপাতে-হাঁপাতে বসে পড়লো, তারপর হাঁপাতে-হাঁপাতেই বলতে লাগলো, ‘আপনি যা-যা হুকুম করেছিলেন মায়িজী, সব-সব। মড়ার মতন প’ড়ে আছে লঙ্গু, পরনে আছে শুধু তার হাফপ্যাণ্ট, বাকি সবই খুলে এনেছি। আপনি যেমন-যেমন বলেছিলেন।’

-‘আচ্ছা ভীম, এখানে খুব কাছে কোথায় একটা এরোড্রাম আছে, জানো?’

ভীম বললে, ‘তা আর জানি না? দু’তিন বার আমি সেই এরোড্রাম থেকে মাথায় ক’রে পেট্রোল এনেছি যে!’

কৃষ্ণা বললে, ‘দরকার হ’লে সেখানে তুমি আমায় পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?’

ভীম বললে, ‘খু-উব…নিশ্চয় পারবো।’

বিপুল আনন্দে বিজয়ী-সন্তানের মাথায় হাত দিয়ে ভীমকে আশীর্ব্বাদ করলে কৃষ্ণা, তারপর রূপ-পরিবর্ত্তন প্রসাধনে মনোনিবেশ করলে।

রত্না অবাক-বিস্ময়ে কৃষ্ণার ‘মেক-আপ’ দেখতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরে হুবহু সেই বেঁটে-খাটো নিগ্রো-বান্দা লঙ্গুতে রূপান্তরিত হয়ে কৃষ্ণা জিগেস করলে রত্নাকে, ‘কেমন? এখন আমাকে তোমার দিদিভাই দেখাচ্ছে, না লঙ্গুর মতন দেখতে হয়েছি আমি? অবশ্য কিছু বাকি আছে এখনো, এবার চুলগুলো আমি মাথার ওপর উল্টে দেবো, আর তুমি এই কালো সিল্কের ফিতেটা আমার মাথা থেকে চিবুক পর্য্যন্ত ঘুরিয়ে টাইট করে বেঁধে দিলেই অবিকল লঙ্গু-বান্দা!’

চুল উল্টে কৃষ্ণা কার্লিং করলে, আবদালার মতন লঙ্গুর ঘাঘরা পরলে, সবই ঠিক করলে, কিন্তু তবু যেন কোথায় একটু খুঁত আছে। কৃষ্ণা রত্নাকে জিগেস করলে, ‘এবার?’

রত্না বললে, ‘উহুঁ? ও ঠিক হলো না। লঙ্গু তো আলকাতরার মতন কালো, আর তোমার তো দিদিভাই, ডালিম-ফাটা রং। রং লুকোবে কি ক’রে?’

কৃষ্ণা মুস্কিলে পড়লো। বুদ্ধিমতী-প্রত্যুৎপন্নমতি কৃষ্ণা তখুনি ভেবে ঠিক করে নিলে; বললে-‘সবুর! সবুর! সাগর পেরিয়ে এসে তরী কি শেষে ঘাটে ডুববে? জ্বালো হারিকেন!’

কৃষ্ণার হারিকেনটা রত্না জ্বাললে; রত্নার হারিকেনের পলতেটা খুব বেশী ক’রে বাড়িয়ে দিলে কৃষ্ণা। তখন হারিকেনের চিমনির ভেতর কুণ্ডলি পাকিয়ে-পাকিয়ে ধোঁয়াগুলো জমাট বেঁধে গেল। আরো ধোঁয়া…আরো…আরো…

ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় ভেতরের আলোসুদ্ধু যখন আর দেখা গেল না, তখন কৃষ্ণা ধোঁয়ার হারিকেনটা নিবিয়ে দিলে। হারিকেন ঠাণ্ডা হলো। তারপর সেই হারিকেনের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটু-একটু করে চিমনির গা মুছে ধোঁয়ার ভুসো বের করা, অর নিজের হাত-ব্যাগ থেকে মাথায় মাখবার বাথগেটের সুগন্ধি ক্যাষ্টরঅয়েল সেই ভুসোয় মিশিয়ে মুখে লেপন করা। কৃষ্ণার নির্দ্দেশমত রত্না সাহায্য করলে। সযত্নে ঠোঁটে ‘লিপষ্টিক’ লাগিয়ে লাগিয়ে রক্তরাঙা ঝোলা-ঠোঁট তৈরী করবার সাহায্য করতে-করতে, অত বিপদের মধ্যেও হেসে কুটিকুটি হলো রত্নাদেবী।

মেকআপ শেষ হলো। ‘জয় মা আদ্যাশক্তি!’…ব’লে এক হাতে ভোজালি আর-এক হাতে রত্নাকে বাগিয়ে ধরে হিড়হিড় ক’রে টানতে-টানতে কৃষ্ণা শুভযাত্রা সুরু করলে, নারায়ণদাসের নির্দ্দেশিত এরোড্রামের উদ্দেশে!

খানিক তফাতে এগিয়ে চললো ভীম পথ দেখাতে-দেখাতে।

দূরে বন্দিশালার একপ্রান্তে একটা স্বল্পালোক ঘরে ব’সে কয়েকজন জুয়াড়ী-দস্যু ‘ব্রিজ’ খেলছিল। তাদের মধ্যে কে একজন মহা উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো, ‘থ্রী নোট্রাম! মার দিয়া কেল্লা!’…

সমবেত সকলে একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘আর কেল্লা মারতে হবে না, পাস!’ খেলা তখন আবার পুরো দমে চলতে লাগলো, এখন আবার কে কার খোঁজ নেয়!

বাইরে নীড়হারা তিনটি বদ্ধ-জীব মুক্তি পেয়ে তখন নিজেদের কুলায়ে ফিরে যাবার আশায় অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে…

ষোলো

মুহুর্মুহুঃ ‘হর্ণ’ দিতে দিতে একখানা ট্যাক্সি এসে থামলো প্রণবেশের বাড়ীর দরজায়।

দোতলার জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখে প্রণবেশ ঠিক বুঝতে পারলেন না, হঠাৎ এ-সময় তাঁর সদরে কান ঝালাপালা-করা ভেঁপু বাজাতে-বাজাতে ট্যাক্সি এসে থামে কেন!

সদর-দরজা খুলে দিয়ে আগন্তুকদের দেখেই রঘুয়া একেবারে থ। যারা এসেছে,তাদের যদি রাতের অন্ধকারে দেখতো ও, তাহ’লে নিশ্চয়ই ভিরমি যেতো, এমনি ওর মুখ-চোখের অবস্থা! একটি শব্দ বেরুলো না রঘুয়ার মুখ থেকে, শুধু বিস্মিত-চোখে একবার দেখে নিয়েই উল্টো দিকে ছুট। তারপর সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠেই মনিবের ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘বাবু, দিদিমণি এসেছে!’

প্রণবেশ বিশ্বাস করতে পারেন না; ‘কি বকচিস পাগলের মতন? কৃষ্ণা এসেছে? কৃষ্ণা কি এ-মুল্লুকে আছে, যে, হুট করতেই ট্যাক্সিতে চেপে চলে আসবে এখানে? চ’ তো দেখি কোথায় কৃষ্ণা এসেছে-‘

-‘কোথাও যেতে হবে না মামাবাবু, সত্যিই আমি ফিরে এসেছি যমপুরী থেকে!’…বলে প্রণবেশের পায়ের ওপর মাথা রেখে কৃষ্ণা প্রণাম করলে। ওর দেখাদেখি রত্নাও ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইলো।

রত্নাকে একখানা চেয়ার দেখিয়ে বসতে ব’লে, তারপর মামার হাত ধরে আর-একখানা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘রঘুয়াকে ডেকে শীগগির চা আনতে বলো মামা, চা একচুমুক পেটে না গেলে আর কথা কইতে পারবো না-গলা শুকিয়ে কাঠ!’

প্রণবেশ হুকুম দেবার আগেই রঘুয়া দৌড়লো চা আনতে।

অবাক-বিস্ময়ে রত্নার মুখের দিকে চেযে প্রণবেশ বললেন, ‘এ মেয়েটি কে? একে তো ঠিক চিনতে পারলুম না? আচ্ছা, শুনছি পরে। তারপর? ব্যাপার কি কৃষ্ণা? কাল রাত্রেও যে ব্যোমকেশবাবু ব’লে গেলেন, তোমার কোনো খবর পাওয়া যায়নি! আমি নিজেও-‘

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘থামো বাপু। আমার জন্যে তুমি কি করেছো, শুনি?’

-‘আমি?’ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে মামা বললেন, ‘আমি কিছুই করিনি? খবর পেয়েই হন্তদন্ত হয়ে দেওঘরে ছুটিছি, সেখান তন্নতন্ন ক’রে খুঁজে সহরটা ওলটপালট করে ফেলেছি, তুমি কি আর সেখানে ছিলে, যে, খুঁজে পাবো তোমায়? বলো? তারপর ওখানকার ইনস্পেক্টর রামরাও যেদিন গুলিতে মারা যান-‘

-‘রামরাও মারা গেছেন? তুমি বলছো কি মামা?’ কৃষ্ণা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞের হাসি হেসে প্রণবেশ বললেন, ‘তবে আর বলছি কি? মোটরে আমরা ব’সে আছি, গাড়ী ছুটছে, হঠাৎ কানের কাছে ‘ক্লীক’ ক’রে একটা শব্দ! কার হাত থেকে রিভলভারের গুলি ছিটকে এসে রামরাওয়ের বুকে বিঁধলো কে জানে! অত-বড় সাজুয়ান লোকটা ধড়ফড় করতে-করতে সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ীর ভেতরেই সাবাড়! ভাগ্যে আছে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া, নইলে আমার বুকেও তো লাগতে পারতো গুলিটা! সেদিনকার পত্রিকা পড়োনি? বা রে বা!’

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্ক ভাবে কৃষ্ণা বললে, ‘আর পত্রিকা! আমি কোথায় ছিলুম জানো না তো? অমরনাথের নাম শুনেছো?’

প্রণবেশ বললেন, ‘ডাকাত অমরনাথ তো? তার নাম আবার শুনবো না কেন? এই কালকের পত্রিকাতেই তো লিখেছে, মহীশূর-ষ্টেটের ম্যানেজারকে খুন ক’রে, দামি-দামি সব জড়োয়ার গহনা, হীরে-জহরৎ লুট ক’রে, মহারাণী আর তাঁর বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে অমরনাথ হাওয়া হয়ে গেছে! এ নিয়ে কাগজওয়ালারা কম বিদ্রূপ করেনি, এই দ্যাখো না-‘

বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘থাক, আর পত্রিকা দেখাতে হবে না। তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই জানি আমি। অত্যাচারী-ধনীর ওপর অমরনাথের মর্ম্মান্তিক আক্রোশ! স্বেচ্ছাচারী ধনীর সর্ব্বস্ব লুট করে বটে অমরনাথ, কিন্তু নিজের জন্যে নয়; লুটের যা-কিছু সব নিরন্ন-বিবস্ত্র গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্ব্বাদ কুড়োবার জন্যে। যাক, চা এসে গেছে। বলা তো আর পালিয়ে যায়নি! এরপর ধীরে-সুস্থে সবই বলবো। এখন শুধু এইটুকু জেনে রাখো, দেওঘর থেকে আমায় ক্লোরোফর্ম্ম ক’রে ঐ দস্যু অমরনাথই এরোপ্লেনে তুলে একেবারে ভূপালে নিয়ে গিয়ে, সেখানে তার বন্দিশালায় আমাকে আটক রেখেছিল, সেখানেই নেহালসিংয়ের এই মেয়েটিকে দেখতে পাই আমি, তারপর সমস্ত বিপদ অগ্রাহ্য ক’রে, নানান কৌশলে একে নিয়ে সেই ভূপালের এরোড্রামে পালিয়ে গিয়ে, কি কষ্টে যে এখানে আসতে পেরিছি, যখন বলবো তোমায়, তুমি অবাক হয়ে যাবে! তবে সেই এরোড্রামে পৌঁছে যে সাহেবটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার, তাঁকে আমাদের বিপদের কথা জানাতে, তিনি দেবদূতের মতন অভয় দিয়ে, আমাদের কলকাতায় পৌঁছে দেবার স্বীকৃতি দিয়ে শেষপর্য্যন্ত সত্যিই পৌঁছে দিলেন, নইলে এজন্মে আর তোমার সঙ্গে দেখা হতো না মামা।’

প্রণবেশ বললেন, ‘বটে? তারপর?’

-‘তারপর আমার পরিচয় পেয়ে তিনি বললেন, ‘আরে, আরে! আপনিই কৃষ্ণাদেবী? গুড লাক, যে, আমি আপনার কিছু উপকারে লাগলুম। আপনাকে আবার না চেনে কে?’ আমি এমন লজ্জায় পড়লুম তাঁর মুখ থেকে এই আত্মপ্রশংসা শুনে! যাক, তারপর আমাদের উপযুক্ত পাহারার বন্দোবস্ত ক’রে দিয়ে সে-রাত্রে সেই এরোড্রামের গেষ্টহাউসে রাখলেন, তারপর নিজে সঙ্গে ক’রে এখানে এনে দমদম এরোড্রামে পৌঁছে দিয়েছেন! আমার ঠিকানা তিনি রেখে দিয়েছেন, হয়তো একদিন আসবেন দেখা করতে। দেখো মামা, তিনি এলে একটু খাতির-যত্ন কোরো যেন। তোমার স্বভাবটা কিছুক্ষণের জন্যে চেপে রেখে বেশ গাম্ভীর্য্যের সঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কোয়ো কিন্তু।’

প্রণবেশ যে এ-কথায় চটেছেন, তা ওঁর ভাবভঙ্গিতেই ধরা পড়ে। বেশ বিরক্তির সঙ্গেই ব’লে ওঠেন, ‘তোর ওই কেমন কথা, আমি ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা কইতে জানি না! আরে বাপু, বাড়ীতে লোক এলে কবে আমি কার অ-খাতির করিছি?’

কৃষ্ণা শান্ত করবার চেষ্টা করে মামাকে, ‘অমনি মামার রাগ হয়ে গেল! আমি কি তাই বলছি, যে, তুমি কিছুই জানো না, তোমার বাবা তোমায় কিছুই শেখাননি? যাক, তুমি যে দেওঘরে গেছলে, কি দেখে এলে? তাঁরা সব ভালো আছেন তো? এই রত্নাকে আবার কালই সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসবো কিনা ওর বাবার কাছে! রায়সাহেব বেশ ভালো আছেন?’

প্রণবেশ মাথা নাড়েন-‘উঁহু! দেওঘরে ওঁরা কেউ নেই! হপ্তাখানেক হলো ওঁরা কলকাতায় চলে এসেছেন। নেহালসিংয়ের অসুখটা হঠাৎ বেড়ে উঠেছিল কিনা; তাই ডাক্তারের পরামর্শে ওঁরা সকলেই সেখানকার বাস উঠিয়ে কলকাতায়-‘

এই পর্য্যন্ত শুনেই রত্না চঞ্চলভাবে উঠে দাঁড়ালো, ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, ‘কোথায় আছেন তাঁরা খোঁজটা নিয়ে দিদিভাই, আজই আমায় সেখানে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো! কি হবে দিদিভাই? বাবাকে আমি দেখতে পাবো কখন?’

কৃষ্ণা বললে, ‘ব্যস্ত হয়ো না রত্না! কলকাতাতেই যখন আছেন তাঁরা, আজই বিকেলের দিকে তোমায় নিয়ে গিয়ে দেখা করিয়ে দেবো’খন। এখন খাওয়া-দাওয়া করো, একটু বিশ্রাম নাও, কি কষ্ট ক’রে এসেছো একবার ভাবো!…হ্যাঁ ওঁরা কে-কে এসেছেন আর কোথায় আছেন, সব জানো তো মামা?’

মামার দিকে ফিরে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে চাইলে।

মামা বললেন, ‘ভবানীপুরে ওঁদের যে বাড়ী আছে, সেই বাড়ীতেই উঠেছেন সবাই। কিন্তু নেহালসিংয়ের অবস্থা মোটেই-‘

রত্না প্রায় চীৎকার ক’রে ওঠে-‘অবস্থা কি-রকম? ভালো নয়? বাবা বাঁচবেন না?’

কৃষ্ণা রাগ ক’রে বললে, ‘তুমি থামো মামা!’ তারপর রত্নার চিবুক ধ’রে বললে, ‘তুমিও যেমন মামাবাবুর কথা শুনছো? উনি ওইরকমই। সব-তাতেই উনি ওইরকম অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়েন! ঠিকানা যখন আছে, তখন আবার যাবার ভাবনা? আজই বিকেলে তোমায় নিয়ে যাবো, গিয়ে দেখো, তোমার বাবা ভালোই আছেন।…রঘুয়া? নীচে ভীম-মানে, আমাদের সঙ্গে যে ছেলেটি এসেছে, তাকে চা-জলখাবার দিইছিস তো?’

রঘুয়া বললে, ‘অনেকক্ষণ।’

সতেরো

স্নান খাওয়া-দাওয়া সেরে, বেশ খানিক বিশ্রাম ক’রে বিকেলের দিকে রত্নাকে নিয়ে কৃষ্ণা ভবানীপুরে রায়সাহেবের বাড়ীতে গিয়ে উঠলো।

দোতলার একটি সাজানো-ঘরে খাটিয়ার ওপর বিছানায় শুয়ে আছেন নেহালসিং। বিস্মিত-চোখে কৃষ্ণা দেখলে, রোহিণীতে একদিন সাবিত্রীদেবীকে যে-অবস্থায় দেখেছিল ও, ঠিক সেই ভাবে প’ড়ে আছেন রায়বাহাদুর। চোখের দৃষ্টি তেমনি স্থির, দেহ তেমনি আড়ষ্ট, রুগীর অবস্থা ঠিক তেমনি সব।

-‘বাবা?’…ব’লে ছুটে গিয়ে রত্না বাবাকে জড়িয়ে ধরবার মুহূর্ত্তে নার্স বাধা দেয়, ‘এখানে আপনি ওরকম কাঁদাকাটা করবেন না মিস সিং, এখানে কোনো রকম শব্দ পর্য্যন্ত করতে নিষেধ আছে ডাক্তারের।’

রত্নাকে ধ’রে কৃষ্ণা বাইরে নিয়ে আসে..সান্ত্বনা দেয়…কৃষ্ণার হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে রত্না ফুলে-ফুলে কাঁদে…

দেখে-শুনে ভীমও নিজের চোখে হাত রগড়ায়…

একজন খানসামা ওদের পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সে-ঘরে দু’জন ডাক্তারের সঙ্গে পিছন ফিরে ব’সে যে যুবকটি কথা কইছিল, তাকে দেখেই কৃষ্ণা বুঝলে ও বৈজুনাথ, তাই রত্নাকে বললে, ‘ওই তোমার দাদা।’

-‘দাদাভাই?’…

রত্না ছুটে গিয়ে বৈজুনাথের পায়ের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে, বালিকার মতন উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে উঠলো!

-‘রত্না? বহিন?’

বৈজুনাথ বোনটির হাত ধ’রে তোলে, নিজের কোলের ওপর ওর মাথাটা রেখে হাত বুলোয়। বহুদিনের সঞ্চিত চোখের জল আর বাধা মানে না!

কৃষ্ণা ভারি খুশী হয় ওদের ভাই-বোনের এই ভাব দেখে।

একেবারে স্বভাবিক সুস্থ মানুষ হয়ে গেছে বৈজুনাথ।

বোনটিকে শান্ত করে, হাত জোড় ক’রে কৃষ্ণাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার উপক্রম করতেই কৃষ্ণা বলে ওঠে, ‘কি এমন আমি আপনাদের করতে পেরেছি বৈজুনাথবাবু, যে তার জন্যে এত কাকুতি-মিনতি! বরং প্রাণ ভরে এখন ভগবানকে ডাকুন, যাতে আপনার বাবা শীগগির সেরে ওঠেন।’

বিনয়ে বিগলিত হয়ে বৈজুনাথ বললে, ‘আপনি যদি দেওঘরে থাকতেন কৃষ্ণাদেবী, তাহলে বাবার এরকম অবস্থা হতো না। জানেন, আপনি চলে যাবার পর সৎমাকে গুলি ক’রে মেরেছে দয়ালচাঁদ! সৎমা অমরনাথের দলের মেয়ে যখন জানতে পারলেন বাবা, তখন নিজেকে ধিক্কার দিয়ে, সৎমাকে নজরবন্দী করে রাখলেন আমাদের বাড়ীরই এক অন্ধকার ঘরে! তারপর দয়ালচাঁদের পালা। কারণ, নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে সৎমা বাবার কাছে ডাকাত-দলের সব রহস্য প্রকাশ ক’রে যখন বললে, দয়ালচাঁদ তোমাকেও হত্যা করবার চেষ্টায় আছে, তখন বাবা বললেন সৎমাকে, তুমি যদি পুলিশের সামনে এইসব এজাহার দিতে পারো, তাহ’লে বুঝবো তোমার অনুতাপ এসেছে, তখন তোমায় ক্ষমা করতে পারি। সৎমা রাজী হলো। গুপ্তচরের মুখে এই খবর পেয়েই দয়ালচাঁদ কৌশলে বাবার সরবৎ খাবার গ্লাসে বিষ মিশিয়ে প্রথমে ওঁর এই অবস্থা করলে, তারপর অন্ধকার-ঘরের জানলা দিয়ে বন্দিনী সৎমাকে গুলি করে মারলে! সরবৎ খাবার পরে বাবা সেই যে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তারপর বারো ঘণ্টা বাদে যদিও আবার জ্ঞান ফিরে এলো, কিন্তু শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া আর নড়বার শক্তি রইলো না বাবার। ডাক্তাররা বলেছেন-পক্ষাঘাত। কি হবে কৃষ্ণাদেবী?’

এর ভবিষ্যৎ ফল যা, তা কৃষ্ণা জানে, তাই কিছু ভরসা দিতে না পারলেও বৈজুনাথকে সান্ত্বনা দিলে, ‘এর চেয়েও শক্ত পক্ষাঘাত রুগীকে আরাম হতে দেখিছি আমি। বিপদে কাতর না হয়ে একমনে এখন ভগবানকে ডাকুন, ফল ভালো হবে।’ তারপর রত্নাকে ভরসা দিলে, ‘ভেবো না বোন, বড়-বড় ডাক্তাররা দেখছেন, দেখো, ঠিক সেরে উঠবেন তোমার বাবা। ভীমকে রেখে গেলুম তোমার কাছে। আচ্ছা, আজ আসি ভাই, কাল সকালে আবার আসবো আমি।’

কৃষ্ণা যখন নীচে নেমে আশুতোষ মুখার্জ্জী রোড থেকে ট্যাক্সি নিলে, তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে।

বাড়ীতে ঢুকতেই রুষ্টস্বরে প্রণবেশ বলে উঠলেন, ‘তুমি বেশ কৃষ্ণা। কতকাল পরে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে যদি-বা বাড়ীতে এলে, এসেই ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিয়েছো! ব্যোমকেশবাবু নাহক দুটি ঘণ্টা ব’সে থেকে-থেকে চলে গেলেন, কাল সকালে তাঁর বাড়ীতে তোমায় আর আমাকে চা খাবার নেমন্তন্ন করে, আর তোমার সেই ভূপালের এরোড্রামের সাহেব ভদ্রলোকটি প্রায় আধঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করে ব’সে আছেন তোমার সঙ্গে দেখা করবেন বলে। আমি যে কোনদিক সামলাই!’

-‘তাই নাকি?’ পোষাক না খুলেই কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি সিঁড়িতে উঠতে থাকে। প্রণবেশ সগর্ব্বে বলতে থাকেন, ‘তুমি জিগেস কোরো তাঁকে, আমি যথেষ্ট খাতির করিছি কিনা।…ডিমের পোচ, ওমলেট, কেক, তোমার জন্য যে পুডিং তৈরী হয়েছিল আজ, সেই পুডিংয়ের ডিসসুদ্ধু সব ধ’রে দিয়েছি তাঁকে, বাড়ী গিয়ে সাহেবকে আজ আর রাত্রে কিছু খেতে হচ্ছে না! হুঁঃ! বলে কিনা আমি খাতির করতে জানি না।’

হাসি-হাসি মুখে কৃষ্ণা বলে, ‘আমি তোমায় রাগাবার জন্যে ওইসব বলি মামা! তুমি আবার খাতির জানো না? আচ্ছা, তুমি তোমার ঘরে যাও, আমি দেখি!’

বলতে-বলতে ওপরে উঠে, বৈঠকখানা-ঘরের পরদা সরিয়ে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে সহাস্য-মুখে কৃষ্ণা বললে, ‘আমি মোটে আশাই করতে পারিনি মিঃ ব্রাউন, যে, সত্যি আপনি আজই আসবেন আমাদের বাড়ী-‘

বলতে-বলতেই কথার মাঝখানে থেমে যেতে বাধ্য হয় কৃষ্ণা-‘একি? অমরনাথবাবু? আপনি?’

ঈষৎ হেসে উঠে দাঁড়িয়ে অমরনাথ বললেন, ‘নমস্তে! চিনেছেন তো ঠিক? কিন্তু এই পোষাকে তো আপনার সঙ্গে এরোড্রামেও দেখা হয়েছিল? তখন তো এই ব্রাউন সাহেবের সঙ্গে বহুক্ষণ কথাবার্ত্তা কয়েছিলেন, তখন তো আমায় অমরনাথ বলেননি?’

সবিনয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘যে-যাই বলে আমায় সম্মান দেখাক না কেন, আপনার কাছে আমি শিশু। তার ওপর আমি মেয়ে, একথা ভুলে যাচ্ছেন কেন? পোষাকটা আপনার সেই আছে, কিন্তু মায়াবীর মেকআপ নেই আজ। কিন্তু আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে, আজই আমি শুনিছি, আপনি পুনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, আবার আজই দেখছি এই মুহূর্ত্তে যাঁর সঙ্গে কথা কইছি তিনি অমরনাথ। ধন্য মায়াবী অমরনাথ! ছাত্রীর সশ্রদ্ধ অভিবাদন নিয়ে প্রথমে আসন গ্রহণ করে আমাকে অতিথি-সৎকারে উৎসাহিত করুন, তারপর চা, মিষ্টান্ন তারপর মিষ্টিমুখে মিষ্টি কথা বলতে থাকবেন, আমি শুনে ধন্য হবো! ভুলিনি আমি, অমরনাথ-ধনীর বিভীষিকা, কিন্তু গরীবের বন্ধু। এসেছেন যদি দয়া করে গরীবের কুটীরে, তাহলে বলে দিন বন্ধু, কি দিয়ে আপনাকে পূজো করবো?’

অমরনাথ বললেন, ‘প্রীতি দিয়ে? স্নেহ দিয়ে? বন্ধু হবার উপযুক্ত সাহস দিয়ে আমায় ধন্য করুন দেবী? পূজো যদি করতে হয় তো আমিই করবো আপনাকে। বৈদিকযুগ থেকে যুগে-যুগে দস্যু-দলন করবার শক্তি নিয়ে আদ্যাশক্তির অংশ আপনারা অবতীর্ণ হয়েছেন পৃথিবীতে, আজ কি তার ব্যতিক্রম হবে? মনে করুন, আপনাকে কত কষ্ট দিয়েছি আমি? দিনের পর দিন বন্দিনী ক’রে রেখেছি, না পালিয়ে এলে, আজও হয়তো আপনি স্বাধীনতা পেতেন না! বলুন ঠিক কিনা?’

কৃষ্ণা বললে, ‘নিশ্চয় পেতুম স্বাধীনতা! আপনি ফিরে এসে যে আমায় মুক্তি দিতেন, এ-বিশ্বাস আমার বরাবরই ছিল অমরনাথবাবু! বাধ্য হয়েই আপনি আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আপনার তাঁবে থেকে এতটুকু কষ্ট তো আমি পাইনি! একা আমায় হাতের মধ্যে পেয়েও আপনি যে উদারতা দেখিয়েছেন, চিরদিন তা স্মরণে রাখবো। বন্দীবাসে আমার এক ব্রহ্মচারীবন্ধুর কথা আজীবন আমার মনে গাঁথা থাকবে,-দস্যু-নামে প্রসিদ্ধিলাভ করলেও তিনি মানুষ।’

-‘তা আমি জানি-জানি। পথে যে কত লোকের সঙ্গে দেখা হলো কৃষ্ণাদেবী, দিনের শেষে মহাকালের কোলে মিশে যাবে হয়তো তাদের স্মৃতি, জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় খেয়া-ঘাটে পৌঁছে দেখবে অনন্তকাল ধরে যে-পথে চলতে হবে আমায়, তার পাথেয় কি সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছি আমি? কিছু না। সর্ব্বহারা রিক্ত! সামনে শুধু নিষ্ফলতায় ভরা আকাশ-জোড়া মহা-শূন্য! কৃষ্ণাদেবী! চলার পথে চলতে-চলতে যখন দেহ অবশ, চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, তখন আমায় হাত ধরে নিয়ে যাবে কে?’

অমরনাথের চোখে জল! এমনিই হয়। কঠিন পাথরের ভেতর থেকেই নির্ঝরিণীর স্নিগ্ধ ধারা নেমে এসে দুঃখ-ভরা পৃথিবীর সব আবিলতা ধুয়ে মুছে নির্ম্মল করে দিয়ে যায়!

পকেট থেকে রুমাল বের ক’রে চোখ মুছে অমরনাথ বললেন, ‘আমার পকেটে একটা যৌতুক এনিছি আপনার জন্যে!’…বলে পকেট থেকে একটা ভেলভেটে-মোড়া কাস্কেট বের করে, তার মধ্যে থেকে একছড়া বহুমূল্যের জড়োয়া হার তুলে নিয়ে আবার বললেন, ‘এ হারছড়া আমার মায়ের। মায়ের নামে আপনি এটা ব্যবহার করলে আমি ধন্য হবো।’

দু’চোখে জল ভরে এলো কৃষ্ণার। দু’হাত পেতে হারসমেত বাক্সটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘সানন্দে-নতশিরে।’

সজল-চোখে অমরনাথ বললেন, ‘তাহ’লে বিদায় কৃষ্ণাদেবী!’

ভিজে-গলায় কৃষ্ণা জিগেস করলে, ‘কোথায় যাবেন এরপর?’

সমান-গলায় অমরনাথ জবাব দিলেন, ‘তার কি ঠিক আছে? মেসোপোটিমিয়ায়… ক্যালিফোর্ণিয়ায়…ইউরোপে…ফ্রান্সে…কোথায় গিয়ে যে সুস্থির হবো তার কিছুই স্থির নেই। এখানকার কাজ আমার শেষ হয়ে গেছে, নেহালসিং যেমন আছে তেমনিই পড়ে থাকবে। ওকে হত্যা করতে পারতুম, কিন্তু পাপের শাস্তি ওর ঠিক হতো না। আমি কেন সে পাপ করবো? আমায় উপলক্ষ ক’রে ঈশ্বর যা ইঙ্গিত করেছেন, আমি পালন ক’রে গেলুম, এরপর বিচার তিনিই করবেন। নেহালসিংকে বিকলাঙ্গ আর রুক্মিণীকে হত্যা করে ছদ্মবেশে পালাতে গিয়ে দয়াল ধরা পড়েছে দিল্লীর এরোড্রামে-পরিণাম তার হয় ফাঁসি, নাহয় দ্বীপান্তর! আপনারা পালিয়ে আসার পরদিন সকালে খবর পেয়ে, আপনার ইনচার্জ্জ নারায়ণদাস কৈফিয়ৎ দেবার ভয়ে আত্মহত্যা করেছে এ-খবর আজই বিকেলে পেইছি কলকাতায় বসে।’

মাথা নীচু করে আঁচলের খুঁট পাকাতে পাকাতে একসময় মুগ্ধদৃষ্টিতে অমরনাথের মুখের দিকে চেয়ে কৃষ্ণা বললে, ‘বন্দিশালা থেকে বারবার আমাকে পালাতে নিষেধ করেও আপনি নিজে আমাকে পালাবার সাহায্য করলেন কেন অমরনাথবাবু?’

অমরনাথ বললেন, ‘আমি যে শপথ করিছিলুম, আমার কাজ শেষ হলেই আপনাকে পৌঁছে দেবার! তাছাড়াও আপনার এ প্রশ্নের উত্তর আছে। কিন্তু শুনে কোনো লাভ নেই আর। যাক, একটা কথা জেনে রাখুন, বৈজুনাথ আর রত্নাকে আমি ক্ষমা ক’রে গেলুম, তার কারণ, ওরা আপনার স্নেহ লাভ করেছে…’

বলতে-বলতে একটু থেমে, হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে অমরনাথ আবার বললেন, ‘আচ্ছা’ আজ উঠি কৃষ্ণাদেবী, আমার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবেন, যেন জীবন আমার অতঃপর সৎভাবে চালাতে পারি, এরকম হীন কাজ যেন আর না করতে হয় আমায়! বিদায় কৃষ্ণাদেবী, বিদায়! নমস্তে!’

অমরনাথ কপালে হাত ঠেকালেন।

যন্ত্রচালিতের মত প্রতিনমস্কার জানিয়ে কৃষ্ণা জড়িত-স্বরে বললে, ‘নমস্তে!’

তরতর করে অমরনাথ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন; শেষ ধাপে পৌঁছে আর- একবার ওপর দিকে চাইলেন, তারপর ম্লান হেসে সেখান থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

পাথরের ষ্ট্যাচুর মতন আড়ষ্ট কৃষ্ণা তখনো রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *