০২. হত্যার প্রতিশোধ

হত্যার প্রতিশোধ

এক

দীর্ঘদিন পরে কৃষ্ণা নিজের গৃহে ফিরিল।

সঙ্গে রহিয়াছেন মাতুল প্রণবেশ। ব্যোমকেশ এ-সময় আসিতে পারেন নাই, বলিয়াছেন, পরে আসিবেন। আরও কিছুদিন কৃষ্ণাকে নিজের বাড়িতে রাখিবার কথা ব্যোমকেশ বলিয়াছিলেন, কৃষ্ণা একটু হাসিয়া বলিয়াছিল, ”আর তো ভয় নেই কাকাবাবু, যার জন্যে ভয়, সে সব জিনিস, টাকাকড়ি, সবই তো ইউউইন নিয়ে পালিয়েছে। আর কিসের জন্যে কে আমার অনিষ্ট করবে বা অনুসরণ করবে? তার কাজ সে শেষ করে গেছে…যার জন্যে কয়েকটা নরহত্যাই করে ফেললে!”

প্রণবেশ তবু সন্দিগ্ধভাবে বলিয়াছিলেন, ”শুধু যদি নকশা আর ওইসব জিনিস, টাকাকড়িই সে নিয়ে যেত, তাহলে তো কথাই ছিল না কৃষ্ণা, সে তোমাকেও নিয়ে যাচ্ছিল যে-”

ব্যোমকেশ মাথা দুলাইয়াছিলেন, ”ঠিক কথা, সে তোমাকেও যে নিয়ে যাচ্ছিল-”

কৃষ্ণা বলিয়াছিল, ”আপনি একজন এতবড় ডিটেকটিভ হয়েও তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলেন না কাকাবাবু? সে জেনেছে আমি তাকে চিনেছি, আর কেউ তার নাম-ঠিকানা কিছুই দিতে পারবে না, সেই জন্যেই সে আমায় নিয়ে যাচ্ছিল। বর্মায় নিয়ে গিয়ে কি করত কে জানে! হয়তো শেষ পর্যন্ত পিন বিঁধিয়ে দিত, চোখ উপড়ে নিত, জিভ কেটে ফেলত-”

প্রণবেশ আতঙ্কে বিবর্ণ হইয়া গেলেন, ”ও বাবা, এ সবও তারা করে নাকি?”

ব্যোমকেশ গম্ভীরমুখে বলিলেন, ”তা করে বইকি! আমাদের এখানেও চোর-ডাকাতেরা যে কত কাণ্ড করে!”

কৃষ্ণা বলিল, ”এখানকার চোর-ডাকাত আর বার্মিজ ডাকাতে অনেক তফাৎ কাকাবাবু! ইউউইনের মতো নৃশংস লোক আর দুনিয়ায় নেই বললেও চলে। আমি আগে তার সম্বন্ধে সব কথাই তো আপনাকে বলেছি, তাতে নিশ্চয়ই তাকে কতকটা বুঝেছেন। তাছাড়া তার অদ্ভুত কাজ তো নিজের চোখেই দেখেছেন। বর্মায় সে যে কতখানি বিখ্যাত তা আপনার ভাইয়ের কাছে শুনেছেন, আমার মামাকে দেখেও বুঝেছেন-বলো না মামা, ওখানে কি দেখলে-শুনলে তা তো একবারও বলোনি এখনও!”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”এখন থাক, সে বিস্তৃত কাহিনি শুনতে নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ দেরি লাগবে-কি বলেন প্রণবেশবাবু?’

প্রণবেশ বলিলেন, ”বিশদভাবে বলতে গেলে তা লাগবে বৈকি! এখন সে সব কথা থাক, আমরা বাড়িতে গেলে ব্যোমকেশবাবু যখন যাবেন তখন একসময় এ সব গল্প করলেই হবে।”

মাতুল প্রণবেশের সহিত কৃষ্ণা বাড়ি ফিরিল।

সঙ্গে আসিল, ব্যোমকেশের বিশ্বাসী ভৃত্য তারক ও দাসী পার্বতী। তারক বিশ্বাসী লোক, পনেরো-ষোল বৎসর বয়সে সে ব্যোমকেশের পিতার নিকটে কাজ পায়। এখানে কাজ করিয়া তাহার মাথার সব চুলই সাদা হইয়া গেছে। দীর্ঘ দুই মাস অসুস্থ কৃষ্ণা ব্যোমকেশের বাড়িতে কাটাইয়াছে, নিকটস্থ লাইব্রেরি হইতে ইংরাজি-বাংলা ইত্যাদি নানারকম বই তারকই তাহাকে আনিয়া দিয়াছে।

পার্বতীর দেশ মজঃফরপুর জেলা হইলেও সে অনেককাল বাংলায় থাকিয়া প্রায় বাঙালি হইয়া গেছে। এই কলকাতাতেই নাকি সে ও তাহার কন্যা যখন গুন্ডাদের হাতে অত্যন্ত নির্যাতিত হয়, সেইসময় ব্যোমকেশবাবু তাহাদের উদ্ধার করেন বলিয়া মাতা ও কন্যা তাঁহার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তাহারা উভয়েই ব্যোমকেশের বাড়িতে কাজ করে এবং সেইখানেই থাকে। বিশ্বাসী এই দাসীটিকে ব্যোমকেশ কৃষ্ণার নিকট সর্বক্ষণ থাকিবার জন্য দিলেন, পার্বতীর কন্যা তাঁহার বাড়িতেই রহিল।

বাড়িতে দারোয়ান ও ভৃত্যেরা আছে। আগে যাহারা ছিল, ব্যোমকেশ তাহাদের বিদায় দিয়াছেন, তাঁহারই জানাশোনা দুইজন দারোয়ান ও একজন ভৃত্য এই বাড়িতে ছিল, কাজেই বাড়ি ও বাগান কিছু অপরিষ্কার নাই।

ঘরগুলো চাবি বন্ধ ছিল। সমস্ত জানলা-দরজা খুলিয়া দিতে অন্ধকার ঘর আলোয় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

পিতার ঘরের দরজার উপর দাঁড়াইল-কৃষ্ণা।

এইসময়ে তাহার মনে হইতেছিল, পরলোকগত মিঃ চৌধুরির কথা। দরজার সামনাসামনি দেওয়ালে মিঃ চৌধুরির বৃহৎ অয়েল পেন্টিং-প্রতিকৃতি। মনে হয়, সহাস্যমুখে তিনি কন্যার পানে তাকাইয়া আছেন।

কৃষ্ণা যুক্ত করে পিতাকে প্রণাম করিল-মনে মনে প্রার্থনা করিল, সে যেন মানুষ হইতে পারে, সে যেন প্রতিজ্ঞা পালন করিতে পারে। জীবনে আর তাহার কিছুই কাম্য নাই।

ঘরের মেঝেয় কোনো চিহ্ন ছিল না, তথাপি কৃষ্ণার মনে হইল, মেঝেয় পিতার বুকের রক্ত যেন এখনও জমিয়া আছে। সে রক্ত কিছুতে যায় নাই-শতসহস্রবার ধুইলেও যাইবে না! একদা প্রভাতে মূর্ছাভঙ্গে ব্যোমকেশের সঙ্গে কৃষ্ণা এইখানে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল-সামনে পিতার রক্তাপ্লুত মৃতদেহ দেখিয়া সে আত্মসম্বরণ করিতে পারে নাই। ব্যোমকেশ তাহাকে বাধা দিতে পারেন নাই, সে পিতার দেহের উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়াছিল।

তারপর পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া সে শপথ করিয়াছে, তাঁহার হত্যার প্রতিশোধ সে লইবে, সে প্রতিজ্ঞা সে ভুলে নাই, গত তিন মাসের প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে সে মনে করিয়াছে তাহাকে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিতেই হইবে।

ব্যোমকেশের কাছে এ কথা বলিতে তিনি গম্ভীরভাবে কেবল মাথা নাড়িয়াছেন, স্পষ্টই বলিয়াছেন, ”এ কি সম্ভব হতে পারে কৃষ্ণা! তুমি মেয়ে-তার ওপর তোমার বয়স নেহাৎ কম, তুমি তোমার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ কি করে নেবে? সংসারের কতটুকুই বা তুমি জানো, বল? দুনিয়ায় এমন সব লোকের সংস্পর্শে আমাদের আসতে হয়েছে, যারা ইউউইনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরা আমাদের কাজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, তাদের ধরা বা শাস্তি দেওয়া কতখানি বিপজ্জনক! ও সব চিন্তা তুমি ছাড়,-নিজের বাড়িতে থেকে বরং পড়াশোনা করো, যা করবার আমরাই করব!”

কৃষ্ণার মুখে যে এতটুকু হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছিল, সে হাসি প্রণবেশ চেনেন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই মেয়েটির পরিচয় ব্যোমকেশ সামান্য কয়েক মাসে পান নাই, তাই তিনি তাহাকে সাধারণ বালিকার পর্যায়ে ফেলিয়াছেন।

কৃষ্ণা তিন মাস আগেকার প্রতিজ্ঞা নূতন করিয়া মনে করিল। পিতার ঘরের দরজায় নিজের হাতে চাবি বন্ধ করিয়া সে চাবি নিজের ড্রয়ারে রাখিয়া দিল, এ ঘর সে খুলিয়া রাখিল না।

দুই

সেদিন কৃষ্ণার পিতৃবন্ধু রেঙ্গুন কোর্টের উকিল অবিনাশবাবু পত্র দিয়াছিলেন। কৃষ্ণা পত্রখানা পড়িয়া প্রণবেশকে ডাকিতে পাঠাইল।

কিছুক্ষণ পরে সর্বাঙ্গে মাটিমাখা লুঙ্গি পরিহিত প্রণবেশ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাগানে প্রত্যহ সকালের দিকে তিনি মাটি মাখিয়া ব্যায়াম করেন।

পরম বিলাসী-একান্ত বাবুপ্রকৃতির প্রণবেশের পক্ষে এ এক আশ্চর্য পরিবর্তন। কৃষ্ণা জানিত না প্রণবেশ ব্যায়াম করেন, তাই সে আশ্চর্য দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

প্রণবেশ তাহার দৃষ্টির অর্থ বুঝিলেন, লজ্জিতভাবে একটু হাসিয়া বলিলেন, ”এই গিয়ে, আজকাল একটু ব্যায়ামচর্চা করছি, কৃষ্ণা! গায়ে জোর না থাকলে তার বেঁচে থাকাই যে মিথ্যা হয়, তার প্রমাণ আমি কিছুদিন আগেই পেয়েছি। আমার গায়ে যদি জোর থাকত, তাহলে কি মাত্র দুজন লোকে আমায় টেনে একটা গাড়িতে তুলতে পারত? এক ঝটকা মেরে তাদের দুজনকে ফেলে দিতুম না?”

সকৌতুকে কৃষ্ণা বলিল, ”মাত্র দুজন লোক তোমার মতো একজন জোয়ান লোককে ধরে গাড়িতে তুললে মামা, আর তুমি একটু চিৎকারও করতে পারনি?”

প্রণবেশ হতাশভাবে একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন, ”শোনো কথা-চিৎকার করব কি করে? তোমার কথামতো ইয়াং চাং-সাহেবকে খুঁজতে যেতে হয়েছিল কোথায় তা জান? একটা অন্ধকার গলির গোলকধাঁধায়! গলির মুখে দাঁড়িয়ে যখন ভাবছিলুম, ফিরব কি ওর মধ্যে যাব, সেইসময় সেই নির্জন জায়গায় দুজন লোক হঠাৎ বেরিয়ে এসে আমায় চেপে ধরে। গায়ে জোর ছিল না বলেই না সেই চিনেম্যান দুটো-”

কৃষ্ণা সবিস্ময়ে বলিল, ”চিনেম্যান! ইউউইনের দলে-চিনেম্যানও আছে নাকি?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”নেই? শুধু চিনেম্যান কেন-জাপানি, ইংরেজ, ভারতীয়, আমেরিকান-সবই আছে। এমন কোনো দেশের লোক নেই যে তার দলে নেই!”

কৃষ্ণা বলিল, ”তুমি এসব জানলে কি করে মামা? এই তো বলেছ, তোমায় তারা ক্লোরোফর্মে অজ্ঞান করে রেখেছিল!”

প্রণবেশ বলিলেন, ”ব্যাপারটা প্রায় তাই হলেও অনেকটা জেনেছি রে বাপু! সে সব কথা তোমরাও জানতে চাওনি, আমারও বলা হয়নি। আমার জ্ঞান ফিরেছিল, জাহাজে। মাথার কাছে একটা ছোট জানলা ছিল। সেটা দিয়ে-জীবনে যা কোনোদিন দেখিনি সেই সমুদ্রও দেখতে পেয়েছিলুম। ওরা ভেবেছিল আমি অজ্ঞান হয়েই আছি, তাই আমার দিকে তত বেশি দৃষ্টি রাখেনি। যেই দেখতুম কেউ সেই কামরায় আসছে-অমনি চোখ মুদে আড়ষ্টভাবে থাকতুম, যাতে কেউ এতটুকু সন্দেহ করতে না পারে।”

কৃষ্ণা উৎসুক হইয়া বলিল, ”তারপর?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”সে কামরাটায় ছিল শুধু চাল, ডাল, নুন আর কতগুলো মুরগি, শুয়োর! আমি শেষটায় খিদের জ্বালায় অনেক রাত্রে যখন চুপি চুপি বার হয়েছিলুম, সেই সময়েই সেইসব লোককে দেখেছিলুম।”

কৃষ্ণা বলিল, ”ধরা পড়নি?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”তবে আর বলছি কি! অন্ধকারের মধ্যে চলতে চলতে একটা চিনেম্যানকে মাড়িয়ে দিতেই ‘চ্যাং-চুং’ করে সে উঠল জেগে, আর ‘ল্যাং-চ্যাং’ করে চেঁচিয়ে জাহাজসুদ্ধ লোককে দিল জাগিয়ে! সেইসময়ই তো পাঁচ-সাতজনে ধরে বেঁধে আমায় কি যে একটা ওষুধ খাওয়ালে-যাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। তারপর কতদিন জানি না, জ্ঞান ফিরতে দেখলুম, রেঙ্গুনের এক ভদ্রলোক, নাম অবিনাশ রায়-”

কৃষ্ণা আনন্দে বলিয়া উঠিল, ”হ্যাঁ হ্যাঁ, তিনি যে আমার বাবার খুব বন্ধু ছিলেন, তাঁর বাড়ির পাশেই তো আমাদের বাড়ি-‘হ্যাপি-ম্যানশন’! তুমি নিশ্চয়ই সে বাড়ি দেখেছ মামা?”

মুখ ভারী করিয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”হাঁঃ, তখন আমার দেখবার মতো অবস্থা কিনা! আমার বাড়ি কলকাতায়, নাম প্রণবেশ মিত্র…এই কথা-কটাই কোনোরকমে বলেছিলুম, বোধহয় তারপর তিনি ব্যোমকেশবাবুর ভাইয়ের জিম্মায় আমাকে দেন। কোনোক্রমে যে এসে পড়েছি এই ঢের, নইলে আমাকে আর পেতে হত না, কৃষ্ণা! পিতৃবংশ তো ধ্বংস, মাতুলবংশও খতম হত।”

কৃষ্ণার চোখ দুইটি অল্পে অল্পে সজল হইয়া উঠিল। সত্যই পিতৃবংশে তাহার কেউ নাই, মাতৃবংশেও একটি মামা ছাড়া আর কেউ নাই। দাদামশাই-দিদিমা ছিলেন, তাঁহারা পরপর ছ’মাসের মধ্যে ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন।

তাহার চোখের পানে তাকাইয়া প্রণবেশ বলিয়া উঠিলেন, ”অমনি চোখে জল এল-বেশ মেয়ে তো! ভয় নেই, আমি মরছিনি, সহজে মরবও না।”

কৃষ্ণা গোপনে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া শুষ্কহাসি হাসিয়া বলিল, ”তাই কি মরতে পার মামা! আমার প্রতিজ্ঞা পালন করতে যে তোমাকেই আমার দরকার। যতক্ষণ না ইউউইনের চরম শান্তি হয়, ততক্ষণ আমার বাবার আত্মা শান্তিলাভ করবে না, আমিও শাস্তি পাব না।”

উৎসাহিত প্রণবেশ বলিলেন, ”সেইজন্যে আমিও আমাদের দারোয়ান প্রতাপসিংয়ের কাছে কুস্তি শিখছি কৃষ্ণা। প্রতাপসিং বলে-আমি যদি রোজ ব্যায়াম করি, আমার গায়ে যা শক্তি হবে, তাতে আমি অমন দু-পাঁচজন লোককে ধরে আছাড় দিতে পারব।”

কৃষ্ণার হাসি আসিতেছিল, কিন্তু হাসিয়া সে মামাকে ছোট করিল না।

টেবলের উপরিস্থিত পত্রখানা দেখাইয়া বলিল, ”ওসব কথা এখন থাক মামা, অবিনাশ রায় এই পত্রখানা দিয়েছেন, পড়ে দ্যাখ।”

প্রণবেশ পত্রখানা তুলিয়া লইয়া পড়িলেন।

অবিনাশ রায় লিখিয়াছেন : তিনি পূর্বে মিঃ চৌধুরির অকস্মাৎ মৃত্যুর সংবাদ পান নাই, সংবাদপত্রে এই নৃশংস হত্যাকাহিনি পড়িয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছেন। তিনি শুনিয়াছেন, মিঃ চৌধুরি এখান হইতে যে নকশা, প্রতিলিপি ও কাষ্ঠ-পাদুকা লইয়া গিয়াছিলেন তাহা অপহৃত হইয়াছে। শুনিয়া তিনি প্রথমে বিশ্বাস করিতে পারেন নাই যে, দুর্দান্ত দস্যু সর্দার ইউউইন নিজেই কলকাতায় গিয়া এ সব অপহরণ করিয়াছে।

এই সম্পর্কে অনেক কথা বলিয়া ও কৃষ্ণাকে সান্ত্বনা দিয়া পরে তিনি লিখিয়াছেন: কৃষ্ণার বাড়ি ‘হ্যাপি-ম্যানশন’ মিঃ চৌধুরির আদেশানুযায়ী বিক্রয়ার্থে আছে। এই বাড়িটি কিনিবার জন্য জনৈক চিনা-ধনকুবের তাঁহার সহিত কথাবার্তা বলিয়াছেন। এ সম্বন্ধে কৃষ্ণার মত জানিয়া তবে তিনি তাঁহাকে কথা দিবেন।

প্রণবেশ মাথায় হাত বুলাইলেন-”আবার চিনেম্যান!”

কৃষ্ণা বলিল, ”কি রকম বুঝছ, মামা?”

মামা ভাবিয়া বলিলেন, ”চিনেম্যান বাড়ি কিনবে বলছে বলেই ভাবছি।”

কৃষ্ণা বলিল, ”ওখানে আর বাঙালি কে বাড়ি কিনবে বল? ওখানকার বাড়ি কিনবে হয় চিনেম্যান, নয় বার্মিজ, অথবা ইন্ডোচিনের লোকেরা! বাঙালি যারা ও অঞ্চলে গেছে তাদের মধ্যে খুব কম লোকই নিজের বাড়ি করেছে।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”কিন্তু ওই চিনেম্যানগুলোকে আমি মোটেই দেখতে পারি না। ওদের ওই হলদে রং, থ্যাবড়া মুখ আর খাঁদা নাক; তার ওপর চ্যাং-চ্যাং করে কথা! আবার খাওয়াও কি রকম জঘন্য দ্যাখো-আরশুলা, ব্যাং আর যা কিছু দুনিয়ার আবর্জনা-কিছুই ওরা বাদ দেয় না। সমরবাবুর মুখে শুনলুম, বার্মিজদের খাওয়া নাকি অমনি, তারা নাকি আবার ‘লাপ্পি’ খায়। সে লাপ্পি আবার এমন বিদঘুটে জিনিস যা-”

কৃষ্ণা গম্ভীরভাবে বলিল, ”যাদের দেশে যা খায় তা নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয় মামা। এই বাংলাদেশে তোমরা আবার এমন অনেক জিনিস খাও, যা দেখে ওরাও আশ্চর্য হয়, তোমারই মতো ঘৃণায় শিউরে ওঠে! যাক, ও সব কথা এখন যেতে দাও, এখন বল, ওই চিনেম্যানটাকে বাড়ি বিক্রি করবার মত আমি দেব কিনা।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”দাম ঠিক দেবে তো?”

কৃষ্ণা হাসিল, বলিল, ”তুমি হাসালে মামা। দাম না দিয়ে কেউ বাড়ি নেবে, না আমরাই দেব? আমার এখন এই বাড়িটা বিক্রি করার ইচ্ছে ছিল না। যদি কোনোদিন আবার ওখানে যেতে হয়-”

প্রণবেশ বলিয়া উঠিলেন, ”একটু ভেবে দেখা যাক, তারপর যাতে ভালো হয় তাই করতে হবে।”

তিনি বাহির হইয়া গেলেন।

তিন

ফোনটা ক্রিং ক্রিং করিয়া উঠিতে কৃষ্ণা ফোন ধরিল।

”হ্যালো…কে?”

উত্তর আসিল, ”আমি কি-কুমারী কৃষ্ণা চৌধুরির সঙ্গে কথা বলছি? তাঁর কাছেই আমার দরকার।”

কৃষ্ণা বলিল, ”হ্যাঁ, আমিই কৃষ্ণা চৌধুরি। আপনি কে,-নামটা জানতে পারি?”

উত্তর আসিল, ”আমি ইয়াং চ্যাং। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই। আমি এখুনি আপনার ওখানে যাচ্ছি, বাড়িতেই থাকুন, আমি না যাওয়া পর্যন্ত কোথাও যাবেন না।”

কৃষ্ণা স্বীকৃত হইয়া ফোন ছাড়িয়া দিল।

প্রণবেশ তখন বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, কৃষ্ণা বাধা দিল, ”এখন তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না মামা, ইয়াং চ্যাং সাহেব আসছেন, তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা কইতে হবে। কি কতকগুলো জরুরি কথা তাঁর আছে, যা তিনি ফোনে বলতে চান না, সামনাসামনি বলতে চান। আমি শুধু ভাবছি-আর্থার মুরের ছদ্মবেশে ইউউইন যেমন আমার চোখে ধুলো দিয়ে কোথায় কি আছে সব জেনে গেল, তারপর রাত্রে এসে সর্বনাশ করল, এ আবার তেমনি ব্যাপার না হয়! ইয়াং চাংয়ের নামই শুনেছি, তাঁকে চোখে কখনও দেখিনি, একমাত্র বাবাই তাঁকে চিনতেন। যাই হোক, তুমি এখনও কোথাও যেও না, বাড়িতেই থাক।”

প্রণবেশ বলিলেন, ইয়াং চাংকে ব্যোমকেশবাবু চেনেন শুনেছি। তাঁকে ফোন করে দিই, তিনি যদি এইসময়ে এসে পড়েন তাহলে কোনো গোলই হবে না।”

পাশের ঘরে তিনি ফোন করিতে গেলেন।

একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, ”ব্যোমকেশবাবু একটু পরেই আসছেন বললেন। এর মধ্যে যদি ইয়াং চাং আসেন, আমি বৈঠকখানায় যাচ্ছি, সেখান থেকে তোমায় খবর পাঠাব।”

প্রণবেশ চলিয়া গেলেন।

কৃষ্ণা নিজের ঘরে আসিল।

পিতার কতকগুলি ডায়েরি সম্প্রতি সে আবিষ্কার করিয়াছে, এগুলি একটা ড্রয়ারে বন্ধ ছিল। কৃষ্ণা এগুলি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, যদি এগুলি হইতে কিছু জানা যায়। ডায়েরি পড়িতে পড়িতে সে স্তম্ভিত হইয়াছে, বিস্মিত হইয়াছে, পিতার কার্যপ্রণালীর ক্রমধারা দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছে।

সত্যকথা বলিতে গেলে, ডিটেকটিভের কার্য সম্বন্ধে তাহার অভিজ্ঞতা খুবই কম। ব্যোমকেশের সহিত এই কয়মাস মিশিয়া তাঁহার মধ্যে সে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখিতে পায় নাই যাহাতে আশ্চর্য হইতে হয়। অতি সাধারণ একজন পুলিশ অফিসার যাহা করিয়া থাকেন, তিনিও তাহাই করেন, সূত্র খুঁজিয়া অপরাধীকে ধরার প্রয়োজন তাঁহার হয় নাই, অপরাধী যেন আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত হয়, হাতে কেবল হাতকড়া লাগানোর অপেক্ষা।

কৃষ্ণা ইহার মধ্যে অনেক ডিটেকটিভ-সংক্রান্ত পুস্তক পড়িয়া ফেলিয়াছে। সে সব কাহিনি পড়িতে পড়িতে সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হইয়া উঠে, মন বিস্ময়ে ডুবিয়া যায়। পিতার ডায়েরির মধ্যে সে সেইসব দৃষ্টান্ত পায়-সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে। পিতা এমন বহু দুষ্কৃতকারীদের নানা কৌশলে ধরিয়াছেন, তাঁহাকে সেজন্য কত কষ্টই সহিতে হইয়াছে!

তারক আসিয়া বলিল, ”একবার বৈঠকখানায় যেতে হবে মা, ইয়াং চাং-সাহেব এসেছেন।”

হাতের বইগুলো নামাইয়া রাখিয়া কৃষ্ণা উঠিল।

বৈঠকখানার দরজার সামনের পরদা সরাইতেই দেখা গেল, প্রণবেশ টেবলের একধারে বসিয়া আছেন, তাঁহার সামনে টেবলের ওধারে বসিয়া একটি বৃদ্ধ বার্মিজ ভদ্রলোক, তাঁহার পার্শ্বের চেয়ারে বসিয়া একটি সুন্দরী বার্মিজ মেয়ে, মনে হয় এই ভদ্রলোকের কন্যা।

তাঁহাদের মূল্যবান বেশভূষাই পরিচয় দেয় তাঁহারা সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভব; তাঁহাদের মার্জিত ইংরাজিভাষায় কথাবার্তা পরিচয় দেয় তাঁহারা উচ্চশিক্ষিত।

কৃষ্ণা প্রবেশ করিতেই প্রণবেশ পরিচয় দিলেন, ”এই যে, এইটি আমার ভাগনী, মিঃ চৌধুরির মেয়ে, কুমারী কৃষ্ণা চৌধুরি…আর ইনিই ধনকুবের মিঃ ইয়াং চাং, আর ওঁর একমাত্র মেয়ে কুমারী মা-পান-উনি এবার ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে বি-এ ডিগ্রি পেয়েছেন।”

কৃষ্ণা সসম্ভ্রমে অভিবাদন করিল। মিঃ ইয়াং চাং ও কুমারী মা-পান তাহাকে নমস্কার করিয়া বসিতে দিলেন।

মিঃ ইয়াং চাং আস্তে-আস্তে বলিলেন, ”একটু আগে আমি তোমাকেই ফোনে কথা বলতে ডেকেছিলুম। আমি অনেকদিন থেকে তোমার সঙ্গে একবার আলাপ-পরিচয় করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু প্রতিবারই একটা না একটা বাধা এসেছে তা বোধহয় তুমিও জান, মিস চৌধুরি!”

কৃষ্ণা মাথা কাত করিল, বলিল, ”হ্যাঁ, জানি। আমার বাবা এখানে এসেই নকশা আর প্রতিলিপি আপনাকে দেবেন বলে যখন আপনার খোঁজ করেছিলেন, তখন আপনার এত কাজ পড়েছিল যে-”

মিঃ ইয়াং চাং বাধা দিলেন, আরক্তিম মুখে বলিলেন, ”ওইখানেই ভুল হয়েছিল মিস চৌধুরি, কারণ আমি তাঁর এখানে আসার সংবাদ মোটেই পাইনি। আমিও বড় কম প্রতারিত হইনি মিস চৌধুরি! আমার প্রাইভেট সেক্রেটারি মহীদল সবরকমে আমার সর্বনাশ করেছে।”

মা-পান মৃদুকণ্ঠে বলিল, ”মিস চৌধুরিকে সব কথাগুলো বলা উচিত মনে করি বাবা।”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”হ্যাঁ, সব কথা আমি বলব বলেই এসেছি। আমি এ কষ্ট কিছুতেই দূর করতে পারছিনি যে, আমারই জন্যে আজ মিঃ চৌধুরি নিহত হয়েছেন,-তাঁর এতটুকু এই মেয়েটির আজ জগতে মামা ছাড়া আর কেউ নেই!”

কৃষ্ণার মুখখানা করুণ হইয়া উঠিল, সে মুখ ফিরাইল।

প্রণবেশ বলিলেন, ”আপনার সেক্রেটারির নামটা কি বললেন-পদ্মদল না চরণদল!”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”মহীদল। এ রকম নাম হওয়ার কারণ সে লোকটি বার্মিজ নয়, সে আসাম দেশের লোক-যাকে সোজা কথায় আমরা আসামি বলি। আমার যেখান থেকে যে সব চিঠিপত্র আসে বা যে কেউ ফোন করে, সব কিছুরই ভার থাকত ওই মহীদলের ওপরে। বিশেষ দরকার না হলে আমি চিঠিপত্র পড়িনি-উত্তরও দিইনি-ফোনও ধরিনি। মহীদলের ওপরেই এ সব ভার ছিল, আর সে আজ তিন বৎসর ধরে একান্ত বিশ্বাসের সঙ্গে এ সব কাজ করে আসছিল। সেই লোক-সে যে ইউউইনের গুপ্তচর, তা আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি, জানতে পেরেছি মাত্র কাল রাত্রে-তার দু-দুদিন আগে সে তার দেশে যাওয়ার নাম করে দীর্ঘদিনের ছুটি নিয়ে গেছে।”

”ইউউইনের গুপ্তচর!”

প্রণবেশ চমকাইয়া বিবর্ণ হইয়া গেলেন। কৃষ্ণা বিস্ফারিত নেত্রে মিঃ ইয়াং চাংয়ের পানে তাকাইয়া রহিল।

মা-পান বলিল, ”মিঃ মহীদল সুশিক্ষিত মার্জিতরুচি ভদ্রলোক। বাবা তাঁকে কাজে নিতে চাননি, আমিই একরকম জোর করে তাঁকে বাবার এই কাজটা দিয়েছিলুম। বাবার যিনি প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন, তিনি সে সময় মারা যান, এ তাঁরই সম্পর্কীয় ভ্রাতুষ্পুত্র, তাঁর কাছেই মানুষ, কাজেই অবিশ্বাস করতে পারিনি। তিনি যে শেষ পর্যন্ত এ রকম বিশ্বাসঘাতকতা করবেন তা আমাদের স্বপ্নেরও অতীত ছিল। মহীদল ছুটি নিয়ে চলে গেল, আমার ছুটি থাকায় আমিই তাঁর ত্যক্ত কাজ করছিলুম, হঠাৎ একতাড়া পত্র পেয়ে সেগুলো দেখতে দেখতে আপনাদের কথা জানতে পারলুম।”

প্রণবেশ বিস্মিত হইয়া বলিলেন, ”মিঃ চৌধুরিকে রেঙ্গুনে পত্র দিয়ে এখানে নকশা আনার কথাও কি মহীদল বলেছিলেন?”

মিঃ ইয়াং চাং বিষণ্ণকণ্ঠে বলিলেন, ”না। সে কথা আমিই মহীদলকে লিখতে বলি। পত্রে স্বাক্ষর আমারই ছিল।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”কিন্তু একটা কথা-নকশা, প্রতিলিপি সবই তো ইউউইন নিয়ে গেছে, আপনার মহীদলও পালিয়েছেন! এখন হঠাৎ আপনাদের এখানে আসা, এ সব কথা বলার কারণ আমি ঠিক নির্ণয় করতে পারছি না।”

মিঃ ইয়াং চাং একটু হাসিয়া বলিলেন, ”বুঝেছি, এতে আপনাদের সন্দেহ হচ্ছে। সন্দেহের কোনো কারণ নেই প্রণবেশবাবু, আমি এসেছি সত্যকথা জানতে, ক্ষমা চাইতে। কারণ, আমি জানি, এই নকশার জন্যেই মিঃ চৌধুরি হত হয়েছেন আর সে নকশা তিনি আমারই জন্যে এনেছিলেন। আপনারা আগাগোড়া না শুনলে কিছু বুঝবেন না, আমি সব বলছি শুনুন।”

চার

কৃষ্ণার বিবর্ণ মলিন মুখের পানে তাকাইয়া বৃদ্ধ ইয়াং চাং বলিতে লাগিলেন :

”আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন, আমরা বর্মার এক পুরাতন রাজবংশে জন্মেছি? আমাদের এক পূর্বপুরুষ নানা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে যখন দেশ ছেড়ে এই ভারতে পালিয়ে আসেন, তখন তিনি তাঁর বিরাট ধনসম্পত্তি একটা নির্দিষ্ট গুপ্তস্থানে পুঁতে রাখেন। তার একখানা নকশাও তিনি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু সেখানা কেমন করে ক্রমে ক্রমে হস্তান্তর হয়ে ঘুরতে থাকে, তা আমি জানি না।

”তবে আজও যে কেউ সেই নকশার নির্দিষ্ট গুপ্তস্থান খুঁড়তে যায়নি, সে কথা আমি জানি। আমার যে সব বন্ধু-বান্ধব বর্মায় আছে, তারা সর্বদা সতর্ক আছে, কেউ সন্ধান পেয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করলেই সে কথা আমায় তারা জানাবে। একই বংশে জন্মেছি আমরা-আমি আর ইউউইন।

”ইউউইনের পিতা আমার সম্পর্কে ভাই ছিলেন। তিনি ইউরোপে বেড়াতে গিয়ে একটি ইউরোপিয়ান মেয়েকে বিবাহ করে আনেন, তিনিই ইউউইনের মা। কাজেই, ইউউইনকে কেবল বার্মিজ বলা চলে না।

”ছোটবেলা থেকেই সে অত্যন্ত দুর্দান্ত-প্রকৃতির-অত্যন্ত নৃশংস তার আচার-ব্যবহার। বরাবরই দল বেঁধে সর্দারি করবার ঝোঁক তার মধ্যে দেখা যেত এবং সেইজন্যেই সে তরুণ বয়সেই বেশ একজন পাকা ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠেছিল।

”আমার সঙ্গে তার কোনো দিনই মিল হয়নি, সে বুঝতো আমি তাকে ঘৃণা করি। আমাদের বংশের কতকগুলি পুরাতন নিদর্শন ছিল, মিঃ চৌধুরি তার মধ্যে দু-খানা পেয়েছিলেন। একটি-বুদ্ধদেবের মূর্তি-সম্বলিত কতকগুলি বাণী, দ্বিতীয়-বুদ্ধদেবের কাষ্ঠ-পাদুকা। আর কয়েকটি জিনিস ছিল আমার কাছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, মূল্যবান পাথরের মালা, মাঝখানে বেশ বড় এক টুকরো হীরক-প্রবাদ আছে, এটি বুদ্ধদেবের গলার মালা, আর একটি ভিক্ষাপাত্র। পুরুষানুক্রমে এগুলি আমার কাছেই ছিল-আমিও খুব যত্নে এগুলি আমার কাছে রেখেছিলুম। আমাদের পিতৃপুরুষের আর একটি নিদর্শন আমার কাছে এখনও আছে-একটি হাতির দাঁতের কৌটোয় একটি হীরকাঙ্গুরীয়। প্রবাদ আছে, এই হীরকাঙ্গুরীয় যার কাছে থাকবে, সে কখনও কোনো বিপদে পড়বে না-”

কৃষ্ণা এইখানে বাধা দিল, বলিল, ”এটা নেহাত প্রবাদ-কথা। কারণ, এই হীরকাঙ্গুরীয়-আপনার যে পূর্বপুরুষ তাঁর অসীম সম্পত্তি মাটিতে পুঁতে রেখে এসেছিলেন, তাঁর কাছেই তো ছিল?”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”না। তাঁর দুর্ভাগ্যক্রমে এক বৎসর আগে এই অঙ্গুরীয় তিনি হারিয়েছিলেন, তাই তাঁর দুর্গতির একশেষ হয়েছিল। এই অঙ্গুরীয় ফিরে পান তাঁরই এক বংশধর এবং এই অঙ্গুরীয় নিয়েই ইউউইনের সঙ্গে আমার বিবাদ হয়। সে অঙ্গুরীয় নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি দেইনি। তাতেই সে ক্রুদ্ধ হয়ে আমার একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে, আমাকেও হত্যা করবার জন্যে অনেক চেষ্টা করে। বিপদ ক্রমে বাড়তে লাগল দেখে আমি মা-পানকে নিয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছি।”

প্রণবেশ সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ”আপনি ও সব মানেন?”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”মানি বইকি, অন্তরের সঙ্গে মানি। ওই হীরকাঙ্গুরীয় আমার কাছে থাকার জন্যে আমার যত বিপদই আসুক, সব কেটে যায়, আমার ঝিমিয়ে পড়া মন আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কর্মে উদ্দীপনা জাগে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”আপনার ভূতপূর্বও সেক্রেটারি নিশ্চয়ই জানতেন, কোথায় কিরকমভাবে জিনিসগুলো রাখা হয়েছে, অবশ্য তিনি যদি সত্যই ইউউইনের লোক হন-”

উত্তেজিতভাবে মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”এতে আর সত্যি-মিথ্যে নেই-সে যথার্থই ইউউইনের গুপ্তচর। সেদিন রাত্রে আমার ঘরের সমস্ত সে খুঁজেছে, কিছুই পায়নি। আমার চাকর হিয়েন তাকে দেখতে পেয়েছে, পাছে তার পরদিন সকালেই ধরা পড়ে সেই ভয়ে রাতারাতি মহীদল পালিয়েছে। কিন্তু যা সে খুঁজেছিল তার কিছুই পায়নি, অনর্থক সে শুধু কষ্টই করেছে।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”মহীদল যখন অত খোঁজ করেছে, আপনারা তখন কি করছিলেন?”

মা-পান বলিল, ”আমিও তাই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলুম। বাবার শোবার ঘরে যা কিছু বাক্স, আলমারি, আয়রন-চেস্ট ছিল, সব খোলা পড়ে আছে, টাকাকড়ি যা যেখানে ছিল সব পড়ে আছে, মহীদল তার কোনো কিছু নেয়নি,-হাতও দেয়নি, অথচ বাবা সেই ঘরেই ঘুমিয়ে আছেন, তাঁর কিছুতেই ঘুম ভাঙেনি। মনে করুন, নিঃশব্দে মহীদল কাজ করেনি; একটু-আধটু শব্দও হয়েছে, হয়তো টর্চও জ্বেলেছিল-”

কৃষ্ণা বলিল, ”নিশ্চয়ই। বাইরে যত আলোই থাক, ঘরের ভেতর তো দারুণ অন্ধকার; বিশেষ জানা না থাকলে কোথায় কি আছে তা কেউ ঠিক করতে পারে না। বিনা আলোয় মহীদল যে সব দেখেছে, খুলেছে, তা তো মনে হয় না। তারপর আয়রন-চেস্টের চাবি-”

অত্যন্ত অসহায়ভাবে বৃদ্ধ ইয়াং চাং বলিলেন, ”হ্যাঁ, সে চাবি আমার মাথার বালিশের তলায় ছিল-”

কৃষ্ণা বলিল, ”তবেই বুঝুন, আপনাকে কোনোরকমে সে-রাত্রে অচেতন করে রাখা হয়েছিল, সেইজন্যেই আপনি শব্দও শোনেননি, আলোও দেখতে পাননি।”

মা-পান বলিল, ”ঠিক, আমিও বাবাকে এই কথাই বলেছি। কিন্তু বাবা মোটে বিশ্বাস করতে চান না।”

বৃদ্ধ ইয়াং চাং কেবল নিজের কেশ-বিরল মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন, একটি কথাও তিনি বলিতে পারিলেন না।

ইত্যবসরে আসিয়া পড়িলেন-ব্যোমকেশ।

মহা কোলাহলে তিনি মিঃ ইয়াং চাংকে অভিবাদন করিলেন-”এই যে, চাং-সাহেব সত্যই সশরীরে এসে উপস্থিত। কিন্তু সবারই মুখ বিমর্ষ দেখছি, ব্যাপার কি বলুন তো-কি হয়েছে?”

কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি বসুন কাকাবাবু, সব কথাগুলো আগে শুনুন, ইউউইনের আরও কারসাজির পরিচয় নিন।”

ব্যোমকেশ বলিলেন,-”বল-শুনি।”

কৃষ্ণা সংক্ষেপে ব্যাপারটা শুনাইল, মিঃ ইয়াং চাংও কিছু কিছু বলিলেন।

ব্যোমকেশ চোখ মুদিয়া কথাগুলো শুনিয়া গেলেন, তারপর বলিলেন, ”হুুঁ, ব্যাপারটা বুঝলুম। কবে এ ঘটনা ঘটেছে বলুন তো?”

মিঃ ইয়াং চাং হিসাব করিয়া বলিলেন, ”আজ চারদিন আগেকার কথা। সোমবারে মহীদল শেষ আমার কাছে কাজ করেছে, সোমবার রাত্রে সে আমার ঘর অনুসন্ধান করেছে, শেষরাত্রে যখন সে বেরিয়ে যায়, হিয়েন তখন তাকে দেখতে পায়। সে চিৎকার করবার আগেই নাকি মহীদল তাকে একটা রিভলবার দেখিয়ে ভয় দেখায়-চিৎকার করবার সঙ্গে সঙ্গে সে গুলি ছুঁড়বে। ভয় পেয়ে হিয়েন একটি শব্দমাত্র করতে পারেনি, সেই সুযোগে মহীদল পালিয়ে গেছে।”

ব্যোমকেশ গম্ভীরভাবে মাথা দুলাইয়া বলিলেন, ”হুঁ, বুঝেছি, মহীদল এখনও কলকাতাতেই আছে জানা যাচ্ছে। এ-ক’দিনের মধ্যে সে কোথাও যায়নি। নাঃ, আপনাদের বার্মিজ ডাকাতগুলো বড় ভাবিয়ে তুললে, চাং-সাহেব-”

মিঃ ইয়াং চাং শিহরিয়া উঠিলেন, ”কলকাতায় আছে, মানে? সে আমাদের গতিবিধি দেখছে?”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”প্রায় তাই। যাহোক, ভয় পাবেন না। যদি কলকাতায় থাকে আমি ধরবার চেষ্টা করব। হ্যাঁ, আপনার সেই আংটি, হার আর কি ভিক্ষাপাত্র বললেন, সেগুলো সব সাবধানে রাখবেন, দেখবেন যেন, কোনোরকমে নকশার মতো হাতছাড়া না হয়।”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”না। মহীদল বা ইউউইন হাজার চেষ্টা করলেও সে সব পাবে না। সেদিক দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত আছি, ব্যোমকেশবাবু! আচ্ছা, আমি এবার উঠি, ওদিকে অনেক কাজ আছে কিনা-”

তিনি কন্যাসহ উঠিলেন।

কৃষ্ণা মা-পানের সঙ্গে সঙ্গে চলিতে চলিতে বলিল, ”সময় পেলে আবার আসবেন! আগে আমায় একবার খবর দিলেই হবে, আমি বাড়িতে থাকব-আচ্ছা, নমস্কার!”

ভারতীয় প্রথায় নমস্কার করিয়া পিতা-পুত্রী গাড়িতে উঠিলেন।

পাঁচ

সেদিন মিঃ ইয়াং চাংয়ের বাড়িতে চা-পানের নিমন্ত্রণ ছিল।

বলা বাহুল্য-চা-পান একটা উপলক্ষ মাত্র। মিঃ ইয়াং চাং সেদিনে এ বাড়ি হইতে যাওয়ার পর তাঁহার মনে হইয়াছিল, কেবল ভদ্রতার অনুরোধে কৃষ্ণা, প্রণবেশ ও ব্যোমকেশ তাঁহার এই অদ্ভুত জিনিসগুলো দেখিতে চাহেন নাই। তাই মা-পান নিজে পত্র লিখিয়া বিশ্বাসী ভৃত্য হিয়েনের হাতে দিয়া পাঠাইয়াছেন-আগামি রবিবার তাঁহাদের সান্ধ্যকালীন চা-পান, মা-পানদের বাড়িতে হইবে এবং সেখানে তাঁহারা অনেক কিছু ইতিহাস-প্রসিদ্ধ জিনিসও দেখিতে পাইবেন।

রবিবার সন্ধ্যায় মিঃ ইয়াং চাংয়ের চৌরঙ্গিস্থিত বিশাল অট্টালিকায় কেবল কৃষ্ণা ও প্রণবেশেরই চা-পানের নিমন্ত্রণ হয় নাই, ব্যোমকেশও নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। বাইরের আর কোনো লোক এই টি-পার্টিতে নিমন্ত্রিত হন নাই, ইহাই ছিল ইহার বিশেষত্ব।

প্রকাণ্ড বড় হলঘরে মা-পান ও মিঃ ইয়াং চাং অতিথিদের সাদর অভ্যর্থনা করিয়া বসাইলেন।

এ বাড়িতে দাস-দাসী, দ্বারবান সবাই বার্মিজ; মিঃ ইয়াং চাং নিজের দেশের লোক ছাড়া আর কোনো দেশের লোক রাখেন নাই।

ব্যোমকেশ জানেন, এখানে তাঁহার যে-সব কারবার, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি আছে, সেগুলিতে বিশেষভাবে কাজ পায় তাঁহারই দেশের লোকেরা; নিতান্তপক্ষে বাধ্য হইয়া তিনি ভিন্নদেশীয়দের নিজেদের কাজে গ্রহণ করেন, নচেৎ নয়। স্বজাতিপ্রীতি এবং স্বদেশ-প্রেমের জন্য ব্যোমকেশ ইয়াং চাংকে খুব পছন্দ করেন।

অতিথিদের চা দিয়া মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”আমি যে কেবল চা-পানের জন্যেই আপনাদের নিমন্ত্রণ করেছি, তা নয়। আমার প্রিয়তমা কন্যা মা-পান সেদিন আপনাদের বাড়ি থেকে ফেরবার সময় প্রস্তাব করেছে-মিস চৌধুরিকে আমি যেন আমার বংশের প্রাচীন জিনিসগুলো দেখাই। মিস চৌধুরি ছেলেমানুষ, এ সব দেখার ইচ্ছা ওঁর হওয়াই স্বাভাবিক, সেইজন্যে আমি আজ আপনাদের এখানে চা-পানের নিমন্ত্রণ করেছি।”

উৎসাহিত হইয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”বাস্তবিক আপনি যখন আপনার পূর্বপুরুষের জিনিসগুলোর কথা বলেছিলেন মিঃ ইয়াং চাং, তখুনি ভেবেছিলুম-একবার দেখতে পেলে হত। প্রাচীন একটা রাজবংশের কীর্তিচিহ্ন, বুদ্ধদেবের ব্যবহৃত নানারকম জিনিস, এ সব কার না দেখতে ইচ্ছে হয় বলুন!”

ব্যোমকেশ শূন্য কাপটা টেবলে নামাইয়া রাখিয়া বলিলেন, ”বাস্তবিকই তাই চাং-সাহেব! আমার ওইসব ঐতিহাসিক জিনিস দেখতে খুব ভালো লাগে। আপনাদের বংশের সৌভাগ্যের প্রতীক আংটি, বুদ্ধদেবের ভিক্ষাপাত্র-আরও যে কি কি বলেছিলেন-”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”আপনারা আমার সঙ্গে আসুন ব্যোমকেশবাবু, আমি অনেক জিনিস আপনাদের দেখাব। মা-পান, তুমি মিস চৌধুরিকে নিয়ে এস-আমরা এগিয়ে চলি।”

বিরাট প্রাসাদের সর্বত্রই মিঃ ইয়াং চাংয়ের ঐশ্বর্যচিহ্ন! সিঁড়ি দিয়ে উঠিবার দুইপাশে দুইটি বৃহদাকার বাঘ বিরাট মুখ-ব্যাদান করিয়া আছে। হঠাৎ সেই পর্যন্ত আসিয়া কৃষ্ণা দাঁড়াইয়া গেল। মা-পান হাসিয়া পাশের সুইচ টিপিতেই বাঘ দুইটির মুখের মধ্যে আলো জ্বলিয়া উঠিল।

দ্বিতলে মিঃ ইয়াং চাংয়ের শয়নকক্ষ। তাহার পাশে মা-পানের শয়নকক্ষ। বিরাট অট্টালিকায় অতিথি সম্বর্ধনার জন্য সমস্ত আলোগুলি জ্বালিয়া দেওয়া হইয়াছে, কোথাও এতটুকু অন্ধকারের লেশমাত্র ছিল না।

মিঃ ইয়াং চাং অতিথিদের নিজের ঘরে লইয়া গেলেন।

ঘরের চারিদিকে দেওয়ালে গাঁথা আলমারি, এক কোণে আমেরিকার বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে প্রস্তুত বিরাট একটি আয়রন-চেস্ট।

মিঃ ইয়াং চাং সমস্ত দেখাইয়া আনিয়া অতিথিদের নিজের কাছে বসাইলেন।

বলিলেন, ”আমার বিশ্বস্ত-সেক্রেটারি মহীদল অনেকবার এ ঘরে এসেছে, মোটামুটিভাবে কোথায় কি আছে তা সে জানত, তাই যে কোনোরকমেই হোক আমায় ঘুম পাড়িয়ে চাবি হস্তগত করে সে সব কিছুই খুলে দেখেছে। আমার দলিলপত্র বা টাকাকড়িতে তার দরকার নেই, তাই সে কিছুই নেয়নি। যা সে খুঁজতে এসেছিল তা পায়নি, তার কারণ, সে সব আমার এখানে থাকে না, ব্যাঙ্কে অত্যন্ত বেশি নিরাপদ জায়গায় থাকে। আজ কেবল আপনাদের দেখাব বলেই আমি এনে আমার এই আয়রন-চেস্টে রেখেছি, কাল সকালেই আবার ব্যাঙ্কে নিয়ে গিয়ে রাখব! আজ সন্ধে আটটা থেকে চারজন সশস্ত্র প্রহরী এখানে মোতায়েন থাকবে, কাল যতক্ষণ না ওগুলো নিয়ে যাওয়া হয়।”

কৃষ্ণা বলিল, ”আপনারা এতক্ষণ যে নীচে ছিলেন, এগুলি তো সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল।”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”এই সন্ধ্যাবেলায় এমন কারও সাহস হবে না যে, বাড়িতে আসতে পারবে। বাড়ির চারদিকে উঁচু পাঁচিল, চৌরঙ্গির মতো জায়গায় কেউ এই পাঁচিল ডিঙিয়ে আসতে পারে না, তাছাড়া গেটে দারোয়ান আছে, তাকে এড়িয়ে আসাও অসম্ভব।”

কন্যার পানে তাকাইয়া তিনি বলিলেন, ”আয়রন-চেস্টের যে জায়গায় সেগুলো আছে-খোলো তো মা, এঁদের সেগুলো দেখাই!”

মা-পান চাবি দিয়া আয়রন-চেস্ট খুলিল।

মিঃ ইয়াং চাং ব্যোমকেশকে লক্ষ করিয়া বলিলেন, ‘আমার এই আয়রন-চেস্ট সাধারণ আয়রন-চেস্ট হতে পৃথক। আমি যখন আমেরিকায় ছিলুম, তখন সেখানে এক বিখ্যাত কোম্পানিতে অর্ডার দিয়ে এটা তৈরি করাই। এর বিশেষত্ব এই-পিছন দিকে একটা জায়গা আছে, সামনের এই জায়গাটা টিপলে, পিছনের সে কামরাটা খুলে যায়। সামনের দিকে সব জিনিসপত্র আছে, পিছনে কেবল সেই জিনিসগুলি রেখেছি।”

কৃষ্ণা বলিল, ”এই কৌশলটা জানা না থাকায় আপনার মহীদল ওগুলো হস্তগত করতে পারেনি বোঝা যাচ্ছে।”

মা-পান এই সময়ে একটা হাতির দাঁতের তৈরি বাক্স আনিয়া পিতার সামনের টেবলের উপর রাখিল।

মিঃ ইয়াং চাং বাক্সটা খুলিতে খুলিতে বলিলেন, ”ছোটখাটো জিনিসগুলো আমি এই বাক্সে রেখেছি-”

বলিতে বলিতে তিনি বাক্সের ডালা উঁচু করিলেন।

”এই দেখুন সেই হার-”

হংসডিম্বাকৃতি একটি ওপেলের মালা-তাহারই মাঝে মাঝে ক্ষুদ্র ওপেল নির্মিত পদ্ম, তাহার মাঝে ছোট ছোট এক এক টুকরা হীরকখণ্ড। মাঝখানে যে ফুলটি দেখা যায়, তাহার মধ্যে যে হীরকখণ্ডটি রহিয়াছে, সেটি বেশ বড়।

আলোক লাগিতে হীরকখণ্ডগুলি ঝিকমিক করিয়া উঠিল। কৃষ্ণার চক্ষু ধাঁধিয়া গেল।

হার-ছড়াটি হাতে করিয়া ভক্তিভরে সেটিকে ললাটে ছোঁয়াইয়া মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”আমাদের বংশে একটা প্রবাদ আছে-এই মালাটি বুদ্ধদেবের কণ্ঠে শোভা পেতো, যখন তিনি সিদ্ধার্থ ছিলেন। কিভাবে এ মালা আমাদের বংশে এল, এই প্রায় আড়াই হাজার বছর ধরে এটা কখন কার কাছে কিভাবে থেকেছে, সে ইতিহাস আমি জানি না। আর, বুদ্ধদেবের এই ভিক্ষাপাত্রটি-”

একটি নারিকেলের মালার আকারের জিনিস, সোনা দিয়া বাঁধানো, উপরের একলাইনে মুক্তা সেট করা।

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”একে ধ্বংসের মুখ থেকে রক্ষা করতে কে যে সোনা আর মুক্তা দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছেন তাও আমার অজ্ঞাত। এ সব ছাড়া আর কতকগুলো জিনিসপত্র যা আজও আমার মা-পানের ‘মিউজিয়ামে’ আছে, সেগুলোও রীতিমতো দেখবার মতো জিনিস। সে সব মা-পান আপনাদের দেখাবে, আমার বংশের সৌভাগ্যের প্রতীকগুলি আগে আপনাদের দেখাই।”

তিনি একটি কৌটা তুলিলেন।

এই কৌটাটিও হাতির দাঁতের তৈয়ারি। ইহাতে অতি চমৎকার শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় পাওয়া যায়।

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”এই কৌটার মধ্যে আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক সেই হীরার আংটিটি রয়েছে। এটি আপনাদের দেখানোর আগে আমি এর ইতিহাস কিছু আপনাদের শোনাই। এই আংটি আমাদের ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ-ভগবান তথাগতের কাছ থেকে উপহার পান। শোনা যায়, এই আংটিটি এই ভারতেরই একজন বিখ্যাত নৃপতি বুদ্ধদেবের চরণে দিয়ে প্রণাম করেন। কিন্তু বুদ্ধদেব তা স্পর্শ করেননি এবং সেইমুহূর্তে যাকে তিনি এটি দান করেন, তিনি ছিলেন আমারই একজন পূর্বপুরুষ। এই আংটি পেয়ে পর্যন্ত আমাদের বংশের শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। আমার আর একজন পূর্বপুরুষ এটি হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁকে দুঃখ ও দারিদ্র্য সমানভাবে বহন করতে হয়েছে। আমার পিতামহ এটিকে পান একেবারে অভাবনীয়ভাবে। এই আংটির জন্য ইউউইনের শান্তি নাই, এইটির জন্য সে আমার একমাত্র পুত্রকে হত্যা করেছে, আমার ও আমার মা-পানের দিকে তার সতত সজাগ দৃষ্টি রয়েছে। যে কোনোরকমে আমায় আর মা-পানকে সরাতে পারলেই উত্তরাধিকারসূত্রে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র এই ইউউইনই সব পাবে।”

সৌভাগ্যলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া মিঃ ইয়াং চাং অতি সন্তর্পণে কৌটাটি খুলিলেন।

ব্যোমকেশ, কৃষ্ণা ও প্রণবেশ কৌটার উপর ঝুঁকিয়া পড়িলেন-…কৌটা শূন্য… কৌটায় কিছুই নাই।

ছয়

”মা-পান!”

পিতার আর্তকন্ঠস্বরে সচকিত মা-পান গৃহকোণে অবস্থিত খোলা আয়রন-চেস্টের দিক হইতে ফিরিয়া তাকাইল।

বৃদ্ধ ইয়াং চাং ছটফট করিতেছেন, তাঁহার মুখ মৃতের মতো বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে।

”আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমার সৌভাগ্যলক্ষ্মী সেই আংটি চুরি গেছে মা-পান! ব্যোমকেশবাবু, দেখেছেন ব্যাপারখানা?”

বৃদ্ধ কিছুতেই শান্ত হন না। ইঁহাদের সান্ত্বনায় তাঁহার শোক যেন আরও বাড়িয়া উঠিল। তিনি ললাটে করাঘাত করিয়া বারবার বলিতে লাগিলেন, ”আমার সর্বনাশ হয়েছে, আমার সব যাবে, আমি এবার পথের ভিখারি হব।”

মা-পান নিঃশব্দে পিতার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছিল-ব্যোমকেশবাবু খানিকক্ষণ মাথায় হাত দিয়া বসিয়াছিলেন, তারপর আস্তে আস্তে নস্যের ডিবা খুলিয়া দুই নাসারন্ধ্রে নস্য নিলেন। প্রণবেশ বেদনার্তমুখে কেবল তাকাইয়াছিলেন, একটা কথাও তিনি বলিতে পারেন নাই।

কৃষ্ণাও খানিকক্ষণ অভিভূতের মতো বসিয়াছিল-এতক্ষণে কথা বলিল…সে ইয়াং চাংকে লক্ষ করিয়া বলিল, ”আপনি অনর্থক হাহাকার না করে কবে আর কিরকমভাবে জিনিসটা গেল, সেটা ভাবলে ভালো হত, মিঃ চাং! আপনি শান্ত হোন, আগে এর সম্বন্ধে আরও যা জানবার আছে, সে সব আমাদের পূজনীয় কাকাবাবু, ডিটেকটিভ ব্যোমকেশবাবুকে বলুন-এখনও খোঁজ করলে হয়তো পাওয়া যাবে।”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”মনে করুন, সেদিন আমি আপনার কাহিনি শুনেই বলেছিলুম, মহীদল এখনও কলকাতা ছেড়ে যায়নি, সে এখানেই আছে। আমার মনে হয়, যে রাত্রে সে আপনার ঘরে এসেছিল, সেখানেই কারও সাড়া পেয়ে সে পালিয়ে যায়। আপনার আয়রন-চেস্টের গোপনীয় স্থান তার জানা থাকলেও সে খুলতে পারেনি। আপনি শেষ কবে আংটিটা দেখেছিলেন, বলুন তো?”

মনে হয়তো আশার সঞ্চার হইয়াছিল, তাই মিঃ ইয়াং চাং তখনকার মতো শান্ত হইয়া উত্তর দিলেন, ”কালও সন্ধের পর আমি সে আংটি দেখেছি ব্যোমকেশবাবু! আজ সকাল থেকে মা-পান বাড়িতেই আছে, আমি যদিও কাজে গেছলুম-”

মা-পান বলিল, ”আমি এদিকে কাউকেই দেখিনি বাবা!”

কৃষ্ণা চিন্তিতমুখে বলিল, ”কয়েকদিন আগেকার রাতের ব্যাপার আবার ঘটেনি তো?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”

ব্যোমকেশ গম্ভীরভাবে বলিলেন, ”না না, ও তোমরা ভুল ধারণা করছ কৃষ্ণা।”

কৃষ্ণা বলিল, ”মোটেই নয় কাকাবাবু। আমার মনে হয়, এ বাড়ির কোনো চাকরকে মহীদল হাত করেছে, তাকে দিয়েই আগের রাতে মিঃ চাংয়ের খাবার কিংবা জলে কোনো কিছু মিশিয়ে দিয়ে অজ্ঞান করেছিল। কে বলতে পারে, মিস মা-পানকেও সেইরকম ভাবে কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করেনি!”

ব্যোমকেশ আপত্তি করিতেছিলেন, মা-পান বাধা দিল, বলিল, ”ঠিক কথা। মিস চৌধুরি ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি রোজ রাত্রে জল খাই, কাল জল খাওয়ার আধঘন্টা পরেই আমার খুব ঘুম এসেছিল। অথচ কোনোদিন আমি রাত বারোটার আগে ঘুমুইনি আর আমার ঘুমও ভারী সতর্ক। কাল রাত্রে আমি সেই যে শুয়েছিলুম, আজ সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙেছে। এমনি বেহুঁশ ঘুম আমার সে রাত্রেও হয়েছিল বটে, মনে পড়ছে।”

কৃষ্ণা ব্যোমকেশকে লক্ষ করিয়া সোল্লাসে বলিল, ”শুনছেন কাকাবাবু?”

উদাসভাবে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”শুনছি।”

কৃষ্ণার তীক্ষ্নবুদ্ধি তাঁহাকে আহত করিয়াছে। তিনি মনে মনে একটু জ্বালা অনুভব করিতেছিলেন।

কোনো প্রশ্ন না করাটা খারাপ মনে হয়, তাই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ”কাল আপনার চাবি কোথায় ছিল?”

মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”চাবি আলমারির মধ্যেই ছিল।”

কৃষ্ণা বলিল, ”এ বাড়িতে এমন কোনো লোক আছে, যে এ সব সন্ধান রাখে।… সে কাল এ সব কীর্তি নিজে করেছে, আংটি নিয়ে মহীদলকে দিয়েছে, তারপর মহীদল সে আংটি ইউউইনকে পৌঁছে দিয়েছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আপনার হিয়েন চাকরটাকে কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমরা এসে পর্যন্ত তাকে দেখিনি। তাকে একবার ডাকতে পাঠান না, দেখি।”

বড় দুঃখেও মিঃ ইয়াং চাং হাসিলেন, বলিলেন, ”আপনারা ডিটেকটিভ মানুষ, সব বিষয়ে সব লোককে সন্দেহ। হিয়েন বেলা পাঁচটা পর্যন্ত আমার কাছে ছিল-পাঁচটার সময় সে গড়ের মাঠে গেছে। রোজই সে যায়, আমি আপত্তি করি না।”

কৃষ্ণা বলিল, ”সে কতদিন আপনার কাছে আছে?”

অসন্তুষ্ট হইয়া মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”সে যখন পাঁচ বছরের তখন থেকে আমার কাছে ছিল। কেবল মাঝে দশ বছর ছিল না। আবার মাস-তিনেক আগে তার দুঃখপূর্ণ পত্র পেয়ে তাকে আমি আসতে লিখি, তাই সে মাস-দুই হল বর্মা থেকে এসেছে।”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”মাঝে দশ বছর সে আপনার কাছে ছিল না কেন?”

বিরক্ত হইয়া মিঃ ইয়াং চাং বলিলেন, ”আমিই তার বিয়ে দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলুম। টুক করে কি কোনো মানুষ এই দূর বিদেশে ঘর-সংসার ছেড়ে আসতে পারে-বলুন তো? তিনমাস আগে পত্র পেলুম তার স্ত্রী আর একটি ছোট ছেলে মারা গেছে, সে আর রেঙ্গুনে থাকতে পারছে না।…আরে মশাই, পাঁচ-বছর থেকে যাকে মানুষ করেছি, মাত্র দশ বছরের তফাতে সে কি শত্রুতা করতে পারে? একি আপনাদের দেশের লোক যে, বাপের গলায় ছুরি বসায়?”

রাগ করিয়া তিনি মুখ ফিরাইলেন।

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”রাগ করবেন না, আমি শুধু তাকে একবার দেখতে চাচ্ছি। তার কোনো ফটোও কি আপনার কাছে নেই?”

মিঃ ইয়াং চাংয়ের ইঙ্গিতে মা-পান একখানা ফটো আনিয়া ব্যোমকেশের হাতে দিল।

ফটোর উপর তিনজনেই ঝুঁকিয়া পড়িলেন।

বিবর্ণমুখে ভগ্নকণ্ঠে কৃষ্ণা চেঁচাইয়া উঠিল-”ফুচু! এ যে আমাদের ফুচু-”

মিঃ ইয়াং চাং সোজা হইয়া বসিলেন, ”ফুচু কে?”

কৃষ্ণা রুদ্ধনিঃশ্বাসে বলিল, ”রেঙ্গুনে আমাদের চাকর ছিল।”

সাত

ক্ষিপ্রহস্তে একখানা পত্র লিখিয়া পোস্ট করিতে পাঠাইয়া কৃষ্ণা ডাকিল, ”মামা?”

প্রণবেশ মিঃ চৌধুরির ডায়েরি পড়িতেছিলেন। কৃষ্ণা এখানা পড়িতে দিয়াছে। মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসু নেত্রে তিনি কৃষ্ণার পানে তাকাইলেন।

কৃষ্ণা বলিল, ”আমি রেঙ্গুনে যাচ্ছি যে। তোমাকেও যেতে হবে আমার সঙ্গে।”

”রেঙ্গুনে?” প্রণবেশ একেবারে আকাশ হইতে পড়িলেন, ”রেঙ্গুনে আবার কেন? ওখানকার কাজ তো শেষ হয়ে গেছে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”কিছুই শেষ হয়নি মামা! অন্ততপক্ষে যতক্ষণ বাড়িটা আছে; ওটা বিক্রি করতে হবে, তারপর ইউউইনকে যেমন করে হোক ধরতে হবে।”

প্রণবেশ হাসিলেন, বলিলেন, ”ওই অসার কল্পনাটা ছাড় কৃষ্ণা। দেখেছ সে কি ধরনের লোক? তোমার পর্যন্ত অজ্ঞান করে জাহাজে তুলেছিল; আর আধঘণ্টা হলেই তোমায় নিয়ে গিয়ে পড়ত এমন জায়গায়, যেখানে হাজার চেষ্টা করলেও তোমার সন্ধান মিলত না।”

কৃষ্ণা হাসিল বলিল, ”তাই বলে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার আয়োজন করব না? তোমায় কিছু করতে হবে না মামা, তুমি শুধু আমার সঙ্গে থাকবে, একটি কথা পর্যন্ত তোমায় বলতে হবে না। একবার জ্ঞানশূন্য অবস্থায় গিয়েছিলে, এবার সজ্ঞানে একবার দেখবে চল।”

লজ্জিত প্রণবেশ বলিলেন, ”ব্যোমকেশবাবু যাবেন তো?”

কৃষ্ণা বলিল, ”শুনলুম ইয়াং চাং-সাহেব তাঁকেই এই তদন্তের ভার দিয়েছেন, কাজেই তাঁকে নিশ্চয়ই যেতে হবে। তাঁকে একবার জানাতে হবে যে, আমরাও যাব আর তিনি রেঙ্গুনে আমাদের বাড়িতেই থাকতে পারবেন।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”সে বাড়ি যে বিক্রি করবার কথা তোমাদের উকিল লিখেছেন?”

কৃষ্ণা বলিল, ”বিক্রি করবার কথা লিখেছেন বটে, কিন্তু তাতে এখনও আমাদের সাংসারিক জিনিসপত্র অনেক আছে। কাজেই বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা হলেই আগে সেগুলো আমাদের সরিয়ে নিতে হবে।”

ব্যোমকেশকে সংবাদ দিতেই তিনি আসিয়া পড়িলেন, বলিলেন, ”বর্মায় যাওয়াটা আমার মনে হয় তোমার পক্ষে উচিত হবে না কৃষ্ণা। ইউউইন একদিন হয়তো বলেছিল তোমার কোনো অনিষ্ট করবে না, কিন্তু তুমি যদি তার স্বার্থে আঘাত কর, সে তোমায় কখনই ছাড়বে না।”

বাধা দিয়া কৃষ্ণা বলিল, ”বারবার ওই কথাটা বলে আমায় বাধা দেবেন না কাকাবাবু! আমি রেঙ্গুনে যাচ্ছি অনেক উদ্দেশ্য নিয়ে।”

বর্মা-গমনের উদ্যোগ-আয়োজন চলিতে লাগিল।

সঙ্গে যাইবে তারক ও পার্বতী। দারোয়ানরা এখানেই থাকিবে।

মিঃ ইয়াং চাং উপস্থিত ব্যোমকেশের হাতে একহাজার টাকা দিয়াছেন, বলিয়া দিয়াছেন-আর যা আবশ্যক হইবে তিনি সংবাদ পাইলেই এখান হইতে পাঠাইবেন। পনেরো বৎসর তিনি দেশছাড়া। ইউউইনের জন্য তাঁহার বর্মায় ফিরিবার জো নাই। ব্যোমকেশ যদি ইউউইনকে ধরিতে পারেন, আগেই আংটিটি আদায় করিতে হইবে। পিতৃপুরুষের অসীম সম্পত্তির উপর তাঁহার এতটুকু লোভ নাই, সে সব ইউউইন যদি পারে গ্রহণ করুক-সুখি হোক। লোকে টাকা-কড়ির জন্যই ডাকাতি করে। ইউউইন যদি সম্পত্তি লাভ করে, তাহার আর ডাকাতি করিবার কোনো প্রয়োজনই হইবে না।

সরলহৃদয় বৃদ্ধের কথা শুনিয়া ব্যোমকেশের হাসি পাইয়াছিল, পাছে বৃদ্ধ অন্তরে ব্যথা পান, সেইজন্য তিনি হাসিতে পারেন নাই!

তবু এ কথাটা তিনি জানাইয়াছিলেন, ইউউইন যে দিনই হোক ধরা পড়িবেই এবং ধরা পড়িলেই তাহাকে হয়তো জীবনান্তকাল পর্যন্ত জেলই খাটিতে হইবে। কাজেই সম্পত্তি পাইলেই সুখি হওয়া তাহার অদৃষ্টে নাই। সেই সম্পত্তি ইয়াং চাংয়ের অদৃষ্টেই আছে বুঝা যাইতেছে।

মিঃ ইয়াং চাং বার বার করিয়া বলিয়া দিলেন, যেমন করিয়াই হোক-বিশ্বাসঘাতক মহীদলকে একবার তাঁহার সামনে আনা চাই। সে শিক্ষিত লোক হইয়া কেমন করিয়া এবং কেন ইউউইনের দলে যোগদান করিল, তিনি তাহাকে সে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন।

তাঁহার বিশ্বস্ত ভৃত্য হিয়েনের জন্যও তাঁহার উৎকন্ঠার সীমা ছিল না। তাঁহার বিশ্বাস, হিয়েন সম্পূর্ণ নির্দোষ। সেদিনে বাড়িতে পুলিশের আগমনে ভয় পাইয়াই সে পলাইয়াছে। এরপর পুলিশ-সংক্রান্ত গোলমাল মিটিয়া গেলেই হিয়েন আবার ফিরিয়া আসিবে।

কৃষ্ণা তাহার যে নাম দিয়াছিল তাহা তিনি বিশ্বাস করেন নাই। স্পষ্টই হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ”তোমার ভুল হয়েছে মিস চৌধুরি, বার্মিজদের চেহারা সম্বন্ধে তোমার অভিজ্ঞতা নেহাৎ কম। আমার যদি কম বয়েস হত, অনায়াসেই আমাকেও ইউউইন বলে ভেবে নিতে। তোমাদের যে ফুচু নামে চাকর ছিল, সে কিছুতেই হিয়েন নয়। আমাদের মুখ-চোখ প্রায় একই রকমের বলে ভিন্নদেশীয় লোকের পক্ষে ধরা মুস্কিল!”

কৃষ্ণা তাঁহার কথায় বাধা দেয় নাই, অথচ তাহার সন্দিগ্ধ মন বারবারই বলিতেছিল, হিয়েন ‘ফুচু’ ছাড়া আর কেউ নয়। সে ইউউইনের গুপ্তচর এবং ইউউইনের দ্বারাই সে মিঃ চৌধুরির বাড়িতে কার্যে নিয়োজিত হইয়াছিল।

কৃষ্ণার মনে পড়ে, একবৎসর পূর্বে পিতা একটা ডাকাতি মামলার আসামিদের ধরিবার জন্য চেষ্টা করিতেছিলেন। আসামি ‘ইউ চো’ অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির লোক। তা সত্ত্বেও হঠাৎ একস্থানে পিতা তাহাকে ধরিয়া ফেলেন। পুলিশ সেই কাফেখানায় আসিবার আগেই পিতা অকস্মাৎ গুলিতে আহত হন এবং সেই শুভ অবসরে ‘হিউ চো’ পলায়ন করে। কাফেখানায় সে সময় বাহিরের লোক ছিল না, তাই পিতা ফুচুকে পুলিশ ডাকিতে পাঠাইয়াছিলেন। কৃষ্ণার মনে হয়-সে গুলি আর কেউ ছুঁড়ে নাই, দলের লোককে বাঁচাইবার জন্য ফুচুই গুলি ছুঁড়িয়াছিল এবং পরমুহূর্তে নেহাৎ ভালোমানুষ সাজিয়া পুলিশ ডাকিয়া আনিয়াছিল।

কাজেই এ সব ফুচুর কাজ। কারণ, ফুচুর বিনীত কথাবার্তা, আচরণ কেবল প্রভু মিঃ চৌধুরিকেই আকর্ষণ করে নাই,-কৃষ্ণাকেও করিয়াছিল।

হিয়েনের ফটোখানা চাহিয়া সে নিজের ব্যাগে লইয়াছিল।

আট

স্টিমার রেঙ্গুনে পৌঁছাইল।

যাত্রীরা একে একে নামিতেছিল, তাহাদের সহিত কৃষ্ণা, প্রণবেশ এবং ব্যোমকেশও নামিলেন।

ব্যোমকেশ পূর্বে কখনও রেঙ্গুন আসেন নাই। রেঙ্গুনের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখিয়া তিনি আশ্চর্য হইয়া গেলেন।

একখানা ট্যাক্সি ভাড়া করিয়া কৃষ্ণা তাহাতে উঠিয়া বসিল এবং মাতুল ও ব্যোমকেশকেও উঠাইয়া লইল। কাকাবাবু এবং মাতুল উভয়েই এখানকার সম্পূর্ণ অপরিচিত। এখানকার পথ সম্বন্ধে কাহারও অভিজ্ঞতা নাই। কাজেই, কৃষ্ণাই তাঁহাদের গাইডের ভার নিল।

আগেই অবিনাশবাবুকে সে একখানা টেলিগ্রাম করিয়া দিয়াছিল, অবিনাশবাবু কৃষ্ণাদের বাড়িতেই অপেক্ষা করিতেছিলেন। কৃষ্ণা আগে তাঁহাকে প্রণাম করিল, তারপর মাতুল ও প্রণবেশের সহিত পরিচিত করাইয়া দিল।

অবিনাশবাবু আগন্তুকদের সম্বর্ধনা করিয়া বসাইলেন। তাঁহার ভৃত্য তাড়াতাড়ি চা আনিয়া দিল। মিঃ চৌধুরির বাড়ির পার্শ্বেই অবিনাশবাবুর বাড়ি, সেজন্য সত্বর যাতায়াতে কোনো অসুবিধা নাই।

অবিনাশবাবু কৃষ্ণাকে লক্ষ করিয়া বলিলেন, ”তোমার বাড়ি নিয়ে আমার যে কি বিপদই হয়েছে মা, তা আর তোমায় কি জানাব। নিত্য নূতন লোক আসছে, দরজা খুলে সব ঘর দেখানো চলে না-জিনিসপত্র রয়েছে; তাই বাইরের দিক থেকে কতকটা দেখিয়ে দিই, কেউ খুশি হয়, কেউ হয় না-”

কৃষ্ণা বলিল, ”স্নেহের খাতিরে সবই সহ্য করতে হবে জেঠামণি, আমার যখন আর কেউ নেই।”

অবিনাশবাবু বলিলেন, ”আমি তো আছিই। তবে তুমি যখন এবার এসেছ, তোমার মামাও এসেছেন, তখন নিজেরা থেকে জিনিসপত্রগুলোর যা হয় ব্যবস্থা কর, বিক্রিটাও তোমরা থাকতে থাকতেই হয়ে যাক।”

বলিতে বলিতে তিনি প্রণবেশের পানে তাকাইলেন-”প্রণববাবু, আমায় বোধহয় চিনতে পারছেন না!”

প্রণবেশ লজ্জিত হাসি হাসিয়া বলিলেন, ”খুব চিনেছি অবিনাশবাবু, সেদিনের কথা আমি ভুলিনি। ভাগ্যে আপনার চোখে পড়েছিলুম তাই, নইলে আমি যে কোথায় যেতুম, কি যে আমার হত, সে কথা ভাবলে আমার জ্ঞান থাকে না।”

অবিনাশবাবু বলিলেন, ”তখনও কিন্তু আমি জানি না যে, আপনিই চৌধুরির সম্বন্ধী, আমাদের কৃষ্ণার মামা। জানলে আপনাকে পুলিশের কাছে জিম্মা করে দিতুম না, অন্তত কিছুদিন নিজের কাছেই রাখতুম। জানতে পারলুম অনেক পরে, খবরের কাগজে-যাকে আমি পুলিশের হাতে দিয়েছিলুম সে আমাদের চৌধুরির সম্বন্ধী।”

প্রণবেশ লজ্জিত হাসি হাসিয়া বলিলেন, ”হয়তো আরও কত লোকের চোখে পড়েছিলুম, কিন্তু কেউই তো কিছু করেননি। আপনি আমায় থানায় দিয়েছিলেন বলেই সমর আমায় দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে, কারণ সে আমায় চিনত। এজন্যে আমি যে কতখানি কৃতজ্ঞ-”

অবিনাশবাবু হাসিয়া বলিলেন, ”তার আগে মনে রাখবেন যে, এ আমার কর্তব্য। কেবল আমারই বা বলি কেন, প্রত্যেক বাঙালির প্রতি বাঙালির কর্তব্য। আমাদের এই সহানুভূতি যদি থাকে-বাঙালি নিশ্চয়ই উঠবে, তাকে এমন হীনভাবে পেছনে পড়ে থাকতে হবে না।”

ব্যোমকেশ এই সময় বিনীতভাবে বলিলেন, ”এবার আমারও একটা উপকার করুন অবিনাশবাবু, এখানে থানা কোথায় আছে, আমাকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থাটা আগে করে দিন।”

অবিনাশবাবু বলিলেন, ”এখুনি থানায় না গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে-”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”সরকারি কাজ নিয়ে এসেছি, কথা আছে, এখানে নেমেই বরাবর থানায় চলে যাব। সাহেবের সঙ্গে দেখা করে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কলকাতা থেকে এখানকার পুলিশে টেলিফোন করে দেওয়া হয়েছিল, তারা স্টিমার-ঘাটেও গিয়েছিল, আমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি, বলেছি, এখুনি আসব এঁদের পৌঁছে দিয়ে। কাজেই আমার দেরি করা চলবে না অবিনাশবাবু, চাকর বই তো নই-মনিবের হুকুম আগে তামিল করতেই হবে।”

অবিনাশবাবু তাঁহার আরদালিকে আদেশ দিলেন, সে ব্যোমকেশকে থানায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসিবে।

কৃষ্ণা বলিল, ”রোজ একবার করে আসা চাই কাকাবাবু, না এলে আমি নিজেই গিয়ে থানায় হাজির হব বলে দিচ্ছি।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”আপনি আসুন বা নাই আসুন, আমি কিন্তু ঠিক যাব ব্যোমকেশবাবু।”

”বেশ।” বলিয়া ব্যোমকেশ বিদায় লইলেন।

বাড়িতে সব জিনিসই পড়িয়া আছে। নিতান্তই আবশ্যকীয় জিনিস কয়টি লইয়া মিঃ চৌধুরি চলিয়া গিয়াছিলেন। মনে হয়, আশা ছিল তিনি আবার ফিরিয়া আসিবেন, এইখানেই কৃষ্ণার বিবাহ দিবেন, কিন্তু দুর্দান্ত দস্যু ইউউইনের জন্য তাঁহার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় নাই।

কৃষ্ণা সমস্ত ঘরগুলো প্রণবেশকে দেখাইল। কোন ঘরে পিতা বসিতেন, শয়ন করিতেন-কোন ঘরে তাঁর জিনিসপত্র থাকিত, সব দেখাইল। কতবার তাহার চক্ষু দুইটি অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠিল, কতবার তাহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল।

পিতার আমলের কনেস্টবল আসগর আজও বর্মা-পুলিশে কাজ করে। কৃষ্ণা আসিয়াছে শুনিয়া সে দেখা করিতে আসিল।

তাহাকে দেখিয়া কৃষ্ণা ভারী খুশি হইয়া উঠিল। বিমর্ষমুখে আসগর জিজ্ঞাসা করিল, ”এখন এখানে থাকবে কি মা?”

কৃষ্ণা বলিল, ”না আসগর, বাড়িটা বিক্রি হবে; জিনিসপত্রগুলো আগে বিক্রি করে দিলে তবে বাড়ি বিক্রি হতে পারবে। তারপর আমরা চলে যাব, আর এখানে আসব না।”

আসগর মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ”সাহেবের খুনের কোনো কিনারা হল কি মা?”

কৃষ্ণার মুখখানা অন্ধকার হইয়া গেল, মাথা নাড়িয়া বলিল, ”কোনো কিনারা হয়নি আসগর! বাবাকে যে খুন করেছে, পুলিশ তাকে ধরবার আগেই সে পালিয়েছে।”

আসগর বলিল, ”কলকাতার যে ডিটেকটিভ সাহেব এসেছেন, তিনি আমাদের বড়সাহেবের কাছে বলছিলেন, এ নাকি এখানকার বিখ্যাত দস্যু ইউউইনের কাজ। সে কথা আমি আগেই জানি মা, সাহেবের কামরা থেকে যেদিন চুরি হয় সেইদিনই আমি বুঝেছিলুম-তোমরা যতই গোপনে কলকাতায় যাও, ইউউইনের বা তার দলের লোকের চোখ কিছুতেই এড়াতে পারবে না। তার চেয়ে এখানে থাকলে হত-হয়তো তাতে এমন সর্বনাশ ঘটত না।”

কৃষ্ণা মলিন হাসিল, বলিল, ”ঠিকই হত আসগর, এখানেও তো বাবা ইউউইনের জ্বালায় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, তাই না এখান থেকে চলে গেলেন। মনে কর তো, ওই ঘরে আমার মা-”

বলিতে বলিতে তাহার কন্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসিল।

প্রণবেশ বলিলেন, ”থাক, ও সব কথা ছেড়ে দাও কৃষ্ণা, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। এখন বরং কি করলে প্রতিশোধ নেওয়া যায়, তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা হয়, তাই ভাব।”

কৃষ্ণার চোখ দুইটি দৃপ্ত হইয়া উঠিল, বলিল, ”ঠিক কথা বলেছ মামা,-আমায় পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতেই হবে।”

আসগর বিস্মিত হইয়া বলিল, ”তুমি নেবে মা?”

দৃঢ়কণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”হ্যাঁ, যতটুকু পারি আসগর। আমাদের শাস্ত্রে আছে, বানরেরা লঙ্কায় যাওয়ার সেতু তৈরি করেছিল, তবে রামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়ে রাবণ বধ করেছিলেন। ইউউইনের মতো দুর্দান্ত দস্যু-যে দেশে দেশে তার অদ্ভুত কীর্তির পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছে-কে বলতে পারে সে কোনোদিন আমার দ্বারাই জব্দ হবে কিনা!”

জানালার নীচে পথে কে এই সময় হাঁচিল-”হ্যাঁচ্চেচা।”

সাধারণ লোকের হাঁচি হইতে এ হাঁচির শব্দ একেবারে ভিন্ন-কৃষ্ণা তাই বাইরের দিকে চাহিল।

এক খঞ্জ ভিক্ষুক একটা লাঠি লইয়া পথ চলিতেছে-সম্ভব সেই হাঁচিয়াছে।

প্রণবেশ বিকৃতমুখে বলিলেন, ”যার একটা অঙ্গ বিশ্রী, তার সবই বিশ্রী!”

নয়

সুন্দর নগরী রেঙ্গুন।

ব্যোমকেশ রেঙ্গুনের সৌন্দর্য দেখিয়া মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। শহরটি একেবারে আধুনিক ধরনের। ইরাবতী নদী রেঙ্গুনের পার্শ্ব দিয়া বহিয়া চলিয়াছে, তাহার উপর ভাসিয়া চলিয়াছে ধানের নৌকা, সেগুন কাঠের ভেলার উপর বাঁশ দিয়া তৈরি ছোট ছোট ঘর।

কৃষ্ণা মাতুলের সহিত একদিন আসিয়া ব্যোমকেশকে লইয়া উচ্চ মাটির ঢিপির উপরিস্থিত সিউ ডেগন (Shew-Dagon) প্যাগোডা বা বর্মার বিখ্যাত স্বর্ণ-মন্দির দেখাইয়া আনিল। মন্দির দেখিয়া ব্যোমকেশ ও প্রণবেশ স্তম্ভিত ও পুলকিত হইয়া উঠিলেন। এই প্যাগোডার বাহির দিকটা বেশির ভাগই স্বর্ণমণ্ডিত, সেইজন্য ইহার নাম স্বর্ণমন্দির রাখা হইয়াছে। উপরে যে সোনার ছাতাটা রহিয়াছে, তাহার গায়ে বিবিধ ধাতুনির্মিত ঘণ্টা বাতাসের বেগে বাজিতে থাকে।

কৃষ্ণা বলিল, ”বিখ্যাত রাজা মিনশুন নাকি এই ছাতাটা দান করেছিলেন।”

প্রণবেশ হিসাব করিয়া বলিলেন, ”এর দাম কত বলুন তো ব্যোমকেশবাবু?”

ব্যোমকেশ গম্ভীরমুখে বলিলেন, ”তা লাখ-আট-দশ হবে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”না। প্রায় ক্রোর টাকার কাছাকাছি হবে শুনেছি।”

মন্দিরের ভিতরের দৃশ্য দেখিয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”ওঃ, এ রকম বুদ্ধমূর্তি কলকাতাতেও ঢের আছে ব্যোমকেশবাবু,-ইডেন গার্ডেনেও এ রকম মূর্তি সব রয়েছে-না?”

ব্যোমকেশ সংক্ষেপে বলিলেন, ”তবুও আসল-নকলে অনেক পার্থক্য আছে প্রণববাবু।”

প্যাগোডার সামনে একটি ভিক্ষুক দাঁড়াইয়াছিল। সে হাত বাড়াইল। কৃষ্ণা ব্যাগ খুলিয়া তাহাকে একটা আনি দিতে গিয়া হঠাৎ তাহার মুখের পানে তাকাইয়া থমকিয়া দাঁড়াইল।

চৈনিক ভিক্ষুক কাতরকণ্ঠে বলিল, ”দিন মেমসাহেব, দু-দিন কিছুই খাইনি-”

কৃষ্ণা সবিস্ময়ে বলিল, ”ল্যাং, এখন তোমায় ভিক্ষা করে খেতে হয়? তোমার যে অনেক আত্মীয়-বন্ধু ছিল শুনেছি!”

ভিক্ষুক তাহাকে চিনিতে পারে নাই। গাউন পরিহিতা কৃষ্ণাকে সে মেমসাহেব বলিয়া ভাবিয়াছিল, তাই আশ্চর্যভাবে তাহার পানে তাকাইয়া রহিল।

কৃষ্ণা বলিল, ”আমায় চিনতে পারছ না, ল্যাং? আমি মিঃ চৌধুরির মেয়ে-আমি কৃষ্ণা!”

ল্যাং মুহূর্তকাল তাহার পানে তাকাইয়া রহিল। তারপর হঠাৎ দুই-হাতে মুখ ঢাকিল।

কৃষ্ণা বুঝিল, সে মিঃ চৌধুরির মৃত্যুসংবাদ পাইয়াছে।

ব্যোমকেশের পানে ফিরিয়া বিষণ্ণকণ্ঠে সে বলিল, ”ল্যাংকে আপনারা চেনেন না কাকাবাবু! আজ দেখছেন একে পথের ধারে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে, একটা চোখ নেই, পা একখানা নেই-কোনোরকমে কাঠের পা জুড়ে বেড়াচ্ছে শুধু পেটের দায়ে, এই ল্যাং একদিন ছিল সবল-সুস্থ একজন লোক, এর ভয়ে ম্যান্ডালোতে সকলেই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকত। একবার ল্যাং যখন দারুণ বিপদে পড়েছিল, সেইসময় আমার বাবা ওকে রক্ষা করেন, সেই থেকে ল্যাং আমার বাবার পরম ভক্ত হয়ে পড়েছিল!”

ল্যাং মুখ হইতে হাত নামাইল। অশ্রুজলে তাহার হাত দু-খানা প্লাবিত হইয়া গেছে। সে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, ”সেদিনকার কথা আমি ভুলতে পারিনি দিদি! ইউউইন সন্দেহ করেছিল, আমি ইরাবতীর ধারে কোথায় কোন জঙ্গলে যে গুপ্তধন আছে তার নাকি সন্ধান জানি! যখন মিঃ চৌধুরি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, সেই সময় ইউউইন আমাকে তার দলে মেশবার জন্যে আহ্বান করে, আমিও হিতাহিত চিন্তা না করে আমার দলের কয়েকজন লোককে নিয়ে তার দলে যোগ দিয়েছিলুম। এরই কিছুকাল পরে বুঝলুম, কেন সে আমাকে তার দলে নিয়েছিল। এরপরই আরম্ভ হল আমার উপর তার দুঃসহ অত্যাচার, যার জন্যে আমি হারালুম আমার একখানা পা-একটা চোখ-”

সবিস্ময়ে প্রণবেশ বলিলেন, ”কি রকম? সে কি-চোখ তুলে নিয়েছিল?…পা কেটে দিয়েছিল?”

ল্যাং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ”না, আমি নিজেই এ সর্বনাশ করেছি। ইউউইনের অত্যাচার সইতে না পেরে আমি তিনতলা থেকে লাফ খেয়ে পড়েছিলুম পথের উপর; সেইখানেই আমি অজ্ঞান হইয়া পড়েছিলুম। পথের লোক আমায় তুলে নিয়ে গিয়ে হসপিটালে দেয়। যখন আমার জ্ঞান হল, আমি দেখলুম, আমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে…একখানা পা কেটে বাদ দিতে হল!”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”তারপর কি হয়েছে?”

ল্যাং বলিল, ”হসপিটালে একদিন ইউউইনকে দেখেছিলুম। শুনলুম, সে ব্যবস্থা করে গেছে, আমি যেদিন মুক্তি পাব, সে গাড়ি নিয়ে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। হসপিটালে আমার জন্যে সে অনেক অর্থ ব্যয় করেছে, আমার এই কাঠের পাখানা তারই দেওয়া।”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”নিশ্চয়ই তুমি বেইমানি করোনি?”

একটু হাসিয়া ল্যাং বলিল, ”দস্যুর কাছে দস্যুর বেইমানি এমন কিছু ধর্মহানিকর নয় সাহেব! সে হসপিটাল থেকে আমায় নিয়ে গিয়ে আবার তার পাপ কাজে আমায় জুড়ে দেবে-সেইজন্যেই আমি যেদিন মুক্তি পেলুম, সেদিন সকালবেলায়ই পালালুম… সোজা এসে উঠলুম একেবারে এই এঁদের বাড়ি।”

বলিয়া সে কৃষ্ণাকে দেখাইয়া দিল।

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”একেবারে বাঘের মুখে?”

ল্যাং বলিল, ”তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্যে তাঁকেই আমি বন্ধু মনে করেছিলুম সাহেব! চৌধুরিসাহেব আমায় আশ্রয় দিলেন, আমাকে তিনি যে কত উপদেশ দিয়েছেন, সে কথা আমি জীবনে ভুলব না।” বলিয়া ল্যাং কাঁদিতে লাগিল।

কোমলপ্রকৃতি প্রণবেশের চিত্ত দস্যুর এই পরিবর্তনে একেবারে দ্রব হইয়া গিয়াছিল, মুখ ফিরাইয়া তিনি গোপনে চোখ মুছিয়া ফেলিলেন।

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলেন, ”তারপর আর ইউউইনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?”

ল্যাং বলিল, ”চৌধুরিসাহেব চলে যাওয়ার পর কিছুদিন দেখিনি, তবে সেদিন জেটিতে ঠিক তারই মতো একজন লোককে দেখেছিলুম, আর আজ দেখেছি এইখানে, আর একটু আগে।”

কৃষ্ণা চমকাইয়া উঠিল, ”একটু আগে এখানে দেখেছ-ইউউইনকে?”

ল্যাং করুণ হাসি হাসিয়া বলিল, ”হ্যাঁ। আমার সুমুখ দিয়ে এই সে চলে গেল আমার গায়ে থুথু দিয়ে-”

প্রণবেশ করুণ কণ্ঠে বলিলেন, ”আহা, বেচারা-”

উৎকণ্ঠিতকণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”করুণা দেখানোর সময় এখন নয় প্রণববাবু, ইউউইনের এই সময়ে এখানে আগমনটাই আমার মনে সন্দেহ জাগাচ্ছে। বিনা স্বার্থে কেবলমাত্র বেড়ানোর মতলবে ইউউইন এখানে আসেনি এ জানা কথা। আমি বেশ বুঝছি, আমরা যে এখানে এসেছি, তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি ওয়ারেন্ট নিয়ে, তা সে জেনেছে। যে কোনোরকমে হোক আমাদের অনিষ্ট করবার জন্যে সে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে!”

প্রণবেশ বলিলেন, ”এতে তার কি লাভ হবে?”

কৃষ্ণা বলিল, ”লাভ কি হবে বুঝছো না মামা? ইউউইন জানে, কাকাবাবু আর আমরা যখন এসেছি, তখন তাকে ধরবারই চেষ্টা করব, আর আমাদের চেষ্টায় সে ধরা পড়বেই। আমরা যদি দীর্ঘদিন এখানে থাকি, তবে আর গুপ্তধন উদ্ধার সহজ হবে না, কাজেই-”

ব্যোমকেশবাবু বলিলেন, ”কাজেই আমাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করবে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”সরানো মানেটা বুঝছ মামা?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”অর্থাৎ জগৎ থেকে সরানো-”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”ঠিক তাই! আমি এখানে এসে খবর পেলুম-ইউউইনের নিজের হাতে, তার দলের লোকের হাতে কত লোকের যে সর্বনাশ হয়েছে, কত লোক যে মরেছে তার আর ইয়ত্তা নেই। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি!”

ল্যাং বলিল, ”তবু আপনারা তার সব পরিচয় পাননি সাহেব, তার আরও পরিচয় আছে, যা বাইরের কেউ না জানলেও, দলের লোক হিসাবে আমরা জানি।”

কৃষ্ণা বলিল, ”তাহলে তুমি নিশ্চয়ই জান ল্যাং, তারা একটা সুঁচের মতো তীরের মুখে কোনো বিষ মাখিয়ে রাখে; যা স্পর্শমাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তারপর মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে মানুষ মারা যায়?”

ল্যাং উত্তর দিল, ”সে বিষ ইউউইনের দলের লোকেরা তৈরি করে নেয়। ওই বিষটাই হচ্ছে ওদের প্রধান অস্ত্র। রিভলভারের গুলি হয়তো ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু এই বিষ কখনও ব্যর্থ হয় না। হাত-কুড়ি দূর থেকে এই তীর ওরা ছোঁড়ে। তীরের মুখে ফাঁপা জায়গায় বিষ থাকে, জোরে ছোঁড়বার দরুন দেহের ভিতর তীর খানিকটা গর্ত করে বিষ আপনিই ঢুকে যায়, তখন রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়ে মানুষ মারা যায় মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে। পৃথিবীতে আরও কত আশ্চর্য জিনিস আছে সাহেব, ক্রমে ক্রমে সবই জানবেন।”

সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল দেখিয়া কৃষ্ণা আর দেরি করিল না। একখানা পাঁচ টাকার নোট ল্যাংয়ের হাতে দিয়া বলিল, ”এই টাকাটা আজ নাও ল্যাং, কাল আবার আমাদের বাড়িতে এসো, তোমাকে আমার খুবই দরকার।”

ল্যাং একটা নমস্কার করিল, বলিল, ”নিশ্চয়ই আসব। চৌধুরিসাহেবের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না দিদিমণি!”

কৃষ্ণা মাতুল ও ব্যোমকেশের সহিত গাড়িতে উঠিল।

দশ

ব্যোমকেশ মুহূর্তমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ”কি জানি কেন তোমাদের ওই ল্যাংকে আমি পছন্দ করতে পারছি না, ওকে আমার যেন কেমন সন্দেহ হচ্ছে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি ওর বিশেষ পরিচয় পাননি কাকাবাবু, তাই ওকে সন্দেহ করছেন। ও লোককে সন্দেহ করবার কিছুই নেই। বেচারা সত্যিই বড় হতভাগা। ইউউইনই ওর সর্বনাশ করেছে এ কথা সত্যি। বাবা থাকতে আমাদের এখানে ল্যাং একদিন নয়, দু-দিন নয়, সাতমাস ছিল। এই সাতমাস সে বাবার অনেক কাজ করেছে, অনেক সন্ধানও দিয়েছে।”

বলিতে বলিতে পিতার ডায়ারির একটা জায়গার কথা মনে পড়িল, কৃষ্ণা বলিল, ”আপনারা একটু বসুন, আমি আসছি।”

পিতার ডায়ারি ক’খানা সে সঙ্গে আনিয়াছিল। পাশের ঘরে ড্রয়ারের মধ্যে সে কয়খানি রাখিয়াছিল। তাড়াতাড়ি গিয়া ড্রয়ার খুলিয়া কৃষ্ণা ডায়ারি বাহির করিল।

ডায়ারির মধ্যে চিহ্নিত একটা স্থান, সেখানে যে তারিখ রহিয়াছে, তাহা আজ হইতে ঠিক এক বৎসর আগেকার দিন।

মিঃ চৌধুরি লিখিয়াছেন-

‘ল্যাং আসিয়াছে। তাহাকে দিয়া অনেক কাজ পাইয়াছি এবং পাইতেছি। তবু মনে হয়, সে সব তেমন জরুরি কাজ নয়। উপরকার অনেক হালকা খবরই শুধু’ সে দিয়া থাকে। মোটামুটি কিছু খবর পাইলেও তাহাকে ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না।”

ইহার দুইদিন পরের তারিখে লেখা আছে :

”কাল হঠাৎ দেখিলাম, ল্যাং আমার ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কি দেখিতেছে, কে জানে। ফুচু বাড়ি নাই, আমার জন্য সিগার আনিতে গিয়াছে, নচেৎ ল্যাং ঘরে আসিতে পাইত না। যাই হোক, ফুচুর কতকটা অন্যায় যে, সে ঘরে চাবি দেয় নাই।…হঠাৎ আমাকে দেখিয়া ল্যাং বিবর্ণ হইয়া গেল কেন? একটু যেন সন্দেহ হয়। সে বলিল, দরজা খোলা দেখিয়া আমি বাড়ি ফিরিয়াছি ভাবিয়া সে আমার নামীয় পত্রখানা দিতে আসিয়াছিল। হয়তো তাই-ই, আমি মিথ্যা তাহাকে সন্দেহ করিয়াছি। সে নিজে কোনো অন্যায় করিতে পারিবে না তাহা জানি, কারণ তাহার একখানা পা নাই।”

কৃষ্ণা ডায়ারি বন্ধ করিয়া আস্তে আস্তে ফিরিল। তখন ব্যোমকেশ উঠিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন। কৃষ্ণাকে দেখিয়া বলিলেন, ”আমি যাচ্ছি মা, ওদিকে জরুরি কাজ আছে কিনা, দেরি করবার জো নেই।”

কৃষ্ণা গম্ভীরমুখে বলিল, ”আসুন। কিন্তু একটা কথা বলে রাখি-ল্যাং সম্বন্ধে যদিও কোনো সন্দেহ হয় তা প্রকাশ করবেন না। সত্যিই যদি সে তার কথামতো নির্দোষ ও দুঃখী হয়, আমি তার ব্যবস্থা করব, আর যদি সে বাস্তবিকই প্রতারণা করতে এসে থাকে, তার উপযুক্ত শাস্তি যাতে পায় তাও আমরা করব।”

ব্যোমকেশ চলিয়া গেলেন।

এইসময় প্রণবেশ ফিরিয়া আসিলেন। তিনি কোথায় বেড়াইতে গিয়াছিলেন। শ্রান্তভাবে একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া মাথার টুপিটা টেবলে রাখিয়া তিনি বলিলেন, ”উঃ, আজ যা বেড়িয়েছি কৃষ্ণা, একেবারে বোধ হয় আট-দশ মাইল হবে। ইরাবতীর ধার দিয়ে চলতে যে কি আরাম, আর কি সুন্দর দেখতে, তা আর তোমায় কি বলব! ঠিক আমাদের বাংলাদেশের গ্রামের মতো সুন্দর জায়গা, অথচ বাড়ি-ঘর, পথ ঘাট সব তার চেয়েও পরিষ্কার, ঝরঝরে!”

কৃষ্ণা বলিল, ”তোমায় একটা কথা বলে রাখছি মামা, তুমি ওরকম করে যেখানে সেখানে যেও না। আবার যদি কোনো বিপদে পড়, তাহলে আর বাংলোয় ফিরতে পাবে না, আর যা করতে এসেছ তাও নষ্ট হবে।”

প্রণবেশ হাসিয়া বলিলেন, ”আমি কি একা ছিলুম? অবিনাশবাবু তাঁর একজন দরোয়ানকে সঙ্গে দিলেন, আর সঙ্গে গেল আমাদের খোঁড়া ল্যাং।”

কৃষ্ণা সবিস্ময়ে বলিল, ”ল্যাং তোমার সঙ্গে গিয়েছিল? তাই আমরা ল্যাংকে দেখতে পাইনি। ওকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করবেন বলে কাকাবাবু সকাল আটটা থেকে বসে হয়রান হয়ে এই খানিক আগে থানায় চলে গেলেন। সেদিন থেকে আজ দশ বার দিন খুঁজে খুঁজে তিনি হয়রান হয়ে গেলেন, অথচ ইউউইনের কোনও পাত্তা নেই, সে যেন হাওয়ায় উড়ে গেছে!”

প্রণবেশ বলিলেন, ”সেদিন মানে-কোনদিন?”

কৃষ্ণা বলিল, ”সেই যে সেদিন ল্যাং প্যাগোডায় তাকে দেখেছিল বললে?”

প্রণবেশ হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, ”ল্যাং এক চোখ দিয়ে কাকে দেখেছে ঠিক নেই, অমনি স্পষ্ট চাপিয়ে দিলে-ইউউইন এসেছে এবং আমাদের পেছনে পেছনে প্যাগোডা পর্যন্ত গেছে। আজ ল্যাংকে জিজ্ঞাসা করতে সে একটু হাসলে, বললে, কি জানি কাকে দেখেছিলুম সাহেব-হয়তো ইউউইন নয়, আমি আর কাউকে দেখে ভুল করেছি! ইউউইন বর্মায় এলে সারা বর্মায় তুমুল কাণ্ড বাধত, বর্মা পুলিশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠত। ইউউইন জাঁকজমক বড় বেশিরকম ভালোবাসে। সে যেখানেই থাক, তার খবর জানতে পুলিশের বড় বেশিক্ষণ দেরি হয় না’।”

কৃষ্ণা বলিল, ”এতসব কথা তুমি জানলে কি করে মামা?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”আমাদের ল্যাং সব জানে কিনা, সে সব বলছিল।”

কৃষ্ণা বলিল, ”ল্যাং ওই কাঠের পা নিয়ে অতখানি পথ হাঁটতে পারলে মামা?”

প্রণবেশ বলিলেন, ”আশ্চর্য, বরং আমার চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি সে চলতে পারে কৃষ্ণা, আর একটুও কষ্ট অনুভব করে না। পথে কত লোকের সঙ্গে তার দেখা হল, দেখলুম অনেক লোকের সঙ্গে তার পরিচয় আছে।”

কৃষ্ণা গম্ভীরমুখে বলিল, ”কাকাবাবু বার বার করে বলে দিয়েছেন, তুমি আর ল্যাংয়ের সঙ্গে যেও না। কাকাবাবু ল্যাংকে বরাবরই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। হ্যাঁ, আর একটা কথা মামা-জেঠামণি খবর পাঠিয়েছেন, বাড়ির খদ্দের আজ বা কাল বিকেলের দিকে হয়তো আসবে। তিনিও সঙ্গে আসবার চেষ্টা করবেন, নইলে তাঁর পুরনো দারোয়ান ভকৎসিংকে বলে রেখেছেন-সে নিয়ে আসবে। তুমি বিকেলের দিকে আজ কোথাও যেও না।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”না, বিকেলের দিকে আজ আর আমার কোনো দরকার নেই, বাড়িতেই থাকব।”

পোশাক ছাড়িতে তিনি নিজের নির্দিষ্ট ঘরে চলিয়া গেলেন।

এগারো

সন্ধ্যার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শহর বৈদ্যুতিক আলোয় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।

কৃষ্ণাদের বাড়ির পাশেই ক্লাবে আজ বার্ষিক উৎসব, মহা ধুমধাম পড়িয়াছে। জানালা হইতে কৃষ্ণা দেখিতেছিল, ফুলের মালা লতাপাতায় ক্লাব-ঘরটি অতি সুন্দর দেখাইতেছে। বর্মার প্রধানমন্ত্রী আজ এখানে শুভাগমন করিবেন, তাঁহার সম্বর্ধনার বিপুল আয়োজন হইয়াছে।

চমৎকার কনসার্ট বাজিতেছিল। কৃষ্ণা তন্ময়ভাবে বাজনা শুনিতেছিল।

তারক একখানা কার্ড হাতে লইয়া আসিয়া দাঁড়াইল-”দিদিমণি, একজন সাহেব এসেছেন, অবিনাশবাবুর দারোয়ান ভকৎসিং তাঁকে সঙ্গে করে এনেছে-অবিনাশবাবু এখনও বাড়ি আসতে পারেননি। আমি হাঁকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলুম, ভকৎসিং বললে, বাবু আপনাকে জানিয়েছেন।”

কৃষ্ণা কার্ডখানা লইয়া তাহার উপর চোখ বুলাইল, নাম লেখা আছে-মিঃ আর. রবিন।

সকালে অবিনাশবাবু মিঃ রবিনের নাম ও আকৃতির পরিচয় দিয়াছিলেন। বহুদিন আগে একদা আর্থার মুর পরিচয় দিয়া পাপিষ্ঠ ইউউইন কৃষ্ণার সম্মুখে আসিয়াছিল, সেদিনকার কথা কৃষ্ণা আজও ভুলে নাই। বৈঠকখানার বারান্দায় আসিয়া কৃষ্ণা ভকৎসিংকে দেখিতে পাইল।

সেলাম দিয়া ভকৎসিং বলিল, ”এই সাহেব বাড়ি কিনতে চান, বেশ পছন্দ হয়েছে,এখন আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হলেই হয়।”

”আমার সঙ্গে আবার কথাবার্তা কেন, জেঠামণিই যখন সব করবার ভার নিয়েছেন তখন-”

বলিতে বলিতে কৃষ্ণা পর্দা সরাইয়া ঘরে প্রবেশ করিল। টেবলের ধারে দীর্ঘাকৃতি এক ইংরাজ যুবক একখানি চেয়ারে বসিয়া সেদিনকার সংবাদপত্রখানা দেখিতেছিল, সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্মিতমুখে অভিবাদন করিল।

কৃষ্ণা কি রকম যেন থতমত খাইয়া গেল। এ মূর্তি যেন তাহার পরিচিত বলিয়া মনে হয়। কবে কোথায় যেন এই দীর্ঘাকৃতি লোকটি তাহার চোখে পড়িয়াছিল!

ইংরাজ যুবক শান্তকণ্ঠে বলিল, ”আমি বোধহয় মিস চৌধুরির সঙ্গে কথা বলছি?”

কৃষ্ণা চকিতে নিজেকে সংযত করিয়া প্রত্যভিবাদন করিয়া বলিল, ”হ্যাঁ, আমিই মিস চৌধুরি। আপনি-”

কৃষ্ণার করধৃত কার্ডখানা দেখাইয়া যুবক বলিল, ”আমার পরিচয় আপনি আগেই মিঃ রায়ের কাছে নিশ্চয়ই পেয়েছেন। আমি মিঃ আর. রবিন-এদিকে ফরেস্ট-বিভাগের ইনচার্জ। আপনি এই বাড়ি বিক্রি করবেন শুনে কিছুদিন আগে বাসিন থেকে আমি মিঃ রায়কে টেলি করে তারপর একদিন এসে দেখে যাই। উনি সেই সময় জানান যে, আপনি বাংলা থেকে শীঘ্রই এখানে আসবেন, তখন দেখা করে একেবারে দরদস্তুর করে কিনে নিলেই চলবে। আমার কাল বিকালে আসার কথা ছিল, আপনারও সেজন্য প্রস্তুত থাকার কথা ছিল; আমি যে ঠিক সময়ে আসতে পারিনি, এজন্যে আমি অত্যন্ত লজ্জিত মিস চৌধুরি!”

মিঃ রবিনের নম্র ও ভদ্র আচরণে কৃষ্ণা ভারী খুশি হইয়া উঠিয়াছিল। প্রথমটা সে অত্যন্ত বেশিরকম ঘাবড়াইয়া গিয়াছিল; কারণ মিঃ রবিন দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে আর্থার মুরের মতোই, মুখের ভাবটাও হঠাৎ যেন সেইরকমই মনে লাগিয়াছিল। কিন্তু, না। অবিনাশবাবুর নিকট আগেই সে মিঃ রবিনের বাড়ি কেনার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনিয়াছে। কাজেই সে তাহাকে অবিশ্বাস করিতে পারিল না।

কৃষ্ণা বসিল, মিঃ রবিনও বসিল।

কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল, ”আপনি কতদিন এখানে এসেছেন?”

মিঃ রবিন বলিল, ”বছর তিন-চার হবে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”দেশে বোধহয় ফেরবার ইচ্ছা নেই, তাই এখানেই বাড়ি নিয়ে থাকতে চান?”

মিঃ রবিন হাসিল, বলিল, ”তাই বটে। দেশে আমার কেউ নেই, তাছাড়া আমার পার্মানেন্ট পোস্ট, আর রেঙ্গুন-শহরটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। মনে করেছি, এখানেই একটা বাড়ি নিয়ে রাখি। যেখানেই থাকি, এখানে এসে বিশ্রাম লাভ করতে পারব।”

প্রণবেশ বাড়িতেই ছিলেন, খানিক আগে থানা হইতে একজন লোক ডাকিতে আসায়, কৃষ্ণাই তাঁহাকে পাঠাইয়া দিয়াছে। প্রণবেশ এখনও ফিরেন নাই, কখন ফিরিবেন তাহারও ঠিক নাই।

মিঃ রবিনের সঙ্গে কথা বলিয়া তাঁহাকে খানিক বসিতে অনুরোধ করিয়া কৃষ্ণা বাহিরে আসিল, ভকৎসিংয়ের সঙ্গে একবার দেখা করিয়া কথা বলিবার জন্য তাহাকে খোঁজ করিয়া জানিল, সে বিশেষ দরকারে একবার বাড়ি গিয়াছে।

কৃষ্ণা তারককে ডাকিয়া বলিল, ”তুমি চট করে একবার থানায় গিয়ে, কাকাবাবু আর মামাকে ডেকে নিয়ে এস তারক, বল গিয়ে, মিঃ রবিন এসেছেন, আর ঘণ্টাখানেক তিনি থাকতে পারবেন, এর মধ্যে তাঁরা একবার আসুন।”

তারক ইতস্তত করিয়া বলিল, ”কিন্তু, তুমি একা থাকবে মা লক্ষ্মী, ভরসা হয় না যে-”

কৃষ্ণা বলিল, ”না না, কোনো ভয় নেই, মিঃ রবিন জেঠামণির পরিচিত লোক, বিশেষ জানাশোনা। তোমার কোনো ভয় নেই তারক, তুমি অনায়াসে যেতে পার। আর, বাড়িতে তো অন্য লোকও আছে, ভকৎসিংও এরমধ্যেই এসে পড়বে এখন, তার একটা দায়িত্বজ্ঞান আছে তো?”

তারককে থানায় খবর দিতে পাঠাইয়া সে ফিরিল।

নিজের চেয়ারে বসিতে বসিতে কৃষ্ণা বলিল, ”মামা আর কাকাবাবুকে ডাকতে পাঠালুম, ওঁদের সঙ্গে বাড়ির সম্বন্ধে কথাবার্তা বলাই ভালো।”

মিঃ রবিন প্রফুল্লমুখে বলিল, ”খুব ভালো কথা। তাঁরা আসুন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলাই ভালো।”

মিঃ রবিন তাহার জঙ্গলের সম্বন্ধে বিবিধ অভিজ্ঞতার গল্প শুরু করিল। কণ্ঠস্বর নিম্ন ও চাপা হইলেও গল্প বলার ক্ষমতা তাহার অপরিসীম, কৃষ্ণা আশ্চর্যভাবে শুনিতে লাগিল।

কাঠের পা ঠক ঠক করিতে করিতে ল্যাং আসিয়া দরজার উপর দাঁড়াইল, বলিল, ”দেখুন, থানা থেকে একজন লোক এসেছে, বলছে, খুব দরকারি কথা আছে।”

কৃষ্ণা উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিল, ”থানার লোক এসেছে-কেন? তাকে ডেকে নিয়ে এস তো!”

ল্যাং ডাকিবার আগেই দরজার উপর একজন পুলিশকে দেখা গেল। একটা সেলাম দিয়া সে বলিল, ”নিসপেক্টারবাবু এখনি আপনাকে থানায় যেতে বললেন-প্রণববাবু সাংঘাতিক আহত হয়েছেন।”

”সে কি কথা-মামা আহত?”

কৃষ্ণা উঠিয়া দাঁড়াইল।

কনস্টেবলটি বলিল, ”মিনিট কুড়ির কথা হবে, প্রণববাবু থানা থেকে বার হয়ে যেমন পথ চলতে শুরু করেছেন, এমন সময় কে তাঁকে গুলি করেছে। তাঁর সৌভাগ্য যে, গুলি তাঁর বাঁ দিককার কাঁধ দিয়ে গেছে, বুকে লাগেনি। থানায় তিনি অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন, নিসপেক্টারবাবু তাই একেবারে গাড়ি দিয়ে আমায় পাঠিয়েছেন, আপনাকে এখুনি যেতে হবে, চলুন-”

রুদ্ধকণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”চল, আমি এখুনি যাচ্ছি। আচ্ছা মিঃ রবিন, বিদায়-”

মিঃ রবিন সঙ্গে সঙ্গে চলিতে চলিতে বলিল, ”চলুন মিস চৌধুরি, আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি থানায়, দেখা যাক কি হয়েছে!”

গাড়িতে উঠিতে উঠিতে মিঃ রবিন বলিল, ”আপনি যে আপনার চাকরকে পাঠালেন মিস চৌধুরি?”

উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে কৃষ্ণা বলিল, ”সে বোধহয় আটকা পড়েছে থানায়-”

গাড়ি তীরবেগে ছুটিল।

মিনিটের পর মিনিট, দীর্ঘসময় গাড়ি ছুটিয়াই চলিয়াছে। আত্মচিন্তায় নিমগ্না কৃষ্ণার কোনো খেয়ালই ছিল না। সে ভাবিতেছিল বেচারা প্রণবেশের কথা। মামা বেচারা আসিতে চান নাই, কৃষ্ণা তাঁহাকে জোর করিয়া বর্মা মুলুকে টানিয়া আনিয়াছে। আজ যদি মামার কিছু হয়…

কৃষ্ণা শিহরিয়া উঠিয়া চক্ষু মুদে।

হঠাৎ তাহার খেয়াল হইল, থানায় যাইতে মোটরে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি দেরি হয় না-এত দেরি হইবার তো কথা নয়।

আতঙ্কে শিহরিয়া উঠিয়া কৃষ্ণা ডাকিল, ”মিঃ রবিন! আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

স্থিরকণ্ঠে মিঃ রবিন বলিল, ”যেখানে গাড়ি যাচ্ছে সেইখানে যাচ্ছি, মিস চৌধুরি!”

কৃষ্ণা তাহার মুক্ত গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনিয়া চমকাইয়া উঠিল, তথাপি আত্মসংযত করিয়া বলিল, ”কোথায় যাচ্ছি?…ওকে থামতে বলুন মিঃ রবিন, আমার মনে হচ্ছে-”

মিঃ রবিন বলিল, ”মনে তো অনেক কিছুই হয় মিস চৌধুরি! চেঁচামেচি করবেন না-জানবেন, এখানে চেঁচামেচি করলে আপনারই বিপদ হবে। কারণ, আমরা এখন বন-জঙ্গলের দিকে চলেছি। এখানে কোনো লোকজনের সাড়া পাবেন না…উঁহু! ওকি করছেন? দরজা খুলে চুপি চুপি লাফ খেয়ে পড়বেন? ও সব মতলব ছেড়ে দিন বলছি!”

মিঃ রবিন খোলা দরজাটা বন্ধ করিয়া দিল।

অস্ফুট বাষ্পীয় স্বরে কৃষ্ণা বলিল, ”আপনি কে, আপনি কি-”

মিঃ রবিন হাসিল-”হ্যাঁ, আমিই সেই…আমি দস্যুসর্দার ইউউইন-”

ভয়ার্ত একটা শব্দমাত্র কৃষ্ণার মুখে শোনা গেল।

বারো

ল্যাং দরজার কাছে বসিয়া ছিল, এমন সময় তারকের সহিত ব্যোমকেশ ও প্রণবেশ ফিরিয়া আসিলেন। সামনেই ল্যাংকে দেখিয়া ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিলেন, ”রবিন সাহেব আছেন তো?”

ল্যাং বিস্মিতভাবে প্রণবেশের পানে তাকাইয়া রহিল, একটি কথাও বলিল না।

প্রণবেশ বলিলেন, ”কি দেখছ ল্যাং? এমন করে চেয়ে আছ, মনে হয় যেন ভূত দেখছ!”

ল্যাং শুষ্ককণ্ঠে বলিল, ”আপনি যে ফিরলেন সাহেব! তবে যে থানা থেকে লোক এসেছিল-”

”থানা থেকে লোক এসেছিল-মানে?”

ইহারই মধ্যে ব্যোমকেশ ঘরের ভিতর হইতে ফিরিয়া আসিলেন, তারক চিৎকার করিতে লাগিল,-”মা লক্ষ্মী কোথায় গেলে গো? বাবু এসেছেন-এদিকে একবার এসো!”

ব্যোমকেশ একটা প্রচণ্ড ধমক দিলেন, ”চুপ! থাম তারক, অনর্থক চিৎকার করো না। ব্যাপারটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কি করে যে হল শুধু তাই বোঝা যাচ্ছে না। ল্যাং, তুমি সব জানো। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তুমিই বাড়িতে আছ। বল, ব্যাপারটা কি হয়েছে!”

ল্যাং সভয়ে বলিল, ”আমি কিছুই জানি না সাহেব, দিদিমণি সোজা গিয়ে গাড়িতে উঠলেন তাই জানি। সাহেব আসার পর দিদিমণি তারককে থানায় আপনাদের ডাকতে পাঠিয়েছিলেন। ভকৎসিং আগে এখানে ছিল, তাকেও বাড়ি থেকে একজন লোক ডাকতে আসায় সে খানিকক্ষণের জন্যে চলে গিয়েছিল। আমি এখানে বসে ছিলুম, এমন সময় একজন কনেস্টবল একখানা গাড়ি নিয়ে এসে খবর দিলে, ইনস্পেক্টারসাহেব গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছেন, এখুনি দিদিমণিকে থানায় যেতে হবে।”

প্রণবেশ রুদ্ধশ্বাসে বলিলেন, ”কেন?”

ল্যাং বলিল, ”সে জানালে, আপনাকে কে গুলি করেছে, আপনি সাংঘাতিক আহত হয়ে থানায় পড়ে আছেন-”

”কনস্টেবল!” বিস্ময়ে ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিলেন।

ল্যাং উত্তর দিল, ”হ্যাঁ, আমি তার নম্বর রেখেছি সাহেব-কাগজে লিখে রেখেছি। সে আপনাদের ভারতবর্ষীয় লোক, আপনাদের ভাষাতেই কথা বলেছিল। দিদিমণি যাওয়ার সময় আমাকে বাড়ি-ঘর দেখবার কথা বলায় আমি বসে আছি।”

সে ব্যোমকেশের হাতে একখানা কাগজ দিল, তাহাতে লেখা আছে, নং ৭৫-

ব্যোমকেশ হতভম্ব হইয়া বলিলেন, ”এখানে পুলিশের নম্বর আবার পাগড়ি-জামায় থাকে নাকি প্রণববাবু?”

বলিতে বলিতে মুখ তুলিয়া দেখিলেন-বেচারা প্রণবেশ দাঁড়াইতে অসমর্থ হইয়া নিকটবর্তী একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া দুই-হাতে মুখ ঢাকিয়াছেন।

ব্যোমকেশ তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বলিলেন, ”ছিঃ প্রণবেশবাবু, এ সময়ে আপনার এমনভাবে ভেঙে পড়া মানায় না। আপনি পুরুষ, যথেষ্ট লেখাপড়া শিখেছেন, কোথায় শক্ত হয়ে কি করতে হবে সেসব উপায় ঠিক করবেন, তা না করে আপনি কিনা একেবারে ভেঙে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছেন?…ছিঃ!”

লজ্জিত প্রণবেশ মুখ হইতে হাত নামাইলেন, রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, ”আমি যে কি অবস্থায় পড়েছি ব্যোমকেশবাবু, তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারছিনি। আমি আগে থেকেই কৃষ্ণাকে বলে আসছি-যা করতে পুরুষে ভয় পায় তুমি তা করতে যেও না, কিন্তু সে আমার একটি কথাও কানে নিলে না। শেষটায় দুর্দান্ত ইউউইনের হাতে…উঃ…উঃ!”

বলিতে বলিতে তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিল।

গম্ভীরকণ্ঠে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আশ্চর্য্যের কথা হলেও মনে করতে হবে, দুনিয়ায় অসম্ভব কিছুই নয়। কৃষ্ণা না হয়ে যদি আপনি বা আমি থাকতুম, আমাদেরও ঠিক এমনিভাবে সে নিয়ে যেত, বন্দি করত। আজ যে ব্যাপারটা ঘটল, এর জন্যে সে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছে প্রণবেশবাবু! প্রথম দেখুন-আগে থেকে অবিনাশবাবুর সঙ্গে মিঃ রবিন নামে সে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। তাঁর বাড়িতেও প্রায় আসা-যাওয়া করে, অবিনাশবাবুর ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত মিঃ রবিনের নামে আনন্দে ভরে ওঠে। কাজেই অবিনাশবাবু বিনা সন্দেহে তাকে কৃষ্ণার কাছে পাঠিয়েছেন। ভকৎসিং সাহেবকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি গেছে এবং কাল বিকেলে আসার কথা সত্ত্বেও কাজের অজুহাতে কাল না এসে আজ এসেছে বলে তার ওপরে কারও সন্দেহ হয়নি। কাজেই, কৃষ্ণাও বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে গাড়িতে উঠেছে এবং রবিন নামধারী ইউউইনও তার এতটুকু উপকার করবার অছিলায় তার সঙ্গী হয়ে গেছে!”

প্রণবেশ আবার ভাঙিয়া পড়িবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, ব্যোমকেশ একটা হুঙ্কার ছাড়িলেন-”আবার প্রণবেশবাবু!”

প্রণবেশ শক্ত হইলেন-সোজা হইয়া বসিলেন এবং কাশিয়া কণ্ঠস্বরটা পরিষ্কার করিয়া বলিলেন, ”সেবার ইউউইনের উদ্দেশ্য ছিল, এবং কৃষ্ণা তাকে চিনেছে এবং পাছে ক্যালকাটা পুলিশকে সাহায্য করে এই ভয়ে তাকে নিয়ে পালাচ্ছিল। এবার আর তার সে ভয় নেই, অতবড় দুর্ধর্ষ একজন লোক যে সামান্য একটি মেয়েকে তারই নিজের দেশে ভয় করে চলবে তার কোনো মানে নেই। বিশেষ যখন কিছুদিন আগে তারই একখানা পত্রে দেখেছি, সে বালিকা-কৃষ্ণার কোনো অনিষ্ট করবে না। তবে হঠাৎ আবার তাকে ভুলিয়ে নিয়ে গেল কেন?”

ব্যোমকেশ চিন্তিতমুখে বলিলেন, ”ওই কারণটুকুই তো দুর্জ্ঞেয় প্রণবেশবাবু! এ প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজে পাচ্ছিনি। দেশ-বিদেশের নামকরা পুলিশ অফিসারদের, বিখ্যাত ডিটেকটিভদের যে শূন্য দেখিয়া আসছে, একটি ছোট মেয়েকে ভয় করার হেতু তার কিছু থাকতে পারে না। তবে আমার একটা কথা মনে হয়-”

বাধা দিয়া প্রণবেশ বলিলেন, ”কি কথা-বলুন তো?”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”ইউউইন জানে তার নামে ওয়ারেন্ট আছে আর আমিও এখানে এসে বর্মা পুলিশের সাহায্য নিয়েছি এবং আমাকে আপনি ও কৃষ্ণা যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। সে কৃষ্ণাকে চুরি করে নিয়ে গেছে তার কারণ, সে জানে, আমরা আর সব কাজ ফেলে কৃষ্ণাকেই খুঁজব, এই অবকাশে সে নকশানুযায়ী স্থান খুঁজে গুপ্তধন উদ্ধার করবে। ইয়াং চ্যাংয়ের সৌভাগ্যলক্ষ্মী আংটি সে হস্তগত করেছে, এখন তার সম্পূর্ণ ভরসা আছে, গুপ্তধন সে লাভ করবেই।”

প্রণবেশ বলিলেন, ”তারপর?”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”তারপর আর কি। তারপর হয়তো বর্মাতে ইউউইনের নাম আর কেউ শুনতে পাবে না! সে চলে যাবে আমেরিকা, চলে যাবে অস্ট্রেলিয়া, চলে যাবে নিউজিল্যান্ড-যেখানে কেউ তার সন্ধান পাবে না!”

প্রণবেশ শিহরিয়া উঠিলনে, ”সর্বনাশ! আর কৃষ্ণা?”

ব্যোমকেশ সংক্ষেপে বলিলেন, ”মানুষের জীবন ইউউইনের হাতের খেলার জিনিস, নিতেও পারে-রাখতেও পারে। যাক, ও সব কথা থাক, আপনি একবার থানায় ফোন করুন। বাড়ি, জিনিসপত্র এবং লোকজন-সব কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাছাড়া একটা ডাইরি করা দরকার।”

প্রণবেশ থানায় ফোন করিলেন, ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী জানাইলেন, তিনি এখনি আসিতেছেন।

মিনিট দশ-বারো পরেই ইনস্পেক্টার লী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি খাস ইউরোপিয়ান,-দীর্ঘকাল এই বর্মা পুলিশে কাজ করিতেছেন।

সমস্ত ঘটনা তিনি শুনিলেন, দারোয়ান এবং ভৃত্যদের জেরা করিলেন। এইসময় অবিনাশবাবুও হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কোর্ট হইতে ক্লাবে নিমন্ত্রণ রাখিতে গিয়া তিনি এতক্ষণ বাড়ি আসিতে পারেন নাই, বাড়ি ফিরিয়া এই ব্যাপার শুনিয়া পোশাক না খুলিয়াই চলিয়া আসিয়াছেন।

এখানে আসিয়া ল্যাংকে দেখাইয়া তিনি গোপনে মিঃ লীকে বলিলেন, ”দেখুন, এই লোকটার ওপরেও আমার সন্দেহ হয়। চৌধুরি কোথা থেকে একে আবিষ্কার করে এনেছিলেন কে জানে! এককালে যখন গায়ে শক্তি ছিল তখনকার ঘটনা তো আপনি জানেন? চৌধুরি বলতেন, ‘চোরকে সাধু হওয়ার অবকাশ দিলে সত্যই সে সাধু হয়।’ আমি কিন্তু এ কথা বিশ্বাস করি না মিঃ লী! আমার মনে হয়, ভিতরে এর সাহায্য না পেলে ইউউইন এতখানি অগ্রসর হতে পারত না, থানার এত কাছ থেকে এরকমভাবে কৃষ্ণাকে নিয়ে পালানোর সাহস তার কিছুতেই হত না।”

মিঃ লী বলিলেন, ”ওকে আমি হাজতে নিয়ে যাচ্ছি, পরে বিবেচনা করে দেখব ওকে নিয়ে কি করা যায়।”

ল্যাংকে লইয়া তিনি চলিয়া গেলেন।

তেরো

ল্যাং পলাইল।

তাহার উপর তেমন কড়াদৃষ্টি রাখা হয় নাই। একপায়ে সে যে পলাইতে পারে, এ ধারণা মিঃ লী করিতে পারেন নাই; তাই তাহাকে তেমন সতর্ক পাহারাতে রাখা হয় নাই।

অন্ধকার রাত্রিতে মিনিট কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে ল্যাং আলোয় উজ্জ্বল শহর ছাড়িয়া শহরতলিতে গিয়া পড়িল। অগ্রহায়ণের রাত্রি, শীত বেশ পড়িয়াছে। তাহার উপর সমস্ত দিন টিপটিপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। হু হু করিয়া ঠান্ডা বাতাস বহিয়া যাইতেছিল। পথে লোকজন প্রায় নাই বলিলেই চলে।

প্রকাণ্ড বড় একটি বাগানের মধ্যে একটি সুন্দর বাংলো, দরজা ভিতর হইতে বন্ধ-ল্যাং দরজায় তিনবার আঘাত করিল।

ভিতর হইতে কে জিজ্ঞাসা করিল, ”কে?”

”আমি কাওয়ান ল্যাং, দরজা খোলো-”

একজন লোক দরজা খুলিয়া দিল। ল্যাং ভিতরে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।

লোকটি বলিল, ”তুমি ল্যাং, হাজতে গিয়েছিলে শুনলুম, ছাড়া পেলে নাকি?”

ল্যাং একটু হাসিয়া বলিল, ”অত সহজে ছাড়া পাওয়া সম্ভব বলে মনে কর ফুজি?…জামাটা ছাড়তে হবে…একটা জামা দিতে পার?”

ফুজি একটা কোট আনিয়া দিয়া বলিল, ”নাও, কিন্তু তোমার লুঙ্গিও তো ভিজে গেছে দেখছি, একটা লুঙ্গি দিই?”

দন্তপাটি বিকশিত করিয়া ল্যাং তাহাকে জিভ বাহির করিয়া ভেংচি কাটিল… ”ইস…দরদ।”

হাসিয়া সে একটা লুঙ্গি দিল।

কাপড়-জামা ছাড়িয়া কাঠের লম্বা পাখানা সোজা ছড়াইয়া দিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া ল্যাং বলিল, ”সাহেব এসেছেন?”

ফুজি বলিল, ”অনেকক্ষণ…হলে আছেন…দেখা করবে তো?”

ল্যাং একটু ভাবিয়া বলিল, ”এখন থাক। এখন তিনি নিশ্চয়ই মন্ত্রণা করছেন, ওখানে যাওয়া আমাদের এখন বে-আইনি, তা জানো তো বন্ধু?”

”আমি খবর দিই। তিনি যদি বলেন, তোমায় এসে নিয়ে যাব।”

প্রকাণ্ড বড় বাড়িটার ঠিক মাঝখানে একটি চতুষ্কোণ আকারের প্রকাণ্ড ঘর। ঘরটি সুসজ্জিত। মেঝেয় কার্পেট বিছানো, তাহার উপর নানা বিচিত্র সোফা, কুশন ইত্যাদি। এই ঘরটি ইউউইনের গুপ্ত মন্ত্রণা-কক্ষ।

কেবল রেঙ্গুনে এই একখানি বাড়ি নয়, বিভিন্ন স্থানে এখানে তাহার আড্ডাস্থল আছে। পুলিশ সে সব সন্ধান জানে না। ইহা ছাড়া বাসিনে, ম্যান্ডালেতে, মৌলমিনে, প্রত্যেক স্থানে তাহার আড্ডা আছে,-খেয়াল ও প্রয়োজনমতো সেইসব স্থানে ইউউইন মাঝে মাঝে পরিভ্রমণ করে।

ঘরখানি তাহার দলের লোকে পূর্ণ। ইহার মধ্যে জাপানি আছে, চাইনিজ, ভারতীয়, বার্মিজ, ইংরাজ প্রভৃতি প্রত্যেক দেশের লোকই আছে। ইহাতে বুঝা যায়, ইউউইনের কার্যাবলী দেশে দেশে কতটা বিস্তৃত হইয়াছে-তাহার কর্মক্ষেত্রের বিস্তৃতি কতখানি!

অপেক্ষাকৃত উচ্চাসনে বসিয়া আছে ইউউইন।

তাহার পরিধানে মূল্যবান সিল্ক লুঙ্গি, সিল্ক জামা, মাথায় আচ্ছাদনও সিল্কের।

সর্বাংশে ইউরোপিয়ান হইয়াও ইউউইন পিতৃবংশের মর্যাদা রক্ষা করে। তাহার পিতা প্রাচীন রাজবংশোদ্ভূত। ইউরোপিয়ান মায়ের চেয়েও সে পিতাকে প্রাধান্য দিয়াছে অত্যন্ত বেশিরকম।

ইউউইনের সামনে একটি হাতির দাঁতের টেবল-সেই টেবলের উপর রহিয়াছে মিঃ চৌধুরির নিকট হইতে আনীত বুদ্ধের পাদুকা, প্রতিকৃতিসহ প্রতিলিপি, মিঃ ইয়াং চাংয়ের নিকট হইতে সংগৃহীত নানা দ্রব্যাদি। বংশের সৌভাগ্য-প্রতীক আংটিটি ইউউইনের দক্ষিণ হস্তের অনামিকায় রহিয়াছে, উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো আংটির মধ্যস্থিত হীরকখণ্ডের উপর ও পার্শ্বস্থিত নীলা দুইখানির উপর পড়িয়া জ্বলিতেছিল। আংটির জৌলুসে চক্ষু ঝলসাইয়া যায়!

ইউউইন বলিতেছিল :

”বন্ধুগণ, কেবল আমার যোগ্যতায় নয়, তোমাদের একাগ্রনিষ্ঠায়, তোমাদের কার্যদক্ষতায় ভগবান তথাগতের অপহৃত এই জিনিসগুলি আবার আমাদের হস্তগত হয়েছে। আমি আজ ‘ফুঙ্গি’দের জানিয়েছি তাঁরা একটা শুভদিন দেখে এগুলি নিয়ে গিয়ে ‘ফায়া’তে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এই পুণ্যের অধিকারী হবে তোমরা, কারণ, তোমরাই অপহৃত জিনিস উদ্ধার করেছ-”

পার্শ্ব হইতে একজন বার্মিজ করজোড়ে সবিনয়ে বলিল, ”এতে আমাদের গর্ব করবার মতো অনেক কিছু থাকলেও, এ সব সংগ্রহ করার গৌরব আমরা লাভ করতে পারি না প্রভু, আপনিই এ গৌরবের অধিকারী। আপনার মতো আত্মত্যাগ আমাদের মধ্যে ক’জন করতে পেরেছে? আমরা কাউকে এমন উপযুক্ত লোক দেখতে পাইনি।”

বাইরে ফুজি অত্যন্ত বিনীতভাবে করজোড়ে দাঁড়াইয়া ছিল। তাহার পানে দৃষ্টি পড়িতেই ইউউইন জিজ্ঞাসা করিল, ”খবর কি ফুজি?”

ফুজি অভিবাদন করিতে করিতে প্রবেশ করিল, নম্রকন্ঠে বলিল, ”ল্যাং এসেছে প্রভু!”

ইউউইনের মুখখানা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, বলিল, ”আমি জানি-ল্যাং যে করেই হোক আসবে, ওকে কেউ আটক রাখতে পারেনি-পারবেও না। ওকে এ ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে তুমি দরজায় থেকো ফুজি।”

অভিবাদন করিয়া ফুজি চলিয়া গেল।

ইউউইন সমাগত সকলের পানে তাকাইয়া বলিল, ”আমি দেবতার জিনিস উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছি এই আমার পরম সৌভাগ্য। আর এক কথা, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার পূর্বপুরুষের জিনিসগুলিও পেয়েছি…সৌভাগ্যের প্রতীক এই আংটি, এই রাজদণ্ড-”

বলিতে বলিতে সে আংটি ললাটে ঠেকাইল, রাজদণ্ড ললাটে রাখিল-

”বন্ধুগণ, তোমরা জানো, আমার পরম শত্রু ইয়াং চাং আমার বংশের এইসব চিহ্ন নিয়ে দীর্ঘ পনেরো বৎসর ভারতে বাস করেছে। সে আমার পিতার কনিষ্ঠ সহোদর হয়েও আমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে বিধিমতো চেষ্টা করেছে। এছাড়া আমি একখানা নকশা হাতে পেয়েছি, যা আমারই পূর্বপুরুষের জিনিস। পাঁচ-সাত পুরুষ পরে, অনেক হাত ঘুরে সে নকশা আমি পেয়েছি। বন্ধুগণ, তোমরা দেখতে পার এই প্রতিলিপিখানি-”

বলিতে বলিতে সে প্রতিলিপিখানি দুই হাতে ধরিয়া তুলিল,-”এই প্রতিলিপি আজ প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বের। এই বর্মারই তৎকালীন রাজা লি-ব এই প্রতিলিপি তৈরি করেছিলেন। দেড় হাজার বৎসর পরে আমাদের পরম শত্রু বাঙালি পুলিশসাহেব মিঃ চৌধুরি ভামোর জঙ্গলে কিভাবে গিয়ে ভগ্নপ্রায় ফায়া-গর্ভ থেকে এই প্রতিলিপি নিয়ে আসে এবং কলকাতার মিউজিয়ামে দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল। আমি যে কষ্টে এ জিনিসগুলি হস্তগত করেছি তা বলতে পারি না।”

প্রতিলিপিখানি নামাইয়া রাখিয়া সে একটি মালা তুলিল, বলিল, ”এই মালা, ভগবান তথাগতের এই জিনিসপত্র প্রভৃতির জন্য আমাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত আমার বন্ধু মহীদলকে। ইয়াং চাংয়ের বাড়িতে অনেকদিন থেকে ইনি তার গুপ্তস্থান আবিষ্কার করেন এবং অনেক কষ্টে এগুলি সংগ্রহ করেন। এগুলিও আমাদের এই ফায়ায় রাখতে হবে, সেজন্যে আমি ফুঙ্গিদের হাতে এগুলি দেব। বিধর্মী এগুলি স্পর্শ করলেও, ফুঙ্গিরা এর পবিত্রতা ফিরিয়ে আনবেন, কথা দিয়েছেন।”

দরজার কাছে হাতজোড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল ল্যাং-অত্যন্ত বিনীত তার মুখের ভাব।

তাহার পানে তাকাইয়া ইউউইন বলিল, ”তারপরে আমরা ধন্যবাদ দেব আমাদের এই বন্ধুটিকে-যে একখানা কাঠের পা এবং একটি মাত্র চোখ নিয়েও আমাদের অশেষ উপকার করেছে। মিঃ চৌধুরির বাড়িতে আমাদের পরম বিশ্বস্ত হিয়েন, ফু-চু নাম নিয়ে চাকরের কাজ করেছিল, ল্যাং নানা কৌশলে চৌধুরি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। ফু-চু নিজে আমাদের কাছে এসে কোনো কথা বলতে পারত না, এই ল্যাংকে দিয়ে যা কিছু প্রয়োজনীয় সংবাদ আমার কাছে পাঠিয়ে দিত।…এই হিয়েন কলকাতার ইয়াং চাংয়ের বাড়িতে থেকে সেখানকার তথ্য জোগাড় করে আমার পরম বন্ধু মহীদলকে জানায়। আংটি অনেক আগেই হস্তগত হয়েছে,-হিয়েন মাত্র এক সপ্তাহ আগে এই মালা ও ভিক্ষাপাত্র সংগ্রহ করে ফিরেছে।…ল্যাং, তুমি এদিকে এসো।”

ল্যাং ঠকঠক করিয়া নিকটে আসিয়া আবার অভিবাদন করিল।

ইউউইন বলিল, ‘তুমি হাজত থেকে বেরিয়ে এলে কি করে?”

ল্যাং বলিল, ”আমি নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছি, ওরা কেউ আমার দিকে লক্ষ করেনি।”

ইউউইন বলিল, ”তোমাকে আমি একটা কাজের ভার দিচ্ছি। মিস চৌধুরিকে এনে আমি এখানে বন্দিনী করে রেখেছি। তুমি এই চাবিটা নিয়ে তোমার কাছে রাখবে, তার দেখা-শোনার ভার আমি তোমার ওপর ছেড়ে দিলুম।”

ল্যাং চাবি লইল।

ইউউইন বলিয়া দিল, ”পাঁচনম্বরের ঘর-সাবধানে খুলো…মেয়েটা বড় চালাক… তাছাড়া সাধারণ মেয়েদের চেয়েও ঢের বেশি শক্তি আছে তার।”

পার্শ্বচর মহীদল বলিল, ”ওই মেয়েটাকে বন্দি করে রাখবার কারণ তো বুঝছি না। সে আপনার অনিষ্ট করতে পারতো?”

গম্ভীর মুখে ইউউইন বলিল, ”জাত-সাপের বাচ্চা-জাত-সাপই হয়ে থাকে মহীদল, বিষহীন ঢোঁড়া হয় না। ওইটুকু মেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে-আমাকে সে যে কোনোরকমে হোক ধরিয়ে দেবে, যাতে চরম শাস্তি পাই তা করবে। কেবল ওকে আমার ক্ষমতা দেখানোর জন্যেই যে বন্দি করেছি তা নয়। কারণ আমি জানি, জগতে ইউউইন দুর্বার-কেউ তাকে দমন করতে পারবে না। আমি আরও একটা উদ্দেশ্য নিয়ে ওকে বন্দি করেছি, সে কথা পরে বলব, আজ থাক।”

কাহার দ্রুত পদশব্দ শোনা গেল-পরমুহূর্তে ঝড়ের বেগে ছুটিয়া আসিল-ফুজি।

”প্রভু, পুলিশ…পুলিশ আসছে-”

”পুলিশ?”

মুহূর্তমধ্যে সকলে উঠিয়া দাঁড়াইল-

ইউউইন একখানা হাত তুলিল-”শান্ত হও বন্ধুগণ, ইউউইনের ক্ষমতার উপর নির্ভর করো।”

সে দেয়ালের গায়ে একটা চিহ্নিতস্থানে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়া চাপ দিতেই সেখানে একটি দরজার মতো দেখা গেল-

বিপরীত দিকে একটা চাপ দিতেই দেয়াল আবার পূর্ববৎ জোড়া লাগিয়া গেল, মাঝখানে রহিয়া গেল কেবল কাঠের চিড়টা। কাঠের দেয়ালের মাঝে মাঝে এ রকম কয়েকটা চিড় বিভিন্নস্থানে থাকায় কেহ সন্দেহ করিতে পারিবে না যে, এখানে একটু আগে একটা পথের সৃষ্টি হইয়াছিল।

সকলকে বাহির করিয়া দিয়া ইউউইন শান্তভাবে টেবলের ধারে চেয়ারটিতে বসিয়া সেদিনকার সংবাদপত্রখানা খুলিয়া ধরিল।

বলা বাহুল্য, টেবলের উপরে তখন প্রাপ্ত দ্রব্যগুলির কিছুই ছিল না। মহীদল সবগুলি ক্ষিপ্রহস্তে কুড়াইয়া সুটকেস ভরিয়া লইয়া গিয়াছে।

এই মুহূর্তে ঘরের অবস্থা দেখিয়া কেহই বুঝিবে না-একটু আগে এই ঘরে কুড়ি-পঁচিশজন লোক ছিল।

চৌদ্দ

পাঁচ মিনিট সময়ই ইউউইনের পক্ষে যথেষ্ট।

* * * *

বাহির হইতে পুনঃপুনঃ দরজায় ধাক্কা এবং সঙ্গে সঙ্গে মিঃ লীর আদেশ শোনা গেল-”দরজা খোলো! শীগগির খোলো!”

ফুজি দরজা খুলিয়া দিল-নিঃশব্দে অভিবাদন করিয়া সরিয়া দাঁড়াইল।

মিঃ লী একা আসেন নাই, সঙ্গে আছে সশস্ত্র পুলিশবাহিনী, আর আছেন প্রণবেশ ও ব্যোমকেশ। মিঃ লী ফুজিকে দেখিয়া কঠোরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, ”এই? তোর মনিব কোথায়?”

ফুজি নিঃশব্দে কেবল তাকাইয়া রহিল।

প্রণবেশ বলিলেন, ”লোকটা বোধ হয় বোবা-কথা বলতে পারে না।”

মিঃ লী ফুজির পেটে একটা গুঁতা দিয়া রুক্ষকণ্ঠে বলিলেন, ”কথা বল হতভাগা-”

নিতান্ত করুণভাবে ফুজি জিভ বাহির করিয়া শুধু একটা অব্যক্ত শব্দ করিল, যাহাতে স্পষ্টই বোঝা যায় সে বোবা। কথা বলিবার ক্ষমতা তার নাই।

প্রণবেশ বলিলেন, ”ছেড়ে দিন। আসুন, আমরাই সব দেখি।”

ফুজিকে একজন পুলিশের হাতে জিম্মা করিয়া দিয়া মিঃ লী দলবলসহ ভিতরে প্রবেশ করিলেন।

অন্ধকার ঘরগুলো টর্চের সাহায্যে আলোয় উজ্জ্বল হইয়া উঠিল-টর্চের আলোয় সুইচ দেখিয়া সব ঘরে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হইল।

মাঝের ঘরের দরজায় আসিয়া ব্যোমকেশ থমকিয়া দাঁড়াইলেন….ঘন সবুজ পর্দার ফাঁক দিয়া ঘরের মধ্যস্থিত অধ্যয়নরত লোকটিকে দেখা যাইতেছিল।

ব্যোমকেশ মিঃ লী-র দিকে অগ্রসর হইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, ”ইউউইন।”

মিঃ লী-র চোখ দুইটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, তিনি পুলিশদের ঠিকভাবে লাইনে দাঁড় করাইয়া ব্যোমকেশের সহিত অগ্রসর হইলেন, পিছনে প্রচুর কৌতূহল লইয়া প্রণবেশ চলিলেন।

দরজার উপরকার পর্দা সরাইয়া উদ্যত রিভলবার হস্তে দাঁড়াইলেন-লী, তাঁহার পার্শ্বে ব্যোমকেশ ও প্রণবেশ।

”মিঃ ইউউইন! ব্রিটিশ আইনের বলে আমি ইনস্পেক্টার-অব-পুলিশ তোমাদের আজ গ্রেপ্তার করছি-”

কয়েক জোড়া বুটের শব্দে পঠনরত ব্যক্তি মুখ উঁচু করিল, তাহার পর যেন পরম বিস্ময়ে উঠিয়া দাঁড়াইল-

”এ কি, মিঃ লী?…আপনি?”

মিঃ লী যেন আকাশ হইতে মাটিতে পড়িলেন। ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলিলেন, ”জেনারেল কুয়ে গাঁ?…আপনি?”

ইউউইনের পরিবর্তে জাপানি বীর জেনারেল কুয়ে গাঁকে দেখিয়া লী যেমন বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়াছিলেন-ব্যোমকেশ তদপেক্ষা কিছু কম হন নাই।

বৃদ্ধ জেনারেল কুয়ে গাঁ-এককালে না কি জাপানে সেনাবিভাগে কাজ করিয়া প্রচুর নাম ও যশ উপার্জন করিয়াছিলেন, বর্তমানে তিনি শহরের উপকণ্ঠে এই বাগান-বাড়িতে বাস করিতেছেন। ইনস্পেক্টর লী বহুস্থানে এই পলিতকেশ অধুনা কুব্জ বৃদ্ধকে দেখিয়াছেন, ব্যোমকেশ সংবাদপত্র মারফৎ এই বৃদ্ধের পরিচয় পাইয়াছেন, চাক্ষুষ কোনোদিনই দেখেন নাই। পরিচয় পাইয়া ইনস্পেক্টর লীর দেখাদেখি তিনিও সামরিক প্রথায় অভিবাদন করিলেন।

জেনারেল কুয়ে গাঁ তাঁহাদের বসিতে বলিয়া বলিলেন, ”এই রাত বারোটার সময় আমার বাগানবাড়িতে এত পুলিশ নিয়ে আসবার কারণ তো আমি কিছু বুঝছিনে, মিঃ লী! আশা করি, ব্যাপার কি শুনতে পাব!”

কুণ্ঠিতকণ্ঠে মিঃ লী বলিলেন, ”তার জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি জেনারেল! আমি জানতুম না এ বাড়িতে আপনি থাকেন, সেইজন্যে এক পলাতক-আসামির খোঁজে এই রাত বারোটায় এখানে এসেছি। আশা করি, সে কথা শুনে আমায় ক্ষমা করবেন।”

জেনারেল ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ”পলাতক-আসামি? কে বলুন তো?”

মিঃ লী বলিলেন, ”বিখ্যাত দস্যু-ইউউইন!”

অকস্মাৎ জেনারেল হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন-হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ”আশ্চর্য! ইউউইন এখানে আছে খবর পেয়ে আপনারা এই রাত বারোটায় এসেছেন এখানে সার্চ করতে? এই শীতের রাতে-বেশ মজা তো আপনাদের পুলিশ বাহিনীর?”

লজ্জাপীড়িত মিঃ লী বলিলেন, ”শুধু তাই নয়, কাঠের পা-ওয়ালা একটা হাজতের কয়েদি ঘন্টাখানেক আগে থানা থেকে পালিয়েছে, খবর পেলুম, সে নাকি এই বাড়িতেই এসে ঢুকেছে, সেইজন্যে-”

বাধা দিয়া জেনারেল অসন্তুষ্টকণ্ঠে বলিলেন, ”সাধে আপনাদের বলি-কেউ যদি বলে ‘কাকে’ কান নিয়ে গেছে, আপনারা কান না দেখে, আগে কাকের পিছনে পিছনে ছুটে যান! এই বোকামির জন্যেই ইউউইন আপনাদের ফাঁকি দিয়ে আপনাদের চোখের সামনে বেড়ায়। বুড়োমানুষের কথা শুনে রাগ করবেন না! আপনারা-পুলিশের লোকেরা দিন-রাত বুদ্ধিতে ধার দিতে দিতে বুদ্ধিকে আরও ভোঁতা করে ফেলেছেন, এ কথাটা স্বীকার আপনাকেও করতে হবে।”

অসন্তুষ্ট হইলেও মিঃ লী কেবল বিষণ্ণভাবে হাসিলেন-বৃদ্ধ জেনারেলের মুখের উপর কথা বলিলেন না।

এতক্ষণে জেনারেল-ব্যোমকেশ ও প্রণবেশের পানে চাহিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, ”এঁরা কে?”

মিঃ লী পরিচয় দিলেন, ”ইনি ক্যালকাটা পুলিশের বিখ্যাত ডিটেকটিভ ব্যোমকেশবাবু, এখানকার ধনী ব্যবসায়ী মিঃ ইয়াং চাংয়ের চুরির কেস আর মিঃ চৌধুরির হত্যাকারীকে ধরতে এসেছেন। কিন্তু-”

জেনারেল বলিলেন, ”অপরাধীর সন্ধান পাওয়া গেছে?”

ব্যোমকেশ উত্তর দিলেন, ”হ্যাঁ, ইউউইনই এ সব কাজ করেছে, আমি তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্যেই এসেছি।”

অসন্তুষ্টকণ্ঠে জেনারেল বলিলেন, ”হত্যাকারী এবং চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে অথচ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি-এই তো আপনাদের যোগ্যতা-ছিঃ-”

প্রণবেশ পুলিশের অপমান সহ্য করিতে না পারিয়া বলিলেন, ”এ অবস্থায় আপনাদের জাপানি পুলিশ কি করত?”

অপরিচিত হইলেও জেনারেল উত্তর দিলেন, ”বিচারের জন্য অপেক্ষার দরকার হত না, গুলি চালিয়ে তখুনি বিচার শেষ হত।”

প্রণবেশ বিকৃতমুখে বলিলেন, ”বে-আইনি-”

জেনারেল মিঃ লী-র পানে তাকাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ”ইনি কে?”

মিঃ লী বলিলেন, ”এখানকার পুলিশে ডি-এস-পি মিঃ চৌধুরী ছিলেন, তাঁকে বোধহয় চিনতেন, তাঁরই সম্বন্ধী, কলকাতা থেকে এসেছেন।”

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া জেনারেল বলিলেন, ”মি চৌধুরী যদিও বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট ছিলেন, তবু তিনি ছিলেন আমার বন্ধুস্থানীয় লোক। প্রায়ই তিনি এখানে আসতেন। আমি যখন জাপান থেকে আসতুম-তাঁকে খবর দিতুম, নিজেও তাঁর ওখানে প্রায়ই যেতুম। তাঁর একটি মেয়ে-কি-যেন তার নাম ছিল, যেন একটি গোলাপ ফুল! সে আমায় ভারী ভালোবাসতো, আমিও তাকে খুব স্নেহ করতুম।”

মিঃ লী সদুঃখে বলিলেন, ”সেই মেয়েটি আজ কুড়ি-বাইশ দিন হল এখানে এসেছিল। আজ দিন-চার-পাঁচ হল একদিন সন্ধ্যায় তার বাড়ি থেকে ইউউইন তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে, আমরা তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

জেনারেল শিহরিয়া উঠিলেন, ”সর্বনাশ! মানুষ চুরি? সেই ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটিকে চুরি! তাকে চুরি করে ইউউইনের কি লাভ হল?”

বিষণ্ণভাবে ব্যোমকেশ বলিলেন, ”হয়তো একটা কোনো উদ্দেশ্য আছে ওর-”

মিঃ লী বিদায় লইলেন।

জেনারেল সাহেব তাঁহার সঙ্গে দ্বার পর্যন্ত আসিলেন। ফুজি তখনও পুলিশের জিম্মায় ছিল, মিঃ লীর আদেশে ফুজি মুক্ত হইল।

জেনারেল বলিলেন, ”মাঝে মাঝে আপনাদের খবরটা জানিয়ে যাবেন মিঃ লী; আমি ভারী উৎকণ্ঠিত রইলুম।”

মিঃ লী বলিলেন, ”নিশ্চয় জানাব।”

পুলিশের দল বাগানবাড়ি ত্যাগ করিয়া পথে নামিয়া গেল। তাহাদের ভারী জুতার শব্দ ক্রমে ক্রমে মিলাইয়া গেল। ফুজি দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

জেনারেলের হাসি আর ধরে না-

মুখের উপরকার বিচিত্র রংয়ের পাতলা রবার-পর্দাটা খুলিয়ে ফেলিয়া, গায়ের আলখাল্লাটা খুলিয়া তিনি একখানা ইজিচেয়ারে বসিয়া পড়িয়া বলিলেন, ”কি চমৎকার অভিনয় করেছি, ফুজি? কথাবার্তায় পোশাক-পরিচ্ছদে কেউ ধরতেই পারেনি যে, আমিই সেই, যাকে ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে। তারপর হঠাৎ গলার স্বর পরিবর্তন-এই স্বর-বৈচিত্র্য শেখবার জন্যে দীর্ঘকাল আর হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে হরবোলা মাস্টারের কাছে থেকে আমায় ‘স্বরিত’ সাধনা করতে হয়েছে। উঃ! কি ভাবেই যে ওদের চোখে ধুলো দেওয়া হয়েছে!”

ইউউইন হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।

দেওয়ালের গায়ে চাপ দিতেই দরজা উন্মুক্ত হইল। লুক্কায়িত লোকগুলি বাহিরে আসিয়া নিজ নিজ স্থানে বসিল।

ইউউইন সকলকে লক্ষ করিয়া বলিল, ”বন্ধুগণ, আমরা আজকের মতো মুক্তি পেয়েছি। এ কথা হয়তো তোমরা জানো যে, ইনস্পেক্টর লী দুজন বাঙালি ইনস্পেক্টর আর একদল পুলিশ নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু ইউউইনের স্থানে জেনারেল কুয়ে গাঁকে দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন! নচেৎ তিনি সমস্ত বাড়ি সার্চ করতেন, যাতে আমাদের নোট জালের কারখানাটাও প্রকাশ হয়ে পড়ত! রাত অনেক হয়েছে, আমার মনে হয় এবার যে যার কাজে যাওয়াই উচিত।”

ইউউইন আসন ত্যাগ করিল।

পনেরো

একটা অন্ধকার কুঠরির মধ্যে মেঝেয় বিচালি পাতা, তাহার উপর একটি কম্বল বিছানো, সেই বিছানার উপরে পড়িয়া আছে-কৃষ্ণা।

পাঁচ দিন সে এখানে রুদ্ধ অবস্থায় আছে। যেন নিস্তব্ধ নিঝুম প্রেতপুরী! কোনোদিকেই জনমানবের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। দু-বেলা দু-মিনিটের জন্য দরজা খুলিয়া যায়, একজন জোয়ান লোক রিভলবার হাতে লইয়া দাঁড়াইয়া থাকে, একটি হাবা ও কালা বৃদ্ধা স্ত্রীলোক খাবার দিয়া যায়। প্রথম দিন কৃষ্ণা কিছুই খায় নাই, দ্বিতীয় দিনে বাধ্য হইয়া তাহাকে আহার্য গ্রহণ করিতে হইয়াছে।

অন্ধকারে থাকিয়া কৃষ্ণার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন হইয়াছে। সে বুঝিতে পারে না তাহাকে কোথায় আনিয়াছে, কোথায় রাখা হইয়াছে। ঘরের আশেপাশে কোথাও টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নাই, শুধু ছাদের উপর মাঝে মাঝে চলাফেরার শব্দ পাওয়া যায়। কৃষ্ণার মনে হয় তাহাকে ভূগর্ভে কোথাও রাখা হইয়াছে, সেইজন্য বাহিরের কোনো শব্দ সে পায় না।

…কি জানি এতদিন মামা কি করিতেছেন! বেচারি ভালোমানুষ মামা, বাড়ি ফিরিয়া কৃষ্ণাকে না দেখিয়া না জানি কি কাণ্ডই বাধাইয়াছেন। ব্যোমকেশবাবু কি করিতেছেন তাই বা কে জানে!

এই ঘরের মধ্যে থাকিয়া কৃষ্ণা বুঝিতে পারে না কখন দিন হইল, কখন রাত্রি হইল।

কৃষ্ণা প্রথমটা মুষড়াইয়া পড়িয়াছিল, তারপর আস্তে আস্তে বুদ্ধি ঠিক করিল, মনে শক্তি সঞ্চয় করিল।

সেদিন যে দরজা খুলিল, তাহার পানে তাকাইয়া কৃষ্ণা চমকাইয়া উঠিল-ল্যাং!…ল্যাং আসিয়াছে। ল্যাংয়ের দক্ষিণহস্তে রিভলবার, বামহস্তে খাবারের থালা-খাবারের থালা নামাইয়া ল্যাং বলিল, ”খেয়ে নাও দিদিমণি,-তোমার ভার আমার ওপর পড়েছে।”

কৃষ্ণা খাবারের থালার দিকে চাহিল না। ঘৃণায় তাহার মুখ বিকৃত হইয়া উঠিল। সে ল্যাংয়ের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইল।

ল্যাং বুঝিল, নরম সুরে বলিল, ”আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, কিন্তু রাগ করে কোনো লাভ হবে না দিদিমণি! আমি ইউউইনের লোক, তার নিমক খেয়ে নিমকহারামি করতে পারিনি, তাই তারই কাজে আমি তোমার বাপের কাছে কাজে এসেছিলুম। তোমাদের সব কথাবার্তা ফুচু আমায় জানাতো, আমি ইউউইনকে বলে আসতুম।”

কৃষ্ণা গর্জিয়া উঠিল, ”বিশ্বাসঘাতক…”

ল্যাং বিকৃতমুখে একটু হাসিল, ”আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি দিদিমণি! মনিবের হুকুম তামিল করেছি। তোমরা এবারে রেঙ্গুনে এসে যেদিন প্যাগোডা দেখতে যাও, সেদিন ইউউইনের হুকুমেই আমি সেখানে দাঁড়িয়েছিলুম।”

কৃষ্ণা মনে মনে কর্তব্য ঠিক করিয়া লইয়াছিল, ল্যাংয়ের দিকে ফিরিয়া বিস্মিতের ভান করিয়া বলিল, ”ও-ও, তাহলে তুমি সেদিন শুধু অভিনয়ই করেছিলে ল্যাং! আমরা কিন্তু এতটুকু বুঝতে পারিনি।”

ল্যাং গর্বের হাসি হাসিল, বলিল, ”এইটুকু যদি না করতে পারব, তাহলে দলে থাকতে পারব কেন?”

কৃষ্ণা বলিল, ”একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ল্যাং, আমায় কি চিরদিন এখানেই থাকতে হবে?”

ল্যাং বলিল, ”না, তোমায় শীগগির অন্য কোথাও পাঠানো হবে শুনেছি। তুমি বসে রইলে কেন-খাও, আমায় আবার ওগুলো নিয়ে যেতে হবে যে।”

কৃষ্ণা বলিল, ”খাচ্ছি। আচ্ছা ল্যাং, আমায় যে বুড়ি খেতে দিতে আসত, সে গেল কোথায়?”

ল্যাং বলিল, ”তোমার সঙ্গে নাকি সে কি মতলব করেছিল, সেইজন্যে তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

কৃষ্ণা আহার সমাপ্ত করিয়া লইলে ল্যাং চলিয়া গেল।

কৃষ্ণা মতলব করিতেছিল-কিভাবে এখান হইতে মুক্তিলাভ করা যায়। যে বৃদ্ধা তাহাকে আহার্য দিত, চুপি চুপি কৃষ্ণা তাহার সহিত কাল পলাইবার কথা বলিয়াছিল, যে কোনোরকমে সে কথা প্রকাশ হইয়া যাওয়ায় আজ হইতে ল্যাং তাহার রক্ষী হিসাবে নিযুক্ত হইয়াছে।

কৃষ্ণা সুযোগ খুঁজিতে লাগিল।

সেদিন কথাবার্তা কহিয়া কৃষ্ণা জানিতে পারিল, তাহাকে ভূগর্ভস্থ একটা ঘরে রাখা হইয়াছে। এখান হইতে উপরের দিকে উঠিবার সিঁড়ি আছে,-তাহার সামনে একজন রক্ষী সর্বদা পাহারায় থাকে।

ল্যাং কৃষ্ণার সহিত বেশ ভালো ব্যবহার করিত। হয়তো কৃষ্ণা যে তাহার সহিত ভালো ব্যবহার করিয়াছিল, সেজন্য সে এতটুকু কৃতজ্ঞ ছিল। বিশেষ-বন্দিনী কৃষ্ণাকে ভয় করিবার মতো কিছুই ছিল না! একে সে বাঙালি মেয়ে, তাহার উপর সে রিক্তহস্ত-সে বন্দিনী।

সে দিন রাত্রির ব্যাপার-

একটা টর্চ হাতে ল্যাং খাবার দিতে আসিল।

ইদানিং কৃষ্ণাকে সন্দেহ করিবার মতো কিছুই ছিল না। ল্যাং যাহা বলিত, অত্যন্ত সুবোধ বালিকার মতো কৃষ্ণা তাহাই করিত, কোনোদিন অবাধ্য হয় নাই।

খাবারের ডিশ নামাইয়া দিয়া ল্যাং টুলের উপর বসিল। প্রতিদিন সে এইখানেই বসিয়া থাকে, কৃষ্ণার আহার সমাপ্ত হইবার পর ডিশ লইয়া চলিয়া যায়।

অন্যমনস্কভাবে সে নিজের জাতীয় চৈনিক ভাষায় গুনগুন করিয়া গান গাইতেছিল। একটা চোখ বন্ধ থাকায় সে জানিতে পারে নাই যে, কৃষ্ণা আস্তে আস্তে উঠিয়া ঠিক তাহার পিছনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

হঠাৎ কণ্ঠে দারুণ পেষণ অনুভব করিয়া ল্যাং ফিরিতে গেল, কিন্তু সেই দুখানা হাত চাপিয়া ধরিবার আগেই সে টুলের উপর হইতে মাটিতে পড়িয়া গেল ও সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞা হারাইয়া ফেলিল।

যখন বুঝা গেল তাহার হাতখানা শিথিল হইয়া পড়িয়াছে, তাহার জিহ্বা আমূল বাহির হইয়া পড়িয়াছে, তখন কৃষ্ণা তাহার গলা ছাড়িয়া দিল।

এই শক্তির পরিচয় দিতে সে এই শীতেও রীতিমতো ঘামিয়া উঠিয়াছিল। অঞ্চলে ললাটের ঘাম মুছিয়া ফেলিয়া কৃষ্ণা দাঁড়াইল-ল্যাংয়ের পানে তাকাইয়া অস্ফুটকণ্ঠে বলিল, ”হায় রে হতভাগ্য! নিজের মুক্তির জন্যে যদি তোমায় হত্যাও করতে হয়, আমি তাও করব, তাছাড়া আমার উপায় নেই!”

ল্যাংয়ের পকেটে হাত দিয়া সে যে রিভলভারটি পাইল, সেইটি হাতে লইয়া নিঃশব্দে খোলা দরজা দিয়া বাহির হইয়াই সামনে সিঁড়ি পাইল। আট-দশটি সিঁড়ি বাহিয়া সন্তর্পণে উপরে উঠিয়া সে কাহাকেও দেখিতে পাইল না। যে রক্ষী এখানে পাহারায় থাকে, হয়তো এই মুহূর্তে সে কোথাও গিয়াছে, তাহার টুল শূন্য পড়িয়া আছে।

কৃষ্ণা একবার ইতস্তত চাহিল। সামনেই একটা ঘর। কৃষ্ণা সেই ঘরটা পার হইল।

বাহিরের উন্মুক্ত বাতাস আসিয়া কৃষ্ণার সর্বাঙ্গ জুড়াইয়া দিয়া গেল।

বিপদ এখনও সামনে, কৃষ্ণা এখনও মুক্ত নয়। এ বাড়ির বাহির হইতে না পারিলে তাহার নিস্তার নাই। এখন যদি সে কোনোরকমে ধরা পড়ে…

এ কথা ভাবিতেও কৃষ্ণার শরীর শিহরিয়া উঠে-সর্বাঙ্গ হিম হইয়া যায়!

ঘরের বাহিরে আসিতেই সামনে পড়িল মস্তবড় বাগান। দেখা গেল, দুজন লোক কথা কহিতে কহিতে এদিকে আসিতেছে। একজন তাহারই দক্ষিণ হস্তস্বরূপ-মহীদল।

কৃষ্ণা বিবর্ণ হইয়া গেল। পিছনদিক ফিরিয়া দেখিল-একটি লোক এদিকে আসিতেছে।

তাহাকে চিনিতে কৃষ্ণার একমিনিটও বিলম্ব হইল না। সে তাহার পিতার বড় বিশ্বাসের পাত্র-ফুচু।

প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া কৃষ্ণা সবেগে সামনের দিকে ছুটিল-একেবারে ইউউইন ও মহীদলের পাশ কাটাইয়া ছুটিল।

”একি-কে, মিস চৌধুরি!”

ততক্ষণে কৃষ্ণা বাগানের গেটে পৌঁছাইয়াছে।

”ধর ধর-” শব্দে মহীদল ও ইউউইন তাহার পিছনে ছুটিল। ছুটিতে ছুটিতে নিরুপায় কৃষ্ণা হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইল। ততক্ষণে মহীদল তাহার অতি নিকটে আসিয়া পড়িয়াছে।

”সাবধান!” কৃষ্ণা গর্জিয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই রিভলবার ছুঁড়িল। অব্যর্থ লক্ষ্যের গুলি মহীদলের বক্ষ ভেদ করিতেই ঘুরিয়া পড়িয়া গেল-ইউউইন থমকিয়া দাঁড়াইল।

ভিতর হইতে আরও দশ-বারোজন লোক ছুটিয়া বাহির হইবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা পথে পড়িয়াই দে ছুট-দে ছুট!!

আঁকা-বাঁকা পথ বাহিয়া সে ছুটিতেছিল। সহজে তাহাকে ধরা সম্ভব নয়। পিছনের লোকেরা বহুদূরে পিছাইয়া পড়িল, শেষ পর্যন্ত আর তাহাদের সাড়া পাওয়া গেল না।

লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্ধকার একটা গাছের তলায় কৃষ্ণা শ্রান্তভাবে বসিয়া পড়িল। তাহার মাথা ঘুরিতেছিল…চোখের সামনে দিগন্তের বনরেখা পর্যন্ত শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার!

ষোলো

ইরাবতীর ঘোলা জলের উপর দিয়া নৌকা চলিয়াছে।

নৌকায় আছে কৃষ্ণা, প্রণবেশ, ব্যোমকেশ ও কয়েকজন পুলিশের লোক।

আশ্চর্যভাবে কৃষ্ণা ফিরিয়াছে। দুইদিন বিশ্রাম করিয়া আবার সে আজ বাহির হইয়াছে। নকশার প্ল্যানটা তাহার মনে আছে-ইউউইন নিশ্চয়ই সেখানে গিয়াছে।

গতকাল সে পথ দেখাইয়া ব্যোমকেশ ও মিঃ লীকে সেই বাগানবাড়িতে লইয়া গিয়াছিল। বাগানবাড়িতে জনপ্রাণী ছিল না, কৃষ্ণা যে রাত্রে পলাইয়াছে, সেই রাত্রেই মৃত মহীদলের শবদেহ মাটির মধ্যে পুঁতিয়া রাখিয়া ইউউইন সদলবলে স্থান ত্যাগ করিয়াছে।…হতভাগ্য মহীদল! ওই ঝাঁকড়া গাছটার শান্ত ছায়াতলে এখনও তাহার শেষ শয়নের মৃত্তিকা খনন-চিহ্ন দেখা যাইতেছে।

কৃষ্ণা দিনের বেলা সেই ভূগর্ভস্থ ঘর দেখিয়া শিহরিয়া উঠিল। এই ঘরে সে কি উৎকণ্ঠা লইয়াই কয়েকটা দিনরাত কাটাইয়াছে। ওপাশের ঘরটায় ইউউইন নোট, টাকা প্রভৃতি জাল করিত। বাড়ি অনুসন্ধান করিয়া অনেক জিনিস পাওয়া গেল।

কৃষ্ণা খুঁজিয়া খুঁজিয়া-যে বৃদ্ধা তাহাকে খাবার দিত তাহাকে বাহির করিয়াছিল। তাহারই মুখে শোনা গেল, ইউউইন ভগবান তথাগতের ব্যবহৃত অনেক জিনিস ফুঙ্গিদের দিয়াছে। সে সব ফুঙ্গিদের নামও বৃদ্ধা বলিয়া দিল। তাহাকে উৎপীড়ন করিতেই সে বলিয়া দিল, ইউউইন আজই ইরাবতী-বক্ষে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে যাত্রা করিবে।

সে অজ্ঞাত স্থানের কথা কৃষ্ণা জানে, ব্যোমকেশ এবং প্রণবেশও জানেন। ফুঙ্গিদের নিকটে পুলিশ যাইতেই তাঁহারা ইয়াং চ্যাংয়ের অপহৃত জিনিসগুলি বাহির করিয়া দিলেন। পাওয়া গেল না শুধু আংটি-ইয়াং চাংয়ের সৌভাগ্য-প্রতীক সেই আংটি।

দীর্ঘপথ ইরাবতী-বক্ষে নৌকা-ভ্রমণের পর কৃষ্ণার নির্দেশমতো এক স্থানে নৌকা থামিল।

কৃষ্ণা ইনস্পেক্টর লীকে লক্ষ করিয়া বলিল, ”নকশার নীচে এই স্থানটি নির্দেশ করা আছে। ওধারে যে মোটর-বোটখানা দেখা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই ওই বোটে ইউউইন এসেছে। বেশি লোক সে সঙ্গে আনেনি, তার খুব বিশ্বাসী দু-চারজন লোক মাত্র নিয়ে এসেছে, যাতে এই ধন-সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল না হয়।”

ব্যোমকেশ বলিলেন, ”আমি খবর নিয়েছি, ইউউইন সামনের সপ্তাহে ইউরোপ যাত্রা করবে। আজ যদি কোনোরকমে তাকে ধরা না যায়, আর কোনোদিনই ধরা যাবে না, সে আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে।”

বোট সেইখানে নোঙর করিয়া সশস্ত্র বারোজন পুলিশসহ কৃষ্ণা-মাতুল, ব্যোমকেশ ও মিঃ লীকে লইয়া নামিল।

এদিকটায় ভীষণ বন, কদাচিৎ কাঠুরিয়ারা এদিকে কাঠ কাটিতে আসে এবং ইরাবতী-বক্ষে নৌকায় তুলিয়া লইয়া যায়। মাঝখানে সরু পথটি বোধহয় তাহাদেরই পায়ের চাপে তৈরি হইয়াছে।

বনের মধ্যে দলবদ্ধ ভাবে সকলে চলিতে শুরু করিলেন। সঙ্গে রহিয়াছে জলের ফ্লাস্ক, কিছু খাবার আর সামান্য কিছু আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি। ভামোর এই ভীষণ জঙ্গলে এখন ক’দিন ঘুরিতে হইবে কে জানে!

দীর্ঘপথ ভ্রমণে কৃষ্ণা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। খানিকক্ষণ বিশ্রাম করিয়া সকলে আবার চলিলেন। দূরে মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা যায়-

মিঃ লী থমকিয়া দাঁড়াইলেন,-ওষ্ঠে একটা আঙুল দিয়া বলিলেন, ”চুপ!”

কান পাতিয়া শোনা গেল, দূরে কোদাল দিয়ে মাটি কাটার শব্দ!

ব্যোমকেশ প্রণবেশকে লক্ষ করিয়া বলিলেন, ”আমার মতে প্রণববাবু, আপনি কৃষ্ণাকে নিয়ে এইখানেই থাকুন, ছেলেমানুষ মেয়েটাকে আর ওখানে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই।’

কৃষ্ণা জিদ ধরিল, ”না, আমিও যাব-”

মিঃ লী বাধা দিলেন, বলিলেন, ”ওখানে গিয়ে হয়তো বিপদে পড়বেন, মিস চৌধুরি! আপনি এখানেই থাকুন, ওখানে আমরা যাচ্ছি।”

প্রণবেশ ও কৃষ্ণাকে রাখিয়া তাঁহারা দ্রুত অগ্রসর হইয়া গেলেন।

কৃষ্ণা বলিল, ”চলো মামা, আমরাও এদিক দিয়ে যাই, এখানে বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে না।”

কৃষ্ণার জিদে প্রণবেশকে অগ্রসর হইতে হইল।

দূরে একসঙ্গে বারোটা বন্দুকের শব্দ শোনা গেল-গুড়ুম-গুড়ুম-গুড়ুম…

কৃষ্ণা ও প্রণবেশ শব্দ লক্ষ করিয়া ছুটিলেন।

উন্মাদের মতো ছুটিয়া কে আসিয়া উভয়ের উপর পড়িল…

সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা চিৎকার করিয়া উঠিল-‘ইউউইন!”

ইউউইন থমকিয়া দাঁড়াইল।

পরমুহূর্তেই সে হাসিয়া উঠিল-উন্মাদের মতো হাসি-”এসেছো তোমরা?…বেশ বেশ…আমি খুব খুশি হয়েছি। এই নাও, হাত এগিয়ে দিচ্ছি-”

বলিতে বলিতে সে পকেট হইতে রিভলভার বাহির করিয়া নিজের ললাটে নলটা রাখিয়া গুলি ছুঁড়িল।

তারপর রিভলভারটা ফেলিয়া দিয়া এক পা অগ্রসর হইবার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে উপুড় হইয়া পড়িয়া গেল।

প্রণবেশ একটা আর্ত চিৎকার করিয়া দু-হাতে মুখ ঢাকিলেন।

কৃষ্ণা স্তম্ভিতমুখে মৃত ইউউইনের পানে তাকাইয়া রহিল।

সেইমুহূর্তে তাহার মনে হইল, এই সেই বিখ্যাত দস্যু ইউউইন, যে রাজবংশে জন্ম লইয়াছিল, উপযুক্ত বিদ্যালাভ করিয়াছিল, কেবল মাত্র কুসঙ্গে মিশিয়া তাহার মন গেল অসৎকর্মের দিকে। তাহার যে বুদ্ধি ছিল, বিদ্যা ছিল-তাহার দ্বারা সে জগতে বরেণ্য হইতে পারিত, উন্নতির উচ্চ শিখরে উঠিতে পারিত।

কৃষ্ণার চোখ সজল হইয়া আসিল। জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হইলেও সে ভাবিতেছিল, দুর্ধর্ষ-দুর্বার ইউউইন-আজন্ম ব্রহ্মচারী জ্ঞানী ইউউইন-সংসর্গ-দোষে সেই বীর ইউউইনের কি শোচনীয় পরিণামই ঘটিল!

ইউউইনের হাতে ইয়াং চাংয়ের সৌভাগ্য-প্রতীক সেই আংটিটা সাপের চোখের মতো জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছিল।

* * * *

দীর্ঘ তিনটি মাস পরে প্রণবেশ ও কৃষ্ণা কলিকাতায় ফিরিলেন। ব্যোমকেশ অনেক আগেই ফিরিয়াছেন।

রেঙ্গুনের বাড়ি বিক্রয় হইয়া গিয়াছে। রেঙ্গুনের সঙ্গে সকল সম্পর্ক চুকাইয়া কৃষ্ণা ফিরিল।

সেদিন ইয়াং চাংয়ের বাড়িতে ছিল বিরাট নিমন্ত্রণের আয়োজন। তাঁহার বন্ধু-বান্ধবদের সহিত কৃষ্ণা ও প্রণবেশেরও নিমন্ত্রণ হইয়াছে। যাইতে ইচ্ছা ছিল না, কেবল ভদ্রতা রাখিবার জন্যই প্রণবেশের সহিত নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে আসিল।

ব্যোমকেশ বহুপূর্বেই আসিয়া আসর জমকাইয়া বসিয়াছেন। নিমন্ত্রিতগণের কলগুঞ্জনে প্রকাণ্ড বড় হলঘরটা সরগরম হইয়া আছে, তাহারই মাঝখানে বক্তার আসনে বসিয়াছেন-ব্যোমকেশ। তাঁহার মুখে ইউউইন-দমনের অপূর্ব গল্প শুনিয়া নিমন্ত্রিতগণ স্তম্ভিত হইতেছিলেন, শিহরিয়া উঠিতেছিলেন!

মাঝখানে টেবলের উপর অপহৃত বস্তুগুলি সাজাইয়া রাখা হইয়াছে, নিমন্ত্রিতগণ সেগুলি দেখিতেছিলেন।

ইয়াং চাংয়ের সৌভাগ্য-প্রতীক আংটিটি কুমারী মা-পানের অঙ্গুলিতে জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছিল। সেদিকে তাকাইয়া কৃষ্ণা চোখ ফিরাইল। মনে পড়িল, মৃত ইউউইনের হাতে এই আংটিটি এমনই করে জ্বলিতেছিল-যাহা দেখিয়া কৃষ্ণা শিহরিয়া উঠিয়াছিল।

ইউউইন তাহার পিতৃহত্যাকারী, তাহা ছাড়া বহু নির্দোষ লোককে সে হত্যা করিয়াছে, অনেক গৃহ আগুনে জ্বালাইয়া দিয়াছে-কৃষ্ণাকে সে দুইবার চুরি করিয়াছে…তাহাকে বড় কম কষ্ট সে দেয় নাই! সেদিন তাহার বাড়ি হইতে পলাইবার সময় যদি সে কৃষ্ণাকে ধরিতে পারিত, কৃষ্ণাকে হয়তো সে চরম শাস্তি দিত। তবু কৃষ্ণা আর একদিক দিয়া তাহাকে শ্রদ্ধা করে-সে দিকটা ইউউইনের বীরত্বের দিকে। অতখানি শক্তি-সাহস খুব কম লোকেরই দেখা যায়। সাধারণের মধ্যে তো নাই বলিলেই হয়।

সে সব পাইয়া সব হারাইয়াছে-এ কথা কৃষ্ণা ভুলিতে পারে না।

এই নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ইয়াং চাং-কৃষ্ণা ও ব্যোমকেশের ভূয়সী প্রশংসা করিলেন এবং তাঁহার কথামতো পাঁচ হাজার টাকার একটি তোড়া তিনি ব্যোমকেশকে প্রদান করিলেন।

মা-পান কৃষ্ণার কণ্ঠে একটি বহুমূল্য প্রস্তরখচিত হার পরাইয়া দিয়া বলিল, ”এ হারছড়াটি তোমার বোনের স্নেহের দান ভাই-”

কৃষ্ণা একটা নমস্কার করিল।

পিতার মৃতদেহ স্পর্শ করিয়া সে যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল তাহা রক্ষা হইয়াছে,-প্রণবেশের তাই আনন্দের শেষ ছিল না। মহানন্দে তিনি বলিলেন, ”যাক, আর কোথাও তোমার যাওয়া হচ্ছে না কৃষ্ণা, এবার পড়বার ব্যবস্থা করো।”

কৃষ্ণা সংক্ষেপে বলিল, ”দেখা যাক।”

গভর্নমেন্ট হইতে ব্যোমকেশ যখন পুরস্কৃত হইলেন-সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণাও পুরস্কার লাভ করিয়াছিল।

সেইদিনই প্রণবেশকে সে জানাইয়া দিল….পড়াশোনা সে যাহা করিয়াছে তাহাই তাহার পক্ষে যথেষ্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না পাইলেও তাহার দিন চলিবে। সে এমনই কোনো কাজ লইতে চায়, যাহাতে সাধারণের উপকার হইবে এবং নিজেও আনন্দ লাভ করিবে।

বিস্মিত প্রণবেশ কেবল মাথা দুলাইলেন।

__

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *