১৩. অপহরণ

পাণ্ডব গোয়েন্দা – ১৩ – ত্রয়োদশ অভিযানঅপহরণ / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়

শীতের মরশুমে এক বিকেলে ইডেনে বেড়াতে গিয়েছিল পাণ্ডব গোয়েন্দারা। যদিও বোটানিকেল গার্ডেনের কাছে ইডেন কিছুই নয়, তবুও ইডেনের একটা নিজস্ব রূপ আছে। সেই রূপের টানেই আবালবৃদ্ধবনিতারা দলে দলে এসে থাকে এখানে। বাবলুরাও এসেছিল। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং ওদের প্রিয় পঞ্চু সবাই। অনেকক্ষণ ধরে ওরা চিনা বাদাম আর কমলালেবু খেয়ে মিষ্টি রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াল। তারপর এক সময় বাবলু বলল, “হোপলেস।”

বিলু বলল, “ফর হোয়াই?”

বাবলু বলল, “কলকাতার নরক যদি কোথাও থাকে তো সেটা হচ্ছে এই ইডেন গার্ডেন।”

ভোম্বল বলল, “কলকাতার স্বর্গ কোনটে?”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কলকাতায় কোথাও স্বর্গ নেই।”

বাবলু বলল, “ঠিক বলেছিস। সমাজবিরোধীরা গোটা কলকাতাটাকে রাহুর মতো গ্রাস করে ফেলেছে। আর এই সব জায়গাগুলো হচ্ছে ওদের এক একটি বেল্ট। বিশেষ করে সন্ধের পর এই সব জায়গাগুলো যা হয়ে ওঠে তা সত্যই অবর্ণনীয়।”

বিলু বলল, “নাঃ। এসব জায়গায় আর দেখছি কোনও ভদ্র সন্তানের আসা উচিত হবে না।”

ভোম্বল বলল, “আমার হাতে যদি একটা মেশিনগান থাকত আর দেশে যদি আইন শৃঙ্খলাটা না থাকত তা হলে সব কটাকে এক সঙ্গে দিতাম সাবাড় করে।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ তুমি অত্যন্ত বীরপুরুষ তা আমরা জানি। এখন চলো কেটে পড়ি এই বিশ্রী পরিবেশের ভেতর থেকে৷”

কথা বলতে বলতে ইডেন থেকে বেরিয়ে এল ওরা। সামনেই হাইকোর্ট। এ পাশে আকাশবাণী। বিচ্ছু বলল, “আমাকে একবার আকাশবাণীর কাছে নিয়ে চলো না বাবলুদা। দেখব।”

বাচ্চু বলল, “কী দেখবি? ভেতরে তো ঢুকতে দেবে না।”

বিচ্ছু বলল, “বাইরে থেকেই দেখব।”

বিচ্ছুর ইচ্ছামতো ওরা আকাশবাণীর সামনে এল। বিচ্ছু খুব খুশি। তবে পঞ্চুর লেজ নাড়া দেখে মনে হল ওর ঠিক এইভাবে ঘুরে বেড়াতে খুব একটা ভাল লাগছে না।

এমন সময় হঠাৎ শর্মিলাদির সঙ্গে দেখা। পাণ্ডব গোয়েন্দাদের দেখে শর্মিলাদি ঝলমলে হাসি হেসে ওদের কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “ওমা, তোমরা এখানে!”

“আপনি এখানে?”

“মেট্রোয় একটা খুব ভাল ছবি হচ্ছে, দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা এদিকে কী মতলবে? যা দস্যি ছেলেমেয়ে তোমরা। ভয় লাগে।”

বাবলু হেসে বলল, “না না, আমরা সব সময় দস্যিপনা করি না। এখন আমরা বেড়াতে এসেছি।”

“বেশ করেছ।”

পঞ্চুও শর্মিলাদিকে দেখে খুব খুশি। তাই কুই কুই করে জবাব দিল, হ্যাঁ আমরা বেড়াতেই এসেছি। দস্যিপনা করতে নয়।

শর্মিলাদি বললেন, “ঠিক আছে। তোমরা এসো তা হলে, আমি চলি।”

বাবলু বলল, “আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে। আপনি বিচ্ছুটাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যাবেন শৰ্মিলাদি? যাবার সময় যদি ওকে ওদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যান তা হলে খুব ভাল হয়।”

“বেশ তো। এ তো খুবই ভাল কথা।”

“অসুবিধে হবে না তো আপনার?”

“না না। অসুবিধে হবে কেন? এ বরং ভালই হল। একা যেতাম। এবার একটা সঙ্গী পেয়ে গেলাম। তা ছাড়া বিচ্ছুর মায়ের সঙ্গেও গল্প করে আসা যাবে একটু। কিন্তু তোমরা যাবে কোথায়?”

“আমরা কলকাতায় পাতালরেলের কাজকর্ম কীরকম হচ্ছে একটু দেখতে যাচ্ছি।”

শর্মিলাদি হেসে বললেন, “আর কিছু দেখার জিনিস পেলে না তোমরা ?”

এমন সময় বাচ্চু বলল, “তোমরা তিনজনেই বরং যাও বাবলুদা। আমার আর হাঁটতে ভাল লাগছে না। পঞ্চু তোমাদের কাছেই থাকুক। আমিও শর্মিলাদির সঙ্গে যাই।” .

বাবলু বলল, “সেই ভাল। তুইও যা। অনেক হেঁটেছিস আজ।”

বাবলু, বিলু, ভোম্বল ও পঞ্চু জেব্রা ক্রসিং ডিঙিয়ে রাস্তা পার হল। আর বাচ্চু-বিচ্ছুরা চলে গেল শর্মিলাদির সঙ্গে ।

আবার সেই ইডেনের ফুটপাথ ধরে আসতে হল ওদের। আসবার সময় ধোকাদার সঙ্গে দেখা হল হঠাৎ। ধোকাদা ওদের পাড়ারই ছেলে। বাচ্চু-বিচ্ছুদের খুব পরিচিত। বাচ্চু ধোকাদাকে দেখে হেঁকে বলল, “লঞ্চে আমাদের জন্যে একটু লাইন ম্যানেজ করে রেখো ধোকাদা।”

ধোকাদা বলল, “আচ্ছা। তোরা পা চালিয়ে আয়।”

লঞ্চে তখন বিরাট লাইন পড়েছে। অফিসযাত্রীরা দলে দলে ছুটতে ছুটতে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। ভাগ্যে ধোকাদা ছিল তাই গোড়ার দিকেই ম্যানেজ হয়ে গেল লাইনটা। ওরা প্রথম সারিতেই দাঁড়াল। খুব বাঁচোয়া। না হলে এই কনকনে শীতে বেশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হলেই হয়েছিল আর কী।

রামকৃষ্ণপুর ঘাটে লঞ্চ এসে যখন ভিড়ল তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কয়েকজন রিকশাওয়ালা তখন প্যাসেঞ্জার ওঠানোর ব্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যেই মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে। তাই দেখে শর্মিলাদি বললেন, “দরকার নেই বাবা রিকশায় চেপে। চলো এ পথটুকু আমরা হেঁটে হেঁটেই চলে যাই।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ তাই চলুন। এইটুকুর জন্যে আবার রিকশা করে নাকি কেউ?”

শৰ্মিলাদি, বাচ্চু ও বিচ্ছু কথা বলতে বলতেই সেই আধো অন্ধকার আধো আলোয় পথ চলতে লাগল।

শর্মিলাদি কখনও জোরে হাটেন না। কী ধীর স্থির তার চলার ছন্দটি। আর কী মিষ্টি তার মুখখানি। গায়ের রঙটিও যেন দুধে আলতায় গোলা। যেমনি ভদ্র, তেমনি নম্র। বাচ্চু-বিচ্ছুর তাই খুব ভাল লাগে শর্মিলাদিকে।

দূর থেকে দেখলেও মন প্রাণ ভরে ওঠে ওদের। কাছে পেলে তো কথাই নেই।

লঞ্চঘাট পার হয়ে বেশ কিছুটা পথ এসেছে ওরা এমন সময় দেখল ফোরশোর রোডের মুখে একটা অস্টিন গাড়ির সামনে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও মাথায় হ্যাট পরা এক ভদ্রলোক আপন মনে সিগারেট খাচ্ছেন আর একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওরা কাছাকাছি আসতেই ভদ্রলোক সিগারেটটা ফেলে পায়ের বুট জুতো দিয়ে সেটার আগুনটাকে চেপে বললেন, “আরে, বিচ্ছু না?”

বিচ্ছু অবাক হয়ে বলল, “কে আপনি?”

“আমাকে চিনতে পারছ না?”

বিচ্ছু বলল, “না।”

“আমি তোমার বাবার বন্ধু। আমার নাম বাসুদেব রায়।”

বিচ্ছু বলল, “চিনলাম না।”

বাচ্চু বলল, “এ নামে বাবার কোনও বন্ধু আছে বলে তো জানি না। আর আপনাকে আমরা দেখিওনি কখনও।”

বাসুদেববাবু হেসে বললেন, “দেখেছ দেখেছ। ঠিক মনে করতে পারছ না।”

তারপর আড়চোখে একবার শর্মিলাদির দিকে তাকিয়ে বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা এনার পরিচয়টা তো পেলাম না?”

বাচ্চু বলল, “ওঁনার পরিচয় জানার দরকারটাই বা কী?”

“না না, এমনি। মানে কখনও দেখিনি তোমাদের সঙ্গে, তাই।”

বিচ্ছু বলল, “উনি আমাদের দিদি হন।”

বাসুদেববাবু বললেন, “তোমাদের কোনও দিদি আছে বলে তো জানতাম না। তা ঠিক আছে। চলো তোমাদের বাড়িতে যাওয়া যাক। অনেকদিন যাইনি। তোমাদের বাবার সঙ্গে একটু গল্প করে আসি। নাও গাড়িতে ওঠে সব৷” তারপর শর্মিলাদির দিকে তাকিয়েও হাসিমুখে বললেন, “উঠুন।”

শর্মিলাদি বললেন, “মাফ করবেন। এরা যখন চেনে না আপনাকে তখন আপনি আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত। অতএব এই অবস্থায় আমরা আপনার গাড়িতে কোনও মতেই উঠতে পারি না।”

বাসুদেববাবু বললেন, “কেন, আপনি আমায় বিশ্বাস করতে পারছেন না? বেশ, আপনি না ওঠেন না উঠবেন, এরা উঠুক।”

বাচ্চু বলল, “না আমরা কেউ উঠব না আপনার গাড়িতে।”

বাসুদেববাবু রেগে বললেন, “কেন উঠবে না? আমি কি চোর না ডাকাত?”

বিচ্ছু বলল, “আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। আপনি নিজেই বরং নিজের গাড়িতে উঠে আপনার সুদর্শন চক্রটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করুন।”

বাসুদেববাবুর মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠল এবার। মুখটা ব্যাঙের মতো ফুলিয়ে কঠিন গলায় বললেন, “সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল কী করে বাঁকাতে হয় আমি জানি। গাড়িতে ওঠ বলছি।” তারপর শৰ্মিলাদির দিকে রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বললেন, “আপনিও উঠুন।”

শর্মিলাদি বললেন, “আপনার কথায় নাকি?”

“হ্যাঁ। আমার কথায়। উঠুন, না হলে বিপদে পড়বেন।”

শর্মিলাদি বললেন, “ওসব ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ হবে না, বুঝেছেন? পথ ছাডুন বলছি, না হলে চেঁচাব।”

এমন সময় আশপাশ থেকে কারা যেন বলে উঠল, “উঠুন উঠুন। বেশি ঝামেলা করবেন না। আমাদের হাতে সময় খুব অল্প।”

শৰ্মিলাদির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল এবার। বাচ্চু-বিচ্ছুরাও ভয় পেয়ে গেল খুব। কপালগুণে দু’একটি রিকশা বা কোনও লোকজনও এখন এখানে নেই। অথচ এ পথ এসময়ে কখনওই জনবিরল হয় না। ওরা দেখল তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল ওদের চোখের সামনে।

শর্মিলাদি বললেন, “আপনাদের মতলব?”

বাসুদেববাবু বললেন, “সেটা পরে জানতে পারবেন। এখন গাড়িতে উঠুন।”

“না উঠব না।”

“উঠুন বলছি।”

বাচ্চু আর বিচ্ছুকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে শর্মিলাদি বললেন, “না। প্রাণ থাকতে নয়।”

কিন্তু সশস্ত্র ওই দুৰ্বত্তদের কাছে ওদের শক্তি কতটুকু? ওরা প্রায় জোর করেই ওদেরকে গাড়িতে ওঠাল। শৰ্মিলাদি চেঁচাবার চেষ্টা করতেই বাসুদেববাবু রিভলভার তাগ করলেন। বাধ্য হয়েই চুপ করতে হল শর্মিলাদিকে। এক্ষেত্রে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করাই ভাল। ওরাও তাই করল। রাতের অন্ধকারে বাসুদেববাবুর অস্টিনটা ওদের তিনজনকে অপহরণ করে ঝড়ের বেগে অদৃশ্য হয়ে গেল ভোজবাজির মতো ।

এই নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে যাবার ঠিক পর মুহুর্তেই সেখানে এসে হাজির হল বাবলুরা। এই কনকনে শীতে ইচ্ছে করেই আর পাতালরেলের কর্মযজ্ঞ দেখতে না গিয়ে ফিরে আসছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে মাঝ গঙ্গায় লঞ্চটি বিকল হয়ে যাওয়ায় অযথা বিলম্ব হয়ে গেল। না হলে যথাসময়েই চরম মুহূর্তটিতে এসে পড়ত ওরা।

যাই হোক। ফোরশোর রোডের মুখে আসতেই পঞ্চু হাউ হাউ করে ছুটে গিয়ে কী যেন কুড়িয়ে আনল একটা মুখে করে। যেটা আনল সেটা দেখেই হকচকিয়ে গেল সকলে।

জিনিসটা হাতে নিয়ে বাবলু সন্দেহের চোখে দেখে বলল, “আরে! এ হার তো শৰ্মিলাদির! এটা এখানে কী করে এল?”

বিলু বলল, “আমার মনে হয় নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে ওদের।”

ভোম্বল বলল, “চল তো দেখি আর কিছু পাই কিনা।”

ওরা তন্ন তন্ন করে চারদিক খুঁজতে লাগল।

এমন সময় পঞ্চু এক পাটি জুতো নিয়ে এল মুখে করে।

বাবলু বলল, “এটা তো বিচ্ছুর চটি।”

বিলু বলল, “কিডন্যাপ।”

ভোম্বল বলল, “তাতে কোনও সন্দেহ নেই আর।”

তবুও ওরা একবার দ্রুত পায়ে বাড়িতে এল। কী জানি, সন্দেহটা যদি অমূলকই হয়? কিন্তু না। বাড়িতে এসে দেখল যা ওরা ভেবেছে ঠিক তাই। শৰ্মিলাদি বাচ্চু-বিচ্ছু কেউ-ই ফেরেনি। প্রত্যেকেরই মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল।

বাচ্চু-বিচ্ছুর মা তো কেঁদেই ফেললেন, “এই জন্যেই আমি এদের সন্ধের পর বাইরে থাকতে বারণ করি। কিন্তু কিছুতেই এরা শুনবে না আমার কথা। যা ভয় করি আমি তাই হল। এখন আমি কী করি?”

ওদের বাবা থানায় ফোন করলেন। ফোন করার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এল। বাবলুরা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ওদের মুখে সব শুনে দারোগাবাবু বললেন, “দেখছ দিনকাল খারাপ পড়েছে কী রকম। দক্ষিণ-কলকাতার বালাজিকে, চৌরঙ্গির নীতুকে দুর্বত্তরা নিয়ে গিয়ে কীভাবে খুন করেছে তা জানো না? বিশেষ করে তোমাদের ওপর অনেকেরই নজর আছে যখন, তখন কোন সাহসে তোমরা বাইরে থাকো সন্ধের পর?”

বাবলু বলল, “সন্ধের আগেই তো আমরা ওদের ছেড়ে দিয়েছি। সঙ্গে আমাদের পরিচিত এক দিদিও ছিলেন। কিন্তু এমন যে হবে তা তো ভাবিনি।”

দারোগাবাবু বললেন, “মানে আমি তো ভাবতেই পারি না তোমাদের মতো ছেলেমেয়েরা এমন ভুল করল কী করে? হাওড়া শহরের মধ্যে ওই জায়গাটা হচ্ছে সবচেয়ে কুখ্যাত এলাকা। ওখানে প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। খুন জখম ডাকাতি রাহাজানি কী না হয় ওখানে!”

ভোম্বল এবার রেগে বলল, “তাই যদি হয় তো আপনারা সব সময়ের জন্য ওখানে কিছু পুলিশ পোস্টিংই বা করে রাখেন না কেন? জানেন তো রাত আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত ও রাস্তায় লোকজন লঞ্চে পারাপার করার জন্য চলাফেরা করে।”

দারোগাবাবুও ততোধিক রেগে বললেন, “তুমি থামো হে ছোকরা। বসো না এসে আমার চেয়ারটায়। তারপর বুঝবেখন জলের মতো তরল জিনিসগুলো কীরকম পাথরের মতো কঠিন।”

বাবলু বলল, “ওর কথা ছেড়ে দিয়ে যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করুন।”

দারোগাবাবু আর কোনও কথা না বলে যৎসামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর ওদের প্রত্যেককে একটু সাবধানে থাকতে বলে চলে গেলেন।

বাবলু আর ভোম্বল, বাচ্চু-বিচ্ছুর মাকে সাত্ত্বনা দিতে লাগল। বিলু অস্থিরভাবে একবার ঘর একবার বাইরে এই করতে লাগল। পঞ্চুও লেজ নেড়ে অযথাই মাটি শুকে শুকে ঘোরাঘুরি করতে লাগল আশপাশে। এমন সময় হঠাৎ এক সময় পঞ্চুর চিৎকারে রাতের অন্ধকার ভেঙে খান খান হয়ে গেল। সেইসঙ্গে শোনা গেল একটা মোটরের চলে যাবার শব্দ।

বাবলু আর ভোম্বল ঘরের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। পঞ্চু তখনও একভাবে চিৎকার করছে ও লাফাচ্ছে। কিন্তু বিলু! বিলু কই? বিলু তো বাইরেই ঘোরাফেরা করছিল এতক্ষণ। গেটের কাছে একটা চিঠি পড়েছিল। বাবলু সেটা কুড়িয়ে নিল। চিঠিটা খুলে পড়ে দেখল তাইতে লেখা আছে, আপনার মেয়েরা আমাদের কাছে সযত্বেই থাকবে। পাছে ওরা থাকতে না চায় বা কান্নাকাটি করে তাই ওদের দিদিটিকেও নিয়ে গেছি। এই নিয়ে যাওয়ার পিছনে উদ্দেশ্য একটা নিশ্চয়ই আছে। সেটা সেই চিরন্তন ব্যাপার। অর্থাৎ কিনা টাকা। আমাদের টাকা চাই। সেজন্যই বলি আপনি কোনও রকম ঝামেলা করবার চেষ্টা না করে মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনারই বাড়ির ছাদে এক সপ্তাহের মধ্যে রেখে দেবেন। আমাদের লোকেরা যখন হোক গিয়ে নিয়ে আসবে। অতি চালাকি করে বা পুলিশকে জানিয়ে ফাঁদ পাতার চেষ্টা করবেন না। তা হলে ফল খারাপ হবে। কেন না আমরা অত্যন্ত বদলোক।”

চিঠিটা পড়ে বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবার হাতে দিল বাবলু। চিঠি পড়ে লাফিয়ে উঠলেন বাচ্চু-বিচ্ছুর বাবা, “সর্বনাশ। এত টাকা আমি কোথায় পাব? আমার এই শৌখিন বাড়ি দেখে কি ওরা মনে করেছে যে অনেক টাকা আছে আমার?”

বাবলু বলল, “তা হলে কী করবেন কাকাবাবু?”

“আমি এখনই থানায় যাব।”

“অমন কাজটি করবেন না।”

“করব না মানে? আমার এত বড় সর্বনাশ হতে চলেছে অথচ আমি পুলিশকে জানাব না?”

বাবলু বলল, “আঁঃ হাঁ। আপনি কেন বুঝছেন না কাকাবাবু? এতে বাচ্চু-বিচ্ছুর বিপদ হতে পারে। তা ছাড়া পুলিশ তো কিডন্যাপের খবর আগেই পেয়েছে। যথেষ্ট তৎপর আছে তারা। এখন আমরা নিজেরাই একটু চেষ্টা করে দেখি বা একটা উপায় বার করি। সব ব্যাপারে সব কিছুর দায়িত্ব কী পুলিশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক? নিজেদেরকেও একটু চেষ্টা করতে হয় ভেতরে-ভেতরে।”

“সে তো বুঝলুম। কিন্তু আমরা কি চেষ্টা করব? কীভাবে করব? কোথায় করব?”

বাবলু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “কাকাবাবু, আপনি একটা জিনিস লক্ষ করেছেন কি, যে আমাদের বন্ধুদের ভেতর থেকে একজন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। অর্থাৎ ওরা চিঠিটা দিয়ে যাবার পর থেকেই বিলুকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও নিশ্চয়ই দুৰ্বত্তদের পিছনে ধাওয়া করেছে।”

“এটা তো তোমার বিশ্বাস। কিন্তু ধরে যদি উলটোটাই হয়ে থাকে? অর্থাৎ কিনা যদি ওরা চিঠি দিতে এসে বিলুকেও একা পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে থাকে?”

ভোম্বল এই কথায় নার্ভাস হয়ে বলল, “হ্যাঁ। তাও হতে পারে।” বাবলু তার এক হাতের তালুর ওপরে অপর হাতের মুষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “না। তা হয়নি। কেন না দুই আর দুইয়ে চার-ই হয়, পাঁচ হয় না। আর যদি উলটোটাই হয়ে থাকে তা হলে জানবেন সোনায় সোহাগা হয়েছে। আপনি জানেন না কাকাবাবু, খেপে গেলে বিলু আর বিলু থাকে না। ও তখন বুলডগ হয়ে ওঠে। ও একাই একশো হয়ে ফিরিয়ে আনবে ওদের। এখন মনে হচ্ছে ওরা চিঠি দিতে আসবে এইরকম একটা কিছু অনুমান করেই বিলু বাইরে ঘোরাফেরা করছিল এতক্ষণ।”

“এখন আমরা কী করব তা হলে?”

“কিছু না। আমার মনে হয় ওরা কাছাকাছিই কোথাও আছে। না হলে এত তাড়াতাড়ি ওদের গুম করার পর এই চিঠি ওরা দিতে আসতে পারত না। যাক, শর্মিলাদির বাড়িতে খবরটা দিয়ে আমরা আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। আজকের রাত্রিটা দেখি। আজ রাতের মধ্যে বিলু যদি ফিরে না আসে তা হলে কাল সকালে তার ব্যবস্থা হবে।”

এই বলে বাবলু আর ভোম্বল ফিরে এল। মুখে ওরা খুব সহজে কথাগুলো বললেও মন থেকে কিন্তু দুশ্চিন্তাটা গেল না ওদের।

ভোম্বল শর্মিলাদির বাড়িতে খবর দিয়ে নিজের বাড়িতেও বলে খেয়ে-দেয়ে বাবলুর কাছে শুতে এল। বাবলু, ভোম্বল আর পঞ্চু ঘরে ঢুকে শোবার জন্য দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে এমন সময় কোথা থেকে যেন ছুটতে ছুটতে বিলু এসে হাজির হল সেখানে।

বাবলু উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে! হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলি?”

বিলু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “ওদের মোটরের পিছনে উঠে ধাওয়া করেছিলাম ব্যাটাদের।”

“তারপর?”

“স্পটে যেতে পারিনি। তবে অনুমান করতে পেরেছি। ওরা শালিমারের রেলওয়ে ইয়ার্ডের মধ্যেই কোথাও আছে। যে মোটরের পিছনে আমি বসেছিলাম, তাতে দুজন লোক ছিল। একজন এক নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আর একজন মোটর নিয়ে এখনই আসছি বলে চলে গেল।”

বাবলু বলল, “এতেই বুঝে নিলি ওরা শালিমারে আছে?”

“হ্যাঁ। কেননা যে লোকটা এখনই আসছি বলে চলে গেল সে যাবার সময় জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা বেগড়বাই করছে না তো? উত্তরে অপর লোকটি বলল—না। খুব ঠান্ডা মেয়ে। বিশেষ করে সঙ্গে ওদের দিদি থাকায় সুবিধেই হয়েছে। চুপ চাপ আছে। এবার গিয়ে ওদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটা করি।”

ভোম্বল বিলুর পিঠ চাপড়ে বলল, “সাবাস বিলু।”

বিলু বলল, “আরও আছে। সম্ভবত গঙ্গার দিকে আছে ওরা। কেন না বাচ্চু-বিচ্ছু আর শর্মিলাদি ওদের পায়ের চটিগুলো ফেলতে ফেলতে গেছে। আমি সেগুলো কুড়িয়ে এনেছি।”

বাবলু বলল, “তা হলে এখনই আমরা চলি। আর দেরি নয়।”

বাবলু, বিলু, ভোম্বল আর পঞ্চু তখুনি চলল তাদের নৈশ অভিযানে। বাবলু পিস্তলটা পকেটে নিল। বিলু আর ভোম্বল নিল ধারালো দুটাে ছুরি।

পঞ্চু একবার শুধু টান টান করে নিল শরীরটা। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। সে এবার বেশ বুঝতে পেরেছে যে এবারের অভিযান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শালিমারে এসে ওরা কিন্তু গেট পার হয়ে ইয়ার্ডে ঢুকল না। সোজা রাতের অন্ধকারে গঙ্গার ধার ঘেঁষে কাঁটা তারের বেড়া ডিঙিয়ে ভাঙা পাঁচিলের গা বেয়ে ভেতরে ঢুকল।

জনহীন নিস্তব্ধ চারদিক।

শুধু মালগাড়ির সাইডিং করার শব্দ ও ইঞ্জিনের চলাফেরা ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

মাঝে মাঝে আর পি এফদের টহল দিতে দেখা যাচ্ছে।

ওদের মনে হল ওরা যেন কোনও একটা প্রেতপুরীতে এসে হাজির হয়েছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে এ এক নতুন জগৎ।

বাবলু বলল, “সব হল। শুধু তাড়াতাড়িতে একটা টর্চ আনতে ভুলে গেলুম রে।”

বিলু বলল, “তাই তো। খুব ভুল হয়ে গেল।”

ভোম্বল বলল, “সে জন্য কোনও চিন্তা নেই। ও আমি ম্যানেজ করে নেব।”

বিলু বলল, “কী করে নিবি?”

ভোম্বল বলল, “ওই দেখ। ওদিকে সারি সারি চৌকিদারের তাবু। ওর ভেতরে হানা দিলে নিশ্চয়ই একটা টর্চ ঝাড়া যাবে।”

বাবলু বলল, “দি আইডিয়া। নে দেখি একটা।”

ভোম্বল অন্ধকারে চতুর বেড়ালের মতো সন্তৰ্পণে পা ফেলে গ্যাং কুলিদের তাবুর কাছে এগিয়ে গেল।

তারপর একটা তাবুর পিছন দিকে গিয়ে সেটা সামান্য একটু ফাঁক করতেই দেখল বুড়ো চৌকিদার তোলা উনুনে রান্না করছে বসে বসে। তার পাশেই পড়ে আছে বেশ বড় সড় একটা টর্চ।

ভোম্বল সেদিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ছুরিটা বার করে খুব সতর্কভাবে একটু একটু করে কাটতে লাগল তাবুটা শক্ত ত্রিপলের তাবু তবু কেটে ফেলল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকে হাত বাড়িয়ে টর্চটা নিতে গিয়েই ঘটে গেল বিপর্যয়।

বুড়ো চৌকিদারটা আচমকা ওর হাতটা ধরে এক চোখ টিপে খিক্‌ খিক্‌ করে হেসে বলল, “বাবা নিশিকুটুম্ব। চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছে বাবা? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।”

ভোম্বল চোখ পাকিয়ে বলল, “হাত ছাড়ে বলছি। শিগগির হাত ছাড়ো। না হলে এখনই ফুটো করে দেব।” বলেই অপর হাতে ছুরিটি উচিয়ে ধরল।

চৌকিদারটা ভয় পেয়ে ছেড়ে দিল ওকে।

ভোম্বল চকিতে টর্চটা নিয়ে যেই না বেরোতে যাবে চৌকিদার অমনি পিছন দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভোম্বলের ওপর। ওর একটা পা টেনে ধরে চেঁচাতে লাগল, “চোর—চোর—চোর।”

কিন্তু ভোম্বলের শক্তির সঙ্গে বুড়ো চৌকিদারের পরিচয় তো ছিল না, তাই ও-কীর্তি করতে গিয়েছিল। ভোম্বল হঠাৎ ঘুরে পড়েই চৌকিদারকে একটা ঝটকা দিল। তারপর লাটুর মতো ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল তাবু থেকে।

বাবলুরা বাইরে অপেক্ষা করছিল।

ভোম্বল বেরিয়ে এসেই বলল, “বাবলু, কেটে পড় এখান থেকে।”

“সে কথা আবার বলতে!”

ওরা তিনজন এবং পঞ্চু প্রাণপণে সামনের দিকে ছুটতে লাগল।

এদিকে বুড়ো চৌকিদার একভাবে চেঁচিয়ে চলেছে, “চোর—চোর—চোর।”

তার চিৎকারে রেলরক্ষী বাহিনীর লোকেরাও তখন ছুটে এসেছে হাঁ হাঁ করে। কিন্তু এলে কী হবে? ওদের নাগাল পেলে তো।

বাবলুরা অন্ধকারে যেদিকে পথ পেল সেদিকে দৌড়ল।

রেলরক্ষী বাহিনীর লোকেরা মানে আর পি এফরা তবুও হাল ছাড়ল না। অনুমানে ভর করেই বন্দুক উঁচিয়ে সমানে তাড়া করে অনুসন্ধান চালাল।

বাবলুরা বুঝতে পারল ওরা যতই ছুটে পালাবার চেষ্টা করুক না কেন পালাবার কোনও পথই নেই। ধরা ওদের পড়তেই হবে। অবশ্য ধরা পড়লে হবে না ওদের কিছুই। পরিচয় দিলেই ছাড়া পেয়ে যাবে। কিন্তু তাতে সব কিছু জানাজানি হয়ে গেলে বাচ্চু-বিচ্ছুদের উদ্ধারের পরিকল্পনাটা একেবারে ভেস্তে যাবে। এবং ওরাও চলে যাবে নাগালের বাইরে।

বাবলু তাই হঠাৎ এক জায়গায় থেমে দাঁড়িয়ে বলল, “আর ছোট নয়। এবার যেমন করেই হোক কোথাও আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে।”

বিলু বলল, “লুকব কোথায়? জায়গা কই?”

ভোম্বল বলল, “লুকোতেই হবে। না হলে ধরা পড়লে আগে তো ওরা পিটিয়ে ছাল তুলে নেবে। তারপরে অন্য কথা।”

দূর থেকে আবার জোড়া জোড়া বুটের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। ওই আসছে। কয়েকজন আর পি এফ এই দিকেই ছুটে আসছে।

তাড়াতাড়িতে ওরা লুকোবার মতো কোনও জায়গা না পেয়ে চট করে বাদিকে বেঁকে অন্ধকারে পাশাপাশি দাঁড় করানো কতকগুলো সারিবদ্ধ ওয়াগনের তলায় ঢুকে পড়ল। তারপর গুটি গুটি আরও কতকগুলো ওয়াগন ক্রশ করেই দেখল এক জায়গায় একটি ভাঙা ইঞ্জিন সাইডিং করা আছে।

আর পি এফরাও তখন দূর থেকেই ওদের দেখতে না পেয়ে চেঁচাচ্ছে, “হুশিয়ার। চোর হ্যায়। পাকড়ো। চোর—চোর— ”

ক্রমে ওরা ওদের খুব কাছাকাছি চলে এল।

বাবলু, বিলু, ভোম্বল আর পঞ্চু ভাঙা ইঞ্জিনের বড় বড় চাকার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বসে রইল চুপটি করে।

আর পি এফরা এসে বার বার ওখানে টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল কেউ আছে কিনা।

চাকার আড়ালে থাকায় ওদের গায়ে আলো পড়ল না।

ওরা তখন কোনও রকম উপায় না দেখে পিছু হটে ধীরে ধীরে ইঞ্জিনের মাথার ওপর উঠে পড়ল। বহুদিনের অব্যবহৃত কানাডিয়ান ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের মাথায় উঠে লম্বা মতো যে অংশটায় জল ভরা হয় ওরা তার ভেতর ঢুকে পড়ল।

পঞ্চু গিয়ে ঢুকল বাইরে কয়লা রাখার জায়গাটায়।

জলশূন্য ইঞ্জিনের খোলের ভেতর ঢুকে অনেকটা নিরাপদ হল ওরা। বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারল। ভেতরে বসেও ওরা বুঝতে পারল আর পি এফগুলো এসে ইঞ্জিনের আশপাশে ঘোরা ফেরা করছে। টর্চ মারছে একপাশে একটু ফাটা ও ভাঙা অংশ ছিল। ওরা সেইখান দিয়ে দেখল আর পি এফরা ইঞ্জিনের কয়লা রাখার জায়গাটার দিকে এগোচ্ছে। তারপরই শুনতে পেল পঞ্চুর ঘেউঘেউ শব্দ।

দু’জনে আর পি এফ ইঞ্জিনের কয়লারাখা জায়গাটায় কেউ লুকিয়ে আছে কিনা দেখবার জন্য উঠেছিল। কিন্তু পঞ্চু আচমকা এমন হাউ হাউ শব্দ করে চেঁচিয়ে উঠল যে এক লাফে নীচে নেমে থর থর করে কাঁপতে লাগল দু’জনে।

নীচে যারা ছিল তারা বলল, “ক্যা হুয়া?”

“আরে ছোড়ো ভাই। কুত্তা চিল্লাতা। চোর কাহা বা? ইসিকে লিয়ে বেটা চৌকিদার হামলোকনকে পরিশান কিয়া।”

একজন বলল, “আরে নেহি নেহি! ও ব্যাটা টর্চ লেকে ভাগা।

আর একজন বলল, “ছোড়ো বাত। ও বেটা বদমাশ টর্চ অপনে নে চুরায়া। আউর আভি চোর চোর করকে চিল্লাতে হ্যায় সাধু সাজনেকে লিয়ে চলো চলো।”

আর পি এফরা চলে গেল।

বাবলুরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাচল এবার।

তারপর খানিক চুপচাপ বসে থেকে একসময় মাথা গলিয়ে বাইরেটা দেখে নিল বাবলু। না। কেউ কোথাও নেই।

ভোম্বল বলল, “ভেতরটা বড় অন্ধকার। টর্চটা জ্বালব বাবলু?”

“জ্বাল।”

বিলু বলল, “আর একটু বিশ্রাম করে আমরা আবার আমাদের অভিযান চালাব।”

ভোম্বল টর্চ জ্বেলে ইঞ্জিনের খোলের ভিতরটা ভাল করে দেখতে লাগল।

হঠাৎ এক জায়গায় আলো পড়তেই চমকে উঠল ভোম্বল। বাবলু আর বিলুরও চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। দেখল এক কোণে অন্তত দশ বারোটা বন্দুক ও কয়েকটা তাজা বোমা জড়ো করা আছে।

বিলু বলল, “ঠিক আছে। দরকার পড়লে এগুলো আমরা কাজে লাগাতে পারব।”

বাবলু বলল, “আর দেরি নয়। আমরা বেরিয়ে পড়ি চল। রাত হচ্ছে।”

এই বলে ওরা বেরোতে যাবে এমন সময় বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কে বা কারা যেন আসছে। তাই বেরোতে গিয়েও বেরোতে পারল না ওরা।

তাড়াতাড়ি এক কোণে সরে বসল। বিলু-ভোম্বল ছুরি নিয়ে এবং বাবলু পিস্তল উচিয়ে রেডি হয়ে রইল। একটু পরেই ওরা দেখল ছোট্ট একটি রেলের লণ্ঠন নিয়ে কে যেন একজন ভেতরে নামছে। যে লোকটা নামল তাকে দেখেই চমকে উঠল এরা। এ সেই বুড়ো চৌকিদার। যার টর্চ নিয়ে ওরা পালিয়ে এসেছে। বুড়োটা ভেতরে ঢুকতেই বাবলু ওর বুকের কাছে পিস্তলটা ঠেকিয়ে ধরল—একদম চুপ।

এমন অপ্রত্যাশিত ব্যাপারের জন্য বুড়ো তৈরি ছিল না। ভয়ে চোখদুটো কপালে উঠে গেল তার। মুখ দিয়ে শুধু বু-বু করে একটা শব্দ তুলেই অজ্ঞান হয়ে গেল।

বাইরে থেকে কে যেন একজন চেঁচিয়ে বলল, “কী হল রে নাথু?”

বাবলু উকি মেরে দেখল মাত্র একজন লোকই বাইরে ইঞ্জিনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাই অন্ধকারে নিজের মুখটা একটু বাড়িয়ে বুড়োর লণ্ঠনটা বার করে একবার দোলাল। যাতে লোকটি মনে করে বুড়োই লণ্ঠন দোলাচ্ছে।

লোকটিও টোপ গিলল। বুড়ো নাথুর সংকেত মনে করে তাড়াতাড়ি ভেতরে এসে ঢুকল। যেই না ঢোকা আমনি তিনজনে ঘিরে ধরল তাকে। লোকটি রীতিমতো ভয় পেয়ে বলল, “তোমরা কারা?”

“তার আগে বলো তুমি কে?”

“সে জেনে তোমাদের লাভ?”

“আমাদের দিদি এবং ছোট ছোট দুটি বোনকে আজ কয়েকজন দুৰ্বত্ত অপহরণ করে এনেছে। আমরা তাদের সন্ধানে এসে এইখানে কতকগুলো গোপন অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করেছি। তোমরা যখন এখানেও এসে জুটেছ তখন আমরা ধারণা করছি তোমরাই সেই অপহরণকারীদের লোক। শিগগির বলো ওরা কোথায় আছে?”

“আমি জানি না।”

বলেই লোকটি হঠাৎ বাবলুর হাত থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নিয়ে বিলু আর ভোম্বলকে আচমকা এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে চকিতে বেরিয়ে পড়ল ইঞ্জিনের খোল থেকে।

ওরা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল তিনজনেই। তারপরই বাবলু ছুটে গিয়ে ইঞ্জিনের ভেতরে সাজিয়ে রাখা সেই বোমাগুলো থেকে একটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে পড়ল ইঞ্জিনের খোল থেকে।

বিলু-ভোম্বলও বেরিয়ে পড়ল। ভোম্বলের হাতে টর্চ ছিল। টর্চ মেরে দেখল লোকটা গঙ্গার দিকে ছুটেছে। লোকটাকে বাগে পাবার জন্য ওরা নীচে না নেমে একবার শুধু ‘পঞ্চু কুইক’ বলেই সারিবদ্ধ লম্বমান কতকগুলো ওয়াগনের মাথার ওপর দিয়ে ছুটে লোকটাকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল বোমাটা। বোমাটা লোকটির গায়ে না লেগে পাশে পড়ে সশব্দে ফেটে গেল। আর লোকটা উঃ বাবারে’ বলে বসে পড়ল সেখানে। যে হাতে পিস্তলটা ধরা ছিল সেই হাত এবং একটি পা উড়ে গেছে তখন।

ওরা ছুটে লোকটার কাছে গিয়ে ছুরি উচিয়ে চেপে ধরল তাকে, “এখনও বলো কোথায় আছে ওরা?”

অদূরে পড়ে থাকা নিজের পিস্তলটা বাবলু কুড়িয়ে নিয়েছে ততক্ষণে। লোকটি বলল, “ওরা কোথায় আমি জানি না।”

এই বলে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল।

বিলু তখন এক ঘুষি মারল লোকটার মুখে। মেরে বলল, “এবার বলবি তো?”

লোকটি অতি কষ্টে গঙ্গার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল।

বাবলু বলল, “ওদিকে কোনখানে?”

“ক্রেন জেটির কাছে যাও।” বলেই অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল সে।

বাবলুরা তখন লোকটাকে ধরে প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এল সেই ইঞ্জিনটার কাছে। একটা হাত নেই, একটা পাও নেই বেচারির। তবুওকে একটা দড়ি জোগাড় করে শক্ত করে বেঁধে ইঞ্জিনের খোলের ভেতরে ঢোকাল ওরা।
কিন্তু এ কী! সেই বুড়ো চৌকিদার নাথুটা গেল কোথায়?

বাবলু বলল, “ব্যাটা পালিয়েছে। আসলে আমাদের চোকে ধুলো দেবার জন্য অজ্ঞান হবার ভান করে পড়েছিল সে, তারপর আমরা বেরোতেই তাল বুঝে কেটে পড়েছে।”

যাই হোক। ওরা লোকটিকে ঢুকিয়ে রেখে সেই অন্ধকারে আস্তে আস্তে গঙ্গার দিকে এগোল।

সামনেই ক্রেন জেটি।

এরই কাছাকাছি কোথাও আছে ওরা। কিন্তু কোনখানে?

ওরা ক্রেন জেটির কাছে যেতেই দেখল এক জায়গায় বোর্ডে দুটো হাড় ও মড়ার মাথার খুলি আঁকা লেখা আছে ‘ডেনজার, এ সি।” কারেন্ট তখন অফ করা। বাবলুরা ক্রেন জেটির ওপরে উঠে চারদিক লক্ষ করতে লাগল।

এখানে গঙ্গার কাদার ওপর অতিকায় সব পষ্টুনের সারি। এর মধ্যে কোনওটি মেরামত হচ্ছে। কোনওটি বা অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে।

ক্রেন জেটির নীচেই একটি পন্টুন। হঠাৎ সেই পন্টুনের ওপর থেকে কে একজন ছোট্ট একটি লণ্ঠন দোলাল।

অমনি দেখা গেল গঙ্গার বুক থেকে একটা টর্চের আলো সেই পন্টুনের ওপর একবার পড়েই থেমে গেল।

বাবলু, বিলু ও ভোম্বল পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল।

পঞ্চু একবার লেজটা নাড়ল শুধু।

একটু পরেই দেখা গেল একটা ছোট নৌকো এসে ভিড়ল ক্রেন জেটির গায়ে। তারপর আরও একটি। কয়েকজন মুখ ঢাকা কালো পোশাক পরিহিত লোক নেমে এল। তারপর সোজা চলে গেল সেই পন্টুনটার কাছে।

পন্টুনের ওপর থেকে সেই লোকটা আবার লণ্ঠন দোলাল।

লোকগুলো গঙ্গার কাদা মাড়িয়ে সেই পন্টুনে উঠে ঢুকে গেল পন্টুনের ভেতরে।

বাবলু বলল, “আমার মন বলছে ওরা ওখানেই আছে।”

তারপর নৌকোগুলোর কাছে গিয়ে দেখল সেগুলো দামি দামি রেডিয়ো, ক্যামেরা আর হাতঘড়িতে বোঝাই।

বিলু বলল, “হু।”

ভোম্বল বলল, “এখন আমাদের কাজটা কী হবে?”

“আপাতত নৌকোগুলোকে দড়ি খুলে ভাসিয়ে দেওয়া।”

“তারপর?”

“ওগুলো পুলিশ উদ্ধার করবে।”

এই বলে ক্রেন জেটির গা থেকে দড়ি খুলে ওরা দুটো নৌকোই ভাসিয়ে দিল।

নৌকো ভাসিয়ে দিয়ে খুব সন্তৰ্পণে পন্টুনের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। .

একটু এদিক সেদিক করে ওপরে ওঠার চেষ্টা করতেই একপাশে ওরা একটা দড়ির মই ঝুলতে দেখল।

বাবলু-বিলু আর ভোম্বল সেই মই ধরে উঠতে যাবে এমন সময় ওরা দেখল কারা যেন নামছে সেই মই ধরে। ওরা অন্ধকার ঘেঁষে সরে দাঁড়াল।

লোকগুলো নেমে চলল গঙ্গার দিকে। অর্থাৎ যেখানে নৌকো বাঁধা ছিল ক্রেন জেটির গায়ে। সেই তালে ওরা করল কী তিনজনে চটপট উঠে পড়ল পন্টুনে। পঞ্চুই শুধু নীচে রইল।

পন্টুনটা অন্তত পাঁচশো ফুট লম্বা ও চল্লিশ ফুট চওড়া। সাবেক কালের অতিকায় পন্টুন। এখন আর কাজে লাগে না। একদিকে পন্টুনের ফাঁপা খোলের ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। পাশেই একটি ছোট্ট কেবিন। তার ভেতরে দু’জন লোক রয়েছে। একজন বলছে, “ওঃ ! আমি যে কী কৌশলে পালিয়ে এসেছি তার তুই কী বুঝবি শ্যাম। শয়তান ছেলেগুলো ভেবেছিল আমি বুঝি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে গেছি। আজ রাতের মধ্যেই যদি এখান থেকে সরে পড়তে না পারি তা হলে কিন্তু সবাই ধরা পড়ে যাব। ইঞ্জিনের খোলের ভেতরে মালপত্তরগুলো রয়েছে, শয়তানরা সেখানেও গিয়ে হাজির। তার ওপর দুলাল যখন এখনও ফিরছে না আমার মনে হয় নিশ্চয়ই ওর কোনও বিপদ হয়েছে।”

যার নাম শ্যাম সে বলল, “আমি তো আগেই বলেছিলুম ওখানে টক্কর দিতে যেয়ো না। যা সব দস্যি ছেলেমেয়ে। আমার কথা যখন শুনলে না এখন ফল বোঝো। আমি বলে রাখছি ওরা এখানেও হানা দেবে।” বাইরে থেকে তখন যে লোকগুলো নেমেছিল তাদের গলা শোনা গেল, “এই নাথু, শিগগির আয়। আমাদের নৌকোর দড়ি খুলে গেছে।”

শ্যাম বলল, “খুলে গেছে না খুলে দিয়েছে? ঠ্যালা সামলাও এবার।” বলে দু’জনেই বেরিয়ে এল। নাথু তাড়াতাড়ি লণ্ঠন নিয়ে দড়ির মই বেয়ে নেমে গেল পন্টুনের নীচে। আর শ্যাম আস্তে আস্তে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে পন্টুনের গহ্বরে নামতে লাগল। বাবলু-বিলু আর ভোম্বল অনুসরণ করল শ্যামকে। শ্যামের বয়স বেশি নয়। সতেরো কি আঠারো বছর হবে হয় তো। এই বয়সের ছেলে কেন যে এমন সাংঘাতিক দলের সঙ্গে রয়েছে তা ভগবান জানে।

বাবলু হঠাৎ দেখতে পেল পন্টুনের গহ্বরে একটা ঘেরা মতো জায়গায় শৰ্মিলাদি বাচ্চু আর বিচ্ছু চুপ করে বসে আছে।

যেই না দেখতে পাওয়া বিলু অমনি পিছন থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল শ্যামের ঘাড়ে। শুধু বিলু নয়। সেই সঙ্গে ভোম্বলও।

বাবলু ছুটে গেল বাচ্চু-বিচ্ছুদের কাছে। শৰ্মিলাদি বললেন, “এ কী বাবলু! তুমি এখানে কী করে এলে?”

“শুধু আমি নয়! বিলু-ভোম্বল এসেছে। ওই দেখুন এক ব্যাটাকে ধরেছে ওরা।”

শ্যামকে দেখেই শর্মিলাদি বললে, “ওরে ছেড়ে দে ওকে। ও সম্পূর্ণ নির্দোষ। এদের দলে ওই একমাত্র ভাল ছেলে। আমি ওকে চিনি। দত্তদের বাড়িতে আগে কাজ করত ছেলেটা।”

বিলু-ভোম্বল তখনই ছেড়ে দিল শ্যামকে। শ্যামের মুখ-চোখ তখন লাল হয়ে উঠেছে। শর্মিলাদি আবার বললেন, “শ্যামকেও ওরা ধরে এনেছিল একদিন। তারপর থেকে শ্যাম ওদের দলেই রয়ে গেছে। তোরা না এলেও কাল সকালে ও নিজেই গিয়ে তোদের ডেকে আনত।”

বাবলু বলল, “তা হলে এখন আমাদের করণীয়?”

শ্যাম বলল, “পালানো। তোমরা যখন এসে গেছ তখন আমি নিশ্চিন্ত।”

“তোমরা আর একটা দড়ির মই বেয়ে পিছন দিক দিয়ে পালাও। কেন না ওরা এখনই এসে পড়বে। আর তোমরা আমার হাত-পা বেঁধে রাখো। যাতে ওরা এসে আমাকে সন্দেহ না করতে পারে।”

বাবলু বলল, “সেই ভাল। তারপর তো পুলিশ নিয়ে আমরা আসছিই। এই বলে শ্যামকে বেঁধে ফেলল ওরা।” তারপর কাঠের সিঁড়ির কাছে যেতেই ওরা দেখল কতকগুলো লোক সিঁড়ির মুখে এসে হাজির হয়েছে। ওরা তাড়াতাড়ি সিঁড়ির পিছনে লুকিয়ে পড়ল।

লোকগুলো লক্ষ্যও করল না ওদের ওপর থেকে তরতর করে নেমে এল নীচে। ওরা নেমে এলে এরাও উঠল। ওপরে উঠে বাবলু বলল, “ভোম্বল, তুই বাচ্চু, বিচ্ছু আর শর্মিলাদিকে নিয়ে বাড়ি চলে যা। তারপর যত তাড়াতাড়ি পারিস পুলিশ নিয়ে চলে আয়। বিলু আর আমি পাহারা দিচ্ছি এদের।”

ভোম্বল তখন ছুটে গিয়ে ক্রেন জেটির দিকে পন্টুনের গায়ে যে দড়ির মইটা ঝুলছিল সেই মইটা তুলে নিল। পঞ্চু নীচেই গঙ্গার কাদার ওপর ছিল। একবার সাড়া দিল, “ভৌ ভোঁ।”

ভোম্বল বলল, “আর একটু একা থাক তুই এখনই আসছি।” বলে মইটা নিয়ে পন্টুনের পিছন দিকে ঝুলিয়ে দিল।

শৰ্মিলাদি বললেন, “আমরা এখন কেউ যাব না এখান থেকে। ভোম্বল তুমি নিজেই গিয়ে পুলিশ ডেকে আনো। না হলে বাবলু বিলুর জন্যে আমার মনে অত্যন্ত দুশ্চিন্তা থাকবে।”

বিলু বলল, “সেই ভাল। তুই বরং বেশি দূর না গিয়ে আর পি এফ অফিস থেকেই ফোন করে দে থানায়। আর রেলরক্ষী বাহিনীর ইনস্পেক্টরকেও সব কথা খুলে বল। আমাদের পরিচয় দে।”

ভোম্বল দড়ির মই বেয়ে নীচে নেমেই পঞ্চুকে ডাকল, “আয় পঞ্চু আয়।”

পঞ্চ পন্টুনের ওপাশে ছিল। ভোম্বলের গলা শুনে দৌড়ে এল সে।

বাবলু তখন পিস্তল ত্যাগ করে পন্টুনের গহ্বরের মুখে বসে আছে।

বিলুও ছুরি উচিয়ে এদিক সেদিক পায়চারি করছে।

শর্মিলাদি কোমর বেঁধে একটা কাঠ চালানো কুডুল পেয়ে সেটা হাতে নিয়ে একদম তৈরি।

বাচ্চু-বিচ্ছু করল কী ভোম্বল চলে যেতেই দড়ির মইটা তুলে নিল ওপরে। যাতে আর কেউ কোনওরকমে পন্টুনে উঠে পড়তে না পারে।

পন্টুনের ভেতরে যারা ঢুকেছিল তারা বাইরে আসতে গিয়েই বাঁধা পেল। একদম মুখের কাছেই বসে আছে বাবলু। যেন সাক্ষাৎ যম।

বাবলুর হাতে পিস্তল দেখে একজন বলল, “ওটা কি সত্যিকারের না খেলনা পিস্তল?”

বাবলু বলল, “এগিয়ে এসে দেখো না মালুম পাবে তা হলে।”

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করল কিছুক্ষণ।

তারপর শ্যামকে এগিয়ে দিল। বলল, “যা তো। গিয়ে ধর তো ব্যাটাকে।”

শ্যাম নির্ভয়ে বেরিয়ে এল।

বাবলু কিছু বলল না।

ভেতরের লোকগুলো বলল, “ধর না ব্যাটাকে, ধর।”

কিন্তু ধরা তো দূরের কথা শ্যাম দাঁত বার করে হাসতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ ক্রেন জেটির ওপর থেকে একটা জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল বাবলু আর শ্যামের ওপর।

বিলু চিৎকার করে উঠল, “বাবলু শুয়ে পড়।”

বাবলু-বিলু তখনই শুয়ে পড়ল উপুড় হয়ে বড় বড় কয়েকটা তেলের পিপের আড়ালে। শৰ্মিলাদি, বাচ্চু আর বিচ্ছুও কেবিনঘরের আড়ালে সরে দাঁড়াল।

রাতের অন্ধকারে শয়তানের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র গর্জে উঠল, “গুডুম।”

হতবুদ্ধি শ্যাম দাঁড়িয়েছিল নির্বোধের মতো। গুলি এসে ওর বুক ঝাঝরা করে দিল। অস্ফুট একটু আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল শ্যাম।

আবার একটা গুলি এসে ঠং করে লাগল পিপেটার গায়ে।

আলো লক্ষ্য করে বাবলুও তখন পিস্তল চালাল।

ওদিক থেকে শোনা গেল আর একটি আর্তনাদ। টর্চের আলোও নিভে গেছে তখন।

বাবলু চকিতে দু-একটা পিপেকে অতিক্রম করে চলে গেল। বাবলুর হাতেও টর্চ ছিল। সেই আলোয় দেখল ক্রেন জেটির ওপর দুজন লোক। একজন সেই বুড়ো চৌকিদার নাথু অপরজনকে সে চেনে না।

বিলু বলল, “ওই তো বাসুদেববাবু দলের লিডার।”

বাসুদেববাবুর ডান দিকের কাঁধেই লেগেছে গুলিটা। ওরা দু’জনেই তখন পালাবার চেষ্টা করছে। বাবলু আবার একটা গুলি খরচ করল। এটা লাগল নাথুর পায়ে। আর লাগা মাত্রই ক্রেন জেটির ওপর থেকে মুখ থুবড়ে একেবারে গঙ্গার কাদায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল নাথু।

গুলির শব্দে হইহই করে একদল আর পি এফ তখন ছুটে এসেছে ক্রেন জেটির দিকে।

এদিকে বাবলুর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে পন্টুনের গহ্বরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল একজন। তার হাতে ছিল মোটা একটি লোহার রড। সেটা নিয়ে যেই না সে মারতে যাবে অমনি পিছন দিক থেকে শৰ্মিলাদির কুডুলের কোপ সরাসরি এসে পড়ল তার হাতে।

লোকটি আর্তনাদ করে উঠল।

দূর থেকে তখন পঞ্চুর ভোঁ ভৌ শব্দ আর ভোম্বলের গলা শোনা গেল।

ওরা চেয়ে দেখল কাতারে কাতারে পুলিশ ও রেলপুলিশ এগিয়ে আসছে ওদের দিকে।

শর্মিলাদি তাড়াতাড়ি দড়ির মইটা নামিয়ে দিলেন।

পুলিশের লোকেরা উঠে এল ওপরে।

মৃত শ্যামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শর্মিলাদি।

পুলিশ শ্যামের দেহটা তুলে নিল।

ন‘জন লোক ছিল ভেতরে। সবাই ধরা পড়ল।

কিছু পুলিশ রয়ে গেল পন্টুনে পাহারায়। বাকিরা নেমে গেল। শৰ্মিলাদিও পাণ্ডব গোয়েন্দাদের সঙ্গে নেমে এলেন।

গঙ্গার কাদা থেকে নাথুর রক্তাক্ত দেহটা টেনে আনা হল। ব্যাটা তখনও মরেনি।

বাসুদেববাবুকে তো আগেই ধরে ফেলা হয়েছে।

ওরা তখন সেই ভাঙা ইঞ্জিনের কাছে গেল।

পুলিশের লোকেরা তার ভেতর থেকেও সেই হাত-পা কাটা লোকটাকে টেনে বার করল। সেই সঙ্গে বোমা-বন্দুকও উদ্ধার হল সব।

ওদিকে জলপুলিশ খবর পেয়েই সেই ভেসে যাওয়া নৌকোদুটোকে উদ্ধার করল। ভাটার টানে খুব বেশি দূর ভেসে যেতে পারেনি নৌকোদুটো।

পুলিশ অফিসার বাবলুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমাদের মতো ছেলেমেয়ে আজ যদি বাংলার ঘরে ঘরে জন্মায় তা হলে এদেশের অগ্রগতি রোখে কে। যাই হোক, তোমাদের আদর্শ আজ প্রতিটি ছেলেমেয়ের আদর্শ হয়ে উঠুক।”

শর্মিলাদির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু ও বিচ্ছু খুশি খুব।

ওরা সকলে পুলিশের জিপে চেপে বাড়ির দিকে চলল। তখন অনেক রাত হয়েছে।

হঠাৎই দারুণ আনন্দে পঞ্চ ডেকে উঠল, “ভৌ। ভৌ ভৌ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *