১১. কৌটা রহস্য

পাণ্ডব গোয়েন্দা – ১১ – একাদশ অভিযান – কৌটা রহস্য / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়

বেলা পড়ে আসছে তখন।

রামকৃষ্ণপুর ঘাটে ক্রেন জেটির ওপর বসেছিল পাণ্ডব গোয়েন্দারা। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু আর বিচ্ছু। পঞ্চুুও সঙ্গে ছিল। ওরা বসে বড় বড় গাদা বোটে ওয়াগনের মাল বোঝাই করা দেখছিল। ওয়াগন খালাস করা মালগুলো ক্রেনের সাহায্যে বোঝাই হচ্ছিল গাদা বোটে।

এমন সময় হঠাৎ পঞ্চুু ভৌ-ভৌ করে উঠল কী যেন একটা দেখে।

বাচ্চু-বিচ্ছুরও নজর পড়ল সেদিকে।

ওরা দেখল পড়ন্ত বেলায় গঙ্গার জোয়ারে কী যেন একটা ভেসে ভেসে আসছে। একটা ঝকঝকে চকচকে কৌটোর মতো। তার ওপর সূর্যের আলো পড়ে দৃষ্টি যেন ঠিকরে যাচ্ছে।

বাবলু বলল, “কী বল দেখি ওটা?”

বিচ্ছু বলল, “মনে হচ্ছে সিগারেটের কৌটো৷”

বিলু বলল, “কোনওরকমে আনা যায় না ওটাকে?”

বাবলু বলল, “যাবে না কেন, তবে জামা-প্যান্ট ছাড়তে হবে। ভেতরে জাঙ্গিয়া আছে অবশ্য। কিন্তু গা মুছব কী করে?”

ভোম্বল বলল, “তুই না। আমি আনছি। বেশি দূরে নেই। একটুখানি সাঁতার কেটে যেতে পারলেই ব্যস। একেবারে হাতের মুঠোয়।” এই বলে ভোম্বল জামা প্যান্ট ছাড়বার উপক্রম করছে এমন সময় হঠাৎ মাঝিদের একজন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে।

মাঝিটা স্নান করবে বলে জলে নামল। গ্রীষ্মের দিন। পড়ন্ত বেলায় দেহের ক্লান্তি দূর করতে গেলে স্নানের চেয়ে তৃপ্তিকর আর কিছুই নেই।

বাবলু বলল, “ওই কৌটোটা আমাদের এনে দেবে মাঝিভাই?”

মাঝিটা অবাঙালি। বলল, “কিধার হ্যায়?”

“ওই যে ভেসে আসছে।”

মাঝি অল্প একটু সাঁতরে গিয়ে কোটোটা নিয়ে এসে বাবলুর হাতে দিল।

বাবলুরা তো কৌটাে পেয়ে খুব খুশি। জেটির ওপর বসে বসেই আনন্দের চোটে কৌটােটা খুলে ফেলল বাবলু। কিন্তু কৌটো খুলেই অবাক। দেখল কৌটোর ভেতরে কাগজের মোড়কে একটা চিঠি লেখা আছে। ওপরেই লেখা আছে আমাকে বাঁচান’।

ওরা সঙ্গে সঙ্গে ভাজ করা কাগজটা খুলে ফেলল। তাতে যা লেখা ছিল তা এই—প্রিয় মহাশয়, যদি কেউ আমার এই চিঠিটা পান তা হলে অনুগ্রহ করে পুলিশে খবর দিয়ে আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করুন। ডায়মন্ডহারবারের কাছে গঙ্গা-তীরবর্তী একটি সুড়ঙ্গ-ঘরে শয়তানের ঘাঁটিতে আমি এবং আমার ছেলে বন্দি আছি। জায়গাটার নাম জানি না। তবে স্থানটি গঙ্গার ওপারে মেদিনীপুর জেলার দিকে। গঙ্গার দিকে এর একমাত্র প্রবেশপথের সুড়ঙ্গটি জোয়ারের সময় জলে ডুবে থাকে, আর ভাটার সময় জাগে। আমরা এখানে মৃত্যুর দিন গুনছি। আমার চিঠি পেয়ে কেউ বাঁচালে আমি তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। ইতি—দীপঙ্কর বোস।

চিঠিটা পড়েই বাবলুরা অবাক হয়ে গেল। লোকটাকে কেন, কী কারণে যে শয়তানরা আটকে রেখেছে সে সব কিছুই লেখেনি সে। শুধু তাকে উদ্ধার করতে হবে সেই কথাই লিখেছে।

বিলু বলল, “কী করবি রে বাবলু?”

“ভদ্রলোককে উদ্ধার করব।”

“কিন্তু কেমন করে?”

“যেমন করেই হোক।”

ভোম্বল বলল, “ব্যাপারটা কিন্তু খুব সাংঘাতিক। মনে কর, কোথায় ডায়মন্ডহারবার। সেখানে জলে ডোবা সুড়ঙ্গ। বেশ রীতিমতো সার্চ না করলে সেটাকে আবিষ্কার করাই যাবে না।”

বাবলু বলল, “রীতিমতো ভাবেই সার্চ করব! তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখব জায়গাটাকে।”

“সেটাই তো মাথা খাটিয়ে বার করতে হবে আমাদের।”

বিলু বলল, “ওখানে গঙ্গার যা ভয়াবহ রূপ তাতে ছোট নৌকায় করে ঘোরা অসম্ভব। তা ছাড়া চারদিকেই তো অকুল পাথার!”

বাবলু বলল, “ওভাবে নয়। যেমন করেই হোক একটা লঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে।”

ভোম্বল বলল, “তা হলে তো জল-পুলিশকে বললেই একটা লঞ্চের ব্যবস্থা হয়ে যায়।”

বিলু বলল, “সেই ভাল। জল-পুলিশ নিশ্চয়ই আমাদের লঞ্চের ব্যবস্থা করে দেবে।”

বাবলু একটু গম্ভীর ভাবে বলল এবার, “আগে আমরা চেষ্টা করে দেখি। কেন না এমনও তো হতে পারে কেউ তামাশা করবার জন্যে বা অযথা পুলিশকে হয়রানি করবার জন্যে মিথ্যে করে চিঠিটা লিখে কৌটোর মধ্যে পুরে জলে ভাসিয়ে দিয়েছে। হতে পারে না কি?”

বিলু বলল, “এ হতে পারে না।”

বাবলু বলল, “চিঠিটা যে ভাবে লেখা হয়েছে তাতে তাই অবশ্য মনে হয়। মনে হয় এটা মিথ্যে নয়। কিন্তু সত্যও তো না হতে পারে? কত রকমের বদমাইশ লোক আছে সমাজে, তার খোঁজখবর রাখিস? এমন লোক অনেক আছে যারা পুলিশ বা ফায়ার ব্রিগেডের লোককে ইয়ার দোস্ত বলে মনে করে। আগুন লাগার মিথ্যে খবর দিয়ে দমকলে টেলিফোন যে কতবার এসেছে তার ঠিক নেই। তেমনই খুন দাঙ্গার ফলস টেলিফোনও পুলিশের কাছে এবেলা ওবেলা আসে।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “তা অবশ্য সত্যি।”

বিলু বলল, “তা হলে এখন আমাদের করণীয়?”

“কাল সকালেই আমাদের সেটা ঠিক করে নিতে হবে। এখন ফেরা যাক। সন্ধে হয়ে এসেছে।”

ওরা আর বিলম্ব না করে ঘরে ফিরে চলল।

পরদিন সকালে মিত্তিরদের বাগানে পাণ্ডব গোয়েন্দারা একে একে জড়ো হল, বাবলুর হাতে কালকের সেই চিঠিটা।

বিলু বলল, “এ সম্বন্ধে কিছু ভেবেছিলি বাবলু?”

“হ্যাঁ। কাল সারারাত ধরে শুধু ভেবেছি। রাতে আমার ঘুম হয়নি।”

“কী ভাবলি?”

“ভাবলাম, আজ দুপুরের মধ্যেই আমরা সকলে ডায়মন্ডহারবার চলে যাব।”

ভোম্বল বলল, “আমাদের কোনও প্রস্তুতিই তো নেই। তা ছাড়া শুধু শুধু ডায়মন্ডহারবারে গিয়েই বা করব কী?”

“যা করবার সে তো আমি করব। তোরা শুধু আমাকে সাহায্য করবি।”

বাচ্চুু বলল, “আমার মনে হয়, এ কেসটা আমাদের হাতে না নেওয়াই উচিত।”

ছোট্ট মেয়ে বিচ্ছু বলল, “আমার মনে হয় এই কেসটা একমাত্র আমাদেরই হাতে নেওয়া উচিত। এবং আজই একবার চলে যাওয়া উচিত ডায়মন্ডহারবারে।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ। এখন সাতটা বাজে। সবাই যা। তাড়াতাড়ি দুটো খেয়ে নিয়ে লঞ্চে পার হয়ে বাবুঘাটে চলে যা৷”

বাবলুর আদেশ। অতএব যেতেই হবে। সবাই যে যার ঘরের দিকে ফিরে গেল।

অল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে চলে এল বাবুঘাটে। ওরা আসবার আগেই বাবলু পঞ্চুকে নিয়ে দাড়িয়েছিল ৭৬ নম্বর বাসের কাছে। বাবলু তৈরি হয়েই এসেছিল। সঙ্গে পিস্তল, ছোরা আত্মরক্ষার জন্য সবকিছু নিয়ে এসেছিল।

বাসের কন্ডাক্টর ওদেরকে দেখেই বলল, “তোমরা কোথায় যাবে ভাই?”

“আমরা ডায়মন্ডহারবারে যাব।”

“এই কুকুরটাও যাবে নাকি?”

“হ্যাঁ।”

“বাসে করে আমি কুকুর নিয়ে যেতে পারব না।”

“কেন? আমরা ওর পুরো ভাড়া দেব।”

“নিয়ম নেই। পুলিশে ধরবে।”

“ধরবে না। আমরা বলছি, তোমার কোনও ভয় নেই।”

“আমি পারব না।”

এক ভদ্রলোক জানলার ধারে একটা সিটে বসেছিলেন। ভদ্রলোক এদের দেখেই বললেন, “আরে, এদের কুকুর নিয়ে নাও, ছেলেমানুষ এরা, মনে কষ্ট পাবে। কেউ কোনও আপত্তি করবে না।”

অতএব আর না করল না কন্ডাক্টর। গজগজ করতে করতে তুলে নিল পঞ্চুকে। পঞ্চুও দিব্যি একটা সিটের তলায় ঢুকে চোখ বুজে শুয়ে রইল গুটিগুটি মেরে।

কন্ডাক্টর বলল, “এটা তো একটা নেড়ি কুত্তা। এটাকে সঙ্গে করে কেন নিয়ে চলেছ ভাই? একটা জাতের কুকুর হলেও তবু জানতাম।”

ভদ্রলোক বললেন, “জাতের কুকুর। ওরে বাবা। মহাপুরুষরা জাতিভেদ দূর করতে বলেছেন না?”

ভদ্রলোকের কথায় বাবলুরা খুব খুশি। বাবলু বলল, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“তোমরা কোথায় যাচ্ছ?”

সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ জনের চোখে চোখে ইশারা হয়ে গেল।

“ডায়মন্ডহারবারে বেড়াতে যাচ্ছি।”

“ভাল ভাল। খুব ভাল জায়গা। তুমিই কি এদের লিডার?”

বাবলু হেসে বলল, “লিডার আর কী? আমরা সকলে মিলে-মিশে চলি।”

“খুব ভাল।”

এমন সময় একজন ফ্যান্টাওয়ালা বাসে ফ্যান্টা বিক্রি করতে উঠল। অমায়িক ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা ফ্যান্টা কিনে অফার করলেন ওদের। ওরাও খাবে না, ভদ্রলোকও ছাড়বেন না। বললেন, “দেখ বাবা, আমি একা মানুষ। বিজনেসম্যান। টাকা পয়সারও অভাব নেই আমার, তোমরা আমার ভাইপো-ভাইঝির মতো। ছোট ছেলেমেয়েদের আমি খুব ভালবাসি। তাদের খাওয়াতে পারলে আমার ভীষণ আনন্দ হয়।”

বাবলু বলল, “কিন্তু আপনি কোথায় যাচ্ছেন তা তো বললেন না? আপনার পরিচয়?”

“পরিচয় তো দিলাম। আমার নাম বি মিত্র। আমিও ডায়মন্ডহারবার যাচ্ছি।”

“বেড়াতে নাকি?”

“না। আমাদের একটা জাহাজ আসবার কথা আছে। তাই দেখতে যাচ্ছি।”

“জাহাজ কি আপনাদের নিজস্ব ?”

“না। আমাদের লঞ্চ আছে। জাহাজে কিছু মাল আসবে। সেই মাল নিয়ে আসব লঞ্চে করে।”

বাবলু বলল, “একটা অনুরোধ করব আপনাকে?”

“আপনাদের নিজেদের যখন লঞ্চ আছে তখন অনুগ্রহ করে একটা লঞ্চ কিছুক্ষণের জন্য দেবেন আমাদের? একটু বেড়াব।”

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “এই কথা? তা বেশ তো, তোমরা ডায়মন্ডহারবারে নেমে জলযোগ সেরে এদিক সেদিক যদি একটু ঘুরতে চাও তো ঘুরে নিয়ো। ততক্ষণে আমি লঞ্চের ব্যবস্থা করে রাখব। লঞ্চের নাম রঞ্জন। মনে থাকবে তো?”

“নিশ্চয়ই মনে থাকবে।”

যথাসময়ে বাস ছাড়ল। আবার যথাসময়ে বাস পৌঁছেও গেল। ডায়মন্ডহারবারে নেমে ভদ্রলোক মানে মি. মিত্তির বললেন, “তা হলে খানিক বাদে এসো তোমরা। আমি ততক্ষণ লঞ্চের ব্যবস্থা করে রাখি। রোদের তেজটাও এখন বড় চড়া। রোদ একটু পড়লে এসো। কেমন? আমিও থাকব। আমি তোমাদের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।”

বাবলুরা আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠল। বিলু বলল, “সত্যি, ভগবান খুব সহায় আমাদের। কী বল?”

“সে কথা আবার বলতে?”

গঙ্গার ধারেই বাস থেমেছিল। তাই গঙ্গার জলের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছু হঠাৎ বলে উঠল, “ভগবান আমাদের সত্যিই সহায়! ওই দেখ, ভাটার টান আরম্ভ হয়েছে।”

বাবলুও উল্লসিত হয়ে বলল, “তাই তো রে! ঘণ্টা দুই বাদে আমরা যখন লঞ্চে ভ্রমণ করব তখন নিশ্চয়ই সেই সুড়ঙ্গমুখ দেখতে পাব। কেন না সুড়ঙ্গটা জোয়ারে ডুবে থাকে এবং ভাটার সময় সামান্য একটু জাগে।”

ওরা কথা বলতে বলতে যখন বাঁধের ওপর থেকে নীচে গঙ্গার গর্ভের কাছে মনোরম হারবারে নেমে এল, তখন ওরা দেখতে পেল চারদিকে কত সব পিকনিকপার্টি পিকনিক করতে বসেছে।

বিলু হঠাৎ বলল, “ওই দেখ, বাবলু, সব আমাদের পাড়ার ছেলে।”

ভোম্বল বলল, “আরে! তপাইদাও এসেছে দেখছি।”

বিচ্ছু বলল, “তপাইদা? কোন তপাইদা?”

“তপাই ব্যানার্জি। কদমতলায় কাটাপুকুরে থাকে। তুই অবশ্য চিনবি না। দেপনের ভাগ্না।” বলতে বলতেই তপাইদা এসে হাজির, “কী ব্যাপার রে? তোরা এখানে? নিশ্চয়ই কোনও অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পেয়েছিস?”

ভোম্বল বলল, “না না। ওসব কিছু নয়। এমনই বেড়াতে এসেছি।”

বাবলু ইশারায় ওদেরকে বেশি কথা বলতে বারণ করে বলল, “চল, একটু এদিক ওদিক করে ঘুরে আসি চল।” বলে ওদের কাছ থেকে খানিকটা তফাতে গিয়ে একটু নিরিবিলিতে বসল। তারপর গঙ্গার দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির দিকে চেয়ে রইল ওরা।

রোদের তেজ তখনও যথেষ্ট। গঙ্গার ওপারে দূরে অনেক দূরে ওদের অভিযান। মিত্তিরবাবুর লঞ্চটা একবার পেলে হয়। ভগবান যে এভাবে ওদের সহায় হবেন তা ওরা ভাবতেও পারেনি।

যাই হোক, বেলা একটু পড়ে এলে ওরা নির্দিষ্ট জায়গায় গেল। দেখল হাসিমুখে সুন্দর চেহারার মিত্তিরবাবু ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। লঞ্চও রেডি।

কী চমৎকার লঞ্চ। সবুজ রং যেন একটি লম্বাটে ডিম। বাবলু বলল, “আরে! এ লঞ্চটাকে আমরা প্রায়ই রামকৃষ্ণপুর ঘাটে যাতায়াত করতে দেখি।”

ওরা লঞ্চে উঠতেই মিত্তিরবাবু বললেন, “কোন দিকে যাবে বলে?”

বাবলু বলল, “গঙ্গার ওপারে।”

মিত্তিরবাবু বললেন, “খুব ভাল করে রড ধরে বসে থাক, কেমন? কেন না অসম্ভব রকমের জোরে ছুটতে পারে আমার এই ক্ষুদে লঞ্চ।”

বাবলুরা সকলে শক্ত করে রড ধরল।

“রেডি।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই গঙ্গার ঘোলাটে জল তোলপাড় করে উল্কার গতিতে ছুটে চলল লঞ্চখানা। কিছু সময়ের মধ্যেই ওপারে পৌছে গেল ওরা। ওপারে গ্রাম, মাঠ, ঘন বন। কিন্তু সেই সুড়ঙ্গ? সুড়ঙ্গ কোথায়?

লঞ্চ ওপারে যেতেই একটা ছোট্ট নৌকো এসে ভিড়ল লঞ্চের গায়ে। মিত্তিরবাবু বললেন, “চলো, একটু ডাঙাটা বেড়িয়ে আসা যাক।”

ওপারে কোনও জেটি নেই। তাই নৌকোয় করে ডাঙায় পৌছুল ওরা। একটা মোটা দড়ি লঞ্চে বেঁধে ডাঙায় একটা গাছের সঙ্গে জড়িয়ে রাখা হল, যাতে লঞ্চটা ভেসে না যায়।

বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং পঞ্চু সকলেই ওপারের মুক্ত অঞ্চলে গিয়ে যারপরনাই খুশি হল। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষুন্ন হল কাছাকাছি কোনও সুড়ঙ্গ না দেখে।

মিত্তিরবাবু বললেন, “কেমন লাগছে জায়গাটা?”

বাবলু বলল, “খুব ভাল।”

মিত্তিরবাবু বললেন, “কিন্তু তোমরা এখানে এসে এমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলে কেন ভাই?”

বাবলু বলল, “ও কিছু না।”

“আমার যেন মনে হচ্ছে তোমরা কিছু একটা আবিষ্কার করবার চেষ্টা করছ?”

বাবলু বলল, “না না। সে রকম কিছু না।”

“বলা যায় না। যা সাংঘাতিক ছেলেমেয়ে তোমরা! এই বয়সে একলা বেড়াতে বেরিয়েছ। এ কী সকলে পারে নাকি! তা যাক। সন্ধে হয়ে এসেছে। এখানে একটা ডাকাতে কালীমন্দির আছে। সেই মন্দিরে গিয়ে মাকে প্রণাম করে ফিরে যাই চল।”

বাবলু বলল, “ঠিক বলেছেন। সময়মতো না ফিরলে বাড়ি পৌঁছুতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

মিত্তিরবাবুর সঙ্গে ওরা ঝোপ-জঙ্গল পেরিয়ে একটা ভাঙা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর হঠাৎ মিত্তিরবাবু খুব জোরে একটা শিস দিয়ে উঠলেন। যেই না শিস দেওয়া অমনি চারদিক থেকে জনা দশেক লোক গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ঘিরে ফেলল ওদের।

কী ভয়ানক সব চেহারা ওদের কালো কালো ষণ্ডামাক ভয়ংকর চেহারা। তারা এসেই সেলাম ঠুকে দাঁড়াল মিত্তিরবাবুর সামনে।

মিত্তিরবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “এই ছেলেগুলো অতি সংঘাতিক। এদের মতলব ভাল নয়। মনে হচ্ছে কোনওরকমে এরা আমাদের ঘাঁটির খবর জানতে পেরেছে। ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেছে এদের সঙ্গে। ভালই হয়েছে। কবজায় যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ছি না। যাও। যথাস্থানে ঢুকিয়ে দাও এদের।”

চোখের পলকে বাবলুরা দেখল শয়তানরা পাজাকোলা করে তুলে ফেলল ওদের। পারল না শুধু পঞ্চুকে ধরতে। বেগতিক দেখে সে যে নিমেষে কোথায় লুকাল তার টেরও পেল না কেউ।

বাবুল বলল, “ছেড়ে দিন। আমরা আপনাদের কী করেছি? আমাদের ছেড়ে দিন।”

মিত্তিরবাবু বললেন, “আমরা যাকে ধরি তাকে ছাড়ি না। আচ্ছা গুড-বাই।”

সেই অন্ধকারে ভাঙা মন্দিরের ভেতরে গিয়ে শয়তানরা ওদের পাঁচজনকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখল কিছুক্ষণ। তারপর এক সময় আবার ওদের তুলে নিয়ে ধাপে ধাপে ক্রমশ নীচের দিকে নামতে লাগল। অনেকটা নামার পর একটা স্যাতসেঁতে ঠান্ডা ঘরের মেঝেয় ওদের নামিয়ে হাত-পায়ের বাঁধন মুক্ত করে দিয়ে চলে গেল ওরা।

ঘরের ভেতর কোথাও কোনও আলো নেই! যা আছে তা হল শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। ঘন অন্ধকার চারদিকে এমনভাবে ঢাকা যে কেউ কারও মুখ পর্যন্ত দেখতে পেল না। ওরা অসহায়ভাবে সেই অন্ধকারে ভূতের মতন বসে রইল পাঁচজনে।

অনেকক্ষণ বসে থাকার পর এক সময় ওরা দেখল দুজন লোক আলো হাতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। হ্যারিকেনের আলো। তাতেই ওরা দেখতে পেল বহুদিনের জরাজীর্ণ মন্দিরের তলদেশের পলেস্তারা খসা একটা গোপন কক্ষে রয়েছে ওরা। বাইরের আলো বাতাস এখানে প্রবেশ করে না। শুধু সিঁড়ির ওপরে যে দরজাটা রয়েছে তারই মাথার ওপর ছোট ছোট পরপর তিনটে ঘুলঘুলি রয়েছে। যার ভেতর দিয়ে বাতাস চলাচল করে।

যে দুজন লোক এল, এদের দু’জনকেই ওরা চেনে। শয়তান চেহারার লোক। এরাই মিত্তিরবাবুর আদেশে ওদেরকে এখানে এনেছে। তাদের একজনের হাতে খাবার, অপরজনের হাতে আলো। যার হাতে খাবার রয়েছে তার অপর হাতে একটা জলের কুজোও রয়েছে। কুজোর মুখে একটা গেলাস ঢাকা।

বাবলু বলল, “তোমরা কেন মিছিমিছি আমাদের ধরে রেখেছ? এখনও বলছি ভাল চাও তো ছেড়ে দাও।”

আলো হাতে লোকটি রক্তচক্ষুতে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, “কথা বলো না। বেশি কথা বলা আমরা পছন্দ করি না।”

বিলু বলল, “কী পছন্দ কর তবে তোমরা? ডাকাতি করতে?”

লোকটা ঝপ করে এক হাতে বিলুর চুলের মুঠি ধরে অপর হাতে ঠাস করে ওর গালে মারল এক চড়। কী দারুণ ওজন সেই চড়ের! বিলুর কান-মাথা যেন ভোঁ ভোঁ করে উঠল।

বিচ্ছু ভয়ে বাচ্চুুকে জড়িয়ে ধরল। ভোম্বল আর বাবলু একটু পিছিয়ে এল। বাবলুর একটা হাত তখন পকেটে ঢুকে গেছে। পিস্তলে একদম গুলি ভর্তি, তৈরি ছিল। হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরল সেটাকে।

যে লোকটার হাতে খাবার ছিল সে খাবার রেখে বলল, “খেয়ে-দেয়ে চুপটি করে শুয়ে থাক সব। কাল সকালে মিত্তিরবাবু এসে যেমনটি বলবেন সেই রকম কাজ হবে। তোমাদের এই পাঁচ-পাচটি ক্ষুদে লাশকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিতে একটুও হাত কাঁপবে না আমাদের।”

বাবলু একবার ভাবল পিস্তলটা বার করে শয়তানদুটোর মাথার খুলি নিমেষে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু তা সে করল না। এদের ঘাঁটিটাকে ভাল করে না জেনে আগেভাগেই গণ্ডগোলটা করে বসা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
লোকদুটো যেমন এসেছিল তেমনি চলে গেল।

বাবলু বিলুকে বলল, “শুধু শুধু গোঁয়ারটার সঙ্গে ফডফড় করতে গেলি কেন?”

বিলু বলল, “ওইটাই ভুল হয়ে গেছে।”

যাই হোক, ওরা আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে খেতে বসে গেল। রুটি আর আলুর দম। এই তো খাবার। খেয়ে ওরা প্রত্যেকে এক গেলাস করে জল খেয়ে নিল। তারপরই শুরু হল ওদের আসল কাজ।

হ্যারিকেন লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে ওরা ঘরের ভেতরটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। বাবলু অবশ্য সর্বাগ্রে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গিয়ে দেখে এল। ওপরের দরজাটা কোনওরকমে ভেতর থেকে খোলা যায় কিনা। কিন্তু না। ঠেলেঠলে বুঝল ও আশা একেবারেই বৃথা! তাই ওরা পাঁচজনে এদিক সেদিক ঘুরেফিরে দেখতে লাগল, পালাবার আর কোনও দ্বিতীয় পথ আছে কিনা।

হঠাৎ এক জায়গা গিয়ে ওরা সবাই থেমে দাড়াল। বাবলু বলল, “শুনছিস ?”

“হু।”

“কাঁসার ঘন্টার শব্দ। বোধহয় কোথাও পুজো আরতি হচ্ছে।”

“কিন্তু এই জঙ্গলে কোথায় হচ্ছে এসব?”

“আমার মনে হয় এই মন্দিরেই কোথাও না কোথাও ডাকাতে কালী আছেন। শয়তানরা তারই পুজো করছে।”

“তা না হয় হল। কিন্তু শব্দটা আসছে কোথা থেকে?”

এমন সয়ম হঠাৎ একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল। ওরা দেখল ছোট্ট একটা আলমারি দেওয়ালের গায়ে আড়াল করা ছিল। তার পিছনটা আলোকিত হয়ে উঠল।

ওরা সকলেই এগিয়ে গেল সেই দিকে। আলোটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। বাবলুর হাতে লণ্ঠন ছিল। তার সাহায্যেই ওরা বুঝতে পারল আলমারিটা সরালেই ওদিকে যাবার রাস্তা পাবে ওরা।

সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে ধরাধরি করে সরিয়ে ফেলল আলমারিটা। আর সেটা সরাতেই ওপাশে যাবার পথ পেয়ে গেল ওরা।

কিন্তু আলো? আলো কই? এখানে যে ঘন অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। যাক। হাতে লণ্ঠনটা তো আছে। তারই সাহায্যে ওরা দেখল খানিক যাবার পর আবার কয়েকটি ধাপ সিড়ি নীচের দিকে নেমে গেছে ক্রমশ।

এমন সময় হঠাৎ এক বিস্ময়। শূন্য থেকে যেন একটা ঢিল অব্যর্থভাবে উড়ে এসে ঠং করে লন্ঠনের কাচে লেগে কাচটাকে চুরমার করে নিভিয়ে দিল আলোটাকে।
ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওদের। কাসর ঘন্টার আওয়াজ এখান থেকে বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সিঁড়ির কাছে আসতেই সেটি দ্বিগুণ হয়ে উঠল।
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ওরা সিঁড়ির কয়েক ধাপ নামতেই দেখল সিড়িটা বাদিকে বেঁকে আরও কয়েক ধাপ নেমে গেছে। আর সেখানেই ওরা সেই ঘন অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোর আভাস পেল।

খুব সন্তৰ্পণে পা টিপে টিপে ওরা কয়েক ধাপ নামতেই দেখতে পেল এক ভয়ংকরী কালীপ্রতিমার সামনে সারি সারি শয়তানরা বসে আছে। দু’জন কাঁসর ঘণ্টা বাজাচ্ছে এবং একজন ভয়ংকর চেহারার কাপালিকের মতো সন্ন্যাসী আরতি করছে সেই দেবী প্রতিমার। খানিক বাদে আরতি শেষ হতেই ওরা দেখল, যে সন্ন্যাসী আরতি করছিল সে তার নকল দাড়ি এবং জটা খুলে রাখল একপাশে।

বাবলু বলল, “উঃ! কী সাংঘাতিক! দেবীর সঙ্গেও ছলনা?”

বিলু বলল, “তোর কাছে তো যন্তর রয়েইছে। দে না সব ব্যাটাকে শুইয়ে।”

বাবলু বলল, “এখনও সময় হয়নি। কিন্তু একটা কথা আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। আলমারির পিছনে আমাদের আলো দেখিয়ে এদিকে যে পথ আছে তার ইঙ্গিত দিল কে? কে আমাদের ঢ়িল ছুড়ে লণ্ঠনের কাঁচ ভেঙে দিল? এবং ভেঙে দিয়ে উপকার করল কে?”

বাবলু বলল, “উপকার করল? অপকার করল বল!”

“না। উপকার করল। আলো হাতে আমরা এখানে এসে পড়লেই শয়তানগুলোর চোখে পড়ে যেতাম।”

বাবলুর কথা শেষ হতে না হতেই ওরা আর এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হল। হঠাৎ শক্তমতো কী একটা জিনিস ঝুপ করে বাবলুর গায়ে এসে পড়ল। আর সেই সঙ্গে সিঁড়ির ওপর দিয়ে লঘু একটা পদশব্দ মিলিয়ে গেল সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারে।

বাবলু জিনিসটা হাতে নিয়ে বুঝল, এটা অন্য কিছু নয়, ন্যাকড়া-জড়ানো ছোট্ট একটা চর্ট। যা এই অসময়ে ওদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। বাবলু বলল, “উঃ! ভগবান সহায়। আমি সব এনেছি। অথচ এই একটি মাত্র জিনিস নিয়ে আসতেই কী সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু কে? কে এই মৃত্যপুরীতে আমাদের এইভাবে সাহায্য করে যাচ্ছে? সে কি কোনও মানুষ না কোনও অশরীরী প্রেতাত্মা?”

প্রেতাত্মার কথা মনে আসতেই ওদের লোম খাড়া হয়ে উঠল। যাই হোক, সিড়িতে বসে বসেই ওরা দেখতে পেল সেই ভয়ংকর চেহারার শয়তানগুলো একে একে চলে গেল ঘর থেকে। ঘরের ভিতর তখন সামান্য একটি মাটির প্রদীপের আলো ছাড়া আর কোনও আলো ছিল না।

ওরা পাঁচ জন এসে মা কালীর সেই ভয়ংকরী মূর্তির সামনে দাঁড়াল। তারপর পিছন দিকে গিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই দেখতে গেল, একটি ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু আলোর রেখা ভেসে আসছে। ঘরের দরজায় শিকল দেওয়া। শিকল খুলে ঘরে ঢুকেই ওরা যা দেখল তাতে বিস্ময়ের আর অবধি রইল না ওদের। ওরা দেখল ঘরের ভেতর বেশ কয়েকটি আশ্চর্য সুন্দর কারুকার্য সমন্বিত স্বর্ণপ্রতিমা সারি দেওয়া আছে। কোনওটি দুর্গা, কোনওটি কালী, শিব, গণেশ, এমনকী আঙ্কোরভাটের অনুকরণে প্রাচীন একটি সোনার বিষ্ণুমূর্তিও রয়েছে সেখানে। যার আর্থিক মূল্য খুব কম করেও কয়েক লক্ষ টাকা তো হবেই।

বাবলু বলল, “এ যে দেখছি অতি সাংঘাতিক ধরনের স্মাগলারদের আড্ডায় এসে পড়েছি আমরা।”

বিলু বলল, “এখান থেকে বেরোবার উপায়?”

“সেটা খুব সাবধানে করে নিতে হবে। তবে কোনও কিছু করবার আগে সর্বাগ্রে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে দীপঙ্কর বোসকে। যাকে উদ্ধার করবার জন্য আমাদের এখানে আসা।”

ওরা আস্তে আস্তে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে খুব সন্তৰ্পণে পা টিপে টিপে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। একটা ঘরের কাছে এসে থমকে দাড়াল ওরা। দেখল ঘরের দরজার সামনে একটা টুলে বসে মূর্তিমান যমের মতো একজন লোক তন্দ্রাবশে ঢুলছে। বাবলু বলল, “এই ঘরে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে, যা পাহারা দিচ্ছে এই শয়তানটা।”

বাবলু এদিক সেদিকে টর্চের আলো ফেলতেই এক জায়গায় দেখতে পেল একটা ভাঙা দরজার খিল পড়ে আছে। সেটা চকিতে তুলে নিয়েই লোকটার মাথায় সজোরে বসিয়ে দিল এক ঘা।

লোকটা ‘ওঁক করে মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দ তুলেই লুটিয়ে পড়ল সেখানে। বাবলু তার ওপর আর এক ঘা দিতেই জ্ঞান হারিয়ে স্থির হয়ে গেল সে।

এ ঘরটাও শিকল দেওয়া ছিল। শিকল খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওরা দেখতে পেল ঘরের মধ্যে জীর্ণ শয্যায় আধশোয়া হয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। ঘরে একটি ছোট্ট চিমনি-লণ্ঠন জ্বলছে।

ভদ্রলোক এদের দেখেই যেন চমকে উঠলেন, “পালাও, পালাও, তোমরা এখান থেকে।”

বাবলু বলল, “আপনি দীপঙ্কর বোস?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিই দীপঙ্কর বোস। কিন্তু তোমরা আমাকে কী করে চিনলে?”

“আপনি সিগারেটের কৌটোয় চিঠি লিখে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ! সে চিঠি তোমরা পেয়েছ নাকি?”

“পেয়েছি, এবং সেই চিঠি পেয়েই আপনাকে উদ্ধার করতে এসেছি।”

“তোমরা কি পাঁচজন আছ?”

“হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন?”

“আমাকে বন্ধু বলেছে।”

“বন্ধু? বন্ধু কে?”

“সে তোমাদেরই মতো একটি ছেলে। এদের একজন সন্ন্যাসী আছে, সন্ন্যাসী ঠিক নয়, সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে থাকে, সে করে কী মাঝে মাঝে দূরে গিয়ে বেশ অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেদের ভুলিয়ে ভালিয়ে চুরি করে নিয়ে আসে। তারপর ছেলেকে ফিরিয়ে দেবার নাম করে তার বাপের কাছ থেকে মোটা টাকা চায়। টাকা হাতে পেলে ছেলেকে ফেরত পাঠায়। না পেলে তাকে মেরে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয়। এই ছেলেটিও সেই রকম একটি ছেলে। ওরই সাহায্যে চিঠি লিখে আমি ওর হাত দিয়ে গঙ্গার জলে কৌটোটা ভাসিয়ে দিয়েছি।”

বাবলু বলল, “এবার বুঝতে পেরেছি এতক্ষণ অলক্ষ্য হতে কে আমাকে সাহায্য করছিল। ওই বন্ধুই নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ। সে তোমাদের পালিয়ে যাবার সুবিধে করতে চাইছিল। কিন্তু চারদিকে এত কড়া নজর যে সে কিছুতেই তোমাদের কাছে যেতে পারছিল না। তবু অলক্ষ্য থেকে যেটুকু করবার সে করেছে।”

“কিন্তু আপনি এখানে কী করে এলেন?”

“আমার ছেলেকে এরা চুরি করে এনেছে, এবং আমার কাছে এরা এক লাখ টাকা দাবি করেছে। সে টাকা আমি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এদের অন্য জায়গায় অস্থায়ী ঘাটিতে এদেরই নির্দেশমতো যাই। তারপর ছেলেকে সেখানে আগে দাবি করে তারপর টাকা দেব, এই কথা বলতে ওরা আমাকে এখানে বন্দি করে রেখেছে এবং প্রতিদিন অকথ্য অত্যাচার করছে।”

বিলু বলল, “আপনার ছেলে কোথায়?”

“বন্ধু জানে। আমি এখানকার কিছুই জানি না। বন্ধু এদের কয়েকজনকে একটু বশ করে ফেলেছে। তাই এখানকার অনেক কিছুই সে জানতে পেরেছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও এর বাইরে যেতে পারেনি সে। কেন না এর ভেতরে যেমন তেমন, বাইরেই পাহারা বেশি।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা, আপনি যে লিখেছিলেন গঙ্গার ধারের সুড়ঙ্গের কথা তা সেটা কোন দিকে?” বলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল বছর চোদ্দো-পনেরোর একটি হাফ-প্যান্ট পরা ছেলে ছুটে ঘরে এসে ঢুকল। দীপঙ্করবাবু বললে, “এই তো বন্ধু।”

বন্ধু বলল, “ও! তোমরা এখানে এসে গেছ?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ।”

বন্ধু বলল, “একেবারে পাঁচ-পাঁচজন এদের খপ্পড়ে পড়লে কী করে?”

বাবলু বলল, “যেমন করেই হোক পড়েছি। কিন্তু এখান থেকে কী করে পালাই বলো তো?”

“এখান থেকে পালাবার কোনও পথই নেই। থাকলে আমরাই কবে পালাতাম।”

বিলু বলল, “কিন্তু তুমি এদের কী করে বশ করলে ভাই?”

“সে অনেক কৌশলে। এদের খাওয়া-দাওয়ায় আমার মন ওঠে না বলে আমি এদের বলেছি, তোমাদের এখানে চাকরের মতো খেটে সব কাজ করে দেব। পালাবার চেষ্টা করব না। বিনিময়ে ভাল করে পেট ভরে খেতে দিতে হবে। ওরা রাজি হলে আমি মন দিয়ে ওদের কাজ করে দিই। ওরা আমাকে বিশ্বাস করে, তাই।”

বন্ধু বলল, “এই ঘরের বা দিকের রাস্তাটাই সেই সুড়ঙ্গ। কিন্তু জেনে লাভ কী ভাই?”

“আমাদের যে কোনও একজন জলপথে পালাবে।”

বন্ধু বলল, “খবরদার! অমন কাজটি কোরো না। গঙ্গার মাঝিমাল্লাদের ভেতরেও এদের লোক অনেক আছে। আশপাশের গ্রামের লোকও কেউ কেউ দলে আছে এদের। আর সাঁতার কেটে যে পালাবে সেও সম্ভব নয়। এখানকার জলের টান সাংঘাতিক।”

বাবলু বলল, “তুমি আমাদের চেনো না বন্ধু, তাই একথা বলছ। এরই ভেতর দিয়ে আমরা পালাব। প্রথমে ডুব সাঁতারে গঙ্গার ধারে ধারে রাতের অন্ধকারে যতটা পারি যাব। তারপর গঙ্গার পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে গিয়ে কাছের কোনও শহরে অথবা যেমন করেই হোক কলকাতায় চলে যাব। আর, একবার যদি পেরোতে পারি তারপর দেখবে কী অবস্থা করি এদের।”

বন্ধু বলল, “পারবে? পারবে ভাই যেতে?”

“নিশ্চয়ই পারব।”

“তা হলে চলো। এখনই উপযুক্ত সময়। গঙ্গায় এখন ভাটা পড়েছে। চলে এসো। কে যাবে?” ভোম্বল বলল, “আমি। আমি যাব। আমাদের দলে প্রত্যেকের চেয়ে সাঁতরে আমি বেশি ওস্তাদ।”

“তা হলে এসো।”

বন্ধুর সঙ্গে ভোম্বল সুড়ঙ্গ পথে চলে এসে টুপ করে গঙ্গার জলে ডুব দিল। তারপর রাতের অন্ধকারে মাছের মতো সাতার কেটে, কখনও ডুবে, কখনও ভেসে, অনেক দূর চলে এল।

বেশ কিছুদূর আসার পর মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল ভোম্বল। ভাগ্যক্রমে সেখানে একটা পেট্রল পাম্প ছিল এবং কলকাতাগামী একটা মাল-বোঝাই লরি ডিজেল নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ভোম্বল চুপি চুপি পিছন দিক দিয়ে সেই লরিতে উঠে লরির মাথায় শুয়ে রইল।

মালবাহী লরি দ্রুতগতিতে চলল কলকাতার দিকে।

ভোম্বল চলে যাবার পরই বাবলুরা করল কী, বন্ধুর সঙ্গে দীপঙ্করবাবুর ছেলেকে উদ্ধার করতে চলল। দীপঙ্করবাবু নিজেও চললেন। ঘরের সামনে যে লোকটার মাথায় ঘা মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিল বাবলুরা, সেই লোকটাকে সকলে মিলে চ্যাংদোলা করে ঘরে ঢুকিয়ে শিকল দিয়ে দিল। তারপর সবাই চলল বন্ধুর সঙ্গে দীপঙ্করবাবুর ছেলেকে উদ্ধার করতে। ওরা সন্তৰ্পণে মা কালীর মূর্তির পিছনে এসে দাড়াল। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ থেকে সবাই পা টিপে টিপে সামনের দিকে এগোতে লাগল।

বন্ধুর হাতে তখন লম্বা একটা শনের দড়ি। বাবলু বলল, “দড়ি কী করবে?”

বন্ধু বলল, “এই দড়িটার কেরামতি সময়কালেই দেখতে পাবে।”

ওরা আস্তে আস্তে সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠল। সেই পুরনো জায়গা। যেখানে বন্ধু ওদের টর্চ দিয়ে সাহায্য করেছিল। তারপর সেই ঘরের আলমারিটার কাছে এল। যেখানে বাবলুরা বন্দি হয়েছিল প্রথমে।

বন্ধু বলল, “আলমারিটা আর একটু সরাও।”

সবাই মিলে ধরাধরি করে সরাল সেটাকে। বন্ধু বলল, “টচটা আমাকে দাও এবার।”

বাবলু টর্চটা ওর হাতে দিল। বন্ধু টর্চের আলো নীচে ফেলতেই ওরা দেখতে পেল নীচের মেঝেয় একটা আংটাওয়ালা কাঠের পাল্লা রয়েছে।

ওরা সবাই মিলে সেটাকে তুলতেই দেখতে পেল একটা সিড়ি আরও নীচের দিকে নেমে গেছে ক্রমশ বন্ধু বলল, “এর ভেতরেই ওরা আছে।”

সত্যিকারের নরক বলতে যদি কিছু থাকে তা এই জায়গাটা। বাবলুরা নামতে যাচ্ছিল। বন্ধু বলল, “না। শুধু দীপঙ্করবাবু যান এবং যারা যারা এর ভেতরে আছে সবাইকে নিয়ে আসুন।”

দীপঙ্করবাবু সবে নীচে নেমেছেন এমন সময় দেখা গেল ওপর দরজায় সিঁড়ির মুখে সাক্ষাৎ যমের মতো মিত্তিরবাবু এসে দাঁড়ালেন। মিত্তিরবাবুর হাতে আলো ছিল। তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা বাবলুদের দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন, “আরে! ছেলেমেয়েগুলো সব গেল কোথায়?” বলেই এদিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।

বন্ধু বলল, “সেরেছে! গোলমাল বাধবে এবার।”

বাবলু বলল,“কুছ পরোয়া নেই।” বলেই তার পায়ের জুতোটা খুলে মিত্তিরবাবুর হাতের লন্ঠনের কাঁচ

লক্ষ্য করে ছুড়ে বসল। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ।

লণ্ঠন ছিটকে চলে গেল হাত থেকে। অন্ধকারে দিশেহারা হয়ে গেলেন মিত্তিরবাবু। বাবলু আর বিলু তখন এক লাফে ঝাপিয়ে পড়ে মিত্তিরবাবুকে ধরাশায়ী করে একেবারে বুকের ওপর চেপে বলল। ততক্ষণে দীপঙ্করবাবু তার নিজের ছেলে এবং আরও জনা দশেক ছেলেমেয়েকে উদ্ধার করে উঠে এসেছেন ওপরে।

চর্টের আলোয় সব দেখেই তো চক্ষুস্থির। মিত্তিরবাবুর কণ্ঠনালির কাছে বিলু ছুরিটা এমনভাবে ধরে আছে যে টু শব্দটি করতে পারছেন না মিত্তিরবাবু।

বন্ধু বলল, “এইবার তোমরা আমার দড়ির ম্যাজিক দেখো। এই বলে দীপঙ্করবাবুর সাহায্যে বেশটি করে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল মিত্তিরবাবুকে।

বাবলু বলল, “ব্যস। এরপর যা যা করতে হবে তা আমিই করব।”

বিলু বলল, “কী করবে ?”

“প্রথমে দীপঙ্করবাবু এই ঘরের পিছন দিকে চলে যান।”

বাবলুর কথামতো তাই হল। দীপঙ্করবাবু পিছন দিকে চলে গেলেন। বাবলু আর বিলুমিত্তিরবাবুকে নিয়ে দীপঙ্করবাবুর কাছে রেখে এল।

বাচ্চু-বিচ্ছু রইল এক কোণে নিরাপদ ব্যবধানে। বাবলু বলল, “আমার কাছে খানিকটা দড়ি আছে। এই দড়ি নিয়ে বাইরে যাবার সিড়ির মুখে একদিকে বাচ্চ-বিচ্ছু এবং অপর দিকে আমি বসে থাকব। বাইরে থেকে কেউ ভেতরে ঢুকলেই দড়িটা এমনভাবে তুলে ধরব যে ব্যাটা যাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে জখম হয়। বিলু, তুই করবি কী তোর ছুরিটা নিয়ে অন্ধকারে মিশে থাকবি, আর টর্চের আলোয় যে যাবে তাকে পথ দেখাবি। আর এখানে দীপঙ্করবাবু মিত্তিরবাবুর পেটের কাছে একটা ছুরি ধরে বসে থাকবে, যাতে আমাদের কথামতো বুলি আওড়াতে মিত্তিরবাবু বাধ্য হন।”

দীপঙ্করবাবু বলল, “মিত্তিরবাবুকে কী বলতে হবে?”

“উনি শুধু বলবেন, আমরা আক্রান্ত। সবাই তাড়াতাড়ি গোপন সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে। অর্থাৎ কি না নরকের ঘরে যাদের ধরে এনে পুরে রেখেছিলেন তাতেই ঢুকে পড়তে বলবেন। আর বন্ধু, তুমি করবে কী ওপরের সিড়ির বাইরে গিয়ে এদের দলের সবাইকে বলবে যে বিশেষ দরকারে মিত্তিরবাবু এখনই ডেকেছে। যাও। দেরি কোরো না।”

বাবলুর কথামতো সবাই যে যার ভূমিকায় অবতীর্ণ হল। বন্ধু একবার বাইরে গিয়ে খবর দিয়েই চলে এল। বন্ধু এলে বাবলু বলল, “বন্ধু! দড়ির একদিকে বাচ্চু-বিচ্ছু ধরেছে, আর অপর দিকটা বরং তুমি ধরো। তোমরা তো পিস্তল চালাতে পারবে না। আমি পারি। আমি পিস্তল নিয়ে থাকি। বেগতিক দেখলেই গুলি চালাব।”

বন্ধু তাড়াতাড়ি দড়ি ধরে অন্ধকারে সিঁড়িতে নামার মুখে বসে রইল। ওদিকের দড়ি শক্ত করে ধরে রইল বাচ্চু আর বিচ্ছু।

বাবলু এক কোণে পিস্তল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আর বিলু করল কী, অন্ধকারে মেঝের ওপর বসে টর্চটা জ্বেলে একেবারে নরকের গর্তের নীচে নামার সিঁড়ির মুখে ধরে রইল। যাতে একমাত্র এই অন্ধকারে সিড়ির পথটুকু ছাড়া শয়তানরা আর কিছু দেখতে না পায়। ওদিক থেকে দীপঙ্করবাবুর ছুরির ফলার ভয়ে মিত্তিরবাবুও সমানে বলে চললেন, “আমরা আক্রান্ত। তোমরা লুকিয়ে পড়ো।”

বন্ধুর মুখে খবর পেয়েই শয়তানগুলো আসতে শুরু করল এক এক করে। তারপরেই শুরু হল ম্যাজিকের খেলা। বাইরে থেকে এসে অন্ধকার সিঁড়িতে নামার মুখেই দড়িতে পা জড়িয়ে অমন বিশাল বিশাল বপুগুলো গাছ পড়ার মতো পড়তে লাগল ধুপধাপ করে। অতটা উঁচু থেকে পড়ে প্রত্যেকেই বেশ রীতিমতো জখম হল। কারও হাত ভাঙল, কারও পা ভাঙল, দাঁত মুখ থেতো হল। কারও বা মাথা ফাটল। তারপর অতি কষ্টে উঠে মিত্তিরবাবুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আলো লক্ষ্য করে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নরকের ঘরে। মিত্তিরবাবু যে কোথায় বসে আদেশ দিচ্ছেন তাও কেউ দেখতে পেল না। আর কে যে আলো দেখাচ্ছে তাও কেউ জানতে পারল না। শুধু বিপদ শুনে আদেশ মতো কাজ করে গেল সকলে।

বাবলুর পিস্তল থেকে একটি গুলিও খরচা করতে হল না অযথা, সব কটাকে ভেতরে ঢুকিয়ে মিত্তিরবাবুকে নিয়ে এসে ধাক্কা মেরে ভেতরে ফেলে দিল ওরা। তারপর ওপরের পাল্লাটা চাপা দিয়ে একটা ছিটকিনি ছিল, সেটা এঁটে দিল।

বাবলু বন্ধুকে বলল, “আর কেউ আছে নাকি?”

বন্ধু বলল, “না। আর কেউ নেই। এখন আমরা একেবারে মুক্ত।”

দীপঙ্করবাবু বাবলুকে আর বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও তখন বাবলুকে ধন্যবাদ জানাল। বিশেষ করে বিচ্ছুর মুখে ওরা যখন শুনল যে, ওরা আসলে সেই বিখ্যাত পাণ্ডব গোয়েন্দা, তখন তো আনন্দের অবধি রইল না ওদের।

বাবলু বলল, “এসো। এখন আমরা সর্বাগ্রে আমাদের পঞ্চুকে খুঁজে বার করি।”

এতক্ষণে সবাই বাইরে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচল। বাবলু ডাকল, “পঞ্চু! এই পঞ্চু!”

অনেক দূর থেকে অমনি পঞ্চর গলা ভেসে এল, “ভৌ-উ-উ৷”

বাবলু আবার ডাকল। পঞ্চু আবার উত্তর দিল। কিন্তু বাবলুর ডাকে কাছে এল না সে। বাবলু বলল, “এগিয়ে গিয়ে দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা কী? নিশ্চয়ই পঞ্চ কোনও বিপদে পড়েছে।” ওরা সবাই টর্চের আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলল। কিছু দূর গিয়েই ওরা দেখতে পেল একজন লোক তালগাছের খানিক উঠে গাছটা জড়িয়ে ধরে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। পঞ্চুর জন্য নীচে নামতে পারছে না, আর পঞ্চু তাকে দেখে গরর গরর করছে।

বাবলু বলল, “আরে, এখানে এক ব্যাটা রয়ে গেছে রে?”

বন্ধু লোকটাকে ভাল করে দেখে বলল, “না, এ এদের লোক নয়।”

লোকটা ওদের দেখে বলল, “এই কুকুরটাকে দয়া করে তাড়ান বাবুরা। আমি এইখানে আটকে আছি।”

বাবলু বলল, “কে তুই?”

“আজ্ঞে আমি লকাই। তালের রস চুরি করতে এসেছিলাম। আমি কথা দিচ্ছি বাবু আর কখনও এখানে আসব না।”

বাবলু পঞ্চুকে ডেকে নিতেই লোকটা গাছ থেকে নেমে দৌড়। ওরা আবার মন্দিরে ফিরে এল। আকাশ তখন ফরসা হয়েছে। ভাল করে সকাল হবার আগেই দেখা গেল দশ বারোটা পুলিশ নিয়ে ভোম্বল এসে হাজির। দলকে দল সবাই ধরা পড়ল।

লক্ষ লক্ষ টাকার সোনার মূর্তিগুলোও উদ্ধার করা হল। দারোগাবাবু বললেন, “সত্যি। তোমরা আবার একটা মস্ত কাজ করে ফেললে। তোমরা যাতে মোটামুটি রকমের পুরস্কার একটা পাও আমি সেই ব্যবস্থা করছি এবার।”

ওরা সবাই বিজয় গর্বে লঞ্চে উঠল। গঙ্গার জল তোলপাড় করে ছুটে চলল পুলিশের লঞ্চ। লঞ্চ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দীপঙ্করবাবু বলে উঠলেন, “থ্রি চিয়ার্স ফর পাণ্ডব গোয়েন্দা।” কেউ কিছু বলার আগেই পঞ্চ ডেকে উঠল, “ভৌ। ভৌ ভৌ।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *