০১. মিত্তির বাড়ির রহস্য

পাণ্ডব গোয়েন্দা – প্রথম অভিযান : মিত্তির বাড়ির রহস্য / ষষ্টীপদ চট্টোপাধ্যায়

বাবলু, বিলু, ভোম্বল তিনটি ছেলে। বাচ্চুু-বিচ্ছু দুটি মেয়ে। এই নিয়ে ওরা পাঁচজন। আর ওদের সঙ্গে আছে কালো একটি দেশি কুকুর, নাম পঞ্চু। কুকুরটির এক চোখ কানা বলে ওকে ওরা কানা-পঞ্চু বলে। আর লোকে ওদের বলে পঞ্চপাণ্ডব।

এই পাঁচটি ছেলেমেয়ে এবং ওই কালো কুকুরটি একজোটে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। এই ক’জনে কেউ কাউকে ছাড়া থাকে না। যেমনই দস্যি, যেমনই ডানপিটে আর তেমনই লেখাপড়ায়।

গ্রীষ্মের ছুটির এক দুপুরে ওরা পাঁচজনে পঞ্চুকে নিয়ে মিত্তিরদের বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঘুরতে ঘুরতে পোড়ো ভাঙা একটা বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। বাড়িটা দোতলা। একদিকের ছাদ নেই। একদিকের দেওয়াল ধসে পড়েছে। একদিকের ছাদে ছোট ছোট বটগাছ, অশ্বখগাছ ইত্যাদি গজিয়েছে। বাড়ির ভেতর আর বাইরেটায় ঘন ঘাস আগাছা ইত্যাদির বন হয়ে আছে। একটা মস্ত গুলঞ্চগাছ তার শাখা-প্রশাখা নিয়ে বুকে আছে বাড়ির ভাঙা দালানের গায়ে।

ওরা পাঁচজনে সেইখানে এসে বসল।

বাবলু প্যান্টের পকেট থেকে বার করল দুটাে কাচা আম। বিলুর সঙ্গে ছিল নুন আর লঙ্কা। ভোম্বলের কাছে ছিল ছোট একটা ছুরি। তাই দিয়ে আমটাকে কুচি কুচি করে নুন লঙ্কা মাখিয়ে বেশ জুতসই একটা চিজ তৈরি করে ফেলল ওরা।

বাচ্চু আর বিচ্ছু মেয়েদুটি নেহাতই ছোট বলে ওরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল।

যখন ভাগ হল তখন সবার ভাগেই সম পরিমাণ পড়ল। বাচ্চু-বিচ্ছু ছোট বলে যে ওদের ভাগে কম পড়ল তা কিন্তু হল না।

আমের কুচি খেয়ে বিলু আর ভোম্বল সেই আঁকা-বাঁকা গুলঞ্চগাছের ডালে উঠে ঠেস দিয়ে বসে রইল।

বাচ্চু-বিচ্ছু শুয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল ঘাসের ওপর।

আর বাবলু করল কী পঞ্চুর সামনেকার পাদুটো ধরে তাকে নিয়ে নানারকম কেরামতি করতে লাগল। পঞ্চুর সঙ্গে খেলা করতে করতেই বাবলুর মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। যেই না আসা বাবলু অমনই নিজের মনেই হাতে টুসকি দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”দ্যাটস আইডিয়া।”

বিলু-ভোম্বল টুপটাপ করে গাছের ডাল থেকে নেমে পড়ল।

বাচ্চু-বিচ্ছুও শোওয়া ফেলে গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে বসল ঘাসের ওপর।

পঞ্চুও তাকাল বাবলুর মুখের দিকে।

বাবলু চোখদুটো উজ্জ্বল করে বলল, “একটা চমৎকার প্ল্যান এসেছে মাথায়।”

ভোম্বল বলল, “কীসের প্ল্যান ?”

“অ্যাডভেঞ্চারের।”

বিলু বলল, “মাথা খারাপ। এই মিত্তিরদের বাগানে বসে অ্যাডভেঞ্চার করা যায় নাকি?”

“সাহস থাকলে ঠিকই যায়।”

ভোম্বল বলল, “তা ছাড়া অ্যাডভেঞ্চারের একটা পরিবেশ তো চাই।”

“কী করে নিবি?”

“যেখানেই রহস্যের গন্ধ পাব সেখানেই ছুটে যাব আমরা।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কাজটা কিন্তু খুব কঠিন।”

বাবলু বলল, “হোক কঠিন। চেষ্টা তো করব।”

বিলু বলল, “এ তা হলে এক ধরনের শখের গোয়েন্দাগিরি হবে, কী বল?”

“ঠিক তাই।”

ভোম্বল বলল, “মন্দ নয়। দেখাই যাক না একটু চেষ্টা করে?”

বিলু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বাবলুর পিঠ চাপড়ে বলল, “হ্যাঁ হ্যা, লেগে পড়। জয় মা কালী। তার ওপর তুই যখন আমাদের লিডার তখন আর ভাবন কী?”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “ওঃ কী দারুণ মজা!”

সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “হিপ হিপ হুরর রে।”

পঞ্চুও অমনই আনন্দে ডেকে উঠল, “ভৌঁ ভৌঁ ভোঁ।”

বাবলু পঞ্চুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুইও আমাদের দলে থেকে সাহায্য করবি। পারবি তো?”

পঞ্চু ডাকল, “ভৌ ভোঁ।”

বাবলু বলল, “এবার কিন্তু আমাদের এই গ্রুপটার একটা নাম দিতে হবে। এবং এই বাগানেই এই পোড়ো বাড়ির ভেতরেই ঘাঁটি হবে আমাদের।”

বিলু বলল, “কী নাম দিবি দলটার?”

ভোম্বল বলল, “সবাই যখন আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলে তখন আমাদের দলের নামও তাই হবে। পঞ্চপাণ্ডব অ্যান্ড কোং।”

বাবলু বলল, “তুই একেবারে রাম বুদ্ধ। অ্যান্ড কোং আবার হয় নাকি?”

বাচ্চু বলল, “তুমিই বলো বাবলুদা।”

বিচ্ছু বলল, “শুধু পঞ্চপাণ্ডব নামটা কেমন?”

বাবলু বলল, “না। নামটাকে আরও একটু মডার্ন করতে হবে। আমাদের দলের নাম হবে পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

বাচ্চুু-বিচ্ছু চেঁচিয়ে বলল, “ওয়ান্ডারফুল।”

ভোম্বল বলল, “আমি এখনই আমাদের পাড়ার ঘ্যাঁচাদাকে দিয়ে একটা সাইনবোর্ড করিয়ে আনছি। যাতে লেখা থাকবে আমাদের দলের নাম পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

বাবলু বলল, “সেই ভাল। আজ থেকেই তা হলে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যাক। ভোম্বল, তুই সাইনবোর্ড তৈরি করগে যা। আমরা ততক্ষণে ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলি।”

ভোম্বল চলে গেল।

বিলু বলল, “ঘর তো পরিষ্কার করবি। কিন্তু একটা ঝাঁটা তো চাই। তারপর জল ছিটোবার জন্যে চাই একটা বালতি।”

বাবলু বলল, “ঝাঁটা না হলেও চলবে। কালকাসুদের ঝাড় দিয়ে ঝাঁটা বানিয়ে নেব। কিন্তু বালতি কোথায় পাব?”

বাচ্চু বলল, “কী করে আনবি? মা যদি দেখতে পায়?”

“সে আমি ঠিক নিয়ে আসব লুকিয়ে।” এই বলে বিচ্ছু চলে গেল।

ততক্ষণে বাবলু, বিলু আর বাচ্চু ঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেছে।

একটু পরে বিচ্ছু বালতি নিয়ে ফিরে এলে সেই বালতি করে পাশের পুকুর থেকে জল এনে ঘরময় ছেটানো হল।

ভোম্বলও ফিরে এল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। ওর হাতে চমৎকার একটি সাইনবোর্ড। যাতে লেখা “পাণ্ডব গোয়েন্দা”। সেই বোর্ডটা ওরা ভাঙা বাড়ির দেওয়ালে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দিল।

দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে এল।

কাজেই ওরা আর কেউ রইল না সেখানে।

পঞ্চুকে নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেল।

রাত্রিবেলা বাচ্চু আর বিচ্ছু পাশাপাশি শুয়েছিল। দু”জনেই ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। এমন সময় গুমোট গরমে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল বিচ্ছুর। বিছানায় শুয়ে তাই এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। দুপুরবেলার ঘটনাগুলোও মনে আসতে লাগল সব।

হঠাৎ মনে পড়ল, আরে! পলিথিনের বালতিটা তো সেই ভাঙা বাড়িটার ভেতরেই ফেলে রেখে এসেছে। সেটা তো আনা হয়নি।

মনে পড়তেই বুকটা ধড়াস করে উঠল।

কেন না কাল সকালে যখন বালতির খোঁজ পড়বে তখন যদি মা বালতি না পান তা হলেই সব ফাঁস হয়ে যাবে। আগে তো দুম দাম করে ঘা কতক দিয়েই দেবেন ওকে, তার পরে অন্য কথা।

বিচ্ছু যে কী করবে কিছু ভেবে পেল না।

পাশ ফিরে দেখল বাচ্চুু অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

রাত এখন কত তাই বা কে জানে ?

বিচ্ছুর মনে হল বাচ্চুকে একবার ডাকে। কিন্তু কেন কে জানে ওর এই আরামের ঘুমটা নষ্ট করতে খুব মায়া হল বিচ্ছুর। তাই বার বার উশখুশ করতে লাগল। তারপর একবার ডাকব কি ডাকব না ভাবতে ভাবতে মৃদু একটু টিপনি দিয়ে ডেকেই ফেলল বিচ্ছু,”এই দিদি। দিদি?”

“শোন।”

বাচ্চুুর ঘুম ভেঙে গেল। তবুও সে তন্দ্রা জড়ানো গলায় বলল, “কী?”

“শোন না ভাল করে।”

বাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “বল না কী বলছিস ?”

“একটা খুব ভুল হয়ে গেছে রে।”

বাচ্চুু এবার চোখ মেলল, “কী হয়েছে?”

“বালতিটা সেখানেই পড়ে আছে। নিয়ে আসা হয়নি।”

ঘুমের ঘোর ক্ষণিকের জন্য কেটে গেল বাচ্চুুর। বলল, “কী হবে তা হলে ?”

“তুই বল না কী হবে? মা সকালবেলা বালতি দেখতে না পেলে খুব বকবে। তা ছাড়া মায়ের রাগ জানিস তো? আগেই মেরে দেবে দুম দাম করে।”

“মারবার আগেই তুই কেঁদে দিবি। তা হলে কিছু হবে না।” বলে পাশ ফিরে শুল বাচ্চুু।

বিচ্ছু বলল, “বালতিটা যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়?”

“যায় যাবে। যেমন নিয়ে গেছিস তুই বুঝবি এবার ঠ্যালা।”

বিচ্ছুর খুব ভয় হল এবার। সে ভয়ে ভয়ে বলল, “তুই একবার আমার সঙ্গে যাবি রে দিদি?”

বাচ্চুু অবাক হয়ে বলল, “কোথায়!”

“সেইখানে।”

“তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! এই রাত্তিরে সেখানে আবার কেউ যায় নাকি?”

“বালতি না পেলে কাল সকালে কী কাণ্ডটা হবে বুঝতে পারছিস তো।”

“যা হয় হবে। এখন চুপ চাপ শুয়ে থাক দিকি। আমার ঘুম পাচ্ছে।” এই বলে বাচ্চু পাশ ফিরে শুল।

বিচ্ছু আর কী করে সেও চুপ করে শুয়ে রইল একপাশে। শুয়ে রইল কিন্তু ঘুম এল না। একটা দুশ্চিন্তা বার বার ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। সে শুয়ে শুয়ে শুধু সেই বালতিটার কথাই ভাবতে লাগল। তারপর একসময় যখন পাশে শুয়ে-থাকা বাচ্চুুর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল তখন বুঝল বাচ্চু বেশ গভীর ঘুমেই মগ্ন হয়ে গেছে।

বিচ্ছু ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছে।

সে আর বাচ্চুুকে কোনওরকম বিরক্ত না করে চুপি চুপি উঠে বসল। তারপর আস্তে আস্তে দরজার কাছে গিয়ে খিলটা খুলে নেমে এল রাস্তায়।

রাস্তায় নেমে চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখল বিচ্ছু। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু লাইট পোস্টের আলোগুলো সেই ঘন অন্ধকারের যবনিকায় ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

বিচ্ছু পায়ে পায়ে বাবলুদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। বাবলুদের বাড়ির কাছে আসতেই দেখতে পেল বাবলুদের রকে বেশ খোশ-মেজাজে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে পঞ্চু।

পঞ্চুু শুয়ে শুয়ে এক চোখে পিট পিট করে একবার দেখে নিল বিচ্ছুকে। তারপর বিচ্ছু ডাকবার আগেই আনন্দে লাফিয়ে লেজ নেড়ে নেড়ে ছুটে এল বিচ্ছুর কাছে। এই অসময়ে বিচ্ছুর সঙ্গটা ওর কাছে সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। পঞ্চু একবার বিচ্ছুর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেয়ে কুই কুই করতে লাগল।

বিচ্ছু পঞ্চুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “চল পঞ্চু। তোতে আমাতেই যাই। সেই ভাঙা বাড়িতে গিয়ে বালতিটা নিয়ে আসি।”

পঞ্চু কী বুঝল কে জানে, এই রাতদুপুরে একটা অভিযানের গন্ধ পেয়েই বুঝি সারা গা ঝাড়া দিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়াল।

বিচ্ছু পঞ্চুকে নিয়ে এগিয়ে চলল মিত্তিরদের বাগানের দিকে। রাতের অন্ধকারে বাগানের এক কোণে ভাঙা বাড়িটা যেন প্রেতপুরীর মতো থমথম করছিল। একে রাত্রির অন্ধকার। তার ওপর ছায়া ছায়া কালো গাছপালাগুলো দেখলে বুকের ভেতরটা যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। নেহাত পঞ্চু রয়েছে তাই। না হলে এই অন্ধকারে একা আসতে বিচ্ছুর সত্যিই খুব ভয় করত। ‘

অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বিচ্ছু আর পঞ্চু নিঃশব্দে বাগান পার হয়ে সেই ভাঙা বাড়িতে গিয়ে জুটল। ঘরের ভেতরটা তখন ঘন অন্ধকারে ঢাকা ছিল বলে বালতিটা যে ঠিক কোনখানে আছে তা দেখতে পেল না বিচ্ছু।

আর পঞ্চুও ঠিক বুঝতে পারল না বিচ্ছুর এখানে কীসের জন্য আসা। বিচ্ছু অনেকক্ষণ ধরে এদিক সেদিকে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল বালতিটাকে। এমন সময় সিঁড়ির ওপর থেকে হঠাৎ এক জোরালো টর্চের আলো ওর মুখে এসে পড়ল। আর কে যেন একজন গম্ভীর গলায় বলে উঠল, “কে রে তুই?”

সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চুও ক্রুদ্ধ গলায় চিৎকার করে উঠল, “ভৌ ভৌ। ভৌ-উ-উ।” তারপরই আলো লক্ষ্য করে তীরের মতো ছুটে গেল সে।

বিচ্ছু তখন ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারল না রাতদুপুরে এই লোকটা কে? পঞ্চু ছুটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয়ে কেঁদে উঠল। বিচ্ছুর কান্না শুনে ওর কোনও বিপদ হয়েছে মনে করেই লোকটাকে ছেড়ে পঞ্চুু আবার ছুটে এল ওর কাছে। আর ঠিক তখনই মনে হল কে বা কারা যেন ছাদের ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে বাগানের দিকে লাফিয়ে পড়ল।

পঞ্চুুকে পেয়ে বিচ্ছুর মনে আবার সাহস ফিরে এল। সে তখন কোনওরকমে বালতিটা খুঁজে নিয়ে পঞ্চুর সঙ্গে বাড়ির দিকে দৌড়-দৌড়-দৌড়।

পরদিন সকালবেলা বাচ্চুুকে সব কথা খুলে বলল বিচ্ছু। কাল রাতে সে আর পঞ্চু কীভাবে গিয়েছিল। কী দেখেছিল সব বলল।

সব শুনে বাচ্চুু চোখদুটো বড় বড় করে বলল, “বলিস কী রে! ভয় করল না তোর?”

বিচ্ছু বলল, “না। ভয় আবার কী?”

“উঃ। তুই সত্যিই বিচ্ছু। আমি হলে তো ভয়েই হার্টফেল করতাম। এই অন্ধকারে রাতদুপুরে একা একা, বাপ রে ; “

বিচ্ছু বলল, “তবে ভয় যে করেনি তা নয়। আলোটা যখন মুখের ওপর এসে পড়ল তখন খুব ভয় হয়েছিল।”

“কী মনে হয়েছিল?”

“আমি ভূত মনে করেছিলাম।”

বাচ্চু বলল, “না না। ভূত নয়। ভূত হলে টর্চ ব্যবহার করত না। এ নিশ্চয়ই চোর ডাকাতের ব্যাপার।”

“তাই বলেই মনে হয়। এখন তা হলে কী করা যায়?”

“ব্যাপারটা বাবলুদাকে জানানো উচিত। আমি একবার বাবলুদার কাছে যাই। তারপর বাবলুদা যা ডিসিশন নেবে তাই হবে।”

“ঠিক। তুই তা হলে এখনই যা।”

বাচ্চু চলে গেল।

দুপুরবেলা মিত্তিরদের বাগানে সেই ভাঙা বাড়িতে গিয়ে জমায়েত হল সকলে। বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু এবং পঞ্চু। কেউ বাদ গেল না।

বিচ্ছু ধীরে ধীরে গতরাত্রের ঘটনাটা সবিস্তারে খুলে বলল।

শুনে তো অবাক সকলে ।

বাবলু বলল, “আমি বিচ্ছুর এই দুর্দান্ত সাহসের প্রশংসা করি।”

বিলু বলল, “কিন্তু এইরকমই যদি হয়ে থাকে তা হলে এর পরেও কি আমাদের এখানে ঘাটি গাড়াটা ঠিক হবে ?”

ভোম্বল বলল, “আলবত হবে। এমন নিরিবিলি জায়গা আর কোথায় পাব বল? তা ছাড়া এই বাগানে যাতায়াত তো আমাদের একদিনের নয়।”

বিলু বলল, “সে কথা ঠিক। কিন্তু কাল রাত্রে যা হয়ে গেল তার পরে-।”

বাবলু বলল, “দেখ, ভীতু ছেলের মতো কথা বলিস না। পাণ্ডব গোয়েন্দারা ভীতু নয়। এইটাই প্রমাণ করতে হবে। আমাদের ঘাটি এখানেই থাকবে। এবং সময় পেলেই আমরা এখানে এসে জড়ো হব। যাক, যে জন্য আমরা, মানে আমাদের এই পাণ্ডব গোয়েন্দা তার উদবোধন আজই হবে। আজ থেকেই শুরু হবে আমাদের কাজ। আজ রাত বারোটার সময় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে তখন আমাদের বাড়ির লাইটপোস্টের নীচে এসে দাঁড়াবি তোরা। সেখান থেকেই দলবেঁধে আমরা এখানে আসব। তবে পঞ্চুকে এবারে আমাদের সঙ্গে নেব না। কেন না যদি ভৌতিক ব্যাপার হয়, তা হলে কুকুরে ভূত চেনে। ও ব্যাটা চেঁচিয়েই সব মাটি করে দেবে। “

বিলু বলল, “কিন্তু আমার মনে হয় পঞ্চুু আমাদের সঙ্গে থাকলে ভালই হত।”

বাবলু বলল, “না।”

সেই না শুনে পঞ্চু অমনি মুখ উঁচিয়ে প্রতিবাদ করে উঠল, “ভৌ ভোঁ।”

বাবলু বলল, “না পঞ্চু। আমাদের আজকের এই অভিযানে তোমাকে আমরা সঙ্গে নিতে পারব না।”

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সবাই তখন বাবলুকেই সমর্থন করল। একেবারে পুরোপুরিভাবে ঠিক হয়ে গেল যে পঞ্চু ওদের সঙ্গে যাচ্ছে না।

রাত তখন বারোটা। বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছু ঠিক সময়েই বাবলুদের বাড়ির সামনে লাইটপোস্টের নীচে এসে দাঁড়াল। এসে দেখল ওরা আসবার আগেই বাবলু এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর যেই ওরা জড়ো হল অমনি সবাই মিলে চলল মিত্তিরদের বাগানের দিকে। যথাসময়ে বাগানের সেই ভাঙা বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকল সকলে। আজ আর এখানে আসতে অন্ধকারেও কোনও অসুবিধে হল না। কেন না বাবলুর হাতে টর্চ ছিল। না হলে যা অন্ধকার তাতে পাশের লোককেই দেখা যায় না।

বাবলু বলল, “আজ রাত্রেই এই বাড়ির সমস্ত ঘর আমরা ঘুরে দেখব। ভাগ্য ভাল থাকলে কালকের রহস্যের আজই উদ্ঘাটন হবে।”

বিলু বলল, “দেখাই যাক। চোর-ডাকাত কি ভূত। যদি ভূত হয় তা হলে আমরা এতজন যখন আছি তখন ভূত নিশ্চয়ই আমাদের কাছে আসবে না।”

ভোম্বল বলল, “সঙ্গে একটা আঁশ-বঁটি রাখলে ভাল হত।”

বাবলু বলল, “আঁশ-বটি কী হবে? আঁশ বঁটি দেখে ভূত পালাবে? বোকা কোথাকার। এত ভয় কেন? এটা বিজ্ঞানের যুগ। এ যুগে ভূত বলে কিছু আছে নাকি? আর ভূত যদি থাকেও তা হলে ভূতের সঙ্গে খালি হাতেই লড়ব আমরা।”

ভোম্বল বলল, “আমি অবশ্য আসবার সময় সঙ্গে একটা গুলতি আর কিছু পোড়া মাটির গুলিও নিয়ে এসেছি। দরকার হলেই কাজে লাগাব।”

বাবলু উৎসাহিত হয়ে বলল, “খুব ভাল করেছিস। অনেক কাজে লাগবে ওটা। দে গুলতিটা আমার হাতে দে।”

ভোম্বল গুলতিটা বাবলুর হাতে দিল। এমন সময় হঠাৎ হিসস” শব্দ করে সবাইকে চুপ করতে বলল বাবলু। কী হল? হল কী? সবাই কান খাড়া করে শুনতে লাগল সেটা। কেমন যেমন রোমাঞ্চকর মনে হল। বিচ্ছু এসে বাচ্চুুর গায়ের কাছে ঘন হয়ে দাঁড়াল। সবাই শুনল ছাদের ওপর কেমন যেন একটা খস খস আওয়াজ হচ্ছে।

কী ভয়ংকর!

এই ঘন অন্ধকারে নিকষ কালোয় এই ভাঙা বাড়িটা তখন সত্যই প্রেতপুরী বলে মনে হল। মুঠো মুঠো জোনাকি চারদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই মিটি মিটি জোনাকির আলোয় মনে হল এই পরিবেশটাই এক সাংঘাতিক রকমের বিভীষিকাময়।

বাইরে চাপা গাছের ডালে একটা প্যাঁচা ডাকল-শ্যাঁ-স্-স।

ওরা টর্চের আলো নিভিয়ে দিয়েছে তখন।

প্রত্যেকেই স্থাণুর মতো দাড়িয়ে আছে।

দেয়াল ঘেঁষে নীরবে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওরা।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর এক সময় খুব সাবধানে অত্যন্ত চাপা গলায় বাবলু বলল, “সবাই আমার পিছু পিছু আয়।”

তারপর গুলতিটা একটু টেনে টেনে দেখে হাতে দিয়ে বাবলু বলল, “এগুলো তোর কাছে রাখ বিলু! তোর হাতের অব্যর্থ টিপ। যদি দেখিস আমাদের মুখের ওপর কোনও আলো এসে পড়ছে তা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই আলো লক্ষ্য করে গুলতিটা টিপ করবি।”

বিলু আচ্ছা বলে গুলি ও গুলতি নিয়ে নিল।

তারপর সবাই মিলে এগিয়ে চলল বাবলুর পিছু পিছু।

ওরা এ-ঘর সে-ঘর করে দোতলায় উঠে এল। দোতলার বারান্দা পার হয়ে একটা ঘরের কাছে যেতেই দেখল ঘরের ভেতর থেকে মৃদু একটু আলোর রেখা খুব অস্পষ্টভাবে বাইরে ভেসে আসছে।

ওরা একবার থমকে দাড়াল।

তারপর খুব সন্তৰ্পণে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল একজন ভদ্রলোক হাত পা বাঁধা অবস্থায় ঘরের মেঝেয় পড়ে আছেন। আর দুটো কঙ্কাল দু”পাশে দাঁড়িয়ে আছে ধারালো দুটো ছোরা হাতে নিয়ে।

কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য!

একজন ছোরা উঁচিয়ে বলছে, “এখনও কিন্তু সময় আছে। যদি ভাল চান তো শিগগির এই কাগজটাতে লিখে দিন আমরা গেলেই যেন আপনার স্ত্রী আমাদের হাতে বিশ হাজার টাকা তুলে দেন। যদি না লেখেন তা হলে আজ রাত্রেই আপনাকে খুন করে আমরা এই বাগানে চাপা গাছের গোড়ায় পুঁতে ফেলব। আপনার মতো আরও অনেককেই সরিয়ে দিয়েছি আমরা। অতএব যা বলি তা চটপট করে ফেলুন।”

ভদ্রলোক কঠিন গলায় বললেন, “ও টাকা আমার মেয়ের বিয়ের জন্য সবে কাল তুলেছি। আমার এখনও পাঁচ হাজার টাকার দরকার। আমি কী করে ও টাকা তোমাদের দেব?”

“আপনাকে দিতেই হবে।”

“অসম্ভব। ও আমি দিতে পারব না।”

“চিঠি তা হলে লিখবেন না আপনি?”

“না। আমার মেয়ের বিয়ে আমার বাড়ির লোকরাই দিয়ে দেবে। তোমাদের যা ইচ্ছা তা করতে পার।”

এই না দেখেই তো পাণ্ডব গোয়েন্দাদের চক্ষু গেল স্থির হয়ে। এ আবার কী আশ্চর্য ব্যাপার। কঙ্কাল যে মানুষের মতো কথা বলে তা ওদের ধারণাতেই ছিল না। কঙ্কাল কঙ্কালই। কঙ্কাল মানেই তো ভূত। আর তাই যদি হয় মানে ভূতই যদি হয়, তবে ভূতে কেন খামোক টাকা চাইতে যাবে? এ শুধু আশ্চর্য নয়, দারুণ এক রহস্যময় ব্যাপার।

বিলু বলল, “কী করবি রে বাবলু? কেটে পড় শিগগির। হাওয়া খারাপ।”

বিলু বলল, “তাই তো মনে হচ্ছে।”

এদের কথা শুনে বাবলু একটু রেগে বলল, “আচ্ছা ইডিয়ট তো! চুপ কর না।”

যেই না বলা সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কালদুটো ঘুরে তাকাল। তারপর চট করে বাতিটা নিভিয়েই টর্চের এক ঝাক তীব্র আলো ওদের মুখের ওপর নিক্ষেপ করে বলল, “কে! কে ওখানে?”

ধরা পড়ে গিয়ে বাবলুদের তখন দারুণ সাহস বেড়ে গেছে। আবার জেদও চেপে গেছে খুব। ওরা তাই সমস্বরে বলে উঠল, “পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

বিলু রেডি হয়েই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে একটু আড়াল হয়ে টর্চের মুখ লক্ষ্য করে গুলতি টিপ করল।

একেবারে অব্যর্থ টিপ। লাগল গিয়ে ঠিক টর্চের আলোর মুখেই লাগা মাত্রই ফট করে ভেঙে গেল কাঁচটা। সে আলোও নিভে গেল তখনই।

ওদের আলো যেই না নিভল অমনি জ্বলে উঠল বাবলুর টর্চ। একটা কঙ্কাল ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ভূ-ভূ-ভু। এ নিশ্চয়ই ভুতুড়ে ব্যাপার।” হাতের কাছে একটা আধলা ইট পড়েছিল। ভোম্বল করল কী চট করে সেই ইটটা কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে মারল কঙ্কালটার মুখে।

ওতেই যথেষ্ট। ইটের ঘা খাওয়া মাত্রই মাথা ঘুরে পড়ে গেল বাছাধন। সেই না দেখে অপর কঙ্কালটা ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠে বলল, “মাই গড়।” বলেই এক লাফে পাশের ভাঙা জানলাটা দিয়ে হাওয়া। তারপর দুড়-দাড় করে ওপরের সিঁড়ি বেয়ে দে দৌড়।

বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চুু, বিচ্ছুও কঙ্কালটার দৌড়ের বহর দেখে অবাক হয়ে গেল। এমন সময় ছাদের ওপর থেকে পঞ্চুর গলা শোনা গেল, “ভৌ ভৌ ভৌ। ভৌ-উ-উ।” বাবলু অবাক হয়ে বলল, “পঞ্চুর গলা না? পঞ্চু কোথেকে এল! ওকে তো আনিনি আমরা।”

বিচ্ছু বলল, “ও নিশ্চয়ই লুকিয়ে আমাদের পিছু পিছুপালিয়ে এসেছে। উঃ! কী দুষ্ট। যাক, ভালই হয়েছে।” বাবলু জোরে চেঁচিয়ে ডাকল, “আয় আয়। পঞ্চু আয়। আমরা এখানে আছি।” কিন্তু কোথায় পঞ্চুু! ওরা বারান্দার কাছে এগিয়ে এসে দেখল পঞ্চু তখন পলায়মান সেই কঙ্কালটাকে ধরবার জন্য তীরের মতো ছুটছে।

বাবলু বলল, “যাক। পঞ্চু যখন গেছে তখন আর আমাদের ওদিকে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখা যাক ব্যাপারখানা কী।”

ওরা সকলে ঘরের ভেতর ঢুকল। তারপর টর্চ জ্বেলে সেই অচৈতন্য কঙ্কালটার কাছে এগিয়ে গেল ওরা। বিলু আর ভোম্বল হাত-পা বাধা ভদ্রলোকের বাঁধন খোলার কাজে লেগে গেল। ভদ্রলোক মুক্তি পেতেই তাড়াতাড়ি পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বেলে ফেললেন বাতিটাকে। বাতির আলোয় ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠতেই ওরা দেখল, এতক্ষণ দূর থেকে যাকে ওরা কঙ্কাল বলে ভুল করেছিল আসলে সে কঙ্কালই নয়। কঙ্কালের পোশাক-পরা মানুষ মাত্র। তার কালো পোশাকের ওপর সাদা সাদা ডোরা এমন ভাবে আঁকা যে তাকে আচমকা দেখলে সত্যিকারের কঙ্কাল বলেই মনে হবে।

মানুষটা তখনও অজ্ঞান হয়েই ছিল। ওরা সেই অবস্থাতেই বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেলল তাকে। এদিকে সেই ভদ্রলোক তো মুক্তির আনন্দে গদ গদ হয়ে বাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কে বাবা তোমরা? বিপদে আমার প্রাণ বাঁচালে। ঠিক সময়টিতে তোমরা এসে না পড়লে ওরা আমাকে নির্ঘাত মেরে ফেলত।”

বাবলু বলল, “আমাদের পরিচয় পরে পাবেন। এখন আপনি এক কাজ করুন। শিগগির গিয়ে পুলিশ ডেকে আনুন। একদম দেরি করবেন না, যান।”

“আমরা ততক্ষণ এই লোকটাকে পাহারা দিই।”

ভদ্রলোক বললেন, “ঠিক বলেছ। আমি এখনই গিয়ে পুলিশ নিয়ে আসছি। তোমরা একটু অপেক্ষা করো।” এই বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন।

দূর থেকে পঞ্চুুর ডাক তখনও কানে আসছে। এই বাড়ির পিছন দিকেই একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরের পাড় থেকে পঞ্চুর গলার স্বর ভেসে আসছে।

বাবলু বলল, “আমার মনে হয় কঙ্কালের পোশাক-পরা সেই লোকটা পালাতে না পেরে জলে ঝাপ দিয়েছে। আর পঞ্চুও ছাড়বার পাত্র নয়। বোধ হয় উঠতে দিচ্ছে না ব্যাটাকে।”

খানিক পরেই বাগানের বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ পাওয়া গেল।

ভোম্বল বারান্দার কাছে এগিয়ে গিয়ে টর্চের আলো ফেলে দেখল সত্যিই পুলিশের গাড়ি সেটা।

গাড়ি থেকে নেমে কয়েকজন পুলিশ বাগানে ঢুকতেই ভোম্বল ওপর থেকে হেঁকে বলল, “আমরা সবাই এখানে আছি। আপনারা সোজা ওপরে উঠে আসুন।”

পুলিশের লোকেরা দ্রুত ওপরে উঠে এল।

ওদের সঙ্গে ছিলেন সেই ভদ্রলোক এবং থানার ওসি।

ভদ্রলোক বললেন, “এই যে, এই সেই ছেলেরা। যারা আমার জীবন রক্ষা করেছে।”

ওসি বাবলুর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “তোমাদের পরিচয় ?”

“আমরা পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

“আজকের দিনে তোমাদের মতন ছেলেমেয়ে দেখা যায় না। তা পাণ্ডব গোয়েন্দার মানে তো কিছু বুঝলাম না ভাই। এত রাত্রে তোমরা এখানে কী করতে এসেছিলে ?”

বাবলু তখন একে একে সব কথা খুলে বলল।

সব শুনে ওসি অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, “এই যে ভদ্রলোকের জীবন রক্ষা করলে তোমরা, ইনি কে জান? ইনি একজন অধ্যাপক। তোমরা হয়তো নামও শুনে থাকবে।”

বাবলু বলল, “কী নাম?”

“এর নাম ভবেশ রায়।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি।”

এমন সময় ওসি-র চোখ পড়ল সেই কঙ্কালের পোশাক-পরা লোকটির দিকে। লোকটিকে দেখেই চমকে উঠলেন তিনি, “আরে, এ ব্যাটা তো একজন দাগী আসামী। আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম ব্যাটাকে। বেশ কয়েকটা মার্ডার কেশ ঝোলানো আছে ব্যাটার নামে।”

বাবলু বলল, “আরও একজন আছে স্যার।”

“কোথায় ?”

“সে গিয়ে পুকুরে ঝাপ দিয়েছে। আমাদের কুকুর পাহারা দিচ্ছে তাকে। ওই শুনুন আমাদের কুকুরের ডাক৷ “

পঞ্চু তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে।

ওসি তার কয়েকজন কনস্টেবলকে বললেন, “এই, তোরা এ ব্যাটাকে অ্যারেস্ট করে ভ্যানে ওঠা। আমি ততক্ষণে অন্যটার ব্যবস্থা করি।” এই বলে আরও দু-চারজন কনস্টেবলকে নিয়ে পুকুরের দিকে চললেন।

পাণ্ডব গোয়েন্দারাও পুলিশের সঙ্গে চলল।

জোড়া জোড়া টর্চের আলোয় আলোকিত পথে দলবদ্ধ হয়ে চলতে কোনও অসুবিধেই হল না।

পুকুর পাড়ে গিয়ে সবাই যা দেখল তা এক মহা কেলেংকারির ব্যাপার।

পলাতক লোকটি প্রাণ বাঁচাবার জন্য সত্যই জলে ঝাঁপ দিয়েছে। আর পঞ্চু তাকে এমন ফ্যাসাদে ফেলেছে যে বাছাধন কোনওরকমেই ডাঙায় উঠতে পারছে না। যেদিক দিয়ে উঠতে যায় সেদিক দিয়েই আক্রমণ করে পঞ্চু। নিরুপায় লোকটি তখন পঞ্চুর আঁচড়-কামড় থেকে বাঁচবার জন্যে জলের ওপর রসগোল্লার মতো ভাসছে।

বাবলু গিয়ে পঞ্চুকে ধরতেই জল থেকে সুড় সুড় করে উঠে এল লোকটি। পুলিশের লোকেরা হাতকড়া নিয়ে একেবারে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উঠে আসতেই অ্যারেস্ট করল লোকটিকে।

পাণ্ডব গোয়েন্দাদের এই নৈশ অভিযান সত্যই সফল হল। দু- দু’জন নামকরা দুষ্কৃতীকে যে ওরা ধরিয়ে দিতে সক্ষম হল এটা বড় কম কৃতিত্বের ব্যাপার নয়। তা ছাড়া একজনের জীবনও রক্ষা হল।

ওসি সেই রাতে পুলিশের জিপে করেই পাণ্ডব গোয়েন্দাদের প্রত্যেককে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। এবং সকলের বাবা-মাকে ধন্যবাদ জানালেন।

আর সেই ভদ্রলোক অর্থাৎ ভবেশবাবু তার মেয়ের বিয়েতে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নেমন্তন্ন তো করলেনই উপরন্তু করলেন কী তার পরদিন রাত্রিবেলা পাণ্ডব গোয়েন্দাদের প্রত্যেকের বাবা-মাকে পর্যন্ত বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দারুণভাবে খাওয়ালেন। সে নিমন্ত্রণে অবশ্য পঞ্চুও বাদ পড়েনি।

সেই থেকে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নাম সকলের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *