০৩৭. যুধিষ্ঠিরের ভীষ্মসমীপগমনে ব্যাস-উপদেশ

৩৭ম অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের ভীষ্মসমীপগমনে ব্যাস-উপদেশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! আপনি সমগ্র রাজধৰ্ম্ম ও আপকালনির্দ্দিষ্ট[রাষ্ট্রবিপ্লব, মহামারী ও দুর্ভিক্ষাদিঘটিত এবং কলিকালোচিত ধৰ্ম্মসঙ্কোচসূচক] নীতির বিষয় কীৰ্ত্তন করুন; আর আমি ধৰ্ম্মপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক কিরূপে পৃথিবী বশীভূত করিব, তাহাও বলুন। আপনার মুখে উপবাসাত্মক প্রায়শ্চিত্তের কথা শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণে কৌতূহল ও হর্ষ সমুৎপন্ন হইয়াছে। ধর্ম্মচৰ্য্যা ও রাজ্যরক্ষা এই উভয় পরস্পর বিরুদ্ধ, অতএব এক ব্যক্তি কিরূপে ধৰ্ম্মরক্ষা ও রাজ্যভার গ্রহণ করিতে পারে, নিরন্তর এই চিন্তা করিয়া আমি মোহে বারংবার অভিভূত হইতেছি।”

তখন বেদবিদ্‌গণের অগ্রগণ্য ভগবান্ ব্যাস সৰ্ব্বজ্ঞ দেবর্ষি নারদের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “বৎস! যদি তোমার সমগ্ৰ ধৰ্ম্ম শ্রবণ করিবার অভিলাষ হইয়া থাকে, তবে কুরুকুলপিতামহ বৃদ্ধ ভীষ্মের নিকট গমন কর। সেই সৰ্ব্বজ্ঞ ধর্ম্মবেত্তা ভীষ্মই তোমার ধর্ম্মগত সংশয় নিরাকরণ করিবেন। যিনি ভগবতী ভাগীরথীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, যিনি ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, যিনি বৃহস্পতি প্রভৃতি দেবর্ষিগণকে শুশ্রূষায় সন্তুষ্ট করিয়া তাঁহাদিগের নিকট রাজনীতি শিক্ষা করিয়াছেন, যিনি দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য ও সুরগুরু বৃহস্পতির বিদিত ধৰ্ম্মশাস্ত্রের মর্মগ্ৰহ করিয়াছেন, যিনি ভৃগুনন্দন চ্যবন ও মহর্ষি বশিষ্ঠের নিকট বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিয়াছেন, যিনি পূর্বে তেজঃপুঞ্জকলেবর আত্মতত্ত্বজ্ঞ প্রজাপতির জ্যেষ্ঠপুত্র সনকুমারের নিকট জ্ঞানোপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছেন, যিনি মহর্ষি মার্কণ্ডেয় হইতে সমগ্র যতিধর্ম্ম শিক্ষা করিয়াছেন, যিনি পরশুরাম ও ইন্দ্র হইতে অস্ত্রলাভ করিয়াছেন, যিনি আপনার ইচ্ছানুসারে কলেবর পরিত্যাগ করিবেন, যিনি অপুত্র হইয়াও উৎকৃষ্ট লোক লাভ করিবেন, ব্রহ্মর্ষিগণ প্রতিনিয়ত যাঁহার সভাসদ হইতেন, জ্ঞেয়পদার্থের মধ্যে কিছুই যাঁহার অপরিজ্ঞাত নাই, সেই ধৰ্ম্মের সূক্ষ্মতাৎপর্য্যবেত্তা মহামতি ভীষ্ম তোমাকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিবেন, সন্দেহ নাই। অতএব ঐ মহাত্মা প্রাণ পরিত্যাগ না করিতে করিতে তুমি শীঘ্র তাঁহার নিকট গমন কর।”

বহুদর্শী ধৰ্ম্মরাজ সত্যবতীপুত্র ব্যাসদেবকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “ভগবন্! আমি জ্ঞাতিবর্গের প্রাণসংহারের কারণ হইয়া সকলেরই নিকট অপরাধী হইয়াছি। আমা হইতেই জ্ঞাতিকুল নির্মূল হইয়াছে, বিশেষতঃ আমি সেই ধর্ম্মযুদ্ধে প্রবৃত্ত মহাবীর পিতামহকে ছলপ্রকাশপুৰ্ব্বক নিপাতিত করিয়া এক্ষণে কিরূপে তাঁহার নিকট গমনপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মসংশয় জিজ্ঞাসা করিব?”

কৃষ্ণের অনুমোদনে যুধিষ্ঠিরের হস্তিনায় যাত্রা

তখন যদুকুলতিলক বাসুদেব বর্ণচতুষ্টয়ের হিতসাধনার্থ পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! শোকের একান্ত বশীভূত হওয়া আপনার কর্ত্তব্য নহে। এক্ষণে মহর্ষি ব্যাস যেরূপ কহিলেন, আপনি তাহার অনুষ্ঠান করুন। এই সমস্ত ব্রাহ্মণ, হতাবশিষ্ট ভূপালগণ এবং আপনার ভ্রাতৃবর্গ ও দ্রৌপদী ইঁহারা সকলেই আপনার অধীন হইতে বাসনা করিতেছেন। বিশেষতঃ আপনার রাজ্যে চারিবর্ণের সমুদয় লোক সমাগত হইয়াছে। অতএব এক্ষণে ইহাদিগের হিতানুষ্ঠান, অমিততেজাঃ ব্যাসের আদেশ-প্রতিপালন এবং আমাদিগের ও দ্রৌপদীর অনুরোধরক্ষার্থ মহাবীর ভীষ্মের নিকট গমন করুন।” তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ, অর্জ্জুন, ভগবান্ ব্যাস এবং অন্যান্য ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক এইরূপ অনুনীত হইয়া মানসিক শোকসন্তাপ, পরিহারপূর্ব্বক লোকের হিতানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান করিলেন এবং নক্ষত্রপরিবৃত শশাঙ্কের ন্যায় বন্ধুবান্ধবে পরিবেষ্টিত হইয়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী করিয়া স্বনগরে প্রবেশ করিবার মানসে অসংখ্য দেবতা ও ব্রাহ্মণগণকে অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন।

অনন্তর ধর্ম্মরাজ কম্বলাজিনসংবৃত, বন্দিগণের পবিত্র মন্ত্রদ্বারা অভিপূজিত, লক্ষণাক্রান্ত, শ্বেতবর্ণ, যোড়শ বলীবর্দ্দকতৃক আকৃষ্ট, শুভ্ররথে আরোহণ করিলেন। তখন ভীমপরাক্রম ভীমসেন তাঁহার রথরশ্মি গ্রহণ ও মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহার মস্তকোপরি সুশোভিত শ্বেতপত্র ধারণ করিলেন। সেই শ্বেতচ্ছত্র অর্জ্জুনকর্ত্তৃক রথোপরি ধৃত হইয়া নভোমণ্ডলে নক্ষত্ৰজালমণ্ডিত শ্বেতমেঘের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন মাদ্রীপুত্র নকুল ও সহদেব জ্যোৎস্নার ন্যায় প্রভাসম্পন্ন সমলঙ্কৃত শ্বেত চামরদ্বয় ধারণপূৰ্ব্বক ব্যজন করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই পঞ্চভ্রাতা রথারূঢ় হইলে ঐ রথ পঞ্চভূতাত্মক দেহের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ঐ সময় ধৃতরাষ্ট্রকুমার যুযুৎসু মনোমারুতগামী বেগবান আশ্বগণে সমলঙ্কৃত শুভ্ররথে আরূঢ় হইয়া যুধিষ্ঠিরের অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। বাসুদেব সাত্যকির সহিত শৈব্য-সুগ্রীব[তন্নামক অশ্বদ্বয়]-সংযযাজিত হেমময় শুভ্ররথে আরোহণ করিয়া কৌরবগণের অনুগমন করিলেন। অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সহিত মনুষ্যবাহ্য যানে আরূঢ় হইয়া মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। কুন্তী, দ্রৌপদী প্রভৃতি অন্তঃপুরচারিণীগণ নানাবিধ যানে আরোহণপূর্ব্বক মহাত্মা বিদুরকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। সকলের পশ্চাৎ অসংখ্য অলঙ্কৃত রথ, হস্তী, অশ্ব ও পদাতি ধাবমান হইল। এইরূপে মহারাজ যুধিষ্ঠির বন্ধুবান্ধবে পরিবৃত হইয়া সূত-মাগধ-বন্দিগণের স্তুতিবাদ শ্রবণপূৰ্ব্বক হস্তিনায় যাত্রা করিলেন। ঐ সময়ে অসংখ্য ব্যক্তির সমাগম ও পরস্পরের কোলাহল হওয়াতে ধৰ্ম্মরাজের নগরযাত্রা অতিরমণীয় হইয়া উঠিল। নগরবাসী মনুষ্যগণদ্বারা সমস্ত নগর ও রাজমার্গ সমলঙ্কৃত হইল। পৃথিবী শ্বেতমাল্য ও পতাকাদ্বারা সুশোভিত, রাজমার্গ ধূপিত[ধূপের ধুমে আমোদিত] এবং রাজভবন বিবিধ গন্ধ, পুষ্প ও মাল্যসমূহদ্বারা পরিশোভিত হইতে লাগিল। নগরদ্বার গৌরাঙ্গী কুমারী, অভিনব পূর্ণকুম্ভ ও সুগন্ধি পুষ্পসমুদয়ে সমাকীর্ণ হইয়া অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিল। পাণ্ডুনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির বন্ধুগণে পৃরিবেষ্টিত হইয়া বন্দিগণের স্তুতিবাদ শ্রবণ করিতে করিতে সেই অসামান্যশোভাসম্পন্ন নগরে প্রবেশ করিলেন।