০৩১. নারদকর্ত্তৃক সুবর্ণষ্ঠীবীর জন্মবৃত্তান্তবর্ণন

৩১ম অধ্যায়

নারদকর্ত্তৃক সুবর্ণষ্ঠীবীর জন্মবৃত্তান্তবর্ণন

বৈশম্পায়ন বলিলেন, তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির দেবর্ষি নারদকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আপনি সুবর্ণষ্ঠীবীর জন্মবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন, উহা শ্রবণ করিতে আমার অতিশয় অভিলাষ হইতেছে।” দেবর্ষি নারদ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! বাসুদেব ইতিপূৰ্ব্বে যাহা কহিলেন, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সংশয় নাই; এক্ষণে যাহা অবশিষ্ট আছে, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা আদি ও আমার ভাগিনেয় মহর্ষি পর্ব্বত আমরা উভয়ে মহাজ সৃঞ্জয়ের গৃহে বাস করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলাম এবং তৎকর্ত্তৃক বিধানানুসারে পূজিত হইয়া তাঁহার আবাসে অবস্থানপূর্ব্বক অভিলাষানুরূপ ভোগসুখ অনুভব করিতে লাগিলাম। ক্রমে বর্ষাকাল অতীত ও আমাদের গমনসময় সমুপস্থিত হইলে মহর্ষি পৰ্ব্বত আমাকে কহিলেন, ‘মাতুল! আমরা এই ভূপতির আলয়ে পরমসমাদরে এতদিন বাস করিলাম, এক্ষণে ইহার শুভ চিন্তা করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য।’ অনন্তর আমি প্রিয়দর্শন পৰ্ব্বতকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলাম, ‘বৎস! তুমি মনে করিলেই রাজার হিতানুষ্ঠান করিতে পার। অতএব অচিরাৎ উঁহাকে অভিলষিত বর প্রদানপূৰ্ব্বক উহার মনোরথ সফল কর। আর যদি তোমার ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে ঐ ভূপতি আমাদিগের তপোবলে সিদ্ধি লাভ করুন।’

“তখন মহর্ষি পর্ব্বত মহারাজ সৃঞ্জয়কে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘নরনাথ! আমরা তোমার অকপট ব্যবহার ও পরিচৰ্য্যায় যারপরনাই প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছি; এক্ষণ তোমাকে অনুমতি করিতেছি, তুমি আমাদিগের নিকট অভীষ্ট বর প্রার্থনা কর। কিন্তু এইরূপ বর প্রার্থনা করিও, যেন তদ্দ্বারা দেবতা ও মনুষ্যের কোন অনিষ্ট হয়।’ তখন সৃঞ্জয় কহিলেন, “হে তপোধন! আপনারা আমার প্রতি প্রসন্ন হওয়াতেই আমি চরিতার্থ হইয়াছি, আর আমার অন্য কোন বর প্রার্থনা করিবার আবশ্যকতা নাই। আপনাদিগের প্রসন্নতাতেই আমার মহাফললাভ হইয়াছে।’ মহর্ষি পৰ্ব্বত সৃঞ্জয়ের বাক্য-শ্রবণে পুনরায় কহিলেন, “মহারাজ। তুমি বহুদিন যাহা সঙ্কল্প করিয়া আসিতেছ, এক্ষণে তাহাই প্রার্থনা কর।’ তখন সৃঞ্জয় কহিলেন, ‘ভগবন্! আমাকে বর প্রদান করা যদি আপনার অভিপ্রেতই হইয়া থাকে, তবে আপনাদের প্রসাদে যেন আমার এক মহাবলপরাক্রান্ত দেবরাজসদৃশ পুত্ৰ উৎপন্ন হয় এবং ঐ পুত্র যেন বহুকাল জীবিত থাকে।’ তখন পর্ব্বত কহিলেন, ‘হে সৃঞ্জয়! তুমি যেরূপ পুত্ৰ লাভ করিবার ইচ্ছা করিতেছ, অবশ্যই সেইরূপ প্রাপ্ত হইবে, কিন্তু আমার বোধ হইতেছে যে, তুমি দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাভব করিবার নিমিত্তই ঐরূপ পুত্র প্রার্থনা করিয়াছ; অতএব তোমার সেই আত্মজ কদাচ দীর্ঘায়ু হইবে না, তোমার ঐ পুত্র সুবর্ণষ্ঠীবীনামে বিখ্যাত হইবে। তুমি সতত তাহাকে ইন্দ্রের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিও।’ মহারাজ সৃঞ্জয় মহর্ষি পৰ্ব্বতের এই কথাশ্রবণে পুত্রের বিঘ্নশান্তির নিমিত্ত তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনার তপোবলে যেন আমার সেই পুত্রটি দীর্ঘজীবী হয়।’ মহাত্মা সৃঞ্জয় এই কথা বলিয়া পৰ্ব্বতকে বারংবার অনুনয় করিতে লাগিলেন, কিন্তু মহর্ষি পর্ব্বত ইন্দ্রের অনুরোধে তৎকালে তাহার বাক্যে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর করিলেন না। তখন আমি রাজা সৃঞ্জয়কে একান্ত কাতর দেখিয়া কহিলাম, “মহারাজ! তুমি দুঃখিত হইও না। তোমার পুত্র অকালে কলেবর পরিত্যাগ করিলে তুমি আমাকে স্মরণ করিও, আমি তোমার পুত্রকে পুনজ্জীবিত করিব।’ হে মহারাজ! আমরা রাজা সৃঞ্জয়কে এইরূপ কহিয়া স্ব স্ব অভিলষিত স্থানে গমন করিলাম; সৃঞ্জয়ও আপনার আবাসে প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর কিয়ৎকাল অতীত হইলে রাজর্ষি সৃঞ্জয়ের এক তেজঃপুঞ্জকলেবরসম্পন্ন মহাবলপরাক্রান্ত পুত্ৰ উৎপন্ন হইল। ঐ পুত্র কালসহকারে সরোবর মধ্যস্থ উৎপলের ন্যায় পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিল। ঐ পুত্র কাঞ্চন ষ্ঠীবন করিত বলিয়া সৃঞ্জয় তাহার নাম কাঞ্চনষ্ঠীবী রাখিলেন। ক্রমে ক্রমে সৃঞ্জয়তনয়ের ঐ অদ্ভুত বৃত্তান্ত সর্ব্বত্র প্রচারিত হইতে লাগিল। দেবরাজ ইন্দ্র ঐ আশ্চর্য্য ব্যাপার কর্ণগোচর করিয়া বিবেচনা করিলেন, ‘মহর্ষি পৰ্ব্বতের বরদান প্রভাবে সৃঞ্জয়ের ঐরূপ পুত্র জন্মিয়াছে, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, যদি বালক দীর্ঘজীবী হয়, তাহা হইলে উহার নিকট পরাভূত হইতে হইবে।’ দেবরাজ মনে মনে ঐরূপ আশঙ্কা করিয়া সুরগুরু বৃহস্পতির পরামর্শানুসারে সেই বালকের রন্ধ্রান্বেষণে প্রবৃত্ত হইলেন এবং মূৰ্ত্তিমান্ দিব্যাস্ত্র বজ্রকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে বজ্র সৃঞ্জয়ের পুত্র মহর্ষি পৰ্ব্বতের বরপ্রভাবে ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করিয়া আমাকে পরাভব করিবে; অতএব তুমি ব্যাঘ্রমূৰ্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া অবিলম্বে উহাকে সংহার কর।’ তখন বজ্র ইন্দ্রের আদেশ প্রাপ্তিমাত্ৰ সতত সেই রাজকুমারের রন্ধ্রান্বেষণ করিতে লাগিল।

“এ দিকে মহারাজ সৃঞ্জয় সেই অপূৰ্ব্ব পুত্ৰ লাভ করিয়া পুলকিতমনে পত্নীগণসমভিব্যাহারে বনমধ্যে গমনপূর্ব্বক বাস করিতে লাগিল। তাঁহার সেই পুত্রটিও ক্রমে ক্রমে পঞ্চবর্ষবয়স্ক হইয়া উঠিল। একদা সেই নাগেন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী বালক সেই বনমধ্যে ক্রীড়া করিবার নিমিত্ত ধাত্রীসমভিব্যাহারে ভাগীরথীতীরে গমন করিল। ইত্যবসরে সেই ব্যাঘ্ররূপী বজ্র সহসা আগমনপূর্ব্বক তাহাকে আক্রমণ করিল। রাজকুমার ব্যাঘ্রের আক্রমণে কম্পিত কলেবর হইয়া প্রাণত্যাগপূৰ্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইল। ধাত্রী বালককে গতাসু দেখিয়া মুক্তকণ্ঠে রোদন করিতে লাগিল। তখন রাজা সৃঞ্জয় ধাত্রীর আর্ত্তস্বর শ্রবণে উৎকণ্ঠিত হইয়া স্বয়ং তথায় আগমনপূর্ব্বক দেখিলেন, সুবর্ণষ্ঠীবী প্রাণপরিত্যাগপূৰ্ব্বক নভোমণ্ডল-পরিচ্যুত নিশাকরের ন্যায় ভূতলে শয়ান রহিয়াছে। তখন তিনি যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া সেই শোণিতসিক্ত পুত্রকে উৎসঙ্গে আরোপিত করিয়া বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। সেই বালকের মাতৃগণও অবিলম্বে শোকাকুলিতচিত্তে অনর্গল অশ্রুজল বিসৰ্জন করিতে করিতে তথায় আগমন করিলেন।

“ঐ সময় রাজা সৃঞ্জয় আমাকে স্মরণ করাতে আমি তৎক্ষণাৎ তথায় সমুপস্থিত হইলাম। হে ধৰ্ম্মরাজ! যদু-প্রবীর বাসুদেব তোমাকে যে সমস্ত কথা কহিলেন, আমি সৃঞ্জয়ের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে ঐ সকল কথাই কহিয়াছিলাম। পরিশেষে আমি দেবরাজের অনুমতিক্রমে সেই বালককে পুনজ্জীবিত করিলাম। অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা অতিক্রম করা কাহার সাধ্য?

“এইরূপে সেই সৃঞ্জয়রাজকুমার পুনরায় জীবনলাভ করিয়া পিতামাতার আনন্দবর্ধন করিতে লাগিল। ঐ রাজকুমার পিতার লোকান্তরপ্রাপ্তির পর সুপ্রণালীমে এক সহস্র শত বৎসর রাজ্য শাসন করিয়াছিল। উহার তুল্য গুণবান্ আর কেহই ছিল না। ঐ রাজপুত্র প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান, দেবতা ও পিতৃগণের তৃপ্তিসাধন এবং বহু পুত্ৰ উৎপাদনপূৰ্ব্বক পরিশেষে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছে। হে মহারাজ! এক্ষণে তুমি শোকপরিত্যাগপূৰ্ব্বক ব্যাস ও কেশবের বাক্যানুসারে পৈতৃক রাজ্য অধিকার করিয়া প্রজাপালন ও যজ্ঞানুষ্ঠান কর। তাহা হইলেই তোমার অতিপবিত্র লোকে গতিলাভ হইবে।”