০১৮. জনকমহিষী-সংবাদে অর্জ্জুনের যুধিষ্ঠিরপ্ররোচনা

১৮শ অধ্যায়

জনকমহিষী-সংবাদে অর্জ্জুনের যুধিষ্ঠিরপ্ররোচনা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির এই বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলে অর্জ্জুন তাঁহার বাক্‌শল্যে [৯] নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া দুঃখশোকসন্তপ্তচিত্তে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! বিদেহরাজ জনকের স্বীয় মহিষীর সহিত যেরূপ কথোপকথন হইয়াছিল, তাহা জনসমাজে বিখ্যাত রহিয়াছে। আমি আপনার সমীপে সেই কথোপকথন কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহারাজ জনক রাজ্য, ধন, রত্ন ও পুত্র কলত্র প্রভৃতি সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্রোধহীন ও নিরীহ হইয়া ভিক্ষুকাশ্রম অবলম্বন করিলে তাঁহার মহিষী তাঁহাকে সৃষ্টবমুষ্টি ভিক্ষা করিতে দেখিয়া নির্জ্জনে তাহার নিকট আগমনপূর্ব্বক ক্রোধভরে কহিলেন, ‘মহারাজ! তুমি কি ধন-ধান্য-পরিপূর্ণ রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলে? ভৃষ্টযবমুষ্টি যাচ্ঞা করা কি তোমার কর্ত্তব্য? তুমি সমুদয় রাজ্য-ধন পরিত্যাগ করিয়াছ বটে, কিন্তু ভৃষ্টবমুষ্টিগ্রহণ-লোভ থাকাতে তোমার সত্যাগের প্রতিজ্ঞা বিফল হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি এই ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া কোনক্রমেই অতিথি, দেবতা, ঋষি ও পিতৃগণের তৃপ্তিসাধন করিতে সমর্থ হইবে না, সুতরাং তোমার এই পরিশ্রম বিফল হইবে। তুমি ক্রিয়াকলাপবিবর্জ্জিত হইলে দেবতা, অতিথি ও পিতৃগণ তোমাকে পরিত্যাগ করিবেন। ইতিপূর্বে সহস্র সহস্র ত্রিবিদ্যাসম্পন্ন[ঋক্, যজুঃ ও সামবেদে জ্ঞানযুক্ত] বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য অসংখ্য লোকে তোমার নিকট জীবিকানির্ব্বাহ প্রার্থনা করিতেন, এক্ষণে তুমিই অন্যের অনুগ্রহে আপনার উদর পূরণ করিবার চেষ্টা করিতেছ। আজ স্বীয় সমুজ্জ্বল রাজলক্ষ্মী পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কুকুরের ন্যায় পরান্ন-প্রত্যাশায় ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করাতে তোমার জননী পুত্রহীন ও ভাৰ্য্যা পতিবিহীন হইলেন। ধৰ্ম্মফললাভার্থী ক্ষত্রিয়গণ অনুগ্রহাকাঙ্ক্ষী হইয়া সতত তোমার উপাসনা করিতেন। তুমি তাঁহাদিগের আশা বিফল করিয়া কোন্ লোকে গমন করিবে? প্রাণীমাত্রেই অদৃষ্টের অধীন; সুতরাং বিশেষ চেষ্টা করিলেও লোকে মোক্ষলাভ করিতে পারে কি না সন্দেহ। তুমি যখন ধৰ্ম্মপত্নীকে পরিত্যাগ করিয়া জীবিত থাকিতে বাসনা করিতেছ, তখন তুমি নিতান্ত পাপাত্মা; তোমার কোন লোকেই অধিকার নাই। তুমি কি নিমিত্ত গন্ধমাল্য, অলঙ্কার ও বিবিধ বস্ত্র পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্রিয়াবিহীন হইয়া প্রব্রজ্যা [সন্ন্যাস] আশ্রয় করিয়াছ? তুমি নিপানের [কূপাদি জলাশয় ও তৎসন্নিহিত পশুপক্ষী প্রভৃতির জলপানের চৌবাচ্চা] ন্যায়, মহাবৃক্ষের ন্যায় সৰ্ব্বভূতের আশ্রয়স্বরূপ; আত্মোদরপূরণার্থ অন্যের উপাসনা করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। তুমি কর্ম্মহীন হইয়া নিতান্ত কুকর্ম্ম করিয়াছ। হস্তীও কার্য্যবিহীন হইলে ক্রব্যাদ ও কৃমিগণ তাহার মাংস ভোজন করে। হায়! যে ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিলে দণ্ডকমণ্ডলু ও বসন পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিতে হয়, তুমি কি নিমিত্ত তাহাতে অনুরক্ত হইতেছ? তুমি সমুদয় রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া ভৃষ্টযবমুষ্টিও ভিক্ষা অবলম্বন করিয়াছ, কিন্তু বিবেচনা করিয়া দেখিলে ঐ যুবমুষ্টিও রাজ্যাদির ন্যায় লোভের দ্রব্য। সুতরাং উহা গ্রহণ করিলে তোমার প্রতিজ্ঞা বিনষ্ট হইবে।

‘মহারাজ! এক্ষণে তুমি আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া এই পৃথিবী শাসন কর। যে ব্যক্তি পরমসুখাৰ্থী সন্ন্যাসীদিগের সমাহৃত কমণ্ডলু প্রভৃতি দর্শন ও স্বয়ং তৎসমুদয়ের আহরণে যত্ন করে, তাহার প্রাসাদ, শয়নীয়[শয্যা], যান, বস্ত্র ও আভরণ প্রভৃতি দ্রব্যজাত পরিত্যাগ করা বিড়ম্বনা মাত্র। যে ব্যক্তি সতত প্রতিগ্রহ করে, আর যে ব্যক্তি নিরন্তর দান করে, এই উভয়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? যে ব্যক্তি সতত যাচ্ঞা করে, তাহাকে দক্ষিণা দান করা দাবানলে আহুতি প্রদানের তুল্য। হুতাশন যেমন দাহ্য বস্তু না পাইলে স্বয়ং প্রশান্ত হইয়া যায়, তদ্রূপ যাচক ব্রাহ্মণও ভিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে স্বয়ং নিরস্ত হয়। ইহলোকে সাধুলোকেরা অন্নদান করিবার নিমিত্ত জীবনধারণ করেন। রাজা যদি দাতা না হয়েন, তাহা হইলে মোক্ষাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিরা কিরূপে জীবনধারণ করিতে পারেন? ইহলোকে অন্নসম্পন্ন মানবগণই গৃহস্থ হইয়া থাকেন। ভিক্ষুকগণ তাঁহাদিগকে অবলম্বন করিয়াই জীবনধারণ করে। সকলেই অন্নদ্বারা জীবিত থাকে, অতএব অন্নদাতাই প্রাণদাতার স্বরূপ। গৃহত্যাগী ব্যক্তিগণ গৃহস্থের আশ্রয়গ্রহণপূর্ব্বক জীবিকানির্ব্বাহ করিয়া দমগুণপ্রভাবে প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া থাকেন। লোকে কথঞ্চিৎ বিষয়ত্যাগ, মস্তকমুণ্ডন বা ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলেই ভিক্ষুক হয় না; যে ব্যক্তি সরলভাবে সমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ ভিক্ষুক। যিনি বিষয়ে অনাসক্ত হইয়া অনুরাগীর ন্যায় ব্যবহার এবং শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমভাবে দৃষ্টিপাত করেন, তাঁহাকেই মুক্ত বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে। কাষায় বসনধারী মুণ্ডিতমুণ্ড ব্যক্তিগণ প্রায়ই বিবিধ কপাশে বদ্ধ হইয়া দান-গ্ৰহণার্থ পরিভ্রমণ ও মঠশিয্যাদিলাভের[গৈরিকাদি] চেষ্টা করিয়া থাকে। ফলতঃ বেদাধ্যয়ন, বার্তাশাস্ত্র ও পুত্রগণকে পরিত্যাগ করিয়া ত্ৰিদণ্ড[বাক্‌সংযম, মনঃসংযম ও উপবাসে শরীরসংযম] ও কাষায়বস্ত্র পরিগ্রহ করা নিতান্ত নির্বোধের কার্য্য। মুণ্ডব্রতধারী ধৰ্ম্মধ্বজীদিগেরই কাষায়বস্তু প্রয়োজন হইয়া থাকে, অতএব এক্ষণে তুমি গৃহস্থাশ্রম অবলম্বনপূৰ্ব্বক জিতেন্দ্রিয় হইয়া অজিনধারী, নগ্ন, মুণ্ডিতমুণ্ড ও জটাধর সন্ন্যাসীদিগকে প্রতিপালন করিয়া সমুদয় লোক জয় কর।

যে ব্যক্তি গুরুলোকের প্রীতিসম্পাদনার্থ অহরহঃ বিপুলদক্ষিণ বহুপশুসমন্বিত বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, এই জগতে তাঁহার তুল্য ধর্ম্মপরায়ণ, আর কে হইতে পারে?

“হে ধৰ্ম্মরাজ! লোকে যে রাজর্ষি জনককে তত্ত্বজ্ঞ বলিয়া কীৰ্ত্তন করে, তিনিও এইরূপে মোহের বশবর্ত্তী হইয়াছিলেন। অতএব বোধ হয়, মোহ সকলকেই অভিভূত করিতে পারে। অতঃপর আপনি আর মোহের বশ্যতাপন্ন হইবেন না। বদান্য মনুষ্যেরাই গৃহস্থধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া থাকেন। এক্ষণে আমরা অনৃশংস, কামক্রোধবর্জ্জিত, দানধর্ম্মপরায়ণ, গুরুসেবানিরত ও সত্যবাদী হইয়া যথাবিধি দেবতা ও অতিথিদিগের সেবা করিয়া প্রজাপালন করিলেই ইষ্টলোক লাভ করিতে পারিব, সন্দেহ নাই।”