০১৭. যুধিষ্ঠিরের অর্জ্জুন-প্রবোধন

১৭শ অধ্যায়

যুধিষ্ঠিরের অর্জ্জুন-প্রবোধন

তখন যুধিষ্ঠির অর্জ্জুনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! তুমি কেবল অসন্তোষ, প্রমাদ, মদ, মোহ, রাগ, দ্বেষ, বল, অভিমান ও উদ্বেগে অভিভূত হইয়া রাজ্যভোগে বাসনা করিতেছ। এক্ষণে ঐ সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রশান্তভাব অবলম্বন করিয়া সুখী হও। যে ভূমিপতি এই অখিল ভূমণ্ডলমধ্যে একাধিপত্য বিস্তার করেন, তাঁহারও এক ভিন্ন দ্বিতীয় উদর নাই। তবে তুমি কি নিমিত্ত বিপুল রাজ্যভোগের প্রশংসা করিতেছ? একদিন বা কতিপয় মাসের কথা দূরে থাকুক, যাবজ্জীবন চেষ্টা করিলেও কেহ আশা পরিপূর্ণ করিতে সমর্থ হয় না। অগ্নি কাষ্ঠসংযুক্ত হইলেই প্রজ্বলিত হইয়া উঠে, আর কাষ্ঠশূন্য হইলে শান্তভাব অবলম্বন করে; অতএব তুমি অল্পাহারদ্বারা সমুদ্দীপ্ত জঠরানলের [প্রদীপ্ত উদরাগ্নির] সান্ত্বনা কর। মূঢ় ব্যক্তি কেবল আপনার উদরপূরণের নিমিত্তই অধিকতর দ্রব্যসম্ভার সংগ্রহ করে। অতএব তুমি অগ্রে উদরকে পরাজয় কর, তাহা হইলেই তোমার সমুদয় পৃথিবী পরাজয় করা হইবে। তুমি ঐশ্বৰ্য্য ও কামাসক্ত মানবগণকে প্রশংসা করিতেছ; কিন্তু যাহারা ভোগাভিলাষশূন্য হইয়া তপানুষ্ঠানদ্বারা দুর্বল হইয়াছে, তাহারাই চরমে পরমপদলাভে সমর্থ হয়। রাজ্যলাভ ও রাজ্যরক্ষা এই উভয়েই ধর্ম্ম ও অধৰ্ম্ম আছে; অতএব উহা পরিত্যাগ করিয়া মহদ্‌ভার হইতে বিমুক্ত হও। ব্যাঘ্র আপনার উদরপূরণের নিমিত্ত অধিকতর আহারসামগ্রী সংগ্রহ করে এবং লোভপরতন্ত্র, অন্যান্য মৃগেরা তাহাকে আশ্রয় করিয়া জীবিকানির্বাহে প্রবৃত্ত হয়। রাজাও ব্যাঘ্রের ন্যায় স্বার্থপর হইয়া অধিক সংগ্রহ করেন, আর অন্যে তাঁহার সেই সংগৃহীত দ্রব্যজাত অনায়াসে ভোগ করে; কিন্তু কি আশ্চর্য্য! প্রায় কোন নরপতিই বিষয় সংগ্রহ করিয়া স্বয়ং উহা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্ন্যাসধৰ্ম্ম অবলম্বন করিতে পারেন না। পত্রভোজী, অশ্মকুট্ট[জাঁতায় ভাঙ্গা যবচুর্ণাদি], দন্তোলুখন [দাঁতে কাটা সামান্য তণ্ডুলাদি ভক্ষণে জীবন ধারী], জলাহারী ও বায়ুভক্ত তপস্বীরাই নরক হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন। যে নরপতি এই অখণ্ড ভূমণ্ডলে একাধিপত্য বিস্তার করিয়াছেন, তাঁহাকে কৃতকাৰ্য্য বলা যায় না; যাঁহার মৃত্তিকা ও কাঞ্চনে সমান জ্ঞান জন্মিয়াছে, তিনিই যথার্থ কৃতকাৰ্য্য; অতএব এক্ষণে সঙ্কল্পিত বিষয়ে নিরাশ, নিশ্চেষ্ট ও মমতাশূন্য হইয়া অক্ষয়পদলাভের চেষ্টা কর, ভোগাভিলাষপরিশূন্য ব্যক্তিরা কখনই শোকে অভিভূত হয়েন না। তুমি বৃথা কেন ভোগ্যবস্তুর নিমিত্ত অনুতাপিত হইতেছ? অচিরাৎ ভোগাবিলাষ পরিত্যাগপূর্ব্বক বিষয় হইতে বিমুক্ত হও; দেবলোক ও পিতৃলোক, এই উভয় স্থানে গমন করিবার পথ অতি সুপ্রসিদ্ধ। যাহাদের বর্ণ ও আশ্ৰমাদির অভিমান থাকে, তাহারা পিতৃলোক, আর যাহারা অভিমানশূন্য, তাহারা দেবলোকে গমন করিয়া থাকে। মহর্ষিগণ তপানুষ্ঠান, ব্রহ্মচর্য্য ও বেদাধ্যয়ন করিয়া দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উকৃষ্ট লোক লাভ করেন; তাঁহাদিগকে মৃত্যুভয়ে ভীত হইতে হয় না। ইহলোক ভোগ্যবস্তুই বন্ধন ও কর্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। লোকে উহা হইতে বিমুক্ত হইতে পারিলেই পরমপদলাভে সমর্থ হয়।

“হে পার্থ! পূৰ্বে জনকরাজ মোক্ষধৰ্ম্ম অবলম্বনপূর্ব্বক মমতাশূন্য হইয়া কহিয়াছিলেন যে, আমি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি; কিন্তু আমার কিছুই নাই। এই মিথিলানগরীমধ্যে অগ্নিদাহ উপস্থিত হইলেও আমার কিছুই দগ্ধ হয় না।’ লোকে প্রজ্ঞারূপ প্রাসাদে আরোহণ করিলে কখনই অশোচ্য বিষয়ের নিমিত্ত শোকপ্রকাশ করে না এবং পর্বতারূঢ় ব্যক্তির ন্যায় জনসমাজ হইতে অন্তরিত মন্দবুদ্ধি ব্যক্তিদিগের কার্য্যসকল সন্দর্শন করে; যে ব্যক্তি জ্ঞানচক্ষুদ্বারা কর্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যবিষয় অবলোকন করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ চক্ষুষ্মন এবং যিনি স্বীয় বুদ্ধিদ্বারা অন্যের অজ্ঞাত বিষয় বুঝিতে পারেন, তিনি যথার্থ বুদ্ধিমান্। যিনি ব্রহ্মজ্ঞানসম্পন্ন বিদ্বান্ ব্যক্তিদিগের বাক্যাৰ্থবোধে সমর্থ, তিনি সমাজমধ্যে সম্মান লাভ করিয়া থাকেন। আর যিনি শরীরস্থিত পঞ্চভূতকে একাকার আত্মায় বিলীন ও আত্মা হইতে উৎপন্ন বলিয়া বুঝিতে পারেন, তিনিই ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়েন। মূর্খ, লখুচেতাঃ[ক্ষুদ্ৰহৃদয়], নির্বোধ, তপানুষ্ঠানবিমুখ ব্যক্তিরা কদাচ ব্রহ্মলোকগমনে সমর্থ হয় না। যথার্থ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই ব্রহ্মলোক লাভ করিয়া থাকেন। ফলতঃ সকল কাৰ্য্যই বুদ্ধির আয়ত্ত।”