১০. পনেরো শতকের শেষাশেষি

১০

সময়টা পনেরো শতকের শেষাশেষি।

হিন্দুরাজত্ব শেষ হতে চলেছে।

গৌড়ে পাঠান-শাসনের শক্তি বাড়ছে।

বল্লাল সেনের যুগ শেষ হল বিস্তৃত অবক্ষয়ে।

বাংলা লুঠ করছে বক্তিয়ার উদ্দিন।

গৌড়ের শাসক পাঠান সুলতান নাসির শাহ।

সুলতানের খাস লোক খান জাহান আলি।

পদ্মার দক্ষিণ পাড়ে নতুন জনবসতি গড়ে তুলছে সে । উদ্দেশ্য ক্ষমতা বাড়ানো।

মামুদ তাহির আর খান জাহান আলি দুই বন্ধু।

মামুদ তাহির মুসলমান হওয়ার আগে ছিল কুলীন ব্রাহ্মণ। সে প্রেমে পড়ে এক সুন্দরী মুসলমান মোহিনীর।

ব্রাহ্মণের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না মুসলমান সুন্দরীটির শরীরের আকর্ষণ থেকে পালিয়ে বাঁচা।

মুসলমান মেয়েটি জানে শরীরের সব ছলাকলা। সে সুযোগ বুঝে ডাক দেয় ব্রাহ্মণ যুবকটিকে।

যুবক লুকিয়ে দেখা করে তার সঙ্গে অন্ধকারের আড়ালে। দিনের আলোয় দুজনকে একসঙ্গে দেখা যায় না কখনও।

মুসলমান সুন্দরীটি বুঝতে পারে, ব্রাহ্মণ যুবকটির মতো কামুক পুরুষ সে দেখেনি। কিছুতেই ছেলেটি নিজেকে সামলাতে পারে না, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না আদিম তাড়না। ছুটে আসে সমস্ত বিপদের ঝুঁকি নিয়ে।

সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত।

ঠিক হল মুসলমান যুবতীর সঙ্গে নির্জন আঁধার অরণ্যে মিলন হবে ব্রাহ্মণ যুবকটির।

যুবকের তর সয়নি।

সে আগেভাগেই উপস্থিত অরণ্যের নির্ধারিত মিলনভূমিতে। মুসলমান যুবতী আসে একটু দেরি করেই।

সে আজ একা আসেনি। তার পিছনে নিকট আত্মীয়-আত্মীয়াদের একটি দল।

অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে ওৎপেতে তারা।

যুবতীটি কাছে আসা মাত্র ব্রাহ্মণ যুবক তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। লোহার মতো একটি হাত এসে যুবককে বাধা দেয়। ব্রাহ্মণকে ঘিরে ফেলে তার মুসলমান প্রেমিকার স্বজনেরা।

আগে গ্রহণ করো ইসলাম, তারপর দেখা যাবে…

ব্রাহ্মণ যুবকটির আর পালাবার পথ নেই। তাকে হতেই হয় মুসলমান। সে শেষ পর্যন্ত সেই মুসলমান প্রেমিকাকে পেয়েছিল কি না, জানা যায়নি।

ব্রাহ্মণ যুবকটির নতুন নাম হল, মামুদ তাহির। সে সমাজচ্যুত। হিন্দু সমাজে তার আশ্রয় জুটল না।

সে আশ্রয় পেল খান জাহানের অনুগ্রহে মুসলমান পল্লিতে। কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণ দিনে দিনে হয়ে উঠল কট্টর মুসলমান। যে, এক রকমের প্রতিশোধ স্পৃহা থেকেই সে জমিজায়গা কিনে ক্ষমতা বিস্তার করতে লাগল যশোরের চেঙ্গুটিয়ায়। চেঙ্গুটিয়ার পিরল্যা বা পিরালিয়া গ্রামে বসবাস করে মামুদ তাহির। গ্রামের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি সে। পিরালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। লোকে তাই তাকে ডাকে ‘পির আলি’ নামে।

কাছেই বসবাস করে তুখড় ও ক্ষমতালোভী জমিদার দক্ষিণানাথ রায়চৌধুরি।

দক্ষিণারঞ্জন সারসত্যটি অচিরে বুঝে ফেলল। ক্ষমতাবান পির আলি-র সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে লাভ নেই। বরং তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে যশোর কব্জা করাই ঠিক কাজ হবে।

শুরু হয়ে গেল পির আলি আর দক্ষিণানাথের কর্মযজ্ঞ।

অরণ্যের গাছপালা কেটে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চলার পথ হল। দুজনেই একমত। শহরসভ্যতার প্রাণ হল পথ।

পথ হলেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে নতুন বাসভূমি। তাই হল, নতুন পথের ধারে ধারে তৈরি হল নতুন জনপদ।

অরণ্য কাটা হল বটে। কিন্তু শুধু ইট-কাঠ-পাথরের বাড়ি হলেই তো হবে না।

পির আলি এবং দক্ষিণানাথ, একজন গোঁড়া মুসলমান, অন্যজন সুবিধাবাদী হিন্দু, দুজনেরই মন বলল, অরণ্য কেটে আম-জাম-শিরীষের বাগান হোক।

তাই হোক।

দক্ষিণানাথ বুঝলেন, এই সুযোগ, নিজের ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নেওয়ার।

যেখানে সবচেয়ে ছড়াল দক্ষিণা চৌধুরির প্রভাব, সেটি হল চেঙ্গুটিয়া পরগণার ভৈরব নদীর তীরে দক্ষিণডিহি গ্রাম।

দক্ষিণানাথ এখানেই গড়লেন তাঁর বিখ্যাত কালীমন্দির। কালীমন্দিরের প্রসঙ্গ এখানে আনলাম বিশেষ কারণে।

এই কালীমন্দিরে এক দুর্যোগের রাতে এখন একটি ঘটনা ঘটবে যার সঙ্গে জড়িয়ে যাবে দ্বারকানাথের এক পূর্বপুরুষ। তবে সেই ঘটনা ঘটবে আরও অনেক পরে।

এখন ফিরে আসি দক্ষিণানাথের হাঁড়ির খবরে।

দক্ষিণা শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ইতিমধ্যে চার ছেলে এক মেয়ের বাপ। একদা কুলীন ব্রাহ্মণ, এখন ঘোর মুসলমান পির আলি-র মদতে অর্থে সম্পদে সংসারে বেশ শাঁসালো জমিদার দক্ষিণানাথ।

দক্ষিণানাথের বড়ো ছেলে কামদেব আর মেজো ছেলে জয়দেব লেখাপড়ায় সরেস। তারা সংস্কৃত ও ফার্সি ভাষায় সুপণ্ডিত।

তাতে পির আলি-র মনে এতটুকু হিংসে নেই। বরং কামদেব ও জয়দেবকে পির আলি তার প্রধান কর্মচারীর পদে নিযুক্ত করল।

সেজো ও ছোটো ভাই, রতিদেব শুকদেবকেও চাকরি দিতে চাইল পির আলি।

কিন্তু পির আলির চাকরি করবে না তারা!

সামান্য খটকা লাগল পির আলির।

তবে তারা যখন পির আলির কৃপা গ্রহণ করে দক্ষিণডিহি গ্রামের জমিদারির তত্ত্বাবধান করতে লাগল, পির আলির খটকা ঘুচল।

কিন্তু একেবারে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ডেকে আনল বিপদ।

ঘটনা ঘটল রমজানের বিকেলবেলা।

তখন রোজার পবিত্র উপবাস ভাঙার লগ্ন আসেনি। পড়া হয়নি সন্ধের নামাজ।

এমন সময় এক পারিষদ পির আলিকে উপহার দিল রোজার উপবাস ভাঙার জন্য অতি উত্তম কিছু ফল।

একটি নধর রসালো লেবু ফলের ঝুড়ি থেকে তুলে নিয়ে পির আলি সেটিকে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিল। আর তৃপ্তিতে চোখ বুজে বলল, গন্ধ শুঁকেই যে জিভে জল আসছে। কামদেব-জয়দেব একথা শুনে অতর্কিতে একসঙ্গে বলে উঠল, এ কী করলেন আলি সাহেব! আমরা হিন্দুরা যে বিশ্বাস করি ঘ্রাণেই আদ্দেক ভোজন হয়ে যায়। আপনি যে রোজার সান্ধ্য নামাজের আগেই উপবাস ভাঙলেন!

হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছে মামুদ তাহির ওরফে পির আলি। পান থেকে চুন খসে না তার। সে প্রতিপদে প্রমাণ করতে চায় যে সে পরম ধার্মিক মুলসমান। আর তাকে কি না এইভাবে অপমান করল দুটো হিন্দু ছোকরা! হতে পারে বন্ধুর ছেলে। কিন্তু খাঁটি মুসলমান পির আলি অপমান মেনে নেবে না কিছুতেই। সে মনে মনে প্রতিশোধের মতলব আঁটতে লাগল।

সুযোগও এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি।

গানবাজনার আসর বসেছে পির আলির বাড়িতে।

কামদেব-জয়দেবকে নিমন্ত্রণ জানাল পিতৃবন্ধু পির আলি।

যত রাত বাড়ছে মজলিস জমছে।

হঠাৎ প্লেটে প্লেটে গোমাংসের কাবাব!

কামদেব-জয়দেবের কাছে সেই প্লেট নিয়ে এল বাবুর্চি।

গো-মাংসের গন্ধে ম-ম করছে ঘর।

দু-চারজন হিন্দুরও আমন্ত্রণ ছিল এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকবার জন্য।

গো-মাংসের কাবাব আসতেই তারা নাকে চাপা দিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে গেল।

– আপনি জানেন, আমরা হিন্দু। গোমাংস ভক্ষণে ধর্মের নিষেধ। আমাদের সামনে কেন আনলেন গোমাংসের কাবাব? পথ ছাড়ুন। আমরা এখানে আর থাকতে চাই না।

কামদেব-জয়দেবের সামনে দাঁড়িয়ে এ যেন অন্য এক পির আলি। গম্ভীর তার কণ্ঠস্বর।

– পালাবে কোথায়? আর তোমাদের পালাতে দিচ্ছেই বা কে? যে-হিন্দুরা এতক্ষণ এখানে ছিল, তারা গ্রামে রটিয়ে দিয়েছে এতক্ষণ, তোমরা গোমাংস ভক্ষণ করেছ তাদের সামনেই।

– কোথায় খেলাম আমরা গোমাংস? ওই দেখুন, একটি কাবাবও কেউ স্পর্শ করেনি।

– কামদেব-জয়দেব, স্পর্শের কথা কে বলছে? বলছি ঘ্রাণের কথা। তোমরাই তো আমাকে বলেছ, হিন্দুরা না কি বিশ্বাস করে, শুঁকলেই খাওয়া হয়ে যায়। আর তোমরা এতক্ষণ ধরে গোমাংস শুঁকছো! আর বলছো গোমাংসের স্বাদ গ্রহণ করনি! তাহলে, বাকিটুকুই বা বাকি থাকে কেন?

পির আলি একথা বলতেই তার বন্ধুরা এসে কামদেব-জয়দেবের মুখে গো-মাংস গুঁজে দিল জোর করে। হিন্দুরা দেখল উঁকি মেরে। এরপর মুসলমান হতেই হল কামদেব-জয়দেবকে। হিন্দুর বাড়িতে গোমাংস খাওয়া হিন্দুর স্থান নেই!

কামদেবের মুসলমান নাম হল কামালুদ্দিন খাঁ চৌধুরি। আর জয়দেবের নাম জামালুদ্দিন খাঁ চৌধুরি।

জমিদার দক্ষিণানাথ উপায়হীন।

আর তার মুসলমান বন্ধু পির আলি ক্ষমাহীন।

এই শুরু কুলীন ব্রাহ্মণ জমিদার দক্ষিণানাথের বংশের ইসলাম শাখা। কাহিনি আরও একটু গড়াল।

কামদেব-জয়দেবের তো আরও দুটি ভাই আছে- রতিদেব আর শুকদেব। দাদারা তো পূর্ণ মুসলমান।

ভাইদের কী অবস্থা?

তারা তখন ব্রাহ্মণ হয়েও মুসলমান।

তাদের নতুন নাম, ‘পিরালি’-ব্রাহ্মণ! অর্থাৎ পির-আলি-নষ্ট ব্রাহ্মণ!

তারা একঘরে। সমাজ-সংসার থেকে বিতাড়িত।

হিন্দুর ঘরে তাদের জায়গা নেই।

তাদের ধোপা-নাপিত বন্ধ।

তাদের জীবন অসহনীয়।

তাদের একটি বোন আছে। নাম রত্নমালা।

তাছাড়া শুকদেবের একটি মেয়েও আছে। নাম সুন্দরী।

কে বিয়ে করবে তাদের?

কোন হিন্দু ছেলে দেখাবে সেই সাহস?

১১

শুকদেবের ওপর ভারি রাগ হিন্দুদের।

‘দেখি কেমন করে তোর বোন রত্নমালার বিয়ে দিস তুই,’ কুলীন ব্রাহ্মণরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অসহায় শুকদেবের ওপর।

সে না ঘরকা, না ঘাটকা।

না হিন্দু, না মুসলমান।

হিন্দুরা তাকে ঘরে নেয় না।

মুসলমানরা তাকে মানুষ বলেই মনে করে না।

কিন্তু তার সুন্দরী বোন রত্নমালার দিকে নজর সবার।

শুকদেবের একমাত্র জোর তার অর্থ।

সে খুঁজছে সেই ছেলে যে অর্থের লোভে রত্নমালাকে বিয়ে করবে। তাতে অবিশ্যি তাকে যে দোষ দেওয়া যায়, তাও নয়। শুকদেব জানে, যে ছেলে রত্নমালাকে বিয়ে করবে সে সারা জীবনের জন্যে হেয় হবে, একঘরে হবে, সমাজচ্যুত হবে।

সুতরাং ক্ষতিপূরণ হিসেবে সে কিছু অর্থ চাইতেই পারে।

তাছাড়া, হিন্দুসমাজে একঘরে হয়ে থাকার যন্ত্রণা অনেক। সবচেয়ে বড় সমস্যা নিঃসঙ্গ অসহায়তা।

বিপদে-আপদে কেউ পাশে দাঁড়াবে না।

ডাক্তারবদ্যি বাড়ির পথ মাড়াবে না।

তবে অর্থ অনেক সমস্যার সমাধান করে সহজেই।

বাড়িতে আশ্রিত এক গরিব ব্রাহ্মণ যুবককে অর্থের লোভ দেখাল শুকদেব।

সেই টোপ শেষ পর্যন্ত গিলল মঙ্গলানন্দ মুখোপাধ্যায়।

বিশাল জমিজায়গার বদলে সে বিয়ে করতে রাজি হল রত্নমালাকে। বিয়ের পর মঙ্গলানন্দ বউ নিয়ে দেশে ফিরতে পারল না।

মুসলমান নষ্ট হিন্দুর বোনকে বিয়ে করার অপরাধে মঙ্গলানন্দের বাপ-মা তাকে ত্যাগ করল। মঙ্গলানন্দের পাশে দাঁড়াল শুকদেব। সে তার প্রতিশ্রুতি রাখল।

বোন রত্নমালাকে বিয়ে করার যৌতুক হিসেবে সে মঙ্গলানন্দকে দিল আড়াইশো বিঘে জমি।

মঙ্গলানন্দ আর রত্নমালার বিয়ে থেকে তৈরি হল পিরালি-ব্রাহ্মণ বংশের আরও এক শাখা।

এবার আসি দক্ষিণডিহিতে। সেখানে ভৈরব নদীর কেয়াতলার ঘাটে দক্ষিণকালীর মন্দির।

এই মন্দির তৈরি করেছেন জমিদার দক্ষিণানাথ চৌধুরি। আগেই জানিয়েছি সেকথা।

এল এক দুর্যোগের রাত।

উত্তাল ভৈরব নদী।

ডুবে যায় বুঝি জগন্নাথ কুশারীর বজরা।

মাঝিরা কোনওরকমে বজরা ভিড়িয়ে দিল দক্ষিণকালীর মন্দির-ঘাটে।

ভীষণ ঝড়বৃষ্টির সেই রাতে জগন্নাথ আশ্রয় নিল মন্দিরে।

সেই সংবাদ গেল শুকদেবের কানে।

সে এই সুযোগ নষ্ট করার মানুষ নয়।

লোকজন নিয়ে ঘিরে ফেলল মন্দির।

জগন্নাথ কুশারীকে পালাতে হলে ঝাঁপ দিতে হবে উন্মত্ত ভৈরব নদীতে।

শুকদেব বলল, আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। তোমাকে শুধু একটি কাজ করতে হবে।

– কী কাজ? প্রশ্ন করে জগন্নাথ।

– আমার মেয়ে সুন্দরীকে বিয়ে করতে হবে তোমাকে। আমরা মুসলমানের জল ছোঁয়া পিরালি ব্রাহ্মণ। আমার মেয়েকে বিয়ে করলে হিন্দু সমাজে তোমার স্থান হবে না।

– তাহলে? আমার এত বড়ো সর্বনাশ আপনি করবেন না।

– তোমার সর্বনাশ করলে তো আমার মেয়েরও সর্বনাশ। তোমাকে যৌতুক হিসেবে দেব বারোপাড়া নামের এক বিশাল গ্রাম। সেইখানেই থাকবে তুমি। তোমার সব দায়দায়িত্ব আমার। একে তুমি সর্বনাশ বলো?

– তার মানে এক রকমের ঘরজামাই?

– তোমাকে তো পুরো গ্রামটাই দিয়ে দেব জগন্নাথ। আমার বিষয়-সম্পদও তোমারই হবে। ঘরজামাই হতে তোমার আপত্তি কোথায়?

– আপত্তি নেই তো, মৃদু স্বরে বলে জগন্নাথ। তারপর প্রণাম করে শুকদেবকে।

জগন্নাথ কুশারী-ই ঠাকুরবাড়ির প্রথম ঘরজামাই! এবং ইনিই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এক আদিপুরুষ।

দ্বারকানাথের সাতপুরুষ আগে জগন্নাথ।

জগন্নাথ কুশারী আর সুন্দরীর দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম।

তার ছেলে বলরাম।

তার ছেলে মহেশ্বর।

তার ছেলে পঞ্চানন।

তার ছেলে জয়রাম।

তার ছেলে নীলমণি।

তার ছেলে রামমণি।

এবং তার ছেলে দ্বারকানাথ।

দ্বারকানাথকে বুঝতে কুশারীদের বংশধারা একটু জানতে হবে বৈ কি।

রবীন্দ্রনাথও কিন্তু আসলে কুশারী। অনেকেই আমরা সেকথা ভুলে যাই।

সব থেকে জরুরি সত্যটি হল, মুসলমান পির আলির ‘প্রভাবনষ্ট’ একটি শাখা কুশারী ব্রাহ্মণ।

দীন নামের এক ব্রাহ্মণই বোধহয় প্রথম কুশারী ব্রাহ্মণ। তিনি কেন কুশারী?

কারণ তিনি থাকেন কুশ গ্রামে।

কুশ গ্রামটি কোথায়?

বর্ধমানে।

কুলীন ব্রাহ্মণ বলে কুশারীদের এক সময়ে খুব খ্যাতি। প্রতিপত্তি-ও কম নয়।

কুশারীরা ক্রমে বিচিত্র শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে পড়ছে। যশোর জেলার ঘাটভোগ-দমুরহুদা থেকে ঢাকার কয়কীর্তন। সেখান থেকে বাঁকুড়ার সোনামুখি। সেখান থেকে খুলনার পীঠাভোগ।

খুলনার পীঠাভোগের কুশারীরাই সবচেয়ে প্রভাবশালী।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবার খুলনার পীঠাভোগের কুশারীদেরই একটা ধারা। এবং এই ধারাই দ্বারকানাথের উৎস। তাঁর ক্রোমোসোম এই ধারারই অবদান।

তাঁর প্রাণশক্তি, তাঁর মেধা, তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞের প্রাণন, উৎসাহ, পরিশ্রম, তাঁর বোধ ও প্রতীতির অনন্যতা, সব কিছু উৎসারিত তাঁর বিশেষ কুশারী-বংশধারার সংকেতবাহী সূক্ষ্ম তন্তু থেকেই। বাণিজ্য ছিল দ্বারকানাথের রক্তে।

আর এই কলকাতাই যে হবে তাঁর বাণিজ্য ও বিস্তারের কেন্দ্র, তাও যেন তাঁর জিন বা বংশাণুর নির্দেশ।

কলকাতার সঙ্গে পিরালি-ব্রাহ্মণ কুশারীদের সম্পর্কের আদিপুরুষ মহেশ্বর।

কে এই মহেশ্বর?

মহেশ্বর রামানন্দ কুশারীর ছেলে।

পুরুষোত্তমের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ রামানন্দ।

মহেশ্বর কুশারীই প্রথম কলকাতায় এল জীবিকার সন্ধানে।

রামানন্দের জীবন কাটে সতেরো শতকের মাঝামাঝি।

সবে তখন জোব চার্নক কলকাতার পত্তন করলেন।

রামানন্দের ছেলে মহেশ্বরের সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে-ই জোড়াসাঁকো কয়লাঘাটা, ঠনঠনিয়া, পাথুরিয়াঘাটা ও রামবাগানের ঠাকুরপরিবারের উৎস!

মহেশ্বরের ছেলে পঞ্চানন, দ্বারকানাথের চারপুরুষ আগে, পাকাপাকি চলে এল কলকাতায়।

তার রক্তে একটিই সন্ধানের ডাক। অর্থ।

সে এক অন্য কলকাতা। অর্থ ছাড়া এ-শহরও যেন কিছু বোঝে না।

বাণিজ্যের রমরমা।

পর্তুগিজ ওলন্দাজ বণিরকরা যেভাবে পারে অর্থ উপার্জন করছে।

বাঙালি পঞ্চানন নেমে পড়ল সেই বাণিজ্য স্রোতে।

শেঠ-বসাকদের তখন সুতাবস্ত্রের হাট কলকাতায়। যার থেকে শহরের নাম ‘সুতানুটি’।

শেঠ-বসাকদের একচেটিয়া, বাণিজ্যের দিকেও হাত বাড়াল হিন্দুসমাজে একঘরে, তবুও কুলীন ব্রাহ্মণ, পঞ্চানন কুশারী।

যেন অবিশ্যি কলকাতা এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম।

কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে, আদি গঙ্গার ধারে, গোবিন্দপুর।

পঞ্চাননের মনে ধরল গোবিন্দপুরের পরিবেশ।

এই গ্রামে মূলত জেলে-মালো-কৈবর্তদের বসবাস। তারা অশিক্ষিত ভালোমানুষ।

পঞ্চানন ধূর্ত। সে বুঝেছে, এই মানুষগুলোর ওপর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করা সহজ হবে।

অচিরে গোবিন্দপুরের মাতব্বর হওয়া তার পক্ষে শক্ত হবে না।

সে কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য প্রথমে কাউকে বুঝতে দিল না। সেই উদ্দেশ্য হল যে সব বিদেশি জাহাজ আসে গোবিন্দপুরে, তাদের মাল সরবরাহ করে সাহেবদের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করা।

এখানে তার প্রতিযোগী হওয়ার মতো কেউ নেই।

পঞ্চানন বুঝতে পারে, ধনী হতে তার বেশি সময় লাগবে না। পঞ্চাননের ছক যে একেবারে সঠিক, তা প্রমাণিত হল তাড়াতাড়ি। অর্থ-সম্পদের প্লাবন এল গরিব সমাজচ্যুত ব্রাহ্মণের ভাগ্যে।

এই গরিব মুসলমানদুষ্ট ব্রাহ্মণ গোবিন্দপুরের গঙ্গার ধারে ক্রমাগত কিনতে লাগল জমি।

প্রতিষ্ঠা করল শিবমন্দির।

সাহেবদের মদত পেয়েছে সে। ভাবনা কী?

কী চতুর বুদ্ধি পঞ্চাননের। সে বসবাস করেনি ব্রাহ্মণ-পাড়ায়।

সে জানে, কলকাতার ব্রাহ্মণ পাড়ায় সে যে পিরালি-ব্রাহ্মণ এ কথা রটে যেতে দেরি হবে না।

তাই সে অচ্ছুৎ জেলে-মালো-কৈবর্তদের পাড়ার ঘর বেঁধেছে। এখানে সে ব্রাহ্মণ বলে ভক্তিশ্রদ্ধা পায়।

তার অর্থ যত বাড়ছে, গরিবদের মধ্যে তার প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধাও ততো বাড়ছে।

এরপর সে প্রতিষ্ঠা করল শিবমন্দির! এবং সেই মন্দিরে পঞ্চানন কুশারী প্রতিদিন নিজেই পুজো করে। ত্রিসীমানায় আর কোনও ব্রাহ্মণ নেই।

সেই একমাত্র সবেধন নীলমণি ব্রাহ্মণ পঞ্চানন কুশারীকে পুজো করে জেলে-মালো-কৈবর্তরা।

তারা জানেও না এই কুলীন ব্রাহ্মণ আসলে হিন্দুসমাজ থেকে বিতাড়িত। এই ব্রাহ্মণের কুলীনত্ব নষ্ট করেছে গো-মাংস ভক্ষণ! মিশেছে মুসলমান প্রভাবের অবিশুদ্ধি। খাদ। ভেজাল।

কুলীন ব্রাহ্মণেরা জানে পঞ্চানন কুশারী কতদূর মেকি ব্রাহ্মণ। আসলে সে তো ‘মুসলমান’-ই।

হিন্দু ঘরে তার ছোঁয়া জল চলবে না।

কী এসে যায় গোবিন্দপুরের অচ্ছুৎ পাড়ায়।

তারা এই প্রথম দেখল, এক ধনী কুলীন ব্রাহ্মণ!

কী সুন্দর দেখতে তাকে!

আর যখন পুজো করে, আহা কী ভক্তি!

গ্রামের উন্নতির জন্যে, গরিবের মঙ্গলের জন্যে পঞ্চানন ঠাকুর তো বিনা প্রশ্নে টাকাও দেয় গো!

আমাদের কী ভাগ্য, অমন ঠাকুরকে আমরা কাছে পেয়েছি।

ঠাকুর বলে ঠাকুর!

পঞ্চানন ঠাকুর!

কুশারী পদবী ঝরা পাতার মতো কখন খসে গেল!

১২

সাহেবরা ঠাকুর বলতে পারে না। ঠাকুর শব্দটার মধ্যে কেমন যেন একটা ধর্ম-ধর্ম ভাব আছে। সেটাও তারা হয়তো আঁচ করতে পেরেছে।

ঠাকুরের পরিবর্তে ‘টেগোর’ তাদের মেজাজ, জিভ এবং রুচির পক্ষে অনেক বেশি গ্রহণীয়।

ঠাকুর বড্ড বেশি মিহি। নম্য। নেতিয়েপড়া।

টেগোর শব্দটার মধ্যে বেশ একটা ওজনদার অভিব্যক্তি আছে।

পদবী নয়তো।

গর্জন!

পঞ্চানন একটি চরিত্র বটে।

এমন বাঙালি সাহেবরাও বেশি দেখেনি।

সকালবেলা সে বেজায় ভক্ত হিন্দু। ভাজা-মাছ-উল্টে- খেতে-না-জানা মিউ-মিউ করা শিবপূজারি পঞ্চানন ঠাকুর।

যত বেলা বাড়ে অন্য মানুষে পরিবর্তিত হয় পঞ্চানন। সে জাহাজে মাল সরবরাহ করত।

এখন সাহেবদের চোখে সে রীতিমতো ‘স্টিভেডর’। জাহাজে মাল তোলা, মাল খালাস করার বাণিজ্যে সে জাঁকিয়ে বসেছে।

নতুন জাহাজ ঘাটে ভিড়লেই ডাক পড়ে স্টিভেডর পঞ্চানন টেগোরের! সকালবেলা শিবমন্দিরে ঘণ্টা নাড়া পুরোহিত। গরিবের চোখে বড় ভালো মানুষ ব্রাহ্মণ পুরোহিত!

স্টিভেডর পঞ্চানন টেগোরের অন্য মূর্তি। জাহাজে মাল তোলা, খালাস করা যে সে কাজ নয়।

কুলিমজুরদের কী করে কম পয়সায় খাটাতে হয়, তাদের দিয়ে নানা কুকর্ম করাতে হয়, ডক চালাবার জন্যে কীভাবে পুষতে হয় গুন্ডা, আর জাহাজের সাহেব কর্মীদের কীভাবে সুরা-নারী-নৈশ জীবনের নানা খোরাক জুগিয়ে হাতে রাখতে হয় সব জানে পঞ্চানন টেগোর।

সাহেবরা ফুর্তি করতেও তারই শরণাপন্ন হয়।

অর্থের উপার্জনে কোনও পাপপুণ্যের ধার ধারে না পঞ্চানন টেগোর। যে-কোনও পথেই মা লক্ষ্মীর আগমন হোক, কী এসে যায়।

তাছাড়া পঞ্চানন টেগোর একটি সার কথা বুঝে নিয়েছে। জীবনের একমাত্র পুণ্যি অর্থোপার্জন।

টাকা সব পাপ সাদা করে দেয়।

মি: পঞ্চানন টেগোর একটি মাত্র অন্ধকারকে ভয় পায়।

দারিদ্র্যের অন্ধকার।

দারিদ্র্যের চেয়ে বড় পাপও আর নেই।

দরিদ্র মূর্খ বোকা কৈবর্ত-মালো-জেলের পাড়ায় বড্ড অন্ধকার।

পঞ্চানন টেগোরের হাঁফ ধরে।

– মিস্টার টেগোর, কেন পড়ে আছ ওই গরিবদের মধ্যে। ওখানে তোমাকে মানায় না, বলে সাহেবরা।

– কিন্তু ওখানে যে প্রতিষ্ঠা করেছি শিবমন্দির।

– আরে ছাড়ো তোমার শিবমন্দির। মাইনে দিয়ে প্রিস্ট রেখে দাও। পুজো তোমাকে করতে হবে কেন?

সাহেবদের এই পরামর্শ মনে ধরে পঞ্চানন টেগোরের।

ঠিক তো!

পঞ্চানন টেগোর বেশ খুশি। সে ভেবে আনন্দ পায় যে এক গরিব কুলীন ব্রাহ্মণ তার তৈরি মন্দিরে পুরুতের চাকরি করবে!

কোথায় গেল কুলীন ব্রাহ্মণের অহং!

অর্থ থাকলে সব সম্ভব।

কুলীন ব্রাহ্মণকে কিনতেও পারে মুসলমান-দুষ্ট পঞ্চানন টেগোর।

টেগোর পদবী থেকে বোঝবার উপায় নেই, পঞ্চানন ব্রাহ্মণ না অব্রাহ্মণ।

বাঙালি না অবাঙালি।

সাহেবদের পরামর্শই সঠিক।

মি: পঞ্চানন টেগোর বিপুল পরিমাণ জমি কেনে আজকে যেখানে ফোর্ট উইলিয়াম।

সেখানে তৈরি করে বিপুল গোলপাতার টেগোর-আবাস।

কলকাতার প্রথম ঠাকুরবাড়ি।

১৩

কাহিনির নায়ক দ্বারকানাথের রক্তের ‘স্বাদ’ পেতে আমাদের জানতে হবে তাঁর আরও দুটি পূর্বপুরুষকে।

ওরা জয়রাম ও সন্তাোষরাম।

পঞ্চানন ঠাকুরের দুই ছেলে।

পঞ্চানন সাহেবদের নেকনজরে পড়ে, ধূর্তামি, বুদ্ধি, পরিশ্রমের ফলে, ঠাকুর থেকে টেগোর হল।

ধর্মতলায় তৈরি করল গোলপাতার ঠাকুরবাড়ি।

তখন ধর্মতলার নাম ধনসায়র।

সেখানেই তো ক্রমে বান আসছে সাহেবদের বৈভব ও ঐশ্বর্য সাগরে।

জয়রাম ও সন্তাোষরামের রক্তে বাণিজ্য।

যেখানে অর্থের গন্ধ সেখানেই দুই ভাই।

অর্থ উপার্জনের যে-কোনও রাস্তা, অলিগলি, উপায় তাদের কাছে গ্রহণীয়।

নৈতিক-অনৈতিকের বাদবিচার নেই।

অচিরে ফুলে-ফেঁপে উঠল জয়রাম সন্তাোষরাম।

এই সময়ে সুযোগ বুঝে এক সাহেবের ছাতার তলায় ঢুকে পড়ল তারা।

জয়রাম সন্তাোষরাম যতো ধনীই হোক, তারা যে একঘরে, ম্লেচ্ছদুষ্ট পিরালি ব্রাহ্মণ, সবাই জানে।

সুতরাং হিন্দু সমাজে তাদের স্থান নেই।

তারা হাত বাড়াল কলকাতার ধনী সাহেব আর মুসলমানদের দিকে। গোমাংস ভক্ষণে আপত্তি নেই তাদের। ম্লেচ্ছ সংসর্গে তাদের বিকার নেই।

যে-সাহেবের ছত্রছায়ায় তারা এই মুহূর্তে আশ্রিত তার নাম র্যালফ সেলডন। কলকাতার ‘কালেকটর।’

দ্বারকানাথের প্রপিতামহ জয়রাম শুধুই যে বাণিজ্যে অর্থোপার্জন করছে তা নয়। সে রীতিমতো মেধাবী। বিশেষ করে তার টান ভাষাচর্চার দিকে।

সে খুব তাড়াতাড়ি শিখে গিয়েছে ইংরেজি ও ফার্শি।

ইংরেজি ভাষায় তৎপর জয়রাম ইংরেজ বণিকদের প্রিয়পাত্র।

ইংরেজরা তাকে ডাক দিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ পে-মাস্টারের অধীনে প্রধান কর্মচারী হওয়ার জন্য।

সেই চাকরি নিতে এতটুকু দেরি করল না জয়রাম। সে বাণিজ্যের পাশাপাশি চাকরিও করতে লাগল।

ইংরেজরা অবাক তার পরিশ্রম করার ক্ষমতায়!

আরও একটি ব্যাপার বিস্মিত করল ইংরেজকে।

জয়রাম ইংরেজের চাকরি করেও বাণিজ্যে ইংরেজের প্রতিযোগী!

এমন বাঙালি তারা দেখেনি!

১৭৪১ সাল।

কলেকটর র্যালফ সেলডন ডেকে পাঠাল জয়রাম আর সন্তাোষরামকে।

– আজ্ঞা করুন স্যর, বিনয়ের সঙ্গে বলল দুই ভাই।

– সুতানুটি ও গোবিন্দপুরে প্রথম জরিপের কাজ শুরু হতে চলেছে। তাই তোমাদের খুব প্রয়োজন।

– কী কাজের জন্য স্যর?

– কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তোমাদের ওপর ইংরেজের আস্থা আছে।

– ধন্যবাদ স্যর। আমরা নিশ্চয় ইংরেজের আস্থার যোগ্য হতে চেষ্টা করব।

– বেশ, তাহলে আমি তোমাদের দুজনকেই আমার অধীনে এই জরিপের দুই আমিন নিযুক্ত করলাম।

ততদিনে জয়রাম গত হয়েছে। দেখে যেতে পারল না এক সমাজচ্যুত পরিবারের দুই সন্তান কীভাবে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির আসনে প্রতিষ্ঠিত হল।

আমিনের কাজ মানেই বেতনের সঙ্গে উপরি পাওনার দরজা খোলা।

জয়রাম সন্তাোষরাম জানে, আগে সাহেব প্রভুর প্রাপ্য চুকিয়ে দাও। তারপর নিজের দিকে ঝোল টানো।

উপরি পাওনার সবটুকু আত্মসাৎ করার লোভ তারা সামলাতে শিখেছে।

সুতরাং তারা রাতারাতি ধনী হল না বটে। কিন্তু সেলডন সাহেবকে খুশি রেখেই তারা ক্রমাগত উপরি অর্থে কিনতে লাগল জমিজায়গা।

তারপর ধীরে ধীরে উঠল দুই সমাজচ্যুত ভাইয়ের প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি। ধনসায়রের ঠাকুরবাড়ি!

ঠিক যেখানে ছিল বাবা জয়রামের গোলপাতার ঘর। পরে যেখানে তৈরি হবে ফোর্ট উইলিয়াম।

সে আর এক গল্প!

১৪

কলকাতার দক্ষিণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রমরমিয়ে চালাচ্ছে জরিপের কাজ।

আটতিরিশটা গ্রাম নিয়ে এই কাজ। কম কথা নয়। প্রাণপাত পরিশ্রম করছে জয়রাম। সেই সঙ্গে বাণিজ্য।

জয়রাম কি জানে তার কত টাকা? কিন্তু তার যে আরও অর্থ চাই। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য অর্থ। ধনী হতে হবে। সাহেবদের মতো ধনী।

সে একটি জিনিস ভারি নিবিষ্টভাবে লক্ষ করেছে।

সাহেবরা ভারি খরচে।

তাদের অনেকেই যা আয় করে উড়িয়ে দেয় তার চেয়ে বেশি। অনেকেই ফুর্তি করতে শিখেছে বেশ্যা-বাইজির সঙ্গে।

– আচ্ছা, কোন সুদূর ইংল্যান্ডে বউবাচ্চচা ছেড়ে এসেছ। রেখে এসেছ ভালোবাসার মেয়েকে। এই যুবা বয়েসে শরীর-মনের কথাও তো ভাবতে হবে, সাহেবদের উস্কে দেয় জয়রাম।

– কী আর উপায় বলো! কোনও-কোনও ইংরেজের আক্ষেপ।

– উপায় আছে সাহেব। সব ব্যবস্থা হতে পারে।

– উৎসাহ ঝিলিয়ে ওঠে ইংরেজের চোখেমুখে।

– ব্যবস্থা করে দেয় জয়রাম।

– ফ্যালো কড়ি মাখো তেল, বলে জয়রাম।

সাহেবরা আদি আনন্দের জন্যে কড়ি ফেলতে পরোয়া করে না। হুঁশ থাকে না খরচের।

হাতটান পড়ে।

– আমি তো আছি সাহেব, চড়া সুদে সাহেবদের টাকা ধার দেয় জয়রাম।

জয়রামের কাছে টাকা ধার করতে-করতে হর্তা-কর্তা-বিধাতা সাহেবরা ক্রমে চলে আসে তার হাতে মুঠোয়।

কিন্তু কী করে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা যায় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে? মতলব পাকা করতে ঘুম নেই জয়রামের চোখে। সন্তাোষরাম না জানতে পারে। তাহলেই ভাগ দিতে হবে।

কিন্তু নবদ্বীপের কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে জয়রামের আলাপ হল কী করে?

খুব সহজে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই তো জরিপের আটতিরিশটা গ্রামের অধীশ্বর। টুক করে তাই আলাপের পর্ব সেরে রেখেছে জয়রাম।

এবার দ্বিতীয় পর্বের খেলা।

গরিব ব্রাহ্মণ জয়রাম। দীনদরিদ্রই বলা যায়। তবে পরম হিন্দু। এবং ভক্ত। এইটুকু সে কৃষ্ণচন্দ্রের বিশ্বাসে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে।

এই মুহূর্তে জয়রাম নবদ্বীপে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সামনে উপবিষ্ট।

– প্রভু, একটি নিবেদন আছে, জয়রাম করজোড়ে বলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে।

– বলো বলো জয়রাম। তোমার মতো পরম ভক্ত এবং পণ্ডিত হিন্দুর কথা শুনতে বড় ভালোলাগে আমার।

– প্রভু, আবেগের বশে গৃহে একটি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি।

– বল কী জয়রাম! তা কার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলে?

– রাধাকান্ত বিগ্রহ!

পরম বৈষ্ণব রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। গরিব ভক্ত পরমহিন্দু জয়রামের মুখে গৃহে রাধাকান্ত বিগ্রহের প্রতিষ্ঠার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে তাকান। তাঁর চোখ ছলছল করছে।

জয়রাম ধনসাগরে তার প্রাসাদতুল্য বাড়ির কথা বেমালুম চেপে গেছে।

এক স্ত্রীতে তার মন ভরেনি। দুই যুবতীকে বিয়ে করেছে সে।

রীতিমতো ভোগবিলাসের জীবন।

তার দুই স্ত্রী যশোরের মেয়ে। যশোরের মেয়েদের মধ্যে আলাদা টান থাকে, মনে করে জয়রাম।

জয়রাম পিরালি ব্রাহ্মণ। কোন কুলীন ব্রাহ্মণের মেয়ে তাকে বিয়ে করবে?

দুই স্ত্রী, গঙ্গা আর রামধনিকে সে অনেক খুঁজে বের করেছে।

দুজনেই গরিবের মেয়ে। তাদের বাবারা জয়রামের অর্থের ফাঁদে ধরা দিয়ে গ্রামে একঘরে হয়েছে।

ইতিমধ্যে চারটি ছেলেও হয়েছে জয়রামের। গঙ্গার গর্ভে আনন্দীরাম আর নীলমণি। আর রামধনির গর্ভে, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম।

জয়রাম আর গঙ্গার ছেলে নীলমণিই তো দ্বারকানাথের ঠাকুর্দা। এবং ঠাকুরবংশের জোড়াসাঁকো-ধারার উৎস। সে-গল্পেই আসবো।

কিন্তু এখন আমরা নবদ্বীপে। মুখোমুখি কৃষ্ণচন্দ্র ও জয়রাম।

গরিব ব্রাহ্মণ জয়রামের গৃহে ‘রাধাকান্ত’ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার গল্পে তিনি অভিভূত।

এই সেই পরম লগ্ন। এক মিনিটও দেরি করল না জয়রাম। খেলে দিল তার তুরুপের তাস।

– বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করলেই তো হল না প্রভু। নিয়মিত সেবার অর্থ কীভাবে যোগাব?

দীন ব্রাহ্মণ জয়রাম কেঁদে পড়ল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পায়ে।

কৃষ্ণচন্দ্র বুকে জড়িয়ে ধরলেন জয়রামকে। ছি ছি এ কী করলে! আমার মতো সামান্য মানুষের পায়ে পড়লে!

জয়রামের কান্নায় মিশে গেল কৃষ্ণচন্দ্রের কান্না।

ধর্মপ্রাণ কৃষ্ণচন্দ্র আর কোনও প্রশ্ন করলেন না।

দেবসেবার জন্য জয়রামকে দান করলেন তিনশোএকতিরিশ বিঘে জমি।

১৫

জয়রামকে দেখতে কিছুতেই মনে হয় না বাঙালি ব্রাহ্মণ।

লম্বা। চওড়া। গৌরবর্ণ। তীক্ষ্ন নাক। চাপা ঠোঁট। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। চওড়া কপাল। ঋজু শিরদাঁড়া। শক্তপোক্ত হাড়। দৈর্ঘ্যে ছ’ফুটের ওপর।

পাঠান মুসলমান ভাবে, আমাদেরই একজন হতে পারত!

ইংরেজ ভাবে, বাঙালিদের মধ্যে এরকম খাঁটি আর্য চেহারা কেমন করে এল।

জয়রামের দুই বউ ভাবে, যেমন শরীর তেমন স্বভাব। তাদের স্বামীটি দেহতৃষ্ণায় অবিরল, অতৃপ্ত।

বিয়ের প্রথম ক’বছর দুই বউকে দু-পাশে নিয়ে রাত কাটায় জয়রাম।

ব্যাপারটা মন্দ লাগে না গঙ্গার। ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগে না রামধনির।

শরীর খোলার ব্যাপার গঙ্গার কুণ্ঠা নেই তেমন কোনও।

সার্থক নাম গঙ্গা।

জয়রামের জন্যে সে যেমন খুশি সাঁতার বিছিয়ে দিতে রাজি।

স্বামীর কাছে কীসের লজ্জা?

কীসের কুণ্ঠা সতিনের কাছে গা খুলতে?

এ রকম মিলেমিশে সঙ্গম ক্রমেই যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছে গঙ্গাকে।

রামধনির ঠিক উল্টো। গঙ্গার চেয়ে লজ্জা তার অনেক বেশি।

সতিনের সামনে একটু আদরটাদর চলতে পারে।

কিন্তু তাবলে একেবারে সবটা?

জয়রামের নাকি এতেই বেশি তৃপ্তি!

লোকটা বড্ড বেশি কামুক। কখনোই ক্লান্তি নেই তার।

গঙ্গা কী করে পারে?

রামধনির যে হাঁফ ধরে যায়।

বয়েসে গঙ্গাই বড়। অথচ ওর শরীর এতটুকু টসকায়নি।

রামধনি সব খুলে নিজের শরীরের দিকে তাকায়।

সুন্দর। কিন্তু আলগা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে যে!

গঙ্গা এখনও তিরতির করে বইছে।

সতিনের ওপর রাগ হয় রামধনির।

– আমার এসব আর ভাল্লাগে না, জয়রামকে একদিন একলা ঘরে বলে রামধনি।

– কী ভাল্লাগে না?

– এই তিনজনে একসঙ্গে শোয়া।

– বাড়িতে তো ঘরের অভাব নেই। আলাদা শুলেই পার।

জয়রামের কাছে এই উত্তর আশা করেনি রামধনি।

– শুধু গঙ্গাকে নিয়ে মন ভরবে তোমার? ও একাই মিটিয়ে দেবে তোমার তেষ্টা?

জয়রাম কোনও উত্তর দেয় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রামধনি বলে, নতুন আর একটিকে ঘরে তুলছ কবে? খুঁজে পেয়েছ আমার বাবার মতো কুলীন বামুন যে তোমার মতো মোচরমানের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে?

জয়রামের বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে।

সে অতি কষ্টে রাগ চেপে বলে, কলকাতা শহরে হাতে টাকা থাকলে মেয়েমানুষ পেতে বিয়ে করতে হয় না।

– ছি^ঃ, ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মিশে মুখে আজকাল তোমার কিছুই আটকায় না। তা, বিয়ে না করে কোনও মেয়েকে শোবার ঘরে ঢোকালে গঙ্গাদিদি মেনে নেবে তো?

– গঙ্গা একাই যথেষ্ট, বলে জয়রাম। যেন বজ্রপাত ঘটে রামধনির বুকে।

– আমার কাছে কিছুই পাওনা তাহলে?

– তুমি বিছানাতেও ধোয়া তুলসি। গঙ্গা নামেই গঙ্গা। ওর মধ্যে পাপের চোরাস্রোত আছে। ও আমাকে উত্তেজিত করে। তৃপ্তিও দেয়। তুমি বয়েসে ছোট। গঙ্গার কাছে পুরুষমানুষ কী চায়, না চায়, সে-বিষয়ে তোমার অনেক কিছু শেখার আছে।

– তোমার গঙ্গার কাছে আমি কিছুই শিখতে চাই না। যা শিখতে হবে, তুমিই শিখিয়ে দিও। আমি আজ থেকে অন্য ঘরে শোবো।

জয়রাম কোনও উত্তর দেয় না। হাতে বইটির পাতা উল্টে সম্ভবত পড়বার ভান করে।

– কানে কথাটা গেল না বুঝি?

জয়রাম কোনও উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। সে বই পড়তে থাকে।

রামধনি হঠাৎ ছোঁ মেরে বইটা জয়রামের হাত থেকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

জয়রাম অবাক হয়ে তাকায় রামধনির চলে যাওয়ার দিকে।

ঘটনাটা সত্যি ঘটল?

বিশ্বাস হয় না তার নিজের চোখকে।

১৬

সেই রাত্রে শোবার ঘরে গঙ্গা আর জয়রাম।

– কীসে ব্যস্ত ধনি? এত রাত হল, তবু ঘরে এল না?

অনেকটা যেন নিজের মনেই বলে গঙ্গা।

– আসবে না। রামধনি এবার থেকে আলাদা ঘরে শোবে?

– কেন? প্রশ্ন করে বিস্মিত গঙ্গা।

– তুমি একাই যথেষ্ট।

– সেকথা বলেছ ওকে?

– হ্যাঁ, বলেছি।

– কী বলেছ শুনি!

– বলেছি, গঙ্গা একাই যথেষ্ট।

– হঠাৎ একথা বলতে গেলে কেন?

সবটুকু বলে না জয়রাম। তবে গঙ্গার কাছে এড়িয়ে যাওয়াও যায় না।

যা জানবার জেনে যায় গঙ্গা।

সে গৃহদেবতা রাধাকান্তকে মনে মনে প্রণাম করে।

ভগবান প্রার্থনা শুনেছেন।

এ তো সোনার সুযোগ!

গঙ্গা অন্ধকারের মধ্যে জয়রামের প্রবল শরীরটিকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। তারপর গাঢ় কণ্ঠে বলে, ডুব দাও তোমার গঙ্গায়।

জয়রামের হাতটিকে নিজের হাতের মধ্যে ধরে গঙ্গা।

– না না ওখানে নয়। ওখানে আজ সাড়া নেই। আজ অন্য জায়গায়। তোমার গঙ্গার এক এক রাতে এক এক জায়গায় সাড়া। বোঝো না? এতদিনেও জানলে না?

– মেয়েমানুষের শরীর চিরকালের রহস্য। বুঝি না বলিই তো ফুরোয় না।

– রামধনির শরীরও তাই?

– না। গঙ্গার।

– তাহলে বললে কেন মেয়ে মানুষের শরীর? গঙ্গা অন্য। গঙ্গা আলাদা।

– তাই তো বলেছি, তুমি একাই যথেষ্ট।

– কথা বোলো না তো। আজ শুধু আমি কথা বলবো, বলে গঙ্গা।

সে জয়রামের হাতটিকে নিয়ে যায় তার উরুসন্ধিতে। তারপর বলে, আঁচ পাচ্ছ?

– আজ বুঝি এখানে সাড়া? বলে জয়রাম।

– বলছি না, কোনও কথা বোলো না। আঁচ নাও। আমার আগুনের হলকা।

জয়রামের হাত ছেড়ে দেয় গঙ্গা। জয়রামের আঙুলের স্পর্শ গঙ্গার উরুসন্ধির গনগনে পথ ধরে এগোতে থাকে। তাড়াতাড়ি নয়। একটু একটু করে। আঁচের প্রতিটি স্তর ছুঁতে-ছুঁতে এগিয়ে চলে জয়রামের আঙুল।

জয়রামের হঠাৎ মনে হয়, সে যেন প্রাগৈতিহাসিক মানুষ। গুহার অন্ধকারে স্পর্শ করছে এক আদিম নারীকে।। তখনও চালু হয়নি বিবাহপ্রথা। স্থায়ী সম্পর্ক বলেও কিছু নেই। নিবিড় আদিম অন্ধকারে কে কার পাশে, কী করে বোঝা যায়?

চেনা স্পর্শ, চেনা কণ্ঠস্বর, চেনা শরীরের উঁচুনীচু, চেনা ভাষা- এইসব নিশ্চিত ইশারা থেকে হয়তো অন্ধকারেও চেনা যায় যাকে চিনতে চাইছে মন।

কিন্তু অচেনা নতুন শরীর পাওয়ার উত্তেজনা নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে! না, আর কোনও কথা নেই।

সমস্ত অন্ধকার তখন শরীর হয়ে জ্বলছে।

আগুন কী অন্ধকার।

হলকা কী উত্তেজক!

আজ জয়রামের ঘরে কোনও আলো নেই।

শেজের শিখাটুকু কাঁপতে-কাঁপতে নিভে গেছে।

গঙ্গা আজ আলো চায় না।

জয়রামও।

গঙ্গার অরণ্যে দাবানল। জয়রামের আঙুল পৌঁছে গেছে সেখানে।

গঙ্গা তুলে আনে সেই আঙুল তার একটি স্তনবৃন্তের ওপর।

গঙ্গার বুক?

না কি অন্য কোনও রমণীর?

শ্যামল মেয়ের কালো বৃন্তটি কতবার দেখেছে জয়রাম এত বছরের বিবাহিত জীবনে।

সে নিজে গৌরবর্ণ বলেই তার ভালোলাগে শ্যামলবর্ণা নারী।

গঙ্গার বৃন্তটি নিটোল। মিলন মুহূর্তে বৃন্ত দুটি জেগে ওঠে। কালো আরও ঘন কালো হয়। চারপাশের বৃত্তটি কুঁচকে ছোট হয়ে আসে।

বৃন্তের গায়ে উঁচুউঁচু হয়ে ফুটে ওঠে কামদানা।

কিন্তু কোনওদিন তো গঙ্গার বৃন্ত দুটি এমন শক্ত আর দীর্ঘ আর উত্তপ্ত হয়ে উঠতে দেখিনি, মনে হয় জয়রামের।

 সে প্রথমে ঠোঁট রাখে গঙ্গার বৃন্তে।

গঙ্গা বৃন্তটি ঠেলে দেয় জয়রামের মুখের মধ্যে।

অস্পষ্ট স্বরে বলে, আঃ, কী ভালো!

জয়রামের সমস্ত ইন্দ্রিয় একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, এই তো অমৃত।

জয়রামের মনে পড়ে, গঙ্গার নাভির নিচে সরু হয়ে নেমে যাওয়া ঘন কালো একটি রোমরেখা।

ছিপছিপে স্রোতের মতো মিশে গেছে তার বিস্তৃত অরণ্যে।

আর কোনও রমণীর নাভির নিচে এমন সরু ঘন লোমের রেখা দেখেনি জয়রাম। জয়রাম নাম দিয়েছে কামরেখা।

গঙ্গার শরীরের এই বিশেষত্বটি জয়রামের রতিসম্ভোগকে আরও বেশি উত্তেজনা আনে।

গঙ্গা জানে সেকথা।

বলে, এবার তোমার কামরেখায় যাও। হাত দাও সেখানে।

অন্ধকারে গঙ্গার কামরেখায় হাত রাখে জয়রাম।

এই প্রথম জয়রাম অনুভব করে, গঙ্গার কামরেখায় তিরতিরে ঢেউ! আগে কখনও তার আঙুল পায়নি এই সুখ।

এ-গঙ্গা সে-গঙ্গা নয়, নিশ্চিত জয়রাম।

– এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলে কেন? বলে জয়রাম।

– কথা বোলো না। গঙ্গাকে নাও।

জয়রামের ওই পাঠান শরীরটাকে এক ঝটকায় নিজের শরীরের ওপর তুলে ফেলে গঙ্গা।

জয়রাম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না।

এই মুহূর্তটি বেছে নেয় গঙ্গা।

বলে, সব দেব। রোজ দেব। শুধু আমার ওইখানে হাত দিয়ে বলো, তোমার ওই বউয়ের ছেলেদের কিচ্ছু দেবে না তুমি।

জয়রাম চুপ।

বলো, তুমি ওদের ত্যাগ করবে, তোমার ও বউটাকেও তাড়িয়ে দেবে।

জয়রাম চুপ।

– কী হলো তোমার! বলো, ওইখানে যেমন ছুঁয়ে আছো, বলো এবার, কথা দাও আমাকে।

জয়রাম অসহায় বোধ করে। কী করবে সে?

তার মন কি বলছে, এই তীব্র সুখ সে ছাড়বে কীসের জন্যে? কার জন্যে?

‘এই সুখের জন্যেই তো বেঁচে আছো জয়রাম!’

ভিতর থেকে চিৎকার করে ওঠে শরীর।

১৭

রাতের পর রাত গঙ্গা নিংড়ে দিচ্ছে তার শরীরের কম্পমান তলানি পর্যন্ত জয়রামকে শুধু এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে, সে রামধনির দুই পুত্র, গোবিন্দরাম ও দর্পনারায়ণকে সমস্ত বিষয়-আশয় থেকে বঞ্চিত করবে। রামধনিকেও দূর করবে জীবন থেকে।

গঙ্গা জয়রামকে সব দিয়ে চলেছে সবটুকুর জন্য।

সে জানে জয়রামকে রাতের পর রাত উস্কে দেবার সব কায়দা।

সে জানে কীভাবে জ্বালিয়ে রাখতে হয় প্রৌঢ় জয়রামের কামবহ্নি। কী করে প্রতি রাতের ব্যবহৃত শরীর দিয়েও তাকে নিয়ে যেতে পারা যায় অসহনীয় তুঙ্গে।

কিন্তু এখনও পাওয়া গেল না জয়রামের প্রতিশ্রুতি।

গঙ্গা ক্রমশ ক্লান্ত। নিরাশ। তার নিজের উত্তেজনায় যত ভাটা পড়ছে, ততোই বাড়ছে জয়রামের প্রতি তার ক্রোধ।

জয়রাম বুঝতে পারছে, গঙ্গার ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। তার শরীর ক্রমে দমছুট।

সে জাগাচ্ছে বটে জয়রামকে।

কিন্তু তৃপ্তি দেওয়ার সোনারকাঠি হারিয়ে ফেলেছে গঙ্গার কামকেলি, রতিরঙ্গ।

জয়রামের উন্মাদন নিভে যাওয়ার আগেই গঙ্গার তাপনে দেখা দিচ্ছে শীতল ক্লান্তির শীর্ণ স্রোত।

জয়রামের প্রতিশ্রুতি বাগিয়ে নেওয়ার মতো রতিসুখ আর তো দিতে পারে না গঙ্গার অঙ্গসঙ্গ, তার আসত্তি, তার সোহাগের নিধুবন।

এই সময়েই ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত সর্বনাশ!

গঙ্গার গর্ভজাত আনন্দীরাম প্রেমে পড়ল।

ধনীর দুলালের জীবনে মেয়েছেলে আসবে, তাতে আশ্চর্যি বা আপত্তির কী আছে?

কিন্তু তা বলে বিয়ের আগেই প্রণয়? সেই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাইল বেপরোয়া আনন্দীরাম!

জয়রাম হয়তো এ পর্যন্তও সহ্য করে নিত।

গঙ্গা স্বামীকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু জয়রাম কিছুতেই মানতে পারছে না, খাঁটি হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়েকে ঘরে তোলার কথা।

– আমরা পিরালি ব্রাহ্মণ গঙ্গা। আদ্দেক মুসলমানই বলতে পারে। হিন্দু ব্রাহ্মণরা আমাদের একঘরে করেছে। সে মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে আনন্দীরামের সঙ্গে এ বাড়িতে উঠবে, এ আমি সহ্য করব না। আমি পিরালি ঘরেই ছেলের বিয়ে দেব। তুমি দেখো, ছেলে তাতেই সুখী হবে।

আনন্দীরাম বাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল, সম্ভবত গঙ্গার মদতে।

আনন্দীরামকে ত্যাজ্যপুত্র করল জয়রাম।

গঙ্গা একেবারে চুপসে গেল।

জয়রাম ইচ্ছাপত্র করল।

তার বিষয় সম্পত্তির সে অর্ধেক দিল গঙ্গার আর এক পুত্র নীলমণিকে। আর বাকি অর্ধেক রামধনির দুই ছেলে দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরামকে।

নীলমণিই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম পুরুষ।

আর পাথুরিয়াঘাটার আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ।

নীলমণি ঠাকুর দ্বারকানাথের ঠাকুর্দা। ধনসায়রের বিশাল বাগানবাড়ির মালিক।

এ হেন নীলমণি ঠাকুর সেই বিপুল সম্পত্তি হারিয়ে কী করে চিৎপুরে একটা চালাঘরে থাকতে শুরু করল, সে গল্পের শুরু এবার।

বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

তার আকস্মিক আক্রমণে ইংরেজের গজিয়ে ওঠা বসতি ও ক্ষমতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।

তখন ইংরেজের দুর্গ এখন যেখানে জিপিও-র অট্টালিকা, সেখানে। সেই দুর্গ দখল করে নিয়েছে সিরাজ।

লড়াইয়ে হেরে ইংরেজ সাময়িকভাবে পালিয়েছে ফলতায়।

হালসিবাগানে জগৎ শেঠের বাড়ি।

সেখানে কয়েকদিন থেকে বিজয়-উৎসব পালন করল সিরাজ।

ইংরেজরা ছাড়বার পাত্র নয়। তারা সাময়িকভাবে পালাতে বাধ্য হলেও তলেতলে তৈরি হতে লাগল প্রতিশোধের জন্য।

সিরাজকে রুখতে তারা তৈরি করেছে নতুন ছক।

তাদের চাই নতুন একটা দুর্গ। যেখান থেকে তারা আক্রমণ করবে সিরাজের জিতে-নেওয়া দুর্গ।

কোথায় হবে সেই দুর্গ?

তারা জায়গা বেছেছে গঙ্গার ধারে, ধনসায়রের পাশে।

সেখানেই তৈরি হবে তাদের নতুন দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম। এই সিদ্ধান্ত তারা কোনও মতেই বদলাবে না।

কিন্তু সেখানে তো ধনসায়দের ঠাকুরবাড়ি!

সে-বাড়ির দুই জাঁদরেল কর্তা। নীলমণি ঠাকুর আর দর্পনারায়ণ ঠাকুর। ততোদিনে গত হয়েছে জয়রাম।

তাদের সম্মতি ছাড়া দুর্গ তৈরি হবে কী করে?

– আমরা তোমাদের বাড়িটা কিনে নিতে চাই, নীলমণি আর দর্পনারায়ণকে জানাল ইংরেজ।

– এ বাড়ি নিয়ে তোমরা কী করবে?

– তৈরি হবে ফোর্ট উইলিয়াম।

নীলমণি দর্পনারায়ণ, কেউই ভাবতে পারেনি ইংরেজ এত দাম দিয়ে তাদের বাড়ি কিনবে।

নগদ এত টাকার লোভ তারা সামলাতে পারল না। তাছাড়া, ইংরেজকে না বলবার সাহসই বা কার আছে?

ধনসায়রের বিশাল সম্পত্তি তারা বিক্রি করে দিল ইংরেজকে।

পলাশির যুদ্ধের পরে মিরজাফর দিল ক্ষতিপূরণের টাকা। সেই টাকা থেকে তেরো হাজার টাকাও পেল দুই ভাই।

আর এইসব টাকা থেকে নীলমণি আর দর্পনারায়ণ বাড়ি কিনল পাথুরিয়াঘাটায়।

১৭৬৯ সালে নীলমণি ঠাকুর রামচন্দ্র কলুর কাছ থেকে জমি কিনল নিজের নামে।

বাড়ি হল সেই জমিতে। তখনও হাতে টাকা। সেই টাকা থেকে কোম্পানির কাগজ কিনে রাধাকান্তের নামে দেবত্র হল।

নীলমণি বিয়ে করল যশোরের পিরালি পরিবারের মেয়ে ললিতাকে।

তার দুই ভাই, দর্পনারায়ণ আর গোবিন্দরাম বিয়ে করল দক্ষিণডিহির মুসলমানদুষ্ট পরিবারের দুই মেয়েকে।

নীলমণির তিন ছেলে, এক মেয়ে : রামলোচন, রামমণি, রামবল্লভ আর কমলমণি।

নীলমণির বাণিজ্যবুদ্ধি কম। তবে সে পরিশ্রম করতে পারে। এবং তার চরিত্রের জোর আছে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করে সে সাহেবদের নেকনজরে এল।

কোম্পানি তখন উড়িষ্যা-বিহার-বাংলার দেওয়ানি লাভ করেছে। স্বয়ং লর্ড ক্লাইভ ডাকল নীলমণিকে।

– তুমি সেরেস্তাদার হয়ে এখুনি চলে যাও উড়িষ্যায়। আমার প্ল্যান অনুসারে সেখানে ঠিকভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব তোমাকে দিলাম।

লর্ড ক্লাইভের এই আদেশ নীলমণি ঠাকুরের কাছে দৈববাণী। সে মাথা পেতে গ্রহণ করল।

তখন তো রেলপথ নেই। উড়িষ্যায় যাও বললেই যাওয়া যায় না। তবু নীলমণি পাথুরিয়াঘাটার আরাম-বিলাস ছেড়ে প্রথমে হাঁটাপথ ধরল উড়িষ্যার দিকে। তারপর জলপথ। রূপনারায়ণ পার হয়ে তমলুক। তারপর মহানদী পেরিয়ে কটক।

এইভাবে শেষপর্যন্ত উড়িষ্যায় পৌঁছল দ্বারকানাথের পিতামহ সেরেস্তাদার নীলমণি ঠাকুর।

সে এইটুকু বুঝেছে তার উপার্জনের একমাত্র পথ ক্লাইভের আদেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা।

উড়িষ্যাতেই বসবাস শুরু করল নীলমণি।

ক্লাইভের দয়ায় তার উপার্জন ভালোই। সে প্রতিমাসে টাকা পাঠায় দর্পনারায়ণের কাছে।

দর্পনারায়ণ কথা দিয়েছে, যে-টাকা নীলমণি পাঠাচ্ছে তা গচ্ছিত থাকবে দর্পনারায়ণের কাছে।

নীলমণি কলকাতায় ফিরলেই সেই টাকা সে ফেরত পাবে।

টাকা জমানোর এরচেয়ে সহজ উপায় আর কী হতে পারে?

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় এক। ওপরওয়ালার খেয়াল বোঝে কার সাধ্যি!

হঠাৎ মারা গেল নীলমণি আর দর্পনারায়ণের ছোটোভাই গোবিন্দরাম।

সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রথম বড় আকারের বিবাদ ঠাকুরবাড়িতে। অশান্তির শেষ নেই।

গণ্ডগোল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল সুপ্রিম কোর্টের গোবিন্দরামের বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়ার মামলায়।

সম্পত্তির সমান-সমান ভাগের জন্য এই মামলা। চিড় ধরল ঠাকুরবাড়ির যৌথ সম্পদে।

বিধবা রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে ছটি বাড়ি নিয়ে আলাদা হয়ে গেল।

এইবার নীলমণির গল্পে ফেরা যাক।

সে তো ইতিমধ্যে জমিয়ে ফেলেছে বেশ কিছু অর্থ। সব গচ্ছিত আছে দর্পনারায়ণের কাছে।

নীলমণি এই ভরসায় দেশে ফিরে এল, ক্লাইভের আদেশ মতো উড়িষ্যার কাজ সুসম্পন্ন করে।

দর্পনারায়ণের কাছে টাকা চাইল নীলমণি।

– কীসের টাকা! গর্জে উঠল দর্পনারায়ণ।

দর্পনারায়ণ ইতিমধ্যে চন্দনগরে দেওয়ান হয়েছে। অর্থ ও প্রতিপত্তির প্রাবল্য সেই গর্জনের পিছনে।

চন্দননগরে ফরাসিদের রমরমা। দর্পনারায়ণ ব্রিটিশদের সঙ্গে ততোটা সুবিধে করতে না পেরে হাত মিলিয়েছে ফরাসিদের সঙ্গে।

ফরাসি শক্তির মদমত্ত দর্পনারায়ণ নীলমণিকে বুঝিয়ে দিল, তার হুঙ্কার ফাঁকা আওয়াজ নয়।

– কী প্রমাণ আছে তোমার যে মাসে মাসে তুমি আমায় টাকা পাঠিয়েছ? এতদিন আমিই তোমার সংসার টেনেছি। সে-টাকা আমাকে কে দেবে?

নীলমণি হতভম্ব।

নীলমণির বুঝতে দেরি হল না, তাকে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। এ-বাড়িতে তার কোনও অধিকার নেই।

সে স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়ে, আর গৃহদেবতা লক্ষ্মী নারায়ণকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

পিছন থেকে হুঙ্কার, ‘দাঁড়াও’! পিছন ফিরে তাকায় নীলমণি। দর্পনারায়ণ একটা পুঁটলি ছুঁড়ে দেয়। নিয়ে যাও তোমার শেয়ার।

দর্পনারায়ণের ছুঁড়ে দেওয়া পুঁটলি, সমস্ত অপমান সহ্য করেও, তুলে নেয় নীলমণি। তার পায়ের নীচে কোনও জমি নেই। নিভে গেল ভবিষ্যৎ। সে ভুলে গেল প্রতিবাদের ভাষা। মুহূর্তে যেন সে হয়ে গেল অন্য মানুষ। সে নিঃসংশয়ে ভাইকে বিশ্বাস করেছিল। সে নির্মমভাবে ঠকে গেছে। কিন্তু এখনও নীলমণির শেষ আস্থাটুকু যায়নি। সে বিশ্বাস করে তার শেষ আশ্রয় লক্ষ্মীজনার্দনকে। গৃহদেবতা আর স্ত্রী ললিতা, আর তিন ছেলে রামলোচন, রামমণি আর রামবল্লভ ও এক মেয়ে কমলমণিকে নিয়ে নীলমণি বেরিয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। পুঁটলিতে যে টাকা দর্পনারায়ণ ছুঁড়ে দিয়েছে তাকে, সেই অর্থে নীলমণির প্রেরিত অর্থের অতি সামান্য অংশ। কতদিন, কোথায়, কী করে চলবে তার সংসার?

এর পরের দৃশ্যেই আমরা ফিরে যাচ্ছি উপন্যাসের প্রায় শুরুতে।

এখানেই শেষ হচ্ছে একটি বৃত্ত।

১৭৮৪।

জোড়াসাঁকোর বৈষ্ণবচরণ শেঠ সবে শেষ করল তার ঐতিহাসিক অবগাহন।

সে দেখে অপর পাড়ের দিকে।

সেখানে এক উজ্জ্বল ব্রাহ্মণ পুরুষ গৃহদেবতার ভোগের আয়োজন করছে।

সে-ই নীলমণি। এখনও তাকে চেনে না বৈষ্ণবচরণ।

বৈষ্ণবচরণ তাকে ডেকে পাঠায়। আলাপ হয় তার সঙ্গে। জানতে পারে নীলমণির দুঃখের কথা। জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক বিঘে জমি তাকে দান করে বৈষ্ণবচরণ। নীলমণি সেই জমিতে চালাঘরের বাসা বাঁধে। এই আটচালাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম সংস্করণ। এই আটচালার নিবাস কেমন করে পৌঁছল কলকাতার ঠাকুরবাড়ির বৈভব ও মহিমায়?

সেই ম্যাজিকের নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর, জয়রামের প্রপৌত্র, নীলমণির পৌত্র, রামমণির পুত্র, রামলোচনের দত্তকপুত্র।

সেই অবিশ্বাস্য নায়ককে এই উপন্যাসের শুরুতেই আমরা পাচ্ছি প্যারিসের নৈশ আমোদে।

তারপর আমরা সন্ধানী হচ্ছি সেই নায়কের রক্তধারা ও বংশাণুর। এই অবিশ্বাস্য অভূতপূর্ব অবিকল্প বাঙালির গল্প যতো উজ্জ্বল ততোই করুণ!

শুধু এইটুকু বলে রাখি, দ্বারকানাথকে মুছে দিলেন তাঁর উত্তরপুরুষেরাই।

হত্যাকারীদের অন্যতম দেবেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ।

কেন দ্বারকানাথকে লোপাট করে দেওয়া অতোটাই জরুরি ছিল এই দুজনের জন্য?

১৮

রবি, তোমাকে আজ কিছু জরুরি কথা বলতে চাই। অনেকদিন ধরে বলবো বলবো ভাবছি। কিন্তু মন থেকে দ্বিধা সরাতে পারিনি। আজ মনে হচ্ছে, মেঘ ছিঁড়ে প্রত্যয়ের আলো দেখা দিয়েছে, বললেন দেবেন্দ্রনাথ। তিনি আজকাল জোড়াসাঁকোর বাড়ি প্রায় ত্যাগই করেছেন। আছেন মেজোছেলে সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে।

– কী কথা বাবামশায়? জিজ্ঞাসা করলেন সামনে উপবিষ্ট রবীন্দ্রনাথ। তাঁর হাতে একটি ইংরেজি বই, সবে তিনি বইটি বিলেত থেকে আনিয়েছেন। শীতের বিকেল। পাঁচটা না বাজতেই আলো পড়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের গায়ে একটি লাল জামদানি শাল।

– কথাটা সত্য। যতোটাই সত্য ঠিক ততোটাই অপ্রিয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে রবি তোমাকে আমার এই অপ্রিয় সত্যটুকু জানানো প্রয়োজন।

– যদি তাই হয় বাবামশায়, সত্যটি যতো অপ্রিয় বা নির্মম হোক না কেন, আপনি আমাকে জানাতে পারেন। আমি সেই সত্য অবিচলিত চিত্তে গ্রহণ করতে পারব। আপনার দীক্ষায় দীক্ষিত আমি। ছেলেবেলা থেকে আপনি আমাকে মনের মতো করে তৈরি করেছেন। বারো বছর বয়েসে আপনি আমাকে হিমালয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সমস্ত দুঃখ কষ্ট বেদনা বিপর্যয়ের মধ্যে হিমালয়ের মতো নিস্পৃহ উদাসীন থাকতে হবে তোকে। বাবামশাই আমি চেষ্টা করে চলেছি আপনার আদর্শে আমাকে গড়ে তুলতে।

– আমি জানি রবি। তুমি আমার অন্যসব সন্তানের থেকে পৃথক। ভাবে, আদর্শে, অনুভবে, উপলব্ধিতে, বোধে ও মননে তুমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। মনের মানুষ। আজকের এই অপরাহ্ণে তাই তো তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি রবি।

– বলুন তাহলে আপনি যা বলতে চাইছেন। কথাটি যদি আমার বিরুদ্ধেও কোনও ভয়ঙ্কর অভিযোগ হয়, তা-ও বলতে দ্বিধা করবেন না। সমস্ত শাস্তি আমি নতমস্তকে গ্রহণ করব।

– রবি, তুমি আমার সব কথা চিরদিন মেনেই নিয়েছ। কোনওদিন কোনওভাবে প্রতিবাদ করনি। একথা ঠিক রবি, তোমার উপর সর্বদা সুবিচার করিনি। সত্যি বলতে, তোমার প্রতিই আমি নিষ্ঠুরতম অবিচার করেছি। তার জন্যে তুমি নানাভাবে অভিমান প্রকাশ করেছ। এমনকী আমার কানে এসেছে তোমার নানাবিধ হতাশার বার্তাও। কিন্তু আমার কোনও রকম সমালোচনা? প্রতিবাদ? কখনও না। আমি যা কিছু আপাত নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছি তা যে পরিবারের মঙ্গলের জন্যই, তা তুমি অন্তত তোমার অন্তরের আলোয় দেখতে পেয়েছ।

– বাবামশায়, আপনি মহর্ষি। আপনি সত্য দ্রষ্টা। আপনার জীবনের দীক্ষা আমার জীবনের মর্মস্থানে সঞ্চারিত হচ্ছে সর্বক্ষণ।

– রবি, আমার দীক্ষা তো কোন সুদূরকালে ৭ই পৌষ ঘটেছিল। তার আলো আজও কি অক্ষুণ্ণ? তার যাথার্থ কি তোমাদের আধুনিকতায় ক্রমেই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে না?

– না না বাবামশায়। আমাদের জীবনে রোজ কতশত ঘটনাই তো ঘটছে। কিন্তু আপনার আধ্যাত্মিকতার চিরপ্রাণ সেই সব ছোটখাটো ঘটনায় বিঘ্নিত হয় না। আপনার সেই দীক্ষার গ্রহণের দিনটি, যা ঘটেছিল সুদূর অতীতে, তা কিন্তু একটি দিনের মধ্যেই কুলিয়ে উঠল না বাবামশায়। সেদিন যা ঘটেছিল একান্ত নির্জন নিভৃতিতে, সেদিন যার খবর কেউ পায় নি, সেই ৭ই পৌষ বছর-বছর ক্রমশ ফল প্রসব করবে বলেই আমার ধারণা।

– হয়তো তুমি ভুল বলছো না রবি। বহু বছর আগে এক ৭ই পৌষ এক মহাপ্রাণ আমার জীবনের একটি মুহূর্তকে স্পর্শ করেছিল। সেই স্পর্শ তার অদৃশ্য চিহ্নটি রেখে গেছে। শুধু আমার জীবনে নয় রবি। তোমার জীবনেও। তা-ই তুমি আমার এমন কাছের মানুষ, মনের মানুষ। মনে রেখো আমার স্নেহ এবং আশীর্বাদ সর্বদা তোমার উপর বর্ষিত হচ্ছে।

– বাবামশায়, আমি তা সারাক্ষণ অনুভব করি। আরও একটি জিনিস গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি।

কোন জিনিসটি রবি? জানতে পারলে নিশ্চয় আমি বিশেষ প্রীত হব।

– আপনার দীক্ষার মর্মবাণীটি আমার মধ্যে থেকে গেছে বাবামশায়। জগতের রাশি রাশি মৃত্যু ও বিস্মৃতির মধ্যে আমার সেই দীক্ষার অঙ্কুরটি অতি অনায়াসেই আমার মধ্যে ক্রমে মাথা তুলে উঠছে। আমার সমস্ত সংশয়ের মধ্যে সেই দীক্ষার বীজটি ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রত্যয়ের ডালপালা। আমার মনে হয়, নিত্যকালের সূর্যালোক এবং নিত্যকালের সমীরণ আমার মধ্যে ক্রমে গজিয়ে ওঠা বৃক্ষটিকে পালন করবার ভার গ্রহণ করেছে। সদাচঞ্চল সংসারের ভয়ংকর ঠেলাঠেলিও তাকে সরিয়ে ফেলতে পারে না। তা-ই এই উপলব্ধিতে আমি উপনীত হয়েছি বাবামশায়, আপনিই আমার প্রাণস্বরূপ অমৃতপুরুষ। আপনার দীক্ষা আমাকে নিঃশব্দে স্পর্শ করেছে। সেই অমৃতস্পর্শের সত্যটুকুর উপর মৃত্যুর কোনও অধিকার নেই। শুধু তা-ই নয় বাবামশায়। আপনার দীক্ষার প্রাণশক্তি ক্রমেই আমার মধ্যে প্রবলতর হয়ে উঠছে।

– কেমন করে বুঝলে একথা?

– আপনি যেমন করে হিমালয়ের পাদদেশে বারো বছরের আমাকে বুঝিয়ে ছিলেন।

– কী বলেছিলেম আমি?

– প্রতিদিন প্রত্যূষে একই মন্ত্র উচ্চচারিত হত আপনার কণ্ঠে। আমার মধ্যে তা আজও ধ্বনিত হয় বাবামশায়।

– রবি, শোনাও আমাকে। তোমার কণ্ঠে বেদমন্ত্র আমার বিশেষ প্রিয়।

– ‘আবিরাবীর্ম এধি’, বলেন রবীন্দ্রনাথ।

– আমার জীবনের গভীর আহ্বান তো এটাই রবি। হে প্রকাশ তুমি আমাতে প্রকাশিত হও। কী অনন্য এই আহ্বান! বললেন দেবেন্দ্রনাথ।

– বাবামশায়, আমার নিজের একটি ব্যাখ্যা আছে উপনিষদের এই মন্ত্রের।

তোমার ব্যাখ্যাটি আমাকে শোনাও রবি। আবিরাবীর্ম এধি আমার জীবনমন্ত্র। আমার সন্তানের মুখে তার ব্যাখ্যা শুনতে আমি বিশেষ আগ্রহী।

– বাবামশায়, আমার মনে হয়, তাঁর সেই প্রকাশ যাঁর জীবনে ঘটে যায়, অর্থাৎ যাঁর জীবনে, কর্মে, বিশ্বাসে তিনি প্রকাশিত হন,সেই মানুষটি নিজের ঘরের প্রাচীরের দ্বারা নিজেকে আড়াল করে রাখতে আর পারেন না। তিনি তখন আর নিজের আয়ুটুকুর মধ্যেও নিজে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তখন তিনি নিজের মধ্য থেকে নিত্যকালে বাহির হয়ে পড়েন। বাবামশায়, সেই রকম মানুষই আপনি। তা-ই আপনি মহর্ষি। দেবেন্দ্রনাথ বিস্মিত ও প্রীত দৃষ্টিতে তাকালেন রবীন্দ্রনাথের দিকে। তাঁর চতুর্দশ সন্তানই তাঁকে সম্যক বুঝেছে, ভাবলেন দেবেন্দ্রনাথ। তারপর গম্ভীর গভীর কণ্ঠে বললেন:

যদৈতম অনুপশ্যতি আত্মানং দেবম অঞ্জসা

ঈশানং ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে।

থামলেন দেবেন্দ্রনাথ। সরাসরি তাকালেন রবীন্দ্রনাথের দিকে। বললেন, উপনিষদের অন্তরবার্তাও তা-ই। তোমার উপলব্ধি ও ব্যাখ্যা সঠিক। যে-মন্ত্রটি উচ্চচারণ করলে তার গূঢ় বার্তাটি হল, যে-ব্যক্তির মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ ঘটে, তিনি আর গোপন থাকতে পারেন না।

– বাবামশায়, আমার তো মনে হয়, যিনি তাঁকে, মানে ব্রহ্মকে তাঁর অন্তরাত্মার মাঝখানটিতে উপলব্ধি করেছেন, তাঁর আর কোনও আড়াল থাকে না। পরদা নয়, দেয়াল নয়, প্রাচীর নয়। সমস্ত বাধা, আড়াল, বন্ধন লুপ্ত হয়ে যায়। তিনি তখন সমস্ত দেশের সমস্ত কালের।

– হ্যাঁ রবি, ঠিকই বলেছ। তখন সেই মহর্ষির আচরণের মধ্যে নিত্যতার লক্ষণ আপনিই প্রকাশ পেতে থাকে।

– এর কারণ কী বাবামশায়?

– এর কারণ ঠিক বলে বোঝাতে পারব না। তুমি একদিন নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে। যেদিন পারবে সেদিনই তোমাকে দেওয়া আমার দীক্ষা সফল হবে। তবে জানতে যখন চেয়েছ, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করছি। কারণটি হল, যিনি নিজের মধ্যে সকল আত্মার আত্মাকে দেখেছেন, তাঁর মধ্যে অহং বলতে কিছু থাকে না। আমিত্ব লুপ্ত হয়। তখন তিনি আর আমার খ্যাতি, আমার বিত্ত, আমার খাওয়া-পরা, এসবকে আর প্রধান করে দেখেন না। কারণ তিনি বুঝতে পারেন, এই অহংকারে সত্য নেই, নিত্য নেই। উপনিষদের মূল ভাবনাটি হল, যে-মানুষ আত্মাকে দেখেছে, ব্রহ্মকে জেনেছে, তার সমস্ত অহং পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

– বাবামশায়, আমি আপনার কথার গূঢ় অর্থটি বুঝতে পেরেছি। প্রদীপে যতক্ষণ না আলোর শিখা জ্বলে উঠছে, ততক্ষণই তার প্রচুর তেল ও পলতের সঞ্চয় নিয়ে অহমিকা। কিন্তু যেই একবার আলো জ্বলল, অমনি সেই প্রকাশে তেল আর পলতের গর্ব লুপ্ত হয়ে গেল।

– রবি, তুমি যেভাবে ব্যাখ্যা করলে তা নির্ভুল, সঠিক। তোমার মধ্যে আমার দীক্ষা সত্যিই সফল হয়েছে রবি। যিনি আমাকে দেখছেন, তিনি দেবকে দেখছেন। রবি, উপনিষদে ‘দেব’ শব্দের অর্থ ‘দীপ্যমান।’ কী অর্থে আত্মা দীপ্তিমান? আত্মা স্বতঃপ্রকাশিত। সেই অর্থে। তোমার উদাহরণ দিয়েই বলি রবি, অহং প্রদীপমাত্র। তার বেশি কিছু নয়। আর আত্মা হচ্ছে আলোক। অহংদীপে যখন জ্বলে ওঠে ভিতরের আলোক, দীপ্যমান হয়ে ওঠে প্রকাশ, তখন অহংকারের সঞ্চয় মূল্যহীন হয়ে যায়। সেই অহং-এর দিকে তখন আর দৃকপাত করে না মানুষ।

– বাবামশায়, আজ মনে হচ্ছে সত্যিই আপনার ৭-ই পৌষের দীক্ষার উপরে আত্মার দীপ্তি পড়েছিল। এবং তার উপরে ভূতভবিষ্যতের যিনি ঈশান তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল।

– রবি, তা-ই তো ক্রমে উপলব্ধি করছি, আমি যদিও ধনীগৃহের সন্তান, এই বিলাসের আচ্ছাদন থেকে নিজেকে আমি সর্বকালের দিকে উদঘাটিত করতে পেরেছি। আজ ক্রমে অনুভব করছি, আমার এই সাধনা নিত্য হয়ে বিরাজ করবে। এবং তুমি সেই সাধনার ধারাটি, তার দীপ্তি বহন করে নিয়ে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ প্রণাম করেন দেবেন্দ্রনাথকে। বলেন, বাবামশায়, আপনি মহর্ষি। আশীর্বাদ করুন।

দেবেন্দ্রনাথ তাঁর দক্ষিণ হস্ত রবীন্দ্রনাথের মস্তকে কিছুক্ষণ ন্যস্ত রাখেন।

১৯

– বাবামশায়, আমার মনে হচ্ছে আপনি অন্য কোনও কথা বলবার জন্য আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। হয়তো সেই কথাটি এখনও বলা হয়নি।

– যে-কথা এতক্ষণ হল, তা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় নয়। যে-লজ্জা, ঘৃণা, সংকোচের কথা তোমাকে আজ জানাতে বাধ্য হব, তার উপর এতক্ষণ যে কথা হল সেই বার্তার আলোকপাত বিশেষ তাৎপর্যের। রবীন্দ্রনাথের চোখে-মুখে বিস্ময়। দেবেন্দ্রনাথ তখুনি কিছু বলেন না। তিনি যেন কিছুটা নাটকীয়ভাবেই নির্বাক।

– কীসের লজ্জা? কীসের ঘৃণা বাবামশায়? চাপা অথচ তীব্র আগ্রহে প্রশ্ন করেন রবীন্দ্রনাথ।

দেবেন্দ্রনাথ তখুনি উত্তর দেন না। আরও কিছুক্ষণ প্রতীক্ষিত রাখেন পুত্রকে। তারপর বলেন, আমাদের বংশের, আমাদের পূর্বপুরুষের কথা, তাঁদের কীর্তি ও অপকীর্তির কথা, তাঁদের অর্থলিপ্সা, তাঁদের গৃধø%তা, তাঁদের লালসা, পার্থিব সাফল্যের প্রতি তাঁদের ঈপ্সা ও তাঁদের আধ্যাত্মিক অপ্রাপ্তির কথা যখন ভাবি, আমার মন সংকোচ ও ঘৃণায় ভরে ওঠে রবি। আমার পূর্বপুরুষদের জন্য আমি লজ্জা পাই। বলতে পার, আমার সাধনা আমার পূর্বপুরুষদেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

– বাবামশায়, আমাদের বংশের ইতিহাস আমি জানি। একথা ঠিক, আমাদের পূর্বপুরুষরা কলকাতায় এসেছিলেন অর্থ উপার্জন করতে। তাঁরা চেয়েছিলেন ব্রিটিশদের সুনজরে থেকে অর্থবান হতে।

– শুধু ব্রিটিশ শাসকদের খোসামোদই করেননি, মুসলমান শাসকদেরও পদলেহন করেছেন তাঁরা অর্থের জন্য। তাঁদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অর্থ- যেনতেন প্রকারে তাঁরা টাকা চেয়েছিলেন। অর্থ। সম্পত্তি। ক্ষমতা।

– কিন্তু জীবনে তো অর্থের প্রয়োজন আছে বাবামশায়। এই যে আমাদের ঠাকুরবাড়ির এত মানসম্মান, তার পিছনে অর্থের ভূমিকা কি অস্বীকার করা যায়?

– ছি^ঃ রবি। তোমার মুখে এ কথা শোভা পায় না। তর্ক কোরো না। যা বলছি, শোনো।

– ক্ষমা করবেন বাবামশায়, হয়তো অর্বাচীনের মতোই কথা বলে ফেলেছি।

– রবি, আমি আমার পূর্বপুরুষদের শুধু অর্থলিপ্সার কথাই বলছি না। অর্থ উপার্জন করতে তাঁদের নানা প্রকার ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছে। নানাভাবে হতে হয়েছে শঠ ও অসাধু। সেকথাও না হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত চরিত্র খুব যে উচ্চচমানের ছিল, তা তো নয়। লালসা ছিল তাঁদের রক্তের মধ্যে প্রবাহিত। নারীলোলুপতা, বিলাস ও ভোগপরায়ণতা আমাদের বংশধারায় আছে রবি। অস্বীকার করার যো নেই। আমার গভীর সংকোচ ও শোচনার জায়গা সেটাই।

দেবেন্দ্রনাথ দীর্ঘক্ষণ নির্বাক। নতমস্তকে রবীন্দ্রনাথ পিতার লজ্জা ও ঘৃণাকে নিজের মধ্যে অনুভব করার চেষ্টা করেন। নারীর প্রতি আগ্রহ, এমনকী লিপ্সা কি তাঁরও নেই? নতুন বউঠানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অনেকটাই তো বুঝতে পেরেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। যে-জন্য কর্মচারীর কন্যার সঙ্গে তড়িঘড়ি তাঁরা বিয়েও দিয়ে দিলেন। তাছাড়া, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে নটী ও বারবণিতাদের ঘনিষ্ঠতাও তো পিতার অজানা নয়। তিনি তো পরিষ্কার ঘোষণা করেছেন, জ্যোতি চরিত্রভ্রষ্ট হয়েছে। সে-প্রমাণ আমি পেয়েছি।

সেই সব প্রমাণ, নতুনদাদাকে লেখা কোনও এক নটীর প্রেমপত্র, নতুন বউঠানের সব চিঠি এবং তাঁর সুইসাইড-নোট, সবই তো পিতৃ-আজ্ঞায় পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছি আমি, ভাবেন রবীন্দ্রনাথ। পিতার চোখের চোখের দিকে তাকাতে পারেন না। নিজেকে তার ভারি অপরাধী মনে হয়। তিনি নতুন বউঠানের সুইসাইড নোটটি চিতার আগুনে অর্পণ করেও ঝলসানো চিঠিটি লুকিয়ে তুলে নিয়েছিলেন। বাবামশায় কি সেকথাও জানেন? বাবামশায়ের কাছে কোনও সত্যই গোপন থাকে না, সব তিনি জানেন। এবং তিনি যতক্ষণ না নিজে জানাচ্ছেন, তার মনের কথা জানার উপায় নেই!

– রবি, কী ভাবছ তুমি? বিশেষ দুশ্চিন্তার কারণ ঘটল কি? প্রশ্ন করেন দেবেন্দ্রনাথ।

ভাবতে-ভাবতে কিছুটা অমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পিতার প্রশ্নে চমকে ওঠেন।

– রবি, কিছুই প্রায় বলিনি তোমাকে। যতটুকু তুমি নিজে জেনেছ, তা হল জলের উপর হিমশৈলের ভাসমান চূড়াটুকু।

– বাবামশায়, যা জেনেছি তাই যথেষ্ট। অপ্রিয় সত্য নাই বা জানালেন আমাকে। হয়তো সেই বেদনা আমার পক্ষে সহনীয় হবে না।

– তোমাকে জানতেই হবে রবি। যদি না জানো, তাহলে যে-কাজটি তোমাকে করতে হবে সেই কাজ করার মতো ঘৃণা, ক্রোধ ও তেজ তোমার মধ্যে সঞ্চারিত হবে না। জানি, তুমি সবটুকু না জেনে-বুঝেই হয়তো পিতৃ-আজ্ঞা পালন করবে। কিন্তু আমি তা চাইছিনে। আমি চাই কোনও অপরাধবোধ ও দ্বিধা ছাড়াই এই কঠিন কাজটি তুমি করো। যে-কাজ তোমাকে দিয়ে আমি করাব সেই কাজের জন্য কোনওদিন না তুমি অনুশোচনার দহনে কষ্ট পাও। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত মুখেচোখে ফুটে ওঠে গভীর বেদনার চিহ্ন। তিনি নীরবে তাকিয়ে থাকেন পিতার দিকে।

– রবি, প্রথম যে-কথাটি তোমাকে মনে রাখতেই হবে, তোমার জন্ম এক ব্রাত্য পরিবারে। এবং তুমি আমি ঠাকুর পরিবারের সবাই আমরা হিন্দুসমাজে ব্রাত্য আমাদের পূর্বপুরুষের পাপের ফলে, অন্যায়ের ফলে।

রবীন্দ্রনাথ কোনও কথা বলেন না। মাথা নীচু করে তিনি শুধু নির্বাক শ্রোতা।

– রবি, তুমি হয়তো ভাবছ আমি কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি করছি। বা অতি-নাটকীয়তার আশ্রয় নিচ্ছি তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য। তা নয় রবি। আমরা হিন্দু সমাজে ব্রাত্য মুসলমানের জল ছুঁয়েছি বলে। জল ছোঁয়া কথাটির ইমপ্লিকেশনটা একটু বিশেষভাবে ভেবে দেখো। সুদূরপ্রসারী কথাটির তাৎপর্য। আমাদের পূর্বপুরুষ যে শুধুমাত্র অর্থলোভে মুসলমান শাসকের পদলেহন করেছে তা নয়। মুসলমান সুন্দরীর টানেও সাড়া দিয়েছে। ধরা পড়ে মুসলমান হতে হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের পূর্বপুরুষ কামিনী-কাঞ্চন উভয়ের লালসাতেই সমাজচ্যুত হয়েছে। রবি, পরিষ্কার জেনে রাখো একটি কথা, আমাদের পরিবারের ব্রাত্য হওয়ার পিছনে শুধু অর্থ-লিপ্সাই কাজ করেনি। কাজ করেছিল মুসলমান রমণীর সঙ্গে সম্পর্ক। এই কারণেই রবি, আমাদের পরিবারের আর্থিক প্রাবল্য এবং শিক্ষার জোর সত্ত্বেও আমরা হিন্দু সমাজে হালে পানি পাইনি। এই কারণেই স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেদের বিয়ে করতে হয় অতি সাধারণ ঘরে। জ্যোতিকে, তোমাকে বিয়ে করতে হয়েছে বাড়ির কাজের লোকের মেয়েকেও। এই কারণেই তাদের মেয়েদের গৃহবধূ করেও আত্মীয় হিসেবে, আমার বেয়াই-বেয়ান হিসেবে কোনও পারিবারিক সম্মান দিতে পারিনি। বা দিইনি। আমার অভিজাত্যে বেধেছে। আমি জানি এই জায়গাটা তোমাদের অত্যন্ত বেদনার জায়গা। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। আমাদের এই সামাজিক নতি আমাদের পূর্বপুরুষের অন্যায়ের অবদান। আমার কন্যারাও যে খুব সম্মানের জায়গায় আছে, তা-ও তো নয়। দেবেন ঠাকুরের মেয়েকে যে সুপুত্র বিয়ে করবে সে আর বাপ-মায়ের বাড়িতে বউ নিয়ে ফিরতে পারবে না। ফিরলে সমস্ত পরিবার একঘরে হবে। এই হল হিন্দু সমাজের ফরমান। অতএব আমার কন্যারা সব ঘরজামাইয়ের ঘর করছে। তুমি জানো, সামাজিকভাবে সেটা খুব সম্মানের নয়।

রবীন্দ্রনাথ নিথর। কী বলবেন তিনি, ঠাওর করতে পারছেন না। পিতা এসব কথা বলছেনই বা কেন? এই পারিবারিক কাহিনি কত দূর গড়াবে? কী সব অজানা তথ্য ও সত্য উদ্ঘাটিত হবে? এবং সব শেষে কী কাজ করতে বলবেন পিতৃদেব? সেই কাজটি যে কঠিন ও বেদনাদায়ক হতে চলেছে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই রবীন্দ্রনাথের মনে। রবীন্দ্রনাথ আভাস পাচ্ছেন, পারিবারিক কাহিনি শুনিয়ে কাজটিকে হয়তো কিছুটা সহনীয় করে তুলছেন বাবামশায়।

–রবি, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস তুমি জানো, তাই হয়তো যথেষ্ট। কিন্তু তুমি প্রায় কিছুই জানো না আমার পিতৃদেব, তোমার ঠাকুর্দা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে।

–তিনিই তো ঠাকুরবাড়ির মোস্ট সেন্ট্রাল ক্যারেক্টর বাবামশায়, বললেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি ছাড়া ঠাকুরবাড়িই তো সম্ভব হত না।

–ভুল ধারণা। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। যে-মানুষটির চরিত্র বলেই কিছু ছিল না, আগাগোড়া ক্যারেক্টরলেস, তাকে তুমি আমাদের পরিবারের সেন্ট্রাল ক্যারেক্টর বললে? তিনি আমাকেও নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। উচ্ছন্নে পাঠাতে চেয়েছিলেন। আর আমি বেছেও নিয়ে ছিলুম সেই পথ। সেই লোভ। আমার প্রথম যৌবনে অর্থ ও নারীর লোভ আমাকে পেয়ে বসেছিল। আর তিনি ইন্ধন জোগাতেন। কোনও রকম বাধা দেননি। বরং আমার উন্মার্গগামিতা তাঁকে খুশি করেছিল। আই হেট মাই ফাদার। আমি দ্বারকানাথকে ঘৃণা করি।

–আপনি আপনার পিতাকে ঘৃণা করেন?

–তিনি আমার সর্বনাশ করতে চেয়ে ছিলেন।

–কী করে জানলেন?

–তখন আমি কিশোর। শাসনহীন ধনীপুত্র। হঠাৎ পিতৃভক্তিতে উথলে উঠলেম আমি। পিতৃভক্তি দেখাতে রোজ যেতাম তাঁর কাছে ভোর না হতেই। তিনি থাকতেন বারবাড়িতে। যাতে ম্লেচ্ছসংসর্গ করতে তাঁর সুবিধে হয়। আমি যাবার সময় দেখতাম সিঁড়ির কোণে ঘড়ায়-ঘড়ায় সোনা-রুপোর টাকা গুনে গুনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। আর আসবার সময় দুটো ঘড়া রোজ তুলে নিতেম। তিনি জানতেন কে নিয়েছে। তবু জিজ্ঞেস করতেন, দুটো ঘড়া কম কেন? সরকারমশাই বলতেন, ‘আজ্ঞে বড়োবাবু’। উনি বলতেন, ‘ও আচ্ছা।’ মুখে তাঁর মৃদু হাসি ফুটে উঠত। আমি সেই অর্থ ভোগবাসনায় ওড়াতাম। আনন্দ পেতেন পিতা দ্বারকানাথ। তাঁর ধারণা, আমি ধনীপুত্রের উচিত কাজই করছি।

–এই কারণে আপনি আপনার পিতাকে ঘৃণা করেন?

–না রবি। আমি পিতাকে ঘৃণা করি আমার পরমা সুন্দরী মাতা দিগম্বরীদেবীর সঙ্গে তাঁর নিকৃষ্ট নির্মম ব্যবহারের জন্য। তিনি আমার মাকে ঠকিয়ে ছিলেন।

–ঠকিয়ে ছিলেন? শুনেছি পিতামহ খুবই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন।

–শোনো। আমার মা সম্পর্কে হয়তো বিশেষ কিছু জানা নেই তোমার। আমার মা ছিলেন যশোরের মেয়ে। নরেন্দ্রপুর গ্রামের রামতনু রায়চৌধুরী আর আনন্দময়ীদেবীর কন্যা। আশ্চর্য সুন্দরী ছিলেন। পিতারই আজ্ঞায় একসময়ে আমাদের বাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মুখ তাঁরই আদলে তৈরি হত?

–তাহলে তো পিতামহ পিতামহীকে বিশেষ ভালোবাসতেন।

–রবি, একটু ধৈর্য ধরো। এক সময়ে হয়তো তাঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতেন। কিন্তু দ্বারকানাথের ম্লেচ্ছসংসর্গে পানভোজনের প্রবণতা যতো বাড়তে লাগল ততোই তাঁর দাম্পত্যজীবন সংকটময় হয়ে উঠল। একটু আগেই তুমি বলেছ, তোমার ধারণা দ্বারকানাথ খুবই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। যদি দু-ঘণ্টা ধরে ইষ্টনাম জপ করা এবং আচারনিষ্ঠ হিন্দুত্বের ভড়ং করা ধর্ম হয়, তাহলে তো তিনি পরমধার্মিক। তিনি বিলেতে পর্যন্ত গঙ্গামাটি নিয়ে গিয়ে বাড়ির দেয়ালে প্রলেপ দিয়েছিলেন। দ্বারকানাথকে বোঝা অত সহজ নয় রবি।

–তাহলে আসল দ্বারকানাথ কেমন মানুষ?

–কতটা মুখ, কতটা মুখোশ, কেউ জানি না আমরা। আমার যে-পিতা আমার মাতৃদেবীর মুখের আদলে বাড়ির জগদ্ধাত্রীর মুখ তৈরি করিয়ে ছিলেন সেই পিতার আজ্ঞাতেই এক বছর জগদ্ধাত্রীর মুখ তৈরি হল এক ইংরেজ অভিনেত্রীর মুখের আদলে। আমি শুধু এইটুকু বলছি রবি, যে-ম্লেচ্ছ সংসর্গের কারণে মাতৃদেবী পিতার সঙ্গে আর সহবাস করতে চাইলেন না, সেই ম্লেচ্ছ সংসর্গ হচ্ছে এই অতি সুন্দরী তরুণী ইংরেজ অভিনেত্রী। পিতৃদেব সেই ইংরেজ নটীর জন্য হাজার-হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। পার্ক স্ট্রিটে ‘সাঁ-সু সি’ থিয়েটার বানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে বেলগাছিয়ার বাগান বাড়িতে, এই জোড়াসাঁকোর বার-বাড়িতেও বেলেল্লাগিরি কম করেননি। মা-কে বাবা অ্যাতোই কষ্ট দেন যে, মা খুব তাড়াতাড়ি মারা যান। পিতার এই চরিত্রহীনতা আমি ক্ষমা করতে পারি না। এ-ছাড়া…

রবীন্দ্রনাথ নীরবে তাকান পিতার দিকে। প্রিন্স দ্বারকানাথের বিরুদ্ধে আরও কী ভয়ঙ্কর অভিযোগ আছে তাঁর?

–রবি, আর বেশি বলবো না আমি। একটি কথা জেনে রাখো। পিতা ভালো মানুষ ছিলেন না। সৎ মানুষ ছিলেন না। অর্থের জন্য হেন হীন কাজ নেই যা তিনি করেননি। অর্থ উপার্জনই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। একমাত্র নেশা। আর সেই অর্থ ব্যয় করতেন শুধু নিজের ভোগ বিলাসের জন্য।

–আপনি কি বলতে চাইছেন ঠাকুরবাড়ির অর্থ, সম্পত্তি সবই অন্যায়ভাবে অর্জিত?

–দ্বারকানাথ ঠাকুরবাড়ির গৌরব নন। কলঙ্ক। সেই পাপকে মুছে ফেলতে হবে।

–বাবামশায়, আপনি ঠিক কী চাইছেন?

–আমার ঈশ্বরের কাছে একটিই প্রার্থনা।

–সেই প্রার্থনাটি বলুন আমাকে।

–পাপমুক্তি। শুদ্ধি। কল্যাণ। রবি, আমার পিতৃদেব হিন্দু ছিলেন বটে, আমরা ব্রাহ্ম। এবং হিন্দুসমাজে যদিও আমরা ব্রাত্য, ব্রাহ্মসমাজে আমাদের প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি অক্ষুণ্ণ। তুমি জানো, মহর্ষি বলে সবাই আমাকে আজকাল জানছেন। আমার মধ্যে আত্মার উদ্ভাস দেখা দিয়েছে রবি। সুতরাং আমি কোনওভাবেই পিতার অন্যায়-অর্জিত অর্থ ও সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চাই না।

–কী কী অন্যায় পথে আমাদের পিতামহ অর্থ, সম্পদ ও সামাজিক প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলেন তার কোনও প্রমাণ আপনার কাছে কি আছে বাবামশায়?

–রবি, তোমার এই প্রশ্ন আমাকে ক্ষুণ্ণ করল। আমার সম্মানবোধকেও আঘাত করল। তুমি তো জান রবি, আমি কখনও মিথ্যা বলি না। আমার মুখের কথাই প্রমাণ।

–আমাকে ক্ষমা করবেন বাবামশায়। আমি শুধু আমার পিতামহ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে চেয়েছিলেম।

–রবি, শুধু তোমার পিতামহ নন, আমাদের পিতৃপুরুষেরা কেউই উচ্চচ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। তাঁরা সবাই পার্থিব ভোগবিলাসে, কামিনী-কাঞ্চনে আসক্ত ছিলেন। সততা এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁদের স্বাভাবিক প্রবণতার কোনও প্রমাণ আমি পাইনি।

রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক। দেবেন্দ্রনাথের মনে হল, রবির মধ্যে দ্বিধা সংকোচ এখনও বর্তমান। রবিকে যে-কাজের আদেশ তিনি দিতে চলেছেন, সেই কাজের জন্য রবির মন এখনও তৈরি নয়।

–রবি, পিতৃনিন্দা শুধু পাপ বা অন্যায় নয়। সন্তানের পক্ষে পিতৃনিন্দা বেদনাদায়ক। কিন্তু সেই গভীর ব্যথার কঠিন কাজটি আমাকে করতেই হবে। আমাদের পরিবারের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকেই এই কাজটি আমি করে যেতে চাই। না হলে আমার আত্মা শান্তি পাবে না।

রবীন্দ্রনাথ দু-চোখ ভরা প্রশ্ন নিয়ে তাকান দেবেন্দ্রনাথের দিকে। সেই দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে তাঁর মনের চাপা কষ্ট। লক্ষ করেন দেবেন্দ্র।

–তুমি যখন জানতেই চাইলে, পিতৃনিন্দার সমস্ত কষ্ট বুকের মধ্যে নিয়ে তোমাকে কিছু কথা জানাচ্ছি রবি, নিস্পৃহ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন দেবেন্দ্র।

রবীন্দ্রনাথ নতমস্তক। তিনি পিতার পায়ের দিকে তাকিয়ে।

–তুমি হয়তো জানো না রবি, আমার পিতৃদেব অর্থ উপার্জনের জন্য তেজারতির মতো নীচ কাজও অবলীলায় করেছেন। এবং নির্মম শঠতার আশ্রয় নিয়ে তেজারতির ব্যবসা তিনি বাড়িয়ে ছিলেন।

–বাবামশায়, শুনেছি স্বয়ং রামমোহন রায়ও টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসা করে ধনী হয়েছিলেন।

–রবি, তুমি কি আমার সঙ্গে তর্ক করছ?

–না বাবামশায়। এটি আমার শোনা কথা। হয়তো সম্পূর্ণ ভুল।

–না রবি, সম্পূর্ণ সঠিক।

–তা হলে?

–রাজা রামমোহনের সঙ্গে আমার পিতৃদেবের তুলনা অর্বাচীন উক্তি। পিতৃদেব রামমোহনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, একথা সত্য। কিন্তু রামমোহনের অজস্র অবিশ্বাস্য গুণাবলি বাদ দিয়ে তিনি তাঁর চরিত্রের দুর্বলতাকেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি রামমোহনের কাছে মদ্যপান করতে শেখেন। তিনি রামমোহনের যৌবনকালীন ভোগবিলাসে দীক্ষিত হন। রামমোহনের ইংরেজ-প্রবণতা ও নারীবিলাস আমার পিতার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু রামমোহনের আধ্যাত্মিক সন্ধান, তাঁর একেশ্বরবাদ, তাঁর উপনিষদচর্চা দ্বারকানাথ ঠাকুরকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি। রামমোহন রায়ের আধ্যাত্মিককতা আমাকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে, যেভাবে তাঁর একেশ্বরবাদ আমি মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছি, আমার পিতা তা পারেননি। আমার পিতা বিট্রিশদের অনুকরণ করেছেন। এই ব্রিটিশভজনার অনেকটাই তিনি পেয়েছিলেন রামমোহনের কাছ থেকে। সাহেবদের মতোই মানি-মেকিং, কী করে আরও অর্থ উপার্জন করে ধনী হব, কী করে ক্রমাগত বর্ধিত হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, এই ছিল পিতৃদেবের ধ্যানজ্ঞান। ঠিক কথা, রামমোহন রায়ও তেজারতির কারবার করেছেন। কিন্তু পিতৃদেবের মতো শঠতা করেননি।

–কী রকম শঠতা, জানতে চান বেদনাবিভ্রান্ত রবীন্দ্রনাথ।

–তিনি তাঁর পার্টিতে আলাপ করিয়ে দিতেন সাহেবদের সঙ্গে শহরের বিখ্যাত বাইজি, নটী, বারবনিতাদের। সাহেবরা ক্রমে এদের পাল্লায় পড়ে খরচ করতে-করতে ফতুর হত। তখন তাদের চড়া সুদে টাকা ধার দিতে হাসিমুখে এগিয়ে আসতেন দ্বারকানাথ। এই টাকা সাহেবদের শোধ দেবার ক্ষমতা ছিল না। আবার পালাবারও পথ পেত না তারা। পিতৃদেবের আদায়বাহিনী ছিল ভয়ঙ্কর। এইভাবে ক্ষমতাধারী ব্রিটিশদের অনেকেই চলে এসেছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। এর ফলে একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল পিতার আর্থিক ক্ষমতা ও সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। তাঁর কার্যসিদ্ধির পিছনে ব্রিটিশদের অবদান কম ছিল না। কিন্তু সব কিছুর মূলে ছিল দ্বারকানাথের চতুরতা, শঠতা, পাপবোধহীন পার্থিব সন্ধান। রবি, পিতার এই কদাচার আমার পক্ষে মেনে নেওয়া বেদনাদায়ক। মাঝেমধ্যে সহ্যের অতীত।

–দ্বারকানাথের আরও কি কিছু অন্যায়ের হদিশ আছে আপনার কাছে? তাঁর চতুরতা, শঠতা, নির্মমতার আরও কিছু নিদর্শন? প্রশ্ন করলেন রবীন্দ্রনাথ। দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়, তাঁকে বিশ্বাস করেই রবি জানতে চাইছে। তার মনে পিতার উক্তিতে আস্থা বাড়ছে। খুশি হন দেবেন্দ্রনাথ।

–আছে রবি, পিতৃদেবের আরও অনেক পাপাচার বিষয়ে আমি জ্ঞাত। কিন্তু বলতে লজ্জা হয়। নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়।

–বাবামশায়, আপনি মহর্ষি। আপনার আধ্যাত্মিকতা শুধুমাত্র যে আমাদের পরিবারের মূল্যবোধ ও জীবনধারাকে বদলে দিয়েছে তা নয়, বাঙালির জীবনবোধ ও ঈশ্বরচেতনাকে নতুনভাবে জাগ্রত করেছে। আপনি কখনও নিজেকে ক্ষুদ্র ভাববেন না। আপনি সমগ্র জাতির প্রেরণা।

দেবেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। এই নীরবতায় ফুটে উঠে তাঁর মনের তুষ্টি। রবির কথাগুলি তাঁর মনের মতো হয়েছে।

–একটি কথা তোমার জানা উচিত রবি। সেই কথাটি হল, আমার পিতৃদেবের ভোগবিলাস, তাঁর নারীপরায়ণতা আমি নিজের চোখে দেখেছি। তখন আমার পূর্ণ যৌবন। বেলগাছিয়া ভিলায় যেভাবে সাহেবমেমদের নিয়ে তিনি মোচ্ছব করতেন, যেভাবে সারারাত পান ও সম্ভোগের উৎসব পালিত হত, আমার মন ঘৃণায় ভরে যেত। আমি সেখান থেকে পালিয়ে এসে উপাসনা করতুম। এ-ছাড়া পাপমোচনের অন্য কোনও উপায় আমার জানা ছিল না। পিতার এই বিপুল ব্যয়ের অর্থ কোথা থেকে আসতো? এই অর্থ আমাদের জমিদারির টাকা। অর্থাৎ গরীব প্রজাদের টাকা। তিনি গ্রামের উন্নতির জন্য তো ব্যয় করতেন না। সমস্ত অর্থই ব্যয় করতেন নিজের ভোগবিলাসে। আমার পিতৃদেবের এই ব্যয় থেকে তো কোনও সামাজিক সম্পদ তৈরি হয়নি!

–বাবামশায়, পিতামহের এই ভোগবিলাস, পানভোজনের সমস্ত অর্থের উৎস কি আমাদের জমিদারি?

–না রবি, তা নয়।

–তাহলে? আরও কী কী সোর্স ছিল দ্বারকানাথের অবিশ্বাস্য ধন দৌলতের? রবির মুখে এই অব্যর্থ প্রশ্ন।

–কী হবে শুনে? আঘাত পাবে রবি। লজ্জাও পাবে বৈ কি।

–বলুন বাবামশায়। আমাকে জানতেই হবে।

–রানিগঞ্জে তাঁর কয়লার খনি ছিল। কী ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে সেই সব খনিতে শ্রমিকরা কাজ করত তুমি ভাবতেও পারবে না। আমার পিতৃদেবের কাছে তাদের জীবনের কোনও দাম ছিল না। অর্থের চেয়ে কোনও কিছুকেই তিনি গুরুত্ব দেননি আজীবন।

–জমিদারির খাজনা আদায়ের জন্য তিনি কি প্রজাদের উপর অত্যাচার করতেন?

–হ্যাঁ রবি। তিনি জমিদারির রেয়াত-প্রথায় বিশ্বাস করতেন। প্রজা খাজনা ঠিক সময়ে দিতে না পারলে তার রেয়াত ছিল না। আমার পিতৃদেব অব্যাহতিদানে বিশ্বাস করতেন না।

–দয়ামায়া?

–ওই দুর্বলতাগুলি বিশেষ ছিল বলে মনে হয় না।

–এই তাহলে আমার পিতামহের অর্থ-সম্পদের উৎস?

–আরও আছে রবি।

–আর কী বাবামশায়?

–ফ্লেশট্রেড। নিষিদ্ধপাড়ায় তাঁর বাড়ি ছিল।

–বাবামশায়, তা হয়তো থাকতেই পারে, কিন্তু তা বলে প্রিন্স দ্বারকানাথ এতখানি নীচে নামবেন, ভাবতে পারছি না। আমার কাছে অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছে।

দেবেন্দ্রনাথ কিছুই বলেন না। শুধু তাকান রবীন্দ্রনাথের দিকে। তাঁর অবয়ব সম্পূর্ণ রক্তবর্ণ। ক্রোধে না অপমানবোধে, বুঝতে পারেন না রবীন্দ্রনাথ। তিনি নতমস্তকে পিতার সামনে নির্বাক হয়ে উপবিষ্ট থাকেন।

কিছুক্ষণ পরে কথা বলেন দেবেন্দ্রনাথ, আমার পিতার কাছে আমার মাতৃদেবীর নিত্যদিন কষ্ট পাওয়ার কথাটি তোমাকে মনে রাখতে হবে রবি। আমার মা ছিলেন এতই সুন্দরী যে তাঁকে লক্ষ্মীর অবতার বলা হত। তিনি ছিলেন বৈষ্ণববাড়ির মেয়ে। ছয় বছর বয়েসে পিতার সঙ্গে সম্ভবত ১৮০৯ সালে তাঁর বিবাহ হয়। তাঁর শাসনে ও পরিচালনায় পিতৃদেবের সংসার ভারি সুন্দরভাবে চলছিল। পিতাই সেই সোনার সংসার তছনছ করলেন শুধুমাত্র কামিনী-কাঞ্চনের প্রলোভন হেতু। পিতার এই অর্বাচীনতা ও নির্মমতা ও চরিত্রহীনতা আমি ক্ষমা করতে পারি না রবি।

রবীন্দ্রনাথ নীরব। তাঁর ভিতরটি ক্রমেই দ্বারকানাথের প্রতি বিদ্বেষে ভরে যাচ্ছে। তিনি আরও শুনতে চান। জানতে চান।

দেবেন্দ্র আবার শুরু করেন, আমার মা দিগম্বরী দেবী প্রতিদিন প্রত্যূষে চারটের সময় স্নান সেরে, কী শীতে, কী গ্রীষ্মে বা বর্ষায়, হরিনাম জপ করতে বসতেন। তাঁর একটি লক্ষ-হরিনামের মালা ছিল রবি। সেই আশ্চর্য মালা আমি দেখেছি। সেই মালার অর্ধেক, অর্থাৎ পঞ্চাশ হাজার বার হরিনাম করার পর মাতৃদেবী সামান্য আহার করতেন। আবার বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত আরও পঞ্চাশ হাজার বার হরিনাম করতেন। পিতৃদেবও তো বৈষ্ণব পরিবারের সন্তান। তিনি আচরণে আহারে প্রথম জীবনে পরম বৈষ্ণবই ছিলেন। নিজের হাতে আমাদের গৃহদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের নিত্য সেবা করতেন। অথচ আমার মাতার গর্ভে পরপর পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করার পর পিতৃদেবের হাতে তাঁর কত লাঞ্ছনাই না হল! পিতা সামাজিক মর্যাদার জন্য তাঁর ধনদৌলতের প্রচার চাইলেন। এবং বাড়ির মধ্যেই সাহেবদের সঙ্গে মদমাংসের মোচ্ছব করতে লাগলেন। ইংরেজ মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ভ্রষ্টাচারের কথা মাতৃদেবীর কর্ণে পৌঁছয়নি, তা নয়। তিনি দিনের পর দিন এই অপমান সহ্য করেছেন। তারপর তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের কাছে জানালেন, তিনি আর স্বামী সংসর্গ করতে চান না। এই বিষয়ে শাস্ত্রীয় অভিমত কী? পণ্ডিতেরা জানালেন, স্বামী-সংসর্গ নাই করতে পারেন, কিন্তু দূর থেকে স্বামীসেবা তাঁর অবশ্য কর্তব্য। আমার পিতৃদেব খুশি হলেন পণ্ডিতদের এই বিধানে। তিনি বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি তৈরি করে তাঁর ইচ্ছামতো নাচ-গান-সুরাপান এবং কামিনী-সম্ভোগে দিন কাটাতে লাগলেন। আর মাতৃদেবী জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একা হয়ে গেলেন। তাঁর উপায় ছিল না পিতার পাপের অর্থ ব্যতীত সংসার চালানো। কিন্তু সেই অর্থ যতবার স্পর্শ করতেন ততোবার গঙ্গাস্নান করতেন। তাঁকে পালকিতে করে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় চুবিয়ে আনা হত। এইভাবে ঠান্ডা লেগে নিউমোনিয়ায় তিনি মারা গেলেন ১৮৩৯ সালে। পিতার বয়েস তখন পঁয়তাল্লিশ। এর পরেই তিনি আরও বেশি ভোগবিলাসে রেকলেস জীবন শুরু করেন। ফলে স্ত্রীকে হারাবার সাত বছরের মধ্যে বাহান্ন বছর বয়েসে বিলেতে বেঘোরে মারা গেলেন। তাঁর মৃত্যু আজও আমার কাছে রহস্য। তিনি পরিবারের কথা, তাঁর সন্তানদের কথা ভাবলে এমন ধারদেনা করে, আকণ্ঠ ঋণগ্রস্ত হয়ে মারা যেতেন না। আমার ধারণা, তিনি যা উপার্জন করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ নিজের আনন্দের জন্যে উড়িয়ে দিয়েছেন। কারও মঙ্গলের কথা ভাবেননি। যদি ভাবতেন তাহলে তাঁর বিপুল ঋণের দায় আমাকে এইভাবে বহন করতে হত না।

–তবু বাবামশায়, আমাদের যতটুকু ধনশালিতা আজও আছে, তা তো তাঁরই জন্য, হঠাৎ বলে ফেলেন রবীন্দ্রনাথ।

–অন্যায়, অন্যায়, অন্যায়। এই পাপের অর্থের এতটুকু আমার ভোগ করতে ইচ্ছে হয় না। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, আমিও পিতৃদেবের পাপের অংশীদার, গম্ভীরকণ্ঠে বলেন দেবেন্দ্রনাথ।

না, আর কথা বলা ঠিক হবে না। পিতা যা বলছেন তা সত্যই বটে, মেনে নিতে যত কষ্টই হোক না কেন, ভাবলেন রবীন্দ্রনাথ।

– রবি, টাকার জন্যে তিনি নীলের ব্যবসা পর্যন্ত করেছেন। সাহেব ম্যানেজার রাখতেন তাঁর নীলকুঠিগুলিতে। নিজে দূরে থেকে সাহেবদের মাধ্যমে অত্যাচার চালিয়ে তিনি নীলের ব্যবসা করেছেন। এই ব্যবসায় টাকার কোনও হদিশ ছিল না। ঘড়ায়-ঘড়ায় অর্থ আসত আমাদের বাড়িতে। তবে দ্বারকানাথের সবচেয়ে বড় অন্যায়ের কথা এখনও বলিনি।

দ্বারকানাথের প্রতি ঘৃণায় রবীন্দ্রনাথের গা গুলিয়ে আসছে। নীলের চাষের চেয়েও ঘৃণ্য অপরাধ কী হতে পারে? না, আর শুনতে চান না রবীন্দ্রনাথ। তবু তাঁকে শুনতে হয়।

– আমার পিতৃদেব, তোমার পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ অহিফেনের বাণিজ্যে নেমেছিলেন।

– বাবামশায়, কী বলছেন আপনি? পিতামহ আফিমের ব্যবসা করতেন?

– হ্যাঁ রবি। ইংরেজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গোপনে ওপিয়াম ট্রেড থেকে অর্থ উপার্জন করতে তাঁর বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা ছিল না। চিনের সঙ্গে আফিমের বাণিজ্য করবার জন্য তিনি জাহাজ কিনেছিলেন। রাতের অন্ধকারে দ্বারকানাথের আফিম ভর্তি জাহাজ ভাসত সমুদ্রে। আফিমের ব্যবসার যাবতীয় নোংরামি তাঁকে করতে হয়েছিল। এবং যাবতীয় ঝুঁকি তাঁকে নিতেও হয়েছিল। এই অর্থই তিনি দিনের পর দিন ভোগবিলাসে উড়িয়েছেন প্যারিসে-লন্ডনে। বেদনায় কাঁপছে স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথের কণ্ঠ। এই প্রথম বাবামশায়ের মধ্যে গভীর বেদনার প্রকাশ দেখলেন রবীন্দ্রনাথ।

দেবেন্দ্রনাথ মুহূর্তে নিজেকে সংযত করলেন। যেন পুত্রের সামনে ব্যক্তিগত বেদনার প্রকাশে তিনি লজ্জিত।

– রবি, দ্বারকানাথ বিষয়ে যা জানাবার প্রায় সকল কথাই তোমাকে জানালাম। এইবার আমার একটি আদেশ।

– বাবামশায়, আপনি যা যখন বলেন, আমি কখনও কোনও বিষয়েই প্রশ্ন তুলি না। আপনার সকল আদেশ মেনে চলাই আমার কর্তব্য বলে আমি মনে করি। এবং তাতেই আমার মঙ্গল, সেই বিষয়েও আমার সন্দেহ নেই।

– রবি একথা স্বীকার করছি। তোমার মধ্যে যে দ্বিধাহীন আনুগত্য, বশংবদতার প্রমাণ আমি বারবার পেয়েছি, তা আর কোনও পুত্রের মধ্যে পাইনি। তাছাড়া, আমার যে-কোনও আদেশ নিপুণভাবে পালন করার ক্ষমতাও তোমার আছে।

– বাবামশায়, আদেশ করুন। যতো কঠিন ও নির্মমই হোক আপনার আদেশ, আমি তা মাথা পেতে নেব।

দেবেন্দ্রনাথ বেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর ধীর পদক্ষেপে তাঁর সিন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। লোহার পাল্লা খুলে বের করে আনলেন প্রাচীন কাগজের একটি বৃহৎ তোড়া। সিন্দুক বন্ধ করে কাগজের তোড়াটি রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিলেন। তারপর বললেন, এইসব নথিপত্র অত্যন্ত গোপন। দ্বারকানাথের সমস্ত রকম বাণিজ্য ও কুকর্মের হদিশ এই নথিপত্রের মধ্যে আছে। আমি চাই এইসব নথিপত্র লুপ্ত হোক পৃথিবী থেকে।

রবীন্দ্রনাথের বুকের ভিতরটা থরথর করে কেঁপে উঠল।

– রবি, তুমি হয়তো আমার আদেশের তাৎপর্য ধরতে পারনি। ভাল করে ভাবলেই বুঝতে পারবে আমি ঠিক কী চাইছি। তুমি বুদ্ধিমান রবি। আমার সকল সন্তানের মধ্যে তোমার বোধ ও বুদ্ধি সবথেকে বেশি।

– বাবামশায়, আপনি যা বলছেন তা ইতিহাসকে লুপ্ত করার কথা। সেটি কি সঠিক কাজ হবে? দ্বারকানাথের প্রতি আমাদের কোনও দায়দায়িত্ব না থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের প্রতি তো আছে। ইতিহাসকে ধ্বংস করা কি উচিত হবে বাবামশায়?

– রবি, তোমার মুখে এই অর্বাচীন প্রলাপ শোভা পাচ্ছে না। কীসের ইতিহাস? আমাদের এত বড়, এত বিখ্যাত, এমন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক এক পরিবার। সমস্ত ব্রাহ্মসমাজ আমাদের পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সেই পরিবারের কলঙ্কিত একটি অধ্যায়কে তুমি ইতিহাসের মর্যাদা দিয়ে তুলে রাখবে? এইসব কথা লোকে জানলে, আমাদের অর্থের পাপক্লিষ্ট উৎসের কথা জানলে আমাদের পারিবারিক সম্মান কি বৃদ্ধি পাবে?

– গোপন নথিপত্র যেমন গোপনে আছে থাক না, বাইরে না পৌঁছলেই তো হল।

– না রবি, আমার আদেশ, তোমাকে দ্বারকানাথ-বিষয়ে সমস্ত নথি পুড়িয়ে ছাই করে দিতে হবে। একটি অক্ষরও বাঁচবে না। মনে রেখো, রবি তুমিই আমাকে মহর্ষি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছ। ব্রাহ্মসমাজের শীর্ষে আমি। আমার সততা, আমার আধ্যাত্মিকতা, আমার জীবনযাত্রা ও জীবনমন্ত্রের সহজতা বাঙালির মনে নতুন বিশ্বাসের সঞ্চার করেছে। আমার যোগ্য পুত্র হিসেবে তুমিও হয়তো আমারই দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে একদিন আচার্যের পদ গ্রহণ করবে। আমার মৃত্যুর পরেও পিতৃকলঙ্কের কোনও রকম প্রচার আমার এতদিনের সমস্ত সাধনা ও আধ্যাত্মিক চর্চাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারে। এবং তোমার ভবিষ্যতেরও অমঙ্গল ঘটবে। দ্বারকানাথ আমাদের দুজনেরই সর্বনাশ। কাল কাকভোরে যেন এই নথিগুচ্ছে অগ্নিসংযোগ ঘটে। তুমি নিজে হাতে আগুন লাগাবে রবি। কারও সাহায্য নেবে না। এইসব গোপন নথির একটি অক্ষরও যেন কেউ না পড়তে পায়।

রবীন্দ্রনাথ কিছু বলেন না। নীরবে নিরীক্ষণ করেন নথিপত্রের প্রাচীন নধর তোড়াটি।

– একটি রাত তোমাকে আমি সময় দিলাম। মাত্র একটি রাত, বললেন দেবেন্দ্র।

– কীসের সময় বাবামশায়?

– এই নথিগুলিতে চোখ বোলাবার। এত নথি এক রাতে পড়ে ওঠা সম্ভব নয়। তবে আমি নিশ্চিত, তুমি যেখানেই চোখ ফেলবে সেখানেই দেখবে পাপ আর কদাচারের চিহ্ন। তুমি তখন নিজেই ঘৃণা করবে তোমার পিতামহকে। এই নথিপত্রে অগ্নিসংযোগ করতে কাল ভোরবেলা তোমার হাত কাঁপবে না রবি। তুমি দ্বিধাহীনভাবে পিতৃ-আজ্ঞা পালন করতে পারবে সহজেই।

দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মাথায় হাত রাখেন। তারপর বলেন, রবি, এতদিনে আমি নিশ্চিন্ত হলুম। পাপ বিদায় হল। তোমার-আমার দুজনেরই মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হল।

রবীন্দ্রনাথ উঠে দাঁড়ান। প্রণাম করেন দেবেন্দ্রনাথকে। নথিগুচ্ছ হাতে করে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। মাত্র একটি রাত তাঁর হাতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *