৩. ‘আমি অন্তরে অসভ্য’

৩. ‘আমি অন্তরে অসভ্য’

১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫: এই আট বছরে ভাইঝি ইন্দিরাকে দুশো বাহান্নটি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ওই আট বছরেই স্ত্রী মৃণালিনীকে দিয়েছিলেন পনেরোটি চিঠি এবং পাঁচটি সন্তান।

১৮৮৭:রবীন্দ্রনাথের বিয়ে ইতিমধ্যেই চার বছরের পুরনো।

১৮৮৭:প্রিয় বউঠান কাদম্বরীও নেই তাঁর জীবনে বছর চারেক হল। ১৮৮৭:রবীন্দ্রনাথের মনে অবিরল ছটফটানি। সংসারে মন নেই। নিঃসঙ্গ তিনি। জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে, চার বছরের পুরনো স্ত্রীর কাছে থেকে দূরে থাকতেই ভালবাসেন।

দিবারাত্র ভাসমান তিনি জলি বোটে পদ্মায়, কিংবা ভ্রাম্যমাণ। কখনও তিনি ভাসছেন ইছামতীতে, কখনও নোয়ালঙ্গের পথে, কখনও দিঘাপতিয়ার জলপথে, কখনও বা পাবনার দিকে। শিলাইদহে পদ্মায় ভাসছেন অবিরল।

চলেছেন সাজাদপুরের পথে। তিনি কটকে, কালিগ্রামে, কুষ্ঠিয়ায়; তিনি চুহালিতে, তিরনে, নাটোরে, পতিসরে, পুরীতে, বালিয়ায়, বোয়ালিয়ায়, বোলপুরে, সোলাপুরে। তিনি দার্জিলিং-এ। তিনি লন্ডন-এ! এবং যেখানেই তিনি, সেখান থেকেই চিঠি লিখেছেন ইন্দিরাকে।

স্ত্রী মৃণালিনীকেও লিখছেন, কিন্তু সে-চিঠি অন্য চিঠি, সে-মানুষ অন্য মানুষ, সে-চিঠিতে নেই রোম্যান্টিক ইশারা, মধুর রসের মাধুর্য, প্রাণখোলা কথা, ব্যাকুলতা।

অবিশ্বাস্য, তবু এমন চিঠি রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন তাঁর স্ত্রীকে, ”যেমনি গাল দিয়েছি অমনি চিঠির উত্তর এসে উপস্থিত। ভাল মানষির কাল নয়। কাকুতি মিনতি করলেই অমনি নিজমূর্ত্তি ধারণ করেন আর দুটো গালমন্দ দিলেই একেবারে জল। এ’কেই তো বলে বাঙ্গাল। ছি, ছি, ছেলেটাকে পর্যন্ত বাঙ্গাল করে তুল্লে গা!”

এই চিঠিটাই যথেষ্ট, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মৃণালিনীর সম্পর্ক বোঝাতে।

মৃণালিনীকে আরও একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ, ”এ রকম করে চিঠি লিখে লিখে কেবল তোমাদের অভ্যাস খারাপ করে দেওয়া হয়-এতে তোমাদের মনেও একটুখানি কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হয় না!…এখন আমার ক্রমশঃ বিশ্বাস হয়ে আসচে তোমার কাছে আমার চিঠির কোনো মূল্য নেই এবং তুমি আমাকে দু ছত্র চিঠি লিখতে কিছুমাত্র কেয়ার কর না।”

বোঝাই যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর তেমন মানসিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা সহজ ছিল না। রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে আন্দাজ করতে পারি রবীন্দ্রনাথ আর মৃণালিনী ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতের মানুষ, ”বাবা ছিলেন তাঁর নিজের ঘরে লেখাপড়া নিয়ে, মা ছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসারের কাজে।”

মৃণালিনী নিজেই লিখেছেন, নিঃসঙ্গ ঘরনির অভিমানে, ”আমি এখন কাজের লোক হয়ে গেছি।”

রবীন্দ্রনাথ-মৃণালিনী ছিলেন দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা। দুই জগতের মধ্যে কোনও সেতুবন্ধন সম্ভব ছিল না। স্ত্রীকে ঘি পাঠিয়ে তাঁর উপযুক্ত ‘স্বীকৃতি’ না পাওয়াতেও তিক্ত ক্ষিপ্ত রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীকে লিখছেন ১৮৯১-এর জুন মাসে, মৃণালিনীর মৃত্যুর এক বছর আগে, ”আমি যে তোমাকে এই সাহাজাদপুরের সমস্ত গোয়ালারঘর মন্থন করে উৎকষ্ট মাখনমারা ঘের্ত্ত, সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম, তৎসম্বন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বল দেখি? আমি দেখচি অজস্র উপহার পেয়ে পেয়ে তোমার কৃতজ্ঞতা বৃত্তিটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসচে। প্রতি মাসে পনেরো সের করে ঘি পাওয়া তোমার এমনি স্বাভাবিক মনে হয়ে গেছে, যেন বিয়ের পূর্ব্বে থেকে তোমার সঙ্গে আমার এই রকম কথা নির্দ্দিষ্ট ছিল। তোমার ভোলার মা আজকাল যখন শয্যাগত তখন এটি বোধহয় অনেক লোকের উপকারে লাগচে। ভালই ত। একটা সুবিধা, ভাল ঘি চুরি করে খেয়ে চাকরগুলোর অসুখ করবে না।”

বোঝা যায়, মনে-মনে কী গভীর বিরক্তি, রাগ, অনীহা, অভিমান পোষণ করতেন রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর প্রতি, অথচ মৃণালিনীর সমবয়সী ইন্দিরার প্রতি তাঁর কী গভীর অনুরাগ!

রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে লিখছেন, ”আমরা দৈবক্রমে প্রকাশ হই, আমরা ইচ্ছা করলে চেষ্টা করলেও প্রকাশ হতে পারি নে,-চব্বিশ ঘণ্টা যাদের সঙ্গে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা আমাদের সাধ্যের অতীত।”

ইন্দিরার কাছে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ব্যক্ত করতে পারেন, কারণ ”সহজে সত্য আকর্ষণ করে নেবার ক্ষমতাটি” ইন্দিরার আছে।

মৃণালিনীর বয়েস মাত্র দশ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তাঁর। যাঁর সঙ্গে মনের সম্পর্ক তেমনভাবে গড়ে উঠল না রবীন্দ্রনাথের, যাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রের মেধা-জ্ঞান-বোধের যোজন দূরত্ব, সেই মেয়েটিই বারো বছর বয়েসে রবীন্দ্রের প্রথম সন্তানের মা! ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪, এই আট বছরের মধ্যে পাঁচটি সন্তানের মা হলেন মৃণালিনী। বেলা রথী রানী মীরা শমী- এঁদের জন্ম দিতে আট বছর প্রায় এক নাগাড়েই কাটল তাঁর আঁতুড়ঘরে।

ঠিক এই সময়েই ইন্দিরাকে তোড়ে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ; বিলেত যাচ্ছেন ১৮৯০-এ; বার করছেন ‘সাধনা’-র একটির পর একটি সংখ্যা; রচনা করছেন সাহিত্যের স্বর্ণযুগ; ভাসছেন পদ্মার স্রোতে, নিঃসঙ্গ ভাবনার আলস্যে কাটছে তাঁর জীবন; স্ত্রীর আগমনের সংবাদ পেয়ে লিখছেন ইন্দিরাকে, ”সমস্ত আকাশ যেন হৃদয়পুঞ্জের মতো আমাকে বেষ্টন করে ধরেছে। আশ্চর্য এই যে, পরশু আমার এখানে যখন জনসমাগম হবে তখন এরা যেন আর থাকবে না।”

কেন রবীন্দ্রনাথের কাছে মরে যাবে প্রকৃতি? কারণটা তিনি নিজেই জানিয়েছেন, ”যদি একলা থাকতুম তা হলে এই সময়টাতে জানলার কাছে লম্বা কেদারায় আবিষ্টচিত্তে পড়ে থাকতুম-দিবাস্বপ্ন দেখতুম, এই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের ভিতরকার একটি গভীর বেলাবলী রাগিণী শুনতে পেতুম এবং নিজের অস্তিত্বকে এই রৌদ্র জল বায়ুর ভিতরে সম্মিশ্রিত পরিব্যাপ্ত হিল্লোলিত অনুভব করতুম…আমার নিজের ব্যক্তিগত নিজত্ব-আবরণ এই শরতের রৌদ্রে বিগলিত হয়ে এই স্বচ্ছ আকাশের সঙ্গে মিশে যেত এবং আমি দেশকালের অতীত হয়ে যেতুম। কিন্তু এখন এ অবস্থায় ঠিক সেই আত্মবিস্মৃত ভাবের মধ্যে নিমগ্ন হওয়া শক্ত।”

এখন রবীন্দ্রনাথ শুধুই ”তমুকের বাপ, অমুকের স্বামী, অমুকের বন্ধু, শ্রীযুক্ত অমুক।” বিবাহক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ পালাতে চান সংসারের সমাগম থেকে তাঁর একান্ত নিজস্ব ভাবনার জগতে-এ-কথাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইন্দিরাকে লেখা চিঠিতে।

কখনও-কখনও স্ত্রীকে ‘মিস’ করছেন রবীন্দ্রনাথ, মৃণালিনীর জন্যে মন কেমন করছে তাঁর, এ-প্রমাণও পাওয়া যায় তাঁর চিঠি থেকে, কিন্তু তা থেকে ভাবাটা ভুল হবে যে, মৃণালিনীকে তাঁর উনিশ বছরের বিবাহিত জীবনে ক্রমাগত নিঃসঙ্গতায়, অবহেলায়, আদরের উপবাসে কষ্ট পেতে হয়নি।

মৃণালিনী সন্তানদের অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ জোর করে বেলা (মাধুরীলতা) ও রানীর (রেণুকা) বিয়ে দিলেন:বেলার বয়েস ১৫ আর রানী ১০।

বেলার বিয়ের এক মাস চব্বিশ দিন পরেই রানীর বিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মৃণালিনী ততদিনে অসুস্থ। আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন তিনি। মারা গেলেন পরের বছর, আটাস বছর বয়েশে। রবীন্দ্রনাথ চল্লিশে পড়লেন।

১৮৮৭:পরমা সুন্দরী ইন্দিরার বয়েস চোদ্দো। সাত বছর বয়েসে লন্ডন থেকে ফিরে প্রথমে সিমলার অকল্যান্ড হাউস-এ, পরে কলকাতার লোরেটো কনভেন্ট-এ লেখাপড়া সেরে এন্ট্রান্স পাশ করেছেন। তাঁর প্রধান বিষয় ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য। শিখেছেন বদ্রিদাস সুকুলের কাছে ধ্রুপদী সঙ্গীত, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-এর অর্গানিস্ট স্লেটার সাহেবের কাছে পিয়ানো, ইটালিয়ান, বেহালাশিল্পী মানজাটো-র কাছে বেহালা। পঞ্চদশী তিনি, রবিকাকার বিলিতি গানের সঙ্গে নিয়মিত বাজাচ্ছেন পিয়ানো।

১৮৮৭: ইন্দিরার থেকে বছরখানেকের ছোটো মৃণালিনী এক বছর মা হয়েছেন। তেরো বছরের মা বাচ্চা এবং সংসার সামলাতে নাজেহাল। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর চিঠি লেখার সময় কোথায়? তা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথের মতো স্বামীকে চিঠি লেখার মতো ভাব-ভাষা-হাতের লেখা- বানান-ই কি তাঁর আয়ত্তে?

ইন্দিরা চোখটানা সুন্দরী। মনে-শরীরে সমান উজ্জ্বল, আকর্ষণীয়। পরদার আড়াল থেকে দ্বিধাহীনভাবে বেরিয়ে এসে পুরুষদের সঙ্গে স্বাধীন মেলামেশায়, সখ্যে কোনও অন্যায়বোধ, কুণ্ঠা নেই তাঁর।

এই নতুন মূল্যবোধ তাঁর বিলিতি শিক্ষার ফসল। বিয়ের আগে, তিনি নিজেই লিখছেন, তাঁর ”পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না।”

পুরুষের সঙ্গে খোলাখুলি মিশছেন, পুরুষ মুগ্ধ হচ্ছে, প্রেমে পড়ছে, তাঁকে যাচনা করছে স্ত্রী বা মানস-সঙ্গিনী হিসেবে।

অথচ ছাব্বিশ বছর পর্যন্ত তিনি বিয়ে করছেন না। পাশাপাশি বাইশ বছর বয়েসে মৃণালিনী পাঁচ সন্তানের মা হলেন।

এই অনূঢ়া উজ্জ্বলাকে তাঁর চোদ্দো থেকে বাইশ বছর বয়েস পর্যন্ত চিঠি লেখার আকর্ষণে সাড়া না দিয়ে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। কেন তাঁর ভাল লাগে ইন্দিরাকে চিঠি লিখতে সে-কথা তিনি জানিয়েছেন ইন্দিরাকে ১৮৯৪-এর ৭ অক্টোবর। ইন্দিরা তখন একুশ। রবীন্দ্রনাথ তেত্তিরিশ।

রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে লিখছেন কলকাতা থেকে, ”আমিও জানি বব (ইন্দিরার ডাকনাম বিবি। রবীন্দ্রনাথ ডাকতেন ‘বব’।) তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার কোনো লেখায় হয়নি। আমার প্রকাশিত লেখা আমি যাদের দিই, ইচ্ছা করলেও আমি তাদের এ-সমস্ত দিতে পারিনে।”

‘এ-সমস্ত’-কী অল্প কথার, কী পরিব্যাপ্ত প্রতিভাস, কত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। রবীন্দ্রমানসে এমন কিছু বিচিত্র ভাব ও ভাবনা রয়েছে, যা আর কারও কাছে প্রকাশ করা যায় না, যার অনেকটাই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের দ্বারাও অনিয়ন্ত্রিত, যা উৎসারিত তাঁর অবচেতনার আচ্ছন্নতা থেকে, যা ধরণীর অন্তর্গূঢ় লাভার মতো, গলিত উত্তপ্ত প্রবল, যার নিঃসরণ ঘটে আগ্নেয় বিস্ফোরণে, যার ইচ্ছাকৃত, পূর্বপরিকল্পিত উদ্ঘাটন রবীন্দ্রনাথের ”ক্ষমতার মধ্যে নেই”।

১৮৯৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ইন্দিরার বিয়ের আগে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে যে দুশো বাহান্নটি চিঠি লেখেন, তার মধ্যে কোনও ছদ্মবেশ নেই, নেই কোনও সাজানো কথার পারিপাট্য, আড়াল; তিনি যেমন ভাবছেন, তেমন লিখছেন, ঢাকনা খুলে দিয়েছেন মনের, অনর্গল প্রকাশিত হচ্ছেন তিনি, দ্বিধাহীন; তরুণী ইন্দিরা তাঁর সব কথা, ইঙ্গিত, ব্যঞ্জনা বুঝবেন কি না, সে-সংশয় কোনওভাবে আটকে দিচ্ছে না তাঁর হৃদয়কথার ব্যাকুল প্রকাশকে।

”তোকে আমি যখন লিখি তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোনো কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে, কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি,” ইন্দিরাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

আর কারও কাছে কেন ঠিক এইভাবেই মন খুলতে পারেননি তিনি?

এ-প্রশ্নের উত্তর রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শোনা যাক, ”যখন মনে জানি পাঠকরা আমাকে ভালো করে জানে না, আমার অনেক কথাই তারা ঠিকটি বুঝবে না এবং নম্রভাবে বোঝবার চেষ্টাও করবে না, এবং যেটুকু তাদের নিজের মানসিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে না সেটুকু আমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করে গ্রহণ করবে না-তখন মনের ভাবগুলি তেমন সহজে ভাষায় প্রবাহিত হতে চায় না এবং যতটুকু প্রকাশ হয় তার মধ্যে অনেকখানি ছদ্মবেশ থেকে যায়।”

ইন্দিরার বিয়ের পরেও তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৩ থেকে ১৯৪১-এর মধ্যে লেখা চুরাশিটি প্রকাশিত চিঠি আমরা পেয়েছি। প্রথম পত্রটি লন্ডন থেকে লেখা, ইন্দিরার চিঠির উত্তরে, চিঠিটি শেষ হয়েছে এহেন যথাযথ নির্লিপ্তিতে, ”রাত হয়ে এল। বর্ষারম্ভের আশীর্বাদ জানিয়ে এইখানে চিঠি শেষ করছি। শুভানুধ্যায়ী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”

এই সিরিজের শেষ পত্রটি শেষ হচ্ছে এইভাবে, ”বিবি আমার জন্মদিনে তুই যে মূর্তিটা পাঠিয়েছিস সে আমার খুব সান্ত্বনাজনক। শেষ দশায় অর্জুন গাণ্ডীব তুলতে পারেননি, আমার সেই অবস্থা। আমার চিরদিনের কলম আজ পরের ঘাড়েই চাপাতে হচ্ছে কিন্তু বকলমে তোকে লিখতে ভাল লাগে না-খোঁড়া কলমকে চাবুক লাগিয়ে কোনো মতে ক’লাইন লিখিয়েছি-এখন সে ফিরে চলল পিঁজরাপোলে। আশীর্বাদ। রবিকাকা।” চিঠির তারিখ ১৩ মে, ১৯৪১। তিরোধানের ঠিক তিন মাস আগে। লিখেছেন শান্তিনিকেতনের ‘উত্তরায়ণ’ থেকে।

এই পর্বের প্রথম চিঠিটিতে বহু বছর পরে রবীন্দ্রনাথ ফিরে এলেন বটে ইন্দিরার কাছে, ইন্দিরার বয়েস এখন ঠিক চল্লিশ, আর রবীন্দ্রনাথ বাহান্ন, এ-বছরেই তিনি নোবেলবিজয়ী,-কিন্তু এ-রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভাসমান- ভ্রাম্যমাণ-উত্তপ্ত-অনর্গল-তরুণ রবীন্দ্রনাথের কত তফাত। তিনি ইন্দিরার কাছেও টানছেন আড়াল, রুদ্ধ তাঁর অবেচতন মনের ”সমস্ত বিচিত্রভাব’, তিনি ”ছদ্মবেশী”, তিনি ইন্দিরাকে আর মনের ভাব অনায়াসে বলে যেতে পারছেন না। এ-এক অন্য রবীন্দ্রনাথ যিনি ইন্দিরাকেও লিখছেন ”সুরচিত কাব্যকথা”।

অন্তিম চিঠিটিতে প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রের অপারগ বিষণ্ণতা। তিনি বেরিয়ে আসতে চাইছেন আড়াল থেকে। খুলে ফেলতে চাইছেন মুখোশ। ছিঁড়ে ফেলতে চাইছেন ছদ্মবেশ। এবং বুঝতে পারছেন, তা আর সম্ভব নয়। তারুণ্যের বেপরোয়া প্রকাশক্ষমতা, অনর্গলতা তাঁকে ত্যাগ করেছে। তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন নিঃশেষিত প্রান্তিক অর্জুনের সঙ্গে, যে-অর্জুন গাণ্ডিব তুলতেও অক্ষম, যেমন রবীন্দ্রনাথও নিজের আঙুলে কলম ধরতে অপারগ।

”খোঁড়া কলমকে চাবুক লাগিয়ে কোনো মতে ক’ লাইন লিখিয়েছি”-কী গভীর অভিমান, কী যন্ত্রণাময় অন্তরদহন ফুটে উঠেছে এই আত্মাভিমানী স্বীকারোক্তির মধ্যে। তিনি যেন চাবুক মারছেন নিজের পিঠের উপর, দুর্বল ইচ্ছাশক্তির উপর, রিক্ত অবশিষ্টটুকুর উপর।

আরও একবার কি ইন্দিরার কাছে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করা যায় না তাঁর ”গভীরতম উচ্চতম অন্তরতম” বিচিত্রভাব? ১৮৮৭-৯৫-এর দ্বিধাহীন সততা, দুর্নিবার প্রাবল্য, গভীরতম সত্য কথার অনায়াস প্রকাশ কি আরও একবার ফিরে আসতে পারে না রবীন্দ্রনাথের কলমে?

না, তাঁর ‘ভাবমূর্তি’-ই প্রধান অন্তরায়, সন্দেহাতীত দুর্বলতা। তাঁর ‘গাণ্ডীব’-কে তিনি নিক্ষেপ করলেন পিঞ্জরাপোলে। মূল্য দিলেন তাঁর তিলে-তিলে অর্জিত মহিমার।

ইন্দিরাকে লেখা এই পর্বেরই একটি চিঠিতে মৃত্যুর কাছাকাছি-আসা রবীন্দ্রনাথ ছলছল করে উঠেছেন নিজের ইমেজ-অবরুদ্ধতার কথা ভেবে, সেই সঙ্গে মনে পড়েছে, তাঁর অন্য যুগ ভিন্ন প্রণয়ের কথাও, ”ছেলেবেলায় নতুন বৌঠান যথোচিত উৎসাহের সঙ্গে তাঁর দেওরের অভিমান খর্ব করে এসেছেন, সেটা আমি ন্যায্য বরাদ্দের মতোই মাথা পেতে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিলুম, কখনো ভাবতে পারতুম না বিহারী চক্রবর্তীর গৌরবের সীমা আমি কোনো দিন পেরতে পারব। তিনি তাঁকে নিজের হাতে পশমের আসন বুনে দিয়েছিলেন, আমি নিশ্চয় জানতুম আমার আসন মাটিতে-আদরের এই উপবাস এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আজ তার প্রাচুর্য আমার পাওনার বেশি মনে না করলেও তাতে অস্বস্তি বোধ করি।”

যে-আদরের উপবাস তাঁকে আজীবন কষ্ট দিয়েছে এবং যে-আদরের প্রাচুর্য ক্রমশ এসেছে তাঁর জীবনে খ্যাতির বিড়ম্বনা হয়ে, সেই দুই ‘আদর’ যে এক বস্তু নয়, তা রবীন্দ্রনাথ জানতেন, তাঁর ক্রমান্বিত ছদ্মবেশের করুণ আড়াল থেকেও। এই অবরুদ্ধতা থেকে তাঁর আর নিষ্ক্রান্তির উপায় নেই, তিনি জানেন।

আদরহীন একাকিত্বের মধ্যেই তাঁর অবসান হবে একদিন, সে-কথাও তাঁর অজানা নয়, ”তোদের অনেকদিন দেখিনি। দেখতে ইচ্ছে করে। তার কারণ, জীবন আকাশের আলো ম্লান হয়ে এসেছে-এখন মনের সব বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো যেন গোষ্ঠে ফেরবার মুখে -বাইরের দিকটা অবরুদ্ধ হয়ে আসচে। এই অবস্থায় নিজেকে একলা মনে হয়। এ জন্মের যাত্রা পথের যারা সঙ্গী ছিল তারা অনেকেই নেই-নতুন যারা এসেছে জীবনের শেষপ্রান্তের সঙ্গে তাদের যোগ-এই প্রান্তটি সঙ্কীর্ণ এবং ক্রমেই ক্ষীণতর হয়ে আসচে। চেষ্টা করছি অন্তরের দিকে নতুন পালা আরম্ভ করতে-সেটা উত্তর অয়ন পেরিয়ে উত্তরতর অয়ন।”

রবীন্দ্রের প্রণয়জীবনে সারাক্ষণই তো রয়েছে উত্তরে বাতাস। কী প্রবল অন্তর্দাহ, অগ্নিগর্ভ বাসনা, অথচ পরিব্যাপ্ত শীত!

”আদরের উপবাস”-এই দুটি শব্দের মধ্যে নিহিত তাঁর নিতান্ত নির্জন ব্যক্তিজীবনের, তাঁর উত্তরঅয়ন পেরিয়ে উত্তরতর অয়নে ‘উত্তীর্ণ’ হওয়ার তৃষ্ণার্ত, উপোসি সরণির জ্যোতির্ময় যাতনা।

যে-ইন্দিরাকে একদা চিঠি লিখতেন প্রাণের প্রণোদনায়, তাঁর সঙ্গে কথা বলার, তাঁর কাছে হৃদয়ের কথা পৌঁছে দেওয়ার নিখাদ তাড়নায়, সেই একই মেয়েকে ১৯৩৪-এ তিনি চিঠি লিখেছেন শুধুমাত্র উত্তর দেওয়ার সৌজন্য রক্ষার্থে, ”কল্যাণীয়াসু বিবি, এইমাত্র প্রমথর চিঠি আমাকে চেতিয়ে দিয়ে গেল যে আমার কাছে তোর একটা উত্তর পাওনা আছে।”

কিন্তু এই পাওনা শোধ করার কোনও তাড়া অনুভব করেন না রবীন্দ্রনাথ, ইন্দিরার কাছে আর তখুনি-তখুনি জানাতে চান না তাঁর মনের বিচিত্রভাব, চিঠি যখন লেখেন তাঁকে, সে সব সাজানো কথা, গড়িমসি থেকে উঠে আসা কিছু শব্দ আর বাক্য মাত্র, ইন্দিরার ”চিঠি হাতে এলেই কর্ত্তব্যপরায়ণ মন বলে উত্তর দেব, তারপর বলি কাল দিলেই হবে, সেই কাল পরম্পরা এগোতে থাকে, অবশেষে যেটা উল্টিয়ে পড়ে বিস্মৃতির অন্ধকূপে।”

তাঁর বিবিকে, তাঁর ববকে আর যেন নতুন কিছু বলার নেই রবিকাকার। এমনকী ইন্দিরার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ‘বব’ নামটিও চিঠি থেকে ক্রমশ ঝরে গেছে।

এখন একটির পর একটি চিঠি শুরু হয় একই ভাবে। ”কল্যাণীয়াসু বিবি, তোরা দুজনে আমার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিস।” ”কল্যাণীয়াসু, তোরা দুজনে আমার আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিস।” ”কল্যাণায়াসু তোরা দুজনে আমার আশীর্ব্বাদ জানিস।” আর একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে লিখছেন, ”কল্যাণীয়াসু, তোকে বিজয়ার আশীর্ব্বাদ জানিয়ে চিঠে লিখেছি কি না মনেও নেই।”

রবীন্দ্রনাথ জানেন, ইন্দিরা আর তাঁর নন, তাঁর আর ইন্দিরার মাঝখানে এক তরতাজা প্রতিভাবান যুবকের আবির্ভাব হয়েছে, এ-যুবক ইন্দিরার স্বামী, যাঁর বিরল বৈদগ্ধ্যে তিনি নিজেও মুগ্ধ। এবং যাঁর ‘সবুজপত্র’ সাহিত্য পত্রিকায় লিখতে তিনি উৎসাহী।

ইন্দিরা আর প্রমথকে আলাদা করে ভাবতে চান না রবীন্দ্রনাথ। ইন্দিরা এখন কাছের হয়েও দূরের। ‘বব’-নামের আদর থেকে নিজেই সরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ঔচিত্যবোধ তাঁকে জুড়িয়ে দিয়েছে ইন্দিরার প্রতি। তিনি রাশ টেনে ধরেছেন তাঁর আবেগের।

এখন শুধু মাঝে মধ্যে ইন্দিরার উপর কাকাসুলভ মাস্টারি করেন, যেমন এখানে, ”তোর উদ্বোধন পড়ে ভালো লাগল। কেবল একটি খুঁৎ আছে। ‘বাধ্যতামূলক’ কথাটা আমি সইতে পারিনে। ঐ দুঃশব্দ ব্যবহারে ভদ্রভাষারীতির প্রতি অবাধ্যতা করা হয়। Compulsory হল অবশ্যকৃত্য, Voluntary হল স্বেচ্ছাকৃত্য।”

কিন্তু কী আশ্চর্য! ইন্দিরা পদ্মাতীরে গিয়েছেন শুনে ১৯২৯-এর পুরনো রবীন্দ্রনাথ আবার ছলকে ওঠেন, যেন হঠাৎ ফিরে আসেন পদ্মাতীরের যুবক রবীন্দ্রনাথ, ইন্দিরাকে ‘বব’ নামে ডেকে চিঠি লেখেন তিনি এই মর্মে, ”কল্যাণীয়া বব, তোরা পদ্মাতীরে গিয়েছিস শুনে মনে মনে লোভ হচ্চেচ। পদ্মার আমন্ত্রণ আমার হৃদয়ের মধ্যে নিয়তই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমাদের বোটের জন্যে উপযুক্ত মাঝিমল্লা পেলুম না বলে এবার এখানকার ডাঙার উপর পড়ে পড়েই রোদ পোহাতে হল। কথা ছিল বোটে করে পদ্মার চরে যাব। তোরা যাচ্চিস শুনলে মনটা আরও ছটফট করে উঠত।”

কিন্তু তিন বছর আগে ইন্দিরা যখন রাখি পাঠিয়েছিলেন তাঁর রবিকাকাকে, প্রেগ থেকে অভিমানের নির্ভুল ইশারা পাঠিয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ”তোর রাখী পেলুম। কিন্তু বিষম ঘুরে বেড়াচ্ছি-কোনো বন্ধন কোথাও ধরে রাখচে না। অথচ একে মুক্তি বলে না।…যাই হোক মনের মধ্যে থেকে আশা হয় যে, একটা রাস্তা পাব।-কেননা বেদনা যে মরেনি, অসাড় হয়নি মন। সব সময়ে পথ দেখতে পাইনে বটে কিন্তু দূরের আলোটা দেখতে পাই তো- তাতেই রাত্রের কোনো একটা প্রহরে বাসায় ফেরাবে। …ভিতরে একটা নিরন্তর কান্না থেকে যায়,… মন দেহ শ্রান্ত হয়ে পড়েচে-

শিথিল ক্লান্ত হাতে দাঁড় ধরে গাচ্চি-

মাঝি তোর বৈঠা নে রে,

আমি আর বইতে পারলাম না।”

প্রেগ থেকে লেখা এ-চিঠিতে আকস্মিক আবেগে ছদ্মবেশ খুলে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বব-এর কাছে, লিখেছেন তাঁর ক্লান্তি আর নিঃসঙ্গতার কথা, জীবনপ্রান্তের স্রোতের টানে তাঁর একক যাত্রার কথা, তাঁর গভীর দুঃখবোধ ও কান্নার কথা।

ক্রমশ মৃত্যুচিন্তা তাঁকে আচ্ছন্ন করছে। সেই মৃত্যুভাবনার মধ্যে নিহিত গভীর অভিমান। তাঁকে কেউ বোঝে না, চেনে না, সত্যি-সত্যি ভালোবাসে না, যে-ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন তা যেন নিত্যন্ত বাহ্যিক, যার মধ্যে একান্ত নিবিড় আদর নেই। তিনি পালাতে চান আদরহীন ভালোবাসার ভিড় থেকে নির্জনতায়।

একমাত্র মৃত্যুর মধ্যেই তিনি হতে পারেন পরিপূর্ণ পলাতক। ১৯৩০-এর ২৫ অক্টোবর তিনি ইন্দিরাকে লিখেছেন, ”অবশেষে আমার শেষ বক্তব্য এই যে আমার মৃত্যুর পরে দেশের লোক আমার স্মৃতি নিয়ে যেন শোকসভাসৃষ্টির বিড়ম্বনা না করে। বেঁচে থাকতে আমি যার কাছ থেকে যা কিছু পেয়েচি তার জন্যেই আমি কৃতজ্ঞ। একেবারে কিছু পাইনি একথা বলা অন্যায়। কিন্তু যারা দেবার মতো জিনিষ দিয়েছে তারা লোক ডেকে শোকসভা করবে না-যারা কিছুই করেনি, তারা সভা করবে, যারা গাল দিয়েচে তারা হাততালি দেবে-এটা কোনোমতে যাতে না হয় এই আমার একান্ত কামনা।”

রবীন্দ্রনাথ কতদূর বীতশ্রদ্ধ, অপরিতুষ্ট, ভালোবেসেও ভালোবাসা না-পাওয়ার অভিমানে উদাসীন, বীতস্পৃহ, তা বোঝা যায় চিঠিটির নির্জন অন্তে, ”আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিমগাছের তলায় বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায় হয়-শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণের সভা মর্ম্মরিত হবে মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে সেই সেই খানেই আমার নাম থাকবে।”

ভাবতে বিস্ময় জাগে সাফল্য ও খ্যাতির তুঙ্গে কী গভীর বিচ্ছিন্নতাবোধ ও উপোসি পীড়ন থেকে এমন হাড়কাঁপানো হিমেল হৃদয়কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর প্রায় এগারো বছর আগে!

তাঁর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে যৌবনের সেই ভাসমান, ভ্রাম্যমাণ দিনগুলিতে যখন একাকী খ্যাতিহীন তিনি প্রাণের তাগিদে দীর্ঘ-দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন আদরের বব-কে, বলেছেন তাঁকে মনের কথা যেমন করে আর কাউকে কখনও বলেননি, বলতে পারেননি, কুণ্ঠায় বিঘ্নিত হয়েছে আবেগ, সীমিত হয়েছে প্রকাশ।

”শীতের মধ্যাহ্ন রৌদ্রে আকাশের পেয়ালা যখন কানায় কানায় ভরে ওঠে তখন আমার এই খোলা ঘরে দুই চক্ষু দিয়ে তাই পান করি। আর কর্ত্তব্যকর্ম্ম টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বপ্নলোকে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। যখনই একটু সময় পাই মনটা ছুটে ছুটে যায় সেই আমার খ্যাতিহীন উদ্দেশ্যহীন সাবেক দিনগুলোর ঠিকানা খুঁজে বের করতে। আজ তাদের ছায়ারূপ আর ধরা যায় না।”

রবীন্দ্রের সেই সাবেক দিনগুলোর একটি বিশেষ ঠিকানা অবশ্যই ইন্দিরা। সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে ইন্দিরাকে এ-কথা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫-এ। সেই ঠিকানার কাছে আর ফিরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সেই ঠিকানার ছায়ারূপ আর ধরা যায় না।

এমনকী ইন্দিরাকে চিঠি লিখতেও রবীন্দ্রনাথের ক্লান্ত মনে হয় নিজেকে, কলম ছুঁতেই ইচ্ছে হয় না, ‘টাকা ছুঁলেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের যেরকম সর্ব্বাঙ্গে আক্ষেপ উপস্থিত হত, কলম ছুঁতে গেলেই আমার সেই রকম হয়।”

১৯২৫-এ ইন্দিরাকে এই কথা! অথচ আরও প্রায় ষোলো বছর পরে মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছতে তাঁকে পেরোতে হবে তাঁর জীবনের অবশিষ্ট একাধিক আগ্রহী এবং বেদনাময় প্রণয়সরণি। জরুরি বার্তাটি হল, ইন্দিরার কাছে ক্লান্ত হয়েও প্রণয়পথে তিনি অক্লান্ত। এবং উৎসুক। আরও ভালোবাসার জন্য তাঁর তৃষ্ণার্ত অপেক্ষা। এবং আরও বেদনাদগ্ধ আদরের উপোস নিংড়ে নিচ্ছে তাঁর তিতিক্ষাকে।

১৯২৪-এ তাঁর দেখা হয়েছে ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে, আর্জেন্টিনায় ওকাম্পোর সান ইসিদ্রোর বাড়িতে অসুস্থ, দুর্বল তিনি কাটিয়েছেন দু-মাস উষ্ণতার এষণায়, ১৯২৪-এর ১১ নভেম্বর থেকে ১৯২৫-এর ২ জানুয়ারি। যে-বিদেশিনির স্বপ্ন রবীন্দ্রমানসে নিহিত ছিল এতদিন, তা-ই যেন হঠাৎ ধরা দিয়েছে ওকাম্পোর মধ্যে- ”কোনো রহস্যসিন্ধুর পরপারে ঘাটের উপরে তাহার বাড়ি, তাহাকেই শারদপ্রাতে মাধবীরাত্রে ক্ষণে ক্ষণে দেখিতে পাই, হৃদয়ের মাঝখানেও মাঝে মাঝে আভাস পাওয়া গেছে, আকাশে কান পাতিয়া তাহার কণ্ঠস্বর কখনও বা শুনিয়াছি।”

১৯২৫-এর ইন্দিরার কাছে অবিরলভাবে ক্লান্ত রবীন্দ্র কিন্তু তখনও, চৌষট্টি বছর বয়েসেও, ক্লান্তিহীনভাবে সন্ধানী নতুন প্রণয়িণীর, নব প্রণোদনার, তাঁর অসুস্থতা এবং শারীরিক বলহীনতা সত্ত্বেও, তিনি যেন নিজেই নিজেকে লিখেছেন, ”প্রথম বয়সের বাতায়নে বসে তুমি তোমার দূরের বঁধুর উত্তরীয়ে সুগন্ধি হাওয়া পেয়েছিলে। শেষ বয়সের পথ পেরিয়ে গোধূলিরঙের রাঙা আলোতে তোমার সেই দূরের বঁধূর সন্ধানে নির্ভয়ে চলে যাও। লোকের ডাকাডাকি শুনোনা।”

কবিরা দূরদ্রষ্টা। ১৯২৪-এর অক্টোবর মাসে, ভিক্তোরিয়া ওকাম্পো তাঁর জীবনে আসার মাত্র ক’দিন আগে, এই কথাগুলি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, অকপটে প্রকাশ করেছিলেন নব প্রণয়ের জন্য তাঁর সন্ধানের কথা। প্রথম দর্শনেই ঘটবে সেই আশ্চর্য রসায়ন, ভিক্তোরিয়াই হয় উঠবেন রবীন্দ্রের অন্তরঙ্গ প্রণয়িনী ‘বিজয়া’।

যদিও রবীন্দ্রনাথ তখন শারীরিকভাবে খুবই শিথিল, ”প্রাণকে বহন করবার যোগ্য শক্তি আমার শেষ হয়ে গেছে”, লিখেছেন তিনি, তবু ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা, রবীন্দ্রনাথকে দেখামাত্র ভিক্তোরিয়া সাড়া দিলেন রবীন্দ্রের শরীরী টানের প্রতি, লিখলেন ভিক্তোরিয়া রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে, ”আমার বাবার বয়েসের কাছাকাছি তাঁর বয়েস। (রবীন্দ্রনাথ ৬৩, ভিক্তোরিয়া ৩৪) অথচ কপালে ভাঁজ পড়েনি। একটিও রেখা চোখে পড়ে না। কী শান্ত লাবণ্যময় তাঁর হিরণবর্ণ দেহ। শুভ্র কেশগুচ্ছ উপচে পড়ছে তাঁর দৃঢ় সুগঠিত গ্রীবা পর্যন্ত। তাঁর দীর্ঘ দীপ্ত মুখমণ্ডল, ঘন আঁখিপল্লব, তাঁর বাঙ্ময় দুটি হাত-এই মানুষটির সান্নিধ্যে আসায় সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল।”

রবীন্দ্রনাথের বউমা প্রতিমাদেবী ভিক্তোরিয়ার সঙ্গে তাঁর বিশ্বজয়ী প্রায়-সত্তরে-পৌঁছানো শ্বশুরের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন এই কটি অব্যর্থ শব্দ, ‘তিনি (ভিক্তোরিয়া) যখন নতজানু হয়ে বাবামশায়ের পায়ের কাছে বসতেন, মনে হত ক্রাইস্টের পুরনো কোনো ছবির পদতলে তাঁর হিব্রু ভক্ত মহিলার নিবেদন-মূর্তি।”

এমনই এক ছবির সঙ্গে আমরা পরিচিত যাতে ভিক্তোরিয়া নিজেহাতে কালির আঁচড়ের নির্মম আঘাত হেনে লোপাট করে দিয়েছেন নিজের মুখ।

কীসের অভিমানে, কোন আদিম যন্ত্রণায় এ-কাজ করেছিলেন তিনি, যাঁর ঈর্ষা হত রবীন্দ্রনাথকে স্পর্শ করে দরজি জামার মাপ নিলেও? তিনিও কি ছিলেন আদরের উপোসি, সেই উপোসের যন্ত্রণা ও অভিমান থেকে, আদিম অকৃত্রিম তাড়না থেকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবিতে তাঁর মুখ? শুধুমাত্র পেলব রোম্যান্টিক প্রেমে কি তৃপ্ত হতে পারেননি আর্জেন্টিনার কন্যা?

বিদায়ী রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯২৫-এর ৫ জানুয়ারি জাহাজ থেকে লিখছেন ওকাম্পোকে যে তাঁর দেওয়া চেয়ারে বসেই প্রথম তিনি বুঝতে পারলেন বোদলেয়র-এর কবিতা, সেই চিঠির উত্তরে ওকাম্পো জানালেন, আপনার প্রতি আমার অনুরাগ আপনি শুধু ততটুকুই বুঝতে পেরেছেন, যতটুকু একটি আরাম- কেদারা থেকে উপলব্ধি করা যায়!

এই বক্তব্যের তির্যক শ্লেষ এবং আহত অহমিকার ব্যথা অনস্বীকার্য। মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নিজেই ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর মধ্যে উসকে দিয়েছিলেন একটি সম্পূর্ণ নারী-পুরুষ-সম্পর্কের অভিলাষ: ‘‘My market price has been high and my personal value has been obscured. This value I seek to realise with an aching desire which constantly pursues me. This can be had only from a woman’s love I have been hoping for a long time and I do deserve it,’’ ভিক্তোরিয়াকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

জীবনে একাধিক নারীর কাছে প্রেম পেয়েও তৃপ্ত নন রবীন্দ্রনাথ। ক্লান্তিহীন তাঁর প্রণয়বাসনা, প্রণয়িনীসন্ধান।

তিনি ভিক্তোরিয়ার কাছে প্রণয়যাচনা করেই লিখেছেন, আমার বাজার মূল্য যদিও বেশ উঁচু, আমার ব্যক্তিগত মূল্য অস্পষ্ট, আচ্ছন্ন। এই মূল্য উপলব্ধি করার বেদনাতাড়িত বাসনা আমাকে ধাওয়া করছে সর্বক্ষণ। আমি জানি, আমার ব্যক্তিগত মূল্য আমি পেতে পারি একমাত্র নারীর প্রণয়ে। এবং আমার অনেক দিনের আশা আমি সেই প্রেমের যোগ্যতাও অর্জন করেছি।

আর্জেন্টিনার ভিক্তোরিয়ার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যখন দেখা হয়, ভিক্তোরিয়ার বয়েস তখন চৌতিরিশ, রবীন্দ্রনাথের তেষট্টি। পরস্পরের প্রবল প্রেমেও পড়েছিলেন তাঁরা।

রবীন্দ্রনাথের শরীর ভাল যাচ্ছিল না। এক দিকে কাজের চাপ, অন্য দিকে শারীরিক অবসন্নতা ও ষাটোর্ধ্ব দুর্বলতা-এই অবস্থার মধ্যে আর্জেন্টিনার ‘বন্য’ প্রেমিকার সব আদিম আশংসনের উপযোগী হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ।

নিজের বন্যতার আংশিক প্রশমন নিয়ে নিজেই কুণ্ঠাহীনভাবে লিখেছেন ভিক্তোরিয়া, ‘‘Thus I came, little by little, to know Tagore and his moods. Little by little he partly tamed the young animal, by turn wild and docile, who did not sleep, dog-like on the floor outside his door, simply because it was not done.’’

ভিক্তোরিয়ার স্বীকারোক্তিটি রবীন্দ্রনাথের প্রণয়যাচনা, তাঁর শারীরিক অবসন্নতা, তাঁর মধ্যবয়সের সঙ্কট, এবং তাঁর সঙ্গে আর্জেন্টিনার প্রেমিকার সম্পর্কের একাধিক স্ববিরোধ পরত বোঝার পক্ষে খুবই প্রয়োজনীয়।

ভিক্তোরিয়া, কখনও উদ্দাম কখনও বশ্য, ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকে বুঝে ওঠার চেষ্টা করছেন বটে সংস্কৃতি ও বয়েসের ব্যবধান পেরিয়ে, কিন্তু একই সঙ্গে এ-কথাও বুঝতে পারছেন যে তাঁর মধ্যে যে-ছটফটে জন্তুটা রয়েছে তাকে মাত্র কিছুটাই বশ করতে পেরেছেন ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ।

রাত্রিবেলা কুকুরের মতো শুয়ে থাকতে চায় ভিক্তোরিয়ার ভিতরের ওই তরুণ জন্তুটি রবীন্দ্রনাথের ঘরের বাইরে মেঝের উপর। বোঝা যাচ্ছে, ভিক্তোরিয়া-রবীন্দ্রের সম্পর্কের মধ্যে প্রথম থেকেই একটা টেনশন ছিল। ছিল শরীরী সম্পর্ক ও শরীরবিহীন আধ্যাত্মিক প্রেমের মধ্যে টানাপোড়েন। এবং রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছিলেন, তরুণীর কামবাসনাদীপ্ত প্রণয় তিনি জীবনে ধরে রাখার ক্ষমতা ক্রমশই হারাচ্ছেন।

১৯২৫-এর রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই ভুগছেন অপারগতার লুকনো যন্ত্রণায়, অবসন্নতায়, চাইছেন নিষ্ক্রান্তি মৃত্যুর মধ্যে।

১৯৩০-এ রবীন্দ্রের সঙ্গে আবার দেখা হচ্ছে ভিক্তোরিয়ার। তিনিই আয়োজন করছেন প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রদর্শনী। এ-সব ছবি রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অন্তরদহনের তাড়সে, তিনি যে-কথা লেখায় বলতে পারেননি সে-কথাই জানিয়েছেন তাঁর ছবিতে-তাঁর ছবিই তাঁর অবচৈতন্যের স্বীকারোক্তি।

এ সব ছবির প্রদর্শনী হল প্যারিসে ভিক্তোরিয়ার আয়োজনে, আর্থিক সমর্থনে। তারপর প্যারিসেরই একটি রেল স্টেশনে ভিক্তোরিয়া বিদায় জানালেন রবীন্দ্রনাথকে চিরদিনের মতো।

ক্রমশ ভিক্তোরিয়া সরে গেলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন থেকে। জানিয়ে গেলেন এই বিচ্ছেদের মূল কারণ। রবীন্দ্রনাথ মূল্য দেননি তাঁর সান্নিধ্যের, উত্তাপের, ‘‘I have gone through such joy and such sufferings all these days. Joy because I felt near you; sufferings because you ignored my nearness,’’ রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন ভিক্তোরিয়া।

”ইউ ইগনোর্ড মাই নিয়ারনেস, আপনি আমার সান্নিধ্যকে প্রত্যাখান করেছিলেন,” রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভিক্তোরিয়ার মধ্যে রবীন্দ্রনাথই জাগিয়ে ছিলেন তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে কাছে পাওয়ার বাসনা, রবীন্দ্রের আদর-উপবাস স্পর্শ করেছিল ভিক্তোরিয়ার হৃদয়, জাগিয়েছিল ইন্দ্রিয়ঘন আশ্লেষের কামনা।

ভিক্তোরিয়া অনেক বছর পরেও ভুলতে পারেননি যে রবীন্দ্রনাথ মাত্র একবারই প্রায় ‘বিদেহী’ আদরে স্পর্শ করেছিলেন তাঁর স্তন। এবং সেই বিহ্বল আচ্ছন্ন মনকেমনের কথা তিনি লিখে গেছেন তাঁর স্মৃতিচারণে।

ভিক্তোরিয়ার সেই স্মৃতিলিখনের ফরাসি সংস্করণ থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসোমিং ফ্লাওয়ার-গার্ডেন’ (১৯৮৮) গ্রন্থে ‘‘Sometimes when I saw him writing, writing, writing in his mysterious Bengali script, I would beg him to translate a portion of the poem for me. One afternoon, as I came into his room to arrange some flowers in a vase, he told me that he was translating. I leaned towards the page which was on the table. Withour lifting his head towards me he stretched his arm, and in the same way as one gets hold of a fruit on a branch he placed his hand on one of my breasts. I think I felt a kind to shudder of withdrawal (‘frimissement de recul’), like a horse whom his master strokes when he is not expecting it. The animal cried at once within me : ‘‘No! not that’’. Another person who lives inside me warned the animal : ‘Be clam, fool. It’a gesture of pagan tenderness (crossed out : and not of senile lewdness)’. The hand left the branch after that almost imcorporeal caress (‘presque immaterielle caresse’), and I read the poem. I think he would have had the same gesture for a statue. But he never did it again. Everyday he kissed me on the forehead or the cheek and took one of my arms : ‘Such cool arms!’’

রহস্যময় বাংলা হস্তাক্ষরে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, লিখছেন, লিখছেন।

আমাকে অনুবাদ করে শোনাবেন একদিন? রবীন্দ্রনাথকে ভিক্তোরিয়ার অনুরোধ। তারপর একদিন ফুলদানিতে কিছু ফুল সাজাতে রবীন্দ্রনাথের ঘরে গেলেন ভিক্তোরিয়া।

আমি অনুবাদ করছি, বললেন রবীন্দ্রনাথ। ভিক্তোরিয়া টেবিলে রাখা কাগজটির উপর ঝুঁকে দেখতে গেলেন, কী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মাথা না তুলে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং গাছে ফলের উপর হাত রাখার ভঙ্গিতে ভিক্তোরিয়ার একটি স্তনের উপর হাত রাখলেন তিনি।

শিউরে উঠলেন ভিক্তোরিয়া, সরে যেতে চাইলেন, যেভাবে একটি ঘোড়া শিউরে উঠে সরে যায় তার মনিবের অসময়ের অপ্রত্যাশিত আদর থেকে।

ভিক্তোরিয়ার মধ্যে জন্তুটা বলে উঠল, ”না, ওটা নয়”! কিন্তু তাঁর মধ্যে আর একটি সত্তা ওই জন্তুটাকে বলে উঠল, ”কী বোকা তুমি! বুঝছ না কেন, এই নরম আদর আসলে বিধর্মী পৌত্তলিকের স্বাভাবিক সঙ্কেত মাত্র, ভীমরতিগ্রস্ত বৃদ্ধের কামুকতা নয়।

একটু পরেই রবীন্দ্রের হাত সরে গেল ভিক্তোরিয়ার স্তন থেকে, রেখে গেল ‘আধ্যাত্মিক’ স্পর্শের রেশ।

এর পরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন না ভিক্তোরিয়া। থাকলেন রবীন্দ্রনাথের পাশেই। পড়লেন কবিতাটি।

এই ঘটনার তিরিশ বছর পরে লিখলেন, রবীন্দ্রনাথ আর কখনও আমার স্তন স্পর্শ করেননি, কিন্তু তিনি রোজ আমায় চুমু খেতেন, কখনও কপালে, কখনও গালে, আর আমার বাহু ধরে বলতেন, ”কী শীতল!”

ভুলে গেলে চলবে না চৌতিরিশ বছরের বিয়েভাঙা ওলট-পালট হয়ে যাওয়া ভিক্তোরিয়া চাইছিলেন আশ্রয়। যে-আশ্রয় তাঁর প্রেমিক জুলিয়ান মার্তিনেজ তাঁকে দিতে পারতেন না। যে-আশ্রয় দিতে পারতেন তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ।

এ-কথাও মনে রাখা জরুরি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্তোরিয়ার দেখা যখন হল, ভিক্তোরিয়া পৌঁছেছেন সেই বয়েসে যে-বয়েসে নারীর যৌনকামনা স্বভাবিকভাবেই তুঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের বয়েস তেষট্টি এবং শারীরিকভাবে তিনি ক্রমশ ঢলছেন অবসানের দিকে। এই মিলন সেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে, যে-নারী মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত, পুরুষের শরীরী আশ্লেষের প্রতি প্রাথমিকভাবে সংশয়ী, কুণ্ঠিত, যে চায় মনের আদর এবং যে-পুরুষ দিতে পারে মনের আদর। চৌতিরিশ বছরের ভিক্তোরিয়া, তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এমন নারী-পুরুষ।

এখানে আরও এক উল্লেখ্য বিষয় হল, ভিক্তোরিয়া একটা বয়েস পর্যন্ত বয়স্ক পুরুষদেরই বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর সম্পর্কের মামা-কাকাদের প্রতিই তাঁর বিশেষ টান ছিল, যাঁদের পৌরুষের তুলনায় সমবয়সিদের নেহাত জোলো লাগত তাঁর। আবার যত বয়েস বেড়েছে তাঁর ততই তিনি প্রবণ হয়ে উঠেছিলেন কমবয়সি পুরুষের প্রতি।

১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানালেন ভিক্তোরিয়া। আর ১৯৩১-এ রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তর বছর বয়েসে পেলেন আর এক প্রিয় নারীকে, যাঁর নাম হেমন্তবালা।

কিন্তু রবীন্দ্রজীবনে দুই নারী, কাদম্বরী এবং ইন্দিরা, একজন বউদি, অন্যজন ভাইঝি,-এঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কই এ-বইয়ের প্রধান বিষয়।

সুতরাং ভিক্তোরিয়া বা রবীন্দ্রজীবনে অন্য নারীর প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি এখানেই, শুধু এইটুকু বলে যে, ১৯২৫-এর রবীন্দ্রক্লান্তি ও মৃত্যুবাসনা সম্পৃক্ত তাঁর জীবনে আরও এক প্রেম ও বিচ্ছেদের সঙ্গে। রানু নামের এক পঞ্চদশীর সঙ্গে বিচ্ছেদের ফলে প্রবল কষ্ট পেয়েছিলেন ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথ, নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব ভেবেছিলেন, ভেবেছিলেন বেঁচে থাকার আলোটাই নিভে গেল, যতদিন না তাঁর জাহাজ ভিড়ল আর্জেন্টিনার নব প্রণয়সৈকতে।

আমরা ফিরে এলাম রবীন্দ্রজীবনের সেই সময়টায় যখন দিনরাত ছবি আঁকছেন রবীন্দ্রনাথ, ছবি যেন তাঁর নতুন প্রণয়, ক্লান্তিহীন এই প্রেমের তাড়না, তাঁর ছবির প্রদর্শনী হবে দু-বছর পরে প্যারিসে, এবং সেই প্রদর্শনীর আয়োজনে থাকবেন ভিক্তোরিয়া,-এই উত্তেজনার কিছুই কিন্তু পৌঁছয় না ইন্দিরাকে লেখা তাঁর চিঠিতে, ইন্দিরাকে চিঠি লিখতে বসলেই তিন বলেন মানসিক অবসাদের কথা, শারীরিক অবসন্নতার কথা, ব্যাধি ও আসন্ন মৃত্যুর কথা।

অথচ এই ইন্দিরাকেই তিনি একদিন পদ্মার জলে ভাসতে-ভাসতে কত বর্ণময় চিঠি লিখেছেন। ১৯২৮-এর ৯ জুলাই, তাঁর অবসানের তেরো বছর আগে, ব্যাধি ও বার্ধক্যের কথা লিখতে-লিখতে ইন্দিরার কাছে কী গভীরভাবে বিষাদময় রবীন্দ্রনাথ, ”প্রতিদিনই বয়েস এক একদিন বেড়ে চলেচে সেটাকে ঠেকাবার কোনো উপায় দেখতে পাইনে। বস্তুত জরাটাই হোলো ব্যাধি-সে ব্যাধির অবসান সমস্তর অবসানে-সেটার বিরুদ্ধে যত আয়োজন করি-ওষুধ খাই ডাক্তার ডাকি, তাতে কেবল যমকে হাসানো হয়।”

যমকে কিন্তু অন্যভাবে হাসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমস্ত বিষাদ ও মৃত্যুভাবনা সত্ত্বেও তিনি তোড়ে লিখছেন, ছবি আঁকছেন এবং নতুন প্রণয়েও অবিরল তাঁর উৎসাহ, আগ্রহ, অভীপ্সা। এ-সব যমের হাসির যোগ্য খোরাকই বটে!

শেষ থামার আগে থামতে শেখেননি রবীন্দ্রনাথ। তিনি লেখায়-আঁকায়-প্রণয়ে-সৃষ্টিতে সমান বিরামহীন। তবু ১৯২৮-এর রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে লিখেছিলেন, ”সেমিকোলনের উচিত হয় না দাঁড়িকে স্মরণ করে আঁৎকে ওঠা।”

কেন তিনি বারবার ভেবেছেন থেমে যাওয়ার কথা? কেন মৃত্যু সর্বক্ষণ তাঁর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে? মনে হয় আজীবন রবীন্দ্রবিষাদ ও মৃত্যুভাবনার একটা বড় কারণ কবি হিসেবে তাঁর অবসানের আতঙ্ক নয়; বড় কারণটা হল, বারবার ব্যর্থ প্রণয়, বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, রুদ্ধ বাসনা, আদরের উপোস।

যত বয়েস বেড়েছে রবীন্দ্রনাথের, যতই হ্রাস পেয়েছে তাঁর দেহের পারগতা, ততই প্রণয়িনীর সঙ্গে বেড়েছে তাঁর বয়েসের বিভেদ। অসম-সম্পর্কের প্রতি রবীন্দ্রের এই প্রবণতা তাঁর প্রণয়জীবনে বিশেষ যন্ত্রণার কারণ।

কমবয়সি প্রেমকে তিনি অনায়াসে অর্জন করেছেন। কিন্তু তা ধরে রাখার অসম্ভবকে তিনিও সম্ভব করতে পারেননি। কষ্ট পেয়েছেন জয় করেও হারানোর, বিচ্ছেদের।

এখানে স্ত্রী-পুরুষের যৌন-জাগৃতির পার্থক্য ও অসম বয়েসের প্রণয় নিয়ে কিছু আধুনিক বার্তা প্রাসঙ্গিক। অনেকেই জানেন, পুরুষের যৌন ক্ষমতা ও উৎসাহ তুঙ্গে পৌঁছয় ১৭-১৮ বছর বয়সে। নারীর যৌন ক্ষমতা তুঙ্গে পৌঁছয় অনেক দেরিতে, ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়েসের মধ্যে। বেশি বয়েসের পুরুষ কমবয়সি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হলে তা এক অর্থে সঠিক। পুরুষ বেশি বয়েসের প্রশমিত পারগতা নিয়ে সেই নারীর কাছেই নিশ্চয়তা পায়, যার উদ্দীপন তখনও প্রবল নয়। তবে এই অলস প্রেম পুরুষটিকে পাঠাতে পারে উপবাসী নির্বাসনেও এবং এক সময়ে আদরের উপবাস ও একাকিত্বের কষ্ট থেকে আত্মহত্যার কথাও ভাবতে পারে সেই পুরুষ। যেমন ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

সেই প্রসঙ্গ ধরেই শেষ হবে এই বই। আপাতত আমরা ফিরে যাচ্ছি যৌবনের রবীন্দ্রনাথের কাছে। বিবাহে ক্লান্ত তিনি। প্রাত্যহিক সংসার থেকে পলাতক। ভেসে বেড়াচ্ছেন পদ্মার বুকে। আর জলি বোটের ভাসমান আশ্রয় থেকে চিঠি লিখেছেন তরুণী ইন্দিরাকে, যে-চিঠিতে বিশ্রাম নেই রোম্যান্টিকতার।

সেই অফুরান রোমান্সের একটি প্রমাণ, কিঞ্চিৎ বাখ্যার সঙ্গে, এখানে দাখিল করা যেতে পারে। ১৮৯২-এর ২১ জুলাই শিলাইদহ থেকে পাবনার পথে ভাসতে-ভাসতে ইন্দিরাকে রবীন্দ্রনাথ, ”আজকাল নদীর সে মূর্তি নেই-তোরা যখন এসেছিলি তখন নদীতে প্রায় একতলা-সমান উঁচু পাড় দেখেছিলি, এখন সে সমস্ত ভরে গিয়ে হাতখানেক দেড়েক বাকি আছে মাত্র। নদীর যে রোখ! যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো ঘাড়- বাঁকানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো। গতিগর্বে ঢেউ তুলে ফুলে ফুলে চলেছে-এই ক্ষ্যাপা নদীর উপরে চড়ে আমরা দুলতে-দুলতে চলেছি। এর মধ্যে ভারী একটা উল্লাস আছে। …ভারী একটা যৌবনের মত্ততার ভাব। এ তবু গড়ুই নদী। এখান থেকে আবার পদ্মায় গিয়ে পড়তে হবে-তার বোধহয় আর কূলকিনারা দেখবার যো নেই। সে মেয়ে বোধহয় একেবারে উন্মাদ ক্ষেপে নেচে বেরিয়ে চলেছে, সে আর কিছুর মধ্যে থাকতে চায় না।”

নদীর এমন একটি বর্ণনা দিলেন রবীন্দ্রনাথ যা তরুণী ইন্দিরার কাছে সহজেই পৌঁছে দিল এক নারীর মদমত্ত যৌবনের ভাবটিকে, যে-যৌবন বন্ধনহীন, পুরুষের রোম্যান্টিক কল্পনা নারীর মধ্যে যে-উন্মাদনার প্রার্থী।

এ-নদী যেন সংসারের সব বাধা, শিকল থেকে মুক্ত নারী, ”নৃত্য করছে, ভাসছে, এবং চুল এলিয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে।… দুই ধারের তীর একেবারে অবহেলায় ছারখার করে দিয়ে চলেচে।”

সেই যুগে এই নতুন মুক্ত বাঁধভাঙা নারী রবীন্দ্রনাথের অবচেতন মনের স্বপ্ন। এই মেয়ের রূপকল্পনার সঙ্গে মিশে আছে তাঁর তমসাচ্ছন্ন কামনাবাসনার তাগিদ, উসকানি এবং ইন্দিরাকে এই মেয়েটির কথা না জানিয়ে পারছেন না তিনি।

আর কোনও তরুণী নেই তাঁর চেনা পৃথিবীতে যার কাছে এমন অব্যর্থ ইশারায় বলতে পারেন তাঁর স্বপ্নের মেয়েটির কথা। ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় বিদুষী ইন্দিরার বুঝতে অসুবিধে হবে না ঠিক কী বলতে চাইছেন তিনি, কেমন নারী হতে পারে তাঁর প্রণয়ের যোগ্য এবং তাঁর প্রেরণা- এমন একটি দ্বিধাহীন ধারণা কাজ করছে রবীন্দ্রনাথের মনে।

পরক্ষণেই তিনি মৃত্যুর কথাও বলেছেন, কিন্তু এই মৃত্যুভাবনার সঙ্গে তাঁর ১৯২৫ বা ২৮-এর মৃত্যুভাবনার অনেক তফাত। এ-চিঠিতে মৃত্যুর যে রোম্যান্টিক মূর্তিটি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, সেভাবে মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করার কথাটি জানিয়েছেন ইন্দিরাকে, তার মধ্যে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন তাঁর বেপরোয়া পৌরুষকেই ফুটিয়ে তুলতে, পত্রের তরুণী প্রাপিকার কাছে।

”কাল যমরাজের সঙ্গে এক রকম হাউ-ড্যু-ডু করে আসা গিয়েছে। মৃত্যু যে ঠিক আমাদের নেকসটডোর নেবার এ রকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না। হয়েও বড়ো মনে পড়ে না। কাল চকিতের মধ্যে যাঁর আভাস পাওয়া গিয়েছিল আজ তাঁর মূর্তিখানা কিছুই স্মরণ হচ্ছে না। অপ্রিয় অনাবশ্যক বন্ধুর মতো একেবারে অনাহূত ঘাড়ে না এসে পড়লে তাঁর বিষয়ে আমরা বড়ো একটা ভাবি নে। যদিও তিনি আড়াল থেকে আমাদের সর্বদাই খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। যা হোক, তাঁকে আমি বহুত বহুত সেলাম দিয়ে জানিয়ে রাখছি তাঁকে আমি এক কানাকড়ির কেয়ার করিনে, তা তিনি জলে ঢেউই তুলুন আর আকাশ থেকে ফুঁই দিন-আমি আমার পাল তুলে চললুম-তিনি যতদূর করতে পারেন তা পৃথিবীসুদ্ধ সকলেরই জানা আছে, তার বেশি আর কী করবেন! যেমনি হোক, হাঁউমাউ করব না।”

মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না, মৃত্যুর মুখোমুখি তিনি বিবিক্ত, এবং বিপদের মধ্যে পাল তুলে দিতে তিনি দ্বিধাহীন,-এক তরুণীর কাছে অব্যর্থভাবে তাঁর রোম্যান্টিক বেপরোয়াভাবকে পৌঁছে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। নারীর মধ্যে যে উন্মত্ততাকে বাসনা করেন তিনি, সেই চাওয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন তাঁর নিজের ভয়হীন দুরন্তপনাকেও।

আমাদের মনে পড়ে যায় আরও অনেক বছর আগে কিশোর রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর ভালোবাসার মেয়েটির সামনে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তিনি, সাঁতরে চলে যাচ্ছেন ওপারে, আর তাঁর ফিরে আসার জন্য উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছেন সেই মেয়ে, কাদম্বরী যাঁর নাম, যাঁর আর কোনও ‘বন্ধু’ নেই এ-জগতে।

কাদম্বরীর আত্মহত্যার পরে রবীন্দ্রনাথ হয়তো চেষ্টা করেছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ পুরুষের মতোই স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গে সংসার করতে। কিন্তু তা কি হয়! তিনি তো রবীন্দ্রনাথ। কাদম্বরীর পরে তাঁর মনের চাহিদা মেটাবার ক্ষমতা কোথায় পাবেন মৃণালিনী?

যে-মেয়ে ক্রমশ কাদম্বরীর জায়গাটি নিয়েছিলেন তিনিও আত্মীয়া, কাদম্বরীর তুলনায় অনেক বেশি বিদ্যাবতী, সুন্দরী, আধুনিকা। যাঁকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে চিঠি লিখে, ”কী জানি পরান কি যে চায়, বলতে লজ্জা বোধ হয় এবং শহরে থাকলে বলতুম না-কিন্তু ওটা ষোলো-আনা কবিত্ব হলেও এখানে বলতে দোষ নেই।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব রকম ‘দোষ’-এর ঊর্ধ্বে, তিনি ধরণীর অন্যান্য কবিদের মতো কোনওভাবে, কোনও দিক থেকেই, ‘পাপবিদ্ধ’ নন-এ-কথা বাঙালির মজ্জা মেনে নিয়েছে। কোথাও কোনও প্রশ্ন নেই, নেই সংশয়ের ঠোক্কর, চোরা খটকা। পরদা ফেলে দিয়েছি অন্বেষার উপর। সেই পরদার গায়ে, শ্রদ্ধার সঙ্গে থুড়ি বলে, ঈষৎ কাঁপন জাগাতে পরে একটি প্রশ্ন।

প্রশ্নটি রবীন্দ্রনাথের তিন কন্যা মাধুরীলতা (বেলা, ২৫.১০.১৮৮৬-১৬.৫.১৯১৮) রেণুকা (রানী, ২৩.১.১৮৯১- ১৪.৯.১৯০৩) এবং মীরার (১২.১.১৮৯৪-১৯৬৯) বাল্য বিয়ে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ মাধুরীলতার বিয়ে দেন ১৯০১-এর ১৫ জুন। মাধুরীর বয়েস তখন পনেরো। ওই বছরেই ৯ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ জোর করে বিয়ে দিলেন তাঁর দ্বিতীয় কন্যা (তৃতীয় সন্তান) রেণুকার (রানী)। রেণুকার বয়েস তখন দশ। আর এক কন্যা মীরার বিয়ে দিলেন ১৯০৮ সালে, মীরার চোদ্দো বছর বয়েসে। ইন্দিরার বিয়ে হয় ১৮৯৯-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি, বয়েস ছাব্বিশ। ১৯০৮-এ কন্যা মীরার যে বয়েসে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, সেই বয়েসের ভাইঝি ইন্দিরাকে চিঠি লিখে ভাসিয়ে দিচ্ছেন তিনি!

ছাব্বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অবিবাহিত ইন্দিরা! পাঁচ বছর বয়েসে মায়ের সঙ্গে বিলেত যাচ্ছেন। সেটা ১৮৭৮-এর কথা। দু-বছর পরে ফিরে এসে, বিলেতে ইংরেজি ও ফরাসি শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ের পরে, ভরতি হচ্ছেন সিমলার অকল্যান্ড হাউসে। পরের বছর চলে আসছেন কলকাতায়, লোরেটো কনভেন্ট-এর ছাত্রী হয়ে। ১৮৮৭-তে চোদ্দো বছর বয়েসে পাশ করছেন এন্ট্রান্স পরীক্ষায়, ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য তাঁর বিশেষ বিষয়।

এই বছরেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক, রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিং থেকে চিঠি লিখছেন তাঁকে, চিঠির তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭। ১৮৯২-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হচ্ছেন ইন্দিরা, মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে পাচ্ছেন ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’, এবং প্রথম হচ্ছেন সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে।

ইন্দিরার বয়েস তখন উনিশ। রীবন্দ্রনাথ তাঁকে লিখছেন, ”যখন বিলেত যাচ্ছিলুম আমার একটা কল্পনার সুখের ছবি এই ছিল যে, তোরা কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছিস, খোলা দরজা-জানলার ভিতর দিয়ে আলো এবং বাতাস আসছে এবং খানিকটা সুদূর আকাশ ও গাছপালা দেখা যাচ্ছে-আমি একটা খোলা জানলার কাছে কৌচের উপর পড়ে বাইরে চোখ রেখে শুনছি।…মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, …এবারে কলকাতায় গিয়ে কত কী যে করব তা ঠিক নেই-কাজ করব, গান করব, হাসব, গল্প করব, ভালোবাসব…।”

ওই একই চিঠিতে তাঁর উপোসের ইঙ্গিত দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, ”বড়ো বড়ো দুরাশার মোহে জীবনের ছোটো ছোটো আনন্দগুলিকে উপেক্ষা করে আমাদের জীবনকে কী উপবাসী করেই রাখি!”

এই চিঠির ফুটনোট হিসেবে একটি তথ্যের উল্লেখ এখানে বিশেষ প্রয়োজন। তথ্যটি হল, খুব ভালো পিয়ানো বাজাতেন ইন্দিরা। আগেই বলেছি, শিখেছিলেন সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের অর্গানশিল্পী স্লেটার সাহেবের কাছে। রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ মুগ্ধ করেছিল ইন্দিরার পিয়ানো। ইন্দিরা লিখেছেন, ”তখনকার কালে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে গানের ঔপপত্তিক প্রশ্ন এ দেশে পাঠানো হত। তার ইন্টারমিডিয়েড পর্ব পর্য্যন্ত আমি পাশ করেছিলুম। পরবর্তী জীবনে আমি রবিকাকার অনেক বিলিতি গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজিয়েছি, সেসব এখনো সেদিনের মূক সাক্ষী-স্বরূপ আমার গানের বাঁধানো বইয়ে পড়ে আছে”…(সংগীতস্মৃতি)।

রবীন্দ্রনাথ কখনও গাইছেন ‘Then you’ll remember me’, তাঁর কণ্ঠস্বর প্রেমমগ্ন, ইন্দিরা বাজাচ্ছেন পিয়ানো। রবীন্দ্রকণ্ঠের ‘Good night, good night beloved’-এর সঙ্গে পিয়ানো বাজানোর মধুর স্মৃতি থেকে কোনওদিন বেরতে পারেননি ইন্দিরা। বেন জনসন-এর বিখ্যাত রোম্যান্টিক গান ‘Drink to me only with thine eyes’ গাইছেন রবীন্দ্রনাথ, পিয়ানো বাজাচ্ছেন ইন্দিরা, কোথাও যেন এ-গানের সুর, কথা গভীরভাবে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে যাচ্ছে তাঁদের মানসসম্পর্কের রূপরেখা-ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে এমন মুহূর্ত সোনার ফ্রেমে বাঁধানো।

”আর একটি গান, রোমান ক্যাথলিকদের বিখ্যাত স্তব ‘আভে মারিয়া’ রবিকাকা পিয়ানো ও বেহালার যুগল সংগতে গাইতেন, সেটি আমার বড়ো ভালো লাগতো,” লিখেছেন ইন্দিরা। রবিকণ্ঠে আরও একটি গানের কথা লিখেছেন ইন্দিরা, ”Darling, your are growing old’’ প্রভৃতি ইংরিজি গানের সুরও মজা করে টেনে টেনে গাইতেন।”

ইন্দিরাকে আরও কটি গান শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ, নিধুবাবুর টপ্পা, ‘যে যাতনা যতনে’, কিংবা রাম বসুর ‘মনে রইল সই মনের বেদনা’, কিংবা শ্রীধর কথকের, ‘ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে’।

রবীন্দ্রের আরও একটি গান ইন্দিরার বিশেষ প্রিয়, ভুলতে পারেননি তিনি রবীন্দ্রকণ্ঠে বেহাগে আশ্রিত এই গানের কথা-‘আমি কারেও বুঝিনে শুধু বুঝেছি তোমারে।’

শুধু কি রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে পিয়ানো বাজাতেন তিনি? রবীন্দ্রনাথের দুশো গানের স্বরলিপিও যে করেছিলেন। তা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর হিন্দুস্থানি গানের প্রভাব নিয়ে তাঁর গবেষণাও তাৎপর্যে দূরপ্রসারী। তাঁরই কণ্ঠে হিন্দুস্থানি ও দক্ষিণী গানের প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন তাঁর অনেক গানের সুর।

যে তরুণী সেই সময়ে এমন বিদুষী, এবং ছাব্বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত অবিবাহিত, রবীন্দ্রনাথই কি তাঁর একমাত্র মুগ্ধ পুরুষ? তা কি হতে পারে?

ইন্দিরার কাছ থেকেই জানা যাক পুরুষমহলে তাঁর বিশেষ টানের কথা, ”ঐতিহাসিক সত্যরক্ষার্থে স্বীকার করতেই হবে যে, আমার পাণিগ্রহণের আগে পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। প্রতিভাদিদির বিয়ে হবার পর থেকে তাঁর দেবরবৃন্দের সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল আগেই বলেছি। তাঁরা প্রায় আমাদের বাড়িতে আসতেন, এবং খেলাধুলা, আমোদপ্রমোদ, লেখাপড়া গল্পগুজব সবেতেই যোগ দিতেন। আমরাও মাঝে মাঝে তাঁদের বাড়ি যেতুম। দুই পরিবারের যুবসঙ্ঘের এরকম অন্তরঙ্গ মেলামেশার যা স্বাভাবিক ফল তার ব্যতিক্রম এ-ক্ষেত্রেও হয়নি বলা বাহুল্য। তবে সব ক্ষেত্রে তা বিবাহে পরিণত হয়নি। সবচেয়ে ‘রোমাঞ্চকর’ পূর্বপাত্র ছিলেন একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তি। যিনি অনেকদিন ধরে আমাদের ফটকের ওপারে মাঠের এক গাছতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন।”

তৎকালের প্রেক্ষিতে একটি মেয়ের এই মুক্ত জীবন ও স্বীকারোক্তি বৈপ্লবিক। রবীন্দ্রনাথ প্রথম যৌবনে যে চার কন্যার প্রণোদনা মিশিয়ে ছিলেন তাঁর সঙ্গীতরচনার সঙ্গে তাঁরা তাঁর ভাইঝি কিংবা ভাগনি, প্রতিভা, সরলা, ইন্দিরা, অভিজ্ঞা। প্রতিভা ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ সন্তান, রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র পাঁচ বছরের ছোটো। প্রতিভার দেওরদের সঙ্গে ইন্দিরা তাঁর ‘যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা’র কথা যেভাবে লিখেছেন, তা থেকে বোঝা যায় পুরুষের সঙ্গে মুক্ত মেলামেশায় তাঁর কোনো কুণ্ঠা ছিল না।

সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীর পৃথক পারিবারিক পরিবেশ ইন্দিরাকে পুরুষ-সংসর্গের সুযোগও দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছেও তখনকার দিনে এমন মেয়ের স্বাদ ছিল এক্বেবারে নতুন। এহেন ইন্দিরার যদি তাঁর দুই কন্যার মতো চোদ্দো বা পনেরো বছর বয়েসে বিয়ে হয়ে যেত? খুশি হতেন রবীন্দ্রনাথ?

ভাগ্যিস ইন্দিরা ছাব্বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত ছিলেন অবিবাহিতা এবং মনেপ্রাণে যাপিতজীবনে মুক্ত! এবং ভাগ্যিস ইন্দিরার জীবনে ছিল আরও অনেক মুগ্ধ পুরুষের সমাগম! সেই ভিড়ের মধ্যে ব্যতিক্রম হতে কি ভালোলাগেনি রবীন্দ্রনাথের, যতদিন না ইন্দিরার আকাশে উদয় হয়েছে উজ্জ্বল নক্ষত্র প্রমথ চৌধুরীর? ইন্দিরার মুগ্ধ পুরুষবৃত্তের দু-একজনকে নিয়ে কি অতীব শীলিত মজাও করেননি রবীন্দ্রনাথ কখনও-কখনও?

যেমন সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিটি, যিনি গাছতলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন যদি ইন্দিরাকে একবার দেখা যায় জানলায়, সেই দূরাশায়, রবীন্দ্রনাথ তো তাঁকে নিয়ে একটি গানই লিখে ফেললেন একদিন, ”সখী, সে আসি ধূলায় বসে যে তরুর তলে/সেথা আসন বিছায়ে রাখিস বকুলদলে।/সে যে করুণা জানায় সকরুণ নয়নে,-/যেন কী বলিতে চায়, না বলিয়া যায় সে।।”

ইন্দিরার সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর বিয়েটাও হয়েছিল উপন্যাসের ঘুরপথে। রবীন্দ্রমোহজাল থেকে বেরতেই সম্ভবত ইন্দিরা প্রথমে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যান প্রমথ চৌধুরীর মেজদাদা যোগেশ চৌধুরীকে। যোগেশ ইন্দিরাকে বিয়ে করতে অতীব আগ্রহী ছিলেন। ইন্দিরা তাঁকে বিয়ে করছিলেন দায়ে পড়েই।

ও দিকে রবীন্দ্রনাথের ন দিদি (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নবম সন্তান) স্বর্ণকুমারীর তৃতীয় সন্তান সরলার প্রেমে পড়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী। সরলার ব্যবহারে তাঁর নিশ্চয় মনে হয়েছিল, মেয়েটিও তাঁর প্রতি দুর্বল। একদিন সরলাকে সরাসরি জানালেন, তাঁকে বিয়ে করতে চান। সরলা প্রমথকে টুক করে পাস করে দিলেন ইন্দিরার কাছে। প্রমথ চৌধুরী নিজেই জানিয়েছেন সে-কথা, ”সরলা দেবী চৌধুরানী একদিন আমাকে বলেন যে, আপনি ইন্দিরা দেবীকে বিবাহের প্রস্তাব করলে তিনি রাজি হবেন। আমি সেই কথা শুনে বিবাহের প্রস্তাব করি।”

ইন্দিরা সরলার থেকে ঠিক এক বছরের ছোটো। এবং ইন্দিরা যোগেশ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে ভেঙে প্রমথর প্রস্তাবে রাজি হওয়ার পর তাঁরা একটি প্রেমপর্বও সেরে নেন। সরলা কী করে জানলেন ইন্দিরা রাজি হবেন প্রমথকে বিয়ে করতে?

এ-প্রশ্নের একটি অব্যর্থ উত্তর এইভাবে পাওয়া যেতে পারে। ইন্দিরার বিয়ের চার বছর আগে, ১৮৯৫-এর ১৬ ডিসেম্বর ইন্দিরাকে এই পর্বের (১৮৮৭-র সেপ্টেম্বর -১৮৯৫-এর ডিসেম্বর) ২৫২তম, অর্থাৎ শেষ চিঠিখানি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। এই চিঠিতেই রবীন্দ্রনাথ বাজালেন বিদায়ের সুর, ”এমন সময়ে হঠাৎ দূরের এক অদৃশ্য নৌকো থেকে বেহালা যন্ত্রে প্রথমে পূরবী ও পরে ইমণকল্যাণে আলাপ”-এর বর্ণনা করলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সঙ্গে নতুনের আগমন-বার্তাও জানিয়েছেন, ”বোটে ফিরে এসে অনেক দিন পরে আবার একবার হার্মোনিয়ামটা নিয়ে বসলুম। একে-একে নতুন-তৈরি- করা অনেকগুলো গান নিচু স্বরে আস্তে-আস্তে গেয়ে গেলুম-”।

রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে আর তেমন যেন তাপ ছিল না। ইন্দিরার প্রতি ক্রমেই যেন তিনি জুড়িয়ে যাচ্ছিলেন। সবে পূর্ণ হয়েছে কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার দশ বছর। প্রিয় বউঠানের তেতলার ঘর এখন রবীন্দ্রনাথেরই অধিকারে। সেই স্মৃতিবিজড়িত নিঃসঙ্গ বেদনার মধ্যে বারবার ফিরে যেতে চায় তাঁর মন:

 তোমাকে আজিকে ভুলিয়াছে সবে,

 শুধাইলে কেহ কথা নাহি কবে,

 এ হেন নিশীথে আসিয়াছ তবে

 কী মনে করে।

পাণ্ডুলিপিতে ‘দুঃসময়’ কবিতাটির উপরে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘‘Late, late, too late, thou canst not enter now!’’ ”বিলম্বে এসেছ, রুদ্ধ এবে দ্বার।” আরও একটি কবিতায় প্রিয় বউদির মৃত্যু প্রসঙ্গে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ:

 তুলিয়া অঞ্চলখানি

 মুখ ‘পরে দাও টানি,

 ঢেকে দাও দেহ।

 করুণ মরণ যথা

 ঢাকিয়াছে সব ব্যথা,

 সকল সন্দেহ।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, মৃত কাদম্বরীর দেহটি। তাঁর মুখ পর্যন্ত ঢাকা। মৃত্যুর এই ঢাকনা শুধু জীবনের উপরেই নয়, ঢেকে দিল সব সন্দেহও। কীসের সন্দেহ?

রবীন্দ্র-কাদম্বরীর সম্পর্ক নিয়েই কি সকল সন্দেহ শেষ হল, কাদম্বরীর আত্মহত্যায়? ১৮৯৪-এর ৩০ মার্চ ইন্দিরাকে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, ”এই জন্যে জীবনে একটা প্যারাডক্স প্রায়ই দেখা যায় যে, বড়ো দুঃখের চেয়ে ছোটো দুঃখ যেন বেশি দুঃখকর। তার কারণ, বড়ো দুঃখে হৃদয়ের যেখানটা বিদীর্ণ হয়ে যায় সেইখান থেকেই একটা সান্ত্বনার উৎস উঠতে থাকে, মনের সমস্ত দলবল সমস্ত ধৈর্য এক হয়ে আপনার কাজ করতে থাকে-তখন দুঃখের মাহাত্ম্যের দ্বারাই তার সহ্য করবার বল বেড়ে যায়।…ছোটো দুঃখের কাছে আমরা কাপুরুষ, কিন্তু বড়ো দুঃখ আমাদের বীর করে তোলে, আমাদের যথার্থ মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে দেয়। তার ভিতরে একটা সুখ আছে-নিজেকে পূরাপূরি পাই বলেই সেই সুখ।”

ক্রমশই ইন্দিরা বুঝতে পারছিলেন এ-এক নতুন রবীন্দ্রনাথ, যাঁর নাগাল পাওয়া তাঁর পক্ষে ক্রমেই আর সম্ভব হবে না। রবীন্দ্রনাথ যেন ইচ্ছে করেই সরে গেলেন, বা সরে যেতে চাইলেন, তাঁর জীবনের এক বৃহৎ দুঃখজনিত সুখের মধ্যে মেনে নিলেন নির্বাসন, হয়তো এই কথা ভেবেই যে ইন্দিরার যা বয়েস সেই বয়েসে তাঁর পক্ষে আর বেশিদিন অবিবাহিত থাকা সম্ভব নয়। ইন্দিরার বিয়ে হয়ে গেলে রবীন্দ্রনাথকেও এই ভাইঝিটির উপর থেকে গুটিয়ে নিতে হবে ছায়া। একটু আগে থেকেই সে-কাজ শুরু করলেন তিনি। আর সে-কাজ শেষ করলেন ইন্দিরা নিজে, অনেক মানসিক সঙ্কটের মধ্যে প্রমথকে বিয়ে করে, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৭ ফাল্গুন, মঙ্গলবার, ১৮৯৯। প্রমথ ৩১। ইন্দিরা ২৬।

বিয়ের আগে ঠাকুরবাড়ির নিয়মানুসারে প্রমথ চৌধুরীকে ব্রাহ্ম হতে হল। বিয়েতে খরচা হল ৫৯৫১ টাকা সাড়ে তের আনা। এখানে একটি কথা না স্মরণ করে পারছি না। রবীন্দ্রনাথের আর এক হৃদয়চারিণী কাদম্বরীর মতো ইন্দিরাও থেকে গিয়েছিলেন নিঃসন্তান।

রবীন্দ্রনাথ নিজে থেকে সরে না গেলে, রবীন্দ্র-আচ্ছন্নতা থেকে সহজে বেরতে পারতেন না ছাব্বিশ বছরের ইন্দিরা। প্রমথ চৌধুরীর মতো স্বামী না পেলেও তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রবিচ্ছেদ সামলানো কঠিন হত। সরলা এ-কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি হদিস পেয়েছিলেন ইন্দিরার সংশয় ও ইচ্ছার। এবং সরলা ঠিক সময়েই তাঁর পাণিপ্রার্থী প্রমথকে তুলে দিয়েছিলেন ইন্দিরার হাতে।

এই ইন্দিরাকেই একদিন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন এই আগুনে-চিঠিটি। ১৮৯২-এর ১৩ জুন-এ। শিলাইদহ থেকে। ইন্দিরার বয়েস উনিশ। রবীন্দ্রনাথ তখন একতিরিশ।

”এ-সব শিষ্টাচার আর ভালো লাগে না-আজকাল প্রায় বসে বসে আওড়াই-‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন!’ বেশ একটা সুস্থ সবল উন্মুক্ত অসভ্যতা! দিনরাত্রি বিচার আচার বিবেক বুদ্ধি নিয়ে কতকগুলো বহুকেলে জীর্ণতার মধ্যে শরীর মনকে অকালে জরাগ্রস্ত না করে একটা দ্বিধাহীন চিন্তাহীন প্রাণ নিয়ে খুব একটা প্রবল জীবনের আনন্দ লাভ করি। মনের সমস্ত বাসনা ভাবনা, ভালোই হোক মন্দই হোক, বেশ অসংশয় অসংকোচ এবং প্রশস্ত-প্রথার সঙ্গে বুদ্ধির, বুদ্ধির সঙ্গে ইচ্ছার, ইচ্ছার সঙ্গে কাজের কোনো রকম অহর্নিশি খিটিমিটি নেই। একবার যদি রুদ্ধ জীবনকে খুব উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খল ভাবে ছাড়া দিতে পারতুম, একবার দিগবিদিকে ঢেউ খেলিয়ে ঝড় বাধিয়ে দিতুম, একটা বলিষ্ঠ বুনো ঘোড়ার মতো কেবল আপনার লঘুত্বের আনন্দ-আবেগে ছুটে যেতুম!

কিন্তু আমি বেদুইন নই, বাঙালি। আমি কোণে বসে বসে খুঁৎখুঁৎ করব, বিচার করব, তর্ক করব, মনটাকে নিয়ে একবার ওল্টাব একবার পাল্টাব,-যেমন করে মাছ ভাজে-ফুটন্ত তেলে একবার এ পিঠ চিড়বিড় করে উঠবে, একবার ও পিঠ চিড়বিড় করবে। যাক গে! যখন রীতিমত অসভ্য হওয়া অসাধ্য তখন রীতিমত সভ্য হবার চেষ্টা করাই সংগত। সভ্যতা এবং বর্বরতার মধ্যে লড়াই বাধাবার দরকার নেই।…”

এই কি তা হলে আসল, নিখাদ, মুখোশহীন রবীন্দ্রনাথ? উপনিষদ-পরিস্রুত আধ্যাত্মিক, নির্মোহ, নির্বিণ্ণ রবীন্দ্রনাথের থেকে আলোকবর্ষ দূরের অন্য এক রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাঙালি সমাজব্যবস্থার বহুকেলে জীর্ণ বাতাবরণ থেকে যাযাবর-বাসনায় বেরিয়ে এসে উনিশ বছরের ভাইঝিকে অকপটে জানাচ্ছেন তাঁর অবচেতন বাসনাকটাহে ‘ফুটন্ত তেল’-এর কথা, তাঁর চিড়বিড়ানির কথা! আরও কি বেশিদূর ইঙ্গিতকে প্রসারিত করতে পারবেন শব্দের এই ঈশ্বর?

আর একটি চিঠিতে ইন্দিরাকে লিখছেন তিনি, ”আমি ভদ্রলোক সেজে শহরের বড় রাস্তায় আনাগোনা করছি, পরিপাটি ভদ্রলোকদের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথাবার্তা কয়ে জীবন মিথ্যে কাটিয়ে দিচ্ছি।”

তারপর সেই দুর্বার প্রশ্ন, ”আমি অন্তরে অসভ্য, অভদ্র, আমার জন্যে কোথাও কি একটা ভারী সুন্দর অরাজকতা নেই?”

দুই আত্মীয়াকে নিয়ে তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ে তাঁর একান্তভাবে কাঙ্ক্ষিত এই ‘ভারী সুন্দর অরাজকতা’র মধ্যেই পালাতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। একজন কাদম্বরী। অন্যজন ইন্দিরা।

”জীবনে যৌবনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাতাসের মতো একবার হুহু করে বেড়িয়ে আসি, তারপরে ঘরে ফিরে এসে পরিপূর্ণ প্রফুল্ল বার্ধক্যটা কবির মতো কাটাই।…উপবাস করে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, অনিদ্র থেকে, সর্বদা মনে মনে বিতর্ক করে, পৃথিবীকে এবং মনুষ্য হৃদয়কে কথায় কথায় বঞ্চিত করে স্বেচ্ছারচিত দুর্ভিক্ষে দুর্লভ জীবন ত্যাগ করতে চাইনে।”

বোঝা যায়, আদরের উপবাস তিনি যেন আর সহ্য করতে পারছেন না। চাইছেন ক্যাথারসিস, তাঁর অন্তর্নিবিষ্ট জ্বলনের শান্তায়ন।

যে-প্রবৃত্তির তাড়নায় রবীন্দ্রের মনের মধ্যে অহরহ যন্ত্রণা, যার টানে তিনি বেরিয়ে যেতে চান ‘ভারী সুন্দর অরাজকতা’র মধ্যে, মুক্তি চান জীবনে যৌবনে উচ্ছ্বসিত হুহু বাতাসের মধ্যে, চান ভদ্রলোকের মুখোশ খুলে অসভ্য, অভদ্র হতে, তা কি অন্যায়? অপরাধ কি তাঁর দুই আত্মীয়ার প্রতি গভীর প্রণয়, তাড়িত প্রবণতা?

লন্ডন থেকে ১৮৯০-এর রবীন্দ্রনাথ, বয়েস তাঁর ঊনতিরিশ, লিখছেন সপ্তদশী ইন্দিরাকে, ”মানুষ কি লোহার কল, যে, ঠিক নিয়ম-অনুসারে চলবে? মানুষের মনের এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত কাণ্ড-কারখানা-তার এতদিকে গতি-এবং এত রকমের অধিকার যে, এদিক-ওদিকে হেলতেই হবে। সেই তার জীবনের লক্ষণ, তার মনুষ্যতের চিহ্ন, তার জড়ত্বের প্রতিবাদ।”

সতেরো বছরের ভাইঝিকে লেখা চিঠিতে আমাদের চিরায়ত নৈতিকতা, মূল্যবোধকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ভিতরের উপোসি যন্ত্রণা থেকেই যেন উড়িয়ে দিলেন ন্যায়-অন্যায়, পাপ-পুণ্যের সমাজ- সমর্থিত ধারণাকে। তিনি তথাকথিত নৈতিক দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলেন কুণ্ঠাহীন ভাষায়, ”এই দ্বিধা, এই দুর্বলতা যার নেই তার মন নিতান্ত সংকীর্ণ এবং কঠিন এবং জীবনবিহীন।”

যে-প্রবৃত্তির টানে ইন্দিরার সঙ্গে ঘটেছে তাঁর অন্তর্গূঢ় সম্পর্ক, যে-প্রবৃত্তির চাপ তাঁকে নিয়ে গেছে কাদম্বরী- আচ্ছন্নতায়, সেই প্রবৃত্তিকে ভিন্ন ব্যাখ্যায় হাজির করেছেন রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরার কাছে, ”যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্বদাই কটুভাষা প্রয়োগ করি সেই আমাদের জীবনের গতিশক্তি-সেই আমাদের নানা সুখদুঃখ পাপপুণ্যের মধ্য দিয়ে অনন্তের দিকে বিকশিত করে তুলছে।…যার এই প্রবৃত্তি অর্থাৎ জীবনীশক্তির প্রাবল্য নেই, যার মনের রহস্যময় বিচিত্র বিকাশ নেই, সে সুখী হতে পারে, সাধু হতে পারে, এবং তার সেই সংকীর্ণতাকে লোকে মনের জোর বলতে পারে, কিন্তু অনন্ত জীবনের পাথেয় তার বেশি নেই।”

এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ”আমি এই যে”… চিঠিটা এখান থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

সম্ভবত ইন্দিরাই ছিঁড়ে দিয়েছেন। পাছে রবীন্দ্রনাথকে মানুষ ‘ঠিক’ বোঝে, তা-ই।

যে-রবীন্দ্রনাথ তাঁর সতেরো বছরের অবিবাহিতা ভাইঝিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন দুশো বাহান্নটি পত্রস্রোতে, কেন তিনিই তাঁর নিজের কন্যাদের বিয়ে দিয়ে দিলেন দশ-চোদ্দো-পনেরো বছর বয়েসে? কেন তাঁদের দিলেন না ইন্দিরার শিক্ষা ও মুক্তি?

রবীন্দ্রনাথের ভাইঝিদের তো অনেকেরই বিয়ে দেরি করেই। প্রতিভাসুন্দরীর বিয়ে একুশ বছর বয়েসে (১৮৮৬), প্রজ্ঞাসুন্দরীর আঠেরো বছর বয়েসে (১৮৯০), অভিজ্ঞার কুড়ি বছর বয়েসে (১৮৯৬), ইন্দিরার ছাব্বিশ বছর বয়েসে (১৮৯৯)।

সাততাড়াতাড়ি বেলা, রানী, মীরার বিয়ে দেওয়ার কী কারণ ছিল রবীন্দ্রনাথের? কারণটি ছোট্টো এবং যতই তিক্ত হোক মেনে নিতে আমরা বাধ্য।

দেবেন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ঠাকুর পরিবারের বিয়ে যাবতীয় খরচের অর্থ আসত পারিবারিক তহবিল থেকে। এই তহবিলের সুযোগ যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় তা-ই দশ বছরের মেয়েরও জোর করে বিয়ে দিতে বাধেনি রবি ঠাকুরের!

বাবা দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে-থাকতেই বেলা আর রানীকে পার করতে পেরেছিলেন তিনি। প্রথম ভারতীয় আই সি এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর্থিক স্বাধীনতা ও জোর রবীন্দ্রনাথের ছিল না। তিনি মূলত ছিলেন পিতৃনির্ভর। কিংবা বলা উচিত দেবেন্দ্রনাথ- অনুমোদিত মাসোহারা নির্ভর। সুতরাং মেয়েদের বিয়ের জন্য পারিবারিক তহবিলের সুযোগ না নিয়ে তাঁর উপায় ছিল না।

১৮৯৯-এ বিয়ে হয়ে গেল ইন্দিরার। যেহেতু প্রমথ চৌধুরীর মেজদাদা যোগেশের সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভেঙে প্রমথকেই বিয়ে করলেন ইন্দিরা, বিয়ের পরের দিন প্রমথ নতুন বউকে নিয়ে নিজের বাড়িতে না গিয়ে উঠলেন ছোটো বোনের বাড়ি।

রবীন্দ্রনাথের বয়েস তখন আটতিরিশ। ১৯০২-এ মারা গেলেন স্ত্রী মৃণালিনী। চল্লিশ বছর বয়েসে তাঁর একাকিত্ব যেন পৌঁছল নিঃসীম পূর্ণতায়।

১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার পেলেন তিনি। তাঁর খ্যাতি যতই হয়েছে আরোহী, ততই যেন ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হয়েছেন আরও বেশি নিঃসঙ্গ, বিফল প্রার্থী হয়েছেন প্রণয়ের, যন্ত্রণা পেয়েছেন আদরের উপবাসে। বোটের মধ্যে আলো নিভিয়ে একা বসে থাকেন তিনি। শব্দ শোনেন বহমান পদ্মার। দু-পাশে সরে সরে যায় অন্ধকারে আচ্ছন্ন নদীর চর, কোনো গ্রামের অস্পষ্ট রূপরেখা।

একা বসে বসে কখনও বা কান্না সামলাতে পারেন না তিনি। তাঁর চুলের মধ্যে হাত বুলিয়ে দেয় নদীর হাওয়া।

১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি সুন্দরী ষোড়শী বিধবা প্রতিমার সঙ্গে পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতিমার বিয়ে হয়েছিল দশ বছর বয়েসে এক নীলানাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, এবং বিয়ের দু-মাস পরেই নীলানাথ মারা যান গঙ্গায় ডুবে। ছেলের বিয়ে দেওয়ার পরে কি আরওই একা হয়ে গেলেন তিনি? ভুগতে শুরু করলেন গভীর বিষাদে? এবং শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে তাঁর মনে হল, তাঁকে মরতেই হবে!

অবিশ্বাস্য। তবু সত্য ঘটনা। এবং এই ঘটনার কথা না জানলে রবীন্দ্রজীবনে আদরের উপবাসের নির্জন যন্ত্রণার সবটুকু আমরা অনুভব করতে পারব না।

‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান’-এর মতো রোম্যান্টিক মৃত্যুবাসনা নয়, জীবন নামক দুঃস্বপ্নকে আর বহন করতে না পারার বিষণ্ণতাপ্রসূত আত্মনাশের তাড়না পেয়ে বসেছিল রবীন্দ্রনাথকে। ”জীবনে আমার লেশমাত্র তৃপ্তি ছিল না”, এ-কথা রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি।

এই অবিরল অতৃপ্তি থেকেই তাঁর প্রিয় বউঠান কাদম্বরীর মতোই রবীন্দ্রনাথও বেছে নিয়েছিলেন আত্মহননের পথ। ”আমি deliberately suicide করতেই বসেছিলুম”, পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন তিনি। এখানে ‘deliberately’ শব্দটিতে সামান্য খটকা লাগে।

শব্দটিকে উনি আক্ষরিক অর্থে, অর্থাৎ ‘অনেক ভেবেচিন্তে’ বোঝাতেই ব্যবহার করেছেন। তিনি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হঠাৎ নেননি। চিন্তাভাবনা করেই তাঁর ক্রমশ মনে হচ্ছিল, আত্মহত্যাই একমাত্র ঠিক পথ জীবনের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির।

১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চার মাস আগে আটান্ন বছর বয়সে এক ভুবনখ্যাত সাহিত্যিক, ভার্জিনিয়া উলফ আত্মহত্যা করার আগে লিখে গেলেন, I am doing what seems the best thing to do.

প্রায় একইভাবে মৃত্যুসিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ: ”দিনরাত্রি মরবার কথা এবং মরবার ইচ্ছা আমাকে তাড়না করছে। মনে হয়েছে আমার দ্বারা কিছুই হয়নি এবং হবে না, আমার জীবনটা যেন আগাগোড়া ব্যর্থ। মরতে হবে।” ১৯১৫ সালে রথীন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ।

কেন রবীন্দ্রনাথকে মরতে হবে? কেন তাঁরও মনে হয়, তিনি আগাগোড়া ব্যর্থ? কীসের অতৃপ্তিবোধ? কোন আগুনে পুড়ছিলেন তিনি?

এ-সব প্রশ্নের কিছু উত্তর রবীন্দ্রনাথের স্বীকারোক্তি থেকেই পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর মৃত্যুইচ্ছার সব কারণ তিনি বলেননি। এক দিকে যেমন তিনি হৃদয়ের কথা ‘বলিতে ব্যাকুল’, যেমন প্রকাশের প্রতিভাও বিবক্ষা তাঁর অপরিসীম, অন্য দিকে তেমনি তাঁর কুণ্ঠাও তো কম ছিল না।

তবে যতটুকু তিনি নিজেই বলে গেছেন, তাও নেহাত কম নয়। তাঁর স্বীকারোক্তি এবং আত্মসন্ধান থেকে বুঝতে পারি আমরা, ১৯১৫-তে এক রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-ই হয়েছিল। তাঁর ফিরে আসার ঘটনাটা ‘রেজারেকশন’ বা পুনর্জন্ম।

যে-রবীন্দ্রনাথ ফিরে এসেছিলেন তিনি এক নতুন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রত্যাবর্তন এবং মুক্তির সঙ্কল্পের কথাও তিনি একটি আচমকা লাইনে লিখে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ভুগছিলেন নার্ভাস ব্রেকডাউনে: ”কিছুকাল থেকেই আমার একটা nervous breakdown হয়েছে তার সন্দেহ নেই।” কী করে বুঝলেন তিনি? ভার্জিনিয়া উলফ শুনতে পেতেন চুপিচুপি কথা, কানের মধ্যে ভোঁ-ভোঁ করত অন্য কণ্ঠস্বর। আর রবীন্দ্রনাথ তীব্র ব্যথা অনুভব করতেন কানে এবং মাথায়। ”যখন আমার কানে এবং মাথায় বাঁ দিকে ব্যথা করতে লাগল, তখন বুঝেছিলুম সেটা ভাল লক্ষণ নয়।”

এই ব্যথার সত্যিই কি কোনও কারণ ছিল? তিনি ভাবছিলেন তাঁর ব্যথা হচ্ছে, তা-ই ব্যথা অনুভব করছিলেন তিনি, তাও তো হতে পারে।

দিবারাত্র সেই যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। তাঁর জীবন ছিল মূলত নিঃসঙ্গ। কান ও মাথার যন্ত্রণা সেই একাকিত্বের মধ্যে ক্রমশই অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। কাজের মধ্যেও ভুলে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না কান-মাথা -মনের যন্ত্রণা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে। কারণ, কাজ করতেই আর ইচ্ছে করছিল না তাঁর।

যেটুকু কাজ করছিলেন, তা নিজের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে। ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছেন, ”আই কান্ট রাইট।”

রবীন্দ্রনাথ অবশ্য ক্রমাগতই লিখেছেন, কাজ করেছেন, কিন্তু ক্লান্তি ও অনীহার বিরুদ্ধে তাঁকে সর্বক্ষণ সংগ্রাম করতে হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে ক্রমাগত গ্রাস করছে মৃত্যুর মধ্যে মুক্তির ইচ্ছা। ‘মরতে হবেই’ কে যেন তাঁকে ভিতর থেকে বলছে বারবার। কান আর মাথার ব্যথা তারই সিগনাল বা সঙ্কেত, ”যে কোনও কাজ অত্যন্ত জোর করে করতে হত। আর মনের মধ্যে একটা গভীর বেদনা ও অশান্তি অকারণে লেগেই ছিল।” স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

নার্ভাস ব্রেকডাউনের ফলে ঠিক কী মনে হচ্ছিল তাঁর? কেন কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষের?

অল্প কথায় উত্তর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, যে-উত্তর থেকে খুব ভালভাবেই আঁচ করতে পারি সেই সময়ে তাঁর মনের অবস্থাটা।

”যা কিছুই স্পর্শ করেছিলুম, সমস্তই যেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিলুম। এরকম একেবারে উল্টোমানুষ যে কি রকম করে হতে পারে এ আমার একটা নতুন experience, সমস্তই একেবারে দুঃস্বপ্নের ঘনজাল।”

নিজেকে অন্য মানুষ মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাঁর নিজের মুখ ও পরিচয়ই যেন নিজের কাছেই হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি আশা করছেন, ”এই ভয়ঙ্কর মোহজাল থেকে নিষ্কৃতিলাভ করে আবার আমার প্রকৃতি ফিরে পাব।”

এই ভয়ঙ্কর মোহজাল, দুঃস্বপ্ন ঠিক কেমন? রবীন্দ্রনাথ যেন নিজের বাইরে বেরিয়ে তা বোঝবার, দেখবার, উপলব্ধির চেষ্টাও করছেন: ”আজ আমি আমার এই ব্যাধিগ্রস্ত অপ্রকৃতিস্থ স্বভাবটাকে কতকটা যেন বাইরে থেকে দেখতে পেয়েছি।”

আত্মহননের তাড়নাকে বাইরে থেকে দেখার চেষ্টায় কিছুটা সফল রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ”কাল সন্ধ্যার সময়ে ক্ষণকালের জন্য এই অন্ধকারের ভিতর দিয়ে একটা আলোর আবির্ভাব দেখতে পেয়েছি।”

এক দিকে তীব্রভাবে মরতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথ, অন্য দিকে সেই মৃত্যুতাড়না থেকে বেরতেও চাইছেন তিনি। লড়াই চলছে তাঁর মনের মধ্যে।

এক অসহ্য নরক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে চলেছেন তিনি। এই যন্ত্রণা থেকে তাঁকে মুক্তি পেতে হবেই। সহজ মুক্তির পথ আত্মহত্যা। সেই দিকেই ভিতর থেকে তাড়িত তিনি। তবু তিনি নিজের কাছে প্রতিশ্রুত হলেন, আত্মহনন নয়, জীবনকে বরণ করে নেওয়ার মধ্যেই তাঁর মুক্তি।

”দুঃস্বপ্নের ঘনজাল…আমি ছিন্ন করব-এর ওষুধ আমার অন্তরেই আছে।” এই আত্মোপলব্ধি এবং আত্মবিশ্বাস কিন্তু বারবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে বিপরীত ভাবনায়: ”কেবলি মনে হচ্ছিল যখন এ জীবনে আমার ideal-কে realise করতে পারলুম না তখন মরতে হবে, আবার নতুন জীবন নিয়ে নতুন সাধনায় প্রবৃত্ত হতে হবে।” নতুন হয়েই ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কেন আত্মহত্যার বাসনা ক্রমশ পেয়ে বসেছিল রবীন্দ্রনাথকে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি নিজেই। সে-ব্যাখ্যা কখনও বাতিকগ্রস্ত, কখনও অতি সারল্যে হাস্যকর, কখনও ব্যাখ্যাটাই এক রকমের পাগলামি।

এতই আবেগপ্রবণ এবং অস্পষ্ট যে বোঝা যায় না। তিনি জানাচ্ছেন, ”কিছুদিন থেকে আমার মনের মধ্যে যে উৎপাত দেখা দিয়েছে সেটা একটা শারীরিক ব্যামো। Yuman ডাক্তার এর জন্যে যে ওষুধ দিলেন সেটা হচ্ছে Aurum খুব high dilution এটা কেন দিলেন আমি বুঝতে পারিনি। আমার বিশ্বাস, এই ওষুধের ফলে আমার কানের ব্যথা সেরে গেল বটে কিন্তু এই ওষুধের যে mental effect সে আমাকে চেপে ধরেছে।”

‘আমার বিশ্বাস’ কথাটাই প্রথম রোগ-লক্ষণ। তিনি ভুগছেন গভীর ‘ডিপ্রেশন’ বা মানসিক নিম্নচাপে। Aurum খাওয়ার পর কী ধরনের মানসিক রোগ হতে পারে, তিনি তা খুঁজে বার করেছেন Materia Medica থেকে। তার একটা তালিকাও করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এবং ভেবেছেন সব কটি রোগ-লক্ষণ তাঁর মধ্যে ফুটে উঠেছে।

‘‘Melancholy, with inquietude and desire to die–Irresistible imqulse to weep. See obstacles everywhere. Hopeless, suicidal, desperate, Great anguish. Excessive scruples with conscience. Despair of oneself and others. Grumbling quarrelsome humour. Alternate peevishness and cheerfulness.’’

সত্যি তো, তাঁর মনের মধ্যে যে-রোগ ঘনিয়ে এসেছে, তা তো ঠিক এই রকমই। কোনও তফাত নেই, মনে হল তাঁর।

”মেটিরিয়া মেডিকাতে যা লিখেছে এর সব লক্ষণই আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে”, লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

তাঁর গভীর ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতাই তাঁকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে মেটিরিয়া মেডিকা-র রোগ তালিকার সারবত্তায়। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতেও বাধ্য হচ্ছেন যে, মৃত্যুই মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি মরতে চাইছেন। হঠাৎ হঠাৎ কাঁদতে চাইছেন অনিয়ন্ত্রিত আবেগের ধাক্কায়। সর্বত্র দেখতে পাচ্ছেন বাধা-বিপত্তি। হারাচ্ছেন আশা, বিশ্বাস।

”অন্যদের সকলের সম্বন্ধেই নৈরাশ্য এবং অনাস্থা,” জানাচ্ছেন তিনি। বিপুল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি তিনি তাড়িত বিবেকজনিত সঙ্কোচ ও সন্দেহের দ্বারা (excessive scruples with conscience)। এই সঙ্কোচ, সন্দেহ ও মানসিক পীড়নকে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বোঝবার চেষ্টা করেছেন এইভাবে। তাঁর সঙ্কোচ, সঙ্কট, ভীতি ও সন্দেহের প্রধান ক্ষেত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে পুত্রবধূ প্রতিমার সম্পর্ক: ”মনের মধ্যে এইরকম সুগভীর অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে বলেই আমি যাদের খুব ভালোবাসি তাদেরই সম্বন্ধে যত রকম মন্দ ও অকল্যাণ আমার কল্পনায় বারম্বার তোলপাড় করেছে, কোনোমতেই তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারিনি।”

রথীন্দ্রনাথকে নিয়েই তাঁর বিশেষ ভয়। বউমার সঙ্গে তাঁর ছেলে মানিয়ে নিতে পারবেন তো? ছেলেকে বারবার উপদেশ দিচ্ছেন তিনি। এবং উপদেশ দেওয়ার সুযোগে নিজের ভাবনাচিন্তা নৈতিকবোধ আদর্শ চাপিয়ে দিচ্ছেন পুত্রের ঘাড়ে।

বউমা প্রতিমারও নিষ্কৃতি নেই। ”বৌমার মধ্যে অনেক ভাল জিনিস আছে-সে দিকে যদি তোর চিন্তা না থাকে তবে এরপরে আর সুযোগ পাবিনে – প্রতিমা নতুন তোর ঘরে এসেছে, এখন ওর জীবনযাত্রার স্রোতকে যে মুখে ফেরাবি সেই দিকেই ও পথ করে নেবে, সংসার বলতে কি বুঝতে হবে…এই সময়টা যদি হাল্কা রকম করে কেটে যায়…তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হবে।”

এতটা লেখার পরেই রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রণা পাচ্ছেন মনে মনে। বুঝতে পারছেন নিজের আদর্শ, বোধ, এই সব ছেলে-বউমার উপর হয়তো অন্যায়ভাবে ন্যস্ত করছেন। হয়তো ভুগছেন অপরাধবোধেও। নিজেকে বাবা হিসেবেও হয়তো ব্যর্থ মনে হচ্ছে তাঁর। তিনি জানাচ্ছেনও সে কথা, ”এই সমস্ত কথা চিন্তা করেই তোদের নিজেদের হাতেই তোদের সমস্ত ছেড়ে দিয়ে আমি ছুটি নিয়েছি-আমি তোদের লেশমাত্র বাধা দিতে ইচ্ছে করিনে-বাইরে থেকে তোদের উপর আমার নিজের ইচ্ছাকে কোনো আকারে চাপাতে চাইনে… আমার দিকে কিছুমাত্র তাকাবি নে। উন্নতি হলেও তোর, অবনতি হলেও তোর।”

খুব ভালো কথা। ছেলে-বউমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন এক নির্লিপ্ত রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সত্যিই কি তিনি নির্লিপ্ত? ”আমার দিকে কিছুমাত্র তাকাবি নে।”-এটা কি আবেগ, অভিমান এবং আত্মপ্রেমের কথা নয়? নিজেদের সুখ নিয়ে, ভোগ নিয়ে আমাকে ভুলে যাবে! তা কি হয়? রবীন্দ্রনাথের ভেতরের কথা কিন্তু সেটাই। এবং এই আপাত নির্লিপ্তির কথা, সরে যাওয়ার কথা লিখেই তিনি ফিরে আসছেন তাঁর উপদেশাবলি নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে এইভাবে পুত্র রথীর কাছে, ”তার (বৌমার) চিত্তকে জাগিয়ে তোলবার ভার তোকে নিতে হবে-তার জীবনের বিচিত্র খাদ্য তোকে জোগাতে হবে-তার মধ্যে যে সকল শক্তি আছে তার কোনটা মুষড়ে না যায়, সে দায়িত্ব তোর। এইখানে সে তোর শিষ্য, তুই তার গুরু।”

নিঃসন্দেহে নিজের গুরুভাবটি পুত্র রথীন্দ্রের উপর জোর করে আরোপ করলেন রবীন্দ্রনাথ। ”তোদের হাতেই তোদের সংসারের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করলাম আমি”-এইরকম একটি গালভরা অথচ অস্পষ্ট বাক্য লেখার পরেই আবার পুত্র-পুত্রবধূর মধ্যে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, অযাচিতভাবেই, রবীন্দ্রনাথ। এবং লিখছেন, ”আমার জন্যে তোরা আর ভাবিসনে।”

আসলে, ভাবতেই তো বলছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কথা না ভেবে ছেলে-বউয়ের জীবন কাটবে কী করে? আমাদেরই কি কাটছে?

এমনকী বউমাটি ঠিক কী ভাববেন তাঁর বিষয়ে, তা-ও গভীর এক আত্মকরুণার সঙ্গে বলে দিচ্ছেন তিনি পুত্র রথীন্দ্রকে: ”তুই বৌমাকে বলিস তিনি যেন আমাকে তাঁর একটি অসুস্থ শিশুর মতো দেখেন এবং মনে জানেন আমি এই অবস্থায় যা কিছু করেছি তার জন্যে আমি দায়ী নই।”

কেন দায়ি নন? কারণ, রবীন্দ্রনাথ মানসিকভাবে সুস্থ নন। কারণ, তিনি ‘মোহাবিষ্ট’। কার প্রতি, কীসের প্রতি মোহ?

তিনি শুধু লিখেছেন, ”এই মোহাবিষ্ট অবস্থায় তাঁকে (বউমাকে) যে আঘাত করেছি তার বেদনা আমি কোনওদিন ভুলতে পারব না।”

আবেগে-অভিমানে কানায়-কানায় রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ‘শিশু’ ভাবছেন, এবং সেইভাবেই বউমার কাছেও গৃহীত হতে চাইছেন, কারণ তাঁর সব অন্যায়, অপরাধ তা হলেই ক্ষমার্হ মনে হবে। চুয়ান্ন বছরের প্রবল পুরুষ রবীন্দ্রনাথকে কি সত্যিই ‘শিশু’ ভাবতে কষ্ট হয়নি তরুণী পুত্রবধূটির?

আবেগ, একাকিত্ব, মধ্য বয়সের জটিল সঙ্কট-এই সব কিছুরই শিকার রবি ঠাকুর বারবার আঘাত পাচ্ছিলেন নিজেরই স্পর্শকাতরতা এবং আত্মাভিমান থেকে। তাঁর মনে হয়েছিল বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। ব্যর্থ তিনি। কেন ব্যর্থ? কেন একা? তাঁর নোবেল প্রাইজ ‘বিড়ম্বিত’ রোম্যান্টিক ব্যর্থতাবোধকে কি নতুন বউমাটি বুঝতে পারবেন? রথী কি বিয়ের পরে পর হয়ে যাবেন আস্তে আস্তে? সরে যাবেন রবীন্দ্রনাথের মতো পিতৃদেবের কাছ থেকে? প্রতিমাই তাঁকে পর করে দেবেন না তো? ‘মোহাবিষ্ট’ অবস্থায় কী আঘাত তিনি করেছিলেন পুত্রবধূকে যার জন্য তাঁকে নিতে হল শৈশব আর সারল্যের আশ্রয়?

১৯১৫-র রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ একা। ১৯১৮ সালে তাঁর জীবনে আসবে এক তরুণী। নাম তার রানু অধিকারী। যিনি পরবর্তিকালে লেডি রানু। এক নতুন দিগন্ত তাঁর অপেক্ষায়। কিন্তু সে-এক অন্য গল্প, রবীন্দ্রের প্রণয়জীবনের সেই বিস্তৃত পর্ব এ-বইয়ের বিষয় নয়। বিষয় শুধুমাত্র তাঁর পরিবারের মধ্যেই তাঁর দুই পরম আত্মীয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কজাত সুখ-সংশয়-তৃষ্ণা- বিচ্ছেদ-যাতনা।

কত পথ এখনও চলতে হবে তাঁকে। কত গান-কবিতা-গল্প-উপন্যাস-ছবি-প্রণয়-বিরহ-মৃত্যুশোক পেরিয়ে পৌঁছবেন তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিনে, ১৯৪১-এর ৭ অগস্ট, বাইশে শ্রাবণ, শেষ প্রহরে, দুপুর ১২টা ১০।

শেষ হবে তাঁর আদরের উপবাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *