৪. দুষ্টু লোক কালীপ্রসন্ন

৪. দুষ্টু লোক কালীপ্রসন্ন

এই দুষ্টু লোকটির অমৃতসমান কথা বলবার আগে একটা স্টার্টার দেওয়া যাক। মহাভোজের আগে মদের সঙ্গে যেমন ‘রোচক’ কিছু। এখানে সেই স্টার্টার হল, দুষ্টু লোকটা কেমন কলকাতায় জন্মাল, তার একটা হালকা ছবি। এই ছবিটা না ভাবতে পারলে দুষ্টু লোকটাকেও ঠিক ঠাওর করা যাবে না।

এখনকার কলকাতার চরিত্তিরের সঙ্গে যে সেই সময়ের কলকাতার খুব একটা গরমিল, তা—ও বলা যায় না। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭—১৮৪৮) সুরসিক বাঙালি বটে। ওই দুষ্টু লোকটা যে—কলকাতায় জন্মাল, সেই কলকাতাকে ভবানীচরণ ডেকেছেন ‘কমলালয়’ নামে। একটা আস্ত বই—ই লিখেছেন, ‘কলিকাতা কমলালয়’। ‘কমলা’ তো লক্ষ্মীর নাম। সেই কলকাতায় হঠাৎ কিছু মানুষ বড়লোক হতে শুরু করল। তা—ই ‘কলকাতা কমলালয়’। তা ধনদৌলত হচ্ছে কাদের?

মূলত সাহেবদের যারা দালালি করছে, তাদের। কলকাতার মানুষদের দু—ভাগে ভাগ করেছেন রসিক ভবানীচরণ : একদল হল ‘হাঙর’। অন্যদল ‘কুমীর’।

যারা সারাক্ষণ অন্যের নিন্দে করে অন্যকে নাশ করেও নিজেকে জাহির করে, তারা হাঙর। আর কুমীররা তুলনায় কম অনিষ্ট করে—তারা বিরাজ করে তাদের অশেষ মূর্খতা নিয়ে।

এদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান তাদের হাতে কলকাতার পথের ধুলো মুঠো—মুঠো সোনা হয়ে যাচ্ছে! হাঙর—কুমীর দু—দলই ধনী হয়ে উঠছে। ভবানীচরণের ভাষায়, কলিকাতা মুদ্রারূপ অপেয় অগাধ জলে পরিপূরিতা হইয়াছে।

আমার পণ্ডিত পাঠক—পাঠিকা আমাকে সুযোগ পেয়ে তিরস্কার করতে ছাড়বেন না, যে—মুহূর্তে তারা জানবেন, কোন দুষ্টু ও প্রখ্যাত বাঙালির গল্প ফাঁদতে চলেছি। তাঁরা সমস্বরে বলে উঠবেন, ভবানীচরণ তো আপনার ওই বিখ্যাত বাঙালিটির মর্ত্যে আগমনের বাইশ বছর আগেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন! সুতরাং ‘কলিকাতা কমলালয়’ তো আরও পুরানো কলকাতার কথা।

না, ঠিক তা নয়, বুঝলেন? ইতিহাসের সময় আর আপনার—আমার সময় তো ঠিক এক হিসেবে চলে না। চারধারে একটু তাকিয়ে দেখলেই এক মোক্ষম সত্যের হদিশ পাবেন।

সেই অন্তর—সত্যটি হল, ‘কলিকাতা কমলালয়’ যতই পুরানো হোক, সে আদিম আরশোলার মতো আজও বেঁচে আছে, নালি নর্দমা দিয়ে ঢুকে পড়েছে আমাদের মল—মহিমান্বিত, মেট্রোমত্ত, উড়ালপুল—উথল কলকাতাতেও!

ভবানীচরণের কলকাতাতে যেমন আজও তেমন—দালালি এখনও দৌলত অর্জনের অব্যর্থ উপায়! এবং এখনও কলকাতায় হাঙর—কুমীর নিয়েই বাস করছি আমরা। বরং তারা এখন আরও ক্ষমতাশালী, প্রবল ও বিপজ্জনক। এখন তো নিজচর্চা—পরচর্চা মিশে গেছে ফেসবুকে। সেখানেই হাঙরে—কুমীরে গলাগলি তো নিত্যদিনের কারবার।

এখনও খোসামোদের পিছনে থাবা উঁচিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে ধান্দা। এখনও বিনিপয়সার মদের আড্ডার জন্যে শৌখিন মোসাহেবরা বাবুবদলাচ্ছে অহরহ। ভবানীচরণের কলকাতায় রূপোপজীবিনীরা যা করত, এখন কলকাতার অনেক কনককন্যা, অনেক দুপুরনটিনী, অনেক রজনীরতায়নীরা তো তা—ই করেই তরে আছে! ‘কলিকাতা কমলালয়’—এর কামলেখা, স্বৈরিণীসংস্কৃতি শুধু ঘোমটা বদলেছে!

ভবানীচরণের পুরানো কলকাতায় যারা হঠাৎ বড়মানুষ তারা চার প্রকার : দালাল, দাদনি, বেনিয়ান, দেওয়ান। এরাই হল গিয়ে বাঙালি সমাজের অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো!

দালালের, বিশেষ করে আধুনিক যুগের দালালের জ্যামিতি স্বয়ং ইউক্লিডেরও অজ্ঞাত। দালালের চরিত্তির ঠাওরাতে ‘সংসদ’ অভিধান লিখছে, দালাল দুই প্রকার, ‘সরকারের ও মালিকের’। দালাল সেই ব্যক্তি যে অযৌক্তিকভাবে কারও পক্ষ অবলম্বন করে। এবং এই মহৎ পরিশ্রমের জন্য সে দালালি পায়, অর্থাৎ টাকা পায়।

‘দাদনি’ শব্দটির আর তেমন চল নেই হয়তো। কিন্তু ‘দাদনি’ আজও আছে। ‘দাদনি’ সেই ধূর্ত ব্যক্তি যে আগাম টাকা দেয়ার ব্যবসা করে।

আর ‘বেনিয়ান’ কে? যে—বাঙালি সাহেবদের মূলব্যবসার মুতসুদ্দি। অর্থাৎ ভারপ্রাপ্ত কেরানি। সাহেবরা গেছে। কিন্তু সেই আসন তো শূন্য নয়। অতএব মুতসুদ্দিরা অন্য রূপে আজও বিরাজ করছে।

আর ‘দেওয়ান’ হল রাজার খাজাঞ্চি। এখন ‘রাজনীতির খাজাঞ্চি’।

এইবার আসল কথাটা পাড়ি। ১৮৩৯ সাল। কলকাতার এই চার প্রকার হঠাৎ—ধনীদের ঈষৎ পরিচয় দিয়ে একটি নামের তালিকা প্রকাশিত হল। ভারত—সরকারের জাতীয় মহাফেজখানায় পররাষ্ট্র বিভাগের নথিপত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে সেই তালিকা। সেই তালিকার একটি নাম শান্তিরাম সিংহ।

ইনিই জোড়াসাঁকোর বিপুল ধনী সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশ রাজের খাজাঞ্চি ইনি। অর্থাৎ দেওয়ান।

দুই সাহেবের খাজাঞ্চির কাজ করে, যাকে বলে ট্রেজারার বা কোষাধ্যক্ষের কাজ, তিনি ফুলেফেঁপে উঠলেন। যে—দুই সাহেবের সৌজন্যে শান্তিরাম বিত্তবান হলেন তাঁরা পাটনার প্রধান মিডলটন এবং স্যর টমাস রামবোল্ড।

শান্তিরামের দুই ছেলে প্রাণকৃষ্ণ ও জয়কৃষ্ণ। জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবারে ১৮৪০—এর ফেব্রুয়ারি মাসে যাঁর আবির্ভাব ঘটল তিনিই এই লেখার ‘নায়ক’, এক প্রবল ‘দুষ্টু’ বিপুল বিদগ্ধ, অভিজাত অবক্ষয়ের বেপরোয়া বাঙালি। তিনি শান্তিরাম সিংহের নাতির ছেলে। কালীপ্রসন্ন সিংহ।

এক অবিকল্প বাঙালি। বললে এতটুকু বাড়াবাড়ি হয় না। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম। বিরল বৈদগ্ধ্যে বর্ণিল এক জীবন। কখনও প্রাণদীপ্ত। কখনও আত্মহত্যাপ্রবণ। কখনও উড়নচণ্ডী লম্পট। কখনও উৎক্ষিপ্ত লেখক। কখনও নষ্টামির রাজা। কখনও ভণ্ডামির শাসক। মৃত্যুকে জয় করল ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ লিখে। অথচ মরেও গেল মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে।

বেহুদা মদ না খেলে, বেহেড দিনরাত্তির না কাটালে, বেহিসাব হটকারিতা না করলে, হয়তো অসংখ্য কুচুক্কুরে ষড়যন্ত্রী দুর্মিত্রের মুখে আস্তাকুঁড় উপুড় করে আরও কিছুদিন বাংলাভাষার কোলে শিশুর মতো অমল লীলায় কাটাতে পারত।

অথচ এই রাজার দুলালকে মরতে হল বিপর্যস্ত, অপমানিত, নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব হয়ে, স্বনির্বাসনের আর্তি বুকে নিয়ে, তার বরানগরের বাগানবাড়িতে। ১৮৭০—এর ২৪ জুলাই। তিরিশ বছর বয়েসে!

কিন্তু নিয়তিনির্ধারিত এই জীবনই তো পেল সেই অকালপক্ক প্রতিভা যে মাত্র তের বছর বয়েসে বাপের বয়েসি লোকজন জড় করে চালু করল ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র সাগ্নিক সোল্লাস। যে ষোলো বছর বয়েসে কলকাতায় ‘বিদ্যোৎসাহিনী নাট্যদল’ করে নিজে উজান অভিনয় করল রামনারায়ণ ভট্টাচার্য তর্করত্ন অনূদিত ‘বেণীসংহার’—এ। যে—ছেলে নব কৈশোর থেকে প্রথম যৌবনের মধ্যেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল বাঙালির রক্ষণশীল সাংস্কৃতিক পরিবহে, তোলপাড় ঘটাতে। যে সোচ্চচার সাহসে উপড়ে ফেলল বাঙালি—গোঁড়ামির শিকড়। যে হ্যাঁচকাটানে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল একের পর এক কপট সৌজাত্য আর সংস্কারবিমুখ পণ্ডিতির ছদ্মমুখ। যে—ছেলে বছর বাইশ বয়েসের মধ্যে অর্জন করল সেই অমরত্ব যা বাংলা ভাষার জীবনমরণের সঙ্গে বিনুনিবন্ধনে চিরায়ত!

এমন জীবন কি আমাদের পৃথিবীতে চলতে পারে স্থাণু বুড়োমি পর্যন্ত? চলে ছিল কি সমুত্থিত শেলির জীবন? বোহিমিয়ান বায়রনের জীবন? কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো বিলোল জীবন তিরিশ বছর পেরিয়েও গড়িয়ে গেল, একথা ভাবতেও কিন্তু বেগ পেতে হয়। এঁচোড়পাকামোরও তো একটা সীমা আছে! অপরিণত পাকামির অপরিণত সমাপ্তি— এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

১৮৫৬ সাল।

সবে ষোলোয় পড়েছে কালীপ্রসন্ন।

এই নবীন কিশোর ঈশ্বরদত্ত একটা চেহারা পেয়েছে বটে!

বলিষ্ঠ গ্রীবা। উন্নত নাক। আয়ত চোখ। যে—চোখ একই সঙ্গে দেবতা এবং শয়তানের। লম্বা ছিপছিপে গঠন। গাত্রবর্ণ সূর্যপোড়া উজ্জ্বল তামাটে। কালো কুঞ্চিত কেশদাম চিরুনিমুক্ত উল্লাসে বাতাসে উড়ছে। ভোরের বাতাস। কালীপ্রসন্ন পায়চারি করছে বাড়ির বারান্দায়। বিঘ্নিত নিদ্রার রাত কাটিয়ে কালীপ্রসন্নের মন একই সঙ্গে বিষণ্ণ ও ক্ষিপ্ত।

কদিন আগেই দ্বিতীয় বিয়েটা সেরে ফেলেছে নবীন কিশোর। তার এই দ্বিতীয় বউটি চন্দ্রনাথ বসুর মেয়ে। শরৎকুমারী। বছর দশেকের শরৎকুমারী এখনও বিছানায় ঘুমিয়ে।

আর পাঁচটা বাঙালির মতো কালীপ্রসন্ন ঘরের বউ নিয়ে পড়ে থাকার মানুষ নয়। আবার বেশিরভাগ বঙ্গ পুরুষের মতো লুকিয়েচুরিয়ে রক্ষিতার আঁচ পোয়াতেও পারে না সে। তার কোনও ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। পেটে খিদে—মুখে লাজ ব্যাপারটা সে বোঝে না। সে রঙের তাস লুকবে কেন?

সে রঙের দান ফেলে সমাজের চোখের সামনে।

বাড়ির কাছেই ‘সোনাগাজি’ (তখন ওই তীর্থের ওই নাম)। ষোলো বছর বয়েসেই কালীপ্রসন্ন ওই তীর্থের কাছে বারবার প্রার্থী হয়েছে। কিন্তু নবীন কিশোরের হাতে তীর্থে যাবার টাকা আসে কোথা থেকে?

পাঁচ বছর বয়েসে বাবাকে হারিয়েছে কালীপ্রসন্ন।

বিধবা মা—র হাতে অঢেল অর্থ—সম্পদ।

কিন্তু সেই টাকা আর জমিজায়গা স্থাবর সম্পত্তি নিজের ভেবেই আদরযত্ন করে প্রতিবেশী হরচন্দ্র ঘোষ। হরচন্দ্রই কালীপ্রসন্নর অভিভাবক।

হরচন্দ্র ঘু—ঘু জাতীয় মানব। সে কিছু কিছু মহৎ কর্মের অর্থ না—চাইতেই—মেঘবর্ষণের মতো কালীপ্রসন্নের হাতে গুঁজে দিয়ে ফিক করে একটু হাসে। এই হাসির মানে কালীপ্রসন্ন বোঝে। তার সারা গা রাগে রিরি করে। তবু সে টাকাটা নেয়। চুনি বাইয়ের নাচ যে অনেকদিন দেখা হয়নি। তাকে আদর করা হয়নি কতদিন!

বনিতাসক্ত কালীপ্রসঙ্গ কিন্তু সরস্বতীরবরপুত্র। সে হিন্দু কলেজের মেধাবী, মননোজ্জ্বল ছাত্র। সে খেলা করতে ভালোবাসে বাংলা ভাষার শব্দ আর শরীর নিয়ে। ভাষার শরীর নারীর শরীরের মতোই নরম লোভনীয় তার কাছে।

সে বাড়িতে তিন শিক্ষকের কাছে শিখছে তিনটি ভাষা: সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি। সে এই বয়েসেই খুঁজে পেয়েছে এক স্বর্ণখনি—বাঙালির মুখের রোজচলতি ভাষা। এই ভাষায় সে একদিন সাহিত্য লিখবে, এই তার অভিপ্রায়।

কালীপ্রসন্ন বেশ পড়তে পারে নিজের চরিত্র। সে আসলে দুষ্টু লোক। দুষ্টুমি করতে তার ভারি আহ্লাদ। সে বাংলা ভাষার সঙ্গেও যা খুশি তা—ই করতে চায়। নিখাদ দুষ্টুমি।

সে যদি দুষ্টু মানুষ না হত, তাহলে কি ষোলো বছর বয়েসে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করে তার নাম দিতে পারত ‘সর্বতত্ত্ব প্রকাশিকা?’

নামটার মধ্যেই তো উপচে পড়ছে সামাজিক ঠাট্টা, বিদ্রুপ, দুষ্টুমি আর সব—ফাঁস—করে দেয়ার হুমকি! পাশাপাশি আরও একটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছে সে। মজার নামটাও সেই রেখেছে—’বিবিদার্থসংগ্রহ’।

বেশ ব্যাকরণ—ব্যাকরণ নাম। আসল উদ্দেশ্য, অপছন্দের লোকজনদের বাঁশ দেয়া। ষোলো বছরের কালীপ্রসন্ন তার ভাবনায় বহন করছে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’—র বীজ।

কিন্তু এত সব কাজ করেও আজ সকালে দ্বিতীয়বার সদ্যবিবাহিত নবীন কিশোরের মন ভালো নেই।

তার মনম্যাজম্যাজানির প্রধান কারণ, মা—র কাছে সামান্য টাকা চেয়েও সে পায়নি। দু—দিন আগেই মা টাকা দিয়েছে। এতটাকা দু—দিনে কীভাবে কোথায় উড়িয়ে দিল কালীপ্রসন্ন?

মা—কে গুছিয়ে হিসেব দিতে পারেনি সে। তাহলে কি আবার সেই হরচন্দ্রের কাছেই হাত পাততে হবে?

এ—টাকাটা যে সে গাঁজা—চরস—মদ—মরফিয়া আর সোনাগাজিতে নিজেকে একটু সেঁকে নেবার জন্যেই চাইছে, একথা হরচন্দ্র বিলক্ষণ বুঝবে। বুঝে দিয়েও দেবে।

কিন্তু সেই হাসি—কালীপ্রসন্ন সহ্য করতে পারে না এই অপমান।

আজকাল মাঝে মাঝে নিজেকেও সহ্য করতে পারে না কালীপ্রসন্ন। মদ আর চরস তাকে আর চাঙ্গা করছে না। সে পদ্মসুন্দরীর কোলে শুয়েও নেতিয়ে থাকে। পদ্ম তার গলার সোনার হার খুলে নিজের গলায় পরে নেয়। তার নেতানো শরীর—মনে তবু কোনও সাড়া নেই।

কালীপ্রসন্ন নিজেকে ফিরে পেতে মদের সঙ্গে আজকাল মরফিয়া মেশাচ্ছে। মরফিয়া আফিমের সার। মদ আর মরফিয়ার বিয়ের পৌরহিত্ব করে ষোলো বছরের চরিত্রহীন তরুণ। তার শরীরে তার রক্তে তার প্রবল প্রবণতার মধ্যে ঘটে মদ আর মরফিয়ার মিশ্রণ। কিছুক্ষণের জন্যে মনে হয়, সে যেন পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে আরতি করছে। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না সেই ভাব।

গত রাতে মদ আর মরফিয়া মিশিয়েই সেবন করেছিল কালীপ্রসন্ন।

তবু ছেঁড়াছেঁড়া ঘুম হয়েছে তার।

খালি মনে হচ্ছে, আসলে হরচন্দ্রই জিতছে। সে হেরে যাচ্ছে।

এই হেরে যাওয়া ব্যাপারটা সে কিছুতেই নিতে পারে না।

সে রেসের ঘোড়া।

দমছুট তার দৌড়।

তাকে বাজিমাৎ করতেই হবে।

আগে মরবার জো নেই তার।

বারান্দায় পায়চারি করতে করতে সে ভাবে, চোদ্দ বছর বয়েসে সে তো একটা আস্ত নাটক লিখে ফেলেছিল। ‘বাবু’ নাটকটা কিন্তু বেড়ে হয়েছে, সে নিজেই বুঝতে পেরেছিল।

খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল কালীপ্রসন্ন। তারপর লেখার ঘরে গেল। প্রাতঃকালেই মদে আফিম মেশাল। পান করল কয়েক চুমুক। মনটা হঠাৎ নড়েচড়ে উঠল। হু—হু বাতাসে উড়ে গেল মেঘ। কোথা থেকে এক ঝাঁক রোদ্দুর এসে পড়ল তার ইচ্ছের ওপর। সে একটা নতুন নাটক লিখতে বসে গেল।

লেখা শুরু করার আগে মাথায় বসাল ইংরেজি তারিখ, ২ জানুয়ারি ১৮৫৬।

কী নাম দেবে এই নতুন নাটকের?

কালীপ্রসন্ন ধীরে ধীরে লিখল ‘মালতীমাধব’।

বাঃ খাসা নাম। নিজেই তারিফ করল। তার মনে হল, এ নাম তার চেনাশোনা আর কারও মাথায় আসতো না।

সে সবাইকে হারিয়ে দিয়েছে।

সে কৃতজ্ঞবোধ করল মদ আর মরফিয়ার মিশ্ররাগের কাছে।

তারপর সে নিজের লেখা একটি গান মনের আহ্লাদে বাউল সুরে ভোরবেলার আকাশ—বাতাস মাতিয়ে গাইতে লাগল:

আজব শহর কলকেতা।

রাঁড়ি বাড়ি জুড়ি গাড়ি মিছে কথার কি কেতা।

হেতা ঘুটে পোড়ে গোবর হাঁসে বলিহারি ঐক্যতা;

যত বক বিড়ালে ব্রহ্মজ্ঞানী, বদমাইসির ফাঁদ পাতা।

পুঁটে তেলির আশা ছড়ি, শুঁড়ি সোনার বেনের কড়ি।

খ্যামটা খানকির খাসা বাড়ি, ভদ্রভাগ্যে গোলপাতা।

রামপ্রসাদের মতো নিজের নামটা ঢুকিয়ে দেয়া যায় না গানটার মধ্যে? কিছুক্ষণভাবে কালীপ্রসন্ন। সে বুঝতে পারে মদ আর মরফিয়ার খোলতাই হচ্ছে তার মস্তিষ্কে।

নিজেকে তার প্যাঁচা মনে হয়। নক্তচর প্যাঁচা। সে মনে মনে বলে, হুতোম, হুতোম, হুতোম। তারপর গানে দুটো লাইন জুড়ে গাইতে শুরু করে :

গিলটি কাজে পালিশ করা, রাঙ্গা টাকায় তামা ভরা,

হুতোম দাসে স্বরূপ ভাসে, তফাৎ থাকাই সার কথা।

কদিন হল কালীপ্রসন্ন বেশ ফুর্তিতেই আছে।

তার মধ্যে দুটি স্রোত। দেবতার ও শয়তানের।

গত কদিন শয়তান জেগেছে। শয়তান জাগলে সে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তার মন প্রফুল্ল থাকে। তার মনে হয়, পৃথিবীতে এমন কোনও অপকর্ম নেই যা সে এন্তার এনার্জি নিয়ে করতে পারে না।

গত মাসেই, তার নানাবিধ সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যেই সে তো হারু গোঁসাইয়ের সুন্দরী মেয়েকে ফুসলে একটা জব্বর কেলেঙ্কারি করেছে।

এই কাজটা তো একদিনের ব্যাপার নয়। বেশ সময় দিতে হয়েছে হরু গোঁসাইয়ের কন্যা তরুবালার মাথা চিবোতে। তবে কাজটা যে শেষ পর্যন্ত ফতে হল, তা তো ঝানু কুটনির সাহায্যেই।

সে—ই কুটনিই তো তরুবালাকে ফুসলে বের করে নিয়ে এল। আবার সে—ই ব্যাপারটা রটিয়েও দিল। শহরে ঢিঢি পড়ে গেল।

তাতে অবিশ্যি কালীপ্রসন্নের কিছু যায় আসে না। লাম্পট্যের যদি রটনা না থাকে তাহলে সে লাম্পট্য তো মিইয়ে যাওয়া মুড়ি। সোয়াদ কোথায়?

তবে কালীপ্রসন্ন বেশিদিন জীবনের এক স্বাদ সহ্য করতে পারে না। কখনও বাঁদি রাখার রং। কখনও বা মেয়ে ফুসলানোর উত্তেজনা। কখনও বা তারই মধ্যে এসে পড়ে একেবারে বিপ্রতীপ স্রোত। শয়তানের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে দেবদূত। কালীপ্রসন্ন তার যৌবনের সমস্ত অসামাজিক বেপরোয়ামির মধ্যে করে চলেছে নীরবে একটি কাজ।

গীতার বঙ্গানুবাদ! সে জানেও না তার মৃত্যুর অনেক বছর পরে এটি প্রকাশিত হবে।

আজ কিন্তু শয়তানে পেয়েছে বছর বাইশের কালীপ্রসন্নকে। কাঠের আর কাচের বহুমূল্য শো—কেসটি ঠিক যেমন সে ডিজাইন করেছিল তেমনই বানানো হয়েছে। কাচের নীচে লাল মখমল। মেহগনি কাঠের শো—কেস। চারটি পায়ায় হাতির দাঁতের কাজ। বিলিতি কাচের ডালা। ডালার চারপাশে রুপোর নকশা। ডালার নীচে লাল মখমলের উপর সারি সারি লম্বাটে খোপ। খোপের তলায় নামের সারি। নামগুলি নামকরা সব ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের : ব্রজপণ্ডিত, ভগবানদাস তর্কালঙ্কার, বরাহপণ্ডিত, গোপীমহন বিদ্যাভূষণ, কাশীনাথ তর্কবাচষ্পতি, ভড়ংরাজ প্রেমানন্দ, জগা পণ্ডিত, গদিওয়ালা (মোটা) পণ্ডিত জ্ঞানানন্দ বিদ্যারত্ন! এবং আরও অনেকে।

আজ বাড়িতে ব্রাহ্মণভোজন করাবে কালীপ্রসন্ন। দরাজ হাতে খরচ করছে সে। মা—র অবিশ্যি আপত্তি ছিল। কিন্তু ছেলে এখন লায়েক হয়েছে। মা—র আপত্তি মি—মি করে তলিয়ে গেছে। হরচন্দ্র টাকা দিতে আপত্তি করেনি। আপত্তি করলেও তার আপত্তি এখন আর ধোপে টেঁকে না।

কালীপ্রসন্ন নিজের জীবন ও খেয়ালখুশির সব দায়দায়িত্ব নিজের হাতেই নিয়ে নিয়েছে। তার এক হাতে কলম। অন্যহাতে ‘দো—নলা’। ভেতো বাঙালি হরচন্দ্র এই তুরুণতুর্কির সঙ্গে পারবে কী করে? তার যতটুকু গুছিয়ে নেওয়ার নিয়েছে। এখন কালীপ্রসন্ন রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ। হরচন্দ্র পৈতৃক প্রাণ নিয়ে কেটে পড়েছে।

যে কথা বলছিলুম, সকাল থেকে জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়িতে জমজমাট আসর বসেছে। কালীপ্রসন্ন বৈঠকখানার মধ্যমণি। চারপাশে তার ইয়ারবকশির বৃত্ত। নানারকম শ্রাব্য—অশ্রাব্য রঙ্গরসিকতার গায়ে ম—ম করছে অম্বুরিতামাক আর বিলিতি মদের গন্ধ।

কেউ কেউ তাগড়া নেশার জন্যে মদে মেশাচ্ছে অহিফেন। বাইগানও চলছে বৈকি। চুনিবাই মাতিয়ে দিচ্ছে বামুনভোজনের আসর :

ভাসিয়ে প্রেম তরি হরি যাচ্ছে যমুনায়।

গোপীর কুলে থাকা দায়।

ও ব্যাটা মুচকি হেসে নয়ন ঠারে কুলের বউ ভোলায়।

বামুনরা এরই মধ্যে জড়সড় হয়ে বসছে। তাদের দেওয়া হচ্ছে শ্বেতপাথরের গেলাসে ডাবের জল। মন্ডামিঠাই থরে থরে। ভাঁড়ে ভাঁড়ে দইরাবড়ি ক্ষীর।

কালীপ্রসন্ন চোখের ইশারা করে। ডাবের জলে মিশিয়ে দেয় তারই দুইতিন তুখড় চেলা অব্যর্থ ‘emetic’। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাবের জলে মিশ্রিত ইমেটিক শুরু করে তার লীলা।

বামুনেরা হুড়হুড় করে বমি করতে থাকে। কেউ বা বমি চাপতে অজ্ঞান হয়ে যায়। এই সুযোগে বেরিয়ে আসে হাতে হাতে কাঁচি। শুরু হয় বাছাবাছা পণ্ডিতদের টিকি কাটা। কিছুটা সুস্থ্য হওয়ার পর টিকিহীন পণ্ডিতেরা নিজ নিজ গৃহে নতমস্তকে ফিরে যায়।

কালীপ্রসন্ন এবার তার অনেক দিনের স্বপ্নের কাজটি করে ফেলে। সেই বহুমূল্য শো—কেসে সে একে একে খোপে খোপে সাজিয়ে রাখে নানা আকার ও দৈর্ঘ্যের টিকি।

প্রতিটি শিখিকে সে ঠিক—ঠিক সনাক্ত করে। অসামান্য তার মেধা ও স্মৃতি। তারপর প্রতিটি চুটকির নীচে সে নিজের হাতে লেখে সেই চুটকিধারীর অপকর্ম। যেমন গদিওয়ালা জ্ঞানানন্দ বিদ্যারত্নর চৈতনচুটকির ফুটনোট : এই পণ্ডিত অমুক বিধবার সম্পত্তি চেটেপুটে খেয়েছে! বরাহ পণ্ডিতের ব্রহ্মকেশের পাদটীকা : বরাহ অসহায় বিধবা কমলাদাসীকে দিনেরেতে ভোগ করে। ভগবান দাস তর্কালঙ্কারের কাঁচাপাকা শিরোরুহের তলায় টিপ্পুনি : বাঁদিনেশায় মত্ত ভগবান!

কালীপ্রসন্নের শরীর খুব খারাপ।

তার লিভারে ব্যথা হয়।

তার নিশ্বাসের কষ্ট হয়।

সে ভিতরে—ভিতরে কেমন যেন টুপ টুপ করে চুঁইয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, মনে হচ্ছে তার।

মৃত্যু! না না, মৃত্যু কেন? সে যে অমর হয়ে থাকবার জন্যে পৃথিবীতে এসেছে। কেমন অমরত্বের প্রার্থী ও প্রত্যাশী কালীপ্রসন্ন?

সে চায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমরত্ব। যতদিন এরা থাকবে, সে—ও যেন থাকে।

সে ঠিক করেছে শহরের গন্যিমান্যিদের ওপর একটি করে নিন্দার নকশা লিখবে রোজ। লিখবে এমন ভাষায়, ভাবে, কায়দায় যা বাংলায় নেই। এক্কেবারে নতুন।

আর তারপর রাতের অন্ধকারে সে বাড়ি বাড়ি বিলি করবে সেই নকশা। কলকাতায় হুল্লোড় পড়ে যাবে। রাগের সঙ্গে মিশবে লজ্জা, লজ্জার সঙ্গে আক্রোশ, আক্রোশের সঙ্গে প্রতিহিংসা।

‘হুতোম’ নামের আড়াল থেকে শুধু প্রতিদিন কলকাতা শহরকে উস্কে দেবে কালীপ্রসন্ন। গায়ের ঝাল মিটিয়ে লিখবে। খুলে দেবে তথাকথিত আভিজাত্য আর ধর্মের ধ্বজা—ধরা পণ্ডিতির মুখোশ।

এই লেখার জন্যে চাই নতুন ভাষা। বাংলা ভাষার ভোল পাল্টে দেব আমি, মনে মনে রণসাজে সজ্জিত হয় এক রোগজীর্ণ, ঋণদীর্ণ, নিরন্তর আসবসেবী, অথচ মননে সদাদীপ্ত ও প্রাতিস্বিক কালীপ্রসন্ন। সে লিখতে শুরু করে :

গঙ্গারও আজ চূড়ান্ত বাহার। বোট, বজরা, পিনেস ও কলের জাহাজ গিজ গিজ কচ্চেচ। সকলগুলি থেকেই মাতলামো, রং, হাসি ও ইয়ারকির গররা উঠচে, কোনটিতে খ্যামটা নাচ হচ্চেচ, গুটি তিরিশ মোসাহেব মদে ও নেশায় ভোঁ হয়ে রং কচ্চেচন, মধ্যে ঢাকাই জালার মত, পেল্লাদে পুতুলের মত ও তেলের কুপোর মত শরীর, দাঁতে মিসি, হাতে ইষ্টিকবচ, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, তাতে ছোট ছোট ঢোলের মত গুটিদশ মাদুলী ও কোমরে গোট, ফিনফিনে ধুতিপরা ও পৈতের গোচ্চচা গলায়—মৈমন সিং ও ঢাকা অঞ্চলের জমিদার সরকারী দাদা ও পাতান কাকাদের সঙ্গে খোকা স্যেজে ন্যাকামি কচ্চেচন; বয়েস ষাট পেরিয়েছে, অথচ ‘রাম’—কে ‘আঁম’ ও দাদা ও কাকাকে দাঁদাঁ! কাঁকাঁ। বলেন—এঁরাই কেউ কেউ রঙ্গপুর অঞ্চলে ‘বিদ্যোৎসাহী’ কবলান, কিন্তু চক্র করে তান্ত্রিক মতে মদ খান ও ব্যালা চারটে অবধি পুজো করেন—অনেকে জন্মাবচ্ছিন্নে সূর্য্যোদয় দেখেচেন কি না সন্দেহ!

কালীপ্রসন্ন থামলেন। তার কলমের ডগায় সরস্বতী না শয়তান! কী হবে জেনে? সে শুধু জানে, তার ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ মরবে না। বাঙালি তাকে বাঁচিয়ে রাখবেই।

সে যেমন মদের সঙ্গে মেশায় আফিম, ঘরের বউয়ের সঙ্গে বারবনিতা, তেমনি সরস্বতীর সঙ্গে শয়তান মিশিয়ে লিখতে লাগল :

গুরুদাসের মেজাজ আলী হয়ে গ্যাছে, সে বললে, ভাই, যত টাকা লাগে, তোমরা তাই কবলে একটা মেয়ে মানুষ নে এসো, আমি বাবা তাতে পেচপাঁও নই, গুরুদাসের সাদা প্রাণ। এই কথা বলতে না বলতেই নারাণ, গোপাল, হরি ও ব্রজ নেচে উঠলেন ও মেয়ে মানুষের সন্ধানে বেরুলেন। এদিকে গুরুদাস, কেদার ও আর আর ইয়ারেরা চীৎকার করে গান ধরলেন:

যাবি যাবি যমুনা পারে ও রঙ্গিনী।

কত দেখবি মজা রিষঢ়ের ঘাটে

শ্যামা বামা দোকানী—

কিনে দেব মাতা ঘষা, বারুইপুরে ঘুনসি খাসা,

উভয়ের পুরাবি আশা, ও সোনামনি।

অ্যামন সময় মেকিন্টশ বরন কোম্পানির ইয়ার্ডের ছুতোরেরা এক বোট ভাড়া করে রাঁড় নিয়ে আমোদ কত্তে কত্তে যাচ্ছিল। তারা গুরুদাসকে চিনতে পেরে তাদের নৌকো থেকে—

চুপে থাক থাক থাকরে ব্যাটা কানা ভাগনে।

গরু চরাস লাঙ্গল ধরিস এতে তোর অ্যাতো মনে!

শহরে কী আর লোক পেলেন না বিদ্যাসাগরমশাই?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এলেন মদ্যপ, লম্পট, বখাটে, উড়নচণ্ডী, বনিতাসক্ত কালীপ্রসন্নর কাছে?

—একটি কাজ তোমাকে করতে হবে কালীপ্রসন্ন।

কালীপ্রসন্নের মনে হল, বিদ্যাসাগর অনুরোধ করছেন না, এ তাঁর আদেশ।

—কী কাজ? কী কাজের আপনি যোগ্য মনে করলেন আমাকে?

—সমগ্র মহাভারতের বঙ্গানুবাদ। এই কাজ তোমাকে করতেই হবে।

—অসম্ভব!

—না কালীপ্রসন্ন। তুমি—ই পারবে।

—আমার শরীর…

—জানি কালীপ্রসন্ন। তার জন্যে তুমিই দায়ী। মৃত্যুর পূর্বে এই কাজটুকু তোমাকে করে যেতেই হবে। কালীপ্রসন্ন, এই কাজ যেদিন সমাপ্ত করবে তুমি, জানবে তুমি মৃত্যুকে জয় করেছ।

ন’ বছর ধরে (১৮৫৬—১৮৬৬) সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ শেষ করেছে কালীপ্রসন্ন। কালীপ্রসন্নের বয়েস ছাব্বিশ। তার মধ্যে এখনও কয়েক বিন্দু জীবন থেকে গেছে। তার অর্থ প্রায় সবই শেষ।

শেষ সামর্থ্য দিয়ে সে প্রকাশ করেছে কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত সম্পূর্ণ মহাভারত। এবং বিনামূল্যে বিতরণ করেছে।

কালীপ্রসন্নের জীবনতলানি শুষে খাচ্ছে পাওনাদারের দল। সম্পূর্ণ সম্পত্তিনাশ ঘটেছে তার।

পাওনাদারের ভয়ে সে লুকিয়ে আছে বরানগরে তার বাগানবাড়ি ‘সারস্বতাশ্রম’—এ।

কিন্তু পাওনাদারেরা জানতে পেরে গেল সে কোথায়।

তাকে টেনে আনা হল আদালতে। তাকে দাঁড় করানো হল কাঠগড়ায়।

শেরিফ বিচার করবেন কালীপ্রসন্নের। অনেকক্ষণ তিনি শুধু তাকিয়ে এক জরাজীর্ণ দারিদ্র্যদীর্ণ ভগ্নস্বাস্থ্য মানুষের দিকে।

এই মানুষটি আমাদের কেউ নন, ভাবলেন শেরিফ।

ভাবলেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো মানুষটি বুঝি অন্য গ্রহের।

অ্যান এলিয়েন। অ্যান আউটসাইডার।

মানুষটি দেবদূত না শয়তান? কিছুতেই হদিশ করতে পারলেন না ইংরেজ বিচারক। সেই ঠাওরহীন দোলাচল থেকে শেরিফ দিলেন বিচারের রায়—

‘কালীপ্রসন্ন মুক্ত’, বললেন তিনি।

আর মাত্র চারমাস বাঁচবেন কালীপ্রসন্ন।

ফিরে এলেন তাঁর সারস্বতাশ্রমে।

নির্জন, নিঃসঙ্গ কালীপ্রসন্ন জানে, মাত্র তিরিশ বছর বয়েসে তার শুধু দেহটাই তিলে তিলে মরছে।

সে আরও একটু মরফিয়া মেশানো মদ ঢেলে দেয় গলায়।

তারপর হাসে। সে জানে, থেকে গেল সে চিরদিন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির কথামৃতে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *