২০. সেপিয়েন্সের শেষের শুরু

পদার্থবিজ্ঞান থেকে রসায়ন, তারপর জীববিজ্ঞান এবং এর উত্তরসূরী হিসেবে মানুষের ইতিহাসকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই বইটির সূচনা। আর সব জীবিত সত্তার মত মানুষের জীবনও নিয়ন্ত্রণ করে একই প্রাকৃতিক শক্তি, রাসায়নিক বিক্রিয়া এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন পদ্ধতি। প্রাকৃতিক নির্বাচন হয়তো মানুষকে অন্যান্য সকল প্রাণীর থেকে বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছে কিন্তু সে বিচরণের সীমারেখাও কিন্তু অসীম নয়। যার কারণে, অনেক চেষ্টা এবং অসংখ্য অর্জন সত্ত্বেও মানুষ এতদিনেও তার শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারেনি।

অবশ্য, আজ একবিংশ শতকের শুরুতে এসে মানুষ তার শারীরিক এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের এতদিনের নিয়ন্ত্রণহীন নকশাকে ভেঙে মানুষ তার বুদ্ধি দিয়ে তৈরি করছে বিবর্তনের নতুন নকশা।

প্রায় চারশ’ কোটি বছর ধরে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণের বিবর্তন ঘটেছে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ এর মাধ্যমে। বুদ্ধিমান স্রষ্টার তৈরি করা কোনো নকশাই প্রাকৃতিক বিবর্তনের এই নিয়মকে সরিয়ে দিতে পারেনি। জিরাফের পূর্বপুরুষদেরকে উঁচু ডাল থেকে খাবার পেড়ে খাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করতে হতো বলেই আজকের জিরাফের গলা এত লম্বা, কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বার খামখেয়ালি নকশার কারণে নয়। জিরাফের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যাদের গলা লম্বা ছিল তারা অন্যদের তুলনায় বেশি খাবার সংগ্রহ করতে পারত। ফলশ্রুতিতে, তাদের সন্তান জন্ম দেবার এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দেয়ার সুযােগও ছিল বেশি। জিরাফ তো নয়ই, অন্য কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বাও নিশ্চয়ই কখনও বলেনি, ‘ইস, জিরাফের গলাটা অনেকখানি লম্বা করে দিলে বেচারা গাছের মগডাল থেকে পাতাগুলো আরামে চিবিয়ে খেতে পারত। দিই ওর গলাটা লম্বা করে।’ ডারউইনের তত্ত্বের সৌন্দর্যটা হলো, জিরাফের লম্বা গলার কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য তাকে কোন বুদ্ধিমান নকশার কথা কল্পনা করতে হয় না।

কোটি কোটি বছর ধরে, মানুষের কাছে কোনো বুদ্ধিমান নকশার অস্তিত্ব ছিল না। কারণ, এমন কোনো বুদ্ধিমত্তারই সন্ধান পাওয়া যায়নি যার পক্ষে প্রতিটি বস্তু ও প্রাণীর স্বরূপের নকশা তৈরি করা সম্ভব। কিছুদিন আগে পর্যন্তও পৃথিবীতে টিকে থাকা একমাত্র জীবিত বস্তু অণুজীবদের কথাই ধরা যাক। টিকে থাকার জন্য এদেরও আছে কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির শরীরে বসবাস করা একটি অণুজীব সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির একটি প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্য তার কোষের ভেতর আত্মীকরণ করতে পারে এবং অর্জন করতে পারে নতুন ক্ষমতা। নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা অণুজীবের এই নতুন ধরনের ক্ষমতা তৈরির একটি উদাহরণ। কিন্তু, এত অসাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও আমরা যতদূর জানি, অণুজীবের কোনো নিজস্ব চিন্তা-চেতনা নেই, নেই জীবনের কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করার কোনো ক্ষমতা।

একটা সময়ে এসে জিরাফ, ডলফিন, শিম্পাঞ্জি এবং নিয়ান্ডার্থালের মত প্রাণীগুলো বিবর্তনের মাধ্যমে চিন্তা-ভাবনা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা করার ক্ষমতা অর্জন করলো। কিন্তু, সেকালের একজন নিয়ান্ডার্থাল ক্ষুধা পেলে হাত বাড়িয়ে ধরা যায় এরকম কোন নাদুস-নুদুস, ধীরগতির মুরগির কথা কল্পনা করতে পারলেও, এই কল্পনাকে বাস্তবায়ন করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাকে ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রাকৃতিকভাবে বিবর্তিত হওয়া বন্য পাখি শিকারের উপরই নির্ভর করতে হতো।

আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে, কৃষি বিপ্লবের সময় থেকে প্রকৃতির উপর মানুষের এই অসহায় নির্ভরশীল অবস্থার পরিবর্তনের সূচনা হলো। যেসব মানুষেরা এতদিন নাদুস-নুদুস, ধীরগতির মুরগির কথা কল্পনা করত, তারা আবিষ্কার করল যে, যদি তারা সবচেয়ে মোটাসোটা মুরগিটার সাথে সবচেয়ে অলস, ধীরগতির মুরগিটির প্রজনন ঘটায়, তাহলে তাদের উৎপাদিত সন্তানের একই সাথে মোটা এবং অলস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এইভাবে উৎপন্ন বাচ্চাগুলো বড় হবার পর যদি তাদের নিজেদের মাঝে প্রজনন ঘটানো যায়, তাহলে আরও অনেক মোটাসোটা, অলস পাখির জন্ম হওয়া সম্ভব। এইভাবে জন্ম নিল মুরগির এমন এক নতুন প্রজাতি, প্রাকৃতিক বিবর্তন যাকে তৈরি করেনি, যার জন্ম হয়েছে একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর তৈরি করা নকশা থেকে। এই বুদ্ধিমান সত্তাটি কোনো দেবতা বা ঈশ্বর নন, এই প্রাণীটির নাম মানুষ।

কিন্তু, এত কিছু সত্ত্বেও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের তুলনায় নতুন প্রজাতির জীবের নকশা তৈরিতে মানুষের এই ক্ষমতা ছিল খুবই নগণ্য। মানুষ মুরগির প্রজননকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বড়জোর কিছু বৈশিষ্ট্যকে বাড়তে না দিয়ে এবং কিছু বৈশিষ্ট্যকে বাড়ার সুযোগ দিয়ে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারত। কিন্তু মুরগির জিনে অনুপস্থিত কোনো বৈশিষ্ট্যকে মুরগির মাঝে আনা তাদের জন্য অসম্ভব ছিল। অন্যভাবে বলতে গেলে জীবজগতে মানুষ ও মুরগির মাঝের এই সম্পর্ক, জীবজগতে আগে থেকে বিদ্যমান আরও কিছু সম্পর্কের থেকে খুব বেশি আলাদা কিছু ছিল না। মৌমাছি যেমন পরাগায়নের জন্য উজ্জ্বল ও রঙিন ফুলগুলোকেই বেছে নিয়ে তাদের বংশবিস্তারে সাহায্য করে, ঠিক তেমনি মানুষও মুরগির প্রজনন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে বেশি বেশি মোটাসোটা ও অলস মুরগির জন্ম নিশ্চিত করেছে।

৪০০ কোটি বছর ধরে টিকে থাকা প্রাকৃতিক বিবর্তনের আধিপত্য আজ সম্পূর্ণ নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি। দুনিয়াজুড়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারেই তৈরি করছেন জীবন্ত প্রাণী। তারা অপ্রতিরোধ্য গতিতে, দক্ষতার সাথে প্রাকৃতিক বিবর্তনের এতদিনের নিয়ম কানুনকে ভেঙেচুরে প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জন্ম দিচ্ছেন সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্যের। এডুয়ার্ডো কাক (Eduardo Kac) নামের একজন জীবকৌশল শিল্পী ২০০০ সালে একটি নতুন শিল্পকর্ম তৈরির পরিকল্পনা করলেন। সেটি হলো- অন্ধকারে ফ্লোরোসেন্ট বাতির মত করে জ্বলা একটি সবুজ জীবন্ত খরগোশ। এরপর, কাক একটি ফরাসি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং উপযুক্ত সম্মানীর বিনিময়ে তার পরিকল্পনা মাফিক খরগোশ তৈরির জন্য ফরমাশ দিলেন। সেখানকার বিজ্ঞানীরা একটি সাধারণ সাদা খরগোশের ভ্রুণ নির্বাচন করলেন, তারপর তার ডিএনএতে সবুজ রঙের আলোজ্বলা জেলিফিসের জিন সংযোগ করলেন। ম্যাজিক! জনাব কাক, এই নিন আপনার কাঙ্ক্ষিত আলোজ্বলা খরগোশ! কাক খরগোশটির নাম রাখলেন ‘অ্যালবা’।

প্রাকৃতিক বিবর্তনের নিয়মকানুন দিয়ে ‘অ্যালবা’র মতো খরগোশের অস্তিত্ব প্রমাণ করা একেবারেই অসম্ভব। সে মানুষের বুদ্ধিমান নকশার ফসল। একই সাথে, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে বুদ্ধিমান নকশা দিয়ে তৈরি যেসব অগণিত প্রাণীর জন্ম হবে, অ্যালবা তাদেরই অগ্রদূত। যদি ‘অ্যালবা’র মত নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীর গুরুত্ব পরিপূর্ণরূপে অনুধাবন করা সম্ভব হয় এবং তার আগেই যদি মানবজাতি পৃথিবীর বুক থেকে নিজেদেরকে নিশ্চিহ্ন করে না ফেলে, তাহলে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব কেবল আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে সীমাবদ্ধ না থেকে আরও অনেক বিস্তৃতি লাভ করবে। এটি হতে পারে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাবের পর থেকে ঘটা সবচেয়ে বড় জীববৈজ্ঞানিক বিপ্লব। প্রাকৃতিক বিবর্তনের চারশ কোটি বছর পরে, ‘অ্যালবা’ একটি নতুন মহাজাগতিক যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যে যুগে জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে বুদ্ধিমান নকশা। যদি সত্যিই সে যুগের সূচনা হয়, তবে তার আগেকার পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাসকেই মনে হতে পারে পৃথিবীতে নানারকম জীবন ভাঙা-গড়ার একটা খেলামাত্র। মহাজাগতিক গণ্ডিতে যেখানে এরকম একটি প্রক্রিয়া বুঝতে কোটি কোটি বছর লেগে যায়, যেখানে মানুষ মাত্র কয়েক হাজার বছরে সে রহস্যের কিনারা করে ফেলবে।

তবে এই ‘বুদ্ধিমান নকশা’ (intelligent design) তত্ত্ব পৃথিবীজুড়ে জীববিজ্ঞানীদের রোষের শিকার হচ্ছে। কারণ একদিকে এই তত্ত্ব ডারউইনের প্রচলিত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বিরোধী, অন্যদিকে এই তত্ত্ব আসলে এটাই প্রমাণ করতে চায় যে, এই সব জটিল জৈবিক নকশা আসলে কোনো এক বুদ্ধিমান স্রষ্টার পূর্বপরিকল্পনারই ফল। হ্যাঁ, এতদিন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সেসবের ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানীদের কথাই ঠিক। কিন্তু এই বুদ্ধিমান নকশা নিয়ে মানুষের কাজ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এই নতুন তত্ত্বকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

পৃথিবীজুড়ে জীববিজ্ঞানীরা ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্বের বিরোধিতায় মত্ত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবীর জীবজগতের অন্তহীন বৈচিত্র্য এবং জটিলতা ইঙ্গিত দেয় যে, এসব সৃষ্টির পেছনে একজন মহান বুদ্ধিমান স্রষ্টার হাত আছে, তার নকশাতেই এসব তৈরি হয়েছে। এই ধারণা ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক বিবর্তন’ তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ এর বিপরীতে বিজ্ঞানীদের এই ধারণা হয়ত এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে বিকাশ লাভ করা জীবকুলের জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু হয়ত আগামীর পৃথিবীতে উদ্ভব হওয়া জীবকুলের পেছনে থাকবে কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর নকশা। তখন, সে সময়ের জীবকুলের জন্য ‘ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্ব মেনে নেয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় থাকবে না।

এখন পর্যন্ত, ‘বুদ্ধিমান নকশা’ তিনভাবে ‘প্রাকৃতিক বিবর্তন’কে প্রতিস্থাপন করতে পারে- জীববৈজ্ঞানিক প্রকৌশল এর ব্যবহারের মাধ্যমে, সাইবর্গ (সাইবর্গ হলো জৈব ও অজৈব অংশ জোড়া দিয়ে তৈরি সত্তা) তৈরির মাধ্যমে বা যান্ত্রিক জীব তৈরির মাধ্যমে।

ইঁদুর ও মানুষ

জীববৈজ্ঞানিক প্রকৌশল হলো মানুষের সচেতন তৎপরতার মাধ্যমে কোন জীবকে কাকের শিল্পকর্মের মতো কোন নির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক ধারণা উপলব্ধি করার উপযোগী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে জীবটির কোন জৈবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে (যেমন একটি নতুন জিন প্রবেশ করিয়ে) তার আকার, আকৃতি, সক্ষমতা, চাহিদা কিংবা বাসনা বদলে দেবার একটি পদ্ধতি।

অবশ্য জীববৈজ্ঞানিক প্রকৌশল নতুন কোনো বিষয় নয়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ নিজের এবং অন্যান্য জীবকুলের পরিবর্তন সাধন করার জন্য এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। নপুংসক করে দেওয়ার ঘটনাটি এ ব্যাপারে একটি সহজ উদাহরণ হতে পারে। মানুষ প্রায় দশ হাজার বছর ধরে এঁড়ে গরু তৈরির জন্য ষাঁড়কে খোজা করে আসছে। এঁড়ে গরু ষাঁড়ের থেকে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও স্থির, তাই তাকে দিয়ে মাঠের লাঙ্গল টানানো সহজ। এমনকি উচ্চগ্রামের সুকণ্ঠী গায়ক কিংবা রাজা-বাদশাহের হারেম বা অন্তঃপুর পাহারা দেওয়ার জন্য মানুষ অনেককাল আগে থেকেই নিজ প্রজাতির তরুণ ছেলেদেরও খোজা করে আসছে।

কিন্তু, জীবের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে অর্জিত সাম্প্রতিক জ্ঞান বর্তমানের মানুষের জন্য এমন নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে যা আগের দিনের মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। মানুষ কাজে লাগাচ্ছে কোষীয় এমনকি নিউক্লিয়ার পর্যায়ে জীবের শারীরতত্ত্বের খুঁটিনাটি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আজকের দিনের মানুষ কেবল অন্য মানুষকে নপুংসক বানাতে পারে তাই নয়, বরং চাইলে তার অস্ত্রোপচার এবং হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে তার লিঙ্গগত পরিচয়ই পাল্টে দিতে পারে। এখানেই কিন্তু গল্পের শেষ নয়। ভেবে দেখুন, ১৯৯৬ সালের টেলিভিশন ও পত্রিকায় নিচের ছবিটি প্রকাশিত হলে পৃথিবীর মানুষের মাঝে সেটা কতখানি বিস্ময়, বিরক্তি এবং উদ্বেগের জন্ম দিয়েছিল।

৪৬। বিজ্ঞানীরা গরুর তরুণাস্থির কোষ দিয়ে একটি ইঁদুরের পিঠে একটি কান তৈরি করেছেন। এটা যেন বহুকাল আগে স্ট্যাডেল গুহায় তৈরি সিংহ-মানবের মূর্তির বাস্তব রূপ। ত্রিশ হাজার বছর আগে মানুষ নানারকম জীবের অঙ্গপ্রতঙ্গের মিশেল ঘটিয়ে নতুন জীব তৈরির কথা কেবল কল্পনাতেই ভাবতে পারত। আজ, মানুষ বাস্তব জগতেই তৈরি করতে পারে সুকুমারের হাঁসজারুকে।

এই ছবিটি কিন্তু চাঁদের মাঝে সাঈদীর ছবির মতো করে ফটোশপে তৈরি করা হয়নি। এটা একটা পুরোপুরি অবিকৃত আসল ইঁদুরের ছবি, যার পিঠে বিজ্ঞানীরা গরুর কার্টিলেজ কোষ স্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞানীরা এই কোষগুলো থেকে উৎপন্ন কলার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছেন এবং তাকে গড়ে তুলেছেন মানুষের কানের আকারে। এই প্রক্রিয়া হয়তো শিগগিরই বিজ্ঞানীদেরকে কৃত্রিম জৈবিক কান তৈরিতে সহায়তা করবে যা হয়তো অচিরেই স্থাপন করা হবে আমাদের শরীরে।১

এমনকি, জিনগত প্রকৌশলকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে এর চেয়েও অনেক বেশি আশ্চর্যজনক, অসংখ্য যুগান্তকারী আবিষ্কার করা সম্ভব। সে কারণেই, বিজ্ঞানের এ শাখাটি নীতিগত, রাজনৈতিক এবং আদর্শিক দিক থেকে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য প্রশ্নের। শুধু যে একেশ্বরবাদী, ধর্মপরায়ণ মানুষরাই একে ‘খোদার উপর খোদকারি’ ভাবছেন এমনটা নয়। অনেক স্বীকৃত নাস্তিক ব্যক্তিরাও একে আশঙ্কার চোখে দেখছেন। এসব ব্যাপারকে তারা দেখছেন প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের উপর বিজ্ঞানীদের হস্তক্ষেপ হিসেবে। প্রাণী অধিকার নিয়ে সোচ্চার কর্মীরা এসব গবেষণার জন্য ব্যবহৃত প্রাণীদের উপর চালানো কষ্টকর, অমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন, প্রাণীদের স্বাভাবিক ইচ্ছা ও চাহিদাকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র উৎপাদন বাড়ানোর জন্য খামারে তাদের লালনপালনের পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন জিনগত প্রকৌশলের উন্নতি একদিন তৈরি করবে ‘সুপারম্যান’, তখন বাকি মানুষদের ‘দাস’ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। জেরেমিয়ানরা জৈব-একনায়কের কথা কল্পনা করছেন যারা তৈরি করতে পারবে একই রকমের অসংখ্য ভয়হীন যোদ্ধা এবং অনুগত কর্মী। মানুষের ধ্বংস তখন অবধারিত হয়ে পড়বে। মানুষের সমষ্টিগত সাধারণ ধারণা হলো, হুট করে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন নতুন জীব তৈরি বা পরিবর্তন করার ক্ষমতা মানুষের যতটা বেড়েছে, এই ক্ষমতাকে সঠিকভাবে ব্যবহারের জ্ঞান এবং এর ভবিষ্যত প্রভাব সম্পর্কে সঠিকভাবে ধারণা করার ক্ষমতা মানুষের ততটা বাড়েনি।

ফলশ্রুতিতে, জিনগত প্রকৌশলের অপার সম্ভাবনার কণামাত্রই আমরা বর্তমানে ব্যবহার করতে পারছি। মূলত উদ্ভিদ, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া এবং পোকামাকড়ের মত রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন জীবগুলোকেই বর্তমানে এ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের অন্ত্রে বসবাসকারী ই-কোলাই (E. coli) ব্যাকটেরিয়ার কথা কথা ধরা যাক। অতীতে ই-কোলাই এর সংক্রমণে অনেক নানারকম রোগ-ব্যাধি দেখা গেলেও বর্তমানে এর জিনগত রূপান্তরের মাধ্যমে জৈব জ্বালানী তৈরিতে একে ব্যবহার করা হচ্ছে।২ ই-কোলাই এবং ছত্রাকের কিছু জাতকে রূপান্তরের মাধ্যমে ইনসুলিন তৈরি উপযোগী করে তোলা গেছে।৩ যার ফলে কমানো সম্ভব হয়েছে ডায়াবেটিস চিকিৎসার খরচ। মেরু অঞ্চলের মাছের একটি জিনকে আলুর জিনে সংযুক্ত করার ফলে সম্ভব হচ্ছে শীত সহিষ্ণু আলুর জাতের উদ্ভাবন।৪

এছাড়া কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীকে এই জিনগত প্রকৌশলের আওতায় আনা হয়েছে। প্রতিবছর ম্যাসটাইটিস (mastitis) নামের একটি রোগের কারণে গবাদিপশু শিল্পের কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়। ম্যাসটাইটিস রোগটি দুধ প্রদানকারী গাভীর ওলানের রোগ। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে রূপান্তরিত জিনের গরুদের নিয়ে গবেষণা করছেন যাদের দুধে থাকবে লাইসোস্ট্যাফিন (lysostaphin), একটি জৈব রাসায়নিক যা ম্যাসটাইটিস রোগের জন্য জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করতে পারে।৫ ইদানীং সবাই শুকরের মাংসে থাকা অস্বাস্থ্যকর চর্বির ব্যাপারে সচেতন হওয়ায় শুকরের মাংসের ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। তাদের জন্য সুখবর হলো, বিজ্ঞানীরা বর্তমানে একটি পরজীবী পোকা থেকে নেয়া জিন শুকরের শরীরে স্থাপন করে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। পরীক্ষা সফল হলে এই নতুন জিন শুকরের মাংসের ক্ষতিকর ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিডকে তার উপকারী জ্ঞাতিভাই ওমেগা ৩ এ রূপান্তরিত করতে পারবে।৬ আর মানুষের শুকরের মাংস খাওয়া নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না।

জিনগত প্রকৌশলের পরবর্তী প্রজন্মে উপকারী চর্বি সম্বলিত শুকর তৈরির ব্যাপারটি ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়াবে। জিন বিজ্ঞানীরা কেবল যে পরজীবীদের গড় আয়ু ছয় গুণ বাড়িয়েছেন তাই নয়, তারা চৌকস ইঁদুর তৈরিতেও সক্ষম হয়েছেন যাদের স্মৃতিশক্তি এবং শেখার ক্ষমতা সাধারণ ইঁদুরের থেকে অনেক বেশি। নেংটি ইঁদুর হলো ছোট লেজ ওয়ালা, নাদুস-নুদুস ইঁদুরের একটি প্রকরণ এবং এদের বেশির ভাগ প্রজাতিরই যৌনতার ক্ষেত্রে কোন বাছবিচার নেই।৭ কিন্তু বিজ্ঞানীরা নেংটি ইঁদুরের এমন একটি প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন যারা বিপরীত লিঙ্গের মাত্র একজনের সাথে দীর্ঘস্থায়ী এবং বিশ্বস্ত যৌন সম্পর্ক বজায় রাখে। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন তারা ইঁদুরের এই একজনের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য দায়ী জিনকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি স্বেচ্ছাচারী, বহুগামী নেংটি ইঁদুরের শরীরে এই জিনটি সংযুক্ত করা হলে সে যদি একটি একগামী, স্ত্রী অনুরক্ত নেংটি ইঁদুরে পরিণত হয়, তখন ‘জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে কেবল ইঁদুর ও মানুষ নতুন শারীরিক বৈশিষ্ট্যই অর্জন করে না বরং এর মাধ্যমে তাদের সামাজিক কাঠামোও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব’ এমনটা দাবি করাটা কি খুব বেশি অসংগত হবে?৮

ফিরে আসবে নিয়ান্ডার্থাল

কিন্তু জীনবিজ্ঞানীরা কেবল জীবিত প্রাণীকুলের পরিবর্তন সাধন করতে চান এমনটা নয়। তারা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদেরও উদ্ধারের চেষ্টা করেন। জুরাসিক পার্ক সিনেমার ডাইনোসরই যে উদ্ধার তালিকার একমাত্র সদস্য এমনটা নয়। রাশিয়া, জাপান ও কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি সাইবেরিয়ার বরফে জমে থাকা একটি প্রাচীন ম্যামথের জিনের সম্পূর্ণ গঠন জানতে পেরেছেন। বর্তমানে তারা আজকের দিনের একটি হাতির নিষিক্ত ডিম্বাণু নিয়ে, তার মধ্যে হাতির ডিএনএ কে নতুন তৈরি ম্যামথের ডিএনএ এ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাচ্ছেন। এরপর এই প্রতিস্থাপিত ডিএনএ এর ডিম্বাণুকে তারা হাতির গর্ভে স্থাপন করবেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২২ মাস পর গত ৫০০০ বছরের মধ্যে প্রথম ম্যামথের জন্ম হবে পৃথিবীতে।৯

কিন্তু, মানুষ কেবল ম্যামথেই সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ চার্চ সম্প্রতি প্রস্তাব করেছেন, নিয়ান্ডার্থাল জিনোম প্রজেক্ট যেহেতু সম্পন্ন হয়েছে, আমরা এখন চাইলেই ম্যামথের মত একটি নবগঠিত নিয়ান্ডার্থাল ডিএনএ সংযুক্ত একটি ডিম্বাণু মানুষের গর্ভাশয়ে স্থাপন করতে পারি। আর এটা করতে পারলে গত ত্রিশ হাজার বছরের মধ্যে পৃথিবী প্রথমবারের মত একটি নিয়ান্ডার্থাল শিশুর মুখ দেখবে। চার্চ দাবি করেছেন মাত্র ত্রিশ মিলিয়ন ডলার পেলেই তিনি এই কাজের দায়িত্ব নিতে রাজি আছেন। কয়েকজন নারীও এই কাজের জন্য স্বেচ্ছায়, বিনা পারিশ্রমিকে তাদের গর্ভাশয় ব্যবহারের সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন।১০

কিন্তু এতদিন পর নিয়ান্ডার্থাল দিয়ে আমরা কী করব? অনেকে দাবি করেন, আমরা যদি সত্যিকারের, জীবিত নিয়ান্ডার্থাল নিয়ে গবেষণা করতে পারি তবে হোমো সেপিয়েন্সের স্বাতন্ত্র্য বা অসাধারণত্ব নিয়ে বহু বছর ধরে চলে আসা অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারব। একটি নিয়ান্ডার্থালের সাথে একটি হোমো সেপিয়েন্সের মস্তিষ্কের তুলনা করে আমরা হয়তো বুঝতে পারব কোন জৈবিক প্রক্রিয়া আমাদের অনুভূতি, চেতনা এসবের জন্য দায়ী। এবং এখানে একটি নৈতিক দায়বদ্ধতারও ব্যাপার আছে। অনেকেই দাবি করেন হোমো সেপিয়েন্স তথা আমরাই নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তির জন্য দায়ী। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে তাদের নতুন করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও আমাদের উপরই বর্তায়। আজকের মানুষের সমাজে নিয়ান্ডার্থাল অন্যভাবেও সহায়ক হতে পারে। অনেক শিল্পপতিই তাদের কারখানায় নিয়ান্ডার্থালদের নিতে চাইবেন। কারণ, তারা হয়তো একজন নিয়ান্ডার্থালকে বেতন দেয়ার মাধ্যমে তাকে দিয়ে দুইজন সেপিয়েন্সের সমান কাজ করিয়ে নিতে পারবেন।

কিন্তু শুধু নিয়ান্ডার্থালেই থেমে থাকলে চলবে কেনো? এরপর কী আমরা চাইব না ঈশ্বরের বানানো মানুষের নকশা তৈরির খেরোখাতায় হাত রাখতে আর সেই নকশার উন্নতি ঘটিয়ে উন্নততর সেপিয়েন্স তৈরি করতে? মানুষের সবরকম সামর্থ্য, চাহিদা এবং কামনার একটি জিনগত ভিত্তি বিদ্যমান এবং মানুষের জিনগত পরিচয় নেংটি ইঁদুরের থেকে খুব বেশি জটিল নয়। ইঁদুরের জিনোমে ২৫০ কোটি নিউক্লিওবেস থাকে, যেখানে মানুষের জিনোমে থাকে ২৯০ কোটি বেস, তার মানে মানুষের জিনভিত্তিক পরিচিতির তালিকা ইঁদুরের জিনভিত্তিক পরিচয়ের থেকে মাত্র ১৪ শতাংশ বড়।১১ বর্তমান শতকের মাঝামাঝি সময়ের দিকে অর্থাৎ আর মাত্র কয়েক দশক পরে জিনগত প্রকৌশল এবং জৈব প্রকৌশলের অন্যান্য শাখাগুলো কেবল যে আমাদের মনস্তত্ত্ব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং প্রত্যাশিত আয়ু বাড়ানোর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করবে তাই নয়, মানুষের বুদ্ধিভিত্তিক এবং আবেগিক দক্ষতার পরিবর্তনেও এদের থাকবে উল্লেখযোগ্য অবদান। জিনগত প্রকৌশল যদি চৌকস ইঁদুর তৈরি করতে পারে তবে চৌকস মানুষ তৈরিতে বাধা কোথায়? আমরা যদি একজন সঙ্গীতে সন্তুষ্ট নেংটি ইঁদুর তৈরি করতে পারি, তবে একজন মানুষও তার একগামিতা নিশ্চিত করতে জিনগত পরিবর্তনের এই সুযোগ নেবে না কেনো?

বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লব হোমো সেপিয়ন্সের মনস্তত্ত্ব কিংবা মস্তিষ্কের বাহ্যিক আকার আকৃতির কোনোরকম দৃশ্যমান পরিবর্তন ছাড়াই সেপিয়েন্সের মত একটি গুরুত্বহীন নরবানর প্রজাতিকে পৃথিবীর প্রভুতে পরিণত করেছে। প্রকৃতপক্ষে, এই বিশাল পটপরিবর্তনের জন্য মস্তিষ্কের কাঠামোর কিছু অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনই যথেষ্ট ছিল। এরকম আরেকটি ছোটখাটো পরিবর্তনই হয়তো একটি নতুন বুদ্ধিভিত্তিক বিপ্লবের সূচনা করবে, তৈরি করবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বুদ্ধিমত্তা বা চেতনা, আর হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রজাতিটির খোলনলচে পুরোপুরি পালটে দিয়ে তৈরি করবে ভিন্ন ধরনের কোন প্রজাতি।

একথা সত্য, এইসব পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধিভিত্তিক উৎকর্ষ আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি, কিন্তু ভবিষ্যতের ‘অতিমানব’ তৈরির পথে আমাদের সামনে দুর্লঙ্ঘ্য কোন প্রযুক্তিগত বাধাও দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। মূলত দার্শনিক এবং রাজনৈতিক যুক্তি-তর্ক এবং বাধাগুলোই মানুষকে নিয়ে গবেষণার গতিকে খানিকটা মন্থর করেছে। এ সংক্রান্ত দার্শনিক দাবিগুলো যতই যুক্তিসঙ্গত হোক, মানুষের সামনে যদি দীর্ঘতর জীবন, জীবনঘাতী রোগের চিকিৎসা এবং তার বুদ্ধিভিত্তিক এবং আবেগিক দক্ষতা বৃদ্ধির মূলা ঝোলানো থাকে, তবে এসব দার্শনিক বাধা মানুষ নিয়ে গবেষণাকে খুব বেশি বিলম্বিত করতে পারবে বলে মনে হয় না।

কী ঘটবে যদি আমরা যদি স্মৃতিভ্রষ্টতাজনিত অসুখ আলঝেইমার এর চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এমন কিছু আবিষ্কার করে ফেলি যা সুস্থ মানুষকে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দিতে পারে ? মানুষের পক্ষে কি তখন এই সংক্রান্ত গবেষণা স্থগিত রাখা সম্ভব হবে? একবার যদি এই চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েই যায়, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কি পারবে সুস্থ একজন মানুষকে এই চিকিৎসা নিয়ে অতিমানবীয় স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়া থেকে বিরত রেখে কেবল আলঝেইমার রোগীদের মাঝেই তার ব্যবহার সীমাবদ্ধ রাখতে?

জৈব-প্রকৌশল সত্যিই পৃথিবীর বুকে আবার নিয়ান্ডার্থালদের ফিরিয়ে আনতে পারবে কিনা সে ব্যাপারটি এখনও অনেকটাই অস্পষ্ট, তবে এটি খুব সম্ভবত পৃথিবীতে হোমো সেপিয়েন্সের নাট্যমঞ্চের যবনিকা টেনে দেবে। না, হোমো সেপিয়েন্সের জিনগত পরিবর্তন যে তার দৈহিক মৃত্যু ঘটাবে এমনটা নয়। কিন্তু, জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা হয়তো হোমো সেপিয়েন্সকে এতটাই পাল্টে ফেলবো যে তখন আমাদেরকে হোমো সেপিয়েন্স বলে ডাকাটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।

যান্ত্রিক জীবন

আরেকটি নতুন প্রযুক্তি জীবনের প্রচলিত নিয়মকানুনকে পাল্টে দিতে পারে, সেটা হলো- সাইবর্গ প্রকৌশল (cyborg engineering)। সাইবর্গ হলো মানুষ এবং যন্ত্রের মিশেলে গড়া একপ্রকার প্রাণী, যেমন ধরুন কৃত্রিম হাতওয়ালা মানুষ। আজকের দিনে আমরা সকলেই কমবেশি চশমা, কৃত্রিম হৃদযন্ত্র, পা সোজা রাখার যন্ত্র এমনকি কম্পিউটার আর মোবাইলের সাহায্যে (শেষের দুটি আমাদের মস্তিষ্কের উপর থেকে বাড়তি কাজের বোঝা কমায়) আমাদের ইন্দ্রিয়ের কাজের ক্ষমতা বাড়িয়ে নিয়েছি বা ইন্দ্রিয়গুলোর উপর চাপ কমিয়েছি। সে অর্থে আমরাও কমবেশি বায়োনিক (bionic) মানুষ। আমরা এখন সাইবর্গে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি, যখন অজৈব অংশগুলো আমাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হবে এবং বদলে দেবে আমাদের কর্মক্ষমতা, ইচ্ছা, ব্যক্তিত্ব এবং স্বকীয় পরিচয়।

“ডিফেন্স এ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি (DARPA)” নামে একটি আমেরিকান গবেষণা সংস্থা কীটপতঙ্গকে সাইবর্গ বানানোর চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য হলো মাছি বা তেলাপোকার শরীরে ইলেকট্রনিক চিপ, সনাক্তকারী যন্ত্র এবং প্রসেসর বসানো যার মাধ্যমে মানুষ বা কোন যন্ত্রচালিত অপারেটরের পক্ষে দূর থেকে এসব কীটপতঙ্গের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং পতঙ্গগুলোকে তথ্য সংগ্রহ এবং সরবরাহের কাজে ব্যবহার করা যাবে। এরকম একটি মাছি সহজেই শত্রুঘাঁটির হেডকোয়ার্টারের দেয়ালে বসে শত্রুদের গোপন পরিকল্পনার কথা শুনে ফেলতে পারবে এবং মাকড়সা বা অন্য কোন পতঙ্গ মাছিটিকে খেয়ে না ফেললে সেসব তথ্য সহজেই প্রতিপক্ষের শিবিরে সরবরাহ করতে পারবে।১২ ২০০৬ সালে আমেরিকার “নেভাল আন্ডার সি ওয়ারফেয়ার সেন্টার (NUWC)” সাইবর্গ হাঙর তৈরির ঘোষণায় জানায়- ‘NUWC মাছের মাথায় প্রতিস্থাপনের জন্য একটি ট্যাগ বা যন্ত্র বানাচ্ছে যার কাজ হবে মাছের মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে তার আচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা।’ এ প্রকল্পের উদ্যোক্তারা মনে করেন, এর মাধ্যমে তারা হাঙরের প্রাকৃতিকভাবে অর্জিত চৌম্বকক্ষেত্র সনাক্ত করার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সাগরের তলদেশে সাবমেরিন এবং চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বোমা সনাক্ত করতে সক্ষম হবেন। হাঙরের এই সনাক্তকরণ ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলে সেটা মানুষ নির্মিত যে কোন সনাক্তকারী যন্ত্রের থেকে অনেক ভালো ফলাফল দেবে।১৩

সেপিয়েন্স নিজেও ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে সাইবর্গে। কানে শোনার সহায়ক যন্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক গুলোকে অনেক সময় ‘বায়োনিক কান’ নামে অভিহিত করা হয়। এই যন্ত্রগুলো কানের সাথে যুক্ত করা হলে তারা কানের বর্হিভাগ থেকে একটি মাইক্রোফোনের সাহায্যে শব্দ শোনে। তারপর যন্ত্রটি শব্দকে ছেঁকে এর থেকে মানুষের শব্দকে সনাক্ত করে এবং সেই শব্দকে তড়িৎ সংকেতে রূপান্তরিত করে সরাসরি মানুষের কেন্দ্রীয় শব্দবাহী স্নায়ুতে পাঠিয়ে দেয়, সেখান থেকে এই সংকেত সরাসরি পৌঁছে যায় মস্তিষ্কে।১৪

“রেটিনা ইমপ্ল্যান্ট” নামে সরকারি অনুদানে চলা একটি জার্মান প্রতিষ্ঠান চোখে বসানোর জন্য একটি কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি করছে যেটি অন্ধ মানুষকে আংশিক দৃষ্টি দিতে সহায়তা করবে। দৃষ্টিহীন মানুষের চোখের ভিতরে বসানো হবে একটি ছোট মাইক্রোচিপ। এই মাইক্রোচিপে বসানো আলোক সংবেদী কোষ চোখের উপর পড়া আলোকে পরিণত করবে বৈদ্যুতিক সংকেতে, যেটি উদ্দীপিত করবে চোখের রেটিনার সাথে সংযুক্ত স্নাযু কোষগুলোকে। এসব কোষে তৈরি হওয়া উদ্দীপনা উদ্দীপিত করবে মস্তিষ্ককে এবং সেখানে এই সংকেতগুলো দৃশ্যানুভূতিতে পরিণত হবে। বর্তমানে এই প্রযুক্তি একজন অন্ধ ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে তার নিজের অবস্থান সনাক্ত করতে, অক্ষর চিনতে এমনকি মানুষের মুখ সনাক্ত করতেও সাহায্য করে।১৫

২০০১ সালে জেস সুলিভান নামের একজন আমেরিকান বিদ্যুৎকর্মী এক দুর্ঘটনায় তার দুটি হাতই হারান। বর্তমানে তিনি শিকাগোর পুর্নবাসন কেন্দ্রের সুবাদে দুটি কৃত্রিম হাত ব্যবহার করেন। জেসের ব্যবহার করা কৃত্রিম হাত দুটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কেবলমাত্র মস্তিষ্কের চিন্তা দিয়েই সেগুলোকে ব্যবহার করা যায়। জেসের মস্তিষ্ক থেকে আসা স্নায়বিক সংকেতগুলো মাইক্রো-কম্পিউটারের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত হয় এবং সে সংকেতের উপর নির্ভর করেই কৃত্রিম হাত দুটো নড়াচড়া করে। একজন সাধারণ মানুষ একটি হাত ওঠানোর সময় অবচেতন মনে যেরকম ভাবেন, জেসও একই রকম চিন্তা করেন এবং তার হাতটি উপরে উঠে যায়। এই কৃত্রিম হাত দুটির কাজের ক্ষমতা জৈবিক হাতের তুলনায় অনেক কম, কিন্তু তা দিয়েই জেসের দৈনন্দিন জীবনের কাজ চলে যায়। এরকমই একটি বায়োনিক হাত সম্প্রতি ক্লডিয়া মিশেল নামক একজন আমেরিকান সৈনিকের শরীরে সংযুক্ত করা হয়েছে যিনি একটি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় তার হাত হারিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, খুব শীঘ্রই কৃত্রিম হাত শুধু মানুষের ইচ্ছামতো নড়াচড়া করতে পারবে তাই নয়, কৃত্রিম হাত মস্তিষ্কেও সংকেত পৌছে দিতে পারবে। তার অর্থ হলো, এটি হাত-পা হারানো একটি মানুষকে কেবল চলতেই সাহায্য করবে না, তাকে ফিরিয়ে দেবে স্পর্শের স্বাদ!১৬

৪৭। জেস সালিভান এবং ক্লডিয়া মিশেল পরস্পরের হাত ধরে আছে। তাদের এই যান্ত্রিক হাতের বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল, এটা পরিচালিত হয় শুধুমাত্র চিন্তা দিয়ে।

বর্তমানে এসব বায়োনিক হাত-পায়ের ক্ষমতা আমাদের স্বাভাবিক জৈবিক হাত-পায়ের তুলনায় নগণ্য, কিন্তু এই ক্ষমতার উন্নতির সম্ভাবনা অসীম। উদাহরণস্বরূপ, একটি বায়োনিক হাতকে এত বেশি শক্তিশালী করে তোলা সম্ভব যে একজন নামজাদা কুস্তিগীরের হাতের শক্তিও তার কাছে অত্যন্ত নগণ্য বলে মনে হবে। এছাড়াও বায়োনিক হাতের সুবিধা হলো, কয়েক বছর পরপরই এগুলো পাল্টানো যায়, শরীর থেকে খুলে রেখে দূর থেকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

সাম্প্রতিককালে নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এই দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারটিকে একটি বানরের মস্তিষ্কে ইলেকট্রোড বসিয়ে হাতে কলমে দেখিয়েছেন। ইলেকট্রোডগুলো বানরের মস্তিষ্ক থেকে সংকেত সংগ্রহ করে অন্য যন্ত্রে পাঠিয়ে দেয়। বানরগুলোকে চিন্তার মাধ্যমে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন, বায়োনিক হাত এবং পা নাড়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অরোরা নামে এরকম একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বানর একই সময়ে তার দুটি জৈবিক হাত নড়ানোর পাশাপাশি চিন্তা দিয়ে দূরে রাখা আরেকটি বায়োনিক হাত নাড়া শিখে ফেলে। অনেকটা হিন্দু দেবদেবীর মতোই অরোরার এখন দুটো নয়, তিনটি হাত এবং তৃতীয় হাতটি থাকতে পারে অন্য কোন ঘরে, এমনকি অন্য কোন শহরেও। সে নর্থ ক্যারোলিনার গবেষণাগারে বসে একহাতে পিঠ এবং অন্য হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে একই সময়ে তৃতীয় হাত দিয়ে নিউইয়র্কে কলা চুরি করতে পারে (যদিও দূরের হাতের এই চুরি করা কলা দূর থেকেই খাবার প্রক্রিয়াটি এখনও মানুষের স্বপ্নই রয়ে গেছে)। ২০০৮ সালে ইডো য়ানামের এরকম আরেকটি বানর নর্থ ক্যারোলিনার চেয়ার বসে জাপানের, কিয়োটেতে রাখা বায়োনিক পা নাড়ানোর মাধ্যমে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করে। এই বায়োনিক পা গুলোর ওজন ছিল ইডোয়ার শরীরের ওজনের প্রায় বিশ গুণ।১৭

“লকড-ইন সিনড্রোম” (Locked-in syndrome) হলো এমন একটি অবস্থা যখন মানুষের মস্তিষ্ক কর্মক্ষম থাকলেও মানুষ তাদের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়ানোর সবরকম বা প্রায় সব ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলে। এখন পর্যন্ত এই সিনড্রোমে ভোগা রোগীরা কেবলমাত্র চোখের মণির সামান্য নড়াচড়ার মাধ্যমেই বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। এরকম কিছু রোগীর মস্তিষ্কে সংকেত সংগ্রাহক ইলেকট্রোড বসিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। চেষ্টা করা হয়েছে মস্তিষ্কের সংকেতকে কেবলমাত্র যান্ত্রিক হাতের মত বাহ্যিক বস্তুর নড়াচড়ার মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে শব্দেও রূপ দেয়ার। এরকম প্রচেষ্টা সফল হলে, লকড-ইন সিনড্রোমের রোগীরা সরাসরি বাইরের দুনিয়ার সাথে কথা বলতে পারবেন এবং তখন আমরা মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলার ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারব।১৮

এই ধরনের বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৈপ্লবিক হলো মস্তিষ্ক আর কম্পিউটারের মধ্যে সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা। এই পদ্ধতির ফলে কম্পিউটার সরাসরি মানুষের মস্তিষ্কের সংকেত বুঝতে সক্ষম হবে এবং কম্পিউটার নিজে মানুষের মস্তিষ্কে বোধগম্য সংকেত পাঠাতে পারবে। এরকম একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে যদি সরাসরি একটি মস্তিষ্ককে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করা যায় তাহলে ব্যাপারটা কেমন হবে? এ সংযোগ পদ্ধতি দিয়ে যদি একাধিক মস্তিষ্ককে সরাসরি যুক্ত করে একটি মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক গঠন করা হয়, কেমন হবে সেটা? যদি একটি মস্তিষ্ক একাধিক মস্তিষ্কের স্মৃতিভাণ্ডারের সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে তখন একক মানুষের স্মৃতি, তার চেতনা আর অস্তিত্বকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এরকম একটি পরিস্থিতিতে একজন সাইবর্গ কোনোদিনও না শুনে, না পড়ে, কল্পনা না করে অন্যের মস্তিষ্কে জমা রাখা একটি ঘটনাকে মনে করতে পারবেন এবং সেই ঘটনাকে নিশ্চিতভাবে তার নিজের স্মৃতি বলেই মনে হবে। মস্তিস্কগুলো একসাথে সরাসরি যুক্ত থাকলে মানুষের লিঙ্গগত পরিচয়ের রূপটাই বা কেমন দাঁড়াবে? ‘আমি’ বলতে তখন কী বোঝাবে? একজন মানুষের একান্ত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কি থাকবে? মানুষ কী করে তার স্বপ্নের পেছনে দৌড়াবে যদি সেই স্বপ্ন তার মস্তিষ্কের অংশ না হয়ে সমষ্টিগত মস্তিষ্কের স্মৃতিতে জমা স্বপ্নভাণ্ডারের অংশ হয়?

এরকম একটি সাইবর্গ আর মানুষ থাকবে না, সম্ভবত সেটা জৈবিক উপাদানে গড়াও হবে না। এটা হবে সম্পূর্ণ নতুন কিছু। এটা মূলগতভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সত্তা হবে যার দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে আমাদের কোন রকম ধারণা নেই।

অন্য জীবন

জীবনের নিয়মগুলোকে পাল্টানোর তৃতীয় উপায় হতে পারে সম্পূর্ণ যান্ত্রিক সত্ত্বা তৈরি করা। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হতে পারে নিজেরাই স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হতে পারে এমন কিছু কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ভাইরাস।

বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানের জগতের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় বিষয় হলো জেনেটিক প্রোগ্রামিং (genetic programming)। এই শাখাটি জীবের জীনগত বিবর্তনের নিয়মগুলিকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। অনেক প্রোগ্রামারই এমন একটি প্রোগ্রাম তৈরির স্বপ্ন দেখেন যেটি তার স্রষ্টার সাহায্য ছাড়াই নতুন নতুন জিনিস নিজে থেকে শিখতে পারবে এবং নিজে বিবর্তিত হতে পারবে। এক্ষেত্রে প্রোগ্রামার কেবল প্রোগ্রামটিকে প্রাথমিকভাবে চলার মত দিকনির্দেশনা দেবেন, কিন্তু এরপরে প্রোগ্রামটি নিজেকে কোন উপায়ে বিবর্তিত করবে সে সম্পর্কে তার স্রষ্টার বা অন্য কোনো মানুষের কোন ধারণা থাকবে না।

এরকম এক ধরনের প্রোগ্রামের নমুনার সাথে আমরা ইতোমধ্যেই কমবেশি পরিচিত- এদের নাম কম্পিউটার ভাইরাস। এরকম নামকরণের কারণ হলো, উৎপত্তির পর এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, নিজের কোটি কোটি অনুলিপি তৈরি করে, তাকে ধরার জন্য ধেয়ে আসা অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামগুলোর সাথে লড়াই করে টিকে থাকার চেষ্টা করে এবং অন্যান্য ভাইরাসগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে সাইবার জগতে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। একদিন এই ভাইরাস প্রোগ্রামটি নিজের অনুলিপি তৈরির সময় একটু গরমিল করে ফেলে- অনেকটা জৈব মিউটেশনের মতো। এই মিউটেশন সম্ভবত এই কারণে হয় যে প্রোগ্রামার এটিকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে একটি মাঝে মাঝে দৈবচয়নে অনুলিপি তৈরির সময় কিছু ভুলচুক করে ফেলে। সম্ভবত এই মিউটেশন কোন অনিয়মিত, দৈবভাবে ঘটা কোন ভুলের ফসল। যদি এই বিবর্তিত ভাইরাসটি তার কম্পিউটারকে দখল করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে আক্রমণকারী অ্যান্টিভাইরাসকে প্রতিহত করতে অধিকতর সক্ষম হয়, তাহলে সেই বিবর্তিত ভাইরাসটি সমস্ত সাইবার জগত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিবর্তিত ভাইরাসটি টিকে যায় এবং নতুন নতুন অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে ভাইরাসের বিবর্তন প্রক্রিয়াটিও চলতে থাকে এবং একসময় সাইবার জগৎ এমন চরিত্রের ভাইরাসে ভরে যায় যাকে কোন প্রোগ্রামার বানায়নি, যার জন্ম সম্ভব হয়েছে ভাইরাসের অজৈব বিবর্তনের ফলে।

এগুলোকে কী জীবন্ত সত্তা বলা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে কাকে আমরা ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে পারি তার উপর। তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তারা একটি নতুন বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফসল, যে বিবর্তন প্রক্রিয়া জৈব বিবর্তনের নিয়ম কানুন এবং সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত।

আরেকটি সম্ভাবনার কথা চিন্তা করা যাক। ধরুন, আপনি আপনার মস্তিষ্কের যাবতীয় তথ্য ও স্মৃতি একটি বহনযোগ্য হার্ড ডিস্কে জমা করতে পারেন এবং আপনার ল্যাপটপে সেই চিন্তা ও তথ্যগুলো ব্যবহার করতে পারেন। আপনার ল্যাপটপটি কী তখন একটি সেপিয়েন্সের মতই ভাবতে এবং অনুভব করতে পারবে? যদি পারে, সেটি কি আপনি হবেন না অন্য কেউ? কেমন হবে যদি কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে আত্নপরিচয়, চেতনা এবং স্মৃতি সম্বলিত একটি সম্পূর্ণ ডিজিটাল মন বানিয়ে ফেলে? আপনি যখন এই প্রোগ্রামটি আপনার কম্পিউটারে চালাবেন, তখন সেটি কি একটি নতুন মানুষ? আপনি যদি প্রোগ্রামটিকে কম্পিউটার থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেন, আপনাকে কি মানবহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে?

হয়তো আমরা খুব শিগগিরই এসব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব। ২০০৫ সালে “হিউম্যান ব্রেইন প্রজেক্ট” নামে একটি প্রকল্পের সূচনা হয়। এই প্রকল্প কম্পিউটারের ভেতর একটি পূর্ণাঙ্গ মানব মস্তিষ্ক তৈরি করার আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছে। যেখানে কম্পিউটারের ভিতরকার ইলেকট্রিক সার্কিটগুলো মানব মস্তিষ্কের নিউরনের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে। এই প্রকল্পের পরিচালক দাবি করেছেন, যদি যথাযথ অর্থায়ন পাওয়া যায় তবে এক থেকে দুই দশকের মধ্যে কম্পিউটারের ভেতরে মানব মস্তিষ্কের সমকক্ষ একটি মস্তিষ্ক তৈরি করা সম্ভব যেটি একটি মানুষের মতই কথা বলতে এবং আচরণ করতে পারবে। এই প্রকল্প সফল হলে, চারশ কোটি বছর পর জীবন জৈব যৌগসমূহের সীমাবদ্ধ জগৎ ছাড়িয়ে অজৈব যৌগের অসীম জগতে প্রবেশ করবে। জীবন এমন সব আকার ও আকৃতিতে আবির্ভূত হবে যার কল্পনা করাও বর্তমানের মানুষের পক্ষে অসম্ভব। যদিও অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বর্তমানের ডিজিটাল কম্পিউটার এবং মানুষের মস্তিষ্ক ও চিন্তা ভিন্নরকম ভাবে কাজ করে। সেটা সত্যি হলে বর্তমান প্রযুক্তির কম্পিউটার দিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানব মস্তিষ্ক গড়ে তোলা হয়তো সম্ভব হবে না। তবে সে চেষ্টা শেষ হবার আগে পর্যন্ত এ সংক্রান্ত ঢালাও মন্তব্য করাটা বোকামির সামিল হতে পারে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, ২০১৩ সালে এই প্রকল্পটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে ১০০ কোটি ইউরো অনুদান লাভ করেছে।১৯

সিংগুলারিটি

বর্তমানে, ভবিষ্যতের অসংখ্য সম্ভাবনার একটি ক্ষুদ্র অংশ সম্পর্কেই কেবল আমরা ধারণা করতে পারছি। কিন্তু তাতেই, এই ২০১৪ সালে এসে, মানুষের সংস্কৃতিকে জীববিজ্ঞানের গণ্ডি ছাড়িয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে হচ্ছে। মানুষ কেবল চারপাশের পৃথিবী নয়, বাহিরের পৃথিবী ছাড়িয়ে নিজেদের শরীর ও মনের ভিতর ও বাহির পালটে দেয়ার ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। ফলশ্রুতিতে জ্ঞানের অনেক শাখা আর প্রচলিত নিয়ম কানুনই এখন নতুন নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। আইনজীবীদের নতুন করে পরিচয় এবং গোপনীয়তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, সরকারকে গোড়া থেকে ভাবতে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা আর সম অধিকার নিয়ে, খেলার নিরপেক্ষতা এবং অর্জনকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করতে হচ্ছে ক্রীড়া সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, অবসর ভাতা এবং শ্রমবাজারের আগে যে বয়স ছিল ষাট, এখন তাকে ত্রিশের সমান হিসেবে ভাবতে হচ্ছে। তাদের সবাইকে নীতি নির্ধারণের সময় জৈব প্রকৌশল, সাইবর্গ এবং অজৈব জীবনের মত ব্যাপারগুলোকে মাথায় রাখতে হচ্ছে।

মানুষের প্রথম জিনোম নকশা তৈরি করতে সময় লেগেছিল পনের বছর, আর খরচ হয়েছিল ৩০০ কোটি ডলার। আজকে মাত্র কয়েকশ ডলার খরচ করে মাত্র কয়েক সপ্তাহে আপনি আপনার জিনের নকশা জেনে নিতে পারেন। শুরু হয়েছে ব্যক্তিগত ওষুধপত্রের যুগ- এমন ওষুধ যা কেবল আপনার ডিএনএর সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অচিরেই আপনার পারিবারিক চিকিৎসক অনেকটা নিশ্চয়তার সাথেই আপনাকে জানিয়ে দিতে পারবেন ভবিষ্যতে আপনার যকৃৎ ক্যান্সারের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে, হৃদরোগ নিয়ে আপনার তেমন না ভাবলেও চলবে, সেটার সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি নির্ণয় করতে পারবেন যে ওষুধটি শতকরা ৯২ জনের জন্য কাজ করে, সেটি আপনার জন্য কার্যকর হবে না। অপরদিকে, যে ওষুধটি অন্যদের জন্য বিষতুল্য, সেটাও আপনার জন্য যর্থার্থ রূপে কাজ করবে। নিখুঁত ওষুধপত্রের দিন আমাদের সামনেই কড়া নাড়ছে।

কিন্তু, স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এতসব উন্নতি অনেক নৈতিক প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে। ন্যায়শাস্ত্রবিদ এবং আইনবিদদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে ডিএনএ’র সাথে জড়িত ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি নিয়ে। মানুষের ডিএনএ নকশা জানা সহজলভ্য হওয়ায় জীবনবীমা কোম্পানিগুলো কি সবার কাছে থেকে তাদের ডিএনএর নকশা দাবি করবেন? যার জিনে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের সম্ভাবনা বেশি পাওয়া যাবে তার থেকে বেশি পরিমাণ বীমার অর্থ দাবি করবে? চাকরিপ্রার্থীদেরকে কি চাকরির আবেদনপত্রের বদলে ডিএনএর নকশা ফ্যাক্স করে পাঠাতে হবে? একজন চাকরিদাতা কি জিনের নকশা দেখে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করবেন? কোনো প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগের ক্ষেত্রে জিনগত বৈষম্যের জন্য কি অভিযুক্ত করা যাবে? যে প্রতিষ্ঠানটি নতুন জীব বা নতুন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আবিষ্কার করবে, সে কি তার ডিএনএ নকশার পেটেন্ট করতে পারবে? এটা স্পষ্ট যে, একজন মানুষ একটি মুরগির মালিক হতেই পারে, কিন্তু একজন মানুষের হাতে একটি পুরো প্রজাতির মালিকানা তুলে দেয়া উচিত হবে কি?

এই ধরনের অনিশ্চয়তাগুলো গিলগামেশ প্রকল্পের (Gilgamesh Project) নৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব এবং আমাদের অতিমানব তৈরি করার নতুন সক্ষমতার সম্ভাবনার কাছে স্তিমিত হয়ে আছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা, সারা বিশ্ব জুড়ে বিদ্যমান সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প, জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প এবং বিশ্বব্যাপী জাতিগুলোর সংবিধান স্বীকার করে নেয় যে, যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া এবং জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা একটি মানবীয় সমাজের আবশ্যক বৈশিষ্ট্য। যতক্ষণ পর্যন্ত ওষুধগুলো কেবল রোগ প্রতিরোধ এবং অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার কাজে ব্যবহৃত হত, ততদিন পর্যন্ত এ ব্যবস্থা নিয়ে কারও মনে কোনো সংশয় ছিল না। যখন ওষুধগুলো মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে তখন কেমন হবে একটি দেশের স্বাস্থ্য প্রকল্প? সব মানুষকে কি সমান সুবিধা নিয়ে সমানভাবে তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা হবে, নাকি কেবল ক্ষমতাবানরা এসবের সুবিধা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করে এক একজন অতিমানব হয়ে উঠবে?

আধুনিক যুগের শেষভাগে এসে ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা সব মানুষের জন্য কিছুটা হলেও সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারার জন্য গর্ববোধ করতে শুরু করেছি। যদিও এই সময়েই তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অসমতা তৈরির সুযোগ। ইতিহাসের পুরোটা সময় জুড়ে অভিজাত শ্রেণীর লোকজন নিজেদেরকে সমাজের নীচু স্তরে বসবাসকারী মানুষদের থেকে শক্তিশালী, চতুর এবং উৎকৃষ্ট বলে দাবি করে এসেছে। তাদের এই দাবি নিছক তাদের ক্ষমতার দম্ভ ছিল, তার কোন জীববৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। কৃষকের ঘরে জন্মানো একজন শিশু এবং রাজপ্রাসাদে জন্ম নেয়া একজন শিশুর সমান বুদ্ধিমান হয়ে জন্ম নেয়ার সুযোগ ছিল। স্বাস্থ্যসেবার নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ফলে ধনিক শ্রেণীর এতদিনের এই মিথ্যে অহংকার বস্তুগত সত্যে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

এটা কোন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়। অনেক কল্পবিজ্ঞানের গল্পেই আমরা দেখতে পাই এমন একটি বিশ্বকে যেখানে হুবহু আমাদের মত দেখতে মানুষ থাকে, কিন্তু তাদের থাকে উন্নততর প্রযুক্তি, আলোর বেগে চলা মহাকাশযান আর লেজার বন্দুক। এসব গল্পের মূল নীতিগত এবং রাজনৈতিক সংকটের দিকগুলো কিন্তু আমাদের বর্তমান পৃথিবী থেকেই নেওয়া, লেখক কেবল ভবিষ্যতের কল্পিত পটভূমিতে আবেগ এবং সামাজিক উত্তেজনার মাধ্যমে সেটাকে উপস্থাপন করেন। যদিও ভবিষ্যতের প্রযুক্তির প্রধান উৎকর্ষ কেবল গাড়ি, মহাকাশযান বা যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে নয়, বরং তার আসল উৎকর্ষ খোদ মানবপ্রজাতিকে, তাদের আবেগ এবং ইচ্ছার প্রকৃতিকেই পাল্টে দেবার মাঝে নিহিত। একটা চিরতরুণ সাইবর্গ, যাকে সন্তান উৎপাদন করতে হয় না এবং যাদের পৃথক পৃথক যৌন পরিচয় নেই, যে সরাসরি অন্য সাইবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং যার মনোনিবেশ করার এবং তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি এবং যে কখনও রাগ ও দুঃখ বোধ করে না, কিন্তু যার আছে আমাদের কল্পনার অতীত আবেগ ও আকাঙ্ক্ষা, তার তুলনায় একটা অত্যাধুনিক মহাকাশযানের গুরুত্বও নিতান্ত নগণ্য নয় কি?

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলো আমাদের এ ধরনের ভবিষ্যতের গল্প শোনায় না। কারণ, সংজ্ঞানুযায়ীই এ ধরনের ভবিষ্যতের একটি সঠিক বর্ণনাও হবে মানুষের বোধের অতীত। নিয়ান্ডার্থাল দর্শকের জন্য ‘হ্যামলেট’ সিনেমা বানানো হলে যেমন তা হৃদয়ঙ্গম করা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব, তেমনি ভবিষ্যতের মহা-সাইবর্গদের নিয়ে একটি ছবি বানানো হলে তা বোঝাও আমাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হবে। তার উপর, আমাদের সাথে নিয়ান্ডার্থাল মানুষের যে পার্থক্য, বর্তমানের মানুষের সাথে ভবিষ্যতের মানুষের পার্থক্য হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। অন্ততঃ নিয়ান্ডার্থাল এবং আমরা দুজনেই মানুষ, কিন্তু আমাদের উত্তরপুরুষরা হয়ে উঠবেন ঈশ্বরপ্রতিম। সুতরাং, বর্তমানের মানুষের পক্ষে তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করাটাই হবে একরকম ধৃষ্টতা।

পদার্থবিজ্ঞানীরা সৃষ্টির শুরুর সময়কার মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাংয়ের নাম দিয়েছেন ‘সিংগুলারিটি’ (singularity)। এটা এমন একটা সময়, যখন আমাদের চেনা প্রাকৃতিক নিয়ম কানুনের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সময়েরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং মহাবিস্ফোরণের আগে কোন কিছুর অস্তিত্ব ছিল কিনা, সে প্রশ্নই ছিল অর্থহীন। হয়তো আমরা খুব শিগগির একটি নতুন ‘সিংগুলারিটি’র দিকে ধাবিত হচ্ছি, যেখানে আমি, তুমি, পুরুষ, নারী, ভালবাসা এবং ঘৃণার মত যেসব ধারণাগুলো আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, সেসবের কোন অস্তিত্বই থাকবে না। এর পরে যা কিছু ঘটবে আমাদের বর্তমানের মানুষদের জন্য তা হবে পুরোপুরি অর্থহীন।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণী

১৮১৮ সালে মেরি শেলি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এই গল্পে একজন বিজ্ঞানী একটি কৃত্রিম সত্ত্বা তৈরি করে যাকে তার স্রষ্টা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন এবং ফলশ্রুতিতে নেমে আসে বিপর্যয়। গত দুই শতকে, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে আমরা এই একই গল্পের অগণিত রূপের মঞ্চায়ন দেখতে পাই। এই গল্পটি বৈজ্ঞানিক কিংবদন্তীর অবিচ্ছেদ্দ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পটি আমরা যদি ঈশ্বর সাজার চেষ্টা করি এবং নিজের ইচ্ছানুযায়ী জীবন উৎপাদনের চেষ্টা করি, তবে তার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে সে সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই গল্পটির অর্থ আরও গভীর ও ব্যাপক।

শেষের দিনগুলো দ্রুত ঘনিয়ে আসছে- ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্পটি মানুষকে এই সত্যটি সম্পর্কে সজাগ করে দেয়। যদি কোন আকস্মিক নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাগড়া না দেয়, প্রযুক্তিগত উন্নতির এই লাগামহীন গতি গল্পের মত অচিরেই হোমো সেপিয়েন্সকে নতুন কোনো প্রজাতি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে ফেলবে। তারা যে কেবল দেখতে আমাদের থেকে আলাদা হবে তাই নয়, তাদের বু্দ্ধিবৃত্তি এবং অনুভূতিও হবে আমাদের থেকে একেবারেই আলাদা। এই ধারণাটিকে বেশিরভাগ মানুষ অস্বস্তির চোখে দেখেন। আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসি, ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে আরাম আয়েশে ভরপুর, আমরা চাইলেই মহাকাশযানে চড়ে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে বেড়িয়ে আসতে পারব। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আমাদের মত আবেগ এবং পরিচয় সম্বলিত মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না, আমাদের স্থান দখল করবে নতুন কোন অচেনা জীব যার কাছে আমাদের আজকের দক্ষতা হবে নিতান্তই তুচ্ছ – এরকম একটি ধারণা মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়।

তার চেয়ে আমরা এইভাবে ভাবতেই পছন্দ করি, ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন একটি জঘন্য দানব তৈরি করেছিলেন, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তাকে হত্যা করতে হয়েছে। আমরা গল্পটিকে এভাবেই বলতে পছন্দ করি, কারণ গল্পটির এই বয়ান পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়, আমরাই সকল সৃষ্টির সেরা, অতীতে কখনও আমাদের চেয়ে সেরা কিছু ছিল না, ভবিষ্যতেও কিছু থাকবে না। আমাদের নিজেদেরকে উন্নত করার যে কোন চেষ্টা শেষমেষ ব্যর্থ হবে, কারণ চেষ্টায় শরীরের কিছুটা উন্নতি যদি আমরা করতেও পারি, কোনোভাবেই আমরা মানুষের চিন্তা-আবেগ পরিবর্তন করতে পারব না।

বিজ্ঞানীরা যে চেষ্টা করলে কেবল শরীর নয়, মনও নির্মাণ করতে পারেন, ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন যে মানুষের চেয়েও উন্নত কিছু বানাতে পারেন, আর সেই উন্নত প্রজাতি যে নিয়ান্ডার্থালদের দিকে সেপিয়েন্স যেরকম অবহেলার চোখে তাকাত, সেরকম অবহেলার চোখে আমাদের দিকে তাকাতে পারে, এই সত্যটা হজম করতে আমাদের বেশ কষ্টই হবে।

আজকের দিনের ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরা এইসব ভবিষ্যতবাণীকে বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সুযোগ নেই। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে উপরের অনুমানগুলো পুরোপুরি সত্যে রূপান্তরিত হলে আমি বরং একটু অবাকই হব। কারণ, ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অনেক কিছুই শেষমেষ বাস্তবে রূপ নেয় না। সামনে এসে দাঁড়ায় কিছু অাকস্মিক বাধা এবং আমলে না আনা নতুন কোন পরিস্থিতি। ১৯৪০ এর দিকে যখন দুনিয়াজুড়ে পারমাণবিক গবেষণার তোড়জোড়, তখন ২০০০ সালের পারমাণবিক শক্তিচালিত বিশ্ব সম্পর্কে অনেকেই অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছিলেন। যখন মহাকাশে স্পুটনিক আর অ্যাপোলো ১১ নিক্ষেপ করা হলো, তখন সবাই শতাব্দী শেষ নাগাদ মানুষ মঙ্গল বা প্লুটোয় উপনিবেশ স্থাপন করে বসবাস শুরু করবে এমনটা ভেবেছিলেন। এসব অনুমানের অধিকাংশই বাস্তবে রূপ নেয়নি। অন্যদিকে, সে সময়ে ইন্টারনেটের মত কোনো কিছু সম্পর্কে সেদিনের কেউ অনুমানই করতে পারেনি। অথচ, সেটিই আজকের দিনের বড় বাস্তবতা।

সুতরাং, ভবিষ্যতের কাল্পনিক কোনো যান্ত্রিক সত্ত্বার দায়ের করা আইনি সালিশ থেকে নিরাপদ থাকতে এখনই আপনার বীমা কোম্পানির কাছে দৌড়ানোর দরকার নেই। উপরের কল্পনাগুলো বা দুঃস্বপ্নগুলো কেবল আপনার কল্পনাকে নাড়া দেবার জন্যই। যেটা গুরুত্বের সাথে নেওয়ার বিষয় সেটা হলো, ইতিহাসের পরবর্তী অংশে আমরা যে কেবল প্রযুক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন দেখতে পাব তাই নয়, বরং মানুষের চেতনা এবং পরিচিতির ক্ষেত্রেও সূচিত হবে নানারকম মৌলিক পরিবর্তনের। এসবের মাঝে কিছু পরিবর্তন হয়তো এতটাই বৈপ্লবিক হবে যে তা ‘মানুষ’ নামক প্রাণীটির পরিচয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এসবের আগে আমাদের হাতে আর কতটা সময় অবশিষ্ট আছে? সত্যিকার অর্থে, কেউ এ প্রশ্নের উত্তর জানে না। যেমনটা আগেই বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ হয়তো কিছু মানুষ মৃত্যুকে জয় করতে পারবে। এ সংক্রান্ত অন্যান্য ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ইঙ্গিত করে মৃত্যুকে জয় করতে হয়তো মানুষের পরবর্তী শতাব্দী বা পরবর্তী সহস্রাব্দ লেগে যাবে। কিন্তু, সেটাও যদি সত্যি হয়, মানুষের ৭০,০০০ বছরের ইতিহাসের তুলনায় কয়েক সহস্রাব্দ কীই বা এমন বড় সময়?

যদি ইতিহাসের মঞ্চে প্রজাতি হিসেবে সেপিয়েন্স এর যবনিকার পর্দা নেমেই যায়, এই প্রজাতির অন্তিম প্রজন্মগুলোর সদস্য হিসেবে একটা শেষ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে কিছুটা সময় আমাদের ব্যয় করা উচিত। প্রশ্নটা হলো- আমরা আসলে কী হতে চেয়েছিলাম? এই প্রশ্নটি, যাকে অনেকসময় মানবিক উন্নয়নমূলক প্রশ্ন হিসেবেও অভিহিত করা হয়, হুট করেই আমাদের বর্তমান পৃথিবীর রাজনীতিবিদ, দার্শনিক, পণ্ডিত এবং সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ্যমান অগণিত বিতর্ককে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্তব্ধ করে দেয়। যদি আমাদের উত্তরসূরীরা একটি ভিন্নরকম চেতনার অধিকারী হয় (বা অধিকারী হয় চেতনার চেয়েও উচ্চতর কিছুর যা আমাদের বোধের বাইরে), তাদের কি আদৌ কোন মাথাব্যথা থাকবে খ্রিস্ট ধর্ম, ইসলাম বা আজকের দিনের প্রচলিত অন্য কোনো ধর্ম নিয়ে, সমাজের গঠন সমাজতন্ত্র নাকি পুঁজিবাদ অনুসারে হবে তা কি তাদের কাছে এতটুকু গুরুত্ব বহন করবে, সমাজের ধারণাটাই কি থাকবে আজকের মতো অথবা নারী-পুরুষের লিঙ্গগত বৈষম্য বা সমানাধিকার নিয়ে মাতামাতি করার ইচ্ছে হবে তাদের?

তা সত্ত্বেও ইতিহাসের এই বড় বড় বিতর্কগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানুষের তৈরি এসব দেবতাদের প্রথম প্রজন্ম বিকশিত হবে মানুষেরই গড়ে দেয়া ছাঁচে। পুঁজিবাদ, ইসলাম নাকি নারীবাদ কোন ছাঁচ অনুযায়ী আমরা তাদের গড়ে তুলব? এই প্রশ্নের উত্তরের উপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর ইতিহাস।

বেশিরভাগ মানুষই এসব নিয়ে ভাবতে চান না। এমনকি জৈবনৈতিকতার মত বিষয়গুলোও মূলতঃ আরেকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেটা হলো- ‘আমাদের কী কী করা অনুচিত?’ জীবিত মানুষের উপর কি জিনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত অথবা পরিত্যক্ত ভ্রুণের উপর? স্টেম কোষের উপর? একটি ভেড়ার হুবহু অনুলিপি তৈরি করা কি যুক্তিযুক্ত? অথবা শিম্পাঞ্জির? কিংবা মানুষের? নিঃসন্দেহে এসব প্রশ্ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এরকম ভাবা সত্যিই বোকামি হবে যে, এসব প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত মানুষের নিজেকে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তর করে ফেলার মতো এইসব বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোকে স্থগিত রাখা সম্ভব হবে। এই প্রকল্পগুলো গিলগামেশ প্রকল্পের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বিজ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করুন কেন তারা জিনোম নিয়ে পড়াশোনা করছেন বা একটি মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করছেন বা কম্পিউটারের ভেতর মানব মন বা মানব মস্তিষ্ক তৈরির চেষ্টা করছেন। দশজনের মাঝে নয়জন আপনাকে সেই পরিচিত উত্তর দেবেন- আমরা এসব করছি রোগমুক্তির জন্য, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য। যদিও কম্পিউটারের মধ্যে মানব মস্তিষ্ক তৈরি করার প্রভাব মানসিক রোগ সারানোর চেয়ে অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী, কিন্তু এটিই তাদের কাজের ন্যায্যতা প্রমাণের সাধারণ ব্যাখ্যা, কারণ কোনো মানুষই এই ব্যাখ্যার বিরূদ্ধে যেতে পারবে না। এই কারণেই গিলগামেশ প্রকল্প বিজ্ঞানের প্রকল্পগুলোর আলোকবর্তিকা স্বরূপ। এটি বিজ্ঞান যাই করুক, তাকেই ন্যায্য বলে বা সঠিক বলে প্রমাণের দায়িত্ব নেয়। এই সুযোগে ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন গিলগামেশের কাঁধে চড়ে নৃত্য করেন। যেহেতু গিলগামেশকে থামানো অসম্ভব, অসম্ভব থামানো ডঃ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকেও।

যে একটা কাজ আমরা করতে পারি, সেটা হলো বিজ্ঞানের গতিপথকে কিছুটা হলেও আমরা প্রভাবিত করতে পারি। যেহেতু খুব শীঘ্রই আমরা আমাদের ইচ্ছা ও চাহিদাকে নির্মাণ করাও শিখে যাবো, সুতরাং তখন ‘আমরা ভবিষ্যতে কী হতে চাই?’ এ প্রশ্নটা হবে অবান্তর। তখনকার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হবে ‘আমরা নিজের ভেতর কী হবার চাহিদা তৈরি করতে চাই?’ এই প্রশ্নটা দেখেও এখনও যারা আতঙ্কে শিউরে ওঠেননি, তারা সম্ভবতঃ এখনও ব্যাপারটি নিয়ে বোঝবার মত করে ভাবেননি।

————–

1 Keith T. Paige et al., ‘De Novo Cartilage Generation Using Calcium Alginate-Chondrocyte Constructs’, Plastic and Reconstructive Surgery 97:1 (1996), 168–78.

2 David Biello, ‘Bacteria Transformed into Biofuels Refineries’, Scientific American, 27 January 2010, accessed 10 December 2010, http://www.scientificamerican.com/article.cfm?id=bacteria-transformed-into-biofuel-refineries.

3 Gary Walsh, ‘Therapeutic Insulins and Their Large-Scale Manufacture’, Applied Microbiology and Biotechnology 67:2 (2005), 151–9.

4 James G. Wallis et al., ‘Expression of a Synthetic Antifreeze Protein in Potato Reduces Electrolyte Release at Freezing Temperatures’, Plant Molecular Biology 35:3 (1997), 323–30.

5 Robert J. Wall et al., ‘Genetically Enhanced Cows Resist Intramammary Staphylococcus Aureus Infection’, Nature Biotechnology 23:4 (2005), 445–51.

6 Liangxue Lai et al., ‘Generation of Cloned Transgenic Pigs Rich in Omega-3 Fatty Acids’, Nature Biotechnology 24:4 (2006), 435–6.

7 Ya-Ping Tang et al., ‘Genetic Enhancement of Learning and Memory in Mice’, Nature 401 (1999), 63–9.

8 Zoe R. Donaldson and Larry J. Young, ‘Oxytocin, Vasopressin and the Neurogenetics of Sociality’, Science 322:5903 (2008), 900–904; Zoe R. Donaldson, ‘Production of Germline Transgenic Prairie Voles (Microtus Ochrogaster) Using Lentiviral Vectors’, Biology of Reproduction 81:6 (2009), 1,189–95.

9 Terri Pous, ‘Siberian Discovery Could Bring Scientists Closer to Cloning Woolly Mammoth’, Time, 17 September 2012, accessed 19 February 2013; Pasqualino Loi et al, ‘Biological time machines: a realistic approach for cloning an extinct mammal’, Endangered Species Research 14 (2011), 227–33; Leon Huynen, Craig D. Millar and David M. Lambert, ‘Resurrecting ancient animal genomes: The extinct moa and more’, Bioessays 34 (2012), 661–9.

10 Nicholas Wade, ‘Scientists in Germany Draft Neanderthal Genome’, New York Times, 12 February 2009, accessed 10 December 2010, http://www.nytimes.com/2009/02/13/science/13neanderthal.html?_r=2&ref=science; Zack Zorich, ‘Should We Clone Neanderthals?’, Archaeology 63:2 (2009), accessed 10 December 2010, http://www.archaeology.org/1003/etc/neanderthals.html.

11 Robert H. Waterston et al., ‘Initial Sequencing and Comparative Analysis of the Mouse Genome’, Nature 420:6915 (2002), 520.

12 ‘Hybrid Insect Micro Electromechanical Systems (HI-MEMS)’, Microsystems Technology Office, DARPA, accessed 22 March 2012, http://www.darpa.mil/Our_Work/MTO/Programs/Hybrid_Insect_Micro_Electromechanical_Systems_percent28HI-MEMSpercent29.aspx. See also: Sally Adee, ‘Nuclear-Powered Transponder for Cyborg Insect’, IEEE Spectrum, December 2009, accessed 10 December 2010, http://spectrum.ieee.org/semiconductors/devices/​nuclearpowered-transponder-for-cyborg-insect?​utm_source=feedburner&utm_medium=feed&utm_campaign=Feedpercent3A​+IeeeSpectrum+percent28IEEE+​Spectrumpercent29&utm_content=Google+Reader; Jessica Marshall, ‘The Fly Who Bugged Me’, New Scientist 197:2646 (2008), 40–3; Emily Singer, ‘Send in the Rescue Rats’, New Scientist 183:2466 (2004), 21–2; Susan Brown, ‘Stealth Sharks to Patrol the High Seas’, New Scientist 189:2541 (2006), 30–1.

13 Bill Christensen, ‘Military Plans Cyborg Sharks’, Live Science, 7 March 2006, accessed 10 December 2010, http://www.livescience.com/technology/060307_shark_implant.html.

14 ‘Cochlear Implants’, National Institute on Deafness and Other Communication Disorders, accessed 22 March 2012, http://www.nidcd.nih.gov/health/hearing/pages/coch.aspx.

15 Retina Implant, http://www.retina-implant.de/en/doctors/technology/default.aspx.

16 David Brown, ‘For 1st Woman With Bionic Arm, a New Life is Within Reach’, Washington Post, 14 September 2006, accessed 10 December 2010, http://www.washingtonpost.com/wp-dyn/content/article/2006/o9/13/AR2006091302271.html?nav=E8.

17 Miguel Nicolelis, Beyond Boundaries: The New Neuroscience of Connecting Brains and Machines – and How it Will Change Our Lives (New York: Times Books, 2011).

18 Chris Berdik, ‘Turning Thought into Words’, BU Today, 15 October 2008, accessed 22 March 2012, http://www.bu.edu/today/2008/turning-thoughts-into-words/.

19 Jonathan Fildes, ‘Artificial Brain “10 years away” ’, BBC News, 22 July 2009, accessed 19 September 2012, http://news.bbc.c0.uk/2/hi/8164060.stm.

20 Radoje Drmanac et al., ‘Human Genome Sequencing Using Unchained Base Reads on Self-Assembling DNA Nanoarrays’, Science 327:5961 (2010), 78–81; ‘Complete Genomics’ website: http://www.completegenomics.com/; Rob Waters, ‘Complete Genomics Gets Gene Sequencing under $5000 (Update 1)’, Bloomberg, 5 November 2009, accessed 10 December 2010; http://www.bloomberg.com/apps/news?pid=newsarchive&sid=aWutnyE4S0Ww; Fergus Walsh, ‘Era of Personalized Medicine Awaits’, BBC News, last updated 8 April 2009, accessed 22 March 2012, http://news.bbc.co.Uk/2/hi/health/7954968.stm; Leena Rao, ‘PayPal Co-Founder and Founders Fund Partner Joins DNA Sequencing Firm Halcyon Molecular’, TechCrunch, 24 September 2009, accessed 10 December 2010, http://techcrunch.com/2009/09/24/paypal-co-founder-and-founders-​fund-partner-joins-dna-sequencing-firm-halcyon-molecular/.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *