০০৮. যুধিষ্ঠির-বিষাদে অর্জুনের সক্রোধ উক্তি

৮ম অধ্যায়

যুধিষ্ঠির-বিষাদে অর্জুনের সক্রোধ উক্তি

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন দৃঢ়পরাক্রম অর্জুন ধর্মরাজের বাক্যশ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া সৃক্কণী[জিহ্বাদ্বারা বার বার অধর-ওষ্ঠ চাটিতে চাটিতে] লেহন করিয়া গৰ্বিতভাবে কহিলেন, “মহারাজ! অলৌকিক কাৰ্য্য সম্পাদন করিয়া ক্লীবের ন্যায় রাজশ্রী পরিত্যাগ করিতে বাসনা করা নিতান্ত আক্ষেপের বিষয়। শত্ৰুসংহারপূর্বক ধর্মানুসারে পৃথিবীর অধীশ্বর হইয়া সমুদয় পরিত্যাগ করা নিতান্ত নির্বোধের কাৰ্য্য, সন্দেহ নাই। ক্লীব বা দীর্ঘসূত্রীর [অলসের] কখনই রাজ্যলাভ হয় না। আপনি কি নিমিত্ত ক্রোধপরায়ণ হইয়া ভূপালগণকে নিপাতিত করিলেন? যে ব্যক্তি নিতান্ত হতভাগ্য, সে কোনক্রমেই জনসমাজে খ্যাতিলাভ করিতে সমর্থ নহে এবং যাহার পুত্র, কলত্র ও পশু প্রভৃতি কিছুই নাই, সেই অর্থচিন্তাপরাঙ্মুখ হইয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে। আপনি সুবিপুল রাজ্যসম্পদ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক নীচজনোচিত ভিক্ষাবৃত্তি আশ্রয় করিয়া জীবনধারণ করিলে লোকে আপনাকে কি বলিবে? আপনি কি নিমিত্ত প্রাকৃত [নির্ব্বোধ] লোকের ন্যায় ঐশ্বৰ্য্যভোগে বঞ্চিত ও উদ্যমশূন্য হইয়া ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিতে বাসনা করিয়াছেন?

“রাজকুলে জন্মগ্রহণ ও স্বীয় বাহুবলে অখণ্ড ভূমণ্ডলে একাধিপত্য সংস্থাপনপূর্ব্বক পরিশেষে ধৰ্মার্থ পরিত্যাগ করিয়া বনপ্রস্থান করা নিতান্ত মূঢ়তার কার্য্য। আপনি যজ্ঞক্রিয়া পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ভিক্ষা অবলম্বন করিলে অসাধুগণ কখনই উহার অনুষ্ঠান করিবে না; সুতরাং আপনাকে যজ্ঞনাশনিবন্ধন পাপভাগী হইতে হইবে। মহারাজ নহুষ কহিয়া গিয়াছেন যে, ইহলোকে অকিঞ্চনতার [নির্ধনতার] অভিলাষ করা নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। নির্ধনতা নিতান্ত নিন্দনীয়। ঋষিগণই অর্থোপার্জ্জন ও অর্থরক্ষায় উপেক্ষা করিয়া ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করেন, কিন্তু ভূপতিগণের কখনই ঐরূপ কার্য্য করা কর্ত্তব্য নহে। লোকে ধনদ্বারা ধর্ম্মোপার্জ্জন করিতে পারে। মনুষ্যের ধন অপহৃত হইলে ধৰ্ম্মও অপহৃত হয়। কেহ আমাদিগের ঐশ্বৰ্য্য অপহরণ করিলে আমরা কখনই তাহাকে ক্ষমা করি না।

“ইহলোকে দরিদ্রতা অপেক্ষা গুরুতর দোষ আর কিছুই নাই। আমরা নিকটস্থ দরিদ্রদিগকে নিয়তই মিথ্যাপবাদদূষিত দেখিতে পাই। অতএব আপনি দরিদ্র হইবার বাসনা পরিত্যাগ করুন। নির্ধন ব্যক্তি পতিতের ন্যায় সতত শোক করিয়া থাকে; সুতরাং পতিত ও নির্ধনের কিছুই ইতরবিশেষ নাই। যেমন পর্ব্বত হইতে নদীসমুদয়ের সঞ্চার হয়, তদ্রূপ সঞ্চিত অর্থ হইতে বিবিধ ক্রিয়াকলাপ সম্পাদিত হইয়া থাকে। লোকে অর্থ হইতেই ধৰ্ম্ম, কাম ও স্বর্গলাভে সমর্থ হয়। অর্থ না থাকিলে জীবিকা নির্বাহ করাও কঠিন হইয়া উঠে। ধনবিহীন অল্পবুদ্ধি পুরুষেরও ক্রিয়াকলাপ গ্রীষ্মকালীন সামান্য নদীসমূহের ন্যায় বিলুপ্ত হইয়া যায়। ইহলোকে যাহার অর্থ আছে, সেই ব্যক্তিই বন্ধুবান্ধবসম্পন্ন প্রধানপুরুষ বলিয়া গণনীয় ও পণ্ডিতপদবাচ্য [জ্ঞানী বলিয়া গ্রাহ্য] হইয়া থাকে। নির্ধন ব্যক্তি অর্থাগমের চেষ্টা করিলেও তাহা বৃথা হয়। মাতঙ্গ যেমন মাতঙ্গের সহিত মিলিত হয়, তদ্রূপ অর্থ অর্থের সহিত মিলিত হইয়া থাকে। অর্থ হইতে ধৰ্ম্ম, কাম, স্বর্গ, হর্ষ, ধৈৰ্য্য, ক্রোধ, শাস্ত্রজ্ঞান ও মত্ততা [দণ্ডদানশক্তি] উৎপন্ন হয়। ধনই কুলমৰ্য্যাদা ও ধৰ্ম্মবুদ্ধির নিদান। নির্ধন ব্যক্তি ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হইতে পারে না। লোকের শরীর কৃশ হইলে তাহাকে কৃশ বলা যায় না; যাহার অশ্ব, গো, ভৃত্য ও অতিথি অধিক না থাকে, সেই যথার্থ কৃশ।

“আর দেখুন, অসুরগণ দেবতাদিগের জ্ঞাতি, কিন্তু দেবগণ তাহাদিগকে নিপাতিত করিয়া অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। অন্যকে পরাজিত করিয়া অর্থ গ্রহণ না করিলে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করা নিতান্ত সহজ হয় না। বেদে নির্দিষ্ট আছে যে, বেদাধ্যয়নপূৰ্ব্বক পাণ্ডিত্য লাভ ও বিবিধ যত্নসহকারে ধন আহরণপূৰ্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। দেবগণ বিদ্রোহাচরণ করিয়াই স্বর্গের সমুদয় স্থান অধিকার ও জ্ঞাতিবর্গের পীড়ন করিয়া বিপুল অর্থসংগ্রহ করিয়াছেন। অধ্যয়ন, অধ্যাপন’, যজন, যাজন ও অর্থসংগ্রহ অতি শ্রেয়স্কর” কার্য্য। অন্যের অপকার না করিলে প্রায়ই অর্থ উপার্জ্জন করা যায় না। এই নিমিত্তই রাজারা অন্যকে পরাজয়২ করিয়া পৃথিবী গ্রহণ এবং পুত্র যেমন পিতার ধন অধিকার করে, তদ্রূপ উহা অধিকার করিয়া গিয়াছেন। ভূপালগণের এইরূপ কাৰ্য্যই ধৰ্ম্মানুগত বলিয়া কীৰ্ত্তিত হয়। তাঁহারা ঐরূপ কাৰ্য্য করিয়াই স্বর্গলাভে অধিকারী হইয়াছেন। সলিলরাশি যেমন পূর্ণ সাগর হইতে বহির্গত হইয়া দশদিকে পরিব্যাপ্ত হয়, তদ্রূপ ধনরাশি রাজকুল হইতে নিঃসরণপূৰ্ব্বক সমুদয় পৃথিবীতে সমাকীর্ণ হইয়া থাকে। পূৰ্ব্বে এই পৃথিবী রাজা দিলীপ, নৃগ, নহুষ, অম্বরীষ ও মান্ধাতার ভোগ্য ছিল, এক্ষণে ইহা আপনার ভোগাৰ্হ[ভোগের যোগ্য] হইয়াছে। অতঃপর আপনার সৰ্ব্বস্বদক্ষিণ[সমস্ত ধন দক্ষিণার্থ-দত্ত] যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। যদি আপনি বিষয়বিজ্ঞ[বিষয়কার্য্যে অভিজ্ঞ] হইয়া উহা না করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনাকে অধৰ্ম্মভাগী হইতে হইবে। রাজা প্রভূতদক্ষিণ অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে সমুদয় প্ৰজাই সেই যজ্ঞের অবসানে স্নান করিয়া পবিত্র হয়। যজ্ঞানুষ্ঠান অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কাৰ্য্য আর কিছুই নাই। বিশ্বরূপ মহাদেব মহাযজ্ঞ সর্ব্বমেধে[আহুতিরূপে সমস্ত-বস্তুপ্রদেয়যজ্ঞে নিজের দেহ পর্য্যন্ত যাহাতে আহুত হয়] সৰ্ব্বভূতের সহিত আপনাকে আহুতি প্রদান করিয়াছিলেন। যজ্ঞানুষ্ঠানের ফল অবিনশ্বর। মহারাজ দশরথ যজ্ঞকে সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়স্কর বলিয়া নির্দেশ ও সতত উহার অনুষ্ঠান করিতেন। অতএব আপনি মহাজনসেবিত যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কুপথে পদার্পণ করিবেন না।”