০০১. রাজধর্মানুশাসনপর্বাধ্যায় – ঋষি-সমাগম

১ম অধ্যায়

রাজধর্মানুশাসনপর্বাধ্যায় – ঋষি-সমাগম

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! এইরূপে পঞ্চপাণ্ডব, মহামতি বিদুর, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও যাবতীয় কৌরববনিতা স্ব স্ব সুহৃদগণের সলিলক্রিয়া[প্রেততর্পণাদি] সম্পাদন করিলেন। মহাত্মা পাণ্ডবগণ আপনাদের বিশুদ্ধিসম্পাদনের [অশৌচান্ত শুদ্ধির; পক্ষান্তরে শোকাপনোদনের] নিমিত্ত একমাস [একমাস অশৌচ শূদ্রের, ক্ষত্রিয়ের অশৌচ ১২ দিন। ক্ষত্রিয়গণের মধ্যেও যাঁহারা যুদ্ধে মৃত, তাঁহাদের অশৌচ ঐ ১২ দিও নহে। যুদ্ধমৃত ক্ষত্রিয়গণের সপিণ্ডাদির সদ্যঃশৌচ হইয়া থাকে। এই নিমিত্ত ১৮ দিন যুদ্ধে এক-একদিন অশৌচ হিসাবে ১৮ দিন হইয়াছিল, তারপর অশ্বত্থামা নিদ্রিত অবস্থায় যেসকল ক্ষত্রিয়কে পশুর ন্যায় বধ করেন, তাঁহাদের যুদ্ধে মৃত্যু না হওয়ায় পূর্ণাশৌচ ১২ দিনই হইয়াছিল। যুদ্ধনিবৃত্তির পর গঙ্গাতীরে এক মাস বাস পক্ষে ব্যাখ্যান্তর—যুদ্ধে শুদ্ৰজাতীয় মৃতসেনার পুত্রাদির অশৌচান্ত অপেক্ষায় তাহাদের সহিত যুধিষ্ঠিরাদির এক মাস বাস।] পুরের বহির্ভাগে ভাগীরথীতীরে বাস করিতে লাগিলেন। ঐ সময় শিষ্যসমবেত মহাত্মা ব্যাসদেব, নারদ, দেবল, দেবস্থান ও কণ্ব প্রভৃতি সিদ্ধ ব্ৰহ্মর্ষিগণ [ব্রহ্মবাদী মুনিগণ] এবং অন্যান্য বহুসংখ্যক বেদবেত্তা[বেদজ্ঞ], স্নাতক[গুরুগৃহে যথোচিত বেদাধ্যয়ন ও ব্রহ্মচর্য্য পরিসমাপ্তির পর গৃহে প্রত্যাগত] ও গৃহস্থ ব্রাহ্মণগণ যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে ভাগীরথীর তীরে সমুপস্থিত হইলেন। ধর্মাত্মা ধর্মতনয় তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র গাত্রোত্থানপূর্বক যথাবিধি পূজা করিলে বিগণ ধর্মরাজের পূজা গ্রহণ ও তাঁহার চতুস্পার্শ্বে মহার্হ[মহামূল্য] আসনে উপবেশন করিয়া তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তপোধনাগ্রগণ্য[তপস্বিগণের শ্রেষ্ঠ] দেবর্ষি নারদ ব্যাসদেব প্রভৃতি মহর্ষিগণের সমক্ষে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সম্ভাষণপূর্বক কহিলেন, “মহারাজ। আপনি স্বীয় বাহুবল ও বাসুদেবের প্রসাদে ধর্মানুসারে এই অখণ্ড ভূমণ্ডল পরাজিত করিয়াছেন।

“ভাগ্যবলে এ ভীষণ সমর হইতে আপনার মুক্তিলাভ হইয়াছে। এক্ষণে আপনি ক্ষাত্রধর্মে [ক্ষত্রিয়োচিত ধর্মে রাজ্যপালনাদি] নিরত থাকিয়া ত’ সন্তুষ্ট হইতেছেন? অরাতিবিহীন [শত্রুশূন্য] হইয়া ত’ সুহৃদগণের প্রতি উৎপাদন করিয়াছেন এবং রাজ্যের অধীশ্বরত্ব লাভ করিয়া ত’ শোক হইতে মুক্ত হইয়াছেন?”

কর্ণবধে যুধিষ্ঠির বিমর্ষ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! আমি মহাত্মা বাসুদেব, ভীম ও অর্জুনের বাহুবলে এবং ব্রাহ্মণগণের প্রসাদে এই পৃথিবী পরাজয় করিয়াছি, কিন্তু আমার রাজ্যলোভনিবন্ধন জ্ঞাতিকুলক্ষয় এবং দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র ও অভিমন্যুর বিনাশ হওয়াতে এক্ষণে এই জয়লাভ পরাজয়ের ন্যায় বোধ হইতেছে। আমার হৃদয় দুঃখানলে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াছে। হায়! মহাত্মা মধুসূদন দ্বারকায় সমুপস্থিত হইলে সুভদ্রা তাহাকে কি বলিবেন? আমাদিগের হিতাকাঙ্ক্ষিণী এই দ্রৌপদী পুত্রহীন ও বন্ধুবান্ধববিহীন হইয়া আমাকে যারপরনাই ব্যথিত করিতেছেন। বিশেষতঃ জননী কুন্তী এক বিষয় গোপন করিয়া আমাকে নিতান্ত দুঃখিত করিয়াছেন। আমি সেই বিষয় আপনার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। যিনি ইহলোকে অযুত নাগতুল্য পরাক্রান্ত, অপ্রতিরথ, সিংহের ন্যায় দর্পিত, করুণাপরতন্ত্র, যতব্রত, বদান্য, অভিমানী, বিচিত্র যোদ্ধা ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের প্রধান আশ্রয় ছিলেন, যিনি প্রত্যেক সমরে আমাদিগের প্রতি বাণ বর্ষণ করিয়াছিলেন, সেই মহাবীর কর্ণ কুন্তীর গূঢ়োৎপন্ন[গুপ্তভাবে জাত] পুত্র ও আমাদিগের জ্যেষ্ঠভ্রাতা। মাতা কুন্তী বীরগণের উদকক্রিয়াসময়ে [প্রেততর্পণকালে] ঐ মহাবীরকে সূর্য্যের ঔরসজাত বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। পূর্বে জননী সেই সর্বগুণোপেত[সমস্ত গুণযুক্ত] পুত্রকে মঞ্জুষা[পেঁটরা -ঐ পেঁটরা এরূপ কৌশলে নির্মিত যে, জলে ডুবিয়াও যায় নাই বা বায়ুরুদ্ধ হইয়া শিশু মরেও নাই]মধ্যে সংস্থাপনপূর্বক গঙ্গার স্রোতে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। লোকে কর্ণকে রাধাগৰ্ভসম্ভূত সূত[রথকার-নীচজাতি ছুতোর]পুত্র বলিয়া বোধ করিত, কিন্তু বস্তুতঃ তিনি কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র ও আমাদিগের সহোদর ভ্রাতা। আমি ঐ বৃত্তান্ত না জানিয়া রাজ্যলোভে জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে নিপাতিত করিয়াছি। এক্ষণে সেই ভ্রাতৃবধজনিত শোক অনল যেমন তুলারাশি দগ্ধ করে তদ্রূপ আমার শরীর দগ্ধ করিতেছে। পূর্বে কি অর্জুন, কি ভীমসেন, কি নকুল, কি সহদেব, কি আমি, আমরা কেহই তাঁহাকে ভ্রাতা বলিয়া অবগত হই নাই, কিন্তু তিনি আমাদিগকে জ্ঞাত হইয়াছিলেন। শুনিয়াছি, জননী কুন্তী আমাদিগের শান্তিলাভার্থ তাঁহার নিকট গমন করিয়াছিলেন। ‘বৎস! তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব আমার বাক্য প্রতিপালন কর’, কুন্তী এই কথা কহিলে মহাত্মা কর্ণ তাঁহার অভিষ্টসাধনে অস্বীকার করিয়া কহিয়াছিলেন, জননি! আমি সংগ্রামকালে দুৰ্য্যোধনকে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। কুরুরাজকে পরিত্যাগ করিলে সকলেই আমাকে অনাৰ্য্য, নৃশংস ও কৃতঘ্ন বোধ করিবে। বিশেষতঃ এক্ষণে যদি আমি আপনার অনুরোধে যুধিষ্ঠিরের পক্ষ অবলম্বন করি, তাহা হইলে লোকে আমাকে অর্জুনের ভয়ে ভীত বোধ করিবে। অতএব আমি বাসুদেবের সহিত অর্জুনকে পরাজয় করিয়া যুধিষ্ঠিরের সহিত সন্ধিস্থাপন করিব।’ তখন জননী কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে কহিলেন, ‘বৎস! তুমি তবে আমার চারিপুত্রকে অভয় প্রদান করিয়া কেবল অর্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও।’ মতিমান্ কর্ণ মাতার সেই বাক্য শ্রবণপূর্বক কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে কহিলেন, জননি! আমি আপনার অন্য চারিপুত্রকে কদাচ বিনাশ করিব না। হয় আমি অর্জুনের হস্তে নিহত হইব না হয় অর্জুন আমার হস্তে নিহত হইবে। যাহা হউক, আপনার পাঁচপুত্রই জীবিত থাকিবে, সন্দেহ নাই। ’তখন জননী কর্ণের মুখে এই কথা শুনিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘বৎস! তুমি যেসমস্ত ভ্রাতৃগণের মঙ্গল প্রার্থনা করিতেছ, তাহাদের মঙ্গলানুষ্ঠানে যত্নবান হও।’ এই কথা বলিয়া গৃহে প্ৰতিগমন করিলেন।

“হে মহর্ষে! এক্ষণে সেই মহাধনুর্দ্ধর মহাবীর কর্ণ অর্জুন-শরে নিপাতিত হইয়াছেন। আমি এতদিনের পর জননীর মুখে ঐ সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কর্ণকে জ্যেষ্ঠসহোদর বলিয়া জানিতে পারিলাম। হায়! ভ্রাতৃবধজনিত শোকে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। মহাবীর কর্ণ ও অর্জুন আমার সহায় থাকিলে আমি সুররাজ ইন্দ্রকেও পরাজয় করিতে পারিতাম। আমি কৌরসভায় দুরাত্মা ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দৌরাত্মদর্শনে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছিলাম, কিন্তু তৎকালে কর্ণকে দেখিবামাত্র আমার ক্রোধশান্তি হইয়া যায়। দ্যূতক্রীড়াসময়ে মহাবীর কর্ণ দুর্য্যোধনের হিতকামনায় আমার প্রতি বিবিধ কটুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, কিন্তু আমি তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া কটুবাক্য প্রয়োগ করি নাই। তৎকালে তাঁহার চরণযুগল দর্শন করিয়া আমার ক্রোধশান্তি হইয়াছিল। ঐ মহাবীরের পাদদ্বয় জননী কুন্তীর চরণযুগলের সদৃশ ছিল। আমি ঐ সাদৃশ্যের কারণ অবগত হইবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্ন করিয়াছিলাম, কিন্তু কোনক্রমেই এত দিন উহার অনুসন্ধান পাই নাই। যাহা হউক, এক্ষণে পৃথিবী কি নিমিত্ত কর্ণের রথচক্র গ্রাস করিয়াছিলেন এবং ঐ মহাবীরই বা কি নিমিত্ত শাপগ্রস্ত হয়েন, আপনি তাহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন। আপনি পৃথিবীর সমুদয় বৃত্তান্তই অবগত আছেন।”