২৩. শল্য-ভগদত্তাদির জন্য শোক

২৩তম অধ্যায়

শল্য-ভগদত্তাদির জন্য শোক

“হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ, মদ্ৰাধিপতি মহারথ শল্য ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের হস্তে নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত রহিয়াছেন। উনি নকুলের সাক্ষাৎ মাতুল। ঐ মহাবীর সর্ব্বস্থানে সর্ব্বদা তোমার সহিত স্পর্ধা করিতেন। উনি কর্ণের রথরশ্মি গ্রহণ করিয়া পাণ্ডবগণের জয়লাভের নিমিত্ত তাঁহার তেজোহ্ৰাস করিয়াছিলেন। আহা! ঐ দেখ, কাকসকল পদ্মপলাশলোচন মদ্ৰাধিপতির পূর্ণচন্দ্ৰসন্নিভ বদনমণ্ডল দংশন ও সুবর্ণবর্ণ জিহ্বা ভক্ষণ করিতেছে। সূক্ষ্মবস্ত্রধারিণী কুলকামিনীগণ পঙ্কনিমগ্ন গজরাজের চতুর্দ্দিকে উপবিষ্ট করিণীকুলের ন্যায় শরবিক্ষতাঙ্গ ভূতলশায়ী মদ্ররাজকে পরিবেষ্টন করিয়া রোদন করিতেছে। ঐ দেখ, পৰ্বতবাসী প্রবলপ্রতাপশালী ভগদত্ত অঙ্কুশ ধারণ করিয়া ভূতলে নিপতিত রহিয়াছেন। শাপদ উহাকে ভক্ষণ করিতেছে। উহার কেশকলাপ শিরঃস্থিত সুবর্ণমালার উজ্জ্বলপ্রভায় কেমন সুশোভিত হইয়াছে। বলিরাজের সহিত দেবরাজ ইন্দ্রের যেরূপ ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল, অর্জুনের সহিত উহারও তদ্রূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইয়া গিয়াছে। ঐ মহাবীর সংগ্রামে ধনঞ্জয়ের প্রাণসংশয় করিয়া পরিশেষে স্বয়ং নিহত হইয়াছেন।

ভীষ্মের জন্য গান্ধারীর শোক

“ঐ দেখ, মহাবীর ভীষ্ম গগনতলপরিভ্রষ্ট যুগান্তকালীন দিনকরের ন্যায় ভূতলে নিপতিত রহিয়াছেন। উহার সদৃশ বলবিক্রমশালী আর কেহই ছিল না। ঐ মহাবলপরাক্রান্ত মহাবীর সংগ্রামকালে স্বীয় অস্ত্রপ্রতাপে অরাতিগণকে পরিতাপিত করিয়া পরিশেষে অস্তগত সূর্য্যের ন্যায় নিপতিত হইয়াছেন। উনি ধর্ম্মানুষ্ঠানে দেবাপি সদৃশ ছিলেন। ঐ বীর রসপরায়ণ [বীরভাবে একান্ত অনুরক্ত] মহাত্মা কর্ণি, নালীক ও নারাচ প্রভৃতি শরনিচয়নিৰ্মিত শয্যায় শয়ন করিয়া শরবনশায়ী ভগবান কার্তিকেয়ের ন্যায় শোভা পাইতেছেন। মহাবীর অর্জুন তিনশরদ্বারা উহার অতি উৎকৃষ্ট উপাধান প্রস্তুত করিয়া দিয়াছেন। মহাত্মা ভীষ্ম পিতার আজ্ঞা প্রতিপালনার্থ উৰ্দ্ধরেতা [অস্থলিত ব্রহ্মচর্য্য] হইয়াছিলেন। উনি অদ্বিতীয় পুরুষ ও পরমধাৰ্মিক; ঐ বীর মর্ত্তবাসী হইয়াও তত্ত্বজ্ঞানপ্রভাবে অমরের ন্যায় প্রাণধারণ করিয়া রহিয়াছেন। যখন মহাবীর শান্তনুতনয় ধরাশায়ী হইয়াছেন, তখন বোধ হইতেছে যে, পৃথিবীর মধ্যে আর কোন যুদ্ধবিশারদ ও বলবিক্রমশালী ব্যক্তি জীবিত নাই। পাণ্ডবগণ জিজ্ঞাসা করাতে উনি স্বয়ং আপনার মৃত্যুর উপায় নির্দেশ করিয়া দিয়াছিলেন। যে সত্যবাদী মহাত্মা ক্ষয়য়ান্মুখ কুরুবংশের প্রত্যুদ্ধার [পুনরুদ্ধার] করিয়াছিলেন, সেই মহামতি এক্ষণে কৌরবগণের সহিত পরাভূত হইলেন। হে মাধব! দেবতুল্য দেবব্রত দেবলোকে প্রস্থান করিলে কৌরবকুল আর কাহাকে ধর্ম্ম জিজ্ঞাসা করিবে?

দ্রোণাচার্য্যের জন্য শোক

“ঐ দেখ, মহাবীর অর্জুন, সাত্যকি ও কৌরবগণের উপদেষ্টা দ্বিজসত্তম দ্রোণাচাৰ্য্য ধরাতলে নিপতিত রহিয়াছেন। যিনি দেবরাজ ইন্দ্র ও মহাবীর জামদগ্ন্যের ন্যায় চতুর্বিধ অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, যাঁহার প্রসাদে মহাবীর অর্জুন এই দুষ্কর কার্য্য সাধন করিয়াছে, যাঁহাকে অগ্রসর করিয়া কৌরবগণ পাণ্ডবদিগের সহিত স্পর্ধা করিত এবং যিনি সমরমধ্যে হুতাশনের ন্যায় বিচরণ করিয়া সৈন্যগণকে সন্তাপিত করিতেন, আজ সেই মহাবীর নিহত হইয়া প্রশান্তশিখ পাবকের ন্যায় ভূতলে বিলীন রহিয়াছেন। উহার বামমুষ্টি বা হস্তাবাপ [হস্তের বাণনিক্ষেপশক্তি শিথিল] বিশীর্ণ হয় নাই। উনি নিহত হইয়াও জীবিতের ন্যায় দৃষ্ট হইতেছেন। চারি বেদ ও সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র প্রজাপতির ন্যায় ঐ বীরকে পরিত্যাগ করে নাই। হায়! আচার্য্যের যে বন্দনীয় চরণদ্বয় বন্দিগণকর্ত্তৃক বন্দিত ও শিষ্যগণকর্ত্তৃক পরিসেবিত হইত, আজি গোমায়ুগণ সেই পদদ্বয় আকর্ষণ করিতেছে। ঐ দেখ, ব্রহ্মচারিণী আচাৰ্য্যপত্নী কৃপী অতি দীনভাবে আলুলায়িতকেশে অধোবদনে ধৃষ্টদ্যুম্ননিহত অস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য স্বীয় পতির সমীপে অবস্থানপূর্ব্বক বিলাপ ও উহার প্ৰেতকাৰ্য্যের নিমিত্ত যত্ন করিতেছেন। ঐ দেখ, জটাধারী ব্রহ্মচারিগণ রথনীড়, শরাসন, শক্তি ও অন্যান্য বিবিধ অস্ত্রদ্বারা দ্রোণাচার্য্যের চিতা প্রস্তুত করিয়াছেন। সামগাথকগণ [সামবেদগানকারী] অগ্নি আহরণপূর্ব্বক যথাবিধানে চিতা প্রজ্বলিত ও তদুপরি আচার্য্যের দেহ নিহিত করিয়া ত্রিবিধ সামগান করিতেছেন। অনেকে শোকে অভিভূত হইয়াছেন। ঐ দেখ, আচার্য্যের শিষ্যগণ সামবেদ গান করিয়া দ্রোণাচার্য্যের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াসাধনপূর্ব্বক তাঁহার পত্নীকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া চিতার দক্ষিণপার্শ্ব দিয়া ভাগীরথীর অভিমুখে গমন করিতেছে।”