১৪. অভিশাপে উদ্যতা গান্ধারীর প্রতি ব্যাস-উপদেশ

১৪শ অধ্যায়

অভিশাপে উদ্যতা গান্ধারীর প্রতি ব্যাস-উপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর বাসুদেব ও পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞা লইয়া গান্ধারীর নিকট গমন করিলেন। পুত্রশোকার্ত্তা পতিপরায়ণা গান্ধাররাজদুহিতা ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে অরাতিবিহীন অবগত হইয়া শাপ প্রদান করিতে অভিলাষ করিলেন। ঐ সময় দিব্যদৃষ্টি সর্ব্বভূতভাববেত্তা সত্যবতীপুত্র বেদব্যাস পাণ্ডবগণের প্রতি গান্ধারীর দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া ভাগীরথীর বিমল জলে অবগাহনপূর্ব্বক মনোমারুতবেগে অচিরাৎ পুত্রবধূর সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে শান্ত করিবার মানসে কহিলেন, “বৎসে! তুমি আমার বাক্যানুসারে পাণ্ডবগণের প্রতি কোপ পরিত্যাগপূর্ব্বক শান্তিগুণ অবলম্বন কর। ইতিপূর্বে তোমার পুত্র দুর্য্যোধন অরাতিগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়া অষ্টাদশ দিবসই সময়ে সময়ে তোমার নিকট আগমনপূর্ব্বক কহিয়াছিল, মাতঃ! আমি শত্রুগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইয়াছি, আপনি আমার মঙ্গল প্রার্থনা করুন। তুমিও সেই সেই সময়ে তাহাকে কহিয়াছিলে, ‘বৎস! যেখানেই ধর্ম্ম, সেখানেই জয়।’ হে কল্যাণ! তুমি সমুদয় প্রাণীর হিতচেষ্টায় নিরত। তোমার বাক্য কদাপি মিথ্যা হইবার নহে। মহাত্মা পাণ্ডবগণ তুমুল যুদ্ধে অসংখ্য নৃপতির প্রাণ সংহারপূর্ব্বক জয়লাভ করিয়া তোমার বাক্যের যথার্থ সম্পাদন করিয়াছে। পূর্বে তোমার অসাধারণ ক্ষমাগুণ ছিল; আজ তুমি কি নিমিত্ত সেই গুণ পরিত্যাগ করিতেছ? এক্ষণে অধর্ম্মকে পরাজয় করাই তোমার কর্ত্তব্য। যেখানে ধর্ম্ম, সেইখানেই জয় হইয়া থাকে। অতএব তুমি স্বীয় ধর্ম্ম ও পূর্বোক্ত বাক্য স্মরণপূর্ব্বক এক্ষণে কোপ সংবরণ কর।”

গান্ধারী কহিলেন, “ভগবন্! পাণ্ডবগণের প্রতি আমার ঈর্ষা নাই; আর উহারা যে বিনষ্ট হয়, ইহাও আমার অভিপ্রেত নহে। কিন্তু পুত্রশোকে আমার অন্তঃকরণ নিতান্ত বিহুল হইতেছে। কুন্তী যেমন পাণ্ডবগণকে রক্ষা করেন, তদ্রূপ আমার এবং রাজা ধৃতরাষ্ট্রেরও তাহাদিগকে রক্ষা করা কর্ত্তব্য। দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন, শকুনি, কর্ণ ও দুঃশাসনের অপরাধেই কুরুকুল ধ্বংস হইয়াছে। যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জুন, নকুল ও সহদেবের কিছুমাত্র অপরাধ নাই। কৌরবগণ দর্পপ্রভাবে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়াই নিহত হইয়াছে, তন্নিমিত্ত আমি কিছুমাত্র আক্ষেপ করি না। কিন্তু মহাত্মা ভীমসেন যে দুৰ্য্যোধনকে গদাযুদ্ধে আহ্বানপূর্ব্বক তাহাকে অপেক্ষাকৃত শিক্ষানিপুণ দেখিয়া বাসুদেবের সাক্ষাতে তাহার নাভির অধোদেশে গদাঘাত করিয়াছে, উহার সেই অধর্ম্মই আমার কোপানল প্রজ্বলিত করিতেছে। সংগ্রামস্থলে আপনার প্রাণরক্ষার্থ সাধুজনসমুদ্দিষ্ট[সাধুজনকর্ত্তৃক বিহিত] ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা কি বীরপুরুষের উচিত কার্য্য?”