১০. মৃতগণের অনুসরণে সমরাঙ্গন-যাত্রা

১০ম অধ্যায়

মৃতগণের অনুসরণে সমরাঙ্গন-যাত্রা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র মহাত্মা বিদুরের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া যান সুসজ্জিত করিতে অনুজ্ঞা প্রদানপূর্ব্বক পুনরায় বিদুরকে কহিলেন, “মহাত্মন্! তুমি গান্ধারী, কুন্তী ও অন্যান্য মুহিলাগণকে অবিলম্বে আনয়ন কর।” অন্ধরাজ বিদুরকে এই কথা বলিয়া শোকসন্তপ্তচিত্তে যানে আরোহণ করিলেন। অনন্তর পুত্রশোকার্ত্তা গান্ধারী পতির আদেশানুসারে কুন্তী ও অন্যান্য অন্তঃপুরচারিণীদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আগমন করিলেন। রোরুদ্যমানা রমণীগণ রাজার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। মহাত্মা, বিদুর শোকসন্তপ্তচিত্তে আৰ্ত্তস্বরে সেই রোরুদ্যমানা কুলকামিনীদিগকে আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক রথে সংস্থাপিত করিয়া পুর হইতে বহির্গত হইলেন। ঐ সময় কৌরবগণের প্রতিগৃহে আর্ত্তনাদ হইতে লাগিল; আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই শোকে নিতান্ত অভিভূত হইল। পূর্বে দেবগণও যে রমণীগণের মুখাবলোকন করিতে পারেন নাই, এক্ষণে তাহারা অনাথা হইয়া সামান্য লোকের নেত্রপথে নিপতিত হইতে লাগিল। আলুলায়িতকেশা, একবাস্ত্রা কামিনীগণ অলঙ্কার উন্মোচনপূর্ব্বক হরিণীগণ যেমন যূথপতির বিনাশে দুঃখাৰ্ত্ত হইয়া শৈলগুহা হইতে বহির্গত হয়, তদ্রূপ গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন এবং শোকাকুলিতচিত্তে অঙ্গনচারিণী [আঙ্গিনায় বিচরণশীল]] ঘোটকীর ন্যায় ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়া পিতা, পুত্র ও ভ্রাতৃগণের নিমিত্ত উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র বোধ হইল যেন, তাঁহারা যুগান্তকালীন লোকসংক্ষয়ের বিষয় প্রকাশ করিতেছেন। ঐ সময় তাঁহারা শোকে নিতান্ত হতজ্ঞান হইয়া কোন প্রকারেই কৰ্ত্তব্যবিধারণ করিতে পারিলেন না। পূর্বে যে কামিনীগণ সখীগণের নিকটেও লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া থাকিতেন, এক্ষণে শ্বশ্রূ[শাশুড়ী]দিগের সমীপেই লজ্জা পরিত্যাগপূর্ব্বক একবস্ত্র পরিধান করিয়া রহিলেন। পূর্বে যাঁহারা অল্প শোকের কারণ উপস্থিত হইলে পরস্পর পরস্পরকে আশ্বাসপ্রদানে প্রবৃত্ত হইতেন, এক্ষণে তাঁহারা শোকে অধীর হইয়া পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র এইরূপে সেই রোরুদ্যমানা রমণীগণে পরিবৃত হইয়া দুঃখিতমনে সমরাঙ্গনে যাত্রা করিলেন। শিল্পী, বণি ও বেশ্যারা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ঐ সময় মহিলাগণের আর্ত্তনাদে ত্রিভুবন ব্যথিত হইয়া উঠিল। বীরগণ যুগান্তকালে প্রাণীগণের ক্ষয় উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া বোধ করিতে লাগিল এবং অনুরক্ত পুরবাসিগণ ব্যথিত হৃদয়ে উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল।