০৮. মরণকামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ব্যাসের উপদেশ

৮ম অধ্যায়

মরণকামী ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি ব্যাসের উপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পুত্রশোকার্ত্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের বাক্য শ্রবণান্তর মূর্হিত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, বিদুর, সঞ্জয় এবং অন্যান্য বন্ধুবান্ধব ও দ্বারপালগণ তাঁহাকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া বহুক্ষণ সুশীতলজলসেক, তালবৃন্ত-বীজন [তালপাতার পাখার বাতাস] ও গাত্রসংস্পর্শদ্বারা পরমযত্নসহকারে তাহার মূর্চ্ছা অপনোদন করিলেন। এইরূপে অন্ধরাজ বহুক্ষণের পর সংজ্ঞালাভপূর্ব্বক পুত্রশোকে একান্ত অভিভূত হইয়া বিলাপ করিয়া ব্যাসদেবকে কহিলেন, “হে দ্বিজসত্তম! মানবদেহধারণে ধিক! মনুষ্যদেহধারণ করিলেই পুত্র, অর্থ ও জ্ঞাতিকুটুম্ববিনাশের নিমিত্ত পদে পদে বিষাগ্নিসদৃশ বিবিধ দুঃখ উপস্থিত হইয়া শরীর দগ্ধ ও বুদ্ধি বিনষ্ট করিতে থাকে। দুঃখাগ্নিতে দেহ দগ্ধ হইলে লোক অচিরাৎ মৃত্যু প্রার্থনা করে। এক্ষণে দুর্ভাগ্যবশতঃই আমার এইরূপ দুর্দ্দশা উপস্থিত হইয়াছে; 

অতঃপর প্রাণপরিত্যাগ ব্যতীত এ দুঃখের আর নিষ্কৃতি দেখিতেছি না; অতএব আমি আজই কলেবর পরিত্যাগ করিব।” মহারাজ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র স্বীয় পিতা কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে এই কথা কহিয়া শোকে নিতান্ত অভিভূত ও চিন্তায় একান্ত আকুল হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।

নিয়তির নিয়োগে দুর্দৈব সঞ্চয়

তখন মহর্ষি বেদব্যাস শোকসন্তপ্ত স্বীয় পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের সেই বাক্যশ্রবণে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আমি তোমাকে যাহা কহিতেছি, তাহা শ্রবণ কর। তুমি সর্ব্বশাস্ত্র বিশারদ, মেধাবী ও পরমধার্মিক। কোন বিষয়ই তোমার অবিদিত নাই। মর্ত্যদিগের অনিত্যতা বিষয় বিশেষ অবগত আছ। যখন সমস্ত জীবলোক অনিত্য এবং জমপরিগ্রহকারী ব্যক্তিমাত্রেরই মৃত্যু নির্দ্দিষ্ট রহিয়াছে, তখন তুমি কি নিমিত্ত শোক করিতেছ? দৈব তোমার সাক্ষাতে দুর্য্যোধনকে নিমিত্ত করিয়া তোমাদের এই বিরোধ উৎপাদন করিয়াছে; সুতরাং কৌরবকুলের ধ্বংস দৈবায়ত্ত ও অখণ্ডনীয়; অতএব তুমি কি নিমিত্ত পরলোকগত বীরগণের নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছ? মহামতি বিদুর সন্ধিসংস্থাপন করিবার নিমিত্ত অনেক যত্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, লোকে চিরকাল যত্ন করিলেও দৈব ও নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিতে সমর্থ হয় না।

“হে বৎস! দেবগণ তোমাদের কুলক্ষয়ের নিমিত্ত যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা আমি স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়াছি। এক্ষণে সেই বিষয় তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিব। উহা শ্রবণ করিলেই তোমার মন স্থির হইবে। পূর্বে আমি একদা পুরন্দরের সভায় সমুপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সমস্ত দেবতা ও নারদ প্রভৃতি দেবর্ষিগণ তথায় উপস্থিত হইয়াছেন। ঐ সময় বসুমতীও স্বকাৰ্য্যসাধনের নিমিত্ত তাঁহাদের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে দেবগণ! তোমরা পূর্বে ব্রহ্মার নিকেতনে আমার নিমিত্ত যে কার্য্যসাধনে অঙ্গীকার করিয়াছিলে, অচিরাৎ তাহার অনুষ্ঠান কর।’ তখন সর্ব্বলোক পূজনীয় বিষ্ণু বসুমতীর সেই কথা শ্রবণে হাস্য করিয়া কহিলেন, ‘বসুন্ধরে! ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের মধ্যে সর্ব্বজ্যেষ্ঠ দুৰ্য্যোধন তোমার কাৰ্য্যসাধন করিবে। সে ভূপতি হইলেই তুমি কৃতার্থ হইবে। ঐ দুরাত্মার কাৰ্য্যসাধনার্থ অন্যান্য ভূপালগণ কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া দৃঢ়তর অস্ত্রাঘাতে পরস্পরের বধসম্পাদন করিলেই তোমার ভারলাঘব হইবে। এক্ষণে অবিলম্বে স্বস্থানে গমন করিয়া লোকদিগকে ধারণ কর।’

“হে মহারাজ! তোমার পুত্র দুর্যোধন লোকসংহারের নিমিত্ত কলির অংশে গান্ধারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। সে নিতান্ত অমর্ষপরায়ণ, চপলস্বভাব, ক্রুদ্ধ ও দুর্বিনীত ছিল। দৈবপ্রভাবে তাহার ভ্রাতৃগণও তৎসদৃশ হইয়া উঠিয়াছিল এবং শকুনি মাতুল ও কর্ণ পরমসখা হইয়াছিল। দুর্য্যোধনের ন্যায় অন্যান্য অনেক ভূপতিও লোকবিনাশের নিমিত্ত পৃথিবীতে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছিল। রাজা যেরূপ সভাবসম্পন্ন হয়েন, প্রজারাও তদনুরূপ হইয়া থাকে। রাজা অধর্ম্মপরায়ণ হইলে অধর্ম্মও ক্রমে ক্রমে ধর্ম্ম [ধর্ম্মরূপে লোকগণের মান্য—আচরণীয়] হইয়া উঠে। স্বামীর গুণ-দোষপ্রভাবে ভৃত্যের গুণ-দোষ সমুৎপন্ন হয়, সন্দেহ নাই। দুষ্ট রাজার দোষেই তোমার অন্যান্য তনয়গণ নিহত হইয়াছে; অতএব তাহাদিগের নিমিত্ত অনর্থক শোক করিবার প্রয়োজন নাই। তোমার পুত্রেরা নিতান্ত দুরাচার ছিল; তাহাদের দোষেই সমুদয় পৃথিবী উচ্ছিন্নপ্রায় হইয়াছে। এ বিষয়ে পাণ্ডবগণের অণুমাত্র অপরাধ নাই।

“পূৰ্বে তত্ত্বদর্শী দেবর্ষি নারদ রাজসূয়যজ্ঞস্থলে যুধিষ্ঠিরকে কহিয়াছিলেন যে, “মহারাজ! কৌরব ও পাণ্ডবগণ পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া আপনাদিগের কুলক্ষয় করিবে, অতএব এক্ষণে তোমার যাহা কৰ্ত্তব্য হয়, তাহার অনুষ্ঠান কর। ঐ সময় পাণ্ডবগণ নারদের সেই বাক্যশ্রবণে যারপরনাই শোক প্রকাশ করিয়াছিলেন। হে বৎস! এক্ষণে তোমার নিকট এই সকল গুপ্তকথা প্রকাশ করিলাম। অতঃপর তুমি দৈবকৃত বিড়ম্বনা অবগত হইয়া শোক পরিত্যাগ, প্রাণধারণে যত্ন ও পাণ্ডবগণের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন কর। আমি পূৰ্বেই এই সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া রাজসূয়যজ্ঞসময়ে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বিজ্ঞাপিত করিয়াছিলাম। যুধিষ্ঠিরও আমার মুখে ঐ কথা শ্রবণ করিয়া কৌরবদিগের সহিত বিদ্রোহঘটনা না হইবার নিমিত্ত অনেক যত্ন করিয়াছিলেন; কিন্তু দৈবের বলবত্ত্ব[প্রাবল্য— প্রাধান্য] ও অখণ্ডনীয়তাপ্রভাবে কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। কি স্থাবর, কি জঙ্গম, কাহারও কৃতান্তের নিয়ম অতিক্রম করিবার ক্ষমতা নাই। তুমি ধার্মিক, বুদ্ধিবিশারদ এবং প্রাণীগণের সদ্গতি ও দুর্গতির বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছ, তবে কি নিমিত্ত এক্ষণে মুগ্ধ হইতেছ? রাজা যুধিষ্ঠির তোমাকে এরূপ শোকাভিভূত জানিতে পারিলে প্রাণপরিত্যাগেও ক্ষান্ত হইবেন না। ধর্ম্মরাজ একান্ত ধীর। তিনি পশুপক্ষীর প্রতিও নিয়ত কৃপা প্রকাশ করিয়া থাকেন। তোমার প্রতি তাহার দয়া না হইবার সম্ভাবনা কি? এক্ষণে তুমি আমার অনুরোধ রক্ষা, দৈবের অখণ্ডনীয়তা অনুধ্যান ও পাণ্ডবগণের প্রতি করুণা প্রকাশ করিয়া জীবনধারণ কর; তাহা হইলে নিশ্চয়ই লোকসমাজে কীৰ্ত্তিলাভ, ধর্ম্মার্থের অনুশীলন ও দীর্ঘকাল তপানুষ্ঠান করিতে সমর্থ হইবে। অতঃপর প্রজ্ঞা রূপ জলসেচনদ্বারা প্রজ্বলিত পুত্রশোকানল নিৰ্বাপিত করাই তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য।”

হে জনমেজয়। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অমিততেজাঃ বেদব্যাসের সেই বাক্য শ্রবণানন্তর মুহূর্ত্তকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “মহর্ষে! আমি গুরুতর শোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়াছি। বারংবার মোহ উপস্থিত হওয়াতে আমার আত্মজ্ঞান তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে আপনার মুখে নিগূঢ়বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অবগত হইলাম যে, আমার পুত্রগণ দৈবপ্রভাবে নিহত হইয়াছে। অতএব আর আমি প্রাণত্যাগের বাসনা বা শোকপ্রকাশ করিব না।” মহারাজ! তখন মহর্ষি বেদব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন।