০৭. দুঃখপরিহারে সংসার-শান্তি

৭ম অধ্যায়

দুঃখপরিহারে সংসার-শান্তি

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মহাত্মন্! তুমি স্বীয় তত্ত্বদর্শিতা প্রভাবে অদ্ভুত উপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিলে। তোমার বাক্যামৃত পান করিতে পুনর্বার কৌতূহল হইতেছে।”

বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! পণ্ডিতেরা যাহা শ্রবণ করিয়া সংসার হইতে মুক্ত হয়েন, আমি পুনর্বার সেই বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। লোকে যেমন অনেক পথ অতিক্রম করিতে হইলে নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া স্থানে স্থানে অবস্থান করিয়া থাকে, তদ্রূপ নির্বোধ লোকেরা এই সংসারপৰ্যটনক্রমে বারংবার গর্ভবাস আশ্রয় করে; কিন্তু পণ্ডিতেরা তাহা হইতে মুক্ত হয়েন, এই নিমিত্ত শাস্ত্রবিৎ বিজ্ঞ লোকেরা এই সংসারগহনকে পথ বলিয়াও নির্দ্দিষ্ট করিয়া থাকেন। স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই এই পথে নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে; কেবল পণ্ডিতগণ উহাতে বিরত হইয়া আছেন। ঐ পথে হিংস্ৰজন্তুর ন্যায় শারীরিক ও মানসিক বিবিধ ব্যাধি সতত মনুষ্যগণকে আক্রমণ করে। যদি কেহ কোনক্রমে ব্যাধির হস্ত হইতে বিমুক্ত হয়, তাহা হইলে জরা ক্রমে ক্রমে তাহাকে আক্রমণপূর্ব্বক তাহার রূপ বিনাশ করিতে থাকে; কিন্তু মনুষ্য এরূপ নির্বোধ যে, ঐরূপ দুরবস্থাতেও কোনক্রমে জীবিতকামনা পরিত্যাগ করে না; সততই শব্দ, রূপ, রস, স্পর্শ প্রভৃতি বিবিধ ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ে বিলিপ্ত থাকে। সংবৎসর, ঋতু, মাস, পক্ষ ও দিবারাত্রি ক্রমে ক্রমে মনুষ্যগণের রূপ পরমায়ু ক্ষয় করিতে থাকে; কিন্তু ঐ নির্বোধেরা উহাদিগকে কালের প্রতিনিধি বলিয়া অবগত হইতে পারে না। সকলে স্ব স্ব কর্ম্মানুরূপ ফলভোগ করিয়া থাকে। বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ প্রাণীগণের শরীরকে যমের রথ, জীবনকে ঐ রথের সারথি, ইন্দ্রিয়গণকে উহার অশ্ব ও কর্ম্মবুদ্ধিকে ঐ অশ্বদিগের রশ্মি বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যে ব্যক্তি সেই ধাবমান অশ্বগণকে বুদ্ধিরূপ প্রগ্রহ[লাগাম]দ্বারা নিবৃত্ত না করিয়া তাহাদের অনুধাবন করে, তাহাকে এই সংসারচক্রে চক্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিতে হয়। আর যাহারা ঐ অশ্বগণের সহিত ভ্রমণ করিয়াও মুগ্ধ না হয়, তাহাদিগকে এই সংসারে বারংবার ভ্রমণ করিতে হয় না।

“হে মহারাজ! মানবগণকে এইরূপে সংসারচক্রে ভ্রমণ করিয়া বিবিধ দুঃখভোগ করিতে হয়; অতএব বুদ্ধিমান ব্যক্তির সেই দুঃখনিবারণের নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। উহাতে উপেক্ষা করা কোনরূপেই বিধেয় নহে। উপেক্ষা করিলে উহা ক্রমে ক্রমে শতধা পরিবর্ধিত হইতে থাকে। ইহলোকে যিনি ক্রোধলোভে বিবর্জিত, জিতেন্দ্রিয়, সন্তুষ্টচিত্ত ও সত্যবাদী, তিনিই শান্তিলাভে সমর্থ হয়েন। আর যে ব্যক্তি নিতান্ত নির্বোধ ও মুগ্ধ, সেই আপনার মত রাজ্য, সুহৃৎ ও পুত্ৰবিনাশে নিতান্ত কাতর হইয়া অনুতাপ ও দুঃখভোগ করে। সংযতচিত্ত সাধু ব্যক্তিরা জ্ঞানরূপ মহৌষধি প্রয়োগপূর্ব্বক দুঃখরূপ মহাব্যাধি নিরাকৃত করিয়া থাকেন। চিত্তস্থৈর্য্য দুঃখবিমোচনের যেরূপ উৎকৃষ্ট উপায়, বিক্রম, অর্থ বা বন্ধুবান্ধব সেরূপ নহে; অতএব আপনি স্থিরচিত্ত হইয়া দুঃখ সংবরণ করুন। দম, দান ও অনবধানতা এই তিনটি ব্রহ্মার অশ্ব। যিনি শীলরূপ রশ্মি গ্রহণপূর্ব্বক তিন-অশ্বসংযুক্ত মানস-রথে আরোহণ করিতে পারেন, তিনি শমন-ভয় পরিহারপূর্ব্বক অনায়াসে ব্রহ্মলোকগমনে সমর্থ হয়েন। আর যিনি প্রাণীগণকে অভয় প্রদান করেন, তিনি অতি উৎকৃষ্ট বিষ্ণুলোকে গমন করেন। অভয়দানে যেরূপ ফললাভ হয়, সহস্র যজ্ঞানুষ্ঠানে ও নিত্য উপবাসেও সেরূপ ফললাভ হয় না। প্রাণীগণের মধ্যে আত্মা অপেক্ষা প্রিয়তর বস্তু আর কিছুই নাই। কেহই মৃত্যু অভিলাষ করে না। অতএব সর্ব্বদা সর্ব্বভূতে দয়া করা অবশ্য কৰ্ত্তব্য। অসূক্ষ্মদর্শী ভ্রান্তবুদ্ধি মানবগণ মোহজালে জড়িত হইয়া অনবরত ভ্রমণ করিতে থাকে। আর সূক্ষ্মদর্শী মহাত্মারা শাশ্বত ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়েন।”