০৪. দেহের অসারতা—গর্ভবস বিবরণ

৪র্থ অধ্যায়

দেহের অসারতা—গর্ভবস বিবরণ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বাক্যবিশারদ[বাক্‌পটু]! অতি দুর্জ্ঞেয় সংসারের গতি কিরূপে অবগত হওয়া যাইতে পারে, উহা শ্রবণ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইতেছে, তুমি যথার্থরূপে উহা কীৰ্ত্তন কর।”

বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! প্রাণীদিগের জন্মাবধি সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। জীব সর্ব্বপ্রথমে গর্ভমধ্যে গাঢ়রক্তে লীন থাকে। পরে পঞ্চম মাস অতীত হইলে সৰ্বাঙ্গসম্পন্ন হইয়া মাংসশোণিতলিপ্ত অতি অপবিত্র স্থানে বাস করে, পরিশেষে বায়ুপ্রভাবে ঊর্দ্ধপাদ ও অধঃশিরা হইয়া যোনিদ্বারে আগমন ও বিবিধ ক্লেশ ভোগ করিয়া তথা হইতে মুক্ত হয়। এইরূপে প্রাণী ভূমিষ্ঠ হইয়া ক্ৰমে ইন্দ্রিয়পাশে বদ্ধ হইতে থাকে। তখন অন্যান্য বিবিধ উপদ্রব তাহাকে আক্রমণ করিতে আরম্ভ করে। গ্রহসমুদয় আমিষলোপ সারমেয়গণের ন্যায় তাহার সন্নিধানে সমাগত হয়, ব্যাধিসকল কর্ম্মদোষে তাহার শরীরে প্রবেশ করে এবং আর আর বিবিধ ব্যসন তাহাকে নিপীড়িত করিতে থাকে। মনুষ্য বাল্যকালে এই প্রকার বিবিধ ক্লেশে পরিক্লিষ্ট হইয়া কোনক্রমেই তৃপ্তিলাভ করিতে সমর্থ হয় না। ঐ সময় কাহাকে সৎকর্ম্ম আর কাহাকেই বা অসৎকর্ম্ম বলে, তাহা কিছুই অবগত হইতে সমর্থ হয় না। তৎকালে তাহার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিরাই তাহাকে রক্ষা করিয়া থাকে। ভ্রান্তবুদ্ধি ব্যক্তিগণ ক্রমে যমলোকগমনের সময় সমুপস্থিত হইতেছে বলিয়া বোধ করিতে সমর্থ হয় না; কিন্তু যমদূত তাহাকে যথাকালে আকর্ষণপূর্ব্বক মৃত্যুমুখে নিপাতিত করে। সংসারের কি চমৎকার গতি! লোকে বারংবার আপনি আপনার বিনাশের কারণ হইয়াও আপনাকে উপেক্ষা করে; ক্রোধ, লোভ ও ভয়ের বশীভূত হইয়া একেবারে আত্মজ্ঞানরহিত হয় এবং কৌলীন্যমৰ্য্যাদা [বংশগৌরব] প্রভাবে কুলহীনদিগকে ও ধনদৰ্পে দরিদ্রগণকে নিন্দা করিয়া থাকে। অনেকে অন্যের উপর দোষারোপ ও অন্যকে মূর্খ জ্ঞান করে; কিন্তু আপনার শাসন বা আপনার প্রতি দৃষ্টিপাত করে না। যখন প্রাজ্ঞ ও মূঢ়, ধনবান্ ও নিৰ্দ্ধন এবং মৰ্য্যাদাপন্ন ও মর্যাদাহীন সকলেই প্রাণপরিত্যাগ পূর্ব্বক একত্র হইয়া অস্থিভূয়িষ্ঠ শিরাসংযুক্ত মাংসশূন্য কলেবরে শ্মশানে শয়ন করিয়া থাকে, তখন কেহ কোন প্রকার লক্ষণদ্বারা তাহাদের কুল, রূপ ও গুণ অবগত হইতে পারে না। যখন সকলকেই সমভাবে ধরাতলে নিপতিত হইয়া দীর্ঘনিদ্রায় অভিভূত হইতে হইবে, তখন বুদ্ধিহীন মানবগণ কি নিমিত্ত পরস্পর পরস্পরকে বঞ্চনা করিতে বাসনা করে? হে মহারাজ! যে ব্যক্তি জন্মাবধি এই বাক্য শ্রবণ করে, তাহার অন্তে পরমগতি লাভ হয় এবং তাহার পক্ষে কোন পথই দুর্গম হয় না।”