০৩. বিদুরকর্ত্তৃক জীবের অস্থায়িত্ব বর্ণন

৩য় অধ্যায়

বিদুরকর্ত্তৃক জীবের অস্থায়িত্ব বর্ণন

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মহাত্মন! তোমার পরম উপাদেয় বাক্যশ্রবণে আমার শোকনিবারণ হইল। এক্ষণে আমি পুনরায় তোমার মধুরবাক্য শ্রবণ করিতে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি। অতএব পণ্ডিতেরা অনিষ্টাপিত ও ইষ্টবিয়োগজনিত মানসিক দুঃখ হইতে কিরূপে মুক্ত হইয়া থাকেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”

বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! যে যে উপায়দ্বারা মনোদুঃখ ও সুখ হইতে বিমুক্ত হওয়া যায়, পণ্ডিতেরা সেই সেই উপায় উদ্ভাবনপূর্ব্বক সুখদুঃখবর্জিত হইয়া শান্তি লাভ করেন। আমরা যাহা কিছু চিন্তা করি, সকলই অনিত্য। মানবগণ কদলীবৃক্ষের ন্যায় নিতান্ত অসার পদার্থ। যখন বিদ্বান, মূর্খ, ধনবান্ ও নিৰ্দ্ধন সকলেই একত্র হইয়া স্নায়ুপরিবৃত [সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শিরাদ্বারা বেষ্টিত] অস্থিময় মাংসশূন্য গাত্রে শ্মশানে শয়ন করিয়া থাকে, তৎকালে অপর লোকে কিরূপে তাহাদিগের কুল, রূপ ও গুণের বিশেষ পরিচয় প্রাপ্ত হইবে? লোকে আপনার বুদ্ধির দোষেই পরস্পর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হইয়া থাকে। পণ্ডিতেরা মানবদিগের দেহকে গৃহস্বরূপ বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। কালক্রমে সেই দেহ ধ্বংস হইয়া যায়; কিন্তু জীবাত্মার কোন কালেই বিনাশ নাই। লোকে যেমন জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক নুতন বস্ত্র পরিধান করে, জীবাত্মা তদ্রূপ এক দেহ পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্য দেহ আশ্রয় করিয়া থাকে। প্রাণীগণ স্ব স্ব কাৰ্য্যদ্বারাই ইহলোকে সুখদুঃখ ভোগ করিয়া থাকে। কর্ম্মদ্বারা স্বর্গ ও সুখদুঃখ লাভ হয় বলিয়াই মনুষ্য অবশই হউক ও স্ববশই হউক, সততই কর্ম্মভার বহন করে। যেমন মৃন্ময় ভাণ্ডের মধ্যে কতকগুলি কুলালচক্রে আরূঢ়, কতকগুলি কিঞ্চিৎ আকারসম্পন্ন, কতকগুলি সম্পূর্ণ গঠিত, কতকগুলি ছিন্ন, কতকগুলি অবরোপ্যমাণ, কতকগুলি অবতীর্ণ, কতকগুলি শুষ্ক, কতকগুলি অনলদগ্ধ, কতকগুলি অনল হইতে উদ্ধৃত ও কতকগুলি জনসমাজে ব্যবহৃত হইয়া বিনষ্ট হইয়া যায়, তদ্রূপ প্রাণীগণের মধ্যে কেহ কেহ গর্ভবাসকালে, কেহ কেহ প্রসবান্তে, কেহ কেহ একদিন পরে, কেহ কেহ এক পক্ষান্তে, কেহ কেহ এক মাসাবসানে, কেহ কেহ এক বৎসর বা দুই বৎসর পরে, কেহ কেহ যৌবনাবস্থায়, কেহ কেহ প্রৌঢ়াবস্থায় ও কেহ কেহ বৃদ্ধাবস্থায় দেহত্যাগ করিয়া থাকে। ভূতগণ জন্মান্তরীণ কাৰ্য্যদ্বারা ইহলোকে জন্মগ্রহণ বা মুক্তিলাভ করিয়া থাকে। হে মহারাজ! যখন সংসারের এইরূপ গতি, তখন আপনি কি নিমিত্ত অনুতাপ করিতেছেন? প্রাণীগণ যেমন সলিলে ক্রীড়া করিতে করিতে একবার নিমগ্ন ও একবার উন্মগ্ন হয়, তদ্রূপ অল্পবুদ্ধি লোক স্ব স্ব কর্ম্মানুসারে এই সংসারে ক্লেশ ও বিনাশ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আর যেসকল বিজ্ঞলোক ইহলোকে প্রাণীগণের হিতচেষ্টা করেন, তাঁহাদিগেরই পরমগতি লাভ হয়।”