০২. বিদুরের উপদেশ

২য় অধ্যায়

বিদুরের উপদেশ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! সঞ্জয়ের বাক্যাবসানে মহাত্মা বিদুর অমৃততুল্য বাক্যে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে পুলকিত করিয়া কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! আপনি কি নিমিত্ত শয়ন করিয়া রহিয়াছেন? অবিলম্বে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক ধৈৰ্য্যাবলম্বন করুন। কিছুই চিরস্থায়ী নহে। ক্ষয় স্তূপের অন্ত, পতন উন্নতির অন্ত, বিয়োগ সংযোগের অন্ত এবং মৃত্যুই জীবনের অন্ত। কৃতান্ত বীর ও ভীরু উভয়কেই আকর্ষণ করেন। অতএব ক্ষত্রিয়গণ কি নিমিত্ত স্বধর্ম্মানুসারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত না হইবেন? দেখুন, লোকে যুদ্ধ না করিয়াও মৃত্যুমুখে নিপতিত হয় এবং যুদ্ধ করিয়াও জীবিত থাকে। ফলতঃ কাল উপস্থিত হইলে কেহই তাহা অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না। হে মহারাজ! প্রাণীগণের জন্মগ্রহণের পূর্বে অভাব থাকে, মধ্যে স্থিতি হয় এবং মৃত্যু হইলে পুনরায় অভাব উপস্থিত হইয়া থাকে; সুতরাং মৃত ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত দুঃখ করিবার তাৎপর্য্য কি? মনুষ্য নিতান্ত শোকাকুল হইলেও যখন মৃত ব্যক্তির অনুগমন করিতে বা স্বয়ং মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে সমর্থ হয় না, তখন আপনি কি নিমিত্ত এইরূপ শোক প্রকাশ করিতেছেন? কৃতান্ত সকলকেই আত্মসাৎ করিয়া থাকেন, কেহই তাঁহার প্রিয় বা অপ্রিয় নহে। তৃণাগ্রসমুদয় যেমন বায়ুবেগে বশীভূত হইয়া উড্ডীন হয়, তদ্রূপ প্রাণীগণ কৃতান্তের বশীভূত হইয়া প্রাণপরিত্যাগ করে। হে মহারাজ! সকলকেই সেই একমাত্র কৃতান্তের করালকবলে নিপতিত হইতে হইবে। কাল সকলেরই অগ্রে অগ্রে ধাবমান হইতেছে। অতএব মৃতব্যক্তিদিগের নিমিত্ত শোকের সম্ভাবনা কি? এক্ষণে যদি শাস্ত্রযুক্তি আপনার গ্রাহ্য হয়, তাহা হইলে সংগ্রামনিহত বীরগণের নিমিত্ত শোকপ্রকাশ করিবেন না। তাঁহারা সকলেই উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়াছেন। ঐ সকল বীর স্বাধ্যায়সম্পন্ন ব্রতপরায়ণ; বিশেষতঃ তাঁহারা যুদ্ধে সম্মুখীন হইয়া বিনষ্ট হইয়াছেন; সুতরাং তাঁহাদের নিমিত্ত শোক করিবার প্রয়োজন কি? আর দেখুন, জন্মগ্রহণের পূর্বে ঐ সমস্ত বীরগণের দর্শনলাভ হয় নাই এবং এক্ষণেও পুনরায় অদৃশ্য হইয়া গিয়াছেন; আর তাঁহাদিগের সহিত আপনার ও আপনার সহিত তাঁহাদিগের আর কোন সম্পর্কই নাই। সুতরাং তাঁহাদিগের নিমিত্ত শোকপ্রকাশ করা নিতান্ত মূঢ়ের কার্য্য। হে মহারাজ! সমরে প্রবৃত্ত হইয়া নিহত হইলে স্বর্গলাভ এবং শত্রু বিনষ্ট করিলে যশোলাভ হইয়া থাকে। এই উভয়বিধ বিষয়ই বহুগুণাত্মক; সুতরাং যুদ্ধপ্রবৃত্তি কখনই নিষ্ফল হইবার নহে। যাঁহারা সমরে নিহত হয়েন, তাঁহারা ইন্দ্রের নিকট আতিথ্য লাভ করেন। দেবরাজ রণনিহত ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত অভীষ্ট লোক নির্ধারিত করিয়া রাখেন, সন্দেহ নাই। বীরগণ সমরে প্রাণত্যাগ করিয়া যেমন অবিলম্বে স্বর্গলাভ করেন, অন্যে প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে যজ্ঞানুষ্ঠান, তপঃসাধন ও বিদ্যানুশীলনদ্বারা সেরূপ করিতে সমর্থ হয় না। সেই সমস্ত মহাবীর বিপক্ষ বীরগণের দেহরূপ হুতাশনে শরনিকররূপ আহুতি প্রদানপূর্ব্বক অরাতিগণের শরবেগ সহ্য করিয়াছেন। হে মহারাজ! যুদ্ধ ব্যতিরেকে ক্ষত্রিয়ের স্বর্গলাভের সুলভ পথ আর কিছুই নাই। সেই সমস্ত মহাবলপরাক্রান্ত মহাত্মা ক্ষত্রিয় উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিয়াছেন। তাঁহাদিগের নিমিত্ত শোক প্রকাশ করা নিতান্ত অনুচিত। এক্ষণে আপনি শোকাবেগ সংবরণপুর্ব্বক ধৈৰ্য্যাবলম্বন, করুন। শোকে অভিভূত হইয়া আপনার কাৰ্য্য বিস্মৃত হইবেন না। এই জগতে সহস্র সহস্র লোকের মাতাপিতা ও পুত্ৰকলত্র বর্ত্তমান আছে, কিন্তু কেহই কাহার নহে। এই সংসারে শোক ও ভয়ের অসংখ্য কারণ বিদ্যমান আছে; তৎসমুদয় প্রতিনিয়ত মুর্খকেই অভিভূত করিয়া থাকে, পণ্ডিতের সম্মুখীন হইতে কদাচ সমর্থ হয় না। হে মহারাজ! কাহারও উপর কালের প্রীতি বা অপ্রীতি নাই। কাল কাহারই প্রতি ঔদাসীন্য প্রকাশ করে না; সকলকেই আকর্ষণ করিয়া থাকে। সকল প্রাণীই কালপ্রভাবে পরিবর্ধিত ও বিনষ্ট হয়। সকলে নিদ্রিত হইলেও একমাত্র কাল নিরন্তর জাগরিত থাকে। উহাকে অতিক্রম করা নিতান্তই সুকঠিন। দেখুন, জীবন, যৌবন, রূপ, ধন, আরোগ্য ও প্রিয়সহবাস কিছুই চিরস্থায়ী নহে; বিবেচক লোকেরা এই ভাবিয়া ঐ সমস্ত বিষয়ে কোনক্রমেই লিপ্ত হয়েন না। হে মহারাজ! এক্ষণে আপনি কি নিমিত্ত একাকী এই সাধারণভোগ্য দুঃখ ভোগ করিতেছেন? লোকে দুঃখ চিন্তা করিতে করিতে বরং স্বয়ং বিনষ্ট হইতে পারে, কিন্তু অনুশোচনদ্বারা তাহার সেই দুঃখ কদাচ নিরাকৃত হয় না। দুঃখ চিন্তা না করাই দুঃখনাশের প্রকৃত ঔষধ। নিরন্তর দুঃখ চিন্তা করিলে উহা কদাচ অপনীত হয় না, প্রত্যুত পরিবর্ধিত হইতে থাকে। অল্পবুদ্ধি মনুষ্যেরা অনিষ্টাপিত ও ইষ্টবিয়োগ এই দুই কারণবশতঃ মনোদুঃখে নিরন্তর দগ্ধ হয়। হে মহারাজ! শোক প্রকাশ করা ধর্ম্মানুশীলন, অর্থচিন্তা বা সুখভোগ নহে। শোকাকুল হইলে লোকের কাৰ্য্যক্ষতি ও ত্রিবর্গ নষ্ট হইয়া থাকে। মুর্খেরা বিশেষ দুর্দ্দশা প্রাপ্ত হইয়া নিতান্ত অসন্তুষ্ট হয়, কিন্তু পণ্ডিতেরা সেই অবস্থায় সন্তোষ লাভ করিয়া থাকেন। বিজ্ঞ ব্যক্তি প্রজ্ঞাবলে মানসিক দুঃখ ও ঔষধপ্রভাবে দৈহিক দুঃখ অপনীত করিবেন। জ্ঞান ব্যতিরেকে অন্য কাহারও দুঃখদূরীকরণের তাদৃশ ক্ষমতা নাই। পূর্ব্বকৃত কর্ম্ম মনুষ্য শয়ন করিলে তাহার পশ্চাৎ শয়ন, অবস্থান করিলে পশ্চাৎ অবস্থান ও ধাবমান হইলে উহা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া থাকে। মনুষ্য যে-যে অবস্থায় যেরূপ শুভ বা অশুভ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, সেই সেই অবস্থাতেই তাহার ফলভোগ করিয়া থাকে এবং যে শরীরে যেরূপ কর্ম্মেরর অনুষ্ঠান করে, তাহাকে সেই শরীরে তাহার ফল ভোগ করিতে হয়। মনুষ্য আপনিই আপনার মিত্র, আপনিই আপনার শত্রু এবং আপনিই আপনার কৃত ও অকৃত কাৰ্য্যের সাক্ষিস্বরূপ। শুভকর্ম্মের অনুষ্ঠানে সুখ ও পাপকর্ম্মের অনুষ্ঠানে দুঃখ হইয়া থাকে। সকলেই আপনার কর্ম্মানুরূপ ফল ভোগ করে। কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিয়া কেহই ফলভোগে সমর্থ হয়েন না। হে মহারাজ! ভবাদৃশ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কখনই জ্ঞানবিরুদ্ধ বহু পাপজনক কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হয়েন না।”